একজন মা তার সন্তানের শিক্ষককে সাধারণত বলেন – আপনি শুধু আমাকে হাড্ডিগুলা ফেরত পাঠাইয়েন। তাইলেই চলবে।
এই যে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র /ছাত্রীদের মারার সংস্কৃতি সে বহু পুরনো। একসময় অভিভাবক ও ভাবতেন শিক্ষকের অধিকার আছে তার শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেবার। এবং এই মারপিট করলেই সে পড়াশোনা শিখতে পারবে। ছোটবেলায় আমরা এক মাস বা দুই মাসের জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতাম। আমার কাজিনদের সাথে ওদের স্কুলে যেতাম। আমার এখনো মনে আছে এই শিক্ষকরা কিভাবে গরুর মত পেটাতেন ছোট ছোট বাচ্চাদের। আবার আমরা শহরের স্কুলেও দেখেছি শিক্ষকদের ছাত্র, ছাত্রীদের পড়াশোনার নাম করে এভাবে নির্বিচারে শাস্তি প্রদান করা। পরের ছেলের গায়ে এভাবে মারামারি করতে হাতের আরাম মনের সুখ। এখানে মনস্তাত্বিক ব্যপার কাজ করে।
যে শিক্ষক ছোটবেলায় নিজেরা যেই আচরণ পান তিনিও সেই আচরণটাই করেন।এই সমাজ প্রভাব প্রতিপত্তি ভালোবাসে। স্কুলে অভিভাবকরা অনেকে অনেক বড় বড় পেশায় আছেন। তারা তাদের সন্তানের স্কুলের শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান এবং সমীহ করেন। ছাত্র /ছাত্রীদের কাছ থেকেও সমীহ পান। সব মিলিয়ে নিজেকে বড় ক্ষমতাধর মনে করেন এবং তার রিফ্লেক্ট তারা শিক্ষার্থীর উপর চাপান। এই সম্মান পেয়ে তাঁরা নিজেদের কি ঈশ্বর ভাবেন ?
আমার ছেলের শিক্ষক একদিন বললেন আপনার ছেলে পড়া শিখে নাই। দুষ্টুমি করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যদি পড়া না শিখে আপনি কি করেন ? উনি বললেন আমি তাকে মাইর দেই। আমি বললাম মাইর দেয়ার জন্য তো আমি স্কুলে পাঠাই নাই। আমি পাঠিয়েছি সে যেনো পড়াশোনা ঠিকমত করে – পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়। সে পড়বে আনন্দের সাথে। আপনি ওকে মোটিভেট করার জন্য কি করেছেন ? উনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমরা সবাই মাইক্রোস্কোপের নীচে পেঁয়াজের কোষ দেখছি। উপুর হয়ে দেখছিলাম। হঠাত আমার পিঠে ব্যথায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলাম। ফিরে দেখি আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক নজরুল স্যারকে। জালি বেত নিয়ে আমার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে আছেন। সেদিন জিজ্ঞেস করবার সাহস হলো না কেনো আমাকে মারলেন ? উনি কি ব্যাখ্যা দিলেন আমার মনে নাই। শুধু মনে আছে চোখে জল নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়েছিলাম।
আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার পড়াতে এসে সব মেয়েদের গায়ে তার নোংড়া হাত ঘুরাতেন। স্কুলের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আমরা বড় হই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়। যারা আবার শিক্ষকতার পেশায় যায়। তারা তাদের পূর্বতন শিক্ষকদের নিকট থেকে যে আচরণ পান সেই আচরণ তিনি পরবর্তী জেনারেশনের উপর প্রয়োগ করেন।
আমাকে একদিন একজন বললেন – আপনারা মানুষ গড়ার কারিগর। (যেহেতু আমি নিজেও শিক্ষকতার পেশায় ছিলাম )। তখন বলছিলাম এভাবে বলবেন না। আমাদের প্রচুর শিক্ষক আছেন যারা খুব ভালো চরিত্রের অধিকারী না। বেল্ট ক্লাসে একজন ম্যাডাম ছিলেন উনি বলতেন দেখেন আপনি ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতিযোগী না। তাদের ঝামেলায় ফেলার জন্য না সহযোগিতার জন্যই আপনি শিক্ষক। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। মিথ্যে না। পড়াশোনা করেই জাতি এগোয়। এর বেসিক কাজটা শিক্ষকরাই করে থাকেন। তাদের আমরা সেই সম্মানটাই দিতে চাই।
কিন্তু কতিপয় শিক্ষকের এই মনস্তাত্বিক সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন। অরিত্রির মতো বাচ্চাদের আমরা হারাতে চাই না। পরীক্ষায় মোবাইল নিষিদ্ধ। খুব ঠিক আছে। কিন্তু এর জন্য তার প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ না করলেও হতো। পরীক্ষা হলে মোবাইল আনার শাস্তিস্বরূপ তার পরীক্ষা এক ঘন্টার জন্য স্টপ রাখা যেতো। অথবা তার পরীক্ষা সেদিনের জন্য স্থগিত রাখা যেতো। তাকে পরের ক্লাসে প্রমোশন দেয়ার সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা যেতো। এরকম আরো বহু পথ আছে। সমস্যা থাকলে সমাধান ও আছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর শত্রু না বন্ধু আবার মা-বাবার মত তাদের অন্তরে মমতাও থাকা জরুরী।
এখন নিজের যখন জেল হবে, চাকরীটা সহ হারাবেন তখন উনি বুঝবেন – এর চাইতে বিষয়টাকে সুন্দর ভাবে সলভ করলে আজ এতোকিছু হতো না। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখতে পেতেন – ক্ষমা কখনো কখনো দুর্বলতা না – ক্ষমা আরো দশটা কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারে।