অশোক বন্দনা
গত মার্চ মাসের ১৭ তারিখে বৃক্ষকথার কয়েকজন সদস্য মিলে আমরা গিয়েছিলাম ঢাকার মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ঘুরে ফিরে অনেকটা সময় ধরে আমরা চেনা অচেনা নানা ফুল আর গাছ দেখেছি, ছবি তুলেছি। ঐ সময়টা ছিল অশোক ফোটার সময়।

অল্পসংখ্যক উদ্ভিদ আছে যারা তাদের কাণ্ড ফুড়ে থেকে ডালপালা জুড়ে ফুল ফোটায়। তাছাড়া অশোকের প্রস্ফুটন কাল অতি দীর্ঘ বলে এই সময় গাছগুলি ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। বোটানিক্যাল গার্ডেনের দ্বিতীয় গেটটা পার হলেই শুরু হয় পথের দুই ধারে অশোকের সারি। ফুলে ফুলে ছেয়ে ছিল গাছগুলি। এমন দৃশ্য দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলে ছিলেন –





“রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।”

আমি দেখেছি রবীন্দ্রনাথের অনেক অনেক কবিতা ও গানে ঘুরে ফিরে এসেছে এই অশোকের কথা। সেসব থেকে কিছু কিছু অংশ আজ তুলে দিব এই লেখায়। তাছাড়া অশোকের সাথে হিন্দু ও বোদ্ধ ধর্মের সুগভীর সম্পর্ক আছে,তারও কিছু ছোঁয়া থাকবে। আর থাকবে আমার তোলা কিছু অশোকের ছবি।

বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত মিলিয়ে অশোক ফুলের অনেকগুলি নাম আছে, যেমন –
অপশোক, বিশোক, কঙ্গেলি, কর্ণপূরক, কেলিক, চিত্র, বিচিত্র, দোষহারী, নট, পল্লবদ্রুপ, প্রপল্লব, পিণ্ডিপুষ্প, বঞ্জুলদ্রুম, মধুপষ্প, রক্তপল্লবক, রাগীতরু, শোকনাশ, সুভগ, স্মরাধিবাস, হেমপুষ্প, হেমাপুষ্প, হিমাপুষ্পা, অঞ্জনপ্রিয়া, মধুপুষ্প, পিণ্ডিপুষ্পা, সিটা-অশোক ইত্যাদি।
অশোকের ইংরেজি নাম হচ্ছে – Ashoka, Sorrowless, Yellow Ashok, Yellow Saraca ইত্যাদি।
আর এর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে – Saraca indica

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে গৌরী দেবী এই বৃক্ষের নিচে তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করে শোক থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। সেই কারণে এই বৃক্ষের নাম অশোক হয়েছে। শুধু কি তাই! রোগ নিরাময়ে, ভেষজ গুণে,শীতল ছায়ায়,পুষ্প প্রাচুর্যের মত কারণেই অশোকের নামকরণ সার্থক।
রামায়ণে বলে সীতাকে অপহরণ করে অশোকবনে রাখা হয়ে ছিল।
হিন্দু ধর্ম মতে অশোকষষ্ঠী বলে একটি পূজা আছে। চৈত্র মাসের শুক্লা-ষষ্ঠীতে মায়েরা সন্তানের কল্যাণ কামনা করে অশোক ফুল দিয়ে অশোকষষ্ঠী পূজা করেন। তাছাড়া চৈত্র মাসের শুক্লা-অষ্টমীতে পালিত হয় অশোকাষ্টমী পূজা।

কামদেবের পঞ্চশরের অন্যতম শর এই অশোক ফুল দিয়ে সজ্জিত, তাই অশোক ফুল প্রেমের প্রতীক। হয়তো এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ অশোককে এতো বার হাজির করেছেন নিজের সৃষ্টিতে।
কথিত আছে গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনিতে অশোক গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং মহাবীর এই অশোক গাছের নিচে ধ্যান করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাই হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে এই অশোক গাছ ও ফুল অত্যন্ত পবিত্র।

অজস্র ফুলে ঘনবদ্ধ অশোকমঞ্জরি বর্ণ ও গড়নে আকর্ষণীয়। তাজা অশোক ফুলের রং কমলা, কিন্তু বাসি হলেই ফুলের রং হয় লাল। অশোকের পরাগকেশর দীর্ঘ।
রবীন্দ্রনাথ অশোক বন্দনার কিছু নমুনা রইলো –
১।
“আসত তারা কুঞ্জবনে চৈত্র জ্যোৎস্নারাতে
অশোক শাখা উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে।“

২।
“আকাশেতে উঠে আমি মেঘ হয়ে গেচি।
ফিরিব বাতাস বেয়ে রামধনু খুঁজি,
আলোর অশোক ফুল চুলে দেবো গুঁজি।”

৩।
“নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান,
একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।
সেই গান শুনি. কুসুমিত তরুতলে
তরুণতরুণী. তুলিল অশোক,
মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল,
এ আমাদেরই লোক।”

৪।
“দূর সাগরের পারের পবন, আসবে যখন কাছের কূলে
রঙিন আগুন জ্বালবে ফাগুন,মাতবে অশোক সোনার ফুলে।”
আজ এই টুকুই।