বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

দেবতার মন্দির

2454187_n

দেবতার মন্দির দেবতায় ভেঙেছে
আমার তোমার যায় আসে কী,
যার আদেশ ছাড়া নড়ে না পাতা
মন্দির ভাঙ্গার সাহস কারোর হবে কি?

তোমরা দুঃখ কেন করো লাঠি কেন ধরো
প্রতিবাদ হানাহানি-ই-বা কেন করো,
হয় যদি দেবতার মন্দির ধৈর্য ধরো
নিশ্চয়ই হবে সাজা একটু সবুর করো!

যার মন্দির তিনিই ভাঙায় তিনিই গড়ায়
তোমার আমার এতো ভাবনা কী,
পাপ করবে যে ভুগেও সে
অন্যের পাপে কেউ ভুগছে কি?

গোলবাড়ির কষা মাংস !!

22401735

উপকরন :~
১. ১ কেজি খাসি/পাঠা-র মাংস
২. ২ টো বড় পেয়াজ সরু করে কুচানো
৩. ২ বড় চামচ রসুন বাটা
৪. ২ বড় চামচ আদা বাটা
৫. ১ বড় চামচ কাঁচা লঙ্কা বাটা
৬. ৩ বড় চামচ জিরে গুড়ো
৭. ২ বড় চামচ লঙ্কা গুড়ো
৮. ৩ বড় চামচ দই ভাল করে ফেটানো
৯. নুন স্বাদমত

১০. ২/৩ এলাচ
১১. দারচিনী ১ টুকরো
১২. ৩/৪ লবঙ্গ
১৩. ২/৩ শুকনো লঙ্কা
১৪. ২ টো তেজপাতা
১৫. ১ কাপ সরষের তেল
১৬. ১ কাপ পাকা পেপে বাটা
১৭. ১ ছোট চামচ পাঁচফোড়ন

প্রণালী :~
মাটন টা পাকা পেপে বাটা দিয়ে ৪-৬ ঘণ্টা ম্যারিনেট করতে হবে।

একটা বড় কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে গরম হলে তাতে শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, পাঁচফোড়ন, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি দিতে হবে। সুন্দর গন্ধ বেরলে পেঁয়াজ কুচানো টা দিতে হবে। পেয়াজ টা সোনালী রঙ ধরলে তাতে মাংস টা দিয়ে দিতে হবে। সাথে নুন দিতে হবে। ১০-১৫ মিনিট রান্না করার পর মাংস টা রঙ পরিবর্তন হয়ে কালচে হতে শুরু করবে। মাংস টাকে কিন্তু সমানে নেড়ে যেতে হবে যেন তলায় বসে না যায়।

তারপর ১ কাপ গরম জল দিতে হবে। আর পাত্র টা ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। তারপর গ্যাস একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। এভাবে ২ ঘণ্টা রান্না করতে হবে। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে নেড়ে দিতে হবে। একটা পাত্রতে আদাবাটা, রসুনবাটা, লঙ্কাবাটা, জিরে গুড়ো একসাথে মেশাতে হবে। অন্য একটা পাত্রে ২ চামচ সরষের তেল গরম করে তাতে ওই মিক্সচার টা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। তারপর সেটা মাংসের ওপর ঢেলে দিয়ে ভাল করে নেড়ে দিতে হবে।

তারপর তাতে লংকা গুড়ো টা আর দই টা মেশাতে হবে।
আর আধঘণ্টা রান্না করতে হবে।
তারপর মাংস থেকে তেল ছাড়তে শুরু করবে।
তারপর মাংসের ওপর গরম মসলা ছড়িয়ে দিয়ে গ্যাস অফ করে দিতে হবে।
এটা রুমালি রুটি অথবা পরটার সাথে খুব ভাল লাগবে।

আজ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিন

225726

আজ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিন। বন্ধুত্ব তো তা-ই, যাকে নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না। প্রকাশ করা যায় না সংজ্ঞা দিয়ে। মানুষ যুগে যুগেই বন্ধুত্বকে উদযাপন করেছে। কিন্তু বন্ধু দিবস কীভাবে এল?

আসলে বহু বছর আগে ১৯৫৮ সালে প্যারাগুয়েতে প্রথম এই দিনটি সেলিব্রেট করা হয়। ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকো ২০শে জুলাই তাঁর বন্ধু পুয়ার্ত পিনাস্ক এর সঙ্গে প্রথম ডিনার করে এই দিনটি পালন করেন। তারপর ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকোই ১৯৫৮ সালে প্রথম ৩০শে জুলাই প্রস্তাব রাখেন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডে। সেদিন থেকেই ৩০শে জুলাইকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

যদিও অনেক দেশে এই দিনটি তারিখে পালন করা হয়। যেমন- ভারতে এই দিনটি পালন করা হয় অগাস্ট মাসের প্রথম রবিবার। ব্রাজিল, উরুগুয়ে তে ২০ জুলাই, এরপর ২০১১ সালে ২৭ এপ্রিল জেনারেল অ্যাসেম্বলি অফ দ্য ইউনাইটেড নেশন ৩০শে জুলাই তারিখটিকে অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষিত করে।

যদিও আজকাল বন্ধু শব্দটি ভীষণ ভাবায়। সত্যিই কী বন্ধু কেউ হয় সেইভাবে? ছোটবেলায় বন্ধু শব্দের অর্থ না বুঝেই কতো বন্ধু ছিলো, যাদের সাথে ছুটোছুটি করে বড় হয়ে ওঠা। তারপর একদিন বড় হয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কর্মস্থলে কতো বন্ধু, কিন্তু সত্যিই কী তারা প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে? ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আর ব্যতিক্রম আছে বলেই বন্ধু শব্দ এখনও অভিধানে আছে।

বন্ধু নিয়ে কিছু বিখ্যাতদের বাণী –
“উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু” চাণক্য বলেছেন।

সিসেরো বলেছেন – “কখনো কোন বন্ধুকে আঘাত করো না, এমনকি ঠাট্টা করেও না।”

এরিস্টটল বলেছেন-
“প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়,ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।”
“বন্ধু কি? এক আত্মার দুইটি শরীর।”

চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন –
“আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হল আয়না, কারন আমি যখন কাঁদি তখন সে হাসে না।”

এইরকম বহু বাণীই তুলে ধরা যায়। কিন্তু বাস্তবে এইরকম বন্ধু পাওয়া কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো।
অথচ বন্ধু মানে বুঝি, যে সবরকম পরিস্থিতিতে হাত ধরে থাকবে। আপনার শক্তি হবে। বন্ধু হলো সেই যে আপনার চোখের জল সহ্য করতে পারবে না। বন্ধু হলো সে যে আপনার ভালোবাসা, বিশ্বাস নিয়ে খেলা করবে না। বন্ধু হলো সে যে আপনাকে প্রাধান্য দেবে, ঝগড়া হবে, মান – অভিমান হবে, অথচ একে অপরকে সম্মান করবে, ভুলেও অপমান করবে না। দোষ করলে ইগো সরিয়ে একে অপরকে ‘সরি’ বলবে। প্রকৃত বন্ধু ঠিক খড় কুটোর মতো আপনার হাতের সাথে আটকে থাকবে।

বন্ধু দিবসে সবার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।

দার্শনিক (তিন)

Photo_1626t

সকাল ৮টা।
ছয় ঋতুতে দেখন-অভ্যস্ত ছয় রূপ তার। দিনে যেতে আসতে দু-বার দেখা। আমাকে দেখেই হেসে ওঠে। গাঁও বুড়োর মতো হিরণ্ময় বলিরেখা জাগিয়ে প্রতিদিন এক কথা, “খবর বলো, খবর বলো –!”

দূর! তোমায় কী খবর দেব? তুমি তো আসমানসম নীরব। তবু দিগন্ত ছাড়িয়ে পাখিডানা চোখে দুনিয়া দেখে নাও। সব খবর তোমার কাছে। তুমিই দেবে।
“সময় খারাপ”।

মানে ধরি না কথাটার। সবাই বলে সময় খারাপ। বাবা বলেছে। ঠাকুর্দা বলেছে। সময়ের চির সাবু-বার্লি, সে মাছের ঝোলভাতে কোনোদিন সেরে ওঠেনি। তাই এটাই বৈশ্বিক স্বাভাবিক।

“একদল চলে যায় তীর্থযাত্রীর মতো আলপথ ধরে। একদল আসে। তাদের দেখি, তবু ঠিক চিনি নাকো। তারা যেন বিশেষত্বহীন মানুষপিণ্ড। শুধু ভেতরে কেউ কাঁকনঝুপুস পা, গেরুয়া প্রান্ত দেবদারু, গোপন ছোরার শ্বাসনালী। চোখে শিশির ঝরা লবনাম্বু, কিংবা আপাদমস্তক গড়িয়ে যাওয়া দাউদাউ টায়ার।

কেউ দেখে না সর্বংসহা তৃণ সবুজে ভেঙে পড়ছে। কাপড় জড়ানো ফুটবল পায়ে উড়ে বেড়ায় ফড়িং। আকাশ উথলে হাসিখুশি জলরঙ। সবাই হেঁটে যায় অপরিচিতের মতো”। তার এসব কথা শুনতে শুনতে আমি পার হয়ে যাই। বিদায় জানাই। ও পাশ ফিরে শোয়।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

বিষাদ ও রূপকথা

79131

বিষণ্ণ নদীর ধারে চুপচাপ পাহারায় বসে
রাতচরা পাখি, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে
মেঘেদের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।
রেখে যায়, এক টুকরো বিশ্বাস, তখন‌ও
আঁজলা ভরে জল তুলে নেওয়া বাকি।

একটুকরো মেঘ কার্নিশে এসে
দাঁড়ায়, রজনীগন্ধা হতে চেয়ে। অজস্র
ক্রিস্টালের মতো বৃষ্টি নামে, বুক জুড়ে,
উঠোন জুড়ে। গ্রীষ্মের ঝিমলাগা দুপুরে
ঝলসে যেতে যেতে মন ভাবে …

“আমার মতো সুখী কে আছে, আয় সখী
আয় আমার কাছে”।

এক বিকেলের ভালো লাগা, সারাজীবনের স্মৃতি, পর্ব (২)

nitai-b

সেদিন বিয়ে সম্পাদন হতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। অমি আর কানাই সহ এলাকার আরো তিন চারজন বন্ধু বাড়ির বাহিরে পুকুরপাড়ে ছালার চট বিছাইয়ে বসে বসে গল্পগুজব করতে করতেই রাত শেষ করলাম ৷ মাঝে মাঝে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে কিরে, তোর কি একটুও খারাপ লাগছেনা? ওদের প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যুত্তর দেই লাগলেই কী কিছু করা যাবে? এমন আরো কয়েকজনই সেদিন রাতে সামনে এসে এসে জিজ্ঞেস করলো, একই ধরণের কথা। সবাইকে একই উত্তর দিয়ে বিদায় দিলাম। আমার মা’ও সেদিন একটু ভয় পেয়েছিল আমার জন্য। খানিক পর পরই মা’ আমাদের কাছে এসে কানাইকে ডেকে শুধু আমার মনের গতিবিধি জানতো। কানাই মা’কে বুঝিয়ে শান্তনা দিত কিছুই হবে না মাসিমা। তুমি কোন চিন্তা করো না ঘরে যাও। কানাই এসে আবার আমার কাছে বলতো। মাসিমা এসে তোর খবর নিল, আমি বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আর বলে দিলাম কোন চিন্তা যাতে না করে। চিন্তা তো করার কথাই, শত হলেও গর্ভধারিণী মা।

আমাদের হিন্দুধর্মের বিবাহ কয়েকটা পর্বে হয়ে থাকে। যার সবগুলো নিয়ম বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের বিবাহে ওইসব নিয়ম মানতে দেখা যায় না। বিবাহের পর্বগুলি (১) পাটিপত্র, (২) পানখিল, (৩) দধিমঙ্গল, (৪) গায়েহলুদ বা অধিবাস, (৫) শঙ্খ কঙ্কন বা সোনা’কাপড়, (৬) বর বরণ, (৭) শুভ দৃষ্টি, (৮) সাত পাক, (৯) মালা বদল, (১০) সম্প্রদান, (১১) অঞ্জলি, (১২) সিঁদুর দান, (১৩) বিবাহ অনুষ্ঠান, (১৪) বাসিবিবাহ। এইসব পর্বের ভিতরেও টুকিটাকি অনেক পর্ব আছে। যা একেক গোত্রের একেক নিয়মের পর্ব। মূলতঃ পর্ব দুইটা, প্রথম পর্ব হলো “বিবাহ অনুষীঠান” দ্বিতীয় পর্ব হলো “বাসিবিবাহ”। প্রথম পর্বে পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা মেয়ের পক্ষ থেকে কন্যাদান। ছেলের পক্ষ থেকে কন্যাকে গ্রহন করা। তারপর শুরু হয় ছেলে ও মেয়ের গুন জ্ঞানের পরীক্ষার খেলা। পাশাখেলা, আংটিখেলা, চাউল ছিটানীখেলা, মনিমনা খেলা। পরিশেষে সমাপ্তি ঘটে বাসিবিবাহের মধ্য দিয়ে।

ওইসব খেলায় উভয়ই জিততে হবে বা জিতার চেষ্টা করে। কেউ কারো কাছে হার মানতে নারাজ। ওইসব খেলার মধ্যে আংটিখেলা হলো অন্যতম। যে চারটে কলাগাছকে সাক্ষী করে ছেলে মেয়েকে সাতপাক ঘুরানো হয় বিয়েতে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, ওই কলাগাছের নিচে ছোট একটা চার কোনা পুকুর বানিয়ে সেই পুকুরে জল ঢেলে দেয়। তারপর ছেলের হাতের আঙ্গুলের শ্রীআংটিখানা সেই পুকুরপাড়ে লুকানো হয়। যা ছেলে লুকোয় তিনবার, আর মেয়ে লুকোয় তিনবার। একজন লুকাবে, অন্যজন বাহির করবে। তখন দেখা যাবে কে কতবার লুকানো আংটিখানা বাহির করতে পারলো। খেলায় যে এগিয়ে থাকবে সেই হবে বুদ্ধিমান। চাউল ছিটানো খেলা ৷ এই খেলাটি ও উভয় পক্ষের শান্তস্বভাব কেমন হবে সেই পরীক্ষা ৷ আংটি খেলার পর, ছেলে মেয়েকে নিয়ে যাবে একটা ঘরে ৷ সেই ঘরের মেঝেতে পাটি বিছাইয়ে সেই পাটি’র উপর বসবে ছেলে-মেয়ে আড়াআড়ি ভাবে। সেখানে থাকে একটা মাটির ঘটে কিছু চাউল ৷ ওই ঘটের চাউল ছেলে পাটি’র উপরে ছিটিয়ে দিবে। আর মেয়ে সমস্ত চাউলগুলি খুঁজে-খুঁজে ঘটে রেখে’ ঘটের ঢাকনাটা এমন ভাবে বসাতে হবে, যাতে করে কোন শব্দ না হয়। যদি শব্দ হয়, তবে গুরুব্যক্তিরা বুঝবে যে, মেয়ের হাঁটা-চলায় শব্দ হবে। এবং উৎপাত করবে বেশি। ছেলের বেলায়ও তাই। মেয়ে চাউলগুলি ঢেলে ছিটিয়ে দিবে, আর ছেলে চাউলগুলি উঠাবে, শব্দ যেন না হয়। মনিমনা খেলা” একটা বড় আকারের বলবাটিতে কিছু জল দিয়ে সেখানে ছেলের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়ে, মেয়ের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়বে। বস্তুগুলি ওই বলবাটির জলে ছেড়ে দিয়ে হাতে ওই জল ঘুরাইতে থাকবে। সেই সাথে ঘুরতে থাকবে ওই মুকুটের বস্তু দুইটি। বস্তু দুইটি ঘুরতে ঘুরতে যদি একসাথে জোড় লাগে, তবে লোকে বুঝবে স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে থাকবে চিরদিন। আরেকটি খেলা হচ্ছে পাশাখেলা” এখন এই খেলাটি নাই বললেও চলে। কেননা এই খেলাটি খুবই কঠিন খেলা ও হিসেবের খেলা। যা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকে না। আসলে এটিই হচ্ছে বর-কনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা। এই খেলাটাকে বলা হয় “চতুরাজি” খেলা। এই খেলায় চারটে গুটি থাকে। অনেকটা দাবাখেলার মত। গুটিগুলির নাম: (১) বোড়ে বা রাজা, (২) নৌকা, (৩) ঘোড়া, (৪) গজ, প্রত্যেক দানে দুইটি পাশার গুটির জন্য দুইটি চাল দিতে হয়। বর্তমানে কোন কোন বিয়েতে পাশার পরিবর্তে কড়িখেলা খেলতে দেখা যায়। যে জিতবে সেই হবে বুদ্ধিমান। ওইসব খেলা থেকেই গুরুব্যক্তিরা বুঝে নিবে তাদের সংসার কেমন সুখের হবে। আর কে বেশি বুদ্ধিমান হবে, ছেলে না মেয়ে।

তারপরে হবে বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পালা। সাথে থাকবে ছেলের বন্ধুবান্ধব ও জামাইবাবুরা। মেয়ের সাথে থাকবে, মেয়ের বান্ধবীরা বর বউদিরা ও বউদির বোনেরা। যাদের সাথে ঠাট্টাতামাশা করা যায়। আমাদের হিন্দুধর্মে বিয়ের দিন ছেলে এবং মেয়েকে উপবাস থাকতে হয়। বিয়ের প্রথম পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত। খাওয়াদাওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বড় একটা কাঁসের থালা করে সবপদের তরকারি থালার চারদিকে সাজিয়ে দিয়ে, মাঝখানে দিলো ভাত। এটা হিন্দুধর্মীয় নিয়ম মত যেভাবে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই দেওয়া হলো তাঁদের। সাথে আছে ছেলের ভগ্নিপতি ও সাথে আসা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। মেয়ের সাথে আছে মেয়েটার ছোট ভাই, ও শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ির ভাড়াটিয়া কয়েকজন অল্পবয়সী মেয়ে। আর শ্যামসুন্দর দাদা স্ত্রী। ছেলেকে বসানো হলো এক পিঁড়িতে। তার বিপরীত দিকে এক পিঁড়িতে বাসানো হলো মেয়েকে। ছেলের বন্ধুবান্ধব ও ছেলের জামাইবাবু ভাত খাওয়ার জন্য খাবারে হাত দিলেও, মেয়েটা কিন্তু খাবারে হাত দিচ্ছে না। সবাই বলছে, খাও খাও কিছুতেই খাবারে হাত দিচ্ছেনা মেয়েটা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী রেগে বলল খাওনা কেন? খাও তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর সকাল হয়ে যাবে। শুরু হবে আবার বাসি বিয়ের কাজ। মেয়েটা বলল “মামি”, নিতাই দাদা কোথায়? ৷ নিতাই দাদা ছাড়া আমি খাবো না, মেয়েটার সোজা কথা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী তো হতবাক! বলে কী? রেগে বলল। ওর কি পাত্তা আছে? তুমি খাও তাড়াতাড়ি করে। মেয়েটির এক কথা “মামি” নিতাই দা বাহিরে আছে। তাকে আসতে বললেই আসবে। নিতাই দা রাতে খায় নাই। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো। নিতাই রাতে খায়নি তুমি জানলে কী করে? মেয়েটি প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না, শুধু চুপ করে রইল। মেয়েটার অনুরোধে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী বাহিরে এসে, সোজা চলে আসলেন পুকুরপাড়। যেখানে আমরা থাকার কথা সেখানে। আমি আর কানাই সহ তিন চারজন বন্ধুবান্ধব মিলে কথা বলছিলাম তখন। এরমধ্যেই শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী এসে আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি বললাম বউদি, কী হয়েছে বলেন শুনি! বউদি কানাই’কেও বলছে। কানাই তুইও আয় ওর সাথে। বউদির সাথে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি, খাবারের থালা মাঝখানে রেখে সবাই চুপচাপ বসে আছে। আমার বুঝতে আর বাকী রইল না, ঘটনা কী হয়েছে। বউদি বলল কানাইকে নিয়ে মেয়েটার সাথে বস ভাত খেতে। তোদের ছাড়া ও খাবে না, তাই তোদের এখানে টেনে আনলাম, বস-বস তাড়াতাড়ি। কানাই বসলো, আমিও বসলাম কানাই’র সাথে। দেখলাম মেয়েটা কানাইকে কানে-কানে কী যেন বলল। কানাই আমাকে বলল, তুই ওকে প্রথম খাইয়ে দিবি, তারপর ও খাবে। ছেলে পক্ষের সবাই শুধু আমাদের দিকেই তাকাচ্ছিল। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেনা। কানাই’র কথা শুনে আমার বিষণ লজ্জা হচ্ছিল। আবার খারাপও লাগছিল। ছেলের পক্ষের কেউ যদি আবার মেয়ে’টাকে সন্দেহের চোখে দেখে! তাই খারাপ লাগছিল। এরপর সবাই বলল, দাদা শুরু করুন সকাল হয়ে গেল। আর কী করা, ভাত মেখে মেয়েটার মুখের সামনে নিতেই, কেঁদে দিল হাউমাউ করে। ওর কাঁদা দেখে আমি কি ঠিক থাকতে পারি? আমিও কাঁদছি। আমার কাঁদা দেখে কানাইও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, নাও সারাদিন তো কিছুই খাওনি এখন খাও, আমি খাওয়াইয়ে দিচ্ছি। সবাই বলল খাও-খাও, মেয়েটা আমার হাত ওর দুহাত দিয়ে ধরে, আমার হাতের খাবারগুলি ওর মুখে নিয়ে খাচ্ছে। আবার মেয়েটা ভাত মেখে আমার মুখের সামনে এনে আমাকে খাওয়াইয়ে দিতে চাচ্ছে। এমন সময় আমি ওর দুহাত ধরে বললাম। আগে তোমার স্বামীর মুখে দাও, তারপর আমাকে খাওয়াবে। মেয়েটি আমার কথা মত ওর স্বামীকে খাওয়াইয়ে দিয়ে, পরে আমাকে খাইয়ে দিল। আমিও ওর স্বামীকে ভাত মেখে খাওয়াইয়ে দিলাম। কানাই তখন খুশিতে হাততালি দিতে লাগল। কানাইর দেখাদেখি উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার বলছে, একথা আগে বললেই হতো। এভাবেই সেদিন বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পর্বটা শেষ করলাম। ওকেও খাওয়ালাম নিজেও খেলাম।

তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব হলো বাসিবিয়ে। অর্থাৎ পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা ছেলে ও মেয়েকে সূচিত করা বা শুদ্ধ করা। এটা ঠিক সূর্য উদয়ের সাথে সাথে হয়ে থাকে। বাসিবিয়ের বাজনা যখন বাজছিল, তখন বুঝতে পারলাম এই বাজনা বিবাহের শেষ পর্বের। ভাবছিলাম মনে মনে। এমন সময় কানাই আমাকে বলল, চল বিয়ে প্রায় শেষ। বাসিবিয়েটা দেখে আসি। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না, কানাই একপর্যায়ে জোর করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। সাথে আছে চার পাঁচজন বন্ধুবান্ধব। সবাই একসাথেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। পুরোহিত মহাশয় মন্ত্রপাঠ করছে। আরেক দিকে বাজনাও বাজাচ্ছে জোরে-সোরে। কানাই ও সাথের বন্ধরা বাজনার তালে-তালে নাচতে লাগলো। ওরা নাচছে আর আমাকেও ওদের সাথে নাচার জন্য টানছে। ওদের টানের সাথে সাথে আমার পিছন থেকেও আমাকে ধাক্কাচ্ছে, ওদের সাথে নাচার জন্য। উপায়ান্তর না দেখে আর কী করা ! নাচতে লাগলাম সবাই মিলে। একপর্যায়ে বাসি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্তি ঘোষণা করল পুরোহিত মহাশয়। কিন্তু আমাদের নাচ তো থামছে না। বাড়ির সবাই তখন আমাদের সাথে নাচতে লাগলো। সাথে মহল্লার লোকও যোগ দিলো। বাজনাবাদকেরা বাজনা আর বাজাবেনা বলে বাজনা বন্ধ করে দিল। নাচ থেমে গেল সকলের। তখন সবাই ক্ষেপলো বাজনাবাদকদের উপর। বাজনা আরো বাজাতে হবে‌, বিনিময়ে তাদের আরো বেশি টাকা দেওয়া হবে। এই আশ্বাসের পর আবার শুরু হলো বাজনা। সকলে শুরু করলো নাচ, অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাচ চলছিলো বাসি বিয়ের সময়। বাসি বিয়ে বলতে, ছেলে মেয়েকে স্নান করানো একটা পর্ব। স্নান করাইয়া পবিত্র করা বা শুদ্ধ করা। দুজনকে দুই পিঁড়িতে দাঁড় করে, পুকুর থেকে কলশী দিয়ে জল আনবে। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করবে, আর কলশীর জল দুজনের মাথায় ঢালবে। এভাবে স্নান করানোর সময় আমরা নাচছিলাম। আর মেয়েটা সেই নাচের দৃশ্যগুলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

বাসিবিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শেষে আমি কানাইকে বলছি। আজতো কাজ করতে পারবো না কানাই। সারারাত ঘুমাইনি, কাজ করবো কী ভাবে। কানাই বলল, তাহলে মিলের কাজ করবে কে? ম্যানেজার রাগ করবে। আমি বললাম তুই মিলে গিয়ে ম্যানেজারকে বলবি ওস্তাদ অসুস্থ, লাঞ্চের পরে আসবে। কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো আট ঘটিকার সময়। তুই এখন বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও একটু ঘুমাবো। সারারাত’তো আর ঘুমানো হয়নি।

এসব বলতে বলতে শ্যামসুন্দর দাদা, ও বউদি পুকুরপাড় এসে, আমাকে আর কানাইকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা খাওয়াদাওয়া করছি কি না। কানাই বুদ্ধি করে বলল, হাঁ দাদা, আমরা খাওয়াদাওয়া করেছি। আপনারা দুজনে খাওয়াদাওয়া করেছেন তো? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, হ্যাঁ করেছি কোনরকম। আর শোন, কিছুক্ষণ পরে তো ওকে জামাইদের ওখানে নিয়ে যাবে। নিতাই সহ তোরা উপস্থিত থাকিস কেমন ! কানাই বললো, দাদা আপাতত ওকে নিয়ে জামাই কোথায় উঠবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আপাতত শহরের মাসদাইরে উঠবে ওরা। ওখানে জামাইর কাকা থাকে। ওদের বাপদাদার ভিটেবাড়ি কুমিল্লা। ছেলেটা একটু সোজা রকম’তো তাই, আমার দোকানেই রেখে দিব। আর মেয়েটা’তো আমার এখানে থাকবেই। ওদের আলাদা একটা ঘর বানিয়ে দেওয়ার, চিন্তাভাবনা করছি। আটনাইয়রীর পর আর যেতে হবেনা ওদের। আমার বাড়িতেই থাকবে ওরা। শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আর আমি শুধু শুনছিলাম। আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি, আমিও কিছু বলিনি। শ্যামসুন্দর দাদা চলে গেলেন, বাড়ির ভিতরে। দাদার সাথে সাথে বউদিও চলে গেলেন। একটু পরে মেয়েটি পুকুরপাড় এসে আমাদের দেখে সামনে এসে বললো। সারারাত হয়তো ঘুমানো হয়নি আপনাদের। তারপরেও এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দুজনে? ঘুমাননি তো বেশ করেছেন। কিছুক্ষণ পরে আমাকে হয়তো নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। যাওয়ার সময় যেন ডাকতে নাহয়। যা চেয়েছিলাম তাতো আর পাওয়া হলো না। না পেলাম দুঃখ নেই, কোনদিন সামনে থেকে তাড়িয়ে দিবেন না, কথা দিন ! আমি আর ওর সাথে কথা বলতে পারছিনা। ওর কথা শুনে আমার কান্না আসতে লাগল। মেয়েটি আমার দুহাত ধরে কথাগুলি বলছিল। হাত আর ছাড়ছে না, ধরেই রাখছে। আমার অবস্থা টের পেয়ে কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এখন বাড়ি যাও। মেয়েটি বলল, দাদা কিছু বলছেনা কেন? তখন আমি মেয়েটাকে বললাম। তুমি বলছো তোমাকে কথা দিতে হবে, কোনদিন সামনে থেকে যেন তাড়িয়ে না দেই। এটা কী করে সম্ভব? আমি এবাড়ির ভাড়াটিয়া। আজ আছি, কাল এখানে না ও থাকতে পারি। তুমিও এখানে চিরদিন থাকতে তো পারবেনা। একদিন না একদিন, তোমাকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। তাহলে তোমাকে আমি কী করে কথা দেই বলো? তবে তোমায় আমি কথা দিলাম। আমি এই পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবো, ততদিন তুমি আমার এই অন্তরেই থাকবে সারাজীবন, যাও কথা দিলাম। আমার কথা শুনে মেয়েটি তখন কান্নাকাটি শুরু করে দিল, হাউমাউ করে। ওর কান্না আর থামছে না। আমি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম। এখন তুমি কান্নাকাটি করলে, লোকে আমাকে কী ভাববে বলো? তখন মেয়েটি আমার দুহাত ছেড়ে দিয়ে বললো। চিরদিন আপনিও আমার অন্তরে থাকবেন। আজ বিদায় বেলা যেন সামনে পাই। এই কথা বলে মেয়েটি চলে গেল বাড়ির ভিতরে।

আমরা দুজনে রওনা হলাম, কোন এক চা’ দোকানের উদ্দেশে। কানাই শুধু বলল, নিতাই অবস্থা বেগতিক। কানাই’র কথায় কোন উত্তর দিলাম না। সোজা হাঁটতে লাগলাম, দোকানের উদ্দেশে। সকাল দশটায় আটজন বরযাত্রী সহ, জড়ো হলো পুকুরপাড়, রিকশার জন্য। পাঁচটা রিকশার দরকার ওদের। দুইটা পেয়েছ, আরো লাগবে তিনটে। যেকোন মেয়েদের বিয়ে দিলে, স্বামীর বাড়ি যাওয়ার সময়, সব মেয়েরাই কান্নাকাটি করে। যাওয়ার আগে মেয়েটিও কাঁদছে। বাড়ির সবাই কাঁদছে পুকুরপাড় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এমন সময় কানাই আর আমি, দোকান থেকে আসছি। দূর থেকে দেখি পুকুরপাড়ে অনেক লোকের সমাগম। কানাই বলল, মেয়েটা মনে হয় জামাইবাড়ি যাচ্ছে, চল শিগ্‌গির। কানাইকে বললাম, তুই যা আমি বরং মিলের দিকে যাই। কানাই বলল, কেন? তোকে না মেয়েটি বলছে, যাওয়ার সময় সামনে থাকতে? তোকে না দেখলে তো আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। আমি বললাম, শোন কানাই। বিদায় বেলা যদি সামনে থাকি, ও আরো কান্নাকাটি বেশি করবে। তখন ওর জামাইবাড়ির লোকজন, ওকে সন্দেহের চোখে দেখবে সবসময়। তুই বরং ,সামনে থেকে ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস। যে, নিতাই’র মিলে খুব কাজ ছিল বিধায়, ও তাড়াতাড়ি মিলে গেছে। কাজটা সেরে আসতে সময় লাগতে পারে। তুই যেভাবে পারিস ওকে ম্যানেজ করবি। কানাই’তো আমার কথায় একটুও এদিক সেদিক করবে না করেও না। কানাই সোজাসুজি চলে গেল পুকুরপাড়ে। যেখানে জামাই সহ, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। রিকশা পাঁচখানা রেডি, সবাই রিকশায় উঠে বসে আছে। মেয়েটা শুধু ওর মা’ আর ছোট ভাইটাকে ধরে কাঁদছে। কানাইকে দেখেই মেয়েটা বলল, কানাই’দা নিতাই দাদা কোথায়? কানাই ওকে উদ্দেশ্য করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝালো চুপ। মেয়েটি চুপকরে কানাই’র দিকে তাকিয়ে বলল কী? কানাই তখন মেয়েটাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে বলল, আমার শিখানো কথাগুলি। কানাই’র কথা শুনে মেয়েটা আরো জোরেসোরে কাঁদতে লাগল। কানাই আর শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মিলে, ওর হাত ধরে, জামাই’র সাথে রিকশায় বসিয়ে দিয়ে, সব রিকশাওয়ালাদের যেতে বলল। রিকশা যাচ্ছে,আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছে বারবার। আমি দূর থেকে কাঁদছি, আর ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি চুপিচুপি ৷

কানাই এসে আমাকে বলল, আয় ঝামেলা শেষ। তুই বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও বাসায় গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করে, খানিক পর, মিলে যাব ম্যানেজারকে বলতে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলেছে মেয়েটা? কানাই বলল, কিছু বলার সুযোগ দেইনি, শুধু তোর দেয়া, মন্ত্রপাঠ করে বিদায় দিলাম। ওতো আবার কাল না হয় পরশু আসবে। আড়াই দিনের একটা নিয়ম তো আছে। কানাই গেল বাসায়, আমিও বাসায় এসে স্নান করে, মায়ের দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে ঘুমালাম। সেই ঘুমেই রাত পাড় করলাম, কেউ আর সেদিন আমাকে ডাকও দেয়নি। একদিন পরেই ঠিক বিকালবেলা, মেয়েটি জামাই নিয়ে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ি আসলো, আড়াই দিনের নিয়ম পালন করার জন্য। আমি আর কানাই মিলে কাজ করছিলাম। ছোট দুইটা বাচ্চা ছোলে মিলে গিয়ে দারোয়ানকে বলল, আমাকে ডেকে দিতে। দারোয়ান গিয়ে বলল, বাবু তোমার লোক এসেছে গেইটে। বলালাম, ভিতরে আসতে বলেন কাকা। দারোয়ান কাকা ওদের নিয়ে ভিতরে আসলো। ওরা আমার কাছে গিয়ে বলল, কাকা তোমায় ডাকছে দিদি, শিগ্‌গির আস আমাদের সাথে। কানাই রাগ করে ওদের বলল, যা’ গিয়ে বল আসতে দেরি হবে, কাকা কাজে ব্যস্ত। আমি আর কিছু বললাম না বাচ্চা দুটোকে, ওরা মিল থেকে বাড়ি চলে গেল, আমরা কাজ করছি। ছুটি হবে রাত আটটায়। এখনো তিন ঘন্টা বাকী? আমার আর ভাল লাগছিল না, শুধু ওকে দেখতে মন চাইছে। কানাইকে বললাম আজ আর কাজ করতে মন চায় না, ম্যানেজার সাহেবকে বলে বাসায় যাব। কানাই আর উত্তর দেয়নি আমার কথায়, ম্যানেজারকে বলে মহল্লায় ফিরলাম, বাসার সামনে এক বন্ধুর মুদিদোকানে দাঁড়ালাম আমি আর কানাই। পুকুরপাড়ের দিকে তাকাচ্ছি ওকে দেখা যায় কিনা, দোকানদারের সাথে কথা বলতে বলতেই দেখি পুকুরঘাটে কী যেন করছে। কানাই আমাকে বলল, ওই দেখ তোর …., আমি কানাইকে ইশারায় বলালাম দেখেছি তো! কানাই বলল, যা, গেলাম সামনে, মেয়েটি আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বলল, পরশুদিন ছিলেন না যে? বললাম কাজ ছিল বিস্তর তাই। কেমন আছো তুমি? বলল, ভালও আছি খুব, মনে শান্তি নেই। বললাম শান্তিও হয়ে যাবে আস্তে আস্তে, সংসার করতে থাক মনস্থির করে সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না।

ওর সাথে কথা বলছিলাম আর শ্যামসুন্দর দাদা দূর থেকে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি বাসায় গেলাম, মা’ আমাকে বলল, আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসলি? মিলে কাজ কম? তো শোন! মেয়েটা বাড়িতে এসেছে, ওর সাথে কথা কম বলবি যাতে কলঙ্ক না হয়। বললাম কেন মা’ কিছু হয়েছে নাকি? মা’বললেন না, আমি’ই বললাম কারণ: মেয়েটার বিবাহ হয়েছে, পরের ঘর, কখন কোন কথা উঠে যায় কে জানে! আমার বিষণ ভয় হয়। বললাম না মা’ তুমি কোন চিন্তা করবেনা, ভয়ের কোন কারণ নাই, তোমার ভয় যাতে না হয়, প্রয়োজনে বাসা বদলে ফেলব। খানিক পর শ্যামসুন্দর দাদা বউদিকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এসে বসলো, আমাকে বলছে তোকে কিছু বলবো বলে আসলাম। আমি বললাম বলেন কী বলবেন! দাদা বললেন মেয়ে’টাকে তো বিয়ে দিয়েছি! মেয়ে’টা এখন পরের ঘরের রমণী, তোর সাথে কী সম্পর্ক সেটা আমি জানিনা, তবে তোর কারণে যদি ওর কোন সমস্যা হয় তবে তোকেই তো এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। আমি বলালাম দাদা, এখন আপনি ও বউদি কী বলতে চাইছেন সেটা বললেই হবে। দাদা বলল, ওর সাথে তুই কোন কথাই বলবি না। আমি বুঝতে পারলাম, তাদের মনে সন্দেহের ডানা মেলেছে নতুন করে, এখানে আর থাকা যাবে না, বাসা ছেড়ে দিব শীঘ্রই। দাদাকে বললাম দাদা, আমি কথা দিলাম ওর সাথে আমার যদি কোন কথা হয় তা হয় খনিকের জন্য, এতে ওর কোন অসুবিধা হবে না, আপনি ও বউদি নিশ্চিত থাকুন। শ্যামসুন্দর দাদা ও বউদি চলে হেলেন বাসায়, আমি মা’কে বললাম সামনের একমাস এখানে থেকে বাসা ছেড়ে দিবো। মা’ রাজি হয়ে বলল, তাই কর আমার মোটেই ভাল লাগে না, মেয়েটার বিয়ের পর থেকে।

তাই করলাম, বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি দাদাকে জানিয়ে দিলাম খুব গোপনে, যাতে মেয়েটি জানতে না পারে। আড়াই দিনের নিয়ম করে যাওয়ার দিন আর দেখা করি নাই, লোকচক্ষুর ভয়ে, আটনাইয়রীর বেলায় ও খুব কম কথা বলেছি মেয়েটার সাথে, আটনাইয়রীর আসার পর, মেয়ে’টির জামাই সহ এই বাড়িতেই থেকে গেল, জামাই আমাকে দেখলে খুব সম্মান করতো। হয়তো মেয়েটাই বলে দিয়েছিল জামাইকে, জামাইটা সোজা মানুষ, যে যাই বলে তাই শুনে। এই বাড়িতে থাকবো আর কয়েক মাস, আমার একটা চাকরি হওয়ার কথা ফরিদপুর রাজবাড়ির গঙ্গাবর্দি, সেখানে গেলে তো আর মা’কে সাথে করে নেওয়া যাবে না, মা’ থাকবে বড়দাদার সাথে, আমি কানাইকে নিয়ে চলে যাবো ফরিদপুর গঙ্গাবর্দি কানাইপুর হাঁট সংলগ্ন। যা কথা তাই করলাম, চাকরিটা খুব জোর দিয়েই ঠিক করলাম শুধু মেয়েটিকে ভুলে থাকার জন্য, আমার দ্বারা মেয়েটার যাতে কোন কলঙ্ক না হয় সেই জন্য। আমার বড় দাদাকেও মা’ সব খুলে বলেছে, আমার দাদাতো রেগে অস্থির। দাদা মা’কে বারবার বলছে তাড়াতাড়ি বাসা ছেড়ে দিতে, না হয় বিপদ সম্মুখে। মেয়েটি জানতে পারলো যে আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি অতি শীঘ্র, একদিন মেয়েটি আমাকে পুকুরপাড়ে একা পেয়ে বললো, আমার ভয়ে আপনি বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমিতো আপনার কোন ক্ষতি করিনি, আর করবও না কোন দিন, শুধু চোখের সামনে আপনাকে চুপিচাপি একনজর দেখতে পারলেই শান্তি পাই। আমি মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম যে, দেখ আমি চাকরিজীবী মানুষ, একেক সময় একেক জায়গায় আমার চাকরী করতে হয়, তোমার ভয়ে নয়, চাকরি করে তো চলতে হবে বলো! আর মাত্র পনের ষোল দিনের মধ্যেই আমি আর কানাই ফরিদপুর যাচ্ছি, তুমি আমাকে ভুল বুঝবেনা। মেয়েটি আর কোন কথা না বলে সোজা চলে গেল বাসায়, আমি আর কানাই, এই মাস শেষ না হতেই ফরিদপুরে যাবো, বড় দাদাকেও বলা হয়েছে আগে। আমরা ফরিদপুর যাওয়ার পর মা’ চার পাঁচদিন এই বাড়িতে থাকবে, তারপর দাদা বাসার মালামালগুলি দাদার বাসায় নিয়ে যাবে ভ্যানগাড়ি দিয়ে।

সেদিন ছিল শুক্রবার, ফরিদপুর যাবো কানাই আর আমি, নাইট কোচে যাবো বলে বিকালবেলা থেকেই প্রস্তুতি চলছিল আমাদের। বিকালবেলা মেয়েটি তিনবার জিজ্ঞেস করেছিল, ভুলে যাবেন না আমাকে। আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছিলেন, সারাজীবন অন্তরে ঠাঁই দিবেন। বললাম সারাজীবন আমার অন্তরে থাকবে তুমি, এটাই সত্য চিরসত্য। রিকশায় উঠলাম আমি আর কানাই। আমার মা’,কানাই’র মা’, আমাদের বিদায় দিচ্ছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আমাদের বিদায় দিলো। তারপর ফরিদপুর থেকে কানাই আর আমি পাঁচ মাস পর ছুটিতে আসলাম। আমি আমার বড় দাদার বাসায় না গিয়ে, কানাই’র সাথে সোজা সেই মহল্লায় গেলাম, মেয়েটিকে দেখবো বলে। দুঃখের বিষয়, মেয়েটি একমাস আগে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে, জামাই নিয়ে এই বাড়ি থেকে মেয়েটির জামাই’র বাড়ি কুমিল্লা চলে যায়। এইসব কথাগুলি কানাই’র মা,’ মাসিমার কাছ থেকে সেদিনের শোনা। ওই দেখার পর শুধু লোকমারফত খবরাখবর নিতাম, জানা শোনা লোকের কাছ থেকে। কেমন আছে মেয়েটি? ভাল আছে। দুই সন্তানের জননী, শুনতাম লোকের মুখে।

১৯৮৬ সালের শেষদিকের কথা, তখন আমি সবেমাত্র বিয়ে করছি। একদিন বিকেলবেলা গিয়েছিলাম নারায়নগঞ্জ শহরে, নিজের একটা কাজের জন্য। কালিরবাজার, কালীমন্দিরের সামনে রিকশা থেকে নেমে, রিকশা ভাড়া দিচ্ছিলাম রিকশাওয়ালাকে। এমন সময় একটা শিশুবাচ্চা কোলে করে একজন মহিলা, আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম মহিলাকে পাশ কেটে। মহিলা, আমার পিঠে টোকা দিয়ে বলছে, কেমন আছেন? তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ মহিলার দিকে। বলল, চিনেন না? আমি সেই মেয়েটি। অবাক দৃষ্টিতে আরো কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম তুমি সেই ! বলতে বলতেই কেঁদে কেঁদে বললো, হ্যাঁ আমি ! বললাম কোলে? বলল, আমার ছোট ছেলে, বড়ো একজন আছে ! ওর মুখে প্রসাদ দিবো বলে কালীমন্দিরে মানস করেছিলাম। তাই কাকা শশুরের বাসা থেকে এখানে আসলাম। জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে করেছেন? বললাম কেবল মাত্র তিনমাস হলো করেছি। আমার সাথে সেদিন ছিল মাত্র চারশ টাকা। সেখান থেকে দুইশ টাকা, ওর ছেলের হাতে দিয়ে বললাম। তোমার কাকা শশুরের বাসার ঠিকানাটা দাও, আমি আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করবো। আমার হাত ধরে বললো, না’ না’ তাদের বাসার ঠিকানায় আপনি গেলে তাঁরা সন্দেহ করবে আমারও সমস্যা হবে। আর আমিতো আজকেই বাড়ি চলে যাচ্ছি। এমনিতেই আর বেশিদিন হয়তো থাকবো না, কাকা শশুর সহ সবাই মিলে বাড়ি বিক্রী করে দিবে বলে শুনছি। হয়তো ওপারে হতে পারে আমাদের গন্তব্য। আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বললাম চিঠি দিও মাঝে মাঝে। মন্দিরের ভিতর থেকে ডাক পড়ল ওর, বললো যাই, ভালো থাকবেন আর মনে যেন থাকে ! আমিও ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আরো অনেক কথাই হলো, শুনলাম, বুঝলাম ওর কথায় জীবন মানেই যন্ত্রণা, শুধু ভালো লাগার কারণে। যেই কাজের জন্য শহরে গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না সেদিন। তারপর লোক মারফত কিছু পাঠাতাম কয়েক বছর, আমার দেয়া কিছু পেলে মেয়েটি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে, যেই লোক মারফত পাঠাতাম সেই লোক ফিরে এসে আমার কাছে বলতো। এখন আর কাউকে পাই না যে, কিছু পাঠাবো ওর জন্য। আছে কী নেই তাও জানিনা, চার-পাঁচ বছর ধরে খোঁজ নিতে পারি না। এখন আরো বেশি মনে পড়ে মেয়েটিকে। চোখ বুজলেই দেখি যেন সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, আমাকে সারাজীবন আপনার অন্তরে রাখবেন বলছিলেন,রেখেছেন কিনা জানিনা। আমি রেখেছি আপনাকে আমার হৃদয়ে যতন করে, ভুলবো না কোনদিন।

কুরবানী

ku

এই মহামারীর ভয়াল দিনে-
তোমার ফ্রীজের এককোনা
নয় রইলো এবার একটু খালি,
খালি পেটের একটি মানুষ
তা দিয়ে মাংস-ভাত খেলো
ক’দিন পেটপুরে এক থালি।

ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাঈল
যখন গিয়েছিলো কুরবানীর
প্রথম ছুরির তলে,
ডীপফ্রীজের নামখানি কেউ
শুনেছিলো সেই কালে?
তাহলে কুরবানী দিয়ে
সেটি ভরে রাখা আজ,
জায়েজ করে নিলে তুমি
কোন ফতোয়ার বলে?

মিসকিন আর প্রতিবেশীদের
হক পূরণের পরে, বুক ফাটে
তবু মুখ ফুটে চায় না, এমন
কাউকে ভেবে নিতে পারো
যদি “আপন” বলে, বিলিয়ে
দিও তোমার ভাগের কিছুটা
তাকে ডেকে নিয়ে নিরলে।

তার খালি পাত ভরে উঠুক
ক’দিন তোমার ভাগের গোশে,
মরমি কবি ভেবে দেখে বলে,
তাতে কিন্তু অশেষ পূন্য মেলে!

সজল চোখের হাম্বারব (দুুই)

Photo_1626

সকাল দরজা খোলার পর থেকে তারাদের রান্নাবাটি শুরু হওয়া পর্যন্ত। সদর দরজায় মাটির রোয়াকে বসে থাকে তো বসেই থাকে। আনা। সারাদিনে ওর সঙ্গে একবার দেখা হবেই। সবার সঙ্গে তার কথা, অবিরত মুখ দিয়ে লালের সঙ্গে ঝরে। ওর কথা না বুঝলেও হৃদয় বুঝি, তাই কিছুক্ষণ বলাটা অভ্যাস।

ঠোঁট ঠেলে বেরিয়ে পড়া উঁচু অপরিচ্ছন্ন দাঁতে অনাবিল হাসি। সদ্য গাইএর বাৎসল্যে চোখ হাম্বা ডাকে। সামনে দিয়ে যে কেউ যাক, তাকেই সে উপহার দেয় ওই হাসি আর কথা।

অন্যথা শুধু দেবুর বেলা। ওই রাস্তা তার নয়। ও রাস্তায় সে গরল ছড়ায়। ওই রাস্তায় দেবু জীয়ন্ত মানুষকে মরণ দিয়ে গাঁথে।
দেবু নিষ্ঠুরতা করে আনার সঙ্গে। – “আনু, ও আনু! তোমার বৌদির সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। তোমাকে সে যেতে বলেছে।”

আনুর নরম চোখে কঠিন আগুন জ্বলে ওঠে। কুঁজো পিঠ তুলে বাঁকা বাঁকা হাতে ঢিল কুড়িয়ে আক্ষেপ আর অপমান ছুঁড়ে মারে। অবিশ্রান্ত চিৎকারে আর কান্নায় ছটফট করে।
দেবতার পিঁড়ি নড়ে যায়, দেবু না! সে তখন হাসির ব্যাপারি।

দেবু যেদিন বিয়ে করে ঠাকুরতলায় জোড়ে প্রণাম করতে এলো, সেদিন আনার অন্ধ নৌকো ঝড়ের রাতে। কেঁদে, হিজিবিজি বকে ইশারায় বলেছিলো ও দেবুর বিয়ে মানতে পারছে না। দেবুর বৌ ও-ই হবে! অবাক না হবার মতো লোকের অভাব ছিলো। দুঃখবোধ ব্যাকরণ খুলেছিলো কেউ কেউ। কেউ শুধু সাদা চোখে আকাশ দেখেছে। কিন্তু কেউ তার দুঃখ সারিয়ে নৌকো তীরে আনেনি।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

আমরা যা করতে পারি!

1600330429

১) আমরা শুরু করি, সংসার করি, ঘর করি,
বাড়ি করি, গাড়ি করি, প্রেম করি,
পিরিতি করি, বিয়ে করি, শাদি করি,
নিকা করি, চাকরি করি, ব্যবসা করি,
বাণিজ্য করি, জায়গা করি, জমি করি,
খরচ করি, হিসাব করি, নিকাশ করি,
বিকাশ করি, ভব করি, ভাবও করি,

২) চাষ করি, বাস করি, জপ করি
তপ করি, ধ্যান করি, ভাণ করি,
বিক্রি করি, খালাস করি, তালাশ করি,
খোঁজ করি, গ্রহণ করি, ত্যাগ করি,
দর করি, দরাদরি করি, দরকষাকষি করি,
মুলামুলি করি, কান্নাকাটি করি, আহাজারি করি,
উপকার করি, অপকার করি, সর্বনাশও করি,

৩) হানা করি, মানা করি, ক্ষমা করি,
কষ্ট করি, দুঃখ করি, সুনাম করি,
দুর্নাম করি, ক্ষতি করি, মতি করি,
বেঈমানি করি, হিংসা করি, অহংকার করি,
মারামারি করি, গালাগালি করি, খুশি করি,
বদনাম করি, তুচ্ছ করি, তাচ্ছিল্য করি,
ঘৃণা করি, জ্বালাতন করি, বকবকও করি।

৪) অপমান করি, অপদস্থ করি, হেনস্তা করি,
হেলা করি, খেলা করি, বেলা করি,
হৈচৈ করি, হৈ হৈ করি, হৈ হুল্লোড় করি,
চিল্লাচিল্লি করি, চিৎকার করি, গণ্ডগোল করি,
সমস্যা করি, সমাধান করি, আলোচনা করি,
সমালোচনা করি, গিবত করি, কুটনামি করি,
অবহেলা করি, স্বীকার করি, অস্বীকারও করি,

৫) দল করি, দলবাজি করি, দালালি করি,
দলাদলি করি, মিল করি, বেমিল করি,
চিন্তা করি, ভাবনা করি, বুদ্ধি করি,
সিদ্ধি করি, সুবুদ্ধি করি, কুবুদ্ধি করি,
ফন্দি করি, সৎ কর্ম করি, অসৎ কর্ম করি,
দলিল করি, কাবিন করি, রেজিস্টার করি,
পোস্ট করি, বড় করি, ছোটও করি।

৬) মিলন করি, মেলা করি, কম করি,
বেশি করি, ঘেনঘেন করি, পেঁনপেঁন করি,
শব্দ করি, জব্দ করি, খেয়াল করি,
খামখেয়ালি করি, সঞ্চয় করি, রপ্ত করি,
তপ্ত করি, শয়তানি করি, দুষ্টামি করি,
ন্যায় করি, অন্যায় করি, চুরি করি,
ডাকাতি করি, খুন করি, গুমও করি,

৭) লেখাপড়া করি, পাস করি, ফেল করি,
মাস্টারি করি, প্রশ্নপত্র ফাঁস করি, বদমাশি করি,
ইমামতি করি, ইয়ার্কি করি, ফাজলামি করি,
বেয়াদবি করি, বিচার করি, বিবেচনা করি,
সম্মান করি, অসম্মান করি, গুণ্ডামি করি,
জুলুম করি, লুচ্চামি করি, রুস্তমি করি,
মাস্তানি করি, নির্যাতন করি, অত্যাচারও করি।

৮) অভিনয় করি, নাটক করি, শুটিং করি,
ভুল করি, ত্রুটি করি, ভণ্ডামি করি,
ঝগড়া করি, দেন করি, দরবার করি,
কারবার করি, মীমাংসা করি, সাধন করি,
সাধনা করি, বাসনা করি, কামনা করি,
আক্ষেপ করি, অপেক্ষা করি, আফসোস করি,
হায়হুতাশ করি, ষণ্ডামি করি, কোলাকুলিও করি।

৯) আমরা গর্ব করি, দর্প করি, খর্ব করি,
গল্প করি, গপ করি, গজব করি,
চেষ্টা করি, অপচেষ্টা করি, ত্রাস করি,
সন্ত্রাসী করি, গায়েব করি, গোপন করি,
কানাকানি করি, হানাহানি করি, মান করি,
মানহানি করি, ইজ্জত করি, বেইজ্জত করি,
আদর করি, কদর করি, সমাদরও করি।

১০) দাহ করি, দাপন করি, কাফন করি,
পূজা করি, রোজা করি, উপোষ করি,
কীর্তন করি, এবাদত করি, বন্দেগি করি,
মানস করি, তপস্যা করি, গোস্বা করি,
রাগ করি, আপ্যায়ন করি, গরিমা করি,
অভিমান করি, উপহাস করি, পছন্দ করি,
অপছন্দ করি, ঘৃণা করি, জিনাও করি।

১১) ভিক্ষা করি, খয়রাত করি, ভরাত করি,
দ্বার করি, কর্জ করি, দেনা করি,
ঋণ করি, শোধ করি, বোধ করি,
গোসল করি, স্নান করি, গান করি,
পান করি, রোপণ করি, বপন করি,
গোপন করি, আত্মগোপন করি, ক্ষোভ করি,
প্রতিবাদ করি, আঘাত করি, জখমও করি।

১২) ইচ্ছা করি, দখল করি, বেদখল করি,
বাহাদুরি করি, নষ্ট করি, স্পষ্ট করি,
চুপ করি, জবাই করি, খতম করি,
কুরবানি করি, সাহস করি, ভয় করি
সমান করি, লেভেল করি, ঢালাই করি,
ক্ষমা করি, ওচা করি, নেচা করি,
হায়হায় করি, তর্ক করি, বিতর্কও করি।

১৩) খাইখাই করি, নাইনাই করি, মজা করি,
হামলা করি, মামলা করি, পূর্তি করি,
রঙ্গ করি, তামাসা করি, কান্না করি,
কান্নাকাটি করি, ইতরামি করি, নেশা করি,
পেশা করি, গোলামি করি, ধূমপান করি,
আহার করি, চা পান করি, জলপান করি,
চোখরাঙা করি, সোঝা করি, বেঁকাও করি।

১৪) ফ্যাশন করি, স্টাইল করি, বাহানা করি,
সাজ করি, ভাজ করি, ঠাট্টা করি,
মশকারা করি, নির্মাণ করি, তৈরি করি,
আবিষ্কার করি, পুরস্কৃত করি, তিরস্কার করি,
জিকির করি, ওয়াজ করি, আওয়াজ করি,
ছোঁয়াব করি, নেক করি, ফরজ করি,
গুনাহ করি, পাপ করি, পুণ্যিও করি।

১৫) হজ্ব করি, জেয়ারত করি, তীর্থ করি,
আল্লাহআল্লাহ করি, ঈশ্বরঈশ্বর করি, ভক্তি করি
চালাকি করি, ছলনা করি, দাওয়াত করি,
ভ্রমণ করি, গমন করি, দমন করি,
ব্যায়াম করি, পেক্টিস করি, খেলা করি,
মুলাকাত করি, আশা করি, ভরসা করি,
নিরাশ করি, ঝগড়া করি, বিবাদও করি।

১৬) মায়া করি, দয়া করি, করুণা করি,
ভর করি, ভরাট করি, কারচুপি করি,
শূন্য করি, ক্ষুণ্ণ করি, পূর্ণ করি,
চূর্ণ করি, জয় করি, ক্ষয় করি,
আপন করি, পর করি, প্রশংসা করি,
ফন্দি করি, বন্দি করি, বৃদ্ধি করি,
হ্রাস করি, জাল করি, নকলও করি।

১৭) অঙ্ক করি, যোগ করি, বিয়োগ করি,
পূরণ করি, ভাগ করি, লসাগু করি,
গসাগু করি, কর্ম করি, ধর্ম করি,
মাপ করি, ক্ষমা করি, চুক্তি করি,
মুক্তি করি, ভক্তি করি,আরতি করি,
নমস্কার করি, প্রণাম করি, সালাম করি,
উৎপন্ন করি, বংশবৃদ্ধি করি, ধ্বংসও করি।

১৮) পরিচালনা করি, ঢং করি, কুয়ারা করি,
যাত্রা করি, থিয়েটার করি, মিছিল করি,
মিটিং করি, সভা করি, মঞ্চ করি,
আলাপ করি, বিলাপ করি, অর্থ করি,
সম্পদ করি, কাম করি, কাজ করি,
ভোজন করি, ভক্ষণ করি, ক্ষুধা নিবারণ করি,
ড্রেসিং করি, ড্রেজিং করি, খননও করি,

১৯) রাজনীতি করি, ধান্দাবাজি করি, হুশিয়ার করি,
এই দল করি, ঐ দল করি, জামাত করি,
শিবির করি, বিএনপি করি, আওয়ামীলীগ করি,
জাতীয় পার্টি করি, ন্যাপ করি, যুক্তফ্রন্ট করি,
ওয়ার্কার্স পার্টি করি, মজলিশ করি, জাকের পার্টি করি,
জোট করি, খারাপ করি, ভাল করি, মন্দ করি,
নিন্দা করি, ধান্ধা করি, ফলও ভোগ করি।

২০) কেইস করি, মামলা করি, মকদ্দমা করি,
গ্রেপ্তার করি, গুলি করি, ক্রসফায়ার করি
ব্রাস করি, হাট করি, ঘাট করি,
ব্যবসা করি, মুনাফা করি, বিক্রি করি,
বাজার করি, সদাই করি, লাভ করি,
লোকসান করি,ভর করি, অর্জন করি,
বর্জন করি, জোর করি, জেরাও করি।

২১) নির্বাচন করি, প্রতিযোগিতা করি, শাসন করি,
শ্বাসরুদ্ধ করি, ধন্দ করি, বন্ধ করি,
খতম করি, জোড়া করি, খোঁড়া করি,
লালন করি, পালন করি, যুদ্ধ করি,
স্বাধীন করি, স্বাধীনতা ভোগ করি, আমোদ করি,
প্রমোদ করি, সঞ্চয় করি, জমা করি,
লোভ করি, লালসা করি, বিলাসিতাও করি।

২২) খেয়াল করি, খামখেয়ালি করি, গড়মিল করি,
গাফিলতি করি, পাঠ করি, খাট করি,
খেতা করি, বালিশ করি, মালিশ করি,
পালিশ করি, নালিশ করি, স্মরণ করি,
বরণ করি, ধরণ করি, গরম করি,
নরম করি, অলসতা করি, সরলতা করি,
লাঠিপেটা করি, ছত্রভঙ্গ করি, দৌড়াদৌড়িও করি।

২৩) অঙ্গীকার করি, প্রতিজ্ঞা করি, ওয়াদা করি,
বরখেলাপ করি, রান্না করি, বান্না করি,
কান্না করি, চিকিৎসা করি, বমি করি,
ভাঁওতাবাজি করি, একগুঁয়েমি করি, জেদ করি,
পাতলা করি, ঘন করি, মনে করি,
শুদ্ধ করি, মুগ্ধ করি, ক্ষুব্ধও করি।

২৪) সময় নষ্ট করি, দেরি করি, ফেরি করি,
সৎসঙ্গ করি, অসৎসঙ্গ করি, গবেষণা করি,
মিল করি, কারখানা করি, উৎপাদন করি,
বিদেশ করি, আমদানি করি, রপ্তানি করি,
প্রচার করি, পাচার করি, স্রষ্টাকে স্মরণ করি,
মাইকিং করি, প্রসার করি, ঈশ্বরকে স্মরণ করি,
সৃষ্টির প্রসংশা করি, বিশ্বাস করি, অবিশ্বাসও করি।

২৫) জয় করি, ক্ষয় করি, নয় করি,
ছয় করি, পার করি, সাইন করি,
স্বাক্ষর করি, নির্বাচন করি, নির্বাচিত করি,
লগইন করি, ভিজিট করি, ব্লগ করি,
ব্লগিং করি, দখল করি, বেদখল করি,
এই করি, সেই করি, এটা করি,
ওটা করি, চিকিৎসা করি, খেদমতও করি।

২৬) চাঁদাবাজি করি, ছিনতাই করি, কবিরাজি করি,
গোল মিটিং করি, শত্রুতা করি, মিত্রতা করি,
ফেসবুক ব্যবহার করি, বন্ধু যোগ করি, বন্ধুত্ব করি,
বন্ধুত্ব স্বীকার করি, বন্ধুত্ব ত্যাগ করি, ব্লক করি,
পোষ্ট করি, বার্তা প্রেরণ করি, মন্তব্য করি,
শুভেচ্ছা বিনিময় করি, গ্রুপ করি, আড্ডা করি,
ইতিহাস সৃষ্টি করি, ইতিহাস ধ্বংস করি, শেষও করি।

বিনামূল্যে প্রাপ্য

2940436703

মানুষ আজ অপেক্ষায় আছে
উদ্বেপ উৎকণ্ঠা আর ভয়ে আছে
পৃথিবীর সব দেশের মানুষেরই আজ ভয়
ফুসফুস নষ্ট করা এই জীনাণুকে যারা ভয় করে না তারা সচেতন নয়।

ফাইট অর ফ্লাইট
মরো অথবা মারো
মানুষের চেয়ে করোনা বুদ্ধিমান নয়
মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে জীবাণুর রাজত্ব চলতে পারে না
মানুষ তা হতে দেবে না।

কিন্তু তোমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল করছো
ব্যাধি নিয়ে বানিজ্য করা যায় না – কিন্তু তোমরা তাই করছো
ভ্যাক্সিন নিয়ে বানিজ্য করা কাম্য নয় – কিন্তু তোমরা তাই করছো
তোমরা ভুল তথ্য দিচ্ছো
এক কোটি বিশ লাখ মানুষকে ইতিমধ্যে ওই জীবাণু টেনে নিয়ে গেছে মাটির নিচে
অথচ তোমরা সঠিক হিসাব রাখতে পারছো না।

ভ্যাক্সিন নিয়ে বানিজ্য করলে – জীবাণুরা বুঝে ফ্যালে
আর তখনি মিউটেড হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে
ভ্যাক্সিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দাও অতি দ্রুত
আর পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ভ্যাক্সিন দাও – বিনা মূল্যে
আঠারো বছরের নিচে বা উপরে – এই ক্ষেত্রেও তোমরা ভুল করছো
করোনা’র বুদ্ধিমত্তা তোমরা এখনো যাচাই করতে সমর্থ হওনি
ফুসফুসের পর সে আক্রমণ করবে মানব মস্তিষ্কের ব্রেইনে
আর মানুষের পর মানুষ পাগল হতে থাকবে।

এসো—
বিনা মূল্যে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করা হোক-
মানুষের ফুসফুস নষ্ট করার পূর্বে
মানুষের ব্রেইন নষ্ট করার পূর্বে
মানব সভ্যতা পচে যাওয়ার পূর্বে
এসো সমস্ত মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন দেওয়া নিশ্চিত করি।

এক বিকেলের ভালো লাগা, সারাজীবনের স্মৃতি

nitai-b

নারায়নগঞ্জ নগরখাঁন পুরে বাসা ভাড়া নিলাম, বাড়িওয়ালা আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, নাম শ্যামসুন্দর সাহা। বাসা ভাড়া মাত্র ১৫০/=টাকা, আমার পরিবারের সদস্য বলতে আমি আর আমার মা। চাকরি করতাম কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল, বেতন মোটামুটি ২০০০/=টাকা। তখন চাউলের মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৫/= টাকা। সময়টা বোধহয় ১৯৮৪ সালের প্রথম দিকের কথা। বড়দাদার সাথে আয়-রোজগার নিয়ে কথা কাটাকাটি করে নারায়নগঞ্জ নগর খাঁনপুরে বাসা ভাড়া নিলাম, থাকবো মা’কে নিয়ে। যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, তারিখটা মনে নেই।

ঠিক দুপুরবেলা হতে দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারী মালামাল নিয়ে ভাড়া করা বাসায় আসলাম, মালামালের মধ্যে তেমন কোন দামী মাল বা দামী আসবাবপত্র নেই, তারপরেও মোটামুটি যা আছে গরিব সমাজে চলনসই। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের তো এর বেশি কিছু থাকার কথাই না, আমার বেলায়ও তাই। রিকশা করে এই মালগুলি আনলাম, বাসার সামনে যখন রিকশা রাখলাম তখন অমার চোখ পড়ল ঐ বাড়িতে থাকা একটা মানুষের উপর।

মানুষটা খুবই সুন্দর ও রূপসী, গায়ের রং ফর্সা, মায়াবী চেহারা, যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দূর্গা। অটল চেরা চোখ, হাঁটু পর্যন্ত তাঁর মাথার কেশ, অপরূপ এক রূপবতী। আমাদের দিকেই শুধু মেয়েটার নজর, খানিক পরপর শুধু এদিকেই ওর আনাগোনা।

রিকশা-ভ্যান থেকে এই সামান্য মালামাল আর নামাতে ভাল লাগছিল না, লজ্জায়। লজ্জা লাগার কারণও আছে, কারণটা হলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া আছে, তাঁরা সবাই ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাদের ঘরে জিনিসের অভাব নাই, তাদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না, তাই হচ্ছে লজ্জা।

রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী যে করি! আমার সাথে আছে আমার এক হেলপার, নাম কানাই লাল। ওর বাসাও এই নগর খাঁনপুরে, বহু আগে থেকে ওরা সপরিবারে এই এলাকায় থাকে। ওর অনুরোধেই আবার আসলাম এই এলাকায় মা’কে নিয়ে।

এর বহু আগেও আমরা এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম সপরিবারে, সেই আগের চেনাজানা বলেই আবার বহুদিন পর এই এলাকায় আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কানাই শুধু বলছে, কি রে! মালগুলি ধর, ঘরে নিয়ে যাই তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কত জিনিসপত্রের দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে, বলছিল কানাই লাল।

একটু পরে ঐ রূপবতী রূপসী মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো, সামনে এসেই বললো, আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি। মামা আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাহায্য করতে। আমি একেবারে চুপ করে রইলাম, কোন কথা’ই বলছি না। কানাই বললো না না থাক তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও। তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে রাখলো, আমি যেই ঘরটা ভাড়া করেছি সেই ঘরে। বাকী মালপত্র কানাই আর আমি মিলে নিলাম, সাথে রিকশাওয়ালাও আছে। আমার মা আসলো বিকালবেলা। মা আসার পূর্বেই ঘরের ভিতরে সব গোছগাছ করে রেখেছি দুইজনে। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আসছে আমার ঘরে। একটু পরে মা বললেন, যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়। মাকে বললাম বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন। কী কী লাগবে মা বললেন, ব্যাগ নিয়ে বেরুলাম আমরা দুইজনে বাজারের উদ্দেশ্যে।

রাতের খাবারে কানাইকে নিমন্ত্রণ দিলাম, কানাই ঠিক সময় এসে হাজির হলো আমার ঘরে। মা ভাত খেতে দিলেন দুইজনকে, ভাত খাচ্ছি দুইজনে। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি? ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল- মা জবাব দিলেন। মেয়েটা ওদের ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি, মেয়েটা অনুরোধ করলো রাখার জন্য, তখন মা ওর অনুরোধে রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলেন, আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে বেরুলাম দুইজনে দোকানে যাওয়া জন্য। বাড়ির সাথেই চা দোকান, মুদি দোকান আছে যা রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে সবসময়, মহল্লার দোকান তো তাই।

কানাই লালকে জিজ্ঞেস করলাম যে, মেয়েটা কে? কোথায় বাড়ি, তাঁরা কয় ভাই, কয় বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। কানাই লাল বিস্তারিত বললো- মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মনাম) ৷ মেয়েটির বাবা নাই, মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার এখানে থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। ওরা একভাই একবোন, মা জীবিত আছে, ওর মাও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। কানাই লাল জিজ্ঞেস করলো, কেন জানতে চাইলি মেয়েটার জীবনী! বললাম একজন কি অন্য আরেক জনের জীবনী সমন্ধে জানতে পারে না? মেয়েটা সারা বিকাল আমাদের খেদমত করার জন্য প্রায় অস্থির, আর শুধু মেয়েটার জীবনী, মেয়েটা কে, মেয়েটা ধনী না গরিব, সেটা জানা কী অপরাধ হবে? কানাই বললো না, কোন অপরাধ হবে না।

রাতে বাসায় ঘুমাতে গেলাম, কানাই ও গেল ওদের বাসায় ঘুমানোর জন্য ৷ওদের বাসা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি, তবে বাড়িওয়ালা ভিন্ন। আমি যখন ঘুমানোর জন্য বাসায় আসি মেয়েটা তখন দাঁড়ানো ছিল বাড়িওয়ালার ঘরের সামনের বারান্দায়। আমাকে দেখে বললো এত রাত অবধি বাহিরে থাকবে না, বিপদ হতে পারে। মেয়েটার কথার জবাবের কোন প্রত্যুত্তর দেইনি, সোজাসুজি আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। আমি আর সেদিন ঘুমাতে পারলাম না, বিছানায় শুয়ে শুধু ভাবছি, মেয়েটির কথা।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুতে গেলাম বাড়ির সামনে থাকা পুকুর ঘাটে। ঘাটের সামনে গিয়ে দেখি মেয়েটা থালা-বাসন ধোয়ায় কাজ করছে আপন মনে। আমি বোতলে করে বিক্রী করা দন্তমাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হাত-মুখ ধোবার আশায়। মেয়েটাকে দেখে সহসা আর নামছি না ঘাটে, আমি আবার অত্যন্ত লাজুক টাইপের একটা মানুষ, আবার সময় মত নির্লজ্জ মানুষও হয়ে যাই। মিলের ডিউটির সময় হয়ে যাচ্ছে, দেরি করা যাচ্ছে না, কানাই সকালের নাস্তা করে ডিউটি ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসছে এই পুকুরপাড় দিয়েই। কানাই আমাকে দেখেই রেগে-বেগে অস্থির, সামনে এসে বললো কিরে, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস! ডিউটিতে যাবি না? বললাম হ্যাঁ যাবো, কানে-কানে বললাম, মেয়েটা ঘাট থেকে তো উঠছে না, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। কানাই রেগে-বেগে মেয়েটাকে বললো ওই মেয়ে উঠ শিগ্‌গির, দেখিসনা দাঁড়িয়ে আছে মুখ ধোয়ায় জন্য! উঠ শিগ্‌গির উঠ। মেয়েটা মুখ কালো করে পুকুরঘাট হতে উঠে আসলো, আমি ঘাটে নামলাম মুখ ধোয়ার জন্য। মুখ ধুয়ে, বাসায় গিয়ে, জামাকাপড় পড়ে, কানাইকে সাথে নিয়ে মিলে রওনা হলাম। সেদিন আর মিলে আগের মত কাজে মন বসলোনা, একটু কাজ করেই দোকানে চলে আসি চা পান করার জন্য, এভাবে দুপুর এক ঘটিকা পর্যন্ত, তারপর হলো দুপুরবেলার লাঞ্চ টাইম, বাসায় ফিরে সেদিন আর মিলে যাওয়া হলো না।

এমন এক শুক্রবার বিকালবেলা আমি বাড়ির সামনে পুকুরপাড় বসে আছি একা একা, মেয়েটা আমাকে পুকুরপাড় বসা দেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, খানিক পর বললো কথা আছে আপনার সাথে। মেয়েটার কথা শুনে আমার শরীর ছম্‌ছম্‌ করতে লাগলো, সাথে ভয়। আমি ভয়ে মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না, যদি বাড়িওয়ালা বা অন্য কেহ দেখে ফেলে তো মান-সম্মান বলতে কিছুই থাকবে না এই মহল্লায়। আবারও মেয়েটা বলছে কী শুনতে পান না! ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম আমাকে কিছু বলছো? মেয়েটা বলে উঠলো এতক্ষণে! হ্যাঁ আপনাকেই বলছি কথা আছে। আমি বললাম বলো কী বলবে, ঝটপট বলে ফেল। মেয়েটি বললো, বাড়ির ভিতরে আসেন তারপর বলছি। আমি তখন একপ্রকার রাগ হয়ে গেলাম, বললাম তোমার সাথে আমার এমন কোন কথা নেই যে, বাড়ির ভিতরে গিয়ে তোমার কথা শুনতে হবে, তুমি এখন যেতে পার। একপর্যায়ে মেয়েটি আমার হাত ধরে টানতে লাগলো বসা থেকে উঠানোর জন্য, আমি ভয়ে তো একেবারে কাতর হয়ে গেছি মেয়েটির কাণ্ড দেখে। উঠে দাঁড়ালাম আমি, একটু দূরে ছিল একটা দোকান, দোকানদার পরিচিত তা আবার বন্ধুর মত, নাম দিপক সাহা। দিপক দূর থেকে আমাকে দেখছে আমি কী করছি আর মেয়েটা কী করছে। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটির সাথে বাড়ির ভিতরে আসলাম, বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর সাহা ও তার পরিবার সেদিন বাড়িতে নেই, শুক্রবার হওয়াতে সপরিবারে কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন। আমার মাও বাসায় নেই, বড়দাদাকে দেখতে শহরের নন্দিপাড়ায় গেছেন, আরো যে দুই তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া থাকে তাদের ঘরেও তালা দেওয়া, মোটকথা বাড়ি খালি একেবারে শূন্য শুধু আমরা দুইজনে বাড়িতে।

বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি হাবার মত, মেয়েটি ধমকের সুরে বললো দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসেন। আমি তখন ভয়ে কাঁপছি, মেয়েটি জোর করে টেনে একটা চেয়ারে বসালো আমাকে। আমি বললাম আচ্ছা কী ব্যাপার কী হয়েছে তুমি বলো আমাকে, আমার কাজ আছে এক্ষণি আমাকে একটা জরুরী কাজে মিলে যেতে হবে, না হয় চাকরিটাই থাকবে না আমার। মেয়েটি বললো আপনাকে ভালো লাগে আমার, আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে, প্লাস ভালবাসতে হবে। আমি বললাম আমি গরিব মানুষ, কিছুই নাই আমার, আর তুমি বলছো তোমাকে বিয়ে করতে হবে, ভালবাসতে হবে। এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মেয়েটি বললো দোহাই আপনার, আমাকে নিরাশ করবেন না, আমি আপনার কাছে আমার সব ঘটনা খুলে বলছি, শুনুন!

আমরা একভাই একবোন, ভাই আমার ছোট, আমি বড়, বাবা বেঁচে নেই, মা আছে। মা শহরে এক লোকের বাসায় কাজ করে। আমাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর দিঘীরপাড়, পদ্মানদীর ভাঙ্গনে আমাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে বহুবছর আগে, তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। পড়া-লেখা তেমন কিছুই করতে পারিনি অভাব-অনটনের কারণে, আমার পড়া-লেখার জন্য মায়েরও বেশি ইচ্ছা ছিল না, তাই পড়া-লেখা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এই বাড়িতে কাজ করছি প্রায় তিনবছর গত হয়ে গেল, আমার মায়ের সাথে বাড়িওয়ালার কথা আমাকে বিয়ে-শাদি দিয়ে দিবে বিনিময়ে কোন টাকাকড়ি আমি বেতন হিসেবে পাবো না। গত একমাস আগে আমার জন্য একটা বর (ছেলে) দেখেছে বাড়িওয়ালা, ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী, তার উপর গরিব। আমি রাজি হইনি, আমার মা এক সরল-সোজা মানুষ যে যেভাবে মাকে বোঝায় আমার মা সেভাবে বোঝে। বাড়িওয়ালার কথা, আমাকে ওই ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে বাড়িওয়ালার মুদি দোকানে কাজ করাবে, আর সারাজীবন আমাকে উনার বাড়িতে গৃহকাজে রেখে দিবে, এই হলো বাড়িওয়ালার ইচ্ছা বা ফন্দি। আমি আপনার ব্যাপারে সমস্ত কিছু জেনেছি, জেনে শুনেই আপনাকে মনে-মনে আপন করে নিয়েছি, আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না, কথা দিন, এইসব কথা বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। আমি আর কিছুই বললাম না, শুধু শুনছিলাম মন দিয়ে। মেয়েটির কান্না আমাকে বিমর্ষ করে ফেলেছিল মুহুর্তে, আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না মেয়েটিকে, ভয়ে আর দুঃখে এমন হয়ে গেছি যে, একপ্রকার বোবা মানুষের মত। মেয়েটির কথা শুনে শুধু বললাম তোমাকে পরে বলবো যা কিছু বলার, এখন আমি যাই, এই বলে মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা হলো, কানাই লাল আমাকে খুঁজতে লাগলো কোথাও যাবে বলে। আমি মেয়েটির কথা শোনার পর সোজাসুজি চলে গেলাম মিলের সামনে কিল্লার পুল ৷ সেখানে চার-পাঁচখানা চা দোকান ও হোটেল আছে যা সারারাত পর্যন্তই খোলা থাকে ৷একটা চা দোকানে গিয়ে বসলাম, এমন সময় কানাই লাল এসে হাজির আমার সামনে, বললো তোকে অনেক্ষণ ধরে খুঁজছি। আমি কিছুই বলছি না, মন খারাপ করে বসে আছি এক ধ্যানে। কানাই মন খারাপের কারণটা জানতে চাইলো কেন হঠাৎ মনটা খারাপ। কানাইর কাছে খুলে বললাম সবকিছু, কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোর এখন মতটা কী? বললাম- না, মেয়েটা যা বলছে সেটা এই মুহুর্তে আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

পরদিন সকালবেলা মিলে আসার সময় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে আমার আগমনের আশায়, হয়তো অনেক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। মেয়েটিকে পাশকাটিয়ে আমি যখন যাচ্ছিলাম মিলের কাজে, মেয়েটি বললো কিছু বললেন না যে! আমি বললাম, পরে বলবো এখন নয়। মেয়েটি বললো, তাহলে তো আর হবে না মনে হয়, কারণ: সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে এখন শুধু পিঁড়িতে বসার পালা। বুঝতে পারিনি মেয়েটির কথা, সোজা চলে গেলাম মিলে, কানাই বললো কিরে এত দেরি করে আসলি? বললাম হ্যাঁরে একটু কাজ ছিলো তো তাই দেরি হয়েছে। কানাই অনুরোধ করতে লাগলো বারবার, বলনা কেন তোর মনটা এমন খারাপ, খুলে বলনা আমার কাছে। খুলে বললাম বিস্তারিত কানাইর কাছে। ওতো শুনে হতবাক! জিজ্ঞেস করলো তোর অভিমত কী? আমি কী মাসিমা’র কাছে কিছু বলবো? বললাম- আরে না, কী দরকার, জানিনা শুনি না, এক বিকেলের দেখা, তাতেই এতকিছু! আর আমার তো এখনো বিয়ের বয়স’ই হয়নি, আবার মা’কে বলবি! এ লজ্জা রাখবো কোথায় বল। কানাই আমাকে ওস্তাদ হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করে সবসময়, ও আর কোন কথা বললো না আমার মুখের উপর। কাজ শেষ করে দুপরবেলা বাসায় এলাম লাঞ্চ করার জন্য।

মা আমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে আর বলছে, বাড়িওয়ালার ঘরে কাজ করে মেয়েটার বিয়ে আগামি শুক্রবার, তুই কী জানিস? বললাম না তো! মা বললেন গরীব মানুষের মেয়ের বিয়ে, আমাদের নিমন্ত্রণ দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। আমি আর কোন কথা বললাম না মায়ের সাথে, কোনরকম একটু-আধটু খেয়ে তাড়াতাড়ি গেলাম কানাইদের বাড়ি, কানাই কেবল ভাত খাচ্ছে। আমাকে দেখে কানাইর মা আমাকে বসতে দিয়ে বললেন কী রে, নিতাই বিয়েতে কী দিবি? না জানার ভান করে বললাম কার বিয়ে মাসিমা? বললো কেন রে, তোদের বাড়িওয়ালার বাসায় কাজ করে সেই মেয়েটার! জানিস না বুঝি! বললাম না মাসিমা না, মোটেও জানিনা। কানাই হয়তো মাসিমাকে ব্যাপারটা বলেছিল, মাসিমা আমাকে বললেন, মেয়েটিতো বেশ সুন্দর ছিলো রে, তোর সাথে মানাতো বেশ। মেয়েটা গরিবের মেয়ে সংসারিক হতো, এখন যেই ছেলের কাছে বিয়ে দিচ্ছে, মেয়েটার জীবন শেষ করার একটা পন্থা। আমি আর দেরি করলাম না, বসা থেকে উঠে চলে এলাম বাহিরে পুকুরপাড়ে। দূর থেকে দেখি, মেয়েটি ওদের পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম অনেক্ষণ। একটুপরে কানাই বাসা থেকে বাহির হলো, কানাইকে নিয়ে একসাথে দুজন হেঁটে আসছি পুকুরপাড় দিয়ে, ঠিক যখন মেয়েটির সামনে আসলাম তখন মেয়েটি শুধু বললো ভালো থাকবেন সারাজীবন প্রার্থনা করি প্রভুর নিকট। কথা শুনে কানাই আর শুধু তাকিয়ে থেকে মেয়েটার কাছ থেকে সরে গেলাম, একটু দূরে গিয়ে কানাই বলছিলো মেয়েটা অসহায় ছিল রে!

আমি মনে মনে বলছিলাম মেয়েটাকে তো আমারও ভালো লেগেছিলো রে, কিন্তু সময় তো পাইনি কিছু করার। এত অল্পসময়ে কী আর করা যায় কার জন্যে, এখানে যদি বছর খানেক থাকতাম, আর মেয়েটির জন্য কিছু করার এক বছর সময় পেতাম, তাহলে কিছু একটা করা যেতো। এই মুহুর্তে মেয়েটি অসহায় নয়, অসহায় হয়ে গেলাম আমি নিজে, কিছুই করতে পারলাম না মেয়েটির জন্য। শুক্রবার আসতে আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে, মিল থেকে ৫০০/=টাকা অগ্রীম নিয়ে নিলাম মেয়েটার বিয়ের নিমন্ত্রণে যাওয়ার জন্য। বিয়ের দুদিন আগে বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদাকে বললাম দাদা, ওর বিয়ের শাড়িটা যদি আমি দেই, তাতে কোন সমস্যা হবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন না না কোন সমস্যা হবে না। আমরা তো দশজনের কাছ থেকেই সাহায্য উঠিয়ে মেয়েটাকে পাড় করছি, বিয়ের শাড়ি অন্য একজনে দিবে বলেছিল, তাকে না হয় বলবো অন্য কিছু দিতে। মিল হইতে ৫০০/=টাকা আর ঘরে ছিল ৫০০/=টকার মত, সেই টাকা নিযে নারায়নগঞ্জ শহরের কালীর বাজার হতে ৮৫০/=টাকা দিয়ে একটু বিয়ের শাড়ি কিনে আনলাম। বাড়ির সবাই সেই শাড়িখানা দেখে প্রশংসা করলো, বললো খুব সুন্দর মানাবে মেয়েটাকে। শাড়িখানা এনে আমার মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, মা এই শাড়িখানা আমি এনেছি মেয়ে’টিকে দিবো বলে, তুমি মা কী রাগ করেছো? মা বললেন না রে, আমি আরো খুশিই হয়েছি, ভাল একটা কাজ করেছিস তুই। মা তাড়াতাড়ি করে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, বউমা এই শাড়িখানা আমার ছেলে এনেছে মেয়ে’টিকে দেওয়ার জন্য, আর এই শাড়িই হবে ওর বিয়ের শাড়ি। সাথে সাথে শাড়িখানা নিয়ে মেয়েটিকে দেখালো শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী, বললো দেখতো তোর পছন্দ হয়েছে কিনা! মেয়েটি শাড়িখানা বুকে ধরে অঝরে কাঁদছে।

শুক্রবার বিয়ের দিন, আগের দিন গেল আদিবাস। বিয়ের দিন ভোরবেলা সবাই ঘুমে থাকতেই আমি বাসা থেকে সোজা মিলে চলে যাই। মিলের সামনে চা দোকানে সকালের কিছু হালকা নাস্তা করলাম, চা পান করলাম, ভাল লাগছিলো না। দোকানেই বসে বসে সময় আটটা পর্যন্ত প্রায় তিনকাপ চা সেরে ফেললাম, সকাল আটটা বাজার সাথে সাথে কানাই এসে হাজির আমার সামনে। ও আমাকে বললো আজ আর কাজ করতে পারবো না, চল মহল্লায় যাই, আজ ত এমনিতেই ওভার টাইম, করলে মজুরী পাবো, না করলে মজুরী পাবো না। বললাম ম্যানেজার সাহেব তো রাগ করবে, কানাই বললো চল ছুটি নিয়ে আসি ম্যানেজারের কাছ থেকে। গেলাম ম্যানেজারের কাছে ছুটির জন্য। ম্যানেজার সাহেব ছুটি দিলেন।

সারাদিন কানাইদের বাসায় ঘুমাইলাম, রাত আট ঘটিকার সমর ব্যান্ডপার্টির বাজনার শব্দ, বরযাত্রী হয়তো আসছে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়িতে। রাত এগারটায় বিয়ের লগ্ন নির্ধারণ করা আছে যা যথারীতি হবে। মেয়েটি তখন ছোট একটা বাচ্ছা ছেলেকে পাঠিয়েছে আমাকে খুঁজে বের করে বলতে বাড়িতে আসার জন্য। ছেলেটা আমার খুব আদরের তাই ও আমার ঠিকানাটা জানে যে, আমি কোথায় আছি। ছেলেটা আমার সামনে গিয়ে বললো কাকা তোমাকে দিদি ডাকছে। তুমি আস বাড়িতে, আমার মাও আমাকে খুঁজছে দুপুর থেকে, কোথাও পায়নি। আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে মালা বদল হয়, যা মেয়ে ছেলেকে পড়িয়ে দেয়, আবার ছেলে মেয়েকে পড়িয়ে দেয়। ছেলে এবং মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে করে আলাদা আলাদা করে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার উপরে উঠিয়ে নাচতে থাকে, এর মধ্যেই মালা বদল করা হয়। সেই পিঁড়িটাই আমাকে ধরার জন্য মেয়েটার ইচ্ছা। বর আসলো, বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো, পুরোহিত মহাশয় মালা বদলের অনুমতি দিলেন। মেয়েটাকে সবাই কোলে তুলে আনতে গেলেন, কিন্তু না, মেয়েটি আসছে না কারো সাথে। কী ব্যাপার কেই জানে না মেয়েটি এমন করছে কেন! বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদা, রেগে-বেগে যখন বললো কী ব্যাপার তুমি উঠছো না কেন? উঠো তাড়াতাড়ি করে লগ্ন পাড় হয়ে যাবে। তখন মেয়েটির সোজাসুজি কথা, নিতাই দাদা কোথায়! উনি না আসলে আমি উঠবো না। এই কথা শোনার পর পুরো বাড়িতে তখন হৈ হাল্লা লেগে গেল, আমার মা ভয়ে কাঁপছে, না জানি কী হয় আজকে। সবাই আমাকে খুঁজতে লাগলো, আমি আর কানাই বাসা থেকে একটু দূরে একটা চা দোকানে বসে কথা বলছিলাম, সেখানে আমাকে পেয়েছে সবাই। আমার হাত ধরে জোর করে টেনে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো সবাই, কারণটা জানতে চাইলাম কী ব্যাপার, এত জোরাজুরি কেন? উত্তরে সবাই বললো তোকে ছাড়া বিয়ে হবে না। আসলাম তাদের সাথে, কানাইও আছে পিছনে পিছনে, বাড়িতে আসার পর শ্যামসুন্দর দাদা হেসে দিলে বললো যা’তো তাড়াতাড়ি মেয়ে’টিকে ঘর থেকে বাহির কর, মালা বদল করার জন্য। আমার মাও বললেন যা শিগ্‌গির তাড়াতাড়ি করো। গেলাম মেয়েটার সামনে, আমার পিছনে আরো দশবার জন লোক, আমি সামনে যাওয়ার পরই মেয়েটি উঠে এসে আমাকে ধরে শুধু কাঁদছে হাউমাউ করে, যা দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমিও আর আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না, কাঁদছি সমান তালে ৷ এই দৃশ্য দেখে আমার মাও কাঁদছে, বাড়ির সবাই কাঁদছে আমাদের এই দৃশ্য দেখে, শ্যামসুন্দর দাদাও কেঁদে কেঁদে বললো, আর কী করা বুঝতে পারি নাই আমি, যা হবার হয়েছে এখন বিয়ের আসরে নিয়ে যা, বললো বাড়ির সবাই। আমি কোলে করে ঘরের বাহির করলাম মেয়ে’টিকে মালা বদল করার জন্য, সাথে কানাই আরো অনেকে মেয়ে’টিকে পিঁড়ির উপড় বসিয়ে, মাথার উপর নিয়ে নাচতে লাগলাম। মালা বদল শেষে পিঁড়িখানা পুরোহিতের সামনে বসিয়ে দিলাম, ছেলেকেও বসিয়ে দিলো সামনাসামনি করে। ধান, দূর্বা, ফুল, তুলসী, আর চন্দ্র সূর্যকে সাক্ষী রেখে মেয়ে’টির বিয়ে সম্পাদন হয়ে গেল, আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে, কিন্তু এখনো মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। প্রেম করিনি, শুধু ভাল লেগেছিল, তবু যেন ভুলে থাকা যায় না।

জীবনাদর্শন ও একান্ত ভাবনা

71221

🔷কাজের প্রতিদানই কী ভাগ্য নয়! আমরা যে ভাগ্যে বিশ্বাসী সেই ভাগ্য বলে কিছু আছে কি? আপনি আজ অন্যের সাথে যে ব্যবহার করবেন ঠিক কোনো এক সময়ে আপনার কাছে সেই ব্যবহারটি ফিরে আসবে। আমরা যদি সেই বিশ্বাসটি নিয়ে আরও কিছু চিন্তা করে থাকি তবে আমরা ব্যথাটি অনুভব করতাম না। সুতরাং আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হল নিয়তি হ’ল কর্মের ফল, কাজের প্রতিদান আপনার কাছে আসবে। আমরা যদি আমাদের জায়গা থেকে অন্যের সাথে খাঁটি আচরণ করি তবে বিনিময়ে আপনিও সেই শুদ্ধ আচরণের প্রাপ্য। আমাকে কেবল মনে রাখতে হবে যে আমি যদি এটাই চিন্তা করে জীবনকে আরও সহজ করে তুলতে পারি তবে আমাদের কোনও অনুশোচনার পথ অতিক্রম করতে হয়না।

🔷২. যেমন …
🔷সৌন্দর্যের অহংকার চূর্ণ হয়।
🔷সন্দেহের ঘর সবসময় ভগ্ন।
🔷হতাশার পথ প্রত্যেকটা মুহূর্তে রুদ্ধ।
🔷অধৈর্যের কর্ম ফলাফল সুখকর নয়।
🔷রাগের ফলাফল শূন্য।
🔷বিশ্বাস এর দরুন বিশ্বাস অর্জিত হয়।
🔷ভালবাসার প্রতিদান নৈকট্য লাভ।
🔷শ্রদ্ধার প্রতিদান ভালোবাসা।
🔷অশ্রদ্ধা ও অসম্মানের প্রতিদান লাঞ্ছিত
🔷খারাপ ব্যবহার একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গ জীবন লাভ

🔷৩.
🔷তিরস্কৃত আচরণ আত্মসম্মানহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
এসব কারণে হলেও মানুষকে সংযম শীল হতে হয়
বিবেকের দরজা বন্ধ রেখে যখন আপনি পথ চলবেন তখন আপনার দুনিয়াটা টোটালি অন্য দিকে মোড় নেবে যে জীবন আপনাকে খুব ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে না।

🔷৪.
🔷অতএব, মনকে উদ্যান করুন সেখানে যেন প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য ধরা দেয়। মনকে ময়লার স্তুপ করবেন না। মনে রাখতে হবে আমাদের কলুষিত জীবন কখনো আড়াল করা যায় না। আমাদের জীবন প্রণালীতে যার-যার অবস্থান থেকে যেমন তা যদি আপনি আমি কোনভাবেই আড়াল করতে না পারি তাহলে কি লাভ সে পথে বিচরণ করে।

.
২০.০৮.২০২১ রাত: ৮:৩৫pm.

গৃহিণী (এক)

Photo

শুধু রান্নাবাটি। আর ছুটন্ত ঘোড়া ,কিংবা ফুল- প্রজাপতি ঘরের এখানে ওখানে যেখানে যেমন মানায় ঘড়ির সঙ্গে টিক্ টিক্ করতে করতে। কঠিনপাচ্যের ইংরাজী ফেল। তার বদলে আসান বোনা, রিফু করা, কাঁথা সেলাই। কুরুশ কাঁটায় পুজোর থালার খুঞ্চিপোষও। … কাঁটায় কাঁটায় ঘনিয়ে আসে ঝড়ঝঞ্ঝা – চারপাশে জেগে থাকা বাঁকা নখ। উগলে আসা কালচে রঙা ডলি সুতোর কঠিন পাক – বাদলা দিনের আগুন – আর একলা হলে জ্যোৎস্নায় পোড়া তরকারির গন্ধ।-বুনতে বুনতে নিজেকে ছাড়িয়ে যায় নিজে।

থতমত সর্বদা। যেন শুকনো পাতা হাওয়ার টানে গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যে যাবে বোঝে না! মন – একটা ঝুপসিকোণা দোনামোনা মেঘ।ঝরবে, না কি ঢোঁক গিলে নেবে? কেউ যখন বকে দেয়, টেনে হাওয়ায় একটাও কথা ছুঁড়ে দিতে পারে না। তখনই কথা বলতে গেলে চোখ থেকে ঝরে পড়ে।

কেউ এগিয়ে দেয় নি যত্নের থালা। বরং সবার গ্রীষ্মদিন নিভিয়ে দিয়েছে তেলহলুদ লাগা আঁচলে। এই আর কি! দুঃখসুখের পাঁচমিশেলি গেরস্তবাড়ির বড় বৌ। তবু গৃহিণীরা কিছু বেশি খোঁজে। শুধু চেনে না ‘বেশি’টা কী?

অথচ তারও তো কিশোরীবেলা – ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছুটন্ত ধুলো, আর ফ্রকের কুঁচি খেলেছে হাওয়ার সঙ্গে? এখন পানের তবক মোড়া দুপুরে খোলা চুলে পিঠ ঝাঁপানো রোদ। তবু নিজস্ব আছে কিছু গোপন বাক্সবন্দী।

একদিন মরচে রঙা সুর ভাসানো তোরঙ্গ খুলে পুরোনোর গন্ধ নিলো। বাক্স ভর্তি জল। জলের শয়ানে এক বুড়োর ছবি আর একটা পাথরের হার। ছবি তার বাবার। বুড়ো কোথায় নাকি খাঁচার দাঁড় কেটে চোখ ছানতে গিয়ে এনে দিয়েছিলো তাকে। পাথর থেকে গোলাপি রঙ ঠিকরোচ্ছে। তার আভা যত তার গালে লাগে ততই চোখ থেকে গঙ্গোত্রী গলতে থাকে।

ছবি হাতে নিয়ে সাত চড়ে রা না কাড়া ঠোঁট কুরুশ কাঁটায় কথা বুনতে থাকে একা একা।

.
“বাইফোকালিজম্ এ প্রথম প্রকাশিত”

দুভাবে রাঁধা পশুমাংস

এক
গত বছর ঠিক এই মার্চেই আমার অচেতন শরীর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডঃ কল্যাণ, কার সঙ্গে জানি না, তিনদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ভাসিয়ে তোলেন আমায়। চতুর্থ সকালে বেডের কোনায় বসে গলাটাকে এক্সটেনশান কর্ড বানিয়ে কানের কাছে ফিসফিসানি: কী সমস্যা আপনার, খুলে বলুন তো? খামোখা বিষ খেতে গেছিলেন কেন!

আমি তো মাল্টিস্টোরিড থেকে পড়লাম: বলছেন কী ডাক্তারবাবু! বিষ খাব, পাগল হয়েছি নাকি?

পাঁচ পাটকাঠি-আঙুল নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন: না না, অবসাদ-এর রোগিকে ক্লিনিক্যালি পাগল বলা যাবে না। কিন্তু বোতলের গায়ে ‘পয়জন’ লেখা দেখেও তো আপনি ওটা গলায় ঢেলেছেন?

— হ্যাঁ, ডঃ কল্যাণ, লেখা ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি!
এক্সটেনশান কর্ড এবার স্প্রিংপাত্তির টান খেল: “ক্কী বলছেন! বিষ লেখা, তবুও অবিশ্…!
— কেননা আমি আমার জীবনে যখনই কাউকে বিশ্বাস করেছি, তখনই ঠকেছি।

দুই
আমাদের যত বয়েস বাড়ে, শিখতে থাকি কীভাবে অন্যের ওপর থেকে ভরসা তুলে নিতে হবে, সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়তে হবে কোন সিজিএস-এফপিএস পদ্ধতিতে। এটা আমার ভেতরে এত ছোট ছোট ডোজে চালু হয়েছিল যে শুরুতে ধরতেই পারিনি! এখন তো করার কিছু নেই, সুতরাং “অবিশ্বাস” শব্দটাকে আপগ্রেড করে আমি তার নাম দিয়েছি “অভিজ্ঞতা”। অবিশ্বাস নিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না — না সম্পর্কে, না খেলার মাঠে। মিলন-বিচ্ছেদ সমান যন্ত্রণার মনে হবে, হার-জিত জিভে ঠেকবে দুভাবে রাঁধা একই পশুমাংস। অভিজ্ঞ সে-ই — যে হৃদয়ের সঙ্গে সব যোগাযোগ সফলভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পেরেছে। তাকে এবার কেউ ঠকাক দেখি?

তবু মোপাসাঁর গল্পে মায়ের হৃদপিণ্ডের মতো মাঝে মাঝে মৃত্যুমুখী মনের গলা শুনতে পাই: তুমি প্রতারিত হওয়ার দায়িত্ব অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিজের হাতেই তুলে নিলে বুঝি!

তিন
মানুষের ‘পরে অবিশ্বাসহেতু কেমিস্ট্রির প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া মেনে আমি জিনিস-এর ওপর নিশ্চয়তা রেখেছি। এখন আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট মারুতি জেন আর ব্যাংকের টাকাক’টাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা, প্রত্যেকটা বাড়িই একরকম স্মৃতিসৌধ আর এও খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করি যে জগতে শুধু স্মৃতিতোরণই অমর হওয়ার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত, সম্পর্কের চেয়ে গাড়ি অনেক বেশি নাইলোগ্রিপ। আর টাকা কখনও নিজের ইচ্ছেয় খরচা হয়ে যেতে পারে না। নোট তো মৃত, তাই সে সব সময় আমার মুঠোতেই থাকবে।

চার
আজকাল কোনও মেয়েকে ভালো লেগে গেলে আমি তাকে জিনিস-এ কনভার্ট করার চেষ্টা করি। মানে একটা ভূমিকা দিই, ধরা যাক, বিয়ে করে ফেলতে চাই। তাকে আমার বউয়ের চরিত্র প্রদান করলাম আর কী। প্রেমিক বা প্রেমিকার চেয়ে একজন স্ত্রী অথবা স্বামী অনেক বেশি সলিড ব্যাপার। রাষ্ট্রের আইন, কোর্ট, সবার ওপরে পুলিশ রয়েছে চরিত্রটাকে ঘনত্ব দেওয়ার জন্যে। প্রেমিক যেন অনেকখানি স্বপ্ন, তাই যেইমাত্র কেউ প্রেমে পড়ল, ওমনি বিয়ের চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় — ভালোবাসা কী মারাত্মক ভয়ের বস্তু ভেবে দেখুন! বিয়ে হলে তবেই না আমরা একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধে মেতে উঠব? যে সম্পর্কের কোনও নাম আছে — বাবা-ছেলে, বোন-ভাই, বন্ধু-বান্ধব, সেখানেই এই কাহিনি। কে কাকে সংজ্ঞায়িত করবে, কে কাকে কমিয়ে আনবে, কে প্রভু হবে কে দাস?

পাঁচ
এত কথা মনে পড়ছিল আজ বাসে চেপে পুরোনো হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায়। না, “জেনেশুনে বিষপানের একবছর” পালন করতে আমাকে ডাকেননি কর্তৃপক্ষ। রুটিন চেকআপে যাচ্ছি — ছোটখাটো রক্ত পরীক্ষা, খুব তেমন বুঝলে একটা সাইকোমেট্রি।

ডঃ কল্যাণ বুকে স্টেথো বসিয়ে আচমকা চমকে দিলেন: আপনি আমার কাছে আসার আগে ডঃ সঞ্জয়কে দেখাতেন?

কোথায় সঞ্জয় মানে কেন সঞ্জয়.., ধরা পড়ে আমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে উঠি।

— আমাদের দুই ব্যাচমেটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কেসগুলো নিয়ে এখনও কথাবার্তা হয়। আপনার ব্যাপারে খুব দরকারি ইনপুট দিল, অথচ নিজে পুরোটা চেপে গেছেন!

কল্যাণ এবার স্টেথো রেখে নাকের সামনে মেটে-হাতুড়ি উঁচু করলেন: আপনার জীবনে গত কুড়ি বছর একটা স্টেডি প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, এদিকে লোকজনকে বলে বেড়ান আমি নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে ডিপ্রেশানের শিকার হয়েছি। ছিঃ!
— যাব্বাবা! বিশ্বাস করুন, এসব গুজব একেবারেই ভিত্তিহীন।
— আপনার মুখে বিশ্বাসের কথা!
একেফর্টিসেভেন হাসি সাতচল্লিশ সেকেন্ড ব্রাশ ফায়ারিং করার পর ডাক্তার আবার গলা এগিয়ে দিলেন আমার চোখের কর্নিয়ার কাছাকাছি: আরন্ট ইউ ইন লাভ উইথ ইওর আমব্রেলা?

ছয়
— হ্যাঁ, আমি ছাতা পছন্দ করি। ওর শ্যামা রঙ আমাকে মায়ের কথা মনে পড়ায়। মা সব সময় মুখনাড়া দিত, কী ছাতামাথা লিখিস! শেষ পর্যন্ত সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল, দেখুন! ও আমার জন্যে অনেক কিছু করেছে, আর আমি দুহাত পেতে নিয়েই গেলাম। আমি হারিয়ে না ফেললে ছেড়েও যায়নি কোনওদিন। আই রেসপেক্ট মাই আমব্রেলা, রোদবৃষ্টি শুধু নয়, ঝড় বা খুব গভীর জ্যোৎস্নাতেও ওর সঙ্গ ভালো লাগে আমার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি ছাতার প্রেমে পড়েছি, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।

মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। সৃষ্টি মানে কি উন্মোচন নয়, ক্রমাগত নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া? সত্যি থেকে সরে আসতে থাকা চাঁদের কলাক্ষয়ের মতো, আর তাই মনের অসুখ? চিকিৎসা মানে নিজেকে না-জেনেও জয়েসের উপন্যাসে স্টিফেন ডিডালাসের মতো হিমঠান্ডা স্বীকারোক্তিবাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো! দুরারোগ্য একা…

(পুরোনো পোস্ট)

কোরবানি

25436_n

অনেক শখের কেনা গোরু
গায়ের রঙ তার সাদা,
আদর করি যত্নও করি
লাগতে দেই না কাদা।

বিধান আছে কোরবানি দিতে
লাগবে নিজের পরিশ্রমের অর্থ,
নাহয় লাগবে নিয়ত সঠিক
এটাই বিধান কোরবানির শর্ত।

দুর্নীতির টাকা, সুদের টাকায়
কোরবানি দেওয়া যাবে না,
যদিও দেয় গায়ের জোরে
তার কোরবানি কবুল হবে না।

কোরবানি দাও মনের পশু
মনে জিইয়ে রাখা শয়তানি,
নিজ মনে শয়তান পুষে
করো না পশু কোরবানি।

.
প্রিয় বন্ধুগণ, আমি হিন্দু।
ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।