বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

কবি বিনয় মজুমদার এর জন্মদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম

ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, ‘আমি সাম্প্রতিকালের এক কবির সম্পর্কে আশা রাখি, যিনি কবিতার জন্যে যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয় একালে এত বড় শক্তিশালী শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন কবি আর জন্মান নি। তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।’

বিনয় মজুমদার এবং দুঃখ একে অপরের পরিপূরক মনে হয়। বিনয় মজুমদারের দুঃখ কিংবা দুঃখের মধ্যে বিনয়। বিনয় মজুমদারের কবিতা পাঠ করতে করতে প্রশ্নও জাগে বিনয় মজুমদারের কবিতায় এত দুঃখ কেন? দুঃখগুলো কিন্তু এক নয়। অনেকগুলো বাঁক এইসব দুঃখের। সঙ্গ-অনুষঙ্গ মিলে কী ভীষণ প্রতাপ তাঁর দুঃখের। অর্ধেকেরও বেশি কবিতা মিলে বিপুল সমারোহে তার পূর্ণতা।

ভালোবাসা দিতে পারি
– বিনয় মজুমদার

“ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম ?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবাতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান —- শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূরা থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।”

অসাধারণ প্রশ্ন রেখে কবিতাটি শুরু হয়েছে-
‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ কবি বিনয় মজুমদার তাঁর ভালোবাসার ভাণ্ডার থেকে আমাদের ভালোবাসা দিয়ে যেতে চান কিন্তু আমরা কী সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে সক্ষম? গণিত ছিলো তাঁর পছন্দের বিষয় তাই গাণিতিক হিসাবের মতোই চলে এসেছে ঝরে যাওয়া হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা বা স্মৃতি।

‘পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু
ভালোবাসা দিতে পারি আমি।’

পঞ্চাশের দশকের এক কবির মুখে এরকম বাণী নিশ্চিতভাবেই ভাব-ভাষার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখনও করে।কবিতাটি ‘তোমরা’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে আসে। বেদনাকে সহজ অনুরণন ভাবতে হয় এখানেও। বেদনা-ই বিনয় মজুমদারকে আক্রান্ত করে আর ওই বেদনার জোরেই ভালোবাসা প্রাণ পায় দ্বিগুণ। ‘তুমি’ তে নেমে এসে এখানে ফের বলা হয়েছে, ‘গ্রহণে সক্ষম নও।’ ভালোবাসা যাকে তিনি দিতে চান সে যে কেন তা গ্রহণে সক্ষম নয় ইঙ্গিতটি অল্প বোঝা যায় শেষে এসে।

“প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।”

কবির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। একসময় ‘তুমি’ নামের মানুষটি চলে যাবে। ‘বিচ্ছেদ’ বা ‘বেদনা’-র পর্বের শুরু এখানে অবশ্য শেষে এসে মূল শুরুটা হয়ে যাচ্ছে। ‘আমি’ বিষয়ক ব্যক্তি কবি বিনয় মজুমদার যন্ত্রনা সাথে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।

তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, কৃত্তিবাস পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার, কবিতীর্থ পুরস্কার, অর্জন করেছেন তার কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, ফিরে এসো, চাকা, আমার ঈশ্বরীকে, অঘ্রাণের অনুভূতিমালা-র জন্য। তিনি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেন, “আমার সব কবিতাই আসলে দিনপঞ্জি।”

কবির জন্ম মায়ানমারের (তৎকালীন বার্মা ) তেডো শহরে ১৯৩৪এর ১৭ই সেপ্টেম্বর। বেশিদিন বসবাস করেননি সেখানে। কৈশোরেই চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। জন্মদিনে এই প্রিয় কবিকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

_______________
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৯।

শিল্পী শাহাবুদ্দিন এবং একাত্তরে একটি আর্ট এক্সিবিশন মিশন


শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তার জীবন নানা নাটকীয়তার ভরপুর। জীবনের প্রতিটি বাঁক তিনি ক্যানভাসে তুলে এনেছেন তুলির আঁচড়ে। তার জীবনবোধ নানা রঙে বর্ণিল। সেই বোধ থেকেই প্রতিটি আঁচড়ের জন্ম।

একজীবনে যিনি ছবি আঁকাকেই ধ্যানজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্ট এক্সিবিশন করেছিলেন জঙ্গলের মধ্যে। শিল্পীর কাছে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেই আর্ট এক্সিবিশনের রোমঞ্চকর দিনের কথা শিল্পীর জবানিতে এমন –
“একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্ট এক্সিবিশন করেছি জঙ্গলে। কর্নেল শওকত যখন জানলো আমি আর্ট কলেজের ছাত্র, তখন আশ্চর্য হলেন। বললেন, আর্ট কলেজ! প্রথম কেউ বুঝে না আর্ট কলেজ কী। এরপর যখন ছবি আঁকা শুরু করলাম তখন আমার সম্মান বেড়ে গেল। তখন আমি প্লাটুন কমান্ডার। খালেদ মোশাররফ তখন আমাকে একুশ রুপি দিলেন। বললেন, আগরতলা থেকে রং-টং কিনে নিয়ে এসো।”

সেই উত্তাল দিনে অনেকদিন ছবি আঁকার অনুশীলন ছিল না। ছিল না ছিল না রঙ, তুলি, কাগজ। তাই প্রথমে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য মনের জোরে কাজ চালিয়ে গেলেন।

“প্রশিক্ষণ নেই। আঁকতে পারি না। আমি যে শিল্পী হবো, জীবনেও ভাবি নাই।”


শাহাবুদ্দিন আহমেদের বিখ্যাত একটি চিত্রকর্ম।

একদিন ছুটি নিয়ে তিনি আগরতলায় গেলেন। জঙ্গল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। আর্টের কাগজ, রং খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কলা-চিড়া কিনে ফিরলেন নিজেদের ক্যাম্পে। তার ভাষায় – “যুদ্ধের সময় খাবারের খুব কষ্ট পাইছি আমরা।”

“জঙ্গলে বড় বড় জোঁক ছিল। হেবি লাফ দিয়ে আসে। শরীর খালি পাইলেই হলো। কাপড় পরলে অবশ্য আসে না। ম্যাক্সিমামের গায়েই তো বেশি কাপড় নাই। লুঙ্গি পরা। আমি একটা প্যান্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। এই জন্য সবাই আমাকে ডাকত মাঞ্জা প্লাটুন কমান্ডার। ট্রেনিংয়ে সবাই পরত লুঙ্গি-গামছা। মূলত সবাই লেংটি দিয়ে রাখত।”

এক্সিবিশনের জন্য অনেক খুঁজে শাহাবুদ্দিন কিছু ক্যালেন্ডার যোগাড় করলেন। রঙ না পেয়ে চোখের কাজল কিনলেন। এরপর কাজল, সবজির আঠা একসাথে মিশিয়ে রঙ তৈরি করলেন। আঁকলেন বঙ্গবন্ধুর একটি পোর্ট্রেট।

মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সকাল থেকে ট্রেনিং হয় বিকেল পর্যন্ত। তারপর অবসর। সেই সময়ে অনেকে গান করে, নিজেদের চাঙ্গা করে। শাহাবুদ্দিন ছবি আঁকতে লাগলেন।

“কাগজের উপর কয়লা, হারিকেনের সলতের কালো রং এইগুলো দিয়ে ছবি আঁকলাম। মাথায় আইডিয়া এলো। এইসব আর প্লাস্টিকের তাঁবু দিয়ে তো ওয়াল বানাতে পারি। কিছু কিছু গাছ কেটে একটা স্পেস করে বেড়ার মতো বানালাম।”


নিজ ক্যানভাসে শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

সংগীত শিল্পী আজম খান ছিলেন একই ক্যাম্পের সতীর্থ। তারা একসাথে যুদ্ধ করেছেন। সমস্বরে যুদ্ধের গান গেয়েছেন। একসাথে আরো কতো স্মৃতি।

“আজমকে বললাম, তুমি গান গাবা আর আমি ওপেনিং করব। তখন খালেদ মোশাররফ বলল, একটা অনুষ্ঠান করা যাক। আমি সব আয়োজন করব। ত্রিপুরা সরকারের সবাই আছে।”

“আজম লিডিং নিল। হারমোনিয়াম আসলো মেলাঘর থেকে। আমার প্রিপারেশন হলো বাঁশ দিয়ে আর্ট গ্যালারি বানানো। গাছ দিয়ে স্টেজ তৈরি হলো। সব প্লাস্টিকের তাঁবু। জাম্বুরার কাঁটা দিয়ে দিয়ে ছবিগুলা লাগিয়েছি প্লাস্টিকে ছিদ্র ছিদ্র করে করে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হবে। চারটি রুম তৈরি করেছি। এক সাইড খোলা রেখেছি। ওই দিকে সব জনতা ও সোলজার। আর সামনে চেয়ারে বসে ছিলেন ত্রিপুরার মন্ত্রীগণ, খালেদ মোশাররফ ও অন্যরা।”

প্রায় ৩ হাজার লোকের সমাগম ঘটলো। অনুষ্ঠানে গান শুরু হলো। স্টেজের উপর কয়েকজন টর্চ লাইট ধরলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবিটা রশি দিয়ে গাছের উপর টানানো হলো। অনেকটা পতাকার মতো করে।

“কেউ কল্পনাও করে নাই, এই জঙ্গলের মধ্যে ছবির এক্সিবিশন। আর যারা চেয়ারে বসে ছিলেন, লাইট-টাইট জ্বালার পরে দেখেন, একি ব্যাপার। এবার বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর জ্বালানো হলো বড় টর্চ লাইট। সাথে সাথে জয় বাংলা স্লোগানে পুরো জঙ্গল যেন কেঁপে উঠল। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল। সবার চোখ ছলছল করছে গর্বে, আনন্দে।”

মামুন রণবীর
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

স্মরণে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম : যার ছিল মাটির সোঁদা গন্ধভরা সুরেলা জীবন


বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।

তার ছিল কথা-সুর, তাল- লয়, রঙ-রূপ, রস আর মাটির গন্ধভরা জীবন। বাংলার পথে-প্রান্তরে ছুটে যিনি মানুষকে শুনিয়েছেন শেকড়ের গান। জীবনের বাহারী রূপ তিনি ধারণ করেছেন সুরে। কালনী নদীর পাড়ে বসে কখনো আনমনেই গেয়ে ওঠেছেন ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি…’। মাটি ও মানুষের এই শিল্পী শাহ আবদুল করিম। একজীবনে যিনি ‘সোনার ময়নারে পুষেছেন মাটির পিঞ্জিরায়’।

শহুরে জীবনে মাটির গন্ধ নেয়া বড্ড কঠিন। শহুরে জীবনধারা প্রতিনিয়ত আমাদের অজস্র বিরক্তির মুহূর্ত এনে দেয়। দিনের অজস্র ব্যস্ততার পর রাতবিরাতে খুব নীরবে ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’ অথবা ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’ শুনলে সেইসব বিরক্তি যেন মুহূর্তেই উধাও! এইতো শিল্প -সংগীত যা মানুষকে এনে দেয় কোমল প্রশান্তি। আবার প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ অথবা ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙখী নাও’ গানগুলো শুনলে মনের ভেতর এক অদ্ভুত ঢেউ তৈরি হয়। মনে হয় ‘মিশে গেছি’ আকাশ,বাতাস,নদী আর সবুজে।

শাহ আবদুল করিমের গানের কথা যেমন নান্দনিক তেমনি তার সুর মুগ্ধতার নিয়ামক। লিরিকে তিনি ধরতে চেয়েছেন গ্রামীণ জীবন,ভাটির হাহাকার, নাগরিক প্রেম, যাপিত বেদনা এবং আরো নানাবিধ বিষয়। গানে গানে তিনি ‘দয়ালের দয়া’ চেয়েছেন।
দেখিয়েছেন মানুষ ও সময়ের দূরত্ব। তিনি বন্ধুকে পেতে চেয়েছেন তুমুল আকুলতায়। মানুষ ও মনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মন ও ভাবনার বৈচিত্র্য, দুনিয়া ও মানুষের মায়াজাল বিষয়গুলো নিজের মতো করে তুলে এনেছেন গানে। মনে মনে কথা সাজিয়ে একান্তে বেঁধেছেন সুর। সে এক অসীম সাধনার সমুদ্র। যেখানে কখনো কখনো ‘কূলহারা’ হতে হয়। তবে গানের এই মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী,আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী’ গানে গানে এমন কথা বলেছেন,তবে মানুষ তাকে ছুঁয়ে গেছে তুমুল আগ্রহে। তিনিও যে ছুঁয়েছেন মানুষের হৃদয়ের অন্দরমহল।

শিল্পীর অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। তার ভাবনার শতভাগ সৃষ্টির তরে। একজন শাহ আবদুল করিম নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন অবলীলায়। মানুষ আর প্রকৃতিপ্রেম তাকে এমন এক জগতে নিয়ে গেছে যেখানে বৈষয়িক কোনকিছুই শিল্পীকে স্পর্শ করে না। তাইতো তিনি একের পর এক গান বেঁধেছেন মানুষের জন্য। যে গানে আছে জীবনের প্রকৃতরূপ, জীবনকে আরো গভীরভাবে দেখার পথ এবং মানুষ ও জীবনের বোঝাপড়া। একজন মানুষ কিভাবে নিজেকে খুঁজে ফেরেন তার চমৎকার দৃষ্টান্ত একজন শাহ আব্দুল করিম। জীবন তাকে কিছুই দেয়নি কিন্তু তিনি জীবনকে দিয়েছেন অনেক।

একজীবনে তার চাওয়ার কিছুই ছিল না। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিনি কেবল নিজেকে প্রস্তুত করেছেন মানুষকে কিছু দেবার জন্য। শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীত ও বাউলগানের যে দীক্ষা তিনি ওস্তাদ রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকস এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন তা ছিল সুদূরপ্রসারী। যা তার সৃষ্টিকর্মেই প্রতীয়মান। এই বাউলসম্রাটের গান বাংলা সঙ্গীতে যে স্বকীয়তা তৈরি করেছে তা তরুণ শিল্পীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। এই সমৃদ্ধ ভান্ডার মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

বাংলা সংগীতের অমর এ শিল্পী পিরিতি বাড়িয়েই চলে গেছেন অজানায়। দিনটি ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯। তার জন্য কেঁদেছিল পৃথিবী। একজন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্য এখনো নাগরিক মন কাঁদে। এইসব দিনরাতে গেয়ে ওঠি ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি’।

মামুন রণবীর
১২/০৯/১৯

মহাত্মা আন্তোনি

মহাত্মা আন্তোনি ২৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের উত্তর অঞ্চলে একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিশরীয় আন্তোনি, মরুবাসী আন্তোনি ও বিজনাশ্রমী আন্তোনি বলেও পরিচিত। তিনি সেই মরুবাসী পিতৃগণের পথদিশারী বলে গণ্য ছিলেন, যারা ৩য় ও ৪র্থ শতাব্দীতে মিশরের প্রান্তরে সন্ন্যাস জীবন পালন করছিলেন।

