নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-২ শেষ পর্ব

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর-মুখ অতিশয় গম্ভীর-১

প্রথম পর্বের শেষাংশ:
শেষতক এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার কানে। জীবন বামনা তখন আরেক মুল্লুকে থাকা এক মন্দিরে থেকে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছিল।

জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার হুলুধ্বনি যখন জীবন বামনার কানে আসলো, জীবন বামনা মনে মনে বলতে লাগলো, ‘না না, আমার লেখা এক টুকরা কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁচে নাইক্কা। কার্তিক বাবু জীবন বাঁচছে হের সৎ কামের লাইগা। জমিদার কার্তিক বাবুর আয়ু আছিল দেইখাই, হের জীবন বাঁচছে। আমার লেখা এক টুকরা কাগজ হেদিন হেই জায়গায় না থাইকলেও জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচতো। হেইডা যেমনেই ওক অইতো। এনো আমার লেখা কাগজখান খালি উছিলা, আর সাক্ষী অইয়া রইছে। ইল্লাইগা আমি যদি কার্তিক বাবুর তুন কিছু চাই, তয়লে আমার অইবো বড় অন্নাই।

এই ভেবে জীবন বামনা সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুতেই সে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে গিয়ে কিছু চাইবে না, কাগজে লেখার ব্যাখ্যাও দিবে না। যদিও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে যেতে হয় তো বামনীকে সাথে করেই নিয়ে যাবে। কিন্তু বামনীকে তো বলে এসেছে টাকাপয়সার বস্তা সাথে করে নিয়ে যাবে। এখন খালি হাতে বামনীর সামনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? বামনী যদি ঝাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়? এমনিতেই বামনী আমাকে বলে কুমিরা আইলসা!’ মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে জীবন বামনা খিটখিটে জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো।

জীবন বামনার হাসির শব্দে মন্দিরে থাকা ঠাকুরের একটু খারাপ লাগলো। ঠাকুর তখন মন্দিরে থাকা দেবমূর্তিতে পূজা দিচ্ছিলো। ঠাকুর মূর্তি পূজা বাদ দিয়ে বারান্দায় বসা জীবন বামনার সামনে এসে বললো, ‘ওই বেডা হারামজাদা, ‘পূজা দেওয়নের সুম আমার কোনও ভুল অইছে?’ জীবন বামনা বললো, ‘নাতো গোসাই!’ ঠাকুর উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘তয়লে বেডা তুই এমনে বেটকাইলি ক্যা, ক?’ জীবন বামনা বললো, ‘আজ্ঞে গোসাই এমনেই হাইসলাম।’ তারপরও মন্দিরের ঠাকুর বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠাকুর আবারও বললো, ‘হাছাকথা যদি না কছ, তয়লে তোরে অনকা মন্দিরের তুন খেদাইয়া দিমু! ভালা অইবো হাছা কইরা ক। এনো থাকলে অইলে কইতে অইবে জোরে জোরে বেটকাইলি ক্যা?’

জীবন বামনা কোনও অবস্থাতেই মিথ্যা বলার পাত্র নয়! এতে যেতো সমস্যাই হোক, সে সত্যই বলবে। তাই মন্দিরের ঠাকুরের চাপাচাপিতে জীবন বামনা জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে বললো, ‘জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় এক টুকরা কাগজ আমিই লাগাইয়া রাখছিলাম, ঠাকুর মশাই। হেই কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচা গেছে। আইজ ক’দিন ধইরা হেই কাগজ কে লেখছে আর কে লাগাইছে, হিল্লাইগা হারা মুল্লুকে ঢোল পিডাইতাছে। এই কথা আমার মনে পরছে দেইখা আমি হাসতাছিলাম, ঠাকুর মশাই। হের লগে আবার আমার বামনীর কথাও মনে পইড়া গেছে। বামনী আমারে কতায় কতায় কয় কুমিরা আইলসা।’ এই বলেই জীবন বামনা আবারও হাসতে লাগলো, হা-হা-হা-হা!

জীবন বামনার কথা শুনে মন্দিরের ঠাকুর অবাক হয়ে বললো, ‘আরে বেডা তুই কছ কী? হাছা হাছাই তুই কাগজ লাগাইছত? চল বেডা, পুরস্কার আছে। যেয় নিকি সন্ধান দিতে পারবো, কার্তিক বাবু হেরে দিবো এক হাজার টেকা। আর যেয় লিখছে, লাগাছে, হেরে দিবো দুই হাজার টেকা। চল তাড়াতাড়ি কইরা। আমি অইলাম গিয়া সন্ধানদাতা, আর তুই লেকছত লাগাইছত। তুই পাইবি দুই হাজার টেকা। চল চল, চলরে বেডারে চল!’ এই বলেই মন্দিরের ঠাকুর জীবন বামনার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। ঠাকুরের জবরদস্তি আর টানাটানিতে মন্দিরের সামনে আরও কয়েকজন মানুষ হাজির হয়ে গেলো। উপস্থিত সবাই যখন এই ঘটনা শুনে ফেললো। তখন মন্দিরের ঠাকুর ভাবছে, ‘হায় হায়, এই লোকগুলা তো আগে আগে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে যাইয়া কইয়া দিবো! তাইলে তো আমি হালায় ফাও যামু!’ এই ভেবে মন্দিরের ঠাকুর মন্দির ফেলে এক দৌড় দিলো জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে। আর যাঁরা এই ঘটনা শুনল, তাঁরাও ঠাকুরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলো। জীবন বামনা তখনো মন্দিরের বারান্দায় বসে কি যেন ভাবছিল! আর লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে এই কথা এক কান থেকে আরেক কানে যেতে লাগলো।

এভাবে এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার বামনীর কাছে আর জমিদার গণেশ বাবুর কাছে। জমিদার গণেশ বাবু খবর শুনে তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে যেতে। এদিকে দশ গ্রামের মানুষও জীবন বামনাকে দেখার জন্য জড়ো হয়ে গেল মন্দিরের সামনে। গ্রামের লোকজনের ভিড়ের মধ্য থেকেও গণেশ বাবুর লাঠিয়াল বাহিনী এসে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গেল, জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে।

জমিদার গণেশ বাবু জীবন বামনাকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। জমিদার গণেশ বাবু রেগেমেগে হাতে একটা লাঠি নিয়ে জীবন বামনাকে বলছে, ‘ও-ই বেডা হাছা কইরা ক, আসলে কার্তিক্কার দরজার মাধ্যে কি তু-ই কাগজের টুকরা লাগাইছত? জীবন বামনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আজ্ঞে হ, আমিই লাগাইছি। হিল্লাইগা কী অইছে?’ গণেশ বাবু ক্ষেপে বললো, ও-ই বেডা তুই কত্ত বড় শিক্ষিত অইছত দেহি!’ এই কথা বলেই জীবন বামনার ঝুলির ভেতরে হাত দিল। জীবন বামনার সাথে থাকা ঝুলিতে শুধু কাগজের টুকরো আর টুকরো।

এসব কাগজের টুকরো দেখে জমিদার গণেশ বাবু ভাবলো লোকটা মনে হয় পাগল। কিন্তু কাগজের টুকরোগুলোতে লেখা দেবদেবীর পূজার মন্ত্র, আর শাস্ত্রগ্রন্থের লেখা দেখে গণেশ বাবু তখন রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তোর বাড়ি কই? তুই বাবা কী করছ? কার্তিক্কার ঘরের দরজার মাধ্যে তুই কী লেকছত? তর হেই লেখার লাইগগা নাপতা হালায় কার্তিক্কার গলা কাইটতে পারে নাইক্কা। ক তুই কাগজে কী লেকছত, ক?’ গণেশ বাবুর কথা শুনে জীবন বামনা হেসে বললো, ‘জমিদার বাবু, ‘এই দুইন্নাইত কেডা কারে মাইত্তে পারে? আয়ু থাকতে মানুষ মরে না। কেউ কারোরে মাইত্তেও পারে না। আমার কাগজখান অইলো উছিলা। হেদিন কার্তিক বাবুর ঘরের দরজার মাধ্যে আমার কাগজ লাগাইন্না না থাইকলেও কার্তিক বাবু যেমনেই ওক বাঁইচা যাইত। আম্নে বড় একখান ভুল করছেন বাবু। এই ভুলের পাচিত্ত আম্নের করন লাগবো।’

জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আসলেই আমি ভুল করছিরে। কিল্লাইগা যে এই আকাম করতে গেলাম! মাথাডা ঠিক আছিল নারে।’ জীবন বামনা বললো, ‘জমিদার বাবু, শত্রুর লগে শত্রুতা না কইরা বন্ধু অন যায় না? তাইলেই ত শত্রু আম্নেরে গোসাই মনে কইরা পূজা দিবো।’ এবার জমিদার গণেশ বাবু নিজের ভুল স্বীকার করলো। আর কীভাবে এই ভুলের ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে সে-ব্যাপারে জীবন বামনার কাছে জানতে চাইল। জীবন বামনা বললো, যাঁর কাছে অপরাধ করছেন, হে ও-ই ক্ষমা করতে পাইরবো। হে ছাড়া স্বয়ং ভগবানও ক্ষমা করতো না, বাবু। এই ভুলের ক্ষমা একমাত্র কার্তিক বাবুই করতে পারবো, অন্য কেউ না।’ জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু বললো, ‘ঠিক আছে কার্তিক বাবুর বাড়িত যাইয়া হের কাছ তুনে মাপ চাইয়া লমু। তুই বেডা আমার লগে থাকবি।’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বাবু, আমি আম্নের লগেই থাকুম। চলেন আমার লগে কার্তিক বাবুর বাইত।’ জীবন বামনার কথায় জমিদার গণেশ বাবু আর দেরি না করে লোকজন সাথে নিয়ে জীবন বামনা-সহ জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।

এদিকে বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিজের স্বামী ঘটিয়েছে জানতে পরে বামনীও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে হাজির হলো। বামনী এসে দেখে জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বাড়ির ভেতরে হাতাহাতি তর্কাতর্কি চলছে। কেউ বলছে আমি আগে খবর নিয়া আইছি। কেউ বলে আমি আগে আইছি। মন্দিরের ঠাকুর তো সবার আগে এসে কার্তিক বাবুর কাছে বলে সবার আগে বসে আছে। কার্তিক বাবু একজন একজন করে জিজ্ঞেস করছে, যে লিখেছে তাঁর নাম কী? তাঁর বাড়ি কোথায়? কিন্তু কেউ আর এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছে না। শুধু বলছে, লোকটা জীবন পুর গ্রামের কালীমন্দিরে থাকে। সবার মুখে জীবন পুর কালীমন্দিরের কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে বলে লোক পাঠিয়ে দিলেন জীবন পুর কালীমন্দিরে। ততক্ষণে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল জমিদার গণেশ বাবুর লোকজন।

এরমধ্যেই জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসেই দেখে বাড়ি ভর্তি লোকজন। বামনী এসেই জমিদার কার্তিক বাবুকে বললছে, ‘আমার স্বামী কই? আমার স্বামীরে কি বাইন্দা রাখছেন?’ জমিদার কার্তিক বাবু জানতে চাইলো, ‘কে তোমার স্বামী?’ বামনী বললো, ‘আম্নের ঘরের দরজার মাধ্যে যেয় কাগজখান লাগাইছে, হেয় আমার স্বামী জীবন চক্রবর্তী।’ তখন বাড়িতে উপস্থিত লোকজনের মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেউ বলছে, ‘যা, সন্ধানদাতা তো কাগজ লাগাইন্নার বউ। তয়লে দুইডা পুরস্কার হেরাই পাইতাছে। আমরা খালি খালি আইয়া নিজেরা নিজেরা গোলমাল লাগাইলাম।’ বামনীর কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবুর বিশ্বাস হলো। বামনীকে সম্মান করে বসতে দিলো। বামনী বসলো। অপেক্ষা এখন জীবন বামনার।

এদিকে বাড়িতে অনেক লোকের মাঝে একজন বললো, জীবন পুর কালীমন্দির থেকে জীবন বামনাকে জমিদার গণেশ বাবু তুলে নিয়ে গেছে। সাথে সাথে জমিদার কার্তিক বাবু ১০/১২ জন লোক পাঠিয়ে দিলো জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে। পথিমধ্যেই কার্তিক বাবুর লোকজন দেখে জমিদার গণেশ বাবু লোকজন নিয়ে কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে আসছে। কার্তিক বাবুর লোকজন তা দেখে দৌড়ে আবার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে বললো, ‘জমিদার বাবু, গণেশ বাবু লোকজন নিয়া আম্নের বাড়ির দিকে আইতাছে।’ এই কথা শুনে কার্তিক বাবুর তাঁর লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রস্তুত হতে বললো। লাঠিয়াল বাহিনী লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হলো। এখন পুরো বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিজার করছিল। এমন সময় জমিদার গণেশ বাবু জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইলে কার্তিক বাবুর লোকজন বাধা দিলো। জীবন বামনা কার্তিক বাবুর লোকদের বললো, ‘আম্নেরা যাইয়া কার্তিক বাবুরে কন, আমি জীবন চক্রবর্তী, জীবন বামনা আইছি। জমিদার গণেশ বাবুরে আমিই লগে কইরা লইয়া আইছি। যাইয়া কনগা।’ কয়েকজন লোক গিয়ে কার্তিক বাবুর কাছে বললো, ‘জীবন বামনা জমিদার গণেশ বাবুরে লগে কইরা লইয়া আইছে। অন আম্নে কইলে হেগো আইতে দিমু।’ কার্তিক বাবু বললো, ‘ঠিক আছে আসতে দাও।’

কার্তিক বাবুর অনুমতি পেয়ে জীবন বামনা আর গণেশ বাবুর লোকজন কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে দিলো। সবাই বসলো। সাথে সাথে জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসে জীবন বামনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। জীবন বামনা বামনীকে শান্তনা দিয়ে আগের জায়গায় গিয়ে বসতে বললো। বামনী গিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

এবার কার্তিক বাবু জীবন বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘গত তিনদিন আগে আমার বাড়িতে এসে আমার ঘরের দরজায় একটুকরো কাগজ তুমি লাগিয়েছিলে?’ জীবন বললো, ‘হ বাবু, আমি আইছিলাম ভিক্ষা করনের লাইগগা। হেসুম আম্নেরা কেয় ঘুমেতুন উডেন নাই। আমি বহুতক্ষণ বইয়া থাইক্কা আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগাই থুইয়া গেছি, আম্নে যন জানতে পারেন যে আমি আইছিলাম।’

জমিদার কার্তিক বাবু এবার জানতে চাইল, ‘কাগজে কী লিখেছিলে, তা কি তোমার মনে আছে?’ জীবন বামনা বললো, কি যে কন বাবু, আমি লেখছি, আমিই লাগাইছি। আর আমিই কইতে পারতাম না, তয় কইবো ডা কেডা?’ কার্তিক বাবু বললো, ‘বলো দেখি তুমি কী কী লিখেছিলে?’ জীবন বামনা বললো, ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর, মুখ অতিশয় গম্ভীর, শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।’ কার্তিক বাবু জানতে চাইলেন, এসবের মানি কী?’ সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিতে পারবে?’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘তাইলে ত পুরা ঘটনা আবার নতুন কইরা কন লাগে, বাবু। হুনতে যন চাইছেন, তয় ত কনই লাগে। তয় হুনেন, হেদিন আমার বামনীর লগে কাইজ্জা কইরা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে লইয়া ঘরের তুন বাইর অইয়া, আটতে আটতে আম্নেগো বাড়ির রাস্তায় আইছি। দেহি রাস্তার মাধ্য কেডা যানি একটা বলদ গরু খুডা গাইডরা থুইয়া দিছে। গরুডা রাস্তার মধ্যখানে আইয়া খারাইয়া রইছে। গরুডার লাইগগা আমি আর আম্নের বাড়ির দিকে আইতে পাত্তাছিলাম না। গরুডায় খালি সামনের একখান পায়ের তিনডা খুর দিয়া মাডি খুদ্দাছে।

হিল্লাইগা আমি লেখছি, “ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর।
কদ্দুর পরে দেহি, গরু মুখ কালা গম্ভীর কইরা অনক্ষণ খারাইয়া রইছে।
হিল্লাইগা আমি লেখছি, “মুখ অতিশয় গম্ভীর।
হের পরে দেহি পেছ পেছ কইরা মুত্তা আস্তে কইরা রাস্তার নিচে নাইম্মা গেছে। হিল্লাইগা আমি লেখছি, “শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।

এই লেখার কাগজখানই আমি আম্নের দরজার মাধ্যে আমগাছের আডা দিয়া লাগাইয়া থুইয়া গেছিগা, বাবু। হের পরে আম্নের বাইত কি অইছে আমি কিচ্ছুই কইতে পাত্তামনা। আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগানে যদি আমার ভুল অয়, তয় আমারে ভগবানের দিকে চাইয়া মাপ কইরা দেন।’

জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার কাছ থেকে কাগজে লেখার ব্যাখ্যা পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে বামনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার সেই অসাধারণ লেখা কাগজের টুকরো সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আর তুমি বলছ, মাপ করে দিতে? তুমি কোনও অপরাধ করোনি জীবন বামনা। তোমার নাম যেমন জীবন চক্রবর্তী। ঠিক তুমি মানুষের জীবন রক্ষায় সবসময় নিয়োজিত। তোমার বুদ্ধিতে আমি নতুন করে জীবন পেলাম। তাই আজ থেকে সবসময় তুমি আমার জীবনের সাথেই মিশে থাকবে। তোমার যাকিছু দরকার তা আমিই দেখবো। আর আমার ঘোষণা করা তিন হাজার টাকা একমাত্র তুমিই পাওনা।’

কার্তিক বাবুর কথা শেষ হতে-না-হতেই জমিদার গণেশ বাবু কার্তিক বাবুর সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘কার্তিক বাবু আপ্নে আমারে মাপ কইরা দেন। আমি রাগের মাথায় একটা আকাম কইরা ফালাইছি। আইজকা আম্নের বাইত আমারে লইয়া আইছে এই জীবন বামনায়।’ জীবন বামনাও জমিদার কার্তিক বাবুর হাতে ধরে বললো, জমিদার বাবু, আম্নে গণেশ বাবুরে মাপ কইরা দেন। আইজগার তুন আম্নেরা দুইজন বন্ধু অইয়া থাকবেন। আর যেই নাপিত আম্নের গলা কাটতে আইছিল, তাঁরেও মাপ কইরা দেন। জীবন বামনার কথায় জমিদার কার্তিক বাবু তা-ই করলো। এরপর সবাই মিলে কোলাকুলি করলো। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে যার যার বাড়ি চলে গেল। জীবন বামনা আর বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতেই থেকে গেল।

এখানেই সমাপ্তি

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-১

রাতভোর হতে-না-হতেই বামনীর লক্ষ্মী পাঁচালীর সুর তোলা শুরু হয়ে গেলে, ঘরে চাল-ডাল তেল লবণ-সহ তরিতরকারি না থাকার কারণে। বামনী তাঁর স্বামী বামনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে– আমি আর পারুম না। আমার জান আর চলে না। ভগবান আমারে নেয় না ক্যা রে? ভগবান আমারে দেহে না ক্যা? দুন্নাইর এতো মাইনষেরে লইয়া যায়, ভগবান আমারে চোক্ষে দেহে না। আমারে লইয়া যা-রে ভগবান, আমারে লইয়া যা। আমি আর কাম করতে পারি না। মাজায় কুলায় নারে ভগবান, দেহে কুলায় না। আমি হারাদিন মাইনষের বাড়িত খাইটা মরি, আর আমার হোয়াদের বামনায় খালি বইয়া বইয়া খাইবো। আমি কি হারাজীবন পরের বাইত বান্দালিগিরি করুম? আর পাত্তাম না। এই কুমিরা আইলসা বামনার লগে ঘর কইরা আমার জীবনডাই শেষ কইরা দিছি। বিয়া অইছে ১৫/১৬ বছর অইয়া গেছে। অনও ভগবান একখান পোলাপাইনের মুখ আমাগো দেখাইল না। আর মনে অয় দেখাইতোও না। হিল্লাইগা কই, আরে বামনা অহন হুইয়া থাইক্ক না। কাম কাইজ কইরা, খাইয়া দাইয়া কিচ্ছু না রাইখলে বুড়া বষে আমাগো দেখবো কেডা? বুঝে না, বুঝে নারে ভগবান। বুঝবো বুঝবো, যনকা বিছনাত পড়বো তনকা বুঝবো।

–হ, হ, যনকার টা তহনকা বুঝা যাইবো। বেয়াইন্নাবেলা বেশি চিল্লাচিল্লি করিস না কইয়া দিলাম বামনী। হালার মাইনষে বেয়াইন্নাবেলা ঘুমেত্তুন উইঠা হরিনাম জপে। আর আমার বামনী জপে শয়তানের নাম। হালার শান্তি পাইলাম না। খালি মরার জীবনকাহিনী! এই জীবনকাহিনী হুনতে হুনতে কান দুইডার ছেদা বন্ধ অইয়া গেছেগা। অহনে মাইনষে ভালা কথা কইলেও হুনি খারাপ কথা। হিল্লাইগা মাইনষের লগে লাগে কাইজ্জা। আর ঘরে ত শান্তি নাই ও-ই।

–এ-এ-এ, শান্তি বিছরায়, শান্তি! শান্তি থাকবো কইতন? কাম না করলে শান্তি থায়ে? শান্তি অ-ত শান্তি চায়! ভাত চায়, কাপড় চায়, এইডা চায় ওইডা চায়। এডি না দিতে পারলে ত অশান্তি অ থাকতো না। অশান্তি অ চায় শান্তিত থাকতে। বামনা আমার ভাত দেওনের মুরুদ নাই, কিল দেওনের গোসাই হাইজ্জা বইয়া বইয়া শান্তি বিছরায়। আইজগা আমি নিজের মতন ঘরে হুইয়া থাকুম। দেহি কেডা আম্নেরে চাইল ডাইল আইন্না রাইন্দা খাওয়ায়।

–ও-ই, বামনী, আমি আইলসা? আমি হুইয়া বইয়া খাই? আমি কি পরের বাইত ভিক্ষা করতে যাই না? পরের বাইত তন চাইল ডাইল কম আনি? যেডি আনি, এডি যায় কই? এডি কি আমি একলা খাই? আইজগা তোর রান্দন লাগত না। আমি বাইর অইলাম এই ঘরেরতুন। হালার এক পেট কুত্তায়ও চালাইতে পারে। মাইনষের বাইত খাইয়া দাইয়া রাস্তায় হুইয়া থাকুম। হের পরেও যদি আহি, কামাই রোজগার কইরা টেকা পইসা বস্তা ভইরা লইয়া আইমু। না অইলে আর বাইত আইতাম না, আমি জীবন বামনা কইয়া গেলাম। এলা তুই একলা একলা থাইছ। এই বলেই বামনা জীবন চক্রবর্তী তাঁর ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বামনা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর ভাবছে, কার বাড়িতে গেলে অন্তত দুপুরের খাবার খাওয়া যাবে! জীবন বামনা ভেবে দেখলো যার বাড়িতে অভাব অনটন নাই, সেই বাড়ি গেলেই হয়তো দুপুরের খাবার কপালে জুটতো পারে। এই ভেবে জীবন বামনা জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, সেটি গ্রামের রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে খাল, মাঝখান দিয়ে হলো রাস্তা। জীবন বামনা যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেই রাস্তার মধ্যে কে একটা গরু খুটা গেড়ে বেধে রেখেছে। গরু তাঁর গলায় বাধা রশির আওতায় ঘুরে ঘুরে ঘাস খেয়ে রাস্তার ঠিক মধ্যখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, গরুটির জন্য এখন আর জীবন বামনা রাস্তার সামনের দিকে যেতে পারছে না। বামনা এখন বসে বসে ভাবছে, এই গরু কখন রাস্তার কিনারে যাবে! এই ভেবে জীবন বামনা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও গরুটি কিছুতেই রাস্তা ছাড়ছে না। জীবন বামনাও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ি যেতে পারছে না।

বামনা এখন বসে রইল গরুটির সামনে রাস্তার একপাশে। জীবন বামনা রাস্তার পাশে বসে তাঁর ঝুলি থেকে কাগজ কলম বের করলো, তাঁর ঝুলিতে থাকা কাগজে কিছু লেখার জন্য। জীবন বামনা আবার গরুটির গতিবিধিও ফলো করছে, গরুটি দড়ি ছেড়ে লেজ তুলে গুঁতো দিতে আসে কিনা! কিন্তু না, গরুটি কাউকে গুঁতো দেওয়ার ভাব নিচ্ছে না। গরুটি তাঁর লেজ উপরে উঠিয়ে প্রস্রাব করতে লাগলো। গরুটি প্রস্রাব করে ঘাস খাবার জন্য আস্তে আস্তে রাস্তার নিচে নেমে গোলো। জীবন বামনা তা দেখে কিছুক্ষণ একা একাই হাসলো। এরপর জীবন বামনা তাঁর হাতে থাকা কাগজে তিনটি কথা লিখে, জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।

জীবন বামনা গেলেন জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে। এই বাড়িতে জীবন বামনা আরও অনেকবার গিয়েছিল। তাই জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির সবাই জীবন বামনাকে খুব ভালো করে চিনে এবং জানে। কিন্তু সেদিন সকালে জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির কেউ তখনো ঘুম থেকে উঠেছিল না। জীবন বামনাও জমিদার বাড়ির উঠোনের এককোণে অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ভালো লাগছিল না। অনেকক্ষণ পর জীবন বামনা ভাবলো আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবো? তারচেয়ে বরং অন্য বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু আমি যে আজ জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসেছি, তার একটা প্রমাণ রেখে যাই। এই ভেবে রাস্তায় বসে গরুর কাহিনী লেখা কাগজের টুকরোটা জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় গাছের আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখে, জীবন বামনা অন্য এক বাড়িতে চলে গেল।

সেইদিনই আবার কার্তিক বাবুর মুখের গোঁফদাড়ি ছাঁটানোর কথা মরণ সীল নামের এক নাপিতের। যেই নাপিত জমিদার কার্তিক বাবুর গোঁফদাড়ি ছাঁটতে এসেছে, সেই নাপিতই আবার গণেশ জমিদারের গোঁফদাড়িও ছাঁটানোর কাজ করে। এদিকে গণেশ বাবু আর কার্তিক বাবুর সাথে অনেক আগে থেকে রেষারেষি চলছিল। এমন রেষারেষির ফলে কার্তিক বাবু সুযোগ খুঁজে গণেশ বাবুকে মারতে, গণেশ বাবু সুযোগ খুঁজে কার্তিক বাবুকে মারতে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর দুই জমিদারের একে অপরকে খতম করার চেষ্টা। কিন্তু কেউ কাউকে সুযোগ বুঝে কোপ দিতে পারছে না। একসময় জমিদার গণেশ বাবু এই মরণ শীল নাপিতকে ফুসলিয়ে আর টাকার লোভ দেখিয়ে হাত করে ফেলে। মরণ শীল নাপিতকে গণেশ বাবু বুদ্ধি দিলো, তুমি যেদিন কার্তিক বাবুর গোঁফদাড়ি ছাঁটতে যাবে, সেদিন তোমার হাতের ধারালো খুর দিয়ে কার্তিক বাবুর গলা কেটে ফেলবে। বিনিয়ে তোমাকে এক হাজার টাকা দেওয়া হবে। যা দিয়ে তুমি অনেক বছর কাজ না করেও পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে পারবে। জমিদার গণেশ বাবুর কুবুদ্ধিতে দরিদ্র নাপিত মরণ শীল রাজি হয়ে, এইদিনই জমিদার কার্তিক বাবুকে মেরে ফেলার প্রস্তুতি নিয়ে আসে তাঁর বাড়িতে।

নাপিত মরণ শীল জমিদার বাড়িতে এসে ডাক দিলো, ‘জমিদার বাবু, ‘আমি মরণ আইছি। আম্নে আহেন।’ নাপিত মরণের ডাক শুনে জমিদার কার্তিক বাবু গোঁফদাড়ি ছাঁটতে বাড়ির উঠোনে এসে, দরজার বরাবর মুখ করে জলচকির পর বসলো। নাপিত বসলো জমিদার বাবুর সামনা-সামনি মুখ করে। নাপিতের সাথে ছোট একটা বাক্স। বাক্সের ভেতরে চুলদাড়ি কাটার খুর কেচি বাটি-সহ লম্বা একটা পশুর চামড়া। যা দিয়ে খুর ধার করে। বাক্স খুলে ভেতর থেকে ছোট পিতলের বাটিটা বের করলো। বাটিতে জল ঢেলে জমিদার বাবুর মুখে সাবান মাখলো। এরপর নাপিত যখন লম্বা চামড়ার সাথে খুরটা ঘষতে ছিল, তখন জমিদার বাবুর চোখ গেল দরজায় লাগানো জীবন বামনার লেখা কাগজের দিকে। তখন নাপিত খুর ঘষছে, আর জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার লেখাগুলো পড়ছে, “ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর।” নাপিত এখন মনে মনে ভয় পাচ্ছিল। নাপিত মনে মনে বলছে, ‘খাইছে আমারে, কার্তিক বাবু কি কইতাছে? কার্তিক বাবু কি আগেত্তে টের পাইয়া গেছে? চামড়ার লগে খুরডা ত আমি তিনবারই ঘষা দিছি। হিল্লাইগাই কার্তিক বাবু কইছে, ‘ঘষন্তি মাঝন্তি তিন খুর।’

এই ভেবে ভয়ে ভয়ে নাপিত মরণ শীল যখন মুখটা কালো করে ফেললো, জমিদার বাবু তখন দরজায় জীবন বামনার লাগানো কাগজের লেখা পড়ছে, ‘মুখ অতিশয় গম্ভীর।’ নাপিত মরন শীল এখন ভয়ে থরথর। এবার কাঁপতে কাঁপতে নাপিত মরণ শীল বাটি থেকে কয়েক ফোঁটা জল বামহাতের তালুতে দিয়ে খুরটা ডানহাতে ধরে যখন ঘষছিল, জমিদার বাবু তখন দরজায় জীবন বামনার লাগানো কাগজে লেখা পড়ছে, ‘শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।’ জমিদার কার্তিক বাবু এই কথা বলার সাথে সাথেই নাপিত খুর ফেলে দিয়ে কার্তিক বাবুর পায়ে ধরে বলছে, ‘বাবু আমারে মাপ কইরা দেন। আমার কোনও দোষ নাই। ঐ গণেশ জমিদার আমারে এক হাজার টেকা জোর কইরা দিয়া কইছে আম্নের গলা কাইট্টা মাইরা হালাইতে।’ নাপিতের মুখে এই কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবু জলচকি থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। জমিদার কার্তিক বাবুর লোকজন এসে নাপিতকে ধরে বেধে ফেললো।

এরপর জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে বলছে, ‘আজ সকালে আমার বাড়িতে কে এসেছিল? তোমরা কেউ কি দেখেছ?’ একে একে বাড়ির সবাই বললো, ‘না।’ কার্তিক বাবু বললো, ‘তাহলো আমার ঘরের দরজায় এই কাগজটা লাগালো কে?’ এবারও বাড়ি সবাই বললো, ‘জানি না।’ এবার জমিদার কার্তিক বাবু ঢুলিকে আসতে খবর পাঠালো। ঢুলি আসলো। ঢুলি জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী ঘোষণা দিতে হবে এবং কীভাবে বলতে হবে?’ জমিদার কার্তিক বাবু ঢুলিকে সব বুঝিয়ে দিলো। ঢুলি তাঁর ঢোল নিয়ে জমিদারের মুল্লুকে বের হলো।

ঢুলি কার্তিক বাবুর পুরো মুল্লুকে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিলো।, ‘আজ জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় একটা কাগজ লাগানো ছিল। সেই কাগজের জন্য আজ জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন রক্ষা পেল। কিন্তু এই কাগজটা কে লাগিয়েছে তা এখনো জানা যাচ্ছে না। তাই ঘোষণা দিচ্ছি যে, যিনি এই কাগজের টুকরোটি জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় লাগিয়েছে, কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারলে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যিনি এই কাগজে লিখেছেন, তাকে দুই হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, দমদমা-দম, দমদমা-দম, দম-দম-দম!

ঢুলি আবারও বলতে লাগলো, ‘আজ জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় একটা কাগজ লাগানো ছিল। সেই কাগজের জন্য আজ জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন রক্ষা পেল। কিন্তু এই কাগজটা কে লাগিয়েছে তা এখনো জানা যাচ্ছে না। তাই ঘোষণা দিচ্ছি যে, যিনি এই কাগজের টুকরোটি জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় লাগিয়েছে, কেউ তাঁর সন্ধান দিতে পারলে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যিনি এই কাগজে লিখেছেন, তাকে দুই হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, দমদমা-দম, দমদমা-দম, দম-দম-দম!

ঢুলির ঢোলের আওয়াজে অনেক মানুষে জড়ো হয়ে গেল। ঢুলি সবার উদ্দেশে বললো, ‘কাগজটি কে লাগিয়েছে, তার সন্ধান কেউ কি দিতে পারবেন? এ বিষয়ে কেউ কি কিছু জানেন? জানা থাকলে ঢোল ধরুন, পুরস্কার নিন!

কিন্তু ঢুলির এই ঘোষণায় উপস্থিত অনেকে জানি বলে ঢোল ধরে। যাঁরা ঢোল ধরে, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে। জমিদার কার্তিক বাবু কাগজে লেখা বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, তখন আর কেউ এর সদুত্তর দিতে পারে না। শেষমেশ কান ধরে ওঠবস করে ছাড় পেতে হয়। এরপর আর কেউ এই খবর শুনলেও ঢোল ধরার সাহস পায় না। কারণ, সত্যিকারের প্রমাণ কারোর কাছে নেই বলে। এভাবে দুইদিন গত হয়ে গেল ঢুলির ঢোল পেটানো। তারপরও এর কোনও সুরাহা মিলছে না। শেষতক এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার কানে। জীবন বামনা তখন আরেক মুল্লুকে থাকা এক মন্দিরে থেকে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছিল।

ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর–মুখ অতিশয় গম্ভীর-২ শেষ পর্ব

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে। হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

প্রহরীর সাথে কথা বলে হিরা যাচ্ছে রাজদরবারে। হিরা’র পিছনে পিছনে গেইটের প্রহরীও গেইট ফেলে রেখে দরবারের দিকে ছুটলো। প্রহরীর উদ্দেশ্য উজির আর ছেলের বাজারের কাহিনী শোনার জন্য। আর উজির সাহেব তো আগেই দরবারে এসে রাজার কাছে হিরা বিষয়ে সব বৃত্তান্ত খুলে বলেছে। উজিরের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে রাজাও একটু দুশ্চিন্তায় আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, আর ভাবছিল।

এমন সময় হিরা রাজদরবারে এসে হাজির। পিছনে পিছনে গেইট প্রহরীও। হিরা’কে দেখেই উজির জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘এই যে হুজুর বাটপারটা এসেছে। মনে হয় আবার পয়সা তিনেক নেওয়ার জন্যই দরবারে এসেছে। দিবেন না হুজুর, দিবেন না। আর একটি পয়সাও দিবেন না। আপনি পয়সা দিলেন সদাই কেনার জন্য। আপনার দেওয়া সেই পয়সা দিয়ে জিলাপি কিনে খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। কাকে যে সদাই আনতে দিলেন হুজুর, এটা আমার মাথায় কিছুতেই খেলছে না। শেষপর্যন্ত আমাকে থাপ্পড় মারার বিচারটাও করলেন না, হুজুর।’ এই বলেই উজির হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাজা উজিরকে শান্তনার সুরে থামতে বললেন।

এরপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, এই ছেলে, ‘আমার উজির যা বলেছে, তা কি ঠিক?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, রাজা হুজুর। আপনার উজির সাহেব যা বলেছে সবই সত্যি।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে আমার পয়সা তুমি খেয়ে ফেলেছ?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, হুজুর। আমি পয়সা খেয়ে সদাইও কিনেছি।’ হিরা’র কথা শুনে উজির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! কখন সদাই কিনলি? তুই বেটা এক পয়সার জিলাপি খাইলি। এক পয়সা ফকিরকে দিলি। আর এক পয়সা দিলি কোমড় ঢুলানি ড্যান্স দেইখা। তিন পয়সা তো এখানেই শেষ! আবার সদাই কিনলি কোত্থেকে? এই বেটা, সদাই কই? সদাই বের কর? এখানে বাটপারি করতে আসছ? তেরো সিকে ঢুকাইয়া রাখুম, বুঝলি!’

উজিরের বাড়াবাড়িতে রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে হিরা’কে বললো, ‘এই ছেলে, সদাই যদি কিনেই থাক, তাহলে সদাই কোথায়? সদাই বের করো। নাহয় পয়সা বের করো! যেই তিন পয়সা তোমাকে দিয়েছি, সেই তিন পয়সা দিয়ে এক মুল্লুকের জমি কেনা যায়। তুমি বাবা সদাই দাও, নাহয় পয়সা বের করো।’ রাজার কথায় হিরা কিছুই বলছে না। হিরা চুপ চোরের মতো এক কোণে করে বসে আছে।

উজির হিরা’র দিকে টগবগিয়ে চাচ্ছে আর বলছে, ‘রাজা হুজুর, আপনি ও-কে বন্দি করে কারাগারে ঢুকিয়ে রাখুন। সকালে ওঁর ঠিকানামতো ওঁদের বাড়িত্তে গিয়ে, ওঁর বাবাকেও তিন পয়সা বাটপারির দায়ে বন্দি করে নিয়ে আসবো। তারপর পরের পয়সা দিয়ে জিলাপি খাওয়া বের করবো।’ এবার হিরা বসা থেকে উঠে হাত দুটো জোড় করে বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাকে সদাই তিনটি কী কী যেন আনতে বলেছিলেন? দয়া করে আবার একটু বলুন, সবাই শুনুক! আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

রাজা বললো, ‘ওহ্! আচ্ছা, মনে হয় তুমি সদাই তিনটির নাম ভুলে গিয়েছ। তাহলে শুনো, আবারও বলছি! এক পয়সার এখন। এক পয়সার তখন। আর এক পয়সার এখনো না তখনো না। এবার শুনলে তো?’ হিরা বললো, ‘তাতো আমি এনেছি হুজুর! সদাই গুলো সব আপনার উজিরের কাছে আছে।’ এই কথা শুনেই উজির বসা থেকে দৌড়ে গিয়ে হিরা’র গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! আমার কাছে সদাই দিছস কখন? তুই বেটা আমাকে জিলাপি খাওয়াতে চাইলি, তাওতো আমি খাইনি! এখন বলছিস সদাই আমার কাছে?’ রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে বললো, ‘এই ছেলে, উজির সাহেবের কাছে সদাই গেলো কীভাবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমি যা করেছি, আপনার উজির সাহেবের সামনা-সামনিই করেছি। তাই সদাই তিনটিও উজির সাহেবের সহযোগিতায় করা হয়েছে।’ উজির উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘কই, সদাই কই হে? জিলাপি খাও! ফকিরকে দাও! ড্যান্স দেখো! আবার সদাই কিনছে? বেটা বাটপার।’

রাজা বললো, ‘কখন কীভাবে সদাই কিনলে? আর আমার উজির সাহেবের কাছেই বা কখন দিলে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, উজির সাহেব-সহ যখন আপনার বাড়ির সামনে বউ বাজার গেলাম। বাজারে ঢুকতেই দেখি এক লোক জিলাপি ভেজে রেখেছে। উজির সাহেবকে বললাম, আমি জিলাপি খাব। উজির সাহেব জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, জিলাপি গরম না ঠান্ডা? জিলাপি বিক্রেতা বললো, একেবারে টাটকা গরম জিলাপি। এখন ভেজে রেখেছি, এখন। উজির সাহেব একপোয়া জিলাপি দিতে বললেন, জিলাপি বিক্রেতা একপোয়া জিলাপি মেপে দিলেন। আমি এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে জিলাপি খেতে শুরু করলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে একটি সদাই, ‘এক পয়সার এখন’। কারণ, জিলাপি বিক্রেতা বলেছিল, এখন ভেজে রেখেছি এখন। তাই আপনার একটি সদাই, এখন।’

হিরা’র কথা শুনে উজির সাহেব এখন ভাবছে! আর মনে মনে বলছে, হায়! হায়! ঠিকই তো! রাজা তো এই এখনের কথাই বলছিল। এটা তো আমিও পারতাম! ছেলেটা তো ঠিকই করেছে।

হিরা’র কথা শুনে রাজা বললো, ‘তা মেনে নিলাম। বাদবাকি সদাই গুলোর হিসাব দাও।’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জিলাপি খাচ্ছি আর হেঁটে যাচ্ছি বাজারে ভেতরে। আপনাদের এখানকার বাজার খুবই সুন্দর হুজুর। হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম। এমন সময় এক ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাইলো। যখন ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো তখন আমি ভিক্ষুককে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে দ্বিতীয় সদাই, এক পয়সার তখন।’

এরপর গেলাম আপনার বউ বাজারের শেষ মাথায়। সেখানে যেতেই কানের সামনে বাজনার আওয়াজ এলো। একটু সামনে গিয়ে দেখি মানুষ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নাচগান চলছে। আমি হুজুর নাচগানের পাগল। তাই আর বাইরে থাকতে পারিনি। ঠেলেঠুলে ভেতরে গেলাম। রূপবান গানের সাথে এক হিজরার ড্যান্স দেখে নিজেও কিছুক্ষণ নাচলাম। চমৎকার ড্যান্স হুজুর। আপনার উজির সাহেবও দেখেছে। উনি আমার পিছনেই ছিল। একসময় যখন ড্যান্স শেষ হলো, সবাই সবার সাধ্যমতো এক পয়সা আধা পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিচ্ছিলো। তা দেখে আমিও সাথে থাকা এক পয়সা হিজরাকে বকশিস দিয়ে দেই, হুজুর। আপনার দেওয়া তিন পয়সার মধ্যে এই এক পয়সার হিসাব পাপপুণ্য বা ইহকাল পরকালের কোনও কাজে লাগেনি। তাই এটা জাহান্নামই গেলো হুজুর। এটা হলো আপনার তিন পয়সার তিনটি সদাই’র মধ্যে তৃতীয় সদাই, এখনো না তখনো না। এই বলেই হিরা উজিরকে জিজ্ঞেস করছে, কি উজির সাহেব, আমি কি মিথ্যে কিছু বলেছি?’

উজির বোকার মতো চুপ করে বসে বসে ভাবছে, এই সদাই তো আমি নিজেও করতে পারতাম। কেন যে বোকার মতো অপারগতা স্বীকার করলাম! পারবো না বলে ছেলেটার হাতে ছেড়ে দিলাম! হায়রে কপাল আমার! এখন ছেলেটাই তো রাজ্যের সব নিয়ে নিবে!

হিরা’র কথা শুনে রাজা এবার মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা তো আমার তিন পয়সার তিনটি সদাই ঠিকই কিনে ফেলেছে। এখন যদি আমি বলি সদাই তিনটি ঠিক হয়েছে, তাহলে তো আমার রাজ্যের অর্ধেক ছেলেটার হাতেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। না, তা হতে দেওয়া যাবে না। এই ভেবেই রাজা বললো, ‘শুনো ছেলে, এই তিনটি সদাই’র মধ্যে শেষ সদাইটি এভাবে হবে না। এটা অন্যভাবে হবে। তিনটি সদাই’র মধ্যে তুমি দু’টি সদাই ঠিকমতো করতে পেরেছ। তৃতীয় সদাইটি ঠিকমতো করা হয়নি।’

রাজার কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে হেল। কেউ খুশি হলো। কেউ রাগ হলো কেউ আবার দুঃখও পেলো। উজির এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো, ছেলেটা তো সদাই তিনটি ঠিকমতোই করেছে। কিন্তু, রাজা এখন অস্বীকার করছে কেন? ছেলেটা যদি কিছু বকশিস পায়, তাহলে তো আমিও সেই বকশিস থেকে কিঞ্চিৎ কিছু পেতাম। তা যে-ভাবেই হোক ছলে-বলে কলেকৌশলে ছেলেটার কাছ থেকে আদায় করতাম। কিন্তু রাজার কথায় মনে হচ্ছে, সব আশাই আমার বিফলে যাচ্ছে। তারপরও দেখা যাক, কী হয়! এই ভেবে উজির কালো মুখ করে হিরা’র দিকে চেয়ে থাকলেন।

হিরা রাজার কথা শুনে বললো, ‘রাজা হুজুর, তা যদি আপনার মনোমত না হয়। তাহলে তো আমার কিছুই করার থাকলো না। দয়া করে আমাকে মাপ করে দিন। যদি তিন পয়সার জন্য আপনার কোনও দাবি থাকে তাও বলুন! আমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে আপনার দেওয়া তিন পয়সা জোগাড় করে নিয়ে আসবো। তবে এরজন্য আমাকে অন্তত তিনদিন সময় দিতে হবে হুজুর।’ এই বলেই হিরা রাজদরবার থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলো।

রাজাও দরবারে বসে বসে ভাবতে লাগলো, এরকম মিথ্যা কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। ছেলেটা তো আমার কথামতো তিনটি সদাই ঠিকই করেছে। কিছু চাওয়া-পাওয়ার জন্য এমন একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই ভেবে মনস্থির করলো হিরা’কে ফিরিয়ে আনতে ডেকে পাঠাবেন, উজিরকে। কিন্তু হিরা ততক্ষণে রাজবাড়ি থেকে অনেকদূর চলে গেছে। রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটাকে ডেকে আনুন! আমি ছেলেটাকে উপযুক্ত বকশিস দিবো। এমনকি, ছেলেটা যা চাইবে, তা-ই দিবো। ডাকুন ছেলেটাকে! এই বুদ্ধিমান ছেলেটাকে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে ডেকে আনুন।’ রাজার উপদেশ পেয়ে উজির সাহেব মনের আনন্দে দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে মনে মনে বুদ্ধি করলেন, ‘যে-করেই হোক, ছেলেটার কাছ থেকে বকশিসের অর্ধেক আমার পেতেই হবে।’

আসলেন গেইটের সামনে। প্রহরী বললো, ‘উজির সাহেব, তাড়াতাড়ি দৌড় দেন! ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনুন! ছেলেটা বকশিস পেলে আমিও কিছু বকশিস পেতে পারি। যান যান হুজুর, তাড়াতাড়ি যান।’ গেইট থেকে বের হয়ে উজির দৌড়াচ্ছে। হিরাও হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। উজির দৌড়ে গিয়ে হিরা’র সামনে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, অনেক কষ্ট করে রাজাকে রাজি করিয়েছি। এখন তুই বাবা যা চাস, তা-ই পাবি! কিন্তু বাবা আগে আমার সাথে তোর একটা শর্ত করতে হবে৷’ হিরা বললো, ‘কী শর্ত করতে হবে উজির সাহেব? তা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন!’ উজির বললো, ‘তুই বাবা যা পাবি, তার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। আমি বাবা রাজাকে তেল মাখতে মাখতে হাত দুটো বিষ করে ফেলেছি। আমি যদি রাজাকে না বলতাম, তাহলে রাজা আর রাজি হতো না, তোর কপালেও আর বকশিস জুটতো না। এখন বল, তুই আমার সাথে শর্ত করতে রাজি কি-না?’

হিরা হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ উজির সাহেব, আমি রাজি আছি। তো, এভাবে মুখের কথার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো বকশিস পেয়ে আমিও অস্বীকার করতে পারি। সেজন্য একটা কাগজে লিখে সই-স্বাক্ষর করে রাখা ভালো।’ উজির মনের আনন্দে রাজি হয়ে গেলেন। হিরা একটা দোকান থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ সংগ্রহ করে কাগজে লিখল, “রাজা থেকে আমি যা পাবো, তার অর্ধেক সম্মানিত উজির সাহেব পাওনা।” এরপর লেখার নিচে উজিরের স্বাক্ষর রাখলো।

এদিকে রাজবাড়ির গেইট প্রহরী গেইট খুলে আগে থেকেই তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে, কখন উজির-সহ ছেলেটা আসবে। উজির-সহ হিরা যখন রাজবাড়ির গেইটের সামনে আসলো, গেইট প্রহরী হিরা’কে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মালিশ করেছি। এখন তুই যা পাবি আমাকে অর্ধেক দিবি। বকশিস কিন্তু আমার কারণেই পাচ্ছিস।’ হিরা বললো, ‘আমি যা পাবো তা থেকে তো অর্ধেক উজির সাহেবকে দিতে হবে। তাহলে আপনাকে আমি কীভাবে অর্ধেক দিবো?’ প্রহরী বললো, ‘তাহলে উজির সাহেবকে অর্ধেক দিয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক আমাকে দিবি।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। তবে এই কাগজে একটা স্বাক্ষর দিতে হবে।’ গেইট প্রহরী মনের আনন্দে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে গেইট ফেলে তিনজন মিলে চললো রাজদরবারের দিকে।

তিনজন মিলে দরবারে যেতেই দেখা হয় এক মহিলার সাথে। তিনি রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সেই মহিলা হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মেখেছি। তারপরও রাজা কি-আর রাজি হয়! অনেকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছি তোকে বকশিস দিতে। এখন বাবা তুই যা পাবি, আমাকে এর অর্ধেক দিবি।’ হিরা হেসে বললো, ‘আমার বকশিসের ভাগিদার আপনার মতো আরও দুইজন আছে। তাহলে আপনাকে দিবো কীভাবে?’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা বললো, ‘তাঁদের দিয়ে থুইয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক দিলেই হবে বাবা।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখানে একটা স্বাক্ষর দিন!’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা স্বাক্ষর জানতেন না। তাই কলমের কালি মহিলার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপসই নিয়ে নিলো। এবার চারজন গিয়ে হাজির হলো রাজদরবারে।

রাজদরবারে তখন অনেকেই উপস্থিত ছিল। যত লোকই থাকুক-না-কেন, হিরা’ই এখন দরবারের হিরো। সবার দৃষ্টি হিরা’র দিকে। হিরা’কে রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, বাজার থেকে তোমার এনে দেওয়া তিন পয়সার তিনটি সদাই আমি খুশি মনে গ্রহণ করেছি। আমি যা চেয়েছি আর যেভাবে চেয়েছি, তুমি ঠিক সেভাবেই করতে পেরেছ। তাই আমি তোমাকে উপযুক্ত বকশিস দিতে চাই। এখন বলো তুমি কী চাও! তুমি এখন এই মুহূর্তে যা চাইবে তা-ই আমি তোমাকে দিতে রাজি আছি। বলো তুমি কী চাও!’

রাজার এই ঘোষণা শুনে উজির হিরা’র কানে কানে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, ‘তুই বাবা রাজার সিংহাসনটা চা! তাহলে আমি রাজ্যের অর্ধেক পেয়ে যাবো। এই রাজার উজিরগিরি আর ভালো লাগে না। তুই বাবা তাড়াতাড়ি সিংহাসনটা চা।’ উজিরের এরকম পরামর্শে হিরা বললো, ‘চাচ্ছি উজির সাহেব, চাচ্ছি! চাইতে আমি আর কম চাচ্ছি না। একটু বেশি করেই চাচ্ছি। যাতে আপনাদের দিয়ে আমারও কিছু থাকে।’ হিরা’র কথা শুনে উজির খুশিতে তাইরে-নাই-রে নাই-রে-না করে নাচতে লাগলো!

হিরা’র চাইতে দেরি দেখে রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার! চাও তুমি, কী চাইবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, চাইতে আমার কেমন যেন দ্বিধাবোধ হচ্ছে। আমি যা চাইবো, তা যদি আপনি না দেন, তাই।’ হিরা’র এমন কথায় রাজা খুব রেগে বললো, ‘কি, আমার মুখের কথার কি কোনও দাম নেই? চাও তুমি কী চাইবে!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার কাছে ধনসম্পত্তি, রাজ সিংহাসন এসব কিছুই চাই না।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি কী চাও? যা-কিছুই চাও, তা-ই তোমাকে দেওয়া হবে। বলো কী চাও!’ হিরা বললো, রাজা হুজুর, ‘আমি আপনার দরবারে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি চাই!’

হিরা’র মুখে এই কথা শুনে রাজা-সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে হিরা’র দিকে তাকিয়ে রইল। উজির কাঁপতে কাঁপতে হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘আরে বাবা, তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’ হিরা উজিরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আবারও বললো, ‘রাজা হুজুর, ‘আমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি দেওয়ার ঘোষণা দিন!’

রাজা অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ভেবে দেখলো, ছেলেটার জুতার বাড়ি চাওয়ার পিছনে কোনও কারণ থাকতে পারে। তাই ছেলেটা জুতার বাড়ি চাচ্ছে। দেখি এর পিছনে কী থাকতে পারে? এই ভেবে রাজা বললো, ‘ঠিক আছে, আমি আজকে এ-ই দরবারে সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিচ্ছি, তোমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়িই দেওয়া হবে।’ রাজা ঘোষণা দেওয়ার পর উজির কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে কপালে থাপ্পড় মারতে লাগলো। গেইট প্রহরী রাজ দরবার থেকে বাইরে যেতে চাইলে, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জুতার বাড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার রাজদরবার থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে। দয়া করে আপনি তাড়াতাড়ি ঘোষণা দিন!’

হিরা’র জুতার বাড়ি চাওয়ার বিষয়টি আর রাজার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাজা দরবারের গেইটে থাকা দুইজন সিপাহিকে বললো কেউ যেন দরবার থেকে বেরুতে না পারে। যেই কথা সেই কাজ। দরবারের গেইট মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। জুতার বাড়ি দেওয়ার জন্য জল্লাদ এসে হাজির হলো। (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারার জন্য রাজার পুরানো গোডাউন থেকে রাজার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিদের ব্যবহার করা সব পুরাতন জুতা খুঁজে বের করে দরবারে আনা হলো। জুতার বিশাল স্তুপ দেখে উজির-সহ গেইট প্রহরী আর পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলার এখন জীবন যায় যায় অবস্থা! এর মধ্যে উজির কয়েকবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছিল।

রাজা জল্লাদকে হুকুম দিলো, ‘এই জল্লাদ, ছেলেটাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারো।’ রাজার হুকুম পেয়ে জল্লাদ দুইহাতে দুটি জুতা নিয়ে হিরা’র দিকে এগুতেই, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার কিছু কথা আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কথা?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, এই বকশিস’র মধ্যে কিছু ভাগবাটোয়ারা আছে।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘জুতার বাড়ির মধ্যে কেমন ভাগা-ভাগি থাকতে পারে?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আমাকে এই বকশিস দেওয়ার জন্য আপনার উজির নাকি আপনাকে তেল মালিশ করে রাজি করিয়েছে? তাই উনি আমার কাছে বকশিস’র অর্ধেক দাবি করেছে। দেখুন, আমার সাথে উজিরের শর্ত করার কাগজ। যেই কাগজে আপনার উজিরের স্বাক্ষর আছে। তাই আমি উনার সেই দাবি পূরণ করতে চাই, রাজা হুজুর। দয়া করে (৫.০০০) পাঁচ হাজার জুতার বাড়ি আপনার সম্মানিত উজিরকে আগে দেওয়া হোক। হিরা’র কথামতো রাজা তা-ই হুকুম দিলেন। জল্লাদ আগেকার দিনের পুরাতন জুতা দিয়ে ঠাস্ ঠাস্ করে শখানেক বাড়ি উজিরের গালে মাথায় বসিয়ে দিলেন। উজিরের এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। শেষতক হিরা’র অনুরোধে পাঁচ (৫.০০০) হাজার জুতার বাড়ি থেকে বাকি থাকা সব মাপ করে দিলেন। জল্লাদ বেটা জুতা মারা বন্ধ করলেন।

রাজা আর বাদবাকি (৫.০০০) জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারতে বললে, হিরা তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘রাজা হুজুর, এই (৫.০০০) পাঁচ হাজারের মধ্যেও ভাগ আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ভাগটা কাকে দিতে হবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, এই ভাগিদার হলো আপনার গেইট প্রহরী।’ রাজা অবাক হয়ে বললো, ‘এই গেইট প্রহরী মানে দারোয়ান। দারোয়ানও তোমার কাছে বকশিসের ভাগ চেয়েছে?’ হিরা বললো, ‘হ্যাঁ রাজা হুজুর! উনিও নাকি আমার বকশিসের জন্য আপনাকে তেল মেখেছে? তাই উনাকেও থেকে যাওয়া বাদবাকি বকশিসের অর্ধেক দিতে হচ্ছে।’ রাজা রেগে-মেগে জল্লাদকে বলললো, ‘ও-কে আড়াই হাজার জুতার বাড়ি খুব জোরে জোরে মারবে। রাজার আদেশ বলে কথা। তাই জল্লাদ গেইট প্রহরীকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুইহাতে মারতে শুরু করলো। শখানেক মারার পর গেইট প্রহরীর জীবন যায়। তখন হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, গেইট প্রহরীকে মাপ করে দিন।’ হিরা’র কথামতো রাজা মাপ করে দিয়ে জল্লাদকে বললো, ‘থেকে যাওয়া বাকি আড়াইহাজার জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারো।’

হিরা বললো, রাজা হুজুর, আরও একজন ভাগীদার আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘সে কে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী এই মহিলা।’ রাজা একেবারে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘এই সুইপার মহিলাও তোমার কাছে ভাগ চেয়েছে? কী আশ্চর্য! আমার দরবারে কি সবাই চোর বাটপার? এতো দিন মনে হয় এঁরা রক্তচোষা হয়ে আমার রক্ত তো চুষে খেয়েছেই, সাথে আমার রাজ্যের সকলের রক্ত চুষে খেয়েছে। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। আজ তোমার কারণে সবাইকে আমার চেনা হয়ে গেল। এই বলেই জল্লাদকে বললো, ‘এই সুইপার মহিলাকে পুরো ১২৫০ টি জুতার বাড়ি মেরে, আরও ৫০টি জোতা বেশি মারবে। একটিও যেন কম না হয়।’ জল্লাদ সাথে সাথে শুরু করে দিল ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ বাড়ি। সুইপার মহিলা মরে যাবে ভেবে হিরা গিয়ে জল্লাদের হাতে ধরে জুতার বাড়ি থামালেন। জল্লাদ থামলেন।

এবার হিরা রাজাকে বললো, ‘রাজা হুজুর, (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি থেকে আর যা বাকি আছে সব আমাকে মারতে হুকুম দিন।’ এই বলেই হিরা তাঁর শরীরের জামা খুলে খালি গায়ে দরবারের মাঝখানে দাঁড়ালো। তখন রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে হিরা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ থেকে তুমিই আমার এই সিংহাসনে বসবে। আমি যে ক’দিন বেঁচে থাকি, তোমার পাশে বসে থাকবো। আজ থেকে তুমিই রাজ্যের রাজা। আমি তোমার প্রজা।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

এখানেই সমাপ্তি।

দুই অন্ধ ভিক্ষুক যখন এক রাস্তায়

বর্তমানে প্রত্যেক জেলা শহরে অনেক ভিক্ষুক দেখা যায়। যাঁদের সংসার চলে ভিক্ষায়, তাঁদেরই আমরা ভিক্ষুক বলে থাকি। এঁদের মধ্যে শহরে থাকা ভিক্ষুকদের ভিক্ষা বা খয়রাত করার স্টাইল একরকম, আর গ্রামগঞ্জের ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার সিস্টেম ভিন্নরকম। শহরে ভিক্ষা করা অনেক ভিক্ষুক নিজস্ব পদ্ধতিতে বানানো বিশেষ ধরনের তিনচাকা বিশিষ্ট গাড়ি চড়ে ভিক্ষা করে। কেউ কেউ আবার পাঁচ-সাতজন মিলে দলবেঁধে নির্দিষ্ট এক জায়গায় বসে গানের সুর তুলে ভিক্ষা করে। দলীয় ভিক্ষুকদের গানের সুর হলো–
‘আমার আল্লা রসূলের নাম
দিলে পরে সার,
আমার আল্লা রসূলের নাম।
কত টেকা কত পইসা হারাইয়া যে যা-য়-য়-য়,
অসহায়রে দান করিলে আখেরাতে পা-য়-য়।
আমার আল্লা রসূলের নাম।’

এমন আরও অনেকরকমের গানের সুর তুলে শহরের দলীয় ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করে থাকে। কেউ কেউ চিৎপটাং হয়ে শুয়ে শুয়ে আল্লা আল্লা করতে থাকে। আবার কোনও কোনও ভিক্ষুকরা তিন-চারজন একসাথে লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে আল্লা রসূলের নামে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার দলবল না করে একা একাই প্রতিদিন পায়ে হেঁটে ভিক্ষা করে। এঁদের মধ্য আছে কিছু মহিলা ভিক্ষুক। এঁরা প্রতি শুক্রবার সকাল হতে-না-হতে ঘর থেকে বের হয়। এঁরা প্রত্যেক দোকানে, আর হাঁটাচলার মাঝে মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চায়। এসব মহিলা ভিক্ষুকরা এখন বাসাবাড়িতে বেশি যায় না। গেলেও, বাসাবাড়ির গৃহিণীদের দেওয়া চালডাল আগের মতো নিতে চায় না। এঁরা এখন চায় নগদনারায়ণ টাকা। যে যা-ই দিক, তা-ই নিবে, কিন্তু তাঁরা চালডালের বোঝা বইতে নারাজ।

আর গ্রামের ভিক্ষুকরা কষ্ট করে পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি বাড়ি আর হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে। এসব গ্রাম্য ভিক্ষুকরা মানুষের কাছে হাত পাতার আগে বলে থাকে–
‘ভিক্ষা দেন গো মা লক্ষ্মীরা,
খারা কইরা রাইখেন না।’
তখন যে যা দেয়, তা-ই তাঁরা নিয়ে নেয়। তাঁদের কোনও আপত্তি থাকে না, নামমাত্র ভিক্ষা পেলেই মহাখুশি!

সেসব গ্রাম্য ভিক্ষুকদের মধ্যে আনোয়ার নামের একজন গ্রাম্য অন্ধ ভিক্ষুক ছিল। ভিক্ষুক আনোয়ার জন্ম থেকেই ছিলো অন্ধ। ভিক্ষুক আনোয়ার যখন রাস্তায় বের হয়, তখন তাঁর হাতে একটা লাঠি থাকে। তাঁর হাতে থাকা লাঠিটা জাতিসংঘ থেকে দেওয়া বিশেষ ধরনের এক লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে আনোয়ার গ্রামের হাটবাজার-সহ বাড়িতে বাড়িতে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুক আনোয়ার যখন ঠুক ঠুক করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তখন ভিক্ষুক আনোয়ার আল্লাহ রাসূলের নাম ধরে সুর তোলে–
‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।
হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।’

ভিক্ষুক আনোয়ার’র মুখে সেই মধুর সুর শুনে মানুষ তাঁর হাতে টাকা দেয়, পয়সা দেয়। কেউ কেউ রুটি কলা খাবারও কিনে দেয়। একদিন আনোয়ার বাড়ি থেকে ভিক্ষা করতে বের হলো। সকাল থেকে ভিক্ষা করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া ভিক্ষা করার মাঝে পরের বাড়িতেই হয়। দুপুরের পর বিকাল হতে লাগলো। এখন তো ভিক্ষুক আনোয়ার’র বাড়ি ফেরার পালা। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার বাড়ি আসার পথ ধরে ঠুক ঠুক করে হেঁটে আসছিল–
‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক” বলতে বলতে।’

যেই রাস্তা দিয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দুইপাশে গাছ-গাছালি, একটু পরপর খাল-বিল, ডোবা-নালা। রাস্তার পাশে যা-ই থাকুক, রাস্তা কিন্তু ভিক্ষুক আনোয়ার’র খুবই পরিচিত ছিল। কারণ, এই রাস্তা দিয়েই সবসময় ভিক্ষুক আনোয়ার হাঁটা-চলা করে থাকে, তাই রাস্তাটি তাঁর চেনা-জানা। ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতে। সেই রাস্তা দিয়েই পাশের গ্রামের এক অন্ধ ভিক্ষুক বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে আসছে। সেও সারাদিন ভিক্ষা করে তাঁর বাড়ি ফিরছিলো।

পাশের গ্রামের ভিক্ষুক ভিক্ষা করার সময় আল্লাহ রাসূলের নামে মুখে কোনও সুর তোলে না। এই ভিক্ষুক শুধু জিকিরের সুরে বলতে থাকে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’
এছাড়া আর কিছুই সে বলতো না। এতেই মানুষ বুঝে নিতো অন্ধ ভিক্ষুকটা ভিক্ষা করতে এসেছে। তারপর কেউ ভিক্ষা দিতো, কেউ মাপ চেয়ে নিতো। এখন এই দুইজন অন্ধ ভিক্ষুক যার যার ভাবে একই রাস্তা দিয়ে দুইদিক থেকে হেঁটে আসছে। পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’
এই বলতে বলতে ভিক্ষুক তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে, ভিক্ষুক আনোয়ার’র দিকে।

ভিক্ষুক আনোয়ার বাঁশ আনি বাঁশ আনি শুনে মনে করলো কেউ হয়তো লম্বা বাঁশ কাঁধে করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার আস্তে আস্তে রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। যাতে বাঁশের খোঁচা-খাঁচি শরীরে না লাগে। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার রাস্তার কিনারে চাপতেই থাকলো, চাপতেই থাকলো। আর পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও জিকিরের সুরে বলতে লাগলো–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’

ভিক্ষুক আনোয়ার এবার চিন্তা করতে লাগলো, শালার বাঁশ মনে হয় লম্বালম্বি করে না এনে আড়াআড়িভাবে নিয়ে আসছে। তাই হয়তো জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে, বাঁশ আনি, বাঁশ আনি। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার তাঁর গায়ে বাঁশ লাগার ভয়ে তাড়াতাড়ি রাস্তার ঢালে নামতে শুরু করলো। নামতে নামতে একেবারে খালের পানিতে গিয়ে নামলো। তারপরও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’

এভাবে ভিক্ষুক আনোয়ার পাশের গ্রামের ভিক্ষুককে সাইট দিতে দিতে যখন খালের মাঝামাঝি গেল, তখনও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও আমি ভাসানী।’

এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার ভীষণ ক্ষেপে গেল! রেগেও গেল! আনোয়ার রেগে-মেগে বললো–
‘আরে মিয়া আম্নের কান্দের বাঁশখান কত লম্বা হে? আমি হালায় অন্ধ মানুষ। চোক্ষে দেখি না। শল্লের মাধ্যে বাঁশের খোঁচ-খাঁচি লাগবো দেইখ্যা, রাস্তা তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যখানে যাইয়া খারাইয়া রইছি। হের পরেও কইতাছেন দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি, দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি? আমি কি অখনে খাল হাতরাইয়া হেপাড় যাইয়া বইয়া থাকুম?’

আনোয়ার’র মুখে বাঁশের কথা শুনে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও বাঁশের ভয়ে কাঁপছে! শালার বাঁশ! কোনদিক দিয়ে যে আশছে! আবার শরীরে বাঁশ লাগে কিনা, সেই ভয়ে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতে আর চাপতে চাপতে আনোয়ার’র সামনা-সামনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো–
‘দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।
দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।’
এভাবে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও শরীরে বাঁশ লাগার ভয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার’র কাছাকাছি চলে গেলো। এবার খালের মাঝখান থেকে ভিক্ষুক আনোয়ার বলছে–
‘আরে ভাই আপ্নের বাঁশ নেওয়া অইছেনি ও?’
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।’
ভিক্ষুক আনোয়ার এবার আরও ভয় পেয়ে গেল! কারণ, বাঁশ আনি বাঁশ আনি কথাটা খুবই সামনা-সামনি শোনা যাচ্ছে। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার খালের আরও গভীরে যেতে যেতে বললো–
‘হালার আজগা যে কোন অলক্ষ্মীর মুখ দেইখা ঘরের তুন বাইর অইছি, কইতে পাইল্লাম না। আইজগা কি আল্লা আমারে বাঁশেই পাইছে? এই হালার বাঁশ কতক্ষণে যাইবো রে, মাবুদ?’
ভিক্ষুক আনোয়ার’র এই কথা পাশের গ্রামের ভিক্ষুক শুনে বললো–
‘ভাই, মনে অইতাছে আরও অনেক সময় লাগবো।’ ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
‘ভাই তাড়াতাড়ি আম্নেগো বাঁশ সরান। আমারে বাইত যাইতে দেন। রাইত অইয়া গেলে ক্যামনে যামু গো ভাই!’

এবার পাশের গ্রামের ভিক্ষুক এখন আনোয়ার’র সামানা-সামনি এসে জিজ্ঞেস করলো–
‘ভাইসাব বাঁশ আনতাছে কেডা ও? আপ্নে কি তাগো চিনেন? এই রাস্তা দিয়াই কি বাঁশ আনতাছে? নাকি নৌকা কইরা খাল দিয়া বাঁশ নিতাছে?’
ভিক্ষুক আনোয়ার’ রেগে-মেগে বললো–
‘ও-ই মিয়া, এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লাইছে কেডা ও?’
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক নরম সুরে বললো–
‘আমিই ত ভাসানী ভাসানী কইয়া আইতাছিলাম। তয় ভাই সাব, আমার লগে ত কোনও বাঁশ টাস নাই। আম্নে বাঁশের ডরে খালে নাইম্মা রইছেন কিল্লাইগা?’
ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
‘আরে মিয়া আম্নে না কইলেই বাঁশ আনি বাঁশ আনি? ইল্লাইগা আমি হালায় আম্নেরে সাইড দেওনের লাইগা রাস্তার তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যে যাইয়া খারাইয়া রইছি। এহনে কইতাছেন আম্নের গলে বাঁশ টাস নাই। ফাইজলামি করনের আর জাগা পান না মিয়া? আমি অন্ধ দেইখা আমার লগে ইয়ার্কি করেন? আল্লায় বিচার করবো মিয়া। আল্লায় বিচার করবো। এক দিনকা আম্নেও কানা অইবেন, কইয়া দিলাম।’
ভিক্ষুক আনোয়ার’র কথা শেষ হতে-না-হতে পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
‘আরে ভাইসাব আমি এমনেই জনমের কানা। ইল্লাইগা হারাদিন ভইরা ঘুইরা ঘাইরা খাই। বাঁশ টাস পামু কই? আমিতো বাঁশের কথা কিচ্ছু কই নাইক্কা। আম্নে হুদাহুদি কিল্লাইগা খালে যাইয়া নাইমছেন? আম্নের মুহে বাঁশের কথা হুইন্না আমিও হালায় খালের কিনারে আইয়া খারাইছি।’

এবার ভিক্ষুক আনোয়ার ভিজা কাপড়ে খাল থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে আর বলছে–
‘ও-ই মিয়া আম্নে কই? হাতের লাডি দিয়া আম্নেরে লাগুর পামু নি? কই আম্নে, কই?’
এই বলেই ভিক্ষুক আনোয়ার হাতে থাকা জাতিসংঘের লাঠি এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছে।
আর বলছে, ‘আম্নেরে আগে দুইখান বাড়ি মাইরা লই। হালা মিত্থুক! এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লান নাই? আমি চোক্ষে দেখি না দেইখা কী অইছে? কানেও কি আর কম হুনি?’

পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
‘আরে ভাই আম্নে এতো চেত্তাছেন কে হুনি? এনো চেতনের কী অইলো? চেইতেন না ভাইসাব, চেইতেন না! আমার নামই ত ভাসানী। আমিও আম্নের মতন অন্ধ ভাইসাব। অন্ধ দেইখা রাস্তায় আঁডাচলার মাধ্যে এই কথা কইয়াই চলি। যাতে মাইনষে বুঝবার পারে আমি ভাসানী আইতাছি।’

এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় মারতে মারতে বলতে লাগলো–
‘হায়রে কয়াল আমার! যেই বাঁশের ডরে নাইমতে নাইমতে খালে যাইয়া নামছি। হেই বাঁশ অইছে ভাসানী। আবার এই হালাও নাকি আমার মতো কানা। হালার নামও নাকি ভাসানী। অন সেনা বুঝলাম বাঁশ টাশ কিছুই না, আসলে এই হালার নাম ভাসানী। আর আমি হালায় কোন আহাম্মকের আহাম্মক! হালার বাঁশ আনি বাঁশ আনি হুইন্না বাঁশের ডরে নামছি খালে।’ এইডা কি একটা কাম অইলো? হালার দুই কানার কারবার!’ এই কারবার মাইনষে হুনলে কি কইবো?’ এই বলেই অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার ‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক, হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক।’
বলতে বলতে বাড়ি রওনা হলেন। পাশের গ্রামের অন্ধ ভিক্ষুকও বাড়ি রওনা হলেন।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

হিরা উজির সাহেবকে সাথে নিয়ে রাজবাড়ীর গেইটের বাইর হলো। তাঁদের সাথে নেওয়া হলো সদাই রাখার জন্য একটা বড়সড় টুকরিও। হিরা উজির সাহেবকে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি আমার আগে আগে হাঁটুন, আমি আপনার পিছনে পিছনে হাঁটি। বাজারে টুকরিটাও আমার সাথে থাকুক। আপনি বুড়ো মানুষ। কষ্ট করার দরকার কী! আপনি শুধু আমাকে আপনাদের এখানকার ধারে কাছে একটা বাজারে নিয়ে চলুন!’ হিরা’র কথা শুনে রাজার উজির খুবই খুশি হলেন। আবার বেজারও হলেন। বেজার হয় তখন, যখন থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে তখন। সেই থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লেই, উজিরের আর ভালো লাগে না। তবুও রাজার হুকুম বলে কথা। তাই আর রাগ থাকতেও রাগ করতে পারছে না, হিরা’র কথা মতোই চলতে হচ্ছে।

এদিকে রাজদরবারে বসে কোতোয়াল সাহেব রাজাকে বললো, ‘হুজুর, চেনা নেই জানা নেই, অচেনা অজানা একটা ছেলের হাতে তিনটি পয়সা দিয়ে দিলেন! কাজটা কি ঠিক হলো?’ রাজা হেসে বললো, ‘এই ছেলে মাত্র তিন পয়সার পাগল নয় বলে আমার বিশ্বাস। এই কারণেই এমন কঠিন সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলেছি। আমি জানি এই সদাই তিনটি ছেলেটা কিছুতেই আনতে পারবে না। যদি সদাই তিনটি না আনতে পারে, তাহলে আমার করণীয় কাজ করে ফেলবো। চলে বলে কলে কৌশলে, যেভাবেই হোক, আমি ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে গোলামের মতো করে রেখে দিবো।’ কোতোয়াল জানতে চাইলেন, ‘আর যদি ছেলেটা সদাই তিনটি কিনে এনে দিতে পারে, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘আমি জানি ছেলেটা তা পারবে না। আর যদি আনতেই পারে, তাহলেও তা হবে না। আমি যা-ই বলবো, তাইতো হবে।’ এই বলেই রাজা দরবারে থাকা দেয়াল ঘড়ির দিকে রাজা তাকালেন। তখন সময় বিকাল চারটার কাছাকাছি বাজতে লাগলো। রাজা ভাবছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উজির-সহ ছেলেটা বাজার থেকে ফিরে আসছে। রাজা সেই অপেক্ষাতেই বসে থাকলেন।

উজির-সহ হিরা যেই বাজারে যাবে, সেই বাজারের নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। এই বাজারে গ্রামের বউঝিরা কেনাবেচা বেশি করে থাকে বলে, বাজারটার নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। উজির আগে হিরা উজিরের পিছনে পিছনে। বাজারে ঢুকতেই একজন জিলাপি বিক্রেতা জিলাপি ভেজে ডালার উপর সাজিয়ে রেখেছে। হিরা তা দেখে উজিরকে ডাক দিল, ‘উজির সাহেব, উজির সাহেব।’ উজির পিছন ফিরে দেখলো ছেলেটা ডাকছে। উজির হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘কী ব্যাপার! ডাক দিলে কেন?’ হিরা উজিরকে বললো, উজির সাহেব, অনেকদিন ধরে গরম গরম জিলাপি খাই না। আজ হাতের কাছে যখন পেয়েছি পোয়া খানিক জিলাপি দুইজনে মিলেমিশে খেয়ে নিই। কি বলেন উজির সাহেব?’

উজির হিরা’র কথা শুনে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘শালার পো, তোমাকে রাজা তিন পয়সা দিয়েছে তিনটি সদাই করার জন্য। সেই পয়সা থেকে তুমি জিলাপি কিনে খেতে চাইছ। আবার আমাকেও খাওয়াতে চাচ্ছো। তাহলে সদাই নিবে কী করে?’ এই বলেই উজির হিরা’কে বললো, ‘না রে বাবা রে, আমার পেট ভালো না। আমি জিলাপি টিলাপি খাবো না। খেতে মন চাইলে তুমিই খাও!’ হিরা বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে উজির সাহেব, আমিই খাবো। তো আপনি দামদর করে কিনে দিন। আপনাদের এখানকার বাজারের ভাবসাব তো আমি বুঝবো না। এঁরা আমার কাছ থেকে দাম বেশি নিবে।’

হিরা’র কথামতো উজির জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা জিলাপি কি গরম না ঠান্ডা রে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আরে হুজুর, এখন ভাজলাম এখন। একেবারে টাটকা জিলাপি।’ উজির বললো, ‘তাহলে ঠিক আছে। তো কত করে সের বিক্রি করছো হে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আজ্ঞে হুজুর, মাত্র চার পয়সা সের।’ উজির সাহেব বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। একপোয়া জিলাপি দাও তাড়াতাড়ি করে।’ জিলাপি বিক্রেতা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে একপোয়া জিলাপি মেপে উজিরের হাতে দিলো। উজির সেই জিলাপি হিরা’র হাতে দিয়ে বললো, ‘দে বাবা এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দে।’ হিরা তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে এক পয়সা বের করে জিলাপি বিক্রেতার হাতে দিয়ে সামনে এগুতে থাকলো। হিরা হাঁটছে আর মনের আনন্দে জিলাপি খাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বাজার দেখছে। দোকানপাট দেখছে। আর জিলাপি খাচ্ছে, হাঁটছে।

এমন সময় এক ভিখারি হিরা’র সামনে এসে হাত পেতে বসলো। হিরা গরিবের সন্তান হলেও মানুষের প্রতি হিরা’র খুব মায়া। মানুষের কষ্ট হিরা সহজে সইতে পারে না। তাই যখন ভিখারি হিরা’র কাছে ভিক্ষা চাইল, তখন হিরা সাথে সাথে ও-ই ভিখারিকে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলো।

হিরা’র এইরকম দরদী কারবার দেখে, উজির সাহেব মনে মনে বলছে, ‘ছাইরা দে মা কাইন্দা বাঁচি। হায়! হায়! করছে কি! রাজা দিলো সদাই কেনার জন্য। আর ও করছে দান খয়রাত! জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। বাঃ দারুণ তো! দেখি, আর আছে এক পয়সা। এই এক পয়সা দিয়ে ছেলেটা কী করে, তা দেখেই দিবো এক দৌড়।’

ফকিরকে এক পয়সা দিয়ে হিরা উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, মানুষের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তাই ফকিরটা যখন ভিক্ষা চাইলো, তখন এক পয়সা ফকিরটাকে দিয়ে দিলাম। এর জন্য আল্লার দরবারে একটু হলে ছোয়াব জমা রেখে গেলাম। কি বলেন উজির সাহেব?’ উজির বললো, ‘ভালো করেছিস বাবা। একেবারে বুদ্ধিমানের কাজ। তো রাজার সদাই কিনতে হবে না? এভাবে ঘুরলে কি হবে? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সন্ধ্যা যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে হবে।’

হিরা বললো, ‘উজির সাহেব, রাজা হুজুর যেই সদাই তিনটা কিনতে বলেছে, তাতো আপনাদের এই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ঘুরে ঘুরে সদাই খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখি সামনে পাওয়া যায় কি-না?’ এই বলেই হিরা সামনে এগুতে লাগলো। হিরা’র পিছনে উজির বোকার মতো হাঁটছে আর ভাবছে। ‘হায়রে রাজা, কাকে দিলি পয়সা! এই ছেলেটা কি আর রাজবাড়ি ফিরে যাবে? মনে হয় না! রাজার এক গৃহস্থের এক বছরের খাজনা মাইর!’ উজির ভাবলেন।

একটু সামনে যেতেই হিরা দেখলো মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাজনার শব্দে পুরো বাজার মুখরিত হয়ে উঠছে। হিরা ভাবলো হয়তো সাপুড়িয়ারা সাপের খেলা দেখাচ্ছে। এই ভেবে হিরা গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষজন ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলো। উজির টুকরি হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ‘কার সাথে যে বাজারে আসলাম রে আল্লাহ! এ দেখি বড় বাটপার। রাজার কাছ থেকে বাটপারি করে তিন পয়সা এনে কি না করতেছে। পরের পয়সা খরচ করতে তো আর গা জ্বলে না। তাই জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। এখন আবার রূপবান গান দেখার জন্য গোলচক্করে ঢুকছে। দেখি কী করে!’

এই বলেই উজির সাহেবও ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে রূপবান গান গেয়ে এক হিজরা ড্যান্স দিচ্ছে। ড্যান্সের তালে তালে হিরাও নাচতে দিতে শুরু করলো। ড্যান্স শেষ হলে উপস্থিত সবাই এক পয়সা দুই পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিতে লাগলো। হিরাও ড্যান্সার হিজরাকে এক পয়সা বকশিস দিয়ে দিলো। উজির সাহেব তা দেখে বললো, ‘খাইছে রে আমারে।’ খাইছে খাইছে বলতে বলতেই হাতের টুকরি ওখানেই রেখে সোজা এক দৌঁড় রাজবাড়ির দিকে। হিরা এখন উজিরকে খুঁজছে। উজির সাহেব নেই। কোথাও নেই। অথচ টুকরি পড়ে আছে, উজির নেই। হিরা বুঝতে পেরেছে উজির সাহেব ভয় পেয়েছে। তাই আগেভাগে উনি রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। হিরাও বাজার থেকে আস্তে ধীরে হেলেদুলে রাজবাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলো।

উজির সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে রাজবাড়ির গেইটের সামনে গেলো। গেইটে টোকা দিলো। প্রহরী গেইট খুলে দিলো। উজির সাহেব ভেতরে ঢুকলো। গেইটে থাকা প্রহরী উজির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব ছেলেটা কোথায়?’ আপনারা গেলেন দুইজন মিলে, অথচ আপনি আসলে একা!’ উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘দূর! বাটপার, বাটপার! রাজার মাথা খারাপ হয়েছে রে, রাজার মাথা খারাপ হইছে। কারে দিয়েছে তিন পয়সা রে।’ প্রহরী আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আসল ঘটনাটা কী?’ উজির বললো, ‘আরে বেটা, রাজার পয়সা দিয়ে জিলাপি খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। এসব কি একটা কাজ? যাচ্ছি রাজার কাছে। ঈশ! আমার থাপ্পড়ের বিচারটা পেলাম না রে!’

এই বলেই উজির রাজদরবারের দিকে রওনা হলো। বাইরে থেকে গেইটে টোকা লাগলো। প্রহরী গেইট খুলেই দেখে হিরা’কে। প্রহরী হা করে হিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে?’ প্রহরী বললো, ‘না, মানে উজির সাহেব বললো তুমি আর আসবে না। তাই অবাক হলাম!’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব কোথায়?’ প্রহরী বললো, ‘এইতো এইমাত্র রাজদরবারের দিকে চলে গেলো। তুমি নাকি জিলাপি খাও, ফকিরকে ভিক্ষা দাও, রূপবান গান শুনো?’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব আপনার কাছে কে বলেছে?’ প্রহরী বললো, ‘কেন, উজির সাহেবই বলেছে! নাহয় আমি শুনবো কোত্থেকে?’ হিরা বললো, ‘উনি ঠিকই বলেছে।’ প্রহরী বললো, ‘তো রাজা যে তিন পয়সা দিলো সদাই আনতে, সদাই কোথায়?’ হিরা বললো, ‘তিন পয়সা দিয়ে কি আর সদাই আনা যায়? বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম! তবুও কিছু সদাই কিনেছিলাম। উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে।’ হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

চলবে…

স্বাধীনতা তুমি বন্দী বাহুবলে!

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের আবিস্কারে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণে,
তুমি ভোরের উদিত রক্তিম সূর্যের আলোর ঝংকারে
মা-বোনের সম্ভ্রমের অবদানে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় গাওয়া
আমাদের জাতীয় সংগীতে,
তুমি পদ্মা মেঘনা সুরমা যমুনার স্রোতে বয়ে যাওয়া
নজরুলের রণসংগীতে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি এসেছ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ চেষ্টার বিনিময়ে
জাগ্রত বিজয় দিবসে,
তুমি এসেছিলে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে
নয়মাস যুদ্ধ শেষে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি এখন রাজনীতির জাঁতাকলে ছাত্রলীগ ছাত্রদলে
দলেবলে গণতন্ত্রের কৌশলে,
তুমি এখন ক্ষমতার ছত্রছায়ায় নেতা নেত্রীদের দখলে
স্বাধীনতা বন্দী বাহুবলে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি শুধু কাগজে কলমে ইতিহাস হয়ে আছ সারাবিশ্বে
আর জাতীয় স্মৃতিসৌধে,
তুমি পৌঁছাওনি প্রতিটি ঘরে জনগণের মনের বিশ্বাসে
তাই সকলে কাঁদে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি নেই স্বাধীনভাবে মুক্তভাবে মুক্তমনে মতপ্রকাশে
অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে,
তুমি এখনো দাওনি কাউকে স্বাধীনতা ভোগ-বিলাসে
বন্দী তুমি রাজপ্রাসাদে।

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ:
রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!

কী সাজা হতে পারে এমন চিন্তা নিয়ে হিরা বসে বসে ভাবছে! দরবারে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে রাজার দিকে, কখন সাজার ঘোষণা দিবে। এমন সময় হিরা বসা থেকে উঠে হাত জোর করে রাজাকে বললো, ‘হুজুর, আপনার দরবারে আমি ছোট্ট একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, যদি দয়া করে আপনি অনুমতি দেন।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা বললেন, ‘কী এমন প্রশ্ন করবে? করো শুনি!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার প্রশ্ন হলো আপনার রাজদরবার-সহ রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুনগুলো বলবত আছে, এসব আইনকানুন বা নিয়মকানুনগুলো কে তৈরি করেছিল? এগুলো কি আপনি নিজেই তৈরি করেছিলেন? নাকি আপনার রাজদরবারে থাকা অন্য কেউ তৈরি করেছিল?’ হিরা’র করা প্রশ্নে রাজা থমকে গেল! আবার ভাবতেও লাগলো! রাজা মনে মনে বললো, ‘সাংঘাতিক তো!’

রাজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আমি শুধু হুকুমের মালিক, হুকুম দিয়ে থাকি। রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুন আছে সেসব আইনকানুন প্রণয়ন করেছিল আমার উজির, নাজির, কোতোয়াল-সহ রাজ্যে থাকা বড়বড় পণ্ডিতগণ। আমি শুধু অনুমোদন দিয়েছি। তো হঠাৎ তোমার এমন প্রশ্ন কেন?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার রাজ্যে যেসব নিয়মকানুন চালু আছে, সেসব নিয়মকানুনগুলোর মধ্যে আপনার রাজবাড়ীর গেইট খোলার নিয়মটা মানুষ ভোগান্তির নিয়ম। তা কি আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন?’ রাজা বললো, ‘কেমন ভোগান্তি?’ হিরা বললো, ‘আপনি আমার রাজা। আমি আপনার মুল্লুকের একজন। প্রতিবছর আপনাকে আমি খাজনা দিয়ে আসছি। না দিলে আপনি আমার বাড়িতে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেন খাজনা আদায়ের জন্য। অথচ আমার কোনও সমস্যায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে হলে আপনার রাজবাড়ির গেইটে খেয়ে-না-খেয়ে দুইতিন দিন বসে থাকতে হয়। জনসাধারণের জন্য এরকম ভোগান্তি নিয়ম হবে কেন? আমারা কি মানুষ না? আমরা কি বন্য জানোয়ার? আপনার কাছে গরিব মানুষের কোন মূল্যায়ন নেই? দয়া করে প্রশ্নের উত্তর দিন, রাজা হুজুর!’

হিরা’র কথা শুনে উজিরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। নাজির-সহ কোতোয়াল সাহেবের অবস্থাও খারাপ। আর রাজা তো একেবারে চুপ হয়ে বসে রইলেন রাজ সিংহাসনে। রাজাকে চুপ দেখে হিরা আবার বলতে শুরু করলো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাদের মুল্লুকের রাজা। সমস্ত প্রজাদের অভিভাবকও। প্রজাদের কোনও আপদ-বিপদে আপনার কাছে আসবে। আপনাকে তাঁদের সমস্যা জানাবে। তখন যদি আপনার বাড়ির এই বিশাল গেইটখানা বন্ধ থাকে, আর যদি দুইতিন দিন অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে কেমন হয়? প্রজারা কার কাছে গিয়ে তাঁদের সমস্যা জানাবে? আর আপনার বাড়ির গেইট দুইদিন পরপর খোলা হয় কেন? জনসাধারণের জন্য প্রতিদিন আপনার বাড়ির গেইট খোলা থাকলে আপনার সমস্যাটা কী?

‘আজ যদি আপনার এই মানুষ ভোগান্তি নিয়ম বহাল না থাকতো, তাহলে আজ আর এই ঘটনার সূত্রপাত হতো না। আমাকেও আপনার বাড়ির গেইটে দুইদিন বসে থাকতে হতো না। আপনার উজির সাহেবও আমার থাপ্পড়ের কবলে পড়তো না। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য তাঁরাই দায়ী, যাঁরা এই নিয়মটা করেছে। আমি সরাসরি তাঁদেরকেই দায়ী করছি, হুজুর। যদি আপনি করে থাকেন, তাহলে আপনিই দায়ী থাকছেন। এখানে আমার কোন দোষ নেই বলেই আমি মনে করি। এরপরও যদি আমাকে সাজা ভোগ করতে হয়, তাহলে আমি মনে করবো বিনা দোষে আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই দয়া করে এই বিষয়টি আপনাকে একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি, হুজুর।’

হিরা’র কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করে দিল। উজির সাহেব চুপচাপ এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো। রাজা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সবাইকে শান্তভাবে বসতে বললো। সবাই চুপ করে বসে রইলেন। রাজা হিরা’কে কাছে ডাকলেন। হিরা রাজার সিংহাসনের সামনে গেলে, রাজা হিরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আজ তুমি আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছ। আজকের এই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী থাকলাম। যদিও আমি এই নিয়মগুলো করিনি, তবুও। কারণ, আমি কেন রাজ্যের রাজা হয়ে এসব নিয়মকানুনগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখলাম না। আর কেন-ই-বা উজির নাজির কোতোয়াল-এর উপর বিশ্বাস করে রাজদরবারে বসে থাকলাম। দোষ তো আমারই!

‘আমি ঘোষণা দিচ্ছি, আজ থেকে আমার বাড়ির গেইট কোনও দিন রাত বারোটার আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে না। দেশের মানুষের জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে। আসলে এসব তো আমি কখনো খেয়াল করিনি। আমি যখন বাড়ির বাইরে কোথাও যাই, তখন গেইট খুলে। বাড়ি আসলে গেইট বন্ধ হয়। আমি থাকি অন্দরমহলের ভেতরে। অন্দরমহল থেকে বাড়ির প্রধান গেইট অনেক দূরে থাকার কারণে এসব আর আমার চোখে পড়ে না। এসব ব্যাপারে তুমি ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত আমার কাছে নালিশও দেয়নি। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য প্রথমত আমি আমার উজিরকেই আমি সরাসরি দায়ী করছি। সেই সাথে আজকের এই ঘটনার জন্য তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করছি। আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি যা করেছ জেদের মাথাই করেছ। তুমি নির্দোষ।’

রাজার ঘোষণা শুনে উজির মনে করছে আজ বুঝি আমার চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, তা আর হিরা হতে দেয়নি। হিরা এর আগেই উজিরের সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘উজির সাহেব, আপনি আমার পিতৃতুল্য। আমি আপনার সাথে সত্যি খারাপ ব্যবহার করেছি। আপনি আমাকে আপনার ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দিন।’

হিরা’র এমন ব্যবহারে রাজা খুবই খুশিও হলেন, অবাকও হলেন। ভাবলেন, ছেলেটার তো উপস্থিত বুদ্ধি আছে। সাজা মওকুফের কথা শুনেও নিজের ভুল স্বীকার করে উজিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। চমৎকার বুদ্ধি। এই ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে সবসময়ের জন্য দরকার। এই ভেবে রাজা হাসতে হাসতে উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, আর কী করা! ছেলেটা নিজের ভুল যখন নিজেই স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে, আপনি নিজের ছেলে মনে করে ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিন।’ উজির রাজার কথা আর অমান্য না করে হিরা’কে ক্ষমা করে দিয়ে হিরা’র সাথে বুকে বুক মিলিয়ে নিলেন। তারপর হিরা রাজা-সহ রাজদরবারে উপস্থিত থাকা সকলকে সালাম জানিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেন। কিন্তু রাজা তখন হিরা’কে যেতে দিলেন না। রাজা হিরা’কে বললেন, ‘আমাকে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে। হিরা জানতে চাইলেন, ‘কাজটা কী হুজুর?’

রাজা বললো, ‘কাজটা তেমন কিছুই না। তবে আবার ফেলনাও না। কাজটা হলো বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে হবে।’ হিরা জানতে চাইল সদাই তিনটি কী কী?’ রাজা বললো, ‘সদাই তিনটি হলো, “এক পয়সার এখন, এক পয়সার তখন, এক পয়সার এখনো না তখনো না।” আমি জানি তুমি এই তিনটি সদাই কিনে আনতে পারবে।’ হিরা তখন অভিনয় করে দাঁড়ানো থেকে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার? তুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লে কেন?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, যে তিনটি সদাই’র নাম আপনি বলেছেন, এই সদাই তিনটি বাজারে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এই সদাই তিনটি যেমন মূল্যবান, তেমন আবার খুবই ভারী।’

রাজা বললো, ‘তা যা-ই থাক, আর যেভাবেই হোক সদাই তিনটি আমার দরকার! যদি এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পার, তাহলে তোমাকে আমি উপযুক্ত বকশিস দিবো।’ হিরা প্রশ্ন করলো, ‘কী বকশিস দিবেন, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘যদি চাও, আমার রাজ্যের অর্ধেক তোমার নামে লিখে দিবো। এ-তে-ও যদি না হয়, তাহলে তুমি যা চাও, তা-ই আমি দিতে রাজি আছি। এসবকিছুর বিনিময়েও আমার আকাঙ্ক্ষা এই তিনটি সদাই চাই চাই। তা কি তুমি পারবে?’ রাজার কথা শেষে হিরা বললো, ‘হুজুর পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কাজ বলতে কিছুই যদি না থাকে, তাহলে আমি এই সামান্য কাজটুকু করতে পারবো না কেন? আমিও পারবো, হুজুর। তবে এখানে আমার কিছু কথা আছে। কথা হলো, প্রতিদিন আপনার সাংসারিক বাজার-সদাই কে করে? যিনি করে, তাকেই আগে এই সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলুন। যদি সে না পারে তাহলে আমি কিনে এনে দিবো, কথা দিচ্ছি!’

হিরা’র কথা শুনে রাজা ভেবে দেখলেন, এ-তো ভালো কথা! আমার বাজার সদাই তো আমার উজির সাহেবই করে। তাকেই আগে জিজ্ঞেস করা দরকার। এই ভেবে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব, আপনি কি তিন পয়সা দিয়ে বাজার থেকে হোক আর যেখান থেকেই হোক, এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পারবেন?’ উজির সাহেব বললেন, ‘রাজা হুজুর, এই তিনটি সদাই’র নাম আমার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিও কোনদিন শুনেনি। আমিও শুনিনি হুজুর। মাফ করবেন হুজুর, আমি এটা পারবো না।’ রাজা তখন হিরা’কে বললেন, ‘আমার উজির তা পারবে না। এই কাজ তোমাকেই করতে হবে।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে হুজুর, আমিই বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে আপনাকে তিনটি সদাই কিনে এনে দিবো।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা খুবই খুশি হলেন। হিরা’কে রাজ অতিথির মতো সমাদর করে খাওয়ালেন। হিরা তো এমনিতেই দুইদিনের না খাওয়া। তাই হিরা পেট ভরে খেলো।

তারপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘সদাই তিনটি আনতে হলে তোমার কী কী দরকার?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আপনার নিত্যদিনের বাজার করা লোকটিকে আমার সাথে দিবেন। আমি সদাই কিনবো লোকটি দেখবে, আর শিখবে।’ রাজা ভেবে দেখল এ-তো চমৎকার বুদ্ধি? লোকটারও তো শেখার দরকার আছে! রাজা বললেন, ‘তা-ই হবে। আমার উজির সাহেব তোমার সাথে যাবে।’ এই বলেই রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটার সাথে বাজারে যাবেন। ছেলেটা কীভাবে কী করে, তা দেখবেন, শিখবেন।’ নিরুপায় উজিরের এখন মরি মরি অবস্থা! না পারে রাজি হতে, না পারে হিরা’র সাথে যেতে। উপায়ন্তর না দেখে উজির বললো, ‘হুজুর, ছেলেটার হাতে থাপ্পড়ও খেলাম, এখন আবার ছেলেটার চাকরগিরিও করতে হবে?’ রাজা উজিরকে দিলেন এক ধমক! ধমক দিয়ে বললেন, ‘থাপ্পড় তো আপনাদের ভুলের কারণেই খেলেন, উজির সাহেব। এখন আমি যা বলছি, তা-ই আপনাকে করতে হবে।’ উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

গল্পের প্রথম পর্বের শেষাংশ:
হিরা’র কথা শুনে সিপাহীরা বলছে, ‘কি মুশকিলে না পড়লাম রে ভাই! এই ধর ধর শালাকে। ওকে কোলে করেই নিতে হবে।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরা’কে আবার কাঁধে করে রাজদরবারে নিয়ে যেতে লাগলো।

সিপাহীরা ধরাধরি করে হিরা’কে কাঁধে চড়িয়ে রাজদরবারে নিয়ে গেল। রাজদরবারে নিয়ে হিরা’কে সিপাহীরা তাঁদের কাঁধের পর থেকে নামিলে বললো, ‘হুজুর, এই সেই লোক। যে আমাদের উজিরের গালে থাপ্পড় মেরেছে।’ রাজা সিপাহীদের জিজ্ঞেস বললো, ‘তা কি তোমরা জানো? সত্যি কি এই ছেলেটা আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরেছে?’ রাজার কথায় সিপাহীদের মধ্যে একজন বললো, ‘হুজুর, আমরা উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখিনি ঠিক। কিন্তু এই ছেলেটি নিজেই স্বীকার করেছে।’
রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কীভাবে সে নিজের ইচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিল যে ও নিজের উজরকে থাপ্পড় মেরেছে? তোমরা কি ছেলেটার গায়ে হাত উঠিয়েছ? ছেলেটাকে মারধর করেছো?’ সিপাহীরা রাজার এমন প্রশ্নে সবাই থমকে গিয়ে কাঁপতে শুরু করে দিল। রাজা আবার ধমক দিয়ে বললো, ‘তোমাদের জিজ্ঞাসা করেছি, ছেলেটা কীভাবে নিজের ইচ্ছায় স্বীকার করেছে, বলো!’

একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, আপনার আদেশ পেয়ে আমরা যখন আপনার বাড়ির প্রধান গেইটের বাইরে গিয়ে খুঁজাখুঁজি করছিলাম, তখনই আমরা গেইটের সামনে ছেলেটকে দেখতে পাই। তখন গেইটের সামনে এই ছেলেটি ছাড়া অন্যকোনো লোক ছিল না। তাই আমাদের সন্দেহের চোখ যায় ছেলেটার দিকে। আমরা ছেলেটার সামনে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, তুমি কাউকে আমাদের উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখেছ? তখন ছেলেটি নিজেই বলতে লাগলো, “উজির না রাজা তা আমি চিনি না, গেইট থেকে বের হবার সময় থাপ্পড় একটা আমিই মেরেছি।” ছেলেটার মুখে এমন কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম, হুজুর! তারপর আমরা ছেলেটিকে ধরে ফেললাম। ছেলেটিকে ধরার পরও আরেক বিপদে পড়ে গেলাম!’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ছেলেটিকে ধরার পর তোমরা কেমন বিপদে পড়লে শুনি!’ একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা যেসব কথা বলেছে, তা আমরা আপনার কাছে বলতে সাহস পাচ্ছি না।’

সিপাহীদের কথা শুনে রাজা ভাবতে লাগলো! এই ছেলেটা কেমন কথা বলতে পারে? যা সিপাহীরা বলতে সাহস পাচ্ছে না! নিশ্চয় মারাত্মক কোনও কথা বলেছে। যা সিপাহীরা বলছে না! যা-ই বলুক, তা আমার শুনতে হবে। এই ভেবে রাজা সিপাহীদের কাছে জানতে চাইলো, ‘তোমরা নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি জানতে চাই ছেলেটা কি এমন কথাবার্তা বলেছে। যা তোমরা সাহস করে বলতে পারছ না? বলো, শুনি!’ এক সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা খুবই সাহসী এবং জেদি। ছেলেটাকে ধরে আমরা যখন বললাম, তোমার এতো বড় সাহস! তুমি আমাদের উজিরকে থাপ্পড় মেরেছ কেন? ছেলেটা তখন বললো, “উজির না হয়ে এখানে যদি তোমাদের রাজাও হতো, তাহলে উজিরে থাপ্পড় রাজার গালেই পড়তো।” আমাদের কথা যদি বিশ্বাস না হয় হুজুর, ছেলেটা আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। দয়া করে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন, আমরা কোনও কথা মিথ্যে বলছি কিনা। ছেলেটা হুজুর এ-ও বলেছে, “আগে জানলে তোমাদের উজিরকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় মারতাম।”

‘এরপরও আমরা যখন ধরাধরি করে ছেলেটাকে আপনার দরবারের দিকে নিয়ে আসছিলাম, তখন ছেলেটা ছিল আমাদের সকলের কাঁধের উপর, হুজুর। আমাদের কাঁধের উপর বসে ছেলেটা বলতে লাগলো, “একটা থাপ্পড় মেরেছি তারজন্য তোমরা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছ! আগে জানলে দুইটা থাপ্পড় মারতাম। তাহলে মনে হয় আমাকে পালকিতে চড়িয়ে নিতে।” ছেলেটার এসব কথা শুনে আমরা তখন আমাদের কাঁধের পর থেকে নিচে ফেলে দিলে আরেক বিপদ হয়, হুজুর। বিপদ হলো, ছেলেটা তখন মাটিতে বসে বসে চিল্লাচ্ছিল। কিছুতেই ছেলেটাকে বসা থেকে উঠাতে পারছিলাম না। উপায়ন্তর না দেখে এই হারামজাদা ছেলেটাকে আবার কাঁধে করে আপনার কাছে নিয়ে আসতে হলো, হুজুর। এখন আপনি নিজেই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন! তারপর সুষ্ঠু বিচার করুন!’

সিপাহীদের সব কথা রাজা সিংহাসনে বসে বসে শুনলেন। শুনলেন দরবারে উপস্থিত নাজির, কোতোয়াল, পেশকার-সহ থাপ্পড় খাওয়া উজিরও। বুড়ো বয়সের উজির তখন গালে ধরে তাঁর আসনে নিরিবিলি চুপচাপ বসে আছে। রাজা সিপাহীদের কথা শুনে ভাবছে। হিরা চার-পাঁচজন সিপাহীদের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজাকে ভালো করে দেখছে। সিপাহীরা তখন জবানবন্দি দিচ্ছিলো, তখনও রাজা শুধু বারবার হিরা’কে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আর কি যেন ভাবছিল। এরই মাঝে উজির রাজার সিংহাসনের সামনে গিয়ে গালে থাপ্পড়ের স্থানে লেগে থাকা হিরা’র আঙুলের ছাপ দেখাতে লাগলো।

রাজাকে গালে লাগা থাপ্পড়ের দাগ দেখিয়ে বললো, ‘হুজুর, আমি এতো বছর আপনার দরবারে উজিরের দায়িত্ব নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছি। আজ পর্যন্ত এমন থাপ্পড় আর কখনো খাইনি। দেখুন! দেখুন! আমার গালের অবস্থা কী হয়েছে, হুজুর। আপনি মহামান্য রাজা। আমি আপনার গোলাম। আপনার চাকরি করে এই বুড়ো বয়সে এই ছেলের হাতে থাপ্পড় খাওয়া কেমন লাগে, হুজুর? এর চেয়ে আমার মরে যাওয়াও ভালো। আপনি এর বিচার করুন!’ উজিরের কথা শুনে রাজা উজিরকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি শান্ত হোন। আমি এর বিচার অবশ্যই করবো। এর আগে ছেলেটার কাছ থেকে কিছু জেনে নেই, ছেলেটা কেন এবং কী কারণে এমন করেছে। ছেলেটার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কেন ই বা এখানে এসেছে। আর কে ই বা আপনাকে থাপ্পড় মেরেছে। এসব কিছু আমি ছেলেটার মুখ থেকে শুনতে চাই।

এই বলেই রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কী?তোমার পিতার নাম কী? তোমার বাড়ি কোন গ্রামে? এখানে কেন এসেছ এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? বল শুনি!’

রাজার জিজ্ঞাসা শেষ হবার সাথে সাথে হিরা তাঁর দুহাত জোর করে এক গ্লাস পানি চাইলেন। রাজা দরবারের খেদমতকারীকে হুমম দিলেন ছেলেটাকে এক গ্লাস পানি দিতে। খেদমতকারী হিরাকে পানি দিলেন। হিরা পরম তৃপ্তিতে পানি পান করলেন। এরপর দুহাত জোর করে বলতে শুরু করলেন, ‘রাজা হুজুর, আমি আপনার মুল্লুকের জয়পুর গ্রামে থাকি। আমার বাবার নাম আক্কেল আলি। আমি দেখেছি প্রতিবছর আমার বাবা আপনার দরবারে খাজনা দিতে আসে। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কোথায় যাও! বাবা বললেন, “খাজনা দিতে যাচ্ছি রাজদরবারে।” আমি জানতে চেয়েছি কোথায় সেই রাজদরবার, আর কে সে রাজা? উত্তরে বাবা বললেন, “যার মুল্লুকে থাকি সে-ই হলেন রাজা। তাকেই প্রতিবছর নিজেদের জমিজমার খাজনা দিতে হয়। সেই রাজার রাজবাড়ীর রাজদরবার আমাদের গ্রাম থেকে আরও অনেক দূরে। কেন, তুমি কি যাবে?” আমি বাবাকে বললাম, তুমি এখন যাও! আমি একসময় একাই যাবো যাবো, বাবা। তারপর থেকে হুজুর আপনাকে একনজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। দিনরাত ভাবতে থাকি আপনাকে নিয়ে। কারণ, আপনার মুল্লুকে থাকি। আপনার নুন খাই। আপনাকে একনজর না দেখলে আমার এই জীবনই বিফলে যাবে ভেবে আমি আপনার রাজবাড়ির গেইটে আসি।

‘গেইটে টোকা দেই, সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমি দুইদিন আপনার বাড়ি গেইটে না খেয়ে গেইট খোলাখুলির অপেক্ষায় থাকি। আজকে সকালে প্রতিজ্ঞা করি গেইট থেকে যে-ই বের হবে তাকেই একটা থাপ্পড় মারবো। সকাল ৮টায় যখন গেইটের ভেতর থেকে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছিল, তখন আমি আমার শক্ত হাতে আরও শক্তি সঞ্চার করে রেডি হয়ে থাকি। তারপর গেইট থেকে একজনকে মাথা বের করতে দেখেই সাথে সাথে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। এখন জানলাম থাপ্পড় খাওয়া লোকটি আপনার সম্মানিত উজির সাহেব। আপনার কাছে মাপ চেয়ে বলছি, সেসময় উজিরে জায়গায় যদি আপনি হতেন; উজিরের থাপ্পড়টা আপনার গালেই পড়তো, হুজুর! কিন্তু আপনার ভাগ্য খুবই ভালো, আপনি সে-সময় সে-জায়গায় ছিলেন না। মানের মান মহান সৃষ্টিকর্তাই রাখে হুজুর। যাইহোক, এখানে আমার আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শুধু আপনাকে একনজর দেখা। এছাড়া আর কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল না, হুজুর! এখন আপনার বিচারে আমি যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকি তো, আমাকে আপনি যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন; তা আমি মাথা পেতে নিবো।’

হিরা’র কথা শুনে রাজার খুবই ভালো লাগলো। আবার ভীষণভাবে ভাবতেও লাগলো! ভেবেচিন্তে রাজা হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার মতো এমন দু-চারটে ছেলে আমার মুল্লুকে খুবই কম আছে। তবে তুমি আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরে যেই অপরাধ করেছ, তার সাজা তোমাকে বেশি নাহয় একটু হলেও পেতে হবে।’ রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

এক রাজার দেশে এক দরিদ্র কৃষক ছিল। জমিজমা যা-ই ছিল আর না-ই ছিল, কৃষকের এক টুকরো সোনা ছিল। সোনার টুকরো বলতে কৃষকের একটিমাত্র ছেলে। কৃষক যুবক কালে বিয়েসাদী করার পর এই সোনার টুকরো পেতে অন্তত ১২টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৩ বছরের মাথায় মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ লীলায় কৃষকের ঘরে ফলল সোনা। সেই সোনার টুকরোর নাম সোনা না রেখে, নাম রেখেছে হিরা। হিরাকে দেখতেও হিরার টুকরোর মতোই দেখা যায়। কৃষকের আদরের ধন হিরা পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছেও ছিল আদরের। সবার কোলেকাঁখে আদরে আহ্লাদে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একসময় হিরা বড় হয়ে উঠলো। স্কুলেও শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে হিরা হিরার মতোই ছিল। এভাবে একসময় মেট্রিক পাস করে ফেললো। কলেজে ভর্তি হলো। হিরা খেলাধুলা যা-ই করতে, লেখা-পড়ার দিক দিয়ে ছিল খুবই মনোযোগী। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর রাতদুপুর পর্যন্ত হিরা বসা থাকে পড়ার টেবিলে।

একদিন সকালবেলা হিরা’র বাবা তাঁদের জমিজমা’র খাজনা দিতে যাচ্ছিল রাজার দরবারে। বাবার পরনে পরিষ্কার জামা-কাপড় দেখে হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ ছেলে হিরার কথার জবাবে হিরা’র বাবা বলল, যাচ্ছি তো রাজদরবারে। আর এই যাওয়া তো আজকে নতুন নয় রে বাপ! প্রতিবছরই তো খাজনা দিতে যেতে হয়। কেন, তুই কি জানিস না?’ হিরা বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘মনে হয় দেখেছি অনেকবার। তবে নিজের পড়াশোনার ধান্ধায় তেমন একটা খেয়াল করিনি। তো বাবা, যেই রাজাকে তুমি খাজনা দাও। সেই রাজা’র রাজবাড়ীটা কোথায়?’ হিরা’র বাবা বলল, ‘সে-তো অনেক দূর বাবা! কেন, তুই কি রাজবাড়ী যাবি নাকি?’ ছেলে হিরা বলল, ‘যার মুলুকে থাকি, তাকে দেখাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার-স্যাপার! তাই এখন দেখার খুবই ইচ্ছে জাগছে বাবা। না দেখলেও তো হচ্ছে না। একদিন আমি নিজেই তোমাদের রাজার দরবারে গিয়ে দেখা করে আসবো বাবা। তুমি এখন যাও।’ ছেলের কথা শুনে কৃষক হাসতে হাসতে রাজ-দরবারের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।

এক রাতে হিরা পড়ার টেবিলে বসে বসে ভাবছে! ভাবনা হলো ঐযে, খাজনা নেওয়া রাজা আর রাজদরবার এসব নিয়ে। সারারাত ভেবে রাত শেষে ভোরবেলা হিরা রাজাকে দেখার জন্য বাড়ি থেকে বের হলো। কোথায় রাজা আর কোথায় রাজার মুলুক, তা হিরা’র ছিল অজানা। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় হিরা রাজবাড়ীর সামনে পৌঁছে গেল। রাজবাড়ীর প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে গেইটে টোকা দিল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। আবার টোকা দিল। তাও কোনও সাড়াশব্দ পেল না। সাড়াশব্দ না পেয়ে হিরা’র মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাজ গেইটের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এভাবে দুপুর শেষে বিকাল হয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে হিরা আর আজ বিড়িতে ফিরতে পারবে না ভেবে আবার নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। সারাদিন রাজবাড়ির সামনে থেকে সন্ধ্যার পর বাড়ি আসলো। রাত শেষে আবার ভোর হতে-না-হতে রাজার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। আগের দিনের মতো রাজ গেইটে টোকার পর টোকা দিয়েও যখন সাড়াশব্দ পাচ্ছিল না, তখন হিরা প্রতিজ্ঞা করল রাজাকে না দেখা পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরে যাবে না। এতে গেইট আরও পাঁচদিন না খুললেও না। আর যে – সময় ই গেইট খুলুক, গেইটের ভেতর থেকে আগে যে-ই বের হবে, তাকেই এক থাপ্পড় মারা হবে। এতে করে জীবন যাক আর থাক, একটা হবেই। যেই ওয়াদা, সেই কাজ! হিরা রাজ গেইটের সামনে ভিখারির মতো বসে রইল।

এভাবে দুইদিন রাজবাড়ির গেইটের সামনেই পার হয়ে গেল। কিন্তু রাজার বাড়ির গেইট আরও খুলছে না। আর খুলবেই বা কেন! রাজবাড়ির গেইট খোলার একটা নিয়ম বাঁধা আছে। নিয়ম হলো, গেইট খুলবে দুই-তিন দিন পরপর। রাজার বাড়ির গেইট যে তিনদিন পরপর খোলে, তা আর হিরা’র জানা ছিল না। প্রতি শুক্রবার, সোমবার, বৃহস্পতিবার। আবার রবিবার, বুধবার ও শনিবার। এভাবে হিসাব করে তিনদিন পরপর গেইট খোলা হয়। হিরা এই নিয়মটা জানলেন রাজবাড়ীর পাশে থাকা এক লোক থেকে। তা কখন কোন টাইমে খোলা হয় তাও হিরে জেনে নিলেন। কেন এই নিয়ম, তাও জানলেন। নিয়মটা হলে রাজবাড়ীর বাজার এবং রাজ্যের কারোর কোনও নালিশ সালিশ করার জন্য এই নিয়মটা নির্ধারণ করা। সময় সকাল ৮টায় বাজার। ১০ থেকে দুপুর পর্যন্ত সালিশ নালিশ, দেন-দরবার। এরপর আবার দুইদিন গেইট বন্ধ। তা থাকুক বন্ধ! একসময় গেইট তো খুলবেই। এই ভেবে হিরা চুপচাপ রাজ গেইটের সামনেই বসে আছে। গেইটেই সামনেই হিরা’র দিন যাচ্ছে, রাত পোহাচ্ছে। নাছোড় বান্দা হিরা তাঁর ক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, বসেই আছে খেয়ে না খেয়ে।

আবারও রাত পোহালো, সকাল হলো। হিরা চেয়ে আছে গেইটের দিকে! কখন গেইট খুলবে, সেই আশায়। সকাল ৮টার সময় রাজার উজির সাহেব সাথে করে এক চাকর বেটা সাথে নিয়ে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে গেইটের সামনে আসলো। প্রহরী গেইট খুলছে এমন শব্দ হিরা’র কানে এলো। হিরা তাঁর ডানহাত বাড়িয়ে রেডি হয়ে আছে। গেইটের ভেতর থেকে যার মাথাই আগে বের হবে তাকেই বসিয়ে দিবে এক থাপ্পড়! এই নিয়ত করে হিরা রেডি! এমন সময় গেইটের পকেট গেইট দিয়ে উজির বের হবার জন্য মাথা বাড়িয়ে দিতেই, ঠাস্ করে এক থাপ্পড় মেরে দিলো উজিরের গালে। উজির তো গালে ধরে মা-গো, বাবা-গো বলে ডাক চিৎকার শুরু করে দিল। উজিরের সাথে আসা চাকর দিলো এক দৌড়! গেইটের প্রহরী দৌড় দিলো রাজদরবারে দিকে। প্রহরী রাজদরবারে গিয়েই কাঁপতে কাঁপতে ধপাস্ করে পড়ে গেল। রাজা তাঁর সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালো। কী হয়েছে, কী হয়েছে শোরগোল পড়ে গেলো! প্রহরীকে দরবারে থাকা সবাই টানাটানি করে ওঠালেন।

তারপর রাজা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা রামছাগল, কী হয়েছে বল!’ প্রহরী তখন কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘হু-হু-হুজুর, উজির সাব শেষ!’ প্রহরীর কথা শুনে রাজার চোখ উঠলো কপালে। রাজা তাঁর দুই চোখ বড় বড় করে বললো, এই বেটা ছাগল, ভালো করে বল কী হয়েছে?’ প্রহরী বললো, উজির সাহেব গেইট থেকে বাইর হবার সময় কে যেন ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় মেরে দিল। সাথে সাথে উজির সাহেব মাটিতে পড়ে গেল। এতক্ষণে মনে হয় উজির সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, ‘হু-হু-হুজুর। প্রহরী এসব বলতে বলতে উজির সাহেব গালে ধরে গেইটের চাকরের কাঁধে হাত রেখে রাজদরবারে হাজির হলো। রাজা উজিরের এই অবস্থা দেখে বলল, ‘এই কে আছিস! জলদি যাও! গেইটের সামনে যাকেই পাও ধরে নিয়ে আস! কার এতবড় সাহস! আমার উজিরকে থাপ্পড় মারে? ওকে আমার একটু দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। যাও তাড়াতাড়ি!’

রাজার হুকুম বলে কথা। হুকুম দিতে দেরি, যেতে আর দেরি নেই। চার পাঁচজন সিপাহী ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দৌড় দিলো গেইটের দিকে। গেইট তখনো খোলা। সিপাহীরা দেখল গেইটের বাইরে একটা ছেলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, আমাদের উজিরকে থাপ্পড় মারলো কে রে?’ হিরা হেসে বললো, উজির না বাদশা তাতো আমি চিনি না। তবে পাঁচ মিনিট আগে একজন লোক গেইট থেকে বের হবার সাথে সাথে আমিই থাপ্পড় মেরেছি।’ হিরা’র কথা শুনে সব সিপাহীরা ঘাবড়ে গেল। সিপাহীরা বলছে, ওরে বাপরে! বলে কী! উজিরকে থাপ্পড় মারার পরও এতো সাহসিকতা?’ ওমনি রাজার সিপাহীরা হিরাকে খপ্ ধরে ফেললো।

হিরা বললো, ‘আমার কি অপরাধ? আমাকে তোমরা এভাবে ধরলে কেন? ছাড়ো, হাত ছাড়ো বলছি! তোমাদের উজিরকে থাপ্পড় মেরেছি বলে আমাকে এভাবে ধরলে? আরে ভাইসব, তোমাদের রাজার তো কপাল ভালো। এখানে উজির না হয়ে রাজা হলেও থাপ্পড়টা রাজার গালেই পড়তো। ছাড় আমাকে। আমি নিজেই রাজার কাছে যাবো।’ হিরা’র কথা শুনে এক সিপাহী বললো, না, তোকে ছাড়া যাবে না। এটা রাজার হুকুম! চল আমাদের সাথে। হিরা বললো, ‘না আমি এভাবে যাবো না।’ আরেক সিপাহী বললো, ‘বেটা তুমি এভাবে যাবে না তো কীভাবে যাবে? প্রয়োজনে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবো।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরার হাত পায়ে ধরে শূন্য করে নিয়ে চললো রাজদরবারের দিকে।

তখন হিরা সিপাহীদের কাঁধে দুই হাত রেখে হাসতে হাসতে বললো, ‘কি যে ভুল করেছি আমি! আগে জানলে তোমাদের উজিরকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম। মাত্র একটা থাপ্পড় মেরেছি। সেজন্য আমাকে তোমরা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছ! যদি আরও দুইটা থাপ্পড় মারতাম, তাহলে তো তোমরা আমাকে পালকিতে করে নিয়ে যেতে।’ এই কথা বলার সাথে সাথে সিপাহীরা হিরাকে শূন্যের উপর থেকে ধপাস্ করে নিচে ফেলে দিয়ে বলে, ‘বেটার সাহস কত বড়? দুইটা থাপ্পড় মারলে নাকি আমারা পালকি করে নিতাম! চল বেটা, হেঁটে চল!’ হিরা তখন মাটিতে বসে বসে মা-গো, বাবা-গে বলে চিল্লাচ্ছে, আর বলছে, ‘ভাই তোমরা তো আমাকে উপর থেকে ফেলে আমার কোমরটা ভেঙে দিলে। এখন আর আমার হাঁটার শক্তি নাই। আমি এখানেই বসলাম, তোমরা তোমাদের রাজাকে এখানে আসতে বলো!’ হিরার কথা শুনে সিপাহীরা বলছে, ‘কি মুশকিলে না পড়লাম রে ভাই! এই ধর ধর শালাকে। ওকে কোলে করেই নিতে হবে।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরা’কে আবার কাঁধে করে রাজদরবারে নিয়ে যেতে লাগলো।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

চলবে…

ধূমপানের কারণে আমার মৃত্যু হলে সরকার দায়ী থাকবে

বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকগুলো সিগারেট কোম্পানি আছে। যা Tobacco company নামে পরিচিত। সেসব কোম্পানিগুলোর তৈরি অনেক রকমের সিগারেট বাজারে আছে এবং প্রত্যেকটি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ বা ‘ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয়’ বা ‘পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি, ধূমপান এক বদ নেশা। যা আমি নিজেও জানি। আবার বুঝিও ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ-ও বুঝি ধূমপান আবার নেশার জগতে শিরোমণি। কারণ, ধূমপানের মাধ্যমেই নেশার জগতে মানুষের পা রাখা শুরু হয়। তাই ধূমপানকে অনেকেই নেশার জগতের নাটের গুরুও বলে। এর একটা কারণও আছে। কারণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা যাকে বলে। যে কোনো মানুষ নেশার জগতে পা রাখার আগেই ধূমপান থেকেই নেশা করার শিক্ষাটা শুরু হয়।

তাই দেখা যায়, বিশ্বে যতপ্রকার নেশা জাতীয় দ্রব্য আছে, তার মধ্যে সিগারেট হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় নেশা জাত দ্রব্য। আর যেসব নেশাখোর আছে, প্রত্যেকেই ধূমপান থেকে শুরু করেছিল নেশার জগতে পা রাখা। নেশাখোররা প্রথমে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা অথবা যে-কোনো তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে শিখে ছিল গাঁজা সেবন করা। এরপর গাঁজার মহাগুরু হয়ে ধরেছিল হিরোইন, মদ, আফিম, ফেন্সিডিল, ইয়াবা-সহ নানাধরণের নেশা। শুরু হয়ে গেল নেশাখোরের সাথে মাদক জাত দ্রব্যের সাথে সখ্য ও বন্ধুত্ব গড়া। এরপর থেকে শুরু হয় নেশার জগতে পা রাখা। আর নেশাগ্রস্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরা।

আমিও একজন নেশাখোর। তবে সিগারেট খোর। সিগারেট ছাড়া অন্য কোন নেশা জাতীয় দ্রব্যের সাথে এখনো আমার পরিচয় ঘটেনি। বন্ধুত্ব গড়েছি শুধুমাত্র সিগারেটের সাথেই। এই মরণ নেশা তামাকজাত দ্রব্য সিগারেটের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ছোটবেলা থেকে। যখন আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে শুরু করেছি, তখন থেকে। দেখেছি মানুষকে ধূমপান করতে। কাউকে দেখেছি হুঁকা বা হুক্কার কল্কিতে তামাক ভরে টানতে। কাউকে টানতে দেখেছি বিড়ি। কারোর হাতে দেখেছি চুরুট। কাউকে দেখেছি সিগারেট টানতে। দেখতে দেখতে একসময় নিজেও একজন মস্ত বড়ো ধূমপায়ী হয়ে উঠলাম। আমি ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমার ঠাকুমার ব্যবহার করা হুঁকা বা হুক্কা টেনে।

তবে আমি চুরিচামারি করে হুক্কা টেনে ধূমপান করা শিখিনি। হুক্কা টানতে বাধ্য হয়েছি একজন গ্রাম্য কবিরাজের পরামর্শে। গ্রাম্য কবিরাজও হুক্কা টেনে ধূমপান করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। কবিরাজের এরকম বাধ্যবাধকতা ছিল আমার পেটের পীড়া নিয়ে। সেসময় আমি সারাদিন যা খেতাম, কিছুক্ষণ পর সবই বমি হয়ে বের হয়ে যেতো। এই অবস্থা দেখে আমার মা পাশের গ্রামে থাকা এক কবিরাজের শরণাপন্ন হলেন। মা গ্রাম্য কবিরাজের কাছে আমার সমস্যা সব খুলে বললেন। কবিরাজ তাঁর কেরামতি চিকিৎসা শুরু করলেন। ঔষধ দিলেন।

নিয়মিত ঔষধ সেবন করেও যখন পেটের বদহজম দূর হচ্ছিল না। তখন গ্রাম্য কবিরাজ পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়! কবিরাজের সাথে আমার মা-বাবা-সহ সংসারের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। উপায়ান্তর না দেখে কবিরাজ হুক্কা টেনে ধূমপান করার পরামর্শ দিলেন। হুক্কা টেনে ধূমপান করতে হবে যখন যা কিছু যা-কিছু খাওয়া-দাওয়া তখন। কবিরাজের পরামর্শ হলো, খাওয়ার পরপরই হুক্কা টেনে ধূমপান করতে হবে। গ্রাম্য কবিরাজের পরামর্শে ঠাকুমার হুক্কা থেকে ধূমপান করা শুরু। কিন্তু আমার মা জননী কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। আমি ছিলাম ঠাকুমার প্রিয় আদরের নাতি। তাই আমার ঠাকুমার জোরাজুরিতে মা আর রাজি না হয়ে পারলেন না। মা-ও রাজি হয়ে গেলেন।

এরপর থেকে শুধু খাওয়া দাওয়াই নয়, খাওয়া-দাওয়ার আগে-পরেও আমার হুক্কা টানা চলতোই। সেই থেকেই আজ আমি নামকরা একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি। প্রতিদিন অন্তত ছোট প্যাকেটের ৫ থেকে ৬ প্যাকেট সিগারেট না হলে আর আমার চলে না। ভোরের ঘুমভাঙা থেকে শুরু করে রাতদুপুর পর্যন্ত খানিক পরপর চলতেই থাকে আমার সিগারেট টানা। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন গ্রাম ছেড়ে স্বপরিবারে শহরে আসি। শহরে এসে প্রায় দুইবছর লেখাপড়া বন্ধ রাখি। ১৯৭৪ সালে আবার স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে যাবার সময় আমার সাথে ‘কাইয়ুম বিড়ি’ থাকতো। সেই বিড়ি স্কুলের বাথরুমের উপরে থাকা ভেন্টিলেটর নামের ছোট একটা খোপে লুকিয়ে রাখতাম। টিফিনের সময় কিছু খেয়ে স্কুলের পেছনে গিয়ে গোপনে একটা বিড়ি টানতাম। সেই টানা আজ পর্যন্ত চলছেই। বর্তমানে আমার বয়স ৫৬ বছর গত হতে চলছে। বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ধূমপানও।

দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে অনেক ধূমপান বিরোধী ব্যক্তি আমাকে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে বলে। বলে আমার ভালোর জন্যই। কিন্তু আমি কিছুতেই ধুমপান থেকে বিরত থাকতে পারি না। মুখে বলি হ্যাঁ, এই ছেড়ে দিচ্ছি! কিছুক্ষণ পর হ্যাঁ ভুলে গিয়ে বা হ্যাঁ’কে তুচ্ছ করে আবার টানতে থাকি স্বাদের ধূমপান নামের সিগারেট। বুঝতে পেরেছি আমি এখন ধূমপানে বা সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছি। তবে ৬ থেকে ৭ বছর বয়স থেকে ধূমপান শুরু করে অদ্য পর্যন্ত আমি একটু কাশিও দেই না। সিগারেটের কারণে বা ধূমপানের কারণে আমার তেমন কোনও শারিরীক সমস্যাও দেখা দেয়নি। আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ সবল এক ব্যক্তি। তারপরও সময় সময় এই ধূমপানের কারণে অনেক মানুষের অনেকরকম কথা শুনতে হয়। শুনতে হয় ঘরের গিন্নির বকুনি। শুনতে হয় ডাক্তারের সাজেশনও। কিন্তু এতকিছুর পরও আমি আমার এই বদ নেশা ধূমপান ছাড়তে পারছি না এবং ধূমপান না ছাড়ার পক্ষেই থাকি।

তা কেন থাকি? থাকি ধুমপানের মধ্যে একটা ‘আভিজাত্য’ আছে বলে। পৃথিবীর অনেক ক্ষমতাবান অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছবিতে তাদের হাতে কিংবা ঠোঁটে চুরুট বা সিগারেট দেখি। আমি মনে করি এটা শুধু আমাকে দেখানোর জন্য অভিনয় করা নয়, এটা তাদের অভিনয়ের বাইরেও যেন একটা আভিজাত্য। একটা সময় ছিল  গ্রাম শহরের মানুষের বৈঠকখানায় হুঁকা বা হুক্কা ছিল। সেসময় হুক্কা শুধু বিচার সালিশেই বৈঠকখানায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল অনেকের বাড়িতেও। এটা ছিল তখনকার সময়ের একরকম আভিজাত্যের প্রতীক। রাজা জমিদারদের বৈঠকখানায়ও লম্বা নল বা পাইপের সাহায্যে তাঁরা হুঁকা বা হুক্কা টানতো। কথিত আছে, ‘এক চুলুম তামাকের বিনিময়ে নিজের এক কাঠা জমিও তামাক সমাদরকারীকে লিখে দিয়েছিলেন’। সেই পাইপওয়ালা হুক্কা তো এখন নেই বললেই চলে। যদিও থাকে তো ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিজে। যেখানে সিনেমা নাটক তৈরি হয়। তবে আগেকার দিনের ধনী ব্যক্তিদের বাড়ির পুরনো কোঠায় সেই যুগের দুই একটা হুঁকা বা হুক্কা এখনো থাকতে পারে বলে মনে হয়।

এছাড়াও হুক্কা শহর ছেড়ে গ্রামের পুরনো গৃহস্থদের ঘরেও থাকতে পারে। তা থাকুক আর না থাকুক, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। মাথা ঘামাচ্ছি এই যুগের সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা রয়েছে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ বা পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায় এই নিয়ে। আচ্ছা, তাই যদি হয় তাহলে রাষ্ট্র কেন এইসব সিগারেট কোম্পানিদের ব্যবসা করতে লাইসেন্স দিলো? যেহেতু এটা বিষের সমতুল্য সেহেতু এটাকে কেন বৈধ ব্যবসা হিসেবে সরকার অনুমোদন দিলো? তাহলে ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয় এই কথাটা কতটুকু সত্য প্রমাণিত হচ্ছে? মদ পানে মাতাল হয়, গঞ্জিকা সেবনে পাগল হয়, ইয়াবা সেবনে নেশা হয়। আবার অনেকের জীবনও ধ্বংস হয়ে যায়, মারাও যায়। তাই সেসব মাদক জাত দ্রব্য সরকার নিষিদ্ধ করেছে এবং সেসব জীবন হরণকারী মাদক জাত দ্রব্যের ব্যবসাও নিষিদ্ধ করেছে।

সিগারেট যদি সেসব মাদক জাত দ্রব্যের সমতুল্য হয়, তাহলে সিগারেট বিড়ি তৈরি ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ-সহ এসব দ্রব্যাদি নিষিদ্ধ করছে না কেন? শুধু প্যাকেটের গায়ে লিখে দিলেই কী এর মরণ থাবা থেকে জাতি রেহাই পাবে? পাবে না। ধূমপানের কারণে যদি মানুষের মৃত্যুই হয়, তাহলে অন্যান্য মাদক জাত দ্রব্যাদির মতো সিগারেট কোম্পানিগুলোও বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি। তা কী এদেশের সরকার কখনো করবে? মনে হয় না। এতেই বোঝা যায় ধূমপানের কারণে মানুষের মৃত্যু হয় না। তাই আমিও ধূমপান করা ছেড়ে দিচ্ছি না। দেখি শেষতক আমার কী হয়! কিছুই হবে না বলে বিশ্বাসও করি।

কারণ,আমি দেখে আসছি ধূমপানের কারণে মৃত্যু হয় না। পরোক্ষভাবে কারোর ক্ষতি হয় না। যদি এমনই হতো, তাহলে গ্রাম শহরের প্রতিটি পাড়া মহল্লার দোকানে দোকানে সিগারেট বিড়ি বিক্রি হতো না। সরকারও এসব মাদক জাত দ্রব্যাদি সিগারেট বিড়ি ওপেন বিক্রি হতে দিতো না। যদিও বিক্রি হতো তা মদ গাঁজা আফিম, হিরোইন, ইয়াবার মতো গোপনে গোপনে। কিন্তু না, এই সিগারেট বিড়ির নেশাখোররা রাস্তাঘাটে, লঞ্চ-স্টিমারে, ট্রেনে লোকালয় থেকেই কিনে মনের আনন্দে টানছে। খোলা আকাশের চিনে দিব্বি টেনেই যাচ্ছে। আর সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সহ ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা মৃত্যু মৃত্যু বলে চিল্লাচিল্লি করে বলছে, ‘ধূমপান থেকে বিরত থাকুন! ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর!’ আরেক দিকে সিগারেট বিড়ি কোম্পানিগুলোও প্যাকেটের গায়ে লিখে দিচ্ছে, ‘ধূমপানে মৃত্যু ঘটায়, ধূমপানের কারণে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়, পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতি হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে মনে হয় ধূমপানের কারণে মানুষের কোনও ক্ষতিই হয় না। যদি হতো, তাহলে আমারও হতো। আর যদি কোনও সময় এই ধূমপানের কারণে আমার কোনও ক্ষতি হয় বা মৃত্যু হয়, তাহলে আমি সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সহ সরকারকেই দায়ী করবো। সরকার কেন এই Tobacco company গুলো বন্ধ না করে লোক দেখানে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লিখে দিচ্ছে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?’ তাই ধূমপানের কারণে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে সরকার।

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৫ শেষ পর্ব

গল্পের চতুর্থ পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪

গল্পের চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
মুহূর্তেই কোঁয়া কোঁয়া এক সাপের রূপধারণ করে ফেললো। জাহাজের নিচতলা থেকে লোকমান হেকিম দেখছে, জাহাজের জানালা বেয়ে এক বিশাল সাপ কুলসুম দরিয়ায় নামছে।

কোঁয়া কোঁয়া সাপের রূপধারণ করে কুলসুম দরিয়ায় যখন নামছে, তখনই লোকমান হেকিম তাঁর সাথে নেওয়া ঔষধের শিশিগুলো রেডি করে ফেললো। যাতে তাড়াতাড়ি তাঁর করণীয় কাজ সেরে নেওয়া যায়। লোকমান হেকিমের বাম হাত রাখল জানালার বাইরে। যাতে সাপের লেজটা খুব সহজে ধরতে পারে। লোকমান হেকিম ভয়কে উপেক্ষা করে সময়মতো সাপের লেজটা ধরে ফেললো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাপের লেজ নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো। এমন সময় লোকমান হেকিম সাথে নেওয়া এক শিশি ঔষধ সাপের লেজের মাঝা-মাঝি পানিতে ঢেলে দিলো। সাথে সাথে অনেকখানি জায়গা নিয়ে সাপের লেজের চারিদিকের পানি পাথরের মতো হয়ে গেল। পরপর আরও কয়েকটা শিশি ঢেলে দিলো। মুহূর্তেই বিশাল জায়গা জুড়ে পাথর হয়ে গেল। সেই সাথে রাক্ষসী কোঁয়া কোঁয়াও সেই পাথরের নিচেই আটকা পড়ে গেল। এরপর লোকমান হেকিম আর সময়ের অপচয় করলেন না।

তিনি বাদশার মুলুক থেকে জাহাজে উঠার সময় সাথে একটা ব্যাগ নিয়েছিল। সেই ব্যাগের ভেতরে কী ছিল তা আর কেউ জানতো না। সেসময় বাদশা তো কোঁয়া কোঁয়ার সাথে জাহাজের উপরেই বসা ছিল। আর অপেক্ষায় ছিল লোকমান হেকিমের। লোকমান হেকিম সাথে কী এনেছিল, সেইদিকে বাদশা আর নজর রাখেনি। সেই ব্যাগে করে লোকমান হেকিম নিয়েছিল পিতলের দু’টি হাত। সেই হাত দুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি পাথর হয়ে যাওয়া জায়গায় নামলেন। এরপর লোকমান হেকিমের নিজস্ব কারিগরিতে সেখানে সুন্দরভাবে হাত দু’টি স্থাপন করলেন। এরকম পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই লোকমান হেকিম তাঁর বন্ধু বাদশাকে সাগর ভ্রমণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই তিনি সাথে করে নিজেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েছিলেন।

সেখানে লোকমান হেকিমের পিতলের হাত দু’টি স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো, এই কোঁয়া কোঁয়া রাক্ষসী কোনো এক সময় মোড়ামুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙে উপরে উঠে যেতে পারে। যদি পাথর ভেঙে উপরে উঠে যায়, তাহলে কোঁয়া কোঁয়া দুনিয়ার সবকিছু তচনচ করে ফেলবে। পুরোপুরিভাবে উঠতে না পারলেও, তাঁর লেজটা পাথরে আটকা থাকা অবস্থায়ও সাগরে চলাচলকারী নৌযান-সহ জাহাজের নাবিকদের আক্রমণ করতে পারে। তাই লোকমান হেকিম এই নির্দিষ্ট জায়গায় পিতলের হাত দুটি স্থাপন করে দেয়। যাতে এই ভয়ংকর জায়গার আশে-পাশে কোনও জাহাজ না আসে। তিনি এমনভাবে হাত দু’টি স্থাপন করেছিলেন, যেন দুটি হাতই না না করে সংকেত দিচ্ছে। স্থাপন করা হাত দুটি যেন সবার উদ্দেশ্যে বলছে, ‘তোমরা কেউ এদিকে আর এসো না, এদিকে আর এসো না।’

লোকমান হেকিমের এরকমই দুঃসাহসিক কাজ মাঝি-মাল্লারা সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিন্তু লোকমান হেকিমের প্রাণপ্রিয় বন্ধু বাদশার কোনও খবর কেউ রাখল না। বাদশা তখনো অজ্ঞান হয়ে জাহাজের দোতলায় বিছানায় পড়ে আছে। লোকমান হেকিম করণীয় কাজ সম্পন্ন করে জাহাজের উপরে তাকিয়ে দেখল, তাঁর বন্ধু বাদশা নেই। মাঝিদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার বন্ধু বাদশা কোথায়?’ একজন মাঝি দৌড়ে জাহাজের দোতলায় গিয়ে দেখে বাদশা অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। উপর থেকেই মাঝি লোকমান হেকিমকে বললো, ‘হুজুর আপনার বন্ধু বাদশাজি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি করে উপরে আসেন।’ লোকমান হেকিম তাড়াতাড়ি জাহাজের উপরে গেলেন। দেখলেন বাদশা ঠিকই অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। বাদশাকে ঔষধ সেবন করালেন পরপর অনেকবার। কিন্তু বাদশার জ্ঞান ফিরছে না।

এখন বাদশাকে নিয়ে লোকমান হেকিম পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়! যেই ঔষধ পানিতে ঢেলে দেওয়ার পর পানি পাথর হয়ে যায়, সেই ঔষধের মত ঔষধও বাদশাকে সেবন করানো হয়েছে। তাতেও বাদশা জ্ঞান ফিরছে না। তাই লোকমান হেকিম এখন ভিন্ন রকমের ঔষধ সেবন করাতে চাচ্ছে। কিন্তু তাঁর কাছে আর জ্ঞান ফিরানোর অন্য কোনও ঔষধ ছিল না।আর মাঝ দরিয়ায় তো আর ঔষধি গাছ নে-ই। ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে হলে লোকমান হেকিমকে যেতে হবে বনে জঙ্গলে। তাই তিনি জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের হুকুম দিলেন, তাড়াতাড়ি দরিয়ার পাড়ে জাহাজ ভেড়াতে। লোকমান হেকিমের কথামতো মাঝিরা জাহাজ পাড়ে ভেড়াতে করছে প্রাণপণ চেষ্টা, আর লোকমান হেকিম প্রিয় বন্ধু বাদশার পাশে বসে করছে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ।

লোকমান হেকিমের ফরিয়াদ হলো, “হে আল্লাহ! তুমি দয়ার সাগর। তুমি জীবের হায়াতের মালিক। তুমি দয়াল আমার কোল থেকে আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে কেড়ে নিও না। তুমি আমাকে যে কবিরাজি ক্ষমতা দিয়েছ, সেই ক্ষমতার কলঙ্ক করো না। যদি আমার কোলে আমার বন্ধুর মৃত্যু হয়, তাহলে আমি যে হেকিমের বাদশা লোকমান হেকিম, এই নামের আর ইজ্জত থাকবে না, দয়াল। তুমি রহম করো, ইজ্জত রক্ষা করো।”

কিন্তু না, সেদিন লোকমান হেকিমের কোনও ফরিয়াদ মহান সৃষ্টিকর্তা শুনেনি। কারণ, সেদিনই ছিল বাদশার শেষ দিন শেষ সময়। হায়াতের খাতায় বাদশার জন্য আর বিন্দুমাত্র সময় অবশিষ্ট ছিল না। মানে বাদশার হায়াত বা আয়ু শেষ। জীবের আয়ু শেষ তো জীবের মৃত্যু! তা সে হোক বাদশা। হোক সম্রাট। হোক সে রাস্তার ফকির। আয়ু শেষ তো জীবন শেষ! তাই লোকমান হেকিমের কোলেই বাদশা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু লোকমান হেকিম তা আর মেনে নিতে পারছিলেন না। মহান সৃষ্টিকর্তার উপর রাগে গোস্বায় একাকার। লোকমান হেকিম বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার বন্ধুকে আমার কোলেই মৃত্যু দিলে? তাহলে তুমিও শুনে রাখ, হে আল্লাহ! আমি লোকমান হেকিম এমন ঔষধ বানাবো, সেই ঔষধ কেউ সেবন করলে তাঁর আর মৃত্য হবে না। এমনকি সেই ঔষধ মৃত: মানুষের মুখে দিলে মৃতব্যক্তিও জিন্দা হয়ে যাবে। এর জন্য শুধু আমাকে একটু সময় তুমি দাও! যাতে আমি আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি।’

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক তাঁর আরশে বসে হেসে বলে, ‘না, লোকমান হেকিম। তা তুমি কখনোই পারবে না। সেই সুযোগও আমি তোমাকে দিবো না। এর আগেই সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী তোমারও মৃত্যু হবে। কারণ, সেই পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তোমার হায়াত শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা আমি আল্লাহ তোমার আয়ুর হিসাবের খাতায় দেখতে পাচ্ছি। তোমার সময় শেষ হতে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি! এরমধ্যেই তুমি যা খুশি করতে পারবে।’

এই সময়ের মধ্যেই মাঝি-মাল্লাদের আপ্রাণ চেষ্টায় জাহাজ দরিয়ার পাড়ে ভিড়ল। লোকমান হেকিম তাঁর প্রাণের বন্ধুকে জাহাজ থেকে নামালেন। সাগর পাড়ে জঙ্গলের ভেতরে বাদশাকে কবর দিলেন। এরপর জাহাজের মাঝিদের বললেন, ‘তোমরা তোমাদের মুল্লুকে ফিরে যাও! এখানে আমার কিছু করণীয় কাজ আছে। আমি আমার কাজ সমাধা করেই আস্তে-ধীরে মুল্লুকে ফিরবো, যদি হায়াত থাকে।’ জাহাজের মাঝি-মাল্লা লোকমান হেকিমের কথামতো চলে গেলেন। লোকমান হেকিম দৌড় দিলেন জঙ্গলের দিকে। তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্র মতে অমরত্ব ঔষধ তৈরি করতে ১০৮ প্রকারের গাছ-গাছালির প্রয়োজন। লোকমান হেকিম জঙ্গলে ঢুকে সেসব গাছ সংগ্রহের কাজে লেগে গেলেন। এক এক করে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে করতে প্রায় ৫০ প্রকারের গাছ সংগ্রহ করে ফেলে। আর বাকি থাকে ৫৮টি গাছ। এদিকে লোকমান হেকিমের আয়ুর অবশিষ্ট সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তা তো আর লোকমান হেকিম জানতেন না। তা জানতেন যমদূত নামে খ্যাত আজরাইল(আঃ)। একদিকে লোকমান হেকিম জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ঔষধি গাছ খুঁজছে।আরেকদিকে আজরাইল(আঃ) লোকমান হেকিমকে খুঁজছে। কারণ আজরাইল(আঃ)-এর কাছে থাকা মৃত্যু তালিকায় লোকমান হেকিমের নাম লেখা রয়েছে।

এমন সময় লোকমান হেকিমও তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান দ্বারা টের পেয়ে গেলেন, যে আজকেই তাঁর শেষ সময়। তিনি লোকমান হেকিম বুঝতে পেরেছেন পিছনে পিছনে কে যেন তাড়া করছে। তখন তিনি শুধু তিনিতে নেই। তিনি হয়ে গেলেন ৫০জন লোকমান হেকিম। ৫০ জন লোকমান হেকিম একসাথে জঙ্গলের ভেতরে কী যেন খুঁজছে। আজরাইল(আঃ) তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন! তখন আজরাইল(আঃ) মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে বললো, ‘হে আল্লাহ! আমার হাতে যেই মৃত্যু তালিকা আছে, সেই তালিকায় লোকমান হেকিমের নাম দেখতে পাচ্ছি। লোকমান হেকিম যে এই জঙ্গলে আছে তাও আমি জানি। কিন্তু হে, বারে এলাহি! আমি এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আমি এখন ৫০ জন লোকমান হেকিমকে এখনে দেখতে পাচ্ছি। এখন আসল লোকমান হেকিম কে, তা আমি বুঝতে পারছি না। হে বারে এলাহি! আপনি আমাকে সাহায্য করুন!’

আজরাইল(আঃ) এর ফরিয়াদে মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে গায়েবি আওয়াজ এলো, ‘তুমি এক এক করে সব-কয়টা লোকমান হেকিমের বুকে হাত দিয়ে দেখ কার বুকখানি থরথর করে কাঁপছে। যার বুক কাঁপছে, সে-ই হবে আসল লোকমান হেকিম। তুমি তাঁর জানই কবজ করবে। আর কাউকে তোমার খোঁজার প্রয়োজন নেই।’ আজরাইল (আঃ) এবং মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে গায়েবি বার্তা আদান-প্রদানের সময়টুকুতে হয়ে গেল ১০০ লোকমান হেকিম। এখন আজরাইল(আঃ) যেদিকে তাকায় শুধু লোকমান হেকিমকেই দেখতে পায়। তারপরও আজরাইল(আঃ)-এর চলছে একেক জনের বুকে হাত দিয়ে চেক করা। এদিকে লোকমান হেকিমের মৃত্যুর সময় আছে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি। আজরাইল(আঃ)ও খুব দ্রুত চেক করে যাচ্ছে।

শেষতক একজনের বুকে হাত দিতেই তাঁর বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। আজরাইল(আঃ)ও সাথে সাথে তাকে খপ করে ধরে ফেললো। যখন আজরাইল (আঃ)-এর হাতে ধরা পড়লো লোকমান হেকিম। তখন লোকমান হেকিম আজরাইল(আঃ)-এর কাছে একটু সময় চেয়ে বললো, ‘আজরাইল(আঃ), তুমি আমাকে আর ৯টি গাছ সংগ্রহ করার সুযোগ দাও! আমি ১০৮প্রকারের গাছের মধ্যে ৯৯প্রকার গাছ সংগ্রহ করে ফেলেছি। আর ৯টি গাছ আমি সংগ্রহ করতে পারলে এই দুনিয়ায় মানুষের জন্য অমরত্ব ঔষধ বানিয়ে যেতে পারবো। সেই ঔষধ সেবন করলে কেউ আর এই পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করবে না। কারোর মৃত্যুও হবে না। এমনকি কোনও মৃতব্যক্তিকে সেই ঔষধ সেবন করিয়ে দিলে সেই মৃতব্যক্তিও জিন্দা হয়ে যাবে। তাহলে তোমাকেও জীবের মৃত্যু তালিকা নিয়ে আর দুনিয়াতে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। তুমি আমাকে এই সময়টুকু দাও।’

লোকমান হেকিমের কথা শুনে আজরাইল(আঃ) হেসে বললো, ‘আমি আজরাইল(আঃ) মহান সৃষ্টিকর্তার গোলাম! তাঁর হুকুমের হেরফের আমি করতে পারি না। আমার হাতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের মৃত্যু তালিকা থাকে। কার কখন মৃত্যু হবে, কার জান কবজ করতে হবে আমি তা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তোমার মৃত্যুর সময়ও হয়ে গেছে। মৃত্যু তালিকায় তোমার নাম উঠে গেছে। কাজেই আমি এখনই তোমার জান কবজ করবো।’ আজরাইল(আঃ)-এর কথা শুনে লোকমান হেকিম বলতে লাগলো, ‘আমি যদি জানতাম তুমি আমাকে ধরে ফেলবে। তাহলে আমি আগে থেকে গাছের ভেতরে লুকিয়ে থাকতাম।’ আজরাইল(আঃ) হেসে বললো, ‘তোমার সময় যখন শেষ হয়ে গেছে, তখন তুমি যদি সাগরের তলদেশে গিয়ে কোনো এক পাথরের ভেতরেও লুকিয়ে থাকতে, সেখান থেকেও আমি তোমাকে খুঁজে বের করে তোমার জান কবজ করতাম।’ এই বলেই আজরাইল(আঃ) লোকমান হেকিমের দেহ থেকে প্রাণ কেড়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। লোকমান হেকিমের দেহ পড়ে রইল জঙ্গলের ভেতরে। এভাবেই এখানেই ক্যাম্বাচারদের বলা লোকমান হেকিমের গল্প শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বলা হয়নি লোকমান হেকিমের করব কোথায় এবং কীভাবে দেওয়া হয়েছিল।

লেখকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ:
গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছিল, এই গল্পের সাথে আমি কোথাও কোনও মিল খুঁজে পাইনি। সত্য আর মিথ্যা, তা বিবেচনায় নিবে আমার পাঠক ও সহ-লেখকবৃন্দ। তারপরও এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলে গল্পের পুরো কাহিনী বিফল হয়ে যাচ্ছে। তাই কিছু শোনা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। শোনা কথা হলো, কোনো এক সাগরের মাঝে দু’টি হাত নিয়ে কথা। যা ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলে শুনে আসছি। কিন্তু এর সত্যতা সবার কাছে আজও কেমন যেন অজানাই রয়ে গেল। বর্তমান বিশ্বের নামীদামি কোনও বিজ্ঞানীর কাছ থেকেও এর সত্যতা মেলেনি। কিন্তু কোনো এক সাগরের মাঝখানে যে দু’টি হাত ছিল এবং এক হাতে ডাকে আর এক হাতে না না করে; একথা আজও অনেক মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। এই কথা আর এই কাহিনী অনেকে বিশ্বাসও করে।

এখনো মাঝে মাঝে ৮০ থেকে ৯০ বছরের বুড়ো বুড়িরা বলে, ‘কোনো এক সময় নাকি ব্রিটিশ সরকার ঐ হাত দুটিতে গোলাবর্ষণ করে। কামানের গোলাবর্ষণে একটি হাত বিধ্বস্ত হয়ে নিচের দিকে হেলে পড়ে। এরপর থেকে নাকি হেলে পড়া হাতটি যেন ডাকে, আর ঠিক থাকা হাতটি না না করে।’ তাঁদের মতো আমরাও এমন কথাই ছোটবেলা থেকে শুনছি কোনো এক সাগরে মাঝে এক হাতে ডাকে, আর এক হাতে না করে। আসলে মনে হয় একসময় দুই হাতেই না না করেছিল। যাতে কেউ সেখানে না যায়। কিন্তু হাত দু’টো কে স্থাপন করেছিল তা কারোর মুখে শোনা যায় না। তবে নিজে থেকে একরকম ধারণা করা যায় যে, লোকমান হেকিমের স্থাপন করা হাত দু’টি বর্তমানে না থাকলেও, সেই জায়গাটা ঠিকই আছে বলে মনে হয়। সেই ভয়ংকর জায়গাটা হতে পারে বর্তমান গোল্ডেন ট্রাঙ্গল। যেখানে আজ পর্যন্ত কোনও জাহাজ যেতে পারেনি। যদিও কেউ ভুলবশত সেখানে গিয়েছে তো বিপদ হয়েছেই। এমনও হয়েছে কেউ আর ফিরে আসতে পারেনি। তাহলে এখানে কী বোঝা যাচ্ছে? যা-ই বোঝা যাক বা না যাক, আর গল্পের কাহিনী যা-ই থাকুক না কেন, এখানেই থেকে যাচ্ছে সেসব শোনা কথার অজানা রহস্য।

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-১

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪

গল্পের তৃতীয় পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৩

গল্পের তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছতে আর অল্প ক’দিনের পথ বাকি। এরপরই শুরু হবে কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কেরামতি।

কোঁয়া কোঁয়ার সাথে সেদিন লোকমান হেকিমের কথা-বার্তা এ-ই পর্যন্তই শেষ। মানে পাকাপাকি কথা। কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কথা-বার্তার সময় বাদশা যে জ্ঞানহারা হয়ে পড়েছে, তা ছিল বন্ধু লোকমান হেকিমের অজানা। বাদশার সাথে কথা হয় সাগর ভ্রমণের যাত্রাপথে ক’দিন আগে। শেষ বিরতির সময়। বাদশার মুল্লুক থেকে জাহাজ ছেড়ে আসার পর থেকে লোকমান হেকিমের সাক্ষাৎ হয়েছিল দুই-তিন বার। তাও সাগর পথে জায়গায় জায়গায় বিরতির এক ফাঁকে দেখা করতেন। আলাপও সারতেন গোপনে। এছাড়া লোকমান হেকিম এই যাত্রাপথে কোনও সময় জাহাজের উপরে উঠে বাদশার সাথে দেখা করতে পারেনি, দেখা করে-ও-নি।এভাবেই যাচ্ছে দিন, গড়াচ্ছে মাস। এভাবেই চলছে জাহাজ। পাড়ি দিচ্ছে সাগরের পর সাগর। এভাবে আর দুইএক দিন চললেই পৌঁছে যাবে কুলসুম দরিয়ার মাঝে। কিন্তু বাদশার কোনও সাড়াশব্দ নেই।

বাদশার সাড়াশব্দ না পেয়ে লোকমান হেকিম নিজে থেকেই কোঁয়া কোঁয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবীসাহেবা, আমার বন্ধুর তো কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। উনি কি ঘুমাচ্ছে?’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘চিন্তার কোনও কারণ নেই, ‘উনি ঘুমাচ্ছে।’ আসলে কিন্তু বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। কোঁয়া কোঁয়া মিথ্যের বলার কারণ হলো, লোকমান হেকিমকে শুধু শান্তনা দেওয়া। যদি বলে বাদশা জ্ঞানহারা, তাহলে লোকমান হেকিম সোজা উপরে চলে আসবে। লোকমান হেকিম যেন উপরে না আসে, তাই মিথ্যে কথা বলা। এরপর অবশ্য বাদশার জ্ঞান আপনা-আপনি ঠিকই ফিরেছে। বাদশার জ্ঞান ফেরার পর কোঁয়া কোঁয়াকে দেখেই বাদশা আবার ভয়ে কেঁপে উঠলো।

বাদশার এই অবস্থা দেখে কোঁয়া কোঁয়া বাদশার সামনে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনও ক্ষতি করবো না। আপনি আমাকে জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আপনার মহলে ঠাঁই দিয়েছেন। তা আমি ভুলে যেতে পারি না। যদিও আমি মানুষ নই, তবুও আমি আপনার ক্ষতি করবো না। যদি আপনার ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার থাকতো, তাহলে তো আমি আপনার মহলে বসেই ক্ষতি করতে পারতাম। আপনি যখন সোনা বনে হরিণ শিকারে গেলেন, তখনও আমি ক্ষতি করতে পারতাম। কিন্তু আপনার ক্ষতি আমি করিনি। শুধু আশ্রয় নিয়েছি আমার মনোমত আহার সংগ্রহের জন্য।

‘আমি ছোটবেলা থেকে সোনা বনে ঘুরেফিরে বড় হয়েছি। বাবাকে দেখিনি। মায়ের মুখে শুনেছি আপনার মতো এক রাজা হরিণ শিকারে এসে বাবাকে তীর মেরে মেরে ফেলেছে। আমার মাকে মরেছিল একজন হেকিম। ওই হেকিম প্রায়ই সোনা বনের গহীনে গিয়ে ঔষধি গাছগাছালি সংগ্রহ করতো। একসময় বনের গহীনে আমার মায়ের গন্ধ উনার নাকে লাগলো। আমার মা-ও হেকিমের সামনা-সামনি হয়ে গেল। ওমনি হেকিম উনার বানানো ঔষধ আমার মায়ের উপর নিক্ষেপ করে। এরপর মায়ের মৃত্যু হয়েছে মনে করে হেকিম তাড়াতাড়ি সোনা বন থেকে চলে যায়। মা বনের গহীনে পড়ে ছটফট করছিল। তখন আমি ছিলাম খুবই ছোট। সেদিন আমি ছিলাম এক বড় গাছের গর্তের ভেতরে। যেখানে মা আমাকে রেখে আহারের সন্ধানে বেরিয়েছিল। আমি গর্তের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম। চিৎকার শুনে দৌড়ে মায়ের সামনে আসি। মা আমাকে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে গিয়েছিল, একজন মনুষ্য হেকিম মায়ে শরীরে কি যেন নিক্ষেপ করেছিল। এরপরই মায়ের মৃত্য হয়।

‘মায়ের মৃত্যুর পর আমি একা হয়ে গেলাম। সোনা বনে পশুপাখি ধরে ধরে খেতাম। খেতে খেতে সব পশুপাখি শেষ করে ফেললাম। আমার ভয়ে সোনা বনে পশু তো আসতোই না, একটা পাখিও উড়ে আসতো না। যখন আর আহার সংগ্রহ করতে পারছিলাম না, তখন ভিন্ন বেশে রাতের অন্ধকারে সোনা বনের আশপাশের গ্রামে ঢুকতাম। মানুষের গরুছাগল হাঁস মুরগী ধরে ধরে খেতেম। এমনকি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সময় সময় মানুষও ধরে খেয়ে ফেলতাম। ভোর না হতেই আবার সোনা বনের গহীনে চলে আসতাম। এভাবে চলতে চলতে সোনা বনের আশপাশের গ্রামের মানুষজন আমাকে বধ করার জন্য উঠেপড়ে গেলে যায়। আমিও ছিলাম মনুষ্য ভয়ে। কারণ আমার বেশ ধরার কেরামতি আর শারীরিক শক্তি যতই থাকুক-না-কেন, মানুষের বুদ্ধির কাছে আমি সবসময়ই শূন্য। আমি বুদ্ধিহীন শক্তিহীন কেবল মানুষের কাছেই। তাই আমি মানুষকে খুবই ভয় পাই না। মানুষের ভয়ে ভয়ে থাকতে থাকতে এমন সময় আপনার দেখা পেলাম। মানুষ বেশে আমার সামনে এলাম। আপনি আমাকে পরিধান করার মত বস্ত্র দিলেন। আদর করে বুকে টেনে নিলেন। আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন। আমিও আশ্রয় পেলাম। আপনার মুল্লুক হলো আমার নতুন মুল্লুক। আপনার মুল্লুকের মানুষের কাছে আমি ছিলাম অজানা। তাই ক’দিন রাতের অন্ধকারে মনের আনন্দে আহার করেছিলাম। মনে করেছিলাম সারাজীবন এভাবে থেকে মনের আনন্দে ঘুরাঘুরি করবো। কিন্তু তা বুঝি আর হলো না। আমি যে মানষ নই, তা টের পেয়ে গেল আপনার বন্ধু লোকমান হেকিম।

‘আমি এখন বুঝতে পেরেছি আমার মাকে কে মেরেছিল। আমি নিশ্চিত, আমার মাকে আপনার এই বন্ধু লোকমান হেকিমই মেরেছিল। এখন আবার উনারই একটা পরীক্ষার মধ্যেও আমি পড়ে গেলাম। যা কিনা কুলসুম দরিয়ার তালা আছে কি নেই, সেই পরীক্ষা। আমি তা প্রমাণ অবশ্যই দেখাবো। এরপর হবে লোকমান হেকিমের সাথে আমার বোঝাপড়া। আপনি নির্ভয়ে থাকুন!’

কোঁয়া কোঁয়ার জীবন কাহিনী শুনে বাদশা আবারও হার্টফেল করলো। তখন কোঁয়া কোঁয়া জ্ঞানহারা বাদশাকে বিছানায় শোয়াইয়া দিলেন। বাদশা নীরবে নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছেন। জাহাজ চলছে শোঁ শোঁ করে। সগরের ঢেউয়ের শব্দে উপর থেকে কোঁয়া কোঁয়ার কথার আওয়াজ নিচে আসেনি। তাই আর লোকমান হেকিম তাঁদের কথা কিছুই শুনেনি। লোকমান হেকিম শুধু কুলসুম দরিয়ায় পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকলো।

একসময় বেতের জাহাজ কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছাল। লোকমান হেকিম মাঝি-মাল্লাদের থামতে বললেন। মাঝিরা জাহাজের বৈঠা টানা বন্ধ করলেন। জাহাজ থামলো। লোকমান হেকিম কোঁয়া কোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ভাবীসাহেবা, ‘আপনি কি সজাগ? আমরা কিন্তু কুলসুম দরিয়ার মাঝখানে আছি। এখানে শুধু পানি আর পানি। নিচে কোনও তলা নেই।’ কোঁয়া কোঁয়া আবারও হেসে বললো, ‘আপনি একজন মস্তবড় হেকিম হয়ে আহাম্মকের মতো কথা বলছে কেন? সব দরিয়ার তলা আছে। তলদেশ আছে। সাগরের তলাই যদি না থেকে তো সাগরের পানি থাকছে কিসের উপরে? এই দরিয়ারও তালা আছে। তা আমি অবশ্যই প্রমাণ দেখাবো।’ লোকমান হেকিম বললেন, ‘এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ভাবীসাহেবা। আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই এর প্রমাণ দেখাতে হবে। আর আপনি আগেও বলেছেন কুলসুম দরিয়ার যে তলা আছে, তা আপনি প্রমাণ করে দেখাবেন। আমি ভাবীসাহেবা আপনার প্রমাণ দেখার অপেক্ষায় আছি। দেরি না করে আপনি আপনার কেরামতি শুরু করুন! আমি উপর থেকে তা পর্যবেক্ষক করতে থাকি।’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি সাপের রূপধারণ করে দরিয়ার নিচে যাচ্ছি। দরিয়ার তলায় গিয়ে আমি আমার লেজ নাড়াচাড়া করলেই, বুঝে নিবেন আমি কুলসুম দরিয়ার তলার মাটি স্পর্শ করেছি।’ এছাড়াও আমি ফিরে আসার সময় আমার মুখে করে কুলসুম দরিয়ার নিচের মাটি নিয়ে আসবো।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘ঠিক আছে ভাবীসাহেবা, আপনি যেকোনো রূপধারণ করে কুলসুম দরিয়ার নিচে যেতে পারেন। আমি উপর থেকে তা দেখছি।’ মুহূর্তেই কোঁয়া কোঁয়া এক সাপের রূপধারণ করে ফেললো। জাহাজের নিচতলা থেকে লোকমান হেকিম দেখছে, জাহাজের জানালা বেয়ে এক বিশাল সাপ কুলসুম দরিয়ায় নামছে।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৫ শেষ পর্ব!

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৩

গল্পের দ্বিতীয় পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-২

আগের পর্বের শেষাংশ:
নিরুপায় বাদশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থাকা খাটের এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, আজ হয়তো আমার নির্ঘাত মৃত্যু-ই হবে।

বাদশা এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও, সেই রাতে বাদশার তেমন ঘুম হয়নি! মৃত্যুও হয়নি। ভোর হতে-না-হতেই বাদশা আবার ছুটে গেলেন বন্ধু লোকমান হেকিমের বাড়ি। বাদশার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। খাওয়া নেই। নাওয়া নেই। ঘুম নেই। বাদশা এখন শারীরিক দিক দিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বাদশাকে দেখে লোকমান হেকিম জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু, বেতের নৌকার খবর কী’? আর আমি তোমাকে বলেছি বেতের নৌকা। তা আসলে কিন্তু ছোট্ট একটা নৌকা নয়! হতে হবে বিশালাকৃতির এক জাহাজের মতো। যেহেতু আমরা সাগরে যাবো, সেহেতু আমাদের নৌযান হতে তার উপযোগী। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ অতিক্রম করে আমাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কাজেই আমাদের নৌযানও থাকতে হবে ঐরকমই। আর মাঝিমাল্লাও থাকতে হবে পর্যাপ্ত। বেতের জাহাজ চলবে দিনরাত। মাঝিরা কেউ কাজ করবে, কেউবা বিশ্রামে থাকবে। তুমি সেইভাবেই জাহাজটা তৈরি করবে, বন্ধু।’

বাদশা বললো, ‘আমি জানি সাগরে চলার জন্য কোন ধরনের নৌযান উপযোগী। তোমার এব্যাপারে বলার আগেই আমি ইতোমধ্যে বেতের জাহাজ তৈরি করার জন্য শ’খানেক লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তাও হবে দোতলা জাহাজ। জাহাজে থাকবে শখানেক মাঝিমাল্লা। থাকবে দীর্ঘদিনের খাবার সামগ্রী। আমার উজির সাহেব বললেন, খুব শীঘ্রই জাহাজ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘ঠিক আছে বন্ধু। তা-ই যেন হয়! আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে সাগর ভ্রমণের ব্যাপারে কিছু বলেছ’? উত্তরে বাদশা বললো, ‘না বন্ধু! তা আর বলা হয়নি। তবে আজকেই রাক্ষসী কোঁয়া কোঁয়াকে বলবো’। লোকমান হেকিম বললো, ‘তাহলে এখন তুমি তোমার মহলে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর বেতের জাহাজ তৈরির কাজে তদারকি করো। যাতে অতি তাড়াতাড়ি জাহাজ তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে ম্যানেজ করো’। এই বলেই লোকমান হেকিম বাদশাকে তাঁর মহলে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। বাদশা আগের মতোই ভয়ে ভয়ে মহলের দিকে রওনা দিলো।

বাদশা মহলে গিয়ে কোঁয়া কোঁয়াকে বললো, ‘ক’দিন পর আমরা সাগর ভ্রমণে বের হবো। নতুন বিবাহ করেছি তো, তাই তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবো। কী বলো, কোঁয়া কোঁয়া?’ উত্তরে কোঁয়া কোঁয়া জবাব দিলো, ‘এসব আমার কিছুই ভালো লাগে না জাঁহাপনা। আপনি বরং নিজেই সাগর ভ্রমণে যান। আমি মহলেই থাকি। এতদিন বন জঙ্গলে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেলাম। আপনাকে স্বামী হিসেবেও পেলাম। এখন আপনার মুল্লুক ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।’ বাদশা বললো, ‘না কোঁয়া কোঁয়া, তা হয় না। তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে। না গেলে আর হচ্ছে না।’ বাদশার অনুরোধে শেষতক কোঁয়া কোঁয়া রাজি হলো। বেতের জাহাজ তৈরি করা সম্পন্ন হলো। জাহাজের ভেতরে মাসেক ছ’মাসের খাদ্যসামগ্রী তোলা হলো। সাগর ভ্রমণে যাবার দিনতারিখ ঠিক হলো। যাবার আগের দিন লোকমান হেকিমকে জানানো হলো। সঠিক সময়ে বাদশা কোঁয়া কোঁয়াকে নিয়ে বেতের জাহাজের দোতলায় গিয়ে উঠলো। মাঝিরাও জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। অপেক্ষা শুধু লোকমান হেকিমের জন্য। কিন্তু বাদশার বন্ধু লোকমান হেকিম আসতে দেরি হচ্ছে। দেরি হবার কারণ হলো লোকমান হেকিম সাথে করে যেসব প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধপত্র সাথে নিবেন, সেগুলো গোছাতেই হলো দেরি।

জাহাজের দোতলায় বাদশার সাথে বসে আছে রূপসী কোঁয়া কোঁয়া। কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে বলছে, ‘কী ব্যাপার জাঁহাপনা, জাহাজ ছাড়ছে না কেন?’ জবাবে বাদশা বললো, ‘মাঝিরা আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার বন্ধু আসলেই জাহাজ ছেড়ে দিবে।’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘এটা আপনার কোন বন্ধু, জাঁহাপনা? ঐযে, সেদিন আপনার সাথে যাকে দেখলাম, তিনি?’ বাদশা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ কোঁয়া কোঁয়া। এই বন্ধুটি ছাড়া আমি একদম চলতে পারি না। আমার যেখানেই যাওয়া হয়, আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে সেখানে যাই।’ কোঁয়া কোঁয়া এবার খুব রাগ হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, জানতে পারি, আপনার বন্ধু কী করে?’ বাদশা নির্ভয়ে মনে আনন্দ নিয়ে জবাব দিলেন, ‘আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হলেন হেকিম। তাঁর নাম লোকমান হেকিম। তিনি গাছেদের সাথেও কথা বলতে পারেন।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনেই কোঁয়া কোঁয়া রেগেমেগে অস্থির হয়ে বললো, ‘আমি সাগর ভ্রমণে যাবো না। আপনি আপনার বন্ধুটিকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন!’ বাদশাও এবার একরকম রাগের মাথায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধু আমার সাথে যাবে, তাতে তোমার সমস্যা কী? আমিতো তোমার কোনও সমস্যা দেখছি না! প্রয়োজনে আমার বন্ধু জাহাজের নিচতলায়ই থাকবে। তবুও আমার প্রিয় বন্ধু সাথে যাবে।’

বাদশার এমন রাগ দেখে কোঁয়া কোঁয়া একটু নরম হলেন। চুপ করে বসে বসে কী যেন ভাবলেন। এরপর নিজে থেকেই বলে ফেললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে জাঁহাপনা। উনি আসুক! নিচতলায় যখন থাকবে, তো আমার কোনও সমস্যা নেই! তবে হ্যাঁ, উনি যেন কোনও অবস্থাতেই উপর তলায় না উঠে। কারণ, আমি পরপুরুষের ছায়া দেখি না।’ কোঁয়া কোঁয়ার কথায় বাদশা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এমন সময় লোকমান হেকিম তাঁর প্রয়োজনীয় ঔষধাদি সাথে নিয়ে জাহাজের সামনে হাজির হলেন। জাহাজে উঠে নিচতলায় গিয়ে বসলেন। মাঝিদের জাহাজ ছাড়ার জন্য বললেন। মাঝিরা জাহাজ ছাড়লেন। জাহাজ চলছে অজানার উদ্দেশে। কোথায় যাবে, কোনদিকে যাবে তার নির্দেশনা দিচ্ছেন, লোকমান হেকিম নিজেই। এভাবে চলতে চলতে দুই মাস পার হলে গেল। তবুও চলছে বেতের জাহাজ। এরমধ্যে কোথাও কোথাও বিরতিও চলছে। বিরতির সময় জাগায় জাগায় নেমে সবাই এদিক সেদিক ঘোরাফেরাও করছে। আবার চলছে জাহাজ অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।

একসময় কোঁয়া কোঁয়া বিরক্ত হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, আপনার ভ্রমণের গন্তব্যস্থান কোন সাগর পাড়ে? যেখানে যাবেন, সেখানকার নামটা জানতে পারি?’ কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে বাদশা রীতিমতো থ বনে গেল! কোঁয়া কোঁয়ার কথার জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলতেই, নিচ থেকে লোকমান হেকিম বললো, ‘বন্ধু তোমার স্ত্রীকে বলো, আমরা ঠিক কুলসুম দরিয়ার কাছাকাছিই যাবো।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হাসতে লাগলো। কোঁয়া কোঁয়ার হাসির শব্দ লোকমান হেকিমের কানে এলে, লোকমান হেকিম নিচ থেকে জানতে চাইলেন, ‘হাসির রহস্য কী?’ লোকমান হেকিমের জিজ্ঞাসার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘কুলসুম দরিয়া আমার খুবই পছন্দের।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এই কথা শুনে বাদশা ভয়ে থরথর! তারপরও তেমন ভয় পাচ্ছে না, কারণ বন্ধু লোকমান হেকিম সাথে আছে বলে।

কুলসুম দরিয়া কোঁয়া কোঁয়ার কাছে খুবই পছন্দের! এমন কথা শোনার পর লোকমান হেকিম বললেন, ‘বাহ্, বেশ তো! তাহলে তো অচেনা অজানা জায়গা নিয়ে আমাদের আর কোনও চিন্তাই নেই। এমনিতেই কুলসুম দরিয়ার পানিতে আঁশ নেই। যাকে বলে দো-আঁশ পানি। শুনেছি এই দরিয়ার পানিতে কোনকিছু ভেসে থাকে না। এ-ও শুনেছি যে, এই দরিয়ার নাকি কোনও তলাও নেই। শুধু পানি আর পানি। তা কী ঠিক, ভাবীসাহেবা? আমি কি তা ভুল শুনেছি?’ লোকমান হেকিমের কথার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললেন, ‘যতসব আহাম্মকের মতো কথাবার্তা! দরিয়ার যদি তলাই না থাকে, তো এতো পানি আছে কিসের উপর? অবশ্যই পানিগুলো একটা পাত্রের উপরেই আছে! শুধু কুলসুম দরিয়া কেন, দুনিয়ায় সব নদীনালা, সাগর মহাসাগরেরও তলা আছে।’

এবার লোকমান হেকিম হেসে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হয় না যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে। আর যদি থেকেই থাকে, তো আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। কুলসুম দরিয়ার তলা আছে তা কি আপনি প্রমাণ করতে পারবেন, ভাবীসাহেবা?’ কোঁয়া কোঁয়া রাগে গোস্বায় বললো, ‘অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে পারবো।’ লোকমান হেকিম বললেন, ‘তা কীভাবে আপনি প্রমাণ দেখাবেন যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে?’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, কুলসুম দরিয়ার মাঝখানে যাওয়ার পর আমি একটা সাপ হয়ে পানির নিচে যাবো। আমার লেজটা থাকবে আপনার হাতে। আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে গিয়ে লেজ নাড়াচাড়া করলেই বুঝতে হবে আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে পৌঁছেছি। আর নাহয় কুলসুম দরিয়ার তলদেশ থেকে আমি আমার মুখে করে মাটি নিয়ে আসবো। তাহলেই তো প্রমাণ হয়ে গেল যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে!’ এখন আপনি কোনটাতে রাজি?’

লোকমান হেকিম বললেন, ‘আপনাকে কষ্ট করে এতো নিচ থেকে মাটি কামড়ে আনতে হবে না, ভাবীসাহেবা। আপনার লেজটা যদি আমার হাতেই থাকে, নিচে গিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে।’ কোঁয়া কোঁয়া তাতেই রাজি হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে হেকিম সাহেব তা-ই হবে।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এমন কথা শোনার পরই বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন। বাদশার আর কোনও হুশ নেই, জ্ঞানও নেই। বাদশা একটা মরা লাশের মতো শুইয়ে আছে। বেতের জাহাজও চলছে জোরেসোরে। কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছতে আর অল্প ক’দিনের পথ বাকি। এরপরই শুরু হবে কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কেরামতি।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৪

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-২

গল্পের প্রথম পর্ব এখানে:
ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-১

বন্ধু লোকমান হেকিমের কথা শুনে বাদশা সেসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য মুহূর্তেই লোক লাগিয়ে দিলেন।
যাঁর লোকের অভাব নেই, তাঁর কাছে অনেক কঠিন কাজ সহজে করাটাও কোনও ব্যাপার নয়। মুহূর্তেই সব কাজ সমাধা হয়ে গেলো। এখন আর বাদশার মুল্লুকের কোথাও এক ফোঁটা পানি পাওয়া যাবে না। কেউ পানি পানি করে চিল্লা-চিল্লি করলেও পানি পাবে না। না পাক! তাতে বাদশার কিছুই আসে যায় না। বাদশার দরকার কোঁয়া কোঁয়ার রূপ দেখা। একসময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হলো। বাদশা দরবার হল থেকে কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে যেতে ভয় পাচ্ছিল! না গেলেও হচ্ছে না। ভয় করলেও বাদশাকে অন্তত আজকের রাতটুকু কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে কাটাতে হচ্ছে।

নিরুপায় বাদশা উপায়ান্তর না দেখে ভয়ে ভয়েই কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলেন। কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, কিছু মুখে না দিয়ে শুয়ে রইলেন যে’? বাদশা ভয়ে কোঁয়া কোঁয়ার দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘আজ আমার পেটে ক্ষুধা নেই। আমার শরীরটা খুবই ক্লান্ত। তাই শুয়ে রইলাম। আমাকে আর ডাক দিও না, কোঁয়া কোঁয়া। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে’। এই বলেই বাদশা ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে রইলেন। রাত যখন গভীর হলো, বাদশা কুড়মুড়িয়ে উঠে পানি পানি করতে লাগলো। বাদশার গলার আওয়াজ কোঁয়া কোঁয়ার কানে যেতেই, কোঁয়া কোঁয়া ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, আপনার কি পানির পিপাসা পেয়েছে’? বাদশা মাথা নেড়ে সায় দিল। কোঁয়া কোঁয়া একটা গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে থাকা পানির পাত্র কলসির সামনে গেল। কিন্তু কলসিতে পানি নেই! হাতে গ্লাস নিয়েই ঘরের বাইরে থাকা জাঁতাকলের সামনে গেলো। জাঁতাকলও নষ্ট! পানি ওঠে না। কোঁয়া কোঁয়া এখন ভাবছে! কী ব্যাপার? ঘরের কলসিতে পানি নেই, জাঁতাকল নষ্ট। এসবের মানে কী? কোঁয়া কোঁয়া ঘরে এসে ভাবতে শুরু করলো। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে লোকমান হেকিমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। কোঁয়া কোঁয়া বুঝতে পেরেছে এটা বাদশার বন্ধুর শলা-পরামর্শগুলোর মধ্যে একটি।

কোঁয়া কোঁয়া ভাবছে, আর বাদশা বুজুবুজু টেরা চোখে ভয়ে ভয়ে দেখছে। এমন সময় কোঁয়া কোঁয়া ঘরের জানালা খুললো। জানালা খুলে জানালার রড বেঁকিয়ে ফেললো। তারপর বাম হাতে পানির গ্লাসটা ধরে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই দৃশ্য বাদশা টেরা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। বাদশা দেখতে পেলো, গ্লাস-সহ হাত শুধু লম্বাই হচ্ছে। এতে পানির গ্লাস-সহ হাত যে কোথায় যাচ্ছে, তা বাদশার ছিল অজানা। এরপর বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় ঢলে পড়ে রইল। কোঁয়া কোঁয়া মুহূর্তেই গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এলো। পানির গ্লাসটা বাদশার সামনে ধরে বলছে, ‘জাঁহাপনা, পানি নিন, পান করুন!’ কিন্তু বাদশার আর হুঁশ নেই, জ্ঞান নেই। বাদশার এই অবস্থা দেখে কোঁয়া কোঁয়া বুঝতে পেরেছে, বাদশা ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। কোঁয়া কোঁয়া মনের ক্ষোভে পানি ভর্তি গ্লাসটা ঘরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে শুইয়ে রইল।

সকাল হতে-না-হতে বাদশা কোঁয়া কোঁয়াকে ঘুমে রেখেই একটা ঘোড়া নিয়ে বন্ধু লোকমান হেকিমের বাড়িতে রওনা দিলো। লোকমান হেকিম তখনও ঘুমের ঘোরে। বাদশা বন্ধু লোকমান হেকিমের ঘরের দরজায় টোকা দিতেই লোকমান হেকিম ঘরের দরজা খুলে বাইর হলো। ঘর থেকে বের হয়ে লোকমান হেকিম দেখলো বন্ধু বাদশাকে। বাদশা কাঁদা কাঁদা স্বরে বললো, ‘বন্ধু আমাকে বাঁচাও! এই রাক্ষসীর হাত থেকে আমার মুল্লুক বাঁচাও!’ হেকিম বললেন, ‘কেঁদো না বন্ধু, তুমি শান্ত হও! সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এই বলেই লোকমান হেকিম তাড়াতাড়ি করে বাদশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বসতে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘটনা কী বন্ধু? কিছু টের পেলে? তোমার নববধূ কোত্থেকে পানি এনেছিল? এবার বুঝতে পেরেছো তো’? বাদশার মুখে কোনও কথা নেই। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন।

লোকমান হেকিম এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু তোমার কোঁয়া কোঁয়া কি রাতে কিছু পানি এনেছিল? যদি পানি এনে থাকে তো কীভাবে এনেছি’? লোকমান হেকিমের প্রশ্নের জবাবে বাদশা গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলতে গিয়ে বললেন, ‘বন্ধু আমি তোমার কথামতো ঘুমের ভাণ করে অনেক রাত পর্যন্ত শুইয়ে রইলাম। এরপর একসময় আমি এক গ্লাস পানি দেবার জন্য কোঁয়া কোঁয়াকে বললাম। কোঁয়া কোঁয়া ঘরে বাইরে কোথাও পানি না পেয়ে ঘরের জানালার রড বাঁকা করে গ্লাস-সহ হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি দেখলাম কোঁয়া কোঁয়ার হাত শুধু লম্বা হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থা দেখেই আমি জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। এরপরের ঘটনা কী ঘটেছে, তা আর আমি জানি না, বন্ধু’। লোকমান হেকিম বললেন, ‘এখন প্রমাণ পেলে তো’? তুমি বন্ধু ভুল করে যেই রাক্ষসী তোমার মুল্লুকে এনেছো, এর খেসারত তুমি তো দিবেই; সাথে তোমার মুল্লুকের জনসাধারণকে দিতে হবে’।

লোকমান হেকিমের কথায় রাগ না করে বাদশা বললেন, ‘এখন উপায়?’ লোকমান হেকিম বললো, ‘অবশ্যই এর উপায় আছে বন্ধু। তবে আরও কিছু কাজ করতে হবে’। জবাবে বাদশা বললেন, ‘এই রাক্ষসীকে তাড়াতে যা করা দরকার তা-ই করবো। আর যাকিছু লাগে তা-ই দিবো। তবু আমার মুল্লুক থেকে এই রাক্ষসীকে তাড়াও, বন্ধু’। লোকমান হেকিম বললেন, ‘ঠিক আছে বন্ধু, তা-ই হবে। এখন তুমি তোমার মহলে চলে যাও’! মহলে যাবার কথা শুনেই বাদশা ভয়ে কেঁপে কেঁপে বললো, ‘না বন্ধু, এই রাক্ষসী থাকতে আমি আমার মহলে যাবো না। তুমি তাড়াতাড়ি ও-কে তাড়ানোর ব্যবস্থা অরো’! লোকমান হেকিম বললেন, ‘তাড়াতে তো অন্তত কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে, বন্ধু। আর এই সময়ের মধ্যে একটা বড় বেতের নৌকা তৈরি করতে হবে। বেতের নৌকাটি হবে দোতলা’।

সেই নৌকায় চড়ে আমাদের যেতে হবে কুলসুম দরিয়ায় (নীল দরিয়া)। যেই সাগরের পানির উপরে কিছুই ভেসে থাকে না। লোহা দিয়ে তৈরি করা জাহাজও ভেসে থাকে না। এমনকি কাঠের জাহাজ অথবা নৌকাও ভাসে না। সব রকমের বস্তু দিয়ে তৈরি জাহাজ অথবা নৌকা মুহূর্তেই ডুবে যায়। ডুবে না একমাত্র বেত দিয়ে তৈরি করা জাহাজ অথবা নৌকা। বেতের নৌকায় চড়ে আমরা সেই দরিয়া-ই যাবো। সাথে তোমার নববঁধূও থাকবে। তবে এর আগে তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে শুনাতে হবে যে, আমরা কিছুদিনের জন্য সাগর ভ্রমণে যাবো। সাথে আমার এক বন্ধুও যাবে। তোমার কোঁয়া কোঁয়া অবশ্য যেতে চাইবে না। তারপরও শত চেষ্টা করে হলেও তাকে রাজি করাতে-ই হবে। তুমি কি পারবে বন্ধু’? জবাবে বাদশাই বললেন, ‘বেতের নৌকা তৈরি করতে বেশিদিন সময় লাগবে না বন্ধু। আমি আমার লোকজন দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সময়ের মধ্যেই বেতের নৌকা তৈরি করে ফেলবো। হয়তো একটু সময় গালবে কোঁয়া কোঁয়াকে রাজি করাতে। তা যেভাবেই হোক আমি কোঁয়া কোঁয়াকে রাজি করাবো-ই’।

বাদশার কথা শুনে লোকমান হেকিম বললেন, তাহলে এবার তুমি মহলে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় কাজ করো। আর হ্যাঁ, তোমার রূপসী কোঁয়া কোঁয়ার সাথে আমাদের কথোপকথন ভুলেও ফাঁস করবে না। যদি করো তো মহা বিপদের সম্মুখীন হতে হবে’। এই বলেই লোকমান হেকিম কইয়ে-বইয়ে বাদশাকে মহলে পাঠিয়ে দিলেন। বাদশা ভয়ে ভয়ে মহলে গেলেন। মহলে গিয়ে উজির, নাজির, কোতোয়ালকে সাথে নিয়ে দরবারে বসলেন। তাঁদের হুকুম দিলেন, ‘আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে আমাকে একটা বেতের নৌকা তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য কী করতে হবে আমাকে বলুন’! এরপর দরবারে উপস্থিত থাকা সবাই বললেন, ‘ঠিক আছে জাঁহাপনা, তা-ই হবে’। এই বলেই উজির নাজির কোতোয়াল বের হলেন বেতের নৌকা তৈরি করার কারিগরের খোঁজে। বাদশা গেলেন অন্দরমহলে। মনের ভেতর ভয় থাকার কারণে বাদশা কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে আর যায়নি। গিয়েছে বড় রাণীর ঘরে। বড় রাণীর ঘরে যাবার সময় কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে দেখে ফেলেছে। এরপর কোঁয়া কোঁয়া বড় রাণীর ঘর থেকে বাদশাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। নিরুপায় বাদশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থাকা খাটের এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, আজ হয়তো আমার নির্ঘাত মৃত্যু-ই হবে।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-৩

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-১

ছোটবেলা হাট বাজারে গেলে ক্যাম্বাচারদের লেকচার শুনতাম। ওঁরা বনাজি ঔষধ বিক্রি করতো। ওঁদের সামনে থাকতো সাজানো দেশীয় গাছগাছালি। কোন গাছের কোন গুণ, তা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতো। অনেক ক্যাম্বাচারদের সাথে হারমনিয়াম তবলা থাকতো। গান বাজনার ফাঁকে ফাঁকে ঔষধের গুণাবলি তুলে ধরতো। ক্যাম্বাচারদের চারদিকে মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতো, ওঁদের কাছ থেকে ঔষধও কিনতো। যেকোনো হাট বাজারের দিন ওঁরা দুপুরের পরপর গাছগাছালির পসরা সাজিয়ে বসতো। থাকতো লোকের সমাগমের আশায়, অপেক্ষায়। লোকের সমাগম হতে, আর ক্যাম্বাচারদের লেকচার শুরু হতো। ওঁরা ক্যাম্বাচাররা মাজার মজার গল্পও বলতো। ওঁদের মুখে সেসব গল্প শুনতে খুবই মজা লাগতো। ওঁদের সাজানো গাছগাছালির সামনে চুপ করে বসে বসে ওঁদের বানানো গল্পগুলো শুনতাম। সেই গল্প মনের ভেতর গেঁথে রেখে আবার না শোনা বন্ধুদের শোনাতাম।

সেসব গল্পের মধ্যে একটা গল্প আজ কয়েকদিন ধরেই মনে পরতে লাগলো। গল্পটা হলো এক হেকিমের বাদশার তেলেসমাতি দেখানোর গল্প। যার নাম ছিল লোকমান হেকিম। তিনি নাকি গাছেদের সাথেও কথা বলতেন। গাছেরাও হেকিমের সাথে কথা বলতো। ক্যাম্বাচাররা লোকমান হেকিমের গল্প বলে মানুষকে আকৃষ্ট করতো। গল্প বলার একটা উদ্দেশ্যও ছিল। উদ্দেশ্য হলো, ওঁরা যে গাছগাছালি নিয়ে বসেছে, এসব গাছগাছালি দিয়ে তো একসময় একমাত্র লোকমান হেকিমই ঔষধ তৈরি করতেন। তাই ওঁরা মানুষকে বুঝানোর জন্য লোকমান হেকিমের গল্প শোনাতো। আজ সেসব গল্পের মধ্যে একটা গল্পের পুরো কাহিনী সবার সামনে তুলে ধরছি। তবে হ্যাঁ, এই গল্পের সাথে আমি কোথাও কোনও মিল খুঁজে পাইনি। সত্য আর মিথ্যা, তা বিবেচনায় নিবে আমার পাঠক ও সহ-লেখকবৃন্দ। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

গল্প ছিল এরকম:
এক বাদশা ছিলেন। বাদশার নেশা ছিল শিকার। দুই তিনদিন পরপর বাদশা সৈন্যসামন্ত নিয়ে হরিণ শিকারে বের হতেন। যেতেন গহীন বনে। ভয় বলতে বাদশার ছিল না। বাদশা ছিলেন খুবই সাহসী। একদিন তিন চারজন সৈন্য সাথে নিয়ে শিকারে বের হলেন। কোথায় কোন বনে যাবেন, তা আর ঠিক করতে পারছিলেন না। হঠাৎ বাদশার মাথায় এক বুদ্ধি চলে এলো। বুদ্ধি হলো, যেসব বনে একবার গিয়েছি, সেসব বনে আজ আর যাবো না। যাবো এক অচেনা বনে। তা হোক নিকটে, হোক দূরে। সাথের সৈন্যদের জিজ্ঞেস করলো, ‘দূরে কোনও অচেনা গহীন বন আছে কিনা’। একজন সৈন্য বললো, ‘আছে’। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই বনের নামটা কী?’ সৈন্য বললো, ‘বনের নাম সোনা বন’। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কোথায়?’ সৈন্য বললো, ‘অনেক দূরে হুজুর’। আবার অনেক ভয়ানকও’। বাদশাহ রেগে বললেন, ‘ভয়ানক হোক আর দূর হোক, আমাকে সোনা বনে নিয়ে চলো’।

যেই কথা, সেই কাজ। বাদশাকে নিয়ে গেলেন অচেনা অজানা সোনা বনের কাছে। সোনা বনের পরিবেশ দেখে বাদশাহ খুবই খুশি হলেন। খুবই সুন্দর! মনোরম মায়াবী পরিবেশ। বনের কাছে যেতেই বনের প্রাকৃতিক শোভা যেনো বাদশাকে ভেতরে ডাকছে। বাদশাহ খুশিতে বলতে লাগলো, ‘এই সুন্দর মায়াবী সোনা বনে মায়াবী হরিণ আছে। আমার শিকার জীবনে এ-ই বনের হবে সেরা শিকার’। কিন্তু সাথে যাওয়া সৈন্যরা কেউ যেতে সাহস পাচ্ছিল না। কারণ এই সোনা বন সবার কাছে অচেনা হলেও, সোনা বনের ভেতরের কাহিনী অনেকের কাছেই ছিল শোনা এবং জানা। তাই বন দেখে সাথে যাওয়ারমত সবাই ভয়ে থতমত। সবার এরকম অবস্থা দেখে বাদশা ভীষণ রাগ করলেন। সবাইকে বললেন, তোমরা পুরুষ নামের কলঙ্ক। এই বলেই বাদশাহ সবাইকে রেখে নিজেই সোনা বনের ভেতরে চলে গেলেন। সাথে যাওয়া সৈন্যরা সোনা বনের বাইরে বসে রইলেন, বাদশার অপেক্ষায়।

বাদশাহ সোনা বনের ভেতরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। যতই ভেতরে যাচ্ছে, সাহসী বাদশার ততই শরীর ছমছম করছে। আর এক সৈন্য তো আগেই বলেছিল বনটি খুবই ভয়ানক। কিন্তু বাদশাহ তা আর গুরুত্বের সাথে নেয়নি। বাদশাহ তাঁর সাহসিকতার দাপটে একপর্যায়ে বনের গহীনে চলে গেলেন। সাথে থাকা সৈন্যদল রয়ে গেলেন বাইরে। বাদশাহ এখন সোনা বনের গহীনে একা। সাহসী বাদশাহ তীর-ধনুক তাক্ করে এদিক সেদিক এগুচ্ছে, তাকাচ্ছে। বাদশার কানে মানুষের কান্নার আওয়াজ আসছে। অতি নিকটেই কে যেন কাঁদছে। সেও আবার মেয়ে গলায়। বাদশাহ ভয় পাচ্ছিল তো পাচ্ছিল না। এগুচ্ছে তো এগুচ্ছে না, এমনই চলছিল বাদশার অবস্থা।

এভাবে একটু একটু করে সময় যাচ্ছে, আর বাদশার কানে বেশি কান্নার আওয়াজ আরও বেশি আসছে। বাদশা এখন হরিণ খোঁজা বাদ দিয়ে, কান্নার খোঁজে মন দিলো। বাদশা জোরে বলতে লাগলো, ‘কে তুমি কাঁদছো? তুমি কে? তুমি আমার মতো মানুষ? নাকি জ্বীন-ভূত? যদি মানুষই হয়ে থাকো, তাহলে আমার সামনে আস! তোমার শত সমস্যা আমি সমাধা করে দিবো।’ এসব বলার পরপরই আড়াল থেকে কে যেন বললো, ‘হুজুর আমি আপনার মতো মানুষ। তবে মেয়েমানুষ। কিন্তু আমি আপনার সামনে আসতে পারছি না। আমি যে বস্ত্রহীন হুজুর! আমাকে এক টুকরো বস্ত্র দিন। আমি আপনার দেওয়া বস্ত্র পরে আপনার সামনে আসি।’ বাদশার এবার একটু বাড়তি সাহস হলো। মনের ভেতর থেকে কিছুটা ভয় দূরীভূত হলো।

এবার বাদশা বললো, ‘তুমি কোথায়? আমি তো তোমাকে দেখছি না। না দেখার মাঝে আমি তোমাকে পরিধান করার বস্ত্র দেই কীভাবে?’ দূর থেকে আওয়াজ আসলো, হুজুর আমি আপনার পিছনে বড় গাছটার আড়ালে আছি। দয়া করে বস্ত্রখণ্ড গাছের ওপাশে ফিকে দিন। আমি বস্ত্র পরিধান করে আপনার সামনে আসি।’ কথামতো বাদশা নিজের মাথায় থাকা সাদা কাপড়ের পাগড়ি খুলে গাছের সামনে ফিকে দিলো। কিছুক্ষণ পর গাছের পিছন থেকে সাদা কাপড় পরিহিত এক রূপসী মেয়ে বের হয়ে আসলো। বাদশাহ দাঁড়িয়ে আছে। বাদশার সামনে এখন উঠতি বয়সের রূপসী যুবতী মেয়ে। বাদশা তো অবাক হয়ে দেখছে। মেয়েটার রূপের বাহার দেখে বাদশার এখন মাথা খারাপ হবার পালা। কিন্তু মাথা খারাপ না করে নরম গলায় মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কী?’ মেয়েটি বললো, ‘আমার নাম কোঁয়া কোঁয়া’। বাদশা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখানে কী করে এলে?’ তোমার মুল্লুক কোথায়? তোমাকে কেউ কী অপহরণ করে এখানে ফেলে চলে গিয়েছে?’ মেয়েটি বাদশার সব কথার উত্তর দিলো, ‘জানি না’।

মেয়েটির কথা শুনে বাদশার মায়া হলো। বাদশার সাথে সীমিত খাবার ছিল। যা-ই ছিল মেয়েটাকে খেতে দিলো। মেয়েটা খেলো। এবার বাদশা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি আমার সাথে আমার মুল্লুকে যাবে? যদি যেতে চাও, তো আমি তোমাকে আমার মুল্লুকে নিয়ে যাবো। বলো তুমি কি যাবে?’ মেয়েটি বললো, ‘জ্বি হুজুর, আমি আপনার সাথে যাবো। তবে এভাবে যেতে পারবো না’। বাদশা জিজ্ঞেস করলো, ‘এভাবে মানে? তুমি যেভাবে যেতে চাও, আমি তোমাকে সেভাবেই নিয়ে যাবো। বলো, তা কীভাবে?’ মেয়েটি বললো, ‘হুজুর, আপনার সাথে নিতে হলো আমাকে বিবাহ করে নিতে হবে। তা কি আপনি করবেন?’ বাদশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ঠিক আছে, তা-ই হবে’। এই বলেই দুইজনে সোনা বনের গহীন থেকে বাইরে আসলো।

এদিকে বাদশার সাথে যাওয়া সৈন্যরা চিন্তায় অস্থির! ওঁরা সৈন্যরা শুধু বনের দিকে তাকিয়ে আছে কতক্ষণে বাদশা আসবে। বাদশাকে দেখার জন্য সৈন্যরা করছে পাঁয়তারা। এমন সময় বাদশা সৈন্যদের সামনে হাজির। সাথে রূপসী এক মেয়ে। সৈন্যরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আপনি গেলেন হরিণ শিকার করতে। অথচ আপনার সাথে হরিণ নেই! সাথে নিয়ে আসলেন এক রূপসী মেয়ে। তো হুজুর, আপনার সাথে এই মেয়েটা কে?’ বাদশা বললো, ‘এটা হবে তোমাদের নতুন রাণী মা’। এই বলেই সবাইকে সাথে নিয়ে বাদশা তাঁর মুল্লুকের দিকে রওনা দিলেন। বাদশার মুল্লুকে গেলেন।

বাদশার মহলে আগে বিয়ে করা এক রাণী আছে। বড় রাণী জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, জানতে পারি, আপনার সাথে মেয়েটি কে?’ বাদশা বললো, ‘এই মেয়েটি আজ এখনই আমার রাণী হবে। তুমি হবে বড় রাণী, আর এই মেয়েটি হবে আমার ছোট রাণী।’ বড় রাণী বাদশার কথা শুনে চুপ করে মহলের ভেতরে চলে গেল। এমনিতেই আগেকার রাজা বাদশাদের মহলে তিন চারটে করে রাণী থাকতো। তাই আর বড় রাণী বাদশার মুখের উপর কিছু না বলে চুপ করে চলে গেলো। এরপর বাদশা উজিরকে ডেকে বললেন, ‘কাজী ডাকো! যেই কথা সেই কাজ। কাজী আসলো। বিয়ে হলো। ছোট রাণীর থাকার জন্য আলাদা এক কোঠা দেওয়া হলো। বাদশা এখন বড় রাণীর ঘরে না থেকে, মনের আনন্দে ছোট রাণী কোঁয়া কোঁয়াকে নিয়েই বেশি থাকে। বাদশা রূপসী কোঁয়া কোঁয়াকে পেয়ে অতীত বর্তমান যেন সবই ভুলে গেছে।

ভুলে গেছে বাদশার প্রাণপ্রিয় বন্ধু লোকমান হেকিমের কথাও। যিনি হলেন, হেকিমের বাদশা। এর আগে বাদশা যখন যা কিছু করতো, প্রিয় বন্ধুর থেকে বুদ্ধি পরামর্শ নিয়েই করতো। যেকোনো জটিল বিষয়ে বন্ধুকে স্মরণ করতে, বন্ধু লোকমান হেকিম সেই জটিল বিষয়ের সমাধান করে দিতো। অথচ বাদশা রূপসী কোঁয়া কোঁয়াকে বিয়ে করে ঘরে তোলার পর প্রিয় বন্ধুকে যেন মনের অজান্তেই ভুলে গিয়েছে। কোঁয়া কোঁয়াকে দেখার পর বিয়ে পর্যন্ত কোনকিছুই জানানো হয়নি, প্রিয় বন্ধু লোকমান হেকিমকে। তবে বাদশার প্রিয় বন্ধু লোকমান হেকিম কিন্তু তাঁর মুল্লুকের বর্তমান হালচাল সবই নজরে রাখছে। স্মরণেও রাখছে। বাদশার মুল্লুকে কখন কী হচ্ছে, সব বিষয়েই সজাগ দৃষ্টি রাখছে। আগে-পরে খবরও রাখছে। বাদশা যে সোনা বনের গহীন থেকে একটা মেয়েকে উদ্ধার করে এনে বিয়ে করেছে, তাও জানে। কীভাবে করেছে, তাও জানে। মেয়েটির জন্ম পরিচয়ও আগে থেকে লোকমান হেকিমের জানা আছে। কিন্তু বাদশা মেয়েটিকে বিয়ে করার পর লোকমান হেকিম নিজে থেকে কোনদিন মুল্লুকে প্রবেশ করেনি।

এদিকে বাদশার মুল্লুকে একের পর এক অঘটন ঘটেই চলছে। অঘটন হলো, প্রতি রাতে কোনো-না-কোনও গ্রামে জনসাধারণের গরু থাকে না, মহিষ থাকে না, ছাগল থাকে না। কোঁয়া কোঁয়াকে মুল্লুকে আনার পর থেকে চারদিকে কিসের যেন এক আলামত শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাদশার কাছে গ্রামের মানুষজন এসে প্রতিকার চেয়ে কান্নাকাটি করছে। লোকজনের মুখে এমন কথা শুনে বাদশা ভাবতে শুরু করলো। অবশেষে ভাবনার কুল-কিনারা না পেয়ে স্মরণ করলো বন্ধু লোকমান হেকিমকে। বাদশার দরবারের উজিরকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো। বাদশা এমন মহাবিপদের কথা শুনে লোকমান হেকিম আর রাগ করে থাকতে পারলেন না। হেকিমের বাদশা ছুটে এলেন বন্ধু বাদশার মুল্লুকে। বাদশার সাথে দেখা করলেন। বাদশা বন্ধু লোকমান হেকিমকে বসতে দিলেন। লোকমান হেকিম বাদশার পাশে বসলেন। ক’দিন আগে সোনা বন হরিণ শিকারের ব্যাপারে বিস্তারিত খুলে বললেন। হরিণ শিকারে গিয়ে হরিণ না পেয়ে সাথে করে এক অসহায় মেয়েকে বন থেকে উদ্ধার করে মুল্লুকে এনেছেন, তা জানালেন। বিয়ে করে ঘরে রেখেছেন তাও জানালেন। এরপর থেকে মুল্লুকে বর্তমান পর্যন্ত মুল্লুকের পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। মুল্লুকের বর্তমান সংকটময় অবস্থার কথা জানিয়ে, কীভাবে কী করা যায়, বুদ্ধি চাইলেন।

লোকমান হেকিম বাদশার মুখে সব বিবরণ শুনলেন। শুনে হাসলেন। বন্ধু লোকমান হেকিমের হাসি দেখে বাদশা হাসির রহস্য জানতে চাইলেন। লোকমান হেকিম বাদশার কথা শুনে চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন বিয়ে করা স্ত্রী কোথায়? আপনার নতুন স্ত্রীর হাতে কি এক গ্লাস পানিও পান করতে পারবো না? নতুন স্ত্রীকে বলুন আমার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে। বন্ধু কথা শুনে নতুন স্ত্রীকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে অন্দর মহলে লোক পাঠালেন। লোক মারফত নতুন স্ত্রীর কাছে খবর যাওয়ার পর, নতুন রাণী এক গ্লাস পানি নিয়ে বাদশার দরবারে এলেন। কোঁয়া কোঁয়া পানি নিয়ে দরবারে এসে লোকমান হেকিমকে দেখে রাগে গোস্বায় একাকার হয়ে গেলেন। নতুন রাণী বললেন, ‘আমি কোনও পরপুরুষের সামনে আসি না, কথা বলি না। আর যেই লোক আপনার বন্ধু, অন্তত এই লোকের সাথে কিছুতেই আমি কথা বলবো না’। প্রিয় বন্ধুকে হঠাৎ ক্ষণিকের দেখায় এরকমভাবে বললো, আর কেন-ই-বা বললো, বাদশা এর কিছুই বুঝতে পারলেন না। এরপরও নতুন স্ত্রীকে বন্ধু লোকমান হেকিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলে, নতুন রাণীর মুখ ঘুরিয়ে মহলের ভেতরে চলে যায়।

নতুন রাণীর এমন অবস্থা দেখে বাদশা অবাক হয়ে বন্ধু লোকমান হেকিমকেই জিজ্ঞেস করছে, ‘এর ঘটনা কী?’ বাদশার এমন প্রশ্নে বন্ধু লোকমান হেকিম শুধু হাসতে লাগলো। বন্ধু লোকমান হেকিমের হাসি দেখে বাদশা রেগে-মেগে বললো, ‘হাসি বাদ দিয়ে বলুন ঘটনা কী?’ এবার লোকমান হেকিম বললো, বন্ধু ঘটনা তো অনেক কিছু! তা বলে কী আর শেষ করা যাবে? যাবে না বন্ধু! তবু্ও অন্তত কিছু তো বলতেই হয়! তাহলে শুনো! মেয়েটিকে মহলে এনে তুমি মারাত্মক ভুল করেছো বন্ধু। যেই ভুল তুমি করেছো, তার খেসারত তোমার মুল্লুকের সবাইকে দিতে হবে। এর কারণ হলো, এই মেয়েটি বন্ধু মানুষ নয়! মেয়েটি একটা রাক্ষস। এই রাক্ষসী মেয়েটি তোমাকে ঘুমে রেখে রাতের অন্ধকারে তোমার মহল থেকে বের হয়ে গ্রামের জনসাধারণের গরু, ছাগল, মহিষ-সহ যা পায়, তা-ই খেয়ে ফেলে। বন্ধু লোকমান হেকিমের মুখে এসব শুনে বাদশার এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। এসব বিষয় আসয় শুনে বাদশা ভয়ে কাঁপতে লাগলো। বাদশার অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধু লোকমান হেকিম এক পুরিয়া ঔষধ খাইয়ে দিলো। বাদশা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে বললো, এসব আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে এর প্রমাণ দেখাতে হবে।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘অবশ্যই প্রমাণ দেখবে বন্ধু’। আর হ্যাঁ, প্রমাণ দেখতে হলে তোমার কিছু কাজ করতে হবে। তা কি তুমি পারবে?’ বাদশা বললেন, ‘অবশ্যই পারবো। বলো আমাকে কী করতে হবে?’ লোকমান হেকিম বললো, ‘প্রথমত তোমার মহল অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত পানির উৎস বন্ধ করতে হবে। যেমন: ঘরে থাকা কলসিতে পানি থাকতে পারবে না। গোপনে পানির কলসি খালি করে রাখতে হবে। তা যেন তোমার নতুন রাণী না জানে। যদি তোমার মহলের ভেতরে পানির কল (জাঁতাকল) থেকে থাকে, তাও গোপনে উঠিয়ে ফেলতে হবে। মোটকথা তোমার মহলে যেন কোথাও কোনও পানি না থাকে। এসব তুমি কি করতে পারবে, বন্ধু?’ বাদশা সায় দিলেন, ‘পারবো। তারপর? লোকমান হেকিম বললো, ‘তারপর গভীর রাতে তুমি তোমার নতুন রাণীর কাছে এক গ্লাস পানি চাইবে। তুমি বলবে, আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। তখন দেখবে তোমার নতুন রাণী তোমাকে কোত্থেকে পানি এনে দেয়। তবে খবরদার! পানি যেখান থেকেই সংগ্রহ করুক-না-কেন, সেই পানি তুমি কিন্তু পান করো না। যদি ভুলবশত সেই পানি তুমি পান করো, তাহলে তোমার নির্ঘাত মৃত্য’। এই বুদ্ধি দিয়ে বন্ধু লোকমান হেকিম বাদশার মহল ত্যাগ করে নিজের গন্তব্যে চলে যায়। যাবার আগে বলে গিয়েছে, ‘আমি বন্ধু আগামীকাল আবার তোমাকে দেখতে আসবো’। বন্ধু লোকমান হেকিমের কথা শুনে বাদশা সেসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য মুহূর্তেই লোক লাগিয়ে দিলেন।

চলবে…

ক্যাম্বাচারদের মুখে শোনা লোকমান হেকিমের এক গল্প-২