রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

রাগ করিস না প্লিজ!

রাগ করিস না প্লিজ!

জানিস আমি কিন্তু কখনোই কথা দিইনি পরিপাটি সংসার, মন জুগিয়ে চলা আর সুখি গৃহকোণের। কিংবা ধর রান্নায় নিখুঁত নুন-ঝাল-মিষ্টি, অথবা তোয়াজি চা-এর কাপ। লিকার না দুধ, আসাম না দার্জিলিং তাও জানতে চাইনি। তাই রাগ করিস না প্লিজ!

আমার তখন কলেজ বেলা,বন্ধুদের সাথে দুরন্ত আড্ডা, তুমুল তর্ক। বন্ধুরা ডাকতো “কমরেড”বলে। না কোন রাজনীতির গন্ধ মিশিয়ে ফেলিস না। তখনও এই শব্দটায় কোনো বাদানুবাদের গন্ধ মেশেনি। তখন সদ্য পড়েছি গোর্কির মাদার। তখনও পাভেল, ইভান আর তাতিয়ানা আমাদের ঘরের নাম হয়ে ওঠেনি। তখনও রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলেছি, “ইস্পাত”। আমার কাছে কমরেড মানে জীবনে জীবন বাজি রেখে, একগুঁয়ে লড়াই-এর গল্প। বন্ধুরা বলতো “সবাই কেন এমন হতে পারেনা, ঠিক যেমন তুই”।

আমি তখন ঘুলঘুলিতে ছলকে আসা সকাল রোদ। তপ্ত দুপুরে জানলার খড়খড়িতে লুকিয়ে থাকা দস্যি চোখ। আমি তখন বিকেল বেলার এক্কাদোক্কার ছক। আমি তখন লম্বা চুলের খোঁপায় গোঁজা চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ। আমি তখন জিন্স টিশার্ট। আমি তখন শখের শাড়ি। আমি তখন ঠাম্মার থেকে নেওয়া মিঠে-পানের রাঙা ঠোঁট। আমার তখন কফি হাউজ, আমার তখন আলসেমিতে বেজায় সুখ।

রাগ করিস না প্লিজ! আমি কিন্তু কখনোই আবদার করিনি বাঁধনহারা সুখের, প্রশ্নহীন বাধ্যতার, আর আমাকে অগাধ ভালোবাসার। অথবা, লোক দেখানো তোয়াজ, মায়াবী ব্যবহার।

দাদু ডাকতো, “অভিমানী” বলে। এই শব্দটায় তখনও কোন মশলা সাঁতলানো আর পাঁচফোড়ন পড়েনি। পান থেকে চুন খসলেই ঠোঁট ফুলিয়ে ঘরের কোনে। জানতাম দাদু ঠিক এসে আমাকে জড়িয়ে নেবে। অভিমান তো এখনো হয়। এখনও ঠোঁট ফুলিয়ে চুপচাপ হয়ে যাই। যেমন কালও হয়েছিল। তারপর হঠাৎ ভাবি কেউ তো নেই। আমার দাদুই তো নেই! তারপর দাদুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি চুপচাপ কিছুক্ষণ। হয়তো দু ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। তারপর নিজেকেই বলি “পাগল মেয়ে! অভিমান কি সবাইকে মানায়!” যাদের কেউ নেই তাদের অভিমান করতে নেই। অথচ দেখ এই ছোট্ট কথাটাই ভুলেই যাই মাঝে মাঝে।

রাগ করিস না প্লিজ! বল দেখি, বদলে যাওয়া নিয়মগুলোয় নিজেকে বদলে নেওয়া সহজ? তবুও রোজ বদলাই আমি, নিজেকে একটু একটু করে। সেইদিনের সেই দস্যি মেয়ে ভীষণ শান্ত আজ। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা থেকে অনেক দূরের সে। কথার সঙ্গে কথার মাঝে গুটিয়ে নেবে আর, গল্প করার সময়টুকু, হ্যাঁ এর পিঠে হ্যাঁ।

আমি তখন শীতের দুপুরে রোদ পোহানো ছাদের দোলনা চড়া মন। আমি তখন গাছের ডালে পা দুলিয়ে পেয়ারা ভাঙা আঙুল। আমি তখন গুলি খেলার ছক কাটা উঠোন। আমি তখন ঠাকুরঘরের একান্ন আলোর প্রদীপ। আমি তখন বাড়ির খাঁজে চড়ুই পাখির পালক। আমি তখন বৃহস্পতি বারের আলতা রাঙা পা। আমি তখন শখের মেহেন্দী পড়া হাত, আমি তখন ঘরে পাতা-কাজল। আমি নাকের ছোট্ট হীরের ফুল। আমি তখন সন্ধ্যেবেলা তুলসি মঞ্চ, আকাশ প্রদীপ, হাজার তারার রাত।

রাগ করিস না প্লিজ! আমি কখনো ইচ্ছেগুলো চাপিয়ে দিইনি তোর ওপরে। স্বৈরাচারী হতেই শিখিনি কখনো। কখনো বলিনি উচ্ছ্বলতা মেনে নে তুই। কখনো বলিনি কেন এতো অবহেলা আমার প্রতি। কখনো বলিনি আমায় কষ্ট দিয়ে তুই কি সত্যিই আনন্দ পাস!

আমি নিজেই ডাকি “বৃষ্টিবিলাস” বলে। বৃষ্টির সাথে আমার বড্ডো বন্ধুতা। এখন আমি গভীর আঁধারে হারিয়ে যাওয়া নদী। এখন একলা আমি এক আকাশ জুড়ে। এখন আমি মেঘের হতাশা। কবেকার শুকিয়ে যাওয়া জলের ফোঁটা। নীল বেদনায় চুপসে যাওয়া দুরের পাখি। এখন আমি অহেতুক প্রলাপ বকা বাচাল এক মেয়ে। এখন আমি উদাস ভোরের বিদায়ী রাতের গান। এখন আমি বৃন্ত থেকে ঝরে যাওয়া ফুল।তপ্ত দুপুরের ঝলসে যাওয়া এক দীর্ঘশ্বাস। হঠাত্‍ দমকা হাওয়া কেঁদে ওঠা বৃষ্টি। এখন আমি ঝাপসা স্মৃতির এক ধুলি ধূসর প্রেম উপাখ্যান।

এইতো, শুধু এইটকুই আমি। যে রোজ রোজ চলার পথে সামলে নেয় নিজেকে যখন তখন সন্ধ্যে কিংবা রাত। মনটা না হয় লুকিয়ে নেবো। মেঘবিলাসি, যদিও চোখ। মন খারাপের মেঘের জলে একাই ডুব স্নান। তবু, রাগ করিস না প্লিজ!

তারচেয়ে, বরং প্রার্থনা কর চিরঘুম আমার হোক।
কোন একভোরে বন্ধ হোক এই তারাগোনা চোখ!

স্রোত

স্রোত

আমি মৃত্যুকে বলেছি, অপেক্ষা কর।
বসো, একটু জিরিয়ে নাও, জল খাও,
আচ্ছা স্মার্টফোন আছে তোমার?
তাহলে একটা ফেসবুকে একাউন্ট খোলো।
তোমার বন্ধু তালিকায় আমাকেও রেখো।

ভাঙনের গান শুনেছো কখনো?
আমার চোখের সামনে নদী পাড় ভাঙে,
ভাঙে মুহূর্ত, ভাঙে হৃদয়, ভাঙে বিশ্বাস।
নিষ্ঠুর উল্লাসে বয়ে যায় দুকূল ছাপিয়ে।
বুকে হাত রেখে অনুভব করি স্রোত।

বর্ষা বিলাস – ৩

বর্ষা বিলাস

হঠাৎ রাতের আঁধারে আর্তনাদ এসে
জমাট বেঁধে রইল আমার হাতের মুঠোয়,
অন্তহীন জলরেখায় এক জ্বলন্ত মোমের মতো
মানুষের মুখোশ চারপাশে ঘিরে থাকে
কালো ছায়া অপচ্ছায়ার বীভৎস মুখ।

পড়ে রইল কিছু শব্দ, কিছু না বলা কবিতা
একরাশ ঘৃণা, আর এক আকাশ অভিমান।
আর জমাট বাঁধা কান্না চিহ্নিত করে গেলাম
আমার পথ, এই উদ্ভ্রান্ত বর্ষায়।

গাছপালা উপড়ে দিলেই বন্ধ্যা মাটি, আর
গোলাপের কাঁটা, আগুনে ভরে যায় হাত,
চোখে নেচে ওঠে সমুদ্রের নোনা ঢেউ।
ভেসে ওঠে নিষ্ঠুর গাংচিলের মাছ শিকার।

কাল রাতেই মিশিয়ে ফেললাম নিজেকে
বর্ষার বৃষ্টির সাথে, চোখের জলের সাথে,
বৃষ্টির ফোঁটার বন্ধুত্ব আমরণ। মিশিয়ে নিলাম
ফুল,পাতা আর একফালি পাথরের সাথে।

মাঝে মাঝেই নেচে ওঠে স্বপ্ন ছুরির ফলায়,
বুকের ভেতরে উথাল পাথাল ঢেউ, আর,
জ্যোৎস্না ঝড়ের মুকুট পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি
সেই প্রাচীন পাহাড়ের চুড়োয়; একা আমি।
প্রতিদিন যে নিজের বুকে আঁকে ক্রুশ চিহ্ন।

একলা যাপন

একলা যাপন

এই সময়টা আমার জন্য নয়
এখনও আসেনি আকাঙ্খিত সময়
আজও হারিয়ে যাইনি
মুখ মুখোশের বেয়াড়া স্রোতে।
মুখোশগুলো অবাক করে শুধু।

সত্যিই হারাইনি।

হারাতে চেয়েছিলাম একবিন্দু আলোর মাঝে,
শুধুমাত্র ভালোবাসা চেয়ে,
হারাতে চেয়েছিলাম বিশাল সমুদ্রে
এককণা ধবধবে সাদা নুড়ি হয়ে।

সত্যিই হারাতে চেয়েছিলাম।

ভালবাসতে চেয়েছিলাম গভীরভাবে,
চেয়েছিলাম উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের মতো
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস হতে।
এখন বুঝি, ভালোবাসা মিথ্যে।

চেয়েছিলাম, সত্যিই চেয়েছিলাম।

তাই আজও একাই হেঁটে যাই
আঁধার থেকে অন্ধকারে।
মুখোশ ছেনে ছেনে মুখের খোঁজে।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

আমার পৃথিবী

প্রকৃতিতে ফাগুনের জোয়ার এলেই,
আমার বেঁধে রাখা,লুকিয়ে রাখা প্রেম,
সমস্ত শিকল ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চায়।
চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে চায় যত মন।
আর তখনই আমার সর্বক্ষণ কল্পনায় শান্ত থাকা
অনু পরমাণু গুলো খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসে।
দারুন বিদ্রোহে ঝড় তোলে, তছনছ করে দেয় সব।

আমার চোখে তখন পলাশের সমারোহ,
শরীরের উজান বেয়ে নামে লাভার স্রোত,
তুমুল বৃষ্টি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
জেগে উঠি বৃষ্টি স্নাত হয়ে, বুকে তখন
ছলাৎ ছলাৎ, উথাল পাথাল ঢেউ।
তুফান তখন নিশ্বাস প্রশ্বাসে,শিরায় শিরায়।
গিরি গুহা উপচে পড়ছে ম্যাগমা প্রপাতে।

ধীর লয়ে বেজে চলেছে মোৎজার্ট, সোনাটা।
চারিদিকে থৈ থৈ ভিজে ভিজে পরাগ রেণু।
তারপর পৃথিবী ক্লান্ত হলে, রণক্লান্ত সময়ে,
ভেঙে যায় বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা,
অভিমানের যত বাঁধ, ভেসে যায় ফাগুন।

প্রেমের দিন

আজ শহরময় প্রেম প্রেম গন্ধ। আমার শহরে আজ এই ভালোবাসার পুজো পুজো গন্ধ। হয়ত তর্কে অনেকেই হারাবে আমায়, “শুধু আজই কেন ভালোবাসার দিন?” তাহলে বাকি দিনগুলো কি ঝগড়ার? অথচ আজকের দিন আজকেই থেকে যায়, কাল হবার আগে। অতো হিসেব আমি বুঝিনা বা বোঝার চেষ্টা করি না। কিছু হিসেব না মিললেই ভালো লাগে !

মনের কোনে মেঘ জমেছে কদিন ধরেই, বর্ষনও হয়েছে অঝোরে চোখের জানলায়। আজ সকাল থেকেই সেই মেঘ এসেছে ঘরে, খাটের পাশে জানলা ধরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। জানলা তবু খোলাই ছিল, বৃষ্টি যদি আসে। কদিন ধরেই, কেউ জানে না, চুপ থেকেছি আর, মেঘের কাছে অনুরোধ ছিলো। বরফ গন্ধ যখন তখন শিরায় শিরায়। একটু খানি শান্তি দিবি ধার?

আমি কিন্তু হাসতে পারি, কষ্ট লুকিয়ে বুকে। ঠিক সবার মতো হিসেবে মিল হয়না জানি, অঙ্কে আমি চিরকেলে কাঁচা। যখন তখন রোদ ঝলমলে আকাশে মেঘ দেখাটাই কাল। আমি এখন কি যে করি! আকাশটাকে টেনে নামাই, মেঘ গুঁড়িয়ে নদী, পারতাম ঠিক, আগুন হতাম যদি!

প্রেমের কথা মনেই নেই। শরতের শিউলি আলোয় প্রেমের বিসর্জন, এখন শুধু তুষারপাত সারাটা পথ জুড়ে। নিজের কথা ভুলেই থাকি, মৃত মানুষ যেন। মনের কথাও ভুলেই থাকি, এমন ভুলোমন! সকাল সকাল পলাশ রঙে মনে সাজতে চায় যে কেন?

একলা চলায় অভ্যস্ত আজ। স্বপ্নগুলো মৃত। আমিও তো তাই চেয়েছি, মৃত্যু তবু অনেক ভাল, অপমানের চেয়ে। মানীর শুধু মানই থাকে, এই টুকুই সম্বল। ইচ্ছেরাও জেগে নেই, সবই ঘুমের দেশে। এমনটা কি হবার ছিলো? মন যে আজ ভীষণ কঠিন, কিছুতেই হয়না সে দুর্বল।

তবে কি সবটুকুই ভুল? মেয়ে জন্ম ভুল, বৃদ্ধি ভুল, বিশ্বাস ভুল, ভালোবাসাও তো ভুলই ছিলো ; আজ দিনটাই ভুল। হয়তো বিতর্কের তুফান উঠবে, হয়তো হারাবো সম্মান। আমার আবার অপমান!! ধুর!! সবটাই যার ভুল, তার নাকি মান!

তবু আজ দিনটা শুধুমাত্র ভালোবাসার দিন। প্রেমের দিন। এমনটাই ভেবেছিলাম কখনো। এই লেখাটা অন্য ভাবে লিখতেও চেয়েছিলাম। সাগরের ঢেউ এসে বারবার মুছে দিচ্ছিল আমার সেই লেখা। তাই আকাশ, নদী, মেঘ সব এক হয়েই প্লাবন দিয়েছে ডাক। লবণ জলে মুখ ধুয়েছি; চোখের পাতা ভেজাই নাহয় থাক।

আলোমাখা ভোর

আলোমাখা ভোর

ভোর চলে যেতে যেতে রেখে যায় চড়ুইদের ধুলাবালি স্নান, শালিখ সংসার, কাকেদের কনসার্ট, স্কুল বাস আর চায়ের দোকানের উনুনের উপচে পড়া কয়লামাখা ধোঁয়া। এ সব কিছু পেরিয়ে এগিয়ে চলে রোদ পরতে পরতে, যত দূর দেখা যায়, তার থেকেও দূরে।

পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শরৎ শেষে হেমন্তের উঠোন জুড়ে ঝরে পড়ে ঈশ্বরময় গন্ধ। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শৈশব জুড়ে বসে থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসার ওম। এক আকাশ কোটি কোটি ক্রিস্টালের মতো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রূপকথা মন। খুঁজে নেয় আনন্দ আর বেঁচে থাকার রসদ।

ততদিন বিষাদ ফিরে আসিস না তুই।

ঋণ

ঋণ

কখনও কখনও এমন রাত আসে, যেসব রাতে, একলা চাঁদের চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। এখনও সেসব রাত আসে, গতকালও এসেছিল। মান, অপমানের তুলাদণ্ডে অপমানের পাল্লাই ভারি থেকেছে সবসময়। সময়ের নদী তিরতির করে পায়ের পাতার নীচে আকুল হয়ে দাঁড়ায়। স্রোতের মতো এগিয়ে যায় সময়, বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে যাই। বড্ডো ভিড় জমে গেছে অবহেলার।

অপমানের আগুনে ভস্মীভূত অভিমান। বুকের ভিতর উপচে ওঠে আকাশ, ঢেউ এর মাথায় বজরা ভাঙে তুফান। ঝড় উঠে মনকে গুঁড়ো করে। মাথার ভিতর গর্জে ওঠে সাপ, অভিশাপে ছাই হয়ে যাক শরীর, আগুন নয়, দাবানলের মতো সব কিছু নিঃশেষ হোক।

মাঝে মাঝে চুপচাপ হয়ে যাই। যেমন গতকাল ছিলাম।একলা জাগা রাত, ছাদে বসে কতক্ষণ যে কেটে গেছে! এইসব সময় গুলো দাদুকে বড্ডো মনে পড়ে। মন খারাপের সময়ে দাদুর কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। চোখের জল দাদু মুছিয়ে মাথা হাত বুলিয়ে দিতো। ভীষণ খটখটে রোদ চারপাশে। ছায়া দেওয়ার গাছটাই যে নেই। কখনও কখনও সব কিছু অসহ্য হয়ে ওঠে, মনে হয় আগুন জ্বেলে ছাই হয়ে যাই।

আগুনে তো শুধু নিজেকেই পোড়াতে চেয়েছি। দাদু বলতেন, “আত্মাকে কষ্ট দিওনা কখনও”, আত্মা কে তাতো জানি না, তাকে কি ভালোবাসতে ভুল হয়ে গেল? তার কষ্টে আজ তাই এ দূর্বিষহ প্রায়শ্চিত্ত। একটু একটু করে মুছে গেছে চাওয়া, স্বপ্ন, ইচ্ছেনদী। চুপ থেকে আরো বেশি নিস্তব্ধতায় ডুবি। আলো চেয়েছিলাম, যাতে ভুলে থাকতে পারি সব যন্ত্রণা। বেশ তবে, অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসুক। এ শুধু আমার প্রায়শ্চিত্ত, তাই আমি পরীক্ষা দিই। শুধু যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার আগে মৃত্যুর মুখোমুখি বসতে চাই।

কোটি জন্ম অব্যক্ত চোখের জল, লক্ষ জন্ম ছটফট যন্ত্রণার, হাজার জন্ম পাপস্খলণ শেষে, শতেক জন্মে কৃতজ্ঞতা, ঋণশোধ!

এজন্মটা এভাবেই কাটুক নাহয়।

___________
রিয়া চক্রবর্তী।

কালবেলায় মধুচন্দ্রিমা

গতকাল অনেক রাত অবধি বসে ছিলাম একা চুপচাপ।
আজকাল মাঝে মাঝেই কুয়াশা এসে ঢেকে দিচ্ছে মনের জানালা।
কাল রাতে কিন্তু চাঁদের আলোয় ভাসেনি আমার ঘর।
চুপচাপ বসে ছিলাম, জানি সে ভুল করে হলেও
ধোঁয়াটে জানলাটা খুলে একবার আসবে এসে ডাকবে আমায়।

বসে বসে আঙুলে কর গুনি নামতা পড়ার মতো, জ্যোতিষীর মতো রেখা চিনি,
তাঁর ছোঁয়ায় ছোঁয়া চিনি, আর বাকি যা কিছু আনাগোনা করে মনে মনে ,
সব নিয়েই অপেক্ষা অপেক্ষা আর শুধুই অপেক্ষা।
আর চলে সময়ের সাথে প্রতিটা ক্ষণে আমার তর্ক-দ্বন্দ্ব।
আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা ভেঙে,অভিমানের দরজা ভেঙে তুমি এলে…
অতি ধীরে, চিরচেনা, বহুদূরে ভেসে যাওয়া সুর টেনে,
একে একে বলে গেলে সেই চেনা কথাগুলো।

মাঝে মাঝে এমন রাত আসে, যখন রাতের আকাশে একলা চাঁদের পাশে
লক্ষ কোটি চাঁদ জ্বলে ওঠে আর সেসব রাত গতকালও এসেছিলো।
হিমেল হাওয়াতে তোমার রাজপথ আঁকা।
আমিও শুধুমাত্র তোমাকেই দিয়েছি আমার ন্যায্য দাবী রাখার।
প্রতিক্ষণের আমার এ অভিসার, চির সখা আমার,
রেখেছি যত্নে তোমার অমোঘ ঈশ্বরীয় প্রেম।

তুমি জানো যে তোমাতেই আমি, আর আমি জানি যে আমাতেই তুমি।

আবার পদাবলী

holi-2a

সেই যেন কতযুগ আগে,
শ্যামের রঙিন ঘন ফাগে।

রাধিকা রাঙালেন নিজেরে,
বাঁধলেন শ্যাম মোহন ডোরে।

রাই কিশোরীর গৌর অঙ্গে,
সাজালো শ্যাম প্রেমের রঙে।

শিমুলে পলাশে লাগে রে আগুন,
রঙিন কত যুগ আগের ফাগুন।

আবার ফিরে এলো সেই দিন,
প্রকৃতিতে আজ বসন্ত রঙিন।

মন যে কোথায় ভেসে চলে,
কত কথা একা একাই বলে!

