বিভাগের আর্কাইভঃ সাহিত্য

ফোটায় ফোটায় শিশির জমে

ha

বৃষ্টি ভেজা আকাশ
একলা চলা বাতাস
কেউ করেনা কারও সাথে সন্ধি
আজকে আমি আমার ঘরে
যেনো খাঁচায় বন্দী।

বর্ষার ওই শ্রাবণ ধারা
টাপুর টুপুর জলে
ঝন ঝনিয়ে পায়ের নুপুর
উথালপাতাল করে।

মনের খাঁচায় মনের মানুষ বন্দী
কেউ কর না আমার মনে সন্ধি

আজ অবেলায় মুক্ত ঝড়ে
ফোটায় ফোটায় শিশির জমে
বেলার মাঝে অবেলা এসে
ভীড় করেছে ফন্দি
কেউ কর না আমার সাথে সন্ধি।

ইচ্ছে করে

nii

ইচ্ছে করে আকাশে উড়ে যেতে,
পারি না পাখির মতো ডানা নেই বলে!
ইচ্ছে করে সব বিলিয়ে দিতে,
তা-ও পারি না কিছুই নেই বলে!

ইচ্ছে করে ভূমিহীনদের ভূমি দিতে,
পারি না নিজের ভিটেমাটি নেই বলে!
ইচ্ছে করে দুখীদের সুখ দিতে,
তা-ও পারি না কপালে সুখ নেই বলে!

মেঘলা আকাশ ফুটো হয়ে গেছে

chooo

ঝুম বৃষ্টির এই প্রহরে তুমি আছো কোথায়
ভেজার বড় স্বাধ
আমায় বেঁধে রাখো বৃষ্টির সুতায়
পেতে রবের এই নিয়ামতের আশীর্বাদ।

চলো পথের কাদা মাটিতে পা রেখে হাঁটি
ভেজাই পা
সুখ শিহরণ জাগাই মনে, বুকে সুখ সাজাই পরিপাটি,
দেখো ঝরছে বৃষ্টি, এ যে রবের কৃপা।

এসো ভিজি, দেহে লাগাই রহমতের ছোঁয়া
অবিরাম ঝরে যাচ্ছে বৃষ্টি
এমনো ক্ষণ পাবে না আর, মন যে আমার সুখেতে গেল খোয়া
আমি এখানে, ছাউনিতে বসে আছি, ফিরাও দৃষ্টি।

পাতাদের কাঁপন গাছে গাছে
বৃষ্টির বিন্দুরা কি ছিল আকাশে!
ঝরছে তো ঝরছেই, বৃষ্টিরা পথের উপর নাচে
এমনো ক্ষণ চাই না কাটাতে দীর্ঘশ্বাসে।

নিয়ামতের জল ছোঁয়াবে কি মাথায়
একা ভিজতে ইচ্ছে নেই এবেলা
দেখে যাও ঝুম বৃষ্টির বিন্দু পাতায় পাতায়
চলো ভাসাই বৃষ্টির জলে সুখের ভেলা।

.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, চুনারুঘাট)

ছায়া

একটা সন্ধ্যা। জুটমিলের রশিতে
ঝোলানো হিম হওয়া অহর্নিশ ছায়া

কাঠগোলাপ ফুলের কেকাসিক্ত
নীরব প্রিজম থেকে উৎসাহিত হচ্ছে
কেরোসিনে জ্বলা পদ্মাচর গ্রাম,
শহরে উঠে আসা ব্রিজ-পথ,
শালিকের পিঠে চড়া ড্যান্সহল
খুলির ভেতরে পৃথিবীর গাউন হাওয়া-
পৃথক বনে শরীর খসায়া অবতীর্ণ
সন্ধ্যা ঘিরে মানুষের চারা
বয়স বাড়লে বদলে যায় আঁতুড়ঘর।

ছোটগল্প “এ শহর প্রান্ত”

0-18

তক্তাপোষের ওপর এক হাঁটু মুড়ে অন্য পা টা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল রনি। আনমনে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের কোনের চামড়া খুঁটে খুঁটে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছিল, যদিও অত মোটা চামড়া একটু খোঁচা হয়ে উঠে আর ছাড়ছিল না। বেশি জোরে টানলে লাগছিল, আর তখনই চমকে হাত সরিয়ে আনছিল ও। কিন্তু আবার একটু পরেই হাতটা সেখানে চলে যাচ্ছিল অজান্তেই।

সামনে উঁচু একটা পড়ার টেবিলের ওপর রাখা টিভি তে ইস্টবেঙ্গলের খেলা হচ্ছে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে। বেশ বেগ দিচ্ছে দলটা। রনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সাপোর্টার। সুযোগ পেলেই ক্লাবহাউসের টেন্টে ঢুকে পড়ে। ভাবও জমিয়ে নিয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। এখন সবই তেলের যুগ। খিক খিক করে আপনমনেই হেসে উঠল ও।

পুরনো সাবেকী ঢঙের দোতলা বাড়ী। তৈরী করেছিল রনির ঠাকুরদা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা চটে গিয়ে ইট দাঁত বার করেছে। কোথাও নোনার স্পষ্ট ছোপ। ছাদের বেশিরভাগ অংশই শ্যাওলার মোটা আস্তরণের দখলে। কতদিন যে রঙ হয়নি ঠিক মনেও করতে পারে না কেউ। কালিঘাটের এই অঞ্চলটা এখনো পড়ে আছে সেই মান্ধাতার আমলের ভাবনা চিন্তায়। ওপরে ওপরে বড় রাস্তার ধারে অনেক চকচকে দোকান, শোরুম, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট হলে কি হবে, গলির মধ্যে কিম্বা মন্দিরের সামনের জগতের মানুষগুলো এখনো সাবেক ঘি এর গন্ধ শুঁকেই দিন কাটায়। এখানে মার্জিত সুরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনা। চিৎকার করে হামেশাই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করা আর সেই কুৎসিত কোলাহল উঁকিঝুকি মেরে উপভোগ করা এখানকার স্বাভাবিক দস্তুর। এখানে সম্প্রতি যারা বাড়ী করেছে, তাদের এই পুরনো বাসিন্দারা বহিরাগত উপদ্রব মনে করে তাচ্ছিল্য করে।
রনি নিজেও ওই ভাবধারার শরিক। সেখানে সে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। নিজেরটুকু গুছিয়ে নিতে পারলেই হল। এত বড় বাড়ীর দেখভাল করার মত কেউই আর নেই। শরিকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। পড়ে রয়েছে রনি আর তার জ্যাঠতুতো ভাই অনীক। সে এখনো বিয়ে থা করেনি। আর করবেও না মনে হয়। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই অনীক সল্টলেকে একটা সরকারী অফিসের কেরানি। বাড়ী বা সংসার সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহই নেই। সন্ধের অনেকপরে বাড়ী ফিরে সোজা একখানা বোতল খুলে বসে। সাথে অফিসফেরতা আনা টুকটাক খাবার আর একটা বই কিম্বা নতুন কেনা ট্যাব। এ বাড়ীর ঐতিহ্য যদিও সেরকম কিছুই নেই কিন্তু সেসম্পর্কে তৈরী করা কিছুটা টনটনে অহংকার তার মধ্যেও আছে।

গোওওল… যাহ! টালিগঞ্জ গোল দিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলকে। নড়েচড়ে বসল রনি। বিড়বিড় করে গাল দিল কাউকে। এই পুচকে দলগুলোর কাছে গোল খাওয়ার আগে এরা আত্মহত্যা করে না কেন? চোখদুটো ঈগলের মত তীক্ষ্ণ করে তক্তাপোষ থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকল সে। পারলে হয়তো টিভির মধ্যে ঢুকেই পড়ত।

উফ! অনেক দেরী হয়ে গেল। আরো জোরে পা চালাল সম্পাতি। এই কলকাতার ফুটপাতে তাড়াতাড়ি হাঁটাও যায়না। এখানে গর্ত, সেখানে নোংরা আর হকারের দৌরাত্য … ধুস শালা…এখানে কেউ থাকে! বিড়বিড় করল আপনমনেই। টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর মোড়ে এসে রাস্তা পেরোনোর জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। হুশ হুশ করে গাড়িগুলো প্রায় গায়ের ওপর দিয়েই চলে যাচ্ছে। এই হতভাগা দেশে কোনো সিস্টেম তৈরী হলোনা এখনো। আর হবেও না কোনোদিন। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও কোনো ট্র্যাফিক পুলিশের চিহ্নও দেখতে পেলনা সে।

থেমেছে। চটপট পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এপাড়ে মেট্রোর সাইডে এল। ঘড়িটা দেখল একবার, বিকেল চারটে বাজে প্রায়। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরা যাবে কি? সামনে একটা বাস থেকে কন্ডাকটর চিৎকার করে যাচ্ছে- হাওড়া…হাওড়া…হাওড়া…! আর না ভেবে পাদানিতে পা রাখল ও, আর আশ্চর্য উঠেই সিট পেয়ে গেল। কলকাতার পুরনো আমলের এই বাসের সিটগুলোও একেবারেই পছন্দ নয় তার। সেই মান্ধাতার আমলের দুদিকে লম্বা লাইন করে বসার সিট। অন্যদেশের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, এই পশ্চিমবঙ্গের অন্য শহরে কিম্বা গ্রামাঞ্চলেও এই বাসগুলো আর দেখা যায়না। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উঠলো সম্পাতির।

আসলে এখন যা দেখছে তাতেই বিরক্ত লাগছে। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমনো উচিৎই হয়নি তার। মোবাইলে একটা অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হত। সিগন্যালে আটকেছে বাসটা। অধৈর্য হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে দেখল সে। কাতারে কাতারে গাড়ি দাঁড়িয়ে সামনে।

কাল দেশপ্রিয় পার্কে অনেকক্ষণ বসেছিল শাখার সঙ্গে। সেই একই টুকটাক কথা হতে হতেই শাখা অনর্গল হয়ে গেল। নিজের কথা, ছেলেবেলার কথা, ওর বাবার কথা, মায়ের কথা, জেঠুমনি, পাশের বাড়ির তাতাই এর কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল। ঘটিগরমের ঠোঙা থেকে একটু একটু খেতে খেতে মন দিয়ে শুনছিল সম্পাতি। খুব মন দিয়ে কিছু শুনলেই তার চোখের সামনে ছবিগুলো পরিস্কার ফুটে ওঠে। সিনেমার মত সব ঘটে যাওয়া অতীত সরে সরে যায়, পিছলে যায়। একাত্ম হয়ে যায় তখন সে।

শাখার হাতের তালুটা বেশ শক্ত। ওর শ্বশুরবাড়ির প্রায় সব কাজই তাকে করতে হয়। আসলে ও বাড়িতে শাখার জায়গা কাজের লোকের প্যারালাল। ওর স্বামীটা একেবারেই অপদার্থ। মোটামুটি সবকিছুই শোনা হয়ে গেছে সম্পাতির।

হাত তুলে কুলফি ডাকলো ও। দুটো দিতে বলে একটা সিগারেট ধরালো। ঘাসের সামান্য রেখার ওপরে বসে আছে ওরা দুজন। পার্কের বাইরের রাস্তার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এদিক ওদিক গাড়ি চলে যাচ্ছে। আচ্ছা এখানে পাখি আছে?

এবারে মাত্র দুদিনের জন্যে এসেছিল সে। চাকরীসূত্রে সম্পাতি থাকে বীরভূমের রামপুরহাটে। লালমাটির দেশে প্রচুর খোলামেলা জায়গা, পাখপাখালি তাকে অভিভূত করে দেয়। আজন্ম এই কলকাতার মানুষ সে। পড়া কমপ্লিট করে প্রথম চাকরী পেয়ে বাইরে গেছিল, তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। কিন্তু সেও কাঠখোট্টা গুজরাতের এক শহর, মেহসানা। বাংলার প্রাম যে একেবারেই দেখেনি তা নয়। দু একবার বন্ধুদের সঙ্গে আশেপাশের গ্রামের কোনো ট্যুরিস্টস্পটে গেছে পিকনিক করতে কিম্বা বেড়াতে।কিন্তু আপাদমস্তক গ্রাম কে এভাবে উপভোগ করা, শরীরে মনে মেখে নেওয়া আগে কখনো হয়নি।

রামপুরহাটে সে যেতেও চায়নি। কিন্তু নতুন এই চাকরীটা বেশ বড় কোম্পানীতে, আর অফারটাও বেশ শাঁসালো। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে শুনে কি হয় দেখি একবার গোছের মনোভাব নিয়েই গেছিল সে। আর গিয়েই জাস্ট প্রেমে পড়ে গেছে জায়গাটার।

শাখার সঙ্গে ওর আলাপ ফেসবুকে। সন্ধের পরে ওখানে বিশেষ কিছুই করার থাকেনা। ওখানে খুব একটা বন্ধুও নেই তার। কাজের সূত্রে যা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ। তার বেশি কখনোই এগোয়নি কোনো সম্পর্ক। তাই সময় কাটাতে সন্ধের পরে ফেসবুক খুলতে শুরু করেছিল সে। প্রথম প্রথম শুধু পড়ত, দেখত। তারপর গুড ইভনিং, গুড নাইট। আর এভাবেই কিভাবে কখন যেন আলাপ হয়ে গেল শাখার সঙ্গে এখন আর ঠিক মনেও করতে পারবে না সে। সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটে কেটে যেত। কখনো মেয়েদের সাথে সেভাবে না মেশার জন্যে ওদের মন, চাহিদা, কল্পনা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সম্পাতির। কথায় কথায় জল গড়িয়ে সম্পর্ক কখন যেন গাঢ় হয়ে গেল। শাখার হাতের আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে সম্পাতি।

পঁয়তাল্লিশ ছুঁল সে এই লাস্ট জুনে। বাড়িতে দাদা আর বউদি। দাদার মেয়েরা বিয়ে হয়ে বিদেশে। এখানে আর ফিরে আসার চান্স খুবই কম। দাদাও রিটায়ারমেন্টের পরে ক্লাব নিয়েই মেতে থাকে। আগে আত্মীয়রা বিয়ের কথা বলত ওকে। ঠাট্টা তামাশাও করত। এখন ওরাও ফেডআপ হয়ে ছেড়ে দিয়েছে ওসব বলা। ধরেই নিয়েছে এরকমই অবিবাহিত হয়েই থেকে যাবে সম্পাতি। আসলে এতদিন মেয়েদের সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহ ছিল না ওর। মেয়ে মানেই বাধা এই ধারণাটা ওর বদ্ধমূল ছিল। আস্তে আস্তে শাখার সঙ্গে আলাপের পরে সব কেমন যেন পাল্টে গেল। সাদাকালো স্কেচের ওপরে রঙের আলতো টান লাগতে শুরু হল।

শাখার জীবনটা ওর খুব অদ্ভুত মনে হয়। ওর বাপের বাড়িও কেমন যেন উদাসীন। দুই বাড়িই প্রাচীন মানসিকতার কূপমন্ডুকতায় পড়ে আছে এখনো এই একুশ শতকেও। কলকাতা শহরটাকে সম্পাতির মাঝেমাঝে গ্রাম মনে হয়। যতই ঝাঁ চকচকে হোক ওপরটা, ভেতরে ভেতরে মানসিকতা পড়ে আছে সেই মধ্যযুগেই। শাখার বাপের বাড়িতে যেমন মনে করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আপদ নেমে যায় ঘাড় থেকে। তেমনি শ্বশুরবাড়িও মনে করে বাড়ির বউএর কদর কাজের লোকের বেশি নয়। আশ্চর্য, এদিকে লোকটা কিন্তু শাখার রোজগারেই বসে বসে খায়।

-“উঠবে না? অনেক রাত্রি হলো তো! না ফিরলে আবার চিৎকার …”
শাখার কথায় হুঁশ ফিরলো সম্পাতির।
-“হ্যাঁ চল”।
টেনিস কোরটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাখার ডানহাতের তালুটা বাঁ হাত দিয়ে মুঠো করে ধরলো সে। শাখাও আঁকড়ে ধরলো ওর হাত। কালিঘাটের গলিতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে শাখাকে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ হিমের কোনো রেশ নেই এই মহানগরে।

একটা মানুষের আইডেনটিটি কি? একটা ভোটার আইডি? একটা আধার কার্ড কিম্বা প্যান কার্ড, পাসপোর্ট? কয়েকটা কাগজের টুকরো বা কয়েকজন সাক্ষী কি একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে? আইডির ফটো থেকে চেনা যায় মানুষটা কেমন?

সে বা তার বাবা, মা কেউই তো রনি কে চিনতে পারেনি কখনো। বিয়ের আগে প্রায় বছর তিনেক একটানা ওদের সিথির বাড়িতে যেত রনি। ভুরিভুরি মিথ্যে বলতো সেসময়। সে নাকি বিশাল আর্টিস্ট। প্রেসিডেন্সির ছাত্র, প্যারিসের ডিপ্লোমা আছে। বড় বড় এক্সিবিশন করে সে, যেগুলো উদ্বোধন করেন বিশাল মাপের বিশিষ্ট মানুষেরা। অবাক হয়ে সেসব শুনত ওদের বাড়ির সবাই। ওর বোন তো রীতিমত ফ্যান ছিল রনির। তারপর যেদিন রনি বিয়ের প্রস্তাব দিল ওদের বাড়ির সবাই যেন হাতে চাঁদ পেল। ও নিজেও বিভোর হয়ে গেছিল এক বিশাল আর্টিস্ট কে নিজের করে পাবে ভেবে। আগুপিছু কোনো খবর না নিয়েই এক অশুভক্ষণে বিয়েটা হয়ে গেল তার।

হ্যাঁ, তার বিয়েই বলবে সে। কারন রনি কোনোদিনই নিজেকে বিবাহিত ভাবেনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই এটা বুঝতে পেরেছিল শাখা। আসলে রনির দরকার ছিল ওর মা কে দেখাশোনা করার জন্যে একটা বিনে মাইনের আয়া আর রান্নার, বাসন মাজার কাজের লোক। বিনেমাইনের, কারন রনির কোনো রোজগার ছিলনা। সব মিথ্যে কথা বলেছিল। সে আদৌ শিল্পী নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়। পড়াশোনাও মাধ্যমিকের গন্ডীর এদিকে। আর রীতিমত দুশ্চরিত্র। প্রথম যেদিন একতাড়া চিঠি ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে হাতে পেল, সেদিন ছুটে গিয়ে রনিকে জবাবদিহি করেছিল স্ত্রীর অধিকারবোধ নিয়েই। কিন্তু রনি চিঠিগুলো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যখন সপাটে গালে চড় মারলো, যেন বাজ পড়েছিল ওর মাথার কোষের মধ্যেই। রনির বাকী চিৎকার আর ওর মাথায় ঢোকেনি। পরে যতবারই ফোনে মা বাবাকে এসব কথা বলেছে, তাঁরা গম্ভীর হয়ে অ্যাডজাস্ট করতে বলেছেন ওকে।

কতভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারে একটা মেয়ে? রাত্রির এই নির্জন সময়ে একা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল শাখা। এই ছাদ আর এই রাত্রি ওর বন্ধু, ওর আশ্রয়। যখনই কোনো মানসিক বিচ্যুতি ঘটে ওর, পালিয়ে আসে এই ছাদে। এখনো পর্যন্ত কোনো ইস্যু হয়নি ওর। রনি ওকে যেমন আজ পর্যন্ত হাতে তুলে কোনো উপহার দেয়নি, তেমনি দিতে পারেনি স্বামী-স্ত্রীর সেরা উপহার। আসলে বহুগামিতায় নানারকম রোগের শিকার হয়ে পড়েছে সে। যে কয়েকবার সে রনির কামনার শিকার হয়েছে, লক্ষ্য করেছে তার আগে রনিকে ওষুধ খেতে হয়েছে। তবুও কখনোই শেষরক্ষা করতে পারেনি সে। নিজের কামনাটুকু চরিতার্থ কোনোরকমে করেই ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের তক্তাপোষের ওপরে। ওপরে সেই বিছানায় শোবার অধিকার ছিলনা শাখার। এখন অবশ্য সেই ঘর ছেড়ে দোতলায় একচিলতে চিলেকুঠুরিই তার জায়গা। ছোট্ট, তাহলেও অন্তত একা নিজের মুখোমুখি হতে পারে এখানে সে। আর খুব বিচলিত হলে, কিম্বা নির্ঘুম এইসব রাতে চলে আসে ছাদে। তাকিয়ে থাকে আকাশের তারাদের দিকে। কথা বলে ওদের সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও। আজও গায়ে হাত তুলেছিল জানোয়ারটা। আঁকছিল শাখা। ছোট থেকেই আঁকার শখ তার। কিন্তু এখানে এসে সব জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। রনি তো কিছু রোজগার করেনা। অথচ তার চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। প্রথম প্রথম বাবার কাছে হাত পাততে হত। কিন্তু তারপর বাবার বিমুখতা আঁচ করে এখন নিজেই টিউশন শুরু করেছে। পড়ানোর আর আঁকার। মোটামুটি চলে যায় এতেই। কিন্তু যা পায় তার বেশিরভাগটাই রনি কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়। কোনোরকমে কিছু বাঁচিয়ে সংসার চালাতে হয় তাকে। অথচ সেই আঁকাটাই সহ্য করতে পারেনা জন্তুটা। হয়তো তার নিজের বলা মিথ্যেগুলো মনে পড়ে যায়। আজ যখন একমনে আঁকছিল, কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল রনি, বুঝতে পারেনি। সাধারণত ওকে লুকিয়েই ছবি আঁকে সে। হঠাৎ কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে হাতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বসলো রনি। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল সে। এখনো হাতের কব্জির ওপরটা ফুলে আছে। দুচোখ ভরে জল এল শাখার। ওপরে তাকিয়ে বলল, আর কত?

নিজের শৈশব, যৌবন সব যখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিল ঠিক সেই সময়েই সম্পাতির সঙ্গে ওর পরিচয়। আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষটার, ওর সঙ্গে কথা বললে সব ভুলে যায় সে। তার নিত্যকার ক্লেদ, গ্লানি, ক্ষোভ কিছুই লুকায়নি সে সম্পাতির কাছে। প্রায় একবছরে আস্তে আস্তে কখন যেন সে তার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। রোজ ফোনে কথা হয় দুজনের। কিন্তু একটাই মুস্কিল বড় অবুঝ আর অভিমানী সম্পাতি। ওকে বোঝাতে হয় সবকিছু। আর এই বোঝানোতে এই এতদিন পরে তৃপ্তি পায় শাখা। এতদিনে সে পূর্ণ নারী হয়ে উঠছে।

ওয়ালেটটা খুলে দেখল রনি।মাত্র পঞ্চাশ টাকা পড়ে আছে। মাগীটা এখন কিছুতেই হাত উপুড় করতে চাইছে না। কি ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারছে না সে। কোনো চক্কর চালাচ্ছে নাকি? কয়েকবার বন্ধ দরজায় আড়ি পেতে মনে হয়েছে কারো সাথে কথা বলছে ফোনে। এইসব বুদ্ধি নিশ্চয় সেই নাগরই দিচ্ছে। রাগে গা কিসকিস করে উঠলো রনির।

শালীকে বিয়ে করে আনার পরে বেশ বাধ্য ছিল। বাপরে! অনেক ভুজুং ভাজাং দিতে হয়েছে ওর বাপ মা দুটোকে। হেব্বি মালকড়ির টোপ দিয়ে তবে কাজ হাসিল হয়েছিল। মাগীটাকে প্রথম দেখেছিল ওদের পাড়ায় একটা ছবির একজিবিশনে। ওখানেই মাথায় বুদ্ধিটা আসে। তারপর আর্টিস্ট সাজতে ওর বেশিক্ষণ লাগেনি। আর টুপি পরানো ওর কাছে জলভাত। কিন্তু সেই বাধ্য মেয়েটা কি করে যে গত একবছরে পাল্টে যেতে শুরু করল, তার থই খুঁজে পায়না সে। যে মালটা এইসব বুদ্ধি দিচ্ছে হাতের কাছে পেলে সেটাকেও ঠ্যাঙাত সে। নিজের পিপের মত পেটটা সামনে বিছিয়ে ভাবতে বসলো রনি। কিভাবে এখন কিছু হাতানো যায়। সন্ধেয় মনিকার সঙ্গে মোলাকাতের টাইম দেওয়া আছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায়না। অলরেডি যা গয়না ছিল চুরি করে ঝেড়ে দিয়েছে সে। আলমারীতে দামী শাড়ীগুলোরও একই অবস্থা। এখন…!

এখন চারদিকেই খারাপ সময় চলছে তার। ক্লাবে ওর ব্যাকিং সতুদাটা পট করে অ্যারেস্ট হয়ে গেল একটা কুকর্মতে ফেঁসে গিয়ে। মনিকাকে ইমপ্রেস করার জন্যে যে পঞ্চাশ কপি বই নিজের নামে ছাপিয়েছিল এর তার বই থেকে ঝেড়ে, সেই প্রেসের মালিক রন্তু আজ রীতিমত শাসিয়ে গেছে টাকা পেমেন্টের জন্যে। দুপুরে টাকা চাইতে গিয়ে দেখে ছোটোলোকের মেয়েটা আবার ছবি আঁকতে বসেছে। দেখেই ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে গেছিল ওর। কতবার বলেছে, বারন করেছে সে, তবুও আবার! এই ছবি আঁকলেই মনে হয় মেয়েটা তাকে বিদ্রূপ করছে। ছবিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল আর মেরে বসেছিল এক ঘুষি।

আফশোষে হাত কামড়াল রনি। ইস। তখন মাথা গরম না করে কোনোরকমে কাজ হাসিল করে নিলে এখন আর এই চিন্তায় থাকতে হত না তাকে। এতটা বোকামি তো কখনো করেনা সে। এখন কি করা যায়? পাড়ায় সবাই ওকে চেনে। সবাই মোটামুটি জেনে গেছে ওর কীর্তিকলাপ। এখন আর কেউই ধার দিতে চায় না ওকে। নানান অজুহাতে এড়িয়ে যায়। সতুদা থাকলে এইসময় কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু…
ডিওর ক্যান থেকে স্প্রে করল অকারণ। তারপর মেসেজ করল মনিকাকে, “শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে। আজ যেতে পারব না। প্লিজ কিছু মনে কোরোনা সোনা”।

মাথা গরম হয়ে আছে। ট্রেনে আসতে আসতেই সব শুনেছে সে। আরো মাথা গরম হয়েছে দুপুরে মেরেছে জানোয়ারটা, হাত ফুলে আছে এখনো, কিন্তু শাখা ডাক্তার দেখায়নি শুনে। ফোনেই প্রচন্ড রাগারাগি করেছে সে। শাখা কথা দিয়েছে কাল সকালেই ডাক্তার দেখাবে।

আরেকটা কথা বলেছে সম্পাতি। একটা এফআইআর করতে থানাতে। প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না শাখা। কিন্তু এভাবে মার খাওয়া বন্ধ করার যে আর অন্য কোনো রাস্তাই নেই সেটা বুঝিয়ে বলার পরে নিমরাজি হয়েছে, কিন্তু ড্রাফট টা এখন করে দিতে হবে সম্পাতিকে এই শর্তে।

মেসের ঠাকুর চন্দন খাবার দিয়ে গেল। প্লেট টা খুলে দেখল ও, রুটি, বেগুনের তরকারি আর একটা ওমলেট। খাওয়ার ব্যাপারে কোনো খুঁতখুঁতে ভাব নেই সম্পাতির। যা পায় তাই খায়। হাত ধুয়ে বসে পড়ল সে। এমনিতে জীবনে খুব বাস্তববাদী সে। কখনো আবেগের বশে কোনো কাজ করেনা। যোগ বিয়োগ গুন ভাগের চাকরী করতে করতে তার মধ্যে আসেনা কাশফুলের রোমান্টিকতা। সব আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে নিখুঁত দেনাপাওনার হিসেবমত। তাহলে শাখার মধ্যে কি এমন খুঁজে পেল সে, যাতে এত কাছাকাছি চলে গেল সে স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে? শাখার ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রশ্ন কাজ করে। স্বভাবগত ভাবেই শাখা খুব রোমান্টিক, ঠিক তার উলটো। সর্বদা একা থাকতে থাকতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে মেয়েটা। ছবি আঁকে, কবিতাও লেখে। যদিও দু একটা ওর কবিতা শাখার ফেসবুকের ওয়ালে দেখেছে সম্পাতি, লাইকও করেছে, কিন্তু বোঝেনি কিছুই। আসলে ওসব কবিতা বা ছবি টবি বোঝার মত অত সূক্ষ্ম বোধ নেই তার। তার শুধু শাখাকে ভালো লাগে। সারাক্ষণ শাখাকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, এটাই কি প্রেম? আপনমনেই মুচকি হাসলো সে। খাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ল্যাপটপ টা খুলে বসল ও। ওয়ার্ডে লিখতে শুরু করল, “ টু দ্য অফিসার ইন চার্জ, কালিঘাট পোলিশ স্টেশন…”

জীবনে এই প্রথম নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। আজকের সকালটার রঙ অন্যদিনের থেকে একেবারেই আলাদা। দেওয়ালে, আশেপাশের আসবাবগুলোতে হাত বোলাচ্ছিল ও। কতদিন! কতদিন হলো এই পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো, এই দাগ ধরা রঙ চটা দেওয়াল ওর সঙ্গী। প্রায় বারোটা বছর একটানা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিল সে। নিজেই আশ্চর্য হয় শাখা। একযুগ! এতদিন সে এই অন্ধকূপে কাটিয়েছে!

আজ ঘুম থেকে ঊঠেই ছাদে গেছিল সে। কাল রাতে ভালো ঘুমও হয়নি। হাতের যন্ত্রণা তো ছিলই, আর ছিল দুশ্চিন্তা। কখনো একা বাড়ির বাইরে যায়নি সে। স্টুডেন্ট লাইফেও যখন ইউনিভার্সিটি তে যেত তখন সঙ্গে থাকত বোন। এখানে টুকটাক কোথাও বেরোতে হলে পাড়ার কোনো মেয়েকে ডেকে নেয় সে। অথচ সম্পাতির জেদে সকাল হলেই যেতে হবে থানায়। একটু একটু রাগও হচ্ছিল সম্পাতির ওপরে। একদিন থেকে যেতে পারত না সে? এরকম ভাবে তাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিয়ে উনি কোন চুলোয় বসে বসে পা নাচাচ্ছেন!

ওর খুব প্রিয় টবগুলোর গায়ে, টবে এতদিন যত্ন করে লাগানো ছোট্ট গাছ গুলোর গায়ে আলতো করে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল সে। গাছেরা ভালোবাসা বুঝতে পারে। পরিস্কার বোঝে শাখা, সে আদর করলেই গাছেরা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার হাতের আঙুলে ওরাও আদর করে। আজ ওদের আদর করতে করতে চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েকফোঁটা ঈষদুষ্ণ জল ঝরে পড়ল।

সকালে যখন বাড়ী থেকে বেরোল, রনি তখনো নাক ডাকছে। এই নাকডাকাও আগে একেবারেই সহ্য করতে পারত না সে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে মানুষকে কত কিছুই সহ্য করতে হয়। এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সহ্য করা কাকে বলে, তা প্রতিদিনই একটু একটু করে জেনেছে ও। রোজ সকাল হলেই একটা ভয়ংকর আতঙ্ক চেপে ধরত তাকে। কোন দিক থেকে কি বিপদ আসবে তা আঁচ করার মত প্যাঁচালো বুদ্ধিবৃত্তি নেই তার। ছিলনা কোনোদিনই। একবার কথায় কথায় কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলে ফেলেছিল এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার কথা। শুনেই রেগে আগুন হয়ে বাবা বলেছিলেন, এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলে যেন সে গঙ্গায় ডুবে মরে। বাবার ঠুনকো আভিজাত্যের মোহ যে তার চেয়েও দামী এটা বুঝতে পেরে সেদিন থেকেই সে আরো কঠিন হয়ে গেছিল। বুঝে গেছিল সব সহ্য করতে হবে তাকে এভাবেই যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে আদর করে নিয়ে যায়। হঠাৎই কোথা থেকে তার এই শপ্ত জীবনে টুপ করে ঝরে পড়ল সম্পাতি।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জে একটু আগেই পাড়ার সকলের চোখের সামনে রনি কে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে পুলিশ। ফাঁকা বাড়ির দরজায় তালা দিল শাখা, চাবিটা ওপাশে ঘুরে অনীকের হাতে দিয়ে এল। সে এখনো ঘুমের দেশেই ছিল। কাল রাতে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। ঘুমঘুম চোখে কিছু না বুঝেই চাবি হাতে নিয়ে ফের বিছানায় লম্বা হল। বাড়ির এদিকটায় যে এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই জানেনা ও। জানতে পারলে হয়তো বাড়ির প্রেস্টিজ চলে গেল বলে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে নিত। এই অপদার্থ পরজীবীদের সম্মানবোধের আড়ম্বর যে কোন ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই বুঝে উঠল না সে এতদিনেও।

বুক ভরে একটা পূর্ণ শ্বাস টানল শাখা। স্যুটকেস টা হাতে তুলে নিল। আর এখানে নয়। জীবনটা এবার অন্যভাবে নতুনকরে শুরু করতে হবে।

দুটি কবিতা

ঘুমতালিকার দ্বিতীয় বোতাম

প্রথমটি খসে পড়েছে অনেক আগেই। আমি যখন তৃতীয় বোতামটি
তালাশ করছিলাম, তখনই দুচোখ জুড়ে নেমেছিল বৃষ্টিঘুম। বেশ দীর্ঘ
হয়েছিল রাততালিকা। আর এই গ্রীষ্মাকাশে তারা উড়াবে বলে, ক’টি
পাখি আমার সাথে ধরেছিল বাজি। হারা-জেতার ভয় না করেই।
রাত মানেই ঘুম।ঘুম মানেই রাত। এই বিনম্র শর্তাবলি অস্বীকার করে
আমি পাখিদের সাথে জুয়া খেলতে বসেছিলাম। খুঁজেছিলাম, অস্তগামী
ভোরের বিবরণ।আবার দেখা হবে বলে যে গোলাপ বাগান থেকে
বিদায় নিয়েছিল- তার ছায়ামূর্তি। আমার একবারও মনে পড়েনি-;
দ্বিতীয় যে বোতামটি আমার বুক থেকে খসে পড়েছিল, মূলতঃ তা
ছিল একটি পাথরদানা। তুমি যাকে বিদ্রূপ করে বলতে- ‘প্রেম’॥
#

ছায়াপেশী

মহান পেশীর ভেতর ডুবে আছে চিতা
চিতার মাঝে হাসছে ফুল,
না- আমি ভুল বলছি না
ভুল করে ওই ছায়াপেশী ঢুকে পড়ছে আরেকটি
পেশীর ভেতর।
কামনার ঘোর চোখে যে আগুন জল’কে পোড়ায়,
আমি তার মাঝেই খুঁজে ফিরি তোমার ভগ্নস্বর।
#

After My Death

(Translated from Bengali Version Created by Me)
(Dedicated to My Friend Late Imdadul Bari Apu)

After my death,
Never ever think
I will not be anywhere:
Keep your eyes on the twilight,
In the evening sky;
Lay your ears in the music of fallen leaves,
In the screech of owl;
Have your nose on the green,
In the tears of dew –
You will find me.

After my death,
Never ever think
I will not be anymore:
Keep your eyes on the clouds of autumn,
In the adamant wind of kashbon;
Lay your ears in the solemnity of rain,
In the melody of falling water;
Have your nose on the hyacinth flowers,
In the water of Bongshi –
You will find me.

After my death,
Never ever think
I will not be anymore:
Keep your senses on the eyes of shalik,
In the flight of sparrow;
Lay your ears in the symphony of jhijhi,
In the light and darkness of jonaki;
Have your nose on the stem of rice,
In the heart of durba grass –
You will find me.

একরকম শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণ করেছিলাম

niii

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল ১৯৯৩ সাল। যেদিন বেনাপোল বর্ডার পাড় হয়ে ওপার বনগাঁ পৌঁছেছিলাম, সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ।

সেদিনের ওই যাত্রায় আমরা ছিলাম চারজন। আমি, আমার বন্ধু ও বন্ধুর দুই বোন। বনগাঁও থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদম নামলাম। রাত তখন প্রায়ই বারোটা। তারপর আমার বন্ধুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম, রাত কাটানোর জন্য। সেই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা দমদম থেকে শিয়ালদা। শিয়ালদা নেমে একটা অটো চেপে সোজা বন্ধুর বাসায়।

ওই বন্ধুর বাড়িতে রাত যাপন করে খুবই ভোরবেলা আবার দমদম রেলস্টেশনে এলাম, শিয়ালদহ যাবার জন্য। যখন দমদম রেলস্টেশনে এলাম, তখনও শিয়ালদাগামী ট্রেন দমদম রেলস্টেশনে পৌঁছায়নি। এই ফাঁকে আমার বন্ধু স্টেশন থেকে চারটে টিকেট সংগ্রহ করে ফেলল। ট্রেন আসতে তখনও মিনিট কয়েক বাকি ছিল।

একসময় শিয়ালদাগামী ইলেকট্রনিক ট্রেন দমদম স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। দমদম স্টেশনে নামার মতো যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামলো আমরা চারজন শিয়ালদহ’র উদ্দেশে ট্রেনে ওঠে সিট নিয়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর যথাসময়ে ইলেকট্রনিক দ্রুতগামী ট্রেন শিয়ালদহ গিয়ে পৌঁছালো। আমরা ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম রেলস্টেশনের বাইরে।

শিয়ালদহ রেলস্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা অটো চেপে চলে গেলাম, বাঘা যতীন সংলগ্ন বন্ধুর ভাড়া বাসায়। বন্ধুর ওখানে ছিলাম, প্রায়ই একমাসের মতো। কিন্তু আমি যেই কাজের আশায় বাংলাদেশ থেকে ভারত গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুর এখান থেকে জলপাইগুড়ি বড়দি’র বাড়ি চলে যাবো। শেষাবধি তা-ই হলো।

বন্ধুর ভাড়া বাসায় মাসেক খানি অবস্থান করার পর চলে গেলাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। জলপাইগুড়ি বীরপাড়া আমার বড় দিদির বাড়ি। একসময় এই বীরপাড়া পুরোটাই ছিলো চা-বাগান। এই চা-বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট একটা বাজার। সেই বাজারের নাম হয়, “বীরপাড়া” বাজার। বীরপাড়া বাজার ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল, ভুটানের গুমটু যাবার রাস্তা।

ভুটান গুমটু যাবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দু’পাশে থাকা চা-বাগান ঘেঁষে জনবসতি গড়ে উঠেছিল তুলনামূলকভাবে। সেইসাথে যখন লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন চা-বাগানের কিছু অংশ হয়ে পড়ে বেদখল।
আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম চা-বাগান ঘেঁষা বড় দিদির বাড়ি। যেখানে বড় দিদির বাড়ি, সেই জায়গার নাম, রবীন্দ্র নগর কলোনী। এই রবীন্দ্র নগর কলোনী ছাড়াও আরও কয়েকটা মহল্লা আছে। সবগুলো মহল্লাই একসময় চা-বাগান ছিলো।

বর্তমানে চা-বাগানের বেদখল হয়ে পড়া জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন। মানে যিনি ওই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছে, তিনিই ওই জায়গার মালিক। শোনা যায় প্রত্যেকেই চা- বাগান কোম্পানি হতে নামমাত্র মূল্যে দখলকৃত জায়গা দলিলের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে নেয়। সে হিসেবে বড় দিদির বাড়িটাও নিজেদেরই কেনা সম্পত্তি।

যাইহোক ৩০ বছর আগে যখন আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আমার বড় দিদি আমাকে চিনতে পারছিলেন না। কারণ আমার বড় দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমি ছিলাম মাত্র দেড় বছরের এক কোলের শিশু। আমার বড়দি’র বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। আমার জামাই বাবু বড় দিদিকে নিয়ে সপরিবারে ভারতে চলে আসে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেই আসা-ই-আসা, আর কখনো তারা বাংলাদেশে যায়নি। সেই দেড় বছরের আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, ত্রিশ বছর বয়সে। না চেনার কারণই ছিলো ওটাই। অবশ্য পরিচয় দেওয়ার পর খুব ভালো করেই চিনেছিল।

বড় দিদির ওখানে গিয়ে মাসেক খানেক ঘুরে-ফিরে সাথে নেওয়া টাকা-পয়সা শেষ করে উপায়ান্তর না দেখে ভাগিনাদের সাথে গ্যারেজে কাজ করা শুরু করি। গাড়ির গ্যারেজে কাজ করার সুবাদে ওখানকারই অনেক ড্রাইভারে সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিলো।

যেখানে যাবার মন চাইত, ভাড়া ছাড়াই সেখানেই চলে যেতাম। গিয়েছিলাম ভুটান গুমটু, সামসি, শিলিগুড়ি, জল্পাইগুড়ি, সিকিম যাবার ভারত-সিকিম মেইন সংযোগস্থান সেবক’র মতো সুন্দর-সুন্দর জায়গায়।। কিন্তু যাবো যাবো বলেও কাজের চাপে যাওয়া হচ্ছিল না, ভুটান ফ্রুন্টসলিং।

ভুটানের ফ্রুন্টসলিং আমার বড় দিদির বাড়ি বীরপাড়া থেকে মাত্র বিশ টাকার ভাড়া। বীরপাড়া থেকে ফ্রুন্টসলিং যেতে সময় লাগতো, দু’ঘন্টার মতো। এতো সামনে থেকেও সেখানে যাওয়া হচ্ছিল না।

একদিন সকালে খাওয়া-দাওয়া করে আর গ্যারেজে যাইনি। এদিন সকালে জামা-কাপড় পড়ে কারোর কাছে কিছু না বলে বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। আমার সাথে টাকার অংক ছিলো মাত্র দুইশো টাকার মতো।
বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে একটু ঘুরা-ঘুরি করে দেখলাম পরিচিত কোন বাস আছে কি-নাই। ঘুরে-ফিরে খানিক পর দেখি আমারই পরিচিত একটা গাড়ি জয়গাঁও যাবার জন্য যাত্রী সংগ্রহ করছে। বাস কাউন্টার থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, “জয়গাঁ জয়গাঁ”। আমি ভাবতে লাগলাম জয়গাঁ আবার কোথায়?

এই ভেবে বাসের সামনে যেতেই বাস ড্রাইভারের সাথে দেখা। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কোথায় যাবে?”
বললাম,“ফ্রুন্টসলিং ঘুরতে যাবো, মামা!”
ড্রাইভার বললো, “আমি-ও-তো গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ যাচ্ছি, মামা। তো যাবে যখন গাড়িতে উঠে আমার সিটের পেছনের সিটে বসে থাকো। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ’র উদ্দেশে রওনা দিবো।”
বললাম, “আমিতো ফ্রুন্টসলিং যাবো মামা।”
ড্রাইভার বললো, “আরে মামা জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং একই জায়গায়। জয়গাঁ হলো ভারত-ভুটান বর্ডার। জয়গাঁ ভারতের আর ফ্রুন্টসলিং হলো ভুটানের একটা শহর। যাও যাও গাড়িতে উঠে আমার পেছনের সিটে বসো।”

ড্রাইভারের কথা শুনে আমি তা-ই করলাম। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসলাম। একটু পরই গাড়ি ফুন্টসলিঙের উদ্দেশে ছুটে চললো।
বিরতিহীন গাড়ি। কোথাও থামা-থামি নেই। গন্তব্য ছাড়া যাত্রীও ওঠা-নামা করতে পারে না। গাড়ি চলছে-তো-চলছেই। প্রায়ই দু’ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম, ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা জয়গাঁও ফ্রুন্টসলিং বর্ডার।

বাস থেকে নেমে ভুটান ফ্রুন্টসলিং প্রবেশের সুবিশাল গেইটের সামনে একটা চা’র দোকানে গেলাম। আমার সাথে বাসের ড্রাইভার হেলপারও ছিলো। সবাই মিলে আমরা ছিলাম চারজন। চারজনেই চা-বিস্কুট খেলাম। দাম দিলাম আমি। কারণ বাসে তো ফ্রি এসেছি, তাই।

চা-বিস্কুট খাওয়ার পর ড্রাইভার তার হেলপারকে বললো, ‘“গাড়িতে বীরপাড়ার যাত্রী ওঠাও!”
আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কখন যাবে?” বললাম, “একটু ঘুরা-ঘুরি করে জায়গাটা দেখে বিকেলে রওনা দিবো, মামা।”

আমার কথা শুনে বাসের ড্রাইভার আমাকে সেখানকার আইন-কানুন সম্বন্ধে বুঝিয়ে বললো, “যা-ই করো, আর ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে যেখানেই যাও, সন্ধ্যার আগে আগে ভুটানের গেইট পাড় হয়ে ভারতের ভেতরে চলে আসবে। কারণ সন্ধ্যার সাথে সাথে ভুটানের বর্ডার গার্ড ফোর্স এই সুবিশাল গেইটটা বন্ধ করে দেয়। গেইট বন্ধ হয়ে গেলে তুমি যদি ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থেকে যাও, তাহলে তোমাকে আটক করে জেলে ভেরে রাখবে। তাদের আইনে যে-ক’দিন সাজা হয়, তা-ই ভোগ করে বের হতে হবে। কাজেই সন্ধ্যার কথাটা তুমি মাথায় রেখে ঘুরা-ঘুরি করবে।”

আমি বাস ড্রাইভারের নির্দেশাবলী মাথায় রেখে বললাম, “ঠিক আছে মামা, তা-ই হবে। আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”
বাস ড্রাইভার কয়েকজন যাত্রী সংগ্রহ করে বীরপাড়ার উদ্দেশে রওনা হলে, আমি আস্তেধীরে ভুটান ফ্রুন্টসলিঙের সুবিশাল গেইট পাড় হয়ে সোজা ফুন্টসলিঙের ভেতরে চলে গেলাম। গেইটে চার-পাচজন সিপাহী ছিলো। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি যে, আমি কোথাকার এবং কোথা-ই-বা যাচ্ছি।

দেখলাম তারা এপার-ওপার হওয়া কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। গেইট দিয়ে অনবরত ভারত ভুটানের লোক আসা-যাওয়া করছে, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে যার-যার নিজের মতো করে। এতে কারোর জন্য কোনও জেরার সম্মুখীন হতে হয় না। জিজ্ঞাসা আর চেক থাকে তখন, যখন ভারত থেকে গাড়িগুলো ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে ঢুকে।

মাঝে-মাঝে ভারত থেকে বিভিন্ন মালা-মাল বোঝাই বড়-বড়ে (লড়ি) ট্রাক ফ্রুন্টসলিং দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। এই গাড়িগুলোর দিকেই থাকে সুবিশাল গেইটে সিপাহিদের তীক্ষ্ণ নজর!

এছাড়া সিপাহিরা মানুষজন আসা-যাওয়ায় কাউকে কিছুই বলে না। আমাকেও কিছু বলেনি। আমি হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রুন্টসলিঙের বেশখানিক ভেতর চলে গেলাম, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে!

ফ্রুন্টসিলিং, ভুটানের একটা বানিজ্যিক শহর। এই ফ্রুন্টসিলিং শহরটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ভারতের অংশ জয়গাঁও। এই জয়গাঁও আর ফ্রুন্টসলিং সমান উঁচু দেখা গেলেও, ফ্রুন্টসলিং জয়গাঁও’র চেয়ে অনেক উঁচু!
ফ্রুন্টসলিং আর জয়গাঁ একসাথেই মিলে-মিশে পাশা-পাশি। জনবসতি আর ছোট-বড় বিল্ডিং, শপিংমল থাকার কারণে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং পাহাড় মনে হয় না। কিন্তু সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং অনেক উঁচুতে। সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং কতখানি উঁচুতে, তা বোঝা যায় ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে গেলেই।

ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে একটা বড় বৌদ্ধবিহার আছে। বৌদ্ধবিহারের সামনেই বড় ড্রামের মতো আছে। এই ড্রামটাকে বলা হয়, প্রার্থনা ড্রাম বা প্রার্থনা চাকা বা ঢোল। সেই ড্রামে বৌদ্ধদের ধর্মীয় শাস্ত্র-গ্রন্থের মন্ত্র ❝ওম মানি পদমে হুম❞ লেখা থাকে।

এই প্রার্থনা ড্রামের সামনে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মাথা নিচু করে দু’হাত জোড় করে ভক্তি করে। তারপর প্রার্থনা ড্রাম কয়েকবার ঘুরায়, আর মুখে মন্ত্রপাঠ করে।

বৌদ্ধ ধর্মে প্রার্থনা ড্রাম ঘুরানোর মানে হলো, ❝মানুষের হৃদয়কে করুণা ও ভালবাসায় পূর্ণ করতে সহায়তা করা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করে যে, নিজের হৃদয়ে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ঢোল ঘোরানো মানে প্রভুর হৃদয়ের সাথে নিজের হৃদয় স্থাপন করা। তাদের ধারণা এই প্রার্থনা ড্রাম বা চাকা বা ঢোল ঘুরানোর ফলে প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই ধরাধামে বেঁচে থাকা যায়।❞

এই বৌদ্ধবিহারের সামনে দিয়েই ভারত থেকে ভুটানের রাজধানী থিম্পু পর্যন্ত হাইওয়ে। ভারত-ফ্রুন্টসলিং টু থিম্পু হাইওয়ে ঘেঁষে একটা খালের মতো আছে। এটা আসলে খাল বা নর্দমা নয়! এটা ভুটানের কোনোএক পাহাড়ের ঝর্ণা। খালের মতো দেখতে সেই ঝর্ণা দিয়ে দিনরাত যেভাবে পানি নামে আসে, তা দেখেও মনে ভয় হয়!

ভয় হয় এই কারণে যে, ওই পানিতে নেমে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। পানিতে নামার সাথে-সাথে তীব্র স্রোতে মুহূর্তেই টেনে নিয়ে যাবে, অন্য কোথাও। এই পাহাড়ি ঝর্ণা ভুটানের কোন পাহাড় থেকে উৎপন্ন, তা-ও আমার অজানা থেকে যায়। শোনা যায় এই ঝর্ণার প্রবাহিত খালের পানি থেকে ভারত-ভুটান যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, এই ফ্রুন্টসলিঙে।

ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হওয়া খালটা ফ্রুন্টসলিং টাউন থেকে অনেক নিচে। এই ঝর্ণা খালের ওপারে যেতে ছোট একটা ব্রিজ আছে। খাল পাড় হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়লো, একটা কুমিরের খামার। কুমিরের খামারটাও অনেক বড়। দিনের বেলা খামারের চারপাশ দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে।

দেখলাম, সেই খামারে কুমিরগুলো কিন্তু পানিতে থাকে না। থাকে শুকনো জায়গায়। পানির সামান্য ব্যবস্থা শুধু ছোটো একটা পুকুরের মতো। সেই কুমিরের খামারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুমিরগুলো দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এই ফ্রুন্টসলিঙে ছুটে আসে। লোকের ভীড় থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

আর অনেক দর্শনার্থীদের সাথে আমিও ঘুরে-ফিরে খামারের সামনে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তারপর ঝর্ণার খালটা পাড় হয়ে ফ্রুন্টসলিং টাউনের উপরে উঠে গেলাম। মনের আনন্দে ঘুরতে থাকলাম, ফ্রুন্টসলিং টাউনের এপাশ থেকে ওপাশ।

ফ্রুন্টসলিং টাউন খুবই সুন্দর! আমি যতক্ষণ সময় ফ্রুন্টসলিং টাউনে ছিলাম, ততক্ষণ আমার মনে হয়েছিল আমি গণচীন অথবা হংকঙের কোনোএক শহরে ছিলাম। উঁচুনিচু রাস্তা। রাস্তার পাশেই ছোট-বড় শপিংমল, বার, নামি-দামি হোটেল, আর বাহারি ফুল ও ফলের দোকান। ফ্রুন্টসলিং টাউনের এক কোণে প্রতিদিন বিকেলবেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার্থে সন্ধ্যাকালীন বাজারও মেলে।

সেই বাজার রাত আটটা অবধি চলে। রাত আটটার পরপরই টাউনের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আর ভারত-ভুটান বর্ডার গেইট বন্ধ হয় সন্ধ্যার একটু পরই।

ফ্রুন্টসলিং টাউনের বাইরেও জয়গাঁও সপ্তাহে দু’দিন স্থানীয়দের হাট মেলে। সেই হাটের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ভারতীয়। সপ্তাহিক এই হাটে ভুটানি ব্যবসায়ীও আছে। তাদের ব্যবসা নিজের জায়গায় ফলানো তরিতরকারি, নিজেদের গাছের সুপারি, পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নানারকম শাকসবজি আর তরতাজা ফলের।

হাটবারে ভুটানিরা জয়গাঁও আসে অনেক দূরদূরান্ত থেকে। ফ্রুন্টসলিঙে গাড়ি চলাচলের জন্য একটামাত্র রাস্তা যা, ভারত-ভুটান হাইওয়ে নামে পরিচিত। এছাড়া ফ্রুন্টসলিং টাউনের আশ-পাশ দিয়ে ভুটানি স্থানীয়দের চলাচলের জন্য আর কোনও রাস্তা চোখে পড়েনি। তারা হাটবারে যার-যার বাড়ি-ঘর থেকে পায়ে হেঁটেই আসে।

ফ্রুন্টসলিঙে আর জয়গাঁও ঘুরে-ফিরে বুঝেছি, তাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে ফল জন্মায়। ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় কমলা। এর সাথে আপেল, আঙুর-সহ আরও নানারকম ফলও দেখা যায়। বেশিরভাগ বিক্রেতা ভুটানি মহিলা।

তারা ভারতের ভেতরে জয়গাঁও এসে ফল বিক্রি করে। আবার সন্ধ্যার আগে তাদের গন্তব্যে ফিরে যায়। কেউ কেউ ভারতের জয়গাঁও হাটে এসে বাজার-সদাইও করে নেয়।

এছাড়াও ভুটানের জনগণ সবসময়ের জন্যই ভারতে আসা-যাওয়া করতে পারে। আবার ভারতের জনগণও একইভাবে আসা-যাওয়া করে থাকে। ভুটানিরা শুধু আসা-যাওয়াই নয়, ভুটানিরা ভারতে এসে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রতিদিন।

অনেক ভুটান নাগরিককে ভারত এসে স্থায়ীভাবে বসবাসও করতে দেখেছি। ভারতের ভেতরে তাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলোতে। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি বসবাস গুমট আর ফ্রুন্টসলিং ঘেঁষা জয়গাঁও এলাকায়।

ভুটানি জনগণ খুবই মিশুক। তারা খুব সহজেই একজন মানুষকে আপন করে নিতে পারে। তাদের আচার-ব্যবহারও মনে রাখার মতো। তা বোঝা গেলো দুপুরবেলা ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থাকা একটা খাবারের হোটেলে ঢুকে।
হোটেলটা বেশি একটা বড়সড় নয়। কিন্তু এই হোটেলে দিনের সারাটা সময় থাকে কাস্টমারের ভীড়। হোটেলের ক্যাশে বসা একজন যুবতী মহিলা। হোটেল বয় বলতে যাদের দেখলাম, তারা সবাই মহিলা। হোটেলের মালামাল সংগ্রহ করে আনার জন্য হয়তো পুরুষ কর্মচারী থাকতে পারে। কিন্তু হোটেলের ভেতরে কোনও পুরুষ দেখা যায়নি।

হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসার জন্য আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু বসার সুযোগ হচ্ছিল না। একজন মহিলা কর্মচারী আমাকে ফলো করে সামনে এসে তাদের ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। তার কথার উত্তর যখন আমি দিতে পারছিলাম না, তখন হোটেলের মহিলা বুঝতে পারলো আমি তার ভাষা বুঝিনি। তারা শুধু তাদের ভাষাই নয়, তারা ভারতের সবকটা প্রদেশের ভাষা জানে এবং যখন যেই ভাষার দরকার-সেই ভাষায় কথা বলে।

তাই আমি যখন তার কথার উওর দিতে পারছিলাম না, তখন ওই মহিলা আমাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভাত খাবেন?”
আমি বললাম, “ইচ্ছে ছিলো ভাত খাওয়ার। কিন্তু কী করে খাবো? লোকের ভীড়ের জন্য তো ভেতরে যেতে পারছি না।”
আমার কথা শুনে ওই মহিলা বললো, “একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।”

দশ মিনিট পরই হোটেলের ভেতর থেকে ওই মহিলা আমাকে হাতে ইশারা দিয়ে ভেতরে ডেকে নিয়ে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবেন? মাছ না সবজি?” বললাম, “মাছ ভাত খাবো!”

দুই মিনিটের মধ্যেই একটা স্টিলের থালায় করে খাবার নিয়ে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আমি খাবার দেখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম! থালার মাঝখানে অপ্ল দুমুঠো চিকন চালের ভাত। ভাতের চারদিকে সাজানো আছে সবজি কাটা আর তরকারির ছোট-ছোট বাটি।

এ-সবের মাঝে ডাল ছিলো তিন রকমের তিনটে বাটি, ভাজি এক বাটি। আর রুই মাছের তরকারি এক বাটি।

এসব দেখে আমি খাওয়ার ভা-ও পাচ্ছিলাম না। পাশে বসা কাস্টমারদের খাওয়া দেখে তাদের মতো করে খেলাম। তাদের রান্না করা তরকারিগুলো খেতে খুবই ভালো লেগেছিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাশের সামনে যেতেই ওই মহিলা ক্যাশের সামনে গিয়ে তাদের ভাষায় খাবারের মূল্যের পরিমাণ বলে দিয়ে চলে গেলো। আমি আমার পকেট থেকে ভুটানি একশো টাকার একটা নোট বের করে ক্যাশে দিলাম। ক্যাশে বসা মহিলা আমাকে আশি টাকা ফেরত দিলো। আমি টাকা হাতে নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা ফ্রুন্টসলিং ত্যাগ করে জয়গাঁও চলে এলাম।

জয়গাঁ এসে দেখি চারটে বাজতে লাগলো। পকেটে টাকা ছিলো প্রায়ই একশো ষাট টাকার মতো। বীরপাড়া যেতে বাস ভাড়া বিশ টাকা খরচ হলেও আরও বেশ ক’টা টাকা আমার কাছে থাকে।

এই ভেবে এক ভুটানি ফল বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এক ঝুরি কমলার দাম কত?”
মহিলা ফল বিক্রেতা বললো, “একশো টাকা।”
আমি আশি টাকা দিতে চাইলে ফল বিক্রেতা মহিলা আমাকে আশি টাকায় এক ঝুরি ফল দিয়ে দিলো। এক ঝুরি ফল মানে ষোল হালি কমলা।

ফলের ঝুরি নিয়ে বাস কাউন্টারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্ট্যান্ডে একটামাত্র বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস ড্রাইভার আমার পরিচিত ছিলো না। এই বাস-ই বীরপাড়ার শেষ বাস। যাত্রী সীমিত! বাসে উঠে সিটে বসলাম। আরও কিছু যাত্রী উঠলো। এর কিছুক্ষণ পরই বাস বীরপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। সন্ধ্যার পরপরই পৌঁছে বীরপাড়া। সেখান থেকে কমালার ঝুরি হাতে নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি।

বড় দিদি ফলের ঝুরি দেখে মাথায় হাত রেখে বললো, “এতো, কমলা খাবে কে-রে? কোত্থেকে এনেছিস, শুনি?” বললাম, “ফ্রুন্টসলিং গিয়েছিলাম, দিদি। হাতে কিছু টাকা ছিলো। তাই ঝুরি-সহ কমলাগুলো নিয়ে এলাম। এগুলো আশ-পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের হাতে কিছু দিয়ে নিজেরা খাবেন।”

আমার কথামতো বড়দি তা-ই করলো। নিজেদের জন্য কিছু কমলা রেখে, আমার বেয়াই বাড়ি-সহ আশেপাশে থাকা আরও বাড়িতে বাদবাকি কমলা বিতরণ করলো। এভাবেই শেষ হলো ফ্রুন্টসলিং থেকে আনা এক ঝুড়ি কমলা, আর শেষ হলো আমার শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণের গল্প।

রাত্রিকথা


বসে আছি বারান্দায়, একা।
এ এমন শহর
আকাশ দেখা যায়না
অথচ খসে পরা তারার
পোড়াগন্ধ টের পাই হৃদয়ে

আমি আরো একা হয়ে যাই।


কারা যেন কোন পাহাড়ে থাকে
অবিন্যস্ত কথাবার্তা আর
কমিউনিকেশনের নতুন ভাষায়
তারা যেন মিথ্যাকে সত্যিতে সাজায়।

কায়দা করে চলো পাথর হই
মানুষ জীবন আর ভালো লাগছে না।

শিখার প্রেম

গাছে গাছে ফোটে আছে হরেক রকম ফুল
হরেক রকম ফুল
শিখা রানী খুলল ফেলে খোপায় বাধা চুল
খোপায় বাধা চুল।

খোপায় কেন চুল বাঁধলো যায় না কারণ জানা
যায় না কারণ জানা
জানলে তবু যায় না বলা বলায় আছে মানা
বলায় আছে মানা।

তবু বলি শুনো সখা শুনো আমার সই
গোপন কথা কই
শিখা রানী পড়তেছিল প্রেম কাননের বই
গোপন কথা কই।

বইয়ের পাতায় গোপন চিঠি গুলাপি এক খামে
গুলাপি এক খামে
প্রেমের পদ্য কেউ লিখেছে শিখা রানীর নামে
গোলাপি এক খামে।

সেই পদ্য শিখার মনে গানের তালে নাচে
গানের তালে নাচে
জানল শিখা তার জন্য কেউ কোথাও আছে
গানের তালে নাচে।

প্রেম আবেগে থরথরো ফেলল বেধে চুল
মনে হুলস্থুল
সই সখীরা বলল শিখা চুল তো এবার খোল
তুই চুল তো এবার খোল।

প্রেমাবেগে সখীর কথায় খুলল মাথার খোপা
খুলল মাথার খোপা
বলল সখি আমার মাথায় কোদাল দিয়ে কোপা
তোরা কোদাল দিয়ে কোপা।

এমন সুখে মরি যদি সুখের মরণ হবে
সুখের মরণ হবে
প্রেমে পরায় এত সুখ কে জেনেছিস কবে
প্রেমের মরণ হবে।

শিখা রানীর প্রেম হয়েছে প্রেমিক বসে ঘাটে
প্রেমিক বসে ঘাটে
প্রেমের নদী পেরিয়ে তারা সুখ সায়রে হাটে
জীবন সুখেই কাটে।

শিখা রানী চুল বাধে কিংবা রাখে খোলা
প্রেমের পাঠে তাহার এখন আড়াই জোড়া পোলা।

ধরিত্রীফুলগাছ

সৌন্দর্য, আমাকে স্নিগ্ধ চোখে চোখে রাখো

বাতাস শান্তিপীড়িত, বাতাস কীটবাসস্থান
আর প্রেমিক-প্রেমিকা ফোঁড় আছে অন্ধকারে
সিক্ত-অভিষিক্ত দুই পাখি
গালে ছোট ছোট সুশ্রী চাঁদের কারখানা

ওই যে ষোলো শাখার ধরিত্রীফুলগাছ
কিছু না কিছু পাপড়ি সবার মাথায়
আমি সেখানে লেখা কুড়োতে যাই
দেখি রোগা এক আহা রে ইঁদুর, তার দিন শুরু হল
আলো এসে বসেছেন ঝিঙেক্ষেতে স্বয়মাগতা
তারপর আজ রাতে যতবার তোমার শরীরে গিয়েছি
ছোট্ট সোঁতায় শুধু মাছ চমকে ওঠার শব্দ

তুমি আর বিবাহ ক’রো না
আমার শান্ত পোতাশ্র‍য় হয়ে যাও

ভালোবাসার জলকামান দুজনে ঘুরিয়ে দেব
পৃথিবীর দিকে

আসুক বৃষ্টি হঠাৎ করে

chh

আসুক বৃষ্টি নামুক বৃষ্টি
ঝরুক বৃষ্টি ধরায়
আর পারি না থাকতে সুখে
গ্রীষ্ম মাসের খরায়।

পুড়ে যাচ্ছি জ্বলে যাচ্ছি
৫০ ডিগ্রি তাপে
নাখোশ বুঝি প্রভু তুমি
মরছি অনুতাপে।

দাও না বৃষ্টি, ঝরাও বৃষ্টি
ওগো দয়াল আল্লাহ্
করো ভারী পাপ কমিয়ে
বান্দার পূণ্যির পাল্লা।

আয় না বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে
আকাশ হতে নেমে
সূর্যের তাপে জনজীবন
থমকে আছে থেমে।

নাই রে শান্তি ধরার উপর
নেইকো সুখ আর অল্প
তাঁর নিয়ামত ছাড়া ধরায়
হয় না সুখের গল্প।

দয়া করো মাবুদ আল্লাহ
দাও ঝরিয়ে বৃষ্টি
হোক না প্রভু একটুখানি
সুখ আরামের সৃষ্টি।

আয় রে বৃষ্টি আয়রে ত্বরা
দে ভিজিয়ে মাটি
সাজুক ধরা সজীবতায়
আজকে পরিপাটি।

আমার প্রিয় কবিতা … আপনারও ভালো লাগতে পারে

আমার প্রিয় কবিতা …
আপনারও ভালো লাগতে পারে

ফটোশপে বানানো ছায়া

আলো দিয়ে বানাবার কথা ছিল ঘর, তা দখল করে নিচ্ছে
ফিকে রেখা। মানুষের মনে জমে থাকার কথা ছিল যে
বিনীত ধর্মের বয়ন, তা চলে যাচ্ছে মিথ্যের দখলে।
কিছু প্রতারক ছবিদোকান খুলে, বিক্রি করছে, মেকি
হাড়-মাংস, অনুভুতি,অহংকার, প্রেম,এবং ভূমিমাটি।

যাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ছিল, তারা বেছে
নিয়েছে অন্ধপ্রায় জীবন। যে পাখিগুলো কবিদের পক্ষে
উড়বে বলে জানিয়েছিল প্রত্যয়- ওদের বন্দী করেছে
কিছু বেনিয়া শিকারী। অবশ হয়ে পড়েছে কিছু রাজনীতিকের হাত

ছবিদোকান থেকে মিথ্যে ছবি কিনে, তা বাজারে ছড়াচ্ছে
কতিপয় সুবিধাবাদী। আর আমরা যারা তালিয়া বাজাচ্ছি,
তারা নিজেরাও জানি না, একদিন এই ছবিদোকানে
নিলাম হয়ে যেতে পারে আমাদের ঘর-সংসার, আমাদের ছায়া।

মুখ দেখা যায়

তফাত জেনে স্পর্শ গড়ায়। আত্মজীবনী
থেকে বহুপুরাতন মৃত্যু পরস্পর ডাকে,
কারোর মুখ নিয়ে বেঁচে থাকার রুটিনে
শাদা বেড়ালের চোখ, হরফে সেসব লেখে
দোরের সামনে ছেড়ে আসা পঠিত রোদ
পাহাড়, গ্রাম, বর্ষা এবং চিরকাল তুমি।

ফের মরে ওঠা ঘাস, বাস্পঘরে দোল খায়।
পৃথিবীর পাশাপাশি জ্যোৎস্না কঙ্কালে রাত
কৈশোর রেখে আসা সেই সন্ধ্যার মতো;
কোনো এক ফেনাস্রোতে ভাসিয়ে আনে

হাসতে হাসতে ক্রোধ কুড়োনো সমতল গাছ,
ছায়ার সঙে বন, পাখি-উঠোন। একই পথে
নির্বিকার মহাকাশ থেকে বৈদ্যুতিক তারে
এসব দিনে যৌথ করতালিতে মুখ দেখা যায়…

.
৮ জুন ২০২৩

সহ ব্লগারেরা এসো…..

out.-3d

বাংলা ব্লগের প্রাণ
নির্মোহ ভালোবাসার অনির্বাণ পুরুষ
আজাদ কাশ্মীর জামান!
প্রেরণা ও প্রেমে নিজেকে করেছেন উন্নত শিরস্ত্রাণ!..

নিভু নিভু প্রোফাইল ছবিতে আছেন আবু সাঈদ আহম্মেদ,
যদিও তিনি শব্দের কারিগর….
কথা সাহিত্যের প্রখর সূর্য
কাজে নিবিষ্ট মন, মানবিক এক তূর্য!

ব্লগ দুনিয়ার আশীর্বাদ তার নাম জামান আরশাদ।
দারুণ মমতাবান আর রয়েছে প্রাজ্ঞ জ্ঞান।

সবার প্রিয় আপা লুবনা মুক্তি, অদম্য প্রেরণা
যিনি- আসলেই এক অনন্য শক্তি
শ্রদ্ধা সম্মানে ভক্তিমান!

স্থির শিল্পের যাদুকর ব্লগগুরু জিয়া রায়হান
নিবিষ্ট ধ্যানে ক্যামেরায় ডুবে যান অহর্নিশ
ছবিতা আর কবিতায় দক্ষ হাতে চলেন সমান।

ব্লগবাড়ির গোড়াপত্তনে যার কর্ম শৈলী নিপুন হস্ত,
দুরন্ত দুর্নিবার সাইক্লোন শিবলীর মর্ম রয়েছে বিন্যস্ত!…

ধ্যানে জ্ঞানে করেছেন সন্ধি
প্রিয় কবি ফকির আবদুল মালেক
নান্দনিক স্ফূরণে বুনেছেন
‘একাকিত্বের জবানবন্দি ‘!..

মননশীল কবিতা রচনায় যার কথা না বললেই নয়
নতুন নতুন কবিতায় রোজ নিজেকে দেয় জানান
ভুতু সোনার কারিগর কবি চারু মান্নান! চারু মান্নান

অসাধারণ মানুষ আমাদের জাকির হোসেন
আবৃত্তি আর মননশীলতায় এখনো সবাইকে ভালোবাসেন।

ভোমরার গুনগুনানিতে শব্দ কুড়ান
কথা সাহিত্যের খালিদ ওমর, নক্ষত্রের গোধূলির বয়ানে আচ্ছন্ন করে রাখতেন সমগ্র আসর।

চট্টগ্রামের রত্ন আ স ম এরশাদ
যত্ন করে পূরণ করতেন
সহব্লগারদের সাধ আহ্লাদ।

গল্প ও রান্না
রান্নার গল্পে রুচির বন্যা বইতো শাহদাত উদরাজী ভাইয়ের চমৎকার সৃজনে
পোস্ট পড়লেই ক্ষুধা পেতো পেটে লাগতো চিনচিনে..

ছবি নামে কবিতার প্রেমে অবিরাম হেঁটেছেন
কাজী ফাতেমা ছবি,
ঝলমলে লেখার আলোয়
আসলেই এক জ্যোতির্ময়ী কবি।

প্রান্তিক কবি প্রিয় এসকে দোয়েল
সাজাতেন গদ্য প্রীতি –
আত্মিক অর্থেই সত্যিকার সাধক তেঁতুলিয়ার বাতি!…

তেলের মতো নিজেকে জ্বালিয়ে আলো দিতো সৈয়দ মাজহারুল ইসলাম রুবেল- কবিতা আর গল্লে বইতো আনন্দধারা, চিত্তাকর্ষক উদ্বেল!..

আরো কত গুনীমান্যি
কত ফুল ও নক্ষত্রের কোলাহল
আমাদের ব্লগবাড়ি হতো মুখরিত, ঐকান্তিক উজ্জ্বল!..

নগন্য আমি
অতি ক্ষুদ্র!.. হত দরিদ্র গাঁও গেরামের মানুষ
শুদ্ধ অশুদ্ধ কত কি লিখি – সেদিকে থাকেনা হুঁশ!
ডাকছি তোমাদের
সহ ব্লগারেরা এসো-
আত্মার নন্দনে বসো..
জানি ভালবাসো… তবুও
মনের সনে মনের সাক্ষাতে মিষ্টি করে হেসো!….

সহ ব্লগারেরা এসো….. দাউদুল ইসলাম
২৭/৬/২৩