রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

তোমার জন্য

আমার ভাল লাগা-বিশ্বাস-কষ্ট-ধৈর্য, সব টুকুই
তোমাকেই দেবো, শুধু তোমাকেই দেবো আমি।
যে কষ্টেরা বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল
আমার দুচোখে, সেইটাও রেখে দেব এখানে,
তোমার আমার মাঝখানে।
ঝলমলে সকাল-মন কেমন করা দুপুর-
দুষ্টুমি মাখা বিকেল-গভীর ঘন রাত…।

পরিচয়ের বড় বেশি সীমাবদ্ধতা, বড় বেশী ক্ষুদ্রতা।

এই শেকলের বাঁধা গণ্ডী পেরিয়ে,
দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে,
তুমি নিয়ে যেও তোমার মনমহলে।
রোজ সন্ধ্যায় থাকো আমার সাথে, আমার ছাদে,
বৃষ্টি বা মেঘ সাথে ভোর নিয়ে…

আমাদের চোখের পাতায়, শুরু হোক অভিসার।

বৃষ্টি ভেজা

একদিন সব ঝড় থেমে যাবে
পাখিদের সুখের সংসারে আর
কোনো বাড়তি খড়কুটো থাকবে না।

একদিন সব যুদ্ধ থেমে যাবে
ছবিতে ছবিতে ভরে যাবে
তোমার পাহাড়ী বাড়ি
তোমার ছাদের বাগান পুকুরে
মাছের মহামিলন হবে।

একদিন মেঘে মেঘে বৃষ্টি নামবে,
সুর তুলবে তোমার উঠোনে,
জমা জলে ভাসবে কাগজের নৌকা।

একদিন সবকিছু শান্ত হবে।
সেদিনও আমি একা দাঁড়িয়ে থাকবো
পাহাড়ের মতো একা,
নির্জন দ্বীপের মতো একা।

একদিন বলেছিলাম দুজনে
বৃষ্টিতে ভিজবো হাত ধরে
এখন বৃষ্টি হলে ভিজে যায় বিশ্ব চরাচর।
একা আমি দূরে দাঁড়িয়ে
তাদের ভিজে যাওয়া দেখি।

আমার আর বৃষ্টি ভেজা হয় না।

_____________
রিয়া রিয়া চক্রবর্তী।

চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ৩

প্রিয় মেঘ,
আজকাল রাতে ঘুমোতে পারিনা জানিস। আগে ঘুম না এলে ছাদে চুপচাপ বসে থাকতাম, আজকাল আর রাতে ছাদে যাই না। মনে পড়ে যায় সমস্ত কথা, তোর সাথে রাতের বেলা ছাদে ঘুরতে ঘুরতে কতো কথা বলতাম! আমি গান শোনাতাম, তুই গান শোনাতিস। আমিই বেশি গাইতাম, তুই খুব লাজুক তাই কম গাইতিস। মনে আছে তোর? আমার বাড়ির কাছের যেসব রাস্তায় তুই এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতিস, এখন সেইসব রাস্তা দিয়ে আমি যাই না মেঘ। অনেকটা ঘুরে আমি আমার গন্তব্যে যাই। সেইসব রাস্তা এড়িয়ে চলি। জানিস মেঘ আজকাল প্রচণ্ড ডিপ্রেশন আমাকে ঘিরে ধরেছে। আজকাল আমি যখন তখন মেজাজ হারাই। হয়তো চাকরিটাও ছেড়ে দেবো। জানিনা শেষ পর্যন্ত শহরের কোন এসাইলামে আমার ঠাঁই হবে।

তুই আমার সেইরকম বন্ধু (!) ছিলিস, যে কিনা নিজের জীবন বাঁচতে, পরিবার বাঁচাতে অনায়াসে বন্ধুকে গুলি করে তার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। আর সেই বন্ধুকে যে কিনা তাকে ভালোবাসে! এই ক্ষেত্রে গুলি তুই করিস নি, তবে খুন করেছিস আমার সব ভালো থাকা গুলোকে, আমার সব আনন্দকে, আমার সব হাসিদের, আমার সব ইচ্ছেদের, আমার মনকে, আমার হৃদয়কে, আমাকে জীবন্ত লাশ করে দিয়ে গেছিস। সেদিন ছুরিটা আমার পিঠে নয়, সামনাসামনি এসে আমার বুকে বিঁধতে পারতিস। তোর সাহস দেখে খুশি হতাম। কিভাবে পারলি মেঘ এতোটা নিষ্ঠুর হতে? তোর মনে হয় নি, যে পাহাড় বহু আগে থেকেই ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে আছে, আর তাকে নাই বা ভাঙলাম। সত্যি মেঘ তুই হঠাৎই যতগুলো টুকরো করে দিয়ে গেলি, সেইসব টুকরো আবার জুড়ে উঠে দাঁড়াবার আর ক্ষমতা নেই রে।

তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আমি বড্ডো অভিমানী। ভুল বলেছিলাম মেঘ। অভিমান তাকেই মানায় যার মান ভাঙানোর কেউ থাকে। আমি একজন একা পড়ে থাকা পাহাড়। যার আশেপাশে কেউ নেই, হাত বাড়ালেও কোনো বন্ধু নেই তাকে কি অভিমান মানায় বল? আর কার ওপরে অভিমান করবো মেঘ? কেউ কি ছিলো আমার? কখনো ছিলো? একা চলা জীবন আমার, একাই চলেছি। চলতে চলতে মুখ থুবড়ে পড়েছি, আবার উঠে চলা শুরু করেছি। তুই বলেছিলি আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, তুই এতোটুকুও জানিস নি আমাকে, বুঝিস নি আমাকে। আমি নিজেকে সামলে নিতে পারি না রে, শুধু বাইরের খোলসটা মিথ্যে হাসি দিয়ে মুড়ে রাখি। ভেতরে ভেতরে একজন ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া পাহাড় আমি। যার শুধু কঙ্কালটুকুই আছে।

