বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

KB-01- 00

খনার বচন – ৩

খনা ও খনার বচন সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কম বেশী ধারণা আছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অনেকেই ধারনা করেন এগুলি কোন একক ব্যাক্তির লেখা নয়, বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের বলা বা লেখাগুলি খনার নামে প্রচলিত হয়েছে। যাইহোক, এই বিতর্কে না যাই।

আমাদের পরিচিতো অনেক খনার বচন আছে, সেখান থেকে কিছু কিছু বচন এখানে শেয়ার করবো ব্যাখ্যা সহ।

১। খনা ডেকে বলে যান
রোদে ধান ছায়ায় পান

ব্যাখ্যা : পান লাগাতে হয় ছায়াতে, আর ধান লাগাতে হয় রোদে।

২। সমানে সমানে দোস্তি
সমানে সমানে কুস্তি।


ব্যাখ্যা : সমান সমান না হলে কোন কিছুই জমে না।

৩। এক পুরুষে রোপে তাল,
অন্য পুরুষে করে পাল।
তারপর যে সে খাবে,
তিন পুরুষে ফল পাবে।


ব্যাখ্যা : তাল গাছে প্রথম ফলন আসতে কমপক্ষে ১২ বছর সময় লাগে। দীর্ঘ এই সময়ের জন্যই এই ভাবে বলা।

৪। নিত্যি নিত্যি ফল খাও,
বদ্যি বাড়ি নাহি যাও।


ব্যাখ্যা : প্রতিদিন ফল খেলে শরীর ভালো থাকে।

৫। দিনের মেঘে ধান,
রাতের মেঘে পান।


ব্যাখ্যা : দিনে বেলা বৃষ্টি হলে ধানের জন্য ভালো, আর রাতের বৃষ্টি পানের জন্য ভালো।।

৬। জৈষ্ঠতে তারা ফুটে,
তবে জানবে বর্ষা বটে।


ব্যাখ্যা : এটা দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে আমি বুঝতে পারি নি।

৭। যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্য রাজার পূণ্য দেশ।


ব্যাখ্যা : মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে ফলন ভালো হয়।

৮। সাত হাতে, তিন বিঘাতে
কলা লাগাবে মায়ে পুতে।
কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।


ব্যাখ্যা : নির্দিষ্ট দূরত্বে কলাগাছ লাগালে তাতে ফলন ভালো হয়।

৯। লাঙ্গলে না খুঁড়লে মাটি,
মই না দিলে পরিপাটি
ফসল হয় না, কান্নাকাটি।


ব্যাখ্যা : ঠিকমত চাষ না করলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না।

১০। সবলা গরু সুজন পুত
রাখতে পারে খেতের জুত।


ব্যাখ্যা : ভাল গরু থাকলে আর চাষে ছেলের সাহায্য পেলে কৃষকের কোন সমস্যা থাকে না।

বি.দ্র. ছবি গুলি নেট থেকে সংগ্রহীত।

হারিয়ে যাওয়া মসলিন

হারিয়ে যাওয়া মসলিন

মসলিন কিংবদন্তির কোন শেষ নেই। ম্যাচ বাক্সে পুরে ফেলা যেত আস্ত একটা শাড়ি। মসলিন শব্দের উদ্ভব মসুল থেকে। ইরাকের এককালের ব্যবসা কেন্দ্র মসুলে তৈরি হতো সূক্ষ্ম সব কাপড়। ইংরেজরা মসলিন কাপড় দেখে এর নামকরণ করে মসলিন হিসেবে। ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। মসলিন রফতানি হতো ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে। শুধু তাই নয়, ইউরোপ-আফ্রিকাতেও মসলিনের চাহিদা ছিল। তেমনি মসলিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন বিদেশি পর্যটকরা।

ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাতে মুঘল আমলে সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল। প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই মসলিন কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেও সেখানে এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় এক শ’ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর ওখানে জন্মাতো উঁচুমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে ২শ’ বছর আগেও বিদেশি বণিকরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রফতানি করত। ওখানকার প্রায় দেড় হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করত ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ হারিয়ে যাওয়ার পথে। অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনো সাতশ’ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এ কাজে। মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা ও ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে।

সাধারণত, মহিলারাই সুতা কাটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার মতো পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকেলের পরে এ কাজ করা হতো। আর্দ্রতার খোঁজে অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত। একজন মহিলা এভাবে প্রতিদিন সুতা কেটেও মাসে মাত্র আধা তোলা সুতা তুলতে পারতেন। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের কারণে দক্ষ সুতা কাটুনির সংখ্যা অনেক কমে আসতে থাকে উনিশ শতকের শুরু থেকেই। জানা গিয়েছে, এই রকম সূক্ষ্ম সুতা কাটার কাজ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এতটা ভালো হতো না। এর কারণ ধরা হয় দু’টো- ঢাকার ফুটি কার্পাস আর শ্রমিকের দক্ষতা ও পরিশ্রম।

বিভিন্ন সূত্র হতে যা জানা যায়, ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা হতে কিছু মসলিন পাঠানো হয়। সেখানে এক পাউন্ড সুতা দেখানো হয়েছিল যা প্রায় আড়াইশ’ মাইল ছিল!! আরো মসলিন সম্বন্ধে, ‘মর্নিং ক্রনিকল’ পত্রিকায় লেখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখণ্ড মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স!! মসলিন তৈরির কাজটি ছিল খুবই জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তার চেয়েও বড় কথা হলো সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর আসুরিক ধৈর্য। মোটামুটি যে কয়েক ধাপ পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন। সেগুলো হলো- সুতা নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাঁধা, আর সবশেষে কাপড় বোনা। এসব শেষে একজন তাঁতি আর তার দু’জন সহকারীর লাগত কমপক্ষে দু’তিন মাস। মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হতো সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। ‘মলবুস খাস’ ছিল সবচেয়ে নামি, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার বর্তা হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রফতানি করত। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিল প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশি ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রফতানির জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন। পরবর্তী সময়ে মসলিন রফতানির ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রফতানি হতো মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগপর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করত। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতিরা দিশেহারা হয়ে ওঠে এই গোমাস্তাদের অত্যাচারে। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি কোম্পানির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই দালাল, পাইকার আর গোমস্তারাই। লোকশ্রুতি রয়েছে, ইংরেজরা নাকি মসলিন তাঁতিদের আঙ্গুল কেটে ফেলত।

চার-পাঁচশ’ বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শ’ বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল। মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী- কেউই এ শিল্প রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং চেষ্টা করেছেন কীভাবে কৃষক-তাঁতিদের শোষণ করে নিজেরা লাভবান হতে পারে। ধীরে ধীর হারিয়ে যেতে থাকে মসলিনের স্বর্ণযুগ, হারিয়ে যায় মসলিন।

মিথ … দ্বিতীয় খণ্ড শেষ

২.
একটা ভালো উদাহরন হলো ট্রয় নগরী, যাকে ঘিরে ঘরে উঠেছে হোমারের ইলিয়াড। অনেক অনেক বছর ধরে এই শহরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়, বলা হয় এটা শুধুই কল্পনা, শুধুই মিথ। ১৮৬৮ সালে আসলেই এই শহর খুঁজে পাওয়া যায়। এঁকে তখন স্থান দেওয়া হয় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এর পরেও ইলিয়াডকে ধরা হয় ফিকশন হিসেবে, ফ্যান্টাসি হিসেবে, মিথ হিসেবে।

আমরা এটাই জানলাম, যে অনেক পুরনো বলেই মিথ, মিথ্যে নয়। প্রমাণের অভাব থাকলেই মিথ, মিথ্যে নয়। মিথের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেক গল্পই আসলে সত্যি হতে পারে। এটা অবশ্য খুবই সম্ভব যে মিথ বলে প্রচলিত অনেক লোককথা আসলে মানুষের তৈরি কল্পনা। অপার বিস্ময়ের এই সৃজনশীল কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ডিভাইন কমেডি, ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত, ইত্যাদি। এ এক অসাধারণ মিথের সমাবেশ।

কিন্তু বাস্তবে চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান তৈরী হয় স্থান, কাল তথা তার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আবহাওয়া ও সভ্যতার ভিত্তিতে। স্থান, কাল পাত্র ভেদে চিন্তার ধরনও আলাদা আলাদা হয়। এগুলো অর্জন করতে হয় জীবন থেকে, সমাজ থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে। পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে শেখায়। প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতির অপার দান থেকে কিছু পাওয়ার জন্য যাযাবর জীবনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে যখন কৃষি সভ্যতার পত্তন হয় তখন থেকেই শুরু হয় অবসর আর সৃষ্টির প্রতি অপার কল্পনা ও বিস্ময়। জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে এই মিথ মানুষকে জানিয়েছে, অতীত ইতিহাস, মানুষকে আরও ভাবতে শিখিয়েছে। আর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ বিজ্ঞানকে ভাবতে শিখেছে। তখন বিজ্ঞান ও ধর্মদর্শনকে এরিষ্টটলের সামগ্রিক চিন্তার মোড়কে ভাবা হত। ধীরে ধীরে চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, বিকাশ ঘটেছে জীবনদর্শন ও বিজ্ঞানের। এরিষ্টটলকে বলা হয় Father of science, ইবনে সীনাকে বলা হয় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক, কবি হয়েও ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেন, Science is lame without religion and religion is blind without science.

মহাকবি হোমারের সময় থেকেই গ্রীসের মিথলজিই সবচেয়ে বিশদ, ব্যাপক এবং জনপ্রিয়। তারও কিছু পরে মিথ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু গ্রীসে মিথের শক্তি ও প্রভাব দুর্বল হয়ে আসে যুক্তিনির্ভর দার্শনিক আলোচনার অগ্রগতির সাথে প্যাগান ধর্মের ক্ষয় শুরু হওয়ায়। যুগে যুগে মিথের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে জানার অসীম আগ্রহ। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে জ্ঞাতে -অজ্ঞাতে মানুষ তৈরি করেছে একের পর এক মিথ। যার কোনটা একেবারেই কাল্পনিক আবার কোনটাতে আছে বাস্তব কাহিনীর সংমিশ্রণ।

‘মিথের মৃত্যু হয়েছে’ একথা খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র বিশারদ বুল্টম্যান এবং কবি ফিলিপ লার্কিন বললেও মিথের বিনাশ নেই। আসলে তার ক্ষয়ও নেই। কেননা মিথ মাঝে মাঝেই রূপান্তরের মাধ্যমে নতুনভাবে আবির্ভূত হয় যেমন হয়েছে উত্তরাধুনিক শিল্প চিন্তায়। যুক্তি এবং কল্পনা যে মাপকাঠিতেই মিথকে বিচার করা হোক না কেন এর উপস্থিতি এবং বাস্তব প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশীলতার নিদর্শন হচ্ছে মিথ। এর শিল্প মূল্য অনেক। মিথের ভবিষ্যৎ পরিণতি কি তা সময়ের বিচার। কিন্তু ধাপে ধাপে সভ্যতার যে বিকাশ এবং উৎকর্ষ ও ঐতিহ্যের স্বরূপ চিনতে পারি। এগিয়ে যেতে পারি শিল্পের নান্দনিক উৎকর্ষে। সংস্কৃতিকে দিত পারি নতুন মাত্রা।

সমাপ্ত।

7 - Sonakand Durgo (66) - Copy

জলদূর্গ

১৬৫০ সালের দিকে মোঘল আমলে যখন মীর জুমলা বাংলার সুবাদার ছিলেন তৎকালীন সময়ে সমৃদ্ধ শহর ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাকে নদী পথে আগত মগ ও পর্তুগিজ শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ও জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষ্যা করার জন্য নদীর তীরে ৩টি দূর্গ তৈরি করা হয়। এই তিনটি দূর্গকে “জলদূর্গ” বলা হতো। ৩টি জলদূর্গের ২টি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে। একটি শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড়ে “হাজীগঞ্জ দূর্গ”। অন্যটি শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে “সোনাকান্দা দূর্গ”। ৩য়টি মুন্সীগঞ্জের “ইদ্রাকপুর দূর্গ”


সোনাকান্দা দূর্গ


হাজীগঞ্জ দূর্গ


ইদ্রাকপুর দূর্গ

প্রথম তিনটি ছবি বিভিন্ন সময়ে আমার নিজের তোলা। শেষ ছবিটি গুগল ম্যাপ স্যাটেলাইট ভিউ থেকে তৈরি করেছি আমি।

পথের হদিস :
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে চলে আসুন নারায়ণগঞ্জ। বাস বা ট্রেন স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে চলে আসুন হাজীগঞ্জ কেল্লা। হাজীগঞ্জ কেল্লা দেখা শেষে খেয়া নৌকায় শীতলক্ষ্যা পার হয়ে আবার রিক্সা নিয়ে চলে যান সোনাকান্দা দূর্গে।

ঢাকা থেকে বাসে চলে আসুন মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর। মুক্তারপুর থেকে রিক্সা বা অটোরিক্সায় ইদ্রাকপুরের কেল্লা যাওয়া যায়।

মিথ … প্রথম খণ্ড

মিথ

মিথ কি? কাকে বলে? সাধারণত দেশের বা বিদেশের কালজয়ী রূপকথা, পৌরাণিক গল্প বা লোককথাকেই আমরা মিথ বলে থাকি। তা ছাড়াও এমন সব গল্পকে মিথ বলা হয়, যা আগে মানুষের মুখে মুখে গান হিসেবে প্রচলিত ছিল। তাহলে মিথ আসলে কি? কোথা থেকে মিথের উৎপত্তি? “মিথ” কথাটার অর্থই বা কি?

“মিথ” কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ Mythos থেকে, যার অর্থ হল anything uttered by a word of mouth. অর্থাৎ মুখ হতে নির্গত বা উচ্চারিত কোন কিছু “শব্দ” বা “লোককথা” বা “সত্য ঘটনা”। এ থেকে বোঝা যায় যে মূলত মানুষের মুখে মুখেই এই মিথ অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তো। এটাও বোঝা যায় এর শেকড় আসলে ছিলো সত্যের মাঝেই। মিথ শব্দটি আরও একটি শব্দের সাথে জড়িত আর তা হলো মিও, যার অর্থ “শেখানো”, অথবা “গোপন রহস্যের সন্ধান দেওয়া”।

খ্রিস্টপূর্ব ৭ম বা ৮ম শতকের দিকে মহাকবি হোমার মিথ শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি “ইলিয়াড” লেখার সময় এই শব্দ ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে তিনি একটি সত্য তুলে ধরার চেষ্টা। এছাড়া দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে mythos শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন কিছু বোঝাতে যা হয়তো বাস্তবিক সত্য নয় আবার পুরোপুরি অসত্যও নয়। মানুষ নিজে বাঁচার লক্ষে এবং নিজের কল্পনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য মিথের। নিয়ানডার্থালরা সর্বপ্রথম আত্মার এক অলীক কল্পনা মানুষের মধ্যে রোপণ করেন। সেখান থেকেও মিথের শুরু বলা যায়। এইবার প্রশ্ন হল নিয়ানডার্থাল? বা কারা? মানব বিবর্তন বা মানুষের উৎপত্তি বলতে বিবর্তন এর মাধ্যমে অন্যান্য হোমিনিড এবং বনমানুষ থেকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভবকে বোঝায়।

“মানুষ” বা “হিউম্যান” শব্দটি দ্বারা এখানে প্রকৃতপক্ষে কেবল হোমোগণ এ অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদেরকে বোঝানো হচ্ছে, তাছাড়া তখন অস্ট্রালোপিথেকাস নামে আরও এক প্রজাতিকেও ছিল। আনুমানিক ২৩ লক্ষ থেকে ২৪ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে হোমো গণটি অস্ট্রালোপিথেকাস গণ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল হোমো গণে অনেক প্রজাতিরই উদ্ভব ঘটেছিল যদিও একমাত্র মানুষ ছাড়া তাদের সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ধরণের বিলুপ্ত মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে হোমো ইরেক্টাস যারা এশিয়ায় বাস করতো এবং হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস যারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য জুুুড়ে ছড়িয়ে ছিল।

আরকায়িক হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভব ঘটেছিল আনুমানিক ৪০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ পূর্বের সময়কালের মধ্যে। আরকায়িক বলতে হোমো স্যাপিয়েন্স দের প্রাচীনতম সদস্যদের বোঝানো হয় যারা প্রজাতি গত দিক দিয়ে এক হলেও আধুনিক মানুষের চেয়ে কিছু ক্ষেত্রে পৃথক ছিল। নিয়ানডার্থালরা ছিলেন আধুনিক মানুষের প্রথম পূর্বপুরুষ, মানে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ। এঁদের অস্তিত্ব ছিল প্লাইস্টেসিন যুগে।প্লাইস্টেসিন হল ভূতাত্ত্বিক যুগের নাম। এর সময়কাল ছিল ২,৫৮৮,০০০ থেকে ১১,৭০০ বছর। ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে আনুমানিক ২ লক্ষ বছর আগে রাজত্ব করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওদের শরীর ছিল রোমশ। কিছুটা ঝুঁকে চলত। গড়ন শক্তপোক্ত। নিয়ানডার্থালরা পাথরের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র বানাত। আর ছিল অসম্ভব বুদ্ধিমান। ৭ হাজার বছর আগে ওরা বেঁচে ছিল। আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্ব থেকে নিয়ানডার্থালদের সঙ্গে আফ্রিকার হাইডেলবার্গদের সরাসরি সংযোগ ঘটেছে। এর মধ্যে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা দুটি প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ তথা আর্কায়িক দের থেকে বিবর্তিত হয়েছি। সে হিসেবে তারা আমাদের খুব নিকট আত্মীয়।

আবার আসি মিথ প্রসঙ্গে, ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ও চরিত্রের সাথে কল্পনার মিশেল মিথকে করেছে সমৃদ্ধ। তবে সময়ের সাথে সাথে এই ভাবনার বদল ঘটে। এক সময় আধুনিকতাবাদ এবং আর ওপরে উত্তরাধুনিকতাবাদে স্থান পায় এই মিথ। অনেক পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালেই কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে। লেভি ক্লদ স্ট্রস তার ‘স্ট্রাকচারাল এনথ্রপলজি ‘ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় মিথ মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। কল্পনা হল মানুষের মনের একটি মৌলিক প্রবণতা যার সূচনা দেখা যায় আদি যুগে। প্রাচীন ধর্ম ভিত্তিক ইতিহাসে মিথকে কেবল অদৃশ্য শক্তির বর্নণায়ই ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাকৃতিক ঘটনা এবং প্রাণীর জন্ম – মৃত্যু রহস্যের ব্যাখ্যার সন্ধান করা হয়েছে।

এই ব্যাখ্যা নানা কল্পিত পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে যেখানে যুক্তির চেয়ে ধারণা ও বিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছ। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনের উন্নতি ঘটতে থাকে। সত্য কি, তার ব্যাপারেই মানুষের ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে। ফলে সময়ের সাথে সাথে মিথের সংজ্ঞাও যায় বদলে। প্রথম দিকের বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা প্রচলিত মিথের সত্যতা এবং স্থায়িত্বকাল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ থেকেই চলে আসে মিথের প্রতি সহজাত একটা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস।

এর প্রায় ৪০০ বছর পরে মিথ সীমিত হয়ে যায় রূপকথা, প্রতীকী গল্প এবং ফিকশন জাতীয় গল্পে। এখনো মিথকে আমরা দেখি এভাবেই- একটা গল্প যার সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ৪০০ বছর পুরনো একটা গল্প যে আসলেই মিথ্যা না কি সত্যি- সেটাই বা প্রমাণ করা যাবে কিভাবে? এটাও তো হতেই পারে যে একটা সময়ে বিভিন্ন সত্য ঘটনা মানুষ মিথের মাধ্যমেই প্রকাশ করতো- এবং তা বিশ্বাসও মিথোলজিতে থাকা এমন কিছু ঘটনা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যাকে মানুষ নিছকই রূপকথা মনে করতো।

(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)

KB-01- 00

খনার বচন – ২

খনা ও খনার বচন সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কম বেশী ধারণা আছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অনেকেই ধারনা করেন এগুলি কোন একক ব্যাক্তির লেখা নয়, বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের বলা বা লেখাগুলি খনার নামে প্রচলিত হয়েছে। যাইহোক, এই বিতর্কে না যাই।

আমাদের পরিচিতো অনেক খনার বচন আছে, সেখান থেকে কিছু কিছু বচন এখানে শেয়ার করবো ব্যাখ্যা সহ।

১। উঠান ভরা লাউ শসা,
খনা বলে লক্ষ্মীর দশা।

ব্যাখ্যা : যে বাড়ির উঠানে বাড়ির বৌঝিরা সবজী ফলায় সেই বাড়িতে কখনোই অভাব দেখা দেয় না।

২। যে চাষা খায় পেট ভরে
গরুর পানে চায় না ফিরে
গরু না পায় ঘাস পানি
ফলন নাই তার হয়রানি।

ব্যাখ্যা : নিজের গরুর যত্ন না নিয়ে শুধু আরাম আয়েশে ঢুবে থাকলে সেই কৃষকের কপালে হয়রানির শেষ নাই।

৩। যদি বর্ষে ফাল্গুনে
চিনা কাউন দ্বিগুণে।

ব্যাখ্যা : ফালগুন মাসে বৃষ্টি হলে চিনা আর কাউনের ফলন ভালো হয়।

৪। সকাল শোয় সকাল ওঠে
তার কড়ি না বৈদ্য লুটে

ব্যাখ্যা : রাতের বেলা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে সকাল সকাল উঠে পড়লে শরীর সুস্থ থাকে।

৫। যে করে পরের আশ
সে খায় বনের ঘাস।

ব্যাখ্যা : কাজ না করে অন্যের আশায় বসে থাকলে কপালে খাবার জোটে না।

৬। হাত বিশ করি ফাঁক
আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ

ব্যাখ্যা : আম আর কাঠাল গাছ লাগানোর সময় ২৫/৩০ ফুট দূরে দূরে লাগাতে হয়।

৭। আউশ ধানের চাষ,
লাগে তিন মাস।

ব্যাখ্যা : আউশ ধান চাষ করলে ৩ মাসেই ফসল ঘরে তোলা যায়।

৮। বাঁশের ধারে হলুদ দিলে,
খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে।

ব্যাখ্যা : বাশ ঝারের ধারে হলুদের চাষ করলে তার ফলন ভালো হয়।

৯। সকল গাছ কাটিকুটি
কাঁঠাল গাছে দেই মাটি।

ব্যাখ্যা : কিছু কিছু গাছ আছে যেগুলির ডাল কেটে দিলে ফলন ভালো হয়। কিন্তু কাঠালের বেলা তার উলটা। ফলন ভালো পেতে হলে কাঠাল গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে নতুন মাটি দিয়ে দিতে হয়।

১০। হালে নড়বড়, দুধে পানি
লক্ষ্মী বলে ছাড়লাম আমি।

ব্যাখ্যা : যে কৃষকের চাষের হাল নড়বড়ে, দুধের সাথে পানি মিশায় সেই কৃষকের উন্নতি হয় না।

বি.দ্র. ছবি গুলি নেট থেকে সংগ্রহীত।

আমি ঢাকা মহানগরী


১৮৭২ সালে ঢাকা কলেজ

বর্তমান ঢাকা কলেজ

এই যে আজকে আপনারা বসবাস করছেন আমার বুকে এই আমি ঢাকা মহানগরী। এক সময় কিন্তু আমি এত বড় ছিলাম না। নবাবদের আমলে মাত্র কয়েকজন নবাব বাড়ির নায়েব, গোমস্তা আর খানসামারা এখানে বসবাস করত এবং তাদের সেবা যত্নের জন্য কামার, কুমার, নাপিত ধোপা, স্বর্ণকার, তাঁতি, গোয়ালা, ময়রা এমনি যাদের প্রয়োজন তেমনি কয়েক ঘর জনবসতি ছিল। সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় চারশো পঞ্চাশ বছর হবে। আমার চারিদিকে ছিল খাল বিল নদী নালা এমনি সব কিছু, হ্যাঁ হ্যাঁ, ধান ক্ষেতও ছিল। ওই যে বুড়িগঙ্গা নদী, সে যে কি সুন্দর নদী ছিল তা বলার নেই। নবাব বাড়ির আশপাশ থেকে এসে রাজহাঁস গুলি যখন নদীর বুকে সাতার কাটত কি সুন্দর ছিল সে দৃশ্য। পানসী নৌকা, নবাবদের বজরা ছোপাত ছোপাত বৈঠা তুলে বেয়ে যেত সে দৃশ্য ছিল দেখার মত। এগুলি আবার কখনও পাল তুলে যেত তখন আরও বেশি সুন্দর লাগত, নানা রঙ বেরঙের পাল দেখতে যে কি সুন্দর ছিল তা আর বলার নয়। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কতজনে এই দৃশ্য দেখত! বজরা বা পানসী থেকে ঘাটে নেমে বেশিরভাগই যেত ঘোরার গাড়ি করে। সাধারণ মানুষেরা যেত এক্কা গাড়ি করে। গরুর গাড়িও ছিল আবার হাতে টানা রিকশাও ছিল অনেক।

নবাব বাড়ির মেয়েরা তাতি বাজারে গয়না বানাতে যেত, তারা বেশির ভাগই আসত ঘোরার গাড়িতে চেপে। অল্প কিছু পাকা রাস্তা ছিল। নবাব বাড়ির সৈন্যরা যখন ওই পাকা রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে যেত ভারি সুন্দর লাগত। লোকজনে চেয়ে দেখত তাদের। সবারই একরকম পোষাক, এক রকম তরবারি হাতে, মাথায় এক রকম পাগড়ী। সন্ধ্যার পরে রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে দিত। সে সব দিন ছিল সুখের দিন শান্তির দিন। মানুষ কত ভাবেই যে উৎসব করত যেমন শবে বরাত, রমজান এবং তারপরে ঈদ, দুর্গা পূজা, কালি পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা। এ ছাড়া বার মাসে তের পাবন লেগেই ছিল। নবান্ন উৎসব, বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব, নৌকা বাইচ এমনি কত কি! সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে লোক জনেরা আমার বুকের উপর দিয়ে হেটে বেড়াত বাচ্চারা কত খেলাধুলা করত! কি আনন্দ ছিল! দেশের নানা জায়গা থেকে নৌকা করে কত মালামাল লোকজন আসত যেত। সদরঘাটে সবসময় হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকত।

একদিন দেখলাম কোথায় থেকে ফিরিঙ্গী না কি যেন বলে তারা এসে হাজির। ইংরেজিতে ট্যাঁস টুস করে কথা বলত। আস্তে আস্তে তাদের অনেক লোকজন এসে আমার বুকে ডেরা বাধতে শুরু করল। সে যে কি ভয়ংকর দিন গেছে সে কথা মনে হলে আজও আমার বুক কেপে উঠে। দেশের মানুষ যারা ওদের কথামত চাষ বাস কাজ কর্ম করত না তাদের ধরে এনে চাবুক দিয়ে যে কি মারাই মারত সে সব চাবুক দেখলেও ভয় হতো। শুরু হলো রক্তের বন্যা, এত রক্ত আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এইতো শুরু হলো অত্যাচার। তবে ওই ফিরিঙ্গীরা কিছু ভাল কাজ করেছিল। আমার উপর দিয়ে বেশ কিছু রাস্তা বানিয়েছিল, স্কুল কলেজ বানিয়েছিল। ওদের দেখাদেখি অভিজাত এবং ধনী পরিবারের লোকজনেরা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বানিয়েছিল। তারপরের ইতিহাস বড়ই করুণ। যখন তাদের অত্যাচার চরমে পৌঁছল তখন এদেশের যুবকেরা একে একে জেগে উঠল। অনেক চোরাগোপ্তা আক্রমণ, শাস্তি আরও কত কি হলো! অনেক দিন পরে দেখলাম ওই ব্যটা ফিরিঙ্গীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু ওরা পালালে কি হবে ওদের জায়গায় যারা এলো তারা আরও ভয়ংকর। পাঞ্জাবী না কি যেন বলত। কেমন করে কথা বলত। একদিন শুনলাম আমাদের এখান থেকে ওরা সমস্ত সম্পদ নিয়ে অনেক দূরে নাকি ওদের দেশ সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে ওরা আবার এক হুকুম জারি করল, কেও বাংলায় কথা বলতে পারবে না। আচ্ছা বলুনতো, বাংলায় কথা বলা যাবে না এটা আবার কেমন কথা? জন্ম থেকে যে ভাষায় কথা বলে আসছে সেই কথা কি ইচ্ছে করলেই বন্ধ করা যায়? এইতো শুরু হলো এক যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ত তারা সহ সকল ছাত্র ছাত্রী মিলে এর প্রতিবাদ করল আর ফলাফল যা হবার তাই হলো। পাঞ্জাবীরা নির্বিচারে গুলি শুরু করল। কতজন মারা গেল। বয়ে গেল রক্ত স্রোত। তাদের কথা মনে রাখার জন্য শহীদ মিনার হলো। আজও তাদের কথা কেও ভুলেনি আর কোনদিন ভুলবেও না। তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। সবই হয়েছে আমার বুকের উপরে। এমনি করে নানা অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন শেখ মজিবর রহমান দল সংগঠন করা শুরু করল। ক্রমে সে যখন শক্তিমান হলো তখন একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিল আর অমনিই সারা দেশবাসী তার আহবানে সারা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। যুবকেরা ট্রেনিঙের জন্য চলে গেল পাশের দেশে। ওদিকে ওই পাঞ্জাবীরা শুরু করল বাঙালি নিধন অভিযান।

আমার উপরে ছাত্র ছাত্রীদের যত হল হোস্টেল, পুলিশ নিবাস ছিল সে গুলিসহ পথে ঘাটে শুরু করল ট্যাংক মেশিন গান দিয়ে গুলি করা। কত মানুষ যে মরল তার কোন হিসাব নেই। অনুমান করে বলছি, কয়েক লক্ষতো হবেই। যারা সুযোগ পেল তারা আমার আশ্রয় ছেড়ে চলে গেল, যার যেখানে সুবিধা। সেদিন আমার যে কি কান্না পেয়েছিল! কিন্তু আমি কাওকে কিছু বলতে পারিনি। আমিই তাদের বলে দিলাম তোমরা যে যেখানে পার চলে যাও। আমি আর তোমাদের বুকে আগলে রাখতে পারছি না, আমার উপরে হায়েনার আসর হয়েছে। আমি নিজেই বিপদগ্রস্ত। কয়েকদিন আগে থেকেই ওদের সেনা দলে আমার বুক ভারি করে ফেলেছে। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পাপে ভরা। ওরা যেমন খুশি তেমনি চলা ফেরা করছে। আমার বুকে বয়ে যাচ্ছে রক্ত নদী। যাকে খুশি তাকে মারছে সম্পদ লুটে নিচ্ছে কেও দেখার নেই কেউ প্রতিবাদ করার নেই। সকল বিদেশীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করে দিল। সংবাদ সংগ্রহের জন্যে কেও আসতে পারেনি। আমার বুকে বাস করে আমার আলো বাতাস জল নিয়ে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের কিছু অমানুষ আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ওই পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মেলাল। আহ! কত অনাচার অবিচার জুলুমই যে ওরা করেছে তা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারা শহর আতংকে ছিল। যখন তখন গোলাগুলি হয়েছে, তখন এক বিভীষিকাময় দিন গেছে। কোন ভাবে কাজকর্ম সেরেই মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। কাজে বের হবার পর বাড়ির মানুষ ভাবতেও পারেনি সে আবার সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।

এভাবেই চলে গেল নয়টা মাস। একদিন পাশের দেশ থেকে সৈন্য এলো আর তাদের কাছে এখানে যারা অত্যাচার করছিল তাদের প্রধান আত্মসমর্পণ করল। এই দেশ স্বাধীন হলো। আমার ইতিহাসের আর এক অধ্যায় শুরু হলো। আমার বুকে বসে কত পরিকল্পনা হয়েছে, কত আলাপ আলোচনা হয়েছে, কত আশা উদ্দীপনা হয়েছে তা মনে হলে আজ মনটা ভরে যায়। শুরু হলো আমার বুকে আর এক খেলা। আমার বুকে নতুন বড় বড় রাস্তা ঘাট তৈরি হলো, কত সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় ভরে গেল। গন ভবন হলো, বঙ্গ ভবন হলো, সংসদ ভবন হলো। এমনি আকাশ ছোঁয়া কত দালান হলো। আমাকে এদেশের রাজধানী বানানো হলো। আমাকে মহানগরীর মর্যাদা দেয়া হলো। একটুখানি জায়গার কত দাম হলো, আমার আকার পরিধি কত বেড়ে গেল। কয়েক হাজার থেকে এখন আমার বুকে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। কত রঙ বেরঙের গাড়ি চলছে। গাড়ি চাপা পড়ে কত মানুষ প্রতিদিন মরছে কে তার হিসাব রাখে আর কেই বা তার বিচার করে? গাড়িতে গাড়িতে আমার সমস্ত রাস্তা ভরে আছে। শুধু গাড়িতে পা দিয়ে দিয়ে যাত্রা বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে বসে থাকে। কাজের কত ক্ষতি হয় কত তেল গ্যাসের অপচয় হয় কেও দেখে না। রাজা মহারাজারা এদিক ওদিক যাবার সময় শহর বাসির সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পথে বসিয়ে রেখে কত আনন্দ পায়। দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে দেখছি যেই আমার বুকে আসে সেই হনুমান হয়ে যায়। আমার মনে কোন শান্তি পাচ্ছি না। কেও আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কত মিছিল দেখেছি, কতি শ্লোগান শুনছি, ভিন্ন মিছিলের ভিন্ন ভিন্ন শ্লোগান। হরেক রকম ভাষা, হরেক রকম উদ্দেশ্য, কত কি যে হচ্ছে! এতদিন ভিন দেশিরা এখানে অন্যায় অনাচার করেছে এখন শুরু হয়েছে নিজেদের অনাচার। এত অনাচার আমি কি করে সহ্য করি? জনসাধারণের সংসদ ভবনে বসে যাকে তাকে অশ্রাব্য গালাগালি করছে। জুতা ছোড়া ছুরি করছে! ছি! ছি! কি লজ্জা!

আমার বুকের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যেয়ে কত পাপ করছে। বিধাতা এই পাপ কেমনে সইবে ভেবে অস্থির হই। মানুষ খুন করা, ধর্ষণ করাতো এখন মামুলি ব্যাপার এতে আর এখন আমি আঁতকে উঠি না। কত বিচিত্র ভাবে নৃশংস উপায়ে মানুষ খুন করছে, গুম করছে। আহা! তাদের পরিবারের কি আহাজারি! সে আর আমি সইতে পারছি না! মানুষ এত নৃশংস এত জঘন্য পিশাচ কি করে হয় ভেবে পাই না। শুনেছি বনের হিংস্র পশুরাও নাকি এমন হয় না। মেয়েরা যে ভাবে চলাফেরা করে তাতে আমার ভারি লজ্জা লাগে, আমি ওদের দিকে তাকাতে পারি না। পুরুষেরা সন্ধ্যার পর ওত পেতে থাকে কখন মেয়েরা আসবে! দেহ ব্যবসা করার জন্য কত বড় বড় লোকেরা তাদের মাইনে দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে আবার ওদিকে মঞ্চে উঠে দামি দামি মন ভেজানো কথা বলে। যে সব মেয়েরা স্বাধীন ভাবে এই ব্যবসা করে তারা এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে না তারা অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেয়।

কত জন্ম হয়েছে কত মৃত্যু হয়েছে এই আমার বুকে। এক দিকে আনন্দ হাসি উচ্ছ্বাস আবার আর এক দিকে শোক কান্না। প্রতিদিন কত লঞ্চ, জাহাজ, বাস, কোচ, প্লেন ছেড়ে যায় আবার কত আসে কেও তার হিসেব জানে না। আমার বুকে একটু আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে কত মানুষ আসছে, রোজগারের জন্য একটু ভাল থাকার জন্য। রাস্তার ফুটপাথে মানুষ গিজগিজ করে, কিন্তু আমি সবার মনের আশা পূরণ করতে পারছি না। রাস্তায় কত বাস চলে কিন্তু তবুও মানুষের ভিড় কমে না। এত মানুষ কেন আসে? মানুষের লোভ লালসা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, কেও আর অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের অভিলাষ এত উঁচু কেন হলো?

চকচকে কর্পোরেট কালচার নামে বৈধ উপায়ে নির্লজ্জের মত লোক ঠকাবার, কর্মচারীদের ঠকাবার জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা আমদানি হয়েছে। শ্রমিক কর্মচারীদের ঠকিয়ে, এ ওকে ঠকিয়ে ফাকি দিয়ে মেরে কেটে কতজনে শত শত কোটি টাকা জমা করছে, টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। ব্যাংকও সে টাকা রাখার জায়গা পায় না অথচ আমার বুকেই কত শিশুকে দেখি খাবার না পেয়ে আস্তা কুড়ে খাবার খুঁজছে। কতজনে ফ্রান্স থেকে পানি এনে পান করে আবার কতজন রাস্তার ফুটপাথে রাত কাটায়। এত টাকা দিয়ে কি করবে ওরা? এই উন্নয়নশীল দেশে এত চাকচিক্যের কি এমন প্রয়োজন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিনে দিনে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে! কি লজ্জা! আমি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর! কিন্তু কারা আমাকে নোংরা করছে? আমাকে নোংরা করে তারা কেমন করে ভাল থাকছে?

যারা আইন রক্ষা করবে তারাই আজ আইনের তোয়াক্কা না করে জঘন্য অপরাধে, পাপ কাজে, অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে। কেও তাদের বিচার করছে না। সবাই শুধু নিজের কথা, নিজের ক্ষমতা-লোভের কথা ভাবছে। আমার বুকে বসেই ওই পাঞ্জাবী ইয়াহিয়া খান বলেছিল আমি ইস্ট পাকিস্তানের মানুষ চাই না শুধু মাটি চাই। এখনও সেই রূপ দেখছি, যারা শাসন করছে তাদের এমন মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।
আসলে আমার কোন পরিবর্তন হয়নি আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি শুধু পাপের প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়েছে, পাপের পথ পরিবর্তন হয়েছে এবং পাপের ওজন ভারি হচ্ছে। মানুষের আমোদ প্রমোদের ধরণ বদলে গেছে। সেদিন দেখলাম কয়েকজন বন্ধু সারাদিন কাজ কর্ম সেরে রাতে ক্লাবে মিলিত হয়ে ইচ্ছে মত মদ পান করে সবাই যার যার গাড়ির চাবি টেবিলের উপরে রাখল এবং এক এক করে চোখ বন্ধ করে সামনে রাখা চাবি থেকে একটা চাবি তুলে নিল, যার হাতে যে চাবি আসল সে রাতের জন্য সে ওই গাড়ি যার তার বাড়িতে যেয়ে তার স্ত্রীর সাথে রাত কাঁটালো। এমন বিকৃত মানসিকতা এবং বিকৃত রুচি আমার বুকে আগে কখনও দেখিনি।
আমার ভীষণ ভয় করে! মাঝে মাঝে লজ্জায় ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার বুকে নিরীহ সাধারণ মানুষ যারা বাস করে তাদের কি হবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আমি আর পারছি না বিধাতা! আমাকে রক্ষা কর! আর কত পাপ আমাকে দেখতে হবে? হে বিধাতা তুমি কোথায়? আমাকে রক্ষা কর! মানুষের মনে শান্তি দাও!

KB-01- 00

খনার বচন – ১

খনা ও খনার বচন সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কম বেশী ধারণা আছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অনেকেই ধারনা করেন এগুলি কোন একক ব্যাক্তির লেখা নয়, বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের বলা বা লেখাগুলি খনার নামে প্রচলিত হয়েছে। যাইহোক, এই বিতর্কে না যাই।

আমাদের পরিচিতো অনেক খনার বচন আছে, সেখান থেকে কিছু কিছু বচন এখানে শেয়ার করবো ব্যাখ্যা সহ।

১। আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো
ধান লাগাও যত পারো।


ব্যাখ্যাঃ আষাঢ় মাসের ১৫তারিখ থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ধান লাগানোর উপযুক্ত সময়।

২। পটল বুনলে ফাগুনে
ফলন বাড়ে দ্বিগুণে।


ব্যাখ্যাঃ ফালগুন মাসে পটল চাড়া বুনলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

৩। শোনরে বাপু চাষার পো
সুপারী বাগে মান্দার রো।
মান্দার পাতা পচলে গোড়ায়
ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়।


ব্যাখ্যাঃ মান্দর গাছে প্রচুর পাতা হয় এবং একটা নিদৃষ্ট সময় পর সেই পাতা ঝরে পরে। সুপারী বাগানে মান্দর গাছ লাগালে তার পাতা পচে ভালো জৈবসার হয়, এর ফলে সুপারি ফলন ভালো হয়।

৪। গাছ-গাছালি ঘন রোবে না
গাছ হবে তাতে ফল হবে না।


ব্যাখ্যাঃ ঘন করে গাছ লাগালে সেখান থেকে আশানুরুপ ফলন হয় না। তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা করে গাছ লাগাতে হয়।

৫। সুপারীতে গোবর, বাশে মাটি
অফলা নারিকেল শিকর কাটি।


ব্যাখ্যাঃ সুপারী গাছের গোড়ায় গোবর (জৈব সার) আর বাশের গোড়ায় মাটি বেশী থাকলে তা ফলনের জন্য ভালো। আর ডাব বা নারকেল গাছে ডাব না হলে সেই গাছ কেটে ফেলাই ভালো।[/quote]

৬। বিপদে পড়ে নহে ভয়
অভিজ্ঞতায় হবে জয়


ব্যাখ্যাঃ বিপদে পড়েই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, আর অভিজ্ঞতার বলেই বিপদকে জয় করা যায়। তাই বিপদে ভয় পেতে নেই।

৭। কপালে নাই ঘি,
ঠকঠকালে হবে কি!


ব্যাখ্যাঃ নিঃষ্ঠুর নিয়তি। ভাগ্যে না থাকলে কিছুই পায়া যায় না। (যদি আপনি ভাগ্যে বিশ্বস করেন।)

৮। খনা বলে শুনে যাও
নারিকেল মুলে চিটা দাও
গাছ হয় তাজা মোটা
তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।


ব্যাখ্যাঃ অনেক আগে, সেই ছোট বেলায় দেখেছি- ধান মাড়ানোর পরে যে চিটা ধান (যে ধানের ভিতরে চাল হয় না) পাওয়া যেত, সেগুলি ছোট নারকেল চারার গোঢ়ায় দিয়ে দিতো। এখানে হয়তো এটার কথাই বলা হয়েছে।

৯। ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান।


ব্যাখ্যাঃ বৃষ্টি হবার আগে আগে ব্যাঙগুলি অবিরাম ডাকতে থাকে। অর্থাৎ ব্যাঙ ঢাকা ঢাকি শুরু করলে বঝতে হবে বৃষ্টি আসবে।

১০। শোনরে বাপু চাষার বেটা
মাটির মধ্যে বেলে যেটা
তাতে যদি বুনিস পটল
তাতে তোর আশার সফল।


ব্যাখ্যাঃ বেলে মাটিতে পটলের ফলন সবচেয়ে ভালো হয়।

বিশ্বের পরিকল্পিত যত রাস্তাঘাট

পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে পথগুলো হয় ভীষণ পরিকল্পিত। হরেক রকম গাড়িতে ঠাসা কয়েক লেনের সোজা, প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার পাশের বিচিত্র ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট এই রাস্তাগুলোর চিরাচরিত চেহারা। কিন্তু বড় বড় শহরেই আবার এমন সব রাস্তাঘাট আছে যেগুলোর চেহারা একেবারেই অন্যরকম। বিচিত্র আর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের এই রাস্তাগুলো দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট, নিউজিল্যান্ড।
নিউজিল্যান্ডের নতুন শহর ডুনেডিনের নগর পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল লন্ডনের ডিজাইনারদের। তারা ডুনেডিনের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে পুরো শহরের সব রাস্তা তৈরি করেছিল গ্রিড প্যাটার্নে। ফলে এই শহরের অনেক রাস্তা খাড়া পর্বতের ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে রাস্তাগুলো হয়েছে ভীষণ খাড়া। ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে খাড়া। পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া রাস্তা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সবচেয়ে সোজা খাড়া সড়ক হিসেবে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট। অনেকেই অবশ্য একে সবচেয়ে খাড়া রাস্তা হিসেবে মানতে রাজি নন। তাতে কি? এর চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত একটি পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ আছে। পর্যটকের ভিড় থাকায় অনেকে এখানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা আদায় করেন। জোকার আর দর্শকের চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখরিত থাকে ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট।

লাম্বার্ড স্ট্রিট, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত শহর স্যানফ্রান্সিসকোয় অবস্থিত লাম্বার্ড স্ট্রিট বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাঁকানো রাস্তা হওয়ার কারণে। স্যানফ্রান্সিসকোর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে রাস্তা তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। লাম্বার্ড স্ট্রিট তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল যার কাঁধে তিনি এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন এবং বেশ ভেবে-চিন্তে রাস্তাটির পরিকল্পনা করেন। তিনি ভেবে দেখেন যে, সড়কটি যদি সোজা করে তৈরি করা হয় তাহলে অনেক খাড়া হবে যার ফলে রাস্তাটি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তাই তিনি রাস্তাটিকে আঁকাবাঁকা করে বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন লাম্বার্ড স্ট্রিট। এই সড়কটির সঙ্গে কিন্তু স্যানফ্রান্সিসকোর ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। লাম্বার্ড স্টিটের নামকরণ করা হয়েছে ফিলাডেলফিলার এক ব্যক্তির নামে। লাম্বার্ড স্ট্রিট অনেক দীর্ঘ একটি রাস্তা। রাশিয়ান হিলের চূড়ায় খাড়া অংশে এর একটিমাত্র ব্লকই কেবল বাঁকানো। বাঁকানো অংশে রয়েছে হেয়ারপিন প্যাটার্নের ৮টি বাঁক। প্রতিটি বাঁকে রয়েছে সুন্দর করে ছাঁটা ফুলগাছের নান্দনিক শোভা। রাস্তার পাশের রাশিয়ান হিলের রাজকীয় ম্যানশনগুলো রাস্তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমব্রেলা স্ট্রিট, পর্তুগাল
পর্তুগালের এগুইডা শহরের একটি সরু গলি। বছরের একটি বিশেষ সময়ে গলির আকাশে রংবেরঙের ছাতার প্রদর্শনী লক্ষ্য করা যায়। বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। তারই অংশ হিসেবে এই ছাতাগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়। দেখে মনে হয়, এই বুঝি উড়ে চলে গেল ছাতা। কিন্তু যায় না। কারণ ছাতাগুলো তার দিয়ে বাধা থাকে। ছাতাগুলো রাস্তায় চলতে থাকা পথিকদের কাঠফাটা রোদ্দুরে শীতল ছায়াই দেয় না শুধু, এর বর্ণিল রঙের সৌন্দর্য দিয়ে মনও রাঙিয়ে দেয়। খুব বেশিদিন হয়নি এই উৎসব চালু হয়েছে, এরই মধ্যে ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা পৃথিবীতে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই রাস্তা দেখতে তাই পর্তুগালে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে।

ব্লু স্ট্রিট, মরক্কো
আফ্রিকা মহাদেশের আটলান্টিক পাড়ের দেশ মরক্কোর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে রয়েছে জাদুকরী এক শহর। শহরটির নাম শেফশাওয়ান। এই শহরের বাড়িঘরের দেয়াল, দরজা, এমনকি রাস্তাঘাটও নীল রঙে রাঙানো। স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিচিত্র এই শহরের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে এই শহরের নীল নামকরণের ব্যাখাও পাওয়া যায়। মুসলমানরা স্পেন অধিকার করলে স্পেন থেকে অনেক ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে আসে। এদের কেউ কেউ মরক্কোতে আসে এবং শেফশাওয়ান শহরে বসতি গড়ে।

তাদের ঐতিহ্য ছিল দেয়াল, রাস্তাঘাট নীল রং করে রাখা। আকাশের নীল রঙের অনুকরণে তারা মর্ত্যরে বাড়িঘরে, রাস্তাঘাটেও নীল রং করত। এটি নাকি তাদের ঈশ্বরের শক্তির কথা মনে করিয়ে দিত। সেই ঐতিহ্য আজও প্রচলিত আছে এবং শহরটিকে আজকের বিখ্যাত ‘ব্লু সিটি’তে পরিণত করেছে।

দ্য জুলিও স্ট্রিট, আর্জেন্টিনা
প্রত্যেকটি বড় শহরের একটি প্রধান রাজপথ থাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের প্রধান রাজপথ হচ্ছে নাইন দ্য জুলিও স্ট্রিট। এটি পৃথিবীর প্রশস্ততম রাজপথ হিসেবে পরিচিত। আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে সড়কটি নির্মিত হয়। ১৮১৬ সালের ৯ জুলাই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সড়কের নাম নাইন দ্য জুলিও স্ট্রিটও রাখা হয়েছে দেশটির স্বাধীনতা দিবস অনুসারেই। সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩০ এর দশকে এবং সমাপ্ত হয় ১৯৮০ সালে। ১৪০ মিটার প্রশস্ত, ১৮ লেনের এই রাজপথের কেন্দ্রে রয়েছে ৭০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সূচালো স্মৃতিস্তম্ভ।

ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতি জ্বললে রাস্তায় বাজিকর, আগুনখেকোসহ বিচিত্র রকমের পথশিল্পীদের নানা কীর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সড়কটি দেখতে গিয়ে আপনি যদি ব্যস্ত শহরের শব্দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যান তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। পুরো রাস্তাজুড়ে রয়েছে গুল্মঘেরা চত্বর এবং পার্ক। সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহে সাজানো পার্কগুলোতে বসার জন্য বেঞ্চও আছে, যাতে আপনি বসে বসে পুরো সড়কে ঘটতে থাকা সব ঘটনাই দেখতে পাবেন।

ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট, ইংল্যান্ড
লন্ডনের সুইনডনে অবস্থিত ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট পৃথিবীর সবচেয়ে বিভ্রান্তকর রাউন্ড এবাউট। অনেকগুলো রাস্তা এসে যখন একটি বৃত্তাকার রাস্তায় মিলিত হয় তখন এই বৃত্তাকার সংযোগ¯’লকে রাউন্ড এবাউট বলে। ম্যাজিক রাউন্ড এবাউটের কেন্দ্রে একটি বড় রাউন্ড এবাউটকে ঘিরে পাঁচটি ছোট রাউন্ড এবাউট রয়েছে। ১৯৭২ সালে নির্মিত এই রাউন্ড এবাউটের নাম নেয়া হয়েছে ব্রিটেনের একটি শিশুতোষ টিভি সিরিজ থেকে। এই রাউন্ড এবাউটটি সুইনডনের যানজট অনেকটাই হ্রাস করেছে। বিশ্বজুড়ে আরো নানারকম অদ্ভুত রাস্তা আছে। যেমন- সুইজারল্যান্ডের জিওমেট্রিক স্ট্রিট। এই রাস্তার পাশের দেয়ালে রয়েছে রংবেরঙের জ্যামিতিক নকশা। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের পিঙ্ক স্ট্রিট আরেক অদ্ভুত সড়ক। এখানে পুরো রাস্তাটাই গোলাপি রং করা। অদ্ভুতুড়ে এসব রাস্তাঘাট সেসব দেশ আর শহরকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে আর পর্যটকদের উপহার দিয়েছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের আধার। সুযোগ পেলে রাস্তাগুলো ঘুরে দেখতে ভুলবেন না!

আজ জন্মাষ্টমী … হ্যাপি বার্থডে টু কৃষ্ণ

হ্যাপি বার্থডে টু কৃষ্ণ, আর হ্যাঁ আজ কিন্তু যোগমায়ারও বার্থ ডে। ওর জন্য কিছু পুজো করার নিয়ম নেই? আসলে, যুগ যুগ ধরে কন্যা সন্তানের বলি দেওয়ার ওপরেই পুত্র সন্তানের ইমারত গড়ে ওঠে। তর্কের খাতিরে নয়, আমরা সবাই অল্প বিস্তর আমাদের হিন্দু মাইথলজি পড়েছি। তাদের কেউ কেউ দেবতা হিসেবেও পূজিত হন।

এদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয়, আন্তর্জাতিক ভাবেও তাঁর নাম কৃষ্ণ। তাঁকে আমরা পুজো করি। ‘‘প্রাচীন প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমী উৎসব শুরু হয় চাঁদ দেখে সন্ধ্যায়। পুজো চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আমরা যখন পড়ি শ্রীরাধিকা কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর। চিরসখা তার কৃষ্ণ। এখানেও শেষে দেখা যায় রাধার sacrifice, কারণ প্রাণের বন্ধুটি এক সময় তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তারপর রাধার শেষ পর্যন্ত কি হলো সেই খবর কিন্ত আমরা রাখিনি। বরং বলা ভালো জানিনা।

আজ জন্মাষ্টমী, আমাদের যেসব বাড়িতে আজ তিনি পূজিত হবে সেইসব বাড়িতে সকাল থেকেই নানা আয়োজন। তিনি কি খেতে পছন্দ করেন। সেইসব রান্নার ধুম পড়ে গেছে। তালের বড়া, মালপোয়া, আহা! জিবে জল আনা সেইসব খাবার।

এইবার একটু জন্মাষ্টমী ব্যাপারটা আর একবার ঝালিয়ে নিই।

হাজার হাজার বছর আগের কথা। তখনকার সময়কে বলা হতো দ্বাপর যুগ। কথিত আছে যে অসুর রাজারা ছিলো খুবই অত্যাচারী (যদিও এটা নিয়েও সন্দেহ আছে যে সত্যিই অসুর রাজারা অত্যাচারী ছিলেন কিনা।) তাদের অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এতই বেশী হয়ে উঠে যে দেবদেবীগণ ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করতে লাগে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র ব্রহ্মাকে অবগতির জন্য দৈববাণীতে বলে, “হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি যদুবংশীয় রাজাদের রাজধানী মুথরা রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হবো। ধরিত্রী দেবসহ তোমরা আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা এবং ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করবে।”

তখন উগ্রসেন নামে মথুরার এক রাজা ছিলো। রাজা ছিলো প্রচণ্ড রকমের ধার্মিক। কিন্তু রাজা ধার্মিক থাকলে কি হবে, তার ছেলে কংস ছিল খুবই অত্যাচারী। কংসের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যে নিজের পিতা উগ্রসেনকেও সিংহাসনচ্যুত করে কারাবন্ধী করে নিজেই মথুরায় রাজত্ব করতো। আবার এই কংসই আরাধনা করে বর লাভ করেছিল, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ছাড়া অন্য কোন ভাবে তার মৃত্যু হবে না। আর এ জন্যই কংসের অত্যাচারের মাত্রাটাও এত বেশী ছিলো। দেবকীর বিবাহ হয় বসুদেবের সঙ্গে। রথের উপর বসানো হয়েছে এবং রথের সারথী হচ্ছে কংস। রথ চলছে এমন সময় হঠাৎ করে সেই দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠলো, “ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছো তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণ হরণ করবে।” দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যোত হলো। এ দেখে বসুদেব কংসকে অনেক সবিনয় অনুরোধ করে রাজী করালো এই বলে যে, তাদের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কংসের হাতে দিতে দেওয়া হবে। একথা শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।

মাঝখানে কেটে গেল অনেক বছর। একে একে জন্ম নিলো ছয়টি সন্তান। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পরই কংস আসে এবং বসুদেব পূর্ব প্রতিশ্রতিমতো নিজেদের সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেয়। আর কংস সঙ্গে সঙ্গে পাথরে আছাড় দিয়ে সন্তানটিকে মেরে ফেলে। সপ্তম গর্ভের সন্তান যখন বলদেব অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তখন ভগবানের নির্দেশে যোগমায়া দেবী দেবকীর গর্ভ হতে তাকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করে এবং প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে। এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা।

কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস এবারও আরও বেশী পাহারার ব্যবস্থা করলো। মাস ছিলো ভাদ্র, তিথি ছিলো অষ্টমী এবং রজনী ছিলো ভীষণ দুর্যোগময়। প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্যরকম মূর্তি, বিদ্যুৎ উচ্ছ্বলিত ঠিক এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন এবং দৈববানী শোনা যায় “বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে গিয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে রেখে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পাবে না।” সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বসুদেব ছুটতে লাগলো নন্দের বাড়ীর দিকে। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল তাই যমুনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। তখন বসুদেবের নিরুপায় মনে হলো। হঠাৎ করে বসুদেব দেখলো যমুনার জল শুকিয়ে গিয়েছে এবং একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। বসুদেব তখন ঐ রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলো। এমন সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো তাদের মাথার উপরে। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এল।

সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে একই ভাবে পাথরের উপরে আঁছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে যেয়েই যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, “তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে”।

এই দেখুন এক্ষুনি আপনারা বলবেন এইসব গল্পতো আমরা জানি। এতে আর নতুন কী? কিন্তু আমরা কেউ মনে রাখিনি যোগোমায়ার কথা। আমরা ভুলেই গেছি আজকের দিনে একই সময়ে যোগমায়াও জন্মেছিলেন। আজকের এই জন্মাষ্টমী তো তারও। তাঁর জন্য পুজো, অর্চনা আজ নেই কেন? তাঁর খবর কি আমরা কেউ রেখেছি? তিনিই তো নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে কৃষ্ণের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

কি অদ্ভুত না! তখনও একটা পুত্র সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে সেই কন্যা সন্তানকেই বেছে নেওয়া হতো বলির জন্য। আজকের দিনে তো কন্যাদের বলি দিতে নব নব পন্থা আনা হয়েছে। তাঁর শরীরের ভেতরে সূচ, ইঁট, পাথর, লোহার রড কতকিছু! অথচ আমরা জানি প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই নিয়েই সৃষ্টি।

আমরা সুন্দরী বান্ধবী চাই, সুন্দরী স্ত্রী চাই, কিন্তু কন্যা সন্তান চাই না। আর দেখুন না দেশের জন্য বিদেশের মাটিতে খেলতে গিয়ে সেই কন্যা সন্তানরা কিন্তু সোনার পদক নিয়ে আসছে।

দুনিয়ার বিচিত্র কিছু আইন

দুনিয়ার বিচিত্র কিছু আইন, যেখানে মেয়ের বাসরঘরে মায়ের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। দেশে এবং বিদেশে এমন কিছু আইন আছে যেগুলো শুনতে একটু হাস্যকর এবং অদ্ভুত বলে মনে হয়। বাংলাদেশের আইনের দণ্ডবিধির ৪৪৮ ধারায় আছে অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ করলে তার শাস্তি এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা এক বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান। এক্ষেত্রে উভয় দণ্ডও হতে পারে।

১। কলোরাডতে যৌক্তিক কোনো কারণ না দেখিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা এক ধরনের চুরি। প্রতারণা অথবা ছিনতাইয়ের পর্যায়েও পড়ে। মহান আদালত এ ব্যাপারে বলেছে, বৃষ্টির পানি এভাবে ধরে রাখলে কৃষিকাজের জন্য পানি পাওয়া যাবে না। অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়বে।

২। হংকংয়ে একটা আইন আছে যদি কারো স্ত্রী পরকীয়া করে তবে স্বামী তাকে খুন করতে পারে। তবে শর্ত একটাই খুন করতে হবে খালি হাতে। তবে যে লোকের সঙ্গে পরকীয়া করেছে তাকে অস্ত্র দিয়ে খুন করতে পারবে।

৩। আমেরিকার আরিজোয়ানাতে শিশুরা পেঁয়াজ খেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না বলে আইন আছে। ১৮৮০ সালে এই পেঁয়াজ নিষিদ্ধকরণ আইন পাস হয়। আমেরিকার আরেকটি আইন হলো কেউ রসুন খেয়ে গির্জা থিয়েটার ইত্যাদিতে যেতে পারবে না। ম্যাসাটুচেসের একটা আইন কেউ গির্জায় চীনাবাদাম খেতে পারবে না।

৪। ক্যালিফোর্নিয়ার সুসানভিলে শব্দ করে স্যুপ খাওয়া অপরাধ। মায়ামীতে পুরুষের স্ট্র্যাপলেস গাউন পরে জনসমক্ষে যাওয়া আইনত অপরাধ।

৫। ইলিনয়িস রাজ্যে আরেকটি আইন রয়েছে শীতকালে কোনো জমে থাকা তুষার দিয়ে স্নো বল বানিয়ে গাছের দিকে ছুড়তে পারবে না।

৬। আলাস্কায় কোনো গ্রিজলি ভালুককে মোটেও বিরক্ত করা যাবে না।

৭। মিশিগানে কঠোর আইন রয়েছে, যদি দোতলার চেয়ে উঁচু কোনো দালান তোলা হয়, তাহলে সেই দালানের প্রতিটা জানালায় একটা করে দড়ি ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

৮। আমেরিকার কলাম্বিয়া প্রদেশে মেয়ের বাসর রাতে তার মার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

৯। গুয়ামের আইন অনুসারে কোনো কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে পারে না। তাই কিছু লোক আছে যারা পয়সার বিনিময়ে কুমারিত্বের অভিশাপ মুক্ত করার কাজ করে। মেয়ের বাবা-মা সাধারণত এই কাজের জন্য অনেক টাকা খরচ করেন। এরা কাজ শেষে সার্টিফিকেট দেয়।

১০। লেবাননের আইন অনুসারে কোনো পুরুষ লোক গৃহপালিত পশুর সঙ্গে সহবাস করতে পারে। কিন্তু পশুটা অবশ্যই মাদি হতে হবে। মর্দা পশুর সঙ্গে সহবাস করার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।

১১। এথেন্সের পুলিশ কোনো গাড়ির চালকের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে যদি ওই চালক গোসল না করে গাড়ি চালায় অথবা চালকের বেশভূষা না ঠিক থাকে।

১২। মস্কোতে আবহাওয়াবিদরা ভুল তথ্য প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে।

১৩। ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টে মৃত্যুবরণ করা বেআইনি।

১৪। ফ্রান্সে শূকরের নাম নেপোলিয়ন রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

১৫। ইংল্যান্ডে একজন গর্ভবতী মহিলা যে কোনো জায়গায় মূত্র বিসর্জন করতে পারেন। এমনকি তিনি চাইলে কোনো ট্রাফিক পুলিশের হেলমেটে মূত্র বিসর্জন করতে পারেন। এটা তার বিবেচনা।

১৬। সিঙ্গাপুরে চুইং গাম অবৈধ।

১৭। ইন্ডিয়ানাতে রবিবারে গাড়ি বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়।

১৮। জাপানে কোনো মেয়েকে ছেলে ডেটিংয়ে যেতে বললে মেয়েটি আইন অনুসারে না করতে পারবে না।

১৯। জাপানে কারো বড় ভাই তার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে ছোট ভাইকে সম্মানিত করতে চাইলে আইন অনুসারে গার্লফ্রেন্ড অসম্মতি জানাতে পারবে না।

২০। জাপানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিল্ডিংয়ে মেয়েদের ব্রা না পরা আইনত দণ্ডনীয়।

২১। ১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা কিং জেমস উইচ ক্রাফ এক্ট নামে একটা আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনে যারা কালোশক্তি মানে ব্ল্যাক ম্যাজিক ব্যবহার করবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়। সাধারণত যারা কৃষ্ণশক্তি বা এই ব্ল্যাক ম্যাজিক ব্যবহার করত তাদের বলা হতো ডাইনি। ডাইনিদের পুড়িয়ে মারা হতো। যদিও বিধান ছিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা। এই আইনের আয়তায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষকে মারা হয়। ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত জোয়ান অব আর্ককে এই আইনের অধীনেই পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তিনি ফ্রান্সকে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই আইন বাতিল করে দেয়।

২২। প্রাচীন ভারতে সনাতন ধর্মে এক আইন ছিল সতীদাহ প্রথা। এই প্রথায় স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের সহমরণে যেতে বাধ্য করা হতো। কোনো ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়তরা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারত। পরে ১৮২৯ সালে ৪ ডিসেম্বর রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের ফলে উইলিয়াম বেন্টিংক এই প্রথা বেঙল প্রেসিডেন্সিতে বাতিল করেন।

২৩। বারবার নর্থ ক্যার্লিফোনিয়াতে একটি আইন আছে তাহলো কুকুর-বিড়াল ঝগড়া করতে পারবে না। তাদের নিয়ম হলো কুকুর ঝগড়া করবে কুকুরের সঙ্গে, বিড়াল বিড়ালের সঙ্গে।

২৪। নিউইয়র্ককে এ ট্রাম অথবা ট্রলিকার থেকে খরগোশ শিকার নিষিদ্ধ।

২৫। মিশিগানে কোনো মহিলা স্বামীর অনুমতি ছাড়া মাথার চুল বিক্রি করতে পারবে না। সেখানে স্ত্রীর চুল স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য।

২৬। নিউইয়র্কে ছাদ থেকে লাফানোর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

২৭। ফ্লোরিডাতে নিজের সন্তান বিক্রি করা বেআইনি।

২৮। আরকানসাসে মাসে একবার বউ পেটানো যাবে। কিন্তু দুই বার পেটালেই সমস্যা!

২৯। থাইল্যান্ডে ত্রিশ বছরের বেশি বয়সী অবিবাহিত মহিলারা দেশের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে।

৩০। ভেনিসে ১১৭৩ সালের পর থেকে মরাও বেআইনি। মানে সেখানে মৃত্যুবরণ করাটাও বেআইনি কাজ। মানুষ শান্তিতে মরবে তারও কোনো উপায় নেই।

৩১। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের আইনে কুমারী মেয়েদের সঙ্গে সহবাস নিষিদ্ধ। এমনকি বিয়ের পর বাসর রাতেও স্বামী তার কুমারী বধূর সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না। তবে কুমারী মেয়ে কীভাবে তার কুমারিত্ব বিসর্জন দেবে এ বিষয়ে কোনো আইনি ব্যাখ্যা দেয়া হয় নাই যেমনটি দেয়া হয়েছে গুয়ামের কুমারী মেয়েদের বেলায়।

রাখি বন্ধন এক মৈত্রীর বন্ধন

রাখি বন্ধন এক মৈত্রীর বন্ধন

রাখি নিয়ে অনেক মুনির অনেক মত আছে। যেমন –

১. আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতায় আর্যদের সময় রাখির প্রচলন ছিল।

২. দৌপদীর বস্ত্রহরণ এর পরে দৌপদীর ঋণ থেকে যায় কৃষ্ণের কাছে। কুরুক্ষেত্র যদ্ধের সময় কৃষ্ণ যখন ভীষণ আহত হয়ে পড়েন। তখন কৃষ্ণের ক্ষত কবজিতে দৌপদী তাঁর বস্ত্রখণ্ড ছিঁড়ে কৃষ্ণের ক্ষত স্থান বেঁধে দেন। রাখির সূচনা সেখান থেকেও হতে পারে। রাখি অর্থাৎ রক্ষা বন্ধন।

৩. দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বলির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।

৪. কথিত আছে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।

৫. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হয়ে রাজপুতানায় এসেছিল রাখি। চিতোরের রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। ঐতিহাসিক রাখী পাঠানোর গল্পটি মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় উল্লেখ পাওয়া যায়।

৬. তবে অতীত যাই বলুক না কেন, বাঙালির রাখির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন ভীষণভাবে।

১৯০৫ সাল। নানা কারণেই এই বছরটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বছরটিতেই তখনকার ভাইসরয় লর্ড কার্জন নবচেতনায় জেগে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শ্বাসরোধ করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেন। সে সময়ে কার্জন অসমে চট্টগ্রাম ডিভিশন এবং ঢাকা ও ময়মনসিং জেলার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিলে সারা বাংলা জুড়েই বিক্ষোভের ঢেউ উত্তাল হয়। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রাজনৈতিক নেতারা, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জমিদাররা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলার সাধারণ মানুষ। কার্জনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় সমগ্র বাংলা জুড়ে বহু সভা ডাকা হয়। এই প্রস্তাবকে ধিক্কার জানিয়ে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলায়ই তখন ৫০০টি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। ঐ বছরেরই ১৬ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করার কথা বলা হয়। শ্রেণি বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল মানুষই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি বলেন, আইনের সাহায্যে বাংলা ভাগ হতে চলেছে ৩০ আশ্বিন, কিন্তু ঈশ্বর বাংলার মানুষকে বিভক্ত করেননি। সেই কথা মাথায় রেখে এবং তা প্রকাশ্যে তুলে ধরতে ঐ দিনটি বাঙালির ঐক্যের দিন হিসেবে উদযাপিত করা হবে। তারই নিদর্শনস্বরূপ তারা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতো। দিনটিকে রাখি বন্ধনের দিন হিসেবে পালন করার ডাক দেন বিশ্বকবি। অপরদিকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদিও অনশনের মাধ্যমে দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে উদযাপনের প্রস্তাব দেন। দুটি প্রস্তাবই গৃহীত হয়।

১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি কলঙ্কের দিন আবার আনন্দের দিনও। এই দিন টুকরো হয়ে যাচ্ছে বিশাল বাংলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারনে আবার বাঙালীরা স্মরণ করছে তাঁদের সু-প্রাচীন ঐতিহ্যকে। একই সঙ্গে দুঃখের ও প্রতিবাদের কারনে দিনটিকে একটি বিশেষ ভাবে পালন করার চিন্তা করেন, যাতে অসংখ্য বাঙালীর আপামর স্বপ্নের বাংলা-বিভক্ত কারনে শেষ হয়ে না যায়। ঠিক হল এইদিন কলকাতার জোঁড়াসাকোর বাড়িতে রান্না হবে না। আর সকালে গঙ্গায় স্নান করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালীরা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবে রাখি। যে হিন্দু-মুসলিম ভাইদের আইনের প্যাঁচে ফেলে ভাঙতে চাইছেন ব্রিটিশ সরকার, তা রাখি সেই বন্ধন রক্ষা করবে। জোঁড়াসাকো থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদের এই মিছিল চলে জগন্নাথ ঘাটের দিকে। মিছিলটার নেতা হিসাবে পুরোই ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পাশে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, তাঁরা যখন মিছিলে বেরিয়েছিলেন রাস্তার দুধার দিয়ে বাড়ির মহিলারা ছাদ বা ফুটপথ সব জায়গা থেকে খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে, উলু দিচ্ছে। সবকিছু যেন কোনোকিছুর শোভাযাত্রার মত। গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে সকলেই চলল … “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।” এই গানটি সেই সময়েই তৈরী হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারন্য। রবীন্দ্রনাথকে দেখার জন্য চারিদিকে ভীড় জমে গেল। স্নান করে সঙ্গে নেওয়া একগাদা রাখি একে-অপরের হাতে বাঁধা হল। রাখি পরানো নিয়ে মেতে উঠলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ছোট-বড় কেউ বাদ নেই … জাতি ধর্ম নেই … সকলেই সকলের জন্য মেতে উঠলেন। কেউ ভাবেননি যে একজন হিন্দু একজন মুসলিমের হাতে রাখি বাঁধছেন। তারপর ঘাট থেকে এগিয়ে গেল সেই শোভাযাত্রা। চিৎপুরে এসে রবীন্দ্রনাথ এক মসজিদে ঢুকে মৌলবীদের হাতে রাখি পরালেন। না হল কোনো হাঙ্গামা, না হল কোনো অসন্তোষ। মৌলবীরা সাগ্রহে মেনে নিলেন, আর নেবেন না কেন। এইভাবে শুরু হল রাখি বন্ধনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

এসবেরই অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ঐ দিন এক বিশাল মিছিল গঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয়। মিছিলে অংশ নেন সমাজের বিশিষ্ট ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। ঐদিন সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে। রাস্তায় কোন যানবাহনও ছিল না। বাংলার স্বাভাবিক জীবন ছিল সেদিন অচল। গঙ্গায় ডুব দেওয়ার পর তারা একে অপরের হাতে রঙিন সুতো বেঁধে দেন। বাংলা তথা বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সংস্কৃতি, তাদের আশা আকাঙ্খা তুলে ধরে গান লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন সারাদিনই কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা জুড়ে ঐ গানটি ধ্বনিত হতে থাকে-

‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ কবিগুরুরই লেখা একটি গান গাইতে থাকেন। তারই কিছু অংশ-

‘চিরদিন টানবে পিছে, চিরদিন রাখবে নীচে-এত বল নাই রে তোমার, সবে না সেই টান।।
আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে, বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরীখান।।’

এর মধ্যে দিয়েই ব্রিটিশের একগুঁয়েমিকে ধিক্কার জানান বিশ্বকবি। সারা বাংলা সে সময় গুঞ্জরিত হতে থাকে এই সব গানে। কোন কোন গানে উঠে আসে রাজনৈতিক অধিকার কায়েমের ব্যর্থ বা লজ্জাজনক প্রচেষ্টা, কোথাও বা নদী ঘেরা ছায়া সুশীতল বাংলার গৌরবের কথা, শস্যশ্যামলা বাংলার ধানক্ষেতের কথা, তার তরুচ্ছায়াবৃত গ্রামগুলির কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন তার সেই বিখ্যাত গান-

“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”

তিনি চেয়েছিলেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী এক থাকুক অটুট বন্ধনে। পরবর্তীকালে এই দিনটিই একটি ইতিহাস হয়ে রইল। এ উৎসব বন্ধুত্বের, এ উৎসব ভ্রাতৃত্বের, এ উৎসব সম্প্রীতির।

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
ষোলো (ক)

ইউ টিউবে ভিডিয়োতে একটা কুড়ি-বাইশের মেয়ে, ছোট্ট উত্তরভারতীয়, আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে বলেছিল, হি সিংগস হোয়াট উই গার্লস ওয়ন্ট টু হিয়ার।

সেই হঁসমুখ বাক্যের ‘হি সিংগস’ ফলাটা ক্যাঁত করে আমার ঘিলুতে গেঁথে যায় আর ‘ওয়ন্ট টু হিয়র’ তার বদ্রীলেজ কাঁপাতে থাকে জুলাই বাতাসে।

তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বয়েসখণ্ড ধরলে ভারতীয় শিক্ষিত মেয়েদের এক প্রস্থচ্ছেদ পাবো যারা পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে অনেকখানি ক্ষমতা স্বাধীনতা সমানাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে; চাকরি করেছে, ডিভোর্স করেছে, সিঙ্গল পেরেনটিং, পছন্দসই পেশায় গেছে, অংশ নিয়েছে একাধিক প্রেমে যৌনতায়, নেশা করেছে, একা বেড়াতে গেছে, ইচ্ছেমতো পোশাক পরেছে, সমাজ-আন্দোলনে নেমেছে, অন্যায়কারী পুরুষকে টেনে নিয়ে গেছে পুলিশ-আদালত পর্যন্ত, সংসারে তাদের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়াতে বাধ্য করেছে।

এর কিছু কাজ নিশ্চয়ই করতে হয়েছে গুপ্তঘাতকের মতো, ফলস-ইমেজের আড়ালে ব’সে, যেহেতু তারা হাড়েমজ্জায় পুরুষতন্ত্রকে চিনেছিল। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চেনাটা আসল জরুরি।

তবু চেনা আর জানায় তফাত থেকেই যায়। স্কুলে যৌনশিক্ষার বই পড়ে তো আপনি সহপাঠির মন জানতে পারবেন না।

আরএসএস আর হিন্দু জনতা, মুসলিম ল’ বোর্ড আর মুসলমান সম্প্রদায়, মাওবাদি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরবাসীর মতোই পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ — একটা এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ি সম্পর্ক। মেসমালিক-বোর্ডার রিলেশানশিপও বলতে পারেন। মাড়োয়ারি ফার্মে যখন রাজস্ব দপ্তরের ‘ছাপা’ পড়ে, মাসে ছ’হাজার টাকা মাইনের কেরানি মেয়েটার কোমরে তিনটে কাঁচা চালান-বই গুঁজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাথরুমে, যেখানে সে অনন্তকাল দরজা টেনে বসে থাকবে। তবু কোম্পানির মালিককে চেনা আর কর্মচারিকে জানা (যে জানা থেকে বোঝা সমাগত) এক জিনিস নয়। এক নয় প্রতিক্রিয়া (reaction) দেখানো আর সাড়া (response) দেওয়া।

তবু ভারতে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ উমরকালের মেয়েরা তাদের ঐতিহাসিক ভুরুগুলো কুঁচকে রেখেছে বলেই এখন ‘বচনা অ্যায় হসিনোঁ, লো ম্যায় আ গয়া’-র মতো গান রেকর্ড হয় না বলিউডে। তাদের ‘হর এক কে মুহ মেঁ আধা-আধা লিটার পেট্রোল’; পুরুষের আচরণে ‘কুছ উঁচনিচ হোয়েঙ্গা তো’ অটোমেটিক ভেতর থেকে নির্দেশ আসবে ‘থুক’, সঙ্গে সঙ্গে ‘মাচিস মারকে নিকল লেনে কা’!

