নাজমুন এর সকল পোস্ট

দেশ বিদেশ (জার্নাল – ডায়েরী )

১২.
নেডা – নামে যে ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন – ভদ্রমহিলার বয়েস মিনিমাম ৭৫ হবে। ছয় ফিট লম্বা প্রায় -স্লিম। শরীর শক্ত পোক্ত হলেও প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু খুব উদ্যমী। ওরা এন্থোয়াসিয়াসটিক শব্দটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। কাজ যাই করা হোক কাজ সেটা কাজই। শতভাগ এফোর্ট এতে দিতেই হবে। নইলে যে কাজ কাজই করা হোক না কেন সে কাজ সে বেশি দিন কন্টিনিউ করতে পারবেনা। তার মানে হলো কাজে এতোটুকু খুঁত থাকলে চাকরী থাকবে না।

আট ঘন্টা চাকরীর টাইম হলে আট ঘন্টার মাঝখানে আধা ঘন্টা ব্রেক এবং বাকী সাড়ে সাত ঘন্টা তাকে কাজ করতে হবে। এইসময় কোনো বিরাম নেই। ইন্টারভিউতে তাই জিজ্ঞেস করা হয় তার ভারী কাজ করতে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কিনা বা ফিজিকাল কোনো সমস্যা আছে কিনা সেটাও জেনে নেয়া হয়। তাই প্রতিটা জবের পাশে এই উদ্যম শব্দটা খুবই আবশ্যিক ভাবে থাকে।

উনি লেকচারের মাঝখানে প্রায় নিজের ফ্যামিলি, ছেলেমেয়ের গল্প করেন। তার মেয়ে আইটি প্রফেশনাল। কথায় কথায় এখানে ধনী, গরীব এবং মধ্যবিত্তের একটা ফারাকের কথা বলেন। ধনীদের এটা সেটা, মধ্যবিত্তের এই প্রবলেম সেই প্রবলেম ইত্যাদি। গর্বের সাথে জানালেন ওনার মেয়েকে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কলেজে পড়াননি। সরকারী স্কুল কলেজে আর দশজনের মতো পড়িয়েছেন। বুঝলাম যে এখানেও বাংলাদেশের মতো ধনী গরীবের স্কুল আছে। কিন্তু ধনীর স্কুল কেমন গরীবের স্কুল কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রতিটা স্কুলের সামনেই বড় মাঠ আছে। ঘন সবুজ সে মাঠ দেখলে আপনাতেই মন ভালো হয়ে যায়। মাঠে বাচ্চারা হইচই করে খেলে। ফুলের মতো বাচ্চাদের এই আনন্দ দেখতে ভালোই লাগে।

প্রতিদিন ঘর থেকে বেরুলে মুল অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতেও বেশী চোখে পড়ে আরবদের। মাঝে মাঝে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যে আছি। এখানে আরবী ভাষা জানলে চাকরি কনফার্ম। বড় ছোট সব চাকুরীর বেতন একই। তবে অড জবে সেলারী সবচাইতে বেশি। নীচে একটা ক্লিনার জবের বিজ্ঞপ্তি দেখলে বোঝা যাবে ক্লিনার হতেও এদেশে যোগ্যতা লাগে।

সেখানেও অভিজ্ঞতা তো লাগেই আবার ইংলিশ ফ্লুয়েন্ট স্পিকার হতে হবে।
Cleaner – Full time
SEGS
Waterloo NSW
Apply Now
$22 – $30 an hour
Part-time, Temporary, Contract, Commission, Volunteer, Casual, Subcontract, Permanent.

We are looking for someone who can immediate start. We are seeking a Cleaner with C1 EXPERIENCE in the Sydney Metropolitan area.
Applicants MUST
– Have at least 2 YEARS cleaning experience and 1 YEAR C1 experience
– Must have good personal hygiene
– Punctual and reliable
– Attention to detail
– Must be fluent in English
Duties include
– Cleaning floors with Paroling, Scrubber, cleaning toilets, windows and other duties
– Experience using scrubbing machines highly desirable
– Following a daily schedule
– Training and inducting cleaner/s
– Insuring site is to standard
– Liaising with Management
– Rectifying issues on site

অস্ট্রেলিয়া গড়ে উঠেছিলো কয়েদিদের দিয়ে। আঠারো শতকে লন্ডনের একদল অপরাধী যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলো, দেশের কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এই নির্জন এলাকায় এবং সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছিল এখানেই এই নতুন জায়গায় তাদের নিজেদের উদ্যেগেই বসতি তৈরী করতে হবে। তখন ছিলো এখানে শুধু অস্ট্রেলিয়ান কিছু আদিবাসী। স্বাভাবিক ভাবেই অবরিজিন এবং এই নতুন বসতি স্থাপনকারী কয়েদিদের সাথে বিরোধ হলেও অবশেষে কয়েদিরা মিলেই যে রাষ্ট্র তৈরী করে সেটি অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু খুব অল্প সময়েই এতো চমৎকার উন্নত এবং সমৃদ্ধশালী দেশে কিভাবে পরিণত হলো সে বিষ্ময়।

এখনো অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র ২৫ মিলিয়ন (আনুমানিক) মানুষ এবং যেহেতু এখনো অস্ট্রেলিয়ায় নিজেরা খুব বেশী সংখ্যক না তাই এখানে ভিন দেশীয়দের স্কিল মাইগ্রেশন এবং বিভিন্ন ভাবে মাইগ্রেশন দেয়া হয়। স্টুডেন্ট হয়ে একবার আসতে পারলে এবং রেজাল্ট ভালো করলে সিটিজেনশিপ পাওয়াটা কঠিন না। আবার রিফিউজিদের আশ্রয় দিচ্ছে এই দেশ। রিফিউজিদের সুন্দর বাসা দেয়া হয়, প্রতি সপ্তাহে সেন্ট্রাল লিঙ্ক থেকেও ভালো একটা এমাউন্ট দেয়া হয়। তাই সিরিয়ান রিফ্যুজিদের এখানে অভায়রণ্য, রোহিংগা প্রচুর। একসময় রোহিঙ্গারা এখানে বোটে করে এসেছে। এখন অবশ্য আর সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। তবে যারা এসেছে তারা বেশ ভালো আছে। তাদের দুই বেডরুমের বাসা, টিভি সহ দেয়া হয় প্লাস প্রতি সপ্তাহে তাদের চলার মতো টাকা তো দেয়াই হয় এবং ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ফ্রী। এবং তাদের ভরনপোষনের জন্যেও একটা এমাউন্ট দেয়া হয়। এটা অনন্তকাল দেয়া হবে না।সেজন্য সরকার তাদের ফ্রী ইংলিশ কোর্স অফার করে এবং এরপরে চাকরি পেলে সেন্ট্রাল লিংকের টাকা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ওরা সেন্ট্রাল লিংকের টাকা নেয় এবং ক্যাশ জব করে। ক্যাশ জব করলে সেটা ব্যাংকে যাবে না ফলে সে সেন্ট্রাল লিংকের টাকাও পেতে থাকবে আর ক্যাশেও ইনকাম করতে থাকবে। এই কাজটা রোহিংগারাই বেশী করে।

এখানে আছে প্রচুর লেবানিজ। পাঞ্চবোল, লাকেম্বা, ব্যাঙ্কসটাউন ওয়েলিপার্কে প্রচুর লেবানিজ। লেবানিজদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের কারণে তাদের নিজেদের কম্যুনিটির লোকদের জব পাওয়াটা অনেকটাই সহজ। তবে তারা এখানে এসে পড়াশোনা করছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও সব সিস্টেমেই তারা পড়ছে। বিত্তশালী হয়েছে। পাঞ্চবোল লাকেম্বা, ব্যাঙ্কসটাউন সাবার্বে লেবানিজদের ব্যবসা বাণিজ্যের স্বর্গরাজ্য। তবে আরবদের অধিক বিয়ে এবং প্রচুর সন্তান নেয়ার বিষয়টা যেনো অনেকটা ইনভেস্টের মত। প্রতি বাচ্চার জন্য সেন্টার লিঙ্ক থেকে প্রতি সপ্তাহে একটা ভালো এমাউন্ট পাওয়া যায়। সব পাওয়ার পরেও হতাশা, যন্ত্রনা থাকে।

আমার এক সিরিয়ান মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো। খুব সরল মেয়েটা জানালো সে তিনবার সুসাইডের এটেম্পট নিয়েছিল। কিন্তু তিনবারই বিফল হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম এতো মরতে চায় কেন সে ?
প্রেম আছে নাকি ? সে জানালো প্রেম না। সংসারে অশান্তি তাদের। ওরা নয় ভাইবোন। বড় তিন ভাই বিয়ে করেছে। তাদের বউ বাচ্চা মিলে বড় সংসার। যদিও দুই ভাই তাদের সাথে থাকে না। কিন্তু বাকী ভাইবোন তো আছে। সে বলে যে এতো বড় পরিবার। প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক সংসারে। ওর বোন একজন ডিভোর্সড। জিজ্ঞেস করলাম কি সমস্যা ? সে উত্তর করলো ওর হাজব্যান্ড গায়ে হাত তোলে। অত্যাচারের মাত্রা বেশী হলে সে ডিভোর্স দিয়ে চলে এসেছে। সিরিয়ান এই মেয়েটার নাম শাইমা। ওর বোনের নাম ইসরা ইয়াতিম। শাইমা বললো – জানো আমাদের আরব পুরুষরা খুব এরোগেন্ট। কথায় কথায় গায়ে হাত তুলে। বললাম তোমার কি ইচ্ছে আছে ভিন্ন কমিউনিটিতে বিয়ে করার ? সে জানালো না সে ইচ্ছে নেই।

আমাদের ক্লাসে আছে এক কোরিয়ান মেয়ে। ওর নাম জেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার দেশ কোথায় – সে এমনভাবে কোরিয়া শব্দটাকে বললো আমি শুনলাম ক্রিয়া – ওরে বার বার জিজ্ঞেস করলেও সে একই ভাবে ক্রিয়া বলল। মনে মনে এই ক্রিয়া দেশ কোথায় আছে সেটা ভাবছিলাম। এরপর বললো সে এসেছে তার পার্টনারের কাছে। তার পার্টনারও কোরিয়ান। কিন্তু সে তার মা-বাবার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় আগেই মাইগ্রেন্ট হয়ে এসেছে। ফেসবুকে প্রেম হয়েছে তার সাথে। সেই এপ্লাই করে তাকে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীকে আনার যে প্রক্রিয়া একই প্রক্রিয়া পার্টনার আনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সে তার পার্টনারের বাসায় পার্টনারের মা-বাবার সাথে থাকে। পার্টনারের মায়ের আবার আগের হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখনের হাজব্যান্ড তার চাইতে দশ বছরের ছোট এবং আগের ঘরের ছেলে পরের ঘরের আর একটা মেয়ে, ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং স্বামী সহ চমৎকারভাবে মিলে মিশে আছেন।

জেনিকে জিজ্ঞস করলাম ‘জেনি এই যে তুমি এখানে চলে এসেছ তোমার বাবা মা কি টেনশন করেন অথবা তোমার কোনো খরচ পাঠান না ? সে বললো – নো, নেভার – আই এম ওল্ড। আর একদিন জেনিকে জিজ্ঞেস করলাম – জেনি তুমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবে ? সে উত্তর করলো – নো –
কেন জিজ্ঞেস করলে সে বললো – নো মিন্স নো –
আমি চুপ করে গেলাম – বাংলাদেশের কাদামাটি লেগে আছে গায়ে – ভাবনার চেঞ্জ আনতে হবে ভাবছিলাম।

১৩
আজ ট্রেনে সামনে বসলো চরম সুন্দরী এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। অবশ্য ওরা অনেকেই ভীষন সুন্দর। লালচে সোনালী চুলের মিশেলে মেয়েটার হাত পা সবকিছু এতো সুন্দর। চোখে পড়েছে সিলভার কালারের চশমা। ওর ওভারকোট, ব্যাগের রং জুতোর রং সব এক। আমি ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছি আর ভাবছি ওর মা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী। আশ্চর্য যে, ওর পাশেই বসেছে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে। সাথে ওর বাচ্চা। দুজনই এতো কালো যে কালোর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

ওরা দুজন পাশাপাশি বসাতে আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ওদের দুজনের মনের মধ্যেকার ভাবনা চিন্তা না জানি কেমন ! রং যাই হোক মানুষের ভেতরে তো রক্ত একই রকম। একই রকম অরগান শরীরে। আমি এখানে কোনো কালো মেয়েকে খুব উচ্ছ্বল হয়ে হাসতে দেখিনি। খুব যেন মন খারাপ। কারো দিকে তাকায় না। শুধু নিজস্ব ঘরানার মানুষজনের সাথেই কথা বলে। আচ্ছা ওরা হাসে না কেন ? ওরা কি অন্যদের মনের ভাষা বোঝে ? হয়তো আমার ধারনা ভুলও হতে পারে।

মানুষ তো আসলেও রেসিস্ট। রেসিসিজম থেকে মুক্তি নেই। আমি কালো মেয়ের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর বয়েস মাত্র একবছর বা তার বেশি কিছু হতে পারে। আশ্চর্য এটুকু বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। নিশ্চয়ই এই ছেলে জিনিয়াস হবে। মানুষের চোখের ভাষা মনের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তো বড়দেরই হয় না। আর শিশু !!

আর একদিন ট্রেনে বসেছি অপেরা হাউস যাবো। আমাদের পেছনে বসেছে এক জাপানী / চাইনিজ মেয়ে (জাপানী, চাইনিজ, ফিলিপিনি, ইন্দোনেশিয়ান, ভিয়েতনাম সবার চেহারা প্রায় একই রকম)।
মোটা সোটা ফরসা চেহেরার মেয়েটা ফোনে অনবরত কথা বলছিল তার নিজের ভাষায়। শব্দগুলো অচেনা হলে শুধু যেনো শব্দই হয়। তাৎপর্য নেই কোনো শব্দের। সমস্যা সেটা নয়। কিন্তু সে কথার মাঝখানে তিনবার মিয়াও মিয়াও বললো। আবার কয়েকটা শব্দের পরেও সে মিয়াও মিয়াও করলো।
মিয়াও মানে কি -তার ভাষায় কে জানে !
সেদিন নেভিটাসে আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে লিসেনিং শোনানো হলে এক আরব মেয়েকে রেচেল জিজ্ঞেস করলেন বলতে পারো সে কি বলেছে ? ওয়াও ওয়াও ছাড়া তো কিছু বুঝলাম না – মেয়েটা উত্তর করলো –
ক্লাস ভর্তি হাসির ফোয়ারায় দুলে উঠলো রুম –
নেভিটাসের শিক্ষক বললেন প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেন্টরা যখন আসে এই সময়টা হলো হানিমুন পিরিয়ড। হানিমুন পিরিয়ডে কোনো টেনশন থাকে না। আনন্দের ঘোরে সময় যায়। কিন্তু জবে ঢোকার পরে ব্যস্ত হলে তখন হানিমুন পিরিয়ড কেটে যায় – টানা আট ঘন্টা কাজের সময়টা খুবই কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। সে সময় হানিমুনকাল স্বপ্নই মনে হয়। হয়তো ওনার কথাই সত্যি।
আমি জীবনকে ভ্রমন মনে করি সে সুখে যাক আর দুঃখেই যাক। জীবনের এই জার্নিকে এঞ্জয় করি –
“লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল”

১৪
মিশেল আমাদের সুইম ইন্সট্রাকটর। আবার একই সাথে নেভিটাসের ল্যাংগুয়েজ শিক্ষক। অত্যন্ত হাসিখুসী মিশেল খুব বন্ধুবৎসল এবং স্টুডেন্টদের প্রিয় শিক্ষক। শেখানোর প্রতিটা ক্ষেত্রে সে খুব সিরিয়াস এবং ধৈর্যশীল। আমি সাঁতারের ক্ষেত্রে একটু হুড়োহুড়ি করি। মিশেল আমাকে বলে শুনো তুমি হাত মুভ করবে স্লোলি – ভেরি স্লো। ডোন্ট হারি।
আমাদের সাথে প্রচুর আরব মেয়ে আছে। ওরা তাড়াতাড়ি শব্দটাকে বলে ইয়াল্লা – আমরা যখন সাঁতারের জন্য সবাই একসাথে রওনা দিলে মিশেল হাসতে হাসতে বলে – হেই গাইজ – ইয়াল্লা – লেটস মুভ –
সুইমিং পুলে যাবার আগে ক্লাসে কিছুক্ষণ সাঁতার সম্পর্কিত বেশ কিছু ধারণা দেয় মিশেল। সাঁতার শেখা হবে বলে সরাসরি সুইমিং পুলে নেয়া হয় না। মিশেলকে বলতে ইচ্ছে করে মিশেল ক্লাসে সাঁতার না শিখলে কি হয় ?কিন্তু মিশেল নাছোরবান্দা। সে ক্লাসেই অর্ধেক সাঁতার শিখিয়ে ছাড়বে। কিন্তু সুইমিংপুলে যখন সাঁতার শিখতে গেলাম তখন বুঝলাম এই ক্লাসে প্রাথমিক লেসনটাও দরকার আছে আসলে।

সে যাই হোক ল্যাপটপে সাঁতার সম্পর্কিত বিভিন্ন টপিক দেখছিলাম। সেখানে কুইজ, সাঁতারের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি লেখালেখি করছিলাম। আমি মিশেলকে ডেকে বললাম মিশেল আমি পরের মডিউলে যেতে পারছিনা। তুমি কি একটু হেল্প করবে ? মিশেল আমার পাশে চেয়ার না থাকাতে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে আমাকে দেখিয়ে দিলো। এখানের শিক্ষকদের এই উদার মানবিক বন্ধুসুলভ দিকটা আমাকে খুব আপ্লুত করে। শিক্ষকরা ছাত্র/ছাত্রীদের সাথে এতোটাই বন্ধুসুলভ যে কে উপরে বসলো কে নীচে বসলো তাতে শিক্ষকের সম্মান হানি হয়ে গেলো অথবা ছাত্র শিক্ষকের দূরত্ব কতটুকু থাকা উচিত কতটুকু থাকা উচিত না সেটা নিয়ে টেনশন থাকার চাইতেও যে বিষয়টাতে গুরুত্ব দেয়া হয় সে হলো স্টুডেন্ট আসলে কতটুকু শিখলো। ভিকারুননেসা নুন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রর জন্য দুঃখ হল। আহা এইসব দেশে থাকলে এইরকম তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যেত না।

আমাদের ভাতিজা হাবিব খান আর তার স্ত্রী জোহরা ক্যনবেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারা ক্যানবেরাতেই থাকে।ওদের ছেলের নাম হিলমি। সে এখানে একটি সরকারী স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। মজার কথা হলো স্কুলে কোনো পরীক্ষা নেই। বিভিন্ন রকমের ক্লাস টেস্ট হয়। সে টেস্টের মার্ক একে অন্যেরটা দেখবে না। কেন প্রশ্ন করা হলে জানা গেলো এতে যে কম নাম্বার পেয়েছে তার মন খারাপ হবে।

বাচ্চারা যা পড়াশোনা করবে সবটাই স্কুলে। বাসায় কোনো পড়াশোনা নেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা নিয়ে চাপ নেই। বাচ্চারা তাই বাসায় পড়েই না। আমার মনে পড়লো দেশের বাচ্চাদের কথা। এই সময় বাচ্চারা স্কুলে তো পড়েই। বাসায় এসে আবার তিন থেকে চারজন শিক্ষকের কাছে পড়ে। নইলে কোচিং করে। মা বাবা বাচ্চা সবাই শুধু পড়াশোনা আর স্কুল নিয়ে হয়রান। কিসের খেলাধুলা কিসের কি। তার উপর তাদের জন্য খেলার মাঠ নেই। ওরা জন্ম থেকেই হচ্ছে রোবট। সেই বাচ্চারাই বড় হচ্ছে নানান ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে। সত্যিই দুঃখ হয় আমাদের দেশের বাচ্চাদের জন্য। আমাদের শিশুদের জন্য সত্যিকার শৈশব দেয়া আদৌ কি সম্ভব হবে? কে জানে ?

জারুলতলার রোমান্টিক কবি ময়ুখ চৌধুরী

সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি ? কেনো মানুষ অযথা সাহিত্যের চর্চা করে ? এতে তো জাগতিক লাভ কমই হয় তবু মানুষ কেনো সাহিত্য সাহিত্য করে এক অদৃশ্য আনন্দঘন জগতে ঘুরে বেড়ায় ? এই কুহক জগতে ঘুরে ঘুরে মানুষ সাহিত্য নামক শিল্পের চর্চা করে। মনের খোরাক যোগায়। কবিতা নামক এক আলো আঁধারী পথে পা বাড়ায়।
সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতাই মানব মনের সর্বাধুনিক শিল্পরূপ সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। কবিতার মোহময় পথে বিচরণ করে কবি অকবি সকলে। যেহেতু সকল মানুষের ভেতরেই একজন কবি বাস করে যে সন্ধ্যায় মায়াময় চাঁদ দেখে অভিভুত হয়। ‘নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাত দেখি কাল, ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল (আল মাহমুদ)
এমন বাক্য রচনা করে বুঝিয়ে দেন মানুষ শুধু মানুষ নন তিনি সৃষ্টিশীল তিনি কবি।
কবিতা তো সহজে কথা বলে না। সে নারীর মতই লাজুক, রহস্যময়ী। নানাভাবে, নানা বর্ণে সে নিজেকে প্রকাশ করে। আজকের বাংলাদেশের আধুনিক কবি ময়ুখ চৌধুরীর বিচরণ ক্ষেত্র কাব্যজগতের সেই চিররহস্যময় পথ। বর্তমান আধুনিক সাহিত্যের জগতে ময়ুখ চৌধুরী (জন্ম – ১৯৫০) কাব্য সুষমায় সমর্পিত প্রতীত পুরুষ। বিশ শতকের নব্বই এর দশকের কবির কবিতায়” কিন্তু তিনি গেল শতকের ৭০ দশকের কবি। অর্থাৎ উনবিংশ শতকের ৭০ এর কবি। তার শরীর মন বুদ্ধির সমন্বয়ে পূর্ণ। কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন – শিক্ষকতা আমার পায়ের তলার মাটি, কবিতা আমার অথিষ্ট নীলিমা, নিঃশ্বাসের বায়ুমন্ডল, একটি জীবিকা অন্যটি জীবন।

কাব্যচর্চায় কবি ময়ুখ চৌধুরী কাউকে গুরু মানেননি। তার কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় কাব্যিক দ্যোতনা পৃথক মন্ত্রনা দান করে। কবিতার কাব্যরস আস্বাদনে পাঠকের মর্মমূল নাড়িয়ে দেয়। যেমন – একমাত্র তুমিই দেখতে পেলে / তোমার শিক্ষিত চোখে /আমার বুকের পাড়ায় কি জবর লেগেছে আগুন“ এমন কবিতা পাঠে পাঠকও নিজের হৃদয়ে কম্পন অনুভব করে। কবির সাথে স্পর্শকাতর হন, মুগ্ধ হন। ভাষার বীর্যতা, কবিতার ভেতরের সুরের নহর তার গভীর এবং দুর্বোধ্য কবিতাকেও সুখপাঠ্য করে।

পিরামিড সংসার, জারুলতলার কাব্য, অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই কবি কবিতাকে খুঁজেছেন। শব্দের মায়াময় বন্ধনে নিজেকে লীন করতে চেয়েছেন। সেই কবিতা আরাধ্য অথচ নির্মম। সহজে ধরা দেয় না। ক্রমশ দূরে সরতে সরতে এতটা দুরত্বেই পৌছায় যে মনে হয় আর বুঝি তাকে পাওয়া যাবে না। জটিল যন্ত্রনার যুথবদ্ধ জীবনে অধরা কবিতা ক্রমশই অনতিক্রম্য ব্যবধানে এসে দাঁড়ায় –
‘সারিবদ্ধ ক্ষুধার্ত অক্ষর
জমা হচ্ছে মাকড়সার ডিমের ভেতর ‘
কবিতা সংগ্রহ /পিরামিড সংসার“
আবার কবিতা যখন এসে ধরাই দিলো তখন এর ধ্যানেই কয়েক শতাব্দী কেটে যেতে পারে। স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে যান কবি।
“স্বেচ্ছাবন্দী – পড়ে আছি শব্দের ভিতর,
স্মৃতিহীনতার কষ্ট খসড়াই থেকে গেল বুঝি !
কি করে বা বলি, উড়ে যাও
শবদেহ কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ চরণ“।
একটি নিঃসঙ্গ পংক্তি /পিরামিড সংসার
ময়ুখ চৌধুরী উত্তরাধুনিক কবি। উত্তরাধুনিক চোখ শব্দের সংগে বহুরূপ দেখে। শব্দের ভেতর দেখে বাহির ও দেখে। উত্তরাধুনিক কবিতায় পরাবাস্তবতা, উপমায় কথা বলা, নান্দনিকতা, শব্দের কারুকাজ, বাক্যের ভেতরে অলংকারের সমারোহ কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। ময়ুখ তার কবিতায় গভীর ভাবের কথাটাই বার বার বলতে চেয়েছেন। গভীর দ্যোতনাবাহী, নান্দনিক শব্দ পরিকল্পনায় কবিতার পথে হাঁটাই যেনো ভবিতব্য – এ থেকে নিষ্কৃতি নেই। তবু অতৃপ্তির একটা হাহাকার – পিরামিড সংসার, “অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে” কাব্যগ্রন্থের বেশ কটি কবিতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

কাব্যদেবীকে পাবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষায় বার বার তাকে খুঁজেছেন প্রকৃতিতে, বাংলা শব্দের সমাহারে। পরমাত্মাকে পাবার আরাধনায় কাটে যেমন জীবাত্মার জীবন। কবিতাকে পাবার আরাধনায় কাটে কবির জীবন।
এ যেনো সেই রাধার আকুলতার মতন। যে রাধা কৃষ্ণকে পেতে চেয়েছেন সমসত জীবন ব্যাপী।
“কবিতা দরজা খোলো ; আমি এক অনিদ্র জোনাকী
নিজের আগুনে পুড়ে রয়ে গেছি অবুঝ সবুজ।
তোমাকে রচনা করি এরকম সাধ্য বলো কই !”
কবিতা তোমার দরজায়/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে“

ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার শরীর নির্মেদ টান টান, জ্যামিতিক নকশার মত গঠন, জামদানীর মতো ক্লাসিক আধুনিক। পংক্তিগুলো গড়ে উঠছে শরীরের জটিল রেখায় ক্রমবর্ধমান এক একটি ভিন্ন অবয়বের সুন্দরী রহস্যময়ী অধরা নারীর মতো। মেদহীন, ঝরঝরে, বুদ্ধিদীপ্ত কবিতার স্বভাব রোমান্টিকতা –
‘পংক্তিগুলো বেয়ে উঠছে শরীরের টান টান জটিল রেখায়
ক্রমশ জ্যামিতিটুকু টানটান, উৎকন্ঠিত তোমার চিবুক‘
নিঃসঙ্গতা বোধ কবির অন্যতম বোধ। অজানা এক বেদনায় মুক অথচ গভীর শব্দের স্ফুরন কবির মুক্তির পথ।
“পাতালের হাতছানি ভারী করে চোখের পাতাকে
নিরীহ জন্মের মতো আমার টেবিলে জেগে থাকে’
আমার টেবিল / পিরামিড সংসার ‘
কবিতা অহীর মতো। নাযেল হয়। আবার রহস্যময় মরিচীকার মতন। আসে মিলিয়ে যায়। অধরা প্রেয়সীর মতো সে ছুঁয়ে যায়, ধরা দিতে চায় না। আলো আঁধারী কুয়াশায় আচ্ছন্ন কবিতাই আরাধ্য হয়ে ওঠে। কবি তো কবিতার পথেই হাঁটতে চেয়েছেন। শিল্পী মাত্রই অতৃপ্ততায় ভুগেন। কবিও এর ব্যতিক্রম নন। যথাযথ শব্দ, বাক্য, কাব্যের অলংকার যেনো কবির কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। ‘পিরামিড সংসার’ কাব্যগ্রন্থে কিংবা ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে‘ কাব্যগ্রন্থে কবির সেই হতাশা ছুয়ে যায়। তবু কবি কবিতাকে ছেড়ে যান নি। কবি তো আসলে নিজেই কাব্যলক্ষী হয়ে পাঠকের ভেতরে আসন গেঁথে রাখেন।।

‘তুমি নও, তোমার মতন কেউ, দূরে থাকে ঘরে থাকে
অংশত লুকিয়ে থাকে ভাসমান বরফের মত
অথবা লুকিয়ে থাকে মলাটের ফিরোজা আঠায়‘
পুনরাবৃত্তি / পিরামিড সংসার“

কেউ পায় তার দেখা
শুয়ে আছে ফুটপাতে মলাটবিহীন খুব একা “
‘কবিতা সংগ্রহ
পিরামিড সংসার ‘

সারিবদ্ধ ক্ষুধার্ত অক্ষর জমা হচ্ছে মাকরসার ভিতর ডিম “/ কবিতা সংগ্রহ

ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় নৈরাশ্য অন্তর্মূখীনতা, তিক্ততা একাকীত্ব বোধ কবিতাকে দেয় রহস্যময় ঘনত্ব। প্রতীক ছেয়ে থাকে মনোগহবরের নিরালোকে” নৈরাশ্য এমন এক বোধ এ থেকে বেরুনো দুঃসাধ্য। আশার তরী থেকে বার বার ছিটকে পড়ে মানুষ। বেঁচে উঠতে চায় খরকুটো যা পায় তা ধরেই। তবুও মুক্তি নেই। নৈরাশ্যে জীবনের সাথে লেপ্টে থাকে। হতাশাবোধ আচ্ছন্ন করে।
তীব্র হতাশাবোধ থেকে কবি উচ্চারণ করেন —
‘বোতামেরও ঘর থাকে
আমার তো হলো না কিছুই।“
অথবা
‘নিজেকে গোছানো বুঝি এ জীবনে হলো না আমার “
কি যেনো পকেটে ছিলো
এখনো পাইনি খোঁজ পুরনো জামার “
পিরামিড সংসার / পুরনো জামা ‘

বিষাদ ও নৈরাশ্য আক্রান্ত কবি অন্তর্মুখী। মমির মত জীবন যাপন করেন। মমির থাকে না জীবনের চঞ্চলতা। স্থবিরতা শুধুই স্থবিরতা। গভীর হতাশা জীবনকে ঘিরে থাকে। যে জীবন হতে পারতো পাখির মতো স্পন্দনশীল সে জীবন আশাহীন মমি ছাড়া কিছু তো নয়। প্রাচীন মিশরীয়দের মতে মৃত্যুর পরেও মানুষ বেঁচে থাকে। কিন্তু সে বেঁচে থাকায় চঞ্চলতা নেই, নেই জীবনের অবিরাম স্ফুর্তি।
‘পাথরে শ্যাওলার মত পড়ে আছে মন
পিরামিড সংসারে বেঁচে আছি মমির মতন / পিরামিড সংসার ‘

“অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’ কাব্যগ্রন্থে কবি হৃদয়ের ডাল পালা লতাপাতা আলো আঁধারী রহস্য নানা ভাবে বিচ্ছুরীত হয়েছে। তার বক্তব্য ঋজু, স্পষ্ট, হৃদয়স্পর্শী। কবি হৃদয়ের অস্থিমজ্জার স্ফুরন টের পাওয়া যায়।

পিরামিড সংসারে এসে কবি যেনো অনেকটাই শান্ত সংহত। কবির কল্পনা প্রবণ মন বিজ্ঞানমনস্কতাকে আঁকড়ে ধরে এগোয় প্রগতির পথে। কিন্তু কবির বাস মাটিতে হলেও অনুভব করেন এই অস্থায়ী পার্থিব জীবনের স্থুলতা।