শ্যামের অপেক্ষায় অনন্ত গণনা,
রাই কিশোরীর আকুল বেদনা।

বড় কাছে ভেসে এল ধ্বনি,
গেয়ে উঠে একাকী গোপিণী।

গোপিনাথ তুমিতো সুন্দরতম,
“মরনরে তুঁহু মম শ্যামসম”

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডদ্রোহী রাজা রামমোহন রায়

সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডদ্রোহী এক মহান ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়……
জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলার নবযুগের প্রথম ও প্রধান নায়ক কীর্তিমান পুরুষ রাজা রামমোহন রায়। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক অগ্রদৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও কর্মনেতা ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ১৮৩০ সালে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

রামমোহন রায় ১৭৭২ খ্রিস্ট্রাব্দের ২২ মে মাসে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দোপাধ্যায়) ব্রাক্ষ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন। রামমোহন খুবই মেধাবী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফারসী ও ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। এ ছাড়া হিব্রু, গ্রিক ও সিরীয় প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন এবং ইসলাম ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন। প্রথম যৌবনেই তিনি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা এবং ইউক্লিডের মূলনীতিগুলো পাঠ করেন। এ গ্রন্থাবলি অধ্যয়নের ফলে তাঁর ভেতরে যুক্তিবাদিতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়। এ সময়ই তিনি ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করেন। পারস্যের সুফি মরমিয়া কবিদের কাব্য পাঠও তাঁর মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। যৌবনের প্রারম্ভে নানা গ্রন্থ ও শাস্ত্র অধ্যয়নের ফলে রামমোহন রায় মূর্তি পুজার ব্যাপারে বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। এবং তাঁর বিপ্লবী চিন্তার ফসল হিন্দুধর্ম সংস্কার আন্দোলন। তিনি প্রতিমা পূজা বর্জন করেন এবং বিশ্বাস করতেন এক সর্বজনীন ঈশ্বরপূজায়। তিনি ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সভা, যা পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্ম সমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ব্রাহ্ম সমাজকে হিন্দুধর্মের নতুন শাখা হিসেবে অভিহিত করা যায়।

স্বামী বিবেকানন্দ এর দৃষ্টিতে রামমোহনের তিনটি দান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। “His acceptance of Vedanta, his preaching of patriotism and the love that embraced the Muslanmans equally with the Hindus”.
এবং স্বামীজী তাঁকে “the first man of new generation” নামে ভূষিত করেছেন।

রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ। সনাতন হিন্দুধর্মে প্রচলিত অমানবিক ও নির্মম সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথার মতো কুপ্রথা সরকার আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে দেয়।

রামমোহন রায় স্বীয় ধর্মমত ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য ১৮২১ সালে সংবাদ কৌমুদী নামে একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ১৮২২ সালে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসি ভাষায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই দুই পত্রিকায় রামমোহন রায়ের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের সপক্ষের যুক্তিগুলো গদ্য রচনার মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।

১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল জন এডাম ভারতীয় প্রেসের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন, তখন রামমোহন রায় বন্ধুদের নিয়ে প্রিভি কাউন্সিলে স্নারকলিপি পেশ করে বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ করেন। তিনি বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরকে নিয়ে ১৮২৬ সালে ভারতীয় জুরি আইনের কতিপয় বৈষম্যমূলক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থবিরোধী সরকারি রাজস্বনীতির বিরুদ্ধে তিনি বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংয়ের কাছে ১৮২৯ সালে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেন। বলা যায়, রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িককালে কলকাতায় সংঘটিত এমন কোনো সামাজিক আন্দোলন পাওয়া যাবে না, যাতে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেননি। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন।

রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর সেখানকার ইংরেজ সমাজ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে। ১৮৩২ সালে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে যান। ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল নগরীতে ভ্রমণকালে তিনি অসুস্থ হন।ব্রিস্টলেই তাঁর চিকিৎসা চলে। বিলেতি প্রাজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলার নবযুগের নায়ক রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

রূপকথা

রূপকথা

কবিতারা পাড়ি দেয় ছদ্মবেশে নিঃশব্দে। মন কথা খুঁজে পায় স্বপ্নের ঘুম চাদরে। বৃষ্টিজলে বাঁধভাঙ্গা শৈশব আর কাগজ নৌকা। কৈশোর আলগোছে ফিরে চলে স্বপ্ন থেকে স্বপ্নান্তরে আনমনা। যৌবন পথে পথে রোদ মাখে ধুলো ওড়ায় আর অবুঝ বার্ধক্য কড়া নাড়ে নিয়তি গ্রাহ্য সবুজ হয়ে।

আকাশের খাঁজে জমা মেঘ নেমে আসে বজ্রসিঁড়ি বেয়ে আমার ঘরে। পথ ভুলে এপথ ওপথ হয়ে মন ডানা মেলে দেয়। আমি যদি পা রাখি ঠিক ওমনি করে? মেঘের মত জানলা বেয়ে কার্নিশে, উড়াল দিতে চেয়ে!

ঝড় উঠুক আকাশ, বাতাস নস্যাৎ করে।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি-
ধম্মং শরণং গচ্ছামি-
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি’

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম
গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্যের (চতুরার্য সত্য) সব কটিই দুঃখকে কেন্দ্র করে। তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে কীভাবে দুঃখের হাত থেকে বাঁচানো যায়। গৌতম বুদ্ধ দুঃখের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাননি, তিনি দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেন। দুঃখের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৌতম বুদ্ধ কারও কাছে সাহায্য না চেয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেছেন।

জগতে দুঃখের কথা শুধু গৌতম বুদ্ধ একাই বলেননি, বিভিন্ন উপনিষদে দুঃখ সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে। সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ সাংখ্যকারিকার প্রথম সূত্রই ত্রিবিদ দুঃখ নিয়ে শুরু করেছে। ভারতীয় দর্শনের একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সব কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করাকেই জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে মনে করেছে। তবে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের কোন দার্শনিকই গৌতম বুদ্ধের মত এত গভীরভাবে এবং যৌক্তিকতার সঙ্গে দুঃখ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেননি।

গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে Schopen Hauer, Nietzsche, Kierkegaard কী বলেছেন আলোচনা করে দেখা যাক।

Schopen Hauer একজন দুঃখবাদী দার্শনিক। তাঁকে অনেকেই‍‍‍ ‘Prince of Pessimism’ বলেন। তাঁর মতে, এ জগত দুঃখের আলয়। দুঃখই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। সুখ অকল্পনীয় ও অসম্ভব বস্তু। যতই আমাদের জ্ঞান বাড়ে, ততই আমাদের দুঃখ বাড়ে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ দুঃখের কথা বললেও আশার বাণী শুনিয়েছেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। Schopen Hauer বৌদ্ধধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করলেও বুদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে আছেন। বুদ্ধের শিক্ষা আমাদের আশার আলো দেখায়, আর শোপেন হাওয়ার তাঁর সামনে পর্দা টেনে আমাদের হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেন।

Nietzsche ও দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্য আরও ভিন্নতর। তিনি প্রথম জীবনে Schopen Hauer দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে সে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সে যাই হোক তিনি মায়া-মমতা, দয়া-সহানুভূতি ইত্যাদিকে অনেক ছোট করে দেখিয়েছেন। তাঁর কাছে মানবিক গুণের চেয়ে শক্তির গুরুত্ব বেশী। তিনি বলেন, উচ্চতর সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়া উচিত। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ঠিক এর বিপরীত। তাঁর শিক্ষা ভালোবাসা আর দয়ার কথায় পূর্ণ। তাঁর কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই শ্রেণী বিভাগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, জন্মগত কারণে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই Nietzscheর দর্শনের মতো উচ্চতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের ধ্বংস বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনে অকল্পনীয়।

Kierkegaardও বুদ্ধের মত তত্ত্ববিদ্যায় উৎসাহী ছিলেন না এবং তাঁরও মূল লক্ষ্য মানুষের নৈতিক দিকটা। তিনিও বুদ্ধের মতো বলেছেন, কামনা-বাসনাই দুঃখ আনে। তবে তাঁর এ ব্যাখ্যা ঈশ্বরকেন্দ্রিক, কিন্তু বুদ্ধের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। বুদ্ধের মতো Kierkegaard বাসনার উর্দ্ধে যেতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন, বাসনা ত্যাগ বৌদ্ধিক আত্মহত্যার শমিল।

প্রত্যেকটি দুঃখের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী, অন্য কেউ নয়। আরব দেশের এক কবি বলেছিলেন, ‘মারা যাওয়ার পর তাঁর কবরের ওপর যেন লিখে রাখা হয় যে, তাঁর পাপের জন্য তাঁর বাপ দায়ী। কারণ তাঁর বাপ না থাকলে তাঁর জন্ম হতো না এবং জন্ম না হলে তিনি পাপ করতেন না ।‘ কিন্তু বুদ্ধ কখনোই উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাননি। তাঁর মতে, আমার দুঃখ আমারই সৃষ্টি। শুধু দুঃখ নয়, এমনকি আমাদের জন্মের জন্যও আমরাই দায়ী। জন্মলাভের বাসনা থেকেই আমাদের জন্ম হয়েছে।

Pragmatism সম্প্রতিক কালের আর একটি দর্শন। এ দর্শনের মূল বক্তব্য হলো, যা কাজে লাগে এবং যা প্রয়োজনীয় ত-ই সত্য, তা-ই আলোচ্য ও বিবেচ্য হওয়া উচিত। সম্ভবত গৌতম বুদ্ধই প্রয়োগবাদেরও পুরোধা। মালুক্য পুত্রের তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, কেউ যদি তীর বিদ্ধ হয় তাহলে কী তার প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত ? যেহেতু সে কষ্ট পাচ্ছে, সেহেতু সে প্রথমে তীরটা খুলবে। এর আগে সে নিশ্চয়ই ভাববে না, তীরটা কী গতিতে এল, তীরটা কে মারল, তীরটা কীসের তৈরী। তাই আমরা যেহেতু দুঃখের সাগরে ভাসছি, আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত এই দুঃখের হাত থেকে কিভাবে বাঁচা যায় তার চেষ্টা করা। বুদ্ধের মতে, আমাদের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই।

সমকালীন দর্শনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো Logical positivism. এ মত অনুসারে principle of verification হচ্ছে সত্যের মানদণ্ড। যে বাক্যকে পরখ করা যায় না তা অর্থহীন। তাঁদের মতে, তত্ত্ববিদ্যাবিষয়ক অবধারণ এই পরখনীতির আওতায় পড়ে না। তাই এরা অর্থহীন।

গৌতম বুদ্ধ পরখনীতির উল্লেখ না করলেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তত্ত্ববিদ্যায় আলোচ্য বক্তব্য প্রমাণও করা যায় না আবার অপ্রমাণও করা যায় না। গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রকার চরম মত ও পথের বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত এটা তাঁর ব্যক্তি জীবনেরই অভিজ্ঞতার ফল। তিনি মধ্যমা প্রতিপদ বা মধ্যম পথকেই উত্তম পথ বলে স্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটল যে Golden Mean এর কথা বলেছেন তা তাঁর ২০০ বছর আগে গৌতম বুদ্ধই বলে গেছেন। বস্তুত বুদ্ধের মধ্যমা প্রতিপদ ও অ্যারিস্টটলের Golden Mean এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন।

অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের আর একটি শাখা বলে মনে করেন। কেউ আবার মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই হিন্দুধর্ম পূণর্তা লাভ করেছে। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় বলেছেন, ‍’ Buddhism is the fulfillment of Hinduism.’ অনেকে আবার বৌদ্ধধর্মের সাথে খ্রীষ্ট ধর্মের মিল খুঁজে পেয়ে এদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ আছে কিনা তা খুঁজতে চান।

বুদ্ধ ব্যবহৃত উপমাগুলি এবং যিশু খ্রীষ্টের প্যারাবেলস –এর মধ্যে সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ যে, তাহা শুধু chance coincidence বলে যেন সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। যেমন বুদ্ধের উপমাগুলি ভারতের পূর্ববর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায় না তেমন যীশুর প্যারাবেলস বাইবেলের পূরাভাগে পাওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধ ও যীশু খ্রিষ্টের শিক্ষার মিল আমাদের চিন্তাকে নাড়া না দিয়ে পারে না।

আমার জানা মতে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোন মনীষীর আবির্ভাব ঘটেনি যিনি গৌতম বুদ্ধের মতো একাধারে নৈতিক শিক্ষার প্রবক্তা ও সমাজ সংস্কারক এবং যার দর্শনকে অস্তিত্ববাদ, প্রয়োগবাদ ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সব ধর্মের শিক্ষিত প্রবক্তাদের কাছে তিনি সমাদৃত এবং এ বিষয়ে তিনি সত্যিই অনন্য। রাজত্বের লোভ ত্যাগ করে তিনি সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। আজ তাই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়সিংহাসনে তিনি সমাসীন।

তথ্যসূত্র : গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন।

আঁকা : রিয়া দাশগুপ্ত।

মহামনীষী ওমর খৈয়াম

আজ থেকে ৯৭১ বছর আগে সুদূর ইরানে জন্ম নিয়েছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও কবি ওমর খৈয়াম। আজ গুগল নিজস্ব ডুডল দিয়ে বিখ্যাত ফার্সি গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কবি ওমর খৈয়ামের ৯৭১ তম জন্মদিন উদযাপন করছে। গণিতবিদ হিসাবে, খৈয়াম ঘনকের সমীকরণ শ্রেণিবদ্ধকরণ ও সমাধান সম্পর্কে তার বিশদ কাজের জন্য পরিচিত। তিনি কণিকের ছেদের জ্যামিতিক সমাধান বের করেছিলেন। তিনি প্রথম ঘন সমীকরণ সমাধান করার জন্য একটি সাধারণ পদ্ধতির ব্যবহার করেন। খৈয়াম সমান্তরাল অক্ষ বিষয়েও কাজ করেছেন। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে, তিনি জালালি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করেন একটি খুব সুনির্দিষ্ট ৩৩ বছরের intercalation চক্রের একটি সৌর ক্যালেন্ডার। এটি পরে বেশ কয়েকটি ক্যালেন্ডার তৈরির ভিত্তি হয়ে ওঠে।

ওমর খৈয়ামের জন্ম ১০৪৮ সালের ১৮ মে ইরানের নিশাপুরে। তাঁবু নির্মাণকারীদের (খৈয়াম) একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ওমর। আরবি ভাষায় তাঁর পুরো নাম ছিল আবু’ল ফাত ওমর ইবন ইব্রাহিম আল খৈয়াম। কবিতা ও গদ্যের জন্যও বেশ বিখ্যাত ছিলেন খৈয়াম। তিনি হাজারেরও বেশি রুবাইয়াত বা গদ্য লিখেছেন। ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ পরে আর এক বিখ্যাত কবি Edward fitzgerald অনুবাদও করেন, তার মৃত্যুর বহুকাল পরে খৈয়ামের এই লেখা পর পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ওমর খৈয়াম চার লাইনের বিশেষ ধরনের কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়ে অাছেন। তার কবিতাগুচ্ছ রুবাইয়াৎ নামে সমাদৃত হয়েছে। পেত্রার্কের সনেটের মত রুবাইয়াৎ এক বিশেষ ধরনের চতুষ্পদী কবিতা। খৈয়ামের কবিতা গুচ্ছের বিষয়বস্তুু প্রেম, উপভোগ,পরকালের সুখ দু:খের অবিশ্বাস,জাগতিক বিষয়ে উদাসীনতা,মাদকতা প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে। ওমর খৈয়াম ঠিক কতগুলো রুবাই লিখে গেছেন তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তাঁর অমর গ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই-খৈয়ামে ৭২২ টি রুবাই পাওয়া গেছে। রুবাই ছাড়াও কবিতা গজল লিখেও তিনি খ্যাতি পান। ঊনিশ শতকে ইংল্যান্ডের কবি Edward fitzgerald ওমর খৈয়ামের কবিতা ইংরেজীতে অনুবাদ করলে পারস্যের বাইরের পাঠকের খৈয়ামকে জানার সুযোগ ঘটে। সেটা সতের শতকের দিকে। ইংরেজী ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ওমর খৈয়ামের কবিতা অনূদিত, বহুল পঠিত ও সমাদৃতি হয়।জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে ১১২৩ সালে ৭৯ বছর বয়সে বিশ্বখ্যাত কবি ও মহামনীষী ওমর খৈয়াম মারা যান।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে অনুবাদ সাহিত্যের অনন্য এক কারিগর, তিনি সে প্রমাণ রেখেছেন পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের ফারসি ভাষায় লেখা ‘রুবাইয়াৎ-ই-খৈয়াম’ বাংলায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে। তিনিই প্রথম বাংলায় এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন এবং গ্রন্থটি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। সে সময় বইটির চিত্রায়ন করেছিলেন খালেদ চৌধুরী এবং ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।

চলুন কাজী নজরুল ইসলামের অনূদিত ওমর খৈয়ামের কয়েকটি রুবাইয়াৎ পড়ে নেওয়া যাক-

১. আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস
মুক্ত পাখায় দেবতা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হল না রে, ছেড়ে তোর ওই জ্যোতির্লোক
ভিনদেশি-প্রায় বাস করতে এলি ধরায় এই আবাস?

২. সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!
প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি ধরতে দাও!
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁট-ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও।

৩. ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।

৪. আমরা দাবার খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই?
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব
খেলা শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!

অতীত মেঘ

অনেকদিন হয়ে গেল আগের মতো হাসতে পারি না আর। সেই ছোট্টবেলার মতো, যেমনটি এই কয়েক বছর আগেও পারতাম। এখনও মনে আছে। আমি তখন ১২ ক্লাসে পড়ি বোন ১১ ক্লাসে আমরা দুই বোন এক সাথেই বাড়ি ফিরতাম। খাবার টেবিলে রাখা থাকতো আমি ও আমার বোন বাড়ি ফিরে হাত, মুখ ধুয়ে যখন খেতে বসতাম তখন শুরু হত আমাদের যত গল্প আর হাসি। আমি আস্তে, মুখ বুজে মেকি হাসি হাসতে পারতাম না, জোরে জোরে শব্দ করে হাসতাম।

কাকিমা পাশের ঘর থেকে বলতেন পাড়ার মানুষেরা বুঝতে পারছেন আমাদের বাড়ির দুই মেয়ে বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে। জানি সেই দিনের সেই সময়ের মুল্য আজ অনেকখানি, কত কিছু আলাদা হয়ে গেছে, কতকিছু ভেঙে গেছে, কতকিছু হারিয়ে গেছে। যখনই তাকাই চারিদিকে দেখি সব কিছু অচেনা, হারিয়ে গেছি মুখোশের ভীড়ে। সব অচেনাদের ভিড়ে। আমার সেই ছোট্ট আমি কে আজ আর কোথাও খুঁজে পাই না। সেই হারিয়ে যাওয়া খুব ভালো হত যদি সত্যিই হারিয়ে যেতে পারতাম। সত্যিই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারতাম!

এখন আর তাকাই না ফিরে, দেখি না কিচ্ছুটি। কোনো দিকেই তাকাই না। ভাল লাগে না। অথচ কি ভিড় চারিদিকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের নিচের সেই চোরাবালিটা আজও বালি ভাঙে। একটা বালি খোঁড়ার যন্ত্র থাকলে ভালো হতো। একটা কবর খুঁড়ে বালিতে, সেই কবরে শুয়ে থাকতাম চিরকালের মতো। আর সমুদ্র ঢেউ মুছে দিয়ে যেতো আমার কবরের শেষ চিহ্ন টুকুও। যাতে কেও কোনোদিন আমাকে খুঁজে না পায়।

একদিন ঠিক আগুনের সাথে আমি মিলে যাব। এই বেঁচে থাকা বড়ই অদ্ভুত। শুনেছি আঘাতে যন্ত্রনায় মানুষ পাগল হয়ে যায় তবে কি একদিন পাগল হয়ে যাবো ? তারচেয়ে বরং আমি কোন এক গ্রামের মাটিতে পুঁতে দেবো আমার প্রিয় ফুলের চারা। যেদিন ফুলে ফুলে ভরে যাবে আমার সেই গাছে, সেদিন আমি ঘুমবো এক শান্তির ঘুম, যে ঘুম ভেঙ্গে আমি আর উঠবো না কোনো দিন। ফিরবো না আর কারো ডাকেই …