তুই বলেছিলি সাগর ভীষণ অভিমানী, বাড়ির ছোট তো তাই ভীষণ আদরে মানুষ হয়েছে। আমি মনে মনে সেদিন হেসেছিলাম। আমি যেভাবে আদর, যত্নে বড় হয়েছি, খুব কম বাচ্চাই সেইভাবে বড় হয়। একটা নরম ফুলের মতো করে আমি বড় হয়েছি। জানিস মেঘ, ছোটবেলাই ভীষণ ভালো ছিলো রে। এই বড় বেলার জীবন আমি চাইনি মেঘ। জানিস আমি আর বাঁচতে চাই না, বিশ্বাস কর। তুই বলেছিলি, সাগর ভাবে, ‘যেটা আমার, সেটা আমার, সেখানে অন্য কেউ হাত বাড়াবে কেন?’ বন্ধু হতে আর আমার জিনিস, তোমার জিনিস কী? বন্ধু তো আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়! আর তোকে শুধুমাত্র বন্ধু ভেবেছিলাম, অন্যকিছু নয়। তুই অন্য লোকের বাড়ানো হাত ধরিস কেন? কেন বলিস অন্য লোককে ভালোবাসি? সাগরের থেকে পারমিশন নিয়ে নিস ভবিষ্যতে আর কারো হাত ধরার আগে। তবে তোর সাগরকে তুই বলে দিস, মেঘকে পাহাড় কোনোদিন সাগরের থেকে কেড়ে নিতে চায় নি। কোনো দিন না। যেদিন তুই বললি, ‘সাগর পাহাড়ের সাথে ঝগড়া করতে চায়’ – সেদিন অবাক হয়েছিলাম। একজন অচেনা, অজানা মানুষের সাথে সে আলোচনা না করে ঝগড়া করবে! ওর জায়গায় আমি হলে, তিনজনে মিলে আলোচনা করতাম। হয়তো তিনজনেই ভালো বন্ধু হয়ে যেতাম। মনটা উদার করা শিখতে হয় মেঘ।

মেঘ, পাহাড় কি তোর খেলার পুতুল ছিলো? যখন ইচ্ছে খেললি আর ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেলে দিলি? মিনিমাম সম্মানটুকুও পাহাড়কে দিলি না? সাগরের কাছে পাহাড়কে এইভাবে ছোট করলি? কেন মেঘ? কোন অপরাধে? তোকে ভালোবাসা কি অপরাধ ছিলো? জানিস, সব ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য আমাকে পেছন থেকে আটকে রাখে। তবে যেদিন আমার দায়িত্ব শেষ হবে, সেদিন হয় আমি নিজেকে শেষ করে দেবো, না হলে দূরে কোথাও চলে যাবো। সব ছেড়ে দিয়ে আমার কষ্টগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো, কারণ আর তো কেউ আমার সাথে থাকতে চায় নি। আমার দুঃখ, আমার কষ্ট এরা ভীষণ আপন। কখনও আমার হাত ছেড়ে দেয় নি। তাই এদের সাথে নিয়ে যাবো। এমন এক জায়গায় যাবো, যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না, কেউ জানবে না। কাউকে বলে যাবো না। হয়তো সেখানে কোনো একটা ছোট্ট ঘরে আমি থাকবো। একা একা, নিজের সাথে থাকবো। আর যখন আমার জীবনের শেষ সময় আসবে, স্থানীয় লোকজনকে বলে যাবো, আমার মৃত্যুর পরে আমার দেহ আগুনে জ্বালিয়েও দিতে পারো, কিংবা মাটির নীচে পুঁতেও দিতে পারো। তবে পুঁতে দিলে সেখানে একটা ছোট্ট চারাগাছ লাগিয়ে দিও। যাতে আমি ফুরিয়ে যেতে যেতেও আমার ভালোবাসা দিয়ে একটা গাছকে সবুজ করে যেতে পারি, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাকে দিয়ে যেতে পারি। কারণ আমি যে শুধু ভালোবাসতেই পারি, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তোকেও এমন করেই ভালোবেসেছিলাম।

আর যদি আমার সেই লাওয়ারিশ লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেয় তাহলে,
ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম –
এই পঞ্চভূতে মিশে যাক
আমার অভিশপ্ত জীবন।

ইতি
একলা পাহাড়।

চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১
চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ২

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ২

প্রিয় মেঘ,
এই প্রিয় কথাটা লিখতে গেলেই মনে প্রিয়া নামটা চলে আসে। কে যেন পাহাড়কে ভালোবেসে(!) প্রিয়া ডাকতো। আর পাহাড় হেসে কুটোপাটি যেতো। আচ্ছা মেঘ তোর ওই দুই বন্ধুর গল্পটা মনে আছে? ওই যে রে একটা বনের ভেতর দিয়ে দুই বন্ধু যাচ্ছিলো, আর হঠাৎই একটা ভাল্লুক পথ আটকায়। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি গাছে উঠে যায়। নিজে বাঁচার জন্য। আর অপর বন্ধুকে রেখে যায় মৃত্যুর মুখে। এরাও বন্ধু ছিলো আর তুইও বন্ধু(!) ছিলিস। কি মিল না? আজ আর বন্ধু শব্দটার আর কোনো ওজন নেই আমার কাছে। এই শব্দে আমি ক্ষতবিক্ষত। ভীষণভাবে রক্তাক্ত। ভীষণভাবে অপমানিত। এই শব্দ আজ আমার কাছে অর্থহীন। আমার কাছে ভীষণ অপমানের আর এক নাম বন্ধু।

আমার ভাঙনের সব কথাই তো তুই জানতিস মেঘ। তবে কি করুণা করেছিলি? না কি ভেবেছিলি একটা ভেঙে যাওয়া পাহাড়কে নিয়ে কিছুদিন খেলা যাক। কি তাই ভেবেছিলি? তোকে তো আমি বন্ধুর জায়গা দিয়েছিলাম মেঘ। আমার প্রেমিকার জায়গাও নয়। বন্ধুর স্থান প্রেমিকার থেকে অনেক ওপরে, অন্তত আমার চোখে। হৃদয়ের সেই আসনে তোকে বসিয়েছিলাম, যেখানে আমি কোনোদিন কাউকে বসাই নি। বন্ধুত্বের থেকে কিছুটা বেশিই ছিলো আমাদের সম্পর্ক। এইভাবে পালিয়ে গেলি? সমস্ত জায়গা থেকে আমাকে মুছে দিয়ে পালিয়ে গেলি? কি ভেবেছিলি সেইসব জায়গায় আমি তোকে খুঁজে বেড়াবো? আমি তোকে ডাকবো ? না রে মেঘ, তুই যতটা নীচে নামতে পেরেছিস, অতটা নীচে আমি নামতে পারবো না। আমার রক্ত, পারিবারিক শিক্ষা অনেক বেশি উন্নত। আমি অন্তত কাপুরুষ নই। আমি তো তোর বাড়িই চিনতাম মেঘ, হাত বাড়ালেই তোর বাড়ি। কিন্তু তোকে ধরার কোনো চেষ্টাই আমি করিনি। যেতে চেয়েছিস চিরতরে চলে যেতে দিয়েছি। হাত গুটিয়ে নিয়েছি। নিজের চোখে নিজে ছোট হয়ে গেছি এই ভেবে, যে জীবনে প্রথমবার আমি বন্ধু নির্বাচন করলাম, তাও এইরকম! যে বন্ধু শব্দের অর্থই বোঝে না!

সাগর, তোর প্রেমিক, তোর সর্বস্ব, যাকে তুই ভীষণ ভালোবাসিস। তোর কথা অনুযায়ী, সে আমার আর তোর বন্ধুত্বের কথা জেনে প্রলয় নৃত্য করেছে। জানিস মেঘ, সাগরের জায়গায় যদি আমি হতাম, যদি জানতাম মেঘ আর পাহাড়ের বন্ধুত্বের কথা, আমি কোনোদিন প্রলয় ঝড় বইয়ে দিতাম না। কারণ, আমার বিশ্বাস, আমার ভালোবাসা মেঘের ওপর অনেক বেশি। আমি কথা বলতাম আর মেঘের বন্ধু বলে পাহাড়ের দিকে আমিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতাম। সাগর আর মেঘের সম্পর্ক অনেক পুরোনো, আর পাহাড় আর মেঘের সম্পর্ক কিছুদিনের। তাই ভালোবাসার থেকে বিশ্বাস থাকে অনেক বেশি, আর সেই বিশ্বাসের ওপরে আস্থা রেখেই আমি সাগর হলে পাহাড়ের বন্ধু হতাম। কারণ জানতাম মেঘের বন্ধু নির্বাচন ভুল হবে না।

মনে আছে মেঘ, তোর আর সাগরের একসাথে একটা ছবি আমাকে দেখিয়েছিলি। আমি বলেছিলাম, মেঘ তোর সাগর তো ভীষণ সুন্দর! আমি মেয়ে হলে নির্ঘাত তোর সাগরের সাথে প্রেম করতাম। তুই মিথ্যে রেগে বলেছিলি, আমিই প্রেম করতে দিতাম না, সাগর আমার। আমি বলেছিলাম, তোদের ভীষণ মানায়, তোরা মেড ফর ইচ আদার। তুই হেসে বলেছিলি, তোর জীবনে সাগরই সব। ও একটু অসুস্থ হলে তুই পাগলের মতো হয়ে যাস। আমি তো তোর সাগরকেও ভালোবাসতাম মেঘ। তোর দুই শাখা নদীর সঙ্গে। তোকে বলেছিলাম, তোর সাগরের সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই মেঘ, সাগর কি আমার বন্ধু হবে? তুই, আমি, সাগর ভীষন ভালো বন্ধু হবো। হলো না মেঘ, আমার কোনো চাওয়া কোনোদিন পূরণ হয় নি।

তোর ওপরে একমাত্র সাগরের অধিকার মেঘ। আমি কোনোদিন তোকে অধিকার করতেই চাই নি। কারণ বন্ধুত্বে অধিকার মানায় না। আমি তো তোর পাশে হাঁটতে চেয়েছিলাম, তোর সাথে কিন্তু কখনো হাঁটতে চাই নি। তোর সাথে তো হাঁটবে সাগর। খুব বেশি কি চাওয়া ছিলো মেঘ? ভালোবাসা অনেক রকমের হয়, বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসা এক রকম, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এক রকম। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা এক রকম, আবার বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা এক রকম। আমি তো সেই বন্ধুর ভালোবাসাটুকুই চেয়েছিলাম মেঘ। সেটা কি একেবারে অমূলক চাওয়া ছিলো? আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না মেঘ? আমি কি সত্যিই অপমানের যোগ্য মেঘ? তবে আমার বন্ধুত্ব খাঁটি ছিলো, তোর কাছে গল্প শুনে আমি সাগরকেও ভালোবেসেছিলাম, আর তোর দুই শাখা নদীকেও ভালোবাসি মেঘ।

বড্ডো ছোট করে দিলি তুই আমার চোখে আমাকে। বড্ডো অপমান করলি মেঘ। যদি এক মুহূর্তের জন্য আমাকে ভালোবাসতিস, তাহলে এইভাবে অপমান করতে পারতিস না। তবে তুই যেভাবে সমস্ত রাস্তা মুছে দিয়ে পালিয়ে গেলি, এতে এটাই বোঝা যায়, অন্যান্যদের মতো এটা তোর কাছে শুধুই খেলা ছিলো। কি খেলা মেঘ? কি অদ্ভূত না, তুইও বাকিদের মতোই ছিলি, তোকে তো আমি আলাদা ভেবেছিলাম। জেনেছিলাম তোর বাবার শিক্ষায় তুই বড় হয়েছিস, ওই মানুষটার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আমার। তুই তার শিক্ষার কি প্রতিদান দিলি ? এইভাবে কাপুরুষতা কি তোকে মানায়? আমি তোকে বিশ্বাস করতাম, অনেক বিশ্বাস করতাম। তোর সব কথাই বিশ্বাস করতাম। আমি তো তোর কথা শুনে সাগরকেও অত্যন্ত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনষ্ক ভেবেছিলাম, সেও যে বন্ধুত্বের মানে বুঝবে না,এটা ভাবিই নি কখনো। কতখানি ভুল ভেবেছিলাম না আমি?

জানিস মেঘ, অনেক প্রাচুর্যের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। টাকা,পয়সা, গাড়ি বাড়ি আমার কাছে অর্থহীন। বিশ্বাস, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এই সবের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি ছিলো। আর সবথেকে যেটা বেশি ছিলো একে অপরের প্রতি সম্মান। তোর প্রতি সম্মান মিশ্রিত ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু তুই সামান্য সম্মানটুকুও আমাকে দিতে পারলি না? এইভাবে বন্ধু – বন্ধু খেলা কি তোর নেশা ? এইভাবে কতো পাহাড়কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিস ?

যেদিন তুই বললি চলে যেতে চাস, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি মেঘ। হঠাৎ করেই এতো জোড়ে ধাক্কা দিলি তো তাই সামলে উঠতে পারিনি। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো, গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম। তারপর যখন জ্ঞান এলো জানলাম ডান হাতের কনুই এর হাড় ডিসলোকেটেড। এক্সরে তে হাড়ে একটা ফাটল দেখা দিলো। সারা জীবনের জন্য একটা যন্ত্রণা উপহার দিয়ে গেলি। ওই হাতেই অনেক বছর আগে এক প্রচণ্ড আঘাতে সমস্ত টিসু ছিঁড়ে গিয়েছিল, ছোট ছোট টিউমার হয়ে আছে, আর সেই হাতেই তোর দেওয়া উপহার। রঙ তুলি আর কোনোদিন ধরতে পারবো না, হাত আর সাথ দেবে না। তোকে চিঠি লিখতেও বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে।

শুধু শুধু বেঁচে আছি আমি মেঘ। একটা জীবন্ত লাশ হয়ে। যে স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়, যার ভেতরে নতুন কোনো ইচ্ছে, অনুভূতির জন্ম হয় না। যার আর কোনো চাওয়া নেই, পাওয়ায় ও আর কিছু নেই। অপমানটুকুও তুই পূরণ করে দিয়ে গেলি। আমি কোনো ভুল করিনি, আমি পালিয়ে বেড়াই নি, মাথা উঁচু করে চলেছি চিরকাল। শিরদাঁড়া ভীষণ সোজা। আপোষ করি না কোনো কিছুর সাথে। কিন্তু তুই তো আমার কোমরটাই ভেঙে দিয়ে গেলি মেঘ। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিই যে হারিয়ে ফেলেছি। আমি জানি মেঘ তোর মনের কোথাও আমি নেই। খেলার সামগ্রী মনে রাখতে নেই।

সাগরের সাথে ভালো থাকিস মেঘ। আর পাহাড় তো চিরকাল নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, যে বার বার ভেঙে যায়, কতো টুকরো যে হয়েছে পাহাড় আজ নিজেও গুনে উঠতে পারে না। পাহাড় চিরকাল একা থেকেছে, যতদিন বাঁচবে একাই থাকবে। প্রেম তো দূরের কথা, বন্ধু হিসেবেই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। পাহাড়ের কান্নায় যদি ভালো থাকতে পারিস তাহলে ভালো থাকিস মেঘ। ভালোবাসা তো নয়ই, আজ আমার ঘৃণাও তোকে দিতে পারলাম না মেঘ। ঘৃণা দিতে গেলেও তোকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটাও আর আমি তোকে দিতে চাই না। একটা কাপুরুষের জীবন নিয়ে বেঁচে থাক তুই।

ইতি
একলা পাহাড়।

চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১
_________
রিয়া চক্রবর্তী।

চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১

প্রিয় মেঘ,
জানতে চাইবো না কেমন আছিস, জানি ভালো থাকবি, ভালো থাকার জন্যই তো পাহাড়ের থেকে দূরে চলে গেলি। জানি আমাকে মনেও পড়বে না তোর। মনে পড়ার কথাও নয়। খেলাধুলার সময় গুলো কি মনে রাখে? রাখে না। কতো মনে রাখা যায়! মনে আছে একটা কবিতা শুনিয়েছিলাম একদিন, অনেক কবিতা ছিলো শুধু তোর জন্য লেখা। তারমধ্যে একটা এইরকম ছিলো, দেখতো চিনতে পারিস কিনা –

‘কিছুদিন পরে জানি আর মনে থাকবে না আমাকে …
এই বিকেলের আলো, এই গোধূলি বেলা, গভীর রাতের কথা, গানের সুর। কিছুই মনে থাকবে না। এই রাত, তারাদের সাথে চলা পথ, চাঁদের আলো, ভালোলাগা সবই ক্ষণস্থায়ী। একা থেকে যাবো আমি, এই হাসি, খেলা, ভোরের শিশির, বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে যাবে। আমার রঙহীন স্বপ্ন গুলো নিয়ে থেকে যাবো।’

কবিতাটার আরও কিছু অংশ আছে, সেগুলো আর দিলাম না। এই কবিতা শুনে তুই কি ভীষণ রেগে গিয়েছিলি! মনে আছে?

এতো সুন্দর অভিনয় তুই কোথা থেকে শিখেছিলি মেঘ? একজন ভেঙে যাওয়া পাহাড়কে আরও ভাঙতে তোর কি বুক কেঁপে ওঠেনি? আমাকে এইভাবে টুকরো টুকরো করে তুই সত্যিই কি সুখের প্রাসাদ গড়তে পারবি? হয়তো পারবি, একটা পাহাড়ের ভেঙে যাওয়ায় মেঘে কি যায় আসে! জানিস মেঘ আমার কাছে আজ, বন্ধু, ভালোবাসা শব্দ অর্থহীন, ভীষণ ভয়ের, ভীষণ ক্লিশে। আমার বন্ধুত্বের হাত কেন ধরেছিলি মেঘ? কেন বলেছিলি ‘ভালোবাসি’? এতো মিথ্যে খেলা তুই কেন খেলেছিলি মেঘ? শুধুই কি সময় কাটানোর জন্য? আর আমি দেখ কি বোকা, ভাবলাম এই নিঃসঙ্গ পাহাড়কে সত্যিই বুঝি তুই ভালোবাসিস!

জানিস মেঘ, আমার প্রতিদিনের ভেসে বেড়াবার জায়গা গুলো, ওই যে রে যেখানে আমরা হাত ধরে মাঝেমধ্যে যেতাম, সেই স্ট্যাচুর পাশে কতো খেলা, আজ যখন সেইসব জায়গা যখন চোখের সামনে আসে, চোখ বন্ধ করে নিই। জানিস তো, শত শত ঝরনা পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে, সেগুলো আসলে পাহাড়ের কান্না। জানিস, সেদিন যখন সেই বড় মাঠটার আমার চোখের সামনে এসে গিয়েছিল, সেই মাঠ যেখানে একদিন রাতে মেঘ আর পাহাড় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছিল, চিনতে পেরেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছি। আমি চাই না আবার একটা ঝরনার সৃষ্টি হোক।

তোকে সত্যি বন্ধু ভেবেছিলাম মেঘ, উজাড় করে সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এতোটুকু অভিনয় ছিলো না, এতোটুকু ছলনা ছিলো না। বিশ্বাস ছিলো অনেক বেশি। নিজের থেকেও বেশি তোর প্রতি বিশ্বাস ছিলো। আমি জানতাম একদিন প্রবল ঝড় উঠবে। বেসামাল হয়ে পড়বি তুই। কিন্তু মেঘ, তবুও অগাধ বিশ্বাস ছিলো হাতটুকু তুই ধরে থাকবি। পারলি না মেঘ!

যেদিন ভয়ংকর ঝড় উঠলো, তুই চলে গেলি, আর বন্ধ করে দিয়ে গেলি আমার শ্বাস প্রশ্বাসের সব জায়গা। সব দরজাগুলো বন্ধ করে, দম বন্ধ অবস্থায় রেখে গেলি আমাকে। তোর একবারও মনে হয় নি পাহাড় বাঁচবে কিভাবে? সত্যিই কি তুই আমার বন্ধু ছিলি? বন্ধু তো এইভাবে হাত ছেড়ে বন্ধুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না মেঘ। বন্ধু হলে বলতিস অপেক্ষায় থাকিস পাহাড় আমি ঝড় শান্ত হলে আবার তোর কাছে ফিরবো। আবার আমরা একসাথে গান গাইবো, বৃষ্টির রাতে কবিতা শোনাবো, আবার আমরা খেলবো, ঘুরবো।

জানিস মেঘ, আমি এখন আর বৃষ্টি ভিজি না। অথচ তুই জানতিস বৃষ্টিতে ভিজতে আমি কতো ভালোবাসি। তোকে বলেছিলাম, আমরা একসাথে বৃষ্টি ভিজবো। বৃষ্টি হলে সেইসব কথা মনে পড়ে যায়। আমার আর ভেজা হয় না। তুই তো পালিয়ে গেলি মেঘ! চোরের মতো পালিয়ে গেলি। ভাবলি তোকে আমি আর ধরতে পারবো না? কিন্তু আমি হাত বাড়ালেই তোকে ছুঁতে পারতাম মেঘ। কিন্তু আমি তা চাই নি। আমার অহংকার, আমার আত্মসম্মান আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে।

জানিস, তোকে নিয়ে যে ‘প্রেমের কবিতা’ আমি লিখেছিলাম! সেইসব পাতা একটা একটা করে ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছি। আমার ভালোবাসার চিতা সাজিয়েছি। সেইসব কবিতার বুকফাটা কান্না আমি শুনেছি মেঘ। তোর আর আমার সেই গাছ তলায় বসা যে ছবি এঁকেছিলাম! সেই ক্যানভাসও পুড়িয়ে দিয়েছি। আর একটু একটু করে টুকরো করেছি নিজেকে। কি অপরাধ ছিলো আমার মেঘ? নিঃস্বার্থভাবে, নিঃশর্তভাবে ভালোবাসলে বুঝি এইভাবে অপমান করতে হয়? তোকে আমি বলেছিলাম মেঘ, পাহাড়কে ভালোবাসা যায় না। আমার জন্য ভালোবাসা নয়। কপট রাগ দেখিয়ে তুই বলেছিলি যায়। আমার সব ছিলো মেঘ, ভালোবাসা ছাড়া, আর এটাই তোর কাছে চাওয়া ছিলো। বলেছিলাম ভালোবাসাটুকু দিস, আমার আর কিছুই চাই না। এটুকুই পারলি না মেঘ? খুব বেশি কি চাওয়া ছিলো?

এখন জানি মেঘ ভেসে বেড়ানোই তোর কাজ। এপাড়া, ওপাড়া, এবাড়ি, ওবাড়ি। আমি আরও অহংকারী হয়েছি মেঘ। কেন জানিস, আমার ভালোবাসাই ছিলো আমার অহংকার। যেখানে কোনো অভিনয় ছিলো না, কোনো মিথ্যাচার ছিলো না। তোকে ভালোবাসার থেকেও অনেক বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। আর এটাই আমার গর্ব যে আমি তো বিশ্বাস করেছিলাম। তুই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিস নি, এটা তোর শিক্ষা। তাই আমি পালিয়ে বেড়াই না মেঘ। আজও আমি মাথা উঁচু করে অহংকারের সাথে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে তোর থেকে আলাদা করে আমাকে রেখে গেছিস। তোর গাওয়া গানগুলো আমার কাছে আছে। তোর কথারা আমার কাছে আছে। শুনি তাদের মাঝেমধ্যে। ইচ্ছে হলে। আর এই নিঃসঙ্গ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যায় নতুন নতুন ঝর্ণা।

আমার ভালোবাসার চিতার ওপরে তোর সুখের প্রাসাদ নিয়ে ভালো থাকিস তুই। তবে সারা জীবনের জন্য আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছিস – সত্যিই ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। সবকিছুই মিথ্যে, অভিনয় মাত্র। বন্ধুত্বের হাত গুটিয়ে নিয়েছি মেঘ। এ হাত আর কারো দিকে এগোবে না। আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না এই পাহাড়।

তোকে একটা কথা বলতাম মনে আছে? রক্ত কথা বলে। আজ তোর রক্ত তুই চিনিয়ে দিয়ে গেলি। হয়তো তোর পরিবারের শিক্ষা যে এইভাবে বন্ধুকে অপমান করেই চলে যেতে হয়। বন্ধুত্বের কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়তো তোর রক্তে নেই। আমি আমার রক্ত নিয়েও অহংকারী। শেষ দিনেও আমি তোকে কোনো কথা না বলেই হাতের মুঠি আলগা করে চলে যেতে দিয়েছি। আর এখানেও আমি অহংকারী।

পাহাড়, মেঘ কখনোই বন্ধু হতে পারে না। আমি জানতাম একদিন আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হতোই। কিন্তু এভাবে চাই নি। কিন্তু যদি সত্যিই বন্ধু হতিস কোনোভাবেই আমাকে ভেঙে যেতে দিতিস না। যদি সত্যি বন্ধুত্ব থাকতো তাহলে তা কোনো ঝড়েই পালিয়ে যেতিস না। চিরস্থায়ী হতো আমাদের বন্ধুত্ব।

আমার কোনো ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস নেই। তুই তোর ঈশ্বরকে বল কোনোদিন যেন এই শুকনো, খটখটে পাহাড়কে মেঘের মুখোমুখি হতে না হয়। পাহাড়ের আর ভাঙার ক্ষমতা নেই। সেই পাহাড় আর বেঁচে নেই।

ইতি
একলা পাহাড়।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

মনের তুমি

আজকাল আমি বড় বেশি অস্থির হয়ে উঠি,
যদিও এখন আমার আরো বেশি চুপচাপ ধীরস্থির থাকার কথা।
তবে কি নিজের অজান্তেই ? একটু একটু করে বদলে যাচ্ছি রোজ?
অবশ্য আজকাল সবকিছুতেই এক ভালোলাগা মিশে থাকে।

আমি রোজই আমার ঘরের প্রতিটি কোণের সাথে কথা বলি,
দূরের ওই আমগাছটাকে রোজ ঝাঁকড়া নিমগাছের গল্প বলি,
ছাদের কার্নিশে বসে থাকা পায়রাদের আমার গল্প বলি –
আর আকাশভরা তারাদের মাঝে নিজেকে হারাই।

অদ্ভুত ভাললাগায় মন ভোরে ওঠে
হালকা একটা হাসি খেলে যায় ঠোঁটের পাশে।
আজকাল সময় আমাকে তুমি ছুঁয়ে থাকো,
তাই মনে হয় কাল-আজ-কাল নিয়ে
তল খোঁজ ডুবুরির মতো সময় ভাবায়।

ডুবে থাকি তোমাতেই বিশ্বাসে-ভালোবেসে
ঠিক কি পেয়েছি, কি পাইনি, কি যে চেয়েছি, কি চাইনি-
কোন পথে মাঝপথ কাঁটাগুলো শেষ।
আজ কেন মনে হয় সামনের কোন পথের বাঁক পেরলেই,
সেই মেঠো পথের সেই আলপথ যারা
কবে থেকে পথ চেয়ে বসে আছে,
যে পথের মাঠে বাজে বাঁশী, মন কেমন করা সুর।

জানিনা আমার সেইখানে যাওয়া হবে কি না,
আলোটা যদি নিভে যায় সে বাঁকের কোনফাঁকে?
যদি দিকভুল করে ফেলি আমি?
যদি কোথাও হোঁচট খেয়ে হৃদয় চিরে যায়?
যদি আমার আর যাওয়া না হয় সেই স্বর্গপুরিতে? মন?
রাত ফিরে আসে আমার এই চিলতে ঘরটায়।

পাশের বাড়িতে রেডিওয় গান “তুম বিন জাউ কাঁহা” লতাজি গাইছেন।
আমারও তো ওই একই কথা মন,
তাঁকে ছাড়া আমি যে কিছুই ভাবতেই পারি না।
গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় ভালোবাসার রং।

বৃষ্টি রাতের কথারা

বৃষ্টি রাতের কথারা

বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু। আজও আমি বৃষ্টি ভিজি আজও আমি বৃষ্টি দিনে হারিয়ে যাই আমার রূপকথার দিনগুলোতে। টিপটিপ বৃষ্টি সারাদিন। বৃষ্টি হয়ে যাবার পর, মন চলে যায় ছোটবেলার বৃষ্টি রাতের সময়ে। সে সব রাত, যখন টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোর চারিপাশে, বাদল পোকারা উড়ে বেড়াত রূপকথার গল্প নিয়ে। আবার যখন জোনাকির ডানায়, বয়ে আনা আলো জানলার বাইরে একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করতো। তখন ঝিঁঝিঁর সুরে ভেসে আসত ঘুম।

বৃষ্টি হয়ে যাবার পর, মন চলে যায় বৃষ্টির রাতের দিনে। যখন অবহেলার আটপৌরে দিনগুলোতে পোষা বেড়ালের মতো ওম পোহাতাম, চাঁদের আলোয় জানলার পাশের কাঁঠাল গাছটার নীচে, নেমে আসত ‘ব্ল্যাক বিউটি’। আর আমি তার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম তেপান্তরের মাঠগুলোতে। তারপর একসময় কোন এক গাছের কোটরে নেমে আসতো নরম ঘুম।

বৃষ্টি হয়ে যাবার পর, মন চলে যায় বৃষ্টির রাতের দিনে।
যখন কুচি কুচি বৃষ্টি কনা নিয়ে হাওয়ারা উড়ে যেত ঢেউ ভেঙ্গে মনের আনাচে কানাচে। রাতভাসি তারারা সিরসিরে সুর নিয়ে যেতো রাতপরীদের দেশে। ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীরা ডানায় বয়ে আনতো পরী ছানাদের। তাদের সাথে খেলতে খেলতে, পালকের ওমে নেমে আসতো আদুরে ঘুম।

কালবেলা

গতকাল অনেক রাত অবধি বসে ছিলাম একা চুপচাপ।
আজকাল মাঝে মাঝেই কুয়াশা এসে
ঢেকে দিচ্ছে মনের আকাশ।
কাল রাতে কিন্তু চাঁদের আলোয় ভাসেনি আমার ঘর।
বসে বসে আঙুলে কর গুনি নামতা পড়ার মতো, জ্যোতিষীর মতো রেখা চিনি, আর বাকি যা কিছু আনাগোনা করে মনে মনে, সব, সব নিয়েই
অপেক্ষা অপেক্ষা আর শুধুই অপেক্ষা।

চলে সময়ের সাথে প্রতিটা ক্ষণে আমার তর্ক-দ্বন্দ্ব।
মাঝে মাঝে এমন রাতও আসে, যখন আকাশে একলা চাঁদের পাশে লক্ষ কোটি চাঁদ জ্বলে ওঠে, আর।
হিমেল হাওয়ায় আঁকা হয় আমার রাজপথ।
আমি শুধুমাত্র আমাকেই দিয়েছি,
আমার ন্যায্য দাবী রাখার।

মন আমার

মন আমার

একটু একটু করে বদলে যাচ্ছি রোজ,
এক পা এক পা করে,
গুটিয়ে নিচ্ছি নিজেকে।
তবু কিছু মন উড়ে যায় হাওয়ায়
বাকি মন পরে থাকে অবহেলায়।
একটু করে বদলে যাচ্ছি রোজ।

মন খারাপটা যখন তখন আসে,
আমি চাইনা, তবু কিন্তু আসে,
এক রত্তি এইটুকুন হয়ে,
আঁজলা পেতে নেয় চোখের জল।

স্বপ্ন কথা, না-বলাই ছিল,
এবং আজো আছে।
অভিমানের গন্ধ ভেজা সুরে
আধো সুরে বলবো কানে কানে
লবণ জলে চোখ ধুয়েছি,
চোখের পাতা ভেজাই না’হয় থাক।

ভুলে থাকা মন … ২১ (চিঠি)

প্রিয় মন। আজ অনেকদিন পর ভীষণ একা লাগছে। যদিও চিরকালই আমি একা, তবু তুই তো ছিলিস কিছুক্ষণের জন্য হলেও। এখন আমি নেট-এ ভবঘুরের মতন ঘুরছি আর পাশে গান চলছে, গান আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ওই যে গানটা “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা”
…. .বাজছে এখন….রোজই শুনি …

মনটা আজ কেমন কেমন যেনো। হঠাৎ করে ইচ্ছে হল একটা চিঠি লিখতে। জানিসই তো চিঠি আজও আমার ভীষণ পছন্দের। এই SMS এর যুগেও। একটা মন কেমন করা ব্যপার আছে চিঠিতে। কিন্তু কি লিখি? হুম.. বলতো? ঠিক কি লিখি তোকে?

যে কথা কাউকে বলা হয়নি। যে কথা তোকেও বলা হয়নি। যা থাকে মনের গভীরের সব থেকে সুরক্ষিত কুঠুরিতে লুকনো সবার চোখের আড়ালে। সে সব কথা? শুনবি? না রে,থাক। সেগুলো আমার বড্ডো আপন কথা। যেগুলো এতদিন জেনেছিস, সেগুলো আমার পাড়ার সবাই জানতো। আশেপাশের বাড়ির, আমার ছোটবেলার বন্ধুরা, আমার আত্মীয়স্বজন সব্বাই। তুই নতুন জেনেছিস। আর আমার ভীষণ আপন কথা আমারই থাক।

হাসছিস বুঝি? ভাবছিস মেয়েটা বড্ডো বাজে বকে? ভাবছিস মেয়েটা বড্ডো গায়ে পড়া তো? মিনিমাম personality টুকুও নেই? তা হাস!! জানিস তো, “smiling is good for health”

কি জানিস, আমার যে এখন বড্ডো কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানিস এখন আমি ভীষণ শান্ত হয়ে গেছি, আর কোন দুষ্টুমি করি না। জানিস আজও আমি যত কথা নিজের সাথেই বলি। তবুও কিছু কথা তো তোর সাথেও বলতাম। যদিও জানি আর তোর কাছে পৌঁছোবে না আমার কোন চিঠি। আমাকে আমি চিনি। মরে যাবো তবুও তোকে আর কিছুই বলবো না। তবুও কত পাগলামী দেখ আমার মধ্যে, তবুও তোকেই রোজ একটা করে চিঠি লিখি, তারপর পুড়িয়ে ফেলি। যেন নিজের চিতা জ্বলতে দেখি সেই চিঠির সাথে। কতজনের এই সৌভাগ্য হয় বল? সেই অর্থে আমি বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। নিজের চিতা নিজেই জ্বালাই।

সবকিছু সামলাতে সামলাতে বড় ক্লান্ত, বড় একা। বোললে হয়ত তোকেই বলা যেত সবটুকু। জানি তুইও এখন অন্য কোথাও একা। কেন জানিনা বসন্তের এই মিঠে গন্ধমাখা হাওয়ায় তোর খবর পেয়ে যাই ছাদের কোনা ঘঁষে দাঁড়ালেই। তোর-আমার দিনগুলো এখন অন্য কারোর, অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিস হয়তো। ক্রমশঃ সরছি দূর থেকে দূরে। কতদিন হয়ে গেছে তোর কথা শুনিনি। কত গল্প জমে যাচ্ছে জানিস? কত কত সময় মনে মনে খুঁজি তোকে। বড় অসহায় লাগে। দূরে সরে গিয়েও অবলম্বন হয়ে আছিস তুই।

হয়তো বিশ্বাস করবি না, তোকেই শুধুমাত্র, হ্যাঁ তোকেই আমি আমার সবটুকু দিয়েছি। আর আজও আমার সবটা জুড়েই শুধুই তুই। তোকেই দেবো আমার যত ভাললাগা, মন্দলাগা। সেই কবেকার গ্রীষ্মের দুপুরের কুলপিমালাই আর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মায়ের চোখ এড়িয়ে জমা জলে ভাসানো কাগজের নৌকোটাও তোর জন্যেই রেখে দিলাম। হাসি-কান্না-হীরে-পান্নায় মোড়া আমার দিনগুলো আজ থেকে শুধু একলা আমার নয় তোর সাথেও ভাগ করে নিলাম।

যত কথা তোর সাথে আমারই, আর কেউ জানবেনা সত্যি। টেলিপ্যাথি হোক নাহয় চুপিচুপি, ফিসফাস আবডালে, মনে মনে হরদম। এইখানে আছি আমি। সেই যে যেখানে একা রেখে গেছিস। সেখানেই আছি আজও। আর তুই! তুই? শুধু জল-ছায়াতে। খুব ভালো থেকে যাব আমি, শুধু তুই ভালো থাক। ভালো থাক তোর ঘর-বাড়ি, ভালো থাক তোর লোক-জন, ভালো থাক তোর কাজ, ভালো থাক তোর ভালোভাবে থাকারা। ভালো থাক একটুকু আমার থেকে যাওয়া! ভেবে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করি রোজ।

এই দেখো কাণ্ড !! বোলতে বোলতে কত্তো লম্বা একটা চিঠি হয়ে গেলো রে। জানি এখন তুই খুব busy? আমার জন্য সময় নেই তোর। ঠিক আছে আমি তবে চিঠিটা খামে মুড়ে রেখে দেব। আজ আর পোড়াবো না। কাল পুড়িয়ে ফেলবো।

আর হিমেল হাওয়ায় তোর উত্তরও খুঁজে পাবো। নীল আকাশের বুকে মেঘেদের আলপনা আঁকা রাজহাঁসেদের মতো নরম পালকের চিকন রঙে। খুঁজে নেবো তোর উত্তর।

ইতি
আমার হারানো মন….

মেঘ সাম্পান

hqdefaultaagttt

হিম হিম রাত আর রাতচরা পাখি,
নিরিবিলি খুঁজে নিক চারকোন এঁকে
আকাশের কুচি কুচি তারা গোনা যাক।
এক ফালি তুলে নেবো মেঘ ভাঙা চাঁদ।
পথ জুড়ে পাতা জালে মরণ ফাঁদ।

আনমনা সেই জন মনে শুধু থাক
আলো চোখে এক টানে তার ছবি এঁকে
বাদ বাকি আর কিছু সব ফিরে যাক।
মিটমিটে আঁধারের টিমটিমে ভালো
মন পেতে তুলে নিই সকালের আলো।

একাবোকা সেই জন কোল কাছে পাক
সুর তুলে বাতাসের আনাগোনা বাড়ে
আধো সুরে ভেসে আসে মন ফেরা ডাক।
অংবং-এ মেঘেদের টমটম গাড়ি
গুটি গুটি হাঁটি দিক শব্দেরা বাড়ি।।

ফুলেদের যত রেনু আঁজলায় ভরে
ঘুরেবেড়াই মেঘেদের রামধনু চড়ে।
শুনে চলি রিমঝিম কুয়াশার গান,
বয়ে যায় তিরতির মেঘ সাম্পান।।

প্রতিচ্ছবি

কাল অনেক রাত পর্যন্ত
চিনে নিতে চেয়েছি নিজেকে।
ইচ্ছে করেই সব বন্ধুদের বলেছিলাম
শুভরাত্রি সময়ের অনেক আগেই।
আমার আমিকে আমার কাছে মেলে ধরে
সবটাই বুঝতে চেয়েছি, যুঝতে চেয়েছি।

ঝড়ের আগের রাঙা মেঘের মতো
কবিতারা একে একে নেমে আসে
হৃদয় চিড়ে আঙুলের রেখা বেয়ে।
কবিতারা জানো অনেকটা তোমার মত
স্বচ্ছ, নির্মল, আর অনায়াস অভিমানী।

বেশি কিছু চাওয়া চাই নি কখনো,
কারো কাছে, কোন প্রত্যাশা নেই।
আমার হাতের পাতা দুটো উপুড় করা আছে
সেই আগের মতো করেই।
আজকাল আমি হঠাৎ করেই শব্দ হারাই,
বাক্যেরাও মাঝ পথে চুপ করে থেমে যায়।

তবুও আমি চেয়ে থাকি, প্রায় মিলিয়ে যাওয়া
আলোর রং স্বচ্ছ করে অপেক্ষা করি তোমার
ভালোবেসে নিজেকে মেলে ধরি সম্পূর্ণ।

আবীর রঙের ছবি

আবীর রঙের আঁকার খেলায়
আমার ছবি এঁকো।
পেঁজা মেঘের স্নিগ্ধ আলোয়
শিউলি কুঁড়িও রেখো।
চলতে চলতে পথের বাঁকে
একটুখানি থেমো।
তোমার হাতেই আমায় দিলাম
তোমার করে রেখো।

অনুবাদ কবিতা : মৃত্যু তোমাকে

মৃত্যু তোমাকে
মূল কবিতা : আনা আখমাতোভা
অনুবাদ : রিয়া চক্রবর্তী

একসময় না একসময় তুমি
গ্রহণ করবে আমায় –
এখনি নয় কেন?

তোমারই প্রতিক্ষায় আছি –
সহ্যের সব বাঁধ ভেঙেছে,
অন্ধকারে, দরজা খুলে রেখেছি।
সাথে এনো যন্ত্রণা উপশমের
আশ্চর্য কোনো যাদুকরী মলম।
যদি কোন মন ভোলানো ছদ্মবেশ ধরতে হয়,
তবে ছদ্মবেশেই এসো।
দস্যুর মতো বুকে বিঁধে দিতে চাও বিষাক্ত তীর,
যদি মারণব্যাধির জীবাণু রূপ নিতে চাও,
সে ভাবেই এসো।

না হয় এসো একটা বিভৎস গল্পের মতো
যার সমাপ্তি সবার জানা।
নীল টুপি পরা পুলিশের মাঝখানে
গৃহস্বামীর বিবর্ণ মুখ।
এইসব আমার সহ্যের মধ্যে।
ফুলে ওঠে এস্নেই নদীর জল,
আকাশে প্রজ্জ্বলিত ধ্রুবতারা,
প্রিয়জনের নীল চোখের আলোয়
মুছে দেয় আতঙ্ক আর ভয়।

ইচ্ছা মৃত্যু

ইচ্ছে ছিলো খুব সকালের সোনা ঝরা রোদ হব,
ইচ্ছে ছিলো বৃষ্টি শেষের একলা দুপুরে
হেঁটে যাব জল থৈথৈ পথ ধরে বহুদূর।
কখনো বিশ্রাম নেবো অচেনা কোন গ্রামের,
শাল, মহুয়া ঘেরা কোন মাটির দাওয়ায়।

ইচ্ছে ছিলো সুখের সুরে সুর মিলিয়ে
নতুন রং এ রাঙিয়ে নেবো নিজেকে।
এখন যাবতীয় ইচ্ছে গুলোকে
বাক্স বন্দী করে রেখেছি –আর,
সুখকে ন্যাপথলিনে মুড়ে গুছিয়ে রেখেছি,
পুরনো আলমারির কোন এক দেরাজে।