একদিন যিশুর এই বাক্য শুনে ‘তুমি যদি সিদ্ধপুরুষ হতে চাও, তাহলে যাও, তোমার যা কিছু আছে সবই বিক্রি করে গরিবদের দান কর তবেই স্বর্গে তোমার জন্য ধন গচ্ছিত থাকবে, পরে আমার অনুসরণ কর’ তিনি সবকিছু বিক্রি করে গরিবদের বিলিয়ে দিয়ে লোকালয় ছেড়ে মরুপ্রান্তরে চলে গেলেন।

তিনি প্রথম খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী এমনকি খ্রিষ্টান সন্ন্যাস জীবনের আদিপিতা বলে পরিগণিত। তিনি একাকি হয়ে পবিত্র বাইবেলে ও মরুপ্রান্তরের নির্জনতায় ঈশ্বরের অন্বেষণ করলেন। কয়েক বছর পর লোকে তাঁকে সাধু বলে গণ্য করায় তাঁর কাছে পরামর্শ ও প্রার্থনার জন্য আসতে লাগল। তাঁর লিখিত ‘আন্তোনির জীবনী’-তে আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল সাধু আথানাসিউস একথা বলেন যে, আন্তোনি সমগ্র বাইবেল মুখস্থ করেছিলেন, যার ফলে লোকেরা তাঁকে দেখে স্বয়ং খ্রিষ্টকেই দেখতেন।

তিনি ৩৫৬ খ্রিষ্টব্দে প্রাণত্যাগ করেন: আপন শিষ্যদের কাছে এমন নির্দেশ রেখে গেছিলেন যেন তাঁর মৃতদেহ গোপন স্থানে সমাধি দেওয়া হয় যাতে করে তাঁর মৃতদেহ জনগণের ভক্তির বস্তু না হয়।

( collected )

দুখু মিয়া

দরিরাম পুরের দুখু মিয়া পারেনি দমিতে।
দুঃখিদের নিপিড়ন পারেনি সহিতে।

সামাজিক বিভেদের সংগ্রামী সৈনিক।
জা‍তীয় চেতনায় নির্ভয় নির্ভিক।
ক্ষুরধার ‍লেখনি তার শানিত অস্ত্র।
সাবলিল ভাষা তার ঐন্দ্রজালিক মন্ত্র।
কাব্যের ঝংকারে দূর্বিনতদের করেছেন শত কষাঘাত।
শ্রাদ্ধ্ করেছেন রূপকের ছলে করেছেন পদাঘাত।
গেয়েছেন সাম্যের গান হয়ে মহিয়ান।
জাতি ধর্ম নি‍র্বিশেষে হয়ে বলিয়ান।
গানে গানে উ‍জ্জীবিত করেছেন নির্জীব জাতিকে বিজয় মন্ত্রে।
জুজুর ভয় পেরিয়ে উদ্বেলিত করেছেন অভয় মন্ত্রে।
দূর্জয় দুর্বার কাজি নজরুল অমর রবে কোটি কোটি প্রানে।
আমার অকুন্ঠ সন্মান বিপ্লবী বিদ্রোহী জাতীয় কবির প্রয়ানদিনে।

অর্ধেক তার প্রাপ্য তোমার

প্রিয় বঙ্গমাতা,

এই বঙ্গোপসাগরের তীরে
এই বঙ্গদেশ বিনির্মাণে
বঙ্গবন্ধুর তীব্র আন্দোলনে
সুদৃঢ় বজ্রকণ্ঠে, আদর্শে, চিন্তা-চেতনায়
তুমিই যে ছিলে তাঁর সংগ্রামের অনুপ্রেরণায়
আজ তা আমরা জেনে গেছি।

এই বঙ্গের জন্য
কারাবরণের চিহ্ন
জাতির পিতার
বাইশ বার।

কতবার যে তুমি জেল গেটে গিয়েছো
প্রতিবার যে রুল টানা কাগজ নিয়েছো
বারবার যে বঙ্গবন্ধুকে লিখতে বলেছো
আজ তা আমরা সবাই জেনে গেছি
তাইতো আজ আমরা দুটো বই পেয়েছি
কারাগারের রোজনামচা পড়েছি
অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়েছি
আমরা সত্য জেনে গেছি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে
উত্তাল জনসমুদ্র যখন পূর্ব পাকিস্তানে
লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে
ডেকেছিলো যখন বঙ্গবন্ধুকে
একমাত্র তুমিই বুঝতে পেরেছিলে
ষড়যন্ত্রের সবকটি যন্ত্র যাবে বিফলে
নিষেধ করেছিলে বঙ্গবন্ধুকে
যেওনা ওই গোলটেবিল বৈঠকে।

অতঃপর !
অতঃপর এলো সেই ৭ই মার্চ
বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠলো পৃথিবী
“ভালো হবে না
সাত কোটি মানুষকে
দাবায় রাখতে পারবা না
তোমাদের যে কিছু আছে
তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো
এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ”

তারপরের ইতিহাসও আমরা জেনে গেছি
আলোকিত স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে গেছি।

প্রিয় বঙ্গমাতা,

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি,
অর্ধেক তার
প্রাপ্য তোমার
নয় শুধু তা হয়ে
বঙ্গবন্ধুর অর্ধাঙ্গিনী।

তোমার দূরদৃষ্টি
নিবিড় অন্তর্দৃষ্টি
প্রখর দূরদর্শিতা
অসম সাহসিকতা
দেখেছি আমরা
এই বঙ্গোপসাগরের তীরে
এই বঙ্গদেশ বিনির্মাণে
বঙ্গবন্ধুর তীব্র আন্দোলনে
সুদৃঢ় বজ্রকণ্ঠে, আদর্শে, চিন্তা-চেতনায়
তুমিই যে ছিলে তাঁর সংগ্রামের অনুপ্রেরণায়
যা এনে দিয়েছে তোমায় এই সম্মান
নয় শুধু হয়ে তা বঙ্গবন্ধুর অর্ধাঙ্গিনী।

.
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব: জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও নিবেদিত কবিতা।

কবি গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফা : প্রিয় কবির শুভ জন্মদিন

শুভ জন্মদিন কবি গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফা। সুদূর ইরাকে বসবাস করে যে নীরবে নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে চলেছে। কবিতার প্রতি তার এই আন্তরিক আগ্রহ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। শৈশব থেকেই সে সাহিত্যব্রতী। সাহিত্যের জন্যে হারিয়েছে অনেক কিছু। এখন এসব কিছুই তার সাহিত্যের উপজীব্য। তার কবিতায় আছে গভীর দেশপ্রেম, বিরহ আর জীবন যন্ত্রণা। প্রবাস জীবনের দুঃখগুলোকে সযত্ন প্রয়াসে শিল্পরূপ দিয়েছে এই কবি। শোক পাথরের মালা তার প্রথম কবিতার বই। যা ইতোমধ্যে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। আজ ১ আগস্ট ইরাক প্রবাসী কবি গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফার জন্মদিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মোহাম্মদপুর গ্রামে তার জন্ম। দীর্ঘ প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় সে ইরাকে প্রবাস জীবন যাপন করছে। শৈশব থেকেই তার কাব্য চর্চার সূচনা। প্রবাস জীবনে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে আছে প্রেম প্রকৃতি আর দেশের প্রতি গভীর আন্তরিক টান। জন্মদিনে তাকে জানাচ্ছি শুভেচ্ছা। সাথে পাঠকদের জন্যে তার একগুচ্ছ কবিতা।

দৃশ্য এবং মন
– গোলাম মোহাম্মদ মোস্তাফা

শীতের সকালবেলা শান্ত থাকে, শান্ত থাকে
পৃথিবীতে মানুষের মন
প্রকৃতির মনোভাব নীরব নির্জন
মধুময় সুন্দর উপমা আমার গভীর হৃদয়
নরম মাটির বুকে ঘাসে গলিত কুয়াশা
শিশির দানা হয়ে জড়িয়ে রয়েছে ,
যেন শামুকের ডিমের মতো
সাদা টলমল বিন্দু বিন্দু জল
সবুজ ঘাসের বিছানো হৃদয়ে
বিনীসূতার মালায় সৌন্দর্যের রূপ হয়ে বসে আছে
যেন তার রূপেভরা পূর্ণিমা চাঁদের হাসি
প্রাণময় সব কথা নিবিড় নীরবে
সোনালি রঙের আলো হয়ে ঝলমল করে
বিশাল হৃদয় তার দারুন ভঙ্গিতে ফুটে উঠে
সকালের স্নিগ্ধ শোভিত প্রান্তরের মত কিক আশ্চর্য মনোহর
এখানে আমার স্বপ্ন পূর্ণ সুখের প্রতিশ্রুতিশীল
অবারিত মাঠ সরলতার মত উৎসব মুখর
দুটো চোখের নিপুন মোহনায় মন নেচে উঠে
সকালবেলার দৃশ্য পটভূমি
মন দিয়ে অনুভব করি
জীবনের সফলতা খোঁজে নিয়ে।

মহান মে দিবস
– গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফা

আমি খুঁজে পাচ্ছি না দেহের ঘাম ঝরা অধিকার
আর তুমি বায়না ধরে অভিমানী মুখ
ফিরিয়ে রেখেছ
আমার মতো আরো কত প্রবাসী শ্রমিক
পূঁজিবাদীদের কাছ থেকে
অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে
বঞ্চিত হচ্ছে
স্বজনের ভালবাসা থেকে।

তোমার মুখটা তুলে আমার দিকে তাকাও
দুদিকের কষ্ট সহ্য হয় না
তুমি একটু ভালবাসার নজরে তাকাও।

প্রিয়তমা,
তুমিই বল শ্রমিক হয়ে জন্ম নেওয়া
এ কোন অভিশাপ
তোমার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করে রাখে।

আমার কি মনে চায় না
শ্রমের অধিকার পেয়ে
তোমার আবদার পূরণ করে
মনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
প্রেম প্রীতির বন্দনে হৃদমন্দিরে বসিয়ে রাখি।

শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে
আজ মহান মে দিবস

মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে অমর হয়ে আছে
অথচ আমার শ্রমের ন্যায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে
তোমার হৃদয় জয় করতে পারিনি।

পদ্মফোঁটা পুকুরের জল
– গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফা

পরির মায়ের পদ্মফোঁটা পুকুরের জলে
এখনো কি কোন রমনীর ঢেউ তোলা চুলের মতো
মুক্ত বাতাসের খেলা করে?
অথবা এখনো কি পদ্মফুল ফোঁটে?
ঢেউয়ের সাথে নিঃসঙ্গ ঘাটলাটির ভাব জমে উঠে?
মায়াভরা ছায়াঘন পরির মায়ের সেই পদ্মপুকুরে
এখনো কি কোন প্রেমিক পুরুষ কারো ভালবাসায় জড়িয়ে যাওয়া
পদ্মফুল কঁড়িয়ে আনে?
সময় অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে আমাদের
কৃত্রিম যান্ত্রিকতায় কত কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে আজ
অন্তরা তোমার মাথার চুলগুলো কত অগোছালো!
মনকে স্থির রেখে এগিয়ে যাও
বৃক্ষের পাতা ও পুষ্পের কাছে,
পরির মায়ের পদ্মফোঁটা পুকুরের জলে যাও,
মনে রেখো, ভালবাসা কোনদিন হারিয়ে যায় না
হারিয়ে যায় না স্মৃতি ভরপুর দিন
সেই ঘাট পদ্মফুল জলভরা পুকুর আর তোমার হাসিতে উল্লসিত দিন
অন্তরা এখনো তরতাজা অমলিন!

বল না তুমি
– গোলাম মোহাম্মদ মোস্তফা

বল না তুমি,
কেন তোমাকে দেখলে ভাল লাগে
কি আছে তোমার দেহের নদীতে
উত্তাল ঢেউ ছাড়া
কিসের টানে মনে পড়ে
বার বার আমাকে ব্যকুল করে

তোমার যোগল চোখ দেখে
তারা জ্বলে বার বার
তারা ফুলের গন্ধ নেয়
তবু কেন আমায় টেনে বস করে

বল না তুমি,
মন মাঝি কেন এতো উতালা হয়
তোমায় নিয়ে যুগ যুগে
পাড়ি দিতে ইচ্ছে হয়।

কি আছে তোমার
মিষ্টি রাঙা ঠোঁটে
হাসিলে না কি ঠোঁট
গোলাপ হয়ে ফোঁটে

তার মাঝে আছে কি পাঁপড়ির ঘ্রাণ
তবু কেন চুমু দিলে দেহে উঠে শিহরণ

বল না তুমি,
কেন তোমায় দেখলে ভাল লাগে!

শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধেয় কবি মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফার সুখ সমৃদ্ধি কামনা।

আহমদ ছফার মতো বড় মাপের লেখক হয়তো আর জন্মাবে না

আজিজে তার ছোট্ট একটা বসার জায়গা ছিলো। সে জায়গাটায় এখন গেঞ্জির দোকান, আবার মাটির টেরাকোটাও পাওয়া যায়। জায়গাটা ছিলো খুব জরাজীর্ণ নোংরা আর অগোছালো। আমি তার ওখানে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে যেতাম। তিনি সব সময় পান খেতেন। পানের পিকে তার ঠোঁট সব সময় লাল হয়ে থাকতো। পানের গন্ধে আমার মাথা ঘুরে যেতো যখন তখন শ্রাবণের (তখনো রবীন আহসানের সাথে আমার পরিচয় হয়নি) সামনের বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতাম। আমার কাছে মনে হতো তখন আজিজে ভ‚ত থাকে। প্রায় সব দোকানের সাঁটার লাগানো থাকতো। ছফা এতো বড় লেখক বা তিনি একদিন এতো বিখ্যাত হয়ে উঠবেন তা আমি জানতাম না। আমি তার লেখার কিছু পাতা দেখে দিতাম। একবার একটা বানান ভুল ছিলো আমি তা ধরতে পারিনি, এজন্য ছফা ভাই আমাকে বিশ্রীভাবে একটা গালি দিয়ে বললেন, তোদের দিয়ে নুম্বাও (নুম্বা মানে কি আমি তা তখন জানি না) হবে না। তার মুখ খারাপ ছিলো, রাগলে তিনি কেমন যেন হয়ে যেতেন তাই আমি তর্কে যেতাম না। তাকে শ্রদ্ধা করতাম খুব।

একবার কবি সমুদ্র গুপ্ত এলেন তার দোকানে, ছফা ভাই আমাকে বললেন, সমুদ্র আইসে তুই এখন বাইর হয়া যা। আমি যাচ্ছি না দেখে তিনি আমাকে গাধা ছাওয়াল বলে গালি দিলেন। তার হঠাৎ হঠাৎ বলে ওঠা গম্ভীর কথাগুলো শুনে ৫০ শতাংশ বুঝতাম আর বাকিটা মাথার উপরে দিয়ে চলে যেতো। গেঞ্জির দোকান তখনো আজিজে এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। কবি শহীদুল্লাহ সিরাজী ওখানে প্রায়শই,আসতেন, আমার সাথে সিরাজী ভাই খুব ইয়ার্কি করতেন (এখনো করেন) আর আমাকে তিনি ‘কাউয়া লাকী’ বলে ক্ষ্যাপাতেন, মাঝে মাঝে আমাকে দৌড়ানিও দিতেন। দাদা (আহমদ ছফা) বলতেন, পান নিয়া আয়। আমি বিরক্ত হলেও তাকে পান এনে খাওয়াতাম। অনেক বছর এভাবে তাকে পান এনে খাইয়েছি। তার পানের বক্সে সব সময়ই পান থাকতো, কিন্তু তিনি আমাকে দিয়ে পান আনাতেন কেন? এই একটা প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি। তাকে নিয়ে এরকম অনেক অস্পষ্ট স্মৃতি আমার আছে তা কোনো একদিন এক গ্রন্থে লিখে রেখে যাবো।

২৮ জুলাই আহমদ ছফার মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তার মতো বড় মাপের লেখক বাংলাদেশে হয়তো আর জন্মাবে না।

আমার ভাবনা – ০২

মানুষকে মারতে নয়, মানুষকে বাঁচাতে ধর্ম এসেছে। বিভেদ নয়, ঐক্য সৃষ্টি করতে ধর্ম এসেছে। ঘৃণা নয়, ভালোবাসা শেখাতে ধর্ম এসেছে। যুক্তিহীন কুসংস্কার ছড়াতে নয়, এগুলি দূর করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে ধর্ম এসেছে। আজ আমরা কোন ধর্মকে আকড়ে ধরে আছি অবশ্যই ভাবতে হবে।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডদ্রোহী রাজা রামমোহন রায়

সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডদ্রোহী এক মহান ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়……
জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলার নবযুগের প্রথম ও প্রধান নায়ক কীর্তিমান পুরুষ রাজা রামমোহন রায়। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক অগ্রদৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও কর্মনেতা ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ১৮৩০ সালে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

রামমোহন রায় ১৭৭২ খ্রিস্ট্রাব্দের ২২ মে মাসে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দোপাধ্যায়) ব্রাক্ষ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন। রামমোহন খুবই মেধাবী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফারসী ও ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। এ ছাড়া হিব্রু, গ্রিক ও সিরীয় প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি হিন্দুধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন এবং ইসলাম ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন। প্রথম যৌবনেই তিনি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা এবং ইউক্লিডের মূলনীতিগুলো পাঠ করেন। এ গ্রন্থাবলি অধ্যয়নের ফলে তাঁর ভেতরে যুক্তিবাদিতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়। এ সময়ই তিনি ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করেন। পারস্যের সুফি মরমিয়া কবিদের কাব্য পাঠও তাঁর মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। যৌবনের প্রারম্ভে নানা গ্রন্থ ও শাস্ত্র অধ্যয়নের ফলে রামমোহন রায় মূর্তি পুজার ব্যাপারে বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। এবং তাঁর বিপ্লবী চিন্তার ফসল হিন্দুধর্ম সংস্কার আন্দোলন। তিনি প্রতিমা পূজা বর্জন করেন এবং বিশ্বাস করতেন এক সর্বজনীন ঈশ্বরপূজায়। তিনি ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সভা, যা পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্ম সমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ব্রাহ্ম সমাজকে হিন্দুধর্মের নতুন শাখা হিসেবে অভিহিত করা যায়।

স্বামী বিবেকানন্দ এর দৃষ্টিতে রামমোহনের তিনটি দান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। “His acceptance of Vedanta, his preaching of patriotism and the love that embraced the Muslanmans equally with the Hindus”.
এবং স্বামীজী তাঁকে “the first man of new generation” নামে ভূষিত করেছেন।

রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ। সনাতন হিন্দুধর্মে প্রচলিত অমানবিক ও নির্মম সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথার মতো কুপ্রথা সরকার আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে দেয়।

রামমোহন রায় স্বীয় ধর্মমত ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য ১৮২১ সালে সংবাদ কৌমুদী নামে একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ১৮২২ সালে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসি ভাষায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই দুই পত্রিকায় রামমোহন রায়ের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের সপক্ষের যুক্তিগুলো গদ্য রচনার মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।

১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল জন এডাম ভারতীয় প্রেসের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন, তখন রামমোহন রায় বন্ধুদের নিয়ে প্রিভি কাউন্সিলে স্নারকলিপি পেশ করে বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ করেন। তিনি বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরকে নিয়ে ১৮২৬ সালে ভারতীয় জুরি আইনের কতিপয় বৈষম্যমূলক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থবিরোধী সরকারি রাজস্বনীতির বিরুদ্ধে তিনি বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংয়ের কাছে ১৮২৯ সালে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেন। বলা যায়, রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িককালে কলকাতায় সংঘটিত এমন কোনো সামাজিক আন্দোলন পাওয়া যাবে না, যাতে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেননি। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন।

রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর সেখানকার ইংরেজ সমাজ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে। ১৮৩২ সালে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে যান। ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল নগরীতে ভ্রমণকালে তিনি অসুস্থ হন।ব্রিস্টলেই তাঁর চিকিৎসা চলে। বিলেতি প্রাজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলার নবযুগের নায়ক রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি-
ধম্মং শরণং গচ্ছামি-
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি’

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম
গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্যের (চতুরার্য সত্য) সব কটিই দুঃখকে কেন্দ্র করে। তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে কীভাবে দুঃখের হাত থেকে বাঁচানো যায়। গৌতম বুদ্ধ দুঃখের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাননি, তিনি দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেন। দুঃখের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৌতম বুদ্ধ কারও কাছে সাহায্য না চেয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেছেন।

জগতে দুঃখের কথা শুধু গৌতম বুদ্ধ একাই বলেননি, বিভিন্ন উপনিষদে দুঃখ সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে। সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ সাংখ্যকারিকার প্রথম সূত্রই ত্রিবিদ দুঃখ নিয়ে শুরু করেছে। ভারতীয় দর্শনের একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সব কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করাকেই জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে মনে করেছে। তবে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের কোন দার্শনিকই গৌতম বুদ্ধের মত এত গভীরভাবে এবং যৌক্তিকতার সঙ্গে দুঃখ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেননি।

গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে Schopen Hauer, Nietzsche, Kierkegaard কী বলেছেন আলোচনা করে দেখা যাক।

Schopen Hauer একজন দুঃখবাদী দার্শনিক। তাঁকে অনেকেই‍‍‍ ‘Prince of Pessimism’ বলেন। তাঁর মতে, এ জগত দুঃখের আলয়। দুঃখই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। সুখ অকল্পনীয় ও অসম্ভব বস্তু। যতই আমাদের জ্ঞান বাড়ে, ততই আমাদের দুঃখ বাড়ে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ দুঃখের কথা বললেও আশার বাণী শুনিয়েছেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। Schopen Hauer বৌদ্ধধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করলেও বুদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে আছেন। বুদ্ধের শিক্ষা আমাদের আশার আলো দেখায়, আর শোপেন হাওয়ার তাঁর সামনে পর্দা টেনে আমাদের হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেন।

Nietzsche ও দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্য আরও ভিন্নতর। তিনি প্রথম জীবনে Schopen Hauer দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে সে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সে যাই হোক তিনি মায়া-মমতা, দয়া-সহানুভূতি ইত্যাদিকে অনেক ছোট করে দেখিয়েছেন। তাঁর কাছে মানবিক গুণের চেয়ে শক্তির গুরুত্ব বেশী। তিনি বলেন, উচ্চতর সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়া উচিত। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ঠিক এর বিপরীত। তাঁর শিক্ষা ভালোবাসা আর দয়ার কথায় পূর্ণ। তাঁর কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই শ্রেণী বিভাগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, জন্মগত কারণে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই Nietzscheর দর্শনের মতো উচ্চতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের ধ্বংস বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনে অকল্পনীয়।

Kierkegaardও বুদ্ধের মত তত্ত্ববিদ্যায় উৎসাহী ছিলেন না এবং তাঁরও মূল লক্ষ্য মানুষের নৈতিক দিকটা। তিনিও বুদ্ধের মতো বলেছেন, কামনা-বাসনাই দুঃখ আনে। তবে তাঁর এ ব্যাখ্যা ঈশ্বরকেন্দ্রিক, কিন্তু বুদ্ধের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। বুদ্ধের মতো Kierkegaard বাসনার উর্দ্ধে যেতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন, বাসনা ত্যাগ বৌদ্ধিক আত্মহত্যার শমিল।

প্রত্যেকটি দুঃখের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী, অন্য কেউ নয়। আরব দেশের এক কবি বলেছিলেন, ‘মারা যাওয়ার পর তাঁর কবরের ওপর যেন লিখে রাখা হয় যে, তাঁর পাপের জন্য তাঁর বাপ দায়ী। কারণ তাঁর বাপ না থাকলে তাঁর জন্ম হতো না এবং জন্ম না হলে তিনি পাপ করতেন না ।‘ কিন্তু বুদ্ধ কখনোই উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাননি। তাঁর মতে, আমার দুঃখ আমারই সৃষ্টি। শুধু দুঃখ নয়, এমনকি আমাদের জন্মের জন্যও আমরাই দায়ী। জন্মলাভের বাসনা থেকেই আমাদের জন্ম হয়েছে।

Pragmatism সম্প্রতিক কালের আর একটি দর্শন। এ দর্শনের মূল বক্তব্য হলো, যা কাজে লাগে এবং যা প্রয়োজনীয় ত-ই সত্য, তা-ই আলোচ্য ও বিবেচ্য হওয়া উচিত। সম্ভবত গৌতম বুদ্ধই প্রয়োগবাদেরও পুরোধা। মালুক্য পুত্রের তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, কেউ যদি তীর বিদ্ধ হয় তাহলে কী তার প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত ? যেহেতু সে কষ্ট পাচ্ছে, সেহেতু সে প্রথমে তীরটা খুলবে। এর আগে সে নিশ্চয়ই ভাববে না, তীরটা কী গতিতে এল, তীরটা কে মারল, তীরটা কীসের তৈরী। তাই আমরা যেহেতু দুঃখের সাগরে ভাসছি, আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত এই দুঃখের হাত থেকে কিভাবে বাঁচা যায় তার চেষ্টা করা। বুদ্ধের মতে, আমাদের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই।

সমকালীন দর্শনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো Logical positivism. এ মত অনুসারে principle of verification হচ্ছে সত্যের মানদণ্ড। যে বাক্যকে পরখ করা যায় না তা অর্থহীন। তাঁদের মতে, তত্ত্ববিদ্যাবিষয়ক অবধারণ এই পরখনীতির আওতায় পড়ে না। তাই এরা অর্থহীন।

গৌতম বুদ্ধ পরখনীতির উল্লেখ না করলেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তত্ত্ববিদ্যায় আলোচ্য বক্তব্য প্রমাণও করা যায় না আবার অপ্রমাণও করা যায় না। গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রকার চরম মত ও পথের বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত এটা তাঁর ব্যক্তি জীবনেরই অভিজ্ঞতার ফল। তিনি মধ্যমা প্রতিপদ বা মধ্যম পথকেই উত্তম পথ বলে স্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটল যে Golden Mean এর কথা বলেছেন তা তাঁর ২০০ বছর আগে গৌতম বুদ্ধই বলে গেছেন। বস্তুত বুদ্ধের মধ্যমা প্রতিপদ ও অ্যারিস্টটলের Golden Mean এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন।

অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের আর একটি শাখা বলে মনে করেন। কেউ আবার মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই হিন্দুধর্ম পূণর্তা লাভ করেছে। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় বলেছেন, ‍’ Buddhism is the fulfillment of Hinduism.’ অনেকে আবার বৌদ্ধধর্মের সাথে খ্রীষ্ট ধর্মের মিল খুঁজে পেয়ে এদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ আছে কিনা তা খুঁজতে চান।

বুদ্ধ ব্যবহৃত উপমাগুলি এবং যিশু খ্রীষ্টের প্যারাবেলস –এর মধ্যে সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ যে, তাহা শুধু chance coincidence বলে যেন সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। যেমন বুদ্ধের উপমাগুলি ভারতের পূর্ববর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায় না তেমন যীশুর প্যারাবেলস বাইবেলের পূরাভাগে পাওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধ ও যীশু খ্রিষ্টের শিক্ষার মিল আমাদের চিন্তাকে নাড়া না দিয়ে পারে না।

আমার জানা মতে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোন মনীষীর আবির্ভাব ঘটেনি যিনি গৌতম বুদ্ধের মতো একাধারে নৈতিক শিক্ষার প্রবক্তা ও সমাজ সংস্কারক এবং যার দর্শনকে অস্তিত্ববাদ, প্রয়োগবাদ ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সব ধর্মের শিক্ষিত প্রবক্তাদের কাছে তিনি সমাদৃত এবং এ বিষয়ে তিনি সত্যিই অনন্য। রাজত্বের লোভ ত্যাগ করে তিনি সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। আজ তাই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়সিংহাসনে তিনি সমাসীন।

তথ্যসূত্র : গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন।

আঁকা : রিয়া দাশগুপ্ত।

মহামনীষী ওমর খৈয়াম

আজ থেকে ৯৭১ বছর আগে সুদূর ইরানে জন্ম নিয়েছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও কবি ওমর খৈয়াম। আজ গুগল নিজস্ব ডুডল দিয়ে বিখ্যাত ফার্সি গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কবি ওমর খৈয়ামের ৯৭১ তম জন্মদিন উদযাপন করছে। গণিতবিদ হিসাবে, খৈয়াম ঘনকের সমীকরণ শ্রেণিবদ্ধকরণ ও সমাধান সম্পর্কে তার বিশদ কাজের জন্য পরিচিত। তিনি কণিকের ছেদের জ্যামিতিক সমাধান বের করেছিলেন। তিনি প্রথম ঘন সমীকরণ সমাধান করার জন্য একটি সাধারণ পদ্ধতির ব্যবহার করেন। খৈয়াম সমান্তরাল অক্ষ বিষয়েও কাজ করেছেন। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে, তিনি জালালি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করেন একটি খুব সুনির্দিষ্ট ৩৩ বছরের intercalation চক্রের একটি সৌর ক্যালেন্ডার। এটি পরে বেশ কয়েকটি ক্যালেন্ডার তৈরির ভিত্তি হয়ে ওঠে।

ওমর খৈয়ামের জন্ম ১০৪৮ সালের ১৮ মে ইরানের নিশাপুরে। তাঁবু নির্মাণকারীদের (খৈয়াম) একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ওমর। আরবি ভাষায় তাঁর পুরো নাম ছিল আবু’ল ফাত ওমর ইবন ইব্রাহিম আল খৈয়াম। কবিতা ও গদ্যের জন্যও বেশ বিখ্যাত ছিলেন খৈয়াম। তিনি হাজারেরও বেশি রুবাইয়াত বা গদ্য লিখেছেন। ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ পরে আর এক বিখ্যাত কবি Edward fitzgerald অনুবাদও করেন, তার মৃত্যুর বহুকাল পরে খৈয়ামের এই লেখা পর পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ওমর খৈয়াম চার লাইনের বিশেষ ধরনের কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়ে অাছেন। তার কবিতাগুচ্ছ রুবাইয়াৎ নামে সমাদৃত হয়েছে। পেত্রার্কের সনেটের মত রুবাইয়াৎ এক বিশেষ ধরনের চতুষ্পদী কবিতা। খৈয়ামের কবিতা গুচ্ছের বিষয়বস্তুু প্রেম, উপভোগ,পরকালের সুখ দু:খের অবিশ্বাস,জাগতিক বিষয়ে উদাসীনতা,মাদকতা প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে। ওমর খৈয়াম ঠিক কতগুলো রুবাই লিখে গেছেন তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তাঁর অমর গ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই-খৈয়ামে ৭২২ টি রুবাই পাওয়া গেছে। রুবাই ছাড়াও কবিতা গজল লিখেও তিনি খ্যাতি পান। ঊনিশ শতকে ইংল্যান্ডের কবি Edward fitzgerald ওমর খৈয়ামের কবিতা ইংরেজীতে অনুবাদ করলে পারস্যের বাইরের পাঠকের খৈয়ামকে জানার সুযোগ ঘটে। সেটা সতের শতকের দিকে। ইংরেজী ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ওমর খৈয়ামের কবিতা অনূদিত, বহুল পঠিত ও সমাদৃতি হয়।জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে ১১২৩ সালে ৭৯ বছর বয়সে বিশ্বখ্যাত কবি ও মহামনীষী ওমর খৈয়াম মারা যান।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে অনুবাদ সাহিত্যের অনন্য এক কারিগর, তিনি সে প্রমাণ রেখেছেন পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের ফারসি ভাষায় লেখা ‘রুবাইয়াৎ-ই-খৈয়াম’ বাংলায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে। তিনিই প্রথম বাংলায় এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন এবং গ্রন্থটি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। সে সময় বইটির চিত্রায়ন করেছিলেন খালেদ চৌধুরী এবং ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।

চলুন কাজী নজরুল ইসলামের অনূদিত ওমর খৈয়ামের কয়েকটি রুবাইয়াৎ পড়ে নেওয়া যাক-

১. আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস
মুক্ত পাখায় দেবতা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হল না রে, ছেড়ে তোর ওই জ্যোতির্লোক
ভিনদেশি-প্রায় বাস করতে এলি ধরায় এই আবাস?

২. সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!
প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি ধরতে দাও!
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁট-ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও।

৩. ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।

৪. আমরা দাবার খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানী সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই?
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব
খেলা শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!

চিত্রকলার প্রাণ-পুরুষ-ভ্যান গঘ এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা

জন্মদিনে সমকালীন ও আধুনিক চিত্রকলার প্রাণ-পুরুষ-ভ্যান গঘ এর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা …

“ছবি এঁকে কিছু বলতে চাই আমি, আর তাতেই সঙ্গীত যেমন সান্ত্বনা দেয় তেমনি সান্ত্বনা পাবো” – বলেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ- পৃথিবীর মহান শিল্পীদের একজন। জন্মেছিলেন হল্যান্ডে ১৮৫৩ সালে আজকের দিনেই। সেজান, গঁগা এবং ভ্যান গঘ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্কর এই তিন শিল্পীই আধুনিক শিল্পের পূর্বসূরী হিসেবে চিহ্নিত। সাতাশ বছর বয়সে শিল্পকর্মে নিবেদিত হয়েছিলেন ভ্যান গঘ। অতীত এবং সমকালীন শিল্প সাহিত্য জগত সম্বন্ধে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের এর প্রচুর জ্ঞান ছিলো; নিজের মননে সব কিছুর সম্মেলন ঘটিয়ে শিল্প জগতে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন।

“কখনো কখনো অনির্বচনীয় অনেক কিছু থাকে, সমস্ত প্রকৃতিটা যেন মনে হয় কথা বলতে চায়; এ জিনিসটা সবাই দেখতে পায় না, অনুভব করতে পারেনা। যার চোখ আছে, কান আছে, হৃদয় আছে তার জন্যেই ঈশ্বর এ সৌন্দর্য করে রেখেছেন। এ কারণেই আমার মনে হয় একজন শিল্পী সুখী, সে যা দেখে তার একটুখানিও প্রকাশ করতে পারলে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যায়।

আমি আমার কাজের মধ্যে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছি যার ভেতর আমার হৃদয় ও আত্মা সম্পূর্ণ দিয়ে নিবেদিত থাকতে পারি এবং যা আমার বেঁচে থাকা অর্থময় করে, অনুপ্রাণিত করে।” (ছোট ভাই ও জীবনের একমাত্র সহযোগী থিও-কে লেখা চিঠির অংশ বিশেষ )

ভ্যান গঘ সম্বন্ধে বলা হয় … His paintings are characterized by thick brush strokes, brilliant colors, and jagged lines, through which Van Gogh expressed his emotional response to his subjects rather than providing an accurate description of them. As a result he became a leader in the development of expressionism in painting.

বেলজিয়ামে গিয়ে এন্টর্প একাডেমিতে ভর্তি হন পদ্ধতিগতভাবে ছবি আঁকার নিয়ম-কানুন শিখতে। কিন্তু নিয়মে বেঁধে থাকা তাঁর পক্ষে ছিল অসহনীয়। ফলে ফার্স্ট টার্ম শেষ হওয়ার আগেই আর্ট একাডেমি ছাড়লেন।

ভ্যান গঘ তার জন্মের সময়ই মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছিলেন। তীব্র মানসিক অস্থিরতার ফলে প্রায় উম্মাদ দশা হয় তাঁর। সেন্ট রেমি-র এক মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হন কিন্তু থেমে থাকেনি শিল্পচর্চা। মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে বসে-ও ২০০ ক্যানভাস আঁকেন !!!

প্যারিসে এসে ফানার্ড করমনের স্টুডিওতে কাজ করতে শুরু করেন। এসময় বন্ধু পল গঁগ্যার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পরেন এবং এক ব্যাক্তিগত কারণে তিনি নিজের এক কান কেটে নেন। এ ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন গঘ। রক্তাল্পতা এবং হ্যালুসিনেসনে ভুগতে থাকেন। আর্লেসের হাসপাতালে দু’সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে ঘরে ফিরে অবিরাম ছবি আঁকতে থাকেন অদ্ভূত উন্মাদের মতো।

এক পর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত গঘকে ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে আর্লেস থেকে বিতাড়িত করে নগর কর্তৃপক্ষ। গঘ নিজেই গিয়ে ভর্তি হন সেন্ট রেমি’র মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে সুস্থ না হয়ে বরং বিষণ্নতায় ভুগে ভুগে পূর্ণ পাগলই হয়ে যান গঘ। এতো অসুস্থতার মধ্যেও বন্ধ করেননি ছবি আঁকা। মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে বসেও ২০০ ক্যানভাস ছবি আঁকেন। ছোট ভাই থিও তাঁকে নিয়ে এলেন প্যারিসে। কিন্তু কিছুদিন পরই গঘ চলে গেলেন অভঁরো। ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে নিজের বুকে গুলি করে শুয়ে থাকলেন আর ঐ অবস্থাতেও খালি পাইপ টেনে গেলেন। ধীরে ধীরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন পৃথিবীর দুঃখীতম এই চিত্রকর। তখন তার বয়স মাত্র ৩৭ বছর।

সেজান, গঁগা আর গঘ … স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এই তিন শিল্পীই আধুনিক চিত্রশিল্পের পূর্বসূরী হিসেবে চিহ্নিত … সাতাশ বছর বয়সে শিল্পকর্মে নিবেদিত হয়েছিলেন ভ্যান গগ … শিল্পী জীবন পেয়েছিলেন মাত্র ১০ বছরের … অতীত এবং সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য জগত সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান ছিলো তাঁর নিজের মননের সাথে সব কিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে শিল্প জগতে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। বন্ধুহীন, নিঃস্ব আর দূর্ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবন কাটালেও সমকালীন চিত্রকলায় তাকেই মনে করা হয় সবচেয়ে সার্থক শিল্পী হিসেবে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দামী ১০ টি চিত্রকর্মের মধ্যে একক ভাবে তাঁরই অঙ্কিত রয়েছে ৪ টি!

সৈয়দ আলী আহসান জীবন ও কর্ম

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম সৈয়দ আলী আহসান। জাতীয় অধ্যাপকে ভূষিত সৈয়দ আলী আহসান একাধারে কবি, শিক্ষাবিদ, সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক, বুদ্ধিজীবী, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক ও অনুবাদক ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই গুণীজন ১৯২২সালের ২৬শে মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার আরমানিটোলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কবি সৈয়দ আলী আহসান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ছিলেন এবং সে সময় তিনি ‘চেনাকণ্ঠ’ ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।

সৈয়দ আলী আহসান কর্ম জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, করাচি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় এর ভিসি ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। কবি সৈয়দ আলী আহসান নোবেল সাহিত্য কমিটির ও বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।

তিনি শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, অনুবাদ সাহিত্য, সাহিত্য সমালোচনা, আত্মজীবনী, সাহিত্যের ইতিহাস ও ইসলাম সম্পর্কিত বইসহ শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে- অনেক আকাশ, একক সন্ধ্যায় বসন্ত, সহসা সচকিত, কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, স্রােতবাহী নদী, যখন সময় এলো, রবীন্দ্র কাব্য পাঠ, পদ্মাবতী, আল্লাহ আমার প্রভু, মহানবী, শিল্পবোধ ও শিল্প চৈতন্য, চর্যাগীতিকা, আমার পছন্দ দেশ-বিদেশের রান্না, আমেরিকা আমার কিছু কথা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ইত্যাদি। সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা আমরা পড়ি না, যেন কেবল কিছু শব্দের আওয়াজ শুনি, তন্ময় হয়ে শুনি আর অনুভব করি সমগ্র সত্তা দিয়ে, কবি যখন এভাবে বলেন :

আমার পূর্ব বাঙলা বর্ষার অন্ধকারের
অনুরাগ
শরীর ছুঁয়ে যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক লতায় ঘেরা
কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভূতি নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে
অনেক মেঘের পালক
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
যেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ
কত দশা বিরহিনীর-এক দুই তিন

উচ্চারণ কাব্যগ্রন্থের ৩৪ নম্বর কবিতাটি পাঠক লক্ষ করুন:
তোমাকে আমার শস্যক্ষেত্র
করবো ভেবেছিলাম
যেখানে প্রথম মানুষের
আনন্দকে বপন করবো
আমার দেহের উজ্জ্বল হাসিতে
তোমার শস্যভূমি নাচবে।
তোমার সুগন্ধ কেশ থেকে
সূর্যকণা ঝরে পড়তো।
কিন্তু কেন তুমি হঠাৎ ছায়া ফেলবে?
এবং আমাকে
মৃতদেহের মতো বরফের পাথর করলে?
এরপর তুমি যখন
আমার সন্ধান করবে,
তখন আমার কবরের মধ্যে
মাথা রাখবার জন্য
একটি শুকনো হাড় পাবে,
যা একদিন আমার বাহু ছিলো।

সৈয়দ আলী আহসান মানুষ ও তার জীবনকে দেখেছেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম চোখে। তার চোখ বড় তীক্ষণ, যা সহজেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ফুঁড়ে অনন্তে পৌঁছে যায়।
জীবনকে পাঠ করেছেন তিনি নানা আলোয়, নানা আঙ্গিনায়, যে কারণে জীবন ও জগতের ঘটে যাওয়া নানা ট্র্যাজেডিও তার কবিতায় শিল্পের আকার ধারণ করে।

তার সফল কবিতাগুলোর একটি সমুদ্রেই যাবো কাব্যগ্রন্থের ‘উরিরচর’। কবি যখন এভাবে বলেন:

রাত্রিতে হারিকেন জ্বালিয়ে তারা শুয়েছিলো
শোবার আগে হেসেছিল এবং প্রদীপের শিখা
বাতাসের গান স্মরণ করেছিলো। কি করে
অন্ধকার হতে হয় রাত্রি তা জানতো এবং
বনভূমি জানতো কি করে রহস্যময় হতে হয়।
এবং ঘুমুতে যাবার আগে মানুষগুলো জানতো
কি করে গায়ে চাদর টেনে দিতে হয়।

কবি সৈয়দ আলী আহসান সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। এই খ্যাতিমান সাহিত্যিক ২০০২ সালের ২৫শে জুলাই ইন্তেকাল করেন।

ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমানের জীবন ও কর্ম

জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯৪১
মৃত্যু ০২ মার্চ ২০১৯
প্রফেসর ডক্টর এস. এম. লুৎফর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন একজন মৌলিক চিন্তাবিদ, ভাষাবিদ, লিপিতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, কবি ও কলামিস্ট হিসেবে আদৃত, স্বীকৃত ও সুপরিচিত। চিকিৎসাবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য ননটেকনিক্যাল বিষয়েও তাঁর নিবন্ধাদি সুধীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় তিনি একালের সেরা বাংলাভাষা গবেষক হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর গবেষণাকর্ম সূর্যের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে অনুসন্ধিৎসুদের মাঝে।

জনাব রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে শিক্ষাজীবনে শুরুতে তিনি পিতার প্রতিষ্ঠা করা ‘খাটর রামানন্দকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ অধ্যায়ন করেন। এখানে শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর তাঁকে ‘পুলুম প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ ভর্তি করা হয়। ১৯৫৯ সালে পুলুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যট্রিক পাশ করেন। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং একই কলেজ হতে বি এ (পাশ) সার্টিফিকেট অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন এবং ২য় পর্বে ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। এবং পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে তিন বহু পদ অলংকরণ করেন : প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক, নজরুল অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মজীবনে তিনি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী, হিন্দী, অহমিয়া প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শীতা অর্জন করেন।

জনাব রহমান গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন ১৫টি। গবেষণাধর্মী নিবন্ধ লিখেছেন দেড়শতাধিক। উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হল: আধুনিককালের কবি ও কবিতা, দৌলৎপুরে নজরুল, ধূমকেতু ও তার সমাধি, মেসোপটেমিয়ায় নজরুল, ভৌগোলিক পরিবেশ ও দৈহিক নৃবিজ্ঞান, বাঙালা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস, বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস (৩ খন্ড), লালন-জিজ্ঞাসা, বাউল তত্ত্ব ও বাউল গান, লালনগীতি চয়ন, লালন শাহ: জীবন ও গান, বাঙালা ভাষা ও বানানের ঐতিহাসিক বিপর্যয়: উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, বাংলাদেশী কথা-সাহিত্যের তিন আমল, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে, বাংলাদেশী জারীগান, বৌদ্ধ চর্যাপদ, দুদ্দু শাহ, বাংলাদেশী লোক-চিকিৎসা ইত্যাদি।

জনাব রহমান ১৯৬৪ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ লেখা ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় দুটোতেই প্রথম পুরস্কার পান। ১৯৬৫ সালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেরা নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কাউন্সিল কর্তৃক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে ‘আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও উন্নয়ন বিষয়ে মৌলিক গবেষণায় অবদানের জন্য ‘জাতীয় লেখক ফোরাম’, ঢাকা কর্তৃক ‘নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ জাতীয় পুরস্কার-২০০৮’-এ ভূষিত হন। দি আমেরিকান বায়োলজিক্যাল ইন্সটিটিউট, নর্থ ক্যারোলিনা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার-১৯৯৭’ নির্বাচিত হন।

এছাড়া জনাব লুৎফর রহমান বাংলা পাণ্ডুলিপি, ইন্দো-ইউরোপীয় আদি ভাষা এর বিশ্ব-ভাষা প্রকল্প এবং মূল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎস বিষয়ে নতুনভাবে আলোকপাত করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি তিনি রেডিও টিভি সহ বিভিন্ন সাময়িকী এবং বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বিবিধ অবদান রেখেছেন সফলতার সঙ্গে। এই গুণী ব্যক্তিত্বের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।