বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

হাবিজাবি লেখা – ১০

তবু শুকতারা পার হলে আমিও ঘাসে ঘাসে নিহারিত পা,
বেহদ্দ ক্লান্তির পোশাক খুলে নদীতে ডুবি, যেন তেষ্টাপূরণ জল –
আদিগন্তময় নিজেকেই ছড়িয়ে বলি, আঃ! জীবন –

এভাবেই প্রথাগত ভালোবাসা লেখার পর যদি ঘৃণার খোলা করতল রাখি –
তবে আর কীসের জয় পরাজয়?

অথচ আমাদের জীবনে প্রেম আছে, আছে পরকীয়া ও স্বকীয়ার দীর্ণ কিংবা দীপ্ত ঘোষণা ;

আমাদের রাতজাগা তারা আছে, আমাদের আছে ইলিশের ল্যাজা মুড়ো চাখা অষ্টপ্রহরের সংকীর্তন…

বাতাসে বাতাসে বয়ে যাওয়া বিকট উদ্গার

কিশোরের ক্ষয়ে যাওয়া আঙুলে দেগে দেওয়া অক্ষয় নীলকালি আছে

রেডলাইট এরিয়ায় একদা কিশোরীর মরা স্বপ্নের হাঁ-করা মুখে ভনভনে মাছি আছে

সেই ঝাঁকের একটা মাছি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা বরাবর সহস্রাক্ষ

ঘুরিয়ে চলেছে —

ঘুরিয়েই চলেছে

আমাদের হৃদয়ের মহামারীতে মরা সব বাসি কবিতার ভেতর

আহা সেইসব দিন

দূরত্ব এতোটাই বেড়ে গেছে যে
আমাদের মাঝে শোভাবর্ধন করছে মৃত্যুফাঁদ
অথচ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে অন্য কথা
ধূলোমাখা সেইসব অতীতের দিন, নিরেট মৃত্যু ঘ্রাণ
সাঁতরে গেছি কৈশোর বয়োঃসন্ধিকাল
আহ যৌবনের নগ্নতা! প্রহসনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল আমায়।

এমন কতো বিরুদ্ধ স্রোত চলে গেছে
জন্মের ফাঁদে আটকে গেছে যাযাবর জীবন
ফিনফিনে দুঃখ দ্বারা ভরেছি লাভের ব্যাগ
আলতো ছোঁয়ায় এঁকেছি যে দেহের ছবি
সেতো ছিল এক ভুলের ক্যানভাস
লাটিমের মতো ঘুরে ঘুরে শুধুই বাড়িয়েছি পথের দেনা
রাতের জরায়ুতে লেগে থাকে মাতৃত্বের ঘ্রাণ।

আহ্ গোপন উল্লাস
পেঁচার চোখ নিয়ে একপাশে পড়ে থাকে ক্ষুধা
আর একপাশে পড়ে থাকে শিল্পকলার মুগ্ধবোধ
অনিবার্য টানে মাঝেমধ্যে ছুটে যাই যুবতী আকাশ পানে
যেনো শঙ্খডানার চিল।

স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা

01

03

04

05

আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। ছোটো বেলায় নানা রকম স্বপ্ন দেখতাম। কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, কিছু ভুলে গেছি। নানা রকম উদ্ভট ইচ্ছেও ছিলো, যেমন ছোটো বেলায় গুলি খেলতাম আর সেইসব রংবেরঙের গুলি জমাতাম। বাক্স ভর্তি থাকতো নানা রঙের কাচের গুলিতে।

আজ দুটো স্বপ্নের কথা বলি – উস্তাদ জাকির হুসেনের তবলা ভীষণ পছন্দ করতাম, না না ক্ল্যাসিকাল গান বাজনা অতো বুঝি না, ভালো লাগতো জাকির হুসেনকে, তাঁর চুল যেভাবে উড়তো ওই “বাহ্ তাজ বলিয়ে” বিজ্ঞাপনে, কেমন একটা ক্রাশ ক্রাশ অনুভব করতাম। স্বপ্ন ছিলো যদি কখনও তাঁকে সামনাসামনি দেখি। স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেছিলো, ভুলেও গিয়েছিলাম সেই ছোটবেলার স্বপ্ন। জীবনের নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বহু বছর কেটে গেছে। জীবন ট্র্যাকে দৌড়ে চলেছি। ততদিনে মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। একদিন কলেজ থেকে ফিরেছে, আমিও পড়িয়ে বাড়ি ফিরেছি, রাতের খাবার খেতে খেতে মেয়ে বললো – “শিশির মঞ্চে ওস্তাদ জাকির হুসেন আর পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের যুগলবন্দী হতে চলেছে, দেখতে যাবে?” আহা! সেই ছোটো বেলার স্বপ্ন যেন সামনে এসে দাঁড়ালো, মেয়েকে পরের দিন বললাম একেবারে সামনের সারির টিকিট কেটে আনিস। সেইদিন খুব কাছ থেকে দেখলাম ছোটো বেলার স্বপ্ন ওস্তাদ জাকির হুসেনকে।

আরও একটি স্বপ্নের কথা বলি – উস্তাদ আমজাদ আলি খান যখনই টিভির পর্দায় আসতেন মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, তাঁর শান্ত, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগতো। ইচ্ছে ছিলো যদি কখনও সামনে বসে ওনার সরোদ বাজানো শুনতে / দেখতে পারি! সেই ইচ্ছে বা স্বপ্নও পূর্ণ হয়েছিল হঠাৎই। দৈনিক পত্রিকা টেলিগ্রাফে একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম যে তারা একটি অনুষ্ঠান করতে চলেছেন যেখানে পণ্ডিত নয়ন ঘোষ, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকছেন আমার সেই স্বপ্নের মানুষ উস্তাদ আমজাদ আলি খান। টিকিট পাওয়া যাচ্ছে মেলোডিতে। রাতে বাড়ি ফেরার পথে মেলডি থেকে টিকিট সংগ্রহ করে নিলাম। তারপর খুব মন দিয়ে দেখলাম আমার সেই স্বপ্নের মানুষকে।

আহা! সব স্বপ্ন যদি এভাবে সত্যি হতো!

ভালোবাসা, ভালো বাসা

325r

আমি চিরকাল গান পাগল মানুষ। কিশোরী বয়সে কোনও কোনও সুর চোখ ভেজাতো। তারপর নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, পলি পড়েছে। থমকে থেকেছে মন। অনেক ওঠা পড়ার পর পুরোনো আমি বদল হয়েও কোন এক ভোরে পুরোনো কোনো সুর আজও একই রকম ভিজিয়ে দেয় চোখ মন, তখন মনে হয় কোথাও কোনোখানে লুকিয়ে থেকে গেছে এক চিলতে আমার না বদলে যাওয়া আকাশ। চোখ বন্ধ করলেই ফিরে আসে না-ফেরত আসা সময়। অন্য রকম হয়ে যায় দিন।

এইসব দিনের জন্য, সেই এক চিলতে না বদলে যাওয়া আমির জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নতুন করে। বারেবারে ফিরে আসে ভালোবাসা এ শহরের আনাচ কানাচ ধরে, পাখির ডানায় ভর করে। অযত্নে বেড়ে ওঠা জংলা গাছেদের পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে।

ভালোবেসো ভালোবাসা।

একটা বাড়ি ছিলো মনের অলিন্দে। সে বাড়িটার কোনো ছবি ছিলো না আজও নেই। শুধু অনেক ভালোবাসার খনি আঁকড়ে জড়িয়ে আছে সেই বাড়িটার সবখানে। উঠোন, ছাদ, বাগান, জানলায়, চিলেকোঠায়, সবখানে জমে আছে পরতে পরতে ভালোবাসা। ঠিক যেন রোদে শুকোতে দেওয়া মায়ের টক মিষ্টি আচারের মতো। সেই বাড়িটা যত্ন করে রেখে দিই মনের গোপন দেরাজে।

সেই বাড়িরটার বড্ড মন কেমন কেমন গন্ধ। দাদুর তৈরি মিঠে পানের মতোই মন কেমন গন্ধ। কোন কোন শীত শীত ভোরে ভালোবাসার টানে এ শহর উড়িয়ে আনে শীতের পরিযায়ী পাখি, ঘুম ভেঙে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আনমনা মন।

ভালো থেকো ভালো বাসা।

কবিবৃক্ষ- ৩ (স্বাধীনতা)

32

ভাবছি কৃষক হবো,
তপ্ত আর শুষ্ক মরুর বুকে সবুজ শস্যের দোল খেলাবো
কৃষাণীর আঁচল তলে লবন পান্তা ভাত খাবো।

অতঃপর,
ছোট্ট একটা মুদির দোকান হবে, সময়ানুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবো
পিতা-মাতা, ভাই-ভাতিজা আর স্ত্রী-সন্তানদের একটু সময় দিবো…

প্রকৃত কথা হলো স্বাধীনতা বলতে পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই
আমরা যা দেখছি, যা ভাবছি তা সবটাই মিছে; স্বাধীন হয় দেশ, স্বাধীনতা পায় দেশ ও দশে;
যেখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় সেখানে স্বাধীনতা থাকে না…

স্বাধীনতার সংজ্ঞা জলের মতো…
ভিন্নভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সংজ্ঞাও পরিবর্তন হয়
কর্ম স্বাধীনতা বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই, কর্ম করতে হবেই;
ধর্মে যেমন স্বাধীনতা নেই, ঠিক তেমন-ই;
ভেবে দেখুন, সেই ধর্ম পালনে পরিতৃপ্ততা আছে, আছে শান্তি
স্বাধীনতা তো সেটাই…
যেমন স্বাধীন কবি ও কবিবৃক্ষ
এসো কবি হই, স্ব-স্ব ধর্মে শান্তিকে করি আলিঙ্গন।

ফুলকপি (বড়দের গল্প) /পর্ব-২

প্রায় তিন যুগ আগের কথা, “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম” গান আর “আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে” শ্লোগানে ক্ষমতাসীন এরশাদ ও তার অনুসারীরা দশদিক মুখরিত করে রেখেছে। এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এশীয় কবিতা উৎসব আয়োজিত হচ্ছে। একদল শক্তিমান কবি এরশাদকে ঘিরে রয়েছে। এরশাদও কবি, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তার কবিতা ছাপা হয়। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তৃতীয় জাতীয় সংসদের আয়ু অকালে ফুরিয়ে এসেছে। তবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান হিসেবে এরশাদ বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় রয়েছে। তার পকেটে ঢুকে পড়া জাসদ (সিরাজ), ফ্রিডম পার্টি আর গুরুত্বহীন বামপন্থীদলসহ কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের জোট সম্মিলিত বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যদিও সবাই জানে ভোট হোক বা না হোক ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিই জিতবে।

অপরদিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার স্মৃতি টাটকা থাকায় শেখ হাসিনা কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছেন। বিধবা গৃহবধূ থেকে খালেদা জিয়া জাতীয় নেত্রী হয়ে উঠেছেন। দুই নেত্রীর নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন চলছে। যে সব্যসাচী লেখক এরশাদকে পল্লীবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, তিনিও পক্ষ বদল করেছেন। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আর একুশে বইমেলার স্টল থেকে ভেসে আসে আলী যাকেরের উদাত্ত আবৃত্তি “জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।” এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের কিছুই কৃষি কামলা বজলুকে স্পর্শ করে নাই। কার্তিকের মঙ্গায় একটানা সাত দিন কলাগাছের কান্ড সেদ্ধ খেয়ে আর সহ্য করতে পারে নাই। এক মুঠো ভাতের আশায় রংপুরের এক গ্রাম থেকে বজলু রাজধানীর পথে পা বাড়িয়েছিল। সাথে ছিলো বউ আর ওবায়দুলসহ চার সন্তান।

চিরদিনের জন্য গ্রাম ছাড়তে বজলুর বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নাই। পিছুটানের মায়া তাড়া করে নাই। তার কোনো কৃষি জমি ছিল না। নিজ হাতে বানানো একচালা খড়ের ঘরে বউ আর চার সন্তান নিয়ে থাকতো। ওই জমিও নিজের নয়। নিজের বলতে ছিল সীমাহীন অভাব, তীব্র ক্ষুধা আর একপাল গরীব আত্মীয় ও স্বজন। এসবের প্রতি কে’ই বা পিছুটান অনুভব করে! তীব্র ক্ষুধা আর যাত্রাপথে রংপুর শহরে লাগানো সোডিয়াম বাতির অদ্ভূত আলো দেখার বিস্ময় নিয়ে পরিবারসহ আরও অনেকের সাথে বজলুরা ঢাকা শহরে এসেছিল। শহরের রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিল। সবচে বিস্মিত হয়েছিল তেল ছাড়া বাত্তি জ্বলা এই শহরে সারাদেশ থেকেই বহু গরীব এসেছে এবং আসছে দেখে।

রাজধানী ঢাকার চরিত্রে একটা নির্লিপ্ত আভিজাত্য বা অহঙ্কার রয়েছে। এ শহর গরীবদের সাড়ম্বরে স্বাগত জানায় না। দূর দূর করে তাড়িয়েও দেয় না। অনারোগ্য অসুখের মত মেনে নেয়। তিলে তিলে বুঝিয়ে দেয় তাদের দায়িত্ব শহরের করুণা ও দয়ায় নির্ভর করে বাঁচার চেষ্টা করা। চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সন্তুষ্ট থাকা। স্বাধীন রাষ্ট্রে সম্পদের সুষম বন্টনের দাবী তোলা নয়। কাজের খোঁজে চার পাঁচ দিন এলোমেলো ঘুরার সময়ে বজলু নিজের মত করে বিষয়টা বুঝে নিয়েছিল।

স্ব-পরিবার নিয়ে দশ/বারো দিন কমলাপুর রেলস্টেশনের মালগাড়ির প্ল্যাটফর্মে কাটানোর পর এক দেশী ভায়ের হাত ধরে বজলু পরিবারসহ কাওরান বাজার রেল বস্তিতে আশ্রয় পায়। পাঁচ হাত বাই ছয় হাত সাইজের একটামাত্র ঝুপড়ি ঘরে ছয়জন মানুষের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়। আরেক ভায়ের কল্যাণে বজলু একটা মজবুত বড় টুকরি কিনে কাওরান বাজারে কুলির দলে নাম লেখায়।

বড় ছেলে হাফিজুলের বয়স পনেরো বছর। মেজো ছেলে মফিজুল এক বছরের ছোট। তাদের ভাগ্য ভাল। কাওরান বাজারের এক হোটেলে চাকরী জুটিয়ে নিতে পারে। দায়িত্ব অতি সহজ – সারাদিন কল থেকে পানি টানা। প্লেট, বাটি, জগ ও হাড়িপাতিল ধোয়া। টেবিল পরিস্কার করা। হোটেল ঝাড়ু দেওয়া। সামান্য ভুলে মালিক, ম্যানেজার বা কাস্টমারের হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া এবং বিনা প্রতিবাদে হজম করা। কার্লমার্ক্স পড়া নাই বলে ‘পেটে ভাতে’ বেতনপ্রথাও তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। একটানা ষোল সতেরো ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে তারা দৈনিক দুই বেলা ভাত খেতে পাবে। কখনো লবণ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে ডলে খাবে। কখনো তরকারির ঝোলের সাথে এক আধ টুকরা আলু আর ভেঙে যাওয়া মাছের কাঁটা। কোনো কোনো দিন মিলে যাবে অমৃতের মত কাস্টমারের এঁটো ভাত। পরিমাণে বেশী হলে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারবে। ভাতের জন্য যারা রাজধানীতে আসে, রাজধানী তাদের বিমুখ করে না।

ভোরের আলো ফোটার আগে বজলু ও দুই ছেলে কাজে চলে যায়। ময়মুনা আর ওবায়দুল ঘুমায়। বজলুর বউ সবিরা বসে থাকে। অস্ফুট স্বরে বিলাপ করে কাঁদে। তার মোটা ঠোঁট আর ভাঙা গ্রীবা তিরতির করে কাঁপে। বোঁচা নাকের পাটি ফুলে উঠে। সবিরার একটা মাত্র শাড়ি। আমপাতা রঙ জমিনে খয়েরি পাড়। টেনেটুনে আট হাত হবে। রং জ্বলে তার ত্বকের মত খসখসে কালচে হয়ে গেছে। সে ছেড়া আঁচলে চোখ মুছে, নাক মুছে। সবিরা নতুন শাড়ির জন্য কাঁদে না। আধা উদোম অবস্থায় শরীরের শাড়ি শরীরে শুকানোর দুর্ভাগ্যের প্রতি অভিসম্পাত করেও অশ্রু বিসর্জন করে না। তাকে কাঁদায় ছেড়ে আসা মহিষমুড়ি গ্রাম- নিজের গ্রামে ফেরার আকুতি এবং ‘আর কোনোদিনও ফেরা হবে না’র মত নির্মম সত্য মিলেমিশে তাকে কাঁদায়। কান্নার বেগ থিতিয়ে এলে প্রত্যেকদিন ঝুপড়ি ঘর কাঁপিয়ে হুইসেল দিতে দিতে একটা যাত্রীবোঝাই ট্রেন খুব ধীর গতিতে কমলাপুর স্টেশনের দিকে যায়।

বেলা বাড়ে। রোদ উঠে। সবিরা পানি আনতে যায়। বস্তির কলপাড়ায় ঝগড়া করে পানির অধিকার আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নাই। প্রতিদিন কেউ না কেউ দয়া করে কলসিতে পানি ভড়ার জন্য তাকে কল ছেড়ে দেয়। সে পানি নিয়ে ঘরে ফিরে। ফিরার পথে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে না। মহিষমুড়ি নয়, দীর্ঘশ্বাসের কারণ আসন্ন বাস্তবতা। অভাবী সংসারে ভাঙনের শুরুটা এত মোলায়েমভাবে হয় যে সবার পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয় না। তবে মেয়েরা বুঝতে পারে। সংসারে ভাঙনের বীজ বুনা হয়ে গেছে। বুঝতে পারলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া সবিরার করার কিছু নাই। সে দীর্ঘশ্বাসই ফেলে যায়। সে বুঝতে পারছে সংসারের সবাই একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। একই শহরে থাকলেও তারা পরস্পরের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। কে কোথায় থাকবে কে জানে! ফিরে ঘরে ময়মুনা আর ওবায়দুলকে দেখতে পায় না। খুঁজেও না। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। সে বাজার নিয়ে ফিরলে পেটের আগুন নিভাতে চুলার আগুন জ্বালাবে।

বজলুর একমাত্র মেয়ে ময়মুনার বয়স বারো হলেও অপুষ্টির কারণে তাকে দশ বছর বয়সী ওবায়দুলের থেকেও ছোট মনে হয়। ময়মুনাও সম্ভবত ওবায়দুলের ছোট হয়েই থাকতে চায়। ওবায়দুলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায় যেনো ওবায়দুল ওর মুরুব্বী। বস্তির অন্য কিশোর-কিশোরীদের মত তাদের জীবনেও সকালের নাস্তা নামক কোনো বস্তুর উপস্থিতি নাই। মা পানি আনতে গেলে ভাইবোন মিলে বেরিয়ে পড়ে। নাস্তার আবশ্যিকতা তাদের আটকে রাখতে পারে না। পেট ভরা ক্ষুধা এবং মন ভরা আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খুব বেশী দূরে তারা যায় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তারা রেলবস্তি হতে সামান্য দূরের অদ্ভুত জগত দেখে। তারা ওই জগত দেখে হাসে। ওই জগতের মানুষের মুখের ভাষা শুনে হাসে। তাদের কাজ কারবার দেখে হাসে। পোশাক দেখে হাসে। স্কুলে যাওয়া হাফপ্যান্ট আর স্কার্ট পড়া সমবয়সী শিশুদের দেখে বিস্মিত হয় এবং হাসে। ক্ষুধার জ্বালায় যে তারা ত্যাক্ত হয় না এমন নয়। ত্যাক্ত হলেও খাওয়া মিলবে না এই চরম সত্য জেনে যাওয়ায় ত্যাক্ত হয়েও হাসে।

কিছুদিন পর বস্তিতে নির্বাচনের ক্যাম্প বসে। ক্যাম্পে সারাদিন গান বাজে “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম।” গানের অর্থ না বুঝলেও বস্তিবাসীর এই গান মুখস্থ হয়ে যায়। এই গানের প্রতি বজলু বিশেষ ধরণের মায়া অনুভব করে। সে শুনেছে এই গানটা প্রেসিডেন্ট এরশাদ লিখেছে। প্রেসিডেন্ট মানে দেশের রাজা। বজলু গুনগুনিয়ে গানটা গায়, বেশ গর্বের সাথে বলে, “আজা হামার অমপুরের ছাওয়াল, বাহে। আজায় গান ন্যাকছে..।” তার এই গর্ব অন্যরা উপভোগ করলেও নিজের ঘরে বলে শান্তি পায় না। সবিরা মুখ ঝামটা দিয়ে গজগজ করে, “হাগার থাকি ঢ্যাড়ঢ্যাড়ি বেশী। পাচাত নাই ত্যানা, ভাসুরে বাজায়ই ব্যানা। পুঁটকিত নাই চাম, আদা কৃষ্ণ নাম।”

নির্বাচনী ক্যাম্পের আশপাশে ওবায়দুল আর মায়মুনা ঘুরঘুর করে। রোজ মিছিল হয়। মিছিলের সাথে গেলে ওবায়দুল এক টাকা পায়। মায়মুনা কোনো টাকা পায় না। উপার্জিত টাকায় কখনো মোয়া কখনো আচার কিনে সমান ভাগ করে খায়। এক একদিন মায়ের জন্যও নিয়ে যায়। নির্বাচন শেষ হয়ে যায়। আবার সব আগের মত। পাঁচ মাস পরে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। বন্যার প্রথম দিকে কাওরান বাজারের রেল বস্তিতে পানি না উঠলেও বজলুর পরিবারে শোক নেমে আসে। ডায়রিয়া আক্রান্ত ময়মুনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় সকাল থেকে পড়েছিল। নিস্তেজ হতে হতে সন্ধ্যায় মারা যায়। ময়মুনা সারাদিনে কোনো চিকিৎসা না পেলেও তড়িত গতিতে ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছিল। মায়মুনা কখনো ওবায়দুলের থেকে বড় হতে চায়নি, এখন সে সকল চাওয়া ও না চাওয়ার বৃত্তের বাইরে চলে গেছে।

ময়মুনার মৃত্যু ওবায়দুলকে একা করে দেয়। বাবা আর বড় দুই ভাই প্রতিদিন আগের মত কাজে চলে যায়। ফার্মগেটের দুই মেসে মা রান্নার কাজ করে। পরিবারে একমাত্র বেকার ওবায়দুল। মন চাইলে ঘরে শুয়ে থাকে। মন চাইলে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। তাকে কেউ কাজের কথা বলে না। শহরে মিছিল হয়। মাঝে মাঝে হরতাল হয়। হরতালের দিন ওবায়দুল হাঁটতে হাঁটতে কাওরান বাজার বা তেজগাঁও মোড়ে যায়। পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে ভালো লাগে। আরও পরে, নব্বই সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে দু’বার ককটেল ফুটিয়েছিল। নেতা নগদ দশ টাকা করে মজুরী দিয়েছিল। বয়স কম বলেই হয় তো দশ টাকা উপার্জনের আনন্দ ওবায়দুলের কাছে বোন হারানোর শোক ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে নাই। দু’টা পাঁচ টাকার নোট মুঠোয় পুড়ে ময়মুনার অভাব বোধ করছিল। খুব কান্না পাচ্ছিলো, বুক চুরমার করা অবর্ননীয় কষ্টের কান্না।

ফার্মগেটের মেসে মা’র বেশী দিন কাজ করা হয় নাই। একদিন কাজ থেকে ফিরে খুব গোমড়া হয়ে রইলেন। তিন চারবার গোছল করলেন। পরদিন ভোর হবার আগে বাবা আর বড় দুই ভাই কাজে চলে গেলে ওবায়দুলকে ধরে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওবায়দুলের ঘুম গাঢ় হয়ে এলো। প্রতিদিনের মত পানি আনতে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না। তুমুল চেঁচামেচিতে ওবায়দুলের ঘুম ভাঙলো। জেগে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। একজন তাকে জোড় করে টানতে টানতে এনে ঠেলে রেল লাইন ঘিরে থাকা জটলার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সে দেখলো ট্রেনের চাকায় পিষ্ট একটা নারী শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কেউ তাকে বলে নাই, তবু সে বুঝতে পারলো এটা মায়ের শরীর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত, মাংস, চর্বি, হাড় আর ঘিলু দেখে মায়ের জন্য কান্নার পরিবর্তে তার বমি পেলো। মায়ের আত্মহত্যার পর কিছু ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো – বাবা আবার বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল। দুই ভাই কাওরান বাজারের রেল বস্তির ঘর ছেড়ে আগাওগাঁও বিএনপি বস্তিতে চলে গেল। বিশাল এই দুনিয়ায় ওবায়দুলের আর কেউ রইলো না, সে একা হয়ে গেলো।

কাওরান বাজারে ওবায়দুল বহুবার ঢুকেছে। বারো বছর বয়সে প্রথমবারের মত ঢুকলো কাজের সন্ধানে। মুরগি পট্টির গন্ধ সহ্য করতে না পারলেও কিছু দিন মুরগি জবাই ও নাড়িভুড়ি পরিস্কারের কাজ করলো। এরপর সবজীর ব্যবসা বেছে নিলো। পোকায় ধরা ও পঁচা সবজি টুকিয়ে ও কিনে , পঁচা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ভালো অংশটা ছালায় সাজিয়ে বিক্রি করতো। তিন দশক পরে এসে একই বাজারে তার দুইটা পাইকারী আলু বিক্রির দোকান। মাঝে কেটে গেছে প্রায় বত্রিশ বছর।

তিন দশকে ওবায়দুল নিজেকে, নিজের পরিবার আর ঢাকা শহরকে বদলে যেতে দেখেছে। কাওরান বাজরও পরিবর্তনের বাইরে থাকে নাই। নাম বদলে হয়েছে কারওয়ান বাজার। ওবায়দুলের চোখে এই পয়ত্রিশ বছরে কারওয়ান বাজারে জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাংবাদিকের সংখ্যা। এদের অনেকে এক কেজি আলু বা এক’শ গ্রাম কাঁচামরিচও পাইকারি দরে কিনার জন্য তোলপাড় করে। ফকিরাপুল হতে প্রকাশিত আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার সবুজ ভাই এমনই এক সাংবাদিক এবং ওবায়দুল তার কাছে হাতে-নাতে ধরা খেয়েছে। ঘটনার নায়ক বা খলনায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যান্টিনের ম্যানেজার জাফর নিরাপদে থাকলেও ওবায়দুলের দুঃসহ সময় কাটছে।

(চলবে)

আলোমাখা ভোর

32

ভোর চলে যেতে যেতে রেখে যায় চড়ুইদের ধূলোবালি স্নান, শালিক সংসার, কাকেদের কনসার্ট, স্কুল বাস, চায়ের দোকানের উনুনের উপচে পড়া কয়লামাখা ধোঁয়া। এ সব কিছু পেরিয়ে এগিয়ে চলে রোদ পরতে পরতে, যত দূর দেখা যায়, তার থেকেও দূরে। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শীত শেষে বসন্ত দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে উঠোন জুড়ে ঝরে পড়ে ঈশ্বরময় গন্ধ। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শৈশব জুড়ে বসে থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসার ওম। আর এক আকাশ, কোটি কোটি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রূপকথা। মন খুঁজে নেয় আনন্দ আর বেঁচে থাকার রসদ।

ততদিন বিষাদ ফিরে আসিস না তুই।

মহাজনের গদি

318

ইহা এক মহাজনি দোকান
যেনো তেনো মহাজনি না
এখানে
আদর্শের তাকিয়া কে
পাপোশ বানাইয়া যতো খুশি পদদলিত করা হোক না কেন-
মহাজন সর্বদাই শির উঁচু করিয়া
খাড়াইয়া খাড়াইয়া মুত্র ত্যাগের অধিকার রাখেন!..
এবং কি অমৃত অমৃত জিকির তুলে
সেই মূত্র গিলে গিলে
যে কেউই হতে পারে হৃষ্টপুষ্ট!..
চোখের লাজ খুলে
বিবেকের বিচার ভুলে
চলছে
নেড়ী কুত্তার প্রকাশ্য সঙ্গম!
শত সহস্র নীতির মালা ছিন্ন করে
নির্বিচারে জন্ম নিচ্ছে বোধ শূণ্য প্রজন্ম…
যেভাবে
চোরে শুনেনা ধর্মের কাহিনী
যেভাবে
একে একে স্তব্ধ হচ্ছে পৃথিবীর সুষম ইতিহাস
স্তব্ধ হচ্ছে যাবতীয় নিয়ম-নখর
উত্তাপ বাড়ছে প্রখর রৌদ্রে
বুকে অনন্ত তিয়াস!…

আহা মহাজনি
যাহা
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে
দালালি ধর্ম মেনে মেখে চকচকে তৈলাক্ত তোষামোদ তৈরির নির্ভর যোগ্য কারখানা!
“পয়সা ফেকো
তামাশা দেখো’
নীতি তে লাভ লোকসান হিসাব করা হয়।
ইহা আমুদে প্রমুদে
লালু সালু
গোল আলু প্রকৃতির সকল তরকারির উপযোগ্য!
ইহা ব্যবহার কারীরা
দিনে দিনে
সারাদেশে যত্রতত্র
বুর্জোয়া বীজ অবিরাম যাচ্ছে বুনে…
যাতে
ক্ষণে ক্ষণে পয়দা হয় নিত্যনতুন ভোক্তা দাশ
তক্তার গায়ে তক্তা ঠেকিয়ে
যেমন করে বোনা হয় বৃক্ষের সর্বনাশ!..
জ্বী হুজুর
জ্বী হুজুর প্রীতির মদন মন্থনে
এইখানে গড়া হয় মাটির পুতুল
কড়ির জোরে
খুটি গেড়ে
উড়ানো ঘুড়ির লাটাই নিশ্চিন্তে বেধে রাখতে পারে
ঘুড়ি নড়িবে না এক চুল!..

ফুলকপি (বড়দের গল্প)

‘ফুলকপি’ বড়দের গল্প। আয়তনেও বড়, নভেলা বলা যায়। গল্পটা টাইমলাইনে শেয়ার করার আগে কিছু বলা দরকার- এখন একটানা তিন চার লাইনের বেশী লিখতে পারি না, চোখে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। চোখের চাপ ছড়িয়ে যায় মাথায়। ছাইপাশ বা অখাদ্য যাই লিখি, হিরো আলমের গানের এসব লেখারও কিছু পাঠক আছেন। এদের অনেকে নতুন লিখার জন্য তাগাদা দেন- হাসিমুখে এড়িয়ে যাই। তবে Asif Iqbal-এর নিয়মিত তাগাদা – “তুমি কিন্তু ক’মাস ধরে তেমন কিছুই লিখছো না, কিছু লিখ। মনসুখিয়া বা গল্প- যা হোক লিখ।” ওকে বলা হয় না, “লিখতে তো চাই, কিন্তু পারি না।” শেষ পর্যন্ত ঘরবন্দী অবস্থায় ভয়েজ টাইপিং’য়ে ধীরে ধীরে “ফুলকপি” গল্পটা লেখা হলো, প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ। খসড়াটা কথাসাহিত্য ডটকমে প্রকাশ করেছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে এডিট করতে গিয়ে আকার আরও বড় হলো। বড়দের বড়গল্প ‘ফুপকপি’ ভালো না খারাপ সে প্রশ্ন যৌক্তিক, তবে বাংলায় বাটারফ্লাই ইফেক্ট প্রভাবিত এই ধরণের পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লেখার সংখ্যা খুবই কম, হয় তো আগে লেখাই হয়নি, কেউ লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নাই।
আজ ফুলকপি গল্পের প্রথম পর্ব শেয়ার করলাম-

ফুলকপি (বড়দের গল্প)
ফুলকপি (বড়দের গল্প/ফাইনাল)

১.
ফুলকপি দু’টা কি করবে – দ্বিধাগ্রস্ত হানিফ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। প্রতিদিন ভোর ৫টার মধ্যে তার দোকানদারি শেষ হয়ে যায়। আজ সোয়া চারটার মধ্যে দু’টা বাদে সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। লাভসহ চালান উঠে এসেছে। এখন ভোর পৌনে ছ’টা, ফুলকপি নিয়ে বিভ্রান্ত হানিফ দাঁড়িয়ে আছে।

হানিফ মাঝরাতে কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে ঠিকায় দু’শ ফুলকপি আর এক’শ বাঁধা কপি কিনে। খুচরা বাজারে নিজের দোকানে সাইজ অনুযায়ী সাজায়। ক্রেতার চাহিদার পরিমাণ অনুযায়ী সাইজ ভেদে পাইকারি ও খুচরা দামে বিক্রি করে। এই কৌশলে তুলনামূলক বেশী লাভ হয়। বর্তমানে ফ্যাশন অনুসারে হানিফকে সবজী উদ্যোক্তা বলা যায়, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সী হানিফ পঁচিশ বছর ধরে একই কৌশলে ব্যবসা করে আসছে।

অবিক্রীত ফুলকপি জোড়া হানিফের মনে বাবার স্মৃতি জাগিয়ে তুলে। বাবা বেঁচে থাকতে ধমক খাওয়া ছাড়া হানিফকে কোনো কিছু করতে হয় নাই- না পড়ালেখা, না কাজ। এই কথাটি অবশ্য আংশিক সত্য, কারণ পড়ালেখার দৌড়ে সে ক্লাশ সেভেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত টিকেছিল। এরপর বস্তির বখাটে বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতার শুরু। এক একদিন একা বা দলবেঁধে দয়াগঞ্জ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বা ঢাকার কমলাপুরে চলে যাওয়া, বস্তির বাইরের ক্লাব ঘরে ক্যারাম খেলা, নিয়মিত সিগারেট খাওয়া এবং মাঝে মধ্যে খুচরো মাস্তানি – এসবকে যদি কাজ বলা যায়, তবে সে কাজও করেছে। এসব কাজের চাপে হানিফ এক ফূর্তিময় জীবন যাপন করছিল।

বাবা রিকশা চালাতেন। স্বল্প আয়, তবু খাবার ব্যাপারে তার জমিদারের মত বাছবিচার ছিল। অন্য রিকশাচালকরা আকিজ বিড়িতে অভ্যস্ত হলেও তিনি স্টার সিগারেট টানতেন। ফুলকপি ছিলো তার অপছন্দের সব্জী। ফুলকপির গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। মুখে তোলা তো দূরের কথা, পাতেও তুলতেন না, বলতেন, “মাইনষ্যে ফুল্কফি খায় ক্যাম্নে!” এই বিস্ময় বা প্রশ্নের মিমাংসা জরুরী ছিলো না, তাই গ্রহণযোগ্য উত্তর পাবার আগেই শীতের এক কুয়াশাঘন সকালে তিনি বিদায় নিলেন। টিকাটুলি মোড়ে “সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন” গোত্রের ট্রাক তাকে পিষ্ট করে পালালো। তার থেতলে যাওয়া দলাপাকানো শরীরটা তিন চারবার ঝাঁকি দিয়ে স্থির হয়ে গেল । আইনী প্রক্রিয়া মেনে থানা থেকে মেডিকেল কলেজ, ফের মেডিকেল কলেজ থেকে থানার চক্কর কেটে সন্ধ্যায় লাশ দয়াগঞ্জ বস্তিতে আনার পর হানিফ, একমাত্র ছোট বোন আর তার মা’কে স্বজন হারানোর বেদনা নয়, আসন্ন দিনের অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছিল।

বাবা মারা যাওয়ার পর হানিফের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল – বাবার পেশা রিকশা চালানো বা দয়াগঞ্জ বস্তির বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দেয়া। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট বাবার দলাপাকানো শরীরটা বহুদিন হানিফকে আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রিকশার প্যাডেলে পা রাখার সাহস হয় নাই। বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দিলে রিকশার বেল চুরি, ছিনতাই এবং ফেনসিডিল ও হিরোইনসহ মাদক কারবার করা যায়। স্বাধীন পেশা, ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নীতি সত্ত্বেও উপার্জন বেশ ভাল। তবে দু’টা ঝুঁকি রয়েছে- নেতারা পুলিশের সাথে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা করলে বা পত্রিকায় বেল-বাটি পার্টির দৌরাত্ম্য ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিষয়ক খবর ছাপলে পুলিশ অতি তৎপর হয়ে পার্টির সাধারণ সদস্যদের গ্রেফতার করে অমানবিক ধোলাই দেয়। দ্বিতীয় ঝুঁকি আরও মারাত্মক- পাবলিকের হাতে ধরা পড়লে নির্বিবাদী ও ভীতু মানুষগুলিই দানবে পরিণত হয়, পৈশাচিকভাবে পিটায়। মেরে ফেলার কৃতিত্বে উল্লসিত হয়। সাহসের অভাবে বেল-বাটি পার্টিতেও হানিফের যোগ দেওয়া হলো না।

রিকশার মহাজনের দেওয়া পাঁচ’শ টাকা পূঁজি নিয়ে হানিফের নতুন জীবনের শুরু। বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো বছর, ফজরের ওয়াক্তে পুরান ঢাকার শ্যামবাজার থেকে কাঁচামরিচ, লেবু, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, শসা পাইকারি দামে কিনে সকালে সূত্রাপুর বাজারে খুচরা দামে বিক্রির মাধ্যমে হানিফের সব্জী ব্যবসায়ে হাতেখড়ি। সময়ের পরিক্রমায় রায় সাহেব বাজার ও জুরাইন বাজার পেরিয়ে, কিছুদিন ঠাটারিবাজারে মাছের ব্যবসা শেষে টানা আট বছর ধরে হানিফ কারওয়ান বাজারের সব্জী কারবারি। ক্ষুদ্র পূঁজির পাইকার। বাঁধা ক্রেতাদের অনেকেই তাকে ‘মাহাজন’ বলে ডাকে।

হানিফ সবুজ রঙের মাফলারটা গলা থেকে খুলে কোমড়ে বাঁধে। লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা গোল্ডলিফের প্যাকেট বের করে। সিগারেট ধরায়। চা’য়ের জন্য আশপাশে তাকায়। মোখলেস নামের দশ বারো বছরের একটা ছেলে মাঝরাত থেকেই ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করে। মোখলেসকে বাজারের সবাই মেসি নামে ডাকে, কেনো ডাকে হানিফ জানে না। সম্ভবত মোখলেসের মেসি হবার ঘটনা কেউই জানে না। আশেপাশে মেসিকে দেখা গেলো না। হানিফ সিগারেটে টান দেয়। প্রথম টানের ধোঁয়া ছাড়তেই মনে জিহাদী হুজুরের চেহারা ভেসে উঠে। জিহাদী হুজুর ওয়াজে সিগারেট টানার এমন অভিনয় করে যে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। ইউটিউবে যতবার জিহাদী হুজুরের ওয়াজ দেখেছে ততবারই হাসির দমকে হানিফের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন হাসি পাচ্ছে না, গোঁফ চুলকে ভাবছে- আজকের লটের সবচে সুন্দর ফুলকপি দু’টা বিক্রির জন্য আরও অপেক্ষা করবে না প্রতিদিনের মত বাড়ির ফেরার পথ ধরবে।

চলতি মৌসুমে ফুলকপির সরবরাহ বেশ ভালো। বাজারে শীতের সবজি আসার শুরুর দিকে মাঝারি আকারের এক জোড়া ফুলকপি দেড়’শ থেকে দু’শ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছে। এখন দাম কমে জোড়া ষাট থেকে সত্তুর টাকায় নেমে এসেছে। হানিফ সিগারেট খাওয়া শেষে ফুলকপি দু’টোর দিকে তাকায়। সবুজ ডাটার মাঝখানে বরফ শাদায় হালকা হলুদ আভায় আচ্ছাদিত বৃত্ত। জমাট বাঁধা ফুল- চূড়োয় মধ্যবিন্দুকে রেখে ফুটবলের অর্ধাংশের মত সুষমভাবে স্ফিত হয়ে আছে। ফুলের কারণে সামান্য এবড়োথেবড়ো হলেও কোমল ও মসৃণ। হানিফ কপির ডাঁটি দুটো ফুলের তোড়ার মত দুই হাতে শক্ত করে ধরে। ঘ্রাণ নেওয়ার ভঙ্গিতে নাকের কাছে এনে শুঁকে। মুহুর্তের মধ্যে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাজারের কোলাহলকে দখল করে গাঢ় নিরবতা। বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে আবছায়া ঘর, ছোটো জানালায় লাগানো প্রিন্টের পর্দা ফুড়ে ঢুকা নরম আলোয় সবুজ ব্লাউজ খোলা মাকসুদার ফর্সা বুক। শ্বাস নেবার দোলায় উঠছে নামছে। ফুলকপির ডাঁটির মত পাতলা-শুকনা একটা গতরে এত স্ফিত বুক কিভাবে হয়- হানিফের কাছে এ এক অমিমাংসিত রহস্য।

দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয় হানিফ। কিছুটা লজ্জাও পায়। কল্পনার রাজ্য ছেড়ে কোলাহল আর প্যাচপেচে কাদা ও সব্জীর মিশ্রণে সৃষ্ট গন্ধ ভরা বাজারে ফিরে আসে। মাথার ভিতরে জেগে থাকে মাকসুদা। মাকসুদার এই উপস্থিতি তাকে অন্যান্য দিনের মত ফুলকপি জোড়া বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করে। মাকসুদা সব কিছুই খুব ভালো রান্না করে। কিন্তু ফুলকপির তরকারি রান্না করতে পারে না। ফুলকপির তরকারিতে এত বেশী হলুদ দেয় যে খেতে বিস্বাদ লাগে। বিস্বাদ ফুলকপির তরকারি উগরে আসা বমি চেপে হাসিমুখে খেতে হয়। খাওয়া শেষে প্রশংসা করতে হয়। কঠিন কিছু বললে মাকসুদা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে, হানিফের কষ্ট হয়। আজ সে নির্যাতিত হবার মত বস্তু নিয়ে ঘরে ফিরবে না, কম দামে হলেও ফুলকপি বিক্রি করে তারপর ফিরবে।

মাকসুদাকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে হানিফ রাজী ছিলো না। বাবা মারা যাবার এক বছরের মাথায়, বাবার অভাবটাহাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছে, মধ্যবয়সী মা এক ঠেলাওয়ালাকে বিয়ে করে আগারগাঁও বস্তিতে চলে গেলেন। তখনই হানিফ প্রতিজ্ঞা করেছিল বিয়ে করবে না। সে মরে গেলে বউ অন্য পুরুষের সাথে সংসার করবে, রঙ্গ তামাশা করবে, এক বিছানায় শুবে – এ কথা ভাবতেই বিয়ের প্রতি অনাস্থা এবং সংসারের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য ও ঘৃণা জন্মেছিল। একমাত্র ছোটবোন তাকে বিয়ের জন্য ত্যাক্তের চূড়ান্ত করলো। “ভাই, তোমার বয়স বাড়তাছে, সেবাযত্ম দরকার” এবং “তোমার থেকা বুইড়া বয়সে মাইনষ্যে বিয়া করে, তোমার বিয়া করতে সমস্যা কি” – এই যুক্তিতে ছোটবোনের নেতৃত্বে সাঁড়াশি আক্রমণে যোগ দিলো বোন জামাই, ভাগ্না-ভাগ্নি আর এক চাচা। হানিফ শেষ পর্যন্ত বিয়েতে সম্মত হলো।ছোটবোন নিজ উদ্যোগে চল্লিশ বছর বয়সী ভাইকে দূর সম্পর্কের বাপ-মা মরা এতিম বিশ বাইশ বছর বয়সী ননদ মাকসুদার সাথে বিয়ে করালো। বয়সের ফারাকজনিত হীনমন্যতার কারণে অল্প বয়সী রূপবতী বউয়ের প্রতি হানিফ কঠোর হতে পারে না।

হানিফের দোকানের তিন-চার দোকান পরই ওবায়দুলের আলুর দোকান। ওবায়দুল অনেকক্ষণ ধরে হানিফকে খেয়াল করছিল। চোখাচোখি হতেই ওবায়দুল ইশারায় হানিফকে ডাকে। হানিফ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওবায়দুল বলে,
– ফুলকপি দুইটারে বুড়া হাত্তির বিচির মত ঝুলায়া দুই ঘণ্টা ধইরা খাড়ায়া আছো ক্যান? বাড়িতে লয়া যাও।
– আইজ বাড়িতে লইয়া যাইত্তাম না।

ওবায়দুল হাসে,
– ক্যান! ফুলকপি লয়া গেলে ভাবী মাইর দিবো! ভাবীরে ডরাও! ভাবী চিল্লাইবো! বাড়িত থেকা বাইর কইরা দিবো! রাইতে একলগে..

ওবায়দুলের রসিকতা হানিফের ভালো লাগে না। ওবায়দুলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠে,
– ডাইকছো ক্যান! কি কইতে চাও তা কও!

ওবায়দুল হাসে,
– বাড়িতে না নিয়া গেলে আমারে দাও, আমি লয়া যাই। শইল মাছ দিয়া রাইন্ধা বউপোলাপান লয়া খাই।

ওবায়দুলের রসিকতায় তেঁতে থাকা হানিফ ঝাঁঝের সাথে বলে,
– দাম দিয়া নিবা! মাগনা দিতাম না।

ওবায়দুলের স্বরে ঝাঁঝ,
– ওই মিয়া! দামের গরম আমার লগে দেখাইও না। দাম দিয়াই লমু। ওবায়দুল মাগনা কিছু লয় না। বুড়া হাত্তির বিচির দাম কত চাও, কও?

হানিফ নরম হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুলকে দেয়। ওবায়দুল সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে হানিফ বলে,
– চ্যাতো ক্যান! আমি কি কইছি তুমি মাগনা নিবা! ফুলকপির আজকার দাম তো তুমি জানোই। ওই দাম লাগবো না। আমার বাড়িত যাওনের বাস ভাড়া বিশ টাকা, তুমি বিশ টাকা দিলেই সই। এমন কপি সারা বাজারে নাই।

এতক্ষণ পর ফ্লাস্ক হাতে মেসিকে দেখা যায়, হানিফ মেসিকে ডেকে ওবায়দুলকে বলে,
– চা খামু। তিয়াস পাইছে। খাওয়াইবা!

ওবায়দুল ফুলকপির দাম বাবদ বিশ টাকা দেয়, হানিফের সাথে নিজেও রঙ চা আর কাচ্চা বিস্কুট খায়। হাসিমুখে হানিফকে বিদায় দেয়।

ওবায়দুল ফুলকপি দু’টার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একজোড়া সরস ফুলকপি, দেখলেই মন ভরে যায়। হানিফ মাত্র বিশ টাকার বিনিময়ে এই ফুলকপি বিক্রি করেছে- ভাবতেই আশ্চর্য হচ্ছে। সকাল ৮টার পর খুচরা ক্রেতার কাছে এই কপি দু’টা খুব কম করে হলেও দেড়’শ টাকায় বিক্রি করা যাবে। নগদ লাভ এক’শ ত্রিশ টাকা। কিন্তু ওবায়দুল বিক্রি করবে না। সবকিছুতে টাকার লাভ দেখলে চলে না। আরও অনেক বড লাভ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সে এই ফুলকপি জোড়া বিনিয়োগ করবে।

(চলবে)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

দশ
নির্মল সহজে ঘন মেঘস্তর থেকে নেমে বৃষ্টি হয়ে কচুপাতার মৃণাল ঘিরে দাঁড়াতে পারে না। “সরল তরল হও, বিকাশের রীতিনীতি এই” এক কবি লিখেছিলেন; কিন্তু মায়া কখনও দুধ তৈরি করতে বললে সে এত মোটা ক’রে গুলত, খাওয়ালে বাচ্চাদের অবধারিত পেট ছেড়ে দেবে। নির্মল নিজেকে মেলে ধরে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রথমে অপ্রবেশ্য, পরে হয়ত গ’লে জল হবে। ছোটদের জবান তার নয়, ভাবও কি বোঝে? সবাই জানে, এ-বংশের যতেক পুরুষ — সন্তানপাগল। রাতে বাচ্চারা নিঃসাড় ঘুমন্ত হলে নির্মল অন্ধকারে আন্দাজে-আন্দাজে ন’বছরের ছেলের হাঁটুর ঘা’য় মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, কোমরে দাগ ব’সবে ব’লে ঢিলে ক’রে বাঁধছে তেরো বছরের কন্যার প্যান্টের ফিতে। সঞ্জু সব সময় টের পায় না, শিউলি লজ্জায় কাঠ হয়ে থাকে।

নির্মলের গল্পের ভাষাগাড়ি ছোট্ট শ্রোতাদের নানা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগোচ্ছিল :
— সভায় তখন গুনগুন শুরু। আরে, ‘নির্গুণ আত্মজ্ঞান’ তো পাতঞ্জল-যোগের গোড়ার কথা, সবে দু’এক বছর নবদ্বীপ শান্তিপুর বা গোপালপাড়ার টোলে যাতায়াত করছে এমন ছেলেছোকরাও জানে। জমায়েত ধরতেই পারছে না হলটা কী! হঠাৎ সভায় বসা একটা লোক চট ক’রে উঠে দাঁড়িয়েছে, তারপর দে ছুট ভীমবেগে। ভিড় চেঁচিয়ে উঠল : ব্যাটা অশা, আরে মধুসূদনের বড় শালা পালাচ্ছে… পালিয়ে মুখ বাঁচাবি ভেবেছিস?

ডামাডোল বেশ বড় চেহারা নিল। গাঁয়ের মোড়লরা জোড় হাত উঁচু ক’রে “শান্তি শান্তি” বলেও ম্যানেজ দিতে পারছে না। এমন সময় দেখা গেল, ডবল জোরে দৌড়ে ফিরে আসছে সেই অশ্বিনীচন্দ্র। কিন্তু অশার হাতে ওটা কী, এ-বাবা, কচি বাচ্চাদের তেলচিটে সরষে-বালিশ একখানা। সেটা ফরাসের ওপর পেতে অশ্বিনী জামাইবাবুকে হাত ধ’রে টেনে শোয়াবেই, আর মধুসূদনও শোবেন না। আবার বিরাট হই হই। সব দেখেশুনে দশরথ মিশ্রের ব্যাঁকা হাসি থেকে করুণা ঝরে পড়ছে। তিনি হাত তুলে বললেন, শয্যাগ্রহণ করতে লজ্জা কী, সার্বভৌম মহাশয়? হয়ত তাতে আপনার শরীরটি কিঞ্চিৎ পরিতোষ লাভ করবে।

দশের ও দশরথের অনুরোধে শেষতক শুয়েই পড়লেন তারকনাথ। ওমনি এক আশ্চর্য পরিবর্তন, ঝিমুনিভাব কেটে গিয়ে জ্বলে উঠল চোখদুটো। মুখে মুচকি হাসি টেনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু গলা খাঁখারি দিলেন :

ধর্ম দুই রকমের, প্রবৃত্তিধর্ম ও নিবৃত্তি বা মোক্ষধর্ম। যার সাহায্যে সুখলাভ, তাই প্রবৃত্তিধর্ম। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত আছে। কিন্তু শান্তিলাভের জন্যে নিবৃত্তিধর্মের অনুশীলন শুধু ভারতেই শুরু হয়েছিল। আত্মজ্ঞানও দু’প্রকার — সগুণ আর নির্গুণ। সগুণ আত্মজ্ঞানের ধারণা দিলেন বাগাম্ভৃণী ঋষি, কপিল ব্যাখ্যা করলেন নির্গুণ আত্মজ্ঞান। মাননীয় নৈয়ায়িক কপিল রাঢ়বঙ্গের সন্তান। আচ্ছা পণ্ডিত দরশরথ মিশ্র, বলুন তো…।

এর পর তর্কসভা মেরেকেটে পনেরো মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। মিথিলার মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের বংশজ টের পেলেন, স্মৃতি, কাব্য, ন্যায়, ব্যাকরণ ও তর্ক বিষয়ে মধুসূদনের জ্ঞানের যে প্রখরতা, তাতে অনায়াসে পঞ্চতীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন। কাজেই টিকি-কাছা আস্ত রেখে মানে-মানে সরে পড়াই শ্রেয়। বজরায় ওঠার আগে বিমূঢ় দশরথ মধুপণ্ডিতের কাছে এসে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, মহাশয়, স্মার্ত রঘুনন্দনের মতে তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে — বাচিক বা উচ্চকন্ঠে পাঠ, উপাংশু বা অনুচ্চ স্বরে পাঠ এবং মানস বা মনেমনে পড়া। তো, আপনার এই শুয়ে শুয়ে পঠন-টি কোন ধারার অন্তর্গত?

এগারো
ঝড়ের বেগে সুধা ঢুকল ঘরে, রাতে যে কাঁথা নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাই গায়ে জড়ানো।
— দিদিমা শুনিছ? টিপুদা বিয়ে ক’রে বউ নিয়ে আইছে!
— আমাগো টিপু? ওমা, আমার কী হবে! বউ পালো ক’নে?

সুধা ঠান্ডা মাটিতে ধেবড়ে ব’সে পড়ে। ওরে মুখপুড়ি, হাসবি পরে, আগে ঘটনা বল।

টিপু জলপাইগুড়ি গেছিল বন্ধু অসীমের মামাতো বোনের বিয়েতে। গেছে যদিও, বিয়েবাড়িতে কনের চাপা রঙ নিয়ে মহিলাদের ঠাট্টা-বোটকেরা, ছাদনাতলায় চ্যাংড়াদের মাতন, পাঁঠার মাংস খেয়ে মাটির গেলাসে হাত গোলা — কিছুই তাকে টানে না। সে কোনও রকমে কাঁধের ব্যাগ নামিয়েই আশপাশের বনপাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের আগে পণের পুরো টাকা হাতে না পেয়ে বরপক্ষ পাত্র উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তখন টিপুকে জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে অসীমের মামা। টিপু অনেক বাধা দিয়েছিল : এ-বিয়ে আমার মা মানবে না। বিশ্বাস করবে না একটা কথাও। বলবে, ওই মেয়ের সঙ্গে তোর আগে থেকেই ভাব ছিল।

তৃপ্তিমামিমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে এ-বাড়ি থেকে। সেই শাপশাপান্তকে নতুন বউ দেখার আহ্বান মনে ক’রে ছেলেমেয়েরা ছুটল। এই ফাঁকে চুপ ক’রে ঘরে ঢুকে একটা সবুজ প্যাকেট চাঁদের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে দিদিমা।
— প্রত্যেক দিন সকালে-বিকেলে ঠোঁটে লাগাবা। ভাইবোনরা কেউ চালি আঙুলির মাথায় ক’রে এট্টু দিয়ে আবার রাখে দেবা নিজির কাছে।

ননীবালা খেয়াল করেনি তার জাঁদরেল মেয়ে পেছন-পেছন বড়ঘরে উঠে এসেছে।
— কী এডা, দেহি? বোরোলীন! এর তো অনেক দাম। টাকা পালে কোথায়, মা? তোমার পানের ডাবরখান দেখতিছি না দুই-তিন দিন।
— তোরঙ্গে তুলে রাখিছি।
— তোমার মুখ না পাইখানা? ডাবর বের করো, আমি দ্যাখবো।
— ভর সন্ধেকালে মা’র পেছনে না লাগলি কি তোর পেটের ভাত হজম হচ্‌ছে না, নাদু?
— এক ফোঁটা দুধির সর মাখলি ঠোঁটফাটা সারে যায়। সংসার চালাতি যে কী কষ্ট তুমি তার কী বোজ্‌বা? কথায় কয়, চালডাল তোমার ম্যাজমানি আমার। দিদিমা হয়ে নাতির ভবিষ্যত ঝজ্‌ঝরে ক’রে দেচ্‌ছো!

নির্মল সদ্য ‘গাঁদাফুল’ লেখা শেষ করল, কবিতাটা দাঁড়াল মোট আট স্তবক, চব্বিশ লাইন। এবার সে কিছুক্ষণ বউ-শাশুড়ির ঝগড়া শুনল মন দিয়ে। ওদিকে হঠাৎ বলরাম ঘোষের বাড়ির হাত্‌নে থেকে উঠোনে খ্যানখ্যান করে গড়িয়ে পড়েছে কাঁসার থালা আর বারান্দাময় লালচে মোটা মুড়ি — শালী, হারামির বাচ্চা, সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আসব আর তুই আমারে এই ব্যাতানো মুড়ি খাওয়াবি! ভাবিছিসডা কী?

প্রদীপ থেকে প্রদীপে যাওয়ার মতো ঝগড়ার শিখা সন্ধের কলোনি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বলরামের মুখখিস্তি ঢেকে গেল পাশের রেখা-রত্নার বাড়ির শাঁখশব্দ, অতি-গৌরাঙ্গী রেখার মায়ের তীব্র উলুতে।

বারো
প্রতিটা মানুষই তর্কে-বিবাদে নিজের মতকে জিতিয়ে আনতে চায়, আর অপরের ধারণাসৌধকে ধসিয়ে দিতে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে ঠিক-টা তার সঙ্গেই আছে, অন্য পক্ষ মিথ্যের রজনীগন্ধা। কলোনির গলাবাজি, কাশ্মীরের সংঘর্ষ বা রাষ্ট্রসংঘের শান্তিআলোচনা সব জায়গাতেই সবাই বোঝাতে রাজি, বুঝতে নয়। তাই শুরু যেখানে আরম্ভ করে, সমাপ্তিও সেখানেই শেষ হয়, একটা বড় গোল্লার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মানুষের ভবিষ্যৎ।

আজাদ হিন্দ ক্লাবের মাঠে রামযাত্রার কনসার্ট শেষ হয়ে অভিনয় শুরু হল। সীতা খুব কাকুতিমিনতি করছে — প্রাণনাথ, তোমার সঙ্গে বনবাসে যাব। উত্তরে রাঘব : জীবনে চলার পথে, নারী নাহি নিব সাথে। ভাই লক্ষ্মণ, তোমার কী পরামর্শ? ভ্রাতা, তুমি যা বলিবে, কিন্তু আমারও মত : জীবনে চলার পথে, নারী… নারী নাহি নিব সাথে।

মায়া এসে ঠক করে এক কাপ চা খাটের কোনায় রেখে বলল, ছেলেডা এই নিয়ে দুবার জ্বরে-টানে পড়ল এক শীতে। আজ মাঘের মোটে তেরো দিন। আপনারে কতবার বলিছি, এইসব ছাইভস্ম না লিখে চাঁদের কুষ্টিডা বানান।

নির্মল উত্তর দেয় না, তার মাথায় সমাধানচিন্তা খেলে গেছে। আচ্ছা যদি এমন হয়, প্রতিটা মানুষ যে-কোনও মতবিনিময়ের সময়ে নিজের দোষ বা ভুলগুলো বলবে আর সমর্থন করবে তার বিরোধীর যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যকে, তাহলে এই ট্র্যাফিক জ্যাম খুলে বেরিয়ে আসা যায় না? কথা মানেই যদি হয় নিজের বিরুদ্ধে কথা, তাহলে শব্দ ঘিরে যে ক্ষমতার দুর্গ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। তখন মানুষের অহং নেমে আসবে গ্রীষ্ম-পুকুরের জলস্তরের মতো, অন্যকে ভালোবাসতে বাধা দেওয়া দেয়ালটা সরে যাবে। কিন্তু এই বুঝ মানুষের মাথায় ঢোকাবে কে?

নির্মল তার ছোট্ট শেলফের বইগুলোর দিকে তাকায় — উপনিষদ-সংহিতা, স্তোত্ররত্নাবলী, অ্যান্ড্রু মোশানের নির্বাচিত কবিতা কিটস, এ হিস্ট্রি অফ স্যানসক্রিট লিটারেচার, অমরকোষ, গীতবিতান, ব্রহ্মসূত্র সঞ্চয়ন, দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে…।

— ও গৃহস্থ?
— শুনতিছি।
— কাল সকালে চাঁদরে নিয়ে যাব ইস্কুলে। ভর্তি করে দিয়ে আসব।

মায়া বিপদ আশঙ্কা করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
— এখনও আট মাস বয়েস কম ছেলেডার। তার উপর এই শরীর…।
— বাড়ি রাখলি আবার আমতলার শিশিরে গড়াগড়ি খেয়ে জ্বর বাধাবে। তার চেয়ে ইস্কুলই ভালো।

(শেষ)

মশা ঘনুবাবু ও ছটা বিয়াল্লিশ

চটাস করে এক চড় নিজেরই ডান পায়ের গুলফের ওপর কষালেন ঘনুবাবু। চলন্ত ট্রেনে যে এত মশা কি করে থাকে! আশ্চর্য! হালকা সাদা আলোয় হাতটা চোখের সামনে তুলে এনে দেখলেন নাহ মরেনি ব্যাটা। মশা মারায় ঘনু একেবারেই অপদার্থ। গিন্নীও হামেশাই বলেন সেকথা। অবশ্য এই একটাই কথা বলেন না। বলতে গেলে সারাদিনই অসহ্য নাকচাবি পরা বোয়াল মাছের মত জাবদা মুখখানা চলছে তো চলছেই। সেই সাতসকালে শুরু হয়ে এই কথার চর্বিতচর্বণ চলতেই থাকে অবিরাম। তাকে থামায় কার বাপের সাধ্যি। আর সব কথার সার হল, ঘনুবাবু অতি অকর্মণ্য। ভাগ্যিস বহু তপস্যা করে তাঁর মত একপিস বউ পেয়েছিলেন তাই বর্তে গেছেন। নইলে যে ঘনুর কি হতো, ভাবলেও তিনি শিউরে ওঠেন। পাড়ার আর পাঁচটা বউকে দেখুক ঘনু, তাহলেই বুঝবে সে কি রত্ন পেয়েছে। শুধু পাড়ার বউদেরই নয়, তার সাথে নিজের অকালকুষ্মান্ড পরিবারের অন্য মেয়ে বউ দেরও দেখুক। তাহলেই হাড়ে হাড়ে বুঝবে তার নিজের বউ কত্তো গুনী। এটসেট্রা…এটসেট্রা…

পাড়ার বউদের যে দেখেন না ঘনু, তা নয়। বরং কাছেপিঠে বউ নেই দেখলেই বেশ ভালো করেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। চব্ব্যচোষ্য করেই চেটেপুটে দেখেন। আর শুধু দেখাই নয়, অনেককিছু কল্পনাও করেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য বউএর অবস্থানটা দেখে নিতে হয়। এখন এই মাঝবয়সে পাড়া কেন দুনিয়ার তাবৎ অন্যলোকের বউ কেই দেখার কি যে সুখ! আহা! চলতি ট্রেনেই মুচকি হাসি ভেসে ওঠে তাঁর দুঠোঁটের মাঝে। পাশের লোকটার এক ঠেলা খেয়ে একটু কাত হয়ে পড়তেই সংবিত ফিরে এল তাঁর।

-“আস্তে রে ভাই! আস্তে আস্তে”।
এই ছটা বিয়াল্লিশের লক্ষীকান্তপুর লোকালের আশি পার্সেন্ট প্যাসেঞ্জারই ডেইলি। তাই মোটামুটি সবাইই মুখ চেনা। বীভৎস ভীড় হয় এসময়টায়। শেয়ালদা থেকে ছাড়ার সময়েই ভীড় কামরা ছাড়িয়ে রড ধরে ঝুলতে থাকে। সবই ছোটখাট চাকরীজীবী কিম্বা হকার, ছোট দোকানদার। সারাদিনের পেটের বন্দোবস্ত করে ফিরে চললো নিজের গ্রামের বাড়ীতে। এই ভীড় ঠেলে ওঠা বা নামা দুইই বেশ কসরতের কাজ। বছরের পর বছর রীতিমত ঠোক্কর খেয়ে তাঁকে শিখতে হয়েছে ওঠা-নামা- দাঁড়িয়ে থাকার কায়দা কানুন। যদিও খুব বেশিদূর যাতায়াত নয় তাঁর। শেয়ালদা থেকে মাত্র খান চারেক স্টপেজ পরেই বাঘাযতীন। বাসেও যেতে পারেন, কিন্তু সিগন্যালে ঠেক খেতে খেতে বাসের প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগে। তাছাড়া শেয়ালদা থেকে এদিকের বাস পাওয়াও সমস্যা। অনেকক্ষণ দাঁড়ালে তবে একটা ভীড়ঠাসা বাস আসে। অনেক ভেবেচিন্তে এই ট্রেনলাইনই বেছে নিয়েছেন তিনি। হোক ভীড় তবু মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আর বছর সাতেক চাকরী আছে। চালিয়ে নেবেন এভাবেই। একটা স্টেশন এল। উঁকি মেরে দেখলেন পার্কসার্কাস।

-“দাদারা, বোনেরা, মিস্টার এন্ড মিসেসেরা, এই চলন্ত ট্রেনে অনেক হকারই আপনাদের কাছে আসে। রোজই তাদের দেখেন। অনেকেই খুব পরিচিত হয়ে গেছে আপনাদের”।

এই ঠাসা ভীড়ের মধ্যে কিভাবে যে এই হকাররা যায়, সেটা একটা ম্যাজিক। শুধু যাতায়াত করাই নয়, কাউকে বিরক্ত না করেই দিব্যি নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে বকবক করে গছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে চলেও যায় ফের। আর কি না বিক্রী করে ওরা! সেফটিপিন থেকে জলের বোতল, গামছা থেকে ডাব। ভাবা যায় না। ওই ভারী জিনিসগুলো বয়ে অনায়াসে এ কামরা সে কামরা করে বেড়ায় ওরা। ঠিকই বলেছে এই নতুন হকার, বহু হকারই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের পরিচিত হয়ে গেছে।

একটু স্বস্তি পেয়ে, ভালো করে হকারের দিকে তাকালেন ঘনুবাবু। বাপরে! এই লোকালে রীতিমত সাদা শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে সেজেগুজে উঠেছে লোকটা। টাই দেখলেই ঘনুবাবু বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকান। তিনি জীবনে কখনো ওই জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেন নি। আসলে টাই এর কোনো দরকারই পরেনি তাঁর। টাই বাঁধতে গেলে যে জিনিস টা দরকার, সেই স্যুটও নেই তাঁর। থাকতোও যদি তাহলেও ওই অফিস-বাড়ী-বাজারের পরিক্রমায় তিনি কিছুতেই সেটা পরতেন না প্যাঁক খাবার জন্যে। অথচ এই হকার তো দিব্যি পুরোদস্তুর অফিসার মার্কা চেহারা আর সাজগোজ নিয়েও চলে এসেছে। এঁকে তো আগে কোনোদিন দেখেননি তিনি। অন্য ডেইলিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারাও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ওই হকারের দিকে।

এ নিশ্চয়ই খুব শিক্ষিত কেউ। অবস্থার চাপে পড়ে আজ হকারি করতে এসেছে। মনে মনে ভাবলেন ঘনু। এবার মন দিলেন ওর কথায়।

-“ দাদারা- বৌদিরা! আপনারা রোজই হরেক সমস্যায় বিব্রত। সারাদিন হাড়ভাঙা খটুনির পরে সন্ধেয় বাড়ী ফিরে চলেছেন একটু শান্তির আশায়। নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা কুলায় ফিরছে সারাদিনের শেষ হয়ে যাওয়া এনার্জি লেভেল বাড়ীর শান্তিতে একটু ঘুমিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আগামীকাল ফের ঝাঁপিয়ে পড়বেন জীবন যুদ্ধে।

কিন্তু ভাবুন তো দাদারা-বৌদিরা, বাড়ী ফিরে সেখানে শান্তি পাবেন কি? বাড়ীতে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে যেই একটু বিশ্রামের জন্যে জলখাবারের প্লেট হাতে মাদুরে কিম্বা চেয়ারে কিম্বা টুলে কিম্বা বিছানায় বসবেন, ওমনি প্যাঁক… ইয়াব্বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে কয়েক লক্ষ মশা। কোথায় পালাবেন? রান্নাঘরে- মশা, বাথরুমে- মশা, ক্লাবে- মশা, রাত্তিরে বিছানায় থইথই করছে মশাবাহিনী। আর কি না রোগ বয়ে আপনার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে ওঁত পেতে বসে আছে ওরা। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এনকেফেলাইটিস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়া আরো কত হাজার রোগ। একটা মশা কামড়ানো মানে আপনার কাজ বন্ধ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে ছোটাছুটি। টাকার শ্রাদ্ধ”।

এত রোগের ফিরিস্তি শুনে যেন ঘনুর শরীর টা খারাপ লাগতে শুরু করলো। আজ সকালেই বাজারে শুনে এসেছেন আজাদগড়ে একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ডেঙ্গু না কি ডেঙ্গি তাও জানেন না তিনি। কেমন জঙ্গি জঙ্গি মনে হয় শব্দটা। ডেঙ্গু হলে কি করে লোকে মরে যায় পটাস করে তাও তাঁর অজানা। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

-“আপনারা এতদিন বহু কোম্পানির অনেক নামী দামী প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ভেবেছেন কি, সেইসব কয়েল বা লিকুইড বা ম্যাটের সাইড এফেক্ট কি? জানেন কি এগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার করলে হাঁপানি, চর্মরোগ, এমন কি ক্যান্সারও হতে পারে!”

ঘনুর অবস্থা এখন রীতিমত করুণ। ক্যান্সার! ওরেবাবা! অফিসের এক পিওন সদ্য পটল তুললো ওই রোগে। শুনেছেন ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। গরমে নাকি ভীড়ের চাপেই দরদর করে ঘামতে থাকেন ঘনু।

-“ আমি আজ আপনাদের কাছে হকারি করে জিনিস বিক্রী করতে আসিনি দাদারা-বৌদিরা। আমি এসেছি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্করের তৈরী এক অনবদ্য ওষুধ এই প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিছুদিনের মধ্যেই পেটেন্ট এসে যাচ্ছে। এরমধ্যেই হামলে পড়েছে দেশ বিদেশের বড় বড় নামী দামী কোম্পানী। ওদের হাতে এর স্বত্ত্ব চলে গেলেই আকাশছোঁয়া দামে বিক্রী করে বিপুল লাভ করবে ওরা”।
পেটেন্ট টা কি ব্যাপার! কাল অফিসে জানতে হবে অম্লানের কাছে। ভাবলেন ঘনু।

-“এই জগতবিখ্যাত ওষুধের কোনো সাইড এফেক্ট নেই। একটা ওষুধ সুতোয় বেঁধে ঘরে ঝুলিয়ে দিলেই মশারা পিলপিল করে পাড়া ছেড়ে পগাড়পার। কোনো রোগ নেই, কোনো অস্বস্তি নেই, আর দামও আপনার হাতের নাগালেই”।

-“পরে এই ওষুধের কি দাম হবে জানিনা। কিন্তু এখন প্রথম আমার দেশকে প্রনাম জানাতে বিজ্ঞানী নস্কর এই ওষুধের দাম রেখেছেন প্যাকেট প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা। প্রায় জলের দরে কিম্বা ফ্রী বলতে পারেন। আর শুধুমাত্র আপনাদের জন্যেই আছে একটা স্পেশাল অফার। তিনটে একসাথে যেকোন বড় দোকানে পরে কিনতে গেলে আপনার পড়বে প্রায় একশো টাকা। কিন্তু আপনাদের জন্যে, শুধুই আপনাদের জন্যে আজ একসাথে এই তিন প্যাকেট নিলে দাম পড়বে মাত্র দশ টাকা – দশ টাকা – দশ টাকা। আমার কাছে আজ বেশি প্যাকেট নেই। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র কয়েক পিস এনেছি। যদি কারো দরকার লাগে তাহলে দয়া করে হাত বাড়ান”।

দেখতে দেখতে লোকটার ব্যাগ খালি হয়ে গেল। ঘনু শুধু নেবার সময় আস্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন-“দাদা কাজ হবে তো?” লোকটা ভুবনমোহন হাসি হেসে বললে-“ বহু টাকাই তো জলে যায় দাদা, এটা একবার ব্যবহার করে দেখুন। তারপরে আবার আমাকে খুঁজে বেড়াবেন”। বেশ গর্বিত হাসি হেসে ঘনু প্যাকেট তিনটে তাঁর ছেঁড়া রঙচটা ক্যাম্বিস ব্যাগে ঢোকালেন।

#
অন্যদিন মশা তাঁকে খোঁজে, আজ বিছানায় বসে তিনি মশা খুঁজছেন। এখনো পর্যন্ত দেখতে পাননি। সদ্য রাতের বরাদ্দ রুটি আর আলু বিহীন পেঁপের তরকারি খেয়ে বিছানায় বসে মেজাজে একটা বিড়ি ধরিয়েছেন। গিন্নী এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত থালাবাসন ধোবার কাজে। রাতের বাসন ধুয়ে না রাখলে সকালে ফের রান্না করতে অসুবিধা হয় তাঁর। সন্ধেয় বাড়ীতে ফিরে বেশ মেজাজে ব্যাগ থেকে প্যাকেট তিনটে বার করে তার গুণাগুণ বোঝাতে শুরু করেছেন, অমনি এক ঝামটা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন গিন্নী।

-“দয়া করে ওসব কেরামতি না দেখিয়ে এখন হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আবার রাতের রান্না আছে”।

বেজার মুখে পড়তে বসে উৎসুক তাকিয়ে থাকা মেয়েকেই চুপিচুপি বুঝিয়ে উঠে পড়েছিলেন ঘনু। গিন্নীর যে তাঁর ওপর এতটুকু আস্থা কেন নেই কে জানে!

মেয়ে আগেই পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। কাল ওর ক্লাসটেস্ট আছে। তিনটে প্যাকেট ওই খুলে সুতো দিয়ে টাঙিয়েছিল খেতে যাবার আগে। হাসি হাসি মুখে বেশ প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতেই দেখছিলেন ঘনু। গিন্নী এলেন হাতের কাজ চুকিয়ে।

-“কি গো মশারী না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছ যে? বাঘাযতীনের বাঘা মশা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে ওই পুরিয়াগুলো দেখে?”
-“হে হে, দেখ, এখনো পর্যন্ত একটাও মশা নেই”।
আর কথা না বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন ঘনুজায়া।

এপাশ ওপাশ করতে করতে সবে ঘুম আসছিল, তখন মনে হল পায়ে একটা কিছু কামড়ালো। পা টা চুলকে নিলেন ঘনু। মনের ভুল হয়তো। ভাবতে না ভাবতেই চারদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমন। এদিকে কামড়ায়, ওদিকে কামড়ায়। উঠে আলো জ্বালাতেই দেখেন গৃহিণী আগেই উঠে বিছানায় বসে আছেন।

-“রইলো তোমার এই পাগলের সংসার। কাল সকালে উঠেই আমি বাপের বাড়ী চলে যাব। আর সহ্য হচ্ছে না। থাক তুমি এ ঘরে তোমার পুরিয়া আর মশাদের নিয়ে, আমি মেয়ের ঘরে চললাম”।

রেগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
আলোয় ঘরটা দেখে ঘনুর চোখ কপালে। গিজগিজ করছে মশা। ঘরের মশা বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, মনে হচ্ছে বাইরের যত মশা ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। উঠে পাশের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি। অন্ধকারে আবছা আলোয় দেখলেন মেয়ে আগেই মশারী টাঙিয়ে নিয়েছে। ভীষণ রেগে ঘরে ফিরে এলেন ঘনু। একটানে সুতো ছিঁড়ে নামিয়ে আনলেন প্যাকেট টা। আজ হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। দেখবেন কি মহামহৌষধ আছে ওতে।
প্যাকেট মানে ফুটো ফুটো প্লাস্টিকে মোড়া একটা পুরিয়া। সেটা ছিঁড়তেই ভেতরে আরেকটা কাগজের পুরিয়া। সেটা খুলতে বেরোল আরেকটা ছোট কাগজের পুরিয়া। উত্তরোত্তর রাগ বাড়ছে। এটাও খুললেন ঘনু। ভেতরে মোড়া একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা-

“মশারী টাঙান। এর কোনো সাইড এফেক্ট নেই।– ইতি বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্কর”।

এফ ওয়ার্ড চ বর্গীও

(১৮+)
রেস্টুরেন্টে যারা খেতে আসে, তারা নানান কথাই বলে কিন্তু একটা শব্দ বারবার রিপিট করে। সেটা এফ ওয়ার্ড; F*ck। কখনো এই শব্দের সাথে ing লাগায়। আমি নতুন দেশ থেকে এসেছি, ইংরেজি জ্ঞান শূন্য বললেই চলে। ইয়েস নো ভেরি গুড পর্যন্ত আমার দৌড় এর বেশি কিছু হলে বুঝতে পারিনা।

দেশ থেকে আসার সময় ইংরেজি টু বাংলা একটা ডিকশনারি নিয়ে এসেছিলাম, প্রয়োজনে কাজে লাগবে ভেবে। কিন্তু ব্রিটিশদের ইংরেজির মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। এরা যেন পরিষ্কার কোন শব্দ উচ্চারণ করে না, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। ডিকশনারি কোন কাজে লাগে না। কিন্তু F*ck শব্দ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। ডিকশনারি উল্টিয়ে এই শব্দের অর্থ খুঁজতে থাকি কিন্তু খুঁজে পাই না। তখন google জমানো ছিল না, চাইলেই দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান হাতের মুঠোয় চলে আসতো না।

রেস্টুরেন্টের খরিদ্দারদের মধ্যে এই শব্দ এত জনপ্রিয় কেন ভাবতে থাকি। প্রতিটি বাক্যে বারবার ঘুরেফিরে এই শব্দই কেন আসে ভাবতে ভাবতেও আমার বুঝে আসে না।

আমার সাথে কাজ করেন আমার চাচা এবং চাচার বয়সি আরেকজন। একবার ভাবি তাদের কাছ থেকে অর্থ জেনে নেই, কিন্তু কোথায় যেন দ্বিধা কাজ করে। সিক্সথ সেন্স বলতে কিছু যে আছে এটা হচ্ছে সেই প্রমাণ। যদি তাদেরকে এই শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতাম তারা যেমন বিব্রত, লজ্জিত হতেন আমিও লজ্জায় মুখ তুলতে পারতাম না।

রেস্টুরেন্টের কিচেনে আমার বয়সী আরো দুজন কাজ করত। তাদের সাথে কিছু পরিমাণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়, একদিন দ্বিধা ঝেড়ে তাদের কাছে এই শব্দের অর্থ জানতে চাই। আমার প্রশ্ন শুনে তারা হাসতে হাসতে শেষ কিন্তু উত্তর দিতে রাজি হয় না।

কিচেনে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক কাজ করতেন তার বয়স সত্তরের উপরে সবাই থাকে দাদু বলে ডাকে। ভদ্রলোক প্রায় পঞ্চাশের অধিক কাল ধরে ব্রিটেনে থাকেন, তার স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাই সাদা চামড়ার। আমার বন্ধুরা বলল দাদুকে জিজ্ঞেস করতে।

দাদুও বন্ধু ভাবাপণ্য; সবার সাথে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন। গুরুগম্ভীর নন বেশ হাসিখুশি ধরনের মানুষ। তাছাড়া তিনি প্রায় ব্রিটিশ, অর্থাৎ জন্ম বাংলাদেশে হলেও তাঁর বেড়ে উঠা এবং কর্ম সবকিছু ব্রিটেনে। তিনি যেভাবে ইংরেজি বলেন অনেক ইংলিশও সেভাবে বলতে পারে না। যদিও আমাদের সাথে আলাপে তার ইংরেজি দক্ষতার তেমন আভাস পাওয়া যায় না, আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলেন।

মুরব্বি হলেও তিনি হাফ ইংরেজ, তাঁর সাথে হাসিঠাট্টার সম্পর্ক আছে; তাই ভাবলাম তাকে জিজ্ঞেস করে অর্থ জেনে নেওয়া যাক। একদিন দুপুরে কিচেনে চা খাচ্ছি দাদু কি একটা কাজে ব্যস্ত, বললাম ‘দাদু F*ck অর্থ কী’? দাদু যেন ভালো করে শুনতে পায় নি আমার দিকে চেয়ে বলল ‘কিসের অর্থ’! আমি বললাম ‘F*ck দাদু’ আমাদের কাস্টমাররা প্রায় এই শব্দ ব্যবহার করে, কিন্তু আমি এর অর্থ জানিনা’।

– দাদু আমাকে বলল তোমার তো বিয়ের বয়স হয়নি; বাজারে গেছ কোনদিন?
– যাব না কেন অনেকবার গেছি, যখনই চাল, ডাল, তেল নুনের প্রয়োজন পড়েছে, খরিদ করে এনেছি।
– আরে চাল ডালের বাজার না, মেয়েদের বাজার।
– মেয়েদের বাজার মানে?
– মেয়েদের বাজার চেন না, পতিতালয়ের নাম শুনোনি
– নাম শুনেছি, যাওয়া হয়নি কোনদিন।
– ওখানে পুরুষ কিসের জন্য যায়?

আমার বয়স সতেরো, সহপাঠিনীদের দিকেই ভাল করে তাকানো হয়নি, আর পতিতালয়ে যাওয়া! আমি কিচ্ছু বলছি না দেখে, দাদু আমাকে F*ck শব্দের চ-বর্গীয় অর্থ বলে দিল।

আমার যে সংস্কার তাতে উত্তর জেনে আমি আশ্চর্য হলাম। আমি যে দেশ থেকে এসেছি সেই দেশের সমাজে এই শব্দ উচ্চারণ করলে আপনি পতিত হতে বাধ্য, সমাজচ্যুত হতে বাধ্য। কিন্তু ব্রিটেনের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই অহরহ এই শব্দ উচ্চারণ করে।

আমি দেখেছি স্যুট টাই পরিহিত ভদ্র জন যাকে আমরা বাবু কিংবা সাহেব হিসাবে অভিহিত করতে পারি বন্ধুদের সাথে আলাপে ক্রমাগত এই শব্দ ব্যবহার করে যাচ্ছে। আমি দেখেছি হিপ্পি তরুণ যার নাকে কানে ঠোঁটে অসংখ্য ছিদ্র সেও বান্ধবীর সাথে কথোপকথনে বারবার এই শব্দ উচ্চারণ করছে। আমি দেখেছি পরিবার নিয়ে খেতে এসেছে, সাথে ছোট ছোট বাচ্চা আছে কিন্তু স্ত্রীর সাথে কথা বলছে আর এই শব্দ উচ্চারণ করছে বাচ্চারাও শুনছে কিন্তু তারা নির্বিকার, যেন এটা একটা স্বাভাবিক উচ্চারণ যেন এই শব্দে দোষের কিছু নেই।

এই শব্দের অর্থ না জানলে হয়তো ভালো হতো, কারণ অর্থ জানার পর থেকে যেই আমার সামনে এই শব্দ উচ্চারণ করতো তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাতাম, কোন কোন সময় করুণার চোখে। এদের আমার খুব নিম্নস্তরের মানুষ মনে হত।

বলাবাহুল্য সময়ের সাথে সাথে আমিও এই শব্দে অভ্যস্ত হয়ে যাই অর্থাৎ প্রথম প্রথম এই শব্দ শুনে যেভাবে আশ্চর্য হতাম; যেভাবে নাক কুঁচকে আসতো এখন আর সেরকম প্রতিক্রিয়া হয় না। ব্রিটেনের সমাজে এই শব্দ খুবই সহজলভ্য…

জীবন মানুষকে প্রতিনিয়ত F*ck করছে, জীবনের অবিচারের প্রতিবাদে মানুষ মুখে শুধু উচ্চারণ করছে F*CK, এতে দোষের কিছু নেই…

দুনিয়ার মোহতেই আটকে আছে মন

দুনিয়ার মোহ জয়ে বাহবা দিচ্ছি, সুর তুলছি নিত্য
দুনিয়ার রঙ তামাশায় রাখছি সুখি চিত্ত;
কেউ জানি না কত না পাপ তুলছি আমলনামায়,
গেয়ে যাচ্ছি সুখেরই গান, ঠোঁট রেখেছি সারেগামায়।

উল্টে রাখছি পাল্টে দিচ্ছি ধর্মীয় বিধি বিধান,
জীবন জুড়ে আসছে নেমে পাপের নিদান;
কোথায় কী আর বলি, নিজের মতামত নিয়েই চলি,
মত বিরুদ্ধ হলেই আগুন হয়ে জ্বলি।

কেউ হিজাব নিয়ে করছে হাউকাউ, কেউ বোরখা
জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে শয়তানগুলো দিচ্ছে ধোকা,
কেউ বুঝেও না বুঝার ভান ধরে থেকে গেলাম চুপ,
কেউ জানে না অসুর গুলার ভয়ঙ্কর রূপ।

কত যুক্তি তর্ক কত জ্ঞানের ভান্ডার ওদের বুকে
কেবল ইসলামের জ্ঞান নেই, আল্লাহ দেন না হেদায়েতের মন্ত্র ফুঁকে
সমাজে ছড়াচ্ছে বিষ হরদম,
ইসলামকে অপমান করতেই যেন ওরা ফলে প্রতিটি কদম।

ভুল শুদ্ধ যাচাই না করেই আমরা লাফিয়ে বেড়াই সমাজে,
কেউ কেউ ইসলামের পক্ষে সাফাই গেয়েও দাঁড়ায় না জায়নামাজে;
মুখে ভালো কথা অন্তর কারো মন্দ,
এরাই সমাজে বাঁধিয়ে দেয় দ্বন্দ্ব।

কেউ কেউ মোহ উপেক্ষা করতে পারে, কেউ পারে না
মুসলিম হয়েও ইসলামের বিধি বিধানকে হেয় করতেও ছাড়ে না;
অনুতাপে হয় না কাতর
এদের দিল আল্লাহ করে দিয়েছেন পাথর।

আধুনিকতার সঙ্কট

শীতের রোদে বসে ভাবনা এলো-

বহু আগের শীতকালে, আমাদের কৈশোরে দেখেছি ভাত খাওয়ার শুরুতে দুই তিন লোকমা/গ্রাস ভাত সরিষা তেল, পিঁয়াজ কুচি/ঝাঁঝপূর্ণ লাল মুলোর টুকরো দিয়ে মেখে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বহু যুগের অভিজ্ঞতা হতে মুরুব্বীরা দাবী করতেন- এতে মুখের স্বাদ/খাওয়ার রুচি বাড়ে এবং সর্দি/কাশি লাগে না। আমরা অভিজ্ঞতার পরিবর্তে অনুকরণকে প্রাধান্য দিয়ে এসব বর্জন করে আধুনিক হলাম, এবং আধুনিকতার দেমাগে (ইচ্ছে করেই অহঙ্কার শব্দটা ব্যবহার করলাম না) ভুলে গেলাম যে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ হতে স্থানীয় পরিবেশ ও প্রকৃতি, অভ্যাস, সংস্কৃতিজাত সঞ্চিত বহু যুগের অভিজ্ঞতা উত্তম।

দুই দশক আগে, যেসব মুরুব্বীরা জীবিত ছিলেন, তাদের চাহিদা বা অভ্যাসজনিত কারণেই ঘরে ঘরে লেবুর আচারসহ বিভিন্ন আচার কাচের বোয়ামে বানিয়ে রাখা হত। আমের মোরব্বাও থাকতো। তবে লেবুর আচার আর আমের মোরব্বার বিশেষ মূল্য ছিলো, অসুস্থ বা যাদের ক্ষুধা কম ছিলো তাদের ভাতের সাথে সামান্য লেবুর আচার দেওয়া হত, হাতে হাতে ফলাফল।

ডাক্তার বললেন, “রোজ সকালে বিশ/ত্রিশ মিনিট রোদে বসবেন, শরীরে রোদ লাগাবেন।” উপদেশ শুনে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতেই ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, “হাসির কি হলো?” বিনয়ের সাথে তাকে বললাম, “না, হাসির কিছু হয় নাই। ছোটবেলা থেকে যৌবনের প্রথমভাগ পর্যন্ত সকালে ঘুম থেকে জেগে রোদে বসা, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার জন্য মুরুব্বীদের প্রবল চাপ ছিলো, তারা ভিটামিন ‘ডি’ও চিনতেন না ‘মর্নিং ওয়াক’ কাকে বলে তাও জানতেন না।

করোনা মহামারীর দিনগুলোতে সবাই রোগের নিদান খুঁজছেন। শরীরের ইম্যুনিটি বাড়ানোর জন্য প্রিয় একজন প্রকৌশলী বন্ধু নিজ গরজে ঐতিহ্যবাহী/প্রাচীন ভেষজ ফুড সাপ্লিমেন্ট ‘চ্যাবনপ্রাশ’ বানালেন। হোমমেড চ্যাবনপ্রাশ কাছাকাছি যারা নিলেন তারা একবাক্যে এর উপকারিতা স্বীকার করলেন। কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া গেলো না। কারণ, আধুনিক আমরা অমিতাভ বচ্চনের বিজ্ঞাপন করা ‘চ্যাবনপ্রাস’ বা জেমসবন্ড হিরো পিয়ার্স ব্রসনানের বিজ্ঞাপন করা ‘পান মাসালা’ মেনে নিতে পারি, কিন্তু ঘরে বানানো চ্যাবনপ্রাশ মেনে নিতে গেলে কি আর আধুনিকতা রক্ষা হয়!

বৃষ্টি বিলাস

323 নিজের সাথে আমার নিজের ছিলো অনেক কথা, খুনসুটি, ঝগড়া, আবদার, মান, অভিমান। এতো কথার মধ্যেও আমি কিন্তু কোনোদিন কথা দিইনি গুছিয়ে সংসার, নিকানো উঠোন আর পরিপাটি আলনার অথবা, রান্নার স্বাদের ঠিকঠাক মাপ। কিংবা নির্ভুল পুজোর আসন। অথবা রোজ পুজো করা। এইসব আমার জন্য নয়। আমার জন্য ছিলো খোলা মাঠ, চু কিতকিত, কিংবা মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ি, গুলি খেলা, ফুটবল, ক্রিকেট আরও কতো কি।

বড় বেশী দামাল ছিলাম আমি। সারাদিন দস্যিপনায় ভরপুর। দাদু ডাকতেন, বড়দিদি। দাদু খেতে বসলেই আমি ঠিক দাদুর পাশে। রাতে দাদুর পাশে ঘুমোনোর সময় দাদুর গল্পের ঝুলি থেকে গল্পেরা তখন টুপ করে চলে আসতো আমার ঝুলিতে।

মাঝেমধ্যে একলা যাপন ছিলো আমার প্রিয় স্বপ্নগুলোর সঙ্গে। আমাকে দেখেই তারা এসে ভিড় করতো। দুহাতের মুঠো খুশি থাকতো ওদের জন্য। ওদের সাথে বকম বকম করতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে যেতো খেয়ালই করতাম না। তারপর ঠাম্মা বলে উঠতেন এই ভরসন্ধ্যে বেলায় চুল খুলে কেউ ঘোরে! বেশ লম্বা চুল ছিলো আমার। বাঁধতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। আবার কখনো জানলার খড়খড়িতে লুকিয়ে থাকা চোখ। দুপুর বেলার এক্কাদোক্কার ছক। আমি তখন বড্ডো অলস। আমার তখন আলসেমিতেই সুখ।

আমি কিন্তু কোনোদিন কথা দিই নি শুধুমাত্র সুখের, প্রশ্নহীন বাধ্যতার, আর অনেক সম্মানের। অথবা, লোক-দেখানো তোয়াজ, মায়াবী ব্যবহার।

ছোটবেলায় জেনেছিলাম আমি অলক্ষ্মী। এই শব্দটা কেমন যেনো অস্পৃশ্য। তখনও পাভেল, ইভান আর তাতিয়ানা গেরস্ত ঘরের নাম হয়ে ওঠেনি। তখনও রদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলতাম, “ইস্পাত”, “মাদার”। এই অলক্ষ্মী নামেই হয়তো অলক্ষ্যে হেসেছিলেন সেই সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার! তাইতো জীবনের খেলাঘরে লক্ষ্মী নয় দুর্গা হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।

যখন বৃষ্টি হতো লুকিয়ে ভিজতাম ইচ্ছেমতো। আর তারপর হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো। আবার কখনো রোদ পোহানো আমের আচার মন। আবার কখনো মেঘবিলাসী ঠাকুরঘরের হাজার আলোর প্রদীপ। ঘরের কোণের খাঁজে খাঁজে চড়ুই পাখির পালক। জীবনের পথ চিনেছি গহীন বনের তুমুল ঝড়ের।

আলতা পাতা-কাজল লতা চোখের কোণের জল। তুলসি মঞ্চ, আকাশ প্রদীপ,তারারা উজ্জ্বল। একলা চাঁদ, হিমেল রাত, একলা হাতে হাত। একলা ছাদের, একলা দুপুর, একলা মনের সাথ।

এইতো, শুধু এইটকুই আমি, ভুল নামতার সাথ। তবুও হাসতে পারি যখন তখন সন্ধ্যে কিংবা রাত। কখনও মেঘ পেরিয়ে রোদের ঝিলিক মাস কয়েকের দেরি, মন খারাপের বাদলা দিনে বৃষ্টি বিলাস বাড়ি।