নাজমুন এর সকল পোস্ট

#মি টু

কেউ একজন বললেন সবাই যখন হ্যাশট্যাগ মি টু নিয়ে সরব তখন আমি কিছু বলছি না কেন ?
একটা মেয়ের জন্ম হলো এবং সে জানেনা চারপাশে কি পাইথন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মা তাকে আগলিয়ে রাখেন, বাবাও আগলিয়ে রাখেন। কিন্তু ওর যদি অনেকগুলো ভাইবোন হয় তবে তাকে আগলে রাখার সময় কই এতো ?
অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি বাচ্চাকে সে সমজেন্ডার হলেও ধরা ছোঁয়া নিষেধ। ফুলের মতোন বাচ্চা কিন্তু কেউ ছুঁয়ে আদর করতে পারবে না। দূরে থেকে শুধু একটু হাসি দিয়ে আদর দেখানো যাবে।

সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম – এক টিনেজ মেয়েকে এই পৃথিবীতে একা রেখে তার মা মারা গেলেন। তার বাবা অলরেডি তার মাকে ছেড়ে চলে গেছেন। সে তার বাবার বাসায় গেলো। বাবা তার নতুন স্ত্রী নিয়ে সংসার পেতেছেন। সে সংসারে আবার নতুন অতিথি আসবে। তাই তার বাবা আর তার সৎ মা অপরাগতা প্রকাশ করলেন তাকে এই সংসারে আশ্রয় দিতে। ঘর থেকে বের হবার সময় তার বাবা বললেন – মামনি ভালোবাসি তোমাকে। সেও বললো আমিও তোমাকে ভালোবাসি বাবা। বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে আপ্লুত হয়েছিলাম। একবারো ভাবলেন না এই বাচ্চা মেয়েটা কোথায় যাবে ! তিনি নিজেও পুরুষ। তিনি জানেন এই পুরুষকুল এই মেয়েকে আস্ত রাখবেনা। অথচ তিনি তার মেয়েকে বাঘ সিংহের খাঁচার দিকে ঠেলে দিলেন। যাই হোক উপায়ান্তর না দেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে সে এলো তার আত্মীয়ার বাসায়। ভদ্রমহিলা তাকে খুব যত্ন করেন। তার স্বামীও যত্ন করেন। কিন্তু ভদ্রলোক যত্ন করতে করতে একদিন বেশিই যত্ন করে ফেলেন। সে বের হয়ে গেলো। ঘরের বাইরে পুরো বিশ্ব তার জন্য ডেঞ্জারজোন। তবু এক ভদ্রলোক সহানুভূতি পরায়ণ হয়ে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখা গেলো তার কাতর স্ত্রীকে। ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী তাকে যথেষ্ট যত্ন আত্তি করলেন। এবং ভদ্রলোক নিজেই তার শরীরের সুবিধা নেয়া শুরু করলেন। মেয়েটা এবার রাগ করে বের হয়ে যেতে পারলো না। সে আর কত জায়গায় ফিরবে !!

কিন্তু সমস্যা হলো ভদ্রলোক নিজে ভোগ করেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি তাকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। অসহ্য হয়ে মেয়েটা আবার বের হয়ে এলো। সেই আত্মীয়ার কাছে গেলো পুনরায়। এবং ততদিনে সে ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। ওর আত্মীয়া তাকে একটা সংস্থায় নিয়ে গেলেন। সেখানে আরো অনেক টিনএজার ছেলেমেয়ে আছে। প্রত্যেকেই দেখা গেছে কোনো না কোনোভাবে সামাজিক বা পারিবারিক বা যৌননিগ্রহের শিকার।

… সিনেমাটা এমেরিকার ব্যাকগ্রাউন্ডে করা। বোঝা যায় পৃথিবীর সব নারী সব মেয়ে শিশু একই ভাবে যৌননিগ্রহের শিকার হয়।

আসলে এটা একটা ঘটনা মাত্র। এরকম হাজারো লক্ষাধিক মেয়ে শিশু, কিশোরী নারীর নিগ্রহের ঘটনা ঘটে যায় মানুষের সামনেই অথবা অগোচরে। কিন্তু যা ঘটে নারীর সাথে নারী ভুলে না। সে তার শৈশব থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার কথা মনে রাখে, আসলে মনে রাখা না তার মনে থাকে। ভুলে যায় না। অভিশাপ দিতে থাকে সেই জানোয়ারদের।

মিটু এর জোয়ারে অন্তত কিছু প্রভাবশালী লোক যারা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় আছেন, তাদের বদ উদ্দেশ্য থেকে ক্ষান্ত হবেন। অন্তত কিছু মেয়ে হলেও রক্ষা পাবে। আমরা জানি তবু লোভী আরো বহুলোক তাদের কালো হাত বাড়িয়েই রাখবেন।
আমরা বলি আবু লাহাবের মত তাদেরও হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক।

খোয়াব

কবিতা -১
খোয়াব

হে আরাকান রাজা সকালে বাসট্রাকের পদশব্দে যদি আপনার ঘুম ভাঙ্গে
তবে বলুন প্রেম বলে আসলে কিছু নেই –

শূন্য দশকের পরে যদি কোনো শতকের গায়ে লেখা থাকে হালাকু খানের হিংস্রতা
তবে আপনি বলেছিলেন সাপের বিষে যেনো তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যু দেবেন অথবা নেবেন।
জমিতে বিষফোঁড়া। পা রাখলেই কাঁটার পর কাঁটা।
অন্তরাত্মা সহ বিদ্রোহ করে।।
শুন্যে ফ্লাই করা খুব সহজ যদি সে শুধু আত্মা হয় –
এই শরীর এই দুনিয়ার আচানক খোয়াবের ঝুরি !!

কবিতা -২
কবি শিশু

ম্যাডাম হিলারী চিতা পোষাক পরিধান করেছেন।
ভালুকের সাথে নেমেছেন বাকযুদ্ধে
শত্রুর সম্মুখে আসলে মানুষের আক্রোশ অবদমিত থাকে
তার অবদমন ছিলো – পশুদের থাকে না।
সৌকর্যে হেলেন – প্রজ্ঞায় তিনি রুবাইয়াত
এপোলো হে গ্রীক দেবতা
বনে ছুটে বেরানো বালিকা হিলারীর গর্ভে যদি জমে যায় তোমার ভ্রুণ
তাকে দিও একজন কবি শিশু।

নীল রক্ত (ছোট গল্প)

একটা খুন করতে ইচ্ছে করে আমার – যেমন সেটা ছুরি দিয়ে হতে পারে অথবা হতে পারে ধাক্কা দিয়ে পাঁচতলা অথবা বারো তলা থেকে ফেলে দিলে বেশ হয় –
আচ্ছা সে যদি উলটে পড়ে যায় কেমন করে তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হবে –
কেমন করে ছিটকে পড়বে মগজ ?
অথবা ভেংগে হাটু ভাঙ্গা দ এর মতো পড়ে থাকবে –
এরপর চারদিকে মানুষের জমায়েত – কেউ একপলক দেখবে কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে – কেউ ভয়ে দূর থেকে সরে যাবে আমার মতো –
আমি আসলে র নামের দস্যুটার কথা ভাবছিলাম।
সে আমার জীবন অস্থির করে দিয়েছে।
যেমন আজ সন্ধ্যাবেলা সে আমার আংগুলে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে বলেছে কেমন লাগে তানু মনি ?

আবার দুপুর বেলা টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে সবার সামনে ধুম করে ধাক্কা দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিলো। আমার সারা গায়ে নোংরা জল লেগে গেলে আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু চোখে জল এলো । মানুষজন আজকাল রোবট হয়ে গেছে। তারা কেউ কিছু বললো না। এমনকি আমার পাশের বাসার যে মহিলার বেড়ালকে আমি তিন বেলা খেতে দিয়েছি সেও কিছু বললো না। শুধু একপলক আমাকে দেখলো
এরপর মাছের চোখ নিয়ে চলে গেলো।
আমি যে র কে কিছু বলতে পারি না তার কারণ আবিষ্কার করতে আমার কত যুগ লেগে যাবে সে জানিনা —
র একদিন আমার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি তানুমনি। এরপর সে একটা কাঁচি এনে আমার চুল গুলো কেটে দিলো এবরো থেবরো করে –
তখনো আমি কিছু বলতে পারিনি।
চোখ ছলো ছলো করে শুধু তার দিকে তাকালাম –
সে খিক খিক করে হাসতে হাসতে আমাকে চুমু খেলো – সমস্ত শরীরে ঝড় ওঠালো। ক্লাসিক আবেদনে আমি ওর সব দোষ মাফ করে দিলাম। এত কষ্ট দেবার পরেও ওর ছোঁয়াতে আমি থর থর করে কেঁপে উঠি।
মনে মনে একলক্ষবার ‘ভালোবাসি ভালোবাসি বলি। সে কি বোঝে সে তিল তিল করে খুন করলেও আমি তাকে ছেড়ে যাবো না ?
আশ্চর্য টানা মায়াভরা চোখ ওর। ওর চোখ দেখে বার বার আমি খান খান হয়ে যাই !!

দুপুরটা কেমন যেনো মায়ায় ভরা। কেউ নেই ঘরে। উত্তর থেকে এই শীতের শুরুতে যে বাতাস বয় তাতে শরীরে অন্যরকম শান্তি হয়। আমি বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে বসি। আকাশ দেখি। পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখি।
র এর দেয়া কষ্ট ভুলে যাই। আনমনে গাই ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।। অথচ এ মিথ্যে। কেউ আমার ধ্রুবতারা নয় জীবনে।
আমার তো কেউ নেই। র’ নেই, বাবা নেই, মা নেই – কোনো আত্মীয় স্বজন নেই – এতো একা মানুষ কি করে থাকে ?

আমি ছাদে উঠলাম – এটা বারো তলা বাড়ি – ছাদ হলো তাহলে তেরোতলায় –
নীচের দিকে তাকালেই গা হিম হয়ে আসে —
র আমাকে ছাদের কিনারে এনে বললো দেখো তো তানু কত উঁচু বাড়ি !!
তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই এখান থেকে বলে সে আমাকে প্রায় উলটে ফেলে দেয় আর কি !!
ভয়ে আতংকে আমার গা কাঁপতে লাগলো -চোখে জল এলো –
তবু র কে আমি কিছু বললাম না – ওর চোখে চোখ রেখে শুধু বললাম র আমি তোমাকে ভালোবাসি —
তুমি কেন এত নিষ্ঠুর আমার সাথে ?
র গান ধরলো – সে চমৎকার গায়
তুমি বিনে আকুল পরান
থাকতে চায় না ঘরেতে –
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
আমি এই মিনতি করি রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
র এর কন্ঠ, গলায় আবেগ অসাধারণ – তার গানের সাথে আমি নেশায় আকুল- ভুলে গেলাম সব
সে ফের গাইতে লাগলো
সাগরে ভাসাইয়া কুলমান
তোমারে সঁপিয়া দিলাম আমার দেহ মন প্রাণ –
সর্ব সাধন করিলাম দান
তোমার চরণের তলে রে
ভুইলো না আমারে —
আমার মনে হলো আমিও সেরকম তার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছি –
আমার কন্ঠ রুদ্ধ – আবেগ সাপের মত বিষ হয়ে কন্ঠাকে চেপে ধরেছে —
র গাইতে গাইতে বিল্ডিং এর দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে – আমি পেছন থেকে বাতাসে উড়তে থাকা তার পাঞ্জাবীর কোনাকে বেসামাল হতে দেখি। ওর চমৎকার চুল শির শির করছে বাতাসে। কি সুন্দর তার সুঠাম শরীর।
তবু ওকে ঘৃণা করি। ভালোবাসি। প্রতিদিন একবার করে প্ল্যান করি খুন করার জন্যে।
আমি এক পা দুপা করে র এর কাছে এগিয়ে যাই — র চলে এসেছে একদম রেলিং এর শেষ প্রান্তে – যদিও প্রায় এই তেরোতলা উপর থেকে নীচে সব দেখলে শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসে –
র আমার উপস্থিতি মনে হয় ভুলেই গেছে। প্রায় চোখ বন্ধ করেই গাইছে —
আমারে ছাড়িয়া যদি যাও
প্রতিজ্ঞা করিয়া বলো
আমার মাথা খাও —
আহা ! এত রিদম ! এত আবেগ ! আমার চোখে জল এলো –
কিন্তু —-
আমি পা টিপে টিপে তার পেছন পেছন এসে তার পিঠের মাঝ বরাবর হাত দিলাম যেখান থেকে ধাক্কা দিলে একদম সে নীচে পড়ে যাবে — ভারসাম্য রাখার মতো কিছু থাকবে না –
আচ্ছা সে যদি পড়ে যায় তেরো তলা থেকে তখন কি তার রক্ত নীল হয়ে যাবে ?????
————

স্ন্যাপশট

একদিন এই শহর জানবে
আমরা প্রেতাত্মা ছিলাম ।
ভালোবাসার খেলায় বুকের নুন
সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে
চোখে চোখ রেখে বলেছি
‘ ভালোবাসি’ ।

আঁধার পার হলে
সময়কে অতিক্রম করে বলি
‘আসলে সব মিথ্যে ছিলো’ –
পাথরের গায়ে যে পাথরকুঁচি গাছ
সে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছে –
আমাদের এক চুমুক হাসি ০০০

শিল্পকলায় তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস –
আহা এতোক্ষণে সময় হলো বুঝি !

প্রেতাত্মাদের তো রাত থাকে না , না দিন
তবু আমাদের বেড়াল জীবন ০০

একদিন আমার সহ প্রেতাত্মার সাথে
বনের ভেতর হালকা পায়ে চলতে দেখে
এক বালক স্ন্যাপশটে আমাদের মানব মানবী বানিয়ে
আকাশের গায়ে লেপ্টে গিয়েছিলো —
বলেছিলো –
‘তোমরা ঐখানে থাকো – তোমাদের ওখানেই মানায় ”

বিভাজন

এভাবে মুখোমুখি না হলে কি হয় ?
কাঞ্জনজঙ্ঘা কি হেলে দুলে বিকেল পার করে ঘরামি আসবে বলে ?
তুমি কি চাইতে পুদিনা পাতার শরাব ?
অথবা ঘোর কেটে গেলে জান্নাতের হুরী গেলবান থেকে মুখ তুলে বলতে –
‘এতো ঘোর কেন আজ বিকেলে’ ?
এক চিলতে বারান্দায় পাশাপাশি বসে কি ছিলো সব অশরীরী কথা –
মধ্যখানে আমাদের আকাশ নেমে দু ভাগ হয়ে গেছে –

লেবুপাতা মাথায় ঢুকে গেছে ব্যাধির মতন – শুধুই ঝি ঝি অন্ধকার –

গুহামানব

ঘোর অমনিশায়
আমার সব কুয়াশা লাগে —
ধোঁয়া ধোঁয়া রাতে
তুমি কার সাথে কথা বলো !!
সমুদ্র দূর হাজার মাইল
অথচ তোমার মুঠোফোনে বার্তা আসে
আজনবী এক বাহিনীর
তাদের ঘর নাই
বাড়ি নাই
ধু ধু মরুর কালা ঝড় –

তোমাকে নিশানা করেছে কালাশানিকভ
তুমি ফিরে এসো গুহামানব – —

পুরুষ সিংহের ন্যায় – পুরুষসিংহ

ধরো একুশ বছর পর আবার দেখা হলো আমাদের
সেদিন আমি তোমার হাত কাটবো
দাঁত উপড়ে ফেলে দেবো
জিভের ডগায় সুঁচ ফুটিয়ে দেবো –
এরপর প্রতিদিন আমরা শিল্পকলায় যাবো
বিস্তারে দুপুর হলে ভাত খাবো
আর তোমাকে খাইয়ে দেবো —

সন্ধায় আমরা সিন্ধু নদীর তীরে খয়েরী চাঁদ দেখবো
হাওয়ায় দুলতে দুলতে তোমার প্রেম দেখে শিহরিত হবো
কোঁচকানো চামড়ায় থির থির করবে ভালোবাসার নিমপাতা
আহা !! ভালোবাসা এতো ভালো
কে জেনেছে আগে তা !!

দেশ বৈদেশ

**
আজ ট্রেনে সামনে বসলো চরম সুন্দরী এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। অবশ্য ওরা অনেকেই ভীষন সুন্দর। লালচে সোনালী চুলের মিশেলে মেয়েটার হাত পা সবকিছু এতো সুন্দর। চোখে পড়েছে সিলভার কালারের চশমা। ওর ওভারকোট, ব্যাগের রঙ জুতোর কালার এক।

আমি ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছি আর ভাবছি ওর মা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী। আশ্চর্য যে, ওর পাশেই বসেছে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে। সাথে ওর বাচ্চা। দুজনই এতো কালো যে কালোর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ওরা দুজন পাশাপাশি বসাতে আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ওদের দুজনের মনের মধ্যেকার ভাবনা চিন্তা না জানি কেমন ! আমি এখানে কোনো কালো মেয়েকে খুব উচ্ছ্বল হয়ে হাসতে দেখিনি। খুব যেন মন খারাপ। কারো দিকে তাকায় না। শুধু নিজস্ব ঘরানার মানুষজনের সাথেই কথা বলে।
আচ্ছা ওরা হাসে না কেন ? ওরা কি অন্যদের মনের ভাষা বোঝে ?
মানুষ তো আসলেও রেসিস্ট। রেসিসিজম থেকে মুক্তি নেই।
আমি কালো মেয়ের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর বয়েস মাত্র একবছর বা তার বেশি কিছু হতে পারে। আশ্চর্য এটুকু বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। নিশ্চয়ই এই ছেলে জিনিয়াস হবে। মানুষের চোখের ভাষা মনের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তো বড়দেরই হয় না। আর শিশু !!

**
নেডা – নামে যে ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন – ভদ্রমহিলার বয়েস মিনিমাম ৭৫ হবে। ছয় ফিট লম্বা প্রায় -স্লিম। শরীর শক্ত পোক্ত হলেও প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু খুব উদ্যমী। ওরা এন্থোয়াসিয়াসটিক শব্দটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাই প্রতিটা জবের পাশে এই উদ্যম শব্দটা খুবই আবশ্যিক ভাবে থাকে। উনি লেকচারের মাঝখানে প্রায় নিজের ফ্যামিলি, ছেলেমেয়ের গল্প করেন। তার মেয়ে আইটি প্রফেশনাল। কথায় কথায় এখানে ধনী, গরীব এবং মধ্যবিত্তের একটা ফারাকের কথা বলেন। ধনীদের এটা সেটা, মধ্যবিত্তের এই প্রবলেম সেই প্রবলেম ইত্যাদি। গর্বের সাথে জানালেন ওনার মেয়েকে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কলেজে পড়াননি। সরকারী স্কুল কলেজে আর দশজনের মতো পড়িয়েছেন। বুঝলাম যে এখানেও বাংলাদেশের মতো ধনী গরীবের স্কুল আছে। কিন্তু ধনীর স্কুল কেমন গরীবের স্কুল কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রতিটা স্কুলের সামনেই বড় সবুজ মাঠ আছে। সেই মাঠ আবার প্রতিদিন যত্ন করে ঘাস কেটে একে সবুজ মসৃণ আদল দেয়া হয়। বাচ্চারা হইচই করে খেলে, ইচ্ছামত দৌড়াদৌড়ি করে। দেশের বাচ্চাদের কথা ভাবলে কষ্টই লাগে। ঢাকা চিটাগাং বড় শহরগুলোতে বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠই নেই।

ভালো হলো অস্ট্রেলিয়া এখন মিক্সড মানুষের দেশ। কত সংস্কৃতি কত দেশের মানুষ যে এখানে আসছে – এসেছে – দেখলে অবাকই হতে হয়। সিরিয়ান রিফ্যুজিদের এখানে অভয়ারণ্য, রোহিংগা প্রচুর। আমাদের ক্লাসে আছে এক কোরিয়ান মেয়ে। ওর নাম জেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার দেশ কোথায় – সে এমনভাবে কোরিয়া শব্দটাকে বললো আমি শুনলাম ক্রিয়া – ওরে বার বার জিজ্ঞেস করলেও সে একই ভাবে ক্রিয়া বলল। মনে মনে এই ক্রিয়া দেশ কোথায় আছে সেটা ভাবছিলাম। এরপর বললো সে এসেছে তার পার্টনারের কাছে। তার পার্টনারের বাসায় পার্টনারের মা-বাবার সাথে থাকে। ওর মা এর আবার আগের হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার হাজব্যান্ড তার চাইতে দশ বছরের ছোট এবং আগের ঘরের ছেলে পরের ঘরের আর একটা মেয়ে এবং ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং স্বামী সহ চমৎকারভাবে মিলে মিশে আছেন। জেনিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম -জেনি তুমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবা ? সে বলে যে -নো – কেন জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে নো মিন্স নো –
আমি চুপ করে গেলাম – বাংলাদেশের কাদামাটি লেগে আছে গায়ে – ভাবনার চেঞ্জ আনতে হবে চিন্তা করছিলাম –

**
আজ দুপুরে বেরোতেই উষ্ণ বাতাস, রোদের তেজ – বুঝলাম একদিনেই শীত চলে গেলো বলে এখানে – কেউ কেউ এখনো ফুল হাতা সোয়েটার, জ্যাকেট পড়েছে। আহা বসন্ত – বসন্তের শুরুতেই হাড়ের ভেতর ফুটে যাওয়া শীতকে বিদায় জানাতে পেরে এতো ভালো লাগছিলো। এখানের শীত কাতরই করে আমাকে। নেভিটাস থেকে বের হলে কয়েক গজ সামনে একটা বড় মাঠ পড়ে। মাঠের সামনেই ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী। মাঠের পাশে পাশে বেঞ্চি দেয়া আছে। আর গাছের এতো নুয়ে পড়া। মনই কেমন করে আমার – আজ বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হলে বের হয়ে এমন চমৎকার বাতাস আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারী পরিবেশে মনই ভালো হয়ে গেলো। এরকম সময়ে উচ্চ দার্শনিক চিন্তাই মনে আসে। আহা এই পৃথিবীতে মানুষ আসবে মানুষ যাবে। আর আমরা সব মানুষ খাওয়া পড়া বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে থাকবো করতেই থাকবো – ইত্যবসরে জীবন পার হয়ে একদিন বলবে এই পৃথিবী তোমার জন্য নয়।

না হোক – তবু এই সময় পাখির কোলাহলে এমন ঝিম ধরা আনন্দ হলো। চোখের চারপাশে উপরে নীচে আশে পাশে নিরব নির্জন মাঠে এক দৌড়ে পার হয়ে ছেলেবেলার মত মনে হলো ছুঁয়ে যাই সব আনন্দ। আহা জীবন – এতো ছোট কেন ! এত সংকীর্ণ কেন ?
তবু মন কেমন করা এই আকাশ বাতাসে বেঁচে থাকা আর একবার সার্থক মনে হলো ।

মনোরম পরিবেশ আর একজন একাকী মানুষ।

কারো অপেক্ষায় বেঞ্চিগুলো।

কি কথা তার সাথে

আন্তিউস-চলো এলোমেলো হয়ে যাই —
চলো একটা থামের আড়ালে চুমু খাই –
বেনারসে রাধা যেমনি জঠরে পাকিয়েছিলো
দশটা সন্তান –
তেমনি সন্তান হোক তোমার –
আন্তিউস তুমি বেদনাহত পেঁচা –
রাত ঘন হলে হা হা করে পাখা মেলো –
চুপি চুপি ওদের সাথে কথা বলো –
কি কথা তাদের সাথে??

ওরা তোমার চোখের মণিতে এঁকেছে ট্যাটু –
তুমি অন্ধ হয়েছ –
শালুকের দেশের পাখিদের বোবা কান্নার সাথে মিশেছে
নাজারাতের পরীদের অন্ত:ক্ষরণ —

সন্ধ্যে

Capping off the first real weekend of summer
in Metro Vancouver.

পরিপূর্ণ উম্মাদ হবার আগে আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি চুমু খেলেন আমার হাতে এবং বাজুতে।
নাভির সন্ধিস্থলে হাত রেখে বললেন ব্যথা হয় তোমার ?
আমি জানি না ব্যথা কি ? উম্মাদ হবার প্রথম স্তর ব্যথা বুঝতে না পারা।
তিনি আমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললেন – বলো তো আকাশ কেমন ?
বুঝতে পারছিলাম একটা মগ্ন আকাশ আমাকে ঘিরে রেখেছে।
হাত ধরেছেন রাণী জারা –
মনে হলো সেতারা আর রাহুর ঘোরে আটকে আছি অনন্ত কাল !
তখন কি সন্ধ্যে ছিল ?

কৃতজ্ঞ হে ঈশ্বর

তীব্র ব্যথায় রাত গভীর হলে বুঝেছি মৃত্যু হয়েছে আজ আটদিন।
তোমার মৃত্যুর কিঞ্চিত আগে।
রিকসার পা দানিতে পা রেখেছ যেদিন
সেদিনই বলেছি মৃত্যু গ্রহীতার মতন।
সুফি গানের রিদমের সাথে ওঠানামা করে আবেগের সুতো।
রোদের ভেতর রোদ আকাশের ভেতর দড়ি পাকানো তুলো –
উপুর হয়েছে আমাদের কবরে।
আমরা শুধু বলেছি সুরা মনে করে
আর কোনো অকৃতজ্ঞতা নেই ঈশ্বর হে –
অনন্ত জীবনে আর একবার ক্ষমা করে পাঠাও
অপার্থিব প্রেম পাঁজরে –

দেশ – বৈদেশ

১০
অস্ট্রেলিয়া এখন মিশ্রকালচারের দেশে পরিণত হয়েছে। এত এত মাইগ্রেন্ট বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে এবং আসছে যে আমার মনে হয় একসময় অরিজিনরা নিজেদের হারিয়ে ফেলবে তাদের মধ্যে। চাইনিজ মনে হয় প্রায় সবচাইতে বেশী মাইগ্রেন্ট হয়ে আসছে। সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে পাখির মতন কিচকিচ করে কথা বলে। তারা যেখানেই যায় সাথে করে ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে যায়। অল্পবয়সী মেয়েগুলো খুব মিষ্টি দেখতে। ওদের মুখের স্কিন যেন লেমিনেটেড শীট। আমার হিংসেই হয়। এতো পলিশ কি করে থাকে এরা !! আমাদের নেভিটাসের ক্লাসে প্রায় চাইনিজ মেয়ে /মহিলা/পুরুষ সাথে করে এককাপ/গ্লাস লেবু স্লাইস মেশানো হালকা গরম পানি সাথে নিয়ে বসে। পুরো ক্লাসে একটু পরে পরে এই মিক্সড পানি পান করে।

আমরা নিজেদের ব্যপারে এতো কেয়ার করি না। অথচ ওরা সবসময় কেয়ারফুল। সম্ভবত এজন্য ওদের স্কিন সবসময় চকচকে, পলিশড। এখানে আমরা যেহেতু পি আর নিয়ে এসেছি তাই আমাদের চিকিৎসা ফ্রি। বাংগালী ফ্রী পেলে বিষও খায়। আমরাও বিষ খেতে দেরী করছিনা। সব ধরনের টেস্ট চিকিৎসা করিয়ে নিচ্ছি। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেলো আমার পেটে ব্যাক্টেরিয়া, শরীরে হিমোগ্লোবিন কম, আয়রন কম, এমনকি ক্যালসিয়াম ও ভীষন কম। ভাবছিলাম আমরা গরীব দেশের মানুষ বলে এই অবস্থা নাকি আমাদের খাবারের মধ্যে ভেজাল নাকি আমি নিজেই নিজের ব্যপারে সবসময় অসতর্ক। মেয়েরা তো বেসিকেলি এমনি হয়।