শোক, মৃত্যুচিন্তা মাত্রা পেয়েছে বৃক্ষ অথবা মানুষের এলিজিতে। সবিতা কবিতায় এসেছে নাগরিক জীবনে নারীর প্রেমের নামে নির্যাতনের বার্তা। টুথপেস্ট ‘কবিতায় মানবিকতার নামে আজকের বিশ্বের নির্মমতার কথা মনে পড়ে যায়।
“মানবতা কাকে বলে ছোটরা জানে না,
বড়রা দোকান থেকে প্রয়োজনমতো কিনে নেয়
টুথপেস্ট আর মানবতা“।
পিরামিড সংসার কবিতায় একাকী নিঃসঙ্গতার হাহাকারের শব্দ পাওয়া যায়।
সমস্ত দিনের শেষে জামাকাপড়ের ভাঁজ থেকে, নিজেকে আলগা করে দেখি, খুব একা –

যদিও বেঁচে থাকেন সে যেনো প্রাণহীন।
“এতোগুলো মৃত্যু গেঁথে থাকে বুকের ভিতরে তুই একা একা খুঁজছিস কাকে ?”
এবং মিলন চৌধুরী /পিরামিড সংসার

ময়ুখ চৌধুরী রোমান্টিক কবি। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম। সাহিত্যে প্রেমের কামনামিশ্রিত শরীর, চেতনাতপ্ত রূপ চিরকালই স্বীকৃত। কিন্তু শরীর কামনামাত্রই প্রেম নয়। তার শরীর মন বুদ্ধির সমুহ্নয়েই পূর্ণ।
প্রেমহীন জীবনও কবির নয়। কবি প্রেমে পড়েন, বার বার পড়েন, ডুবে থাকেন এক অবিশ্রান্ত প্রেমের সমুদ্রে। প্রেম, রমণী শরীরের প্রতি কাব্যময় শিহরনে কবি লীন হয়েছেন। কবির কাছে কাম ও নারী অবিচ্ছেদ্য। পরম আরাধ্য নারীকে পেয়েছেন অথবা পান নি কিন্তু কবি হৃদয় আর শরীরের কামনা বাসনা লুক্কায়িত রাখেননি। স্বাভাবিক ভাবেই তৃষ্ণার্ত হয়েছেন। অনন্ত কামনা বাসনার নদীতে নিজেকে ডুবিয়ে পবিত্র হয়েছেন। প্রেম তো আরাধনারও নাম।
“সারা দেহে জ্বালা ধরে জমে ওঠে লালা
তখনই পবিত্র হই
যখন তোমাকে দেখি আজও মধুবালা‘
‘দি মিথ অব মধুবালা / পিরামিড সংসার‘
“জীবনের দুপুরবেলায় আবার পিপাসা লাগে
নরম নগ্নতা থর থর
ছোঁয়া লেগে কেঁপে ওঠে প্রবীন পাথর
নতচক্ষু হয়ে আজ দেখি
অনায়াসে ডুবে যেতে পারি“
ঝর্ণার দেখা /জারুলতলার কাব্য
নারীর শারীরিক স্পর্শে মোহগ্রস্ততা তৈরী করে। ইন্দ্রিয় ঘনিষ্ঠতায় মোহগ্রস্থ কবি নদী, নারী, দেশ প্রকৃতি ঐতিহ্য প্রেম রসে সিক্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যান লৌকিক থেকে অলৌকিকতায়, বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে – অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্থ কবি তার উঁচুমার্গের কবিতায় পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যান।

“তোমার উন্নত গ্রীবা রজনীগন্ধার মতো একদিন নগ্ন মনে হয়েছিলো
সে দৃশ্য প্রাক্তন আজ, গ্রীবাময় হৈম কারুকাজ “
রানী বিভাবতী / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে
তবে যদি হও তুমি রাজহংসী
তবে আমি ঘুমভাংগা শংখচুড় আজ
তুমি রানী বিভাবতী, আর আমি কুমার সন্ন্যাসী “
অথচ এই অহংকারী অবিনীত প্রেমিকার কতটা কাছে ছিলেন, জমকালো অবজ্ঞার প্রসাধন “ আজ সে প্রেমিকার সাজে সজ্জিত করেছে নিজেকে তার সকল গুপ্ত রহস্য জানেন বলে কবি বঙ্কিম হেসেছেন –
“বলো কেন ?
আমি তো জানি
তোমার ওখানে একটা তিল আছে রাণী “
রানী বিভাবতী / অর্ধেক রয়েছো জলে অর্ধেক জালে
প্রেমের সাথে কাম স্থুল সুক্ষ্ণ দুভাবেই সংশ্লিষ্ট। কামজ ঘ্রাণ পাওয়া যায় “কাটা পাহাড়‘ “রোহিনীর স্নান” কবিতায়।
“এইসব দৃশ্যের আগুন নিয়ে একা জলাশয়ে
মাছের স্পর্শ পেতে রোহিনী রচনা করে অর্থহীন স্নান।“
নারী কবির কবিতার এক প্রধান অনুষঙ্গ। কবি ময়ুখের কাব্যের দুই প্রধান অনুষঙ্গ নারী এবং প্রেম। নারী এসেছে নানা রূপে নানা বর্নে, ঢং এ, নানা ভাবনায়।

‘সবিতা দেখতে ভালো
মানিপ্ল্যান্টের মত সতেজ, আর টগবগে
‘সবিতা নামের অর্থ ‘/ পিরামিড সংসার
‘লজ্জাবতী নাম তার সম্রাজ্ঞীর বাগানে ফুটেছে।
‘সামান্য ছোঁয়ায় শরমে সে মরে যেতে চায়“
ক্রমশ লজ্জাবতী ‘ /পিরামিড সংসার
“যেনো তুমি অভিঘাতে রাজহংসী আজ
তোমার চোখের সামনে সবকিছু খরকুটো
আর্শি ব্যাতিরেকে “

“এভাবে তাকানো তুমি শিখলে কবে থেকে “
রানী বিভাবতী /অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘

“উড়ছে মাতাল চুল ,এলোমেলো আঁচলের ঢেউ
লাবন্য ধরেছো নারী , সারা অঙ্গে তরঙ্গ প্রবণ “
তুমি কি মাছের বোন ?
আঙ্গুর চোরাবালি চরের নেশায়
মানুষের ছদ্মবেশে লোকালয়ে এসে
লতাগুল্মে ফেলে গেছো বরশীর মতন চাঁদ “

শরীর কামনার আধার হলেও প্রেম কামনা বাসনার উর্ধ্বে। যদিও শরীরকে আশ্রয় করে প্রেম বেড়ে ওঠে। কিন্তু একসময় তা হয়ে ওঠে অলৌকিক। প্রেম মানে তুমি, তুমি মানে আমি। তাকে অস্বীকার করলে নিজেকেও অস্বীকার করা হয়।
‘তোমার শরীর ছোঁয়া সরীসৃপ জল
সেই কবে শিখিয়েছে চিরায়ত প্রেমের কৌশল
সিন্ধু সভ্যতা / দুই পর্ব /অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে‘

“আমি কাল চলে যাচ্ছি দেহটাকে নিয়ে যাচ্ছি
ছায়াটা তোমার কাছে যাক ( যাওয়া থেকে যাওয়া )
তবে প্রেমের কবিতা লেখলেও তার নিজস্ব একটি দর্শন আছে। একই সাথে মানবিক সংকটময় মুহুর্তের কবি বলা যায় তাকে, যার কবিতায় মুহুর্মুহু গল গল করে শব্দগুলো আর্তি করতে থাকে প্রায়শ ভিন্নতর ব্যঞ্জনায়। কাব্যে নিছক প্রেম কিংবা ভালোবাসা নয়, শব্দ আর চিত্রকল্পের চেয়েও অধিক জ্ঞানী শব্দাংশ পরিপূর্ণ একটি বিশ্বাসের জোরে খাঁটি মানবিক আত্মার নির্যাস রয়েছে। তার প্রেম কামনায় যেমন আছে দেহজ লতার সুঘ্রাণ তেমনি জেগে ওঠার অদম্য আকুতিও আছে।

অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জলে‘ কাব্যগ্রন্থে পূরান, ইতিহাস চেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, মিথ, প্রেমের জন্য আকুতি, কাম একই সাথে সমান্তরালে চলেছে। ঘন বনের ভেতর সাদা বাড়ির রহস্যময়তা তার কবিতাকে ঘিরে রাখে –ইতিহাস চেতনায় কবিতাগুলো ভাস্মর অনন্যতায়।

“মহেঞ্জোদারোর এক জাতিস্মর প্রাচীন প্রেমিক
পাথরে খোদাই করে দুঃখ তার জমা রেখেছিলো “
কিংবা
“দ্বিতীয় বাল্মিকী নেই
তাই পাখিরা মিথুন লগ্নে মানুষের সামনে আসে না “
“তোমার কালিতে কালোর অনেক ঋন
কোন বনে আজ ঘুরিয়া বেড়ায় শকুন্তলার হরিণ “ ‘
তুমি ছিলে তুমি আছো
সেই কথা জানে দুষমন্তের আংগুরী গেলা মাছ ও
বাল্মিকী ,কালিদাস, ভুসুকু/ অর্ধেক রয়েছি জালে অর্ধেক জলে “
অস্থির সময়। সম্পর্কগুলো ক্রমশই পলকা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।
যুগ যন্ত্রনার শিকার কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। দাম্পত্য সম্পর্ক খসে যায়, গভীর ভালোবেসে প্রেমে বিরহে মাখামাখিতেও থাকছে না আর অনুবন্ধগুলো। সংসারের আনুসাংগিক প্রয়োজনীয় সবই হয় কিন্তু সংসারটাই টেকে না।
“ বিয়ে হয়ে গেলো
পেয়ারাতলায় ঘরবাড়ি
বিস্কুট প্যাকেটের খাট, পাতার সবুজ বালিশ
সন্ধ্যার আগেই জামাই বউতে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।
পুতুলের বিয়ে / পিরামিড সংসার
ময়ুখ চোধুরী কবিতার মধ্যে ব্যাপকভাবে সংলাপ, কথোপকথনের ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন। এ থেকে যে সত্যটা উপলদ্ধি হয় তা হলো বহুমাত্রিক সংলাপধর্মীতা।
আবার আত্বগত উচ্চারণ মথিত হয়েছে অনেক কবিতায়। অনেক কবিতায় এইসব স্বগত উচ্চারণ ডায়ালগ সদৃশ। কবির হৃদয় উৎসারিত আবেগ মননের বহিপ্রকাশ কিন্তু কোনো প্রতুত্তরের প্রত্যাশা নেই। স্বগত সংলাপের প্রভাব ময়ুখের কবিতায় পাওয়া যায়। স্বগত উচ্চারণের পাশাপাশি সত্যিকার ডায়ালগ ও কথোপকথন ঢুকে পড়েছে তার কবিতায় –

“দুপুরবেলায় খাবার বেড়ে গিন্নী আমায় ডাকতে এল পুকুরপাড়ে
ভাত খাবে না ? বলার আগে বললো হেসে – বয়স কতো ?
উত্তরে তার বলতে পারতাম
পুকুরপাড়ে বয়স বারো ‘’
“নদী পাথরের গল্প’/‘অর্ধেক রয়েছি জালে অর্ধেক জলে ‘

‘যা উড়ে যা উড়ে যা বনিকবাড়ির ঝি
নাইওর এলে আমার নায়ে উঠিস
ফিসফিস করে বলিস একটিবার
কেমন আছিস মাঝি ?
“সোনা মাঝির ঘাট’/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে ‘
স্বগত সংলাপ’
লবনাক্ত মানুষের মতো
কতোরাত ঘুমিয়েছি পাথরের বুকে মাথা রেখে
তা বলে ইর্ষায় চাঁদ সেই থেকে পাথর হয়েছে ‘
বনানী গিয়েছে বলে কাল রাতে খুব একা একা
কথা ছিলো কার সাথে তার ?
শেষ দেখা আহা শেষ দেখা
হয়নি তো তার সাথে, কারো সাথে
শুধু বেদনার লতাপাতা‘
বনানী গেছে বনে ‘/ অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “

ময়ুখ চৌধুরী নিজস্ব কাব্যভাষা ও নতুন শিল্প নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। চিত্রকল্প নির্মানে তিনি যে দক্ষ কারিগর সে নতুন করে বলার নেই। চিত্রকল্প নির্মিত হয় কল্পনার বস্তুকে নতুন শব্দযোজনায় কল্পনার রঙে চিত্রিত করে। নতুন চিত্রকে নতুন শব্দে নান্দনিকতার সাথে উপস্থাপনে পাওয়া যায় কবির স্বাভাবিক সৌকর্যে। শ্রেষ্ঠ চিত্রকল্প শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্মানের প্রাথমিক ভিত্তি বলা হলেও বেশী বলা হবে না।
“কি জন্যে দৌড়াচ্ছ এভাবে !
তুমি কি পালাচ্ছ নাকি ছুটে যাচ্ছো ? লাটাইয়ের টানে
বাড়ি যাচ্ছ ? – কেন যাচ্ছ , কি আছে ওখানে !
ট্রেনের ছাদে বাড়ি যাওয়া দেখে / পলাতক পেন্ডুলাম

“বন বিভাগের রাস্তা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ফুটপাতে, ব্যাপার তেমন কিছুই নয়। গতকাল শেষরাতে মারা গেছে উলঙ্গ পাগল।“
মৃত মানুষের কাছে লজ্জা ঢাকা / পলাতক পেন্ডুলাম“
“খাটিয়া বহন করতে যেয়ে
নুইয়ে যাচ্ছে এতগুলো বলিষ্ঠ শরীর
“লোককথা ‘/পিরামিড সংসার

মূলত ত্রিশের স্বভাব তার মর্মগত। ময়ুখ চৌধুরী আধুনিক কবি কিন্তু ঐতিহ্যচেতনা তার বেশীর ভাগ কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ। অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাতেই কবি পূরান, চর্যা আর মধ্যযুগের আলো আঁধারীকে মর্মে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়েছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং প্রাচীন বাংলার বাকচিত্র এখানে চাঁদের আলোর মতই মসৃন মায়াময়। প্রাচীন মহেঞ্জোদারো, ফুল্লরার সংসার, ঈশ্বর পাটনী অলঙ্করণ পদ্ধতিতে স্পষ্ট করেছেন প্রাচীন বাংলার সাহিত্য এবং ঐতিহ্যকে।
“আষাঢ় শ্রাবণ দুই চোখে
বয়ে যাক বেহুলার নদী
ভাসান লাশ নিয়ে
তুমি চলে যাও নিরবধি
“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “
“দেবতার ঘরে বসে লেখা এক নিয়তি নাটক
সংসার শ্রমিক কাজে দায়বদ্ধ সূত্রধার
অবিচারে ফুঁসে ওঠে আজও কালিন্দীর বোবা জল
কাহার গাভীর দুধ পান করে সাপ নিশিরাতে ‘
আইহন গোয়ালা / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে

“ফুল্লরা বৌ ফুল্লরার বৌ গাঁও গেরামের ঝি
তোমার নাতি গঙ্গা ঘাটে ঈশ্বরিনীর মাঝি “
“ঈশ্বর পাটনীর সংসার / অর্ধেক রয়েছিজলে অর্ধেক জালে “
একই সাথে সমাজের শোষণ বঞ্চনার চিত্র অনবদ্য ভাবে এসেছে। গরীব সকল সময়ই নির্যাতীত। প্রাচীন বাংলায় কিংবা আধুনিক সভ্য সমাজেও একই ভাবে গরীব ইশ্বরের আশির্বাদ পুষ্ট হলেও তার ভাগের চিড়ে ধনীর পাতেই পড়ে।
‘দেবী দিলো পয়সা বিনে ঈশ্বরীরে বর
দুধ মাখা ভাত কাকে খেলো সন্তানেরা মর “
“ঈশ্বর পাটনীর সংসার / অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে “

নাগরিক জীবনে, আধুনিক মিডিয়া নারীকে আরো বেশী নির্যাতনের মুখোমুখি করে। নারীর নির্যাতন একই থাকে কিংবা বেড়ে যায়। নির্যাতনের ধরনের পরিবর্তন হয়।
“এমন সময় চারজন যুবক
তারপর অজানা অচেনা একটা ঘর
পরপর চারজন যুবক
সংবাদপত্রের খাদ্যে পর্যবসিত করলো সবিতাকে “
সবিতা নামের অর্থ / পিরামিড সংসার

মৃত্যুচিন্তা থেকেও কবি পালাতে পারেন নি। মৃত্যু কবিতার আর এক অনুসংগ।
তার অনেক কাব্যেই মৃত্যুচিন্তা এসেছে প্রাসংগিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে।
“ঘুমের সাদা বাড়ি , মানে সাদা বাড়ি। সেই বাড়ির শাদার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে কালো মানে অন্ধকার ঘুম। আলখাল্লা ফাঁক করে ঢুকে পড়ে সকালের রোদ। স্পষ্ট শাদা জাগরণ। গতরাতে বিছানা থেকে উঠে আসে খবরের কাগজ। কালো কালো পোকা থেকে স্পষ্ট শাদা নড়াচড়া।“
কিংবা
“যাবতীয় শাদা হিশাবনিকাশ ঝিমিয়ে পড়লে
প্রচন্ড ভারি কালো একটা ঘুমকে পড়ানো হবে শাদা জামা“।
একটা খাটিয়া নামানোর জন্য ক’জনকে কষ্ট দেবো ! তাই / পলাতক পেন্ডুলাম

মরে যাওয়া মানেই তো চলে যাওয়া। আর এই পৃথিবীকে না দেখার আফসোস। তার চাইতেও বেশী আফসোস প্রিয়জন রেখে যাবার বেদনা।
মানুষ আসবে যাবে, এই আমি আর আসবো না “
অথচ তখনো প্রিয়তমাকে নিজের করে রাখার বাসনায় মরেও যেন শান্তি নেই
“একদিন থাকবো না, তাই
তোমার সারাটি অঙ্গে চুম্বনের প্রহরী বসাই।
পূর্ব প্রস্তুতি / পলাতক পেন্ডুলাম

কবি বেঁচে থাকতে চান প্রিয়তমার মাঝে। মৃত্যুর পরেও নিজেকে দৃশ্যমান রাখতে চান প্রেমিকার শরীরে।
“তোমার প্রতিটি মোড়ে প্রহরী চুম্বন ছাড়া আর কেহ নাই
এইভাবে থেকে যাওয়া “
পূর্বপ্রস্তুতি / পলাতক পেন্ডুলাম
“আমাদের সমুদ্র সাময়িকী ‘ কবিতায় প্রকৃতিকে কবি একটা স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। প্রকৃতির প্রতি আবিষ্ট মুগ্ধতা থেকে সরে এসে তাকে দেখা যায় ভিন্ন অবয়বে —
“নদীর তীর ধরে হেঁটে যাওয়া লাঠির মত সতর্ক ,সরল
অতএব পাখির ওড়াওড়িকে মনে হচ্ছিল ছেঁড়া পলিথিন।“

কবি ময়ুখ চৌধুরীর কাব্য ভাষা যে খুব স্বতন্ত্র তা নয়। কিন্তু তার কবিতার প্রেম রোমান্টিকতা নান্দনিকতার সাথে জায়গা করে নেয় পাঠক হৃদয়ে। টের পাওয়া যায় দীর্ঘদিন আড়ালে আবডালে থাকা কবির শক্তি। তার বাকরীতি সংক্ষিপ্ত, নিগূঢ় অথচ অর্থবাহী। কাব্যভাষায়, শব্দনির্মাণে অভিনবত্ব, প্রতীক, উপমা তাকে চিনিয়ে দেয় জাত কবি হিসেবে। শব্দের খঞ্জনীতে তিনি যে ছন্দ লয় নিয়ে আবির্ভাব হন তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে কালান্তরে। সংকোচহীন ভাবে কবি ময়ুখ চৌধুরীকে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের মেধাবী কবি।

মাজনুন

তোমার জন্য কদম রসুল পাড়ের মাজারে কিছু মোম আর তিতা ইলিশ মানত করেছি -যদিও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছাড়া আমার হার্টের ভেতর তিনটা ছিদ্র জ্বল জ্বল করে – সমুদ্রের নুন জলে এক দল ফেরিওয়ালা বিক্রি করে রেকাবী ইঁদুরের তিন কৌণিক মুন্ড –

লোটাসের কোনায় তিন কুসুমি বলে আজকের আবহাওয়ার গুরুত্ব –
আমি তুমি বলি আমাদের মাঝে চিরতার ডাল থাকে
সেই ডালের গায়ে লৌকিক বিষফল জন্মাতেও পারে —

দুপুরের সূর্যটা বেশী নেমে গেছে –
পিচ কালো করে ঘেমেছে রডের বাঁকা ছাদ —
আমার হৃদপিন্ড থেকে গল গল করে ঘামে তেতো বিষ –
বড় বেশী মাজনুন তুমি –
বড় বেশী আনচান মন –
অকালে মরবো আমি –

আল মাহমুদ বাংলার কিংবদন্তী অসাধারণ এক কবি

কবি তাকে বলি যিনি জানেন কি করে সৌন্দর্য তৈরী করতে হয় তাঁর দক্ষ হাতের সাবলীল ব্যবহারে। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ছন্দের ক্ষেত্রে, উপমার ক্ষেত্রে, অলংকার, উপমা উতপ্রেক্ষার বিচিত্র ব্যবহারে তিনি যে কবিতাকে সামনে তুলে ধরেন তাতে পাঠক মোহগ্রস্থ হয় এবং এটা সুর একটা আবহ কবি তৈরী করেন যেখানে পাঠক আর নিজের মধ্যে থাকেন না – কবির কবিতার সাথে একধরনের সংলগ্নতা তিনি বোধ করেন যাতে একটা কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে। অথবা কবিতা তাকেই বলি যা চকিত চমকে মনকে দুলিয়ে দিয়ে যায়। চৈতন্যে সাড়া জাগায়। সেই দোলা বা সাড়া কখনো আসে ভাবের ব্যঞ্জনায়, কখনো মনোভঙ্গির অপ্রত্যাশিত খরতায়, কখনো বা রূপকলার আকস্মিক জ্যোতির্ময়তায়। এদের যে কোন একটির অভিঘাতেই পাঠকের মনের উদ্ভাসন ঘটতে পার, তার অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্তৃততর হতে পারে। সেই প্রজ্বলন ও প্রসারন পাঠকের মধ্যে ঘটিয়ে কবির বাক্য সৃষ্টি যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে। যেমন –

শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেব আদ্যাক্ষর রক্তবর্ন অনার্য প্রাচীন।
(সোনালী কাবিন -২ ) কবি আল মাহমুদ।

এভাবে বিশ্লেষণ করলে একজন কবি আল মাহমুদকে আমরা পাই, যিনি বিশের দশক থেকে শুরু করেন কিন্তু তিরিশের দশকের ধারাকে উপেক্ষা করে ভিন্ন একটা গতিধারা তৈরী করেন, যেখানে একজন আল মাহমুদ বিশেষ ভাবে নিজেকে চিনিয়ে দেন। তিরিশের দশকের কবিরা কবিতার ধারা রবীন্দ্র ধারা থেকে সরিয়ে পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করেন সেখানে কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র স্বত্তায় দাঁড় করান। গ্রামীন, লোকজ এবং মৌলিক শব্দের স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে তাঁর কবিতার শরীরকে অলংকৃত করেন। তাঁর উপমা উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এমনই গ্রামীন লোকজ যে সেখানে কবি আল মাহমুদ একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবে চিনিয়ে দেন তাঁর জাত। তাঁর লোকজ শব্দে যেভাবে পাওয়া যায় মাটির টান তেমনি তিনি যে আধুনিক কবিতার একজন আলাদা নতুন শব্দের রূপকার সে আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। যেমন –

রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে ,
সৃষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাংগে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশী ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জায় আগল
(সোনালী কাবিন – ১৪)

কবি আল মাহমুদ তিরিশোত্তর কবিদের চাইতে ভিন্ন তাঁর শব্দ ব্যবহারের চমকপ্রদ ব্যবহারে। গ্রামীন শব্দ তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন কবিতার শরীরে এবং একটা ভিন্ন মাত্রা দেন। যেমন –

বুবুর স্নেহের মত ডুবে যায় ফুলতোলা পুরনো বালিশ –
স্নেহের সাথে বুবুর ফুলতোলা বালিশের অনুষঙ্গ চমৎকার – কারণ বুবু যখন ভাইয়ের জন্য বালিশের কভারে ফুল তুলেন তখন ভাইয়ের প্রতি বোনের স্নেহের আতিশয্যের কারণেই সেই বালিশ ভিন্ন এক ব্যঞ্জনার আবেশে ভরপুর হয়। কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার – একে তো মক্তবের মেয়ে আবার সে চুলখোলা এবং একটা সাধারণ নাম যে নাম গ্রাম্য মেয়েদের সাথে মানিয়ে যায় – একটা গ্রামীন নিষ্পাপ মেয়ের ছবি চোখে আসে যেখানে একই সাথে কাব্য বোধের সাথে একাকার আয়েশা আকতার।

বধুবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মত কন্যা বলো কবুল কবুল –
কবুল বলার সাথে একটা মেয়ের ভাগ্য পরিবর্তন হয় গাঙ্গের মতন। যে গাং এক এক সময় এক এক রকম। কবুল বলার সাথে সাথে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে যে একটা বিচিত্রতর পরিবর্তন হয় সেখানে কবুল একটা ভিন্ন জীবন, নতুন রোমান্সের জগতে সে প্রবেশ করে সে এক বিচিত্র অভিনিবেশের দাবী রাখে।
নারীই শিল্পের মহাশক্তি। পৃথিবীতে যত কবিতা মহাকাব্য লিখা হয়েছে তার অধিকাংশই নারী বিষয়ক। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মহাযুদ্ধ হয়েছে নারীকে কেন্দ্র করেই। আল মাহমুদের কবিতায় নারী তার সমস্ত সৌন্দর্য আর উচ্ছ্বলতা নিয়ে হাজির হয়। কবি তার নারীকে রূপ আর জৈব তৃষ্ণার আঁধার করে খোলা তরবারির মত হাজির করেন। নদীর ঢেউ আর ভাংগা গড়ার চলার ছন্দের সাথে নারীর শরীরের ভাঁজ, শিহরণ আর গতিময়তার চমৎকার সাদৃশ্য ভিন্নতর ব্যঞ্জনা দান করে।

ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ (সোনালী কাবিন)

এক্ষেত্রে কবি কমরুদ্দিন আহমেদের “আল মাহমুদ কবি ও কথাশিল্পী” প্রবন্ধে লিখেন আবহমান বাংলার বাঙ্গালীর জীবন যাপন, মৃত্যুর সীমারেখাকে অতিক্রম করে ভাষা আর প্রেমময় কাব্যের শপথের নান্দনিকতায় পাঠকচিত্তকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যায় কবি আল মাহমুদের কবিতা।”

কবি আল মাহমুদের কবিতায় পল্লী প্রকৃতি, লোকজ জীবন ধরা পড়ে ভিন্ন আঙ্গিকে – স্বতন্ত্র তাৎপর্য নিয়ে। তিনি অবহেলিত বাংলার গ্রামীন জীবনের খুঁটিনাটি প্রসংগকেও অনায়াসে উপমা চিত্রকল্পে স্থাপিত করেন অনন্যতায়। মূলত আল মাহমুদের ভাষা একান্তই তাঁর নিজস্ব। পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ প্রবচনকে আর কোন কবি সম্ভবত এমন নিপুন ও শৈল্পিক ভংগীতে ব্যবহার করেন নি। গ্রামীন জীবনের উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা ও চিত্রকল্প। জসীমউদ্দিন যেমন লোক সাহিত্যের উপর তাঁর কুটির নির্মাণ করেন সেখানে আল মাহমুদ আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান তাঁর কাব্যে ব্যবহার করেন। পলায়ন পর মানব সত্তা আল মাহমুদের চেতনায় গড়ে প্রবল দূরাগত ভাংগনের শব্দ। পালাবার পথ খোঁজেন কিন্তু পান না। কেননা –

নারীর নিঃশ্বাস এসে চোখে মুখে লাগে
বুকে লেগে থাকে ক্লান্ত শিশুর শরীর”

সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালী কাবিন একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সোনালী কাবিন কাব্যে আল মাহমুদ লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে উদ্ভাবন করেন এক ধরণের শব্দ জাদুময়তার।

আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গৃঞ্জার মালা পরো বালা,
প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে? —-

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর এবং ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্য কালের কলস। এ দু’টি কাব্যের ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ নিজেকে প্রকাশ করেন সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব ঘরানার কবি হিসেবে। আল মাহমুদ প্রকরণ সচেতন কবি। ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একাধারে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত এবং গদ্য কবিতা লিখেছেন। কবি মনে করেন ছন্দ ত্যাগ করলে কবির চলে না। ছন্দ নির্মাণে তিনি কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। উপমা সমৃদ্ধ কবিতা কবি আল মাহমুদ অনেক লিখেছেন। দেশ, নারী, প্রকৃতি, তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ –

১। চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণাস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী (কবির বিষয়/অদৃষ্টবাদীর রান্নাবান্না )
২। স্তন দুটি দুধের ভারে ফলের আবেগে ঝুলে আছে”
(অন্তরভেদী অবলোকন/সোনালী কাবিন)
৩। — আর নরম দুটি বুক,
পুঞ্জিভূত অভিমান (দোয়েল ও দয়িতা/দোয়েল ও দয়িতা)
৪। বেড়ালের পায়ের সতর্কতা নিয়ে লোকটা গোলার্ধ থেকে গোলার্ধে
ঘুরে ফিরে সংবাদপত্রের ছবি হয়ে থাকে
(মীনার প্রান্তরে ইয়াসির আরাফাত/একচক্ষু হরিণ)
৫। কোন খানে পাড়ো তুমি জবর সোনার আন্ড, কও মিছাখোর ?
বলেই টানবে লেপ, তারপর তাজ্জবের মতো
পেখম উদোম করে দেখবে এক বেশরম কাউয়ার গতর –
(আমিও রাস্তায়/সোনালী কাবিন)

আল মাহমুদকে সত্যিকার শক্তিশালী কবি মনে হয়েছিল তাঁর ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ কবিতাটি রচিত হওয়ার পর। হাজার বছরের প্রচলিত মিথকে ভেঙে ফেলার ক্ষমতা যিনি রাখেন তিনি নতুন মিথেরও জন্মদাতা বটে। আল মাহমুদ যখন বলেন:
মাঝে মাঝে ভাবি, ছেলেটি কেন এমন ‘বাঘ বাঘ’ বলে চেঁচাতো?
আমরা ভয়ে বিহ্বলতায় চারদিকে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে
বলতাম শুয়োরের বাচ্চা। সে বোকার মতো হাসতো। বিব্রত,
অপদস্থ। তারপর আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম,
মিথ্যাবাদীর ডাকে আমরা আর সাড়া দেব না।
আহ, আবার যদি ফিরে আসত সেই মিথ্যাবাদী ছেলেটা
জনমত ও তিরস্কারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্তরের চারণের মতো
বলে উঠতো, ‘মুত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী-
হুঁশিয়ার’।

ছেলেটা যদি মিথ্যাবাদী হবেই তবে বাঘ কেন এসেছিল শেষ পর্যন্ত? এটা এক ভয়ঙ্কর আবিষ্কার। এভাবে ঈশপের কাহিনীকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে নতুন করে কাহিনী গড়ার দুঃসাহসী অভিযানে নামেন আল মাহমুদ, যে অভিযানে তিনি সফলও হয়েছেন বলা যায়। কী অসাধারণ হয়ে উঠেছে তাঁর দিব্যদৃষ্টি তা আমরা টের পাই যখন তাঁকে বলতে শুনি:

আমি তাদের উরতের পেশিতে বিদ্যুতের চমক দেখে
থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই পথেই তারা
গন্তব্যে পৌঁছুবে, যেখানে শ্বাপদারণ্যের পাশেই আছে নদী।
মানুষের জন্য পারাপারের পানসি বাঁধা। গোটানো পালে
জলপুষ্পের প্রতীক। দড়ি আর দাঁড়।

কিংবা যখন তিনি বলেন:

তারপর সত্যি একদিন বাঘ এসে সব খেয়ে ফেলল। প্রথম
সেই বালকটিকে, শেষে নখ আর দাঁত দিয়ে আঁচড়ে ফেলল
মানুষের গ্রাম, ঘরবাড়ি, রক্ত, মাংস।
এই যে প্রচলিত গল্পের বাইরেও বোঝার একটা গল্প আছে সেটাকে তিনি প্রকাশের তাড়না অনুভব করেন। যদিও কবিতাটির ভাষা কোথাও একটু ঢিলেঢালা হয়ে গেছে তবু যে মেসেজ দেবার তাড়না তাঁর ছিল সেটা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। পাঠকের মনে হতে পারে কেউ সাদামাটা গল্প শোনাচ্ছেন কিন্তু কিছু পংক্তি সত্যিই চমকে দেয়।

আমরা তো সেই মিথ্যাবাদীর খুলির ওপর রোদ চমকাতে দেখে এসেছি’
কিংবা ‘আর দেখেছি সকল সত্যবাদীদের পঙ্গপালের মতো পালাতো।”–
মৃত্যু এসেছে এই যে অসাধারণ দর্শন তিনি এখানে নিয়ে আসেন যেখানে আগে শুধু ভাবা হতো রাখালের মিথ্যাবাদী চরিত্র। সে চরিত্রের উপর তিনি আরোপ করেন দার্শনিকতা। প্রতিদিনই আমাদের দুয়ারে মৃত্যু এসে হানা দেয়। প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে পায়ে হেঁটে যাই। কবি কমরুদ্দিন আহমেদ তাঁর আল মাহমুদ কবি ও কথা শিল্পী প্রবন্ধে লিখেন –

কবি আল মাহমুদ গ্রীক, রোমান পুরাণ থেকে শুরু করে লোকগল্প ও লোক শ্রুতি অকপটে ব্যবহার করেছেন। এবং প্রচুর সাহিত্যিক উপাদান ও ব্যবহার করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো “কাব্যগ্রন্থের সক্রেটিসের মোরগ এর উজ্জ্বল উদাহারণ।

ইহুদীরা হাসুক তবু সম্পদের সুষম বন্টন অনিবার্য
ইহুদীরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর
মানুষ মানুষের ভাই (ইহুদীরা – অ, বা , রা, বা)
সম্পদের সুষম ব্যবস্থা ইসলামের সুষম বন্টনের দিকেই ইংগিত করেন, যা যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা।”

সিন্দুকের তালা কি খেয়ে ফেলে সংরক্ষিত সোনার দিনার ? ইউসুফের সেই কঠিন যুক্তির কাছে সমস্ত
রূপ ও লালসার আগুন নিভে যায়।

আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবি। যিনি শুধু একটি টিনের সুটকেস নিয়ে শুধু কবিতাকে অবলম্বন করে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ জ্ঞান বৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অকিঞ্চিৎকর দান বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। লোকজ উপাদান, নারী, রাজনীতি সচেতনতা, আশাবাদ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দ বয়ন কৌশল তাঁর কবিতার অনন্য সম্পদ। তিনি কবিতায় গভীরভাবে খোঁজেন জীবনকে, মানুষকে, প্রেম ও প্রকৃতিকে। কবির জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ ই জুলাই। আসছে ১১ জুলাই কবির জন্মদিন। কবির ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। কবি সুস্থ্য থাকুন। ভালো থাকুন। তিনি দীর্ঘায়ু হোন।

তথ্যসূত্র –
আল মাহমুদ কবি ও কথাশিল্পী – কমরুদ্দিন আহমেদ
আধুনিক বাংলা কবিতা বিষয় ও প্রবণতা – ফজলুল হক সৈকত
এবং ইন্টারনেট।

একুশের হরফ

তুমি তো বাংলিশ লেখো
বালিয়ারীর তীরে শয্যা নিয়েছো মাতাল শারাবের
আমাদের এখানে চিতুই নদীর তীরে পালা পার্বন
একুশের কবিতার হরফে লাল রক্ত
আমাকে আর বলো না সমুদ্রে যাই
রেংগুন ভুলে গেছে শরম —

রাত শিকোয়াতে তোমার রেগে যাওয়া
চেহারায় প্রেম রোগ লেগেছে
রক্ত লাল চোখে শীতের অসুখ
সব বেদনার কথা বলে না দিলে হয়
সব অনার্যও জানে অসুখ কারে কয় —

ডাহুক

নাভির কাছে ডাহুক এলে শিল্প খোদাই করে দেখি
কতটা নিকোটিন লুকিয়ে থাকে ।
ছাই হবে , ভস্ম হবে দোল যাত্রার কালে –
চকমকি পাথরের বুকের ভেতরের আগুন জ্বলে উঠলে
আমি চুমু খেয়ে দেখে নেবো কতটা আগুন তাতে –
কতটা জল হলে ,কন্ঠার হাড় ঠেলে জানাবে না দুঃখ ভালোবাসা ।
হে আমার প্রদীপ ঘুমাও তুমি
আন্ধার হোক রজনী –
সন্ধ্যামালতি ফুটুক ।
আমার বুকের ভেতর অমরাবতী গান গাক –
আমার ভুলে ভুলে কামিনীর রঙ বদলাক –
জানবো না জানতে চাই না কোনদিনও –
কতবার ভুল করলে সন্ধ্যার লেক বিষন্ন হয়
পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ছায়া মাপে পাহাড়ের –

মুরংকন্যা

আজ তোমাকে আমার বলা হয় নি, তোমাকে আমার অনেক কথাই বলা হয় না। তুমি অবিরাম বলে যাও, আমি ঈষৎ হাসতে হাসতে শুনি। মাঝে মাঝে হাতের নড়াচড়ায় গ্লাস পড়ে যায়, শব্দ করে চাঁদ উঠলে তুমি বাঁকা হয়ে দেখো। হাঁটো আনমনে। পূর্ব প্রেমিকাদের থ্রি কোয়ার্টার জামা পড়ার স্মৃতিতে বুঁদ থাকো। নিকোটিনের তীব্র গন্ধ নিয়ে দূরে যেয়ে বলো, আমি ভালোবাসি মন প্রাণ দিয়ে, প্রেমিকারা কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। তারা ছেড়ে গেছে, আমি ছেড়ে যাই নি।

রিকসায় হুড টেনে তোমাকে বলি চোখ বন্ধ করে দেখো একটা দুর্দান্ত মাঠ, একদল নবীন খেলোয়াড়, আর তুমি –
তবু নস্টালজিকতায় বুঁদ থাকো – পাহাড়ী ঘোড়ায় চড়ে যখন তোমার পা ভেংগেছিলো, বুকের ভেতর জমে গেছিলো চর, পদ্মায় শুকিয়ে গেছিল বালি, ধাক্কা খেলো ভরা নদীর লঞ্চ – তুমি বলো আসলে সে কিছু না। ভুল পথে চাঁদ চলে গেছে। আমিও বলি চাঁদ ভুল পথেই গেছে – যেমন তুমি যাও, ভাংগো নদীর মোহনা, সমুদ্রের মাঝখানে যেয়ে বলো আমি ভুল করে চলে এসেছি – বাঁচাও কাদম্বিনী !!

বলা হয় নি — সাঁওতাল পাড়ার চাঁদ ভুমিতে চলে এসেছে, মুরংকন্যা নগ্ন মোমের শরীর নিয়ে তোমার পাশে শুয়ে থাকে – তুমি তীব্র নিকোটিনে ডুবে থেকে শরীর ভুলে থাকো।
ভালোবাসা কারে বলে প্রশ্ন থাকে মুরংকন্যার কাছে – সে তাঁত কেটে কেটে জীবন বানায়
বলে “শোনো যুবা ভালোবাসা এরেই বলে” —

মায়া হরিণ

গত মাসে পাঁচটা ঘুমের বড়ি খেয়েছিলাম। সে যখনই মুঠোফোনে নক দেবে এবং তুমি সামনে বসে চুমু খাবে সারল্যের
তখন কি করে বলি আমার আত্মা খড়ায় হয়ে গেছে চাকনা চুর –খুলে গেছে প্রতিটি ফুলের পাপড়ি – অথচ বর্ষণ যেনো মায়াহরিণ –
ওই পারের যমুনা নদীতে কাড়ি কাড়ি টাকা – বোল্ড খুলে – আনে নেয় – আর গরম এলে এসিতে ঠাণ্ডা করে শরীরের রোমকূপ –
আমি তৃষিত হৃদয়ে থাকি। অথবা আমরা চেয়ে থাকি। আমাদের তো খড়ায় নদী শুকিয়ে বালির রাস্তা –
ঠোঁট আর মায়ের চোখের পাতায় আটকে থাকে ঐ ফারিশতাদের ঘরের দরজা —

_______
২৬।১।১৭

ফরলুম

হচ্ছে কি!! অবলীলায় দিয়েছ সব নিকেশ। শেষ প্রহরে রীতিবিরুদ্ধ গজিয়ে ওঠা কুচবরণ কন্যার ওষ্ঠে এক নগরীর শেকড় বেড়ে ওঠে। সম্পাদকীয়তে লেখা তিনি ব্যাবিলনের পুর আমলের এ্যাম্পায়ার – যদিও টুপি নেমে গেছে হাঁটুতে, খেয়াল অথবা টপ্পায় তিনি ততোধিক রসিক।
তাম্বুল রসে ঠোঁট রক্তাভ, পোড়া ছাই এর গন্ধে ভারী পৃষ্ঠ।
রজকিনী কন্যা উড়ছো কেন এতো?

দ্রাব্য

এই শহরটা দ্রবীভুত হয়ে আমার শরীরে
আমার শরীর দ্রবীভুত হয়ে এই শহরে
হাঁটছি
গিলে খাচ্ছি
আর থু থু ছিটিয়ে পরিষ্কার করছি গলগন্ড

তুমি মেসোস্ফিয়ারে দশজন হয়ে হাসছো
কুয়াশা ভেদ করে তোমার দশ একশত জন হয়েছে
রাস্তা এই শহর তুমিময়
তুমি একটা বৃত্ত তৈরী করছো আমি কেন্দ্রে
আমি কেন্দ্র থেকে ছুটে যাই পরিধির দিকে
পরিধি ভেদ করতে গেলে
শত শত তুমি বেরিকেড তৈরী করো

তুমি আমার উপরে খাও
গড়াগড়ি করো
খেয়ে দেয়ে আমার উপরে কুলকুচি করো
আমার পিঠের উপর চেয়ার পেতে আয়েশ করো
একটা সিগার ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ো
বৃত্তের মতো কুন্ডলী পাকায় তোমার ধোঁয়া
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আয়েশ করো
পরম ওম ওম সুখে
পুরুষ হাঁসের মতো আরামের নিঃশ্বাস ছাড়ো আহ !!

লসিং

বুঝতে পারছিলাম হারাচ্ছি তাকে –
যখন সকালে উঠেই তাকে বলেছি একা লক্ষ্মীন্দরের ঘরে যেও না।
ওর ঘরে সাপ আছে ।
সে শুনলো না কথা । সাপের ঘরেই তার পা রাখা চাই।

আমি ওর চোখজোড়া খুলে নিলাম । সে অন্ধ হলো না।
কি এক জোনাক পোকার গন্ধ নিয়ে ছুটে গেলো অন্দরে।
সাইক্লোনে আমার ভয় ভীষন । অথচ তার ভালোবাসা সাইক্লোনে।
বলেছিলাম উড়ে গিয়ে গাছে আটকে থাকো।
সে জটাধারী এক কাপালিকের গা জড়িয়ে ধরলো।
সামনেই আগুনের একটা জ্বালামুখ।
বিচ্ছিন্ন নারকীয় দৃশ্য দেখার জন্য কাপালিকের বুকের ভেতরে ঢুকে পড়ি —

লিলিথ

চলুন অধ্যাপক সাহেব আর একবার ঘুরে আসি ইতিহাসের পাতা ধরে।
ধরুন কমলালেবু একটা স্বর্গ। আপনি একটা নরক।
আপনি লিলিথের হাত ধরে চলে গেলেন স্বর্গের মধুর নহরে।
ওই যে দেখুন উলটো করে শুয়ে আছে আঙ্গুর গাছ।
তাকালেন না সেদিকে। কেননা আর একটা চিৎ হওয়া গাছে ঝুলে আছে হুরীর নগ্ন শরীর।
আপনি নহরের ধার ঘেঁসে মুসার লাঠিকে বাহন করে
ওর হাত ধরে ভাবছেন সিসিলি উপত্যকায় বাতাস খেতে খেতে স্বর্গের স্বাদ নেবেন।
তাও হলো না, কেননা আপনি ভাবছেন যতটা দূরত্ব পোল্যান্ড ততটা দূরত্ব কি স্বর্গ ?
রাশি রাশি ডলার আর মুদ্রাতেই যদি পার্থিব স্বর্গ কেনা যায়
তবে ভাবছিলেন এই নরক কাম্য হোক।
একদিন এই নদী আর মধুর নহর সবই বিষের মতোন লাগে।

কলংকিনী রাধা

আমি তোমার ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দেবো
গায়ের গন্ধে মাতাল হবে তুমি
যেভাবে মাঝ রাস্তায় চেপে ধরে বলেছিলে
কেনো যাস ওদিকে ?

চরম বেলাল্লাপনায় ছি ছি করবে লোকে
তবু কলংকিনী রাধার মতো
তোমার কাছে রাত বিরাতে ছুটে যাবো –

সহস্র বছর শুয়ে থাকবো পাশাপাশি কবরে
যে কথা বলতে পারিনি লোক সমাজে
সে কথা উচ্চস্বরে বলবো
নিয়তির মতো করে —

প্রজাপতি

এক অনুক্রম ছিলো গত সৌর বৎসরে। তখন বন্য ছিলাম – রেগে ছিলাম – প্রেমে ছিলাম।
গভীর এক রাতে বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছি দীর্ঘশ্বাসের ধারাবাহিক পরিক্রমা।
রূপায়নের রাজধানীতে আরবী মেয়ের চোখ দেখে জিজ্ঞেস করেছি ভালোবাসতে পার ?
সে উত্তরে বললো – বাংলাদেশ।
ওর নরম হাত ছুঁয়ে বলেছি – স্নান করবে কন্যা ?
সে স্নান জানে না। একদল বন্য শুকরের মধ্যে পড়ে চিৎকার করে – বাঁচাও মোহতারেমা –
আমার বধিরতা দীর্ঘ বর্ষায়। এখন ফাল্গুন মাস। কিছুটা সুরের ধ্বনি খেলা করে বুকে।
অথচ অন্ধ হয়েছি।
আরবী কন্যার মোহতারেমা ডাক কান ভেদ করে পৌঁছেছে হৃদপিণ্ডে – হাত ধরেছি ওর।
শান্ত হও কুমারী। আমাদের স্নান ঘরে চারটা প্রজাপতি রঙ্গিন পাখা মেলে উড়ছে।
আমরা অচিরেই তুষারে স্কি করবো –

শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থী

একজন মা তার সন্তানের শিক্ষককে সাধারণত বলেন – আপনি শুধু আমাকে হাড্ডিগুলা ফেরত পাঠাইয়েন। তাইলেই চলবে।

এই যে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র /ছাত্রীদের মারার সংস্কৃতি সে বহু পুরনো। একসময় অভিভাবক ও ভাবতেন শিক্ষকের অধিকার আছে তার শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেবার। এবং এই মারপিট করলেই সে পড়াশোনা শিখতে পারবে। ছোটবেলায় আমরা এক মাস বা দুই মাসের জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতাম। আমার কাজিনদের সাথে ওদের স্কুলে যেতাম। আমার এখনো মনে আছে এই শিক্ষকরা কিভাবে গরুর মত পেটাতেন ছোট ছোট বাচ্চাদের। আবার আমরা শহরের স্কুলেও দেখেছি শিক্ষকদের ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াশোনার নাম করে এভাবে নির্বিচারে শাস্তি প্রদান করা। পরের ছেলের গায়ে এভাবে মারামারি করতে হাতের আরাম মনের সুখ। এখানে মনস্তাত্বিক ব্যপার কাজ করে।

যে শিক্ষক ছোটবেলায় নিজেরা যেই আচরণ পান তিনিও সেই আচরণটাই করেন।এই সমাজ প্রভাব প্রতিপত্তি ভালোবাসে। স্কুলে অভিভাবকরা অনেকে অনেক বড় বড় পেশায় আছেন। তারা তাদের সন্তানের স্কুলের শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান এবং সমীহ করেন। ছাত্র /ছাত্রীদের কাছ থেকেও সমীহ পান। সব মিলিয়ে নিজেকে বড় ক্ষমতাধর মনে করেন এবং তার রিফ্লেক্ট তারা শিক্ষার্থীর উপর চাপান। এই সম্মান পেয়ে তাঁরা নিজেদের কি ঈশ্বর ভাবেন ?

আমার ছেলের শিক্ষক একদিন বললেন আপনার ছেলে পড়া শিখে নাই। দুষ্টুমি করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যদি পড়া না শিখে আপনি কি করেন ? উনি বললেন আমি তাকে মাইর দেই। আমি বললাম মাইর দেয়ার জন্য তো আমি স্কুলে পাঠাই নাই। আমি পাঠিয়েছি সে যেনো পড়াশোনা ঠিকমত করে – পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়। সে পড়বে আনন্দের সাথে। আপনি ওকে মোটিভেট করার জন্য কি করেছেন ? উনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমরা সবাই মাইক্রোস্কোপের নীচে পেঁয়াজের কোষ দেখছি। উপুর হয়ে দেখছিলাম। হঠাত আমার পিঠে ব্যথায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলাম। ফিরে দেখি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক নজরুল স্যারকে। জালি বেত নিয়ে আমার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে আছেন। সেদিন জিজ্ঞেস করবার সাহস হলো না কেনো আমাকে মারলেন ? উনি কি ব্যাখ্যা দিলেন আমার মনে নাই। শুধু মনে আছে চোখে জল নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়েছিলাম।

আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার পড়াতে এসে সব মেয়েদের গায়ে তার নোংড়া হাত ঘুরাতেন। স্কুলের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আমরা বড় হই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়। যারা আবার শিক্ষকতার পেশায় যায়। তারা তাদের পূর্বতন শিক্ষকদের নিকট থেকে যে আচরণ পান সেই আচরণ তিনি পরবর্তী জেনারেশনের উপর প্রয়োগ করেন।

আমাকে একদিন একজন বললেন – আপনারা মানুষ গড়ার কারিগর। (যেহেতু আমি নিজেও শিক্ষকতার পেশায় ছিলাম )। তখন বলছিলাম এভাবে বলবেন না। আমাদের প্রচুর শিক্ষক আছেন যারা খুব ভালো চরিত্রের অধিকারী না। বেল্ট ক্লাসে একজন ম্যাডাম ছিলেন উনি বলতেন দেখেন আপনি ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতিযোগী না। তাদের ঝামেলায় ফেলার জন্য না সহযোগিতার জন্যই আপনি শিক্ষক। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। মিথ্যে না। পড়াশোনা করেই জাতি এগোয়। এর বেসিক কাজটা শিক্ষকরাই করে থাকেন। তাদের আমরা সেই সম্মানটাই দিতে চাই।

কিন্তু কতিপয় শিক্ষকের এই মনস্তাত্বিক সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন। অরিত্রির মতো বাচ্চাদের আমরা হারাতে চাই না। পরীক্ষায় মোবাইল নিষিদ্ধ। খুব ঠিক আছে। কিন্তু এর জন্য তার প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ না করলেও হতো। পরীক্ষা হলে মোবাইল আনার শাস্তিস্বরূপ তার পরীক্ষা এক ঘন্টার জন্য স্টপ রাখা যেতো। অথবা তার পরীক্ষা সেদিনের জন্য স্থগিত রাখা যেতো। তাকে পরের ক্লাসে প্রমোশন দেয়ার সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা যেতো। এরকম আরো বহু পথ আছে। সমস্যা থাকলে সমাধান ও আছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর শত্রু না বন্ধু আবার মা-বাবার মত তাদের অন্তরে মমতাও থাকা জরুরী।

এখন নিজের যখন জেল হবে, চাকরীটা সহ হারাবেন তখন উনি বুঝবেন – এর চাইতে বিষয়টাকে সুন্দর ভাবে সলভ করলে আজ এতোকিছু হতো না। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখতে পেতেন – ক্ষমা কখনো কখনো দুর্বলতা না – ক্ষমা আরো দশটা কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারে।