বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

মা বাবা


আমার বাবা-মা এর রেখে যাওয়া আমি।

আমার পিতার কথা লিখতে গেলে এক পুথি বা রামায়ণ হয়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
কি নিয়ে লিখব আর কি লিখব না সে কথা ভাবতেই পারছি না। কোথা থেকে শুরু করব তাও বুঝতে পারছি না। যাকে পিতা বলে জেনে এসেছি তাকে যে কোন শ্রেণীর মানুষ হিসেবে ফেলা যায় তাই আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। কখনও ভেবেছি তিনি অতি উদার ও মহৎ শ্রেণীর আবার কখনও মনে হয়েছে তিনি অতি রাগি এবং মেজাজি মানুষ। আবার কখনও যে তাকে ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির মনে হয়নি তেমন করেও ভাবার সুযোগ হয়নি। কখনও মনে হয়েছে বাবা খুব অস্থির এবং ছটফটে মেজাজের মানুষ। তবে তিনি যে ধরনের মানুষই হোক না কেন তিনি যে একজন সফল পিতা তাতে কোন সন্দেহ নেই। সফল বলেই হয়ত তার সন্তানেরা আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং বেশ সুনাম ও মর্যাদার সাথেই রয়েছে। তার মেঝ ছেলে বিলাতের নেইলসওয়ার্থের ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলর এবং অবাক হতে হয় যে সেখানে বাংলাদেশী তো দূরের কথা এশিয়ান বলতে মাত্র তিন ঘর বাসিন্দা। এই ইংরেজ অধ্যুষিত এলাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে বেশ সুনাম ও দক্ষতার সাথে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ করেছে।

ছোট বেলায় মার্টিন রোড এলাকায় যখন আমরা থাকতাম তখন আমার বাবাকে ভলি বল খেলতে দেখেছি এবং এখনও মনে পড়ে ওই এক বিকেলে আমার মা কি যেন বানিয়েছিল আর আমি তাই হাতে নিয়ে খেতে খেতে বাসার বাইরে আব্বার খেলা দেখার জন্য কোটের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম আর তাই আব্বার নজরে এলে তিনি খেলা রেখে আমাকে চিলের মত ধরে উঁচু করে বাসায় আমার মার কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। বাইরে কিছু খেতে হয় না একথা আমার মাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরে এ নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ হৈ চৈ করেছিলেন। সেই সাথে আমার মনেও ওই কথাটা এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে আজ আমিও আমার মেয়েদের সেই শিক্ষা দিতে পেরেছি। যদিও সে শিক্ষা এখন আমি রাখতে পারছিনা। বিলাতে থাকার সময় ওদের দেখা দেখি এবং সময়ের মূল্য দিতে গিয়ে হাটতে হাটতে বাগেট বা পিজা বা কেক খেতে খেতে বাস স্ট্যান্ড কিংবা টিউব স্টেশনে গিয়েছি।
আমার পিতাকে কিছু কিছু বাজার করতে দেখেছি সরাসরি আড়ত থেকে। যেমন সবজি, আলু পিয়াজ এই সব বাজার তিনি সপ্তাহ বা কোন ক্ষেত্রে মাসের জন্য এমনকি পুরো বছরের জন্য করে রাখতেন। যে কোন ফলের সিজনে কোন ফল তাকে সের দরে কিনতে দেখিনি, আঙ্গুর, আপেল, আম এবং পেশোয়ায় কাবুল তেহরানে উৎপন্ন নানান জাতের সুস্বাদু ফলমূল তিনি ও দেশের প্রচলিত খেজুর পাতার আস্ত ঝুরি ধরেই কিনতেন এবং বাড়িতে আনার পর আমার মা সেগুলিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে নিপুণ হাতে সুন্দর করা সাজিয়ে রাখতেন। আমার মা বাবার সন্তান বলতে গেলে তখন একমাত্র আমিই ছিলাম সবে ধন নীলমণি কাজেই সঙ্গত কারণে আমাকেই ওই সব ফল নামের যন্ত্রণা গিলতে হতো। যদিও আজ ভাবি ইসসস তখন কি আর জানতাম এই সব ফল ফলাদিগুলোকে এক সময় আমাদের দেশে ভিসা নিয়ে যেতে হবে!

আমরা যখন আবিসিনিয়া লাইনে থাকতাম ওই এলাকার কাছেই ছিল করাচী শহরের কসাই খানা। প্রতিদিন দেখতাম শত শত গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা আর ছাগল নিয়ে কসাই খানায় যেত আর ওখানে ওগুলি জবাই হয়ে ড্রেসিং হয়ে পৌরসভার সিল লাগিয়ে ভ্যানে করে সমস্ত করাচী শহরে সেগুলি পৌঁছে দিত। সে কি বিশাল কসাই খানা! আমরা বন্ধুরা মিলে মাঝে মাঝেই ঐ কসাই খানা দেখতে যেতাম আর পাঠান দারোয়ান আমাদের ভিতরে যেতে দিতে চাইত না। বলত রক্ত দেখে তোমরা ভয় পাবে। আমরা বলতাম আমরা কি আর তোমার মত ভয়ের ডিপো? আমরা কিছুতেই ভয় পাই না। তাই নাকি? হ্যাঁ, দেখনা আমরা বড় হয়ে গেছি! পাঠান ব্যাটা একটু হেসে আর একজনকে বলে দিত এই ওদের নিয়ে একটু দেখিয়ে আন। সত্যিই কি বীভৎস সে দৃশ্য! বিশেষ কায়দার এতো বড় বড় শিং ওয়ালা গরু মহিষগুলো বিশাল মুছ ওয়ালা দুই জন কসাই ধরে বেল্টের উপর ফেলে বিশাল ছুরি দিয়ে জবাই করে ফেলত। পাশে দেড় ফুট গভীরতার নর্দমা দিয়ে কল কল শব্দ করে রক্তের স্রোত বয়ে যেত। জবাই হয়ে গেলে বেল্ট টেনে নিয়ে যেত চামড়া ছাড়াবার জন্য। একের পরে চলছে এভাবে। ওদিকে চামড়া ছাড়ানো হয়ে গেলে আবার মেশিনে ওগুলো ড্রেসিং হয়ে পাতলা কাপড়ে ঢেকে কভার্ড ভ্যানের হুকে ঝুলিয়ে রাখত। এলাহি কাণ্ড। এখন সেই দৃশ্য মনে ভয়ই করে। আমার বাবা এখান থেকে প্রায়ই একটা রান কিংবা মাথা কিংবা তার পছন্দ মত কোন বড় এক টুকরা নিয়ে গেয়ে নিজেই ছোট ছোট টুকরা করে কেটে কুটে বানিয়ে আমার মার হাতে দিতেন আর মা সেগুলি খুব যত্ন করে কিছু রেখে দিতেন আবার কিছু তখনই রান্না করতেন যেদিন এমন কিছু রান্না হতো সেদিন আমার মা আটা মাখিয়ে একটা থালায় নিয়ে মার হাতে বানান সুন্দর কাপড়ের তৈরি ঢাকনা দিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলতেন যা ওই দোকান থেকে রুটি বানিয় নিয়ে আয়। ও দেশে সবাই রুটি খায় বলে রুটি বানাবার দোকান আছে যারা শুধু রু|টি বানিয়ে দেয়। তন্দুরের রুটি। এই দোকানে দেয়ার জন্য আটা মাখাবার ভিন্ন কৌশল আছে। আমার মনে আছে আমার মা বাংলাদেশি বলে ওই কৌশল তার জানা ছিল না তাই দোকানদার আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল আর তাই আমার থালা নিয়ে ঢাকনা খুলে বলে দিয়েছিল এটা নিয়ে বাসায় যাও আর তোমার মাকে বল এ ভাবে আটা মেখে দিতে। ঘরে ফিরিয়ে এনে মাকে বললাম। মা তাদের দেখান কৌশলে আবার আটা মেখে দিলে নিয়ে গেলাম। দোকানি তন্দুরের রুটি বানিয়ে দিল। বাসায় এসে সেই কসাই খানা থেকে আনা মাংস রান্না দিয়ে বাবা আমি আর মা কি মজা করে খেয়েছি। আমি নাকি ওদের দেখাদেখি আলু পরটা, মুলা পরটা, মেথি শাক খেতে শিখছিলাম। মার কাছে শুনেছি।

এখনও স্পষ্ট মনে আছে ছোট বেলায় তখন আমরা ফেডারেল এরিয়ায় থাকতাম। দেখেছি বাবা অফিসে যাবার পোশাক পরে বের হতেন আর মা দরজাটা বন্ধ করে তিনতলা বাসার বারান্দায় এসে আমাকে ধরে দাঁড়াতেন। বাবা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডান দিকের রাস্তায় যেখানে বাসের অন্যান্য যাত্রীরা কিউতে দাঁড়াত সেখানে গিয়ে কিউতে দাঁড়াতেন। মা আমাকে দেখিয়ে দিতেন ওই যে দেখ তোমার বাবা। আমি এবং মা বাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম বাবা এক সময় পিছনে ফিরে দেখে কিউতে দাঁড়াতেন। এই দিন গুলির কথা একটু একটু ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। সম্ভবত এর মধ্যে আরও কিছু বড় হয়েছি তখন ওই তিন তলার বাসার এলাকায় থাকতাম না। সে দিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন বেশ হাটতে পারি। বাবা আমাকে নিয়ে মার্টিন রোড নামে এক আবাসিক এলাকায় এলেন বাসা দেখার জন্য। আগের ওখানে সব দিক দিয়েই ভাল ছিল। খোলা মেলা এলাকা তিন তলা সব দালান। বেশ ফাঁকা এলাকা কিন্তু বাবার অফিস অনেক দূর হয়ে যায় বলে এই মার্টিন রোড এলাকায় বাসা দেখতে এসেছেন।
ছোট বেলার একটা কথা আমার সবসময় মনে পড়ে। বাবার কথা বলতে হলে এই কথাটি সবসময় মনে হয়। করাচী শহর সমুদ্রের পাড়ে হলেও এখানে ভীষণ শীত। একদিন এমনি এক শীতের সন্ধ্যায় আমার বয়সী এক বিকলাঙ্গ ছেলে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভিক্ষা করছে। ছেলেটি আমাদের বাসায় নক করলে বাবাই দরজা খুলে দেয় এবং ছেলেটিকে এভাবে কাঁপতে দেখে ওকে বাসার ভিতর নিয়ে এসে চুলায় আগুন জ্বেলে ওকে আগে গরম করে নিয়ে আমার মাকে বলে দুধ গরম করিয়ে ওকে খাইয়ে তারপরে আমার মায়ের বানানো নতুন কফি কালারের ফুল হাতা সোয়েটারটা আমার গায়ে থেকে খুলে ওকে দিয়েছিল। লক্ষ করে দেখেছি আমার মেয়েগুলি হয়েছে এমন। ওরা প্রচণ্ড গরমে বা শীতে যে রিকশায় করে বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরে সেই রিকশা চালককে আগে বাড়ীতে পৌঁছে কিছু খাইয়ে নেয় হাতের কাছে থাকলে কাপড় চোপর কিছু দিয়েও দেয় আবার ভাড়া দেয়ার সময় কিছু বেশিই দিয়ে দেয়। দেখি আর ভাবি জেনেটিক ধারা বোধ হয় একেই বলে।
বড় হবার পর যেদিন আমাকে আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেখে আসেন সেদিন বাবার এই আশ্চর্য চেহারা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা চাননি আমি এই সময়ে কাজ শুরু করি কিন্তু তখনকার দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির কারণে নিরুপায় বাবা এই ব্যবস্থা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিলেন এবং তাতে কতটা ব্যথা পেয়েছিলেন সে দেখলাম যখন তিনি আমাকে রেখে ফিরে আসছিলেন। যে বাবাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি সেই বাবার চোখ দিয়ে টল টল করে পানি ঝরছিল এবং সে চোখের পানি আমার চোখে ধরা পরার ভয়ে তিনি ঘুরে দাড়িয়ে কিছু না বলে সামনের দিকে হাটা সুরু করেছিলেন। ছোট বেলায় জ্বর হলে দেখেছি সারা রাত জেগে পাশে বসে থেকে আবার সকালে যথারীতি অফিসে চলে যেতেন। একটু বিশ্রাম নিতে দেখিনি। তখন ভাবতাম আমাকে এভাবে রেখে বাবা কেন অফিসে যায়? ছোট বেলায় আমি প্রায়ই নানান অসুখে ভুগতাম আর হেটে যেতে পারব না বলে বাবা আমাকে কোলে নিয়েই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন।

ঈদের সময় মনে আছে অফিস থেকে ফিরে রোজা রেখে আমাদের জামা ক্লথ মার্কেটে নিয়ে যেতেন। নিজের পছন্দ মত পোশাকের কাপর, খেলনা নানা কিছু কিনে দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন দেখ তোমার কোনটা পছন্দ হয়। মা আবার সেই কাপড় কেটে নিজেই জামা প্যান্ট সেলাই করে দিতেন। ঈদের দিন আবার নিজের ইচ্ছে মত খরচ করার জন্য নামাজ পড়ে এসে কিছু টাকাও দিতেন। দেয়ার আগে জিজ্ঞেস করতেন কত দিতে হবে। তখন যদিও টাকার হিসাব বুঝতাম না বলে কিছু বলতাম না। আমার একটা নেশা ছিল কলম হারাবার। এখনকার মত তখন পাঁচ টাকায় কলম পাওয়া যেত না বা সস্তা কলমও বাবা কিনতেন না কিন্তু আমি আমার নিয়ম অনুযায়ী একদিনের বেশি সে কলম রাখতে পারতাম না হারিয়ে ফেলতাম। একবার আমার জন্য, মায়ের জন্য এবং তার নিজের জন্য একসাথে তিনটা খুব সুন্দর কলম এনেছিলেন এবং বন্ধুদের দেখাবার জন্য বিকেলে খেলতে যাবার সময় ওই তিনটা কলমই এক সাথে পকেটে নিয়ে গিয়েছিলেম এবং ফলাফল গতানুগতিক। হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাসায় ফিরে আসার পর বাবা কিছুই বললেন না দেখে অবাক হলাম বাবা কিছুই বল না? একটু নয় বেশ অবাক হয়ে কিছুতেই বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না। কয়েক দিন পরে মাকে সে কথা জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আম্মা আমি যে সেদিন কলম হারিয়ে ফেললাম আব্বা যে কিছু বলল না! মা বললেন তুমি যে হারাওনি তাতেই তোমার বাবা খুশি তাই কিছু বলেনি। তেমনি করে আমার মেয়েরাও যখন ছোট বেলায় কিছু হারিয়ে ফেলত বা ভেঙ্গে ফেলত তখন ওরা অনুতপ্ত হয়ে কেঁদে ফেলত আর আমি ওদের কোলে নিয়ে বা বুকে টেনে নিয়ে বলতাম কি হয়েছে মা এতে কাঁদতে নেই তুমি যে ভাল আছ এই আমার জন্য যথেষ্ট। বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান পরীক্ষা খারাপ দিয়েছিল আর সেদিন আমি ওর এই পরীক্ষা খারাপ হবার জন্য আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলাম যাতে সে মন খারাপ করে পরের পরীক্ষা খারাপ না করে। সেই বাবাকে বড় হয়ে বিদেশ থেকে অন্যান্য জিনিসের সাথে একটা ছাতা এনে দিয়েছিলাম আর তিনি সে ছাতা হারিয়ে এসে খুব বিষণ্ণ মনে মাকে জানিয়েছিল সে ঘটনা। আমি যে ছেলের ছাতা হারিয়ে আসলাম! ও যখন জানতে চাইবে তখন কি বলব? শুনে আমার ছোট বেলার সেই সব দিনের কথা মনে হলো যখন আমি এক সাথে তিন কলম হারালেও বাবা কিছু বলেনি। আমি বলেছিলাম কি হয়েছে তাতে একটা ছাতা হারিয়েছেন আমি দশটা ছাতা কিনে দেব। আপনার চেষ্টায় আপনাদের দোয়ার বলেই আমি এই যোগ্যতা অর্জন করেছি আর আমার বাবার চেয়ে কি একটা ছাতার দাম বেশী হয়ে গেল? কথাটা সুনে আমার মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বলেছিলেন এইতো একেবারে বাবার মত কথা বলতে শিখেছে আমার বাবা! বাবা মায়ের এই দোয়া কি বিফলে যেতে পারে?

হজে যাবার আগে ভিসার আবেদন করার সময়ে নেয়া ছবি। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা মায়ের দুটি ভিন্ন ছবিকে একত্রে এনলার্জ করে বাঁধান ছবি থেকে নেয়া ছবি। এমন দেয়ার মত ছবি নেই যা আছে সে স্ক্যান করা ছাড়া দেয়া যাবে না।
আমি তখন দেশে চাকরি করি। একবার বাসার স্প্রিং ও রেক্সিনের সোফা মেরামত করালাম বেশ দামি রেক্সিন দিয়ে। সরকারি চাকরি জীবীদের হিসেবে বেশ অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। যেদিন মেরামত শেষ হলো সেদিন মিস্ত্রিরা কাজ শেষ করে বলল দেখেন স্যার আমাদের কাজ শেষ এখন আমাদের বিদায় দেন। ওদের প্রাপ্য টাকা গুনে দিলাম ওরা সিরি দিয়ে নেমে চলে গেল। ভাবলাম দেখি কেমন হলো। ভিতরে এসে দেখি একটা সিঙ্গেল সোফার সিটের মাঝ খানে অনেক খানি কাটা। দেখেই আমার প্রাণ শুদ্ধ চমকে উঠল। কি ব্যাপার নতুন মেরামত করা সোফা এমন হলো কি করে? ভাবছি এমন সময় রুমের বাইরের বারান্দায় শুনলাম খচ খচ শব্দ হচ্ছে। দরজা দিয়ে দেখলাম ছোট মেয়ে কি করছে। আব্বু বলতো সোফাটা এমন হলো কি করে? আব্বু তুমি জান না ওটা আমি করেছি!
কেন?
দেখলাম কাটে নাকি!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
মেয়ে বলে কি? কেন কাটলে?
দেখলাম কাটে না কি!
কি দিয়ে কেটেছ?
ব্লেড দিয়ে!
অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়েই রইলাম। কিছুই বললাম না। ভাবলাম ও সত্যি কথা বলেছে এবং সত্যি বলার সাহস ওর আছে। কাজেই একে কিছুই বলা সঙ্গত হবে না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম কাজটা কি ভাল করেছ?
না আব্বু, আমি ভাবতে পারিনি যে ওটা কেটে যাবে!
এই মেয়েকে কি কিছু বলা যায়? রেক্সিনের টুকরো দিয়ে আঠা লাগিয়ে ওটা মেরামত করে নিলাম। আমার বাবাও আমাদের এমন কোন কাণ্ড ঘটলেও কিছু বলতেন না। তাই আমিও ওকে কিছু বলতে পারলাম না।

আবিসিনিয়া লাইনের বাসর ভিতরে বাগানে একটা বিশাল সজনে গাছ ছিল বারান্দায় খেতে বসলে ওই গাছের ছায়া পরত। গাছের ডালে নানা জাতের পাখি এসে বসত দেখতে খুব ভাল লাগত। খেতে বসলে আমি অনেক হাঙ্গামা করতাম কিছুতেই খেতে চাইতাম না। খাবার প্রতি আমার খুবই অনীহা ছিল। আমি এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত মায়ের রান্না ছাড়া কারও রান্না খেতে চাইতাম না। যাই হোক যা বলছিলাম মা প্লেটে যা দিতেন তার থেকে একটু খেয়েই রেখে উঠে যেতাম, আর ভাল লাগছে না মা আর খাব না। বাবা তখন প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে বলতেই দেখি কি ভাল লাগে না! আমার কাছে আস, দেখত ঐ ডালে কি সুন্দর পাখি বসেছে! যেই পাখির দিকে তাকাতাম আর অমনি বাবা তার প্লেট থেকে কিছু মাখান ভাত আমার প্লেটে দিয়ে বলতেন ঠিক আছে খেতে না চাইলে খেয়ো না কিন্তু এই যতটা ভাত মাখিয়েছ সেটুক খেয়ে ফেল। আচ্ছা খাচ্ছি। এই করতে করতে দেখতাম আমার প্লেটের ভাত শেষ হচ্ছে না। তখন মা বাবা দুইজনের হাসি দেখে অনুমান করতাম কোন চালাকি হয়েছে কিন্তু কি হয়েছে তখন বুঝতাম না। পরে একদিন আব্বা যেদিন ধরা পরে গেলেন সেদিন বুঝলাম।

ঈদের দিন সকালে মা গোসলের পানি গরম করে দিলে বাবা আমার সব ভাই বোনদের একে একে গোসল করিয়ে দিতেন। সে প্রক্রিয়া রীতি আমার মেয়েদের বেলায় আমিও করেছি। তখন বাবার কথা মনে হতো। আবার এমন অনেক কাজ যা তিনি আমার জন্য করেছেন আমিও আমার সন্তানদের জন্য তেমন করেই করার চেষ্টা করেছি। এইতো সেদিন ৬ই জুন তারিখে বাবাকে এগিয়ে আনার জন্য এয়ারপোর্ট গেলাম। এয়ারপোর্টে ১ নম্বর টার্মিনালে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এই এয়ারপোর্টে আমার বাবা এক সময় আমাকে রিসিভ করার জন্য আসতেন আর তাকে নেয়ার জন্য আজ আমি এসেছি আমার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে। আমার বাবা ইংল্যান্ড আর কানাডায় তার সফল ছেলেদের কাছে থেকে আসলেন প্রায় এক বছর। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল কি ভাবছ? তখন তাকে বললাম সেই যেবার গ্রিস হয়ে এসেছিলাম তখন বিমানের ফ্লাইট দুই দিন দেরি করে এসেছিল এবং আমি কোন ভাবেই বাসায় জানাতে পারছিলাম না ফ্লাইট কখন পৌঁছাবে। কাজেই আমার বাবা বিমানের প্রতিটা ফ্লাইটে এসে এয়ারপোর্ট থেকে বিমানের প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখে ফিরে ফিরে গেছে। আর আজকে আমার বাবার একটু দেরি হচ্ছিল বলে আমার কেমন বিরক্ত লাগছে। যদিও মেয়েকে ভিতরে পাঠিয়ে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। একটু পরে পরেই মেয়ে মোবাইলে খবর দিচ্ছিল না আব্বু দাদাকে দেখছিনা ওদিকে ভিড় কমে আসছে। শেষ পর্যন্ত একসময় দেখলাম হুইল চেয়ারে করে আমার মেয়ে তার দাদাকে নিয়ে বেরিয়ে আসছে।

আমার বইটি যখন প্রকাশ হয় তখন তিনি কানাডার টরন্টোতে ছিলেন। ওখানে আমার ছোট ভাইয়ের বৌ সোহানা তার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিল “আব্বা দাদার বই বের হয়েছে আজ, এ কথা জেনে আপনার কেমন লাগছে?” ” কেমন লাগবে ছেলের বই প্রকাশ হলে কোন বাবার ভাল না লাগে বল!” ওখানে থাকতে আমার ব্লগে লেখা কিছু কিছু গল্প সোহানা এবং লন্ডনের সেঝ ভাইয়ের বৌ সোমা পড়ে শোনাত এবং সেগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। দেশে ফিরে আসার পর বইটা বাবার হাতে দিয়ে একটা আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করলেম যে যে বাবাকে কেবল মাত্র ধর্মীয় বই ব্যতীত ভিন্ন কোন বই পড়তে দেখিনি সেই তিনি তার ছেলের বইটি দুই দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেললেন! তার পাঠ প্রতিক্রিয়া বুঝলাম ‘ আর কিছু লিখেছিস? হ্যাঁ আব্বা লিখেছি এবং লিখছি, এখন এটাই আমার একমাত্র নেশা। সামনে কি আর কোন বই প্রকাশ হবে? সবাই বই প্রকাশ করলে সাধারনত দেখা যায় সাহিত্য অঙ্গনে কোন নামি ব্যাক্তিত্ব বা কোন মহাজন কিংবা কোন মন্ত্রি-নেতাদের দিয়ে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করে কিন্তু আমি করেছি আমার বাবা আর স্ত্রীকে দিয়ে (তখন আমার মা জীবিত ছিলেননা)। স্ত্রীকে করিয়েছি এইওজন্য যে, সে আমাকে লেখার ব্যাপারে সকল রকমের সহযোগিতা না করলে আমি কোনদিনই কিছু লিখতে পারতামনা। লেখার সময় সে কোনদিনই কোন কাজের কথা বলেনি দরকার হলে সে নিজে বাজারে গিয়ে বাজার করে এনেছে কিন্তু আমাকে বিরক্ত করেনি।

এই বাবাকে নিয়ে লিখলে অনেক লিখা যায় কিন্তু বাবার কথা কি আর এমন পরিসরে লিখা যায়? বাবার ভাল মন্দ কত কি আছে কত কি নিয়ে একজন মানুষ বাবা হয়। একজন মানুষ মন্দ হলেই যে সে মন্দ বাবা হবে এমন কেউ বলতে পারে কি? এক জন মন্দ স্বামী হতে পারে, মন্দ মানুষ হতে পারে কিন্তু কক্ষনো মন্দ বাবা হতে পারবে না! আজ নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারছি একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতখানি ত্যাগ আর পরিশ্রম করেন। আমি যেদিন বাবা হলাম সেদিন আমি দেশ থেকে অনেক দূরে। প্রায় একমাস পরে বাবা হবার খবরটা জানতে পেরে মনে হচ্ছিল তক্ষুনি ছুটে আসি, মনে হচ্ছিল আমার কেন এক জোড়া পাখনা নেই, কেন আমি আজ উড়ে যেতে পারছি না? কেন আমার এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমার প্রথম সন্তানকে দেখতে পারছি না? যেদিন দেশে ফিরে এসেছি পরে আমার সন্তানের মা পাশে বসে তাকে আমার কোলে তুলে দিল তখন মেয়ে একবার ওর মায়ের দিকে আবার আমার দিকে দেখছিল তখনই বুঝলাম এই ছয় মাসের শিশু বুঝতে পেরেছে সে তার কোন ঘনিষ্ঠ একজনের কোলে এসেছে। একটুও কাঁদেনই, বা আমার কাছে থাকতে একটুও আপত্তি করেনি। মায়ের কোলে যেমন ছিল তেমনি বাবার কোলে শুয়ে রইল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমরা কেবল মায়ের কথাই ভাবি কিন্তু বাবার অবদান যে কতখানি সে কেবল একজন বাবাই বুঝে। আমার মনে হয় মা কিংবা বাবা কেউ কিছুতে কম না। সারা দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও যে মহিলা তার স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ি বা এই বাড়ির আর কারো মন জোগাতে পারেনি শুধু পেয়েছে অবহেলা, অবজ্ঞা আর নির্যাতন সেই মহিলা তার সন্তানের কাছে মহারানীর সম্মান পেয়ে ধন্য হয়েছে, আনন্দে আপ্লুত হয়েছে।

তবুও বলব সন্তানের জন্য বাবার চেয়ে মায়ের প্রয়োজনটাই বেশি। আমিও একদিন আমার স্ত্রীকে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম তুমি দেশে ফিরে যাও। আমাদের মেয়েদের জন্য আমার চেয়ে তোমার প্রয়োজনটাই বেশি। আবার একথাও ভাবি যে একজন সন্তান ঈদের আগে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঈদের পোশাকের চাহিদা জানাবার মধ্যে যে তৃপ্তি পায় সে তৃপ্তি আর কারো কাছে পায় না। বাবাও তার ছেলে মেয়েদের চাহিদা মিটিয়ে সন্তানের মুখে হাসি দেখে যে তৃপ্তি পায় সে তৃপ্তি পৃথিবীর আর কিছুতে পায় না। যে সংসারে মা বাবার মধ্যে সু সম্পর্ক আছে সে সংসারের সন্তানেরা একটা স্বর্গীয় সুখ নিয়ে বেড়ে উঠে। আরও একটা কথা জেনেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব পিতাও তার সন্তানকে যেমন ভালবাসে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং ধনী পিতাও তার সন্তানকে ততটাই ভাল বাসে শুধু প্রকাশ ভঙ্গির তারতম্য হয়, এ ছাড়া বাকী সবই এক।

জন্মদিনে একগুচ্ছ হুমায়ুন আহমেদ!

জন্মদিনে একগুচ্ছ হুমায়ুন আহমেদ!

** মনে তীব্র ব্যাথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা। যে লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় সবদিকে। – হুমায়ুন আহমেদ (আমার ছেলেবেলা)।

** যারা সবসময় মিথ্যা কথা বলে তাদের চেহারায় একটা মাইডিয়ার ভাব থাকে।……………..
মানুষের অনেক অদ্ভুদ ক্ষমতার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলার ক্ষমতা | কল্পনা শক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে। যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারেনা সে সৃষ্টিশীল মানুষ না- রোবট টাইপের মানুষ।
-হুমায়ুন আহমেদ (তন্দ্রাবিলাস)।

** বুদ্ধিমানের কাছ থেকে দশ হাত দুরে থাকবে আর বোকাদের কাছ থেকে একশ হাত দুরে থাকবে।
-হুমায়ুন আহমেদ (হিমুর মধ্যদুপুর)।

** কাউকে বিরক্ত করার সবচে সহজ পথ হচ্ছে তাকে অনুকরণ করা। সে হাসলে হাসা। সে ভুঁরু বাঁকালে ভুঁরু বাঁকানো, সে কাশলে কাশা।
– হুমায়ুন আহমেদ (একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা)।

** কোন সৃষ্টিশীল কাজ যখন কেউ করে তখন কাউকে না কাউকে পাশ লাগে যে সেই কাজটা এপ্রিশিয়েট করবে।
– হুমায়ুন আহমেদ (একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা)।

** লাজুক মানুষের আত্নবিশ্বাস কম থাকে।
– হুমায়ুন আহমেদ (ফিহা সমীকরণ)।

** অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় এই ছেলেমানুষীটা করে। তাদের বুদ্ধির ছটায় অন্যকে চমকে দিতে চায়।
– হুমায়ুন আহমেদ (আমি এবং আমরা)।

** যাদের মনের ভেতরের অবস্থাটা থাকে বিশৃঙ্খল এবং হয়তোবা অসুন্দর তারা বাইরের পৃথিবীটাকে সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল দেখতে চায়, সে কারনে হাতের লেখার মত তুচ্ছ বিষয়েও তাদের মনোয়োগী হতে দেখা যায়।
– হুমায়ুন আহমেদ (আমি এবং আমরা)।

** বেশীরভাগ সময় আমরা মনের কথা বলতে পারিনা বলে কষ্ট পাই।
– হুমায়ুন আহমেদ (দারুচিনি দ্বীপ)।

** চিন্তাহীন জীবন যাপন করা উচিৎ।
-হুমায়ুন আহমেদ (চলে যায় বসন্তের দিন)।

ইন্টারাপ্টার


সত্যি কথাই বলছি। আমাকে কিন্তু আপনারা কেও চিনতে পারবেন না। আপনাদের সাথে আমার তেমন করে আলাপ পরিচয় হয়নি তবে আমার নানা ভাইয়াকে আপনারা ভাল করেই জানেন, তার সাথে আপনাদের বেশ সখ্যতা আছে আমি জানি। যখন তিনি ল্যাপটপ দিয়ে আপনাদের জন্য গল্প লেখেন আবার এখানে পোস্ট করেন তখন আমি কাছে এলেই তিনি তার যত রকমের বাধা দেয়ার কৌশল জানা আছে সবই করেন। আমাকেও যে ল্যাপটপে কাজ করতে দিতে হবে তা তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না। তিনি অবশ্য তার একটা ল্যাপটপ আমাকে দিয়েছেন কিন্তু এটার মনিটরে কোন আলোতো জ্বলেই না, কী বোর্ড বা মাউস প্যাডের সাথে কুস্তী করেও কিছু হয় না, পরে বুঝলাম ওটা তার বাতিল নষ্ট ল্যাপটপ।

তবুও কিছু কথা আপনাদের না জানালে আমি অস্বস্তি বোধ করছি, কথাগুলি আমার পেটের ভিতর শুধু টগবগ করে ফুটছে কিছুতেই আটকে থাকতে চাইছে না। আমিওতো আপনাদের সাথে পরিচিত হতে চাই, শব্দনীড়ের জন্য কিছু লিখতে চাই। আমার নানা আমাকে শোনান “ থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগতটাকে” কিন্তু যখনই আমি নানার সাথে ঘরের বাইরে যেতে চাই তখনই তিনি বিরক্ত হন। কোমরে ব্যথা, পায়ে ব্যথা এমনি নানা রকম অজুহাত দাড় করেন। তবুও কখনও বাইরে নিয়ে গেলে আমি যখন চারিদিকের নানা কিছু দেখে সব কিছু জানতে চাই তখনও তিনি বিরক্ত হন। এইতো সেদিন আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তখন শুনলাম রাস্তার মাঝের ম্যান হোল থেকে শব্দ আসছে। আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জানতে চাইলাম এটা কিসের শব্দ? নানা ভাই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন এটা ম্যান হোল, এখান দিয়ে প্রতিটি বাড়ির নোংড়া পানি সহ বৃষ্টির পানি নিষ্কাসিত হয়, একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছে সেই পানি যাচ্ছে বলে শব্দ হচ্ছে।

আবার ছাদে যেয়ে যখন টবে পানি দেয়ার বালতি হাতে পানির ট্যাংক এর কাছে যেতে চাইলাম তখন বাধা দিয়ে বললেন না না তোমাকে এ কাজ করতে হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে করলাম না। তার পরে ছাদের একটা চেয়ার টেনে আম গাছটার নিচে নিতে চাইলাম তাতেও তার নিষেধাজ্ঞা, বলে কিনা “এই পণ্ডিত ওটা ধরবে না ব্যথা পাবে”। আচ্ছা বলতে পারেন এতসব বাধা বিপত্তি এড়িয়ে আমি কেমন করে সত্যিকারে পণ্ডিত হতে পারি?
সেদিন নানা ভাই ইনসুলিন নিচ্ছিলেন। আমি তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে তার কাছে গিয়ে মাত্রই ইনসুলিনের বাক্সটা ধরেছি আর ওমনি তিনি চ্যাচিয়ে আমার মাকে ডেকে বললেন ওকে ধর। কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা, না আমার হাতে ওই বাক্স দিতেই হবে, না তিনি তা দিলেন না। এর মধ্যে ইনসুলিন নিয়ে আমার হাতে তুলার টুকরা দিয়ে বললেন যাও এটা বিনে ফেলে দাও, যাক এতেই আমি খুশি কিন্তু তাকে ইনসুলিন দিতে না পারার একটু দু:খ মনের কোণে রয়েই গেল।

আর একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে যেতে চাইছিলাম তখন আমাকে দেখেই ভাইয়া দৌড়ে এসে বাধা দিলেন, বলে কিনা আমি নাকি পরে গিয়ে ব্যথা পাব! এমনি যখন যাই করতে চাই সব কিছুতেই আমাকে interrupt করেন। সেদিন দেখলাম মা রান্না ঘরে চুলা জ্বেলে কি যেন রান্না করছিল, মা তখন সিংকে কি ধোয়ার কাজে ব্যস্ত। ভাবলাম আমার একটু গরম পানি দরকার তাই আমার পানির ফিডারটা নিয়ে মাত্রই চুলার উপরে ধরতে গেছি আর অমনি ভাইয়া এসে আমাকে চিলের মত ছো দিয়ে নিয়ে এলো। জ্বলন্ত চুলার উপরে আমার ফিডারটা ধরতেই পারলাম না, মা পিছনে ঘুরে দেখে অবাক হয়ে আমার দিয়ে তাকিয়ে রইল।

নানা ভাই অফিস থেকে ফিরলেই আমি তার জুতা মুজা খুলে রাখার জায়গা দেখিয়ে আবার ঘরে স্যান্ডেল কোথায় আছে তাও দেখিয়ে দেই তারপরে তার কোলে উঠে হাতের ইশারায় গেট দেখিয়ে বলি আমাকে নিয়ে এখন একটু বাইরে চল।

কয়েকদিন আগে নানা ভাই পাশের রেজা ভাইয়ের দোকান থেকে মসুর ডাল, সাবান, চিনি এরও কত কি আনতে গেল সাথে আমাকে কোলে নিয়ে গেল, সবকিছু মিলিয়ে প্যাকেটটা অনেক বড় হয়ে গেল তাই আমি ভাবলাম অন্তত মসুর ডালের প্যাকেটটা আমার হাতে নিই নানা ভাইয়ের কোলে বসে মসুর ডালের প্যাকেট হাতে করে এনে নানুর হাতে দিলাম, আর নানু যে কী খুশি হলো তা আর বলার নয়। আমার যে সংসারের অনেক কাজ করতে ইচ্ছা হয়, মনে হয় আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি। সারাদিন কি আর পড়াশুনা এবং খেলাধুলা করা যায়? যদিও নানা ভাইয়া আমাকে অনেক বই আর খেলনা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু করতে গেলেই তিনি আমাকে ভীষণভাবে interrupt করেন তাহলে আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বাড়বে কেমন করে? আমার বয়স এখন দেড় বছর, এখন থেকেই যদি এই ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর সবকিছু এক এক করে শিখে না নেই তাহলে আমি সত্যিকারে শিক্ষিত হব কি করে? আমার নানা ভাই এ কথা কেন বুঝতে চায় না বুঝি না!

আপনারা একটু আমার নানা ভাইয়াকে বলে দিবেন তিনি যেন আমার ইন্টারাপ্টার না হন।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা।

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেলে “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স্ রাইমের” প্রবর্তক। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, ছড়াকার, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭ সালে কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ও ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বিধুমুখী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান অর্থাৎ সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরনের স্বর্ণযুগে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় ছিলেন তাঁর দুই ভাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এছাড়াও পারিবারিক বন্ধু ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ছোটদের জন্য অনেক মজার ছড়া লিখে গেছেন। যেগুলো আজও সমান ভাবে বড়দের মধ্যেও জনপ্রিয়।

“মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-
সবাই বলে, “মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই “মুখ্য ছেলে”, বলবে আমায় “গো গর্দভ!”
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?”

এমন আজগুবি অথচ সার্থক রচনা ছিলো সুকুমার রায়ের।‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই লিখেছিলেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’

১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সুকুমারের প্রথম কবিতা ‘নদী’ প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরপর ন’বছর বয়সে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন ইংরাজি শিশুপাঠ ‘Hickory,Dickory,Dock’-এর অনুবাদ হিসাবে। ১৯০৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর দ্বারা শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে পুরস্কৃত হন তিনি। এরপর ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি (অনার্স) পাশ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এবং তারপরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ননসেন্স ক্লাব’ ১৯০৭-এ। এর মুখপাত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। এই সময় থেকেই তাঁর আবোল-তাবোল ছড়ার আত্মপ্রকাশ।

“হেড অফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত ?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে !
আঁৎকে উঠে হাত পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল,
হঠাৎ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধরে তোল !”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউবা হাঁকে পুলিশ,
কেউবা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”

আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিন্তার ধরণও পাল্টে যায়। বড় এবং ছোটদের চিন্তা এক হওয়া কখনও সম্ভব নয়। বড়দের ভাবনা জটিল হলেও ছোটদের ভাবনা সহজ-সরল। ছোটদের জগত ভিন্ন, আলাদা। শিশু ও কিশোর মনের সাথে তালমিলিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় মূলত তা-ই শিশু সাহিত্য। সপ্তম শতকে ল্যাটিন ভাষায় আদি শিশু সাহিত্য রচিত হয়। ঊনবিংশ শতকে জার্মান রূপকথা, এডওয়ার্ড লিয়ারের book of nonsense, লুইস ক্যারলের alice in wonderland প্রভৃতি শিশু সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। ১৯১১ সালে সুকুমার রায় ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে আলোকচিত্র ও মুদ্রণপ্রযুক্তির ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং কালক্রমে ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। হাফটোন মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর ১৯১২ সালে তিনি ‘Halftone Facts Summarized’ রচনা করেন যা Penrose Annual-এ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের ‘Royal Photographic Society’-র সদস্য নিযুক্ত হন। এরপর ১৯১৩ সালে তাঁর রচিত ‘Standardizing the Original’, ‘Penrose Annual’ – এ প্রকাশিত হয় এবং ‘Pin-hole theory’–র ওপর একটি রচনা ১৯১৩-এর জুলাই মাসে ‘The British Journal of Photography’ – তে প্রকাশিত হয়।

সুকুমারের ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়েই পিতা উপেন্দ্রকিশোর উন্নতমানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন এবং ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত করেন ১৯১৩ সালে। এই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর সুকুমার স্বদেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কালীমোহন ঘোষের সাথে। দেশে ফিরেই সুকুমার যোগ দেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর সাথে এবং ১৯১৪ সালে ‘সাধারন ব্রাহ্মসমাজের’ যুগ্ম সচিব পদে নিযুক্ত হন।পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোর মারা যাওয়ার পর সুকুমার রায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার কাজ নিজের হাতে তুলে নেন।

“যে আনন্দ ফুলের বাসে, যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়, যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দে বাতাস বহে, যে আনন্দ সাগর জলে,
যে আনন্দ ধূলির কণায়, যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দে আকাশ ভরা, যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে, যে আনন্দ রক্ত ধারায়,
সে আনন্দ মধুর হয়ে তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত থাকুক তব জীবন ভরি।”

১৯১৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর কালীনারায়ণ গুপ্তর নাতনি শ্রীমতি সুপ্রভা দাসের সাথে বিবাহ হয় এবং দুই বৎসর পরে ১৯২১ সালের ২য় মে সত্যজিতের জন্ম হয়। ১৯২২ সালে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে ‘Royal Photographic Society’-র সহকর্মী নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সুকুমার রায় কালাজ্বরে (লেইশ্নানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক বছর পরে ১৯২৩ সালের ১০ম সেপ্টেম্বর মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল ‘আবোল তাবোল’,’পাগলা দাশু’,’হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’,’হ য ব র ল’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাবগ্রন্থ।

“মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে,
রামধনুকের আব্‌ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কণ্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন আকাশতলে
স্বপ্ন দোলা হাওয়ায় দোলে
সুরের নেশার ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাই বা বুঝুক বেবাক্ লোক
আপনাকে আজ আপন হাতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।”
______________________

অক্ষরে অক্ষরে তিনি সুনীল

অক্ষরে অক্ষরে তিনি সুনীল : বাঙলাভাষী এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক” ও “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অাকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রাথমিক জীবন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ফরিদপুর জেলায়, বর্তমান যা বাংলাদেশের অন্তর্গত। জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি বড় হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ব্যাংকের পিয়নের চেয়েও স্কুল মাস্টারের বেতন ছিল কম। সুনীলের মা কখনোই চাননি তাঁর ছেলে শিক্ষকতা করুক। পড়াশুনা শেষ করে কিছু তিনি আপিসে চাকুরি করেছেন। তারপর থেকে সাংবাদিকতায়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় হয়। সেই সূত্রে মার্কিন মুলুকে গেলেন সুনীল ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে। ডিগ্রী হয়ে গেলে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল।

সাহিত্যিক জীবন
সুনীলের পিতা তাকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল তিনি যাতে দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। তিনি তাই করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত সুনীল তখন পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ একঘেঁয়ে উঠলে তিনিই নিজেই লিখতে শুরু করেন। ছেলেবেলার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করা লেখা কবিতাটি তিনি দেশ পাঠালে তা ছাপা হয়।

সম্মাননা
সম্মাননা [সম্পাদনা] ২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে সাহিত্য অাকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে সাহিত্য অাকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

দেহাবসান
২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর দেহ দাহ করা হয়। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২৫ অক্টোবর ২০১২ তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
____________________

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ

প্রথাগত কবিতাকে মুক্তি দিয়ে, কবিতার আধুনিকায়নের কারণেই কবিতাপ্রেমীদের কাছে তিরিশ দশকে বাংলা কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ খুব দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ-মধুসূদনকে ছাড়া, বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ, যিনি বিবর্তন-বিবর্ধন ঘটিয়েছেন বাংলা কবিতার। ২২ অক্টোবর আধুনিক বাংলা কাব্যের এই প্রাণপুরুষের মৃত্যুদিন।

জীবনানন্দ দাশের জন্ম বরিশাল শহরে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯। জীবনানন্দ দাশই লিখেছিলেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যাই না আমি…।’ আজ থেকে বহু বছর আগে লিখেছেন কালজয়ী এবং সব সময়ের আধুনিক কবিতা ‘বনলতা সেন’। যা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতার জগৎকে যারা সমৃদ্ধ করে গেছেন জীবনানন্দ দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম।

জীবনানন্দ দাশের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুর পরগণার পদ্মাতীরবর্তী গুয়াপাড়ায়। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ছোট সন্তান। তার ডাক নাম ছিল ‘মিলু’। ছোটবেলায় তিনি বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন। তাকে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য বাবা-মা নিয়ে যান লখনৌ, আগ্রা এবং গিরিধিতে। তার দাদা সর্বনান্দ দাশগুপ্ত বরিশালে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। ছিলেন ব্রহ্মসমাজের অনুসারী। তিনি তার নাম থেকে গুপ্ত উপাধি বাদ দেন। এর পর থেকে তার পরবর্তী বংশধররা দাশ উপাধি ব্যবহার করেন। জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যনানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি একজন ভালো প্রবন্ধকার এবং ‘ব্রহ্মবাদি’ সাময়িকীর প্রকাশক ছিলেন। মা কুসুম কুমারী দাশ কবিতা লিখতেন।

জীবনানন্দের বয়স যখন ৮ বছর তখন তাকে বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯১৫ সালে তিনি ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন প্রথম বিভাগ নিয়ে। এর পর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তিনি অনার্স পাস করেন। ১৯২১ সালে এমএ পাস করেন দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে। একই সময় তিনি আইন পড়েন। ঠিক এ সময়ই তিনি কলিকাতা সিটি কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেন। এর পর চলে আসেন বাগেরহাট পিসি কলেজে। সেখানে ভালো না লাগায় চলে যান দিল্লি। সেখানে যোগ দেন রামজোস কলেজে। সেখানে অধ্যাপনা করা অবস্থায় ছুটিতে বরিশাল আসেন। ১৯৩০ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লাবণ্যপ্রভা গুপ্তের সঙ্গে। বিবাহের কারণে দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে দিল্লির ওই কলেজ থেকে তার চাকরি চলে যায়। এর পর তিনি যোগদান করেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। তার সময়ই ১৯৩৫ সালে ব্রজমোহন কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলেশন লাভ করে। এ সময়ই তিনি তার বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘বনলতা সেন’ রচনা করেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নোয়াখালী এবং ত্রিপুরায় বহুলোক নিহত হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পেশায় যোগ দেন। তিনি এ সময় রচনা করেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতাটি। একই সময় তিনি ‘স্বরাজ’ নামের একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় ২৬৯টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার প্রয়াণের পর আরো ১৬২টি কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। ভোরের নির্মল আকাশ, শিশির ভেজা ঘাস, ধানের ক্ষেতের উদ্দাম হাওয়ার মতন, নদীর চরের চিল ডাকা বিষণ্ন দুপুর- প্রকৃতির নানা বর্ণবৈচিত্র্য জীবনানন্দের কবিতায় ধরা দিত। ১৯৫৩ সালে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৫-তে তার লেখা শ্রেষ্ঠ লেখা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ মরণোত্তর আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর বিকেলে তিনি ট্রামের ধাক্কায় গুরুতরভাবে আহত হন এবং ২২ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ : ঝরা পালক (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহান পৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪), রূপসী বংলা লেখা (১১৯৩৪-প্রকাশ ১৯৫৭)।, বেলা অবেলা (১৯৬১), সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গ (১৯৭৯)।

উপন্যাস ও গল্প : পূর্ণিমা, কল্যাণী, চারজন, বিরাজ,সতীর্থ, বাঁশমতির উপাখ্যান, প্রীতিনিড়, কারু-বাসনা, মৃণাল। তার ছোটগল্প একান্ত কামনার বিলাস, সঙ্গ, নিসর্গ, রক্তমাংসহীন, জামরুলতলা, মেয়ে-মানুষ, পূর্ণিমা, নকলের খেলা, হাতের তাস, ছায়ানট, চাকরি নাই, উপেক্ষার শীত, বই, মহিষের শিং, বৃত্তের মত, সাধারণ মানুষ, পালিয়ে যেতে ইত্যাদি যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পায়। এছাড়াও জীবনানন্দ দাশ ইংরেজিতে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।

বাংলা কবিতায় আগে বা পরেও আর কোনো কবিই জীবনানন্দের মতো এতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়ে ওঠেননি। রবীন্দ্রনাথের কথা হয়তো অনেকেই বলবেন। সত্য বটে, রবীন্দ্রনাথ এককভাবে বাঙালির সংস্কৃতিকে যতটা প্রভাবিত করেছেন আর কোনো লেখকই তা করতে পারেননি। কিন্তু যদি কেবল কবিতার কথা ওঠে তাহলে রবীন্দ্রনাথ নন, বরং জীবনানন্দ দাশই সেই প্রবল ব্যক্তিত্ব যিনি কাব্যরুচির সম্মোহনী শক্তি দিয়ে আজকের প্রজন্মকেও মুগ্ধ করে রেখেছেন।

বঙ্গবন্ধুর শৈশবের সোনাঝরা সময়গুলো

বঙ্গবন্ধুর শৈশবের সোনাঝরা সময়গুলো

রং তুলির আচঁড়ে যেন ছবির মতো গ্রাম। গাছগুলো সারি সারি। নদীতে পালতোলা পানশি, নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটির চেহারা হতো একখণ্ড জলছবি। গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। সেই পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে চেহারার শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জগৎ স্বীকৃত সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ। তিনি ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সন্তান। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এ ঘেরা টুঙ্গিপাড়াতেই। পুষ্পভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন।

দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তু‘র প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে।

গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আর্কষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তার মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার পতি ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তার পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি।

পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করতেন। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।

ওই সময় গোপালগঞ্জে স্বদেশি আন্দোলনের এক সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠির্চাজ দেখে বিক্ষুব্ধ হয় শিশু মুজিব। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন তিনিও বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীর দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে তারা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের। তার সাহস দেখে অবাক হন থানার বড়কর্তা। তার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তার লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।

তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এসময় বিরোধীচক্রের রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাকে। হাজতবাস করতে হয় সাতদিন। এটিই তার জীবনের প্রথম কারাবরণ।

শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তার গৃহ শিক্ষক। তার এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করতেন। তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। স্কুল টিমের নেতা হয়ে বেশ কয়েকবার জিতে যায় তার দল।

শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি।

বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
‘তাঁহার মহত্ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১২ই আশ্বিন ১২২৭ সাল) ১৮২০ খ্রী: ২৬শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশীয় পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঠাকুরদা রামজয় তর্কভূষণ।বিদ্যাসাগরের অজেয় পৌরুষ, মনুষ্যত্ব, স্বকীয়তা, মানবিক ঔদার্য, স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনমনীয় দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাঙালি চরিত্র খুবই কম আছে। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি।

তিনি হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্যান্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে। বিদ্যাসাগরের এ আইনের ফলে বঙ্গ-ভারতের কোটি কোটি বিধবাদের স্বামীর ঘরে আশ্রয় হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ কলেজের বর্তমান নাম ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’, কর্মজীবনে ঈশ্বর চন্দ্র ছিলেন কলেজশিক্ষক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ছিলেন। এরপর তিনি সংস্কৃতি কলেজের সহকারী সম্পাদক ও সংস্কৃতের অধ্যাপক হন। কিছু দিন পর তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।

সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্যপুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের অভাব পূর্ণ করেছেন। তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তার বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো- শকুন্তলা, বোধোদয়, আখ্যান মঞ্জুরী, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি ও সীতার বনবাস। শিশু শিক্ষার মান ও পাঠ সহজ করার জন্য লিখলেন ‘বর্ণ পরিচয়’, সংস্কৃত ভাষা সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপনের জন্য লিখলেন ‘ব্যাকরণের উপক্রমনিকা’, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের এ সব গ্রন্থ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পরিপূর্ণ।মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মাকে তিনি দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন। তাও আবার ছিল ভরা বর্ষায়।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক অভিধার জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আমার যদি কোন কৃতিত্ব থাকে তবে এর দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ প্রথমেই বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা বলেছিলাম। তার কয়েকটি উদাহরন দিই।

১. সংস্কৃত কলেজ থেকে চাকরি ছাড়ার সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘খাবেন কী করে?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আলু-পটল বিক্রি করে খাব, কিন্তু যেখানে মর্যাদা নেই, সেখানে থাকব না।’

২. হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ মি. কার সাহেব টেবিলের ওপর জুতাসুদ্ধ পা তুলে পাইপ টানতে টানতে আলাপ করছিলেন। প্রতিদানে বিদ্যাসাগরও অনুরূপভাবে আলাপ করেছিলেন। শিক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি এই আচরণের কৈফিয়ত্ চাইলে বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এদেশীয় নেটিভ অসভ্য, ভদ্রতা ও ভব্যতা জানি না। কার সাহেবের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গিয়ে তার কাছেই আমি এই আচরণ শিখেছি। একজন সুসভ্য ইউরোপীয়ের আচরণ এমন অশোভনীয় হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি ভাবলাম এই বোধ হয় আপনাদের অভ্যর্থনার রীতি। তাই আমি এদেশি রীতিতে তাকে অভ্যর্থনা না করে, তার কাছে শেখা অনুযায়ী সেদিন তাকে অভ্যর্থনা করেছি। যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, এর জন্য আমি দোষী নই।’

৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন। শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বর চন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে প্রায়ই হিন্দু কলেজের এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন, “কি হে,বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর প্রতিদিন কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একইভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবার সেই ইংরেজের সাথে দেখা। আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চন্দ্র তার ট্যামর থেকে একটা কয়েন বের করে বললেন, “এই যে গুজে রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগেনা। এবার হলো তো?

সমসাময়িক অন্যরা ছিলেন পোশাকে আধুনিক আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মননে ও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক। দেবতা হওয়া সহজ। কিন্তু মানুষ হওয়া যে কঠিন, এর প্রমাণ বিদ্যাসাগর। কারন ত্যাগ, সাধনা ও সততা দিয়ে মানুষ হতে হয় বিদ্যাসাগর আমাদের বুঝিয়েছেন। বিদ্যাগাসর তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা পেয়েছিলেন বাবা ও মায়ের কাছে। এ জন্যই বিদ্যাসাগর বলেছেনঃ- ‘যদি আমার দয়া থাকে তা পেয়েছি মা’র কাছে আর যদি বুদ্ধি থাকে তবে তা পেয়েছি বাবার কাছে।’ রামমোহন রায় মূর্তি পুজো করতেন না বলে তার মা আদালতে পুত্রের ছিন্ন মস্তক চেয়েছিলেন। আর

বিদ্যাসাগরের মা তাকে বলতেনঃ
‘যে দেবতা আমি নিজ হতে গড়িলাম, সে আমাকে উদ্ধার করবে কি করে? বাঁশ, খড় ও মাটি দিয়ে গড়া মূর্তিতে কী প্রকৃত দেবতা হয়! জীবন্ত মানুষই তো প্রকৃত দেবতা।’
তাঁর বাবা বললেন—
‘বাবা, ধরিবার পূর্বে বাবা ভাবা উচিত। ধরেছ তো ছেড়ো না, প্রাণ পর্যন্ত স্বীকার করিও।’

বিদ্যাসাগরের প্রকৃত মূল্যায়ন করেছেন মধূসূদন-
The man to whom I have appeal has the generosity and the wisdom of an ancient sage, the energy of one Englishman and the heart of a Bengali Mother.

কাঙাল হরিনাথ

“আমি ধনী আমি জ্ঞানী মানী রাজ্যপতি।
শ্মশানে সকলের দেখ একরূপ গতি।”

– কাঙাল হরিনাথ।

তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। কিন্তু প্রায় সবাই তাঁকে চেনেন কাঙাল হরিনাথ নামে। বাউল গানে নিজেকে কাঙাল বলে উপস্থাপন করতেন বলেই তাঁর এই পরিচিতি গড়ে ওঠে। বিখ্যাত বাউল সাধক লালনের শিষ্য ছিলেন তিনি। তবে কাঙাল হরিনাথ তাঁর বাউল গানের জন্য শুধু নয়- অন্য অনেক কাজের জন্য অমর হয়ে আছেন। তিনি ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিক টানাপড়েনে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু তরুণ বয়সেই অসহায় মানুষের পক্ষে কাজ শুরু করেন।

সে সময় ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতনের শিকার গ্রাম-বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের কথা লিখতে থাকেন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। পরে পত্রিকাটি পাক্ষিক এবং তার কিছু পরে সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এক পয়সা মূল্যের এই পত্রিকাটিতে কাঙাল হরিনাথ অবিরাম নীলকর ও জমিদারদের নানা জুলুমের কথা প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। কাঙাল হরিনাথের পত্রিকাটি সেই সময়ে নির্যাতিত কৃষক ও প্রজাদের পক্ষের একটি পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু সরকারের কঠোর মুদ্রণনীতি ও নানা বিরোধিতায় ১৮ বছর প্রকাশের পর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই উনিশ শতকে গ্রামের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের কারণে কাঙাল হরিনাথ অমর হয়ে আছেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

এদেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা অন্যতম পথিকৃতের।গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখা হয়নি। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদী ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। কাঙালের জীবনীকার অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, এই শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসঙ্গীতশিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না’, তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন।

গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদাররা তাঁর ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণের রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায় ছিলেন তাঁর শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্ত্তার লেখক।

হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশাতেই।নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোকশিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর চলেছিল। তখনও তিনি তার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। ১৮৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মজার মানুষ রবীন্দ্রনাথ

মজার মানুষ রবীন্দ্রনাথ

এক. মরিস সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। একা থাকলে তিনি প্রায়ই গুনগুন করে গান গাইতেন। একদিন তিনি তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, জানো গুরুদেব, চিনির ওপর একটি গান লিখেছেন, গানটি বড়ই মিষ্টি।’ প্রমথনাথ বিশী বিস্মিত হয়ে বললেন, “কোন গানটা? তার আগে বলুন, এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন?”
উত্তরে মরিস সাহেব জানালেন,
‘কেন, স্বয়ং গুরুদেবই তো আমাকে এটা বলে দিয়েছেন।’
অতঃপর তিনি গানটি গাইতে লাগলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপারে।’ প্রমথনাথ বিশী মুচকি হেসে বললেন, তা গুরুদেব কিন্তু ঠিকই বলেছেন, চিনির গান তো মিষ্টি হবেই”।

দুই. শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ একবার লিখে পাঠালেন, ‘আজকাল আপনি কাজে অত্যন্ত ভুল করছেন। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। এজন্য কাল বিকেলে “আমি আপনাকে আমি দণ্ড দিব।”

গুরুদেবের এহেন কথায় শাস্ত্রী মশাই তো একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এমন কি অন্যায় তিনি করেছেন যার জন্য তার দণ্ডপ্রাপ্য ? চিন্তিত, শঙ্কিত শাস্ত্রী মশাই পরদিন শশব্যস্তে কবির কাছে উপস্থিত হলেন। আগের রাতে দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারেননি। এখনো তাঁকে বেশ কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যেই বসিয়ে রেখেছেন কবিগুরু। অবশেষে পাশের ঘর থেকে একটি মোটা লাঠি হাতে আবির্ভূত হলেন কবি। শাস্ত্রী মশাই তখন ভয়ে কাণ্ডজ্ঞান লুপ্তপ্রায়। তিনি ভাবলেন, সত্যি বুঝি লাঠি তাঁর মাথায় পড়বে। কবি সেটি বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এই নিন আপনার দণ্ড! সেদিন যে এখানে ফেলে গেছেন, তা একদম ভুলে গেছেন।’

তিন. একদিন সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ জলখাবার খেতে বসেছেন। প্রমথনাথ এসে তার পাশে বসলেন। উদ্দেশ্য, গুরুদেবের খাবারে ভাগ বসানো। ফল, লুচি, মিষ্টি সবকিছুরই ভাগ পেলেন তিনি। কিন্তু তার নজর একগ্লাস সোনালি রংয়ের সরবতের দিকে যেটা তাকে দেওয়া হয়নি। গুরুদেব তার ভাব লক্ষ্য করে বললেন, “কী হে এই সরবত চলবে নাকি?” প্রমথ তাতে খুব রাজি। অমনি গুরুদেব বড় এক গ্লাসে সেই সরবত প্রমথকে দেওয়ার আদেশ দিলেন। বড় গ্লাস ভর্তি হয়ে সেই সোনালি সরবত এল। প্রমথনাথ এক চুমুক খেয়েই বুঝলেন সেটা চিরতার সরবত। এদিকে গুরুদেব তার মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। ভাবখানা এমন– ‘কেমন জব্দ’।

চার. একবার রবীন্দ্রনাথ ঘুমোচ্ছেন। ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আলোতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ভৃত্য মহাদেবকে ডেকে বললেন, “ওরে মহাদেব, চাঁদটাকে একটু ঢাকা দে বাবা।” মহাদেব তো হতভম্ব। চাঁদ সে কীভাবে ঢাকা দেবে? গুরুদেব হেসে বললেন, “জানালাটা বন্ধ কর, তাহলেই চাঁদ ঢাকা পড়বে।”

পাঁচ. রবীন্দ্রনাথ তার ভক্ত ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে গান গাইছেন, ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’ তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় বিরক্ত হবেন কিনা কে জানে। গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন, ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’ বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভালো নয়।’

ছয়. সাহিত্যিক ‘বনফুল’ তথা শ্রীবলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে অধ্যয়নের জন্য শান্তিনিকেতনে পৌঁছেই কার কাছ থেকে যেন জানলেন, রবীন্দ্রনাথ কানে একটু কম শোনেন। অতএব যা বলতে হবে চিৎকার করে বলতে হবে। আশ্রমে এসেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন বললেন, ‘কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি’, তখন বলাইবাবুর ভাই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।’রবীন্দ্রনাথ তখন হেসে উঠে বললেন, ‘না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই।’

সাত. একবার এক মহিলা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য কিছু পিঠা বানিয়ে নিয়ে যান। কেমন লাগল পিঠা জানতে চাইলে কবি গুরু উত্তর দেন- লৌহ কঠিন, প্রস্তর কঠিন, আর কঠিন ইষ্টক, তাহার অধিক কঠিন কন্যা তোমার হাতের পিষ্টক।

আট. এক সভা শেষে ফিরবার পথে কবিগুরু চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে বললেন -“দেখলে চারু আমার প্রায়শ্চিত্ত। আমি না হয় গোটা কয়েক গান কবিতা লিখে অপরাধ করেছি। তাই বলে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে এরকম যন্ত্রণা দেয়া কি ভদ্রতা সম্মত। গান হল কিন্তু দুজনে প্রাণপন শক্তিতে পাল্লা দিতে লাগলেন যে, কে কত বেতালা বাজাতে পারেন আর বেসুরা গাইতে পারেন। গান যায় যদি এ পথে তো বাজনা চলে তার উলটো পথে। গায়ক বাদকের এমন স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টা আমি আর কস্মিনকালেও দেখিনি। তারপর ঐ একরত্তি মেয়ে, তাকে দিয়ে নাকিসুরে আমাকে শুনিয়ে না দিলেও আমার জানা ছিল যে, তঁবু মঁরিতে হঁবে। ”উল্লেখ্য, গানের প্রথম লাইন ছিল ‘তবু মরিতে হবে’।

নয়. মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে বেশ কয়েকদিন ধরে নিরামিষ খাওয়াচ্ছিলেন। তো একদিন মৈত্রেয়ী দেবী কিছু খাবার নিয়ে এসে বললেন -“এটা একটু খাবেন ? রোজ রোজ আপনাকে কি নিরামিষ খাওয়াবো ভেবে পাইনা।” কবিগুরু বললেন -“ও পদার্থটা কি?” মৈত্রেয়ী দেবীর উত্তর-ব্রেইন।
তখন কবিগুরু বললেন- “এই দেখ কাণ্ড, এ তো প্রায় অপমানের শামিল। কি করে ধরে নিলে যে, ঐ পদার্থটার আমার প্রয়োজন আছে? আজকাল কি আর আমি ভাল লিখতে পারছিনে ?”

দশ. কবিগুরু নাকি বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়ের মা’কে পছন্দ করে এসেছিলেন। স্বয়ং কবির মুখেই শোনা যাক সেই কাহিনী :- “মেয়ের বাবা অনেক পয়সা কড়ির মালিক। বাসায় যাবার পর, দুটো অল্প বয়সী মেয়ে এসে উপস্থিত হলো। একটি মেয়ে নেহায়েত্ সাধাসিধে, জড়ভরতের মত এক কোনে বসে রইল এবং অন্যটি যেমন সুন্দরী তেমনি স্মার্ট। কোন জড়তা নেই। শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলছে। ওর সঙ্গে কথা হল। আমাদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনালো। আমি মুগ্ধ, বিস্মিত। মনে মনে ভাবছি, সত্যিই কি আমি ওকে পাবো। ভাবনায় ছেদ পরলো। বাড়ির কর্তা তখন ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকেই তিনি মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েটিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, হেয়ার ইজ মাই ওয়াইফ। আর জড়ভরতটিকে দেখিয়ে বললেন, হেয়ার ইজ মাই ডটার। আমি তো শুনে থ হয়ে গেলাম। যা হোক, বিয়ে হলে মন্দ হতো না। সাত লাখ টাকা পাওয়া যেতো। বিশ্বভারতীর কাজে ব্যয় করতে পারতাম। তবে শুনেছি, মেয়েটি নাকি বিয়ের দু’বছর পরই বিধবা হয়। যাক, বাঁচা গেছে। কারণ স্ত্রী বিধবা হলে আমার প্রাণ রাখা শক্ত হতো।”

এগার. একবার মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে জিজ্ঞেস করলেন ,’আপনার বিয়ের গল্প বলুন।’ কবি জবাব দিলেন, ”আমার কোনো বিয়ের গল্প নেই। বৌঠানরা বিয়ের জন্য জোরাজোরি শুরু করলে আমি বললাম, তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আমার কোন মতামত নেই। তারপর বোঠানরাই যশোরে গিয়েছিলেন। আমি বলেছি ‘আমি কোথাও যেতে পারবো না। আমার বিয়ে জোড়াসাকোঁতেই হবে।‘ মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, ”কেন আপনি বিয়ে করতেও যান নি ?” “কেন যাবো? আমার একটা মান সম্মান আছে না ?” – রবীন্দ্রনাথের সাফ জবাব।

বার. একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন ভ্রমনে গিয়েছিলেন সেন মশাই (ক্ষিতিমোহন সেন)। আর সেটা ছিলো আমের মরশুম। কবিগুরু আম ভালবাসেন যেনে চীন কর্তৃপক্ষ আম আনালেন বাংলাদেশ থেকে। তখন তো আর দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল না। আম যেন না পচে তাই রাসায়নিক মিশানো হয়েছিল। কিন্তু আম যখন চীনে পৌঁছল তখন সেগুলি শুকিয়ে চুপসে গিয়ে রুপান্তরিত হয়েছিল এক অদ্ভুত বস্তুতে। খাবার টেবিলে দেয়া হলো রবীন্দ্রনাথ, তার ভাগ পেলেন সেন মশাইও। চীনের লোক তো আর আম চেনে না, কবিকে তার প্রিয় খাদ্য দিতে পেরে ভারি খুশি। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য এত কষ্ট করে আনা আম গলাধঃকরণ করলেন দু’জনেই মুখ বুজে। কবিকে সেন মশাই জিজ্ঞেস করলেন -“কেমন আম খেলেন গুরুদেব ?” মৃদু হেসে জবাব দিলেন কবি- “আম খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এক রবীন্দ্রনাথ আর এক রবীন্দ্রনাথের দাড়িতে তেঁতুল গুড় মেখে চুষছে।”

তের. একবার শান্তিনিকেতনে ওজনের একটি মেশিন ক্রয় করা হয় এবং এতে ছেলেমেয়েদের একে একে ওজন নেয়া হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা লক্ষ্য করছিলেন। এক একজনের ওজন শেষ হলেই কবি তাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন -কিরে তুই কত হলি ! এর মধ্যে একটি স্থূলাঙ্গী মেয়ে বলল -দু’মন। এই মেয়েটির সে সময় বিয়ের আলাপ চলছিল এবং কবি তা জানতেন। তাই তিনি পরিহাস করে বললেন -“তুই এখনও দু’মন, এখনও এক মন হলি নে”।

চৌদ্দ. কবিগুরুকে এক ভদ্রলোক লেখেন -আপনি কি ভুতে বিশ্বাস করেন ? কবি উত্তরে লিখলেন- “বিশ্বাস করি বা না করি -তবে তাদের দৌরাত্ব মাঝে মাঝে টের পাই -সাহিত্যে, পলিটিক্সে সর্বত্রই একেক সময় তুমুল দাপাদাপি জুড়ে দেয় এরা। দেখেছি -দেখতে ঠিক মানুষের মত।”

তথ্য সুত্র :

১। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: রবীন্দ্র জীবন ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক।
২। প্রমথনাথ বিশী: রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন।
৩। মৈত্রেয়ী দেবী: মংপুতে রবীন্দ্রনাথ
৪। সীতাদেবী: পুন্যস্মৃতি ৫। প্রতিমা ঠাকুর: নির্বাণ
৬। রানী চন্দ: আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ।

হুমায়ুন আহমেদ এর কিছু উক্তি …

হুমায়ুন আহমেদ দুই বাংলার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা কথা সাহিত্যে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আজ তাঁর কিছু উক্তি/বাণী এখানে তুলে ধরছি যদিও অধিকাংশ পাঠক এগুলো জানেন তবুও মুলত আমার সংগ্রহে রাখার জন্যই শেয়ার করছি। আশা করি অনেকেরই ভালো লেগে থাকবে:

১. ভদ্র ছেলেদের জন্য মেয়েদের মনে কখনো প্রেম জাগে না। যা জাগে তা হল সহানুভূতি।

২. একজন মানুষকে সত্যিকারভাবে জানার উপায় হচ্ছে তার স্বপ্নটা জানা।

৩. মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা।

৪. দুঃসময়ে কোনো অপমান গায়ে মাখতে হয় না।

৫. এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের সাথে প্রেমে পড়ে।

৬. মেয়েদের দুটি জিনিস খুব খারাপ, একটি হচ্ছে অত্যাধিক সাহস অন্যটি গোয়ার্তমি।

৭. যে মানুষ নিঃশব্দে হাসে তার বিষয়ে খুব সাবধান, দুই ধরণের মানুষ নিঃশব্দে হাসে – অতি উঁচু স্তরের সাধক এবং অতি নিম্নশ্রেণীর পিশাচ চরিত্রের মানুষ।

৮. দরিদ্র পুরুষদের প্রতি মেয়েদের একপ্রকার মায়া জন্মে যায়, আর সেই মায়া থেকে জন্মায় ভালোবাসা।

৯. বোকা মানুষ গুলো হয়তো অন্যকে বিরক্ত করতে জানে কিন্তু কাউকে ঠকাতে জানে না।

১০. ভালো মানুষের রাগ থাকে বেশী। যারা মিচকা শয়তান তারা রাগে না। পাছায় লাথি মারলেও লাথি খেয়ে হাসবে।

১১. মেয়েরা এমনিতেই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় সন্দেহ রোগ অনেক গুনে বেড়ে যায়।

১২. সব গ্রেটম্যানরাই কোনো না কোনো সময় বাড়ী থেকে পালিয়েছেন। একমাত্র ব্যাতিক্রম রবি ঠাকুর।

১৩. মানব জাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিরাপদ মনে করে।

……/হুমায়ুন আহমেদ।

ভার্চুয়াল ভণ্ডামি

কি, হিংসে হয়? আমার মতো হতে চাও ?
মদ খাও মানুষ হও।
.
বর্তমান সোশ্যাল মাধ্যমে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে যাওয়া ডায়লগ/ট্রলের জন্মদাতা সেফাত উল্লাহ (সেফুদা) এর সব অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ বিশ্রী ভাষা আর মদ খাওয়া চিত্র গুলোকে কেনো আমরা ধারণ করছি ? আক্রান্ত হচ্ছি কেন ?
.
তার সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা ? নাকি আদতে কিছুই নাহ! হয়তো জেনে শোনে’ই তাকে অনুসরণ করছি!
.
ইউটিউবে ঝড় তুলা একটা ভিডিওতে সেফাত উল্লাহর স্পিক শোনলাম ‘পৃথিবীর কোনো ধর্মেই সে বিশ্বাসি নাহ’। এমনকি ইসলাম ধর্মতেও নাহ’।
.
মহা গ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন, বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)কেও বিশ্রী ভাষায় যাচ্ছে তাই গালাগাল করছে। যে স্রষ্টার সৃষ্টি (ধর্ম) বিশ্বাস করেনা, নামধারী মুসলমান হয়েও ইসলামধর্ম মানেনা, সে নাস্তিক নয় কী ?
.
এতসব পেছনে ফেলে রাজনৈতিক/সেলিব্রেটিদের গালির সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে দেখে যারা তাকে বাহ বাহ দিচ্ছি তারাই বা কোন ধর্মের ? কেমন মানুষ? নাকি তারাও বোতলমারা পাবলিক!
.
যে মহা গ্রন্থ আল কোরআন মানেনা সে নিজেকে মহা পণ্ডিত দাবী করে। সুন্নি বলে দাবী করে। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের কবি সাহিত্যিকরা যেখানে কোরআনের ভাষার মাধুর্যতার কাছে হার মেনেছে অতঃপর তারা কবি, সাহিত্যিক। অন্যদিকে সেফাত উল্লাহর সেসব কথা আমরা মহৌষধ মনে করে গলাধঃকরণ করছি।
.
ব্যাপারটা আরেকবার বলি:- যে বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ( সঃ) কে গালি দেয় সেই আবার হাদীসের কথা শোনায়,অন্য ভিডিওতে দেখলাম সেফাত উল্লা হজ্জে যাচ্ছে/গিয়েছে! কি লাভ তাতে, সে তো কোনো ধর্ম মানেনা।
.
অনেকে বলবে ‘পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কিনা খায়’। তবে পাগলের পাগলামোরও একটা লিমিট থাকা চাই। যদি আনলিমিটেড হয় তাহলে তার স্থান পাগলাগারদে হওয়া উচিৎ। নাহ অস্ট্রিয়ায় হয়তো পাগলাগারদ নাই।
.
আরেক ভিডিওতে দেখলাম যারা(সেফাত) এর মাকে তুলে গালি দিয়েছিলো সে কোনোরূপ প্রতিবাদ ছাড়াই তাদের শান্তশিষ্ট ভাবে (মাকে তুলে গালি দিওয়োনা, তোমারো তো ঘরে মা বোন আছে) ইত্যাদি অসাধারণ লজিক দ্বারা বুঝাচ্ছে। ঐ লজিক’টা জাস্টিফাই করলে দেখবেন, লজিকটা বরাবর ঠিক।
.
কিন্তু সমস্যা হলো লজিক ছাড়া আমারা কোনো কিছুই আমলে নিইনা। কোনটা বুলি, কোনটা গালি!কোনটা হালাল কোনটা হারাম! কে মানুষ। আর কে মানুষরূপী অমানুষ। সেফাতের বেলায় ও নাহ।
.
ব্যাপারটা বুঝুন সেফাত উল্লাজ নিজেই অন্যর মাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। আবার লজিক দেখায়। ব্যাপারটা ভূতের মুখে রাম নাম শোনার মতো হয়ে গেলো না?
.
তাকে গালিবাজ বললে চলবেনা, লিডার অব বেড নেমার, কিংবা নির্ভুল একটা গালির ডিকশনারি। অভদ্র ইতর প্রকৃতির মানুষরূপী অমানুষ।

কুরআনে মহান আল্লাহ মুমিনদের ভদ্রতা শিক্ষা দিয়ে বলেছেন-

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কোনো দল যেন অপর কোনো দলকে উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর ফুসূক অতি মন্দ। যারা তওবা করে না তারাই যালেম।” (সূরা হুজুরাত : আয়াত-১১)।
.
মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে এক হাদীসে মহানবী সা.বলেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপকারী, অশ্লীল ও গালিগালাজকারী হয় না। (জামে তিরমিযী হাদীস : ২০৪৩)।
.
অতঃপর মানুষের বাচ্চা হয়েও আর কারা সেফাত উল্লাকে নিয়ে প্রাউড ফিল করবেন! আইকন অব জেনারেশন বলবেন! তার ভণ্ডামি গুলোকে লিজেন্ডারি ভাববেন! তার মতো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে বোতল মেরে মেরে বলবেন…
.
”কি হিংসে হয়? আমার মতো হতে চাও ?’
মদ খাও মানুষ হও।

শেখ মুজিব একটি নাম, একটি ইতিহাস

মানুষের যতগুলো অনুভূতি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালবাসা । আর এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালবাসা সম্ভব তার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু হওয়া উচিত মাতৃভূমির জন্য । যে মাতৃভূমিকে ভালবাসতে পারে না কোন কিছুকেই তার পক্ষে ভালবাসা সম্ভব না । আমাদের এই ছোট্ট সোনার বাংলাদেশ, যার রয়েছে বীরত্বপূর্ণ গৌরব গাঁথা ইতিহাস । আর এই সাফল্যগাঁথা ইতিহাসের পিছনে রয়েছেন কয়েকজন মহানায়ক।যাদের ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না ।তাদের মধ্য অন্যতম হচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।যার জন্ম না হলে এই বাংলাদেশ হত না । যার জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক কোন দেশের নাম থাকতো না । এই বাংলাদেশ, এই মায়ের সৃষ্টির জনক হচ্ছে আমাদের জাতীয় পিতা শেখ মুজিবুর রহমান । এই সুন্দর বাতাস, এই সুন্দর নদী, এই স্বাধীনতা যাকে ছাড়া সম্ভব ছিল না তিনি হলেন আমাদের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । যার কথা আজো আমাদের বুক নাড়িয়ে দেয়, আমাদের বাহুতে শক্তি এনে দেয় তিনি হচ্ছে আমাদের পরম বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।কিন্তু এই বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে কিছু কিছু কুলাঙ্গার এই নেতার বিরুদ্ধে কথা বলে । জাতীয় পিতার গৌরব গাথা ইতিহাস ম্লান করে দিতে চায় । তার ইতিহাস মুছে দিতে চায় ।এই বাংলার মানুষ কি এতই নিমকহারাম যে মাত্র ৪৭ বছর আগের ইতিহাস ভুলে যাবে? জাতির পিতার মহান অবদান অস্বীকার করবে?
‘তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা
তুমি কি তাই টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে
বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির ওপর পড়ে গিয়েছিলে?’

১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের মর্মস্পর্শী দৃশ্যপট এভাবেই চিত্রায়িত হয়েছে কবিতায়। সেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট জাতি দু’দিন পর পালন করবে, শোকাবহ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আঁধার রাতের রূপকল্প কেবল কবিতায় নয়, গানের কলিতেও প্রকাশ পেয়েছে_ ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ’। প্রবীণরা বলেন, সেই রাতে ঢাকার আকাশে কালো মেঘ ছিল, ছিল না বৃষ্টি, ছিল না আঁধার বিদীর্ণ করা নীল জ্যোৎস্না। শ্রাবণের আঁধারে ডুব দিয়েছিল বৃষ্টিহীন রুক্ষরাত। আর এই অমানিশার অন্ধকারে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজধানীর আকাশে-বাতাসে তখনো ছড়ায়নি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে আজানের সুরেলা ধ্বনি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘোর কৃষ্ণপ্রহরে হায়েনার দল বেরিয়ে আসে। নিদ্রাচ্ছন্ন নগরীর নীরবতাকে ট্যাঙ্ক-মেশিনগানের গর্জনে ছিন্নভিন্ন করে ওরা সংহার করে তাঁকে_ ‘লোকটির নাম বাংলাদেশ। শেখ মুজিবুর রহমান।’স্বাধীনতার মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘তার মৃত্যু অমোচনীয় কলঙ্কের চির উদাহরণ কোনোভাবেই কাটবে না অমাবস্যার ঘোর কৃষ্ণপ্রহর কোনো কিছুতেই ঘটবে না এর অপরাধমোচন।’৪২ বছর আগে শেষ শ্রাবণের সেই মর্মন্তুদ দিনে বিশ্বাসঘাতকরা যাকে বিনাশ করতে চেয়েছিল সেই মুজিব মরেননি, বাঙালির হৃদয়-মননে অবিনাশী হয়ে রয়েছেন_

‘ওই তাকে দেখা যায়।
দেখা যায় ওই দিনের রৌদ্রে, রাতের পূর্ণিমায়।
মুজিব! মুজিব!

জনকের নাম এত সহজেই মোছা যায়!’বঙ্গবন্ধুর জলদগম্ভীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল তা বাঙালির শিরায় শিরায় এখনো শিহরণ তোলে। সেই আহ্বান বাক্সময় হয়ে আছে কবিতায়_
‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’বাংলাদেশের হৃদয়সম এ মানুষটির অমরত্বের কথা_
‘সহসা দেখি আমার ছোট্ট ঘরখানির দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব;/গায়ে বাংলাদেশের মাটির ছোপ লাগানো পাঞ্জাবি হাতে সেই অভ্যস্ত পুরনো পাইপ চোখে বাংলার জন্য সজল ব্যাকুলতা’

কাগজ ছিঁড়ে যায়, পাথর ক্ষয়ে যায়, কিন্তু হৃদয়ে লেখা নাম রয়ে যায়। সেই নাম শেখ মুজিব।ইতিহাসই তার স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। ‘তার জন্ম একটি জাতির উন্মেষ, নতুন দেশের অভ্যুদয় তার মৃত্যু অমোচনীয় কলঙ্ক, এক করুণ ট্র্যাজেডি বঙ্গোপসাগর শোভিত ব-দ্বীপে জ্বলজ্বল তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি কোনো বিশেষ দলের নন, দল-মত নির্বিশেষে সমগ্র জাতির। তার মর্যাদা সর্বজনীন।

এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী
ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি
হেরিতে এখনও মানব হৃদয়ে তোমার আসন পাতা
এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।

—-‘ডাকিছে তোমারে / কবি সুফিয়া কামাল

যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

—-কবি অন্নদাশংকর রায়

১৫ই আগষ্ট। জাতীর জন্য এক কলঙ্কময় দিন। জাতীয় শোক দিবস। ৪৩ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে একদল বিপদগামী পাক হায়েনাদের প্রেতাত্মা তথা সেনাবাহিনীর একটি চক্রান্তকারী চক্র সপরিবারে হত্যা করে বাঙালী জাতীর জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালী জাতীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭০ সহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর দ্বার হতে বার বার ফিরে এসেছিলেন, ৭১-এ পাকিস্তানী হায়েনারা যা করতে পারে নাই, সেই কাজটিই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ ঘাতকরা। ওরা মানুষ নামের হায়েনার দল, ওরা শয়তানের প্রেতাত্মা। ওরা জঘন্য। ওরা বিপদগামী হিংস্র জানোয়ারের দল।একদিন যে অঙ্গুলী উচিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর অঙ্গুলি চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয় ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক সেই বাড়িতে। আর কোনদিন ঐ অঙ্গুলি আমাদেরকে প্রেরণা দিতে আসবেনা, দিবেনা মুক্তির বারতা। তবে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি মৃত্যুহীন। প্রাণী হিসেবে মানুষ মরণশীল বলে সবারই একটি মৃত্যুদিন থাকে। তবে কোনো কোনো মানুষের শুধু দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যিনি আমাদের জাতীর পিতা, তার কি মৃত্যু হতে পারে ? না তিনি মৃত্যুহীন। চির অমর।

১৫ আগষ্টের প্রেতাত্মা ও তাদের দোসররা আজও সক্রিয়। আজ ২০১৮ সালের ১৫ আগষ্ট। জাতীর জনকের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী। তিনি ও তার পুরো পরিবার এখনও সেই ১৫ আগষ্টের প্রেতাত্মা ও দোসরদের কাছ থেকে নিয়মিত হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা করে ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের নায়কদের উত্তরসুরিরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। এভাবে কয়েকবার তারা বোমা হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায়।গুলশানে জঙ্গী হামলা, শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলা করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে তৎপর এখনও পচাত্তরের খুনিরা। আজ তারা সংবিধান সংশোধন করা নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে আর একটি ১৫ আগষ্টেরও হুমকি দিয়েছে। তাহলে সত্যিই শেখ হাসিনাকে বা তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও ঐ ১৫ আগষ্টের মত নির্মম হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ? সাম্প্রতিক ঘটনায়ও তাই পরিলক্ষিত হয়। আমরা কি দেশে আর একটি ১৫ আগষ্ট চাই বা কামনা করি ? জাতির বিবেক কী বলে ?

************
লেখক: কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক।

স্মরণে … এ পি জে আবদুল কালাম

২৭শে জুলাই। ২০১৫ সালে এমনই এক দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী তথা আমাদের কাছের মানুষ আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম। যাকে আমরা চিনি এ পি জে আবদুল কালাম নামে। জীবদ্দশায় ৮৪ বছরের দীর্ঘ ও সফল কর্মজীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দর্শন থেকে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য মহামূল্যবান উক্তি। তাঁর থেকে কিছু উক্তি তুলে ধরা হল :

১. স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হল সেটাই যেটা পুরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।

২. তুমি তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং তোমার অভ্যাসই নিশ্চিত ভাবে তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করবে।

৩. একটি ভাল বই একশত ভাল বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভাল বন্ধু একটি লাইব্রেরীর সমান।

৪. সফলতার গল্প পড়ো না কারন তা থেকে তুমি শুধু বার্তা পাবে। ব্যার্থতার গল্প পড় তাহলে সফল হওয়ার কিছু ধারনা পাবে।

৫. যদি তুমি সূর্যের মত উজ্জ্বল হতে চাও, তাহলে প্রথমে তোমায় সূর্যের মতোই জ্বলে উঠতে হবে।

৬. জীবন এবং সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে।

৭. জীবন হলো এক জটিল খেলা। ব্যক্তিত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে তুমি তাকে জয় করতে পার।

৮. যদি তুমি পরাজিত হও, তাহলে হাল ছেড়ো না, কারণ সেটাই তোমার শেখার প্রথম পদক্ষেপ।

৯. End কথার অর্থ কখনওই ‘শেষ’ নয়। End-এর অর্থ ‘Effort Never Dies’ ( চেষ্টা কখনওই বিফলে যায় না) যদি কিছু কোনও কিছু উত্তরে ‘NO’ ( না) শোনো। তাহলে জানবে এর অর্থ ‘Next Opportunity’ ( পরবর্তী সুযোগ রয়েছে)।

# If you fail, never give up because F.A.I.L. means “First Attempt In Learning”

# End is not the end, in fact E.N.D. means “Effort Never Dies”

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক …

আজ ১১ই জৈষ্ঠ্য, আমাদের আর এক প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিন। তাই আজ একটু অন্যরকম ভাবনা শেয়ার করার চেষ্টা …

সম্পর্কে নক্ষত্রেরা

বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলাম। কেমন ছিলো দুজনের মধ্যে সম্পর্ক? বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

**রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক :- ১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষের পরের পাঠককে বসন্তের পুষ্পাঞ্জলি পাঠিয়েছেন।

“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!”

কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

“আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে!”

**রবীন্দ্রনাথ নজরুল সম্পর্ক ২:-

রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাদ বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা।

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বরাবর ছিল ভালো। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ- রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাঁধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক :-৩

কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম বহু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন তা ভেবে অবাক হই।’ সেকালে যারা নজরুলের কাছে গান শিখেছেন, কবি তাদেরকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখিয়েছেন শুরুতে। কাজী মোতাহার হোসেনও নজরুলের কাছে দু’খানি রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখেছিলেন। ‘কে যেন আমারে এনেছে ডাকিয়া এসেছি ভুলে’ এবং ‘তোরা পারবি নাকি যোগ দিতে সেই ছন্দেরে।’
প্রতিভা বসুকে নজরুল প্রথম শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীত ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে।’
উমা মৈত্রকে শিখিয়েছিলেন ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।’
বিখ্যাত ফজিলাতুন্নেসার বোন শফিকুন্নেসাকে শিখিয়েছিলেন ‘হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।’

একবার শান্তিনিকেতিনে যাওয়ার সময় নজরুল ডক্টর শহীদুল্লাহকে গীতাঞ্জলির সব গান স্মৃতি থেকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন ট্রেনের কামরায় যেতে যেতে। রবীন্দ্রনাথ এই কথা শোনার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর উদাহরণ আছে।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক :-৪

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শুনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’ নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’…

এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়।

১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ৫:-

নজরুলের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ)। তরুণ কবির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে —

‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’

“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষনের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।”

এই কাব্যবাণী প্রতি সংখ্যায় ছাপা হতো। এরপর নজরুল সম্পাদনা করেন ‘লাঙ্গল।’ এবারও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন নজরুলকে। প্রথম প্রকাশ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৫।

“জাগো জাগো বলরাম
ধর তব মরুভাঙ্গা হল
বল দাও, ফল দাও
স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।”

মজার কথা হলো, প্রথম শুভেচ্ছাস্তবকটি সবাই জানলেও কোন কারণে পরেরটি তেমন বিখ্যাত হয় নি।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ৬:-

ধূমকেতুর ১২শ সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রতীকধর্মী কবিতা প্রকাশের পর নজরুলকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। ১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো মামলার রায় দেন। এতে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়।

এই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগারে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু সময় ও শরীর অনুকূল না থাকায় তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে বইয়ের এক কপি স্বাক্ষরসহ দেন।

কবিতায় লেখেনঃ

‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু।’
‘সে সুন্দর বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে ‘বসন্তে’র পুষ্পিত মালিকা।’

রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’

পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ৭:-

১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে নজরুল অনশন করেন। এই অনশন ভঙ্গ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় নজরুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে লেখেন, Give up hunger strike, our literature claims you. জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে।

তখন কবিগুরু লেখেন —
*একটি ঐতিহাসিক চিঠি*

কল্যাণীয়েষু,
রথী,
নজরুল ইসলামকে Presidency Jail এর ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম ‘Give up hunger strike, our literature claims you’। জেল থেকে Memo এসেছে The addressee not found; অর্থাৎ ওরা আমার message দিতে চায় না। কেননা, নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অতএব, নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাঁধা দিতে চায় না।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[সূত্রঃ ‘বসুমতী’ পত্রিকা]

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ৮:-

রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি। আরও পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ৯:-

নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জেলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’

উক্ত চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, কবিতা

“হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।..
তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-
তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।…
প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।”

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক ১০:-

কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?’ নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, ‘গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি…।’

**রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক.১১ :-

রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।
_____________________

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তি। তাঁদের মহত্ব বাঙালির গর্বের। একজন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, অপরজন আমাদের প্রাণের কবি, চিরতরুণ কবি নজরুল ইসলাম।

এ বিষয়গুলো সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত।