আন্‌ওয়ার এম হুসাইন এর সকল পোস্ট

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন সম্পর্কে

শ্লোগান দেয়া মিছিলগুলো আমাকে খুব মোহন করে ডেকেছিল

পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্বঃ কাজী নজরুল ইসলাম

নজরুলের বিপুলা সৃষ্টির কত কমই না আমরা জানি। নজরুল আধা জীবনে যা লিখেছেন আমাদের কয় জীবন লাগবে শেষ করতে? এই দেখুন না নজরুলের এমন একটি মজার লেখা আমরা কয়জনেই পড়েছি! এখন পড়ে দেখুন আনন্দ পাবেন।

পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব
———- কাজী নজরুল ইসলাম

ঘোড়ার ভুরু হয় না। ( তাই বলে কই তাকে ত বিশ্রী দেখায় না!)

রোমন্থনকারী জন্তু মাত্রেরই ক্ষুর বিভক্ত। (কিন্তু সাহিত্য রোমন্থনকারীদের আদতেই ক্ষুর হয় না! এটা বুঝি ব্যতিক্রম!)

তিমি মৎস্যের দাঁত হয় না। তবে হাড়ের মত এক রকম পাতলা স্থিতিস্থাপক ( যা রবারের মত টানলে বাড়ে আবার আপনি সংকুচিত হয়) জিনিস তার ফোকলা মুখের উপর-চোয়ালে সমান্তরাল হয়ে লেগে থাকে তাই দিয়ে এ মহাপ্রভুর কাজ চলে।

কচ্ছপ বা কাছিমের আবার দাঁত বিলকুল নদারদ ( ছেলেবেলায় কিন্তু শুনেছি যে কাছিমে বা ব্যাঙ এ একবার কামড়ে ধরলে মেঘ না ডাকলে ছাড়ে না)

শশক বা খরগোশের কখনো চোখ বন্ধ হয় না, কেননা বেচারিদের চোখের পাতাই নেই। মেম সাহেবদের মুখের বোরকার চেয়েও একরকম পাতলা চামড়ার পর্দা ঘুমোবার সময় তাদের চোখের উপর ঘনিয়ে আসে। মানুষেরর যদি ও রকম হত তাহলে ত লোকে তাকে ‘চশমখোর’ , শা’র চোখের পর্দা নেই প্রভৃতি বলত! তাছাড়া চোখের পর্দা না থাকলে প্রথমেই ত আমাদের চোখে ঘা হয়ে ফ্যাচকা চোখো হয়ে যেতাম। )

নিশ্বাস- প্রশ্বাসের জন্যে হরিণের নাকি নাকের ছ্যাঁদা ছাড়া আরও কতকগুলি ঐরকম ছ্যাদা আছে। আশ্চর্য বটে!

প্যাঁচার চোখে কোন গতি বা ভঙ্গি নাই, অর্থাৎ কিনা তাদের ঔ ভাঁটার মত চোখ দুটির তারা নড়েও না চড়েও না। সদা-সর্বদাই ডাইনী-মাগীর মত কটমট করে তাকায়।

ভেড়ার আবার উপর চোয়ালে দাঁত হয় না। (তাহলে দেখা যাচ্ছে যাঁর উপর- চোয়ালে দাঁত ভেঙ্গে যায় তিনি ওই ভ্যাঁ-গোত্রের)।

উট একে ত একটা বিদঘুটে জানোয়ার , যাকে দূর থেকে আসতে দেখে অনেক সময় একটা সচল দোতলা বাড়ী বলেই মনে হয়। কিন্তু এর চেয়েও ঐ কুঁচবগলা’র বৃহত্তম সংস্করন জীবটির একটা বিশেষ গুণ আছে সে গুণ আবার পেছনকার পদদয়ে। উষ্ট্র-ঠাকুর তাঁর পেছনের শ্রীচরন দুটি দিয়ে তার বড় বপুর যে কোন স্থান ছুঁতে পারেন!

একটি হাতির গর্দানে (স্কন্ধে) মাত্র চল্লিশ হাজার ( বাপস!) মাংশপেশি আছে। সাধে কি এ জন্তুর নাম হাতি রাখা হয়েছে।

কাঁকড়া এগিয়েও যেমন বেগে হাটতে পারে, পিছিয়েই তেমনি হাটতে পারে। বাহাদুরি আছে এ মস্তকহীন প্রাণিটির।

আপনারা কোন সর্বদর্শি জানোয়ার দেখেছেন কি? সে হচ্ছে জিরাফ। এই জন্তুপ্রবর চতুর্মুখ না হয়ে ও আগেও যেমন দেখতে পান পিছনেও তেমন দেখতে পান। ভাগ্য আর কাকে নলে।

আর একটি মজার বিশয় হয়তো আপনারা কেউ লক্ষ্যই করেননি। বৃষ্টি হবার আগে বিড়াল জানতে পারে। যে বৃষ্টি আসবে, আর সে তখন হাঁচে। অতএব বিড়ালকে বৃষ্টির দূত বললে কেউ আপত্তি করবেন না বোধ হয়। উত্তর আমেরিকার ময়দানে একরকম খেঁকশিয়ালি আছে । শুনেছি , দুনিয়ার কোন প্রানীই নাকি তাদের সংগে দৌড়ুতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশি খেঁকিও কম যাবে না। দিব নাকি এই লাল খেঁকির সঙ্গে আমাদের দেশি খেঁকির ঘৌড়দৌড় লাগিয়ে?

এই মহিমান্বিত রজনীতে আমরা কি করব

ইসলামী শরীয়তে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাত আছে তার অন্যতম হল লায়লাতুল বরাত আমাদের দেশে যা শবে বরাত নামে পরিচিত। বাকী রাতগুলো হল লায়লাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর এবং ঈদের রাত্রিগুলো।

এই সমস্ত রাতের অসীম ফজিলত রয়েছে। এই সব রাত আসলে আমাদের জীবনে আসে বোনাস হিসেব। আসে আত্মশুদ্ধির জন্য। আর আসে পরকালীন পাথেয় অর্জনের এক দারুণ সুযোগ নিয়ে। এইসব রাত তওবা ও অনুতাপ করার জন্য, পাপ হতে পূণ্যের পথে আসার জন্য, জীবনকে সুপথে পরিচালিত করার দৃড় শপথ নেয়ার জন্য, সর্বপোরি আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) নৈকট্য ও ভালবাসা অর্জনের জন্য।

শবে বরাতের প্রতিটি ক্ষণ তাই অতি মূল্যবান। এটি আপনার মালিকের পক্ষ থেকে আপনার জন্য বিশেষ দয়া ও রহমত। এ রাতের প্রতিটি মূহুর্ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি’র জন্য ব্যয় করা উচিত। নফল ইবাদত, নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জিকির আসকার ইত্যাদির মাধ্যমে সারারাত অতিবাহিত করা উচিত। ফরজ নামাজগুলো অবশ্যই জামাতে পড়বেন। এ রাতে এমন কোন প্রোগ্রাম রাখবেন না যাতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। একাগ্রচিত্তে আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) দিকে মনোনিবেশ করুন। দান খয়রাত করুন, চেষ্টা করুন অভাবী ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে ফিরিয়ে না দিতে। ভালখাবার তৈরি করুন । নিজেরা খান, অন্যকে খাওয়ান। আমাদের দেশে এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরির প্রচলন আছে তা করতে পারেন। কোন সমস্যা নাই। কিছু কিছু লোক আপনাকে হালুয়া রুটি তৈরি করত নিষেদ করবে। এরা এক ধরনের বেকুব বটে। খাবার দাবার হালাল হলেই সেটা করা যায়, খাওয়া যায় এতে কোন নিষেদ নাই। আমাদের দেশে আমরা ছোলামুড়ি দিয়া ইফতার করি, ঈদের দিন সেমাই পাকাই। এগুলো কোনটাই অবৈধ নয়। একইভাবে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খেলে অন্যকে খাওয়ালে ভাল’র চেয়ে মন্দ কিছু নাই। আল্লাহতো অন্যকে খাওয়ানো পছন্দ করেন। নিজে খাবেন, গরীব দুঃখী, আত্মীয় বন্ধুকে খাওয়াবেন। তবে এই খাওয়া দাওয়া যাতে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটায়। এ রাতে গোসল করাও পূণ্যময়। এ রাতে গোসলের প্রতি ফোটা পানির জন্য রয়েছে অতি উত্তমপ্রতিদান। এ রাত হল ভাগ্যরজনী। এ রাতে মানুষের আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। পরবর্তী এক বছরের জন্ম মৃত্যু, রিজিক সুনির্দিষ্ট হয়।

এ রাত ক্ষমার রজনী। হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী এ রাতে বনু কালবের ছাগ-পালের পশমের চেয়েও অধিক বান্দাকে আল্লাহ ক্ষমা করেন। এ রাতে জান্নাতের প্রথম দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন আজ রাতে রুকুকারীর জন্য রয়েছে সুসংবাদ। একই ভাবে বাকী দরজাগুলো তে যথাক্রমে সিজদা, জিকির, আল্লাহর ভয়ে ক্রনদনকারী, তসবিহ থলিলকারী ও মুমীন মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ ঘোষনা করা হয়। সপ্তম দরজা হতে বলা হয় প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা মন্জুরের নিশয়তা আর অষ্টম দরজা হতে ক্ষমার নিশ্চয়তা ঘোষনা করা হয়।

এ রাতে আল্লাহর সাথে শরিককারি, অহংকারী, হিংসুক, ব্যাভিচারি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, যাদুকর-গণক প্রভৃতিকে ক্ষমা করা হয় না। এছাড়াও এই তালিকায় মদ্যপ, খুনী, জুয়াড়িরাও রয়েছে। তবে এই সব অপকর্ম হতে কায়মনোবাক্যে তওবা করলে আল্লাহ তা’লা ক্ষমা করে দিবেন।

মহানবী ( দঃ ) এই রাতে কবর জিয়ারত করতেন। জান্নাতুন বাকীতে যেতেন। সুতরাং এ রাতে কবর জিয়ারত করুন। মা-বাবা, দাদা, দাদী, নানা,নানী আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহতো ক্ষমাশীল। হয়তো এ রাতের প্রার্থনা আপনার স্বজনের আজাব আনন্দে পরিনত করে দিতে পারে। আর স্মরণ করুন তাদের মত আপনাকেও একদিন কবরবাসী হতে হবে। সেই কবরে যাবার পাথেয় আপনার কতটুকু আছে?

প্রার্থনা করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বাবা মা ভাই বোন সন্তান সন্ততি আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য, সমস্ত মুসলিম জাহানের জন্য। জীবিতদের জন্য। মৃতদের জন্য। সুস্থদের জন্য। অসুস্থদের জন্য। শিশুদের জন্য বৃদ্ধদের জন্য। ইহকাল ও পরকালের জন্য। ঈমান ও আমলের জন্য। আল্লাহর রসুলের ( দঃ ) সুপারিশ লাভের জন্য।

যা করবেন না
১। আড্ডাবাজি
২। আতশবাজি
৩। অযথা সময় নষ্ট করা
৪। হাসি ঠাট্টা আমোদ-ফূর্তি করে বাজে সময় পার করা।
৫। নেটে, ব্লগে, ফেসবুকে ফাও সময় নষ্ট করা।
৬। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা
৭। গান বাজনা, নাটক সিনেমা, টিভি এই সব নিয়ে সময় কাটানো।
৮।অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো।

রবীন্দ্র পাঠ

কাগজের নৌকা

ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক’রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।

আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্‌
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে –
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।

আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো –
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।

বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ’রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে –
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি ‘পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।

রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে –
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার –
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।

গান্ধারীর আবেদন

দুর্যোধন। প্রণমি চরণে তাত!

ধৃতরাষ্ট্র। ওরে দুরাশয়,
অভীষ্ট হয়েছে সিদ্ধ?

দুর্যোধন। লভিয়াছি জয়।

ধৃতরাষ্ট্র। এখন হয়েছ সুখী?

দুর্যোধন। হয়েছি বিজয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র। অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই
রে দুর্মতি?

