বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

ফেসবুকের একটা লাইকের মূল্য কত?

ফেসবুক হলো বর্তমান বিশ্ব-সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট। নির্মাতা হলেন, মার্ক জাকারবার্গ। যার পথচলা শুরু হয় ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। শুরু থেকে অদ্যবধি ফেসবুক ব্যবহারকারী শুধু লাইক নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। যা এখন সারাবিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক ব্যবহারকারী লাইক ভিক্ষুক সেজেছে। তা দেখে মনে হয় ফেসবুক নির্মাতা মার্ক জাকারবার্গ শুধু স্বাদের লাইক সিস্টেমটাকে কেন্দ্র করেই, ফেসবুক তৈরি করেছেন। কারণ, লাইক ছাড়া তো ফেসবুকের মজাই থাকে না, তাই।

আমি ফেসবুকে সদস্য হয়েছি ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ফেসবুকের ধরণ ধারণই ছিল ভিন্ন। তার মানে হলো সোজা সাপটা যাকে বলে! তখন ফেসবুকে হরেকরম লাইক ছিল না, গ্রুপও ছিল না। আর এই বিশ্ব-যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, লেখিকা, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, মিনিস্টার, ডাক্তার, উকিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, নেতা, নেত্রীদের দেখা যেত না। একসময় তাঁরা ফেসবুকের সুনাম তো মুখে আনতেন-ই-না, বরং এর সমালোচনাই বেশি করতো।

আর এখন সব দেশের সব রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সাহিত্যক, লেখক/ লেখিকা, সিনেমার নায়ক, নায়িকারাও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ফেসবুকে যারযার পেইজ বা গ্রুপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সবর থাকে, নজরও রাখে। লেখকগ্ণ লেখে। কবিগণ কবিতা লেখে। সাহিত্যিকরা সাহিত্য নিয়ে লেখে। তাঁরা পেইজ বা গ্রুপ তৈরি করে সেখানে অন্য লেখক/লেখিকাদের আমন্ত্রণ জানায়, “আসুন, এখানে লিখুন! আপনার আলোকিত প্রতিভা প্রচার করুন!” অনেকে তা করেও।

ওইসব পেইজ বা গ্রুপে সদস্য হতে হলে আগে গ্রুপের পিন পোস্ট (শর্তাবলী) পড়তে হবে। তারপর গ্রুপের শর্ত মেনে নিয়ে গ্রুপে অ্যাক্টিভ হতে হবে। শর্ত থাকে গ্রুপে অন্যদের পোস্টে পড়তে হবে, লাইক/ কমেন্ট করতে হবে। একজন সদস্য যদি কারোর পোস্টে লাইক/কমেন্ট না করে, তাহলে কয়েকদিন পর ঐ সদস্যকে গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আবার অনেক গ্রুপের একটা ভালো দিকও চোখে পড়ে। ওইসব পেইজ বা গ্রুপের অ্যাডমিনরা বা গ্রুপ পরিচালকগণ গ্রুপে অ্যাক্টিভ থাকা সদস্যদের নিয়ে বিভিন্নরকম আয়োজনেও করে থাকে। যেমন–পিকনিক, আড্ডা, সভা, সেমিনার সহ নানারকমের আয়োজন করে। আবার গ্রুপে লেখা বা পোস্টের উপর ভিত্তি করে পুরস্কৃতও করা হয়। যা অনলাইনের থাকা লিখিবার পড়িবার কোনও স্বনামধন্য ব্লগ কর্তৃপক্ষও করতে পারে না বা করেও না। তা করে থাকে ফেসবুকে থাকা পেইজ বা গ্রুপ পরিচারকগণ। এসব করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, লাইক আর গ্রুপের কর্মকাণ্ড প্রচার কার।

আর রাষ্ট্রপ্রধানরা তো এখন একরকম ফেসবুক নির্ভর হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাঁদের সুকৃতি নিয়ে ফেসবুকে তাঁদের নিজস্ব পেইজ বা গ্রুপে প্রচার করে। যাতে তাঁদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে। বর্তমানে ফেসবুকে সারাবিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্টপ্রধানদেরও পেইজ বা গ্রুপ আছে। তবে এসব ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে পেইজ বা গ্রুপ কতটা সত্যিকারের তা অনেকেরই জানা নেই। তবু অনেকেই সত্যি সত্যি মনে করে লাইক দিচ্ছে, মন্তব্যও দিচ্ছে। আর ভিআইপি ব্যক্তিরাও তাঁদের পেইজ বা গ্রুপে তাঁদের গুণগান যেমন প্রচার করছে, তেমন আবার ফেসবুকের দিকে খেয়ালও রাখছে।

খেয়াল রাখছে এই কারণে যে, যদি তাঁদের কোনও অপকর্ম আর অসৎকর্মের খবর ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়? তাই বর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধানরা ফেসবুকের দিকে বেশি খেয়ালি। তবে এসব ভিআইপি ব্যক্তিদের পোস্টে অন্যদের করা মন্তব্যের কোনও রিপ্লাই করা হয় না। মেসেজ পাঠানোর সিস্টেম থাকলেও কারোর মেসেজের উত্তর দেওয়া হয় না বলেই মনে হয়। তাঁরা শুধু লাইকের দিকে আর বাজে মন্তব্যের দিকেই বেশি খেয়াল রাখে। যদি কেউ ভুলবশত মনের ক্ষোভে কোনও বাজে মন্তব্য করে, তাহলে কয়েকদিনের মাথায়ই খবর হয়ে যায়। মামলা হয়, কারাদণ্ডে দণ্ডিতও হয়। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, নেতা, নেত্রীদের নিয়ে ফেসবুকে কেউ বেশি মাথা ঘামায় না। যার যার পোস্টের লাইকের ধান্ধায়ই বেশি থাকে।

এবার আলোচনায় আসা যাক ফেসবুকে থাকা লাল লাইক, সবুজ লাইক, আঙুল মার্কা লাইক, ইমেজি লাইক আর ট্যাগ নিয়ে। আগে এতো হরেকরকমের লাইক ছিল না। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী ট্যাগ করাও বুঝতো না। ছিল না মেসেঞ্জার, ফ্রি ফোন কল, ভিডিও কল, ভিডিও শেয়ারিং-এর ব্যবস্থাও। শুধু নিজ টাইমলাইনে ছবি আর কয়েক লাইন লেখা সহ স্ট্যাটাস দেওয়ার সিস্টেমেই ছিল। মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বর্তমানে অনেক শর্টকাট সুবিধা ফেসবুকে যুক্ত করে ফেলেছেন।

বর্তমানে শুধু লাইকের জন্য নিউজফিডে থাকে, খবর বিনোদন সহ দেশবিদেশে ঘটে যাওয়া নগদ খবর। আছে দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার খবর। সেসব পত্রিকার পেইজ থেকে প্রতি মিনিটে মিনিটে খবর আপডেট করা হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারী নিউজফিডে তা দেখতে পারছে, পড়তেও পারছে। লাইক দিচ্ছে। মন্তব্যও করছে। কিন্তু কোনও মন্তব্যকারীর মন্তব্যের উত্তর দেওয়া হয় না। আগে ফেসবুকে পত্রপত্রিকার খবরাখবর ছিল না, যা বর্তমান সময়ে দেখা যায়। এটা বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকের একরকম সফলতাও বলা চলে।

আগেই বলেছি ফেসবুকে সর্বপ্রথমও ট্যাগ ছিল। যা ব্যবহারকারী বুঝেশুঝে ট্যাগ করতো। এখনো ট্যাগ সিস্টেম ফেসবুকে আছে। ট্যাগ হলো, শিকল। নিজের করা পোস্ট অন্যের ঘাড় চাপানোই হলো ট্যাগের কাজ। তবে আগে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সহসা কেউ কাউকে ট্যাগ করতো না। এখন একটা লাইকের আশায় একটি ছবি আপলোড করে তা ৪০ থেকে ৫০ জন বন্ধুকে ট্যাগ করে বসে থাকে। যা একধরণের যন্ত্রণা। যন্ত্রণা হলো এই কারণে যে, এক বন্ধুর একটা বল্টু মার্কা ছবি ফেসবুকে আপলোড করে তা আমাকে কেন ট্যাগ করা হবে? এটা তো একরকম অন্যায়। কিন্তু ন্যয় অন্যায়ের দিকে আর কেউ বিচার বিবেচনা না করে শুধু একটা লাইকের জন্যই; সিরিয়াল ৪০ থেকে ৫০ জনকে একই শিকলে বেধে ফেলে। একবার শোনা গিয়েছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আনলাইক সিস্টেম চালু করবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। শুধু আলোচনার মাঝেই তা থেকে গেল।

তবে আমার মতে ফেসবুকে আনলাইক সিস্টেম চালু করার খুবই দরকার ছিল। দরকার ছিল এই কারণে যে, বর্তমানে শুধু আমাদের দেশের ফেসবুকাররা হচ্ছে লাইক পাগল। ফেসবুকে একটা লাইকের জন্য নিজের প্রেমিকার বিকিনি ছবিও ফেসবুকে সবার মাঝে শেয়ার করছে। আরও কত যে অভিনব কায়দা কৌশল অবলম্বন করে থাকে, তা আর লিখে শেষ করা যায় না। যদি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আনলাইক সিস্টেম চালু করতে, তাহলে দেখা যেত কত ছবিতে কত লাইক, আর কত আনলাইক!

লাইক পাগল ফেসবুকারা এখন সেলফি মোবাইল ব্যবহার করে। যেমন–OPPO মোবাইল। যা কিনা ছবি আর সেলফির জন্য বিখ্যাত। সেলফি যে কী, তা আমি নিজেও আগে জানতাম না। এখন জানি সেলফি কী? সেলফি হলো, নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে নিজের ছবি নিজে তোলা। এর নাম হলো সেলফি। ফেসবুকেও চলছে সেলফি ছবির রমরমা পোস্ট। আর লাইকের জন্য ভিক্ষা আর ফরিয়াদ।

লাইক পাগল ফেসবুকাররা তাঁদের ছবি পোস্টে লিখে থাকে, “ভাইয়া একটা লাইক দিবা?” কিছু লাইক পাগল মেয়ে ফেসবুকার আছে। ওরা নিজের ছবি আপলোড করে ছবির উপরে লিখে থাকে, “ভাইয়া আমার ভাই কোনও নেই! ফেসবুকের সকল বন্ধুরাই আমার ভাই। ভাইয়া আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? যদি ভালো লাগে তো একখান লাইক দিতে ভুলবেন না!” আবার দেখি লেখা থাকে, “কেউ এড়িয়ে যাবেন না!” আরও লেখা দেখি, “একটা লাইক বা একটা কমেন্ট করুন! আজ আপনার ভাল কিছু একটা হবে।” কেউ আবার সরাসরি সাক্ষাতে বলে ফেলে, “ছবি ছাড়ছি, লাইক দিয়েন ভাই!” কেউ লাইকের জন্য ধর্মের বানীও পোস্ট করে থাকে।

এমন আরও শতরকমের অভিনব কায়দায় অনেক ফেসবুকারকে লাইক ভিক্ষা করতে দেখা যায়। সেসব লাইক ভিক্ষুক ফেসবুকে এখনো আছে। ওরা পোস্টে মন্তব্যের জন্য পোস্ট করে না। আর মন্তব্য যে কী, সেদিকে ওরা গুরুত্বও দেয় না। কেউ পোস্টে মন্তব্য করলে, সেই মন্তব্যের রিপ্লাইও করে না। ওরা শুধু লাইকের জন্যই ফেসবুকে ছবির পর ছবি আপলোড করতেই থাকে, আর ট্যাগ করতে থাকে।

এখন আসল কথায় আসি। কথা হলো, ফেসবুকে ওইসব লাইক পাগলদের কাছে একটা লাইকের মূল্য কত হতে পারে? আমরা মনে হয় ফেসবুকার লাইক পাগলদের কাছে একটা লাইক মানে, দিল্লিকালাড্ডু আর পোড়াবাড়ির চমচমের মতো। ওরা লাইক পাগল ফেসবুকাররা মনে করে থাকে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ হয়তো কোনও একদিন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের পোস্টের লাইক হিসেব করে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পুরস্কৃত করবে। আসলে তাঁদের ধারণা কি ঠিক? তা টিক হোক আর না হোক, তাতে কারোর কিছুই যায় আসে বলে মনে করি না।

তবে ফেসবুক লাইক পাগলদের পোস্টে লাইক/কমেন্টও আমাদের কিন্তু দেখেশুনে করতে হবে। কারণ, কোনও বন্ধুর অপছন্দের পোস্টে যদি আমি লাইক করে ফেলি তো, সেই বন্ধু আমার পর খুব রাগ করতে পারে। আর না বুঝে মন্তব্য তো করাই যাবে না। কারণ, সময়সময় একটা মন্তব্যের সাংঘাতিক বিপদ টেনে আনতে পারে। আবার ঝগড়াও হতে পারে। সময়সময় ঝগড়া বেধেও যায়।

জাতির জনকের জন্মদিবস এবং কিছু কথা

আজ জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৯৯-তম জন্মদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে তুমুল স্মৃতিচারণ, শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। টক-শোগুলিতে ধুমায়িত কফির মগ সামনে রেখে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। সবাই যার যার মতো নিজেকে কঠিন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী জাহির করাতে সচেষ্ট।

কিন্তু কথা হলো, এখন আওয়ামীলীগের সুবর্ণ সময়। টানা দশ বছর পার করে এই ঐতিহ্যবাহী দলটি পরপর তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে। তাই স্বভাবতই এখন ‘বসন্তের কোকিলদের’ আগমন। এইসব কোকিলেরা ‘হাইব্রিড আওয়ামীলীগার’ হিসেবেই কোনো কোনো মহলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এরা ‘চাম্পু’ টাইপেরও বলতে পারেন। ‘চাম্পু টাইপ’ কী সেটা জানতে চাইলে অন্য কোনো সময় এ বিষয়ে জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা করা যাবে।

বলছি বসন্তের কোকিলদের কথা। আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে এদেরকে পাওয়া যায় না। তখন এরাই ১৫ আগস্ট সহ বিভিন্ন দিবসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে বাঁধা সৃষ্টি করে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে (এ ব্যাপারে আমার নিজের দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে)। বহু পুরনো সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে এমন বসন্তের কোকিলরাও রয়েছেন। আবার এইসব হাইব্রিড লীগাররাই আওয়ামীলীগের বিরোধীদের থেকে সুবিধা গ্রহণ করে তাদেরকে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দিতে সদা তৎপর। এরা আসলে আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে বসবাস করা ক্ষতিকারক নেংটি ইঁদুর। এসব ইঁদুর থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

বলছিলাম পুরনো সময়ের বসন্তের কোকিলদের কথা। পুরনো সময় বলতে আমি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়কেই ধরলাম। তখন সময় এমন ছিলো যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলে কিংবা সপরিবারে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় অথবা পত্রিকায় দু’কলম লিখবে- এমন কাউকেই তখন পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সাথে সামান্যতম লিংক আছে এমন দিবস এলেই এইসব পুরনো কোকিলেরা জাতির জনকের স্তুতিগানে নিজেদের মুখের ফেনা তুলে ফেলে এমন অবস্থা।

আজ জাতির জনকের শুভ জন্মদিনে কেন তাঁর মৃত্যু দিবসের প্রসঙ্গ তুলে আলাপ করছি- অনেকেই হয়তো এমনটি ভাবছেন। ভাবুন। ভাববার মতো বিষয়ই বৈকি।

আমার মতে আজ এবং জাতির জনকের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দিবসে এই দেশে কেবলমাত্র কবি নির্মলেন্দু গুণই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছু বলার, লেখার কিংবা গাইবার অধিকার রাখেন। কেন? বলছি শুনুন…

১৯৭৭ ইং সাল। ভয়ংকর একটা সময় পার করছে বাংলাদেশ। পাথরচাপা সেই অন্ধকার সময়ে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে প্রথম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শীর্ষক প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন তিনিই। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর একুশে স্মরণিকা ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ এ এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এটিই ছিল প্রথম প্রতিবাদী কবিতার সংকলন।

‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ বললেন-

‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।’

তাই, আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে যারা বঙ্গবন্ধুর জয়গান গাইতে ভয়-ভীতি শংকা কিংবা অন্য কোনো প্রলোভনে নিশ্চুপ থেকেছে, যে সব লেখক/কবি/সাহিত্যিকের লেখনি স্তব্ধ থেকেছে- আজও তাঁদের নিশ্চুপ থেকে দুঃসময়ের নিশ্চুপতার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিৎ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদণ্ড’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার লেখা প্রথম কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর এ কবিতাটি তিনি যখন লেখেন তখন মুজিব কারাগারে।

আজ জাতির জনকের ৯৯তম জন্মদিবসে আমিও কোনো শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবো না। আমিও আরেকটি কবিতা (এটি গানও) দিয়ে লেখা শেষ করবো-

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।

যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো, করেনি কো কখনো মাথা নত।
এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
কে আছে বাঙ্গালি তার সমতুল্য, ইতিহাস একদিন দেবে তার মুল্য।
সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে, যায় কি রাখা কখনো তা।

যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’

youtu.be/VdphdjUQMc8

আজ ১৭ই মার্চ, শুভ জন্মদিন তোমার…

আজ ১৭ই মার্চ, শুভ জন্মদিন তোমার…

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সাহেরা খাতুনের ঘরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের তৃতীয় সন্তান।

উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ … অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা

উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ জন্মে ছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরী পুরে ২৮ শে অগাস্ট ১৯২৮ সালে। বাবা সেতার ও সুরবাহার বাদক এনায়েৎ খাঁ, মা বশিরন বেগম। ওনার ঠাকুর্দা বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ইমদাদ খাঁ। তাই ওঁর শিক্ষা ইমাদাদখানী বা এটাওয়া ঘরানায়।

বিলায়েৎ খাঁ বহু বছর কলকাতায় কাটিয়েছেন। এক সময়ে তিনি ও তাঁর ছোটভাই ইমরাত খাঁ (সুরবাহার) একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে বাজাতেন। দুবার বিয়ে করেছিলেন বিলায়েৎ খাঁ। প্রথম পক্ষের তিনটি সন্তান দুই পুত্র এক কন্যা। দুই পুত্র হলেন ইমন খাঁ, কন্যা জিলা খাঁ একজন প্রতিষ্ঠিত সুফি গায়িকা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সেতার বাদক সুজাত খাঁ। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটি পুত্র হিদায়ৎ খাঁ। তিনিও সুপ্রতিষ্ঠিত সেতার বাদক।

বিলায়েৎ খাঁ প্রথম জীবনে বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন। অর্থ যেমন উপার্জন ব্যয়ও করেছেন সেইভাবে। দামী গাড়ি, দামী বেশভুষা, দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক জিনিস সংগ্রহ ইত্যাদিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। ঘোড়ায় চড়তে ভালো বাসতেন; পুল খেলা, সাঁতার, বলরুম ডান্স – সবকিছুতেই উৎসাহ ছিল। শেষের জীবনে এসব জিনিসের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। বিলায়েৎ খাঁর সেতারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সাধারণ সেতারের যা গঠন তাতে অনেকগুলি উচ্চ-স্বর পর্যন্ত মীড় দিতে গেলে তারের টানে অন্যান্য তারগুলির সুর হারানোর সম্ভাবনা থাকে, বাজনার ফাঁকেই তাদের নতুন করে বাঁধতে হয়। এই সমস্যা দূর করার জন্য বিলায়েত্ খান বাদ্যযন্ত্র-নির্মাতাদের সাহায্য নিয়ে সেতারের গঠনকে মজবুত করেন। তবলী (নিচের গোলাকৃতি তুম্বার-এর কাঠের ঢাকনা) এবং তারগহনকে (দণ্ডের উপরে সেতারের কান থেকে বার হয়ে তারগুলি যেখানে বসে নিচে নেমে আসে) সুদৃঢ় করেন।

এছাড়া সেতারের ঘাটগুলোতে (ফরএতস) তিনি আরও বক্রতা দেওয়ান এবং তার ও ঘাটের মধ্যে দূরত্বটা বাড়ান যাতে তারকে টেনে পাঁচ-স্বর পর্যন্ত মীড় দেওয়া সম্ভব হয়। সেতারের সাতটি প্রধান তারের বদলে তিনি ছয় তারের সেতার চালু করেন। অন্যান্য কিছু তারকে এমন ভাবে বাঁধেন, যাতে রাগের ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো বাজিয়ে ভরাট করা যায় – তানপুরার সহযোগিতা ছাড়াই বাজানো যায়।

বিলায়েৎ খাঁকে অনেক পুরষ্কার বা সম্মান দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, যার বেশির ভাগই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্ম-বিভূষণ সবকিছুই তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ভারত সেতার সম্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ তাঁকে ‘আফতাব-ই-সিতার’ বা ‘সান অফ দ্য সিতার’ আখ্যা দেন। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে কোনও বড় ওস্তাদের স্নেহচ্ছায়ায় না থেকে নিজের অক্লান্ত চেষ্টাতেই তিনি বড় হয়েছিলেন। এনায়তখানই কানাড়া, সাঁঝ সারাবলি, কলাবন্তী ও মান্দ ভৈরব রাগের উদ্ভাবক ছিলেন তিনি।

যশলোক হাসপাতালে ১৩ মার্চ রাত ১১ টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সারা জাগানো এই সেতার শিল্পী। তাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হয় সঙ্গে আসেন স্ত্রী জুবাইদা (এলিজাবেথ)। সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের শবাধার, তিনি যে আজীবন শৌখিন মানুষ ছিলেন। শিল্পীর নিজস্ব রুচিমাফিক তৈরি করা হলো কাঠের শবাধার। তাতে পিতলের প্লেটে লেখা। উস্তাদ বিলায়েত খাঁ। প্রিয় শিল্পীকে শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আসেন স্বনামধন্য সরোদিয়া আমজাদ আলি খান।

বিলায়েত খাঁকে ‘সেতারের কিংবদন্তি’ আখ্যায় স্মরণ করে আমজাদ বলেন, তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ইমদাদখানী ঘরানা, ইনায়েতখানী ঘরানা বা কখনো ইটাওয়া ঘরানার সেতারবাদক বলে। খাঁ সাহেব ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। আসলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেই একটা ঘরানা হয়ে উঠেছিলেন। সেতারের দুনিয়া তাঁকে স্মরণ করবে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ ঘরানা হিসেবেই। পার্ক সার্কাসে পিতা মহানশিল্পী ইনায়েত খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় সেতার সাধক বিলায়েত খাঁকে, তাঁর ইচ্ছানুসারে।শিল্পীর কোন জাত নেই, শিল্পীকে কখনো সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে রাখা যায় না। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এমন দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন যা এক কথায় অসাধারণ। তাঁর অসংখ্য বাজনা আমাদের চিরকাল আনন্দ দেবে। আজ তাঁর মৃত্যু দিনে তাঁকে জানাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

জ্ঞান বিতরণের ফেরিওয়ালা অমর

পলান সরকার
মানুষের কৃতিত্ব থাকে বেচে ইতিহাসে।
মিথ্যা নয় সত্য, কাজের মূল্য বেঁচে থাকে চিরতরে।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের থাকে ছন্দ নাম,
তাঁরই মধ্যে একজন “পলান সরকার”।

আলোর জগতে সমাজকে আলোকিত করতে তাঁরই পথ চলা।
হয়েছেন বইয়ের ফেরিওয়ালা।
কখনো গ্রামে,কখনো বিদ্যালয়ে, কখনো হাটে বাজারে করেছেন আলো বিতরণ।

তাঁরই কৃতিত্ব দেখে অনেকেই অবাক,
আজ দুনিয়া জুড়ে সমালোচিত,
বই পড়ায় উদ্বুদ্ধকারী তিনি আর নেই।

রবী ঠাকুর বলেছিলেন, নাম মানুষকে বড় করে না, নামকে মানুষ জাগাইয়া তুলে।
তিনিও তাই করেছেন, ভুলবো না তাঁরই অবদান।

অসীম নাম, দিয়েছে না-কি! তাঁরই অবদান।
বলতে গেলে সময় শেষ তবুও বলি, প্রথম আলো পত্রিকা দিয়েছিল নাম “আলোর ফেরিওয়ালা।

নামের সাথে তাল মিলিয়ে, দিলাম এক নতুন নাম “জ্ঞান বিতরণের ফেরিওয়ালা।

উনি নেই, বলা যাবে না? উনি থাকবেন উনার কৃতি নিয়ে নতুন এক মানবের মাঝে।

বই ফেরিওয়ালার আর্দশ অনুসারে,
জগতে তৈরি হবে, হাজারো হাজারো “আলোর ফেরিওয়ালা।”

একজন নিজাম ভাই এবং আমার খিদের গল্প

ছবিতে আহমাদ মাগফুর।নজরুল মঞ্চে ২০১৫ এর বইমেলায়। আফসার নিজামের তোলা।

অতীতের অসংখ্য গাঢ়তর বিষয়কেও বর্তমানে এসে অনেকের কাছে হালকা লাগতে পারে। তবে সত্য হল, আজকের এই হালকা বিষয়টাই অতীতের সেই উপস্থিত সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাই অতীত আমার কাছে বরাবরই উৎসাহের বিষয়। দিনের পর দিন যায়, তবুও এই উৎসাহ আমার কমে না। বর্তমানের চেয়েও আড়ম্বরপূর্ণ এক অনন্য আবহে, ভেতরে আমার বেঁচে থাকে শুধু অতীত, অতীতের সব ছবি।

উন্মেষ আমার জীবনে তেমনই এক দারুণ অতীত। ভাবতেই অবাক লাগে সেই সময়টার কথা। চার পাঁচটা তরুণ। যারা সদ্য মাত্র কৈশর পেরিয়েছে। তারা একটি সাহিত্যের লিটলম্যাগ বের করছে। প্রথমটা হাতে লিখে বেরিয়েছে। দ্বিতীয়টা কম্পোজ আর ফটোস্ট্যাট। তৃতীয়টাই প্রেসের ঝকঝকে ছাপায়। পত্রিকাটাই যে শুধু তরতর করে এগিয়ে গেছে তাই নয়। এগিয়ে গেছে রাতজাগা অসংখ্য আলাপ, আড্ডা, গল্প, কবিতা আরও কত কত স্বপ্ন!

সব রাত্রিই সকাল হয়। সব গল্পই ফুরায়। সব স্বপ্নও তাই ভেঙে যায়। যেতে হয়। এই নিয়ম মেনেই বোধকরি উন্মেষ একদিন অনাকাঙ্ক্ষিত এক মহাবিরতির স্টেশানে ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই এই ঘুমকে মৃত্যু বলতে চাইলেও আমি মনেমনে মানতে পারিনি। তাই উন্মেষ’র এই ঘুম ভাঙাতে আমি আমার সবটুকু সুর দিয়ে ঘুমভাঙানির গান গাইতে চেয়েছি। উন্মেষকে জাগাতে চেয়েছি। ঘুম যখন ভাঙলই না, তখন মনকে বলেছি; থাক, ঘুমিয়েছে ঘুমোক, ছেড়ে দিলাম। তাকে মহা বিরতি দিলাম। তবুও মৃত বলতে রাজি হলাম না।

উন্মেষ’কে নিয়ে যখন একা হয়ে পড়েছিলাম, তখনকার সময়ের ছোট্ট একটা গল্প। নিজাম ভাইয়ের গল্প। খিদের গল্প।

আল কাউসারে ছিল আমাদের মাসিক ছুটি। দুইদিন। এই ছোট্ট ছুটিতেই পত্রিকার সবটুকু কাজ করতে হত। তেমনি এক মাসিক ছুটির দুপুরবেলা কাজে বেরোতে যাবো। তখনই একজন শিক্ষক ডেকে নিয়ে তাঁর ব্যাঙ্কের কিছু কাজ দিয়ে দিলেন। সেই কাজ শেষ করতে করতে আমার সারাটা দুপুর চলে গেল। খিদায় পেট লেগে যাচ্ছে। এদিকে পত্রিকার কাজও কিছু হয়নি। কোন কাজটা করবো! বিজ্ঞাপন নাকি মেকআপ! নাকি প্রুফ? নাকি বাসায় চলে যাব, কিছুই বুঝে আসছে না।

এমনই যখন অবস্থা। তখন কী মনে করে যেন হাঁটা দিলাম নিজাম ভাইয়ের অফিসের দিকে। যেতে যেতে ভাবলাম; তিনি যদি পত্রিকার কোন একটা কাজে সহযোগিতা করতে পারেন, বিজ্ঞাপন/লেখা/ছাপাখানার খোঁজ, যেকোনো একটা হলেই হল।

নিজাম ভাইয়ের সাথে দেখা হতেই বল্লাম; আজ তো বৃহস্পতিবার না, বিপরীত’র আড্ডাও নাই, তবুও চলে আসলাম। নিজাম ভাই অভিযোগের স্বরে বললেন, আরে, তোমার সাথে কি আমার আড্ডার সম্পর্ক নাকি, তুমি যেকোনো দিন, যখন ইচ্ছা আসবা। সাথে সাথেই জানতে চাইলেন, দুপুরে খেয়েছি কি না। আমি হালকা করে মাথা নেড়ে প্রসঙ্গ পালটাতে গিয়ে বললাম, নিজাম ভাই, পত্রিকার কাজের বিষয়ে আসছিলাম। তিনি নরম করে ধমক দিয়ে বললেন, চলো চলো, আগে খাবা। কাজ টাজ কী আছে সব পরে হবে।

অসম্ভব খিদে ছিলো। ক্যান্টিনে বসে তারপর আমি রুই মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছি। নিজাম ভাই বসে আছেন আমার মুখোমুখি। তিনি দুপুরের খাবার অনেক আগেই সেরেছেন। এখন বসে আছেন আমাকে সঙ্গ দিতে। আমি যেন অস্বস্তিতে না পড়ি তাই তিনি নিজের জন্য চা’য়ের অর্ডার করেছেন। চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর আমার সঙ্গে টুকটাক গল্প করছেন। তার দিকে চোখ তুলতেই তিনি জানতে চাইলেন, আর কিছু লাগবে কি না। আমি বললাম, না। কিন্তু মনেমনে বললাম, লাগবে। অবশ্যই লাগবে। শুধু প্রিয়জন নয়, প্রিয়জনের খিদে অনুভব করার মত জগতে আপনার মত অসংখ্য আফসার নিজাম লাগবে।

আজ বিশ’ই ফেব্রুয়ারি। আফসার নিজাম ভাইয়ের জন্মদিন। সারাদিন অসংখ্য মানুষ তাকে নানান শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এখন এই শেষবেলা এসে আমি সেসব পড়ছি। আর ভাবছি; শুভেচ্ছা আর কী জানাবো, কৃতজ্ঞতাই তো কত জানানোর বাকি। দুয়া করি, নিজাম ভাই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন। তার পরবর্তী প্রজন্মও ভালোবাসা আর আদর্শিকতায় তাকে ছাড়িয়ে যাক। তার মত আরও অসংখ্য ‘নিজাম’ এর হাত ধরে পৃথিবীটা ভালবাসার পথে এগিয়ে যাক!

পুনশ্চ :
খাবার শেষ করেই নিজাম ভাই সেদিন আমাকে ছেড়ে দেন নি। পত্রিকার জন্য তিনি আমাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছেন। প্রুফ, মেকাপ, কভার থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন কি রাত জেগে উন্মেষের বর্তমান অসাধারণ লোগোটিও তিনি আমাদের জন্য করে দিয়েছিলেন।

ছবি :
দুই বছর ধরে বইমেলায় যাই না। পনের’র বই মেলায় নিজাম ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে গিয়ে তিনি বললেন, বন্ধুর (নজরুলের) গলায় হাত রেখে দাঁড়াও তো, দুজনের একটা ছবি তুলে দিই!

বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীর হৃদয়ে চির অমলিন……………

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যার রাজনীতি ছিল বহুল বর্ণিল, তাঁর কণ্ঠে ছিল ইন্দ্রজাল, সেই ইন্দ্রজালিক শক্তিতেই তিনি ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে এক কাতারে সামিল করতে পেরেছিলেন। নির্ভীক ও স্বপ্নের কারিগর বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে নির্মাণ করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও এর গৌরবদীপ্ত সাফল্যের ইতিহাস……
.
তিনি ছিলেন এক রাজনীতির মহান কবি, যার ভাষণের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে ছিল কাব্যিক ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস ও মাত্রাবোধের এক অপূর্ব সম্মিলন। দেশের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালি জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি যেমন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তেমনি বাঙালির জাতির জনক জাতির পিতা। যে ডাকে জেগেছিল সাড়ে সাত কোটি প্রাণ রণাঙ্গনে, সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করা শুধু নয়, জাতির বিকাশকে স্থিমিত করার ঘৃণ্য চেষ্টাকে অবলোকন করেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। যেকোনো বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অনন্য নেতা। সহজ সরল, সাদামাটা অথচ দৃঢ়চেতা এক মানুষ। বজ্রকণ্ঠের বিস্ময়কর শক্তি এ মানুষটিকে সহজেই আলাদাভাবে চেনা যায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…..
.
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তিনি বেঁচে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। কেননা একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি তিনিই। তিনি গড়েছিলেন স্বাধীন সোনার বাংলা। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে ততদিন অমর তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্থান ছিল কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। তখন বাংলাদেশে একটি নামই উচ্চারিত হতো শেখ মুজিব তার নাম স্বগর্বে উচ্চারিত হবে ততদিন যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রবাহিত হবে, যতদিন বাংলার মাটি আর মানুষ থাকবে। হাজার বছর পরেও যদি একটি নাম উচ্চারিত হয়, তবে সে নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…..
.
আরব্য সাহিত্যের কবি আব্দুল হাফিজ লিখেছেন – আমি তার মধ্যে তিনটি মহৎ গুণ পেয়েছি – সেগুলো হলো দয়া, ক্ষমা ও দানশীলতা। তিনি যেমন ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্ট্রা, বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তেমনি ছিলেন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের চেতনার মূর্ত প্রতীক। আর চিরদিনের শোষিত-বঞ্চিত বাঙালিদের সম্রাট।
বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান সবসময়ই বলতেন —
বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারবে না, নিশ্চিতভাবেই জানি, পারবে না। কারণ ৩০ লাখ মানুষের তাজা রক্ত বৃথা যেতে পারে না, লাখো নারীর সম্ভ্রম বৃথা যেতে পারে না, লাখো মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এখন বঙ্গবন্ধু রাজপথের জয়বাংলা স্লোগান। বঙ্গবন্ধু এখন চেতনার নাম, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই সবুজের বুকে লালের সমাহার। বঙ্গবন্ধু মানেই রবিঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এ জয়গান……
.
বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয় প্রদীপ। বাঙালির নিবিড় মায়ায়, ধ্রুবতারা, কবির কবিতায় অলঙ্কৃত হয়েছে মহাকাব্যের নায়ক বঙ্গবন্ধু।
তাঁর সকল ভাবনাই ছিল দেশের মানুষকে নিয়ে তিনি মানুষকে যেমন বিশ্বাস করতেন তেমনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর নেতৃত্বেও এমনই একটি জাদুকরি শক্তি ছিল যে, দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। কেননা, প্রতিটি বাঙালি জানতো ও বিশ্বাস করতো বঙ্গবন্ধু এমনই এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যার নিজের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল চিরনিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তিনি মানুষের ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চান না। না প্রধানমন্ত্রীত্ব না প্রভুত্ব। তাঁর কাছে, অর্থ, সম্পদ, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন ও ঐশ্বর্য সবই ছিল তুচ্ছ। মানুষকে ভালবাসতেন বলেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু থেকে গেছেন মানুষের কাতারেই,
এই ভালবাসা মানুষের প্রতি বিশ্বাসই একদিন কাল হলো……
.
মানবিকতা ও মনুষ্যত্বেও ধারক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল কোনো বাঙালি কোন দিন তাকে হত্যা করতে পারে না। তিনি সবার কাছে বলতেন সবাই আমার সন্তান তাই কে আমাতে মারতে আসবে। মানুষের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাসই তাঁর মধ্যে মানবতাবাদের উৎকৃষ্ট গুণাবলীর উন্বেষ ঘটেছিল, তিনি শুধু বাঙালি বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের সব মানবতাবাদী ও শান্তিকামী মানুষের আদর্শ ও চেতনার মূর্তপ্রতীক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীর হৃদয়ে চির অমলিন…………

আল মাহমুদ এখন মা‌টির জগ‌তের অ‌ধিবাসী

আল মাহমুদ নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরেও অংশ নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই কবির প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।

২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকার ধানমণ্ডির ইবনে সিনা হাসপাতা‌লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামেই ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রবিবারে কবরস্থ করা হয়।

কালের কলস, সোনালি কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে উঠো, কাবিলের বোন, পানকৌড়ির রক্তসহ অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্যের এই স্রষ্টা তাঁর কৃতকর্মের জন্য একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছিলেন।

শ্রদ্ধায় ও স্মরণে ….

শ্রদ্ধায় ও স্মরণে ….

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে, অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে…’

এই বিখ্যাত লেখাটি যিনি বাংলা সাহিত্যে ভাণ্ডারে রেখে গেছেন সেই প্রেমের কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন আজ। জীবনানন্দ দাশ নিঃসন্দেহে সর্বকালের সর্বোৎকৃষ্ট নিঃসঙ্গতার কবি। বিশ্ব ইতিহাসে ক্ষণজন্মা প্রতিভাশীল প্রচার বিমুখ অন্যতম এক কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্য সংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় তার নামের প্রতি কোন সুবিচার হয়নি বললেই চলে।

######

আজ আরও এক মহান ব্যাক্তির মৃত্যু দিন যাঁকে আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। তিনি হলেন ….

জিওর্দানো ব্রুনো।

কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক, সৌরজগতের ধারণা সংক্রান্ত বইটির নাম অরবিয়াম। বইটি ১৫৫৯ সালে প্রকাশের পর জিওর্দানো ব্রুনো তা প্রচারে নামেন। রোমের ধর্মযাজক এই মতবাদের বিরোধীতা করে, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে, তাঁকে দণ্ডিত করেন। উক্ত দণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হল রোমের বধ্যভূমিতে। রক্তলাল পতাকা, সব গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল, আনুষ্ঠানিক পোশাকে শত-শত যাজক মৃত্যুকালীন স্তব গাইতে লাগল। খুঁটিতে বাঁধার আগে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। যা ছিলো তাঁর প্রচারিত তত্ত্ব ভুল, একথা স্বীকারের জন্য। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে একটি মঞ্চে খুঁটিতে বেঁধে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়।

ব্রুনোর জন্ম দক্ষিণ ইতালির নোলা নগরে ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে, কোপার্নিকাসের মৃত্যুর ৫ বছর পরে। ইতালীয় এই ঘটনা আমাদের নিয়ে যায় সেই প্রাচীন কাপুয়া থেকে রোম যাবার আপ্পিয়ান মহাপথের ধারে, মনে করিয়ে দেয় যার দু’ধার দিয়ে স্পার্টাকাসের ছয় হাজার মৃত্যু প্রতীক্ষারত দাস সঙ্গীকে ক্রশে ঝুলিয়ে রাখার কথা, যুদ্ধে সময় স্পার্টাকাসকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার কথা। ফলে তাঁর শরীর শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, রোমানদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় বিদ্রোহীরা মহা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। স্পার্টাকাসের দোষ ছিল তিনি দাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, গ্ল্যাডিয়েটরদের নির্মম অমানবিক খেলা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। মানবিক জীবনের জন্য সংগ্রামের পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন, যারা দাসত্ব ও গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো পশুর জীবনকে নিয়তি ভেবে প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছিল। আর তাঁর দেড় হাজার বছর পরে মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, হাজার বছরের পুরনো চিন্তার-দাসত্ব থেকে বের করে মানুষকে বিজ্ঞানের আলোয় নিয়ে আসতে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন জিওর্দানো ব্রুনো। বিজ্ঞানের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, যে-বিজ্ঞান মানুষের জীবন-যাপনে স্বাচ্ছ্যন্দ এনে দিয়েছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে বৃহত্তর মানবতার, সমগ্র মানব জাতিকে এগিয়ে নিয়ে নক্ষত্রে যাবার।

আমার স্মরণীয় দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ইং

২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ছয় বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সম্মানিত মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করছি, আমি নিতাই বাবু।

একসময় বাটন মোবাইলের সেটিং থেকে কনফিগারেশন সেটিং করে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। মোবাইল ছিল নোকিয়া N73। দীর্ঘদিন ব্যবহার করার পর মোবাইলটি আর ভালো লাগছিল না। এরপর শুরু হলো নোকিয়া C-3 দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করা। গুগলে সার্চ করা। বিভিন্ন ব্লগে উঁকি মারা। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলা সহ আরও অনেককিছু।

২০১৫ সালের জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লেখকদের লেখা পড়তে ভালো লাগতো। মনে স্বপ্ন জাগতো। নিজেরও লিখতে ইচ্ছে করতো। একসময় ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে রেজিস্ট্রেশন করলাম। নোকিয়া C-3 মোবাইলে বাংলা লেখা যায় না। কোনরকমভাবে ইংরেজি বর্ণ দিয়ে কয়েকটি শব্দের সমন্বয়ে একটা লেখা জমা দিলাম। লেখা জমা দেওয়ার বেশকিছুদিন আর ব্লগে প্রবেশ করিনি।

এরপর প্রায় দুই তিনমাস পর সিম্ফনি W82 মডেল-এর একটা মোবাইল কিনলাম। দাম ৯৫০০টাকা মাত্র। সেইদিনই ব্লগে উঁকি দিলাম। উদ্দেশ্য হলো, আমার জমা দেওয়া লেখাটার অবস্থা দেখা। দেখি সম্মানিত মডারেটর লেখার শিরোনাম বাংলায় দেওয়ার জন্য বলছে। সিম্ফনি এন্ড্রোয়েড মোবাইলে বাংলা লেখা যেত। লেখার শিরোনাম দিলাম, “আমিও মানুষ”। আবার জমা দিয়ে আর ব্লগে প্রবেশ করি না। প্রায় পনেরো দিন পর ব্লগে উঁকি দিলাম। দেখি আমার লেখায় কয়েকজন সম্মানিত লেখকদের মূল্যবান মন্তব্য। সেসব মন্তব্যের উত্তর লিখতে গেয়েই, আমি ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সকল সম্মানিত ব্লগারদের হৃদয়ে বন্দি হয়ে গেলাম। এরপর নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমস্যা নিয়ে ব্লগে অনেক লিখেছি। বেশি লিখেছি শীতলক্ষ্যা নদী নিয়ে, আর নারায়ণগঞ্জ শহর নিয়ে।

এরপর নির্ধারিত হলো ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর ছয় বছর পূর্তির দিনক্ষণ। তারিখ ছিল, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং, বৃহস্পতিবার। ব্লগের ছয় বছর পূর্তিতে থাকবে, লেখক সম্মাননা ও লেখকদের লেখায় ছাপা অক্ষরে তৈরি বই-এর মড়ক উম্মোচন। অবশ্য ব্লগের সকল ব্লগারদের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সেইদিন আমাদের নাগরিক সাংবাদিকদের মিলনমেলায় কাউকে সেথে করে নিতে পারিনি। কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুও আমার সাথে যায়নি। অথচ অনেক বন্ধুকে আমি রিকুয়েস্ট করেছিলাম। নিরুপায় হয়ে আমি একাই পৌঁছে গেলাম ব্লগের ছয় বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে। মিলন মেলার আয়োজন করা হয়েছিল, ঢাকা ধানমন্ডি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি টাওয়ারে।

ওইদিন ছয় বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ব্লগের লেখক লেখিকা ছাড়াও আমন্ত্রিত ছিলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সম্মানিত মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেব, বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কমিশনার সম্মানিত জনাব গোলাম রহমান সাহেব সহ আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল এর সাংবাদিকবৃন্দও। তাদের সাথে যোগ হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর।

একসময় শুরু হয় ব্লগের ছয় বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিকতা। সভামঞ্চে আসন গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, আমন্ত্রিত অতিথিদের। সম্মানিত অতিথিবৃন্দ সভামঞ্চে আসন গ্রহণ করার পর তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফুলের তোড়া। আর দেওয়া হয় ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর ব্লগারদের ২৫টি লেখা দিয়ে প্রকাশিত ‘নগর নাব্য- মেয়র সমীপেষু বই। নাগরিক সাংবাদিকদের নির্বাচিত ২৫ লেখার সংকলন ‘নগর নাব্য- মেয়র সমীপেষু’র বইয়ের মোড়ক ‘উম্মোচন হয় সম্মানিত অতিথিবৃন্দের হাতের ছোঁয়ায়।

এরপর সম্মানিত ব্লগ মডারেটর প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় ব্লগারদের সম্মাননা দেওয়ার বিষয়ে প্রসঙ্গ টেনে আমার লেখার একটা শিরোনাম বলতে থাকে। শিরোনামটা ছিল ‘শীতলক্ষ্ম্যা নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি এবং আমাদের মৃত্যু’, আমি বসে বসে সম্মানিত মোডারেট-এর কথা শুনছিলাম। পরে সম্মানিত মেয়রের কাছ থেকে আমাকে সম্মাননা পুরস্কার নেওয়ার জন্য মঞ্চের সামনে আসতে বলেন।

ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে আমার পাশে বসা আমার প্রিয় লেখক ফারদিন ফেরদৌস দাদা আমাকে অতিথিবৃন্দের সামনে যেতে বললেন। তখন আমি আনন্দে আর ভয়ে কাঁপছিলাম। আবার এই সম্মাননা পাবার আনন্দে ভেতরে-ভেতরে একপ্রকার কাঁদতে লাগলাম। সেটা ছিলো অতি সুখে আনন্দের কান্না। আমতা-আমতা করে সম্মানিত অতিথিবৃন্দের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সম্মানিত মেয়র সাহেব আমাকে আর একটু সামনে আসতে বলেন। আমি সামনে গেলেই সম্মাননার একটা ক্রেস্ট ও রঙিন কাগজে মোড়ানো দুটি পুস্তক সহ আমার হাতে তুলে দেয়।

আমি সম্মানিত মেয়রের হাত থেকে ব্লগের সম্মাননা পুরস্কার আমার হাতে নেওয়ার পরেই শুরু হয় মঞ্চে উপস্থিত সকল সম্মানিত ব্যক্তি ও আমার প্রিয় সহ-ব্লগার/লেখকবৃন্দদের হাততালি। আমি হাতে নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত সম্মানিত অতিথিবৃন্দদের সাথে করমর্দন করে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমার প্রিয় লেখকদের সাথে বসি।

এর কিছুক্ষণ পর শুরু হয় প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। সেই পর্বে আমাদের বিডিনিউজ ব্লগের অনেকেই সম্মানিত মেয়র সাহেবকে নগরের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করেন, সম্মানিত মেয়র সাহেবও সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রশ্ন-উত্তর পর্বের পরপর শুরু হয় স্বাগত ভাষণ, এরপর শুরু ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তির কেক কাটা। সম্মানিত অতিথিবৃন্দ ব্লগের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তির কাক কেটে মিষ্টিমুখ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। আমরা সকল ব্লগার/লেখকরা মেতে উঠি আনন্দে উল্লাসে, হাসি আর গানে।

সেইদিন মিলনমেলায় সবার সান্নিধ্যে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ি। মনে হয়েছিল আমি নিজ পরিবারের আপনজনদের সাথেই আনন্দে মেতে আছি। ব্লগের এই মিলনমেলায় এসে বুঝতে পারলাম, যারা লেখক, যারা লিখে তাদের মনটা থাকে অনেক বড়। লেখকরা খুব সহজেই যেকোনো মানুষকে আপন করে বুকে টেনে নিতে পারে। যারা লেখক তাঁরাই বুঝে মানুষের মনের কথা আর মনের ব্যথা।

আমার এই সম্মাননার জন্য আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগটিমের কাছে চিরদিন ঋণী। আমি ওই প্ল্যাটফর্মের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। যারা আমাকে এই সম্মাননা দেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন। এই ঋণ শোধরানোর মতো নয়। ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর আমাকে বহু কিছু দিয়েছে। ব্লগ থেকে আমি বহুকিছু পেয়েছি, শিখেছি। দিতে পারি নাই কিছুই। আমার দেওয়ার সামর্থ্যও নাই।

আমার মতো একজন নগণ্য মানুষকে এই বিশাল সম্মাননা দিয়ে আমাকে ঋণী করার জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেই সাথে বিডিনিউজ ব্লগের সকল ব্লগার/লেখকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ও আজীবন ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে রইলাম। এই ভালোবাসা কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। আর এই সম্মাননা আমার একার নয়, এই বিশাল সম্মাননা এই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগের সবার সম্মাননা। জয়তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জয়তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগের নাগরিক সাংবাদিক ব্লগার/লেখকবৃন্দ। সেইসাথে জয় হোক স্বনামধন্য শব্দনীড় বাংলা ব্লগ সহ ব্লগের সকল লেখক লেখিকাদের। জয় হোক মানবতার।

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – শেষ পর্ব

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – পর্ব ৩

এখন আরও কিছু প্রতিভাবান ব্যাক্তিদের কথা বলবো যারা এই রকম রোগের শিকার হয়েছেন। মায়াকোভিস্ক, আইজাক নিউটন, মারিনা স্ভেতায়েভা, এমিলি ডিকিনসন।

শতাব্দির শুরুতে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত মায়াকোভস্কিকে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘raging bull’. ওভারকোট আর হ্যাট মাথায় দীর্ঘদেহী এক মানুষ। যিনি পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে ঘৃণা, অসাম্যের কথা বলেছেন তাঁর কবিতায়। অসাধারণ সুন্দর আবৃত্তি করতেন মায়াকোভস্কি, তাঁর কবিতায় রয়েছে এক ধরনের বিমর্ষ চিৎকার। মায়াকোভস্কির জীবনের শেষ বছরটি ছিল খুবই ঝঞ্ঝাময়। তাঁর স্ত্রী লিলি ব্রুকের মতে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি তার স্বভাবজাত ছিল। তিনিও নানান কারনে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি তাতিয়ানা নামের এক মডেলের প্রেমে পড়েন, তাতিয়ানা একজন ফ্রেঞ্চকে বিয়ে করায় তিনি মানসিক অবসাদে ভোগেন। এছাড়াও যে আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন তার অবনমন তাঁকে ব্যাথিত করে তুলেছিল। এসব বিবেচনা করে অনেকে মনে করেন যে তিনিও সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল সকাল ১০:১৭ তে মায়াকোভস্কি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।

মারিনা স্ভেতায়েভা কবির ইংরেজি প্রতিবর্ণীকরনে কবির পূর্ণ নাম – Marina Ivanovna Tavetaeva. এটি মূল রুশ উচ্চারণের প্রায় কাছাকাছি। বাংলায় রুশ উচ্চারণ অনুসারে পদবীর উচ্চারণ করলে সেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মারিনা স্ভেতায়েভার শহর ছিল মস্কো। এটা যেন তাঁর শহর, একান্ত নিজের। এই শহর যেন তাকে কোন জাদু করেছিল। এই ভাললাগা ছিল তাঁর নিজস্ব ও ব্যাক্তিগত। রাশিয়ার বিখ্যাত কবিদের মধ্যে তিনি একজন। আখমাতোভা, মায়াকোভস্কি, ও অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর নাম ও সমান ভাবে উচ্চারিত হতো। তথাপি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। বহুবার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছেন। খুব দারিদ্রের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মারিনা স্ভেতায়েভার কোনোদিনই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন নি। অসহায়তায়, অক্ষম সমর্পণে ছিল তাঁর তীব্র অনীহা। এই সবের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। একটু শান্তির জন্য তিনি এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। দু’বেলা অন্নের জন্য তিনি লড়াই করেছেন। হয়ত পুরোপুরি সফল হন নি। সেটা বড় কথা নয়। দুঃখভার সইবার শক্তি ছিল তাঁর অসীম। কিন্তু আমাদের এই প্রিয় কবিও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন। ১৯৪১ সালের ৬ই অগস্ট কামা নদীর তীরে এলাবুগা নামক একটি জীর্ণ, পোড়ো এক শহরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ফাঁসের জন্য ব্যাবহার করেছিলেন শণের দড়ি।

এমিলি ডিকিনসনকে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা কবিদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ছোটবেলায় এমিলি নিজেকে মেধাবী ছাত্রী ও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে প্রমাণ করেন। ছড়ায় ছড়ায় গল্প লিখে তিনি তার সহপাঠীদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। সমাজ জীবন থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে একাকিত্বের ঘেরাটোপে আটকে রেখে এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন তিনি, একেবারেই সাদামাটা ও নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। ডিকিনসন এক অজানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই, সম্ভবত রোগটি ছিল মানসিক বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ বা স্থায়ী বিষাদগ্রস্ততা। তিনি নানদের মতো সাদা পোশাক পরতেন। তিনি মৃগী রোগে মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এবং এই মৃগী রোগের কারনেই তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন।

সেরা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের ব্যক্তিত্ব ও কিছু ব্যবহার ছিল বেশ অদ্ভূত এবং পাগলাটে। নিউটনের সময়ে আলো নিয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় নি। চোখ কি নিজে আলো তৈরি করে, না কি সংগ্রহ করে এ বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না মানুষের কাছে। সেই কারনে তিনি নিজের ওপরই একটা পরীক্ষা করে দেখেন। অপটিক্স নিয়ে নিজেই নিজের গিনিপিগ হন এবং তার নোটবুক থেকে একটা পরীক্ষার কথা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি তার দুই চোখের মাঝখানের হাড়টিতে একটা ভোঁতা সুঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে দেখেছিলেন রংয়ের অনুভূতিটা কেমন। ১৬৭৮ সালে তাঁর আলোকবিদ্যার (থিওরি অব অপটিক্স) বিভিন্ন দিক নিয়ে এক বিতর্কে জড়ানোর পর, তিনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। ১৬৯৩ সালে দ্বিতীয়বার এমন হয়েছিল তিনি আবারও মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন তারপর তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের মানসিক ভেঙে পড়ার পেছনে কম ঘুমকে দায়ী করেছেন নিউটন। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। গবেষণার সময় রাসায়নিক দ্রব্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং দীর্ঘকালীন মানসিক দুর্বলতা ও বিষন্নতার সম্মিলিত কারণে এটা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষকেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যারা এই অসুখে ভুগছেন। ২০০৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক উইলিয়ামস দেখেন মেডিটেশন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে কাজ করেছে। কেমিব্রিজ ইউনির্ভার্সিটির জন টিসডেল ক্রনিক বিষন্নতা গ্রস্ত রোগীদের ওপর মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনের প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন, এদের মধ্যে পুনরায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার হার অর্ধেক কমেছে। ২০০৮ সালে বিজ্ঞানী প্রোলাক্স দেখেন মেডিটেশনের ফলে এই ৪০% রোগীর উন্নতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে সানডিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী সানহফ খালসা দেখেন, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, হতে হবে সংযমী। আমরা আমাদের মন কে পুরোপুরি জয় করতে না পারলেও তাতে লাগাম দেয়ার চেষ্টা তো অবশ্যই করতে পারি। আর এই চেষ্টার ফলে যদি আমাদের কিছু অন্যায় ইচ্ছে বা মুড প্রশমিত হয় তাহলে আমরাই উপকৃত হবো। আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠবে সুখী-সুন্দর ও নির্মল। এর ফলে মন-প্রাণ সুন্দরের সৌরভে ভরে যাবে জীবনে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি।

(সমাপ্ত)

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – পর্ব ২

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – ২

এর আগেই আমরা জেনেছি যে প্রতিভাবান ও সৃজনশীল মানুষেরা বাইপোলার ডিসঅর্ডার নামক মানসিক রোগের শিকার হয়ে থাকেন। ইতিমধ্যেই আমরা কিছু সাহিত্যিক ও সৃজনশীল ব্যাক্তিত্বদের সম্বন্ধে (যেমন ভ্যান গঘ, সিলভিয়া প্লাথ, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এডগার অ্যালান পোর মতো খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের সম্বন্ধে) জেনেছি।

আজ প্রথমেই যেটা জানবো সেটা হল বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি? আমরা জানি শরীর ও মন একে অপরের জন্য অপরিহার্য। মন ভাল না থাকলে শরীর ভাল থাকে না। তেমনি শরীর ভাল না থাকলে মনও ভাল থাকে না। আপনাকে সুস্থ থাকতে হলে শরীর ও মন দুটোতেই সুস্থ থাকতে হবে। কিন্তু শরীরের অসুখ হলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি এবং চিকিৎসক এর কাছে গিয়ে নিজেরাই চিকিৎসা করাতে পারি। মনের অসুখ হলেও তা পারি কি? হ্যাঁ আমরা তাও পারি, তবে তার আগে মনের অসুখ হয়েছে কি না, সেটার গুরুত্ব দেওয়ার উপর নির্ভর করে আমরা মনের অসুখের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাবো কি না। বেশীর ভাগ সময় আমরা বুঝতেই পারি না যে আমাদের মনের সমস্যা আছে এবং চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

তাছাড়া মনোরোগ শুরুতেই বুঝতে পারলে এর ক্ষতিগ্রস্ততা কম হয়, কারণ তাতে চিকিৎসা করে অথবা সাবধান হয়ে রোগটি সাড়ানো যায়। মনের অসুখ সারাতে মেডিটেশন খুবই দরকারি। আমরা অনেকেই কম বেশী মেডিটেশন সম্পর্কে জানি যে কিভাবে মেডিটেশন করতে হয়। স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, হতাশা, বিষণ্নতার পাশাপাশি অন্যান্য মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন কার্যকরী। অনেক সাইকিয়াট্রিস্টই এখন অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মনোযোগের বিক্ষিপ্ততা, হাইপার এক্টিভিটি ডিসঅর্ডার, এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে মেডিটেশন করাকেই যুক্তি সঙ্গত বলে মনে করেন।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলো হঠাৎ করে কোন ইচ্ছের বা মুডের ফলে যে মানসিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়, একে ‘ম্যানিয়া’ও বলা হয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার এক ধরনের গুরুতর আবেগজনিত মানসিক রোগ, এর এক দিকে থাকে ‘ডিপ্রেশন’ বা বিষণ্নতা এবং অন্য দিকে থাকে ম্যানিয়া। ডিপ্রেশনে মনের আবেগের উদ্দীপনা কম থাকে। মনে বিষণ্ণতা অনুভব হয়। কোনো কাজ ভালো লাগে না। শরীরে ও মনে অবসাদ অনুভব হয় আর অন্যদিকে ম্যানিয়াতে মনের আবেগের উদ্দীপনা অতিরিক্ত অনুভূত হয়। সব কিছু বেশি বেশি ভালো লাগে মনে অতিরিক্ত উত্তেজনা কাজ করে ইত্যাদি।

এ রোগের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হলো রোগী হঠাৎ করে আত্মহত্যা করতে পারে। বাইপোলার ডিপ্রেশনে থাকাকালীন সময়ে আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় ৪০% হতে পারে। ম্যানিক ডিসঅর্ডারেও প্রায় ১০% রোগী আত্মহত্যা করতে পারে। অধিক উত্তেজনার কারণে অনেক সময় কাউকে মেরেও ফেলতে পারে। জিনিসপত্র ভাঙচুর বা অন্য কাউকে শারীরিকভাবে আঘাতও এ রোগের অন্যতম ঝুঁকি। তাছাড়া ম্যানিক রোগগ্রস্ত অবস্থায় অনেকের বেশি টাকা-পয়সা খরচের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ সময় হঠাৎ করে বিভিন্ন ব্যাবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে রোগীর জীবনের একটা বড় কার্যক্ষম সময় নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোগী বিভিন্ন সময় নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত থাকে এমনকি বহু ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে আকৃষ্ট হতে পারে।

চলবে …

প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা

প্রতিভাবানব্যক্তি দের মানসিক সমস্যা

প্রতিভাবানদের মধ্যে ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ বা ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’ এর নজির দেখা গেছে হাজার হাজার বছর ধরেই। ভান গঘ, সিলভিয়া প্লাথ কিংবা ভার্জিনিয়া উল্ফে’র মতো খ্যাতিমান চিত্রকর-কবি-লেখকদের জীবনযাপন দেখে সহজেই তা বোঝা যায়। অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও সক্রেটিসের জীবন কথায়ও এইরকম উল্লেখ আছে। অ্যারিস্টটল একসময় দাবি করেছিলেন, “পাগলামির ধাত্ ছিল না – অদ্যাবধি কোনো মহান প্রতিভাধরের জন্ম হয়নি।” কিন্তু, পাগলামি-ক্ষ্যাপামি-বিষাদগ্রস্ততা বা ইত্যকার সব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রতিভার যোগসূত্রের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এতোদিন দুর্বলই ছিল। লন্ডনের কিংস কলেজের ‘ইন্সটিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’র গবেষকরা স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইন্সটিটিউটের গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন। ভ্যান গঘ -এর আঁকা বিখ্যাত সূর্যমুখী ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ স্থায়ী বিষাদগ্রস্ততা বা ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’ হিসেবে পরিচিত। ‘মুড’ বা ভাবের পরিবর্তনে ম্যানিয়া বা ‘ইলেশন’ থেকে সহজেই ‘ডিপ্রেশন’-এ চলে যেতে পারেন এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা। ম্যানিক পর্যায়ে এঁরা নিজের সক্ষমতা বা অক্ষমতা সম্পর্কে অতিশয়োক্তিতে ভোগেন, কথাবার্তায় অভাবনীয় চাতুর্যের পরিচয় দেন এবং বিশ্রামহীন হয়ে পড়েন, অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করেন।

১৯ শতকের মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’-এ ভুগেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। পো একবার বলেছিলেন, “লোকে আমাকে পাগল বলে। কিন্তু পাগলামিতেই বুদ্ধিবৃত্তির সবচেয়ে শিখরস্পর্শী অবস্থান নিহিত কিনা সেই প্রশ্নের এখনও সুরাহা হয়নি। ”জীবনভর মানসিক অস্থিতিশীলতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। অনেক জীবনীকাররই লিখেছেন, ভান গখ ডিপ্রেশন ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছেন। ১৮৮৮ সালে মানসিক আঘাতের চরম পর্যায়ে আর একটু হলেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু পল গঁগার জীবননাশ করতে চলেছিলেন তিনি। ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে এক নারীকে নিজের কানের একাংশ কেটে উপহার দেন তিনি। কবি সিলভিয়া প্লাথ নিজেকে সামলাতে ভয়াবহ যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন বারবার। আত্মহত্যার প্রবণতা, নিজেকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া থেকে শুরু করে কী করেন নি তিনি। এসব কারণে তাঁর কোনো সম্পর্কই টেকেনি। শেষপর্যন্ত গ্যাস-ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে আত্মহত্যার পর প্লাথের এই চরম আত্মঘাতী প্রবণতার রহস্য নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা করেছেন পাঠকরা। গবেষকরা বলছেন, সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছিলেন প্লাথও। ভার্জিনিয়া উল্ফ ১৯১৩ সালে জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভয়েজ আউট’ শেষ করার পরপরই ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। উল্ফ নিজেই লিখেছেন, ‘”আমি বিয়ে করে ফেললাম এবং আমার মাথায় যেন আতশবাজির আগুনের ফুলকি ফুটতে শুরু করল। পাগলামির অভিজ্ঞতাটা আসলেই ভয়াবহ ভীতিকর৷ কিন্তু, আমি এখনই খুঁজে পাই যে, আমি যা কিছু লিখেছি, যেসব নিয়ে লিখেছি তা ওই আগুনের লাভাতেই জন্ম নিয়েছিল।”

প্রতিভাবানদের মধ্যে পাগলামির এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মনোবিশ্লেষক, মনস্তত্ত্ববিদ এবং মনরোগবিশষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিভাবানদের সঙ্গে পাগলামির যোগসূত্রটা আসলে এক ধরণের স্নায়বিক ভারসাম্যহনীতার মধ্যে নিহিত। ইন্সটিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’র সিনিয়র লেকচারার ড. জেমস ম্যাকাবে এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সুইডেনের ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সি স্কুলছাত্রছাত্রীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সমীক্ষা চালান তারা। এইসব ছাত্রছাত্রীদের কতজন ৩১ বছর বয়সের মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণে চিকিৎসা নিতে গিয়েছে হাসপাতালের রেকর্ড থেকে তাও দেখা হয়েছে। গবেষকরা জানান, উচ্চ প্রতিভাবানরা যেমন মানসিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন তেমনি এই ঝুঁকি রয়েছে স্কুলে খুব খারাপ ফলাফলকারীদেরও। আর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও দেখা গেছে নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে এমন পাগলামি জেগে ওঠার সম্ভাবনা বেশি।

চলবে …

শুভ জন্মদিন হে মহাকবি…

শুভ জন্মদিন হে মহাকবি…

প্রথমে আসাদ নামে কবিতা লিখতেন, পরে গালিব নাম ধারণ করেন। ১১ বছর বয়স থেকে ফার্সি ও উর্দু ভাষায় গজল লিখেছেন। ভারতের উর্দু কবিদের অন্যতম শিরোমণি। জন্ম আগ্রায়। দিল্লিতে স্থায়ী বসবাস। শেষদিকে বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ছিলেন। প্রেম, বিশ্বাস, সুর, সুরা, অবক্ষয়, হাহাকার, জরা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় সার্থক রূপায়ণ করেছেন। মৃত্যু নিঃসঙ্গ করুণভাবে দিল্লিতেই। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানে গালিব’। দাস্তাম্বু’ তাঁর সিপাহি বিপ্লবের রোজনামচা নির্ভর একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। আমি এমনি এমনিই তাঁর প্রেমে বিভোর নই, তাঁর শের, শায়েরী, গজল এইসব পড়লে, আমি নিশ্চিত আপনারাও তাঁকে ভালোবেসে ফেলবেন। আজ এই ঈশ্বরের জন্মদিন। তাঁর কিছু শায়েরী …

১. হ্যায় অউর ভি দুনিয়া মে সুখনবর বহত আচ্ছে,
ক্যহতে হ্যায় কি গালিব কা হ্যায় আন্দাজ-এ বায়াঁ অউর,

২. আদায়ে খবাস সে গালিব হুয়া হ্যায় মুখ্তসর,
সালায়ে আ-ম হ্যায় ইয়ারা-এ নুক্তা দাঁ কে লিয়ে!

৩. ইয়ে মাসায়িল-এ তাসাউফ ইয়ে তেরা বায়াঁ গালিব,
তুঝে হাম ওলি সামাঝতে জো না বাদাখবার হোতা,

৪. হাথো কে লাকিড়োঁ পে মত্ যা এ গালীব ,
নসীব উনকে ভী হোতে হয়্ জিনকে হাত নেহি হোতে।

৫. গালীব শরাব পীনে দে মসজিদ মে বৈঠ কর,
ইয়া ওহ জগাহ বাতা জাহাঁ খুদা নেহি।

৬. হাজারোঁ খোয়াইশ এ্যয়সে কে হর খোয়াইশপে দম নিকলে,
বহত নিকলে মেরে আরমাঁন লেকিন ফির ভি কম নিকলে!

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন

আজ আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থুড়ি পদ্য (কারণ তিনিই বলে গেছেন “আমি কবিতা লিখিনা, পদ্য লিখি” ) এক আশ্চর্য ব্যাপার, বোধহয় কিছুটা তাঁর প্রথম জীবনের বোহেমিয়ান জীবনধারার মতই “UNPREDICTABLE” যা প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, ছন্দের বিবর্তনে নেশা জাগিয়ে রাখে চিরন্তন ! কত অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনের জন্মদাতা, যা এখনো মুখে, মুখে ফেরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি। এই কবি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ অর্থাৎ আজকের দিনে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কাব্য- ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’, ‘ছিন্নবিচ্ছিন্ন’, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’, ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’ প্রভৃতি।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা মজাদার গল্প বলে গেছিলেন অভিনেতা রবি ঘোষ –“..কোন মদ্যপায়ী লেখক বা গুনী ব্যক্তি হলফ করে বলতে পারবে যে তাকে একদিন রাত্রে GOVT. STATE BUS DRIVER বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে! পারবে না। নাম করা লোকজন বাড়ি পৌঁছবার জন্য দামি গাড়ী আনতে পারে..আনতে পারে লরি, কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটা আস্ত খালি STATE BUS আনতে পারে। কারণ – সেই STATE BUS এর DRIVER শক্তির কবিতার ভক্ত। ” এই রকম বহু ঘটনা আর কবিতার দ্বারা সৃষ্টি শক্তি নামক একটি মিথ যা আমাদের এখনো বিস্মিত করে, স্তম্ভিত করে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কবিতাঃ-

**অবনী বাড়ি আছো

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ

** যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।

** একবার তুমি

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর –
দেখবে, নদীর ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল – ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই – পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল –
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় |
মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার | আমরা ঘরবাড়ি গড়বো – সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো |
রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো |

** চতুর্দশপদী কবিতাবলী–
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে…
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা–
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।

***
‘শিশিরভেজা শুকনো খড়’

শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে
মিছুবাড়ির জনলা দোর ভিতের দিকে টানছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা
শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা
নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার …
বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে
শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে
করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে
অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ
প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব’সে কাঁদছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে

***স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি’

মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ ধ’রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান…
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
ব’লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।
তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে – মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়!