বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

শান্তির জন্য ধৈর্য

Wha

ভালোবাসাটাই ভালো না থাকার সব চেয়ে বড় কারণ। সুতরাং, আমরা কখনোই ভালো থাকতে পারবো না। কারণ, আমরা মায়া ছাড়তে পারবো না। আর মায়ার সাথে হৃদয় জড়িত, হৃদয় ছাড়া মানুষ বাঁচে না। অতএব, পৃথিবীতে আসার পরই আমাদের প্রথম শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল, শান্তির জন্য ধৈর্যশীল হওয়া।

টুকটাক রমযান ৩

রমযানের সাড়ে পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাকী আছে চৌদ্দ দিনের মত। এবারের রমযান চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। রমযান না বছরই চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। ভাবা যায় চারদিন আগে মাত্র নতুন বছরের ফানুস উড়ালাম, এর মধ্যে তিনমাস পাঁচ দিন চলে গেছে। সময় কত দ্রুত যায় বুঝা যায় না। কেন যেন মনে হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর আহ্নিকগতি বেড়ে গেছে। এই কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সময়কে দৌড়াতে হচ্ছে, তাই মানুষ সময়কে ধরতে পারছে না।

এ পর্যন্ত রমযান ভাল কেটেছে। নির্ঝঞ্ঝাট। বিলেতের আবহাওয়া এখনো গরমমুখী হয়নি। যদিও মার্চের শেষ রবিবার থেকে গরমের মৌসুম আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে তবু এখনো পর্যন্ত গরম মহাশয় দেখা দেননি। ঠাণ্ডা চাচা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। রমাযানের শেষ পর্যন্ত যদি তিনি বিরাজ করেন তাহলে উত্তপ্ততার দোয়াই দিয়ে রমযানকে হালকা করতে হবে না। গরমের রমযানে খিদের কষ্ট না হলেও পানির কষ্ট কিছুটা অনুভূত হয়। ঠাণ্ডার দাপটের কারণে এবার জলের তেষ্টা পাচ্ছে না।

এবারের রমযানের অধিকাংশ সময় কাজে ব্যয়িত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যস্ততায় যাচ্ছে তাই ইফতারের অপেক্ষায় কাতর হতে হচ্ছে না। আমার কাজের জায়গায় বিরতির সময় হচ্ছে সাড়ে ছ’টা, কিন্তু কতৃপক্ষ মুসলমান কর্মচারীদের জন্য ইফতারের সময় বিরতি নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। সাড়ে সাত পোনে আটে ইফতার। আমার বেশ ভাল লাগছে। বিভিন্ন দেশের মুসলমান ভাই বোন একসাথে ইফতার করছি। বিচিত্র খাবার একে অন্যের সাথে শেয়ার করছি, বেশ একটা উৎসবের আমেজ।

ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু বইয়ের অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তবেও দেয়া যায় এর প্রমাণ আজকের ইফতার। সোমালিয়ার এক ভাই ইফতার নিয়ে আসেনি, ঠিক কী কারণে জানিনা। সে ভেবেছিল ভেণ্ডিং মেশিন থেকে কিছু একটা কিনে ইফতার সেরে ফেলবে কিন্তু ভেণ্ডিং মেশিন কাজ করছে না। সে পানি পান করে যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওমনি দেখা গেল ক্যান্টিনের সবাই (অন্তত বিশ জন) খাবার হাতে নিয়ে তার সামনে হাজির।

তার সামনে যে খাবার জড়ো হল অন্তত পক্ষে পাঁচজন খেয়েও শেষ করতে পারবে না। সে একা বসে খেতে চেয়েছিল কিন্তু সবাই তাকে ঘিরে বসল, হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে ইফতার খাওয়া হল।

সে সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিল কিন্তু অন্য এক সোমালিয়ান ভাই বলল, আমাদের নয় তোমাকে ধন্যবাদ তোমার কারণে আমাদের খাতায়ও কিছু পুণ্য জমা হল। রমাযানে ছোটখাটো সৎকর্ম পুণ্যের খাতায় অনেক বড় হয়ে জমা হয় হয়। হাদিসে উল্লেখ আছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমযানের পরিপূর্ণ ফযিলত নসীব করুন। আমিন।

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

পঁচিশ
অনেক শেয়াল ডেকে উঠল এই প্রজনন-ঋতুতে। তাদেরই কয়েকজন রাতের নির্বাক রেললাইন ঘেঁষে, গোরুখাটালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পাখির ডিম, ইঁদুর অথবা বেড়ালবাচ্চা খাবে ব’লে।

শব্দ পেয়েই ভোর অবতরণ শুরু করল আকাশ থেকে, তিন ঘন্টা পরে শেষবার বাঁশি বাজিয়ে শেয়ালরা তাদের বাড়ি-বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে। “প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি” হয়ত এক গিধড়সংগীতই! এবং সকালবেলা আদাড়ে পড়ে থাকা রক্তমাখা ফর্দাফাঁই মার্জারশিশুদের কোনও কররেখা নেই, গ্রহশান্তিকবচ নেই…।

জ্যোতিষ নিয়ে বরুণের খোঁটা শুনে অন্য টিচাররা হাসে, তবু দুর্গরক্ষার দায়িত্বে আছে বলেই নির্মল স্বীকার করতে পারেনি, খনার বচনও প্রমাণের অভাবে ভুগেছে বহুবার। অনেক যুগ আগে তার বাবা বাণীনাথ বড় ছেলের কোষ্ঠী প্রস্তুত ক’রে দেখেছিলেন, জাতকের অতিপ্রবল সন্ন্যাসযোগ। কাজেই, আঠেরো বয়েস হতেই দাও বিশ্বদেবের বিয়ে, তিনটে বাচ্চা রেখে বউ মারা গেলে তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় পরিবার ঘরে আনো। তারপর খুলনার বাতনাই নৌকোর মতো সংসার সুকলেবর হতে হতে শেষে পরেশান স্বামীস্ত্রীর মধ্যে খটরমটর লাগলে বিশ্বদেব ঠোঁট ওলটাতো : আমার তো সংসার করার কথাই না! গিন্নির ঝটাকসে উত্তর, হ্যাঁ সন্নিসি হবেন বলেই তো দুই বিয়ে আর ন’টা ছেলেমেয়ে। ব্যাস, জোঁকের মুখে একথোকা নুন।

বাণীনাথ কখনও মানেননি জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল; গণকেরই ত্রুটি হয়ে থাকবে দণ্ড-পলের হিসেবে। তেমনি যদি কোনও বেদপন্থীকে জিগ্যেস করো, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী আয়ুস্তোম যজ্ঞ করেও কেন যজমান দীর্ঘজীবন পেল না — নিশ্চয়ই যাগের নিয়মপালনে গন্ডগোল হয়েছিল। যুক্তিটা এমনভাবে সাজানো আছে যে বৈদিক যজ্ঞ ফল দিক বা না দিক, মিথ্যে প্রমাণিত হবে না। একই প্যাটার্ন নির্মল লক্ষ করে বরুণের মধ্যেও। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পানমুখো গান্ধিবাদী মহাদেব সেনগুপ্ত সারাদিনে তিনটে খবরের কাগজ মুখস্থ করে। বাড়ির রেডিয়োয় সারাক্ষণ বিবিসি নিউজ। সে বরুণকে পেলেই — ১/ সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিন ইহুদিদের ওপরে যে অত্যাচারটা করেছে তারপর সে হিটলারের চেয়ে ভালো হয় কী করে? ২/ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত চেয়ারম্যান কুলাক চাষি আর কবিসাহিত্যিকদের মারল কিম্বা নির্বাসনে পাঠালই বা কোন দর্শন মেনে? ৩/ বুলগেরিয়ার জার ব্রিটেন-আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়নি ব’লে সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার রেড আর্মি ঢুকে সে-দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল, এটা কি মার্ক্সবাদ সম্মত? কিছুক্ষণ তাচ্ছিল্যভরে ‘বুর্জোয়া সংবাদপত্র’, ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ বলাটলার পরে বরুণ ঘোষণা করত, মার্ক্সবাদের প্রয়োগে নেতৃত্বের ছোটখাটো বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু সাম্যবাদী আদর্শে কোনও ভুল নেই।

— কী ক’রে বুঝলে?
— স্যার, এটা আপনাদের ভাববাদী দর্শন নয়, বিজ্ঞান। তাই সত্য।
টিচার্স রুমের জানলা দিয়ে পানের পিক ফেলে মহাদেববাবু :
— বিজ্ঞান সত্য তোমায় কে বলেছে? সে হল সত্যের খোঁজ, সত্যের জন্যে অভিযাত্রা।

ছাব্বিশ
জীববিদ্যার মাস্টার অশোক, যার পদবি মণ্ডল থেকে মেন্ডেল হয়ে গেছে বংশগতি সূত্রের অত্যাচারে, চেয়ার থেকে বাঁদিকে কাত হয়ে নির্মলের মুখের কাছে মুখ নেয় :
জ্যোতিষ নয়, জিন, বুঝেছ পণ্ডিত? মানে পূর্বপুরুষ যেমন জাতের হবে… আম গাছে তো বাতাবি লেবু ফলতে পারে না! আমাদের মা-মাসিরা জানত এসব — “আগের হাল যেদিকে যায়, পাছের হালও সেদিকে যায়” শোনোনি?
দুজনের মাঝখানে ব’সে আছে অতি-ফক্কড় বাংলা টিচার সচক্রবর্তী (কারণ সন্তোষ সারা জীবন এভাবেই নাম লেখে)। মেন্ডেল এবং মণ্ডলকে সে সমর্থন দিল ঘটা ক’রে মাথা নাড়িয়ে।
— হুঁ, বংশগতি খুব মারাত্মক জিনিস। বাবা যদি অপুত্রক হয়, ছেলেও অপুত্রক হবে!

মায়ার এক দাদামশাই হরিশংকর মাঝেমাঝেই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ঘরের সব টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি হাতিয়ে নিয়ে দু’এক মাসের জন্যে বেরিয়ে পড়ত। নিজের ধুতিচাদরগুলো কাতার দড়ি দিয়ে বেঁধে নিত কোমরে, হাতে একখানি বদ্‌না। এবার বেগ চাপলে জঙ্গলে কাজটাজ সেরে বদ্‌নায় জল নিয়ে উবু হয়ে বসেছে, কিন্তু কটিদেশ হোল্ডঅলে পরিণত হওয়ায় বাঁ হাত কিছুতেই যথাস্থানে পৌঁছচ্ছে না। তখন খুব অবাক হয়ে বিড়বিড় করত — আমার হাত খাটো হইছে, না পাছা দূরি গেছে? বৌয়ের হাড়-জ্বালানো কড়িচণ্ডাল লোকটার ধাত হয়ত এখন চাঁদের রক্তে!

নির্মলের ছোটঠাকুর্দা পিনাকপাণি কুৎসিত দেখতে হেতুক বিয়ে করেনি। তার ভয় ছিল, বউ সৌম্যদর্শন ভাসুরদের অঙ্কশায়িনী হবে। সারা জীবন আত্মীয়-পড়শি যে-মেয়েই পাণিদাদুর পায়ে গড় করেছে, তাকে দুটো স্তন খামচে ধ’রে তুলত সে। শেষে মেয়েরা দূর থেকে জোড়হাতে প্রণাম সারত, বুড়ো করত মুখখিস্তি। বংশ-ধারামতে সেই লোচ্চামিও কি চাঁদের পিছু নিল?

প্রথম দেশলাইকাঠিতে আঙুল পুড়িয়ে দ্বিতীয়টায় মোমবাতি খুঁজে পায় নির্মল, ছেলের জন্মকুণ্ডলী টেনে নিয়ে আর একবার আয়ুর্গণনাসহ মারক-বিচারে বসে। দেখা যায় জৈমিনী, পরাশর, পারিজাত একই দৈব পরামর্শ পেয়ে নিধনভাব-বিবেকঃ অধ্যায়টি লিখে গেছেন — আয়ুর্দাতা যোগত্রয়ের সবক’টিই দুর্বল হওয়াতে অনধিক ত্রিশ বর্ষাদি বয়সে কেতুর দশায়, বৃহস্পতির অন্তরে, শনির প্রত্যন্তরে, বুধের সূক্ষ্ম দশায় এবং শুক্রের প্রাণদশায় জাতকের দফারফা নির্ধারিত আছে।

বুদ্ধিরহিত নির্মল পরাশরসংহিতাপথ ধ’রে ছুটতে থাকে যতক্ষণ না রেড সিগন্যালের মতো “পিতামাতার পাপে বিনষ্ট হয় সন্তান” — এই পরোক্ষ বংশগতি-নিয়মের মুখে পড়ছে! চোখে ফুটে ওঠে দৌলতপুর স্কুল, ভূগোলশিক্ষিকা ঢাকার মেয়ে পারমিতা শূর… তার শাড়ির ভাঁজ-কুশলতা, সহবতবুদ্ধি, সুরের জোয়ারিখেলা রূপ, উদাস কবিতাপাঠ, আশ্চর্য হাতের রান্না…! এক ছুটির দিনে দুজনেরই ভুল ক’রে স্কুলে চলে আসা আর বেলা গড়াতেই হঠাৎ শরীরের শিরাধমনী উপড়ে ফেলা ঝড়জলে একমাত্র ছাতার নীচে পেছল আলপথে হেঁটে ফিরতে ফিরতে টবের দুই ফুলগাছের মতো ঠোঁটে-ঠোঁটে অনিশ্চিত পাপড়িসংযোগ। নিজের অন্যায়ের আঙারে ঝলসে যাওয়া নির্মল মাঝরাস্তা থেকে ছুটে পালিয়ে আসে। এখন ভাবে, সেদিন কোনটা বেশি অপরাধ ছিল, ঐ পাপচুম্বন নাকি পারমিতাকে বৃষ্টিপ্রলয়ে মাঠের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়া!

সাতাশ
এক অক্ষর শব্দও না ক’রে দরজা খুলে উঠোনে নামে নির্মল। শুক্লাতিথির জ্যোৎস্না আমডালের ফাঁক দিয়ে বায়োস্কোপের আলোর মতো তার গায়ে-মাথায় ঘুরে বেড়ায়। ভটচাজবাড়ির কর্তা যদি নির্মল হয়, তবে নির্মলেরও অভিভাবক এই সুরোট বোম্বাই আমগাছখানা। দুটো ডাল চাঁদের বাড়ির দুটো ঘরের মাথায় এমন চাপিয়ে রেখেছে, ভূভারতে কোনও কালবোশেখির ক্ষমতা নেই টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার এক এক শাখায় এক এক জাতের আম আর এমন মিষ্টি, পেটে কৃমি থাকলে তোমার গা ঘুলিয়ে বমি হয়ে যাবে।
তখন চরাচরে একা নড়বড়ে পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম সাইকেলচালক। বাঁ কানে পৈতে জড়িয়ে বাথরুমে উবু হয়ে পেছছাপ সারে নির্মল, তারপর ছাদহীন বাথরুম থেকে রঘুনাথের মাঠে তাকিয়ে থ’ হয়ে যায়।

গোল ঘুরতে ঘুরতে বাবলু গিরি সাইকেল নিয়ে তাঁবুর পেছনে চলে এসেছে। সেখানে মাকে সোয়েটার খুলে দিয়ে ত্রিপলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আর ফুলপ্যান্ট-পরা মা ছেলের ঢলঢলে পুলওভার গায়ে গলিয়ে সাইকেলে চেপে বসল। আমতলার ছায়া-আবডালে দাঁড়িয়ে নির্মল দ্যাখে, মাথায়-টুপি বাবলুর মা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে শুরু করল মাঠচক্কর, হাতের শাঁখাজোড়া জলজ্যোৎস্না মেখে চকচক করে।

গোটা রাতের রাগী শোক কেটে গেল নির্মলের। জীবনের এর চেয়ে দিলখুশ সংজ্ঞা হতে পারে না। শুধু চাঁদ তো নয়, প্রত্যেক রিফিউজির ভবিষ্যতের একটা এক্স-রে নিলে দেখা যাবে প্লেটটা সাদা হয়ে আছে মৃত্যুভয়ের ফুলকপি-মেঘে। তাহলে নৈতিকতা চুলোয় দিয়ে শেষ নিঃশ্বাসবিন্দু পর্যন্ত ভালোবাসো। মহৎ স্নেহের মতো ভালোবাসো। শুরুতে সেই ভিখারিমাসি আর এখন বাবলুর মা তাকে হাত ধ’রে শাস্ত্রবিধির বাইরে এনে আকাশ দেখাল।

শেষ সাতাশ
ফিরে আসা খড়মের খুটখুট কানে আসছে মায়ার। তাদের দু’ঘরের মাঝে ঘুমন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অন্যমনস্ক পাদুটো। তারপর দীর্ঘস্থায়ী কাগজ ছেঁড়ার শব্দ পেল মায়া। শুধু কাগজ নয়, ফরফর ক’রে কালিঅক্ষর ছিঁড়েকুটে যাচ্ছে, প্রজন্মগড়ানো রেওয়াজ আস্ত থাকল না, অলুক্ষুনে ঐতিহ্য হারিয়ে মুছে যাক — বেড়ার গায়ে আঁকা ভোটের ছবিতে সাপটে চুনকাম ক’রে দেওয়ার মতো। আহ, উথাল সমুদ্রে পিপেভর্তি তেল ঢেলে দিয়ে অবধারিত জলডুবি থেকে বাঁচা গেল। নমো শ্রীহরি!

.
(আর একটু লিখতে পারি?)

যাতনার নকশিকাঁথা

আমার পূর্ণ আকাশে তুমি অর্ধচন্দ্র। একদিকে তার মায়াময় বিভায় আমার আনন্দসুষমা, আর বাকি আধখানায় অন্ধকার। সেই আধখানা আকাশ যেন দূরের নক্ষত্র দিয়ে কালো পশমিনায় বোনা একটা যাতনার নকশিকাঁথা।

ওগো প্রেম, তুমি তো এমনই! তোমার ভেতর একজন ঈশ্বরীতলার ফুলধূপচন্দনগন্ধের সম্ভ্রম আর শুচিবাইগ্রস্ত। তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আর একজন বড্ড নিজের, বড্ড আপন। ধুলো পায়ে এসে ধপ করে দুয়ারের মাটিতে বসে পড়ে, একটা আসন বা পিঁড়িরও প্রত্যাশী নয় সে।

মানুষ যে দুটোকেই চায়! কিন্তু সে সোনার হরিণ। ইঙ্গিতে ডাক দিয়ে পালিয়ে বেড়ায় চিরকালই!

ডাক্তারের চেম্বার, হোলি বাইবেল এবং

313 গত পরশু গেছিলাম আমার ডাক্তার জেরল্ড টার্নারের কাছে রুটিন চেক আপ করাতে। তখনই তাঁকে বললাম ডান পায়ের সমস্যার কথা। এবং বললাম শহরের দ্য বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে যার কাছে রেফার করলেন, তার নাম জেমস হার্ট। এবং ডাঃ টার্নার অভাবনীয় দ্রুততার সাথে আজকের জন্য এপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন।

আজ সকাল ১০ টায় মিথীলাকে নিয়ে গেলাম অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে। বিশাল বড়ো পার্কিং গ্রাউন্ড দেখে মিথীলা অবাক, একটা ছোটো শহরে অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে এতো গাড়ি! বললাম, তোর মা ছাড়াও এই শহরে লুলা ল্যাংড়া মানুষের সংখ্যাই বেশী। লুলা ল্যাংড়া শব্দ দুটোর বিদ্রুপাত্মক ব্যবহার সম্পর্কে মিথীলার ধারণা নেই। তাই নিশ্চিন্তে শব্দ দুটো ইউজ করলাম।

যাই হোক, অন্যান্য ফরমালিটিজ শেষ করে নার্সের সাথে ডাঃ জেমসের কক্ষে এসে পৌঁছেছি। নার্স বলে গেলো, দশ মিনিটের মধ্যেই ডাঃ হার্ট আসছেন। মাঝারি সাইজের বর্গাকৃতি কক্ষ, দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে ডাক্তারের জন্য নির্দিষ্ট একটি টেবিল একটি চেয়ার, কক্ষের মাঝখানে আয়রন রডের তৈরি রোলিং বেড, রোলিং বেডের শিয়রের বাম পাশে রোগীর জন্য একটি চেয়ার, বেডের ডান পাশে আরেকটি চেয়ার।
কক্ষের দুধ সাদা রঙ চার দেয়ালের তিন দেয়ালে তিনটি পেইন্টিং। দুই মিনিটেই কক্ষের চেহারা দেখে নিলাম, সুন্দর ছিমছাম।

আমার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে মিথীলাকে বললাম আরেক চেয়ারে বসতে। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ডাক্তারের জন্য সাজানো টেবিলে নজর গেলো। ছোটো টেবিলের এক কোণে সবুজ রঙের একখানা ফাইল, সাদা রঙের ফাইল অর্গানাইজার আছে। আর আছে পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল। আমার চোখটা আটকে গেলো বাইবেলের উপর। সবুজ রঙের ফাইলের পাশেই বাইবেল রাখা, ডাক্তার এবং রোগী উভয়ের চোখ বরাবর।
আমেরিকায় যত্র তত্র বাইবেল গ্রন্থ সাজানো থাকে। গির্জায় তো থাকেই, গির্জা ছাড়াও যে কোনো সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকের অফিস, গ্রসারি শপের কাউন্টার, বাস টার্মিনালের ওয়েটিং রুম, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির অফিস- লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, হাইওয়ে ধরে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই রেস্ট এরিয়া থাকে, সেই রেস্ট এরিয়ার অফিসরুমে সেন্টার টেবিলে বাইবেল থাকে। কোথায় থাকে না, সেটাই ভাবছি।

বাইবেল সাজানো থাকে বলেই যে সবাই বাইবেল খুলে বসে থাকে তা নয়। বাইবেলের পাশ থেকে হয়তো ফ্যাশন সংক্রান্ত কোনো ম্যাগাজিন কেউ তুলে নেয়, কেউ তুলে নেয় টাইম ম্যাগাজিন। বাইবেল দেখেছি সর্বত্র কিন্তু কাউকেই বাইবেল হাতে নিয়ে বসতে দেখিনি। এই যে যেখানে সেখানে বাইবেল সাজানো থাকে, বাইবেলের পাশেই হয়তো উন্মুক্ত পা কোনো মডেলের ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন পড়ে আছে, বাইবেল না তুলে কেউ হয়তো ম্যাগাজিন থেকে উন্মুক্ত পা মডেলের ছবি দেখছে, তা নিয়ে কোনো খৃষ্টানের মাথা ব্যথা নেই, আপত্তি নেই, অনুভূতিতে আঘাত নেই, গির্জার কোনো ফাদারের চোখ রাঙানি নেই।

গ্রন্থ সবই পবিত্র, গ্রন্থ পড়ার জন্য সাজানো থাকে। ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, নভেলও পড়ার জন্য, ফ্যাশন রান্না বিষয়ক ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, বাইবেলও পড়ার জন্য। যার যেটা প্রয়োজন সে সেটা পড়বে। আমাদের দেশে এটা ভাবা যায় না। আমেরিকায় মদের দোকানেও বাইবেল থাকে, কেউ এর মধ্যে কোনো অন্যায় খোঁজে না। আর আমাদের দেশে পবিত্র কোরান গ্রন্থ নিয়ে কত অপ রাজনীতি চলে।

আমেরিকায় খৃষ্টান ছাড়াও মুচি মেথর গোয়ালা হিন্দু বৌদ্ধ নাস্তিক আস্তিক যে কারো হাতেই বাইবেল থাকতে পারে, যে কারো বাড়িতে বাইবেল থাকতে পারে। তাতে বাইবেলের সম্মান হানি হয় না। পাদ্রীরা তো বাইবেল পড়ার জন্য এরে তারে ফ্রি বাইবেল দিতে চায়। যাকে দিচ্ছে সে হিন্দু না মুসলমান তা জানতে চায় না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাইবেল দেখে তাদের জাত যায় না। অথচ আমাদের দেশে কথায় কথায় কোরানের অবমাননা

হয়েছে ধুয়া তোলা হয়, তাতে কত মানুষের প্রাণ যায় মান যায় ঘর বাড়ি যায়, ব্যবসা বাণিজ্য জায়গা জমি যায়, নারীদের সম্মান যায় এমনকি গোয়াল থেকে গরু বাছুর ছাগলও লুট হয়ে যায়! পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের দিকে চোখ রেখে দশ মিনিটের মধ্যেই আমেরিকা আর বাংলাদেশ ঘুরে ফেললাম। তখনই সাত ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা, গৌর বর্ণ, ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের কোঠায় সৌম্য দর্শন ডাঃ জেমস হার্ট হাসিমুখে প্রবেশ করলেন।
হাসিখুশি মানুষ দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আর হাসিখুশি মানুষটি যদি হয় সুপুরুষ অথবা সুন্দরী ডাক্তার, ওষুধ দেয়ার আগেই আমার রোগ যন্ত্রণা কমে যায়।

ডাঃ হাসিমুখেই চোখের তারা আমার আর মিথীলার দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে রোগী? প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, যেহেতু হাঁটুর প্রবলেম তাহলে তুমিই রোগী এবং তুমি রিটা রয়? আমার সাথে কথা বলে ডিটেলস জানার পর ডাক্তার বললেন, তোমার হাঁটু পরীক্ষা করে দেখার আগে বলছি, এক্সরে রিপোর্ট বলছে তোমার এংকেলে বাজে ধরনের ফ্র‍্যাকচার হয়েছে, লিগামেন্ট তো ছিঁড়ে গেছেই হাড়েও ফ্র‍্যাকচার হয়েছে।
এরপর আমাকে রোলিং বেডে উঠে পেছনের রেস্ট সীটে হেলান দিয়ে পা সামনের দিকে ছড়িয়ে বসতে বলা হলো।

আমি পা ছড়াতে গিয়েও সোজা করে ছড়াচ্ছি না দেখে জেমস ভাবলেন পায়ে ব্যথা। বললাম, না পায়ে ব্যথা নেই। পা সোজা মেলতে চাইছি না কারণ টেবিলে হোলি বাইবেল রাখা আছে। আমার পা সোজা করলে বাইবেলের দিকে হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন, তাতে কি। হোলি বাইবেল তো হোলি প্লেইসে রাখা আছে, আর তোমার পা আছে বেডে। তুমি তো টেবিলে পা রাখছো না!
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমেরিকান ডাক্তারের ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রার সাথে বাংলাদেশী আমার ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রা তো মিলবে না।

আমাদের দেশে শিবের মাথায় পবিত্র কোরানের ফেইক ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়! সেই আমাকে যদি পবিত্র বাইবেলের দিকে পা ছড়িয়ে বসতে বলা হয়, আমার তো অস্বস্তি হবেই। ডাক্তার এবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলগোছে বাইবেলটি তুলে ফাইল অর্গানাইজারের উপর রেখে দিলেন। তারপর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, এবার নিশ্চিন্তে পা লম্বা করে বসো।

ডাক্তারের অমায়িকতায় আমার হাঁটু ব্যথা সেরে গেছে। ডাক্তার আমার হাঁটু যতভাবেই টুইস্ট করে পরীক্ষা করছে, আমার ব্যথা লাগছে না। এমনকি এংকেলেও ব্যথা নেই। ডাক্তার বললেন, তোমার এংকেল যেহেতু তোমায় তেমন বদার করছে না, আপাতত তোমাকে কিছু এক্সারসাইজ দেখিয়ে দেয়া হবে, বাড়িতে করবে। আশা করি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এংকেল ঠিক হয়ে যাবে। এবার আসি হাঁটুর প্রশ্নে। হাঁটুতে মেজর কোনো সমস্যা নেই। আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ আছে, এক্সরেতেও তেমন সিগনিফিকেন্ট সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। টিস্যুতে একটু রাবিং স্পট দেখা যাচ্ছে যার কারণে অল্প ইনফ্লামেশন আছে।

আপাতত এন্টি ইনফ্লামেটরি মেডিসিন দেবো দিনে একটা, আর হাঁটুর এক্সারসাইজ। এক মাস পর আবার আসবে, তখন রেজাল্ট দেখবো।
কি, তোমার কিছু বলার আছে?
বললাম, ডাঃ টার্নারকে অনুরোধ করেছিলাম শহরের বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে বেস্ট সার্জনের কাছেই পাঠিয়েছেন।

আমার এই কথাতে জেমস হার্ট বিনয়ের সাথে মাথা এমনভাবে ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ বললেন, আমার মনে হলো, আমার সন্তানের বয়সী এই ডাক্তারটিকে প্রণাম করি।
ডাঃ জেমস হার্টের নির্দেশে ফিজিও থেরাপিস্ট লাল এবং নীল রঙের ব্যান্ড দিয়ে আমায় এংকেল ( লাল ব্যান্ড) আর হাঁটুর ব্যায়াম ( নীল ব্যান্ড) দেখিয়ে দিলেন, শিখিয়ে দিলেন এবং এংকেল ও হাঁটুর ব্যায়ামের ছবি ছাপিয়ে ব্যান্ড সহ ছবিগুলো দিয়ে দিলেন।

ডায়নোসরের মাংস

আহা রে ধনী হওয়ার কষ্ট! শুক্রবার সকাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কাঁচাবাজারে প্রচুর ভিড় হয়। অভিজাত ধনীরাও এই দিনটাতে কেনকাটা করতে বাজারে যায়। প্রাণ খুলে দুই হাতে বাজার করে। তাদের বাজার করাটা সবাই দেখে। হিংসা করে। কিন্তু পছন্দের জিনিস কেনার জন্য ধনীদের সংগ্রামটা অনুভব করে না। এই যেমন তহুরা বিবি আজ আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে নিজে ডায়নোসরের মাংস কিনতে বাজারে এসেছিলেন।

বাজারে ভিতরে কয়েক সারি মাংসের দোকান। দোকানগুলিতে থরে থরে মাংস সাজানো, লোহার সিকের আংটায় ঝুলছে টুকরো টুকরো মাংস। তহুরা বিবি পৃথিবীর সবচে দামী মাংস, অর্থাৎ ডায়নোসরের মাংস কিনবেন। তিনি ধনী মানুষ, ঘুম থেকে জাগলেই তার মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। প্রতিদিনই ধনী হয়ে ওঠেন। একজন আদর্শ ধনী হিসেবে সাপ্তাহিক ছুটি উদযাপনে ডায়নোসরের মাংস ছাড়া তিনি আর কি’ই বা খেতে পারেন!

আমি তহুরা বিবির তুলনায় কম ধনী। প্রতি সপ্তাহে ডায়নোসরের মাংস কেনার সামর্থ্য নাই। খুব বেশী হলে মাসে অন্তত একবার কিনতে পারি। কিন্তু বৃটেনের মানুষ টমেটো কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দু’বেলা খাবার যোগাতে পশুর মত লড়ছে, অস্ট্রেলিয়ায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলো পান্তা ভাতে নুন পর্যন্ত যোগাতে পারছে না, তখন ডায়নোসরের মাংস খাওয়া অমানবিক বলে মনে করি। শতবার চেষ্টা করলে এতটা অমানবিক হতে পারব না।

গোরু, খাসি আর মুরগির সস্তা দামের নিম্নমানের মাংস হল গখাদ্য। গখাদ্য মানে গোখাদ্য নয়, গরীবের খাদ্য। এসব মাংস কিনলে আমার মত ধনীর মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। রুচি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কেও কেও টিপ্পনি কেটে বলবে, “লাখ টাকার কাঁথায় শুয়ে দশ টাকার স্বপ্ন দেখা! ছি:. ছি:. ছি।” তাই ডায়নোসরের তুলনায় সস্তা কিন্তু গখাদ্যের তুলনায় দামী ম্যামথ হাতির মাংস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্ষুধাকাতর বিশ্বে একমাত্র আমাদের বাজারগুলিই ব্যতিক্রম, লক্ষ লক্ষ বছর আগের প্রাণীর মাংসেও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

দেরী করে বাজারে আসার কারণেই হয় তো হাতির মাংস পেলাম না। সোবহান কসাই বলল, “সরকারপন্থী মিডিয়া হাউজগুলি ভাবমূর্তির দামে হাতির মাংস কিনে নিচ্ছে। তাই ব্রেকিং নিউজে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও খালি চোখে মাংস দেখা যাচ্ছে না।”

হাতির পরিবর্তে প্রাগৈতিহাসিক কালের দাঁতাল বাঘের মাংস কিনব কি নেহারি খাওয়ার জন্য দাঁত কিনব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তখনই কাজের বুয়া তহুরা বিবির সাথে দেখা হল। সাধারণ কুশল বিনিময়ের পর বললেন, “ডায়নোসরের মাংস কিনতে এসেছিলাম। কোনো দোকানে টিরানোসরাসের মাংসও পেলাম না।”

তহুরা বিবির চেহারায় গভীর ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। তার দুর্দশা দেখে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলাম। আনন্দে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। ধনীদের দুর্বিপাকে আনন্দ অনুভব করা গরীবদের সহজাত অভ্যাস, তাই বলে এতটা গরীব হই নাই যে হাসির স্তর পর্যন্ত নামব। তিনি আরও জানালেন, মাছবাজারে তিমি বা হাঙর মাছ নেই। অন্যসব মাছের সাথে তেলেপিয়া ও পাঙ্গাসের দাম এত কমেছে যে একমাত্র গরীব ছাড়া কারো পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

তহুরা বিবি দীর্ঘশ্বাসের সাথে “ধনীরা কি খেয়ে বাঁচবে!” বলার পর প্রস্তাব দিলাম, “তবে মুরগী পট্টিতে যাওয়া যাক।” ধনী হবার পরও, পকেট ভর্তি টাকা আর পাকস্থলী ভর্তি উন্নয়ন থাকার পরও, শুধু ছুটির দিন উদযাপনের স্বার্থে দু’জন বড়লোক মিলে মুরগি পট্টিতে যাই। ব্রয়লারের দাম এত কমেছে যে কিনতে রুচি হয় না। দু’জন মিলে ভাগা হিসাবে সাজানো ডায়নোসরের পায়ের মত দেখতে ব্রয়লার মুরগির ঠ্যাং কিনি, হাতির মাংসের পরিবর্তে ব্রয়লারের গিলা-কলিজা কিনি।

বাজার শেষে বাসায় ফেরার পথে আমরা দু’জন ঐক্যমত পোষণ করি যে, দেশটা স্বল্পসংখ্যক গরীবের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে৷ দয়ায় টইটুম্বুর সরকার শুধু গরীব শাবকদের স্বার্থই রক্ষা করছে। অথচ ধনীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অঢেল প্রাচুর্য, প্রতিদিন বেড়ে যাওয়া মাথাপিছু আয়, দু’হাত খুলে বাজার করা আর রাজকীয় বিলাসিতায় মগ্ন ধনীদের বসবাসের জন্য দেশটা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।

বসন্তের তারাখসা

out.

এমন একটা সময়ে তুমি এসেছিলে যখন একটা কালো অন্ধকারের মেঘ থামিয়ে দিয়েছিলো আমায়। ফুরিয়ে যেতে যেতেও উঠে এসেছিলাম, বিশল্যকরণীর মতো তোমার স্পর্শে। তোমার জন্যই বসন্ত এসেছিলো। তোমার জন্যই শিমূলে, পলাশে খেলেছিলো জীবন। রাতজাগা ক্লান্ত পাখিটা গেয়ে উঠেছিল ভাটিয়ালী সুরে জীবনের গান। তোমার স্পর্শে গুমোট জীবনেও উঠেছিল ঢেউ। তোমার চোখ থেকে আবীর মেখেছিলো ধুসর মন। সাতটি রং সেজে উঠেছিল আমার চোখের আকাশে।

হঠাৎই অবিশ্বাসী কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে, ‘ও কিছু নয়’ বলে চুপ থেকেছি, ভেঙেছি ভীষণ। অথচ তোমাকেই দিয়েছিলাম এক সাগর ভালোবাসা। কবোষ্ণ বুকের তরলের মতো।

ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জীবনের টুকরো গুলো গোছাতে গোছাতে ভীষণ ক্লান্ত। একদিন নিঝুম রাতের ধূমকেতুর মতো, রাতজাগা কোনো তারাখসার মতো, কিংবা দাবানলে ঝলসে যাওয়া কোনো শুকনো পাতার মতোই ঝরে যাবো। কোনো ডাকেই আর ফেরাতে পারবে না।

শুধু পড়ে থাকবে আমার ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত পৃথিবী। কোনো বিবর্ণ ভুলে যাওয়া জলছবি মতো।
————
.
প্রচ্ছদের ছবি আঁকা: আমি।

মায়ের গন্ধ! … আজও খুঁজি, আজও পাই

Screenshot আমার মা সারাজীবন চুলে নারকেল তেল মাখতেন। শ্যাম্পু করতে দেখিনি, মাঝে মাঝে জেট পাউডার জলে গুলে তা দিয়ে মাথার চুল ধুতেন। চুল শুকিয়ে ঝরঝরে হওয়ার সাথে সাথে তেলের শিশি নিয়ে বসতেন, চুল ভিজিয়ে তেল দিতেন। আমার মা কখনও গায়ে মুখে লোশান ক্রিম বা স্নো মাখেননি। পন্ডস পাউডার অথবা কিউটিকোরা পাউডার মুখে গলায় ঘাড়ে মেখে কপালে সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন, হয়ে যেত সাজগোজ।

সবার মায়েরই আলাদা একটা গন্ধ আছে। সেই গন্ধ দিয়েই সন্তান তার মা’কে চিনতে পারে। জন্মের পর শিশু তার মায়ের কোলে থেকে যে গন্ধটা পায়, সেই গন্ধটাই তার মায়ের গন্ধ। আমার মায়ের গন্ধ ছিল মাথায় থাকা নারকেল তেল, আর গায়ে জড়িয়ে থাকা ব্লাউজ শাড়ি হতে আসা ন্যাপথলিনের গন্ধ মিলে মিশে ককটেল ধরণের একটা গন্ধ। এই গন্ধের বর্ণনা হয় না, এই গন্ধের সাথে ফুল ফল পারফিউমের গন্ধের মিল হয় না, এটা আমার মায়ের গন্ধ। গন্ধটা এমন ছিল যে, কেউ যদি একশটা একই রকম শাড়ি দিয়ে আমায় বলতো, গন্ধ শুঁকে বের করো কোন্ শাড়িটা তোমার মায়ের।

