বিভাগের আর্কাইভঃ সমকালীন

শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থী

একজন মা তার সন্তানের শিক্ষককে সাধারণত বলেন – আপনি শুধু আমাকে হাড্ডিগুলা ফেরত পাঠাইয়েন। তাইলেই চলবে।

এই যে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র /ছাত্রীদের মারার সংস্কৃতি সে বহু পুরনো। একসময় অভিভাবক ও ভাবতেন শিক্ষকের অধিকার আছে তার শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেবার। এবং এই মারপিট করলেই সে পড়াশোনা শিখতে পারবে। ছোটবেলায় আমরা এক মাস বা দুই মাসের জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতাম। আমার কাজিনদের সাথে ওদের স্কুলে যেতাম। আমার এখনো মনে আছে এই শিক্ষকরা কিভাবে গরুর মত পেটাতেন ছোট ছোট বাচ্চাদের। আবার আমরা শহরের স্কুলেও দেখেছি শিক্ষকদের ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াশোনার নাম করে এভাবে নির্বিচারে শাস্তি প্রদান করা। পরের ছেলের গায়ে এভাবে মারামারি করতে হাতের আরাম মনের সুখ। এখানে মনস্তাত্বিক ব্যপার কাজ করে।

যে শিক্ষক ছোটবেলায় নিজেরা যেই আচরণ পান তিনিও সেই আচরণটাই করেন।এই সমাজ প্রভাব প্রতিপত্তি ভালোবাসে। স্কুলে অভিভাবকরা অনেকে অনেক বড় বড় পেশায় আছেন। তারা তাদের সন্তানের স্কুলের শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান এবং সমীহ করেন। ছাত্র /ছাত্রীদের কাছ থেকেও সমীহ পান। সব মিলিয়ে নিজেকে বড় ক্ষমতাধর মনে করেন এবং তার রিফ্লেক্ট তারা শিক্ষার্থীর উপর চাপান। এই সম্মান পেয়ে তাঁরা নিজেদের কি ঈশ্বর ভাবেন ?

আমার ছেলের শিক্ষক একদিন বললেন আপনার ছেলে পড়া শিখে নাই। দুষ্টুমি করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যদি পড়া না শিখে আপনি কি করেন ? উনি বললেন আমি তাকে মাইর দেই। আমি বললাম মাইর দেয়ার জন্য তো আমি স্কুলে পাঠাই নাই। আমি পাঠিয়েছি সে যেনো পড়াশোনা ঠিকমত করে – পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়। সে পড়বে আনন্দের সাথে। আপনি ওকে মোটিভেট করার জন্য কি করেছেন ? উনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমরা সবাই মাইক্রোস্কোপের নীচে পেঁয়াজের কোষ দেখছি। উপুর হয়ে দেখছিলাম। হঠাত আমার পিঠে ব্যথায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলাম। ফিরে দেখি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক নজরুল স্যারকে। জালি বেত নিয়ে আমার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে আছেন। সেদিন জিজ্ঞেস করবার সাহস হলো না কেনো আমাকে মারলেন ? উনি কি ব্যাখ্যা দিলেন আমার মনে নাই। শুধু মনে আছে চোখে জল নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়েছিলাম।

আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার পড়াতে এসে সব মেয়েদের গায়ে তার নোংড়া হাত ঘুরাতেন। স্কুলের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আমরা বড় হই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়। যারা আবার শিক্ষকতার পেশায় যায়। তারা তাদের পূর্বতন শিক্ষকদের নিকট থেকে যে আচরণ পান সেই আচরণ তিনি পরবর্তী জেনারেশনের উপর প্রয়োগ করেন।

আমাকে একদিন একজন বললেন – আপনারা মানুষ গড়ার কারিগর। (যেহেতু আমি নিজেও শিক্ষকতার পেশায় ছিলাম )। তখন বলছিলাম এভাবে বলবেন না। আমাদের প্রচুর শিক্ষক আছেন যারা খুব ভালো চরিত্রের অধিকারী না। বেল্ট ক্লাসে একজন ম্যাডাম ছিলেন উনি বলতেন দেখেন আপনি ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতিযোগী না। তাদের ঝামেলায় ফেলার জন্য না সহযোগিতার জন্যই আপনি শিক্ষক। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। মিথ্যে না। পড়াশোনা করেই জাতি এগোয়। এর বেসিক কাজটা শিক্ষকরাই করে থাকেন। তাদের আমরা সেই সম্মানটাই দিতে চাই।

কিন্তু কতিপয় শিক্ষকের এই মনস্তাত্বিক সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন। অরিত্রির মতো বাচ্চাদের আমরা হারাতে চাই না। পরীক্ষায় মোবাইল নিষিদ্ধ। খুব ঠিক আছে। কিন্তু এর জন্য তার প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ না করলেও হতো। পরীক্ষা হলে মোবাইল আনার শাস্তিস্বরূপ তার পরীক্ষা এক ঘন্টার জন্য স্টপ রাখা যেতো। অথবা তার পরীক্ষা সেদিনের জন্য স্থগিত রাখা যেতো। তাকে পরের ক্লাসে প্রমোশন দেয়ার সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা যেতো। এরকম আরো বহু পথ আছে। সমস্যা থাকলে সমাধান ও আছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর শত্রু না বন্ধু আবার মা-বাবার মত তাদের অন্তরে মমতাও থাকা জরুরী।

এখন নিজের যখন জেল হবে, চাকরীটা সহ হারাবেন তখন উনি বুঝবেন – এর চাইতে বিষয়টাকে সুন্দর ভাবে সলভ করলে আজ এতোকিছু হতো না। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখতে পেতেন – ক্ষমা কখনো কখনো দুর্বলতা না – ক্ষমা আরো দশটা কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারে।

“যেমন কর্ম তেমন ফল-নেতা নির্বাচনে থাকুন সচেতন”

হ্যালো!
হ্যালো!!
হ্যালো!!!
রিক্সাওয়ালাকে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করতে কয়েক বার হ্যালো হ্যালো বলার পরও তিনি শুনছেন না। রিক্সাওয়ালা সোজা রিক্সা থামালেন এক অফিসের দরজায়। রিক্সায় আরোহী ভদ্রলোক অবাক! তার গন্তব্যের বিপরীতে চলে আসায় অনেকটা রাগ হয়েই বললেন।
-আরে বেটা তোরে একটা চড় দিতে মন চায় বুঝলি, তুই যাবি আমার অফিসে আর তুই এলি এদিকে।
-স্যার, রাগ কইরেন না…সময় শেষ তাই আজই কিনতে হবে।
-মানে!
-মানে স্যার নমিনেশন পেপার। আমি ইলেকসনে খারাইমু।
ভদ্রলোক এবার হার্টফেল করার অবস্থা। বলে কি বেটা!।ভদ্রলোকের মুখভঙ্গি দেখে রিক্সাওয়ালাও একহাত নিলেন।
-কেন স্যার! আমরা কি মানুষ না এ দেশের জনগণ না?
-তা কেনো! আমি ভাবছি ইলেকশন করতে হলে তো সামান্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে তাছাড়া নমিনেশন পেপার কিনতে আর জমা দিতে কম করে হলেও পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে।
-কোন সমস্যা নাই স্যার, আমি মেট্রিক পাস আর টাকা! আমার আরো দুটো ব্যাটারী রিক্সা আছে ওগুলা বিক্রি কইরা দিমু।
-এর পর তুমি চলবে কি করে?
-কি যে কন স্যার, আমি পাস করলে কি আর এগুলা চালামু!
-আগে তো পাস করবি তারপর না হয় ভাববি।
-কেন? এ দেশে এতো এতো চোর মাস্তান পাস করতে পারলে আমি পারমু না কেন? হুনছি আমাগো খেলোয়ার মাশরাফি, হিরো আলমও নাকি নির্বাচন করব আমি হেগো থেকে কম কিসে? পরিশ্রম করে খাই হুম। তাছাড়া আর কত কাল এমন গরিবী হালে থাকমু কন? পাস যদি নাই করতে পারি তবে ইলেকসন খারানোর কারনে এলাকায় মানষে আমারে এমপি সাব কইয়া ডাকবো তাতেই আমি কোটিপতি হইয়া যামু। বুঝলেন স্যার, আস্তে আস্তে কই-এদেশে রাতরাতি কোটিপতি হইতে রাজনিতীই হইল এহন উত্তম জায়গা। দেহেন না এহন রাজনিতী কে না করে বলেন! দেশের সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দুই এহন রাজনিতীর কাতারে।

ভদ্রলোক ভাবলেন এর সাথে তর্কে পারা যাবে না। এ দিকে অফিসের সময়ও যায় যায়।
-ঠিক আছে ঠিক আছে, এই নাও তোমার ভাড়া।
রিক্সাওয়ালা ভদ্রলোকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন।
-ছি ছি স্যার লজ্জা দিয়েন না, ভাড়া লাগবে না শুধু দোয়া চাই।
এ কথা বলে রিক্সাওয়ালা রিক্সার চাকায় লক করে নমিনেশন পেপার কিনতে দিলেন দৌড়। ভদ্রলোকটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। আর ভাবেন হায়রে রাজনিতী তুই এখন কোন পর্যায়ে চলে গেলি। না আছে বংশপরায়নপর রাজনীতির অভিজ্ঞতা না আছে শিক্ষা আর জনপ্রিয়তার আলো। ইচ্ছে হলেই, যে কেউ নেতা হতে চায়, হয়েও যায়।

অফিশিয়াল ব্যাগটি হাতে নিয়ে মাথা নীচু করে কিছুটা হেটেই যাচ্ছিলেন তার অফিসের দিকে। হঠাৎ সামনে এসে দাড়ালেন তার এক সহকর্মী।
-আরে স্যার যে, হেটে হেটে কি অফিসে যাচ্ছেন?
-আরে না ভাই রিক্সায় আসছিলাম হঠাৎ রিক্সাওয়ালার সাধ জাগল নেতা হবার। সে অনেক কথা। চলুন ঐ চা দোকানটায় একটু চা পান করে রেষ্ট নিয়ে নেই।

ব্যাস্ত শহরে আজ কাল মানুষের ঢল। আসছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ জাতীয় নির্বাচন। তাই নমিনেশন পেপার কিনতে মানুষের জোয়ার। নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে তেমন কঠিন কোন নিয়ম নীতি না থাকায় দিন দিন বাড়ছে নেতা বা প্রার্থীর সংখ্যা। কখনো দেখা যায় একই ঘরে স্বামী-স্ত্রী, দেবর-ভাবীর নমিনেশন নেয়া এবং নির্বাচনী লড়াই। আজব মানুষ আমরা কোন একটা সেক্টর বা উৎসতে প্রফিটেবল দেখলে যেন আমরাই হ্যামিলনের বাশিঁর সূরে মেতে উঠি।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই সেই দোকানে দল বল নিয়ে হাজির হলেন এক নির্বাচনী প্রার্থী। মার্কার কাগজটি জনে জনে বিলি করছেন তার কর্মীরা আর সে নিজে যখন, যেখানে যাকেই পাচ্ছেন বুকে বুক লাগিয়ে দোয়া ও দাওয়া চাচ্ছেন। ঠিক সেই সময় সেখানে হঠাৎ উদয় হলেন এক উড়নচন্ডী পাগলের। পাগলের শরিরের অবস্থার কথা বর্ননা নাই বা দিলাম তার শরির হতে নির্গত দুগন্ধ যেন আমাদের রাস্তাঘাটে ফেলে দেয়া পচা ডাষ্টের চেয়েও অসহনীয়। সেই পাগল আচমকা প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন… যাবে যাবেগো এবার যাবেগো ইত্যাদি পাগলের যা প্রলাপ।

বেচারা প্রার্থী! নিজেকে খিচ মেরে সংযত রেখে পাগলের আলিঙ্গনকে স্বাগত জানালেন। তৎক্ষনাত তার কর্মীরা এসে পাগলটিকে ধীরে ধীরে নেতার কাছ হতে সরালেন। নেতার শরীরে জামা পুরোটাই ময়লা আর পাগলের মুখের লোল পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। চায়ের দোকানে আর সবাইকে সালাম দিয়ে তড়িৎ তিনি চলে গেলেন তার দলবল নিয়ে। দোকানদারও কিছুটা স্বস্তি পেলেন। সেই দোকানেই বসা দুজন লোকাল বাসিন্দা বলাবলি করছেন।

১ম জন-শালায় একটা ভন্ড!গত বারও এ ভাবে ভোট ভিক্ষা চাইয়া এলাকায় কোন কাম করে নাই খালি নিজের পকেট ভরেছে।
২য় জন-তাতো হবেই! দেখতে হবে না ওর বংশ পরিচয়! ওর জাত খান্দান! ও’তো নন মেট্রিক,ট্রাকের হেলপারি করত। দিন আনতো দিন খেতো। মায় করত বেশ্যাগিরি বাবা করত কুলিগিরি… ও আর কত ভালা হইব! ট্রাকষ্টেসনের সদস্য হইয়া কিছু টাকা কামাইছিলো! সেই টাকার গরমের নির্বাচনে দাড়াইয়া টাকা উড়াইয়া পাস করছিলো। এই বার কি করবে?
পাশেই বসে চা পান করছিলেন ভদ্রলোক ও তার সহকর্মী। লোকাল বাসিন্দাদের এমন তর্কে যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার মন। এক সময় তর্কের সাথে তাল মিলালেন। মাঝে মধ্যে তার সহকর্মীও দু একটা কথা বলে ফেললেন।
-হ্যালো! ভাইজানরা কি এখানকার লোকাল পাবলিক?
-হ’ভাই।
-আচ্ছা, এই যে তর্ক করছেন দুজনে, এখানে কি আমি কিছু কথা বলতে পারি? যদি অনুমতি দেন।
লোক দুটো খুব উৎফুল্ল ভাব নিয়ে অনুমতি দিলেন।
-জি জি বলেন।
-আপনাদের কথায় বুঝতে পারলাম তিনি মানে ঐ যে কিছুক্ষণ আগে একজন নির্বাচন প্রার্থী এসেছিলেন ভোট চাইতে। তিনি সাবেক সাংসদ ছিলেন তাইতো?
১ম জন- জি, এমপি ছিলেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তো তিনি এমপিতে পাস করলেন কি ভাবে? আপনারা মানে জনগণ কি তাকে ভোট দিয়ে পাস করান নাই? নাকি সে ভোট ছিনতাই করে সন্ত্রাসী কায়দায় এমপি হয়েছেন?
২য় জন- না, না, সে ভোট পেয়েই পাস করেছিলো।
-তাহলে তার এমপি হওয়াতে তার দোষটি কোথায়? আপনি আমরাইতো তাদেরকে ভোট দেই তাই না? যদি আমরা আমাদের দেখবালের প্রতিনিধি নির্বাচনে সঠিক যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে বেছে নিতে না পারি তবে তার এমপি হওয়ার পরবর্তী অপকর্মের দায় কার? নিশ্চয় আমাদের?
১ম জন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললেন।
-এবার আসি আপনার শেষের কথায়। আমাদের দেশে প্রতি পাচ বছর অন্তর অন্তর আমরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেই। ভোট দেয়া একটি পবিত্র দায়ীত্ব এবং মৌলিক অধিকার। এখন আপনি আমি যদি সেই পবিত্র ভোটটিকে অপবিত্র করি টাকা খেয়ে তবে দোষ কার? আমি আমার কর্মফল ভোগ করব এটাই চিরন্তন সত্য, তাই নয় কি? সেতো আপনাকে আমাকে টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলল এ অবস্থায় তার কাছ থেকে কি আর কোন সুবিদা আশা করতে পারি? সেতো ভোটে পাস করে তার লগ্নি তুলবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?

তর্ক করা দুজনেই একদম বোবা হয়ে গেলেন। এবার ভদ্রলোকটির সহকর্মী বললেন।
-আর ঐ যে বললেন বংশ পরিচয়!। ভাল এবং যোগ্য নেতা হতে হলে ভাল কোন বংশ পরিচয় লাগে না। জগতে এ রকম বহু উদাহরণ আছে যারা মুচির ঘরে জন্মেও সমাজ সেবায় জীবন দিয়েছেন, হয়েছেন জগৎ বিখ্যাত। তাইতো গুণিজনেরা বলে গেছেন ”জন্ম হোক যথা তথায় কর্ম হোক ভাল”।
আর একটা কথা মনে রাখবেন, যে দেশের রাজনৈতীক নেতারা কেবল মাত্র তাদের স্বার্থ সম্বলিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া কি ভাবে হবে তা ঠিক করতেই পার করে দিয়েছেন দীর্ঘ ৪০/৪৫টি বছর সে দেশের জনগণ হয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে আমাদের ভবিষৎ ভাল করার নেতা নির্বাচনে। শুধু অন্যের দোষ নয় নিজেকেও মাঝে মধ্যে আয়নায় দেখতে হবে নিজের চেহারাটা কেমন। তাই আসছে নির্বাচনে সঠিক নেতা নির্বাচনেই দেশ ও দশের উন্নয়ণ ঘটবে নতুবা আমরা যেই আছি সেই থেকেও পিছিয়ে পড়ব বহুগুণ দূরে।

তর্ক কারীদের মুখ বন্ধ-মাথা নত। শুধু মুখে বলে যাচ্ছেন, জি জি….স্যার।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

ছবি:অনলাইন সংগ্রীহিত।

OBSCENE: from latin obscenus

OBSCENE: from latin obscenus. meaning ill-omened, a sign of fearful future

অবসিন শব্দের অর্থ অশ্লীল। কিন্তু ওপরে দেখা যাচ্ছে, অবসিন এসেছে ল্যাটিন obscenus থেকে, যার মানে “কুলক্ষণযুক্ত”, “এক ভয়জনক ভবিষ্যতের চিহ্ন”।

নগ্নতাকে আমরা অশ্লীল বুঝি, অথচ শুরুতে মানুষ ছিল নগ্ন বা নগ্নপ্রায়, যৌনতা নিয়ে বিধিনিষেধ অনেক সামান্য ছিল, ভাষাকে ভালো-খারাপে ভাগ করে দেওয়া হয়নি। সভ্য-অসভ্যের বাইনারিও তখন অ-তৈরি।

অশ্লীল কী? যা শোভন নয়। কিন্তু অশোভন কিছু আমাদের ভয়ের শাসানি দেবে কেন? বিশেষ করে যখন ওই অবস্থাটার ভেতর দিয়েই এগিয়ে এসে মানুষজাত এ-পর্যন্ত পৌঁছেছে?

সভ্যতা নিয়ে অত বড় ক’রে না ভেবে যদি নিজের বেড়ে ওঠা নিয়েই চিন্তা করি, আমার ন্যাংটো শিশুরূপ সামনে এসে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে ইল-ওমেনড মনে করবো না সেই নগ্নতাকে?

তার মানে, যত দিন গেছে আমরা ভাবতে শিখেছি — অশ্লীলতার বিহার যৌনতাযোগে। সাদা বাংলায়: যে নগ্নতা প্রাপ্তবয়স্কের, যে নগ্নতার যৌনসক্ষমতা আছে, সেটুকুই আসলে অশ্লীল, অথবা — আবার শব্দের মূল মানেতে ফিরে আসি, কুলক্ষণযুক্ত।

এই যুক্তি অনুসরণ করে পাবো: একজন “সুলক্ষণা” নারীর শরীর থেকে পোষাক খসে গেলে সে “কুলক্ষণযুক্তা” হয়ে পড়ছে (পুরুষের বেলাতেও তাই)। মানে, স্বভাবে বা চেহারায় নয়, সুলক্ষণ সুতোর গায়ে লেগে থাকে। সভ্যতা আর অসভ্যতার মাঝখানে এইভাবে পোশাক এসে দাঁড়িয়েছে — থার্ড আম্পায়ার। থার্মোমিটারও বলতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞান বা ক্রিকেট খেলার মতো এখানে কোনও পরীক্ষিত নিয়ম বা কর্তৃত্ব নেই ব’লে আমরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে বুঝি আর বোঝাতে চাই কতোটা নগ্নতাকে অশ্লীল নাম দেওয়া যাবে। কুড়ি পার্সেন্ট, চল্লিশ নাকি শতকরা ষাট ভাগ?

অবসিনিটি-র ধারণা যৌনতার শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করছে। আর কার্য-কারণ নিয়মে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে নগ্নতা যৌনতা ডেকে আনবে (যেমন দুর্গন্ধ বমন-উদ্রেককারী)।

আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বড় ধর্মমতগুলো যৌনতাকে ঠেকানোর চেষ্টা করে গেছে। ক্বচিৎ দুএকজন ছাড়া আমরা কোনও গুরু পেয়েছি কি যিনি যৌনতার শক্তির কাছে “ঈশ্বর” গোহারা হারবে টের পেয়ে তার পেছনে “নরকের ভয়” নামের তদন্ত সংস্থা লাগিয়ে দেননি? বদনামের বন্যা বইয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি যে যৌনতার বহি:প্রকাশ হচ্ছে অশ্লীল মানে obscenus মানে “এক ভীতিজনক ভবিষ্যতের স্বপ্ন”, মানে, ধর্মের ভাষাতে “নরকের ভয়”?

নদীর বান সমুদ্রজোয়ার আটকাতে পারে কিনা আমার জানা নেই, তবে ধর্ম-যৌনতার এই মুটভেড়ে আমরা সেই সৌন্দর্যময় ইনোসেন্ট বিষয়টাকে হারালাম — নগ্নতা। ধর্মরাষ্ট্র থেকে রাজনৈতিক রাষ্ট্রে আসার সময় সভ্যতা লাগেজে করে এই বোঝাপড়া খুব দারুণ বয়ে এনেছে। সভ্যতার এক নম্বর অসভ্যতা হয়তো এখানেই: নগ্নতাকে শহীদ বানিয়ে সে যৌনতার কোমর ভেঙে দিতে চেয়েছিল। আর তাই শরীরের ধারণা হয়ে দাঁড়াল একমাত্রিক, বস্তাপচা কিন্তু ভীষণ গোপনীয়! দেহের অধিপতি হয়ে বসলো পোশাক। কোন দেহ? যে চাঁদের আলো মাখে না, বসে না শিল্পীর তুলির সামনে, মাতৃভাষা ভুলেছে… যে দেহের দর্শক তো আছে, কিন্তু কোনও দর্শন নেই!

আর তাই নগ্নতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু যৌনতা উৎক্ষেপকারী নকল এক স্পেস শাটল।

গুলিস্তান – নয়ারহাট মুড়ির টিন

গুলিস্তান – নয়ারহাট মুড়ির টিন

মাওলানা ভাসানী তখন খবরের শিরোনাম। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে হুজুরের ভূমিকা ছিল খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। অনেকটা সমসাময়িক কাদের সিদ্দিকীর মত। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার প্রায় প্রতিদিন হেডলাইনে থাকতেন এই মজলুম জননেতা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতো সকালের পত্রিকার জন্যে। তো একদিন সকালে এক হকার পত্রিকা হাতে দৌড়চ্ছে আর চীৎকার করছে…মাওলানা ভাসানীর কোন খবর নাই, খবর নাই…। জাতি চমকে উঠল, ভাবল মাওলানাকে গুম করা হয়েছে। হুমড়ি খেয়ে কিনতে লাগল সেদিনের দৈনিক পত্রিকা। কিছুক্ষণের ভেতর পাঠককুল আবিষ্কার করতে সক্ষম হল গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোন খবর নেই। হকারকে আটকে মিথ্যা বলার জন্যে উত্তম মধ্যম দিতে উদ্যত হল জনতা। হকার জানতে চাইলো কি তার অপরাধ। ক্রেতার দল উত্তর দিল, তুই মিথ্যা বলছিস, ভাসানীকে গুম করা হয়েছে তেমন কোন খবর নেই পত্রিকায়। হকার তখন উত্তর দিল; আরে, আমি কি তাই বলেছি না-কি! আমি তো বলেছি ভাসানীর কোন খবর নেই! পত্রিকা পড়ে দেখুন, সেখানে ভাসানীর কোন খবরই নেই। জমায়েত পাঠককুলের হুঁশ হল…আরে তাইতো, আজকের পত্রিকায় মাওলানা ভাসানীর আসলেই কোন খবর নাই!!!

কথা-ছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে বীর-দর্পে ঘুরে বেড়াবে। কিলবিল করবে গ্রাহকের ভিড়। অর্থের বৈভব পাহাড় বাইয়্যা যাবে এবং তাতে জন্ম নেবে দ্বিতীয় প্রকল্প। উড্ডয়ন সাফল্যে রোমাঞ্চিত হয়ে সভা-সেমিনার সহ রাস্তায় বিজয় মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। আজ অনেকদিন হয়ে গেল। মহাকাশ বিজয়ের এই আইকন অনেকটা ধূমকেতুর মত মিলিয়ে গেল মহাকাশের গর্ভে। মাওলানা ভাসানীর মতই এর কোন খবর নেই। সব প্রশান্ত মহাসাগরের মত শান্ত। জাতীয় অর্থ লুটপাটের এই স্ক্যাম একদিন নিশ্চয় উধঘাটিত হবে এবং আমরা জানতে পারবো কার পকেট আর ব্যাংক একাউন্টে ঘুরপাক খাচ্ছে এই স্যাটেলাইট। বলা হচ্ছে যে কোঅরডিনেটে এই আদরের দুলালকে পাঠানো হয়েছে সেখানে গ্রাহক পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।

জোটচিত্র ও ঐক্যের নীতিগত দিক

বাংলাদেশে এখন রাজনীতি নির্বাচননির্ভর। অনেক কিছুই ঘটছে। অনেক কিছুই ঘটবে। সবচেয়ে বড় চমকের বিষয় হচ্ছে, এখন জোটবদ্ধ রাজনীতি। অনেক অপরিচিত রাজনীতিক এখন তাদের দলকে জোটভুক্ত করতে মরিয়া হয়ে আছেন। সংখ্যা বাড়াতে চান তারা। তাদের ভোটের মাঠে শক্তি কেমন- তা দেশের মানুষের অজানা নয়। তারপরও তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এজন্য জোট চাই।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি জোট বেশ সক্রিয়। এই জোটে কারা আছেন- তাদের বাংলাদশের মানুষজন চেনেন। তবে হঠাৎ করে কিছু কথাবার্তা মানুষকে চমকে দিচ্ছে। আসলে এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কে কার পারপাস সার্ভ করছে তা বলা খুবই কঠিন।

হঠাৎ করেই কামাল হোসেন বলেছেন-নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদ পাওয়ার ইচ্ছা তার নেই। অথচ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সবাই জানে তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি গরম করতে এসেছেন!

সংসদ ভেঙে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন কামাল হোসেন। এই জোটে আ সম রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যও রয়েছে। একটি সংবাদ সম্মেলন করে ড. কামাল হোসেন বলেছেন- ‘যারা ক্রমাগতভাবে আমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ, ভিত্তিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করে চলেছেন, তাদেরকে আমি এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বা কোনো রাষ্ট্রীয় পদ পাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোনো নির্বাচনী জোট নয় বলেও দাবি করেন জোটের এই উদ্যোক্তা। তিনি বলেছেন, ‘এই যে আমাদের একটা ঐক্য হয়েছে কয়েকটি পার্টি মিলে, এটা শুধু নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার স্বার্থেই হয়েছে। শুধু ইলেকশনকে অবাধ-নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে আমরা সবাই একে অপরকে সহযোগিতা করব। এটা কোনো ইলেকশন এলায়েন্স অথবা ইলেকশন করার ব্যাপারে না। আমি জানি যে এরকম প্রশ্ন আপনাদের মাথায় আসতে পারে, এই জন্য ক্লিয়ার করছি। ইলেকশনকে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ারের জন্য আমরা সবাই মিলে দায়িত্ব পালন করব, ঘোরাঘুরি করব।’

প্রশ্ন আসতেই পারে এটা কি তবে একসাথে ঘোরাঘুরির নির্বাচন? তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি জনমত গঠন করার প্রয়োজন আছে, এই জন্য আমরা কাজে নেমে গেছি। আজকে এখান থেকে শুরু হলো, কালকে সিলেটে যাব, চট্টগ্রাম যাব, রাজশাহী যাব, আবার ঢাকায় ফিরে আমরা একসাথে মিলিত হব। এখানে নাগরিক সভা হবে।’

এই যে এতগুলো সভা তা কি তবে যৌথ নির্বাচনের জন্য নয় ? মানুষ জানতে চাইছে। এদিকে একটি মাননাহির মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এর পরপরই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সক্রিয় মইনুল হোসেনের একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। যাতে বিএনপিতে তারেক রহমানের নেতৃত্ব ‘ধ্বংস’ করার কথা বলতে শোনা গেছে তাকে। এই অডিও ক্লিপে কথোপকথনে এক প্রান্ত থেকে জনৈক মজুমদার জানতে চেয়েছেন, ‘রিউমার উঠেছে আপনি আর কামাল হোসেন লন্ডন যাচ্ছেন তারেকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে?’

তখন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন , ‘তারেকের সঙ্গে আমরা মিটিংয়ে যাব? এটা কোথাকার ছাগল?… গোট না কাউ? ড. কামালসহ তারেকের সঙ্গে দেখা করতে যাব? আমরা তারেকের নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্যে ড. কামালকে আনছি।’

একই ফোন কলে মইনুল বলেছেন, ‘জেলের ভাত কয়েকদিন খেতে হবে আমাকে। সেজন্য রেডি হচ্ছি। আজকে তো বেইল নিয়ে এলাম। কেইস করলো দুইটা। মামলা কামলার নামই তো রাজনীতি। ঠিক আছে করুক। দেখি।’ এসব নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। ড. কামাল হোসেন তারেক-খালেদার কথা বলছেন উচ্চস্বরে। তাদের মুক্তি চাইছেন। আর মইনুল বলছেন ভিন্নকথা। তাহলে ঐক্যের নামে আসলে কী হচ্ছে!

আরেকটি বিষয় এখন উল্লেখযোগ্য হয়ে পড়েছে। রিয়াদ থেকে ফিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাতে তিনি ব্যারিস্টার মইনুলকে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘দালাল’ বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছেলেকে একাত্তরে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ডের জন্যও দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তিনি বলেছেন- ‘সে কে তা জানেন? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করে বেড়াত। ইত্তেফাক থেকে যে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এর জন্য তো সেও কম দায়ী না, অন্তত আমি এতটুকু বলতে পারি।’

এটা বাংলাদেশের মানুষ জানেন, মানিক মিয়ার ছেলে ব্যরিস্টার মইনুল জরুরি অবস্থার সময় সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ছিলেন। ওই সময় দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এক সময় ইত্তেফাকের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মইনুল এখন নিউ নেশনের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও প্রকাশক। বাবার সম্পত্তি ভাগাভাগির পর ইত্তেফাকের মালিকানা পেয়েছেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তিনি শেখ হাসিনার সরকারে মন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সে (মইনুল) ইত্তেফাকে একটা মার্ডারও করে। নিজে মার্ডার করে নিজের ভাইকে ফাঁসানোরও একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।’ এসব বিষয় কি তবে এখন আবার বেরিয়ে আসবে? সেই খুনের জন্য কে প্রকৃত দায়ী তা কি খতিয়ে দেখবে সরকার! তা নিয়ে এখনই কিছুই বলা যাবে না।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকারকে হটাতে নানা মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। তেমনি একটি ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ইসলামি ছাত্রসংঘের রাজনীতি দিয়েই তার হাতেখড়ি বলে চাউর আছে সর্বত্র। তার কথায় তার গভীর পাকিস্তান প্রেম বেরিয়ে এসেছে।

মাহমুদুর রহমান মান্না সম্প্রতি নাগরিক টেলিভিশনের টকশোতে এসে পাকিস্তান বন্দনায় মুখর হয়েছেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। মান্নার এহেন মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। কারণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচক বলছে, অর্থনীতি, সামাজিক অগ্রগতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

নাগরিক টেলিভিশনের টকশোতে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলে বহুল ব্যবহৃত বাক্যাংশকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে মান্না বলেন, ‘বাংলাদেশ কোন দেশের রোল মডেল বলেন তো? পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো। যাকে আমরা সবচাইতে সমালোচনা করি।’

মান্নার এমন মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে সঞ্চালক তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন ‘পাকিস্তানের অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো?’ উত্তরে মান্না বলেন, ‘হ্যাঁ, ডেফিনেটলি। তাদের গ্রোথ ইয়ে টিয়ে সব দিক থেকে অনেক বেশি স্টেবল এবং তাদের ইনস্টিটিটিউশনগুলো অনেক বেশি স্টেবল।’

অথচ দেখা যাক বাস্তবতা কি ? ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বলতে গেলে কোনো রকম উন্নয়নই হয়নি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ২০ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্কালিন ব্যয় ছিল ১১,৩৩৪ কোটি রূপি আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্কালিন ব্যয় ছিল ৪,৫৯৩ কোটি রূপি। তাছাড়া ১৯৪৭- ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট রফতানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল ৫৪.৭ শতাংশ। কিন্তু রফতানি আয় বেশি করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি ব্যয় বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩১.১ শতাংশ। রফতানি উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানির জন্য ব্যয় করা হতো। আর জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয় যার প্রত্যেকটিতেই পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল দ্বিগুণ।

রাজনৈতিক ভাবেও পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের সরকার গঠনের সুযোগ না দিতে অন্যায়ভাবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাতিল করে সরকারকে উচ্ছেদ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের কথা থাকলেও পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে তা বানচাল হয়ে যায়।

সত্যগুলো হচ্ছে- গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক। জিডিপিতেও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানি ওয়েবসাইট দ্যা কান্ট্রি ইকোনমির তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে পাকিস্তানের জিডিপির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ আর বাংলাদেশে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ ছিল ৭.৪ শতাংশ। আ স ম আবদুর রবের ক্ষমতার রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের জানা। তিনি এরশাদের বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বহুধা বিভক্ত জাসদের একাংশের নেতা তিনি।

গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জেএসডি আয়োজিত ‘গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার : প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার আ স ম রব বলেছেন- ‘রক্ত দিতে হবে, মাঠে নামতে হবে এরপর সরকারকে হটাতে হবে।’

গোলটেবিল-সমাবেশ করে দাবি আদায় হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। প্রথমে হবে সরকার হটানোর, দাবি আদায়ের আন্দোলন। এরপর হবে বাংলার মাটিতে নির্বাচন। তার আগে বাংলার মাটিতে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’

জেএসডির প্রধান বলেছেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে জনগণের সরকার কায়েম করা হবে। সে সরকার হবে যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্বাধীন সরকার। ওই সরকার সবসময় জবাবদিহিতার ভেতরে থাকবে। জবাব দিতে না পারলে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবে।’

এভাবে না না কথা বলা হচ্ছে ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে। এটা রাজনীতির নৈতিক ঐক্য যে নয়- তা বেশ স্পষ্ট। তাই শেষহ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এসব ঐক্য কতটা স্থায়ী হয় নির্বাচন পর্যন্ত। একটি কথা মনে রাখা দরকার, এই দেশটি ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণ। একাত্তরের চেতনার সাথে মোনাফেকি করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার প্রচেষ্টা জনগণ মেনে নেবে না। কারণ এই দেশে এখনও প্রজন্মের মাঝে জাগ্রত রেয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

ফকির ইলিয়াস: কবি, সাংবাদিক। প্রথম প্রকাশ এখানে।

একজন প্রতারক ও তার প্রতারণা!

একজন প্রতারক ও তার প্রতারণা!

১৯৮১ সাল। স্থান নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের আটলান্টিক সিটি। কুয়াশার ফাঁক ফোকর গলে দিনের আলো মুখ খুলতে শুরু করেছে কেবল। পাপের এ নগরী এক অর্থে কখনো ঘুমায় না। জুয়ারিদের ভিড়ে ২৪ ঘণ্টা জমজমাট থাকে ক্যাসিনোর স্লট মেশিন গুলো। রুলেট ও পোকার টেবিল গুলোর আড্ডা একটু দেরী করে শুরু হয়। আটলান্টিক মহাসাগর হতে ভেসে আসা শো শো গর্জন আর ভেতরে জুয়ারিদের চাপা কোলাহল, সব মিলিয়ে পারফেক্ট একটা দিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। পোকার অথবা রুলেট টেবিলগুলোর ব্যস্ততা শুরু হতে বেশ কিছুটা দেরী তখনও। সাধারণত জুয়ার এ দিকটা জমে উঠে রাত গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু আজ কি এক অজানা কারণে একটা পোকার অসময়ে খোলা হয়েছে। জনশূন্য টেবিলের ডিলার বার বার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে এবং উদগ্রীব হয়ে চোখ ঘোরাচ্ছে এন্ট্রান্সের দিকে। লক্ষ্য করলে বুঝা হবে কারও অপেক্ষায় আছেন ভদ্রলোক। ঘণ্টা খানেক পর কালো একটা ক্যাডিলাক এসে থামল ভ্যালেট পার্কিংয়ে। রিসেপসনিষ্ট এগিয়ে এসে খুলে দিল কালো কাঁচের নীচে ঢাকা পড়া সামনের দরজা। মাথায় কাউবয় হ্যাট ও হাতে কালোমতো একটা ছড়ি নিয়ে গাড়ি হতে বেরিয়ে এলেন মধ্যবয়স্ক একজন। হাতের হাতব্যাগটা প্রয়োজনের চাইতেও বড় দেখাচ্ছে। সাধারণত জুয়ারিদের এ ধরনের ব্যাগ বহন করতে দেখা যায়না। ডান-বা না তাকিয়ে আগন্তুক সোজা চলে গেলেন পোকার টেবিলে। পকেট হতে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে তাতে আগুন ধরালেন খুব আস্তে ধীরে। বুঝাই যাচ্ছে কোন তাড়া নেই আগন্তুকের। এবার বেশ সতর্ক চোখে চারদিকে চোখ ঘোরালেন। কেউ লক্ষ্য করছে কিনা যাচাই বাছাই করলেন। সন্তুষ্ট হলেন চারদিকের পরিবেশে। এবার রহস্যময় একটা হাসি উপহার দিয়ে হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন ডিলারের দিকে।

– না, তোমাকে গুনতে হবেনা। যাদের দরকার তারা আগেই গুনে নিয়েছে। পাক্কা ৩.৩৫ মিলিয়ন।’
– উপরের নির্দেশ আমি রাতেই পেয়েছি। তাই গোনা গুনতির ঝামেলায় যাচ্ছিনা। তা চিপসগুলোর কোন এমাউন্টের হলে আপনার সুবিধা হয়?
– তোমার তো তা আগ হতে জানার কথা, নতুন করে তা জানতে চাইছো কেন? কথা ছিল প্রতিটা চিপস ৫ হাজার ডলারের হবে। অবশ্য তোমাদের যদি এর চাইতে বড় কোন অংকের থাকে তাহলে আরও ভাল। কমের হলে বহনে অসুবিধা হবে।
– না, ৫ হাজার ডলারের চিপসই গুনে রাখা হয়েছে। আসুন হাতবদল করা যাক।

ডিলার ব্যাগ হতে টাকার বাণ্ডিলগুলো বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। ভাব দেখালেন যেন তিনি গুনতে শুরু করেছেন। টেবিলের অন্যপাশের ভদ্রলোক দুহাত বাড়ালেন চিপসগুলোর দিকে। তিনিও গোনার ভাব করলেন। দুজনই যে অভিনয় করছেন তা কাছ হতে লক্ষ্য করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। মিনিট পনেরর ভেতর হাতবদল স্থায়ী হয়ে গেল। দুজনেই মুচকি হেসে বিড় বিড় করে কি যেন একে অপরকে বললেন। ভদ্রলোক খালি ব্যগটায় চিপসগুলো ভরলেন এবং হাতের কাউবয় হ্যাটটা আলতো করে মাথায় ঝুলিয়ে উঠে পরলেন। সোজা হাটা দিলেন অপেক্ষমাণ ক্যাডিলাকের দিকে। ভ্যালেট পার্কিয়ের হোষ্ট দরজা খুলে আহবান জানালেন সাইজে ছোট ও টেকো মাথার ভদ্রলোককে। আবারও মুচকি হাসি বিনিময় এবং এ যাত্রায় একে অপরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। কালো ক্যাডিলাক নিকস কালো ধোঁয়া উড়িয়ে নিমিষেই মিলিয়ে গেল নিউ ইয়র্কের পথে।

এখানে এইমাত্র কি ঘটে গেল তা সীমাবদ্ধ ছিল হাতেগোনা কিছু বিস্বস্ত কর্মচারীর মাঝে। এবং তা লম্বা সময়ের জন্য। ১৯৮১ সালের এই ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে ২রা অক্টোবর, ২০১৮ সালে। দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বছরের ইনভেষ্টিগেশনে বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ এসব তথ্য। আটলান্টিক সিটির ট্রাম্পস ক্যাসেল টাওয়ার অর্থ সংকটে ধুকছে তখন। ব্যবসার অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। দেউলিয়া ঘোষণা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দিনটা ছিল ব্যাংকের বেধে দেয়া শেষদিন। একদিন দেরী হলে ক্যাসিনোর মালিকানা চলে যাবে ব্যাংকের কাছে। মালিক ডোনাল্ড ট্রাম্পের কপালের কুচকি দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে দিন দিন। কোথাও কোন তলা না পেয়ে শেষপর্যন্ত হাত পাতলেন পিতা ফ্রেড ট্রাম্পের দিকে। ফ্রেড ছেলের বিপদের দিনে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এমনটা যে হবেনা ডোনাল্ড তা জানতেন। ৩.৩৫ মিলিয়ন হলেই উদ্ধার পাওয়া যায় এ যাত্রায়। বাপ ছেলে মিলে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নিলেন অর্থ বিনিময়ের কাজে। মূল উদ্দেশ্য ট্যাক্স ফাঁকি। পিতা ফ্রেড যদি সরাসরি পুত্র ডোনাল্ডকে এ টাকাটা দিতেন তা হত ট্যাক্সের পরিভাষায় উপহার। যা মার্কিন ট্যাক্স আইনে শতকরা ৫১ ভাগ কর আরোপের যোগ্য। অর্থাৎ, ৩.৩৫ মিলিয়ন ডলারের সিংহভাগই চলে যেত সরকারী খাজাঞ্চিখানায়। প্রতারণার সূত্রপাত এখানেই। যে ভদ্রলোক ব্যাগে করে টাকাটা নিয়ে ক্যাসিনোতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি ছিলেন পিতা ফ্রেডের বিশ্বস্ত লোক। ক্যাসিনোতে এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি জুয়া খেলতে এসেছেন। আর দশটা জুয়াড়ির মত টাকা দিয়ে চিপস কিনলেন। কিন্তু জুয়া খেলার ধারে কাছেও গেলেন না প্রি-প্লান মাফিক। ব্যাগ ভর্তি চিপস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ক্যাসিনো হতে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আয় করলেন ৩.৩৫ মিলিয়ন এবং এ টাকা দিয়ে উদ্ধার পেলেন দেউলিয়া হতে। অথচ সত্যিকার এ অর্থে এ ছিল ছেলের জন্যে পিতার উপহার। সবকিছু পানির মত সহজভাবে সমাধা হয়ে গেল। মাঝখান হতে সরকার মহাশয় বঞ্চিত হলেন প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স হতে। আমেরিকার আইনে এ ধরণের প্রতারণা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কর্পোরেট আমেরিকায় ট্যাক্স প্রতারণা নতুন কোন ঘটনা নয়। হরহামেশাই তা ঘটছে। তবে যারা এসব করছে তাদের কেউই কোনদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া দূরে থাক স্বপ্ন দেখারও সাহস পায়না। অথচ একজন প্রফেশনাল প্রতারক এখন উন্নত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে আছেন। সমস্যাটা এখানেই।

বাবা মা-ও একদিন শিশু হবে

শিশুবেলায় বাবার আঙ্গুল ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে হলেই মনে পড়ে আমার বৃদ্ধ দাদার কথা। দাদা বৃদ্ধ অবস্থায় আমার বাবার সাথে খুব বেশী ঘুরে বেড়াতে চাইতেন। দাদা প্রায়ই কথা বলতে শুরু করলে আর থামতেন না। বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কখনও কখনও একবারে মধ্য রাত পর্যন্ত দাদা কথা বলেই যেতেন। স্মৃতিচারণ, সাংসারিক, জীবনে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা সব কিছুই থাকতো এই আলাপচারিতার মধ্যেই। আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হত যে বাবা সারা রাত ধরে দাদার একই কথা শুনে যায় তবুও কখনও বিরক্তি বোধ করে না এর কারণ কি আসলে !

উত্তর পাওয়ার জন্য অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। দাদা এবং দাদু মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি শূণ্যতা আর অনুভূতির কতটা গাঢ়ত্ব। বৃদ্ধকালে দাদা এবং দাদু দুজনেই একেবারে শিশুর মত হয়ে গিয়েছিলেন। যাই করতেন সব কিছু বাবাকে জিজ্ঞেস করে করতেন। বাবা অনেক সময়ই দেখতাম দাদার বিছানা থেকে ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন এবং আমার মাও সাহায্য করছেন। এত কিছুর পরও দাদা দাদু প্রায়ই একাকী আলাপ করতে এবং বলতেন সেই তারুণ্য ভরা জীবনের গল্পগুলো। এক সময় একজনের মৃত্যুর পর যখন অন্যজন খুব বেশী একা হয়ে যান তখন দেখলাম শিশু আচরণের একেবারে চুড়ান্ত পর্যায়।

ঠিক এই সময়টাতে প্রতিটি মানুষই একদিন আসে। কিন্তু প্রতিটি মানুষই কি আমার দাদা দাদুর মত সঙ্গ পায় ? অনেক প্রতিষ্ঠিত পরিবার গুলোর এখন একক পরিবার হিসেবে থাকতে পছন্দ করছে। বাবা মাকে তারা ঝামেলার মনে করে। একটি পরিবারে যেখানে সন্তান আছে কিন্তু বাবা মা নেই এ বিষয়টি যে অভাবের, তাড়নার তা যেন ভাববার মানুষই পৃথিবীতে এখন আর নেই। আরেক ধরণের পরিবার আছে যারা বাবা মা এর সাথে একসাথে থাকলেও বাবা মায়ের খবর রাখতে যেন খুব অমনোযোগিতা ! তেমনি একটি বাস্তব দেখা গল্প বলি।

আমাদের বাড়ির কাছেই একজন মানুষ যিনি খুব বেশী প্রতিষ্ঠিত সমাজে। রাজনীতির সাথেও খুব বেশী সংশ্লিষ্টতা আছে তার। সে হিসেবে প্রতি ঈদে যাকাতের কাপড় নেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমান মানুষের সমাগম ঘটে তার বাড়িতে। শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে সবার মন জয় করে নেন খুব তাড়াতাড়িই। মানুষ দোয়া করে যায় আর তার মুখে দেখি অনাবিল হাসি !

তার মা বৃদ্ধ অবস্থায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। এক সময় একটি ছোট্ট ঘরে তার মাকে আমরা বেঁধে রাখতেও দেখেছি ! কি সেই মর্মান্তিক দৃশ্য ! চিৎকার করে কান্না আর অভিশাপের চরম হাহাকার দেখে হৃদয়ে দাগ কেটে যেতো বার বার ! প্রতিবেশীরা কিছু বললে তাদের উপরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন তিনি।
আচ্ছা যখন এই লোকটি খুব ছোট ছিলেন তখন মা কিভাবে বড় করে তুলেছেন ? আমার ছোট্ট বাচ্চাটির জন্য রাতে ঘুমোতে পারি না, তার আবদার রাখার জন্য মধ্য রাত্রিতে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে চাঁদ দেখাতে হয়, যখন হাঁটা শুরু করলো একাধারে দু-ঘন্টা ধরে তার হাতে ধরে ধরে হাঁটাতে হত, একটু মন খারাপ হলেই আমার কোলেই অর্ধেক রাত কাটিয়ে দেয় আরও কত কি ! এরকম তো প্রতিটি শিশুই বাবা মা কে ঘিরেই বেড়ে ওঠে। তারপর শিশুরা বড় হয় আর বাবা মায়েরা হয়ে ওঠেন শিশু !

যখন বাবা মায়েরা শিশু হয়ে ওঠেন তখনই যেন ঘোর বিপত্তি। এই বিপত্তি গুলোই প্রবীণদের জীবনকে ঠেলে দেয় অসহায়ত্বের দিকে। বৃদ্ধাশ্রমে না গিয়েও বয়স্ক মানুষেরা অনেকেই আছেন ঘরে বন্ধী হয়ে। দেখার কেউ নেই, কথা শোনার কেউ নেই, নেই মান অভিমানের কোন পরিসমাপ্তির মানুষও !

আপনি যখন পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত তখনই হয়ত আপনার বাবা মা আপনার শিশু জীবনে ফিরতে শুরু করবে। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। আমাদের শিশু জীবনে আমরা যেমন বাবা মাকে ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখি তেমনি আমাদের বাবা মায়েরাও আমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সময় যেন আমরা পাশে থাকি এটাই বড় কর্তব্য। ধর্মগত দিক আর বাস্তবিক দিক যেভাবেই যাই না কেন পিতামাতার স্থান সবার উপরে। সুতরাং এখনি আমাদের মানবিকতার উন্নয়ন ঘটানোর সময়।

পারিবারিকভাবেই শিক্ষা দিয়ে সন্তানকে বড় করুণ যে সন্তানই বাবা মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল। আগে থেকেই শিশুদের বোঝাতে হবে একটা সময় বাবা মাকেই আবার সন্তানের দায়িত্বে থাকতে হয় বা হবে। সঠিক শ্রদ্ধার জায়গায় যদি বাবা মাকে স্থান দেওয়া যায় তবে বৃদ্ধ অবস্থায় বাবা মা কে সন্তানেরা নিজেদের শিশুদের মতই আদরে লালন পালন করতে থাকবে।

আমার বাবা দাদার সাথে যে আচরণ করতেন তা আমার প্রায়ই মনে হয় আর আমি শুদ্ধ হই। একারণেই যৌথ পরিবার প্রথাও প্রয়োজন যাতে করে একজনকে দেখে অন্যজন অনুপ্রাণিত হয়। বয়স্ক মানুষ একটি বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে বসবাস করবে এটাই আমাদের চাওয়া।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রবাসীদের অভিবাদন গ্রহণ করুন

বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আশা করেছেন, আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে। এই আশাবাদ প্রায় সকলেরই। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তার নেতৃত্ব দরকার।

বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভূমিকার জন্য শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। চলতি বছরের শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক উচ্চপর্যায়ের সংলাপে অংশ নেন শেখ হাসিনা। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর, ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, এস্তোনিয়ার প্রেসিডেন্ট কের্স্টি কালিজুলেইদ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি মঘেরনিনি এবং মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ক্রিশ্চিয়ানা স্ক্র্যানার বারগেনার জাতিসংঘ সদর দফতরে আলাদাভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

এবারের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধান সেখানেই হতে হবে। বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমার সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কথা জাতিসংঘে তুলে ধরে এক বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আশাহত হয়েছি, কেননা আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে- আমরা তার আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে যেতে পারেন তার জন্যও আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাচ্ছি।’

নিউইয়র্ক এখন সরগরম। জাতিসংঘ অধিবেশন শুরু হয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভিন্যুর অনেকগুলো সড়কও বন্ধ। বিশ্বের অনেক নেতানেত্রী এখন নিউইয়র্কে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন প্রতি বছর হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই অধিবেশনে যোগ দিতে প্রতি বছরই নিউইয়র্কে আসেন। আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিবারই বিভিন্ন দাবি জানান। কেউ কি এসব দাবি শোনেন? এই দাবিগুলোর কিছুটাও কি পূরণ হয়?

এমন নজির খুব কম। উদাহরণ দেওয়া যায় অনেক। বিমান এখনো নিউইয়র্ক রুটে চালু হয়নি। অথচ গেলো বছরই আমাদের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়ে গিয়েছিলেন। একই কথা এবারও বলেছেন নাগরিক সম্বর্ধনায়। প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগ করে অনেক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। প্লট আর ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীরা কাউকে পথেও নামিয়েছে। দেখার কেউ নেই। দেশে গিয়ে প্রবাসীরা অনেক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। বিচার পাচ্ছেন না। সব রাঘব-বোয়ালের নদী একটাই। তারা এই নদীতেই সাঁতার কাটেন। তাদের কোনো দল-মত নেই, তারা ভোগে মেতে ওঠেন। ব্যবসা-বাণিজ্যও করেন দল-মত ভুলে। শুধুমাত্র টকশোতে তারা একে অন্যের প্রতিপক্ষ। কী আজব এই দেশ!

সরকার যায় সরকার আসে। এটা একটা নিয়মিত প্রসেস। যেসব মন্ত্রী কাজে ব্যর্থ হন- তাদের বাদ দেওয়া হয়। অন্তত শেখ হাসিনার সরকার তেমন কিছু নজির স্থাপন করেছেন। কিন্তু মন্ত্রীরা কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়মিত তাদের রিপোর্ট দিচ্ছেন? তারা জানাচ্ছেন তাদের ব্যর্থতা?

মন্ত্রীরা সবসময়ই বড় বড় ভালো কথা বলেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একজন জাঁদরেল রাজনীতিক। তিনি মিডিয়ার বিষয়ে অনেক কথাই বলছেন। হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘সঠিক তথ্য জনগণের কাছে তুলে ধরা এবং খণ্ডিত তথ্য, মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন, তথ্য আড়াল করা, অসৎ তথ্য প্রচার ও অসৎ সাংবাদিকতাকে নিরুৎসাহিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করবো।’ আমরা দেখছি মিডিয়া এখন বিশ্বের একটি বড় আলোচিত বিষয়। মিডিয়া অনেক সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যাকে উৎসাহিত করছে- বিষয়টা নিয়ে ভাবার অবকাশ তো থাকছেই।

মন্ত্রীরা সব সময়ই বড় বড় কথাবার্তা বলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে সৃজনশীলতা যতোটা না এগুচ্ছে, চুরি-চামারি এগুচ্ছে তার বহুগুণ। এর প্রতিকারে সরকার কী করছে? কতোটা করছে? অপরাধের ধরন, অপরাধীর মানসিকতা বদলাচ্ছে। তাই আগে ছিল না, এমন অপরাধ দমনে নিরাপত্তা আইনও করতে পারে যে কোনো রাষ্ট্রপক্ষ। সমাজ বাঁচাবার জন্য সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আইন প্রণীত হতেই থাকে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা কালে কালে।

আমাদের এ বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে, প্রণীত আইন কখনোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য চাপিয়ে দেন না কিংবা বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জাতি-গোষ্ঠী বর্ণ-ধর্ম বৈষম্যমূলক ঘটনাবলীকেও প্রশ্রয় দেন না বিশ্বের বরেণ্য রাজনীতিকরা। অথচ আমরা দেখি বাংলাদেশে আইনের খড়গ নেমে আসে বিরোধীপক্ষের ওপর। একটা বিষয় আমরা খুব গভীরভাবে দেখছি, যখনই সরকারি বড় কোনো নেতা কোনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তখনই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে খুব সূ²ভাবে। ধরা যাক হলমার্কের কথা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের ছাড় দেওয়া হবে না বলা হয়েছিল। কিন্তু এর মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাংলাদেশে আসলে চলছে এটা সাপলুডু খেলা। সরকারেরই অংশীদার কয়েক নেতাই সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যে। এরশাদ কখন কী বলেন- তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আমাদের মনে আছে, শেয়ারবাজারে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়েছে। ডেসটিনি ইউনিপেটুসহ এমএলএম কোম্পানি মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করে নিচ্ছে। হলমার্ক এতো টাকা লুট করলো, অথচ এর সুরাহার ধীরগতি বিনিয়োগকারীদের হতাশ করছে তো বটেই। এই যে দুই চিত্র আমরা দেখছি, তা আসছে সরকারের ভেতর থেকেই। কোনটা জানবে, মানবে দেশের সাধারণ মানুষ!

আমরা দেখছি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দল গুছানোর কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলে এখন ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনেক ইউনিয়ন আর উপজেলায় সম্মেলন হচ্ছে। এখান থেকেই নতুন নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। গিয়ে ঘুরে আসা নয়। বসে থেকে সম্মেলন করতে হবে’ কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সময় বেশি নেই। আমার বিশ্বাস, আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবো। আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবো।’

আমরা যারা অভিবাসী তারাও একটি উন্নত মাতৃভূমি চাই। আমরা চাই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। কথা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ আপন গতিতেই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির কথা এলেই সামনে চলে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা দেখেছি, দেশের ডানপন্থী একটি পক্ষ তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা প্রয়োজনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু নেই’ এমন তত্ত্বও শোনাচ্ছে যত্রতত্র। যারা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিল, যারা একাত্তরে এ দেশের মা- বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্যই এই সরকারকে মানুষ ভোট দিয়েছিল। সেই বিচার কাজ চলছে। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। ঘাতক রাজাকার আলবদরদের বিচারের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই প্রজন্মকে অবশ্যই মাঠে থাকতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সহনশীলতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে খুব কঠিন কাজ ছিল না। যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রধান দলগুলোকে সমানভাবে সম্মান করতো। এটা হয়নি। বরং কেউ কেউ এই চেতনাকে নিজ স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগিয়েছে। অথচ জাতীয় উন্নয়নে সেটাই প্রধান রক্ষাকবচ। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের এখনো মনে আছে কী চেতনা বুকে নিয়ে তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই শাণিত শক্তির আজ খুব বেশি প্রয়োজন। এ প্রজন্ম বাঙালি জাতিসত্তাকে বলীয়ান করেই বিশ্বে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, সরকার এর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলো না। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো বিএনপি-জামাত জোট যদি রাষ্ট্রক্ষমতা পায় তখন আজ যারা জেলে বসে হাসছে, তারা বেরিয়ে আসবে খুব সহজে। এরপর দেশের পরিণতি কী হবে- তা অনুমান করা কঠিন নয়।

মনে রাখা দরকার দেশের মানুষ জঙ্গিবাদের হোতাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কিন্তু চরম লুটপাটকারীদের হাত থেকেও রেহাই পেতে চায় সাধারণ মানুষ। একটা সময় আসবে, প্রবাসী সমাজ আর দাবি জানাবেন না। তারা ইতোমধ্যে কুয়েত এয়ারওয়েজ, ইত্তেহাদ, কাতার এয়ারওয়েজ, গালফ, তার্কিশ এয়ারকে বেছে নিয়েছেন বাহন হিসেবে। তারা এখন মাতৃভূমিতে নিরাপত্তাহীন হয়ে বিদেশেই বিনিয়োগ করছেন। এর জন্য দায় বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরই নিতে হবে। এভাবে এই প্রজন্ম ক্রমশই স্বদেশবিমুখ হবে। দেশের কথা মনেও করবে না। এর দায় রাজনীতিকরা এড়াতে পারবেন না কোনোমতেই।

আমরা দেখছি, এই প্রবাসেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর দলাদলিতে ব্যস্ত আওয়ামী রাজনীতিকরা। এর অবসান দরকার। কারণ হানাহানি প্রতিপক্ষকেই সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ২০১৮-তেও জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছেন। স্মরণ করেছেন জাতির জনককে। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। আমি যে বিষয়টি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই তাহলো, ফিলিস্তিনি মজলুম মানুষের পক্ষে অনেক বৃহৎ শক্তি যখন কথা বলেনি, তখন বাংলাদেশ কথা বলেছে। কথা বলেছেন এই সময়ের সাহসী বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এভাবেই সত্যের পক্ষে থাকতে চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী- আপনি লাখ লাখ প্রবাসী বাঙালির অভিবাদন গ্রহণ করুন। ন্যায়ের পক্ষে আপনার জয় অব্যাহত থাকুক।

ফকির ইলিয়াস: সাংবাদিক।

জাতীয় ঐক্য ও একটি স্বপ্নভঙ্গের গল্প

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি ‘জাতীয় ঐক্য’র ডাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপির মূল মোর্চায় এই ঐক্যের ছায়াতলে এসে সমবেত হয়েছেন ড. কামাল হোসেন, ডা. বি চৌধুরী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না। হঠাৎ করে এসে শামিল হয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদও। এই প্রকাশ্যে আসার মাধ্যমে সুলতান মনসুর, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন- তা বলাই যায়।

এই ঐক্যে এখন পর্যন্ত একটি দলকে দেখা যায়নি। তারা জামায়াতে ইসলামী। আসেননি জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকীও। মি. সিদ্দিকী আসবেন কী না, তা পরিষ্কার নয় যদিও কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহায়ক শক্তি বিএনপি এই ঐক্যের মূল চালিকাশক্তি। এটা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। বিএনপি বলে দিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েই এই ঐক্য হতে যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে। আমরা জানি বিএনপির মহাসচিব সম্প্রতি আমেরিকা-ইংল্যান্ড সফর করে গেছেন। তিনি জাতিসংঘে নালিশ জানিয়ে ওয়াশিংটন যান। সেখানে মার্কিন স্টেট ডিপার্টম্যান্টে তিনি অভিযোগ জানান বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। এর পরে লন্ডন গিয়ে জনাব তারেক রহমানের কাছে রিপোর্ট দিয়ে ঢাকায় ফিরেন। এই ঐক্য- সেই সফরেরই অংশ। কারণ মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেই ঐক্যে শামিল হয়েছেন।

এই ঐক্য নিয়ে দুটি প্রশ্ন আসছে প্রথমেই। তা হলো- বিএনপি একা যে আন্দোলনের হুমকি ধমকি দিচ্ছিল, তা কি চুপসে গেল? আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিএনপি’র অন্যতম ভোটব্যাংক জামায়তকে নেপথ্যে রেখে ঐক্যের যে মহড়া হচ্ছে, তার আসল পরিণতি কী?

২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। দুটি মন্ত্রীত্ব জামায়াতকে দেওয়া হয়। এমন দু’জনকে মন্ত্রী করা হয়, যারা ১৯৭১ সালে সরাসরি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গোলাম আজমকে পুনর্বাসনের পথ ধরে এই মন্ত্রীত্ব দেওয়াটা ছিল ইতিহাসের অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। বিএনপি মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে দেশে জঙ্গীবাদ কায়েম করেছিল। এই দেশের মানুষ ‘শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের’ তাণ্ডব ভুলে যাননি। একটি ভবন নিয়ন্ত্রণ করতো সকল ক্ষমতা। এসব কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যাননি।

২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের হেরে যাওয়া ছিল সময়ের দাবি। এর পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রপট। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা আনে। নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করার ঘটনা- বিশ্বসবাসীকে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনিয়ে দেয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের আগুয়ান প্রজন্মের হাত দেখে চমকে উঠে দুনিয়ার অনেকেই। এর সবই সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এইবারে টানা আট বছর। অথচ বিএনপি ক্ষমতার জন্য মরিয়া। এই টানাপোড়েন থেকেই বিএনপি পথ খুঁজতে থাকে ক্ষমতায় পুনরায় আরোহণ করার।

কি করেনি তারা! জ্বালাও পোড়াও করে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন তো এরাই! যোড়ষ সংশোধনীর মাধ্যমে এর বীজ বুনতে থাকে বিএনপি-জামায়াত জোট। এর পরের ঘটনাক্রমে সামনে চলে আসেন সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি শ্রী সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। একটা পর্যায়ে বিচারপতি সিনহা দেশত্যাগ করেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল এর জের ধরেই তিনি ক্ষমতা হারান অথবা পদত্যাগ করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর পরপরই এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ উঠলো কি করে!

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ উঠেছিল, যার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরে বিবৃতিটি আসার আগে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন।

ছুটি নিয়ে বিচারপতি সিনহা বিদেশে যাওয়ার আগে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাকে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ আখ্যায়িত করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় নিয়ে সমালোচনার মধ্যে সংসদে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল মন্ত্রীদের কাছ থেকে। সেইবারে তার সহকর্মীদের মধ্য থেকেও একই অভিযোগ এসেছিল।

বিষয়টি প্রকাশের পর আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন খসরু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে বলা হয় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ৩০ সেপ্টেম্বও ২০১৭ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ডেকে নিয়ে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ‘১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তুলে ধরেন। বলা হয়- “দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। তন্মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিচারপতি সিনহার ভাইয়ের নামে রাজউকের প্লট নেওয়ায় অনিয়মের কথা সংসদে বলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথাও বলেছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ব্যাংকে বেনামে বিচারপতি সিনহার অর্থ জমা রাখার কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। এমন অনেক অভিযোগ ঝুলন্ত রেখেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এখন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বলে মিডিয়া জানাচ্ছে। তিনি আবার আলোচনায় এসেছেন একটি বই লিখে।

প্রধান বিচারপতির বই -’ এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নিয়ে না না আলোচনা চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বই ব্যাপক প্রশ্নের অবতারণা করেছে।

একই সাথে একটি রিপোর্ট ছেপেছে ভারতের একটি জাতীয় ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’।পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোষানলে দেশত্যাগী প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করবে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি। ইতোমধ্যে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। দলটির একাধিক শীর্ষনেতা যুগশঙ্খের কাছে বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশটির ‘প্রথম হিন্দু রাষ্ট্রপতি’ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।

যুগশঙ্খের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, এর আগে প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন সুরেন্দ্র কুমারকে বিএনপি তাদের প্রস্তাবিত ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম প্রস্তাবের কথা বলেছিল। বিএনপির একাধিক নেতা ওই সময় বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ‘ঐক্যমতের রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। পত্রিকাটি আরো লিখেছে, বিচারপতি সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করার আলোচনা নিয়ে বাংলাদেশের একাধিক বুদ্ধিজীবীর কথায়, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে ভারতবিরোধীতা বাড়ছে; সেটা কমাতে বিএনপির এই সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও কাজে দেবে। একই সঙ্গে দিল্লির তরফ থেকেও বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাবে।

সব মিলিয়ে একটি ঐক্য এবং এটি ব্রোকেন ড্রিম এখন বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী। এসব নিয়ে তাঁকেও বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক ঐক্য হতেই পারে। কিন্তু সেই ঐক্য যদি হয় জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য হাতিয়ার তবে তা কি বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে?

বিচারপতি সিনহা যা বলছেন, এর জবাব অনেকেই দিতে পারবেন। সবচেয়ে ভালো পারবেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা। যিনি মিস্টার সিনহা বিদেশে চলে আসার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমরা দেখছি, একটি মহল বিদেশে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। এরা খুবই চিহ্নিত শক্তি। এদের অর্থ কোথা থেকে আসছে, তাও
বাংলাদেশ সরকারের অজানা নয়। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এগুতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির জনকের স্বপ্নের বিরোধীরা তাদের মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। এবার তাদের ভালো করে চেনার পালা।

ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।

ভাত

যখন আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে তখন টাকা দিয়ে কি করবেন তার একটা ফর্দ তৈরী করা হয়। সেখানে ভ্রমণের একটা অংশ থাকে, গিফটের একটা অংশ থাকে, অংশ থাকে কিছু মানুষকে আনন্দ দেওয়ার। কতশত ইচ্ছের সাথে যোগ হয় টাকা দিয়ে জলসাঘরে ভালোবাসা কেনা, সুস্থতা কেনার প্রয়োজনীয়তা আর কত যে ছালাম পাওয়ার দাম্ভিকতা তৈরী হয় তারও একটি ফর্দ মনে মনে ঠিক করে মানুষ !

কেউ কেউ রাতে ভাত খেতে পারে না। প্রবল অসুস্থ। বসে থেকে থেকে ডায়বেটিকস হয়েছে। টাকার অধিক ব্যাপ্তিতে ব্লাড প্রেশারও হাই থাকে। কোন রকম খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারলেই যেন শান্তি। তাই কি আর হয় ? মধ্য রাত্রিতে উঠে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে ভাবতে হয় আপন মানুষগুলোর দূরে চলে যাওয়ার দুঃখ, নিজের মানুষের অবহেলার দুঃখ আরও কত কি ! সব কিছুর পরও তার কাছে যা আছে তা হল টাকা। বিশ্বাস করা যায় টাকা দিয়েই ভাত কিনতে হয় ! বিশ্বাস তো করতেই হবে আমাদের।

বিপরীতে খুব রোগাক্রান্ত একজন মানুষ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। প্রতিদিন সকাল হয় শুধু পরের দিনের ভোর দেখার প্রত্যাশায়। তার কাছে ভাতের আকাঙ্ক্ষা নেই। সে স্যালাইনে বাঁচে। তার বাঁচা, শরীরে রক্ত প্রবাহ আর চোখের দৃষ্টি সবকিছুই চলে অন্য মানুষের দেয়া সাহায্যে। কিন্তু এই মানুষটিরও পরিজন থাকে। এরও একটি শিশু থাকতে পারে, শিশুটির বাবার কাছে আকুতি থাকতে পারে, একটা খেলনা দেখে দৌড়ে গিয়ে বাবার কাছে এসে বলতে পারে “বাবা আমাকে খেলনাটা কিনে দাও”! বাবার উত্তর তখন কি এই সন্তানের কাছে ? সন্তান বাবার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বেডের কাছে বসে থাকে। স্ত্রীও বসে থাকে। স্ত্রী বোঝে তার স্বামী রক্ত শূণ্য হয়ে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তারপরও স্ত্রী পাশে থাকে।

কিন্তু স্ত্রী সন্তান কেউ ভাত খেতে পারে না ! যে টাকা মানুষ চিকিৎসার জন্য সহায়তা করে সে টাকায় চিকিৎসাও হয়না ! ভাতের টাকা আসবে কোথা থেকে ? অন্যের ভাত খাওয়া দেখে শিশুটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, সে হিসেব কষতে শুরু করে ভাত খাওয়ার অধিকার হীনতার স্তর বিন্যাসের ! কলা আর বন রুটিতে তাদের দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়ার পরও যে ভালো দিন না আসার চরম বাস্তবতা মেনে নেওয়ার মত কঠিন সত্য মেনে নিয়ে ছেলেটির মা ছেলেটির মুখে বুকের দুধ ঠেলে দেয় ! ছেলেটি ভাতের তেষ্টায় অচেতন হয়ে যতক্ষণে ঘুমের ঘোরে চলে যায় তখন ততক্ষণে মায়ের নিজের ক্ষুধা নিবারণ শুধুই একজন মানুষের বাঁচার আকুতিতে নিঃশেষে বিভাজ্য।

একদিকে শহরের লক্ষ লক্ষ টাকার বিল্ডিংয়ের কাচের চাকচিক্য অন্যদিকে টাকা গচ্ছিত না রেখে তা দিয়ে ভ্রমণ করে দেশ দেশান্তর ঘুরে জীবনের মানে খোঁজা মানুষগুলো আর ঠিক তার পাশ ঘেঁষেই হা-ভাত ওয়ালা মানুষ বড় বেশী অপ্রয়োজনীয় একটা অংশ বলা যায় ….

মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী জেনারেলরা

শেষ পর্যন্ত সত্য প্রকাশ হচ্ছে। মিয়ানমারের কয়েকজন জেনারেলের সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি উঠেছে। কী নারকীয় গণহত্যা হয়েছে মিয়ানমারে! মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যায় ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় মিয়ানমার সেনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্বের কথা তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকেই এ গণহত্যার দায় নিতে হবে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির বেসামরিক নেতৃত্বও এই নিধনযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর তথা সরকারপ্রধান অং সান সু চি তার সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রাখাইনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকারের মাত্রায় তারা অবাক হয়েছেন। জাতিসংঘ এ প্রতিবেদনটি তৈরি করতে শত শত ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছে। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের তরফ থেকে এটাই মিয়ানমারের সংঘটিত নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কড়া হুঁশিয়ারি ও নিন্দা। ইন্দোনেশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব মারজুকি দারুসম্যান এ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিশনের সদস্য ছিলেন শ্রীলঙ্কার রাধিকা কুমারাস্বামী ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টোফার সিদোতি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন মিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা দেয়।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-কে আমরা চিনি। আমরা তার অতীত জানি। তিনি নোবেল পেয়েছিলেন ও কেন তিনি পেয়েছিলেন এই পদক? কারণগুলোও জানানো হয়েছিল তখন।

১৯৯১ সালে অং সান সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে নোবেল কমিটির প্রেস রিলিজে বলা হয়েছিল, ‘নরওয়ের নোবেল কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার অং সান সু চিকে দেওয়া হবে। এটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য তার অহিংস সংগ্রামের জন্য দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন আদর্শ হিসেবে পরিণত হয়েছেন। ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি নোবেল কমিটি অং সান সু চি-কে সম্মান জানাতে চায় বিশ্বের বহু মানুষের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মানবাধিকার ও জাতিগত শান্তি বজায় রাখায় তার শান্তিপূর্ণ সমর্থন ও অবিরত প্রচেষ্টার জন্য।’

প্রিয় পাঠক, এটা হলো ঘোষণাপত্র। কিন্তু বাস্তবে কি দেখছি আমরা? বড় ভয়াবহ আজকের মিয়ানমার। কেন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে? এটা কেমন অমানবিকতা? কেউ কিছু বলছেন না কেন? জাতিসংঘের সংবিধান কি বলছে? আমাদের মনে আছে, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে বন্দি শিবির ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তা নিয়ে কি কোনো তল্লাশি করেছিল বিশ্বসম্প্রদায়? না- করেনি। খবর বেরিয়েছিল, মায়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নির্যাতন করে দেশ থেকে জোরপূর্বক সাগরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করছে দেশটির ক্ষমতাসীনরা। তারপরও বিশ্বের মানবতাবাদী নেতারা পালন করছেন এক ধরনের নীরবতা। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, বর্তমান মায়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভ‚গোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি স¤প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস।

২০১২ সালে, ২০১৬ সালেও একবার এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর হামলে পড়েছিল খুনিরা। কিছুদিন পরে তা কিছুটা স্তিমিত হলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ চলছেই নীরবে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক কথা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় গোত্র দাবি করেন। অথচ সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাতির দেশ মায়ানমারে গণহত্যা চলছে। তারা ভুলে গেছে মহামতি বুদ্ধের অমর বাণী- প্রাণী হত্যা মহাপাপ। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সীমান্ত খুলে দেয়ার এবং অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবিক বিবেচনায় সীমান্ত খুলে দেয়ার কথা বললেও বাংলাদেশ মনে করে, মানবতার দায় বাংলাদেশের একার নয়। কথাটা বাংলাদেশের সরকার ঠিকই বলছে। কারণ মায়ানমারে কোনো যুদ্ধ চলছে না। একটি গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। বিশ্বেও প্রভাবশালীরা কেন মায়ানমারের শাসকচক্রকে ডেকে তা জিজ্ঞাসা করছেন না? বিশ্ব সম্প্রদায়েরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দায় রয়েছে। তাদের উচিত, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানে এগিয়ে আসা।

মনে আছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তল্লাশিচৌকিতে হামলার জের ধরে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতে সেখানকার মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা এখনও রয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে এখনই সময় এসেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও জোট। এই সেপ্টেম্বরেই জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আসছেন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচ্যসূচিতে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ ছাড়া তুরস্কসহ ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বেশ কয়েকটি দেশও বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে যুক্ত করতে চাইছে। দুই সপ্তাহ পর অধিবেশন শুরুর আগের সময়টাতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমারকে আহবান জানাতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

অন্য যে মারাত্মক বিষয়টি সবার নজর কাড়ছে তা হলো- মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু মৌলবাদী-জঙ্গি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যে জঙ্গি গ্রুপ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার মদদ দিচ্ছে। ইতিহাস বলছে, ১৯৭৮ সালে এরকম এক হামলার পর প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরা এখনো বাংলাদেশেই আছে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিহারিরা বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল- এদের প্রজন্মের সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি বলে বলা হচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে অর্থ পাওনা দাবি করেছে স¤প্রতি। কিন্তু তারা তাদের ওই বিহারিদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা একবারও বলেনি গেল ৪৫ বছরে।

ফিরে আসি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে। আগেই জানানো হয়েছে মায়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সম্পর্কিত একটি কমিশন গঠন করবে দেশটির সরকার। আমরা জানি না কফি আনান কমিশনের সর্বশেষ অগ্রগতি কি! এই কমিশন মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা ও তাদের ঘিরে দেশটিতে যে সংকট রয়েছে তার সমাধান খোঁজার জন্য কাজ করছিল। তবে, নতুন এই কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে চলমান সংকট নিয়েও কাজ করবে কিনা সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। জাতিসংঘের ভাষায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটি। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাস, যারা পৃথিবীর কোনো দেশের নাগরিক নয়। দেশটি রোহিঙ্গাদের তার নাগরিক মনে করে না। বরং মিয়ানমার মনে করে তাদের আদি আবাস বাংলাদেশ। এমনকি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারেও দেশটির সরকারের আপত্তি রয়েছে। এসব বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সাং সুচি বহুদিন যাবৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করেননি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই নেত্রী রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে কথা বলবেন সেটাই বিশ্ব প্রত্যাশা করেছিল। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি চাইলে এই সমস্যার জোর সমাধান দরকার। সু চি কি তাহলে তার অবস্থানের পরিবর্তন করেছেন? কেন করেছেন? তিনি তো ‘শান্তির’ জন্যই নোবেল পেয়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন-নেপাল-শ্রীলঙ্কার যৌথ আলোচনা দরকার। মায়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা দরকার, বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য। কারণ রক্তাক্ত সহিংসতা আরো রক্তপাতের জন্ম দেয়। যা প্রতিবেশী দেশের শান্তি খুব সহজেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। সুচি, মানুষের রক্ত নিয়ে খেলছেন। এর পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে। মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে। যা সংকট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ হওয়া দরকার। এই তীব্র আর্তনাদের সমাপ্তি দরকার।

___________________

ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।
প্রথম প্রকাশ : এখানে।

তেতো কথা!

তেতো কথা! “ধর্ষণে টপ লিস্টে আছে আমেরিকা, ইউরোপ, বাংলাদেশ নেই”– কি করে জানলে?
বাংলাদেশে তো ধর্ষণের কেইস হয় না, ধর্ষিতার সমাজে ঠাঁই হয় না, ধর্ষিতার বিয়ে হয় না। ফলে ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। তাই প্রতিদিন কত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার পরিসংখ্যান জানা যায় না। বাংলাদেশে নারী মূর্তিও ধর্ষিত হয়, দেবী প্রতিমাও ধর্ষিতা হয়।

৯৫ বছরের বুড়াও নারীকে তেঁতুল ভেবে জিভে লালা দিয়ে টকর টকর আওয়াজ তোলে, এটাও ধর্ষণ। ধর্ষণ যে করে, সে ধর্ষণের সংজ্ঞা জানেনা, ধর্ষিতা যে হয়, সেই শুধু জানে ধর্ষণের সংজ্ঞা। শফি হুজুরের তেঁতুল তত্ত্বে বাংলাদেশের সকল নারী ধর্ষিত হয়েছিল।

ধর্ষিতার মৃত্যু দেখানো হয় ভালুকের কামড়ে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দুই রকম আসে, প্রথমে বলে, ধর্ষণ হয়েছে। দুই দিন পর কবর থেকে গলে যাওয়া দেহ পরীক্ষা করে বলা হয়, ধর্ষণের আলামত নেই। তাহলে??

যাও বা সাহস দেখিয়ে দুটো মেয়ে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল করলো, তাতেও প্রশ্ন উঠেছে, মেয়ে কেন বাইরে গেলো? মেয়ে কেন ছেলে বন্ধুর নিমন্ত্রণে হোটেলে গেল? ধর্ষণের এক মাস পরে কেন অভিযোগ?

** শিশু পূজা কোন হোটেলে গেছিলো? তনু কোন ছেলের সাথে গেছিলো? মাদ্রাসায় ছোট ছেলেদের বলাৎকার করা হচ্ছে কেন? মাদ্রাসা তো পবিত্র স্থান!
বাকোয়াজদেরও নির্লজ্জতার সীমা থাকা উচিত!**

আমার বন্ধুদের মধ্যে দয়া করে আর কেউ বোকার মত বলো না, “ধর্ষণে আমেরিকা সবার উপরে, বাংলাদেশে ধর্ষণ হয়না।” কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে!

আমেরিকা ধর্ষণ লিস্টে কেন টপে আছে জানতে চাও? একটা ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি।

ওয়ালমার্টে একদিন কাজের ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে অন্য এক ডিপার্টমেন্টে গেছি। সেখানে পরিচিত এক মেয়ে এসোসিয়েটকে না দেখতে পেয়ে তার সহকর্মীকে ( ছেলে) জিজ্ঞেস করলাম, “আমান্ডা( কল্পিত নাম) আজ আসেনি?”
সহকর্মী বলল, “আমান্ডা আজ পুলিশের কাছে গেছে”।
-কেন?
-গত সন্ধ্যায় ওর এক ছেলে বন্ধু ওর ফ্ল্যাটে বেড়াতে এসেছিল। ড্রিংক করেছে , হাসি গল্প করেছে এরপর নাকি বন্ধু ওকে জোরপূর্ব্বক ফিজিক্যালি এবিউজ করেছে। তাই ও তখনই পুলিশ কল করেছিল। পুলিশ এসে বন্ধুকে নিয়ে যায়। সেটারই রিপোর্ট করতে হবে আজ, তাই ও আজ আসেনি”।

এই কারণেই আমেরিকার নাম সব কিছুর টপে দেখা যায়; কারণ আমেরিকানরা কোন কিছু নিয়ে লুকোছাপা করেনা অথবা লুকোছাপা করে রাখতেও পারে না। সব প্রকাশিত হয়ে পড়ে অথবা বিনা দ্বিধায় যার যার সমস্যা সে জায়গা মত প্রকাশ করে। আইন এদেশে সকলের জন্য প্রযোজ্য।

ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি হলেও গর্হিত অপরাধ। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমেরিকাতেও ঘটে, তবে আমেরিকায় ধর্ষিত/ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়না, তাকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা দেয়া হয়, সমাজ তাকে মানসিক এবং মানবিক সাপোর্ট দেয়। ফলে যে কোন ধরণের লাঞ্ছনার অভিযোগ পুলিশি বইয়ে নথিভুক্ত হয়, তাতেই পরিসংখ্যানে ধর্ষণ লিস্টে আমেরিকার নাম টপে, আর আমেরিকার নাম টপে দেখতে পেয়েই গর্বিত বাংলাদেশীরা খুশিতে বগল চাপড়ায়। ১৬ই মে, ২০১৭।

১৬ই মে, ২০১৮ তে পৌঁছে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে একটি কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রথমে। এরপর পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে। শেষে উপায় না দেখে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করেছে।

হ্যাঁ, আপনাদের কথাই ‘ধ্রুব সত্য, ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে। কথা সেটা নয়, ধর্ষণে শীর্ষে থাকা অথবা মাঝে থাকা নিয়ে আলোচনা হতে পারেনা। কথা হচ্ছে, ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ কিনা! অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী সনাক্ত হবে কিনা, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে কিনা, অপরাধী শাস্তি পাবে কিনা! আমেরিকা ধর্ষণের শীর্ষে থাকলেও ধর্ষণকে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকায় ধর্ষককে অপরাধী গণ্য করা হয়, ধর্ষিতাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় না। ধর্ষিতা পরিবারের কাছে, আইনের চোখে, সমাজের চোখে নিগৃহীত হয় না। আমেরিকায় ধর্ষিতা আত্মহত্যা করে না।

এদিক থেকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিন্তু শীর্ষে। এসব দেশে মেয়েরা প্রথমে পুরুষের চোখের দৃষ্টিতে ধর্ষিত হয়, পরে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হয়, এরপরের প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে ধর্ষিত হয়। তিন ধাপে ধর্ষিত হওয়ার ধকল যে মেয়ে সামলাতে পারেনা, সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

এসব দেশে ধর্ষক পায় বীরের মর্যাদা, ধর্ষিতা পায় অপরাধীর তকমা। লোক জানাজানি হলে ধর্ষিতার কোনদিন বিয়ে হবেনা তাই ধর্ষণের ঘটনার কথা প্রকাশিত হয় না। ঘটনাক্রমে ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে মিডিয়ায় যে হই চই শুরু হয়, তাতে প্রতিবাদের চেয়েও অনেক বেশি প্রকাশ পায়, মানুষের কৌতূহল।

সকলের রসালো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেঃ ধর্ষিতা মেয়েটি দেখতে কেমন, সুন্দরী হলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে! ধর্ষিতার পরনে কি পোশাক ছিল, শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে পেটের অংশ দেখা গেলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে, ধর্ষিতার গায়ে বোরকা ছিল কিন্তু বোরকা ছিল টাইট, ফলে তার দেহের বিশেষ অংশের ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মেয়েদের বুকের ভাঁজ, কোমরের খাঁজ যদি স্পষ্ট দেখা যায়, ধর্ষিতা না হয়ে উপায় কি!

এসব কৌতূহল, মুখরোচক আলোচনার আড়ালে চলে যায় ধর্ষকের চেহারা, জেগে উঠে ধর্ষিতার মুখ। ধর্ষক আইনের আওতার বাইরে চলে যায়, ধর্ষকদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়না, ধর্ষকের বিচার হয় না। তাই প্রতিদিনের ধর্ষণের ঘটনা নথিপত্রভুক্ত হয়না। এজন্যই ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে, বাংলাদেশ সর্বনিম্নে।

সকলেই তো পূর্ণিমা শীলের মত সাহসী, আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা হয়ে বড় হয়ে উঠতে পারেনা। গণধর্ষণের শিকার হয়েও যে মেয়ে নিজের পায়ে ভর করে মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে পারে, তাকে তো ‘সাহসিকা’র খেতাব দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ণিমা শীলকে তেমন কোন খেতাবেই সম্মানিত করা হয়নি, বরং পূর্ণিমা শীল নামটিকে রাজনীতির দাবাখেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এতকাল।

বাংলাদেশের মেয়েদের পিতামাতাদেরও এতকালের ঘুণে ধরা চিন্তা ভাবনার বেড়াজাল ছিঁড়তে হবে। তাদের বুঝতে হবে, ধর্ষণের মত পাশবিক ঘটনায় একটি মেয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত থাকে। সেসময় মেয়েটির পাশে থেকে তাকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা উচিত। নাহলে ঘরের মানুষদের মলিন মুখের ফুঁয়ে তাদের জীবনের আলো নিভে যেতে পারে।

লোকলজ্জার ভয় পাওয়ার পুরাতন নিয়ম ভাঙ্গতে হবে। মেয়েটিতো আপনাদের, তাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আপনাদেরই। কন্যাকে দোষ দেয়া নয়, মেয়েটিকে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সাহস দিন। যদি পারেন ধর্ষক পুরুষটিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে এনে গাছের সাথে বেঁধে জুতা পেটা করে বুঝিয়ে দিন, আপনার কন্যাকে অপমান করার ফল কি হয়!

মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রকাঠামোর আয়না

আমরা যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি, তা কোথায় আছে? ইউরোপে-আমেরিকায়? না- নেই। মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্যের কথা বাদই দিলাম। আপনারা কেউ যান তো নিউইয়র্ক টাইমসে একটি বিজ্ঞাপন দিতে, বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ওরা আপনার বিজ্ঞাপন নেবে? না- নেবে না।

বলুন আমরা প্যালাস্টাইনে গণহত্যার বিচার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতে চাই। ওরা ছাপবে না। কেন ছাপবে না? কারণ দুনিয়ার কোথাও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। যা আছে- তা মেকি। লোক দেখানো। একটা তন্ত্রশাসিত স্বেচ্ছাচারিতার নামই আজ গণতন্ত্র। সবখানেই। ট্রাম্প সাহেবের নাম না হয় না-ই নিলাম।

বাংলাদেশে এই সময়ে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র নামে এক ধরণের পেশবাজি চলছে। যার যা ইচ্ছে তা বলছে। রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধেই দাঁড়াচ্ছে কখনও কখনও। চিত্রসাংবাদিক শহিদুল আলম এই সময়ে একটি বড় উদাহরণ। তিনি আল-জাজিরা টিভির সাথে যা বলেছেন, তা সবাই দেখেছেন। ফেসবুকে লাইভ যা বলেছেন তাও অনেকেই দেখেছেন। আমিও দেখেছি। আর দেখেছি বলেই, এই লেখাটি লিখছি। দেখেন নি আমাদের জাফর ভাই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই সময়ের প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী তিনি আমাদের। তিনি এই বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি তরুণকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করেছেন। আমরা তার কাছে ঋতী। না- তিনি শহিদুল আলমের ফেসবুক লাইভ দেখেন নি। তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন একটি লেখায়। যা গত ১০ আগস্ট ২০১৮ শুক্রবার দেশের অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম-‘আমরা জানতে চাই’। তিনি লিখছেন- ‘তার দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে ফেসবুক লাইভে তার বক্তব্যের কথা শুনতে পাচ্ছি। ফেসবুক লাইভ বিষয়টি কী আমি সেটা সঠিক জানি না। সেখানে তিনি কী বলেছেন সেটাও আমি জানি না, কিন্তু যেটাই বলে থাকেন সেটা তার বক্তব্য। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বিশাল ষড়যন্ত্র করে ফেলেছেন, সেটি তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপত্তিকর কিছু বলে থাকলে, কেন সেটি বলেছেন সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে, তারচেয়ে বেশি কিছু তো হওয়ার কথা নয়। আমি শুনেছি তার থেকেও অনেক বেশি আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার পরও অভিনয় শিল্পীদের অনেকে পার পেয়ে গেছেন, তাহলে খ্যাতিমান সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই আলোকচিত্র শিল্পীর ওপর এই আক্রমণ কেন? যদি সত্যিই তিনি ষড়যন্ত্র করে থাকেন, আমরা সেটি জানতে চাই।’

এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। ‘দৃক’ গ্যালারির শহিদুল আলম একজন খ্যাতিমান চিত্রসাংবাদিক। দেশে বিদেশে তার অনেক পরিচিত জন আছেন। তিনি অধ্যাপিকা রেহনুমা আহমেদ এর স্বামী। চিত্রসাংবাদিক শহিদুল আলমের পিতার নাম ডা. কাজী আবুল মনসুর। তিনি ১৯৯৬ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’ পান। ১৯৯৬ এর মার্চ মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই পদক ঘোষণা করেন। মনে রাখা দরকার, ৫ বছর মেয়াদ শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার সরকার গঠন করেন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ আবার পদত্যাগ ও করেন বেগম খালেদা জিয়া। তাই পদক প্রদানের এই সময়টি সকলের খেয়াল রাখা দরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ এর ১২ জুন নির্বাচনে জিতে। ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তাই আওয়ামী লীগ ডাঃ কাজী আবুল মনসুর কে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েছিল এই বিষয়টি সত্য নয়। পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ডা. মনসুরের স্ত্রী, আনোয়ারা মনসুরের হাতে পদকটি তুলে দেওয়ার রুটিনওয়ার্ক সম্পন্ন করেছিলেন শেখ হাসিনা।

উইকিপিডিয়ায় সকল তথ্য সংরক্ষিত আছে। বলে রাখি, আনোয়ারা মনসুর মূলত ছিলেন ৭১ সালে পাক বাহিনীর এজেন্ট। যা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে সবিস্তারে লিখেছেন। আমরা শহীদ জননীর ভাষ্য থেকে জানতে পারি- ‘১৯৭১ সালে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুরের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টর কমা-ার খালেদ মোশারফের দুই কন্যাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গৃহবন্দী করে রাখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাদল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী ও তার মাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। যদিও বাদলের মাথার ওপর মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছিল। কিন্তু তা সত্বেও ঢাকার বিখ্যাত ক্রাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা বদি (মোহাম্মদ বদিউল আলম বীর বিক্রম-পরে শহীদ), কাজী, স্বপন, চুল্লু ড. আনোয়ারা মনসুরের বাসা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ড. কাজী আনোয়ারা মনসুরের বাসা এলিফ্যান্ট রোডের ‘নাসেমন’ সরকারী ভবনে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে যায়। নিচে চুল্লু গাড়ি স্টার্ট করে বসে থাকে। সেখানে ড. আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খালেদ মোশাররফের মেয়ে বেবী ও রূপনকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে তর্কাতর্কি হয়, এ সময় কেউ একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খবর দেওয়ার জন্য টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা স্বপন দেয়ালে গুলি করেন। ড. আনোয়ারা মনসুরের বড় বোন বাঁধা দেওয়ার জন্য আসলে তার পা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। গুলি পায়ের চামড়া ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। ড. আনোয়ারা মনসুরের মাথায় স্টেনগান দিয়ে আঘাত করে মুক্তিযোদ্ধারা, তখন তিনি খালেদ মোশাররফের ছোট মেয়ে রূপনকে জাপটে ধরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বেশি সময় ছিল না। তারা রূপনকে রেখে বেবীকে কোলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। নিচে লোক জমা হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত গাড়ি নিয়ে মিলিয়ে যায়। তারপর তারা খালেদ মোশাররফের ক্যাম্পে গিয়ে তার বড় মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়।

উল্লেখ্য, ড. শহিদুল আলমের মা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুর ছিলেন ঢাকার আজিমপুরে অবস্থিত অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। (তথ্যসূত্র: ‘একাত্তরের দিনগুলি’,পৃষ্ঠা-২৩০ সন্ধানী প্রকাশনী, চতুর্বিংশ মুদ্রণ, প্রকাশকাল: ২০০৩)

শহিদুল আলমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কেন করেছে, তার কিছু কারণ দেখা দরকার। শহিদুল আলম আল-জাজিরা টিভিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেটি দেখলেই বুঝা যায় – নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তিনি বর্তমান সরকারকে অবৈধ আখ্যায়িত করে তার ক্ষোভ ঝাড়তে থাকেন একতরফা। আন্দোলনে দাবি মানা হয়েছে, ছাত্রদের সংযত হওয়া দরকার এমন একটি কথাও বলেননি এই সিনিয়র সাংবাদিক। বরং তার বক্তব্য ছিল এরকম, যেন এই মুহুর্তেই সরকারের পতন হোক!

শহিদুল আলম এই কাজটি খুব জোরেশোরেই করে আসছিলেন তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে। ৪ আগস্ট ২০১৮ তার নিজের ফেসবুকে তিনি বেশ কয়েকবার লাইভে আসেন। দেড় থেকে তিন মিনিটের স্থায়ী এসব লাইভ ভিডিওতে তিনি চোখে মুখে বেশ আতংক নিয়ে ইংরেজিতে কথা বলেন। যা পুরোটাই ছিল সরকারবিরোধী। ছাত্র আন্দোলনের বিষয়গুলো ছিল তার ভাষ্যে অত্যন্ত গৌণ। একটি বিষয় আমরা দেখছি, প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করে উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ, রিপোর্ট, চিঠিপত্র লেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের পুলিশ কি সবাইকে গিয়ে গ্রেফতার করছে? না করছে না।

তাহলে শহিদুল আলম কেন গ্রেফতার হলেন? এর কারণ হলো, তিনি খুব সচেতনতার সাথে ইংরেজিতে লাইভ করে বিদেশিদের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের দিকে এবং তা তিনি করেছেন দেশের অভ্যন্তরে থেকেই। সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মুখপাত্র হিসেবে তিনি বিবেকহীন প্রোপাগান্ডায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। রিমান্ডের নামে কোনো নির্যাতনই গ্রহণযোগ্য নয়। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাকে ডাক্তার দেখানো থেকে বঞ্চিত করাও রাষ্ট্রের কাজ নয়। ছাত্ররা ঘরে ফিরেছে। সড়ক ও পরিবহন আইন হচ্ছে।

এই ছাত্র আন্দোলন কিন্তু শুরুতে গণ অধিকার আন্দোলন ছিল। কিন্তু এটাকে যখনই রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে- তখনই তা ইমেজ হারিয়েছে। আমরা দেখছি আজ একটি মহল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য পিটিশন সাইন কালেক্ট করছে। এরা কারা ২০০১-২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জঙ্গীরাষ্ট্রের তকমা পেতে যাচ্ছিল- তখন কোথায় ছিলেন তারা? বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে হরে দরে দোষ দিয়ে লাভ হবে না। এই দেশে ছাত্রদল, শিবির, থাকলে ছাত্রলীগও থাকার অধিকার রাখে। আজ হঠাৎ করে যারা আওয়ামী লীগকে বধ করতে গিয়ে বিশ্বে গোটা দেশ ও জাতিকেই পদদলিত করার পায়তারা করছেন- তাদের আসল মতলব কী? তারা সরকার বদল চান। এর জন্য ভোটে আসতে হবে। তারা তো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও জয় পাচ্ছেন। তাহলে পেছনে ছুরি মেরে সরকার পতনের এতো খায়েশ কেন তাদের?

গণ-অধিকার আন্দোলনের মোড়কে সরকার পতন ঘটানো যায় না। আরব বসন্তের আদলে ‘বাংলা বসন্ত’র হাওয়া যারা গায়ে লাগাতে চেয়েছিলেন তারা চিহ্নিত হচ্ছেন ক্রমশ। এখন দেখা যাচ্ছে হেলমেটধারী যারা ধরা পড়ছে এরা বহিরাগত এবং বিএনপি-জামায়াতের সদস্য। রাষ্ট্রকাঠামোর আয়নায় মানুষের আশা-আকাঙ্খা দেখা যায়। দাবি করতে হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে। নিরাপদ সড়কের দাবি তেমনই ছিল। এটাকে দলীয় হীন স্বার্থে কারা ব্যবহার করলো- আমরা এদের প্রকৃত পরিচয় জানতে চাই।

_________________
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।

কবর হতে উধাও হয়ে গেছে চার কংকাল …

কবর হতে উধাও হয়ে গেছে চার কংকাল…

কনটেম্পোরারি কনটেক্সটে বাংলাদেশের জন্য এটা কোন খবরই না। যেখানে কবর হতে লাশ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়, সেখানে কংকাল তো কোন ফ্যাক্টরই না! কোমল মতি বিশ্বাসীদের বিশ্বাস করানো কঠিন হবেনা যদি বলা হয় ধর্মীয় রোডম্যাপের ট্রেইল ধরে লাশ চলে গেছে তার আপন ঘরে। অর্থাৎ ফেরেশতারা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন সৌরজগতের বাইরে অন্য এক জগতে। যেখানে কৃতকর্মের জবাবদিহিতে শুরু হবে লাশের। কিন্তু বর্ণনায় যখন কংকাল উঠে আসে তখন ধরে নিতে হবে এখানে ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে অন্যকিছু আছে। এই যেমন চেতনার ফাঁক-ফোঁকর গলে ব্যাংকের ভল্ট হতে সোনা-দানা, হীরা-জহরত অথবা থোকা থোকা নগদ বেরিয়ে যায়। কবর আর ব্যাংকের ভল্ট আমার কাছে সব সময় এক ঔরসে জন্ম নেয়া মায়ের পেটের খালাত ভাইয়ের মত মনে হয়েছে। লাশের মত সোনা-দানাও যখন ভল্টে যায় ওদের প্রাণ থাকেনা। পার্থক্য একটা আছে বৈকি; লাশকে কবরে পাঠানো হয় চোখ আর নাকের পানিতে একাকার করে। আর সোনা-দানার দাফন হয় লোলুপ দৃষ্টির কামনা বাসনায়।

বলাই বাহুল্য মানব সভ্যতার নতুন করে খৎনা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে। যার কারণে লাশ, কংকাল আর ভল্টের সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে পালা করে। চার হাজার কোটি যেমন এখন কোন টাকা নয়, তেমনি লাশও কোন বস্তু না। স্রেফ হিউম্যান ওয়েস্ট। এখানেই আসে আইনস্টাইনের পদার্থের সৃষ্টিও নাই, ধ্বংসও নাই, ও এক অবস্থান হতে অন্য অবস্থানে রূপান্তরিত হওয়ার তত্ত্ব। সেই তত্ত্বের গবেষণা চালাতেই কি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা কবর খুঁড়ে চারটি কঙ্কাল চুরি করে নিলো? হতে পারে। গবেষণার গিনিপিগ পাওয়া না গেলে হিউম্যান ওয়েষ্ট ব্যবহার কতটা বৈধ তা ৫৭ ধারা নামক আওয়ামী হাদিসে নিশ্চয় লিপিবদ্ধ আছে। এসব অব্শ্যই আমার মত ম্যাঙ্গোর জানার কথা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে একই পরিবারের চারটি কংকাল একসাথে খোয়া গেছে। লাশ হতে মাংস খসে কংকাল হওয়ার বয়স খুব একটা বেশী ছিলনা। চার মাস হতে শুরু করে এক বছর পর্যন্ত।

উপসংহার হচ্ছে; গোটা বাংলাদেশই এখন একটা কবর। এখানে ১৬ কোটি জীবন্ত লাশ খাদ্য হয়ে শুয়ে আছে একদল শকুনির অপেক্ষায়। শকুন আসবে… লাশ খুবলে খুবলে খাবে, তবেই ধন্য হবে আমাদের বেচে থাকা।

গুজব, ভাইরালযুদ্ধ ও প্রজন্মের ভবিষ্যত

দেশে কি হচ্ছে, তা সবাই দেখছেন। একজন মধ্যম শ্রেণির মডেলকে ওরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলো! তিনি কি উদ্বেগ নিয়ে অভিনয় করলেন ফেসবুক লাইভে। চোখ তুলে নিয়েছে, মেরে ফেলেছে! কি নিখুঁত তার অভিনয়! ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দলের অফিসের দিকে মারমুখো হলো। কি আজব এই গুজববাজদের মানসিকতা!

আপনারা অনেকেই নিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ফোনালাপ শুনেছেন। একজন অপরিচিত যুবকের সাথে তিনি ফোনে কথা বলছেন। তিনি বলেছেন- ৫/৬ শ’ মানুষ নিয়ে ঢাকা ঘেরাওয়ে শামিল হও। তোমরা ফেসবুকে ছড়িয়ে দাও। কুমিল্লা না- ঢাকা দখল নিতে পারলেই আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই ছিল এই সিনিয়র বিএনপি নেতার মোদ্দাকথা। ছাত্ররা তাদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছে। এই দাবিগুলোের সাথে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও একমত। নয়টি দাবিই মানা হয়েছে। তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। তারপরও ছাত্ররা রাজপথ ছাড়ছে না কেন? তাদের পেছনে কারা? কি ওদের উদ্দেশ্য? দেশে-বিদেশে একটি চক্র সক্রিয়। তারা এই সরকারের পতন চায়। পতন চায় এই আগস্ট মাসেই। আগস্ট মাসটি তাদের খুব প্রিয়। ১৫, ২১ আগস্টের কথা বাঙালি জাতি কি ভুলতে পারবে কোনোদিন?

এই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় নাশকতা চালাতে চায় তারা। এজন্য ভাইরালযুদ্ধে ওরা মেতেছে গত চার-পাঁচদিন থেকে। অনেকভাবেই তারা গুজব ছড়াচ্ছে। ফোন হাতে নিলেই ভাইরাল সব ছবি। ২০০১-২০০৬ সালের ছবি ভাইরাল করেও এই সরকারের উপর চাপানোর অপচেষ্টা চলছে। ফটোশপ করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন ফেকনিউজের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে।

দাবি মানার পরও ছাত্ররা ঘরে, ক্লাসে ফিরছে না কেন? নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে ‘সাহস’ নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ ‘কঠোর’ হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষার্থীদের এখন ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। আছাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশ সারা বাংলাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করবে।

ট্রাফিক সপ্তাহে লাইন্সেস ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি, হেল্পার দিয়ে ড্রাইভিংসহ ট্রাফিক আইনের যে কোনো ব্যত্যয় হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। একইসঙ্গে মোটর সাইকেলে তিনজন চড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল ভায়োলেশন করা, উল্টো পথে চলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, সাধারণ ছাত্রদের তারা স্যালুট করেন। যে কাজটি তাদের আরও আগে করার কথা ছিল, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা পারেননি। আজকে শিক্ষার্থীরা তাদের নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন- ট্রাফিক আইন যুগোপযোগী করার জন্য ‘গণপরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে নতুন একটি আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাশ হবে।

তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা সূত্রে আমরা প্রমাণ পেয়েছেন, স্কুল ড্রেস বিক্রি ও তৈরির হিড়িক পড়েছে। স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে অন্যখাতে প্রবাহিত করে ঘোলাজলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন- এটা সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা হতে পারে না। যারা তাদের উস্কানি দিচ্ছে, তারা নৈরাজ্য তৈরি করে জনগণের পুলিশের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চাইছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছে।

যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। কাঁচা শাকসবজি, মাছ, মাংসের দাম বেড়ে গেছে। জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মহানগরে এমন জনদুর্ভোগ দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। দেশের মানুষ চাইছেন, যারা গুজব ছড়াচ্ছে ওদের আইনের আওতায় আনা হোক।

এর মাঝেই দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- তৃতীয় পক্ষ মাঠে নেমেছে, ঢাকার বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছে এখানে। তাদের কাজ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা। যখনই আমি এটা জেনেছি, আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিতে তৃতীয় পক্ষ নেমেছে জানিয়ে আন্দোলনরতদের এখন ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এদের দাবি-দাওয়া যা ছিল, সবই একে একে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। যেখানেই স্কুল, সেখানেই ট্রাফিক থাকবে, রাস্তা পারাপার করিয়ে দেবে। আন্ডারপাস করা হবে। ওভারব্রিজ হবে, তবে তা যেন ব্যবহার করে। রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন- শিক্ষার্থীদের এখন যদি কিছু হয়, তবে এর দায়িত্ব কে নেবে। অভিভাবক-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, আপনারা তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিন, পড়াশোনা করা তাদের দায়িত্ব।

আমরা দেখেছি ছাত্ররা আন্দোলন করেছে ৫২,৬৯,৭০,৭১ ৯০সালে বিভিন্ন সময়ে। দাবি মানার পর তারা ঘরে ফিরে গেছে। এবার তাদের না যাওয়ার উসকানি কারা দিচ্ছে? সরকার পতনই তাদের মূল উদ্দেশ্য- তা নেপথ্যের নায়কেরা প্রকাশ্যে বললেই পারে। এই বাংলাদেশ তারুণ্যের অনেক অগ্নিশিখা দেখেছে। তাই এই গণ-ছাত্র জাগরণ নতুন নয়। গণজাগরণ মঞ্চ এর সর্বশেষ উদাহরণ। আমরা তো দেখেছি, এই মঞ্চকেও নস্যাৎ করে দেওয়ার পায়তারা করা হয়েছিল, শুধুমাত্র আলবদর-রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য। এই কদিনে আমরা দেখেছি, অত্যন্ত অকথ্য ভাষায় পুলিশ বাহিনীকে গালিগালাজ করে ফেসবুকে পোস্টার ভাইরাল করা হয়েছে। এসব কি কোনো মানুষের ভাষা

হতে পারে। সর্বশেষ যে অভিনেত্রী ও মডেল লাইভে কথা বলেছেন তা ছিল এই সময়ের সেরা মিথ্যা। ১ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের লাইভ ভিডিওর শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আমি কাজী নওশাবা আহমেদ বলছি, আপনাদেরকে জানাতে চাই, একটু আগে জিগাতলায় আমাদের ছোট ভাইদের একজনের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে।’

সকলকে এক হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘আপনারা সবাই একসাথে হোন। ওদেও প্রোটেকশন দিন প্লিজ। বাচ্চাগুলো আনসেইফ অবস্থায় আছে। আপনারা রাস্তায় নামেন প্লিজ।’

ছাত্রলীগ এই হামলা করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘একটু আগে অ্যাটাক করেছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা। তারা জিগাতলায় আছে। আপনারা এখনই নামবেন, আপনাদের বাচ্চাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবেন। ট্রাফিক যে পুলিশরা আছেন, প্লিজ আপনারা নিজের দেশের বাচ্চাদের প্রটেকশন দেবেন। কিছু একটা। সরকার যদি দায়িত্ব নিতে না পারে, তবে জনগণ কিসের জন্য আছি আমরা? আমরা ৭১ দেখেছি, বায়ান্ন দেখেছি, আমরা এবারও পারব।’

অথচ দেশবাসী দেখলো-জানলো সেখানে কিছুই হয়নি। এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে আঁধারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এর অবসান দরকার। ছাত্ররা আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন তারা তো স্থায়ীভাবে ট্রাফিকের দায়িত্ব নিতে পারে না। এই বোধোদয় দরকার। এই দেশের মানুষ শান্তি চান। কেউ দেশকে অশান্ত করে তুলুক, তা কেউই মেনে নেবেন না।

__________________
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।