রোখশানা রফিক এর সকল পোস্ট

রোখশানা রফিক সম্পর্কে

I'm a mom, teacher, designer, poet, social worker, own home maker, a visionary dreamer.

ছল

নৈসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশের স্মরণে আমার একটি কবিতা। প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা।

ধান, কাউন, চিনার শস্যঘ্রাণ
বাতাসে ভাসিলে, আমিও চলে যাবো
এক মেঠো দুপুর ভেজা
গাঁয়ের ফসলী প্রান্তরে।
চারিদিকে শুনশান সুপারীর বন
আলতো বাতাসে কেঁপে কেঁপে
ভীরু কিশোরীর মতোন,
আকাশের বুকে আলপনা
এঁকে যাবে সবুজ মাঠের ‘পরে
দাঁড়ানো আমার দু’চোখে।

ফিঙে এক দোল খাবে
মনের সুখে , কৃষাণীর
বড় আদরের গাভীন
পিঠ বাহনে চড়ে।
কালো কইতর গুলি
উড়ে যাবে পাখনায়
সাদা সাদা শান্তির
ছবি পুষে।

কিন্তু, তোমারে নেবো
নাকো সাথে আমার।
কেন তাহা বলো?
দূরের বিভ্রম স্বপ্নে
আমারেই জানো তুমি,
কাছে গেলে নৈকট্যের
বিষাদের কাছে হার মানো।

আমি

ঘর যখন দূরে সরে যায়
আমার মনের বারান্দা থেকে,
তুমি বোঝ নাই
তোমার মনে তখনো
আমার বসত থেকে থেকে।

যতো নারী হেঁটে যাবে
উড়িয়ে আঁচল শাড়ীর
এলোচুল, চকিতে আড়চোখে
একপলক ছায়া খুঁজবে
তুমি আমাকেই করে ভুল।

তালপাখা হাতে মাদুর আসনে
মধ্যাহ্ন কিংবা নৈশভোজে,
কোনো নারী যদি বেড়ে দেয় পাতে
একমুঠো বেশি ভাত,
লুকাবে অশ্রু তুমি
যার নামে আড়ালে গিয়ে,
সে যে কার নাম,
কোন আখরে লিখা,
সেকথা আমি
বেশি জানি বুঝি আজ
তোমার নিজের চেয়ে।

হাসছো বুঝি এসব শুনে
আড়েঠাড়ে বাঁকিয়ে ঠোঁট?
দিন যেতে দাও আরো কিছু
মাসে, টের পাবে যখনি
খাবে তোমার আমাতে হোঁচট!

নীড় ২

পাখিদের ঝাঁকে মিশে
চলো একদিন অজানায় যাই উড়ে।
শান্ত পাহাড় ঘেরা সুনীল জলে
ডানা ছুঁয়ে ভেসে থাকি দু’জনায়
খুব কাছাকাছি।

তুমি কিছু কথা ক’বে,
আমি ক’বো কিছু,
তারপর কথা নেই আর কোনো।
কেবলি স্বর্ণালী আলো ঠিকরে গেলে
আকাশ আলোকে আর আমাদের নরম
পালকে, জেনে নেবো প্রাণে, আগামী বসন্তে
সাজাবো খড়কুটো আর ঘাসফুলে বোনা
স্বপ্নমাখা নিরালা নীড়। তখন জন্মান্তরের পরিচয়
আমাদের একফোঁটা “সুখ” হয়ে ধরা দেবে,
ক্লিন্ন-কিষ্ট-বেদনায় ক্লান্ত পৃথিবীর চোখের পরে।

আকাশ- আবীর

এমনো তো হতে পারতো
আমি হতেম জলভরা মেঘ, ☁🌧
ফোটা ফোটা অশ্রুঝরা 💦
বৃষ্টিবিলাসে ঝরে যেতাম
দূরের কোনো দ্বীপে? 🌊🐳

পরী হলে আমি
কেমন হতো বলো?
উড়ে উড়ে চাঁদের কোনে 🌙💫
ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নিতাম
ঝিলের জলের পাশে। 🍀🐟🌳

ফোটা ফুল হয়ে
ঝরে যেতাম যদি 🌸
নাম না জানা বনে,
তুমি কাঁদতে কি
কিছু দুঃখ নিজের
মনে করে নিয়ে? 💌

এজন্মে মানুষ হয়েছি,
আর জন্মে হতে চাই
এক অবাক গোধূলি বেলা, 🌞🌈
মনে কোরো তুমি
প্রগাঢ় এক সন্ধ্যায়, ছিলাম
বিষাদে ভাসানো ভেলা। 🎋🏜

নিমগ্ন অবকাশ

ছিপ ফেলে ঠায়
বসে আছি কতোদিন
এই জীবনের খেয়াঘাটে।
ফাৎনাটা নড়ে ওঠে
গুড়াগাড়ি সুখের ঠোকরে
ঠিকই মাঝেসাঝে।

গভীর জলের চেয়েও
সুগভীর অতলান্ত
দুঃখ আমার আসে না
কিছুতেই তীরের কাছে,
ডুব সাঁতারে তারা যেন
আমারেও টেনে নিতে চায়
বিষাদের নীল অবকাশে।

আমি দিন গুনি,
কাল চলে যায়
মহাকালের আকাশে।
ভালো আছি বুঝি তবে
নিরালায় এই নির্জন
নিমগ্ন কারাবাসে?

সুদূরের শুকতারা

নাবিকের চোখ খুঁজে ফেরে শুধু
সুদূরের শুকতারাটিরে
এই ছুঁয়ে থাকা
ভেসে যায় যাক্
আরো দূর বহুদূরে।
প্রবাল পাথর ঝাপটানি দেয়
ঢেউভাঙ্গা রুক্ষ পাহাড়ে,
সাগর সেতো অতলান্তিক
যেন ধরনী ঢাকা চাদরে।

দূর দ্বীপবাসিনী

মেরু সাগরের বুকে আঁধার রাতে অরোরার রঙের সিম্ফনি আমি। মরূদ্যানে ছায়াশীতল ইরাণী বালিকার নৃ্ত্যপারা তা থৈ থৈ জরিণ ঘাগড়ায় চুমকি চমক।

কেজো দুপুরের ফাঁকে আমি এক কাপ চায়ে আয়েশী চুমুক। যান্ত্রিক জ্যাম যাতনায় স্কাই স্ক্র্যাপার টেম্পারড গ্লাস দেয়ালে রোদেলা নীলাকাশ।

আমি মধ্য যামিনীর অস্ফুট প্রেমালাপ। দূর দ্বীপবাসিনী সুনয়না প্রোফাইল ছবি। আমি বোশেখ বিকেলে প্রেয়সীর অভিমানী খোঁপায় বিরহ বকুল।

অধরা মাধুরী আমি। আঙুল ছোঁয়ালেই ঝুরঝুর ভেঙ্গে পড়ি প্রাণহীন প্রজাপতির সাতরঙ পাখনার লাজুক ভঙ্গিমায়।

নীড়

যাযাবর পথ আমায়
নিয়ে যায় বহুদূর,
সেই সেখানে,
যেখানে হিম রাত্তিরে
মেঠো পথে একা চাঁদ জাগে।
নিঃসঙ্গ পথিক এক আনমনা
বুকে বয়ে চলে তীব্র বিষাদ
মেশানো ভালোবাসা নেশা।

তুমুল ঝোড়ো হাওয়ার বিকেলে
একেলা চায়ের কাপে
তলানির মতো পড়ে থাকে
তার না বলা স্বপ্ন গল্প-গাঁথা।
দিনমান ঘুরে ঘুরে
কেজো পৃথিবীর যন্তর-মন্তর
ঘাম-শ্রমে ভেজা অলিতে গলিতে,
যেন বেলাশেষে একা এক গাঙচিল
ঘুরে ঘুরে মরে, তাহার মায়ার তরী
ভাসায়ে আঁধারের নির্ঘুম নীড়ে।

বোঝাপড়া

টুপ্টাপ ঝরে পড়লেই
তাকে কি বৃষ্টি বলে?
হতেও পারে সে অশ্রুজল,
আমার হৃদয়ে গোপনে জমানো
সজল কিছু দুঃখ বীজের ফসল।

নদী বললেই স্রোতস্বিনী বোঝ?
হতেও পারে সে জীবন-মরণে
বয়ে চলা পাহাড়ি বানের ঢল।
কিংবা শীর্ণ শীতের মরা স্রোতে
পলি পড়া আবেগের কোলাহল।

নীড় বললেই দু’টি পাখি হয়?
হতে পারে তা ঝড়ে ডানা ভাঙ্গা
পক্ষীছানার শেষ আশ্রয় স্থল।
কিংবা ভুলে যাওয়া স্মৃতির বাসা
বেঁচে থাকার হাতছানি সম্বল।

“তুমি” বললেই কি তুমি বোঝ?
জানে শুধু আমার চোখের তীরে
ভেড়া স্বপ্নতরীর মেঘমল্লার দল।

ইচ্ছে হাওয়ায় স্বপ্ন ওড়ে

ইচ্ছে হাওয়ায় স্বপ্ন ওড়ে
মনটা যেন ঘুড়ি,
কল্পলোকের গল্প শুনে
আকাশ দেবে পাড়ি।
নীল আকাশে আসমানী চাঁদ
পূর্ণিমাতে প্লাবন,
চাঁদ- তারাদের আলোয় আলোয়
রয় যে ভরে গগন।

সকালবেলায় সূর্য ওঠে
রাত্রিবেলায় তারা,
তারি মাঝে পথটি খুঁজে
অবাক দিশেহারা।
পথের শেষে নদীর বাঁকে
ছোট্ট আমার ঘর,
তারই কোনে চুপটি বসে
স্বপ্নেতে রই বিভোর।
স্বপ্ন দেখি কান্নাহাসির
স্বপ্ন দেখি সুখের,
সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে
ক্ষণ গুনি দিন শেষের।।

দুর্বোধ্য

হঠাৎ করে মনের মাঝে
মনে হয়, কেউ যেন আছে
কোথাও আমাকে বোঝার।
ইতিউতি ঘুরি আমি,
হাত ধরি এর তার।
ছিঁড়ে ফেলে আমার সেতার
এরা সেই পুরনো আঁধারে
ফিরে যায় যার
যেখানে ছিলো যাবার।

থেমে গিয়ে, থমকে গিয়ে,
অনেকটা ভুল মেনে নিয়ে,
অনেক বোঝা পিঠে বয়ে,
অনেক ক্ষত সয়ে যেয়ে,
অনেক অশ্রু চোখে নিয়ে,
আবার একাকী হাঁটি
একেলা পথ আমার।

ভুলগুলো ভেংচি কেটে
মজাই মজার সঙ সাজিয়ে
পুতুল নাচের খেলায়
সুতো নাচায় বারবার।
ভুলের জীবন কি আর
সহজে সোজা পথে
পথ কেটে নিতে পারে
চাইলেই কখনো আবার?

চোখের নীলিমায়

রাত এসে থেমে যায় তোমার চোখে,
তারার ঝিলিক যেন জোনাক আলোকে।
তুমি তা জানো না,
দ্যাখে যার চোখ, সেই জানে শুধু
কোন দূর সাগরের অশান্ত ঢেউ
আছড়ে পড়ে হৃদয় তটে
ও চোখের নীলিমায়।

সন্ধ্যা আলোর ঘোর মেখে
যখন তাকাও দিগন্তে,
আকাশ ছাড়িয়ে যেন
তুমি খুঁজে নাও
অলোক পাখিকে।
আমি ডুবে যাই
সূর্যাস্তে, তবু কিছু
না বলা অভিমান
আমি রেখে যাই
তোমার স্বপ্নলোকে।

গোপন কথাটি

নাগরিক ধুলোর বিকেলে
সন্তর্পণে আমি একবুক
পাহাড়ী আকাশ পুষি।
কেউ যেন টের না পায়!

অসুস্থ এ দমবন্ধ নগরের
মানুষের অবয়বে প্রেতাত্মারা
যদি জেনে যায়,
একবুক নীলাকাশ ছুঁয়ে
আমি ধ্যানরত শান্ত এক
বিলের ধারের মৌন দুপুরের,
তবে ওরা অপারগতার প্রতিশোধে
খুবলে নেবে আমার
হৃদপিণ্ড থেকে মন,
চোখ থেকে সত্যের জ্যোতি,
হাসির থেকে আনন্দ,
শরীর থেকে সম্ভ্রম।

ভুল করেও বোলোনা ওদের,
মানুষ নামের আগাছার
জঞ্জালে জঞ্জালে ভরে যাওয়া
এ শহরে দাঁড়িয়ে আমি খুঁজছি
পাইন বনের স্নিগ্ধ শীতলতা,
চন্দনের সৌরভ আর দিগন্তজোড়া
আকাশ ছোঁয়া কিছু চিরহরিৎ বৃক্ষ।

চুপ করে থাকো, চুপ, চুপ।
বোলোনা কাউকে একথা
জেনেছো তুমি।
আমার স্বপ্নের উঠোনে
তুমিও এসে দাঁড়ালে,
ওরা খুবলে খুলে নেবে
তোমার আচ্ছাদন,
ঠুকরে খাবে তোমার
চোখের মনি শ্বাদন্ত
নখরে খাঁমছে-পিষে।

জিজ্ঞাসা

একাকী এক নির্জন দুপুরে শুধালাম সাগরকে,
গাঙচিলের কান্না বুকে নিয়ে কেনো এমন
আছড়ে পড়ো বালুকাবেলায়?
জবাব পাইনি তার।

একলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে জোছোনাকে বলেছিলাম,
অপরূপ আলোর ফুলঝুড়ি বুকে নিয়ে কেনো
মায়াবী করে তোলো রাতের অন্ধকার?
সে থেকেছে নিরুত্তর।

সূর্যাস্তের রেশমী লাল আলোকে প্রশ্ন করলাম,
আবীর রঙে কেনো সাজাও পৃথিবীকে
নববধূর সাজে প্রতিদিন?
উত্তর মেলেনি কোনো।

প্রতিদিন অবিরত এইসব প্রশ্নেরা
উত্তর না পেয়ে দূর পাহাড়ের গায়ে
প্রতিধ্ব্নির মতো ফিরে ফিরে আসে
আমারই মনের প্রান্তরে। সাগর-পাহাড়,
জোছোনা তবুও খেলা করে ধ্রুপদী সুরে
পৃথিবীর তানপুরায়।

বুনন

মেঘ ছিলো, ছিলো কিছু রোদ্দুর
আকাশে আকাশে, কিছু সুখের সাথে
ছিলো কিছু এলোমেলো দুঃখ একাকার
মিলেমিশে।

পরিপাটি চোখের কাজলে
গোপন বিষাদ ঢেকে
ফুলশয্যায় ডুব দিলো
যে মায়াবতী মেয়ে,
সে এখন গোধূলি উঠোনে
রূপকথা কুড়োয় হাওয়ায়
হাওয়ায় একঢা্ল এলোচুল মেলে।

দীঘির শান্ত জলে রোদ মরে এলে
কুহকিনী পিছু ডাকে কাঁচপোকা টিপ,
ডুরে শাড়ীর জমিনে থৈ থৈ অন্ধকারে
ভাসে তার জলজ প্রেম। শাপলা বিকেলে
দুরন্ত যুবা এক ছায়াঘন মেঘ এঁকে
পানকৌড়ি হৃদয়ে বলেছিলো,
“পাশে থেকো।”

দূরে থাকা কি শুধুই দূর
দুঃখনীল ক্যানভাসে ?
ভুলে থাকা মানে ভুলে যাওয়া
নির্জন অবকাশে ?
নাকি নিরন্তর বুনে চলা
নীলাভ এক রেশমী প্রহর
অভিমানের বিনি সুতোয় ?