রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

যাওয়া আসা

আমার জ্যোৎস্না বেলা শেষ।
বুকে অমাবস্যা পোষা আছে।
প্রস্তুত আমি, তরোয়াল নিয়ে এসো।
বেদনাকে কোরো তরোয়ালের ধার।

শ্মশানের মাঝামাঝি আমি
তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি।
আমার চোখ, আমার আকাশ,
সর্বস্ব নিয়ে অপেক্ষা করছি।

হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে এসো
বেদনাকে কোরো সে তরোয়ালের ধার।

টুকরো হৃদয়

এক টুকরো হৃদয় কেটে দিলাম তোমায়,
তুমিই তো এখন আমার স্থির আকাশ,
অথচ জানি, এই স্থির আকাশেও
একদিন ঝড় উঠবে, অস্থির হবে।
আবার রক্তাক্ত হবে ছিন্নভিন্ন হৃদয়।

জানি আলো শেষ হবার পরেও
তোমায় দেখতে পাবো না।
বুকের ভেতর থেকে যাবে তুমি
পৃথিবীর প্রথম দিনের সূর্যের মতো।
আবার প্লাবনে ভাসবে আমার চোখ।

প্রতিদিন মঞ্জরিত আমি তোমার প্রেমে,
তৃষ্ণার এক অঞ্জলি আমি,নেফারতিতি।
অদৃশ্য তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমায়।
হিমেল হাওয়ায়, দক্ষিনের হাত ধরে
ক্ষেতের দিকে, কাজল জলের সাথে
বয়ে যাওয়াই হল আমার পথ।

ত্রিনয়নী

ত্রিনয়নে আগুন রাখে, দুচোখেতে জল।
জলের তবু নদী আছে, নদীর আছে তল।
অভিমানী শরত রানী, শিউলি ঝরা গান।
গানের তবু ছন্দ আছে, ছন্দের আছে মান।

মন উঠোনে উথালপাথাল, আগমনী দিনে।
দুর্গা রানী, শিব ঘরনী, অসুর নেবে চিনে।
খুশির দেখো জোয়ার আসে, পানসি ভাসাক মন।
কাশের বনে, মাঠের পারে চালতা রঙা বন।

রূপকথাতে চুপকথাতে, মন জুড়োবে কই।
বিসর্জনের সময় বুঝি এগিয়ে এলো ওই।
কান ফুসফুস মন চুপচুপ, কি জানি কি হয়,
ঢাকের কাঠি উঠলো বোলে, দুর্গা মায়ের জয়।

___
বাংলাদেশের দৈনিক ভোরের কাগজ এ আজ প্রকাশিত। কবিতা : ত্রিনয়নী

জীবন কথন

মন আজ কি বলবো তোকে? আমি যে নিজের ছায়াকে লঙ্ঘন করতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে ছিলাম, ওই অহংকারী চাঁদের আলোতে চারিদিক ঝলমল করছিলো। আর সারা আকাশ জুড়ে যে সব তারাদের মেলা বসেছিল তারা সবাই মিটিমিটি করে আমায় দেখছিল। আর আমি আমার পছন্দের তারাদের যখন একটা একটা করে তুলে রাখছিলাম আমার মনের মণিকোঠায়, ঠিক তখনই বাকি তারাগুলো মিছিল করে ঘিরে ধরল আমায়, শোনালো তাদের দুঃখের কথা। আমি আমার চোখের জল দিয়ে তাদের দুঃখগুলোকে ধুয়ে দিলাম।

কতক্ষন যে এইভাবে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই। শোনালাম তাদের আমার কথা, মন তোর কথা। জানিস ঠিক তখনই চারিদিকে টুপটাপ শব্দ শুনতে পেলাম। তারাদের চোখের জল রাতের শিশির হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। ঠাণ্ডা বাতাস এসে আমায় বলে গেলো দোষ নাকি আমারই ছিল। কেন আমি তাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে গেলাম।

হ্যাঁ রে মন দোষ তো আমারই ছিল। কিন্তু আমি কি করবো বলতে পারিস? আমি যে তাকে ছেড়ে থাকতেই পারিনা। যখন অনেকক্ষণ তাঁকে না পাই তখন নানান অভিমান ভিড় করে আসে। আমি যে মগ্ন থাকি সর্বক্ষণ তাঁর মধ্যেই। যখন গোধূলির সন্ধ্যে হাওয়া এসে আমাকে জানিয়ে দেয় আমি যে শুধুই তাঁর। যখন অন্ধকার চুপি চুপি এসে আমায় বলে যায় আমি নাকি শুধুই তাঁর। যখন ওই চাঁদ তার স্নিগ্ধ আলোতে পৃথিবীর অন্ধকার দূর করতে করতে বলে যায় আমি যে শুধুই তাঁর।

হ্যাঁ রে মন আমিও তাঁকে বলতে চাই চিৎকার করে বলতে চাই আমি যে শুধুই তোমারই। কিন্তু, না রে মন বলতে পারবো না, বোঝাতে পারবো না কোনোদিন আমি তাঁকে আমার কথা। জানিস মন আজ আবার আমি একা, এক এক করে বিসর্জন দিয়েছি আমার সব আশা, আকাঙ্ক্ষাদের ,বিসর্জন দিয়েছি আমার আমিকে গতকাল নীল বেদনার নীলচে নদীর ঘাটের কালচে গভীর জলে। আজ আমার এক মুঠিতে একটু বাতাস, আরেক মুঠি জল।

জানিস মন আমি আমার কোন মুঠিতেই তাঁকে ধরে রাখিনি। যে যাবার সে তো যাবেই চলে। আমি কোনোদিন তাঁকে বলবনা ফিরে আসতে। কষ্ট পেয়ে মরে গেলেও না। মন আর কেও আমাকে না জানুক, নাই বা চিনল তুই তো আমাকে জানিস আমার কষ্টদের সাথে সেই ছোটো থেকেই বসবাস। নীল দুঃখ গুলো যে আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না রে মন।

জলের তবু নদী আছে, আমার তো কিছু নেই, যে আমি তোর হাতে দেবো মন আমি সব তাকেই দিয়ে দিয়েছি। আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার আমিকে এমন কি আমি যে তোকেও তাঁর হাতেই সঁপে দিয়েছি রে মন। তবু কেউ জানবেনা, এখন, ঠিক এই সব মূহুর্তেরা বড় বেশি নিঃসঙ্কোচে নিঃসঙ্গ।

আজ আমার কোন অহংকার নেই, জেদ নেই, মান নেই, অভিমান নেই, রাগ নেই, হিংসে নেই, আমার আমি নেই আর মন তুইও যে নেই। তবু ও তো বলি আমার তো সব আছে, কোথাও তো কমতি পড়েনি কিছুর। একটা মন ছিল, আজ সেটাও নেই।

টুকরো হৃদয়

এক টুকরো হৃদয় কেটে দিলাম তোমায়,
তুমিই তো এখন আমার স্থির আকাশ,
অথচ জানি, এই স্থির আকাশেও
একদিন ঝড় উঠবে, অস্থির হবে।
আবার রক্তাক্ত হবে ছিন্নভিন্ন হৃদয়।

জানি আলো শেষ হবার পরেও
তোমায় দেখতে পাবো না।
বুকের ভেতর থেকে যাবে তুমি
পৃথিবীর প্রথম দিনের সূর্যের মতো।
আবার প্লাবনে ভাসবে আমার চোখ।

প্রতিদিন মঞ্জরিত আমি তোমার প্রেমে,
তৃষ্ণার এক অঞ্জলি আমি,নেফারতিতি।
অদৃশ্য তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমায়।
হিমেল হাওয়ায়, দক্ষিনের হাত ধরে
ক্ষেতের দিকে, কাজল জলের সাথে
বয়ে যাওয়াই হল আমার পথ।

মৃত্যু

একদিন হঠাৎই চলে যাব দেখো
এরকমই হাসি ছুঁড়ে দিয়ে
সব অবহেলা আলগোছে ফেলে,
একদিন বলে যাব ভালো থেকো
নিরালম্ব এক সংক্রান্তি সময়ে।
দেখো ঠিক একদিন…

বহুবার মরেছি! মৃত্যু এখন
নেশা হয়ে গেছে !
নীল রঙের পাত্র যদি তুলে দাও…
প্রশ্ন করবো না,
শোধ করে যাবো জন্মের যত পাপ,
বেঁচে থাকাটাই যে অবিশ্বাস্য ভয়।
তারপর নিশ্ছিদ্র অতীত
ধুলোয় ঢেকে নেবে,
সন্ত মহাকাল…

কবি বিনয় মজুমদার এর জন্মদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম

ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, ‘আমি সাম্প্রতিকালের এক কবির সম্পর্কে আশা রাখি, যিনি কবিতার জন্যে যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয় একালে এত বড় শক্তিশালী শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন কবি আর জন্মান নি। তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।’

বিনয় মজুমদার এবং দুঃখ একে অপরের পরিপূরক মনে হয়। বিনয় মজুমদারের দুঃখ কিংবা দুঃখের মধ্যে বিনয়। বিনয় মজুমদারের কবিতা পাঠ করতে করতে প্রশ্নও জাগে বিনয় মজুমদারের কবিতায় এত দুঃখ কেন? দুঃখগুলো কিন্তু এক নয়। অনেকগুলো বাঁক এইসব দুঃখের। সঙ্গ-অনুষঙ্গ মিলে কী ভীষণ প্রতাপ তাঁর দুঃখের। অর্ধেকেরও বেশি কবিতা মিলে বিপুল সমারোহে তার পূর্ণতা।

ভালোবাসা দিতে পারি
– বিনয় মজুমদার

“ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম ?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবাতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান —- শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূরা থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।”

অসাধারণ প্রশ্ন রেখে কবিতাটি শুরু হয়েছে-
‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ কবি বিনয় মজুমদার তাঁর ভালোবাসার ভাণ্ডার থেকে আমাদের ভালোবাসা দিয়ে যেতে চান কিন্তু আমরা কী সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে সক্ষম? গণিত ছিলো তাঁর পছন্দের বিষয় তাই গাণিতিক হিসাবের মতোই চলে এসেছে ঝরে যাওয়া হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা বা স্মৃতি।

‘পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু
ভালোবাসা দিতে পারি আমি।’

পঞ্চাশের দশকের এক কবির মুখে এরকম বাণী নিশ্চিতভাবেই ভাব-ভাষার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখনও করে।কবিতাটি ‘তোমরা’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে আসে। বেদনাকে সহজ অনুরণন ভাবতে হয় এখানেও। বেদনা-ই বিনয় মজুমদারকে আক্রান্ত করে আর ওই বেদনার জোরেই ভালোবাসা প্রাণ পায় দ্বিগুণ। ‘তুমি’ তে নেমে এসে এখানে ফের বলা হয়েছে, ‘গ্রহণে সক্ষম নও।’ ভালোবাসা যাকে তিনি দিতে চান সে যে কেন তা গ্রহণে সক্ষম নয় ইঙ্গিতটি অল্প বোঝা যায় শেষে এসে।

“প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।”

কবির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। একসময় ‘তুমি’ নামের মানুষটি চলে যাবে। ‘বিচ্ছেদ’ বা ‘বেদনা’-র পর্বের শুরু এখানে অবশ্য শেষে এসে মূল শুরুটা হয়ে যাচ্ছে। ‘আমি’ বিষয়ক ব্যক্তি কবি বিনয় মজুমদার যন্ত্রনা সাথে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।

তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, কৃত্তিবাস পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার, কবিতীর্থ পুরস্কার, অর্জন করেছেন তার কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, ফিরে এসো, চাকা, আমার ঈশ্বরীকে, অঘ্রাণের অনুভূতিমালা-র জন্য। তিনি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেন, “আমার সব কবিতাই আসলে দিনপঞ্জি।”

কবির জন্ম মায়ানমারের (তৎকালীন বার্মা ) তেডো শহরে ১৯৩৪এর ১৭ই সেপ্টেম্বর। বেশিদিন বসবাস করেননি সেখানে। কৈশোরেই চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। জন্মদিনে এই প্রিয় কবিকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

_______________
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৯।

এক রঙা মন

আজ সারাটা দিন জুড়ে মনে মনে তোমার ওড়াউড়ি। মেঘ, ঘাস, ফুল, রোদ আর জল তোমার সুর বুনে পশমিনা চাদরের ওম হয়ে ধরে রাখে আমায়। চারপাশে আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা মেখে নিলে, মন তার দরজা খোলে অতি ধীরে।

বহুদূরে ভেসে যাওয়া সুর একে একে কি যে সব বলে চলে। কান পাতি, মন পাতি, নিঃশ্বাস থেমে থেমে শুনি যেন রূপকথা। সেই সব কথা, যা নাকি আগে কেউ শোনে নি, একদম আনকোরা, তুলে রাখা সিন্দুকে। ভালো লাগা সেই কবে ভুলে গেছিলো মন। চিরন্তন প্রতীক্ষায় রঙে রঙে ঢেকে যায় চারপাশ। সে রঙের নাম মনে নেই।

এই রকম এক রঙা দিনে মন খুঁজে পায় তোমাকে। আনমনে চেয়ে থাকি তোমার ছবির দিকে। আকাশের সব তারাগুলো জানে আমি আজকাল আমার পছন্দের তারাদের তোমার নামে ডাকি। একটা একটা করে তুলে রাখি তাদের মনের মণিকোঠায়। এইসব সময়, এইসব মুহূর্ত খুব যত্নে তুলে রাখা।

মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে এভাবেই ভালো থেকো ভালোবাসা।

.
রিয়া রিয়া চক্রবর্তী।

মোমরাঙা মন

মোমরাঙা মন

এক পশলা বৃষ্টির বয়ে নিয়ে এলো তোমার সুবাস। একলা হয়ে যাওয়া দুপুরের আয়েশী হাওয়ায় ভেসে আসছিলো তোমার কথারা। এক একটা দিনের সাথে মিশে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ভালোবাসার অনুভূতি। মন জুড়ে, কোল পেতে, এক বুক আকাশ নিয়ে বসে থাকি তোমার অপেক্ষায়।

দিগন্তের চিহ্ন বরাবর মনে মনে হেঁটে আসি তোমার সাথে। এঘর ওঘর পেরিয়ে যায় হাওয়া, গ্রীষ্ম থেকে বর্ষায়, শরৎ থেকে শীতে। আমার অপেক্ষা শেষ হয় না। ভীষণ ইচ্ছে হয় তোমার চোখে চোখ রেখে দেখি সাঁঝের আকাশ। আর ঠিক তখনই ভীষণ ভালোবেসে জড়িয়ে থাকি পাখির পালকের ওম মাখা তোমার মোমরঙা মন।

আমি ও তুমি

শেষ বিকেলে আকাশের অহংকার
কমে যায় অনেকটাই,
তখন নরম এক আলো ছড়িয়ে পড়ে
পৃথিবীর কোনায় কোনায়
এমনকি ওই নরম আলোয় তুমিও
নতুন করে নতুন হয়ে দেখা দাও-
তোমার মতই পৃথিবীও ভালোবাসার যোগ্য হয়।

আমার মনে পড়ে না এর
আগে আমি কিভাবে বেঁচে ছিলাম!
তোমায় পাওয়ার মুহূর্তে আমার দ্বিতীয় জন্ম হয়,
ক্রমে সন্ধ্যার আকাশ আবার অহংকারী হয়
আমার মনে পড়ে তখন আমার কবিকে-
কোন এক বিকেলে কবি চেয়েছিলেন আমায় নিয়ে
কোন এক অজানা গাঁয়ে হারিয়ে যেতে…

শিক্ষক দিবস

আমি মানুষটা ভীষণ প্রাইভেট পার্সন। নিজের ব্যক্তিগত কথা কাছের বন্ধুরা ছাড়া খুব একটা বলি না। কিন্তু আজকে কিছু কথা ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে। আমার বহু ছাত্র ছাত্রী আমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত। কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রীর বাবা মা ও আছেন আমার সাথে ফেসবুকে। তারা সাইলেন্ট রিডার। কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলি।

আমার এক ছাত্রীর সাথে আমার লাস্ট দেখা ২০০৩ এ। তারপর তার সাথে আমার আর দেখা হয় নি। সে আমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত নয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে গত সপ্তাহে তার মা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। আমি দেখা মাত্রই নিয়ে নিই। মেসেঞ্জারে আমার নম্বর চাইলেন দিলাম। দীর্ঘ ১৬ বছর পরে কথা হলো। ভালো লাগলো দীর্ঘ ১৬ বছর আগের নিজেকে খুঁজে পেলাম।

রাস্তায় একটি দোকান থেকে কিছু দরকারী কাগজ ফটোকপি করছি, এমন সময়ে এক ভদ্রলোক এসে বললেন -“ম্যাডাম, আপনার ছাত্রী একটি পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। আমার বাড়িতে আছে গত ছ মাস। আপনি একদিন আসুন না দেখতে”। তিনি আমার এক ছাত্রীর বাবা। উত্তরে বললাম অবশ্যই যাবো।

একদিন ওষুধের দোকান থেকে কিছু ওষুধ কিনছি, হঠাৎ একটি হাতের স্পর্শ আমার পায়ে। চমকে উঠে সরে গেলাম। ছেলেটি বলে উঠলো, “আমি জানি আপনি কারো প্রণাম নেন না, তাইতো আমি চুপিচুপি প্রণামটা সেরে নিলাম। “চিনতে পারলাম, আমারই এক ছাত্র। আশীর্বাদের হাত তার মাথায় রেখে বললাম ভালো আছিস? কতো বড় হয়ে গেছিস! চাকরি করছিস বুঝি? উত্তরে সে বললো, “হ্যাঁ আন্টি একটা চাকরি পেয়েছি। বাবা মারা গেছেন, আমি আর মা থাকি”। কষ্ট পেলাম ছাত্রটির বাবা, মা দুজনেই অত্যন্ত ভালো মানুষ।

এইরকম অনেক ঘটনা আছে। এইসব ছেলে, মেয়েরা আমাকে খুঁজে বের করে, কারণ আমি নাকি তাদের প্রিয় শিক্ষিকা ছিলাম। কিন্তু আজ আমি যার কথা বলবো, সে আমার এক অত্যন্ত স্নেহের ক্ষুদে ছাত্র। কোলকাতার এক নামি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে সে। ক্লাস ফোরে পড়ে। তার মা যখন আমার সাথে যোগাযোগ করেন তখন সে মাত্র ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ বাচ্চার থেকে আলাদা। একটু স্পেশাল বাচ্চা। তাকে যখন আমি প্রথম দেখি সে তখন একেবারে তার বাবার কোল ঘেঁষে বসে আছে। অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মা যা বলার আমাকে বলছেন। ধীরে ধীরে সে আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। বাচ্চাটির বাবা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ান। মা একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। কিন্তু বাচ্চাটি তার মায়ের কাছে পড়তে চায় না, মাঝেমধ্যে বাবার কাছে অবশ্য পড়ে। আমি যখন পড়াই তার বাবা, মা পাশের ঘর থেকে শোনেন। যেহেতু ওকে পড়াতে হয় স্পেশাল ভাবে। আমিই বলেছি আমার পড়ানো শুনতে এবং ওইভাবে পড়াতে। আমরা শুধু পড়াশোনা করি না, আমরা গান করি, গল্প করি, আমরা মাঝেমধ্যে খেলনা দেখি। মাঝেমধ্যে আবার ওর খাতায় দু লাইনে কবিতাও লিখে দিতে হয়। আমাকে সে মাঝে মাঝে বলে “জানো আন্টি, আমার সৌভাগ্য যে আমি তোমার মতো আন্টি পেয়েছি।” নতজানু হই এইরকম অকৃত্রিম ভালোবাসার কাছে। ছাত্রটি একটি বিখ্যাত পণ্ডিতজির কাছে তবলা শেখে এবং অত্যন্ত ভালো তবলা বাজায়। প্রতিটি তবলার ভিডিও আমাকে ওর বাবা, মায়ের নম্বর থেকে হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠায়। দেরী করে উত্তর দিলে সামান্য অভিমান হয়। ছাত্রটির মা অত্যন্ত ভালো গান করেন ছাত্রটি মায়ের সাথে তবলায় সঙ্গদ দেয়।

এতোকিছু বলার কারণ, আজ শিক্ষক দিবসে আমার সেই অতি প্রিয় ছাত্রটি আমাকে একটি অভিনব উপহার দিয়েছে। যা আমি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সে নিজে বাংলায় কবিতা লিখেছে এবং তাতে সুর দিয়েছে। সেই কবিতাটি দিলাম এখানে। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। বাচ্চাটির নাম উহ্য থাক।

সাতকাহন

এখন আমার চূড়ান্ত খরা,
রক্তাল্পতায় ফুটে ওঠে
জ্যামিতিক নকশা।
সামনেই মরূদ্যান
নরম ঘাসের জমি
কিছুদূর এগোলেই
আমার পায়ের পাতায়
চুমুতে ভরিয়ে দিতো
নরম ঘাসেরা।

দিনের আলোর গভীরে
লুকিয়ে রাতের ইতিহাস
নাটোরের ঘন অন্ধকারে
তোমার মুখোমুখি অন্যজন
আমার জায়গা তবে কোথায়?
দিনের শেষে, গোধূলির সময়ে?

দিকচিহ্নহীন নকশা হাতে এখনও
আল বাঁধে আরুণি সংকেতে।
আমার সীমানা চিহ্ন,
আল ছোঁয়া ফসলের ক্ষেতে।

ভাঙনের গান কখনও
উৎসবের থীম সং হতে পারে।
বছর শেষের চড়কের
শিহরণ যেমন।

একটা কবিতার জন্য প্রয়োজন
বরফের এক তীক্ষ্ণ ফলার
দীর্ঘ রাতের পরে, আমূলভাবে,
বিঁধে যাওয়া বুকের গভীরে।
স্ব -নির্বাচিত মৃত্যু যন্ত্রণা ছাড়া
কবিতা লেখা কি সম্ভব?

আমি বারংবার তোমার কাছে নতজানু
কারণ আমার অহংকার,
তোমার প্রেমের থেকে বেশী নয়।।

রাত্রির গভীরতায় হোক একান্ত পরিমাপ
বল, কে বেশী গভীর, আমি না রাত্রি?

ভূত কাব্য

বাঁশ গাছেতে ভূত বসেছে
ঝুলিয়ে দু’খান পা,
শ্যাওড়া গাছে পেত্নী নাচে
তাইরে নাইরে না
নিমগাছে ওই ঝিমধরা ভূত
করছে বিকট হাঁ,
তাই না দেখে কান্না ধরে
মামদো ভূতের ছা।
ব্রহ্মদত্যি নাকি সুরে
গান ধরেছে রাতদুপুরে,
সে গান শুনে পা ভেঙেছে
শাঁকচুন্নি মা।

ফিরে চাওয়া

আর কোনও দিন আসবে না
তোমার কাছে এই প্রণয়প্রার্থী হাত।
জানু পেতে থাকবো না কোনও
ছায়াদীঘল চোখে, তোমার অপেক্ষায়।

রাতের নিঃসঙ্গ লাইটপোস্টের কাছে
আর তোমার কথা বলবো না। যেসব,
গোপন অনুভবের ইতিবৃত্ত আঁকা হয়েছিল
কথামালায়, ছায়াহত আজ সব।

তোমার বিরহ শোকে মুহ্যমান তারা।
বিসর্জনের সময়ে, অকালবোধনে,
যে-আত্মহত্যার চিরকুট লেখা হয়েছিল
বিফল মৃত্যুর আগে- বালিশের তলায় রেখে
প্রতিদিন দিব্যি বেঁচে থাকি।

পরকীয়া

পরকীয়া

চলে নির্ঘুম রাত জাগা আমার
রাতের সঙ্গে যত রাগ, অনুরাগ।
রাতই আমার সকল দুঃখ জানে
মনের কোণের কালশিটে দাগ।

রাত জানে মুখ, মুখোশের খেলা
রাতই আমার লয়, অবক্ষয়
রাতের আঁধারে লুকিয়ে আজও,
আমার অপমান, নীরব পরাজয়।

রাত আমার একলা প্রেমে জাগা।
রাত জানে বেদনা, বিষাদ, আর
রাতের সাথেই আমার পরকীয়া
রাতেই ছোটে শব্দেরা দুর্বার।