আমি প্রতিটি শাড়ি শুঁকে শুঁকে ঠিক বের করে ফেলতে পারতাম, কোন্ শাড়িটা আমার মায়ের। মায়ের বালিশের ওয়ার, গামছা বিছানার চাদরে ছিল আরেকরকম গন্ধ, শাড়ির গন্ধের থেকে আলাদা। এই গন্ধে নারকেল তেলের পুরানো গন্ধ মিশে থাকতো। ওটাও ছিল মায়ের গন্ধ, আমার মায়ের গন্ধ। আমার মাসি মামী পিসীদের জামাকাপড়, গামছা বালিশ থেকে অমন গন্ধ আসতো না।

২০১২ সালে বিনা নোটিশে আমার মা মারা যান।
মায়ের বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর, কিন্তু মায়ের দেহ ছিল সতেজ সুঠাম, মৃত্যুর জন্য তখনও মায়ের দেহ মন তৈরী হয়নি। তারপরেও মা’কে চলে যেতে হয়েছে। বিনা নোটিশে মৃত্যুটা হয়েছে বলেই আমরা মায়ের মৃত্যুটাকে সহজ কঠিন কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুর পর এক বছর উদভ্রান্তের মত আমি চলেছি। রান্না খাওয়া চাকরি সংসার সবই করেছি, কিন্তু কিছুই স্বাভাবিকভাবে করিনি।

ওয়ালমার্টে কাজের ফ্লোরে আছি, ঝরঝর করে চোখ থেকে জল পড়ছে। কাস্টমারের সাথে কথা বলছি, চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। ঐ সময়টা আমি সুযোগ পেলেই সবার অলক্ষ্যে নিরালা স্থান খুঁজে নিজের মত হাঁটতাম আর মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলতাম। একদিন কাজের ফাঁকে অমনই নিরালায় হাঁটছিলাম, পেছন থেকে হালকা বাতাসের ঝাপটা আমার কান ঘেঁষে চলে গেলো। সেই বাতাসের ঝাপটায় আমার মায়ের গন্ধ ছিল। মায়ের বালিশে গামছায় বিছানার চাদরে যে গন্ধটা ছিলো, মায়ের সেই গন্ধটা। নারকেল তেলের পুরনো গন্ধের মত, ওটার ব্র্যান্ড নেম ছিল, ‘আমার মায়ের গন্ধ’।

সেদিন একবার নয়, দুই তিনবার মায়ের গন্ধটা নাকে এসে লাগলো। অমন বেদিশা সময়েও আমি দিশা ফিরে পেয়েছিলাম। প্রথমবার গন্ধ নাকে আসতেই খুঁজছিলাম গন্ধের উৎস। এটা তো হতে পারেনা যে এক বছর পর স্বর্গ থেকে মা বাতাসে ভেসে এসেছে! তাহলে মায়ের গন্ধ কোথা থেকে আসতে পারে! ঘাড় থেকে আমার চুলের গুছি টেনে নাকে ছোঁয়ালাম, সেখানে আমেরিকান শ্যাম্পুর গন্ধ। আমি মাথায় তেল দেই না, তেলের গন্ধ আসবে কোত্থেকে! বিয়ের আগে হলেও কথা ছিল, তখন মায়ের নির্দেশে চুলে জবজবে করে তেল দিতেই হতো, সেটাওতো নারকেল তেল নয়। আমার মাথার চুলে মাখা হতো জবাকুসুম তেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের টিভি আইলের সামনে, সেখানে তেল স্নো পাউডার সামগ্রীও সাজানো নেই। তাহলে মায়ের গন্ধটা এলো কোথা থেকে, তবে কি মনের ভুল!

ঠিক তেমন সময় আরেকবার, আরও একবার মায়ের গন্ধের ঝাপটা আমার নাকে ছুঁয়ে গেলো! আশেপাশে আর কেউ ছিলোও না যে তাদের গায়ের গন্ধ বাতাসে আসছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! তবে কি সত্যিই মা বাতাসের সাথে ভেসে আমায় ছুঁয়ে দিতে এসেছিলো! মা কি স্বর্গে বসে দেখতে পায় যে, আমি ওয়ালমার্টে কাজের ফাঁকেই আনমনা হয়ে মা’কে খুঁজি, মায়ের জন্য কাঁদি! তাই মা বলে গেলো, আমি আছি!
মায়ের গন্ধটা এরপর অনেকদিন আর পাইনি। মায়ের কথা ভেবে এখন উনমনাও হই না। তবে খুব একাকী বোধ করি।

দশ বছর পেরিয়ে গেছে মা নেই, গত দশ বছরে প্রতি দিন টের পেয়েছি, আমি কতখানি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি। এখনও চোখে জল আসে, তবে সব সময় আসে না। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে উঠে শিয়রের কাছে রাখা মায়ের ছবিতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করি। ভক্তিতে গদগদ হয়ে এই কাজটা করি না। মায়ায় মমতায় ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে এই কাজটা করি। মনে হয়, মা আছে। এখন আমার আর মনে হয় না, মা নেই।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, মনটা অস্থির। অস্থির সময়ে আগে মা’কে ফোন করতাম। মায়ের সাথে চেঁচামেচি করতাম, চোপা করতাম, মা’কে বকতাম সবই করতাম, এরপর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ বাণী নিয়ে অস্থির মনটাকে সুস্থির করতাম। এখন তো মা নেই, কার সাথে চোপা করব? মাসীর সাথে, পিসীর সাথে, মামীর সাথে, কাকীর সাথে? তাঁদের সাথে চোপা করলে তাঁরা দ্বিতীয় দিন আর আমার সাথে কথা বলবে? মোটেও না। রাগারাগি, গলাবাজি মায়ের সাথে করা যায়, আর কারো সাথে না। একমাত্র মায়েরাই বুঝতে পারে ছেলে মেয়ের অস্থিরতা।

মেয়ে কেন এত চেঁচামেচি করছে, মায়ের সাথে চোপা করছে তা মা ছাড়া কার এত দায় পড়েছে বুঝতে চাওয়ার! আমার অস্থিরতা কমানোর মানুষটা দশ বছর হয়ে গেলো নেই, তাই আমি সুস্থির হতে পারি না। আমার পারিবারিক জীবনে, ব্যক্তি জীবনে কতইতো উঠা নামা চলে, সবই মনের ভেতর চেপে রাখি। মনের ভেতর চাপি আর ভাবি, মা যদি থাকতো, মা’কে ফোন করে সব খুলে বলতাম। মা নিশ্চয়ই আমায় ইতিবাচক কথা বলে মন খুশি করে দিত। সকল পুরানো কলিগদের সাথে মায়ের যোগাযোগ ছিল, তাছাড়া স্কুলের আয়া ছিল কয়েকজন যারা মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে এসে কোথায় কার পরিবারে কি কি ঘটেছে তার বার্তা শুনিয়ে যেতো। সেগুলো থেকেই মা আমার কাছে কোট করতো।

মা হয়তো বলতো, ” থাক, যা হইছে হইছে, এত ভেবে করবি কি? ঐ তো আমাদের শিউলি টিচারের কথা শুনলাম, আঞ্জুমান আরা আপার কথাও শুনলাম। তাগোও একই সমস্যা। আজকাইল এই রকম ঘটনা আকছার ঘটে। এইসব দুশ্চিন্তা মাথা থিকা ঝাইড়া ফালাইয়া সংসারে মন দে”।
নাহ! মা চলে যাওয়ার পর এখন কেউ আমায় কিছু বলে না, আমিও কাউকে কিছু বলি না।
মনে মনে মা’কে মিস করি।

এভাবেই দিন কাটে, মায়ের গন্ধও ভুলে গেছি। আজ দুপুরের দিকে ডিভানে শুয়ে টিভিতে জি বাংলায় রাণী রাসমণি’ দেখছিলাম। আমি এই ধারাবাহিকগুলো পছন্দ করি। দুই শত বছর আগের ঘটনাগুলোর নাট্যরূপ, এগুলো দেখে হুবহু না হোক, কিছু তো ইতিহাসের গন্ধ পাই। ঠিক সেই সময় আমার নাকে মায়ের গন্ধ এসে ছুঁয়ে গেলো!

চমকাইনি, আরেকবার পেলাম গন্ধটা। শাড়ি ব্লাউজ পাউডারের গন্ধ নয়, সেই নারকেল তেলের পুরনো গন্ধ যা মায়ের বালিশ, গামছা, বিছানার চাদর থেকে আসতো। মনে পড়ে গেলো, শৈশব কৈশোর যৌবনের শুরুর দিকে প্রতি রবিবার এবং গরমের ছুটির দুপুরে মা গল্পের বই নিয়ে শুতো। আমি মায়ের বালিশে মাথা দিয়ে শুতাম, আর মায়ের তেলে ভেজা চুল নিয়ে খেলা করতাম। সেই থেকেই ঐ গন্ধটাই আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে গেছে।

আজ আর চারদিক খুঁজিনি, কোথা থেকে গন্ধ আসে বলে। অভ্যাসবশে নিজের চুলের গুছিতে নাক দিলাম, শ্যাম্পুর গন্ধ। থাক, মায়ের গন্ধ মায়েরই থাক। মায়ের গন্ধ কেন আমার চুলে আসবে? আমার মনটা যে এত অস্থির, তাতো মা স্বর্গ থেকে দেখতেই পায়। মা’কে মিস করি, আজও মিস করি। তাই মা মাঝে মাঝেই আমায় ছুঁয়ে যায়, এবং প্রতি বার বলে যায়, “আমি আছি”।

.
‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’—- ( আর্কাইভ থেকে )

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

তেইশ
“হৌত লেখা কপালে আর মৌত লেখা পা’য়
যার যেখানে মৃত্যু আছে, পায়ে হেঁটে যায়

ধরো, এখুনি আমার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মিত্তু হল। আমি তো নিজিই পায়ে হেঁটে এয়েছিলাম তোমার বাড়ি। আসিনিকো?
এবার ধরো, প’ড়ে যেতে দেখে তুমি ছুট্টে এসে আমার মাথাটা কোলে তুলে নিলে। হাঁ করলাম, এট্টু জল দিলে গেলাস থেকেন। জলঢোঁক খেয়েই আমি চোখ মুদিছি। শেষ বেলায় এই কাজ কে করে, ছেলে তো? তাহলে তুমি আমার সন্তান হলে কি না!”

কারও কারও সঙ্গে আচমকা পরিচয় হয়, তারপর মাথা খুঁড়লেও জনমভ’র আর খোঁজ নেই। সেই গোবিন্দভক্ত ভিখারিবুড়িও তাকে কথাক’টা বলে অন্তর্ধান হয়ে গেছে।

একটু আগে ঘরের দেয়ালে নিজের ফুল-ফ্রেম ছায়া দেখে চমকে উঠেছিল নির্মল। যেন অতিকায় যম কাঁধে চেপে ব’সে এইসব বিনাশবার্তা লিখিয়ে নিচ্ছেন! মনে হয়েছিল, চাঁদের সর্বোচ্চ আয়ু উনত্রিশ, আর বাবা বাণীনাথের তৈরি তার নিজের জন্মপত্র বলছে, ‘নবতি বর্ষানী জীবতি’। সন্তানশোকে পুড়ে আঙরা হতে না চাইলে এখনই পালানো উচিত জীবনের দরজায় তালা ঝুলিয়ে।

তারপর ভিখারিমাসির কথা মনে প’ড়ে ভূমিকম্পের পর নিজেকে নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বার করছিল সে। ক’বছর আগে হলেও নিরক্ষর জনতার এমন হাবিজাবি বিশ্বাসের ধারই ধারত না, হয়রান হয়ে যেত উপনিষদের পাতা ছানতে ছানতে। এই নাও বৃহদারণ্যক আর ছান্দোগ্য থেকে মায়াবাদের তারাকুচি — সুষুপ্তির অবস্থাই আত্মার স্বরূপ, ব্রহ্মাবস্থা। আত্মা যখন স্বধর্ম পায়, তখন জগৎ বর্তমান থাকে না। তাই আত্মা বা ব্রহ্মের কাছে মহাবিশ্বের কোনও অস্তিত্ব নেই। নাও কঠোপনিষদের শ্লোক : পুত্র ইত্যাদি প্রিয় মানুষও অনিত্য, অসার; না কোনও কিছু থেকে ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়, না ব্রহ্ম থেকে তৈরি হয় কোনও বস্তু… নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ। এই মিথ্যে বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়াশক্তির খেলা মাত্র।

কিন্তু কলোনিতে নীড়বাঁধা নির্মল, যার মনের একপিঠ থমথমে ভিটে হারানোর কষ্টে, আর একপিঠ কালকীখাবো-র তরাসে অস্থির, এক সময় আবিষ্কার করল, দর্শনের স্বতঃপ্রমাণ মীমাংসাগুলোয় তার সন্দেহ জাগছে। শংকরের ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের ২।৩।১৬ নম্বর শ্লোকটা ধরা যাক : এক জন্মের কর্মের ফল যখন সেই জন্মে সম্পূর্ণ ভোগ করা যায় না, তখন পুনর্জন্মে ওই একই আত্মা উপস্থিত থাকবে।

কর্মফল আছে এবং কর্মীকে ফল ভোগ করতেই হয় — এমন বিশ্বাস এই শ্লোকের পূর্বগামী; শঙ্করাচার্যের মতে ব্যাপারটা নীতি আর যুক্তিসম্মতও। হয়ত তিনি কোনও অত্যাচারী রাজাকে ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে জীবন কাটাতে দেখে ভেবেছেন ব্যাটা এ-জন্মে পার পেয়ে গেলি, কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না; পরের বার ভগবান ঠিক মজা বুঝিয়ে ছাড়বে। এভাবে কর্মবাদের মোমবাতির মাথায় জ্ব’লে উঠেছে জন্মান্তরবাদের আলেয়া।

কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, জীবন নীতিবুদ্ধি মেনে চলবে, আবার চলবেও না। বাস্তবতার এলাকা আসলে ক্ষমতাঘেঁষা, সুবিধেনির্ভর। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের মতো কাজ আর কাজের ফলের মধ্যে কান টানলে মাথা আসার মতো কোনও শারীরিক আত্মীয়তা নেই। তাই দার্শনিক চারপাশের বাস্তবকে তার পছন্দসই ধারণার সঙ্গে মেলাতে চাইলে রূপকথারই জন্ম হবে শুধু।

চব্বিশ
হারিকেনের আলো কেরোসিন ফুরিয়ে দপদপ করছে, সেটি নিভিয়ে রাত দুটোর গ্রামীন অন্ধকারে পদ্মাসনে শিরদাঁড়া সোজা ক’রে বসে থাকল নির্মল। ঘর জুড়ে চাঁদ-সঞ্জু-বাসুর নিদ্রিত আ-নাভি নিঃশ্বাসের ঝড় বইছে। নির্মলের ঘুম এখনও কোন দূর কাওরাপাড়া দিয়ে আসছে-যাচ্ছে কে জানে!

বিছানায় ব’সে সে ভাবছিল বরুণের কথা। বনমালীপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশানের ইতিহাস টিচার, গোটা বারাসাতে টুকাইদা-ডাকে বিখ্যাত বরুণ মিত্র ছিল সিপিআই পার্টির সদস্য। তারপর দলে রাশিয়া-লাইন আর চায়না-লাইনের ঝামেলা বাড়তে বাড়তে গত বছর জুলাইয়ে ডাঙ্গে-বিরোধী চিনপন্থী নেতারা তেনালি কনভেনশান ডেকে দেয়। মাস তিনেক হল, কলকাতার ত্যাগরাজ হলে মিটিং ক’রে নতুন দলের নাম ঘোষণা হয়েছে — কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সসিস্ট)। আর সঙ্গে সঙ্গে সিপিআইএম নেতাকর্মীদের একধারসে ধরছে-পাকড়াচ্ছে পুলিশ। এখন সেভেনের ক্লাসটিচারের পিরিয়ডটা বেশির ভাগ দিন অন্য কেউ নেয়, মাঝেমাঝে টুকাই কলোনিমোড়ের বাড়ি থেকেও বেপাত্তা, কিন্তু যেদিন স্কুলে এসেছে, টিচার্স রুম জমিয়ে রেখে দেবে। গতকাল যেমন তার সঙ্গে ভারতীয় ধর্মনীতি নিয়ে তর্ক বাধাল। নির্মলের সংশয় বরুণের অনেক সমালোচনাকেই ধ্বনিভোটে জিতিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পণ্ডিতমশাই হিসেবে হিন্দুধর্ম তারই দুর্গ, যাকে বাঁচানোর দায়িত্বও তার। নিজের কালাপাহাড়ি ভাবনাগুলো সে ভুলেও লোকনজরে আনে না।

বরুণ বলছিল, ধর্মের হিসেবে যা স্বর্গলোক,
সেটা ধরাছোঁয়ার জিনিস নয়। কিন্তু গরীব মানুষ জেগে উঠলে এই ধরাতলেই স্বর্গ বানিয়ে নেবে। নচিকেতার কথা আছে না, দিব্যলোকে কোনও ভয় নেই, যম নেই, জরাও না; খিদে-তেষ্টা পার ক’রে শুধু শোকাতীত আনন্দের অনুভব? তাহলে দেবপুরী একটা উন্নত মর্ত্যই তো; সব পেটে ভাতের ব্যবস্থা, সবার জন্যে শিক্ষা আর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারলে দেখবে স্বর্গ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে।

স্কুলবাড়ির মাথায় দুধ-মরিচ রঙ শঙখচিলের ডানাবিস্তার দেখছিল নির্মল : শস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে শস্যমিবাজায়তে পুনঃ। মরঃ শব্দটা থেকেই মর্ত্য এসেছে। এই দীনদুনিয়ায় পা রাখলে শস্যের মতো পচে মরতে হবে, পরক্ষণে জন্মাতেও হবে, আবার মরো… জীবনমৃত্যুর এই ক্রমচক্কর দুঃখময় এবং কোনও মানুষই দুঃখিত হতে চায় না। তাই উপনিষদের উপদেশ : পুনর্জন্ম এড়াতে নরলোকে কামনাবাসনা চেপেচুপে ব্রহ্মের সাধনা ক’রে যাও, আর জন্ম নিতে হবে না — গ্যারান্টি; তোমার জীবাত্মা মিশে যাবে পরমাত্মা মানে পরব্রহ্মে; স্বর্গে গিয়ে ভোগ করবে কাম্য যা কিছু, অমরতা, পার্মানেন্ট পুলক।

বাচ্চাদের আমরা খানিকটা এরকম কথাই বলি না? এখন বেশি খেলো না, সিনেমা দেখো না, পড়াশুনো ক’রে চাকরি পাও, তারপর নিজের উপার্জনে যতখুশি আনন্দ ক’রো, কেউ মানা করবে না। চাকরি পাওয়া একটা ছোট স্বর্গ। আবার যে রিটায়ার করেছে, তার কাছে ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর মেয়ের বিয়ে হল অমরাবতীর দুই সিঁড়ি। পৃথিবীতেই আমাদের টুকরো টুকরো ব্যক্তিগত স্বর্গবাস চলতে থাকে। নিজ-মালিকানার দিব্যলোকটাকে সামাজিক স্বর্গের চেহারা দিতে চাইছে বরুণদের মার্ক্সবাদ।

— কিন্তু ঈশ্বরের স্বর্গে তো বুড়ো বয়েস, যমের দক্ষিণ দুয়োর এসব কিচ্ছু নেই; শর্ত পুরোবে কী ক’রে?

— সাইন্টিস্টরা চেষ্টা করছেন। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান কীভাবে এগিয়ে গেছে দেখেছ? বুকে পেসমেকার বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিডনি খারাপ হলেও ডায়ালিসিস নিয়ে বেঁচে থাকছে রোগি।
— বিজ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দেবে? অ্যালকেমি সত্যি হবে বলতে চাও!

এবার নির্মলের অনাস্থায় ভেজাল নেই।
— তোমার জ্যোতিষবিদ্যে যদি ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, অ্যালকেমিও সবাইকে এলিক্সার অফ লাইফ রেঁধে খাওয়াবে একদিন।

.
(আরও আছে)

তুমি জেনে রাখো

এভাবেই কান্নাকে বিলিয়ে দিচ্ছি জলের দরে। যার কান্না নেই, সে তো শালগ্রাম শিলা। নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়েখুঁড়ে নেবার পর তোমার উঠোনে রেখে গেলাম একটা ওপড়ানো নিষ্পত্র গাছ। তাই এখন আমার কোনো কষ্ট নেই। তোমার দেউড়িতে ঢুকতে না-পারা আমার কথারা গর্ভপাতের মতো নষ্ট হয়। আমার কথারা না জন্মাতেই পর্ণমোচী। তারা তোমার নীরবতার শীতঋতুতে অনর্গল ঝরে পড়ছে নড়বড়ে একটা গোটা সাঁকো জুড়ে। তোমার ফুৎকারে তারা উড়ে যায় এলোমেলো। অথচ তারা তোমার উঠোনের কোনায় একটু মাটি পেলে বট-অশ্বত্থ হতে পারত, গড়ে তুলতে পারত ভাষাদেহের ছায়ার মিনার। অথচ আমার জিভ কেটে ফেললে তুমি। আমার চারপাশে যখন ধূধূ দিগন্ত নেমে এলো, টের পেলাম আমি কোথাও নেই, কোনোদিন ছিলাম না। সেই না-থাকার ভেতর টের পাই, তোমার নাভিকুন্ড গনগনে লাল আঙরার এক বলয় পেরিয়ে এক কৃষ্ণগহ্বরের মুখ। তার ভেতর যে আঁধারের উনুন, সেইখানেই বুঝি আমার জন্ম ও মৃত্যু? আসলে অনাদি আমি কিংবা অনন্ত গর্ভাধানের অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা এই আমি একটি নুড়িমাত্র।

কিন্তু তুমি খুশি থেকো, কোটি সূর্য গিলে নিলেও কৃষ্ণগহ্বর নিজেকেই চেনে না। তুমি নিশ্চিত থেকো, অনাদি আমির কোনো রূপান্তর নেই। তাই তোমার উঠোনে দূরও আসবে না, নিকটও আসবে না কোনোদিন। নিশ্চিত করে তুমি জেনে রাখো।

মানবতা নিয়ে ৬০টা উক্তি

মানবতা নিয়ে ৬০টা উক্তি।

১. মানবতার প্রকৃত মূল্য বস্তুগত সম্পদ বা আর্থিক শক্তি লাভ দ্বারা পরিমাপ করা যায় না, তবে আমরা যদি যার যার জায়গা থেকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান সহানুভূতি এবং ভালোবাসার প্রদর্শন করি ঠিক তাঁর দ্বারা মানবতার প্রকৃত মূল্য নিরুপণ করা সম্ভব।

২. মানবতার প্রকৃত মূল্য আমরা যা সঞ্চয় করতে পারি তার মধ্যে নয়, তবে আমরা কীভাবে আমাদের চারপাশের বিশ্বে অবদান রাখতে পারি তার মধ্যে।

৩. টাকা বস্তুগত সম্পদ কিনতে পারে, কিন্তু তা কখনোই প্রকৃত সুখ বা পরিপূর্ণতা কিনতে পারে না সেটি হৃদয় থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

৪. একজন ব্যক্তির মূল্য অন্যদের উপর প্রভাব দ্বারা পরিমাপ করা হয়, তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের আকার দ্বারা নয়।” তবে সেই প্রভাবটা হলো প্রজ্ঞা জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

৫. আমাদের মানবতা আমাদের সম্পত্তি বা প্রাপ্ত মর্যাদা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় না, তবে সংজ্ঞায়িত হয় তাঁর ভেতরে অন্যের জন্য থাকা আত্মত্যাগের মহিমা কিম্বা তাঁর দৃষ্টি প্রাপ্ত ভালবাসা, সহানুভূতি এবং সহানুভূতির জন্য আমাদের ক্ষমতা দ্বারা।

৬. একজন ব্যক্তির মূল্য তার মোট মূল্য দ্বারা পরিমাপ করা যায় না, তবে তারা অন্যদের প্রতি যে দয়া এবং উদারতা দেখায় তার দ্বারা।

৭. সত্যিকারের সম্পদ ধনসঞ্চয়ের মধ্যে নয়, আমাদের সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে।”

৮. “টাকা শক্তি কিনতে পারে, কিন্তু অন্যের কাছ থেকে কখনো সম্মান বা প্রশংসা কিনতে পারে না।

৯. মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য আমরা যা গ্রহণ করি তার মধ্যে নয়, আমরা যা দেই তার মধ্যে।

১০. একজন ব্যক্তির মূল্য তার মালিকানার মধ্যে নয়, তবে তারা যা তৈরি করে এবং বিশ্বে অবদান রাখে তাতে।

১১. মানবতার প্রকৃত মূল্য হল আমাদের অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং তাদের জীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা।

১২. অর্থ সাময়িক সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারে, কিন্তু এটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা থেকে আসা আনন্দকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

১৩. মানুষ হিসাবে আমাদের মূল্য আমাদের যা আছে তা দ্বারা নির্ধারিত হয় না, তবে আমরা বিশ্বকে কী দিয়েছি তার দ্বারা।

১৪. মানবতার মূল্য আমাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং কল্পনার ক্ষমতার মধ্যে নিহিত।

১৫. অর্থ সাময়িক স্বস্তি আনতে পারে, কিন্তু তা কখনোই উদ্দেশ্য এবং পরিপূর্ণতার অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না যা একটি অর্থপূর্ণ জীবন যাপন থেকে আসে।

১৬. মানবতার প্রকৃত মূল্য হল কম সৌভাগ্যবানদের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া দেখানোর ক্ষমতা।

১৭. মানুষ হিসাবে আমাদের মূল্য আমাদের অর্জন বা প্রশংসা দ্বারা নির্ধারিত হয় না, তবে আমাদের চারপাশের বিশ্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে আমাদের ক্ষমতা দ্বারা।

১৮. টাকা হয়তো সাময়িক আনন্দ কিনতে পারে, কিন্তু তা কখনোই উদ্দেশ্য ও অর্থপূর্ণ জীবন যাপন থেকে আসা আনন্দকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

১৯. একজন ব্যক্তির মূল্য তারা যা গ্রহণ করে তার মধ্যে নয়, তবে তারা যা তৈরি করে এবং সমাজে অবদান রাখে তার মধ্যে।

২০. মানবতার প্রকৃত মূল্য আমাদের সৌন্দর্য তৈরি করতে, অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে এবং বিশ্বকে একটি ভাল, সুন্দর, অহিংস জায়গা করে তোলার ক্ষমতার মধ্যে।

২১. টাকা হয়তো সাময়িক সুখ আনতে পারে, কিন্তু এটা কখনোই পরিপূর্ণতার অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না যা পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে আসে।

২২. মানুষ হিসাবে আমাদের মূল্য আমাদের সম্পত্তি বা মর্যাদা দ্বারা নির্ধারিত হয় না, কিন্তু ভালবাসা, সহানুভূতি এবং সহানুভূতির জন্য আমাদের ক্ষমতা দ্বারা।

২৩. মানবতার প্রকৃত মূল্য আমাদের যা আছে তাতে নয়, আমরা অন্যকে যা দেই তার মধ্যে।

২৪. টাকা হয়তো সাময়িক সাফল্য কিনতে পারে, কিন্তু তা কখনই পরিপূর্ণতার অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না যা উদ্দেশ্য ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপন থেকে আসে।

২৫. একজন ব্যক্তির মূল্য সম্পদ জমা করার ক্ষমতার মধ্যে নয়, বরং বিশ্বের উপর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতার মধ্যে।

২৬. মানবতার প্রকৃত মূল্য হল আমাদের সহানুভূতি, বোঝা পড়া এবং অন্যদের প্রতি ভালবাসার ক্ষমতা।

২৭. অর্থ অস্থায়ী নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে, কিন্তু এটি কখনই কোন রাষ্ট্র, সমাজ, সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না যা অন্যদের সাহায্য করার ফলে আসে।

২৮. মানুষ হিসাবে আমাদের মূল্য আমাদের বস্তুগত সম্পদ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, কিন্তু অন্যদের প্রতি দয়া, সমবেদনা এবং ভালবাসা দেখানোর ক্ষমতা দ্বারা।

২৯. মানবতার প্রকৃত মূল্য হল আমাদের অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা।

৩০. টাকা হয়তো সাময়িক আরাম কিনতে পারে, কিন্তু তা কখনোই জাগতিক জীবন ব্যবস্থায় পরিপূর্ণতার অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না যা উদ্দেশ্য ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপন থেকে আসে।

৩১.একজন ব্যক্তির মূল্য তাদের ক্ষমতাশীল হয়ে উঠা অংশীদারহীন কৃতিত্বের মধ্যে নয়, তবে তাদের অনুপ্রাণিত করার এবং একটি ইতিবাচক করার ক্ষমতা।

৩২. মানবতার প্রকৃত মূল্য আমরা যে অর্থ উপার্জন করি তার মধ্যে নয়,(অর্থ কমবেশি সবার রয়েছে) আমরা যে ভালবাসা দিয়ে থাকি এবং আমরা যে প্রভাব তৈরি করি তার মধ্যে।

৩৩. “অর্থ আমাদের সাময়িক সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু এটি সহানুভূতি এবং দয়া যা স্থায়ী আনন্দ নিয়ে আসে।”

৩৪. একজন ব্যক্তির মূল্য তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দ্বারা পরিমাপ করা উচিত নয়, কিন্তু তার চরিত্রের বিষযবস্তু দ্বারা।

৩৫. আমরা শুধু ভোক্তা এবং উত্পাদকদের চেয়ে বেশি কিছু নয়; আমরা বিকাশ এবং আত্ম-আবিষ্কারের জন্য অসীম সম্ভাবনার মানুষ।

৩৬. টাকা সুখ কিনতে পারে না, কিন্তু সুখের মায়া কিনতে পারে। প্রকৃত সুখ ভেতর থেকে আসে যার ভেতরে বোধ বুদ্ধি স্নেহ ভালোবাসা বিরাজমান।

৩৭. মানবতার প্রকৃত মূল্য আমরা পৃথিবী থেকে যা নিয়েছি তাতে নয়, বরং আমরা যা পৃথিবীকে ফিরিয়ে দিই তাতে।

৩৮. আমাদের যোগ্যতা আমাদের কাজের শিরোনাম দ্বারা নির্ধারিত হয় না, তবে আমাদের চারপাশের বিশ্বে আমাদের প্রভাব দ্বারা নির্ধারিত হয়।”

৩৯. “আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব অনন্য উপায়ে মূল্যবান, এবং আমাদের সকলেরই বিশ্বে একটি পার্থক্য করার সম্ভাবনা রয়েছে।

৪০. মানবতার মূল্য আমাদের সম্পদ সঞ্চয় করার ক্ষমতার মধ্যে নয়, বরং একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।

৪১. অর্থ আমাদের বস্তুগত সম্পদ সরবরাহ করতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের জীবনে সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি কিনতে পারে না, যেমন প্রেম, সুখ এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি।

৪২. আমাদের মালিকানাধীন জিনিস দ্বারা আমরা সংজ্ঞায়িত করি না, কিন্তু আমরা যে জিনিসগুলি করি এবং আমরা যাদের স্পর্শ করি তার দ্বারা আমরা সংজ্ঞায়িত হই।

৪৩. মানুষের জীবনের মূল্য টাকা ডলার এবং সেন্টে পরিমাপ করা যায় না, তবে তারা বিশ্ব এবং তাদের চারপাশের মানুষের উপর প্রভাব ফেলে।

৪৪. আমাদের কাছে যা আছে তার মধ্যে সত্যিকারের মূল্য নিহিত নয়, বরং আমরা কী বৃহত্তর ভাবে ভালো কর্মের দ্বারা অবদান রাখি তার মধ্যে।

৪৫. একজন ব্যক্তির মূল্য তাদের সম্পদের মধ্যে নয়, তবে তাদের চরিত্রের গভীরতা এবং তাদের হৃদয়ের দয়া।

৪৬. অর্থ আমাদের সাময়িক আনন্দ আনতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি এবং আমাদের সংযোগের গভীরতা যা স্থায়ী আনন্দ নিয়ে আসে।

৪৭. আমরা উত্পাদন এবং গ্রাস করার জন্য মেশিন নই; আমরা মানুষ যা ভালবাসা এবং ভালবাসার জন্য।

৪৮. মানবতার প্রকৃত মূল্য হল সহানুভূতি এবং সহানুভূতির মধ্যে যা আমরা অন্যদের প্রতি দেখাই, বিশেষ করে যাদের প্রয়োজন।

৪৯. টাকা আমাদের সম্মান বা প্রশংসা কিনতে পারে না; এটি আমাদের কর্ম এবং আমাদের চরিত্র যা আমাদের এই জিনিসগুলি অর্জন করে।

৫০. আমাদের চাকরি বা বেতন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় না, কিন্তু আমাদের চারপাশের মানুষ এবং বিশ্বের উপর আমাদের প্রভাবের দ্বারা।

৫১. মানবতার মূল্য প্রকৃতি এবং সম্পদ শোষণ করার ক্ষমতার মধ্যে নয়, তবে তাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করার ক্ষমতা।

৫২. টাকা আমাদের আরাম এবং নিরাপত্তা দিতে পারে, কিন্তু এটি আমাদেরকে একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন যাপনের মাধ্যমে পাওয়া পরিপূর্ণতা কিনতে পারে না।

৫৩. একজন ব্যক্তির মূল্য তাদের সম্পদের মধ্যে নয়, তবে অন্যদের অনুপ্রাণিত করার এবং উন্নত করার ক্ষমতার মধ্যে।

৫৪. মানবতার প্রকৃত মূল্য একটি সাধারণ লক্ষ্যের দিকে একসাথে কাজ করার এবং পথ ধরে একে অপরকে সমর্থন ও উন্নতি করার ক্ষমতার মধ্যে নিহিত।

৫৫. আমাদের সাফল্য বা আমাদের ব্যর্থতা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় না, কিন্তু প্রতিকূলতার মুখে আমরা যে স্থিতিস্থাপকতা এবং সংকল্প দেখাই তার দ্বারা।

৫৬. টাকা আমাদের মনের শান্তি কিনতে পারে না যা সততা এবং নৈতিক দৃঢ়তার জীবনযাপন থেকে আসে।

৫৭. মানবতার মূল্য আমাদের ভুল থেকে শেখার এবং ব্যক্তি এবং একটি প্রজাতি হিসাবে বেড়ে ওঠা এবং বিকাশ করার ক্ষমতার মধ্যে নিহিত।

৫৮. আমাদের চিন্তা শক্তি নির্দিষ্ট কোন যন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে কিন্তু তাকে বৃহৎ পরিসরে হওয়া বোঝানো হয় না, তবে আমাদের নিজস্ব প্রতিভা এবং বিশ্বের সাথে ভাগ করে নেওয়ার আবেগ সহ অনন্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবিত করতে পারে এবং এমনটাই হওয়া উচিত।

৫৯. মানবতার প্রকৃত মূল্য সকলের প্রতি ভালবাসা এবং সকলের জন্য ভালবাসা, সৃষ্টি করা এবং অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা।

৬০. মানবতার প্রকৃত মূল্য তার বৈচিত্র্য এবং তার সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে বিরাজমান।

অসমঝদার আড্ডায় গেলে কী হয়

এক আড্ডায় গেছি বন্ধুর সাথে, সব অপরিচিত মুখ; কারো সাথে দেখা সাক্ষাত হয়েছে বলে মনে হল না। বন্ধু আমাকে কবি বলে পরিচয় দিল। কবি বলার সাথে সাথে সমীহ বেড়ে গেল। ভিআইপি খাতিরে আড্ডার মধ্যমণি করে সবচেয়ে আরামদায়ক চেয়ারে বসানো হল। আড্ডা আড্ডার মত চলতে থাকল। চুটকি, গসিপ, রঙ-তামাশা চলছে সমানতালে। আমি খুব উপভোগ করছি। কিন্তু কবি হিসাবে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে বসানো হল সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আমার কাছে কিছু শুনতে চাওয়া হল না। কিছুটা মন খারাপ, আমার মুখের দিয়ে চেয়ে হয়তো কারো দয়া হল। হঠাৎ একজন সবাইকে থামিয়ে বলল এবার কবি সাহেব বলুন ‘তার কাছ থেকে বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানি’। আমার বন্ধু বলতে চেয়েছিল বাদ দেন; অন্য কোনদিন বলবে। কিন্তু সবাই অনুরোধ করলে আমি বললাম এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কবিতা পদবাচ্য নামে যা হয়েছে শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। কবিতাকে নতুন করে লিখতে হবে, নতুন সময় এসে গেছে, নতুন কবি এসে গেছে, নতুন কবিতা এসে গেছে। বলে নিজের পকেট থেকে সদ্য লেখা কবিতা পড়ে শোনাতে শুরু করলাম…

আমার কবিতা শুনে আড্ডার সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। আড্ডার যে উত্তেজনা ছিল নিমিষেই চুপসে গেল। সবার মুখ হয়ে গেল পেঁচার মতন। তখন পিছনের চেয়ারে বসা একজন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল ‘ভাইজানের কী গ্যাস হয়েছে? লেখা থেকে বদ গন্ধ বেরুচ্ছে; ঘরে গিয়ে বাথরুম সেরে এন্টাসিড খান’। আমার বন্ধু তড়িঘড়ি করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমি বললাম ‘এরা এমন করল কেন?’ বন্ধু বলল ‘এরা সাহিত্য সমঝদার নয় তোর কবিতা বুঝতে পারেনি, মন খারাপ করিস না…’

.
#সত্য_ঘটনার_গল্পরূপ

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

একুশ
ওঁ আদিত্যাদি গ্রহাঃসর্ব্বে নক্ষত্রাণি রাশয়ঃ।
দীর্ঘমায়ুঃ প্রকুর্বন্তু যস্যেয়ং জন্মপত্রিকা।।

ফালি কাগজের মাথায় চটপট শ্লোকটা লিখে নির্মল স্কেল দিয়ে কালিদাগ টানল। তার নীচে ধীর হস্তাক্ষরে একটা ক’রে বসাতে লাগল শব্দ :

শুভমস্তু শকনরগতে রতীতাব্দাদয়ঃ ১৮৮২ সন ১৩৬৭ ইং ১৯৬০ এতচ্ছকীয় সৌর শ্রাবণস্য সপ্তম দিবসে ইং জুলাই মাসস্য চতুর্বিশতি দিবসাৎ পরং রাত্রৌ সার্দ্ধেক ঘটিকায়াং ঘঃ ১-৩০ মিনিট সময়ে সেনহাটী গ্রাম নিবাসিনঃ শ্রীনির্ম্মলচন্দ্র দেবশর্ম্মণো কাব্যতীর্থোপাধিকস্য শুভ কুমারোহ জায়ত ভারতে…।

এবার ঠোঁটের ওপর বাঁহাতের তেলোর উল্টোপিঠ রেখে ভাবতে লাগল সে। ভারতে কোথায় ভূমিষ্ঠ, উদ্বাস্তু শিবিরে! সেটা কি প্রাণে ধ’রে লেখা যায় — সূতকমুহূর্তে ছিন্নমূল? নির্মলের কলম আবার চলতে লাগে, “…জায়ত ভারতে তস্য মাতামহীগৃহে। তস্যেয়ং লিখ্যতে সংবৃত্তিপত্রিকা”।

মায়া অনেকবার বিরক্ত হয়েছে : চাঁদের কুষ্টিটা বানাচ্ছেন না কেন? এত রোগবালাই লেগে থাকে ছেলেটার! হ্যাঁ, জ্যোতিষশাস্ত্রও বলে, “জন্মপত্রিকা যিনি প্রস্তুত করান নাই তাহার নিকট জীবন নিশাকালীন দীপবিহীন মন্দিরের ন্যায়”। তাছাড়া এসব দু’ঘন্টার মামলা, নিজের পরিবার বাদেও আত্মীয়-প্রতিবেশী এত লোকের জাতপত্র নির্মলের হাতে গড়া, ছকটা কষে ফেললে আর কী করার থাকে, পঞ্জিকা দেখে দেখে বসিয়ে যাও মাসফল, ঋতুফল, হোরাফল, নক্ষত্রফলম্‌…।

স্কেলে আরও একটা দাগ কেটে তার নীচে সে লিখতে লাগল, রাত্রি ঘন্টা ৯/৪৫ গতে মীনরাশি, বিপ্রবর্ণ, নরগণ, অষ্টোত্তরী শুক্রের ও বিংশোত্তরী শনৈশ্চর দশায়াং…।

মীনের অন্য নাম অস্ত্যভ। এটি সৌম্য ও জলজ রাশি। মীনের শেষার্ধ কীট নামে খ্যাত। তার দিবা ও রাত্রিতে সমান বল (অন্য রাশিরা দিবাভাগে বলী)। মীনের বর্ণবিবেক মলিন। এই রাশি অনুযায়ী জাতকের নাম চ বা দ অক্ষরে শুরু হবে। নির্মল লিখছে : প্রকাশ্য নাম শ্রীমান্‌ চন্দন কুমার দেবশর্ম্মা ভট্টাচার্য্য। রাশিনাম… একেবারে গোপনীয় হতে হবে… শ্রীমান্‌ দিগন্ত।

এবার সমান্তরাল দুটো রেখা টেনে খানিক দূরত্ব রেখে এঁকে ফেলল জন্মনকশা, তারপর বারো অর্ধে গ্রহের অবস্থান সাজাতে সাজাতে ভুরু কুঁচকে উঠল তার। মুখ দিয়ে দুবার অসহিষ্ণু শব্দ করল, মশারি থেকে নেমে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে খাটের নীচে রাখা টিনের সুটকেস খুলে নামাল বাঁধানো খাতা আর তিনটে জুস-আলগা মলাটছেঁড়া বই।

এবার প্রতিটা পর্যবেক্ষণ সে কোষ্ঠীতে তুলবে গুনেগেঁথে, শাস্ত্র মিলিয়ে। প্রথমে সংস্কৃতে লিখে নীচে তার বাংলা, কিন্তু ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশান আর রোগিকে বলা সংলাপে যেমন সময়-সময় মিল থাকে না, নির্মলও অনুবাদ করছিল শুধু বাছাই অংশের। লগ্নফলে “পীন ললাট ঘোণ গণ্ডৌষ্ঠ” বা “শূরঃ ক্লেশসহিষ্ণু সুখী রিপুহন্তা” পর্যন্ত সুন্দর চলছে, কিন্তু হোরারত্নে “পরদারকঃ” শব্দে এসে তার মুখ লাল। পরের বিশেষণ “তেজস্বী”, সন্ধি ক’রে লিখল “পরদারকস্তেজস্বী এষু”। বাংলায় ভাঙলই না কথাটা।

এভাবে কত ধামাচাপা দেওয়া যায়? দ্রেক্‌কাণফল, শুক্রের দ্বাদশাংশফল একের পর এক লজ্জাজনক মার্কশীট খুলে ধরছে সামনে; প্রত্যেক সাবজেক্টেই লাল কালির দাগ — দাম্ভিক, রতিবশ্য, লোভী, স্ত্রীপ্রিয়, বিলাসী, পানভোজনপটু, কুটিল, কলহমত্ত, চপল, কৃতঘ্ন, ক্রোধী, স্থূলতনুসম্পন্ন!

বিছানায় তার দুহাত দূরে নিরপরাধ ঘুম দিচ্ছে সেই চরিত্রহীন মুজরিম — চোখের পলক এত টানা, কর্ণকুহর ছুঁয়ে দেবে যেন। আর মন? বিজয়া দশমীর দিন চুপিচুপি এসে বাবাকে বলেছিল, রাত্তিরে মা দুর্গা স্বপ্ন দেখিয়েছে : আমাকে তোরা ভাসান দিস না, জলে সব মাটি ধুয়ে হাড়ে ঠান্ডা লেগে জ্বর আসে, আমি ঠাকুর থেকে ভূত হয়ে যাই। বরং প্যান্ডেলের পাশে একটা বাড়ি বানিয়ে আমাদের রেখে দে। আশীর্বাদ করে দেব, সবাই পরীক্ষায় পাশ। কাজেই, “আপনি আজাদ হিন্দ কেলাবে যেয়ে একবার ব’লে দেন — বিসজ্জোন হবে না, দুগ্‌গাঠাকুরের ইচ্ছে নেই”!

ছেলের অজাগর মুখ থেকে নির্মল আবার চোখ ফেরাল গণনায়, ত্রিশাংশ ফলের দিকে :
ধাতুবাদী ক্রিয়াযুক্তঃ ধন-দার বিবর্জিতঃ। তস্করো মলিনো ধূর্ত্ত ভৌমত্রিশাংশসম্ভবঃ।।

তার ফলিত জ্ঞান ভেঙে পড়ছিল, বুকের ধকাস-ধকাস নিশ্চয়ই স্কুলের দেয়ালঘড়ির চেয়েও জোরে। গণনার এই ক্ষমাহীন ধ্রুপদী ভাষা আসলে কোনও ভয়ানক পরিণতির ইশারা — সন্তান আঁতুড়ে থাকতেই ঠিকুজী বানাতে গিয়ে নির্মল জাতকের যে দগ্ধভাগ্য দেখে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল।

চন্দ্র মনের কারক। কেউ তার বৈরী নয় — চন্দ্রমসো চন্দ্রস্য ন কশ্চিৎ শত্রু ইতি ভবঃ। মানুষের শরীরে বিন্দুচক্রে শশাঙ্কের অবস্থান, সে নতুন অথচ সুদৃশ্য বস্ত্রের অধিপতি। কিন্তু চন্দ্র হীনবল ও নীচস্থ হলে মানব দোলাচলচিত্ত হয়। যদি শনি দ্বারা যুক্ত বা পূর্ণদৃষ্ট হয় তবে সর্বদা চিন্তাযুক্ত, অল্প দুঃখে অধিক ম্রিয়মান, সন্দেহস্বভাবী ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকবে; আর শুক্রের সঙ্গে মিলিত হলে বা শুক্র দ্বারা পূর্ণদৃষ্ট হলে জাতক সারাক্ষণ কামাদি চিন্তায় রত। চন্দ্র দুর্বল ও শনিদ্বারা পীড়িত হলে মানব আক্রান্ত হবে উন্মাদ রোগে।

নামটা রেখেছিল শিউলি। বাসে যেতে যেতে মহিলা-গলায় “চাঁদ, শিগগিরি নেমে এসো” ডাকের সঙ্গে এক মিষ্টিমুখ বালকের ঝনাৎ ক’রে লাফ দিয়ে অবতরণ দেখা মেয়ে বাড়ি ফিরে সবার আগে পৌঁছোয় উদরিণী মায়ের কাছে — “যদি ভাই হয়, আমি কিন্তু নাম রাখব চাঁদ”। এভাবে সন্তান হাজির হওয়ার আগেই তার ডাকনাম উপস্থিত হয়ে অপেক্ষারত, যেন মালিককে গর্ভযান থেকে এক-লাফে নেমে আসার অনুরোধ পাঠাচ্ছে। শিউলি যদি তখন জানত, চাঁদই হবে চাঁদের অপৌরুষ; তার পরিপন্থী, তার অসমীচীনতা, তার বিপর্যয়…!

বৈদ্যকুলতিলক প্রজাপতি দাস বলে গেছেন, “শিশু ভূমিষ্ঠ হলে যোগজ শিশুরিষ্টি বা পতাকী শিশুরিষ্টি আছে কিনা তা সবার আগে নিরূপণ করে পশ্চাৎ ভাগ্য ফলাফল বিচার করবে। যেহেতু প্রবল রিষ্টি থাকলে শিশুগণ প্রায়ই মানবলীলা সংবরণ করে থাকে”। সেদিকে যাওয়ার আগে… ক্ষীণ চন্দ্রের ওপর বুধের প্রভাবটা কোথায় লিখেছে, ভয়চকিত নির্মল ‘জাতক পারিজাত’ হাতড়াতে থাকে… হা ঈশ্বর :

“বুধ ক্ষীণ চন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হলে পাপ সংজ্ঞায় অভিহিত হয়েন। পঞ্চ-ত্রিংশ বর্ষ পরমায়ু”।

বাইশ
“ঘুমোবেন না? বারোটা তো বাজে… ও কী, মুখ ওর’ম কেন! খারাপ কিছু দেখিছেন চাঁদের কুষ্টিতি?”

হারিকেনের কাচের একদিকে কাগজ আঁটা, ঘুমন্ত বাচ্চাদের চোখে আলো না পড়ে। মায়া পাশের ঘর থেকে ওই প্রচ্ছায়ার ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে ব’লে তাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে বরের মুখ পড়তে পারছে স্পষ্ট।
অবস্থা সামাল দিতে মিথ্যে যুগিয়েও গেল নির্মলের মুখে:
— ভাবছিলাম, কাজল কেন যে এমন একটা কীর্তি ক’রে গেল!
— সেসব আমি ভুলে গেছি। আপনি সুন্দর ক’রে বুঝিয়ে বললেন যে।

বরাহাচার্য্যের সূত্র মেনে সে দ্রুত হাতে নতুন কুণ্ডলী গড়ছিল পতাকীরিষ্টির। পুব-পশ্চিমে লম্বা পতাকালাগানো তিনটে লাইন টেনে তার ওপর উত্তর-দক্ষিণে আরও তিন লাইন বিন্যাস করলে কুণ্ডলী দ্বাদশ ভাগে বিভক্ত হল। নিয়ম মেনে দুই-দুই রাশির মধ্যে তির্যক রেখা এঁকে তাদের বেধ বা যোগ নির্ণয় করল নির্মল। তৈরি হল পতাকী-চক্র। চাঁদের জন্মছকে গ্রহেরা যে-যে রাশিতে আছে, তাদের পতাকীচক্রের ঠিক ওই জায়গায় বসাল। এবার বেধ অনুযায়ী শুভাশুভ ফল-বিচারটা শুধু বাকি।

— জানেন, বাসু বলছিল কাজল-কৃষ্ণেন্দু এখান থেকে বাড়ি যায়নি, স্টেশানে গিয়ে উল্টোদিকের ট্রেন ধরেছে। তার মানে ছোট্‌ঠাকুরপো-র কাছে যাচ্ছে, নিমতায়। আমাদের এখানেও তো এসেছিল চারঘাট-এ নারায়ণদার বাড়ি থেকে। পোয়াতি মেয়ে এইভাবে নিজের ভিটে ছেড়ে অন্যের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটো পেটের ভাতের জন্যে!

ঠিকুজী থেকে জন্মের দণ্ডকাল ১৭।৫৪।১৪ তুলে বিড়বিড় করতে করতে নির্মল দণ্ডাধিপতি কষতে বসল এবার। দেখল, সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে মন্দটাই ঘটে ব’সে আছে। অশুভ দণ্ডাধিপতি গ্রহের সঙ্গে লগ্নের যোগ, এমনকি চারটেই পাপগ্রহ বেধচতুষ্টয়ে। সমস্ত ফাঁড়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় রাক্ষস এই ‘নিয়ত পতাকীরিষ্টি’। গণ্ডযোগ নয় যে নবগ্রহের পুজো দিলে পরিত্রাণ আছে, রাহু-ফাঁড়া কেতু-ফাঁড়া নয় যে পাথর পরাবে। মীন রাশির পতাকীরিষ্টিকাল (নির্মল পরাশর-সংহিতা ঘাঁটছে)… মানে জাতকের সর্বোচ্চ আয়ু… হ্যাঁ পঁয়ত্রিশও না, উনত্রিশ বছর!

চাঁদের মা তখনও বলে যাচ্ছে, “আপনার বুনঝি গোপার কানের দুলজোড়া নেয়ায় পেত্থোমে আমার খুব রাগ হইছিল। পরে চিন্তা কল্লাম, ঠাকুরির ইচ্ছেয় কাজ্‌লার মেয়ে হোক, মুখদ্যাখানি সোনা তো কিনতিই হতো মামা-মামির, নয় আগাম দিয়ে রাখলাম”।

যেন দুই নেশাড়ুর দুটো সমান্তরাল গল্প একে অন্যের কাছে। তবু মায়ার গলা থেকে কোনওভাবে কি ‘কানের দুল’ খুলে কানে গিয়েছিল নির্মলের? ভিজিয়ে রাখা চা-পাতার মতো অপেক্ষায় ছিল তার স্মৃতি : “দিয়ে তোমার রতনমণি আমায় করলে ধনী”… আর তারপর মনে পড়েছে, “আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে”। আর্তের মতো উৎকন্ঠায় সে মায়াকে জিগ্যেস করল, তুমি কাল একটু রবি ঠাকুরের গান শোনাবে আমাকে?

.
(আরও আছে)

বইপাঠ নিয়ে আমার স্মৃতিকথা

চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি, বাবা-মা, ভাই-বোন সবার হাতে বই। বলা চলে, একটি পাঠক পরিবারে আমি বড় হয়েছি। সঙ্গত কারণেই আমিও সেই বাল্যকাল থেকেই বইয়ের সাথে আছি। দস্যু বনহুর সিরিজ থেকে শুরু। অতঃপর মোহন সিরিজ, বাহরাম সিরিজ, দস্যুরাণী সিরিজ, রানা সিরিজ এসব পড়তে পড়তে একটা সময় নাওয়া-খাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। মাঝে মাঝে মা বকুনি দিতেন। বলতেন, আউট বই এতো পড়লে পাঠ্যবই কখন পড়বি…? জানতাম, মায়ের কথা একান্তই সত্য; কিন্তু মন মানতো না। পরের বইয়ে কী ঘটনা ঘটল সেটা জানার জন্য ছটফট করতাম! সেই আমি এখনও একজন আপাদমস্তক পাঠক। রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ এখনও আমাকে ভিন্ন ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়।

নিজের সম্পর্কে একটা ছোট্ট ফিরিস্তি ইচ্ছে করেই দিলাম। কারণ নতুন প্রজন্ম আমাদের মতো নয়। আমাদের সময় একটা পাঠক সমাজ ছিল। আর এখন আছে মোবাইল সমাজ। ছোট-বড় সবার হাতে হাতে বইয়ের বদলে মোবাইল শোভা পায়। ইন্টারনেট যেন বিনোদনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার এবং অনলাইনে একা অথবা গ্রুপ ভিত্তিক গেমস খেলার রয়েছে অবারিত সুযোগ। এভাবেই আমরা বদলে গেছি। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছি। তবে এতকিছুর পরেও যে পাঠক একেবারেই নেই… আমি সে দাবী করছি না। কিছু পাঠক এখনও আছেন। কিন্তু তাদের অনেকের হাতে বই নেই!

কেন বই নেই? এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। যেহেতু আমি বই প্রেমিক, সেহেতু যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন… বইমেলায় আমার যাওয়া চাই-ই চাই। তবে নানা কারণে এবার যাওয়া হয়নি। অবশ্য কথা হয়েছে বেশ কয়েকজন পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকের সঙ্গে। মোটের উপর বলা যায়, পাঠক, লেখক এবং প্রকাশক কেউ সন্তুষ্ট নয়। পাঠকের অভিযোগ, বইয়ের অনেক দাম। এতো দাম দিয়ে আমার মতো মানুষের পক্ষে বই কেনা সম্ভব নয়। লেখকের অভিযোগ আরও গুরুতর। কোন প্রকাশক তাদের নিজস্ব খরচে বই প্রকাশ করে না। লেখককে নিজের ঘাটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করতে হয়। তার উপর প্রকাশিত বই কেউ কিনেন না। সবাই কেবল উপহার চান। একবারও ভাবেন না, একটি বই লিখতে লেখক অনেক শারীরিক-মানসিক শ্রম দিয়েছেন। পকেটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করেছেন। শুধু এখানেই শেষ নয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীরা কিছু বই কিনলেও প্রকাশক কোনো রয়্যালটি দেন না। জিজ্ঞেস করলে উল্টো ঝাড়েন, আরে ভাই.. বললাম তো, আপনার কোনো বই বিক্রি হয়নি।

প্রকাশকের অভিযোগ আরও গুরুতর। ভাইরে… খুব বিপদে আছি। কাগজ, প্লেট, বাঁধাই, সবকিছুর দাম বেশি। বই কেউ কিনে না.. খালি খরচ আর খরচ… লস আর লস ইত্যাদি… ইত্যাদি। এই যখন বাস্তবতা তখন একজন পাঠক হিসাবে, একজন লেখক হিসাবে আমার আর কিছুই বলার নেই। কেবল এক চিলতে সান্ত্বনার জায়গা খুঁজছি।।

স্মৃতির গলিতে একঘণ্টা…

3

সময় নদীর মতই বয়ে যায়…কেবলই বয়ে যায়। নদী এদিক ওদিক ধাক্কা খেলেও সময়কে ধাক্কা দেয়ার কেউ নেই। এ যেন অনন্ত কালের চলা। এ চলার শুরু ও শেষ কোথায় কারও জানা নেই।

সময় গুনে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে ৪৫ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। সেন্ট পিটার্সবার্গে সে বছর শীত নেমেছিল ক্ষমাহীন রূঢ়তায়। হিমাংকের নীচে ৪৫ ডিগ্রী। সাথে উত্তর মেরুর শীতল বাতাস। রাস্তাঘাট অচল। স্কুল কলেজে মনুষ্য পদচারণা নেই অনেকদিন। আমি ও আমরা ডর্মের জানালায় বসে কেবল প্রহর গুনি কবে বরফ গলা শুরু হবে।

আবুল ফজল মোহম্মদ আকা এএফএম ভাই আমাদেরই একজন। বয়সে দুই বছরের বড় হলেও এক বছর পরে এ দেশে আসায় আমার জুনিয়র হয়ে গেছেন। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের সমীকরণে কোন দাগ লাগেনি।
বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকার কোন এক গ্রামে।
যে কোন বিচারে ভদ্র ছেলে। আমরা সবাই যখন যৌবনের উদ্দাম ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি এএফএম ভাই তখনও পরে আছেন সিলেটের কোন এক কলেজ আঙ্গিনায়। কট্টর না হলেও ধার্মিক। সোভিয়েত দেশের নির্বাসিত ধর্মের লাল চক্ষু উপেক্ষা করে প্রায়ই জায়নামাজে বসে পরেন সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে।
বাংলা বলেন সিলেটী সুরে। রান্নাবান্নায় পাকা হাত। খারাপ অভ্যাসের ভেতর এক সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা। মদ মেয়ে মানুষের দিকে সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকান।
আমরা সবাই যখন একাধিক মেয়ের শিডিউল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি এএফএম ভাই তখন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। সে পৃথিবীতে সাদা মেয়ে মানুষ নেই। লম্বায় কিছুটা খাটো হওয়ায় কোন মেয়ের সাথে আলাপ করতে দ্বিধায় করতেন যদি রিজেক্ট করে দেয়!

শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে সে রাতে আমরা বের হয়েছিলাম। নেভা নদীর কোল ঘেঁষে একটা রেস্তোরা আছে। সপ্তাহান্তে ওখানে যৌবনের হাট বসে। সে হাটে অনেক সদাই হাত বদল হয়।
এএফএম ভাইকে অনেকটা জোর করে ওখানটায় নিয়ে যাই। সাথে গেলেও ভদকার বদলে গ্লাসে অরেঞ্জ জুস নিয়ে উপভোগ করেন নৈশ জীবন। ভাল করে দেখলে মনে হবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। এ নিঃসঙ্গতার মূলে যে নারী সহচর্য তা বুঝতে অসুবিধা হয়না।

পাতাল রেলে চড়ে ডর্মে ফিরছি। অন্য সময় হলে যাত্রীর পদভারে মুখরিত হয়ে উঠত ট্রেনের বগি। কিন্তু এ সময়ের শীত অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে শহুরে জীবন হতে, যার অন্যতম শনিবারের ব্যস্ততা।

বগির প্রায় সবকটা সীট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা কেন এএফএম ভাইয়ের পাশ বসল এ নিয়ে আমরা সবাই কৌতূহলী হয়ে পরলাম। ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সামনের শনিবার বিকেল ৫টায় পাতাল রেলের নির্দিষ্ট এক ষ্টেশনে অপেক্ষায় থাকবেন এএফএম ভাই এভাবেই পরিচয় পর্বের সফল সমাপ্তি ঘটে। ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা নাতাশার সাথে সম্পর্কের শুরু এভাবেই।

দৃশ্যপটে উদয় হল নতুন এক এএফএম ভাইয়ের। নিঃসঙ্গতার বলয় হতে বেরিয়ে তিনি এখন অদম্য এক তরুণ। সুখের সাগরে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছেন অচেনা সব নগর বন্দরে।

বহুল কাঙ্ক্ষিত শনিবার দৃশ্যপটে হাজির। এএফএম ভাই সেদিন আর ক্লাসে যাননি। ডর্মে বসেই উপভোগ করছিলেন আগত সুখের শিহরণ।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরলেন।
সুখনিদ্রার পর চেহারায় নাকি অলৌকিক পরিবর্তন আসে। সবকিছু প্রেমময় হয়ে উঠে। চেহারার পাশাপাশি শরীর মনও কাব্যিক হয়ে উঠে। এএফএম ভাই এ বিষয়ে এত গভীর জ্ঞান রাখেন এ ছিল আমাদের জন্যে বিস্ময়কর এক আবিষ্কার।

দুষ্টুমিটা প্রথম আমার মগজে জন্ম নেয়। পল্লবিত হয়ে একে একে সবাইকে গ্রাস করে নেয়।
ঘুমচ্ছেন এএফএম ভাই। সময়মত ঘুম ভাঙ্গার জন্যে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছেন। একঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়ে প্রস্তুতি নেবেন মাহেন্দ্রক্ষণের। অপেক্ষার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে ভেবে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বসিত।

এলার্ম ঘড়িটা একঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে আসি এএফএম ভাইয়ের রুম হতে। এ নিয়ে আমাদের বাকি সবার হাস্য রসের শেষ নেই।
সময় ঘনিয়ে আসার সাথে কোথায় যেন অপরাধ-বোধ জন্ম নিতে শুরু করে। একজন মানুষের এতদিনের অপেক্ষাকে এভাবে হাল্কা করে দেয়ার ভেতর তৃপ্তি নেই ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে আবারও ঢুকে পরি রুমে।
তবে শয়তানি বুদ্ধি একেবারে বিদায় নিয়েছে সেটাও না। এ যাত্রায় এলার্ম একঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে কেটে পরি।

এএফএম ভাই সব প্রস্তুতি সমাধা করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে রওয়ানা দিলেন গন্তব্যে। আমরাও এডভেঞ্চার কোন পথে গড়ায় তা জানার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।

আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে এলেন এএফএম ভাই। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। জীবনে ও পথে আর পা বাড়াবেন না এমন একটা প্রতিজ্ঞা করে মুখ লুকালেন।
অপরাধ-বোধটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। সহজ সরল এএফএম ভাইয়ের এহেন চেহারা দেখে নিজকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অকপটে সব স্বীকার করে ক্ষমা চাইলাম। বিছানা হতে টেনে নামিয়ে গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিলাম। ৫টা বাজতে তখনও কিছু সময় অবশিষ্ট ছিল।

রাত প্রায় ২টার দিকে ফিরে এলেন। শীতের তীব্রতার কাছে হার না মেনে কি করে এত সময় কাটিয়েছিলেন তা আজও আমার জন্যে রহস্য হয়ে আছে।

এএফএম ভাই ও নাতাশার সাথে দেখা হয়েছিল ৩২ বছর পর তাসমান পাড়ের এক দেশে। ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছেন।
বাকি সব স্মৃতি রোমন্থনের পর ভয়ংকর শীতের সে সন্ধ্যার স্মৃতি টেনে আনলাম…
‘আচ্ছা আবু ফজল মোহম্মদ ভাই, সেদিন সন্ধ্যায় ঘড়ির ঘণ্টা এক ঘণ্টা পিছিয়ে থাকলে জীবন আপনার কোন বন্দরে ঠাঁই নিত ভেবে দেখেছেন কি?
সে প্রশ্নের উত্তর ছিল একান্ত ব্যক্তিগত যা পাবলিক করা যায়না। তবে জীবন যে একটা জটিল সমীকরণ মেলানোর প্রেক্ষাপট তা অকপটে স্বীকার করলেন। আরও স্বীকার করলেন নাতাশার আগমনে জীবন সুখের সায়রে ভেসে গেছে এমনটা নয়। হয়ত ঘড়ির কাটা উলটো দিকে না ঘুরালেই ভাল হত।