দুর্যোধন। সুখ চাহি নাই মহারাজ!
জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি– দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,
সদ্য করিয়াছি পান; সুখী নহি, তাত,
অদ্য আমি জয়ী। পিতঃ, সুখে ছিনু, যবে
একত্রে আছিনু বদ্ধ পাণ্ডবে কৌরবে,
কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে
কর্মহীন গর্বহীন দীপ্তিহীন সুখে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের গাণ্ডীবটঙ্কারে
শঙ্কাকুল শত্রুদল আসিত না দ্বারে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবেরা জয়দৃপ্ত করে
ধরিত্রী দোহন করি’ ভ্রাতৃপ্রীতিভরে
দিত অংশ তার– নিত্য নব ভোগসুখে
আছিনু নিশ্চিন্তচিত্তে অনন্ত কৌতুকে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের জয়ধ্বনি যবে
হানিত কৌরবকর্ণ প্রতিধ্বনিরবে।
পাণ্ডবের যশোবিম্ব-প্রতিবিম্ব আসি
উজ্জ্বল অঙ্গুলি দিয়া দিত পরকাশি
মলিন কৌরবকক্ষ। সুখে ছিনু, পিতঃ,
আপনার সর্বতেজ করি নির্বাপিত
পাণ্ডবগৌরবতলে স্নিগ্ধশান্তরূপে,
হেমন্তের ভেক যথা জড়ত্বের কূপে।
আজি পাণ্ডুপুত্রগণে পরাভব বহি
বনে যায় চলি– আজ আমি সুখী নহি,
আজ আমি জয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র। ধিক্‌ তোর ভ্রাতৃদ্রোহ।
পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ
সে কি ভুলে গেলি?

দুর্যোধন। ভুলিতে পারি নে সে যে–
এক পিতামহ, তবু ধনে মানে তেজে
এক নহি। যদি হত দূরবর্তী পর
নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর
মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,
কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব-উদয়শিখরে
দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।
আজ দ্বন্দ্ব ঘুচিয়াছে, আজি আমি জয়ী,
আজি আমি একা।

ধৃতরাষ্ট্র। ক্ষুদ্র ঈর্ষা! বিষময়ী
ভুজঙ্গিনী!

দুর্যোধন। ক্ষুদ্র নহে, ঈর্ষা সুমহতী।
ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি
মধ্যে রাখে ব্যবধান; লক্ষ লক্ষ তৃণ
একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন;
নক্ষত্র অসংখ্য থাকে সৌভ্রাত্রবন্ধনে–
এক সূর্য, এক শশী। মলিন কিরণে
দূর বন-অন্তরালে পাণ্ডুচন্দ্রলেখা
আজি অস্ত গেল, আজি কুরুসূর্য একা–
আজি আমি জয়ী!

ধৃতরাষ্ট্র। আজি ধর্ম পরাজিত।

দুর্যোধন। লোকধর্ম রাজধর্ম এক নহে পিতঃ!
লোকসমাজের মাঝে সমকক্ষ জন
সহায় সুহৃদ্‌-রূপে নির্ভর বন্ধন।
কিন্তু রাজা একেশ্বর; সমকক্ষ তার
মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,
সম্মুখের অন্তরাল, পশ্চাতের ভয়,
অহর্নিশি যশঃশক্তিগৌরবের ক্ষয়,
ঐশ্বর্যের অংশ-অপহারী। ক্ষুদ্র জনে
বলভাগ ক’রে লয়ে বান্ধবের সনে
রহে বলী; রাজদণ্ড যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা, তত তার ক্ষয়।
একা সকলের ঊর্ধ্বে মস্তক আপন
যদি না রাখিবে রাজা, যদি বহুজন
বহুদূর হতে তাঁর সমুদ্ধত শির
নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির,
তবে বহুজন–‘পরে বহুদূরে তাঁর
কেমনে শাসনদৃষ্টি রহিবে প্রচার?
রাজধর্মে ভ্রাতৃধর্ম বন্ধুধর্ম নাই,
শুধু জয়ধর্ম আছে, মহারাজ, তাই
আজি আমি চরিতার্থ– আজি জয়ী আমি–
সম্মুখের ব্যবধান গেছে আজি নামি
পাণ্ডবগৌরবগিরি পঞ্চচূড়াময়।

ধৃতরাষ্ট্র। জিনিয়া কপটদ্যূতে তারে কোস জয়,
লজ্জাহীন অহংকারী!

দুর্যোধন। যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র, পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,
তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ
কোন্‌ নর লজ্জা পায়? মূঢ়ের মতন
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমাঝে আত্মসমর্পণ
যুদ্ধ নহে, জয়লাভ এক লক্ষ্য তার–
আজি আমি জয়ী পিতঃ, তাই অহংকার।

ধৃতরাষ্ট্র। আজি তুমি জয়ী, তাই তব নিন্দাধ্বনি
পরিপুর্ণ করিয়াছে অম্বর অবনী
সমুচ্চ ধিক্কারে।

দুর্যোধন। নিন্দা! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মোর পাদপীঠতলে। “দুর্যোধন পাপী”
“দুর্যোধন ক্রূরমনা” “দুর্যোধন হীন”
নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন,
রাজদণ্ড স্পর্শ করি কহি মহারাজ,
আপামর জনে আমি কহাইব আজ–
“দুর্যোধন রাজা, দুর্যোধন নাহি সহে
রাজনিন্দা-আলোচনা, দুর্যোধন বহে
নিজ হস্তে নিজ নাম।”

ধৃতরাষ্ট্র। ওরে বৎস, শোন্‌,
নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্বাসন
নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে
গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,
নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।
রসনায় নৃত্য করি চপল চঞ্চল
নিন্দা শ্রান্ত হয়ে পড়ে; দিয়ো না তাহারে
নিঃশব্দে আপন শক্তি বৃদ্ধি করিবারে
গোপন হৃদয়দুর্গে। প্রীতিমন্ত্রবলে
শান্ত করো, বন্দী করো নিন্দাসর্পদলে
বংশীরবে হাস্যমুখে।

দুর্যোধন। অব্যক্ত নিন্দায়
কোনো ক্ষতি নাহি করে রাজমর্যাদায়;
ভ্রূক্ষেপ না করি তাহে। প্রীতি নাহি পাই
তাহে খেদ নাহি, কিন্তু স্পর্ধা নাহি চাই
মহারাজ! প্রীতিদান স্বেচ্ছার অধীন,
প্রীতিভিক্ষা দিয়ে থাকে দীনতম দীন–
সে প্রীতি বিলাক তারা পালিত মার্জারে,
দ্বারের কুক্কুরে, আর পাণ্ডবভ্রাতারে–
তাহে মোর নাহি কাজ। আমি চাহি ভয়,
সেই মোর রাজপ্রাপ্য– আমি চাহি জয়
দর্পিতের দর্প নাশি। শুন নিবেদন
পিতৃদেব– একাল তব সিংহাসন
আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে,
কণ্টকতরুর মতো নিষ্ঠুর প্রাচীরে
তোমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান–
শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্যগুণগান,
আমাদের নিত্য নিন্দা– এইমতে, পিতঃ,
পিতৃস্নেহ হতে মোরা চিরনির্বাসিত।
এইমতে, পিতঃ, মোরা শিশুকাল হতে
হীনবল– উৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে
পাষাণের বাধা পড়ি মোরা পরিক্ষীণ
শীর্ণ নদ, নষ্টপ্রাণ, গতিশক্তিহীন,
পদে পদে প্রতিহত; পাণ্ডবেরা স্ফীত,
অখণ্ড, অবাধগতি। অদ্য হতে পিতঃ,
যদি সে নিন্দুকদলে নাহি কর দূর
সিংহাসনপার্শ্ব হতে, সঞ্জয় বিদুর
ভীষ্মপিতামহে, যদি তারা বিজ্ঞবেশে
হিতকথা ধর্মকথা সাধু-উপদেশে
নিন্দায় ধিক্কারে তর্কে নিমেষে নিমেষে
ছিন্ন ছিন্ন করি দেয় রাজকর্মডোর,
ভারাক্রান্ত করি রাখে রাজদণ্ড মোর,
পদে পদে দ্বিধা আনে রাজশক্তি-মাঝে,
মুকুট মলিন করে অপমানে লাজে,
তবে ক্ষমা দাও পিতৃদেব– নাহি কাজ
সিংহাসনকণ্টকশয়নে– মহারাজ,
বিনিময় করে লই পাণ্ডবের সনে
রাজ্য দিয়ে বনবাস, যাই নির্বাসনে।

ধৃতরাষ্ট্র। হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মোর
কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর
সুহৃদের নিন্দাবাক্য, হইত কল্যাণ।
অধর্মে দিয়েছি যোগ, হারায়েছি জ্ঞান,
এত স্নেহ। করিতেছি সর্বনাশ তোর,
এত স্নেহ। জ্বালাতেছি কালানল ঘোর
পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে–
তবু পুত্র, দোষ দিস স্নেহ নাই ব’লে?
মণিলোভে কালসর্প করিলি কামনা,
দিনু তোরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা
অন্ধ আমি।– অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন– তোরে লয়ে প্রলয়তিমিরে
চলিয়াছি– বন্ধুগণ হাহাকাররবে
করিছে নিষেধ, নিশাচর গৃধ্র-সবে
করিতেছে অশুভ চীৎকার, পদে পদে
সংকীর্ণ হতেছে পথ, আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর, তবু দৃঢ়করে
ভয়ংকর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তোরে
বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে
ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে
উল্কার আলোকে– শুধু তুমি আর আমি,
আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী–
নাই সম্মুখের দৃষ্টি, নাই নিবারণ
পশ্চাতের, শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের। সহসা একদা
চকিতে চেতনা হবে, বিধাতার গদা
মুহূর্তে পড়িবে শিরে, আসিবে সময়–
ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরো না সংশয়,
আলিঙ্গন করো না শিথিল, ততক্ষণ
দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব স্বার্থধন–
হও জয়ী, হও সুখী, হও তুমি রাজা
একেশ্বর।– ওরে, তোরা জয়বাদ্য বাজা।
জয়ধ্বজা তোল্‌ শূন্যে। আজি জয়োৎসবে
ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে–
না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,
নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা-ভয়
কুরুবংশরাজলক্ষ্ণী নাহি রবে আর–
শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,
আর কালান্তক যম– শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।

চর। মহারাজ, অগ্নিহোত্র দেব-উপাসনা
ত্যাগ করি বিপ্রগণ, ছাড়ি সন্ধ্যার্চনা,
দাঁড়ায়েছে চতুষ্পথে পাণ্ডবের তরে
প্রতীক্ষিয়া; পৌরগণ কেহ নাহি ঘরে,
পাণ্যশালা রুদ্ধ সব; সন্ধ্যা হল, তবু
ভৈরবমন্দির-মাঝে নাহি বাজে, প্রভু,
শঙ্খঘণ্টা সন্ধ্যাভেরী, দীপ নাহি জ্বলে;
শোকাতুর নরনারী সবে দলে দলে
চলিয়াছে নগরের সিংহদ্বার-পানে
দীনবেশে সজলনয়নে।

দুর্যোধন। নাহি জানে
জাগিয়াছে দুর্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন!
ঘনায়ে এসেছে আজি তোদের দুর্দিন।
রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়
ঘনিষ্ঠ কঠিন। দেখি কতদিন রয়
প্রজার পরম স্পর্ধা– নির্বিষ সর্পের
ব্যর্থ ফণা-আস্ফালন, নিরস্ত্র দর্পের
হুহুংকার।

[প্রতিহারীর প্রবেশ]

প্রতিহারী। মহারাজ, মহিষী গান্ধারী
দর্শনপ্রার্থিনী পদে।

ধৃতরাষ্ট্র। রহিনু তাঁহারি
প্রতীক্ষায়।

দুর্যোধন। পিতঃ, আমি চলিলাম তবে।

ধৃতরাষ্ট্র। করো পলায়ন। হায়, কেমনে বা সবে
সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ
ওরে পুণ্যভীত! মোরে তোর নাহি লাজ।

[গান্ধারীর প্রবেশ]

গান্ধারী। নিবেদন আছে শ্রীচরণে। অনুনয়
রক্ষা করো নাথ!

ধৃতরাষ্ট্র। কভু কি অপূর্ণ রয়
প্রিয়ার প্রার্থনা?

গান্ধারী। ত্যাগ করো এইবার–

ধৃতরাষ্ট্র। কারে হে মহিষী?

গান্ধারী। পাপের সংঘর্ষে যার
পড়িছে ভীষণ শান ধর্মের কৃপাণে,
সেই মূঢ়ে।

ধৃতরাষ্ট্র। কে সে জন? আছে কোন্‌খানে?
শুধু কহো নাম তার।

গান্ধারী। পুত্র দুর্যোধন।

ধৃতরাষ্ট্র। তাহারে করিব ত্যাগ!

গান্ধারী। এই নিবেদন
তব পদে।

ধৃতরাষ্ট্র। দারুণ প্রার্থনা, হে গান্ধারী
রাজমাতা!

গান্ধারী। এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি
হে কৌরব? কুরুকুলপিতৃপিতামহ
স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা করে অহরহ
নরনাথ! ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে–
কৌরবকল্যাণলক্ষ্ণী যার অত্যাচারে
অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ
রাত্রিদিন।

ধৃতরাষ্ট্র। ধর্ম তারে করিবে শাসন
ধর্মেরে যে লঙ্ঘন করেছে– আমি পিতা–

গান্ধারী। মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা
জাগ্রহ হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে– লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,
প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।

ধৃতরাষ্ট্র। কী রাখিব তারে ত্যাগ করি?

গান্ধারী। ধর্ম তব।

ধৃতরাষ্ট্র। কী দিবে তোমারে ধর্ম?

গান্ধারী। দুঃখ নব নব।
পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে
জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে
দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া?

ধৃতরাষ্ট্র। হায় প্রিয়ে,
ধর্মবশে একবার দিনু ফিরাইয়ে
দ্যূতবদ্ধ পাণ্ডবের হৃত রাজ্যধন।
পরক্ষণে পিতৃস্নেহ করিল গুঞ্জন
শত বার কর্ণে মোর, “কী করিলি ওরে!
এক কালে ধর্মাধর্ম দুই তরী-‘পরে
পা দিয়ে বাঁচে না কেহ। বারেক যখন
নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ
তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে;
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
কী করিলি হতভাগ্য, বৃদ্ধ বুদ্ধিহত,
দুর্বল দ্বিধায় পড়ি? অপমানক্ষত
রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলাবে না আর
পাণ্ডবের মনে– শুধু নব কাষ্ঠভার
হুতাশনে দান। অপমানিতের করে
ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।
সক্ষমে দিয়ো না ছাড়ি দিয়ে স্বল্প পীড়া–
করহ দলন। কোরো না বিফল ক্রীড়া
পাপের সহিত; যদি ডেকে আন তারে,
বরণ করিয়া তবে লহো একেবারে।”
এইমত পাপবুদ্ধি পিতৃস্নেহরূপে
বিঁধিতে লাগিল মোর কর্ণে চুপে চুপে
কত কথা তীক্ষ্ণ সূচিসম। পুনরায়
ফিরানু পাণ্ডবগণে; দ্যূতছলনায়
বিসর্জিনু দীর্ঘ বনবাসে। হায় ধর্ম,
হায় রে প্রবৃত্তিবেগ! কে বুঝিবে মর্ম
সংসারের!

গান্ধারী। ধর্ম নহে সম্পদের হেতু,
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু–
ধর্মেই ধর্মের শেষ। মূঢ়-নারী আমি,
ধর্মকথা তোমারে কী বুঝাইব স্বামী,
জান তো সকলই। পাণ্ডবেরা যাবে বনে,
ফিরাইলে ফিরিবে না, বদ্ধ তারা পণে।
এখন এ মহারাজ্য একাকী তোমার
মহীপতি– পুত্রে তব ত্যজ এইবার;
নিষ্পাপেরে দুঃখ দিয়ে নিজে পুর্ণ সুখ
লইয়ো না, ন্যায়ধর্মে কোরো না বিমুখ
পৌরবপ্রাসাদ হতে– দুঃখ সুদুঃসহ
আজ হতে, ধর্মরাজ, লহো তুলি লহো,
দেহো তুলি মোর শিরে।

ধৃতরাষ্ট্র। হায় মহারানী,
সত্য তব উপদেশ, তীব্র তব বাণী।

গান্ধারী। অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।
ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে
ফেলে রাখি সেও চলে যাক নির্বাসনে,
বঞ্চিত পাণ্ডবদের সমদুঃখভার
করুক বহন।

ধৃতরাষ্ট্র। ধর্মবিধি বিধাতার–
জাগ্রত আছেন তিনি, ধর্মদণ্ড তাঁর
রয়েছে উদ্যত নিত্য; অয়ি মনস্বিনী,
তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য করিবেন তিনি।
আমি পিতা–

গান্ধারী। তুমি রাজা, রাজ-অধিরাজ,
বিধাতার বাম হস্ত; ধর্মরক্ষা-কাজ
তোমা-‘পরে সমর্পিত। শুধাই তোমারে,
যদি কোনো প্রজা তব সতী অবলারে
পরগৃহ হতে টানি করে অপমান
বিনা দোষে– কী তাহার করিবে বিধান?

ধৃতরাষ্ট্র। নির্বাসন।

গান্ধারী। তবে আজ রাজপদতলে
সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে
বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্যোধন
অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন,
প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব
স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ– ভালোমন্দ
নাহি বুঝি তার; দণ্ডনীতি, ভেদনীতি,
কূটনীতি কত শত, পুরুষের রীতি
পুরুষেই জানে। বলের বিরোধে বল,
ছলের বিরোধে কত জেগে উঠে ছল,
কৌশলে কৌশল হানে– মোরা থাকি দূরে
আপনার গৃহকর্মে শান্ত অন্তঃপুরে
যে সেথা টানিয়া আনে বিদ্বেষ-অনল,
যে সেথা সঞ্চার করে ঈর্ষার গরল
বাহিরের দ্বন্দ্ব হতে, পুরুষেরে ছাড়ি
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী
গৃহধর্মচারিণীর পুণ্যদেহ- ‘পরে
কলুষপরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে
হস্তক্ষেপ– পতি-সাথে বাধায়ে বিরোধ
যে নর পত্নীরে হানি লয় তার শোধ,
সে শুধু পাষণ্ড নহে, সে যে কাপুরুষ।
মহারাজ, কী তার বিধান? অকলুষ
পুরুবংশে পাপ যদি জন্মলাভ করে
সেও সহে; কিন্তু, প্রভু, মাতৃগর্বভরে
ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ
জন্মিয়াছে– হায় নাথ, সেদিন যখন
অনাথিনী পাঞ্চালীর আর্তকণ্ঠরব
প্রাসাদপাষাণভিত্তি করি দিল দ্রব
লজ্জা-ঘৃণা-করুণার তাপে, ছুটি গিয়া
হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্ত্র আকর্ষিয়া
খল খল হাসিতেছে সভা-মাঝখানে
গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা– ধর্ম জানে
সেদিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন
জননীর শেষ গর্ব। কুরুরাজগণ,
পৌরুষ কোথায় গেছে ছাড়িয়া ভারত!
তোমরা, হে মহারথী, জড়মূর্তিবৎ
বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে,
কেহ বা হাসিলে, কেহ করিলে কৌতুকে
কানাকানি– কোষমাঝে নিশ্চল কৃপাণ
বজ্রনিঃশেষিত লুপ্তবিদ্যুৎ-সমান
নিদ্রাগত– মহারাজ, শুন মহারাজ,
এ মিনতি। দূর করো জননীর লাজ,
বীরধর্ম করহ উদ্ধার, পদাহত
সতীত্বের ঘুচাও ক্রন্দন; অবনত
ন্যায়ধর্মে করহ সম্মান– ত্যাগ করো
দূর্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র। পরিতাপদহনে জর্জর
হৃদয়ে করিছ শুধু নিষ্ফল আঘাত
হে মহিষী!

গান্ধারী। শতগুণ বেদনা কি, নাথ,
লাগিছে না মোরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তারে প্রাণ
কোনো ব্যথা নাহি পায় তার দণ্ডদান
প্রবলের অত্যাচার। যে দণ্ডবেদনা
পুত্রেরে পার না দিতে সে কারে দিয়ো না;
যে তোমার পুত্র নহে তারো পিতা আছে,
মহা-অপরাধী হবে তুমি তার কাছে
বিচারক। শুনিয়াছি বিশ্ববিধাতার
সবাই সন্তান মোরা– পুত্রের বিচার
নিয়ত করেন তিনি আপনার হাতে
নারায়ণ; ব্যথা দেন, ব্যথা পান সাথে;
নতুবা বিচারে তাঁর নাই অধিকার,
মূঢ় নারী লভিয়াছি অন্তরে আমার
এই শাস্ত্র। পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি
নির্বিচারে, মহারাজ, তবে নিরবধি
যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষীজনে,
ধর্মাধিপ নামে, কর্তব্যের প্রবর্তনে,
ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে–
ন্যায়ের বিচার তব নির্মমতারূপে
পাপ হয়ে তোমারে দাগিবে। ত্যাগ করো
পাপী দুর্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র। প্রিয়ে, সংহর, সংহর
তব বাণী। ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,
ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর
ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,
তাই তারে ত্যজিতে না পারি– আমি তার
একমাত্র। উন্মত্ত-তরঙ্গ-মাঝখানে
যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্‌ প্রাণে
ছাড়ি যাব? উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি
তবু তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি,
তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি
এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি
অকাতরে– অংশ লই তার দুর্গতির,
অর্ধ ফল ভোগ করি তার দুর্মতির,
সেই তো সান্ত্বনা মোর– এখন তো আর
বিচারের কাল নাই, নাই প্রতিকার,
নাই পথ– ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,
ফলিবে যা ফলিবার আছে।

[প্রস্থান]

গান্ধারী। হে আমার
অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে
প্রতীক্ষা করিয়া থাকো বিধির বিধিরে
ধৈর্য ধরি। যেদিন সুদীর্ঘ রাত্রি-‘পরে
সদ্য জেগে উঠে কাল সংশোধন করে
আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।
দুঃসহ উত্তাপে যথা স্থির গতিহীন
ঘুমাইয়া পড়ে বায়ু– জাগে ঝঞ্ঝাঝড়ে
অকস্মাৎ, আপনার জড়ত্বের ‘পরে
করে আক্রমণ, অন্ধ বৃশ্চিকের মতো
ভীমপুচ্ছে আত্মশিরে হানে অবিরত
দীপ্ত বজ্রশূল, সেইমত কাল যবে
জাগে, তারে সভয়ে অকাল কহে সবে।
লুটাও লুটাও শির– প্রণম, রমণী,
সেই মহাকালে; তার রথচক্রধ্বনি
দূর রুদ্রলোক হতে বজ্রঘর্ঘরিত
ওই শুনা যায়। তোর আর্ত জর্জরিত
হৃদয় পাতিয়া রাখ্‌ তার পথতলে।
ছিন্ন সিক্ত হৃৎপিণ্ডের রক্তশতদলে
অঞ্জলি রচিয়া থাক্‌ জাগিয়া নীরবে
চাহিয়া নিমেষহীন। তার পরে যবে
গগনে উড়িবে ধূলি, কাঁপিবে ধরণী,
সহসা উঠিবে শূন্যে ক্রন্দনের ধ্বনি–
হায় হায় হা রমণী, হায় রে অনাথা,
হায় হায় বীরবধূ; হায় বীরমাতা,
হায় হায় হাহাকার– তখন সুধীরে
ধুলায় পড়িস লুটি অবনতশিরে
মুদিয়া নয়ন। তার পরে নমো নম
সুনিশ্চিত পরিণাম, নির্বাক্‌ নির্মম
দারুণ করুণ শান্তি! নমো নমো নম
কল্যাণ কঠোর কান্ত, ক্ষমা স্নিগ্ধতম!
নমো নমো বিদ্বেষের ভীষণা নির্বৃতি!
শ্মশানে ভস্মমাখা পরমা নিষ্কৃতি!

[দুর্যোধন-মহিষী ভানুমতীর প্রবেশ]

ভানুমতী। ইন্দুমুখী, পরভৃতে, লহো তুলি শিরে
মাল্যবস্ত্র অলংকার।

গান্ধারী। বৎসে, ধীরে, ধীরে।
পৌরব ভবনে কোন্‌ মহোৎসব আজি?
কোথা যাও নব বস্ত্র-অলংকারে সাজি
বধূ মোর?

ভানুমতী। শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ
সমাগত।

গান্ধারী। শত্রু যার আত্মীয়স্বজন
আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম শত্রু তার,
অজেয় তাহার শত্রু। নব অলংকার
কোথা হতে হে কল্যাণী?

ভানুমতী। জিনি বসুমতী
ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি
দিয়েছিল যত রত্নমণি-অলংকার–
যজ্ঞদিনে যাহা পরি ভাগ্য-অহংকার
ঠিকরিত মাণিক্যের শত সূচীমুখে
দ্রৌপদীর অঙ্গ হতে, বিদ্ধ হত বুকে
কুরুকুলকামিনীর, সে রত্নভূষণে
আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে।

গান্ধারী। হা রে মূঢ়ে, শিক্ষা তবু হল না তোমার–
সেই রত্ন নিয়ে তবু এত অহংকার!
এ কী ভয়ংকরী কান্তি, প্রলয়ের সাজ।
যুগান্তের উল্কাসম দহিছে না আজ
এ মণিমঞ্জীর তোরে? রত্নললাটিকা
এ যে তোর সৌভাগ্যের বজ্রানলশিখা।
তোরে হেরি অঙ্গে মোর ত্রাসের স্পন্দন
সঞ্চারিছে, চিত্তে মোর উঠিছে ক্রন্দন–
আনিছে শঙ্কিত কর্ণে তোর অলংকার
উন্মাদিনী শংকরীর তাণ্ডবঝংকার।

ভানুমতী। মাতঃ, মোরা ক্ষত্রনারী, দুর্ভাগ্যের ভয়
নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়–
মধ্যাহ্নগগনে কভু, কভু অস্তধামে,
ক্ষত্রিয়মহিমা-সূর্য উঠে আর নামে।
ক্ষত্রবীরাঙ্গনা, মাতঃ, সেই কথা স্মরি
শঙ্কার বক্ষেতে থাকি সংকটে না ডরি
ক্ষণকাল। দুর্দিন দুর্যোগ যদি আসে,
বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি উপহাসে
কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবী–
কেমনে বাঁচিতে হয় শ্রীচরণ সেবি
সে শিক্ষাও লভিয়াছি।

গান্ধারী। বৎসে, অমঙ্গল
একেলা তোমার নহে। লয়ে দলবল
সে যবে মিটায় ক্ষুধা, উঠে হাহাকার,
কত বীররক্তস্রোতে কত বিধবার
অশ্রুধারা পড়ে আসি– রত্ন-অলংকার
বধূহস্ত হতে খসি পড়ে শত শত
চূতলতাকুঞ্জবনে মঞ্জরীর মতো
ঝঞ্ঝাবাতে। বৎসে, ভাঙিয়ো না বদ্ধ সেতু,
ক্রীড়াচ্ছলে তুলিয়ো না বিপ্লবের কেতু
গৃহমাঝে– আনন্দের দিন নহে আজি।
স্বজনদুর্ভাগ্য লয়ে সর্ব অঙ্গে সাজি
গর্ব করিয়ো না মাতঃ! হয়ে সুসংযত
আজ হতে শুদ্ধচিত্তে উপবাসব্রত
করো আচরণ– বেণী করি উন্মোচন
শান্ত মনে করো, বৎসে, দেবতা-অর্চন।
এ পাপসৌভাগ্যদিনে গর্ব-অহংকারে
প্রতিক্ষণে লজ্জা দিয়ো নাকো বিধাতারে।
খুলে ফেলো অলংকার, নব রক্তাম্বর;
থামাও উৎসববাদ্য, রাজ-আড়ম্বর;
অগ্নিগৃহে যাও, পুত্রী, ডাকো পুরোহিতে–
কালের প্রতীক্ষা করো শুদ্ধসত্ত্ব চিতে্‌।

যুধিষ্ঠির। আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি, জননী,
বিদায়ের কালে।

গান্ধারী। সৌভাগ্যের দিনমণি
দুঃখরাত্রি-অবসানে দ্বিগুণ উজ্জ্বল
উদিবে হে বৎসগণ! বায়ু হতে বল,
সূর্য হতে তেজ, পৃথ# হতে ধৈর্যক্ষমা
করো লাভ দুঃখব্রত পুত্র মোর! রমা
দৈন্য-মাঝে গুপ্ত থাকি দীন-ছদ্ম-রূপে
ফিরুন পশ্চাতে তব সদা চুপে চুপে,
দুঃখ হতে তোমা-তরে করুন সঞ্চয়
অক্ষয় সম্পদ। নিত্য হউক নির্ভয়
নির্বাসনবাস। বিনা পাপে দুঃখভোগ
অন্তরে জ্বলন্ত তেজ করুক সংযোগ
বহ্নিশিখাদগ্ধ দীপ্ত সুবর্ণের প্রায়।
সেই মহাদুঃখ হবে মহৎ সহায়
তোমাদের। সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী
ধর্মরাজ বিধি, যবে শুধিবেন তিনি
নিজহস্তে আত্মঋণ তখন জগতে
দেব নর কে দাঁড়াবে তোমাদের পথে!
মোর পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ
খণ্ডন করুক সব মোর আশীর্বাদ
পুত্রাধিক পুত্রগণ! অন্যায় পীড়ন
গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক মন্থন।
(দ্রৌপদীকে আলিঙ্গনপূর্বক)
ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,
হে আমার রাহুগ্রস্ত শশী, একবার
তোলো শির, বাক্য মোর করো অবধান।
যে তোমারে অবমানে তারি অপমান
জগতে রহিবে নিত্য, কলঙ্ক অক্ষয়।
তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়
ভাগ করে লইয়াছে সর্ব কুলাঙ্গনা–
কাপুরুষতার হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।
যাও বৎসে, পতি-সাথে অমলিনমুখ
অরণ্যেরে করো স্বর্গ, দুঃখে করো সুখ।
বধূ মোর, সুদুঃসহ পতিদুঃখব্যথা
বক্ষে ধরি সতীত্বের লভো সার্থকতা।
রাজগৃহে আয়োজন দিবসযামিনী
সহস্র সুখের– বনে তুমি একাকিনী
সর্বসুখ, সর্বসঙ্গ, সর্বৈশ্বর্যময়,
সকল সান্ত্বনা একা, সকল আশ্রয়,
ক্লান্তির আরাম, শান্তি, ব্যাধির শুশ্রূষা,
দুর্দিনের শুভলক্ষ্ণী, তামসীর ভূষা
উষা মূর্তিমতী। তুমি হবে একাকিনী
সর্বপ্রীতি, সর্বসেবা, জননী, গেহিনী–
সতীত্বের শ্বেতপদ্ম সম্পূর্ণ সৌরভে
শতদলে প্রস্ফুটিয়া জাগিবে গৌরবে।

সহযাত্রী

নাম তার জানিনা
একই বাসে আসি
সকাল বেলা আমার অফিস নয়টায়, তারো
আমি ভাবি আহা আমাদের মাঝে কত মিল

সে বাসস্টপে আসে ঠিক আটটায় কিংবা আরো আগে
আর আমি ঘুম থেকেই উঠতাম আটটায়
সময়ের সাথে মেয়েদের একটা বিপরীত
সম্পর্ক থাকলেও এইখানে তার ব্যাতিক্রম

এখন আমিও উঠে যাই সাতটায়
আটটার পাঁচ মিনিট আগেই টীকিট কাটি
টিকেট কাটতে না কাটতেই
তার টিকেটের অর্ডার পরে।

সাগ্রহে জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন
তার মুচকি হাসির জন্য আমার
সারা রাজ্যের সমান সকাল বেলাকার ঘুম
বিক্রি করে দিয়েছি

টেবিলে ফাইলের স্তুপ শেষ হয় না
আমি তবু ঠিক ছয়টায় বের হয়ে যাই
উপরে নিচে সবাই ভাবে
ব্যাপার খানা কি

এই ভাবে সে আমার সহ যাত্রিনি
আস্তে আস্তে পার্শ্ববর্তিনি
মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনি
রাতে ঘুম আসে না
সকালে সাতটাই উঠি

টুকটাক কথা হয়
রাজনীতি বাজার দর
ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেটের খবর

আমার স্বপনের জাল বড় হতে
বুকের মোচড়ানি বেড়ে যায়
খাবারে অরুচি ধরেছে
চোখের নিচে কালি।

আমার গায়ের গন্ধে টের পেয়েছিল বোধহয়
বললে স্মোক করেন
বললাম আজই ছেড়ে দেব
মনে ভাবি শুধু সিগারেট কেন
আমার জন্ম জন্মান্তরের সব ছেড়ে দেব

কিন্তু এইভাবে তো আর চলে না
কত কথা হয়
আসল কথা বলতে গেলে
আমার গলার জল শুকিয়ে যায়

যা থাকে কপালে
চলুন যাই কোন রেস্তোরাঁয়
কত কাজেই তো লেট হয়
আজকে বুঝি আমার জন্য
এইটুকু হতে পারে না
জানা সব কবিতা সব গান
মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করে

আজ তার দেখা নাই
কাল তার দেখা নাই
পরদিন দেখা নাই

আর কোন দিন তার দেখা পাই নাই

আজ আরশে আসেন মোদের নবী কামলীওয়ালা

আজ আরশে আসেন মোদের নবী কমলীওয়ালা

আসিছেন হাবীবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর,
চাঁদ পিয়াসে ছুটে’ আসে আকাশ- পানে যেমন চকোর,
কোকিল যেমন গেয়ে উঠে ফাগুম আসার আভাস পেয়ে,
তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে,-
দেখ আজ আরশে আসেন মোদের নবী কামলীওয়ালা
হের সেই খুশীতে চাঁদ- সুরুজ আজ হল দ্বিগুন আলা।।

ফকির দরবেশ আউলিয়া যাঁরে
ধ্যানে জ্ঞানে ধরতে নারে,
যাঁর মহিমা বুঝতে পারে
এক সে আল্লাহতালা।।

বারেক মুখে নিলে যাঁহার নাম
চিরতরে হয় দোযখ হারাম,
পাপীর তরে দস্তে যাঁহার
কাওসারের পেয়ালা।।

মিম হরফ না থাকলে যে আহাদ
নামে মাখা যার শিরীন শহদ,
নিখিল প্রেমাস্পদ আমার মোহাম্মদ
ত্রিভুবন উজালা।।
[নজরুল]

আজ পবিত্র মে’রাজ রজনী।
মে’রাজ আরবী শব্দ, বাংলায় এর শাব্দিক অর্থ করা যায় ঊর্ধ্বারোহণ। ব্যাপকঅর্থে মে’রাজ বলতে বুঝায় সপ্তম আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন ও ধনুক কিংবা তার চেয়ে কম দূরত্ব পরিমাণ আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য পর্যন্ত ভ্রমণ।

পারিভাষিকভাবে নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ সালের ২৭ রজবের রাতের শেষ প্রহরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) হযরত জিব্রাঈলের (আ.) সঙ্গে আল্লাহর নির্দেশে ও তাঁর খাস রহমতে বায়তুল্লাহ হতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ‘বোরাক্বে’ ভ্রমণ, অতঃপর সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সপ্ত আসমান পেরিয়ে আরশে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস হয়ে বোরাক্বে আরোহন করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাকে মে’রাজ বলা হয়।

মে’রাজের পুরো ভ্রমনে জীবরাঈল আমীন রাসূলে করীমকে (দঃ) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সঙ্গ দিয়ে ছিলেন। এরপরে জীবরীল আমীনের আর যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করলেই জীবরাঈলের পাখা পুড়ে যেত। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশ পর্যন্ত নবীজী একাই ভ্রমন করে আল্লাহর দীদার লাভ করেন। মে’রাজের পুরো ঘটনাই অলৌকিক এবং নবীজীর অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। মহানবীর (দঃ ) অনন্যসাধারণ মু’জিজা এবং রাসূলে করীমের শ্রেষ্ঠত্ত্বের অন্যতম প্রমান।

মানব ইতিহাসে এটা চরম আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। তৎকালীন অবিশ্বাসীরা এই অনন্য সাধারণ ঘটনা প্রথমেই অস্বীকার করে। সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বাকার (রাদিআল্লাহু আনহু) শোনামাত্রই নিঃসংকোচে ও নিঃসন্দেহে এতে বিশ্বাস স্থাপন করেন।

অন্যান্য নবীগণ আল্লাহর দিদার লাভের প্রার্থী হয়েও ব্যর্থ হন। কিন্তু আমাদের নবীজীকে আল্লাহ নিমন্ত্রণ করে দেখা দেন। এটা উম্মত হিসেবে আমাদের জন্যও চরম সৌভাগ্যের বিষয়। এরাতে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে সুক্ষ্ণাতি সুক্ষ্ণ জ্ঞান দান করেন। বেহেশত দোজখ পরিদর্শন করান।

এ রাত্রিতে উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হয়। ফলে এটা খুবই ফজিলতের রাত্রি। অতএব এই রাত্রিতে যতদূর সম্ভব জেগে নফল নামাজ, জিকির-আসকার, কুরআন তিলওয়াত ও দরুদ শরীফ ইত্যাদি পাঠ করা এবং নফল নিয়তে দিবাভাগে রোজা রাখা ভাল।

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এই মে’রাজের রজনীর ফজিলত ও বরকত দানে ধন্য করুন। এটাই প্রার্থনা।

সন্ন্যাসী

দূর ছাই ভাললাগে না আর
এই বাড়িঘর সংসার
সারাদিন বউয়ের ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যানানি
তার সাথে যোগহয় হাড়ি পাতিলের ঝনঝনানি
ছেলে পেলে আছে মোটে গোটা দুই
কুড়াল চালায় তারা যেখানে চলে না সুই
এরে ধরে তারে মারে
কার ডাব কার গাব কখন যে পাড়ে
সারাদিন সকলের এই সব নালিশ
চুল সব যায় বুঝি করিতে সালিশ
দিন রাত ঘানি টানাটানি ছেড়ে দিয়ে
ভাল হয় সন্ন্যাসী বনি যদি বনে গিয়ে
জগত সংসার মিথ্যে মায়া
মুক্তি পাবে ছেড়ে দিলে তার ছায়া

এই ভেবে মতি মিয়া বের হয়ে আসে
সে আর থাকবে না জগতের কারো পাশে
বনবাসি হবে বলে বনের দিকে চলে
সন্ন্যাসী জীবনের শুরু হবে কিছু ক্ষণ পরে

লুঙ্গি বাধা ছিল কোমরে
খুলে নিয়ে শকত করে আবার পরে
কয়েন কয়েক গোঁজা ছিল তাতে
লুঙ্গি খুলতে ঝরে পড়ে মাটিতে
কানে যেতে কয়েনের আওয়াজ
ভুলে গিয়ে সব ক্যাওয়াস
তুলে নিয়ে সেলাম করে বার দুই
টাকা বড় প্রয়োজন যতই সন্ন্যাসি হই

তৈল

তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে ?

সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।

বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।

যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না — উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোন কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মুক হইলেও ম্যাজিষ্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্ণর হইতে পারে।

তৈলের মহিমা অতি অপরূপ। তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না। তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না,ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহেরা খোলে না, হাজার গুন থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না, তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।

সর্বশক্তিময় তৈল নানারূপে সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি, যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্বারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য “ফিলনথপি।” যাহা দ্বারা সাহেবকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম লয়েলটি ; যাহা দ্বারা বড়লোককে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম নম্রতা বা মডেষ্টি। চাকর বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তৈল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ন পাই। অনেকের নিকট তৈল দিয়া তৈল বাহির করি।

পরস্পর ঘর্ষিত হইলে সকল সকল বস্তুতেই অগ্ন্যুদ্গম হয়। অগ্ন্যুদ্গম নিবারণের একমাত্র উপায় তৈল। এইজন্যই রেলের চাকায় তৈলের অনুকল্প চর্বি দিয়া থাকে। এইজন্যই যখন দুজনে ঘোরতর বিবাদে লঙ্কাকাণ্ড উপস্থিত হয়, তখন রফা নামক তৈল আসিয়া উভয় ঠাণ্ডা করিয়া দেয়। তৈলের যদি অগ্নিনিবারণী শক্তি না থাকিত, তবে গৃহে গৃহে গ্রামে গ্রামে পিতাপুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে রাজায়-প্রজায় বিবাগ বিসম্বাদে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত।

পূর্বেই বলা গিয়াছে, যে তৈল দিতে পারে, সে সর্বশক্তিমান, কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে,সময় আছে, কৌশল আছে।

তৈল দ্বারা অগ্নি পর্যন্ত বশতাপন্ন হয়। অগ্নিতে অল্প তৈল দিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে আবদ্ধ রাখা যায়। কিন্তু সে তৈল মূর্তিমান।

কে যে তৈল দিবার পাত্র নয়, তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দিবার পাত্র। তৈল এমন জিনিষ নয় যে, নষ্ট হয়। একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোন না কোন ফল ফলিবে। কিন্তু তথাপি যাহার নিকট উপস্থিত কাজ আদায় করিতে হইবে, সেই তৈলনিষেধের প্রধান পাত্র। সময় — যে সময়েই হউক, তৈল দিয়া রাখিলেই কাজ হইবে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয়।

কৌশল — পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হউক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে। তাহার প্রমাণ ভট্টাচার্যেরা সমস্ত দিন বকিয়াও যাহার নিকট পাঁচ সিকা বৈ আদায় করিতে পারিল না, একজন ইংরেজিওয়ালা তাহার নিকট অনায়াসে ৫০ টাকা বাহির করিয়া লইয়া গেল। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না।

ব্যক্তিবিশেষে তৈলের গুনতারতাম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনীশক্তি আছে যে, তাহাতে যে উহা অন্য সকল পদার্থের গুনই আত্নসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।

তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে, কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর, বাহিরের লোককে তৈল দিতে পারে না। তৈলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ।

আজকাল বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতি শিখাইবার জন্য নানাবিধ চেষ্টা চলিতেছে। যাহাতে বঙ্গের লোক প্রাকটিক্যাল অর্থাৎ কাজের লোকের হইতে পারে; তজ্জন্য সকলেই সচেষ্ট, কিন্তু কাজের লোক হইতে হইলে তৈলদান সকলের আগে দরকার। অতএব তৈলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি, বাছিয়া বাছিয়া কোন রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শীঘ্র একটি স্নেহ-নিষেধের কালেজ খোলা হয়। অন্ততঃ উকীলি শিক্ষার নিমিত্ত ল’ কালেজে একজন তৈল অধ্যাপক নিযুক্ত করা আবশ্যক। কালেজ খুলিতে পারিলে ভালই হয়।

কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তৈল সবাই দিয়া থাকেন — কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার। এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না। যদিও কোন রীতিমত কালেজ নাই, তথাপি যাঁহার নিকট চাকরীর বা প্রমোশনের সুপারিস মিলে, তাদৃশ লোকের বাড়ী সদাসর্বদা গেলে উত্তমরূপ শিক্ষালাভ করা যাইতে পারে। বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল — বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে, বাঙালীদিগের তৈলের মূল্য অধিক নয়; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন। যাঁহারা জানেন, তাঁহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন।

তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হইবে, ইচ্ছা করিলে সে শিক্ষা এদেশে হওয়া হওয়া কঠিন। তজ্জন্য বিলাত যাওয়া আবশ্যক। তত্রত্য রমণীরা এ বিষয়ের প্রধান অধ্যাপক, তাহাদের থ্রু হইলে তৈল শীঘ্র কাজে আইসে।

শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।

** এতক্ষণ আপনারা যাহা পড়িলেন ইহা আমার লিখা নয়। এই লেখা তৈয়ার করিয়াছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। আমি কেবলমাত্র সংগ্রহ করিয়া আপনাদের পড়িবার নিমিত্তে প্রকাশ করিলাম। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ভাষার গুরু। কলিকাতায় সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ১৯২১-১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত পড়াইয়াছেন। তাঁহার জীবনকাল ছিল ১৮৫৩ হইতে ১৯৩১ পর্যন্ত।

নতুন একটা সত্যগল্প

অফিসে কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। খেয়াল ছিল না। নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে সবার মাথায় আগুন ধরে আছে। কাল সকালের মধ্যে রিপোর্ট জমা না দিলে, প্রজেক্ট মিস হয়ে যেতে পারে, এমন জরুরী অবস্থা। কোম্পানীর টাকায় নিজেদের ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়; তাই সবাই জান দিয়ে খাটছে যেন প্রজেক্ট কোন ভাবেই মিস না হয়। কাজ শেষ করে দেখি দশটা ওভার। বাসা থেকে ফোন এসেছে কমছে কম পনের বার। আজ যে কপালে কি আছে সেটা চিন্তা ভাবনা না করেই ফোন দিয়ে বললাম, বের হচ্ছি। ওপাশে উদ্বেগ উৎকন্ঠা অভিমান রাগ প্রভৃতি একসাথ ঝরে পড়ছিল। বললাম, বাসায় আসি, সব শুনব, সব বলব। এখন তাড়াতাড়ি বের হই।

বের হয়েই দেখি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা জনমানব হীন। অফিসের সামনের এই রাস্তা এমনিতেই সুবিধাজনক না। সন্ধ্যার পরে এটা পার হতেই হয় জানমালের রিক্স নিয়া। ট্যাক্সিতে ফোন দিলাম। বলল, পাঁচমিনেটের মধ্যেই আসছি। রাস্তা ফাঁকা আছে। সুতরাং পাঁচ মিনিটেই চলে এল। গাড়িতে উঠেই মনে হল বউকে বলছি সন্দেশ নিয়ে যাব। এমনিতেই কপালে আজ শনি আছি। সন্দেশ নিয়ে গেলে শনির দশা কিছুটা উপশম হয়। ড্রাইভারকে বললাম, প্রিমিয়ামের সামনে দিয়ে যাবে। শনি কপালের পিছে লেগেই আছে। প্রিমিয়াম বন্ধ। মাথার খুলির নিচে নরম মগজে তখন প্রজেক্ট, সন্দেশ, শনি এইসব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বুদবুদের মত করে সেগুলো ঠেলে বের হতে গিয়ে ঠোকর খাচ্ছে। তালগোল পাকাতে পাকাতে কাওরান বাজার এসে সিগনালে আটকা পড়লাম। এই সিগনাল দিনের বেলায় আধা ঘন্টার আগে ছাড়ে না। এত রাতে সারা ঢাকা শহরে গাড়ি ঘোড়া না থাকলেও এখানে কোন অভাব নাই। মিনিমাম পনের মিনিটের ধাক্কা। জ্যামে বসে থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ভাঙচুর করে এগিয়ে যাই। কিন্তু আসে পাশের গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।

আচমকা ড্রাইভিং সিটে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার নাই। গাড়ির আশে পাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও নাই। মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। এই মুহুর্তে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে নামবে কেন। এখন সিগনাল যদি ছেড়ে দেয়? এবং সিগনাল ছেড়ে দিল। প্যাঁ-ফোঁ করে লালবাতি জ্বালিয়ে গাড়ি গুলো নড়তে শুরু করেছে। আমি ড্রাইভারকে দেখি না। আমাদের গাড়িও দেখি নড়তে শুরু করে। ড্রাইভার ছাড়াই গাড়ি চলছে। ডাইনে বাঁয়ে কেটে, লাইট মেরে, সিগনাল দিয়ে, ব্রেক মেরে মেরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার ছাড়াও গাড়ি চলে। আজকাল শুনছি নানান দেশে চালক ছাড়া গাড়ি চলে। গুগলের অফিসে নাকি এরকম গাড়ি আছে। এও তো দেখি সেই রকম। কিন্তু ড্রাইভার গেল কই।

ড্রাইভার যে গেল আর ফেরার নাম নাই। গাড়ি চলছে গাড়ির মত করে। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। কাদের পাল্লায় পড়েছি। হরর কি সাইন্স ফিকশনের কাহিনীর মত আমাকে রিমোট কন্ট্রোলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে নাকি? পান্থপথে এসে সিগনালে পড়লে ভাবলাম নেমে যাই। ও খোদা, দরজা লক করা। আসলেই তো রিমোট কনট্রোল। ভাবলাম শেষ চেষ্টা করা যাক। লাফিয়ে উঠে সামনে ড্রাইভিং সিটে বসতে গেলাম। কে যেন পেছন থেকে টান দিয়ে বসিয়ে দিল। অটো সিট বেল্ট এসে আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। আমার কান্না কাটি করা ছাড়া কোন উপায় রইল না। আমি যে কোন অত্যাধুনিক চক্রের হাতে পড়েছি, সন্দেহ নাই। সম্ভব অসম্ভব সব সম্ভাবনা খতিয়েও কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না। এলিয়েনের পাল্লায় পড়েছি না অফিসের প্রজেক্টের রাইভালরা না স্মার্ট কিডন্যাপার না অন্য কিছু – আমার মাথা একেবারে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা। মাথার গিলু ফুটে ফুটে ঘাম ঝরতে লাগল। আমাকে কেন কিডন্যাপ করবে, আমার মত ছা-পোষা কেরানীকে কিডন্যাপ করে কার কি লাভ? ফোন হাতে নিয়ে কাকে ফোন দেব ভাবছি। ফোনে কাকে বলা যায়, কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে বলা যায়। আবার ভয় হচ্ছিল, মুখে চড় মেরে আবার ফোন টা না নিয়ে যায়। কিন্তু না, শান্তি মতোই কাঁদ কাঁদতে বউকে বলতে পারলাম। বউ ধমক দিয়ে বলল, আমার এখন রঙবাজির টাইম নাই। বাসায় এস তোমার রঙবাজি দেখাচ্ছি। শেষে মরিয়া হয়ে বললাম, আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার কথা শুন, তুমি ফোন রাইখ না। ধরে থাক। প্লিজ। বউয়ের গলা নরম হয়ে এলে বললাম, আজ বাসায় না ফিরলে, আমার বাচ্চাটাকে দেখো। এবার দেখি বউও ফোঁপাতে শুরু করেছে।

সিগনাল ছেড়ে দিলে দূর্বার গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তার পাশে এক রিকসাওয়ালা রিকশা দাঁড় করিয়ে চা খাচ্ছিল, রিসকাটাকে ইচ্ছে করেই এমন একটা ধাক্কা দিল রিসকা গিয়ে উলটে পড়ে রইল। রিকসাওয়ালা বুঝে উঠে একটা গালি দেয়ার আগেই গাড়ি পরের সিগনালে। এখানে এসে সিগনালও শুনল না। একটা মাইক্রোকে ধাক্কা দিয়ে ওর ছাল তুলে দিল, আরেকটা প্রাডোর লুকিং গ্লাস ভেঙে বাম্পার ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে চলল। টালমাটাল মাতালের কি বদ্ধ উন্মাদের কাজ কারবার।

কিন্তু গাড়ি ঠিকঠাক রাস্তায় যাচ্ছে। আমার বাসার দিকেই। বউকে সে কথা বললাম। সে কিছুটা আশ্বস্ত হল। সে এক টানা দোয়া দরূদ সূরা কালাম সব পড়েই যাচ্ছে। ঘামে আমার সারা শরীর ভিজে গেছে, হাত পায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। গাড়ি কিন্তু ঠিক ঠিক আমার বাসাতেই এল। দারোয়ান গেট খুলতে গিয়ে কি করবে না করবে বুঝতে উঠতে পারছিল না। আমি ইশারা করলাম তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিতে । বাসায় ঢুকলে সিটবেল্ট ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে আমাকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দিল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গাড়িটা বাতাসে মিলিয়ে গেল। বেচারা দারোয়ানের খুলির নিচে নরম মাথা ঘটনাটা হজম করতে না পেরে ঘুরে পড়ে গেল।

কুপমণ্ডুক আখ্যা দিয়াছ যারে

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভণ্ডামী ও প্রতারনার বসবাস তা থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয় বৈশাখের বর্ষবরণ। আমাদের শিক্ষিত ও সমাজের উপরের তলার মানুষেরাই ভান ও ভণ্ডামীতে আক্রান্ত সর্বাধিক। সেই ভান ও ভণ্ডামী এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌছেছে যে সেটা পুরোপুরি ফ্যাসীবাদী রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমরা দাবী করি বৈশাখের বর্ষবরণ আমাদের শেকড়ে ফেরার প্রচেষ্টা, আমাদের ঐতিহ্যকে ধারন করা। বাস্তবতা কিন্তু উলটো। বংশ পরম্পরায় আবহমানকাল ধরে পুরুষানুক্রমে যেটা আমাদের নিঃসংকোচ আচরিত সেটাই আমাদের ঐতিহ্য হওয়ার কথা। বিজাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আমাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তখনি আমরা ফিরে যেতে চাই নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কারের কাছে। যুগ যুগ ধরে আচরিত এই আচরণ এই অভ্যাস এই প্রথা আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমরা যখন নিজেদের রক্ত নিজেদের আচরণ ভুলে যাই তখনি আসে শেকড়ে ফেরার কথা।

বাস্তবে শেকড়ে ফেরার চরিত্র বৈশাখে কতটুকু? শেকড়ে ফেরার কিংবা শেকড়ের কোন চরিত্রই এই বৈশাখী বর্ষবরণের উৎসবে আমরা রাখিনি। এখানে তৃণমূল মানুষের আচরিত চিরাচরিত আচারের পরিবর্তে আমরা করেছি একে পরিনত আরোপিত উৎসবের এক ভুল ঐতিহ্যের মহোৎসবে। বর্ষবরনের সবচেয়ে বড় আয়োজন তা হল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রার শুরু ১৯৮৯ সালে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলায়। এই শোভাযাত্রাকে আমরা দাবী করি অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। আমাদের গণমানুষের ঐতিহ্যে কখনোই এই ধরনের শোভাযাত্রার অস্তিত্ব ছিল না। এই শোভাযাত্রার মধ্যে যেমন ঐতিহ্যের কোন সম্পর্ক নাই তেমনি এর অণুষঙ্গের সাথে আমাদের দেশীয় চিরাচরিত কোন ঐতিহ্যের দূরতম সম্পর্ক নাই। এই শোভাযাত্রায় মুখোশ পরি আমরা। আমদের দেশের তৃণমূল মানুষ মুখোশ পরা তো দূরে থাকুক অনেকে মুখোশ দেখেছেন কিনা সে নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। আমরা কিসের মুখোশ পরি, পেঁচার, ময়ূরের। আরো আছে ভাল্লুক, হনুমান, পেঁচা, অসুর, রাক্ষস-খোক্কস, ডাইনি, পেত্নি। এইগুলার সাথে আমাদের তৃণমূল গণমানুষের কি সম্পর্ক? নিদেন পক্ষে যদি দোয়েলের মুখোশ দেখতাম তাও ভাবতাম ঐতিহ্য না হলেও জাতীয় পাখি তো।

এবার আসি আমাদের এই উৎসবের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে। এই চরিত্র পুরোই প্রশ্নবিদ্ধ। আমি যখন একটা বিষয়কে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করব তখন সব সম্প্রদায়ের ও ধর্মের মানুষের কাছে তথা দেশের সকল নাগরিকের কাছে সেটা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মনে হতে হবে। আমার কাছে ধর্মনিরপেক্ষ তো আমার বিবেচনায় কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারনের কাছে যদি সেটার এরকম ধর্মনিপেক্ষ আবেদন না থাকে? এই দেশের নাগরিকদের একটা অংশ মোটেই অসাম্প্রদায়িক হিসেবে মানতে রাজি নন। এর মধ্যে তাঁরা একটা সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচরিত ধর্মীয় আচারের আচরনগুলি স্পষ্ট দেখতে পান। প্রকৃতই এগুলোর মাঝে এক সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় রীতিনীতি ও অর্চনার সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমনঃ প্যাঁচা, ময়ূর, ভাল্লুক, হনুমান, পেঁচা, অসুর, রাক্ষস-খোক্কস, ডাইনি, পেত্নি।

আমি যাকে ধর্মনিরপেক্ষ মনে করি সেটা যদি অন্যের কাছে সাম্প্রদায়িক মনে হয় তাহলে তো এর অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটাই থাকে না। ধরুন, আমি সবাইকে এক অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলাম আর এসে সবাই দেখলেন সেটা ওয়াজের মাহফিল কিংবা কীর্তনের অনুষ্ঠান তাহলে একে কি আপনারা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান বলবেন?
পহেলা বৈশাখের উৎসব মূলত শহুরে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে এই বলয়ের বাইরে বের হচ্ছে। রাজধানী থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিভাগীয় শহরে, জেলা-উপজেলায়। শেকড়ে চরিত্রটাতো এখানেই মার খায়। শেকড়ে ফেরার হলে তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তৃণমূলে বছরের পর পর আচরিত হয়ে একটা পোক্ত আসন নিয়ে নিজেই ধাববান থাকার কথা। তৃণমূল থেকে বিত্তবানের ড্রইং রুমে আসার কথা। তাহলে এখানে আমরা কোন শেকড়ে ফিরছি। নাকি ধার করা সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছি সাধারনের উপর। এই ধরনের বাস্তবতায় ইংরেজী নববর্ষ আর বাংলা নববর্ষের উৎসবের চরিত্রগত ও তাৎপর্যগত তফাত কোথায়? দুটোই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। দুটোতেই সরকারকে নিরাপত্ত বিধানে গলদগর্ম হতে হয়। দুটোতে মেয়েদের শ্লীলতাহানির, যৌণ নিপীড়নের উদাহরণ আছে।

আমরা যখন একটা অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বজনীন উৎসবের শুরু করব তখন সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের মতামতের মূল্য আমাদের দিতে হবে। আমি আমার মত করে গায়ের জোরে বলে দিব এটা অসাম্প্রদায়িক, এটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন, আর কেউ এটাকে যদি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে না মানে তো তাকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, বলে গালাগালি করব। তাদের মতপ্রকাশকে বলব অশনিসংকেত, অশুভশক্তি আর বৈশাখে তাদের নিপাত কামনা করব, তাহলে তো সেটা হবে একপেশে, প্রতিক্রিয়াশী এবং সভ্য নয় মোটেই বর্বর।

একটা সার্বজনীন উৎসব বা প্রথা সৃষ্টির জন্য সর্বজনের মতের মূল্য দিতে হবে। সে যদি আমার মতে বিরোধী হয় তার মূল্য দিতে হবে সর্বাধিক। তবেই না যুক্তি-তর্ক-বিতর্কের মাঝে সমাজের একটা প্রগতিশীল রূপ দাঁড় হবে। তা না হলে সেটা হবে একেবারেই ফ্যাসিবাদি। কেবল ফ্যাসিবাদই নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়।

আজকে মঙ্গল শোভাযাত্রা যাদের কাছে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং যারা এই প্রোগ্রামে শামিল হতে চায় না তাদেরকে তো এটা চাপিয়ে দিতে পারি না। একটা সাম্প্রদয়িক অনুষ্ঠান শুধু মাত্র অসাম্প্রদায়িক বললেই সেটা অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। এই রাষ্ট্রে যারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিশ্বাস করে আর যারা করে না, সকলেই এই রাষ্ট্রের নাগরিক এবং তাদের সবার টাকায় রাষ্ট্র চলে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ও অন্যান্য সরকারী বৈশাখী অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হয়। সুতরাং এই সব আয়োজনে তাই সকলের মতামত প্রতিফলনের দরকার আছে। আমার দেশে শুধু আমার মতই চলবে, আমার বিশ্বাস ও নীতে রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হবে বাকিদের কথা মানা যাবে না, আমার মত ও পথের বাইরে গেলেই সে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদি এই ধরনের চিন্তা ভাবনা চরম প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদী ভাবনা।

অন্যের উপর আমার মত চাপিয়ে দেয়ার অধিকার সংবিধান আমাকে দেয়নি। তাই সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব নির্মান করতে হলে প্রকৃত মুক্তমন নিয়ে যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে সকলের অংশগ্রহনমূলক বিনির্মান দরকার। নচেৎ এগুলো কেবলি ভান তৈরি করবে।

==============================
থার্ড আই ও ফকির আবদুল মালেক ভাইকে উৎসর্গীকৃত।

শূণ্য বিষণ্ণ

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,

গত কালের সন্ধ্যাটা আমার কিছুতেই কাটছিল না। কোন সন্ধ্যাই আমার কাটে না। প্রতিটি সন্ধ্যার গোধূলি বেলা আমার কাছে কেমন এক অজানা অক্ষরের বেদনা নিয়ে হাজির হয়। রাস্তার সোডিয়াম বাতির সাথে সাথে যখন সমস্ত বাড়ি ঘর আর বহুতল বিপনিবিতান গুলো রঙ-বেরঙের আলোয় ঝলমল করে উঠে আর শহরের কাক গুলো যখন কা কা করতে করতে দলবেঁধে ঘরে ফিরে আমার শুধু মনে হয় আমার কোথাও যাবার নেই। এতো আলো এত কথার ঝনাৎকারের মাঝে আমি দূর দিগন্তে দাঁড়িয়ে বৃক্ষ এক। কোন আড্ডা কিংবা রেস্তোঁরায় যাই না। একা একা এদিক সেদিক হেঁটে হেঁটে আর কাটছিল না সময়গুলো। কাল সন্ধ্যার পরেই তাই ট্রেনে চেপে বসলাম। সারারাত আমার একটুও ঘুম হয় নি। পাশের যাত্রীটি মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আমার গায়ের উপর এসে পড়ছিল। সারারাত নির্ঘুম আমি যেন একটু ক্লান্ত হইনি। বরং বিশ্বাস কর, বহুদিন পর আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। আমার মত নিতান্ত নির্জীব ঘরমুখো একটা জীবের পক্ষে এ যেন এক বিরাট ঘটনা। মনে আছে একবার তুমি আমাকে বলেছিলে,’’ তুমি কি কোন দিন আমাকে দেখতে আসবে!” আমার মত উদাসীন উজবুকের পক্ষে এ যে অভাবনীয় সে তুমিও টের পেয়েছিলে। অথচ দেখ সেই উজবুকই গতকাল সারারাত না ঘুমিয়ে তোমার দেশে হাজির হয়েছে। আমরা যখন ক্লাস শেষে একসাথে বাসায় ফিরতাম তুমি অনবরত কথা বলতে। তোমার এত গল্প ছিল আর এত সুন্দর তোমার বলা আমি কেবল শুনেই যেতাম। তাছাড়া এমনিতেই কথা বলি কম। গুছিয়ে কথা বলা শিখিনি কোন দিন। তাই তোমার কথাগুলো আমার কাছে যেন পুষ্প হয়ে ফুটত।

কাল যখন আর কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না, চেপে বসেছি মেইল ট্রেনে। মনে হচ্ছিল একদিন, শুধু এক সন্ধ্যায় যদি মুখোমুখি বসি। দরকার নেই নদীর ধার, কাশবন। দিগন্ত জোড়া কোন মাঠ, বটবৃক্ষ এসবও দরকার নেই কিছুতেই। শুধু একসন্ধ্যা, মুখোমুখি কোথাও। ফুটপাত, টং দোকান, আটপৌরে যেকোন জায়গায়।

সমস্ত বন বাদাড়, ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে সকাল বেলা নেমে সোজা তোমার ঠিকানায়। এসে দেখি আমার প্যারাডাইস লস্ট। তুমি নেই আর আগের ঠিকানায়।

কেন লিখি? – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কোনটাই না। কিন্তু মানিক বাবু এমন একজন যাকে নিয়ে জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ছাড়াও যেকোন দিন আলোচনা করা যায়। সব লিখকই লিখার জন্য ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেন। সেই তাগিদ থেকেই তাঁদের লিখা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন লিখতেন? তাঁর উত্তর তিনি দিয়েছেন কেন লিখি নামে এক প্রবন্ধে। ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে কেন লিখি শিরোনামে একটি সংকলন বের হয়েছিল। সেখানেই বের হয়েছিলে মানিকের এই প্রবন্ধ। ‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি।’ আমার প্রিয় লেখকদের একজন মানিক। তাঁর সৃষ্টি বিষ্ময় ঘোর নিয়ে আমি পড়ি। আজ তাই মানিকের সেই লেখাটি হাজির করলাম আপনাদের জন্য। বেশি বক বক না করে সরাসরি তাঁর কাছেই আপনাদের নিয়ে যাই।

কেন লিখি
–মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখক হবার ইচ্ছে সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হইনি। স্কুল জীবনের শেষের দিকে ইচ্ছেটা অল্পে অল্পে নিজের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে হাত মেলেছিল বহু দূরের ভবিষ্যতে – সঙ্গে সঙ্গে লেখবার তাগিদ যোগায়নি। অধিকাংশ স্কুল কলেজে হাতে লেখা মাসিকপত্র থাকে। সারা বাংলায় ছড়ানো গোটা দশেক স্কুলে আর মফস্বল ও কলকাতায় গোটা তিনেক কলেজে আমি পড়েছি। লিখবো? এই বয়স আমার। বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখবো? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়। বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে।

১৩৩৫ সালেও – যে বছর আমি প্রথম লেখা লিখি, – আমার এ মনোভাব বদলায়নি। বরং আরও স্পষ্ট একটা পরিকল্পনা হয়ে দাড়িয়েছে। বয়সের সীমা ঠিক করেছি। তিরিশ বছর বয়সের আগে কারো লেখা উচিত না – আমি সেই বয়সে লিখবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে সব দিক দিয়ে। কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নয়। নিশ্চিন্ত মনে যাতে সাহিত্য চর্চা করতে পারি তার বাস্তব ব্যবস্থাগুলোও ঠিক করে ফেলবো।

হ্যাঁ তখন আমার বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক পড়েছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? তখনও বিশ্বাস করিনি, আজও বিশ্বাস করি না যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ আছে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্বন্ধ এযুগের অতি প্রয়োজনীয় যুগধর্ম।

স্বীকার করছি, ১৩৩৫ সালে এসব তত্ত্বকথা মানতাম না – অস্পষ্ট অনুভূতি ছিল মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রেমের সঙ্গেই দৃঢ়তর হতো লেখার সঙ্কল্প। কলেজ থেকে তখনকার বালিকা-বালীগঞ্জের বাড়িতে ফিরতাম, আলোহীন পথহীন অসংস্কৃত জলার মতো লেকের ধারে গিয়ে বসতাম – চেনা অচেনা কোন একটি প্রিয়ার মুখ স্মরণ করে একটু চলতি কাব্যরস উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ভেসে আসতো নিজের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শীর মুখ, জীবনের অকারন জটিলতায় মুখের চামড়া যাদের কুচঁকে গিয়েছে। ভেসে আসতো স্টেশনে ও ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মুখ – তাদের আলাপ আলোচনা, ভেসে আসতো কলেজে সহপাঠীদের মুখ – শিক্ষার খাঁচায় পোরা তারুণ্য-সিংহের সব শিশু, প্রাণশক্তির অপচয়ের আনন্দে যারা মশগুল। তারপর ভেসে আসতো খালের ধারে, নদীর ধারে, বনের ধারে বসানো গ্রাম – চাষী, মাঝি, জেলে, তাঁতিদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখ। লেকের জনহীন স্তব্ধতা ধ্বনিত হতো ঝিঁঝির ডাকে, শেয়াল ডেকে পৃথিবীকে স্তব্ধতর করে দিতো, তারারা চোখ ঠারতো আকাশের হাজার ট্যারা চোখের মতো, কোনদিন উঠতো চাঁদ। আর ওই মুখগুলি – মধ্যবিত্ত আর চাষাভূষো – ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও।
আমি কি জানি ভাষা দিতে?…

…একদিন কলেজের কয়েকজন বন্ধু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছে। আলোচনা গড়াতে গড়াতে এসে ঠেকলো মাসিকপত্রের সম্পাদকের বুদ্ধিহীনতা, পক্ষপাতিত্ব, দলাদলি প্রবণতা ও উদাসীনতায়। বললাম, ‘কেন বাজে কথা বকছো? ভালো লেখা কি এত সস্তা যে, হাতে পেয়েও সম্পাদকেরা ফিরিয়ে দেবেন? মাসিকগুলি তো পড়ো, মাসে ক’টা ভালো গল্প বেরোয় দেখেছো? সম্পাদকেরা কি পাগল যে, ভালো গল্প ফিরিয়ে দিয়ে বাজে গল্প ছাপবে? ভালো দূরে থাক, চলনসই একটা গল্প পেলে সম্পাদকেরা নিশ্চয় সাগ্রহে ছেপে দেয়।’
অনেক কথা কাটাকাটির পর বাজি রাখা হলো।
বাজি হলো এই। আমি একটি গল্প লিখে তিন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ, প্রবাসী বা বিচিত্রায় ছাপিয়ে দেবো। যদি না পারি – সে কথা আর কেন?

আমি জানতাম পারবো। কোনদিন এক লাইন লিখিনি, কিন্তু গল্প তো পড়েছি অজস্র। সাহিত্য হবে না, সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সম্পাদক ভোলানো গল্প নিশ্চয় হবে। আমি কেন, যে কেউ চেষ্টা করলেই একরকম গল্প লিখতে পারে।
তখন মনে পড়লো পূর্ববঙ্গের এক স্বামী-স্ত্রীর কথা। বাস্তব জীবনে নাটকীয় প্রেমের চরম অভিজ্ঞতা ওদের দেখেই আমি পেয়েছিলাম। স্বামী বাশিঁ বাজাতেন। বাঁশের বাঁশি নয়, ক্ল্যারিওনেট। প্রায় পায়ে ধরে তাঁকে আসরে বাজাতে নিয়ে যেতে হতো – গিয়েও খুশি হলে বাজাতেন, নইলে বাজাতেন না। বাড়িতে বাজাতেন – স্ত্রীকে শ্রোতা রেখে। বছরখানেক আমি শুনেছিলাম। বেশিক্ষন বাজালে তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো।

এদের অবলম্বন করে এক ঘোরালো ট্র্যাজিক প্লট গড়ে তুলে গল্প লিখলাম। নাম দিলাম অতসী মামী। ভাবলাম, এই উচ্ছা্সময় গল্প, এই নিছক পাঠকের মন ভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেবো না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখবো, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু ক’জনকে জানিয়ে, গল্পে দিলাম ডাক নাম – মানিক। কল্পনাশক্তি একটা ভালো ছদ্মনামও খুঁজে পেলো না।
বাংলা মাসের মাঝামাঝি। বিচিত্রা আপিসে গিয়ে গল্পটা দিয়ে এলাম।

একদিন সকালে ভাবছি, কলেজে যাবো কি যাবো না। একজন ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন। আমার ‘অতসী মামী’ গল্পের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ নগদ টাকা হাতে তুলে দিয়ে দাবী জানালেন, আর একটি গল্প চাই।

তারপর সব ওলোট পালট হয়ে গেল। সব ছেড়ে দিয়ে আরম্ভ করলাম লেখা।
হঠাৎ একটা গল্প লিখে মাসিকে ছাপিয়ে কি কেউ লেখক হতে পারে? হাত মক্‌স করতে হয় – কঠিন সাধনায় জীবনপাত পরিশ্রমে মক্‌স করতে হয়। কেরানীর বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোট খাটো লেখকও লেখক হতে পারেননি। হঠাৎ কি কেউ লিখতে শেখে, না পারে? সাহিত্য সাধনার জিনিস। এ সাধনার সূত্রপাত কি ভাবে হয় অনেক সাহিত্যিকের জীবনে তার চমকপ্রদ উদাহরণ আছে। আজ সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রথম লেখা’ লিখবার কাহিনীতে তার একটা নমুনা পাবেন।

এখনো আত্মীয়স্বজন আপসোস করেন, ‘তোর দাদা লেখাপড়া শিখে দু’হাজার টাকার চাকরি করছে, তুই কি করলি বলতো, মানিক? – না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি – ‘আপনারা কি বলেন?…

চৈতী রাতে

চাঁদ উঠেছে গগণে গগণে
পথে পথে আলো চেয়ে গিয়েছে
সখির দেখা নয়নে নয়নে
দখিন সমীরনে এলায়িত কুন্তলে।।

মোর ভুবন ভরিয়া
কোন কোলাহল কি হরষে
থামিয়া থামিয়া জাগিছে
কোন কথা আসেনা অধরে
শুধু দেখা মুগ্ধ নয়নে।।

[ আমি কবি নই মোটেই। তবু মাঝে মাঝে এরকম এলেবেলে আঁকিবুঁকি করতে ইচ্ছে করে।]

সাইমন কমিশনের রিপোর্ট – কাজী নজরুল ইসলাম

সাইমন কমিশন বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটু্টরি কমিশন বা ভারতীয় সংবিধানিক কমিশন ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাতজন সদসবৃন্দের দ্বারা গঠিত কমিশন যারা ১৯২৭ সালে ভারতের সংবিধানিক পুনর্গঠন অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন। ভারতে ভারতীয় সমস্যাবলি অনুসন্ধান করে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশন ছিল সরকার ও বিরোধীদলীয় সাতজন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত একটি সংসদীয় কমিশন। সভাপতি স্যার জন সাইমনের নামানুসারে এ কমিশন সাইমন কমিশন নামে বেশি পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলাম সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নামে ব্যাঙ্গাত্বক একটি কবিতা লিখেন। সেই কবিতা শব্দনীড়ের ব্লগার, পাঠক ও ভিজিটরদের জন্য শেয়ার করলাম। কবিতাটি পড়ে সবাই আনন্দ পাবেন এবং সেই সময়ের ইতিহাসও আপনার মনে উঁকি দেবে।

সাইমন-কমিশনের রিপোর্ট
( প্রথম ভাগঃ ভারতের যাহা দেখিলেন )

কোরাস্– “কি দেখিতে এসে কি দেখিনু শেষে,
রিপোর্ট লেখেন সাইমন,—–
হুটোপুটি ক’রে ছুটোছুটি করে
বুড়োবুড়ী, কাজে নাই মন !