এরা সন্দিগ্ধ আর অবিশ্বাসী; নখ মেরুদাঁড়া একসঙ্গে উঁচিয়ে রেখেছে-হেতু সন্তানের জীবনে পুরুষ-অত্যাচারের কোনও লিগ্যাসি-ফাইল বদলি হয়ে আসেনি। প্রজন্ম-পুরনো শোষণের লাগেজ পিঠে হাঁটছে না নতুন মেয়ে।

আর মেধাবী অকৃত্রিম আত্মনির্ভর নারীকে পেয়ে বেঁচে গেছে এখন-পুরুষ। সে তাকে একই সঙ্গে রক্তমাংসে, আবার শরীরের বাইরে গিয়ে আইডিয়া হিসেবেও দেখতে পাচ্ছে, যে যোগসাজশ সম্পর্কের পরিত্রাণের জায়গা।

অরিজিৎ গাইলঃ
তুম হো না হো, লগতা হ্যায়
অব জ্যায়সে কি তুম হী তো হো
(গানের নামঃ লাভ মি থোড়া অর)

অথবা
তূ হী তূ হ্যায় জো হর তরফ মেরে
তো তুঝসে পরে ম্যায় জায়ুঁ কঁহা
(গানের নামঃ ইশক মুবারক)

তো, দুটো গান প্রেমকে অ্যাপ্রোচ করছে পুব আর পশ্চিম, দুই উলটো দিক থেকে। সূর্যাস্তের পরেও সূর্যের থেকে যাওয়া সূর্যনিরপেক্ষ, বোধনির্ভর। তপনজ্যোতি, তুমি আছো নাকি নেই, এই বাস্তবতা একান্তই তোমার বিষয়। কিন্তু আমার কাছে শুধু ‘তুমি’ই আছো, কারণ ‘আমি’ লুপ্ত হয়ে গেছি সেই কবে!

অথবা আমার সমস্ত পাহাড়চুড়োয় তুমি জেগে উঠেছ ভোর পাঁচটায়, আমার বাইনোকুলারে, মাংকিটুপিতেও। বরং আমি দেখছি এখানে তোমার কাছ থেকে পালানোর রাস্তাটাই লা-পতা! তার ওপর কখন রবীন্দ্রনাথও গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছেনঃ ‘যেথা আমি যাই নাকো/তুমি প্রকাশিত থাকো’ ব’লে। কানের কাছে ঘাড় নামিয়ে ফিসফিসোচ্ছেন — কখনো যদি তার হৃদয় বিপথে যেতে চায়, তৎক্ষণাত লজ্জা পেয়ে সরে আসে।

ভারতীয় মান সে আধ্যাত্মিকতাই অনুভবেই গভীরত ম বিন্দু, কারণ ইশ্বরের চেয়ে বড় ভাবকল্পনা এদেশে আজও কিছু হয় না। ‘সনম বে-ওয়াফা’ ছবিতে লতা গেয়েছিলেন ‘আল্লাহ করম করনা, লিল্লাহ করম করনা’, আর ‘সনম রে’ ছবির অরিজিৎসিংগীত ওই একই পুজোপ্রবচন ব্যবহার করল ভালোবাসাতেও, ‘সনম রে, সনম রে, তেরা মুঝপে করম হুয়া রে’। স্বানন্দ কিরকিরের লেখা ‘ফিতুর’ ছবিতে একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং আর ফাটানো প্রেমের গান ‘পরবরদিগারা’, যে শব্দের মানে, খুব কম করে বললেও, ভগবান। এখানে আবার হালকা রবীন্দ্রনাথ পালন ক’রে নিচ্ছি — ‘এলিজে’ ছবির অরিজিতসংগীতটা দিয়েঃ

প্যার ম্যায়নে জো নিভায়া
তেরে রহতে তেরে সাথ ভী
সচ কহুঁ তো উসসে জ্যাদা
চাহা তুঝকো তেরে বাদ ভী

শুনতে শুনতে আপনি গুনগুনাতেই পারেন—
যে কথাটি বলবো তোমায় ব’লে/কাটলো জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে/ উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে

ষোলো (খ)
ধুলোকপাল, জটপাকানো চুল, ক্লান্ত কিটোজুতো — ওই দেখুন অফিস-ফেরত পুরুষের কাঁপা কাঁপা হাত উঠছে রাত ন’টার কলিং বেলের দিকে। দরজা খুলতে দু’মিনিট দেরি, কিন্তু সে গলার ভেতর থেকে বাঘ বের করে আনলো না। একবার ফ্যাঁস পর্যন্ত করল না আজও পাঁচফোড়ন আনতে ভুলেছো!-র জবাবে। পুরুষ বিশ্রাম চাইছে, স্বপ্ন দেখছে একটা সহজচেয়ারের যেখানে তার গা ঘেঁষে হোমপোস্টিংয়ে থাকবে অঘ্রাণের রোদ্দুরও।

জো তুম না হোতে
হোতা হী ক্যা হার জানে কো
(গানঃ কভী ইয়াদোঁ মেঁ আয়ুঁ)

হেরে যাওয়ার জন্যে এত যত্ন, এত টেনশান, এত নির্ভরতা, এমন নমনীয় গর্দান…!

ফুটন্ত জলের পাত্রে বুদবুদ ভেসে ওঠে, নিচে নেমে যায়, অরিজিৎ গাইতে শুরু করে ‘তেরা ইয়ার হুঁ ম্যায়’-

“তুই যদি রেগে যাস, কে হাসবে তবে
তুই ছেড়ে গেলে কে থাকে শূন্য বৈভবে

আয় আবার ঝগড়া ক’রে পুতুল কেড়ে নিই
তুই জিতিস,আমি হেরে ভূত হবো
আয় ফের করি আগের সব শয়তানি
তুই পালাস, আমি নয় মারই খাবো
তোর ওই মিষ্টি বকুনি শুনবো ব’লে ছটফটাচ্ছি,
দিব্যি বলছি, কিরে!

তোর বন্ধু আমি রে…”

গানটার ভেতরে একটা দ্বিজনপথ বসানো দেখতে পাই। গানের তরুণতরুণী মাঠের মধ্যে মিশে যাচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে…দুপায়ে বাতাসের প্রোটিন, শিশিরের জলসঞ্চয়। দেখি মরা ঘাসে বিখ্‌রে আছে দুটো মুকুট, ফুটো হয়ে যাওয়া পুরুষতন্ত্র আর আধাতৈরি নারীআগম।

(ষোলোকলা)

১৫ই আগষ্ট জাতীর শোক এবং লজ্জার দিন

পনেরোই আগষ্ট, বাংগালীর জীবনে এক শোকের মাস, এক পরাজয় আর লজ্জার দিন। বাঙ্গালী ভালোবাসার মুল্য দিতে জানে না, বাঙ্গালী বিশ্বাসের কোন দাম দিতে জানে না এই কথা গূলোকে প্রমাণ করে দিয়ে বাঙ্গালীর জীবনে এক মহা সত্য হয়ে ১৫ই আগষ্ট প্রতিবছর আসে। শোকে মুহ্যমান হলেও সেই সাথে এক চরম আত্মগ্লাণি বাংগালীকে কুড়ে কুড়ে খায়। একটি জাতির স্বাধীনতা আর জাতীয় চেতনা প্রতিষ্টায় একজন মানুষের নেতৃত্ব কতো খানী হতে পারে বংগবন্ধু ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর একজন মানুষ কতোখানি তার জাতিকে ভালোবাসতে পারেন তারও উজ্জল দৃষ্টান্ত বংগবন্ধু। তার পক্ষেই সম্ভব পাকিস্থানী হানাদারদের রাইফেলের মুখে বলা আমি বাঙ্গালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। একমাত্র তিনিই বলতে পেরেছেন আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমার শক্তি আমার দেশের মানুষের ভালোবাসা। ঠিক একই সাহস আর বিশ্বাস নিয়েই ১৫ই আগষ্ট রাতে খূনীদের সামনে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন “তোরা কি চাস?”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে জায়েজ করতে সেই সময় সাধারন মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিলো বংগবন্ধু সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। লুঠপাট, ব্যাংক ডাকাতি, অগ্নিকান্ড আর ঘুম খুনের নানান কিচ্ছা কাহিনী। একদিকে জাসদ আর গোপন বামপন্থী দলসমুহের সশস্ত্র লড়াই, গন শত্রু নিধনের নামে সারা দেশে গলা কাটার মহোৎসব, অন্য দিকে ৭১ সালে পরাজিত শত্রুদের প্রতিশোধের লেলিহান শিখা। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র আত্মসমর্পণ করা হলেও রাজাকারদের অস্ত্র থেকে যায় নিরাপদ ভান্ডারে। রাতারাতি অনেক রাজাকার আত্মরক্ষার্থে যোগ দিতে থাকে জাসদের গনবাহিনী আর গোপন বাম দলগুলোর পতাকা তলে। তাদের ছত্রছায়ায় থেকে তাদের নামে চালাতে থাকে নানা অপকর্ম। অন্যদিকে জাসদ নেতৃবৃন্দ বা গোপন বাম দলগুলোর নেতৃবৃন্দ মনে করতে থাকেন সাধারন মানুষ দল বেধে তাদের দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবকে তরান্বিত করছে।

গত ১৩ই আগষ্ট দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত বিট্রিশ রাষ্টদুতের এক লিখিত প্রতিবেদন থেকে সেই সময়ের বাংলাদেশের সামগ্রীক চিত্র নিয়ে এক সরকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই সরকারী নথি থেকে জানা যায় সেই সময় অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সামগ্রীক অবস্থার উন্নতি সাধন হচ্ছিলো। শুধু তাই নয় বাকশাল গঠন এবং সেই বাকশালের সুফল দেশের প্রায় ত্রিশ শতাংশ ভুমিহীনের মধ্যে কিভাবে কাজ করবে এবং পরীক্ষামুলক সমবায় সিস্টেমে বিভিন্ন জায়গায় ভুমিহীন কৃষোক এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে কি পরিমান উতসাহ সৃষ্টি হয়েছিলো তার বিবরন পাই। একটা যুদ্ধ বিধস্ত দেশ কিভাবে ঘুরে দাড়াতে পারে তার এক বিশেষ দৃষ্টান্ত বংগবন্ধু বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারতেন এ কথাও বিট্রিশ রাষ্টদুত তার সরকারকে অভিহিত করেছিলেন। বিট্রিশ রাষ্টদুত বলেছেন বংগবন্ধু প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তলা বিহীন ঝুড়ি নয়, একটি খাদ্যে সয়ং সম্পুর্ণ দেশ হবে বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালের মধ্যে দেশ কে খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছিলেন বংগবন্ধু।বিট্রিশ রাষ্টদুত খুব দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশের ঘুরে দাড়াবার কথা বলেছিলেন এবং বিট্রিশ সাহায্য অব্যাহত রাখার সুপারীশ করেছিলেন।

বংগবন্ধুর দোষ ছিলো দুটো, এক তিনি বাংলাদেশ কে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন করেছিলান দ্বিতীয়টা হলো তিনি শুধু সংবিধানে সমাজতন্ত্র কথাই সংযোজন করেন নাই, তিনি তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার এই দুই পদক্ষেপ মার্কিন সামাজ্যবাদ, পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দালালদের ভালো লাগে নি। ভালো লাগেনি সেই সময়ের চীনা পন্থী বাম রাজনীতিক দের। ভালো লাগে নি আওয়ামী লীগের ভিতর ঘাপ্টি মেরে বসে থাকা মুজিব সরকারের পাকিস্তানী কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখা কিছু বেঈমানের। তাই তারা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগে। এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় পাকিস্থান থেকে ফেরত আসা কিছু সামরিক বেসামরিক আমলা। পাকিস্তানের মাতিতে মুক্তিযুদ্ধ কালীন সমইয়ে আরামে থেকে যুদ্ধার পর দেশে এসে পদোন্নতি আর সুযোগ সুবিধা আদায়ে হয়ে উঠেন তৎপর। তাদের অসন্তুষ্টিকে উপরের চক্র কাজে লাগায় খুব সফলভাবে।

বংগবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশ কে পিছনে নেওয়ার যে কাজ সেই কাজ খুব দক্ষতার সাথে শুরু করেন জেনারেল জিয়া। তার সুবিধা ছিলো তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার এবং যেড ফোর্সের অধিনায়ক। এই তিন পরিচয় কে উর্দ্ধে তুলে ধরে তিনি পিছনে থেকে কল কাঠি নাড়তে থাকেন। এবং সুযোগ পেয়েই প্রাণ রক্ষাকারী বন্ধুকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। পরবর্তী ইতিহাসো সবাই জানেন। বাংলাদেশ একে একে তার সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি, গনতান্ত্রিক ভিত্তি, আর ধর্মনিরেপেক্ষতার ভিত্তি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ আর পরবর্তীতে রাষ্ট ধর্ম বিল পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী পরাজিতদের আশা ষোলকলা পুর্ণ হতে থাকে। একে একে রাষ্ট ক্ষমতার অংশীদার হয়ে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা জাতিয় পতাকা উড়িয়ে মুলত আমাদের স্বাধীনতাকেই ব্যঙ্গ করতে থাকে।বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ এবং অকার্যকর রাষ্টে পরিনত করার অংশ হিসেবে জংগীবাদ এবং জংগি গোষ্টীগুলো কে রাষ্টীয় পৃষ্টোপোষকতা দেওয়া শুরু হয়। জাতীর জনকের কন্যা শেখ হাসিনা কে হত্যার উদ্দেশ্যে চলতে থাকে প্রাণনাশী আক্রমন। ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা সেই প্রাণনাশী চক্রান্তের অন্যতম। হত্যা করা হতে থেকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতাদের।

বংগবন্ধু কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে থাকে জগাখিচুড়ী মার্কা এক রাজনৈতিক দল যাদের জন্ম হয় সামরিক ছাউনীতে, যাদের পিছনে শক্তি যোগায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, আর ক্ষয়ে যাওয়া বাম ভুল রাজনীতি।

বাংলার ইতিহাস থেকে শেখ মুজিব কে মুছে দেওয়ার যে হাস্যকর প্রয়াস নিয়েছিলো সেই পদক্ষেপে আজ নিজেরাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবিত জাতির পিতা আজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে তারুন্য আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে। আজ যে যবক মাঠে নামে তার ন্যায্য দাবী আদায়ে তার বুকেও থাকে শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি। প্রতিবাদী যুবক সাহসের সাথে উচ্চারন করে আমার বুকে গুলি করো না, আমার বুকে আছে শেখ মুজিব। গুলি যদি করতেই হয় আমার মাথায় করো।

নারীবাদের সাদাকালো

[Ev’ry leaf, and ev’ry whispering breath
Convey’d a foe, and ev’ry foe a death
ওলাদা একুইয়ানো (১৭৪৫-১৭৯৭) একজন
নিগ্রো দাসের লেখা কবিতা]

যদি কোনও মেয়েকে গভীর ঘুম থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে জিগ্যেস করো, তুমি কে — একজন কালো মেয়ে বলবে ‘আমি কালো মেয়ে’, একজন সাদা মেয়ে শুধুই ‘মেয়ে’, বা তাদের কেউ ‘লেসবিয়ান’; কিন্তু কেউই নিজেকে ‘সাদা মেয়ে’ বা ‘সাদা মানুষ’ বলবে না।

ফেমিনিজমের টুকরো না হওয়ার সমস্যাও এখান থেকে শুরু হয়। ‘রেডস্টকিংস’দের ঘোষণা, যা নারী-আন্দোলনের প্রথম ম্যানিফেস্টোগুলোর একটা, বলেছিল — পুরুষরা মেয়েদের দমন করে আর অল্প কয়েকজন পুরুষ দমন করে বাকি সবাইকে। এই বিশ্লেষণে দুটো সম্ভাবনার কথা ধরা হয়নিঃ সাদা মেয়েরা শোষণ করতে পারে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেদের আর, সাদা ও কালো মেয়েদের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা যথেষ্ট ভূমি রয়েছে।

একদিকে নারী-আন্দোলনের প্রধান ধারা, যা অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ নারী অধ্যুষিত, বলেছে যৌনতা জাতিবাদের চেয়ে অনেক মূল বিভাজন আর পুরুষ-নারী সম্পর্ককে একান্তই ‘সেক্সুয়াল পোলিটিক্স’-এর যুক্তিকাঠামোয় বিধৃত করেছে; অন্যদিকে কালো মেয়েরা (অস্তিত্ববাদী ডিকশান ব্যবহার করা যাক) ‘doubly the other’, কেননা তারা যুগপৎ যৌন ও জাতিগত অদৃশ্যতায় ভুগছে। আরও স্পষ্ট বললে, কালো মেয়েদের আগাগোড়া আক্রমণ করে গেছে এই ত্রিশূল সমস্যাঃ কালো পুরুষের যৌনবাদ, সাদা মেয়ের জাতিবাদ আর সাদা পুরুষের জাতি-যৌন রাজনীতি। এর পরিণতিতে ওরা অবিশ্বাসী আর হোস্টাইল হয়ে উঠেছে শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিষয়ে আর এই Bad Faith জন্ম দিয়েছে এমন ধারণার যে নারীমুক্তি আন্দোলন হল সাদা মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার।

এই বিরোধ মেটাতে গিয়ে মেইনস্ট্রিম (সাদা) নারীবাদীরা কিন্তু স্ববিরোধী বক্তব্য রাখছে। ‘সাদা মেয়েদের নারীবাদ’-এর ধারণাকে ‘ছেলেদের সমাজতন্ত্রে’র মতো হাস্যকর বলার পর তাদের বক্তব্যঃ নারী-পুরুষ আর সাদা-কালো এই দুই শোষণের মধ্যে প্রথমটার অস্তিত্ব এই পুরুষ রাষ্ট্রগুলো স্বীকারই করে না, যেখানে পরেরটা সম্পর্কে অপরাধবোধে ভোগে। কাজেই নারীবাদী আন্দোলন আক্রমণের লক্ষ্য করবে যৌনরাজতন্ত্রকেই। নাহলে নারীবাদীদের তো বামপন্থী বক্তব্যকেই সমর্থন করা হল, যারা বলে যৌনতা-বিষয়ক ইস্যুগুলো অপেক্ষা করুক যতদিন জাতি আর দারিদ্র্যের সমস্যা না মেটে [বামপন্থী অ্যাঞ্জেলা ডেভিস-এর বই ‘উইমেন, রেস অ্যান্ড ক্লাস’]। শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী এলেন উইলিস যৌন আর জাতিগত সমস্যার মধ্যে প্রায়রিটির প্রশ্নকেই অস্বীকার করেছেন এই ব’লে যে ‘Insistence on hierarchy of oppression never radicalizes people because the impulse behind it is moralistic’ [প্রবন্ধ ‘সিস্টারস আন্ডার দ্য স্কিন?’]।

কিন্তু যৌনশোষণকে শ্বেতাঙ্গ নারী-আন্দোলনে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া মানে তো তাকে পূর্ববর্তিতা দেওয়াই। আর নারীবাদী আন্দোলনের মূল ধারা কখনও নৈতিকতার সীমা ছাড়ায় কি? কীভাবেই বা এরা কালো মেয়েদের নিজেদের আন্দোলনের ছাতার নিচে আনতে চান দর্শনগত অবস্থান একটুও না পালটে? ধরা যাক গর্ভপাতের বিষয়টা। রেগন-শাসনের সময় থেকে সঠিকভাবেই আমেরিকার শ্বেত মেয়েরা আবার গর্ভপাতের পক্ষে সোচ্চার। অথচ পরিসংখ্যানই বলছে কালো মেয়েদের জীবনে অভিশাপের নাম অ্যাবরশান। তাদের বিরাট এক অংশের আজও জোর করে পেট খসানো হয় যৌন-শোষণের সুবিধের জন্যে। তবে কি ঐক্যবদ্ধ নারীমুক্তি আন্দোলনের স্বার্থে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের এই বুঝে নিতে হবে যে তাদের বর্তমান সমস্যা নিয়ে আর লড়াইয়ের দরকার নেই, কেননা তা কম গুরুত্বপূর্ণ, কেননা কম আধুনিক, কেননা রাষ্ট্র বিষয়টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ফেলেছে আর তাই তাদের এ-ব্যাপারে কোনও দুঃখকষ্ট থাকতে নেই? অর্থাৎ শোষণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ হচ্ছে হীনমন্যতাবোধও!

প্রত্যেক নারীর সমস্যাই তার নিজের কাছে চরম গুরুত্বের। এই সত্য অস্বীকার গেছে মার্ক্সবাদ, এখন নারীবাদীরা। তাই মার্ক্সসাহেবদের একটাকা সমালোচনাকারী ফেমিনিজমের মূল ধারার শক্তিশালী হয়ে ওঠা যেন এক নতুন মার্ক্সবাদী দলেরই আত্মপ্রকাশ। মার্ক্সইজম জনসংখ্যাকে ভাগ করেছে অনুভূমিকভাবে (নিচে শোষিত, ওপরে শোষক) আর নারীবাদ উল্লম্বভাবে (ডানদিকে পুরুষ, বাঁয়ে মেয়েরা)। এই পাইকারি শ্রেণীবিভাজন — পাইকারি, কেননা পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চাকরির মতোই কোনও সমসত্ত্ব শ্রেণী হয় না —নারীবাদীকে সমাজতাত্ত্বিক সমস্ত সূক্ষ্মতা, বৈচিত্র্য ও জটিলতা না মানতে লোভ দেখায় কখনও এক অনমনীয় তত্ত্বের নামে, তো কখনও সাংগঠনিকতার দোহাই দিয়ে। মার্ক্সবাদের মতোই শ্বেতাঙ্গ নারীমুক্তি আন্দোলন জন্ম দেয় হায়ারার্কি নামে এক উচ্চতর ইয়ারকির, ডিসক্রিমিনেশানের, হয়ে ওঠে প্রভুত্বপরায়ণ আর শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় ডগম্যাটিকতায়।

আসলে চিরকাল সভ্যতা এক একটা আন্দোলন প্রসব করার পর প্রসন্ন হয়ে দেখেছে লক্ষ্য অর্জনের কিছু আগেই তারা নিঃশেষ হয়ে গেল, প্রতিটা মতবাদ তাৎপর্য হারানোর বহু মুহূর্ত আগে ঢাকা পড়ে গেল নতুন মতবাদের রোদ্দুরে। এভাবেই ব্ল্যাক লিবারেশান মুভমেন্ট অর্ধশেষ পথে কোথায় হারায়, উঠে দাঁড়ায় ফেমিনিজমের সাদাকালো। কোনও আন্দোলন তাই স্থির, সদৃশ ভূমি পায় না ছায়া রেখে দাঁড়ানোর, আর আকাশ যা পায় — অর্ধেক-মরা দর্শন আর সেই সংলগ্ন সমাজ-অবস্থার এক কোলাজ ছাড়া কিচ্ছু নয়।

এমন অবস্থায় নারীবাদকে যদি শুদ্ধ সমাজ-আন্দোলনের চেহারার কাছাকাছিও দাঁড়াতে হয়, তবে তার বিশেষ রূপ হবে খণ্ডিত, সামাজিক ভূগোলের বিভিন্ন দিকে ছড়ানো টুকরো টুকরো অনেক আত্মনিয়ন্ত্রিত নারীমুক্তি আন্দোলন, আর সাধারণ রূপ হবে এগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহের। ভারতে দলিত নারী-আন্দোলন, শ্রীলঙ্কায় তামিল নারী-আন্দোলন… এমন বহু-র পাশে পাশে হয়তো কালো নারীবাদও ভেঙে যাবে একদিন আমেরিকান আর আফ্রিকান ব্ল্যাক নামের দুই দেশিয়তায়। তাতেই মঙ্গল। নয়তো কালো মেয়েদের ভবিষ্যৎ আর বর্তমান আর অতীত সেই রকম হয়ে থাকলো ওলাদা একুইয়ানো যা একটু আগে লিখেছেন তার কবিতায়।

[মন শোকে মন্থর হলে পুরনো বইখাতা হাঁটকাই। তাতেই জালে পড়ল ১৯৯৫ সালের নোটবুক, দু’খান প্রবন্ধিকা আর একগাল গল্প তার পেটে পেটে। দুঃখজনকভাবে প্রথম গদ্যটা এখানে ছাপিয়ে দিলাম ননস্টপ। সুদীর্ঘ তেইশ বছর আগে এত জ্ঞান ছিল আমার! ভেবে ভয় করছে। হাসিও পাচ্ছে একটু]।