সেদিন ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি – অপেক্ষা বাংলাদেশের মত এখানেও করতে হয় – তবে পার্থক্য হলো এখানে ডাক্তার সাহেব নিজেই এসে রোগীকে ডাকেন। কোনো কম্পাউন্ডার নেই যে তার দাপটে রোগী হয়রান হবে। যাই হোক এখানে প্রচুর আরবী ভাষাভাষী মানুষও সিটিজেনশীপ নিয়ে বাস করছে। একজন আরব বিশেষ করে লেবানিজরা প্রায়ই চারটা বিয়ে করে। এরপর তাদের আরো সদস্যদের আনার ব্যবস্থা করে। এবং এই যে এতোগুলো বিয়ে করে ওদের স্ত্রীদের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। এক বুড়োর চার স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী আমার আম্মার সমান, দ্বিতীয় স্ত্রী আমার বয়সী, তৃতীয় স্ত্রী আমার ছোটবোনের বয়েসী আর চতুর্থ স্ত্রী আমার মেয়ের বয়সী। এতে তাদের সমস্যা নেই। ওরা বান্ধবীর মতো চলাফেরা করে। কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী মেয়েগুলো দেখতে অসম্ভব সুন্দর। এখানে ওরা সবাই একসাথে থাকে বলে ওদের ইনকাম প্রচুর। যেমন একজনের ঘরে সাত থেকে আটজনই যদি ইনকাম করে সে অবশ্যই ধনী /সম্পদশালী যাদের অনুপরিবার তাদের চাইতে। এখন এখানে তারা ব্যবসা করে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত। অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতেও সম্ভবত।

যাই হোক ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। এক আরবী মা তার তিন মেয়ে আর একজন সাথে গভর্নেস (সম্ভবত) নিয়ে এসেছে। এজন্যই মনে হলো গভর্নেসের গায়ের রঙ কালো আর ওদের গায়ের রঙ পশ্চিমাদের মতই। মেয়ে দুটোর বয়স হবে সাত বা আট। ওদের চুল বড়। এত বড় যে সুন্দর করে বেণী করে রেখেছে। আমি পিচ্চিটাকে ডেকে বললাম এসো তোমার ছবি তুলি। সে রাজী হলো। সুন্দর ছবি তুললো। কিন্তু ওদের গভর্নেস ডেকে ওকে বলে দিলো যে অপরিচিত কারোর কথায় ছবি তুলতে হয় না (যদিও তার কথা শোনা যায় নি কিন্তু ধরে নিলাম )। গভর্নেস মেয়েটা কালো মোটা আর ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলে। একটু অপমান লাগলো আমার। মেয়েটা হাসিখুশি ছিল খুব, দুই বোন চমৎকার খেলছিলো কিন্তু ওর কথায় সেও আপসেট হয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি সামান্য হেসে চোখে চোখে অভয় দিলাম – আহা ব্যপার না তো !!

আরব শিশু –

সবগুলো মেয়ে বাচ্চার চুল সোনালী এবং কোমর অবধি – বিষয়টা ভাবার মতো

১১
আমার আম্মা বলতো আমি শুকনাতেও আছাড় খাই। আর আব্বা বলতো ‘তোর হাতে কি কোনো রগ নাই ? কিছু ধরলেই পড়ে যায় !! এসব শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে বলে আর কেউ বললে পাত্তা দেই না। সেদিন আমাদের ক্লাসে সিদরা নামে পাকিস্তানী মেয়েটা বললো – জানো সেদিন তোমার ছেলে কি বললো ?
হাসতে হাসতে তার দিকে ফিরলাম – আচ্ছা বলতো কি বললো !
‘তোমার সাথে বেরোলে তোমাকে নাকি ওরা কিছুক্ষণ পরে খুঁজে পায় না। তুমি নাকি হারিয়ে যাও”।
সে আবার যোগ করলো – তুমি নাকি কবি মানুষ, তাই আনমনা – বলে সে আবার হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিলো।
আমি হাসলাম। এরকম ঘটনা যে প্রায়ই হয় সেটা ভেবে নিজেই হয়রান হলাম। আমার ছেলেমেয়েরাও যে এই বিষয় নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তিত থাকে এতে আত্মপ্রসাদ নাকি আত্মতুষ্টি হয় সেটা বুঝতে পারছিলাম না। সে যাই হোক – নিজের ব্যপারে এমন একটু আধটু ধারণা আবার সত্যি প্রমাণিত হলো সেদিন সত্যি সত্যিই যখন ব্যাঙ্কসটাউনের শুকনা ঝকঝকে পোলিশ রাস্তায় আছাড় খেয়ে পা’য়ে ফ্র্যাকচারই করে ফেললাম। এর কি কোনো মানে আছে ?

ব্যাঙ্কসটাউন যে এরিয়াতে ইংলিশ ভাষা শিক্ষার ক্লাস হয় সে জায়গায় যেতে রেলস্টেশন থেকে একটা মার্কেট, মাঠ, ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরী পার হয়ে যেতে হয়। এই লাইব্রেরী দেখে তো আমার মাথা খারাপ। এতো বড়, সুন্দর ঝকঝকে লাইব্রেরী যে মনই ভালো হয়ে যায়। লাইব্রেরীতে ঢোকার মুখে থিয়েটার, একটা টেকওয়ে ফুডশপ এরপর লাইব্রেরী। লাইব্রেরীর সামনে একপাশে আছে সুইমিং পুল। আপনি ইচ্ছে করলে সুইমিংপুল সামনে রেখেও বই পড়তে পারেন। অনেকে বাচ্চা নিয়ে যায়। তাদের বাচ্চাদের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা আছে। শুয়ে বসে সব ভাবে পিনপতন নিরবতায় বই পড়তে পারবেন। ৫০০০ স্কয়ার মিটারের তিনটা ফ্লোরের এক সুবিশাল লাইব্রেরী। শুয়ে বসে রিলাস্কিং মুডেও বই পড়ার ব্যবস্থা আছে। কম্পিউটার ইউজিং ফ্রি ওয়াইফাই সহ। মন খারাপ হলে গাছের পাতাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেও বই পড়তে পারবেন কেননা লাইব্রেরীর ভেতর থেকে কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায় সুবিশাল মাঠ, বৃক্ষ, পাখির কোলাহল। কত হাজার ধরনের বই যে আছে – আছে পৃথিবীর সব বিখ্যাত বই।

আছে নানান ধরনের জার্নাল, ম্যাগাজিন। ভোগের মত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও আছে। তবু নিজের ভাষায় বই দেখলে অথবা পড়তে পেলে ভালো লাগে নিশ্চয়। ইংরেজী বই অনেকটা যেনো সব তরকারী রান্না হলেও লবন ছাড়া সব স্বাদ মাটি এরকম। সব আছে অথচ কিছুই নাই। একবার কলেজে (আমার জব করতাম যেখানে) একজন ইংলিশে বিজ্ঞাপন রেডি করছিলেন ছাত্র ভর্তির জন্য। আমি বলছিলাম নিজের ভাষা হলো এমন যে দেখা মাত্র হৃদয়ে গেঁথে যাবে কিন্তু পরের ভাষা আগে পড়বে তারপরে বুঝবে তারপর সে রেসপন্স করবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। নিজ দেশ ছেড়ে আসলে সেই অনুভবটা আরো তীব্র হয়।

কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।” আমাদের তো দেশ ভালো লাগে, ভাষাকেও প্রাণের অধিক ভালোবাসি। তবু এই দেশ বিদেশ মানুষের আসা যাওয়া -এটা চলবেই – ক্রমশ এই পৃথিবী ছোট্ট গ্রামের মত হয়ে গেলে সব ভাষাই আমাদের ভাষা, সব দেশই আমাদের দেশ, পুরো পৃথিবীই একটা গ্রহ – এর বাইরে যেতে হলেও আমাদের এর মাটিতেই মিশতে হবে – আহা পৃথিবী ! আর কি অসম্ভব সুন্দর এই বেঁচে থাকা !!

ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরীর অন্দর মহল

ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী

লাইব্রেরীর সামনে রয়েছে মন উদাস করা পার্ক

হরণ

তোমার কথা ভাবলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার
নাফ নদীর উৎস মুখ খুলে যায় যখন আসে জোয়ার
যে প্রেমিক পুরুষ ছুঁড়ে কুমারী নারীকে কর্ণফুলীতে
তাদের মতন আমি হারসমেত দেই গলা খুলে
প্রস্তত হে মরন ” ফেলো অগ্নিকুন্ডে
দুয়ারে দাঁড়ায়ে প্রেম
খুলে ফেলে বসন
কিছু নাই আর
দেখো অস্থিসুদ্ধ হয়েছি হরণ –

দেশ-বৈদেশ


মালয়েশিয়ার লাংকাউই – সমুদ্রের পাড়ে এক দল থাকেন যারা প্যারাস্যুটে ওঠার ব্যাপারে গাইড করেন এবং যে বা যিনি প্যারাস্যুটে উঠবেন তার সাথে গাইড হিসেবে থাকেন একজন। আমাদের গ্রুপের সবাই প্যারাস্যুটে উঠে ভীষন এক্সাইটেড। স্মিতা, দুরন্ত, সুমন, মইনুল সবাই বল্লো ওঠো তুমি। কোন ভয় নেই।

আমার উচ্চতা ভীতি আছে এটা কোন রকমেই তাদের বোঝাতে পারলাম না। ঠেলে ঠুলে পাঠানো হলো আমাকে। ওঠার আগে আমাকে একটা ড্রেস পরিয়ে দেয়া হল, একটা বেল্ট সামনে পেছনে আর বসার জন্য একটা বেল্ট দুহাতে ধরার জন্য মোটা রশি এবং পেছনে আমার গাইড। যখন উড়ে যাব তখন অন্যরা বললো “রান রান রা -আ- ন –”

কিছুদিন আগে সিঁড়িতে ওঠার সময় পায়ে ভীষন ব্যথা পেয়েছিলাম।
তখনো ব্যথা ছিল তবু দৌড়ালাম। মূহুর্তেই আমরা মাটি ছেড়ে শুন্যে উঠলাম। নীচের মানুষ গুলো সব ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল। আমার পাশে গাইড সে একটা কথাও বলছিল না। এত সুন্দর আকাশ নীচে সমুদ্রের সবুজ জল – ঠান্ডা গা জুড়ানো বাতাস, ঘন সবুজ পাহাড় – নীল আসমান – ধীর গতিতে পাখির মত উড়তে থাকা – পাখিরই রয়েছে এমন সুন্দর জীবন, আত্মবিশ্বাস – উড়তে পারার বিশ্বাস –বিকেল ছিল ওই সময়টা – কি যে অসাধারণ ঠান্ডা মৌন ঋষির মত এই পৃথিবী – ব্যাখ্যাতীত সব – সব সুন্দর ব্যাখ্যা করা যায় না – কিন্তু কিছুই উপভোগ করতে পারছিলাম না। ভয়ে টেনশনে আমি পর্যুদস্ত ।
মনে হচ্ছিল যদি পড়ে যাই বেঁচে উঠব কি করে -এই আতংক আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে ছিলো। অনেকটা আকাশ পথে উড়ে উড়ে একসময় ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগলো প্যারাস্যুট। অদৃশ্য মানুষ গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো। আস্তে আস্তে প্যারাসুট মাটি স্পর্শ করলো । হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। জোরে নিঃশ্বাস নিলাম – আহ ! কি অসাধারণ এই বেঁচে থাকা –
সবাই জিজ্ঞেস করছিল কেমন লাগছিল ! কেমন লাগছিল !
অনেক সুন্দর এমাজিং, বিশ্বাস করার চাইতেও সুন্দর- বলতে পারলাম না –
রবীবাবুর সেই গানের কথা মনে পড়লো ‘ অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলি-

মালয়েশিয়ায় স্পাইডারম্যানের সাথে পায়ে পায়ে’-

মালয়েশিয়া – বুকিত বিনতাং


যে অবস্থাতেই থাকি সেটাকে আমি অভিজ্ঞতা বলি। কে আছে যে তার সব দিন সমান আনন্দে কাটে ? সেদিন ক্লাসে নিজের সম্পর্কে লিখতে বলাতে দেশের কথা এতো তীব্রভাবে মনে পড়লো আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম। আশ্চর্য! চোখের পানি কিছুতেই থামছে না। চোখের জলের কিছু ধর্ম আছে , যেমন বন্যার পানির মতো বাঁধ ভেংগে উপচে পড়া। যখন কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না, আমি হাল ছেড়ে দিলাম। যা বুকের ভেতর থেকে আসে সে আসুক – যদি ভাসিয়ে নেবার হয় সে নিক, সে আপনাতেই থেমে যাবে। জীবনের ধর্ম গতিশীলতার মতো ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হবে জীবন। জীবন থেমে থাকার নয় –

সিডনীর পাঞ্চবোলে যখন আমরা আছি তখন ভাবছিলাম এতো গ্রামীন ভাব – বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া পরিবেশ বান্ধব ভীষন। পাখিরা মানুষকে ভয় পায় না। পাখি এতো পাশে এসে দাঁড়ায় যে , যেনো জানে তারা নিরাপদ। এতো বেশী বৃক্ষের সারি – নাগরিক জীবনকে সুশীতল শান্তির পরশ দেয়। আমার ছেলে দুরন্ত বলে – কিন্তু মা এখানের গাছ পালা দেশের মত এতো বেশী সবুজ না। আমিও তাই ভাবি। অথবা হতে পারে এখনো এখানে শীত। শীত যাই যাই করছে। এই সময়টা তো পাতা ঝরার সময়। পাতা হলুদ হয়ে বিবর্ণ হবে এরপর ঝরে যাবে। তাই দেখা যায় প্রায় গাছের শাখা আছে কিন্তু একটা পাতাও নেই। চিকন উর্ধ্বমুখী শাখায় গাছগুলো পত্রশুন্য ।

সে যাই হোক মুল সিডনী শহরে গেলে ভুল ভেঙ্গে গেলো। হাইরাইজ চকচকে ঝকঝকে বিল্ডিং, নারী পুরুষ ছুটছে তো ছুটছেই। এরই মাঝে প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতন দুএকজন ভিক্ষুককে বসে থাকতে দেখেছি রাস্তার পাশে। একজন আবার উবু হয়ে দুহাতের ভেতর মুখ লুকিয়ে হাত দুটো দিয়ে ধরে রেখেছে একটা বক্স যাতে কয়েন জমা হবে। যদিও ওরা মনে হয় না বাংলাদেশের ভিক্ষুকের মত গরীব। বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কাপড় চোপড়ে এত দরিদ্র না। তবু মনটা কেন যেনো খারাপ হলো তাদের জন্য। সেন্ট্রাল লিংক তো বেকার ভাতাও দেয়। আর এক স্বাস্থ্যবতী মহিলাকে দেখেছি গীটার বাজিয়ে ভিক্ষা করতে। ভালই গাইছে। ফরসা চেহারা, ভীষন হেলদি, চকচকে লিপস্টিক ঠোঁটে, প্রায় ছয় ফিট লম্বা মহিলাকে ভিক্ষুক ভাবতে কষ্ট হয়।

এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো মনোরম যে মাঝে মাঝে মনে হয় আহা বাংলাদেশে যদি এমন হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। যেমন পাঞ্চবোল থেকে যদি টাউন হলে যেতে হয় তবে প্রায় দশটা বা পনেরটা জায়গা টাচ করতে হয়। এক মিনিট পরে পরে স্টেশন। তার মানে শহরের নাগরিকদের যাতায়াতের সুব্যবস্থার জন্য প্রতিটা জায়গাতেই ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। যদিও এতো ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা তারপরেও আমার তীব্র ভাবে রিকসা জার্নির কথা মনে হয় –
সন্ধ্যার পরে রিকশায় উঠলেই ঝিরি ঝিরি বাতাস – উপরে আকাশ, চাঁদের সাথে সাথে চলা –
আহা -আমাদের গেছে যে দিন -একেবারেই কি গেছে !!

sydney তে আকাশ স্পর্শ করা স্থাপনা সব
হাইড পার্ক

দেশ -বৈদেশ

বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে তিনবার প্লেন বদল হলো আমাদের। প্রথম বাংলাদেশ বিমানে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, এরপর থাই এয়ারে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড দুই ঘন্টার জার্নি, থাইল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ নয় ঘন্টার জার্নি।
বাংলাদেশ বিমান যদিও মোটামোটি স্মুদ চলেছে কিন্তু থাই এয়ার দুটোই আকাশে উঠে এমন ঝাকাঝাকি শুরু করলো – ভয়াবহ ভয়ে সময় কাটলো । তবু ওদের দুর্দান্ত সুন্দরী এয়ারহোস্টেস দেখে চোখ আটকে থাকে। কিন্তু ওদের ভাষা বিদ্ঘুটে শোনায় মেয়েগুলোর মুখে। নামা এবং ওঠার সময় ওরা ওদের ভাষাতেই সম্ভবত ওয়েলকাম বা বিদায় জানায়। আইয়া বা এই ধরনের একটা শব্দ বলে যে মেয়েগুলোর মুখে যেনো মানাচ্ছে না এই শব্দগুলো । তবু নিজেদের ভাষা বলে কথা ।

থাইল্যান্ড এয়ারপোর্ট

কিন্তু থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টে নেমেই চোখ জুড়িয়ে যায়। জানতাম এই সংক্ষিপ্ত ট্রানজিটে নামা সম্ভব না তাই ভাবলাম জানালা দিয়ে দেখে নেই থাইল্যান্ড। যদিও খুব বেশি দেখা সম্ভব না তবু বোঝা যায় খুব প্ল্যানড শহর। রাস্তাঘাট বিল্ডিং, দীর্ঘ নদীও সরু ফিতার মত মনে হয়। বাংলাদেশ থেকে যখন প্লেন উপরের দিকে উঠে বিশেষ করে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে তখন সমুদ্র আর কর্ণফুলির জল খুব মন কেমন করা অনুভুতি এনে দেয়।
কি হবে – কি হবে না- কি আছে কি নেই কেন এই জীবন এই ধরনের অহেতুক বোধের জন্ম নেয় সম্ভবত আকাশযানে উঠলেই। বড় বেশী অকিঞ্চিৎকর মনে হয় এই জীবন। আহা কেন এই ছুটোছুটি – বড্ড নিরর্থক এই জীবন —


আরববাসী এখানে এত বেশী যে আমার খুব অবাক লাগে। বলা যায় যে এখানে তারা খুব স্বাধীন জীবন যাপন করে। সম্ভবত তাদের দেশে এতোটা স্বাধীন জীবন যাপন তাদের সম্ভব ছিলো না। মেয়েরা খুব যে নাক মুখ ঢেকে রাখে তা নয় তবে ভালো করে মাথা ঢাকা হিজাব পড়া কিন্তু ফ্রিকোয়েন্ট চলাফেরা সম্ভবত স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ধনী দেশ কিন্তু স্বাধীনতা না থাকলে সমস্ত ধন সম্পদ ও যে অর্থহীন যাকে পরাধীনতার স্বাদ নিতে হয় তারাই জানে। স্বাধীনতা এবং পর্যাপ্ত স্বাধীনতা মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। পরাধীনতা এবং একই সাথে জীবন যাপনের জন্য অপর্যাপ্ত অর্থ স্বাধীনতা থাকলেও সে স্বাধীনতাও অর্থহীন মনে হয়।


কি যে ওয়েদার ! কিছু বুঝতে পারি না। শুধু ক্লান্তি লাগে। ঘুম আসে সারাদিন। সময় পেলেই ঘুমিয়ে কাটাই। নেভিটাসে সপ্তাহে চারদিন ক্লাস। নেভিটাস ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কোর্সের ইন্সটিটিউট। এখানে (অস্ট্রেলিয়া) যারা রেসিডেন্সি নিয়ে আসে সরকার তাদের এই কোর্সটা ফ্রী অফার করে। সিরিয়ান রিফিউজি প্রচুর এখানে। এরপর আছে মিশর, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ইন্ডিয়ান, বার্মার রিফিউজি, চীন এবং আরো বহু দেশের মানুষজনের মিলনমেলা। শিক্ষার্থীদের তিনটা ভাগে ভাগ করা হয়। যারা খুব কম জানে তাদের লেভেল ১, যারা মোটামোটি জানে তাদের লেভেল ২ এবং যারা এক্সপার্ট তাদের লেভেল ৩। আমি পড়লাম লেভেল ২ এ আর দুরন্ত পড়লো লেভেল ৩ এ। সে যেহেতু দেশেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে তাছাড়া মালয়েশিয়াতেও সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়েছে। তার ইংলিশ অনেক স্পিডি। সে তাই মাঝে মাঝে ক্লাসে যায়।

আমার অবাক লাগে সিরিয়ানদের দেখলে। ওদের জীবন যাপন পোশাক আশাক ফিগার ফেইস সবই পশ্চিমাদের মতই। এমনকি কারো কারো চুলও সোনালী। চোখগুলো শুধু কালো। খুব মিশুক।
মেয়েরা – মেয়েরা ওরা খুব হইচই করে মজা করে কথা বলে। আমরা সিরিয়ানদের সাথে এক বাসে ছিলাম। ওরা আরবী ভাষায় গান গাইছিলো। তবে যেটা হলো ওদের ছেলেরা সম্ভবত কাজ করে বলে সিরিয়ান ছেলেরা এখানে পড়তে আসে না। কয়েকজন সিরিয়ান অল্প বয়েসী মেয়ে বয়স ২৭ – ২৮ এর বেশী না। ওদের তিনটা করে বাচ্চা। আশ্চর্য খুব হাসিখুশী, ফ্যাশনেবল। কি করে মেনেজ করে ! অবাক লাগে। আর একজন মহিলা ওনার হয়তো ৪০ এর উপরে বয়স তার ছয়টা বাচ্চা। নেভিটাসের বেশীরভাগই মেয়ে শিক্ষার্থী। অতএব সবারই বাচ্চা আছে। তাদের বাচ্চাদের জন্য আবার চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। ওই ছয় বাচ্চার মা দুজন বাচ্চা নিয়ে আসে সাথে করে। মহিলার সাথে দুটো মেয়ে শিশু। একটা ট্রলিতে দুজন বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা। সেদিন ওর বাচ্চা দুটোকে দেখে অবাক হলাম। অদ্ভুত সুন্দর। যেনো বেহেশত থেকে এদের আনা হয়েছে।

কাল আমার ম্যাডাম বললেন – সবাই যেনো দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসে সাথে করে প্লেট। প্রত্যেক দেশের মানুষ তার নিজস্ব ঘরানার খাবার নিয়ে আসবে। গতকাল সন্ধ্যায় প্ল্যান করলাম আমি পোলাও আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে যাব। সকালে উঠে রান্না করে নেব। সারাক্ষন মনে মনে এটা পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি বারটা বাজে। আশ্চর্য এ কি রকম ব্যপার। দুরন্ত দুইটা বাজে এলো নেভিটাস থেকে। সে বললো ‘গেলা না কেন মা। কতজন কত রকম খাবার আনলো’।
কি আর করা – মিসই করলাম –


ব্যাংকসটাউন (নেভিটাস ) টু তামারামা বিচ–

তামারামা সমুদ্র সৈকত

তামারামা সমুদ্র সৈকত

নেভিটাস থেকে বলা হলো যে আমাদের তামারামা সমুদ্র সৈকত দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে। সমুদ্র সৈকতে নেয়া হবে ভাল কথা। কিন্তু সমুদ্রে কি কি বিপদজনক ঘটনা ঘটতে পারে সে সম্পর্কে প্রতিটা ক্লাসেই কিছু না কিছু ব্রিফিং দেয়া শুরু হলো। সমুদ্রে শার্ক থাকতে পারে, কুমির থাকতে পারে, কয়েক ধরনের জেলি ফিস আছে। কিছু নিরীহ কিছু বা ভয়াবহ। সমুদ্রে কোথাও বা কারেন্ট আছে। সে জায়গা গুলোতে যাওয়া যাবে না। সাঁতার কাটতে একা যাওয়া যাবে না। বিপদে কিভাবে হাত নাড়াতে হবে সমুদ্র গিয়ে আরো কত কি। যাই হোক গত ৪ তারিখ আমরা সবাই নেভিটাসের অঙ্গনে হাজির হলাম। হাওদা নামে ইরানী মেয়েটা সে এসেছে তার দুই বাচ্চা নিয়ে। একটার বয়স সম্ভবত ছয় মাস আর একটার দুই বা তার কিছু বেশী। সে হয়রান এই বাচ্চাদের নিয়ে ।

চারটা বাস ঠিক করা হলো। সে বাসে করে আমরা সবাই নেভিটাসের শিক্ষার্থীরা যাবো। হাওদা একা পেরে উঠছিল না তার বাচ্চাদের নিয়ে। বাংলাদেশের এক মেয়ে এগিয়ে এলো। সে পিচ্চিটাকে সামলালো আর বড়টাকে হাওদা। এরপর আবার ট্রলিটা নিয়ে বাসে ওঠা। ওর কষ্ট দেখে মনে হলো আহা পৃথিবীর সব মায়েরই সমান কষ্ট।

নেভিটাসে আমাদের লেভেল ২ এর ম্যাডাম এক মরিশাসের মহিলা। ছয়ফিটের মত লম্বা একটু শ্যামলা ছোট চুলের খুব হাসিখুশী একটানা সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর ঠিক দুইটা পর্যন্ত ক্লাস নেন কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়াই। মরিশাসে তিনটা ভাষায় মানুষ কথা বলে। ওদের মাতৃভাষার সম্ভবত কোনো বর্ণ নেই। ফ্রেঞ্চ ভাষায় তাই লেখাপড়া চলে। ইংরেজীটাও ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজের মত শিখতে হয়। বাসে উনি আমার পাশে বসেছিলেন। নিজেদের ভাষায় কি অসম্ভব তাড়াতাড়ি কথা বলে যাচ্ছিলেন। কথার শেষে বার বার মেসি মেসি বলছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম মেসি মানে কি। তখন উনি বললেন যে মেসি হলো ধন্যবাদ। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ধন্যবাদকে মেসি বলে।

যাই হোক শহর পেরিয়ে যখন সমুদ্র সৈকতে পৌছালাম তখন আমাদের সবাইকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে একটা বড় হলরুমে নেয়া হলো। আয়োজকরা সবাই পড়েছে হলুদ গেঞ্জি, লাল শর্টস। হলুদ গেঞ্জির কলার লাল। উজ্জ্বল রঙ। তামারামা বিচে স্কারশানের আয়োজক নেভিটাসে লেভেল ২ এর শিক্ষক মিসেল। মিসেল সারাক্ষল হই চই করা ফুর্তিবাজ মহিলা। মিসেল ও হলুদ গেঞ্জি লাল শর্টস পড়লো। আমি ভাবলাম সকালে হয়তো নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। কিসের কি – আবার সেই প্যাঁচাল। সমুদ্রে কি কি বিপদ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে তিন থেকে চারজন ব্রিফিং করলো। আবার বড় বড় স্টিকার দিয়ে বিপদজনক চিহ্নগুলো দেখানো হলো। সমুদ্র দেখতে গেলাম এরপর। মনে পড়ে গেলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। কত যে বিশাল আমাদের এই সমুদ্র সৈকত। সেই তুলনায় তামারামা সমুদ্র সৈকতকে নদীর তীরই মনে হয়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের যে উত্তাল ঢেউ এর ওঠা নামা সে এক অবর্ণনীয় ইতিহাস মনে হলো। তবে এই সমুদ্রের ঢেউ যে কম ভয়ংকর তা বলা যাবে না। এরই মাঝে কিছু তরুণ ইয়টে সমানে ঢেউ এর সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে দেখতে ভালই লাগে আবার ওদের সাহসের প্রশংসা না করে পারি না ।

দুপুর ঠিক একটা বাজে আমাদের লাঞ্চ দেয়া হলো। মেনু – একটা বান , একটা সসেজ (বিফ অথবা পোর্ক যার যেটা পছন্দ ), সালাদ বাদাম সহ, জুস আর পানি। খাওয়া দাওয়া শেষ এবার ফেরার পালা। পাকিস্তানী আর একটা মেয়ে তার মেয়েকে নিয়ে হয়রান হচ্ছিল। আমার কর্তা তাকে বললো তোমার ট্রলি আমাকে দাও। তুমি ফ্রী যাও। মেয়েটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েরা আসলেও মায়ের জাত। তার পোষাক আশাক যতই আধুনিক হোক ভেতরে সে মমতাময়ী মা। সিরিয়ান ছোট ছোট মেয়েরাও ছেড়া ফাটা জিন্স সোনালী চুল, আইল্যশে ভর্তি চোখ নিয়ে ট্রলি ঠেলে ঠেলে নিলেও মনে হয় পৃথিবীর সব মা- এর হৃদয়ই তো সমান মমতায় আদ্র ।