ম্যাদা’ দল আর উদোদল
পায়ে হস্ত বুলায় হর্দ্দম,
পুঁচকে দলের ফচ্ কে ছোঁড়ারা
ছিটাইছে বটে কর্দ্দম !
ত্যক্তের চেয়ে ভক্তই বেশী,
আহাহা ভক্ত বেঁচে থাক্ !
ছোলা ভাজা দেবো, কাঁচকলা দেবো,
নিশ্চয়ই মনে এঁচে রাখ্ ||
আসিয়া ভারতে সান্ কি লইয়া
আসিল ফকির ফোক্ রা,
পিছন হইতে ঠোক্ রায় টাকে
ডেঁপো গোটা কয় ছোক্ রা |
ছেলে যা দেখিনু, ছেলের চাইতে
পিলে বড়, অধিকন্তু—
বৃহত্তম ‘জু’ দেখিনু জীবনে—
প্রথম দু’পেয়ে জন্তু ||
মাথা নাই হেথা, নাই ক হৃদয়,
শুধু পেট আর পিঠ সার,
এত ‘পিঠে’ খেয়ে কেমনে হজম
করে, করে না কো চিৎকার !
ঠুঁটো হাত শুধু চিৎ ক’রে রাখে
শূন্যের পানে তুলিয়া,
বিপদে শ্রীপদ ভরসা, তাহাও
শ্লীপদে গিয়াছে ফুলিয়া ||
মাড়োয়ারী আর ‘মালোয়ারী’ জ্বর
এদের পরম মিত্র,
মরমরদেরে একেবারে মেরে
রাখিছে দেশ পবিত্র !
ইহাদের হরি বন্ধু মোদেরি
“গুড ওল্ড জেন্টল্ ম্যান্”
কুচুরি-পানায় ডোবা ও খানায়
এঁর কৃপা করে ‘ভ্যান্ ভ্যান্’ ||
এদেশের নারী বেজায় অনাড়ী,
পুরুষের হাতে তবলা,
তবলাতে চাঁটি মারিলে সে কাঁদে,
ইহারা কাঁদে না, অবলা !
জরীসাড়ি-মোড়া চকলেট ওরা
বন্দী হেরেম-বাক্সে,
বাহির করিলে খেয়ে নেবে কেউ
কাজেই বাক্সে থাক্ সে ||
ইস্ কুলে, প্রেমে, জ্বরে পড়ে পড়ে
জীবন কাটায় ছেলেরা ;
মাঝে মাঝে করে ভ্রান্ত শিষ্ট
শান্তে লেনিন ভেলেরা |
চোখের চাইতে চশমাই বেশী,
ভাগ্যিস্ ওরা অন্ধ,
নৈলে কখন টানিয়া ধরিত
আমাদের গলা-বন্ধ ||
আমাদের দেখাদেখি কেহ কেহ
করিছে ক্লাবের মেম্-বার,
স্কার্ট্ পরে চাষারা, বাবুরা
বিবি লয়ে যায় চেম্বার !
বিলিতি দাওয়াই ধরিতেছে ক্রমে,
আর বাকী নাই বেশী দিন,
গুড্ বয় হয়ে গিলিছে আফিম,
হুইস্কি, ব্রান্ডি, কুইনিন্ ||
কাফ্রি চেহারা, ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে ;
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা
অস্ত্র-আইন বাঁচাতে !
চাচা-ভাইপোতে মিল নাই সেথা
আড়াআড়ি টিকি দাড়িতে,
যুদ্ধ বাধাই উহাদেরি দিয়ে,
ধরিয়া আনাই ফাঁড়িতে ||
উহাদের মতো কেলে রং সব
গাছপালা জল আকাশের,
উহাদের গাই মোদেরি গাই-এর
মতো সাদা দুধ দেয় ফের |
কালো চামড়ার ভিতরে ওদের
আমাদেরি মত রক্ত,
এ যদি না হ’ত —-শাশ্বত হ’ত
ও-দেশে মোদের তক্ত !

( দ্বিতীয় ভাগ / ভারতকে যাহা দেখাইলেন )

কোরাস্– “ যীশুখ্রীষ্টের নাই সে ইচ্ছে,
কি করিব বল আমরা |
চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি
ভারতে বিলিতি আম্ ড়া ||

চামড়া ওদের আমাদের মতো
কিছুতেই নহে হইবার !
হোয়াইট্-ওয়াশ যা করিয়াছি—তাই
দেখিতেছি নহে রইবার !
আমাদের মত যারা নয় তারা
অমনি র’বে কি ক’রে বল্,
সাদাদের মত কালা অসভ্য
হইবে স্বাধীন ? হরিবল্ !
আঁঠি ত চামড়া বিলিতি আমড়া মন্টেগু দিল চুষিতে,
শাঁস নাই ব’লে কাঁদিল, দিলাম
বিলিতি কুমড়ো তুষিতে |
তাহাতেও যারা খুশী নয়, এত
ভুষি খেয়ে ভরে নাকো পেট,
ঘুষি বরাদ্দ তাহাদের তরে,
ঝুটি ধরে কর মাথা হেঁট ||
পুলিশের লাঠি আরো বড়ো হোক,
আরো যেন তাতে থাকে গিঁঠ,
হস্তেরে ফেল অস্ত্র-আইনে,
ঘর হ’তে তোলা হোক ইঁট
কাগজের শুধু হইয়াছে নোট,
কাগজের হোক রুটিও,
মাথা কেটে দাও, কেটে দাও হাত
থাকে নাকো যেন টুঁটিও ||
যতটুকু দড়ি ছাড়িয়াছে , তাহা
গুটাইয়া লও পুনরায়,
একবার যদি বেড়া ভাঙে, তবে
আর্ বার ধরা হবে দায় !
আরো প্রশস্ত ক’রে দাও পিঠ
ধুর্ম্মুস-পেটা করিয়া,
টিকি ও দাড়ির চায় কর, লহ
নখর দন্ত হরিয়া ||
ও দেশের জলে ম্যালেরিয়া-বিষ ,
উহারা বিলিতি-জল খাক্ |
খেতে দাও তা’দেরে , ওদের
চ্যাঁচায় যে একদল কাক !
পা কেটে ওদের ঠেকো করে দাও,
উহাদের সাথে ছুটিতে,
হার মেনে যায় এরোপ্লেন, পায়ে
গুলি পারে নাকো ফুটিতে ||
শিরীঞ্জ্ লইয়া আরো ফাঁপাইয়া
দাও প্লীহা আর যকৃৎ !
ঢাক কিনে দাও হিঁদুরে ,
মুসলমানে বল, কর বক্ রিদ |
ভাতে নাই কিছু ভিটামিন, ওতে
মদ হোক, ওরা খাক ফেন,
এ স্বাস্থ্যে ভাত বড় ক্ষতিকর,
খুব জোর দুটো শাক দেন ||
অতিশয় বেশী কথা ক’য়ে ক’য়ে
বাড়াতেছে প্যাল্ পিটেশন,
গ্যাস্ পরাইতে কর সশস্ত্র
ডাক্তারে ইন্ ভিটেশন |
মা ভগবতীর সার উহাদের
ব্রেনে আরো দাও পুরিয়া,
যদি থাকে মেরুদন্ড কারুর
দাও তা ভাঙিয়া চুরিয়া ||
বোমা মেরে মেরে পায় নাকো খুঁজে
আজও উদরে ‘ক’ অক্ষর,
এ মেষ কেমনে সভ্য ষাঁড়ের
সহিত হানিবে টক্কর ?
পায়ে ও গলায় ছাড়া ইহাদের
কোনো সে অঙ্গে বল নাই,
ব্যারাম মাফিক ওষুধ দিলাম,
দিলাম কিন্তু ফল নাই ||

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া।

আরো একটা সত্য গল্পের বয়ান

শহীদ বুলু খান শহীদ হওয়ার পর বহুবছর পার হয়ে গেছে। তিনি যে শহীদ হয়েছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক করার কোন অবকাশ নাই। যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে। তাঁর শাহাদাতের পরে তৈয়ার হয় শহীদ বুলু খান মহিলা কলেজ। আরো আছে শহীদ বুলু স্মৃতি সংসদ। স্মৃতি সংসদ প্রতি বছর শহীদ বুলু স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। বিশাল জাঁকঝমকের আয়োজন। শহীদ বুলুর নামে প্রতি বছর টুর্নামেন্টে গোল্ড কাপ দেয়া হয়।

দেশে ভদ্রলোকের সংখ্যা অতি নগণ্য। কিন্তু নিন্দুকের সংখ্যা অতিরিক্ত। নিন্দুকেরা বলে বুলু খান শহীদ হননি চরের জমি দখল করতে গিয়ে মারা গেছেন। চরের ভূমিহীন লোকজন একদিন তাঁকে একলা পেয়ে মেরে বস্তায় ভরে নদীতে চুবিয়ে রাখে। পরে সেই বস্তাও আর নাকি পাওয়া যায়নি। তাই বুলু খানের কোন মাজার করা সম্ভব হয়নি। কলেজ আর স্মৃতি সংসদ সেই অভাব কিঞ্চিত পরিমানে হলেও পূরনে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বুলু খান মরার পরে নাকি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল হারু শেখ। সে সেদিন বাড়ির বড় সাইজের মোরগটি জবাই করে খেয়েছিল, আনন্দে। কারণ এর পূর্বে সে একসপ্তাহ না খেয়ে ছিল। খান সাহেব হারু শেখকে বলেছিল তালগাছ তলের জমিটা তাঁকে লিখে দিতে। টাকা পয়সা নিয়ে খামাখা চিন্তা করতেও নিষেধ করেছিলেন। কারণ তিনি বেইনসাফী নন, তাঁর ইনসাফ আছে। খান সাহেবের মুখের উপর না করা শেখের পো’র পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এ বছর হারু শেখের জমিতে ফসল ফলে দারুন। যাকে বলে বাম্পার ফলন। ফসল চুরির ভয়ে রাত্রি বেলা তাঁবু খাটিয়ে ক্ষেতের পাশে পাহারা দেয় শেখের পো। আধাআধি রাত্রির সময়ে হারুর গা চমচম করে উঠে। দেখে তালগাছের আগা থেকে কে যেন লম্বা লম্বা পা ফেলে নেমে আসছে তার তাঁবুর দিকেই। কাছে আসতেই সে পরিষ্কার চিনতে পারে খান সাহেব। হাতে কাগজ-কলম। বললেন, “হারু, তোরে কইছিলাম, জমিটা দিয়া দে। আমার বড় মায়া লাগেরে হারু জমিটার জন্য। ফলন হইছে দারুন। আমি কাগজ কলম নিয়া আসছি। তুই খালি লেইখা দে।”

বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকে হারু। পরদিন লোকে দেখল হারুর নাকের ফুটোতে পিঁপড়ারা বাসা করেছে।

জমে উঠুক আমাদের শব্দনীড়

আমাদের অনেক আবেগ ও ভালবাসার নাম শব্দনীড়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শব্দনীড় আবার সচল হয়েছে। জেগে উঠছেন ব্লগাররা। দেখে আনন্দ হয়। আমাদের শব্দনীড়কে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের পদচারনায় সচল থাকবে শব্দনীড়। পুরনো অনেক ব্লগারর ফিরে এসেছেন। নিয়মিত পোস্ট দিচ্ছেন। টুকটাক মন্তব্যও করছেন। সবার মাথায় ছাতা নিয়ে আগের মতই আছেন আমাদের প্রিয় আজাদ কাশ্মীর জামান ভাই – মুরুব্বী।

বাংলাভাষায় যে ক’টি ব্লগ আছে তাদের সর্বশীর্ষে শব্দনীড়ে অবস্থান না হলেও শীর্ষদের মাঝে অন্যতম। আমার হিসেবে ব্লগার, ভিজিটর ও পাঠকের সংখ্যা বিবেচনায় আমরা প্রথম না হলেও দ্বিতীয় অবস্থানে আছি। বর্তমানে বেশিরভাগ বাংলা ব্লগের অবস্থা নিভু নিভু।

ব্লগ মত প্রকাশের পরীশিলিত মাধ্যম, সহজ মাধ্যম। নিজের মতামত অতি দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ায় অনন্য। এই মাধ্যম কাজে লাগানোর কিছু তরিকা আছে। এটা পারস্পরিক মাধ্যম। আমি বলব সবই, কিন্তু কিছুই শুনব না। এই নীতি এখানে অচল। এই জায়গাতেই আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা লিখছি খুবই কিন্তু অন্যদের লেখায় যাচ্ছি না। মন্তব্য করছি না। কিন্তু মন্তব্য প্রতি মন্তব্য না আসলে ব্লগ জমে না। ব্লগারদের মাঝে বন্ধুত্ব তৈয়ার হয় না। আমি অনেকের খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছি শুধু এই ব্লগের মাধ্যমেই।

দেখা যায় অনেক নতুন ব্লগার আছেন তাঁরাও মন্তব্য করছেন না। হয়ত বা তাঁরা ধরে নিয়েছেন মন্তব্য না করলেই চলে। কিন্তু মন্তব্য না করলে জনপ্রিয় ব্লগার হওয়া যায় না। মন্তব্য কম হওয়ার আরেকটি কারন বোধহয় এটা, শব্দনীড়ে কবিতা আসে বেশি। কবিতায় হয়ত ভাল লাগা মন্দলাগা ছাড়া মত প্রকাশের সুযোগ খুব একটা থাকে না। কিন্তু গদ্যেও দেখি তেমন মন্তব্য নাই।

তাই সকলে মিলে আসুন ব্লগটাকে জাগিয়ে তুলি, আলাপ আলোচনায় জমিয়ে রাখি।