বিভাগের আর্কাইভঃ সমকালীন

কর্মকাল

stock-vector-cartoon-father-scolding-unhappy-boy-isolated-267276749

আমাদের এই বেকারের দেশে নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য, পরিবারের ভরন পোষণের জন্য, সাময়িক সুখের সন্ধানের জন্য লক্ষ লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেয়া বা এক কথায় বলা যায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক যুবতী একটি কর্ম সংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। হ্যাঁ এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অভাব রয়েছে বা কেহই এই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নয়। তারচেয়ে অফিসে বসে কলম ঘষাঘষি করাতেই তৃপ্তি। হাতের কাজ? সেতো ভাবতেও ঘেন্না করে!

আবার আর এক দিকে যারা বিশেষ কোন ভাবে সে পিতার সম্পত্তির জোরে কিংবা আত্মীয়তার জোরে কিংবা চাটুকারিতার জোর যেভাবেই হোক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিতে পেরেছে বা অন্যের কর্মক্ষেত্রে বস হয়ে বসেছে তারা নিজেরা না জুটিয়েছে শিক্ষা না পেয়েছে দীক্ষা। ভদ্রতা সভ্যতা বলতে কি বোঝায় তাই জানে না। কার সঙ্গে কি ভাবে কী কথা বলতে হয় জানে না তারা উপযুক্ত কাজের জন্য অপ্রাসঙ্গিক জনকে নিয়োগ দিয়ে কাজের বারোটা বাজিয়ে দেন। মালিক বা বস নিজেই জানে না এই কাজের জন্য উপযুক্ত কর্মী কে? তার কি যোগ্যতা প্রয়োজন। যেমন ডাক্তারকে নিয়োগ দিচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারের পদে, ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ দিচ্ছে পরিবহন কাজের এস্টিমেট করার কাজে আবার প্রশাসনিক কাজ দেখার জন্য নিয়োগ দিচ্ছে হিসাব বিজ্ঞান পড়া লোককে। বিস্কুটের দোকানের ম্যানেজারকে নিয়োগ দিচ্ছে হিসাব দেখার জন্য আবার ট্রাক মালিকের সুপারভাইজারকে নিয়োগ দিচ্ছে জাহাজ পরিচালনার কাজে। এর ফলাফল কি হচ্ছে তা আমরা চারিদিকেই দেখতে পাচ্ছি।

একজনকে দিয়ে ৫ জনের কাজ আদায় করে নেয়া একটা যোগ্যতা এবং শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালিকের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষে একজনকে দিয়ে যদি পাঁচ জনের কাজ আদায় করিয়ে নেয়া যায় মন্দ কি? আল্লাহত’আলা কাজকর্ম কিংবা জীবন ধারণ কিংবা খেয়ে পরে জীবন বাঁচাবার জন্য দিনকে নির্ধারণ করেছেন আর বিশ্রামের জন্য রাত। এই বিধান কি জন্য করেছেন? এমনিতেই ধীরে ধীরে মানুষের মন, মানসিকতা, বিবেক, ধৈর্য-সহ্য অর্থাৎ মানবিক গুণের পচন ধরছে। এগুলি দেখার মত বা উপযুক্ত বিচার করার মত ব্যবস্থা থাকলেও তা মানা হয় না। শ্রম দপ্তর নামে একটি দপ্তর নামে থাকলেও কাজে এর কোন অস্তিত্ব নেই সম্ভবত তাহারা সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত থাকেন।

যিনি কাজ করবেন তাকে দিয়ে কাজ করাতেই থাকবে, লাথি গুঁতা, চোটপাট সবই তার প্রাপ্য কিন্তু প্রমোদে মন ঢালিয়া অফিসে বসে facebook চালাইবেন বা you tube এ সিনেমা দেখিবেন তিনিই উত্তম এবং যোগ্য কর্মচারী বলে বিবেচিত হবেন, সবসময় বাহবা পাবেন, এমনটাই কি রীতি?
সরকার যখন তার কর্মচারীদের পে-স্কেল বাড়িয়ে দিচ্ছেন তার ফলে সারা দেশে সমস্ত কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার শুধুমাত্র ২০/২৫ লক্ষ মানুষের কথা ভেবে অস্থির অথচ বেসরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের বেতন স্কেলের কথার কোনও উল্লেখ থাকে না তাহলে কি চাকুরীজীবী বলতে ওই সরকারি কর্মচারীদেরকেই বোঝায়? এমনিতেই বেসরকারি কর্মজীবীরা নিয়মিত ভাবে বেতন তো পায়ই না বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট তো দূরের কথা। ৫/৭ বছর চাকরি করেও ইনক্রিমেন্টের কোন দেখা নেই। তাহলে তারা সরকারি চাকুরেদের সাথে তাল মিলিয়া সংসার কি ভাবে ম্যানেজ করছে? এর জবাব কি কেও কোনদিন ভেবে দেখেছে না ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেছে?

কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করাটাও যেমন যোগ্যতা আবার সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারাটাও অযোগ্যতা এমন করে কি কেও ভাবেন? দিনে কাজ করবে রাতে বিশ্রাম নিবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু যারা সন্ধ্যার পর অফিসে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে তারা কারা? কেন করে এমন? টেবিলে ফাইল, কাগজপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে চিঠিপত্র নির্দিষ্ট ফাইলে না রেখে যেখানে খুশী সেখানে রেখে সময়মত খুঁজে না পাওয়াকে মালিক বা বস মনে করে এরাই ব্যস্ত মানুষ, এরাই ভাল কাজ করছে! ইহা কি যথেচ্ছাচারিতা নয়?

অফিসে রাতে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে কে?
১। যারা সময় মত নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে পারে না।
২। যার ঘরে শান্তি নেই অর্থাৎ সহজ কথায় স্ত্রীর সাথে বনিবনা নেই।
৩। যারা নিজের কাজ কি এটাই বুঝতে পারে না।
৪। যারা কাজের সময় আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে সময় নষ্ট করে।

সময়মত অফিসের কাজ শেষ করে সময়মত বাড়িতে ফিরে এসে নিজের পরিবারকে সময় দেয়া, তাদের সাথে সুখ দু:খের কিংবা কোন স্বপ্ন দেখা বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাড়ির বাজার বা প্রয়োজনীয় কেনা কাটা করে, চিকিৎস্য করে, প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য কিনে এনে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের ভালবাসা স্নেহ-মমতা নিয়ে রাতে ভাবনা হীন একটা সুখ নিদ্রা দিয়ে ভোরে এক্কেবারে তরতাজা হয়ে উঠতে পারে তাহলে যে সে কতখানি কর্মশক্তি যোগাতে পারে তা কেন এই মহাপন্ডিত জন মালিক বা কথিত বস সম্প্রদায়ের রোবটগুলি বুঝতে পারে না সে প্রশ্নের জবাব কে দিতে পারে?

বিড়ালের সাথে বন্ধুত্ব

বিড়ালের সাথে বন্ধুত্ব আমাদের অনেক দিনের ৮১ সাল থেকে।
অনেক আগে সেতু বন্ধনকে বলেছিলাম সে কথা শোনাব একদিন….

আমরা তখন মনিপুরি পাড়ায় ছিলাম আমার মেয়ের বয়স ৬ বছর। বাড়িতে কেউ বিড়াল পছন্দ করেনা কিন্তু মেয়ের এত শখ হয়েছে যে বিড়াল আনবেই। আমাদের পাশের বাসার খান সাহেবদের বাসা থেকে একদিন একটা বাচ্চা নিয়ে আসে।

বাড়িতে তো এর জায়গা হবেইনা….রাগা রাগি চিল্লা চিল্লি… তার পরেও প্রায় ৩০ বছর ওর বংশধর এই বাড়িতেই পার করে গেল সে কথাই বলব……… প্রথমে যেখানে ছিলাম নতুন বাড়ি আমরাই প্রথম বাসিন্দা। সেখানে বাইরের থেকে আনা কতগুলি কার্টুন ছিল। সেখানে কিভাবে যেন ছোট ইদুর আসল।
বিড়ালের বাচ্চাও ছোট কিভাবে যেন একটা ইদুর ধরে কর্তার সামনেই পেশ করে…
কর্তা একটু খুশি কিন্তু মেয়ের উপর রাগ যায়না।
কার্টুন নেড়ে কেউ ইদুর ধংস করতে না পারায় ওর থাকার মেয়াদ বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে আমরা ঐ বাড়ি ছেড়ে পরিবাগে সিফট করতেছি। জিনিস পত্র সব ট্রাকে উঠে গেছে এখন আমরা গাড়িতে উঠব, কেউ কিন্তু ওর কথা একবারও ভাবেনি, মেয়েওনা। একে একে সবাই উঠলো, বিড়াল কি ভাবল নিজেই গাড়িতে উঠে বসল, এমন শক্ত ভাবে বসল জোর করেও নড়ানো গোলনা। ফেলে যাবে ভাবলো তারপর ওর মুখের দিকে চেয়ে আর ফেলা হলোনা। …
এর পর একদিন ওর বাচ্চা হয় বাচ্চা মুখে করে নিয়ে এসে কর্তার পায়ের কাছে এনে রাখে
একে একে সবগুলি (৩টা) …
কর্তা খুশি, নিমকের মান রাখছে। বাড়ল থাকার মেয়াদও……..

এরপর আমরা নিজের বাড়িতে সিফট করি।
সেখানে আনেক মাটি ভরাট করতে হয়, ইদুরের মাটি নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে ওর বংশধর সহ যায়গা পায় সেখানে আজতক। শেষে বিড়াল পরিবার এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ এ।
এর মধ্যে হুলোরা বাচ্চা মারতো বিধায় কর্তা কয়েকটাকে এয়ার গানের নিশানা করেছে।
এর পর শুরু হয় আর এক অধ্যায় সে কথা পরে বলবো………..

না ভাবনার কিছু বিচিত্র

ভাবনা এভাবে শুরু করা যেতে পারে। ছেলে না মেয়ে। নারী না পুরুষ। সমান তালে দুজনেই সমরেখ কি?
যদিও প্রথম পার্থক্য। নারী এবং পুরুষ।
কিন্তু শিশু বলতে উভয়কেই বোঝায়। আর তাদের মানুষ হিসেবে মানুষ করার দায়িত্ব থাকে বাবা মায়ের এবং সমাজের। এই মানুষ করা ভাবনা থেকে ছেলে মেয়ে বিভাজন শুরু হয়ে যায়।
মেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে পর পর ভাবনা থাকে। আর ছেলে আপন আপন। অর্থাৎ নিজের বা নিজেদের কাছে কাছাকাছি রাখা বা রাখা যাবে এই ভাবনায় শিশুটির খাওয়া পরা দেখাশোনা আদব কায়দা ও পড়াশোনা ইত্যাদি নির্ধারিত হয়।
যেমন, মেয়ে অন্যের বাড়িতে চলে যাবে তাই যতটা শিখে শিখুক না হলেও ক্ষতি নেই। ফলে সেও সেই মানসিকতায় বড় হয়। হয়তো বাড়ির কেউ সেভাবে ভাবে না। কিন্তু সমাজ দেখে এবং শিশুটিও দেখে। ফাঁকির রাস্তা সেখান থেকে শুরু।
অন্যদিকে ছেলের ক্ষেত্রে একটা কিছু করতেই হবে। তার মানে সেভাবে চাপ তৈরি করা। আবার সেই চাপের জন্য সেই চাপে সেই শিশু কিছুটা রাস্তায় ফাঁক খুঁজতে থাকে। তার মানে, ছেলেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো মানসিকতা, না হলে বাবা মায়ের ব্যর্থতা প্রকট। আবার মেয়ের ক্ষেত্রে সেই মানসিকতা হল, কিছু করা গেল তো ঠিক আছে, না হলে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব ওখানে ভাল থাকবেই।
তাহলে কি দাঁড়াল? ছেলে মানুষ করা কঠিন, মেয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সহজ। আপনাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় আপনি কি চাইবেন? ছেলে না মেয়ে? ভাবুন।
এবার ছেলের ক্ষেত্রে আপনি টিন এজের পর আর তার যৌবন আগমন জনিত কাজকর্মের অনেককিছুই টের পাবেন না। দেখবেন বাবা মায়ের নানান ঘেরাটোপের বাইরে সেও ঠিক চালাকি অনায়াসে বেছে নেয়। কিছুতেই মনের খারাপ ভাল ইত্যাদির হদিশ পাবেন না। বাবা মা যতই বন্ধুর মত ব্যবহার করুক, বন্ধু যে হাতছানিকে ডাক দেবে, প্রশয় দেবে তা বাবা মা কিছুতেই মেনে নেবে না। অর্থাৎ সে কিছুতেই আপনার সাথে সে সব শেয়ার করবেই না। এই হাতছানি থেকে অনেক ছেলে বেরতেই পারে না। অনেক সময় জানা গেলেও তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। নাগালের বাইরে।
সে তুলনায় মেয়ে আপনার সীমানার মধ্যেই থাকবে বা থাকে। যেহেতু আপনি জানেন মেয়ে মানেই অনেকটাই বেশি মান সম্মান জড়ানো। সেও নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কে সমাজের ভিন্ন মানসিকতায় ওয়াকিবহাল। তাকে সেই মর্যাদার বিবেচনায় বড় হতে দিলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। সে তার সমস্ত হয়তো মাকে কিংবা বাবাকে বলবে না বা বলতে চাইবে না। কিন্তু ঠিক মত ওয়াচ করলে হয়তো বোঝা যেতেই পারে। বাইরের অনধিকার হাতছানিতে মেয়েরা চট করে সাড়া দেয় না। সে তার সীমানায় একটা বেড়া খুঁজে পায়। বাবা মায়ের অনেকবেশি না-নজরে সে বেরিয়ে যেতে পারে। না হলে সম্ভাবনা কম।
আবার ঠিক একই রকমভাবে নেশার ক্ষেত্রে মেয়েদের মধ্যে যতটা ছড়ায় ছেলেদের ক্ষেত্রে তা পুরো শতাংশই ছড়িয়ে যায়। এই নেশা ধরা পান বিড়ি সিগারেট খৈনি গুটখা মদ ভাঙ ড্রাগ ইত্যাদি কিছুতেই ছেলেদের ক্ষেত্রে ওয়াচ করেও ধরতে পারবেন না। যেদিকে বাঁধন দেবেন তার ঠিক অন্য দিকে দিয়ে অন্য রাস্তা খুঁজে ছেলেরা বেরিয়ে যাবে। ঠিক এই কারনে সমস্ত নেশা সামগ্রী বেশিরভাগ ছেলেদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ছে।
মেয়েরা যদিও বা করে আপনি এলার্ট থাকলে তা সহজেই ধরতে পারবেন। বাবা মায়ের দায়িত্বশীল ভাবনায় সহজেই ফিরিয়ে আনা যায়।
এই বিপথে যাওয়া ছেলে মেয়ের মধ্যে মেয়েকে যত সহজে ফিরিয়ে আনতে পারবেন ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। যদি না ছেলে নিজে ফিরতে না চায়। একটা জেদি একগুঁয়ে ভাব কাজ করে। এই একগুঁয়ে মনোভাব মেয়ের ক্ষেত্রে যতটা পরিবর্তনশীল ছেলের ক্ষেত্রে ততটা নয়। তাই বিপথে যাওয়া থেকে ফেরাতে ছেলের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে মেপে এগোতে হয়। কখন কি করে বসে কিংবা আরও বেশি কিছু না হয়ে যায়। মেয়ের ক্ষেত্রে এই ফেরানো একটু রূঢ় হওয়া যেতেই পারে। আর একটু বেশি নিরাপত্তা নির্ভরতার আশ্বাস দিলে সহজেই মানানো যায়।
এবার যদিও আপন তবুও যদি এ রকম ভাবনা ভাবি যে এই শিশুটি শুধু ছেলে, এই শিশুটি শুধু মেয়ে। তাহলে দুজনকে যদি সমানভাবে মানুষ করি তাহলে মেয়েরা যার ঘরে যাবে তার ঘর থেকে মেয়ে বেরিয়ে আসবে ফলে সবার ঘরে এই মানুষ করা মানসিকতায় জোর থাকবে। ছেলেও এই বিভাজন থেকে বেরিয়ে আপনাআপনি দৃঢ় চেতা হতে শিখবে।

ভারতীয় হিন্দী সিরিয়ালঃ ধ্বংসের পথে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি

ভারতীয় হিন্দি সিরিয়াল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দি সিরিয়ালের শিক্ষনীয় কোন বিষয় না থাকলেও এর দর্শক দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাবারের মতো টেনে-হিঁচড়ে এসব সিরিয়াল এমনভাবে লম্বা করা হয় যে, এর শেষ পর্ব কবে প্রচারিত হবে তা কেউ যেমন জানে না তেমনি আন্দাজও করতে পারে না।

শুরুর কথাঃ গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। তখন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। শুরু থেকে অদ্যাবধি এ চ্যানেলটি এককভাবে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বিধায় এই চ্যানেলটি জনগণকে পরিপূর্ণ বিনোদন দিতে পারেনি। আর তাই জনগণও বিনোদনের অন্য বিকল্প উপায় না পেয়ে হিন্দি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ১৯৯৬ সালের দিকে বাংলাদেশে হিন্দি চ্যানেল বলতে শুধু সনি আর জিটিভি কে বুঝাতো। বর্তমানে ত্রিশোর্ধ ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা চ্যানেল এবং ভারত কর্তৃক সম্প্রচার সত্বাধিকারপ্রাপ্ত কিছু ক্রীড়া, প্রাণীজগৎ, সৌরজগৎ ও ধর্ম বিষয়ক চ্যানেল সহ প্রায় শতাধিক চ্যানেলে অনুষ্ঠান সার্বক্ষণিক সম্প্রচারিত হচ্ছে। আমাদের দেশে হিন্দি সিরিয়ালের যাত্রা শুরু হয় মূলত স্টার প্লাসে সম্প্রচারিত ‘সাসভি কাভি বাহু থি’ সিরিয়ালের মাধ্যমে। সিরিয়ালটি অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ‘কাহানী ঘার ঘার কি’, ‘কাসেটি জিন্দেগী কি’, ‘শশুড়াল গেন্দা ফুল’, রিসতা ক্যা কেহরাহে, সাথ নিভানা সাথিয়া, কুম কুম ইত্যাদি সিরিয়ালগুলো দেশের বিশেষ করে মহিলাদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মহিলাদের নিকট এসব হিন্দি সিরিয়াল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ হলো, গৃহবধূদের সময় কাটানোর একটি চমৎকার উপায়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয়ে একটানা রাত বারটা পযর্ন্ত সম্প্রচার করা হয়। আবার পরের দিনেই সারাদিন ব্যাপি তার পুনঃপ্রচার করা হয়। ফলে মহিলাদের সময়গুলো খুব স্বচ্ছন্দেই কেটে যায়। কিন্তু নির্মম সত্যি হলো এসব হিন্দি সিরিয়াল মানুষের স্বাভাবিক জীবনে প্রচুর প্রভাব ফেলছে। ইতিবাচক দিকটির চেয়ে নেতিবাচক দিকটি ফুটে উঠছে সবচেয়ে বেশি।

হিন্দি সিরিয়ালের খারাপ দিকগুলোঃ হিন্দি সিরিয়ালের মধ্যে যে সব ম্যাসেজ বা বার্তা থাকে তা একটি পরিবার তথা সমাজ কে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফলে সমাজ থেকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে তেমনি সামাজিক, মানসিক সবক্ষেত্রেই দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। অনৈতিক ও ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছাড়া শিক্ষণীয় তেমন কিছুই পাওয়া যায় না বলেই এমনটি হচ্ছে। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে যে সব দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অসম প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া, পারিবারিক ভাঙ্গন, বহু বিবাহ, বউ-শ্বাশুড়ীর ঝগড়া, সম্পত্তির কারণে ভাই-ভাই ঝগড়া, স্ত্রীর কূটনৈতিক চাল, ভুল বোঝাবুঝি, হিংসা, সন্দেহ, অশ্লীলতা, আত্মীয়দের ছোট করা, অন্যকে বিপদে ফেলা, চুরি শিক্ষা, অপরাধ শিক্ষা এসব বিষয়ই হিন্দি সিরিয়ালের মূল বিষয়বস্তু।

ছেলে-মেয়েদের ওপর হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবঃ কোন কোন পরিবারে দেখা যায় মা-বাবার সাথে পরিবারের ছোট শিশুটিও হিন্দি সিরিয়াল দেখতে টিভির সামনে বসে গেছে। এর ফলে বাবা-মারা জানতেই পারে না যে শিশুটির মানসিক বিকৃতি ঘটছে। মাঝে মধ্যে এমনও দেখা যায় যে, এসব পরিবারের কর্তারা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর পর্যাপ্ত সময় না পেলেও তাদের কে নিয়েই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসে যান। ফলে ছোটবেলা থেকেই এসব শিশু পরিচিত হচ্ছে অপসংষ্কৃতির সাথে। অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের পড়ার খবরটি ঠিক মতো না জানলেও হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্র ও সময়সূচী ঠিকই জানে। এভাবে মা-বাবারাই মূলত তাদের অজান্তেই আদরের বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের পথে বড় বাঁধা তৈরি করে চলেছেন দিনের পর দিন। শিশুর অকালে নষ্ট হওয়ার জন্য এসমস্ত রুচিহীন ও নির্বোধ বাবা-মায়েরাই দায়ী হবেন।

সমাজ ও নিজস্ব সংষ্কৃতির উপর প্রভাবঃ বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচারিত হওয়া অনুষ্ঠানমালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বিভিন্ন নামে প্রচার হওয়া টিভি সিরিয়ালগুলো। এসব সিরিয়ালের দাপটে বাংলার নিজস্ব সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্য আজ হুমকীর সম্মুখীন। একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা নামলেই পরিবার-পরিজন সবাই একত্রে বসে গল্প-গুজব করে সময় কাটাতো। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। সন্ধ্যার পরেই হিন্দি সিরিয়াল দেখে মানুষ শিখছে কিভাবে শাশুড়ী তার বউকে কিংবা বউ তার শাশুড়ী শায়েস্তা করতে পারে, কেমন করে অন্য পরিবারের ক্ষতি করা যায় তার ফন্দি আঁটে। এমনকি সমাজে পরকীয়ার মতো ঘটনাও বেড়ে চলছে রুচিহীন এই হিন্দি সিরিয়ালের কারণে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয় জৌলুসপূর্ণা পরিবেশ, চাকচিক্যময় জীবন ব্যবস্থা, দামী গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী গয়না যা আমাদের দেশের তরুণদেরকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। আমাদের ধর্ম, মূল্যবোধ, পরিবার, সমাজ এসব সর্মাথন না করলেও আমরা তা দেখছি। আমরা আমাদের নিজস্ব সংষ্কৃতি পায়ে দলিত করে ভারতীয় সংষ্কৃতির ওপর আজ দাঁড়িয়ে আছি। হিন্দি সিরিয়ালের ভয়াল থাবায় আমাদের সমাজ-সংষ্কৃতি আজ ক্ষত-বিক্ষত। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও এর প্রভাবে আজকাল হিন্দিতে কথা বলছে। ঈদ-বা পূজার অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা তাদের ওপর ধীরে ধীরে যেন নির্ভশীল হয়ে পড়তেছি। কেননা এখন ঈদ বা পূজা এলেই বাজারে বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়ালের নামানুসারে কিংবা নায়িক/মডেলের নামানুসারে কাপড় কিনতে পাওয়া যায়। মাসাক্কালি, ঝিলিক, আশকারা, খুশি নামের পোশাকগুলো ঈদের সময় হলেই বাজার দখল করে নেয়। আকাশ ছোঁয়া এসব দামী পোশাকগুলো কিনতে বসন্ধুরা সিটিসহ গুলশান, বারিধারা, উত্তরার মতো অভিজাত পাড়ার দোকানগুলোয় ভীড় লেগে থাকে। আবার কিছু কিছু দোকানও ইদানিং হিন্দি সিরিয়ালের নামে নামকরণ করা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

অথর্নৈতিক ক্ষতিঃ হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবে আমরা সাংষ্কৃতিক ভাবে যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি তেমনি অর্থনৈতিক ভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের দেশে ভারতের যে সব চ্যানেল সম্প্রচারিত হয় আমাদের কে সেগুলো পয়সা দিয়ে কিনে দেখতে হয়। এজন্য প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ভারতকে দিতে হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের দেশীয় কোন চ্যানেল চালুর অনুমতি দিচ্ছে না ভারত। বিপুল দর্শক চাহিদা থাকা সত্বেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী আমাদের দেশ হতে সম্প্রচারিত টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসমূহ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমরা তাদের হিন্দি সিরিয়াল দেখার পাশাপাশি তাদের পণ্যের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এর ফলে তাদের পন্যের যেমন প্রচার ও প্রসার হচ্ছে আমাদের দেশের সেটা হচ্ছে না। নিজ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করে কেন তাহলে আমরা হিন্দি চ্যানেল দেখতে যাব।

দায় এড়াতে পারে না দেশের মিডিয়াঃ হিন্দি সিরিয়ালের দর্শক প্রধানত আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত বস্তিবাসী ও শ্রমিকশ্রেণী, পোশাক শ্রমিক, উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন যুবসমাজ এবং একই মানসিকতার কিছু উচ্চবিত্ত। তাদের নিকট এসব সিরিয়াল ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে মূলত মিডিয়ার প্রচার। মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে নিজ দেশের সংষ্কৃতি-সভ্যতা, কৃষ্টি ও নিজস্ব মূল্যবোধ প্রচারের মাধ্যমে তাদের দায়িত্বশীলতা জনতার সামনে ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু সেই সৎ সাহস আজও আমাদের দেশের পত্রিকা অর্জন করতে পারেনি বলেই মনে হয়। প্রতিটা পত্রিকায় ‘বিনোদন’ বা ‘লাইফ স্টাইল’ নামে একটা আলাদা পাতা থাকে। যেখানে দেশের শিল্প ও সংষ্কৃতির সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এসব পত্রিকার বিনোদন পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে আধুনিকতার নামে মেয়েদের টপস্ আর জিন্স প্যান্ট, স্লিভলেস ড্রেস পরার ছবি, ছেলেদের চুল থেকে পা পর্যন্ত উদ্ভট সাজ। যা আমাদের সমাজ-সংষ্কৃতির সাথে যায় না। এসব পত্রিকার সম্পাদকেরা একবারও দেশের সংষ্কৃতির কথা ভাবেন না। ভাবেন শুধু নিজ পত্রিকার কাটতির কথা। কিছুদিন আগেই দেশের নামকরা একটা জাতীয় দৈনিকের বিনোদন পাতায় দেখলাম ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের সংবাদ। কখন, কোন চ্যানেলে প্রচারিত তার ছবি সহ সময়সূচী দেয়া হয়েছে। অথচ এই পত্রিকাগুলোকেই বলা হয় সমাজের দর্পণ। তারা যেভাবে সমাজকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরবে সেভাবে জনতা সেটা মনেপ্রাণে গেঁথে নিবে, বিশ্বাস করবে। তাই পত্রিকাগুলোর কাছে বিশেষ দাবী আপনারা হিন্দি সিরিয়ালের সংবাদ প্রচার না করে নিজ দেশের সংষ্কৃতি-সভ্যতা, কৃষ্টি ও নিজস্ব মূল্যবোধের সংবাদ বেশি করে প্রচার করুন।

হিন্দি সিরিয়াল বন্ধে আমাদের করণীয়ঃ আমাদের জীবন-যাপনের সাথে হিন্দি সিরিয়ালগুলোর মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। হিন্দি সিরিয়াল এমনই একটি বিনোদন মাধ্যম যেখান থেকে আপনি নতুন কিছু শিখতে পারবেন না। এই সিরিয়ালগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবোধ পাল্টে দিচ্ছে, রুচির বিকৃতি ঘটাচ্ছে মানুষের। আজ আমরা আমাদের বাঙ্গালীয়ানা ভুলে গিয়ে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করছি তাদের দেখে। ‘শাড়িতে বাংলার নারী’ এই কথা ভুলে গিয়ে শাড়ি পরার নতুন ধরন শিখছি তাদের দেখাদেখি। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার শাড়ী তো দূরে থাক টপস্ আর প্যান্ট পরেই রাস্তায় চলাচল করছে মেয়েরা। আমরা কেন পোশাক পরি তার সংজ্ঞাই হয়তো পরিবর্তন করে দিচ্ছে এই হিন্দি সিরিয়ালগুলো। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ঘরের ভিতর যেমন বন্দি হয়ে থাকতে চাই না তেমনি চাই না অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। ভারতীয় চ্যানেল, সিনেমার অবাধ বিচরণ আমাদের দেশে। আর তাই ইচ্ছে করলেও এই অবাধ বিচরণ থামাতে পারবো না। আমাদের সবকিছু্র সানিদ্ধ্যে আসতে হয়। কিন্তু এখান থেকেই আমাদের বুদ্ধি-বিবেক আর শক্তি দিয়ে খারাপ সংষ্কতি বর্জন করতে হবে। আমরা বাঙ্গালী। আর বাঙ্গালীদের রয়েছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংষ্কতি। আমাদের সাহিত্য-সংষ্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। তাই এ সমৃদ্ধ সংষ্কৃতির চর্চা করলে, বাংলা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা দেখলে নিঃসন্দেহে কমে আসবে হিন্দি সিরিয়াল দেখার প্রবণতা। হিন্দি সিরিয়ালের এই অপসংষ্কৃতি রোধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি তরুণদেরকেও এই সংষ্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত করতে হবে।

(নিবন্ধটি প্রিয়.কম এ ২৩ মার্চ ২০১৪তে প্রকাশিত হয়েছিল)

বাংলাদেশের অনন্য উদাহরণঃ উপমহাদেশে প্রথম

সর্বোচ্চ আদালতে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন উপমহাদেশে বাংলাদেশেই প্রথম। পাশের দেশ ভারতে পৌত্তলিকতার প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে নেই এই প্রতীক। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে এই মূর্তি নেই। একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালেও নেই এই দেবীর মূর্তি। এমনকি শ্রীলঙ্কা-মিয়ানমারেও নেই তথাকথিত ন্যায়বিচারের এই প্রতীক। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানে ১৯৬৪ সালে কুখ্যাত শাহ প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের সামনে পাশ্চাত্যের অনুকরণে গ্রিক বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করেছিল। একমাত্র এ উদাহরণটি বাদে এ পর্যন্ত মুসলিম দেশের শাসকরা যত মন্দই হোক না কেন আদালতের সামনে দেবীমূর্তি স্থাপন করতে সাহস পাননি।

কুপমণ্ডুক আখ্যা দিয়াছ যারে

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভণ্ডামী ও প্রতারনার বসবাস তা থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয় বৈশাখের বর্ষবরণ। আমাদের শিক্ষিত ও সমাজের উপরের তলার মানুষেরাই ভান ও ভণ্ডামীতে আক্রান্ত সর্বাধিক। সেই ভান ও ভণ্ডামী এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌছেছে যে সেটা পুরোপুরি ফ্যাসীবাদী রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমরা দাবী করি বৈশাখের বর্ষবরণ আমাদের শেকড়ে ফেরার প্রচেষ্টা, আমাদের ঐতিহ্যকে ধারন করা। বাস্তবতা কিন্তু উলটো। বংশ পরম্পরায় আবহমানকাল ধরে পুরুষানুক্রমে যেটা আমাদের নিঃসংকোচ আচরিত সেটাই আমাদের ঐতিহ্য হওয়ার কথা। বিজাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আমাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তখনি আমরা ফিরে যেতে চাই নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কারের কাছে। যুগ যুগ ধরে আচরিত এই আচরণ এই অভ্যাস এই প্রথা আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমরা যখন নিজেদের রক্ত নিজেদের আচরণ ভুলে যাই তখনি আসে শেকড়ে ফেরার কথা।

বাস্তবে শেকড়ে ফেরার চরিত্র বৈশাখে কতটুকু? শেকড়ে ফেরার কিংবা শেকড়ের কোন চরিত্রই এই বৈশাখী বর্ষবরণের উৎসবে আমরা রাখিনি। এখানে তৃণমূল মানুষের আচরিত চিরাচরিত আচারের পরিবর্তে আমরা করেছি একে পরিনত আরোপিত উৎসবের এক ভুল ঐতিহ্যের মহোৎসবে। বর্ষবরনের সবচেয়ে বড় আয়োজন তা হল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রার শুরু ১৯৮৯ সালে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলায়। এই শোভাযাত্রাকে আমরা দাবী করি অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। আমাদের গণমানুষের ঐতিহ্যে কখনোই এই ধরনের শোভাযাত্রার অস্তিত্ব ছিল না। এই শোভাযাত্রার মধ্যে যেমন ঐতিহ্যের কোন সম্পর্ক নাই তেমনি এর অণুষঙ্গের সাথে আমাদের দেশীয় চিরাচরিত কোন ঐতিহ্যের দূরতম সম্পর্ক নাই। এই শোভাযাত্রায় মুখোশ পরি আমরা। আমদের দেশের তৃণমূল মানুষ মুখোশ পরা তো দূরে থাকুক অনেকে মুখোশ দেখেছেন কিনা সে নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। আমরা কিসের মুখোশ পরি, পেঁচার, ময়ূরের। আরো আছে ভাল্লুক, হনুমান, পেঁচা, অসুর, রাক্ষস-খোক্কস, ডাইনি, পেত্নি। এইগুলার সাথে আমাদের তৃণমূল গণমানুষের কি সম্পর্ক? নিদেন পক্ষে যদি দোয়েলের মুখোশ দেখতাম তাও ভাবতাম ঐতিহ্য না হলেও জাতীয় পাখি তো।

এবার আসি আমাদের এই উৎসবের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে। এই চরিত্র পুরোই প্রশ্নবিদ্ধ। আমি যখন একটা বিষয়কে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করব তখন সব সম্প্রদায়ের ও ধর্মের মানুষের কাছে তথা দেশের সকল নাগরিকের কাছে সেটা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মনে হতে হবে। আমার কাছে ধর্মনিরপেক্ষ তো আমার বিবেচনায় কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারনের কাছে যদি সেটার এরকম ধর্মনিপেক্ষ আবেদন না থাকে? এই দেশের নাগরিকদের একটা অংশ মোটেই অসাম্প্রদায়িক হিসেবে মানতে রাজি নন। এর মধ্যে তাঁরা একটা সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচরিত ধর্মীয় আচারের আচরনগুলি স্পষ্ট দেখতে পান। প্রকৃতই এগুলোর মাঝে এক সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় রীতিনীতি ও অর্চনার সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমনঃ প্যাঁচা, ময়ূর, ভাল্লুক, হনুমান, পেঁচা, অসুর, রাক্ষস-খোক্কস, ডাইনি, পেত্নি।

আমি যাকে ধর্মনিরপেক্ষ মনে করি সেটা যদি অন্যের কাছে সাম্প্রদায়িক মনে হয় তাহলে তো এর অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটাই থাকে না। ধরুন, আমি সবাইকে এক অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলাম আর এসে সবাই দেখলেন সেটা ওয়াজের মাহফিল কিংবা কীর্তনের অনুষ্ঠান তাহলে একে কি আপনারা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান বলবেন?
পহেলা বৈশাখের উৎসব মূলত শহুরে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে এই বলয়ের বাইরে বের হচ্ছে। রাজধানী থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিভাগীয় শহরে, জেলা-উপজেলায়। শেকড়ে চরিত্রটাতো এখানেই মার খায়। শেকড়ে ফেরার হলে তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তৃণমূলে বছরের পর পর আচরিত হয়ে একটা পোক্ত আসন নিয়ে নিজেই ধাববান থাকার কথা। তৃণমূল থেকে বিত্তবানের ড্রইং রুমে আসার কথা। তাহলে এখানে আমরা কোন শেকড়ে ফিরছি। নাকি ধার করা সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছি সাধারনের উপর। এই ধরনের বাস্তবতায় ইংরেজী নববর্ষ আর বাংলা নববর্ষের উৎসবের চরিত্রগত ও তাৎপর্যগত তফাত কোথায়? দুটোই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। দুটোতেই সরকারকে নিরাপত্ত বিধানে গলদগর্ম হতে হয়। দুটোতে মেয়েদের শ্লীলতাহানির, যৌণ নিপীড়নের উদাহরণ আছে।

আমরা যখন একটা অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বজনীন উৎসবের শুরু করব তখন সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের মতামতের মূল্য আমাদের দিতে হবে। আমি আমার মত করে গায়ের জোরে বলে দিব এটা অসাম্প্রদায়িক, এটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন, আর কেউ এটাকে যদি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে না মানে তো তাকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, বলে গালাগালি করব। তাদের মতপ্রকাশকে বলব অশনিসংকেত, অশুভশক্তি আর বৈশাখে তাদের নিপাত কামনা করব, তাহলে তো সেটা হবে একপেশে, প্রতিক্রিয়াশী এবং সভ্য নয় মোটেই বর্বর।

একটা সার্বজনীন উৎসব বা প্রথা সৃষ্টির জন্য সর্বজনের মতের মূল্য দিতে হবে। সে যদি আমার মতে বিরোধী হয় তার মূল্য দিতে হবে সর্বাধিক। তবেই না যুক্তি-তর্ক-বিতর্কের মাঝে সমাজের একটা প্রগতিশীল রূপ দাঁড় হবে। তা না হলে সেটা হবে একেবারেই ফ্যাসিবাদি। কেবল ফ্যাসিবাদই নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়।

আজকে মঙ্গল শোভাযাত্রা যাদের কাছে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং যারা এই প্রোগ্রামে শামিল হতে চায় না তাদেরকে তো এটা চাপিয়ে দিতে পারি না। একটা সাম্প্রদয়িক অনুষ্ঠান শুধু মাত্র অসাম্প্রদায়িক বললেই সেটা অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। এই রাষ্ট্রে যারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিশ্বাস করে আর যারা করে না, সকলেই এই রাষ্ট্রের নাগরিক এবং তাদের সবার টাকায় রাষ্ট্র চলে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ও অন্যান্য সরকারী বৈশাখী অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হয়। সুতরাং এই সব আয়োজনে তাই সকলের মতামত প্রতিফলনের দরকার আছে। আমার দেশে শুধু আমার মতই চলবে, আমার বিশ্বাস ও নীতে রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হবে বাকিদের কথা মানা যাবে না, আমার মত ও পথের বাইরে গেলেই সে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদি এই ধরনের চিন্তা ভাবনা চরম প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদী ভাবনা।

অন্যের উপর আমার মত চাপিয়ে দেয়ার অধিকার সংবিধান আমাকে দেয়নি। তাই সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব নির্মান করতে হলে প্রকৃত মুক্তমন নিয়ে যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে সকলের অংশগ্রহনমূলক বিনির্মান দরকার। নচেৎ এগুলো কেবলি ভান তৈরি করবে।

==============================
থার্ড আই ও ফকির আবদুল মালেক ভাইকে উৎসর্গীকৃত।

শাড়ি পড়া থেমিসের মূর্তিটি সরিয়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত

১৯২৮ সালে লিখিত পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুঃ পৃথিবীর ইতিহাস, অধ্যায় ২৫, পৃঃ ১১১ – এ এক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেন, “আদিম যুগের মানুষেরা অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণই ঠিক ঠাক বুঝতে না পেরে ভয় পেত। … নদী, পাহাড়, সূর্য, গাছ, পশু এদের সবকিছুকেই প্রাচীন মানুষেরা দেব-দেবী বলে মনে করত; কতগুলো ছিলো আবার অদৃশ্য মনগড়া ভূত। ভয় তাদের মনে লেগেই ছিলো, কাজেই তারা মনে করত দেবতা বুঝি তাদের শাস্তি দেবার জন্যই সব সময় ব্যস্ত। তারা ভাবত দেবতা বুঝি তাদেরই মতো কর্কশ আর নিষ্ঠুর; কাজেই একটা পশু, পাখি অথবা মানুষ বলি দিয়ে তারা চাইত দেবতাকে খুশি রাখতে। এই দেবতাদের পূজার জন্য ক্রমে ক্রমে মন্দির গড়ে ওঠতে লাগল। মন্দিরের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান ছিল যাকে বলা হত ‘পূজা-ঘর’। সেখানে তাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি থাকত। ”

সহজ সরল ভাবে আরাধ্য দেবতাদের ইতিহাস এই।

প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী খুজলে অনেক দেব দেবীদের সন্ধান মিলে। এমনি এক দেবী নাম থেমিস।

থেমিস কে ছিলেন?

গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। ইনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশের বিচারে ইনি ১২ জন টাইটানের একজন। ভবিষ্যৎ-বাণী করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন গেইয়ার কাছ থেকে। পরে এই ক্ষমতা ফিবিকে প্রদান করেছিলেন। দেবরাজ জিউসের ঔরসে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন হোরায়ে (ঋতু নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী) এবং মোইরায়ে (ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী। রোমান পুরাণে এর নাম জাস্টিয়া (Justitia)।

ইউরোনোমে এই থেমিস এবং ইউরিমেডোন-কে বৃহস্পতি গ্রহ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।

আদি রোমানরা গ্রিক মিথ এর কথিত দেবী জাস্টিসিয়াকে বিচারের প্রতীক হিসেবে মনে করতো ।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমন লোক নাই বললেই চলে যিনি বা যারা গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটু, এরিস্টেটল এর নাম শুনেননি বা তাদের চিন্তা চেতনায় কোন না কোনভাবে প্রভাবিত নন।

দ্বাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মহাজ্ঞানী আবু রায়হান মুহাম্মাদ বিন আহমদ। জনসমাজে খ্যাত আলবেরুনী নামে। ১০৩১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারতবর্ষের ওপর একটি তত্ত্ববহুল গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘সক্রেটিস নিজে যখন জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং গ্রহনক্ষত্রকে ওদের ভাষায় ভগবান বলতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন এথেন্সের ১২ জন বিচারকমন্ডলীর মধ্যে ১১ জনই তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে একমত হয়েছিল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতবর্ষে এইরূপ দার্শনিকের মতো কোনো লোক জন্মায়নি যার দ্বারা জ্ঞানের তেমন উৎকর্ষ সাধন হতে পারত। (আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, বাংলা একাডেমি, টিকা ১৯, পৃ: ৮)

অতএব, দেখা যায় দুটি কারণে সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড দেয় এথেন্স আদালত। এক. ভাস্কর্য, মূর্তি, ম্যুরাল, প্রতিমা তৈরি ও পূজার প্রতিবাদ করেছিলেন; দুই. গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, প্রকৃতিকে ভগবান, স্রষ্টা বলতে অস্বীকার করেছিলেন। আলবেরুনী বলেছেন, সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড হয়।

প্রাচীন রোমে বিচার বা সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিলো সেটা মনে করতে গ্লাডিয়েটর মুভির কথা মনে করে দেখা যেতে পারে।যেখানে দাসদের আটকে রেখে হিংস্র পশুর সাথে যুদ্ধ করতে দেওয়া হতো, আর সেই জঘন্য দৃশ্য দেখে মজা নিতো সম্রাট ও সাধারণ জনগন।
৫০০০ বছর আগে বর্বর রোমানরা কি কল্পকাহিনী বিশ্বাস করতো, সেটাকে একেবারে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগাতে বসাতে চাইছে আধুনিকতার নামে, কি বিস্ময়কর!

বলা হয়, এ ন্যায়ের প্রতীক এবং অনেকেই বলে থাকেন এ মূর্তি নয় ভাস্কর্য।

আাসুন দেখে নেই মূর্তি আর ভাস্কর্য কি?

আভিধানিক অর্থে ভাস্কর্য :
ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা-ই ভাস্কর্য। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরি করে। পক্ষান্তরে মূর্তি অর্থ ছায়া বা এমন আকৃতি-শরীর, যার ছায়া আছে।

ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। এককথায় যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা ভাস্কর্য- রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া পড়ে না। আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্রে বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা হয়েছে।

পারিভাষিক অর্থে, যে আকৃতির পূজা করা হয় সেটি মূর্তি। আর যার পূজা করা হয় না সেটি ভাস্কর্য। এ ব্যাখ্যা প্রচলিত নয়। যেমন আমরা দেখেছি যখন লেলিনের আকৃতিকে টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলেছে ‘লেলিনের মূর্তি ..’ এমনিভাবে যখন সাদ্দামের আকৃতি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলল, ‘সাদ্দামের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।’

এই দুইটি প্রতিকৃতি উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়নি, তবু এগুলি মূর্তি হিসাবেই প্রচলিত ছিল।

বাংলাদেশে ভাস্কর্যের উদাহরণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্য। স্বাধীনতাযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত এসব ভাস্কর্য রাজধানী শহর ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্রই প্রায় রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের বাইরে, বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেও রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের এসব ভাস্কর্য।

কয়েকটি বিখ্যাত ভাস্কর্য নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।

অপরাজেয় বাংলা

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তিন নারী-পুরুষের ভাস্কর্য যেটি সর্বসত্মরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেটি ‘অপরাজেয় বাংলা’। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তযোদ্ধা বদরম্নল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পূর্ণোদ্যমে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শুরম্ন হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোন শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গুণী শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুলস্নাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। এ ভাস্কর্যে সব শ্রেণীর যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে।

সংশপ্তক l

সংশপ্তক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণমূলক ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম। এই ভাস্কর্যটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এর স্থপতি শিল্পী হামিদুজ্জামান খান।
এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এ ভাস্কর্যটি ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ স্থাপন করা হয়।
মূল ভূমি থেকে ভাস্কর্যটির ঊচ্চতা ১৫ ফুট। মূল ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি।

স্থাপত্য তাৎপর্য
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের তাঁজা প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি জাতি। । হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে এতে দৃশ্যমান করা হয়েছে।‘ সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদী যোদ্ধাদের নাম। মরণপন যুদ্ধে যারা অপরাজিত। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান।

এই সকল স্থাপত্যগুলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগকে চিত্রায়িত করে। আমার একটি স্বাধীন জাতি বটে কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনও অনেক সেকেলে অন্ধকারে আছে। আড়াইশ’ বছর আগে ব্রিটিশ জলদস্যুরা যে কুসঙ্কারাচ্ছন্ন আইন শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটাই এখন মুর্খের মত ফলো করে যাচ্ছে উকিল-জাস্টিসরা।

প্রধান বিচারক মাথায় উলের টুপি পড়ে মা-ভেড়া সেজে থাকে, দাবি করে- সে মা ভেড়া তার সামনে সবাই সমান। এখনও উকিলরা জাস্টিসদের দেখলে ব্রিটিশ নিয়মে ‘মাই লর্ড’ ‘মাই লর্ড’ (আমার প্রভু, আমার প্রভু) করে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এতটাই অন্ধ অনুকরণপ্রিয় যে, ব্রিটেনে তীব্র শীত পরার কারণে উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট, গাউন পরে থাকে। আর বাংলাদেশে সেই অণুকরণে গরমকালে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে শত শত লোকের মধ্যে ভ্যাপসা আবহাওয়ায় উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট-গাউন পরে থাকে। দরদর করে ঘামতে থাকে, কিন্তু ব্রিটেনের অন্ধ অনুকরণ বলে কথা!!

দুঃখের কথা- ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৫ বছর হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর, কিন্তু এখনও বিচারবিভাগ সেই ব্রিটিশ ভাষা থেকে বের হতে পারলো না। এখনও সুপ্রীম কোর্টে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ অচল।

কথাগুলো এ কারণে বললাম- সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা যেন আরো উল্টো পথে হাটছে। এতদিন ২৫০ বছর আগের ব্রিটিশ জলদস্যুদের ফলো করতো, আর এখন আরো পিছিয়ে গিয়ে ৫০০০ বছর আগে রোমান বর্বরদের কাল্পনিক বিষয় ঘেটে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগায় বসাচ্ছে।

এই মূর্তিটি কোনভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপস্থাপন করে না বা আমাদের স্বাধীন দেশে ন্যায় বিচারের ভাস্কর্য হতে পারে না, এমন কি এটি গ্রীক দেবীকেও সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একে শাড়ি পড়িয়ে হাস্যকর করে তুলা হয়েছে, একে সরিয়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সঠিক মনে করি, আমার এই দীর্ঘ আলোচনা এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে।

সেরা কৌতুকঃ মূর্তি বনিয়ে তাকে আবার শাড়িও পরিয়ে দেওয়া হয়েছে

themise57e77c1 থেমিস কে ছিলেন?
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। ইনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশের বিচারে ইনি ১২ জন টাইটানের একজন। ভবিষ্যৎ-বাণী করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন গেইয়ার কাছ থেকে। পরে এই ক্ষমতা ফিবিকে প্রদান করেছিলেন। দেবরাজ জিউসের ঔরসে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন হোরায়ে (ঋতু নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী) এবং মোইরায়ে (ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের তিন দেবী। রোমান পুরাণে এর নাম জাস্টিয়া (Justitia)।

ইউরোনোমে এই থেমিস এবং ইউরিমেডোন-কে বৃহস্পতি গ্রহ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।

আদি রোমানরা গ্রিক মিথ এর কথিত দেবী জাস্টিসিয়াকে বিচারের প্রতীক হিসেবে মনে করতো।

প্রাচীন রোমে বিচার বা সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিলো সেটা মনে করতে গ্লাডিয়েটর মুভির কথা মনে করে দেখা যেতে পারে।যেখানে দাসদের আটকে রেখে হিংস্র পশুর সাথে যুদ্ধ করতে দেওয়া হতো, আর সেই জঘন্য দৃশ্য দেখে মজা নিতো সম্রাট ও সাধারণ জনগন।
৫০০০ বছর আগে বর্বর রোমানরা কি কল্পকাহিনী বিশ্বাস করতো, সেটাকে একেবারে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগাতে বসাতে চাইছে আধুনিকতার নামে, কি বিস্ময়কর!

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এখনও অনেক সেকেলে অন্ধকারে আছে। আড়াইশ’ বছর আগে ব্রিটিশ জলদস্যুরা যে কুসঙ্কারাচ্ছন্ন আইন শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটাই এখন মুর্খের মত ফলো করে যাচ্ছে উকিল-জাস্টিসরা।

প্রধান বিচারক মাথায় উলের টুপি পড়ে মা-ভেড়া সেজে থাকে, দাবি করে- সে মা ভেড়া তার সামনে সবাই সমান। এখনও উকিলরা জাস্টিসদের দেখলে ব্রিটিশ নিয়মে ‘মাই লর্ড’ ‘মাই লর্ড’ (আমার প্রভু, আমার প্রভু) করে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এতটাই অন্ধ অনুকরণপ্রিয় যে, ব্রিটেনে তীব্র শীত পরার কারণে উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট, গাউন পরে থাকে। আর বাংলাদেশে সেই অণুকরণে গরমকালে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে শত শত লোকের মধ্যে ভ্যাপসা আবহাওয়ায় উকিল-জাস্টিসরা কোর্ট-গাউন পরে থাকে। দরদর করে ঘামতে থাকে, কিন্তু ব্রিটেনের অন্ধ অনুকরণ বলে কথা!!

দুঃখের কথা- ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৫ বছর হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর, কিন্তু এখনও বিচারবিভাগ সেই ব্রিটিশ ভাষা থেকে বের হতে পারলো না। এখনও সুপ্রীম কোর্টে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ অচল।

কথাগুলো এ কারণে বললাম- সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা যেন আরো উল্টো পথে হাটছে। এতদিন ২৫০ বছর আগের ব্রিটিশ জলদস্যুদের ফলো করতো, আর এখন আরো পিছিয়ে গিয়ে ৫০০০ বছর আগে রোমান বর্বরদের কাল্পনিক বিষয় ঘেটে সুপ্রীম কোর্টের নাকের ডগায় বসাচ্ছে।

উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাইকোর্টের সামনে গ্রিক থেমেসিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ গ্রিক থেমেসিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে। এটাতো আমাদের দেশে আসার কথা না। আর গ্রিকদের পোশাক ছিল একরকম, সেখানে মূর্তি বানিয়ে তাকে আবার শাড়িও পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাও একটা হাস্যকর ব্যাপার করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা কেন করা হলো, কারা করল, কীভাবে—আমি জানি না। ইতিমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এই খবরটা দিয়েছি এবং খুব শিগগিরই আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।

আশা করা যায় মূর্তি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তার অবসান হবে।

আনন্দে মঙ্গলে বাঙালির শোভাযাত্রা

আরেকটি বাংলা বছর চলে গেল। আর কয়েকদিন পরেই বাংলা নববর্ষ। ১৪২৪ বঙ্গাব্দ কড়া নাড়ছে আমাদের দরজায়। কবিগুরু বলেছেন- এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/ রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। হ্যাঁ- আমরা একটি অগ্নিস্নান চাই। চাই শুচি হোক ধরা। বৈশাখ বাঙালির উৎসব। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির উৎসব। সেই উৎসবকে বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। বর্ষবরণের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের বিরোধিতা করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। শোভাযাত্রাকে অনৈসলামিক আখ্যায়িত করেছে তারা। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল না করলে আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছে দলটি।

সরকারের উদ্দেশে তারা বলেছে, বর্ষবরণের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার আদেশ বাতিল করা না হলে ঈমানদার জনতা ময়দানে নেমে আসতে বাধ্য হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ইসলামবিরোধী। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িক। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনোক্রমেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত নয়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার কোথাও কি বলা হয়েছে, মানুষ অন্য কোনো শক্তির কাছে মঙ্গল চাইছে? তাহলে হঠাৎ করে ধর্মের দোহাই দিয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হয় বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক। তা ফুটিয়ে তোলা হয় চিত্র, মুখোশ আর প্রতীকে। প্রতি বছরই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি মূলভাব থাকে।

এই মঙ্গল শোভাযাত্রার দিকে ফিরে তাকানো যাক। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের পয়লা বৈশাখে যশোরে। তখন ছিল দেশে সামরিক স্বৈরশাসন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে এক করা। এক যাত্রায় নিয়ে আসা। আর সেই শোভাযাত্রায় অশুভের বিনাশ কামনা করে শুভ শক্তির আগমনের প্রার্থনা করা। এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম। তিনি ঢাকার চারুকলা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যশোরেই ‘চারুপিঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তখন। তিনি মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন, পহেলা বৈশাখে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। দেশের লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। আর তার মাধ্যমে সবাইকে সত্য এবং সুন্দরের পথে আহ্বান করা। তাই তাদের শোভাযাত্রায় স্থান পায় নানা ধরনের চিত্র, হাতে বানানো পাখা, ঘোড়া, হাতি, ঢোল, বাঁশি প্রভৃতি। শোভাযাত্রাটি থাকে নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। এই শোভাযাত্রার মূলভাব প্রতিবাদের, ভালোবাসার এবং দ্রোহের। সেখানে অশুভের বিনাশ কামনা করা হয়। প্রার্থনা করা হয় সত্য এবং সুন্দরের জন্য। আনন্দের কথা হচ্ছে, এখন সারা দেশেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সারা দেশে একই সময় পহেলা বৈশাখ সকাল ১০টায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। এই আলো ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, টরেন্টো, টোকিও, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডাসহ অনেক দেশেই এখন বের হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে চারুকলা ইনস্টিটিউট। এই শোভাযাত্রার আয়োজনে নানা ধরনের চিত্র, প্রতিকৃতি, মুখোশ তৈরি করেন চারুকলার ছাত্র এবং শিক্ষকরা। প্রাণের টানে, স্বেচ্ছা শ্রমে এগিয়ে আসেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী।

বাঙালি জাতির জন্য এটা খুবই আনন্দের কথা, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক এই সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্বীকৃতির কথা জানিয়েছে। ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরো যে কয়েকটি কারণ ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। আমি মনে করি, বাঙালি জাতি ১৯৭১ সাল থেকেই তাদের নবউদ্যমে যাত্রা শুরু করেছে। বিজয়ী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বে। তাহলে আজ সাড়ে চার যুগ পরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টুঁটি চেপে ধরার পাঁয়তারা করা হচ্ছে কেন? কারা এটি করছে? তাদের অতীত পরিচয় কি?

আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি, এবারের শোভাযাত্রাকে ঘিরে জয়নুল গ্যালারির সামনেই তৈরি হচ্ছে বৃহৎ আকারের নানা মুখোশ। বাঁশ- বেত দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাখি। তৈরি হচ্ছে বিশাল আকৃতির নানা শিল্প-কাঠামো। তার জন্য আনা হচ্ছে বাঁশ, বেত ও অন্যান্য সরঞ্জাম। আয়োজকরা জানিয়েছেন, অন্ধকারের বিরুদ্ধে এবার থাকছে নানা মোটিভ, থাকছে নানা শৈল্পিক প্রতিবাদ। শোভাযাত্রায় অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে থাকছে সূর্যের মুখের কাঠামো। অন্ধকার তাড়াতে যেন আলোয় ভরে ওঠে পৃথিবী। বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী বলেছেন, ‘যেহেতু মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তাই এবারের আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করার প্রচেষ্টা থাকবে। আশা করছি, এবারের শোভাযাত্রাটি আরো বর্ণাঢ্য ও বিস্তৃত হবে। সর্বসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত‚র্ত অংশগ্রহণও বাড়বে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে।’

অন্যদিকে একটি মৌলবাদী মহল এই শোভাযাত্রা বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। তারা বলছে, এই দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের। তাহলে কি দেশটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের নয়? ১৯৭১ সালে তো সবাই মিলেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমশ ছড়াচ্ছে দেশে-দেশে। মনে পড়ছে, বাঙালির উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, খাদ্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম এবং সাহিত্য আমেরিকানদেরও সমৃদ্ধ করেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সারা বিশ্বের বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ১৪২৩ এর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেছিলেন। ওবামা বলেছিলেন, বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর গৌরবময় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এই উৎসবে যুক্তরাষ্ট্রও সঙ্গে রয়েছে। বাংলা উচ্চারণে ‘শুভ নববর্ষ’ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা বাঙালিদের উদ্দেশে আরো বলেছিলেন, ‘পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে আপনারা যখন এই বর্ষবরণে একত্রিত হবেন, তখন আপনাদের বন্ধু এবং এই আনন্দের অংশীদার হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের পাশে রয়েছে।’

বাঙালির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। একাত্তরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই দেশমাতৃকার মুক্তিপণে অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের অনেকেই এখনো আছেন এই বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বটবৃক্ষ হয়ে। আজ তাদের সামনেই মৌলবাদীরা নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। দেশে যখন জঙ্গিবাদী আস্তানার খোঁজে সরকার মরিয়া, তখন এমন হুমকি মূলত বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর আঘাত। তারা সাধারণ মানুষকে গোটা জাতির মূলধারার বিপক্ষে দাঁড় করাবার অপচেষ্টা করছে। এ অবস্থা রুখে দিতে প্রজন্মকে সাহস নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই দেশে জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে কারা বিষোদগার করেছে- তা আমাদের অজানা নয়। কারা এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে না, তা আমাদের অজানা নয়।

গত বছর বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেছিলেন- ‘আবহমান বাঙালির এ উৎসবে নতুন মাত্রা দিতে আমরা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে উৎসবভাতা প্রবর্তন করেছি। বাঙালির শাশ্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয়তাবোধ ও চেতনাকে শাণিত করে। বর্ষবরণের উৎসবে এ চেতনাকে নস্যাৎ করার জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। আঘাত করা হয়েছে বারবার। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো অপচেষ্টাই সফল হয়নি। বাঙালি জাতি নববর্ষকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। আমি আশা করি, পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির এ চর্চা আমাদের জাতিসত্তাকে আরো বিকশিত করবে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগাবে। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা ও দেশের সম্পদ ধ্বংসকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ করবে।’ হ্যাঁ- সেই ঐক্যের পথেই এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ। দেশের মানুষ শান্তি চায়। তাই কতিপয় ধর্মীয় উন্মাদের হাতে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জিম্মি থাকতে পারে না।

__________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৭

পুলিশ বাহিনীকে হেয়প্রতিপন্ন করার আগে

বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই লিখব ভাবছিলাম। এটা আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীতে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে উসকে দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনীর একটি গৌরবপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমি আজ সেই বিষয়টি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। তার আগে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই, সেই বীর পুলিশ সদস্যদের যারা এই বাংলাদেশে জঙ্গি হামলায় তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অতি সম্প্রতি সিলেটে দুইজন পুলিশ অফিসার ও একজন র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান প্রাণ দিয়েছেন। এরা হচ্ছেন- সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিএসবির সিআইও-১ চৌধুরী মোহাম্মদ আবু কয়সর দিপু , সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. মনিরুল ইসলাম এবং র‌্যাব-৯-এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। আহতদের মধ্যে রয়েছেন মেজর আজাদ ও দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি হারুনুর রশিদ।

প্রিয় পাঠক, আমি আপনাদের একটি খোলা চিঠি পড়াতে চাই। নিজের ফেসবুকে এটি লিখেছেন আরেকজন পুলিশ ইন্সপেক্টর শাহরিয়ার বিপ্লব। তিনি তার সহকর্মী অফিসার চৌধুরী আবু কয়সর দীপুকে লিখেছেন এই চিঠিটি। ‘অশ্রুসিক্ত জানাজায় রক্তিম বিদায় দিপু ভাই’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন- ‘কিছুই লিখতে পারছি না। কোনো কিছুই আসছে না। শুধুই স্মৃতি। কিছু স্পষ্ট। কিছু অস্পষ্ট। এলোমেলো। অগোছালো। রাতেই খবরটা পেয়ে হাসপাতালে যাই। বিছানায় শুয়ে আছেন। সবাই ব্যস্ত। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আর্মি, দলীয় নেতা, কর্মী জনগণ। এর ভেতরেই দীপু ভাই কি ঘুমাচ্ছেন? ডাকব? ও মা নাকে তুলা। চোখের নিচে কানের কাছে লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। গভীর ঘুম। মহা ঘুম। চিরতরের ঘুম।

শনিবার দুপুরে যখন শিববাড়িতে গিয়েছিলাম পেশাগত কৌত‚হল থেকে। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ভেতরে যাইও না, ওখানে যাওয়া নিষেধ। তবু আমাকে যেতে দেখে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুকে বললেন, হারা জীবন খালি বিপদ ডাইক্কা আনে। যাও গিয়া মর গিয়া। ওনাদের ক্রস করে একটি বাসার ওপরে গেলাম যেখানে পরিচিত বড় ভাইরা নিরাপদে অভিযান দেখছিলেন। সেখান থেকে দেখছিলাম সাংবাদিক বন্ধুদের এক্টিভিটিজ। দীপু ভাইকেও দেখছি সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করছেন। একজনকে দেখলাম দীপু ভাইয়ের কাঁধে ক্যামেরা রেখে ছবি তুলছেন। বিকালে চলে আসি বালুচরে একটি বাসায় দাওয়াত খেতে। সন্ধ্যায় মুসলিম হলে অন্য একটি অনুষ্ঠানে। বন্ধু মানোয়ার যখন সংবাদটি দিল বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দৌড়ে যাই ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে।

আমাকে সাবধান করে নিজেই মরে গেলেন? কীভাবে বিশ্বাস করি দিপু ভাই? আপনি তো বোম্ব ডিস্পোজালের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এই বোমায় আপনাকে মরতে হলো। দুপুরের কথাগুলো কানে বাজছে এখনো। কত লাশ টেনেছি জীবনে। আপনার সঙ্গেও বহুবার। হবিগঞ্জে থাকার সময় প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনায় আপনি আমায় ডাকতেন। আমার ডিউটি না থাকলেও আপনার কারণে আমাকে যেতে হতো। রাতের পর রাত আপনার টহল গাড়িতে আমি ডিউটি করেছি। আমার রুটিন মাফিক অন্য ডিউটি থাকার পরেও এসপি সাহেবকে বলে আমাকে হাইওয়ে পেট্রোলিংয়ের নাইট ডিওটিতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন শুধু আপনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। আপনি বলতেন নিজের মানুষ পেলে বুকে সাহস বেশি পাই। আমিও ক্রাইম কন্ট্রোলের কাজ পেয়ে এনজয় করছিলাম নিজেকে। বড় ভাই থেকে পরে বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়কার আনন্দ সুখের দিনগুলো দ্রুত মনে পড়ছিল। আমি সিলেটে আসার কিছুদিন পর আপনিও চলে আসেন। সিলেটের অনেক ঘটনার সাক্ষী আপনি। বারবার আমাকে বড়ভাই সুলভ শাসন করেছেন। আমার বিয়েতেও বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আপনার কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। দুঃখের কথাগুলো আমায় বলতেন। আপনার আমার পরিচিত অপজিশনের ছেলেগুলো নেতাদের তেল মেরে মেরে ভালো ভালো পদে বসে আছে কিন্তু আপনি পজিশনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেও গুরুত্বহীন পদে বসে আছেন। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও কারো কাছে যাননি তদবির করতে। এ নিয়ে আপনাকে কিছু বললে আপনি আমাকে উল্টো ঝাড়ি দিতেন। কিন্তু আজকে শাসন করে আজকেই চলে গেলেন। কীভাবে মেনে নেই। আমেরিকা থেকে আসার পরে আপনাকে বলেছিলাম চলে যান। শুধু আমি না। সারোয়ার ভাই, বিজিত দাসহ পরিচিত অনেকেই। আপনি রাগ করে বললেন, তোমার ব্যবস্থা করে দেই তুমি যাও। গিয়া দেখ কেমন লাগে।

দীপু ভাই, অকালে মৃত্যুর স্বাদ পেতেই বুঝি এসেছিলেন? বুকটা ভার হয়ে আসছে। মুখে দলা আসে। বমি বমি লাগছে। কেন দীপু ভাই। কত সঙ্গী-সাথীকেই তো হারালাম। একসঙ্গে ডিউটি করা অবস্থায় বন্ধু সার্জেন্ট করিমকেও হারিয়েছিলাম। ওর লাশ নিয়ে রাজারবাগে মিছিল করেছিলাম। লাশ নিয়ে রাজারবাগ থেকে আরিচা পর্যন্ত গিয়েছিলাম ইমোশনাল হয়ে। আজ কেনই বা সিলেটে এলাম। আমার তো এখানে আসার কথা না। তবে কি আপনাকে এভাবে বিদায় দিতেই আসা। কফিন টানার জন্যই কি ঢাকা থেকে আসা? বুকের ভার কমছে না দীপু ভাই। আপনি তো নাইওরপুল মসজিদে প্রতিদিন নামাজ আদায় করতেন। আপনি না বলতেন আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে তদবির করবেন না। তবে কি মৃত্যুর তদবির করেছিলেন? কীভাবে মেনে নেই? যদি কাঁদতে পারতাম। জোরে জোরে কান্না। গগনবিদারী কান্না। কিংবা চিৎকার। জোরে যদি চিৎকার দিয়ে একটি স্লোগান দিতে পারতাম। আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে যদি বলতে পারতাম, জঙ্গিবাদ মৌলবাদ-ধ্বংস হোক, নিপাত যাক।

দীপু ভাই, বিশ্বাস করুন আপনারা আমাদের ঋণী করে গেলেন। লাল- সবুজের এই মানচিত্রকে আরো গাঢ় লাল করে দিয়ে গেলেন। সবুজ মাটিকে আরেকটু ভিজিয়ে দিয়ে গেলেন। এ ঋণ আমরা শোধ করবই। এ দেশকে আফগানিস্তান সিরিয়া হতে দেব না। এ আমার দেশ। বাংলাদেশ। এ আমার মা। মায়ের আঁচলে যতই খামচে ধরুক জঙ্গিবাদের বিষাক্ত শকুন। শকুনের এ ডানা ভাঙবই। এ আমাদের অঙ্গীকার।’

সুধী পাঠক, এই হলো বাংলাদেশ। এই হলো আমাদের একাত্তরের চেতনা। এই হলো আমাদের পুলিশ বাহিনী। আমাদের গর্ব, এখনো আমাদের হাজার হাজার শাহরিয়ার বিপ্লব বেঁচে আছেন। তারা আছেন এই দেশকে রক্ষা এবং সেবা করার জন্য। আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, বাংলাদেশে আমাদের অনেকেই পুলিশকে খুব সহজেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি। হেয়প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালাই। কেন এমনটি করি? এরাও তো আমাদের ভাই। আমাদের বোন। আমাদের সন্তান। খুব বিনয়ের সঙ্গে জানাই বিশ্বের অন্তত ১৫টি দেশের পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর নীতি ও আদর্শ বিশ্বের সব দেশেই প্রায় সমান। একটা উদাহরণ দিই। নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যেদিন আক্রমণ হয়, সেই নাইন ইলেভেনটি ঘটেছে ঠিক আমার চোখের সামনেই। পেশাগত কাজে খুব দূরত্ব বজায় রেখেই, পুলিশ ব্যারিকেড মেনেই আমাদের এগোতে হয়েছিল। বাংলাদেশে সেই ব্যারিকেড কতটা মানেন জনগণ? কিংবা কেন মানেন না? হুমড়ি খেয়ে পড়ে তো মূলত পুলিশের কাজেই বাধা দেয়া হয়। কেন এমনটি করা হয়?

আমি দেখেছি, যে সাংবাদিক হুমকি-ধমকি দিয়ে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমতা দেখান তারা নিউইয়র্কে-লন্ডনে এসাইনমেন্ট নিয়ে এসে এখানের পুলিশকে খুব সমীহ করেই চলেন। বাংলাদেশে তা করতে অনেকের অসুবিধা কোথায়? না আমি গড়পরতা সবাইকে দোষ দিচ্ছি না। কেউ কেউ তা করে থাকেন। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

আমরা দেখেছি, গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দুই পৃথক হামলায় নিহত চার পুলিশ সদস্যের পরিবারের হাতে মোট ৫০ লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছেন তিনি। গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট রবিউল করিম এবং বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খান ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। একই বছরের ৭ জুলাই শোলাকিয়া ঈদ জামাতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন কনস্টেবল জহুরুল হক ও কনস্টেবল আনসারুল হক।

রাষ্ট্র, পুলিশের (ডিএমপি) জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহ উদ্দিন খানকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) দিয়েছে। এই সম্মান গোটা বাঙালি জাতির। আমি বলছি না পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতিপরায়ণ সদস্য নেই। কোথায় নেই? সব দেশে, সব ক্ষেত্রেই আছে এমন মানুষের বিচরণ। তাই বলে পুরো বাহিনীকে দোষ দিতে হবে কেন?

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাব পাওয়া পুলিশ সদস্যের সংখ্যা কম। পুলিশের মহান দেশপ্রেম ও ত্যাগকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি, যতদিন পৃথিবীর বুকে এই স্বাধীন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। সিলেটের শিববাড়ির অপারেশনের সমাপ্তি ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেছেন, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট যে কোনো ক্রাইসিস মোকাবেলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’ কথাটি খুবই সত্য। মনে রাখা দরকার- এই অপারেশনের সূচনা করেছে পুলিশ বাহিনী। আর সমাপ্তি করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। তাই আমি খুব দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, পুলিশ বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে সবার সাহায্য করা উচিত। এই বাহিনীকে হেয়প্রতিপন্ন করার আগে সবাইকে সংযত হতে হবে। সাহায্য করতে হবে সব শক্তি দিয়ে। দেশে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী যে শক্তি দাপট দেখাচ্ছে, তা মোকাবেলা করার প্রথম বাহিনী পুলিশ। র‌্যাব, বিজিবি, সামরিক বাহিনী এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী শক্তি। প্রথম বলয়টি কিন্তু পুলিশের হাতেই রচিত হয়। আর তাই ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা সাক্ষ্য দেয়, তুলনামূলক পুলিশ বাহিনীতেই হতাহতের কিংবা আত্মত্যাগের সংখ্যা বেশি। আসুন আমরা পুলিশের সহযোদ্ধা হই। পাশাপাশি দেশমাতৃকার জন্য দাঁড়াই- যে যেভাবে পারি।

_________________________________
নিউইয়র্ক থেকে ফকির ইলিয়াস : কবি, কলাম লেখক।
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। ১ এপ্রিল ২০১৭ শনিবার।

মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন প্রবাসীরা ও প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু ভবন

ইচ্ছে ছিল ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর একটি খণ্ডচিত্র দিয়ে এই লেখাটি লিখব। এই সময়ই একটি বিষাদ সংবাদ। লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ২২ মার্চ ২০১৭ বুধবার দুপুরে। লন্ডনে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ভবনের কাছে একটি গাড়ি পথচারীদের ওপর তুলে দিয়েছিল এই সন্ত্রাসী। এরপর ছুরি হাতে পুলিশকে মেরে এক ব্যক্তি পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকতে গেলে তাকে গুলি করে মেরেছে নিরাপত্তাকর্মীরা। বিকেলে পার্লামেন্টে অধিবেশন চলার সময় হঠাৎ বিকট একটি শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর পরক্ষণেই কয়েকটি গুলির শব্দ পাওয়ার কথা পার্লামেন্ট সদস্য ও কর্তব্যরত সাংবাদিকরা টুইটারে জানালে সঙ্গে সঙ্গে তা গণমাধ্যমের শিরোনামে চলে আসে। এই ঘটনায় মোট চারজন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। কেন এই হামলা? কেন এই আক্রমণ? মানুষ শান্তির কথা বলছে। তাহলে বিশ্বের দেশে দেশে এই শান্তি বিনষ্ট করছে কে?

ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার মাস। এই যে স্বাধীনতা, তা বড় চড়া মূল্যে পাওয়া। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের একটি বিশাল ভূমিকা ছিল। এর মাঝে, ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বিভিন্ন দলিলে আমরা এর প্রমাণ পাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯১ থেকে আমরা জানছি- মার্চেই যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছুটে আসেন রাস্তায় রাস্তায়। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্থানে স্থানে জনসভার ব্যবস্থা হয়। লন্ডনের ‘স্মলহিত পার্কে’ এক বিরাট গণসমাবেশ হয়। এতে জোরালো ভূমিকা রাখেন জনাব জগলুল পাশা, আসোক আলী, আহসান ইসমাইল, আফরোজ মিয়া, আব্দুল হান্নান, সবুর চৌধুরী, আব্দুল ওয়াহিদ লোদী প্রমুখ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের ব্যক্তিরা। তারা বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল সহকারে জনগণকে নিয়ে সমবেত হন স্মলহিত পার্কে। লন্ডনের বার্মিংহামের স্মলহিত পার্কে হাজার হাজার বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রোববার দুপুর ২টার সময়। এসব ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, জেনারেল ওসমানীর আদেশক্রমে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে, ‘একশন কমিটির ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউ কে’, সংক্ষেপে ‘একশন কমিটি’ স্টিয়ারিং কমিটি, বাংলাদেশ সেন্টার, বাংলাদেশ ফান্ড ইত্যাদি সংস্থা গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত অর্জনে ও চাঁদা সংগ্রহে লাফিয়ে পড়েন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

জেনেভা থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এসে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ওসমানীর নির্দেশ সংবলিত পত্র ও আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। স্বেচ্ছায় হাজার হাজার যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে লাখ লাখ পাউন্ডে সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ফান্ডে জমা দেন। সরকারি হিসাবে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ৪,১২,০৮৩,২৬ পাউন্ড দান করেন। (তথ্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড পৃ.৭৭৭)।

বাংলাদেশ সেন্টারকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন তাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন মিনহাজ উদ্দীন, গৌছ খান, আবদুল মুতালিব চৌধুরী, তৈয়বুর রহমান, রমজান আলী, মশরু মিয়া, আতাউর রহমান খান, হাফিজ মজির উদ্দীন, নিছার আলী, মোস্তাক কুরাইশী, উস্তার মিয়া, খন্দকার ফরিদ উদ্দীন, সোনা মিয়া, নিম্বর আলী, শামসুর রহমান, শামসুদ্দিন খান, নূর মিয়া, আবদুর রকিব, আবু বকর সুলতান শরীফ প্রমুখ। তাদের অনেকেই এখনো সাক্ষী হয়ে আছেন।

সেই ব্রিটেনে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ নির্মাণের একটি প্রস্তাব করেছেন ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক, প্রতিদিনের সিলেট ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক সুজাত মনসুর। তিনি তার একটি লেখায় শুরু করেছেন এভাবে- “আমার প্রথম দুটো বই ‘কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘সফল রাজনীতিক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’-র পাঠোন্মোচন অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রথমেই একটা ধাক্কা খাই। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, যার অনুপ্রেরণায় আমি আজ কলাম লেখক থেকে একজন পূর্ণাঙ্গ লেখক বনে গেলাম, সেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠানটি করার। কিন্তু যারা এই অনুষ্ঠানটির মূল আয়োজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তারা জানালেন গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করতে কাউন্সিলের কি জানি কি আপত্তি আছে। কেননা, গাফ্ফার ভাইয়ের দুটি কথিত বিতর্কিত লেখা নিয়ে লন্ডনের জামায়াত-বিএনপি নাকি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলকে জানিয়ে দিয়েছে- যদি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয় তখন তারা বাধা দেবে। তাই স্বাভাবিক কারণেই কাউন্সিল কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য অনুমতি দিতে গড়িমসি করে। তখন মনে কষ্ট পেলেও গাফ্ফার ভাইকে বাদ দিয়েই পাঠোন্মোচন অনুষ্ঠানটি করতে হয়। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর আপস করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। পরবর্তী সময়ে আবারো একই ঝামেলায় পড়তে হয় বঙ্গবন্ধু লেখক এবং সাংবাদিক ফোরাম, ইউকের প্রথম প্রকাশনা ‘মুজিব মানেই মুক্তি’ প্রবন্ধ সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে। কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত পূর্ব লন্ডনের একটি হলে অনুষ্ঠানটি করার ইচ্ছে থেকেই অনুমতির জন্য দরখাস্ত করা হয়। দরখাস্তে উল্লেখ করতে হয় কি বিষয়ে আলোচনা হবে, কারা কারা অতিথি কিংবা বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন হ্যাঁ অথবা কোনো উত্তরই পেলাম না তখন বাধ্য হয়ে একটা ব্যক্তি মালিকানাধীন হলে অনুষ্ঠানটি করতে হয়।”

তিনি তার নিবন্ধে লিখেছেন- ‘এ বিষয়গুলো উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, লন্ডন শহরেও বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনে কোনো অনুষ্ঠান করতে হলেও স্বল্প খরচে স্থানপ্রাপ্তির বিষয়টি সহজলভ্য নয়। দুটো অনুষ্ঠান করতে গিয়েই আমি তা অনুভব করেছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভাবছিলাম, সব প্রকার ঝক্কি-ঝামেলামুক্ত হয়ে কীভাবে মনের মতো অনুষ্ঠান করার একটা হল কি আমরা গড়ে তুলতে পারি না? উত্তরটা সহজেই পেয়ে গেলাম। আমরা প্রবাসীরা উদ্যোগী হলেই তো একটা নিজস্ব ভবন গড়ে তোলা যায়। এমনকি আমাদের তো একটা ভবন ছিলই, বাংলাদেশ ভবন। যা বিক্রি করা হয়েছে অনেক আগেই এবং ভবনটি বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়ে পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ডে একটা ঘরও কেনা হয়েছিল এবং বাকিটা ব্যাংকে গচ্ছিত আছে। এখনো আছে বাংলাদেশ সেন্টার, যদিও তেমনভাবে চলছে বলে মনে হয় না। আর সেন্টারটি পশ্চিম লন্ডনে অবস্থান করার কারণে বাঙালিরা ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কেননা, আমাদের সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় পূর্ব লন্ডন কেন্দ্রিক। এই ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আবির্ভূত হলো সম্প্রতি বিলেতে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত হাইকমিশনার নাজমুল কাওনাইনের সঙ্গে লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব। প্রস্তাবটি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর নামে একটা ভবন স্থাপনের। যুক্তরাজ্য ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও বঙ্গবন্ধু লেখক এবং সাংবাদিক ফোরাম, ইউকের অন্যতম সদস্য শাহ রহমান বেলালের উত্থাপিত প্রস্তাবের ব্যাপারে হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তিনি এ ব্যাপারে কাজ করছেন।’

সুতরাং সাদামাটা ভাবেই বলা যায়, যদি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর নামে একটা ভবন গড়ে তোলা যায়, তাহলে সে ভবনকে কেন্দ্র করে এমন একটি সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে উঠতে পারে যাতে আমাদের গোটা মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতার সংগ্রামী জীবন ও আবহমানকালের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম তো অবশ্যই, এমনকি ভুলে যাওয়া প্রজন্মও নতুন করে স্মরণ করার সুযোগ পাবে। এই ভবনে অনুষ্ঠান করার মতো একটি হল ছাড়াও গড়ে উঠতে পারে পাঠাগার, চিত্রপ্রদর্শনীর মতো গ্যালারি। থাকতে পারে নাটক-সঙ্গীতানুষ্ঠানের মহড়ার উপযোগী কক্ষ। অর্থাৎ ভবনটি হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ব্যক্তিদের মিলনকেন্দ্র। লাইব্রেরিতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং আবহমান বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কিত পুস্তকাদি। থাকবে অনুবাদের জন্য একটি সেল, যারা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুবাদের কাজ করবে এবং সেই অনূদিত বই বা রচনা প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। গ্যালারিপূর্ণ থাকবে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আর আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য সংবলিত আলোকচিত্র আর শিল্পকর্মে।’

তিনি উপসংহারে লিখেছেন- ‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধু ভবন গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব পালন করবে কে? প্রবাসী বাঙালিরা, নাকি বাংলাদেশ সরকার। উত্তর একটাই, বাংলাদেশ সরকার। ব্যক্তি বা সমষ্টিগত উদ্যোগে করতে গেলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হবে এটাই বাস্তবতা। কেননা, সবাই তালগাছটি নিজের করে চাইবে। আর যেহেতু হাইকমিশন হচ্ছে সরকারের বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান, তাই দায়িত্বটি তাদেরই নিতে হবে। সেটা বাংলাদেশ ভবন বিক্রি করে মাইল এন্ডে যে ঘরটি কেনা হয়েছিল সেখানে করবেন নাকি ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সঙ্গে আরো যুক্ত করে নতুন ঘর কিনে করবেন তারাই তা ঠিক করবেন। তবে শর্ত কিন্তু একটাই, তা হতে হবে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে। আর হাইকমিশনার এবং হাইকমিশন যাতে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে না পারে সেজন্য বিলেতের বিভিন্ন শহর থেকে জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে। এমনকি দেশে ও প্রবাসের অন্যান্য দেশেও এই দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে। শুধু ফেসবুকে কিংবা পত্রিকায় লিখে অথবা টকশোতে ঝড় তুলে কাজ হবে না।’ আমি লেখক-সাংবাদিক সুজাত মনসুরের বক্তব্যের সঙ্গে পুরোই একমত। তবে শঙ্কা একটাই, যদি কোনো দিন বঙ্গবন্ধুবিরোধী কোনো শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসে- তাহলে এই ভবনের ভবিষ্যৎ কি হবে? এর উত্তরও আমি খুঁজে পেতে চাই এই বলে- বাংলাদেশে যদি বঙ্গবন্ধুর নামে গড়া স্থাপনাগুলো বহাল থাকে, তবে বিদেশেও থাকবে। আমিও মনে করি, লন্ডন শহরে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ নির্মাণে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগী হতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন।

__________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ২৫ মার্চ ২০১৭

বিশ্ব কবিতা দিবস আজ (World Poetry Day Today)

poetry

আজ “বিশ্ব কবিতা দিবস”। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ মার্চকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, “এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলোকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।”

পূর্বে অক্টোবর মাসে বিশ্ব কবিতা দিবস পালন করা হত। প্রথম দিকে কখনও কখনও ৫ অক্টোবর এই উৎসব পালিত হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণে ১৫ অক্টোবর এই দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। অনেক দেশে আজও অক্টোবর মাসের কোনো দিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস পালন করা হয়।এই দিবসের বিকল্প হিসেবে অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসের কোনো দিন কবিতা দিবস পালনেরও প্রথা বিদ্যমান।

কবিতা কী? কবিতার গুরুত্ব কটোটুকু আজকের এই সমাজে? – এসব নিয়ে বিতর্ক হয়তো করা যায়। কিন্তু কবিতা যে হৃদয়ের সুকুমারবৃত্তিকে লালন করে তাতে সন্দেহ নেই। কবিতা অনেকক্ষেত্রেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বড় হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।
বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে সমকালীন কবিতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মনে করে, কবিতা হলো কিছু মানুষের অপ্রয়োজনীয় সৃষ্টি কিংবা মিথ্যা ভাষ্য মাত্র। তবে কবিতাকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করি কিংবা কবিতা আমাদের চেতনাকে কতটা জাগ্রত করে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

কবিতা দিবস
কবিতা দিবস

কবিতায় সমসাময়িক বিষয় ওঠে আসবে এটা স্বাভাবিক। কবি এস টি কোলরিজের মতে—‘কোনো কবিই বড় কবি হতে পারেননি সত্যসন্ধ দার্শনিক হওয়া ছাড়া।’

আজকের দিনে, আমাদের কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ –এর “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি” কবিতার অংশবিশেষ তোলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ

জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।“


তথ্যসূত্রঃ বাংলা উইকিপিডিয়া

সমাজ, স্বাধীনতা ও আত্মশক্তি

একজন মানুষকে আত্মশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হলে তার স্বাধীনতা থাকতে হয়। সেই স্বাধীনতা হতে হয় ন্যায়ের, সেই স্বাধীনতা হতে হয় সামাজিক কল্যাণের। অতিসম্প্রতি দুটি সংবাদ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হচ্ছে। কর্মস্থলে স্কার্ফ নিষিদ্ধের পক্ষে রায় দিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আদালত। নিয়োগকর্তারা চাইলে কর্মস্থলে কর্মচারীদের মাথার স্কার্ফ বা এমন কোনো রকম ধর্মীয়, রাজনৈতিক কিংবা দার্শনিক প্রতীক পরায় বাধা দিতে পারবেন বলে রায় দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ আদালত।

ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিকভাবে বহুল আলোচিত হচ্ছে এ বিষয়টি। ঠিক এই সময়েই প্রথম ইউরোপীয় কোর্ট অব জাস্টিস (ইসিজে) এমন আদেশটি দিয়েছে। তবে আদালত রায়ে এও বলেছে যে, কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মচারীদের নিরপেক্ষভাবে পোশাক পরার অভ্যন্তরীণ নীতির ভিত্তিতেই এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। কোনো কাস্টমারের ইচ্ছার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

বেলজিয়ামের একটি ফার্ম ২০০৬ সালে মাথায় স্কার্ফ পরার কারণে একজন রিসিপশনিস্টকে বরখাস্ত করে। এরপরই কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন দাবি করে চাকরিচ্যুত সামিরা আচবিতা আদালতের শরণাপন্ন হন। পরে বেলজিয়াম আদালত বিষয়টির আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যার জন্য ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি হস্তান্তর করে। ‘ওপেন সোসাইটি জাস্টিক ইনিশিয়েটিভ’ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইইউ বৈষম্যহীনতা আইনে সমঅধিকারের নিশ্চয়তার বিষয়টি এ রায়ে দুর্বল হয়ে পড়বে।’

আরেকটি সংবাদ খুবই চিন্তিত করেছে বিশ্ববাসীকে। নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার ব্যাপারে সৌদি আরবে নারী কাউন্সিল চালু করা হয়েছে। কিন্তু শংকার কথা হচ্ছে, কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো নারী ছিলেন না। ১৩ জন পুরুষের বৈঠকের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে কাউন্সিল। আল-কাশিম প্রদেশের প্রথম এ নারী পরিষদকে বলা হচ্ছে ‘কাশিম গার্লস কাউন্সিল’। বিবিসি তাদের সংবাদে বলেছে, খুব সম্ভবত নারীরা অন্য একটি কক্ষে ছিলেন এবং ভিডিওকলের মাধ্যমে বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

আল-কাশিম প্রদেশের গভর্নর প্রিন্স ফয়সাল বিন মিশাল বিন সৌদ গার্লস কাউন্সিলের উদ্বোধনী বৈঠকের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি সম্মেলন নিয়ে তিনি গর্বিত এবং সৌদি আরবে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। তিনি বলেছেন, ‘কাশিম প্রদেশে আমরা নারীদের পুরুষদের বোন হিসেবে দেখি। আমরা নারীদের প্রতি আরো উদারতা দেখানো এবং তাদের আরো সুযোগ দেয়া যা নারী ও মেয়ে শিশুদের কাজে লাগবে সেটিকে আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি।’

সৌদি আরব বলছে, তারা মডারেট হচ্ছে। অথচ সৌদি আরবে নারীদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আছে। এমনকি সেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিও দেয়া হয় না। কিন্তু তারা বলছে, ‘ভিশন-২০৩০ প্রোগ্রাম’-এর অংশ হিসেবে দেশটির সরকার নারীদের ওপর ওই সব বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করতে পারে। ওই প্রকল্পের অধীনে কর্মক্ষেত্রে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ নারী কর্মী থাকার লক্ষ্যমাত্রাও ধার্য করা হয়েছে। গোটা বিশ্বেই একটা বৃহৎ অংশ নারী। চলমান পুঁজিবাদের আওতায় এটা ধরেই নেয়া হয় যে, নারীরা গৃহভিত্তিক নানা কাজ ও অন্যান্য বিষয়ে শ্রমদান করবেন। গৃহের কাজ কর্মসম্পাদন, শিশুদের লালনপালন ও বড় করে তোলাসহ নানা প্রকৃতির কার্যক্রম বিনা পারিশ্রমিকে করার জন্য নারীদের প্রচলিত সমাজ দয়িত্ব প্রদান করে রেখেছে। ফলে তাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করাকে সমাজে ও অর্থনীতিতে অবমূল্যায়ন করে আসছে। একটু ভিন্নভাবে বিষয়টিকে দেখলে আমরা দেখতে পাব যে, মুনাফা লাভের জন্য শ্রমিকের বেতন কমানোর সূত্র থেকেই এর উৎপত্তি হয়েছে। মহামহিম লেনিন প্রাভদা নং ১০২-এ লিখেছিলেন- ‘বর্তমানে সমাজে বহু প্রকার দারিদ্র্য ও নিপীড়নকে আড়াল করে রেখেছে যা প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ে না। কর্ম সময়ে, কর্মস্থল ও পরিবার উভয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে দরিদ্র ও শহুরে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো, শিল্পী, শ্রমিক, কর্মকর্তা এবং ছোট ছোট অফিস কর্মচারীরা তাদের জীবনে অবিশ্বাস্য রকম অসুবিধায় বসবাস করছে। মিলিয়ন মিলিয়ন নারী এরূপ পারিবারিক জীবনে গৃহদাসী হিসেবে দিনাতিপাত করে আসছে। পরিবারের সামর্থানুসারে তাদের খাদ্য, কাপড় ও অন্যান্য বিষয়ে অর্থ খরচ করেই সম্পাদন করা হয়, শুধু তারা নিজেদের পারিশ্রমিকটিই পান না। পুঁজিপতিরা তাদের প্রয়োজনে নারীদের নিয়োগ দান করে খুবই অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তারাও নিয়োজিত হয় ভাত-কাপড় ও নিজেদের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য।’ শুধু প্রাচ্যে কেন, পাশ্চাত্যে এই চিত্র এখনো চোখে পড়ার মতো। আর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে জেন্ডার ইস্যুগুলোই প্রকৃত সমাধান করতে পারবে না এবং তা সত্যিকার কৌশলও নয়। নারী মুক্তির জন্য সর্বাগ্রে বুঝতে হবে নারী নিপীড়নের গভীরতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো যা জেন্ডারভিত্তিক শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জেন্ডার ইস্যু ও শ্রেণির প্রশ্নের আন্তঃসম্পর্কের মীমাংসাই আমাদের নারী স্বাধীনতার সংগ্রামে সফলতা এনে দিতে পারে। বিষয়গুলো আমি এ জন্য বলছি, আমাদের সামাজিক স্বাধীনতার যে বলয়- তার অন্যতম খুঁটি হচ্ছেন নারী সমাজ। সে নারীদের ভূমিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে লিখেছেন- ‘য়ুরোপের যেখানে বল আমাদের সেখানে বল নহে। য়ুরোপ আত্মরক্ষার জন্য যেখানে উদ্যম প্রয়োগ করে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য সেখানে উদ্যম প্রয়োগ বৃথা। য়ুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার। সেই স্টেট দেশের সমস্ত হিতকর কর্মের ভার গ্রহণ করিয়াছে- স্টেটই ভিক্ষাদান করে, স্টেটই বিদ্যাদান করে, ধর্মরক্ষার ভারও স্টেটের ওপর। অতএব এই স্টেটের শাসনকে সর্বপ্রকারে সবল কর্মিষ্ঠ ও সচেতন করিয়া রাখা, ইহাকে অভ্যন্তরিক বিকলতা ও বাহিরের আক্রমণ হইতে বাঁচানোই য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রাণরক্ষার উপায়।’

আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে। তাহা ধর্মরূপে আমাদের সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া আছে। সেই জন্যই এতকাল ধর্মকে সমাজকে বাঁচানোই ভারতবর্ষ একমাত্র আত্মরক্ষার উপায় বলিয়া জানিয়া আসিয়াছে। রাজত্বের দিকে তাকায় নাই, সমাজের দিকেই দৃষ্টি রাখিয়াছে। এই জন্য সমাজের স্বাধীনতাই যথার্থভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। কারণ, মঙ্গল করিবার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা, ধর্মরক্ষার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা।

এতকাল নানা দুর্বিপাকেও এই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু এখন ইহা আমরা অচেতনভাবে, মূঢ়ভাবে পরের হাতে প্রতিদিন তুলিয়া দিতেছি। ইংরেজ আমাদের রাজত্ব চাহিয়াছিল, রাজত্ব পাইয়াছে, সমাজটাকে নিতান্ত উপরি-পাওনার মতো লইতেছে- ফাও বলিয়া ইহা আমরা তাহার হাতে বিনামূল্যে তুলিয়া দিতেছি।

তাহার একটা প্রমাণ দেখো। ইংরেজের আইন আমাদের সমাজরক্ষার ভার লইয়াছে। হয়তো যথার্থভাবে রক্ষা করিতেছে, কিন্তু তাই বুঝিয়া খুশি থাকিলে চলিবে না। পূর্বকালে সমাজবিদ্রোহী সমাজের কাছে দণ্ড পাইয়া অবশেষে সমাজের সঙ্গে রফা করিত। সেই রফা অনুসারে আপসে নিষ্পত্তি হইয়া যাইত। তাহার ফল হইত এই, সামাজিক কোনো প্রথার ব্যত্যয় যাহারা করিত তাহারা স্বতন্ত্র সম্প্রদায়রূপে সমাজের বিশেষ একটা স্থানে আশ্রয় লইত। এ কথা কেহই বলিবেন না, হিন্দুসমাজে আচারবিচারে কোনো পার্থক্য নাই; পার্থক্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু সেই পার্থক্য সামাজিক ব্যবহারগুণে গণ্ডিবদ্ধ হইয়া, পরস্পরকে আঘাত করে না। ‘কবিগুরুর কথাগুলো আজও আমাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য। সমাজ প্রযুতির দিকে এগোচ্ছে। এগোচ্ছে মানবিক স্বাধীনতার দিকে। এই সত্যকে মানতে হবে। মননে, মনীষায় মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল, তা হলো মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতা। ধর্ম-বর্ণের স্বাধীনতা। এই সত্যটি যদি আমরা অনুধাবন করতে না পারি, তবে শান্তি বারবারই পরাহত হবে আমাদের সমাজে।

_________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ১৮ মার্চ ২০১৭

সৃষ্টিগতভাবে নারী শান্তির প্রতীক

মানবসমাজের দেহ যদি পুরুষ হয় তবে নারী সে দেহের আত্মা বা প্রাণ। যে ঘরে, সমাবেশে, যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই, যে মসজিদে, সে সালাতে নারী নেই, যে হজ্বে নারী নাই সেটা প্রাণহীন ও অপূর্ণ। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে।

আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি মানুষ। সেই মানুষের মধ্যে দু’টি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সৃষ্টি হচ্ছে পুরুষ এবং নারী। তাদের উভয়কেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করলেও নারী ও পুরুষ হিসাবে তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পৃথক। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর জান্নাতের অঢেল সুখ ও শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করতে দিলেন। সেখানে তাঁর ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, যা খুশি খাওয়ার, যা খুশি করার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু এত কিছু পেয়েও আদম (আঃ) এর হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক অদ্ভূত শূন্যতার অনুভূতি। সব আছে তবু কি যেন নেই। জান্নাতের এত সুখ-সম্ভোগ ও রঙ-রূপ-রসও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছে না, সব কিছু অর্থহীন, বিবর্ণ, নিরস মনে হয়। তখন আল্লাহ তাঁরই পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সঙ্গিনী এবং সাহায্যকারী হাওয়াকে (বাইবেল- জেনেসিস ২:২২)।
হাওয়াকে পেয়ে শান্তির সুধারসে আদমের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন কিসের অভাবে তিনি এতকাল সব পেয়েও বিমর্ষ ছিলেন। এভাবে জান্নাতেই নির্ধারিত হয়ে গেল পুরুষ ও নারীর সৃষ্টিগত উদ্দেশ্য। আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের উভয়কে শাস্তি-স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। শাস্তি হলো, পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে, সন্তান লালন পালন করবে (বাইবেল- জেনেসিস ৩:১৬-১৭)। এভাবে তারা বেঁচে থাকবে কিন্তু তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য কিন্তু এটা নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে তাদের উভয়েরই জীবনের লক্ষ্য আল্লাহ ঠিক করে দিলেন তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেবল পারিবারিক জীবনেই নয়, জীবনের সর্ব অঙ্গনের জন্য আল্লাহ নারীকে পুরুষের সঙ্গী এবং সাহায্যকারী হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি নারীকে সৃষ্টিই করেছেন রহমত, বরকত ও নেয়ামতে পূর্ণ করে। সে নিজেই এমন এক শান্তিময় সৃষ্টি যাকে ছাড়া জান্নাতও মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি, পারবেও না। পৃথিবীর জীবনেও তাই নারী ছাড়া শান্তি কল্পনা করা যায় না। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া।” (আর-রূম ৩০:২১) আর আল্লাহর রসুল বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী আল্লাহর নেয়ামত আর সম্পদরাশিতে পূর্ণ এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মঙ্গলময় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও নেয়ামত হচ্ছে সেই স্ত্রী যে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সদা সতর্ক (সহীহ মোসলেম, ২য় খণ্ড ৩৪৫৬)। এই হচ্ছে নারীকে আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টিগত মর্যাদা।

নারী কেবল তার স্বামীর জন্য শান্তির প্রতিমূর্তি নয়, জান্নাতকে যেভাবে সে শান্তিময় করে তুলেছে ঠিক সেভাবে মানবসমাজের প্রতিটি অঙ্গনে যেখানেই সে যাবে সেখানেই সে শান্তির সুবাস ছড়িয়ে দেবে। সে মা হিসাবে সন্তানের জন্য মমতার আশ্রয়, বোন হিসাবে ভাইয়ের জন্য আদরিনী আর স্নেহের আধার, স্ত্রী হিসাবে সে স্বামীর জন্য প্রেমময়, ঘরের কর্ত্রী, বার্ধক্যের অবলম্বন। কন্যা হিসাবে সে পিতা-মাতার জন্য নিরন্তর আনন্দের ফল্গুধারা। মানবসমাজের দেহ যদি পুরুষ হয় তবে নারী সে দেহের আত্মা বা প্রাণ। যে ঘরে, সমাবেশে, যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই, যে মসজিদে, সে সালাতে নারী নেই, যে হজ্বে নারী নাই সেটা প্রাণহীন ও অপূর্ণ। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে। সেই নারীদেরকে আজ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে তার পক্ষে সম্ভব নয় একটি প্রস্ফুটিত গোলাপকে জুতার তলায় মাড়িয়ে যাওয়া, অথচ আজ অতুলনীয় সৌন্দর্য ও শান্তির উৎস যে নারী, সেই নারীকে আজ দাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের উপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তাদের দেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এমন কি মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে তাদের উপর নির্যাতনও চালানো হয়। এই যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এর সূত্রপাত কোথায়?

আদমের (আ:) পর থেকে পৃথিবীতে যখন মানুষের বিস্তার হলো আল্লাহ তাদের শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য নবী রসুলদের মাধ্যমে তাঁর বিধান পাঠাতে থাকলেন। সেই বিধানগুলি মানুষ যখন মেনে চোলত তাদের সমাজে অনাবিল শান্তি বিরাজ কোরত। কিন্তু নবীদের প্রস্থানের পর একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে প্রতিটি জাতির মধ্যে যারা ঐ বিধানের অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসেছে। তারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। ফলে ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কল। সেই বিকৃত বিধানের ফলে সমাজের শান্তিময় পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। যেহেতু নারীরা চিরকালই পুরুষদের অধীন ছিল তাই স্বভাবতই তারা নিষ্ঠুরতার প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছে। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম বিপন্ন হয় সেই পরিবেশের কোমলতর সৃষ্টিগুলি। শীতের আবির্ভাবে যেমন প্রকৃতি তার রঙ রূপ রস হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়, তেমনি সমাজে অমানবিকতা সৃষ্টি হলে কোমলতর সৃষ্টি হিসাবে নারী সর্বপ্রথম তার বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য হারায়। পুরুষ সমাজ যদি নারীকে রুজি রোজগারের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কাজের দিকে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার দিকে ঠেলে দেয় যা তার দেহ কাঠামো ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার চরিত্রে কোমলতার বদলে আসে পুরুষালী রুক্ষতা, তার কীন্নর কণ্ঠ হয়ে যায় কর্কশ।

শান্তির প্রতীক নারীই আল্লাহর সার্বভৌমত্বহীন বস্তুবাদী ভারসাম্যহীন জীবন ব্যবস্থার প্রভাবে সাক্ষাৎ ডাইনীতে রূপান্তরিত হয়। ফুলের বাগান মরুভূমি হয়ে যায়। যার উদাহরণ আমাদের আজকের পৃথিবী। ‘আধুনিক’ পশ্চিমা সমাজের নারী পুরুষরা এখন মানুষের জীবন বাদ দিয়ে জীবজন্তুর মত ইন্দ্রিয়সম্ভোগের জীবন বেছে নিয়েছে। আমাদের এখানেও এখন সেটাকেই আধুনিকতা ও বন্ধনমুক্তির পথ বলে প্রচার করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদী খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র বস্তুবাদী জীবনের আকর্ষণ, সম-অধিকার, স্বাধীনতা জাতীয় প্রহেলিকামূলক মতবাদ, আর্থিক উৎকর্ষের পেছনে ছুটে ছুটে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশও তাদের সৃষ্টিগত আত্মিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছেন, তাদের সৌন্দর্য্য, করুণা, দয়া-মায়া, শিষ্টাচার, নম্রতা, লাজ-লজ্জা সবই প্রায় খুইয়েছেন। নিজেদের পরিবারে তারা একেকজন অশান্তির আকর। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, যে নারী তার পরিবারের জন্য অশান্তির কারণ, সেই নারী তার সমাজের জন্য কখনোই শান্তির কারণ হোতে পারে না। নারীর এই যে বিবর্ণতা এর পেছনে প্রাথমিকভাবে দায়ী কিন্তু পুরুষ সমাজই। যদি আপনি একটি মনোরম ফুলের বাগান তৈরি করেন, সেই বাগানের পরিচর্যা করার দায়িত্বও কিন্তু আপনার। আপনি যদি সেই বাগানে পানি না দেন গাছগুলি শুকিয়ে যাবে, ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য কি ফুলকে দায়ী করা যাবে? যে নারীকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন রহমত, বরকত ও শান্তির আধার হিসাবে সেই নারীকে তার উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করে তাকে সার্বিক সৌন্দর্য্যময় ও সুষমামণ্ডিত করে রাখার দায়িত্ব ছিল পুরুষের। কিন্তু পুরুষ তার এই দায়িত্ব পালনে প্রথম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে নারীও তার মর্যাদা, সৌন্দর্য্য, সম্মান হারিয়ে প্রায় ক্যাকটাসে পরিণত হয়েছে। ক্যাকটাসের ভিতরেও তবু কিছু পানি থাকে, কিন্তু দাজ্জালের তৈরি নারী প্রকৃতিতে যেন কেবলই শীতের শুষ্কতা আর গ্রীষ্মের খরতাপ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: সর্বস্তরের নারী ও আমাদের সমাজ

WOOOOOOOOO

নারী এবং বাস্তবতাঃ
নারী ও পুরুষ মানব জাতির দুটি রূপ। সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর মানুষ, গাছপালা, পশু পাখি, ধূলিকণা, সাগর নদী, পাহাড় পর্বত সব। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। পৃথিবীর চালিকাশক্তির প্রধান ভূমিকায় রেখেছেন মানুষকে মহিয়ান সৃষ্টিকর্তা। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে নর এবং নারী হয়ে। ‘আদম’ এবং ‘ঈভ’ মানবজাতির আদি পিতা ও মাতা। সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবী চলছে নর তথা পুরুষ ও নারীর যৌথ প্রচেষ্টায়। একা নারী কিংবা একা পুরুষ বড় কিছু করতে পারেনি কখনো। আর তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় বলেছেনঃ

“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।”
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা সম্পন্ন করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সমাজে নারী অনেকক্ষেত্রেই বৈষম্যের নির্মম শিকার। নির্যাতন আর অত্যাচারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে অনেক নারীর জীবন। এটা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। কারণ, সৃষ্টির কাঠামোতে পুরুষ আর নারীকে সমান দক্ষতায় আঁকা হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। এ সমাজে পুরুষরা স্বঘোষিত মানুষ হয়। কিন্তু নারী যেনো সবসময় মানুষ নয়- তার যেনো রয়েছে অন্য এক অস্তিত্ব। শুধু ভোগ করার সময় তাকে আদর করে মানুষ বলে ডাকা হয়। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন আর মর্যাদার প্রশ্নে পুরুষ নারীকে তার সমকক্ষ হিসেবে স্বীকার করতে দ্বিধা করে। অনেকসময় শারীরিক, মানসিক ও বস্তুগত বৈষম্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেয়াল তুলে তাকে বুঝিয়ে দিতেও কুণ্ঠা করে না যে নারী একটি দ্বিতীয় শ্রেণির ভোগ্যপণ্য বা প্রাণীবাচক অস্তিত্ব। তাই, কিছু ব্যতিক্রম সহজভাবে মেনে নিয়েই বলতে হচ্ছে – নারীর সত্যিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের আরো অনেকপথ হাঁটতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসঃ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ৮ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আন্তর্জাতিক নারী দিবস- আজকের পর্যায়ে আসার পেছনে লম্বা ইতিহাস আছে। প্রথমে ৮ই মার্চ ‘বিশ্ব শ্রমজীবি নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই ‘শ্রমজীবি নারী দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করা হতো। জাতীয়ভাবে নারী দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী, যুক্তরাস্ট্রে। পরের বছর কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ‘নারী দিবস’ উদযাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ঐ সম্মেলনে জার্মান সমাজবিদ লুইস জিৎস আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব করেন, তাঁকে সমর্থন জানান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন।

পরের বছর ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ডের এক মিলিয়নের অধিক জনগন প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পক্ষে মত দেয়। সেটা ছিলো ১৮ই মার্চ। এই দাবী ধীরে ধীরে নারীর সমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। নারীকে ‘নারী’কে নারী হিসেবে নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে সম্মান দেয়ার দাবী ছিলো তাদের। আমেরিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারিতেই ‘নারী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালিত হতো। কিন্তু রাশিয়ায় ১৯১৩ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন আয়োজনের উদ্যোক্তারা লক্ষ্য করলেন যে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যে দিনটি ২৮শে ফেব্রুয়ারি হিসেবে চিহ্নিত, তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ই মার্চ হিসেবে চিহ্নিত আছে। সেই থেকেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ৮ই মার্চ বিশ্ব নারীদিবস পালিত হয়ে আসছে। অনেক পরে, ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সকল সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, ৮ই মার্চ দিবসটিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য। স্ব স্ব দেশের ঐতিহাসিক, জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথার আলোকে নারীর অধিকার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দিনটিকে পালনের জন্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস জনপ্রিয়তা লাভ করে আজকের পর্যায়ে আসে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৭ প্রতিপাদ্যঃ

‘‘নারী-পুরুষের সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা’’
The theme for International Women’s Day 2017 is
“‘Women in the Changing World of Work: Planet 50-50 by 2030’, asking for #BeBoldForChange”.

এগিয়ে যাবার গল্প
এগিয়ে যাবার গল্প


নারী প্রগতিঃ পরিসংখ্যান যা বলেঃ

সমাজ যখন নারী প্রগতি, নারী আন্দোলন আর নারী নির্যাতন বন্ধের শ্লোগানে তুঙ্গে, তখনও সর্বস্তরের নারীদের নিয়ে বিচার করলে তারা কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে- তা চিন্তার বিষয়। “অমুকের ঘর ভেঙ্গে গেছে, অমুক মায়ের মর্যাদা পেতে চায়, কিশোরী ধর্ষিতা, কাজের মেয়ে নির্যাতন ইত্যাদি খবরের হেডলাইন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে একজন হৃদয়বান ব্যক্তি দেখতে না চাইলেও নিউজগুলো ঠিক আসে। নারীর অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কিন্তু নির্যাতন কি কমেছে? না। নির্যাতনের টেকনিক পাল্টেছে আর বেড়েছে নির্মমতা ।

মহিলা পরিষদের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- গতবছর (২০১৫) জানুয়ারি মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন নারী। এঁদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৫৫ জন আর গণ- ধর্ষিত হন ৯ জন । ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৭ টি। শ্লীলতাহানি হয়েছে চার নারীর।– এ পরিসংখ্যান পত্রিকা প্রকাশিত তথ্য থেকে নিয়েছে মহিলা পরিষদ। প্রকৃত ঘটনা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনাই পরিবার পর্যায়েই চাপা পড়ে থাকে।
এছাড়া, দৈনিক সমকাল-এ গত ১ জানুয়ারি ২০১৫ প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, “২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৬৫৪ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৯টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জনকে। মহিলা পরিষদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করে এ খবর দেয়া হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন দাবি করেছে গত এক বছরে ১৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ নারীকে।

মহিলা পরিষদ জানায়, গত বছরে এসিডদগ্ধে মৃত্যু ৪, অপহরণ ১১৮, নারী ও শিশু পাচার ৩০, নারী ও শিশু হত্যা ৮৯৮, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ৪৩১, উত্ত্যক্তের শিকার ৪৬৫, বিভিন্ন নির্যাতনে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৩৪১ ও ৯৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন রিপোর্টমতে গত বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার ৫ হাজার ৬১ জন। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনে হত্যা ২৭, যৌতুকের কারণে হত্যা ৩০, এসিড নিক্ষেপে ১, পারিবারিক সহিংসতায় ৬৮৫, রাজনৈতিক হত্যা ১০১ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক হত্যা ৮৬ জন। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ১৬ ও ৯টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।”

আছে কষ্টের বাস্তবতা
আছে কষ্টের বাস্তবতা

উল্লেখিত দুটি পরিসংখ্যানে সংখ্যাগত কিছু হেরফের আছে – এ কথা ঠিক। কিন্তু শুধু সংখ্যা গণনায় না গিয়ে সাধারণভাবে এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, দেশজুড়ে নারীরা নিগৃহীত হচ্ছে অস্বাভাবিকহারে। যে নারীকে জাতীয় কবি ‘বিজয়ী- লক্ষ্মী’ বলে গেছেন, সে নারী আজ যেনো সমাজে আপদ!


নারী বা পুরুষঃ মানদণ্ড হোক পারস্পারিক সম্মান ও বোধে উজ্জীবিতঃ

কেনো ঘটে এসব? নারীর উপর কেনো চলে এতো অত্যাচার? সমাজের কি কিছুই করার নেই? বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে কি দায় সাড়া যায়? কিংবা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে কতোটা অর্জন হচ্ছে তা ভাবতে হবে
পুরুষের প্রতিপক্ষ হয়ে নয়; মানুষ হিসেবে নারীর আছে পূর্ণ অধিকার সবকিছুতে। নারী ও পুরুষ তাই পরস্পরের সহযোগী হয়ে নিজেদের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে মানবতার উন্নয়নেও বৃহৎ পরিসরে ভূমিকা রাখতে পারে।
নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর প্রতি বিকৃত মানসিকতাকে নৈতিক অবক্ষয়ই বলা যায়। আর এমন নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি হবে খুব নেতিবাচক। মানবতার উন্নয়ন রবে সুদূর পরাহত।

তাই চাই এ মানসিকতার পরিবর্তন। আর তা লোক দেখানো কিছু আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে সম্ভব নয় মোটেও। শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র্যা লি আর বক্তৃতা করে খুব যে ফল আসবে তা নয়। সমাজকে, দেশকে যারা কিছু দিতে চান, এ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন তাঁরা।

যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিদ্বেষের বীজটি ঢুকে গেছে, তাদেরকে সুস্থ চিন্তায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। সফল না হলে আইনের হাতে দিতে হবে ছেড়ে। তবে সে আইনকে হতে হবে সত্যিকার অর্থে আইন।
আমাদের ভাবতে হবে আগত দিনের কথা। আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে তাদের মানসিকতা মানবিক করে গড়ে তোলার সার্বিক প্রয়াস নিতে হবে। তারা যেনো পুরুষ হয়ে নারীকে মানুষ ভাবতে শেখে এবং নারী হয়ে পুরুষকে নিছক প্রতিপক্ষ বা শত্রু না ভাবে। সমচিন্তা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
বলিষ্ঠভাবে বলতে হবে- নারীরা এ সমাজের আপদ নয়, যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের পাত্র নয়; নারী হলো পুরুষের বন্ধু, ‘বিজয়ী লক্ষ্মী’। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। পৃথিবী আমাদের। নারী ও পুরুষের মানবিক বোধকে মূল্য দিয়ে একে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবার।