বিভাগের আর্কাইভঃ প্রবন্ধ

পবিত্র কোর’আনটা কি?

কোর’আনের আইন, শরীয়াহ আইন ইত্যাদি পরিভাষা দেখে দয়া করে কেউ প্রতারিত হবেন না। মনে রাখবেন কোর’আন কোনো আইনের বই না। আবার কোর’আনকে সংবিধান হিসেবে পরিচিত করার যে প্রবণতা লক্ষ করা যায় সেটাও একটা ফাঁদমাত্র।

মূলত কোর’আন কোনো সংবিধান নয়। অনুরূপ কোর’আনকে দণ্ডবিধির বইও বলা চলে না। তবে হ্যা, কোর’আনে কিছু আয়াত আছে যা অনেকটা আইনের মত শোনায়, কিছু আয়াত সংবিধানের মত শোনায়, কিছু আয়াত দণ্ডবিধির মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সর্বসাকুল্যে কোর’আন ওসবের একটাও নয়।

কোর’আনে বিশ্বপ্রকৃতি ও মহাকাশ সংক্রান্ত বহু আয়াত আছে যা বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক সত্যে পূর্ণ কিন্তু তাই বলে কি কোর’আন বিজ্ঞানের বই না কোর’আন কোনো ইতিহাসের বইও নয়, যদিও কোর’আনে অতীতের বহু জাতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

কোর’আন কী সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ স্বয়ং দিয়েছেন। বলেছেন এটা উপদেশগ্রন্থ। আবার কোর’আনকে বলো হয়েছে ‘ফেরকান’ অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকারী গ্রন্থ। বলা হয়েছে কোর’আনুল কারীম অর্থাৎ যেটা পুনঃপুনঃ পাঠ করা হয়। কারণ যেন মানুষ কোর’আনের মূল্যবোধকে সদাসর্বদা স্মরণে রেখে কাজ করতে পারে। কাজেই আল্লাহ যেটুকু বলেছেন আমরা কোর’আনকে আধুনিকতার মোড়ক পরাতে গিয়ে যেন তার বাড়াবাড়ি না করে ফেলি। কোর’আনের আইন নিয়ে যদি কেউ কথা বলতে আসে তাদেরকে সোজা প্রশ্ন করবেন, কোর’আনে কয়টা আইনের কথা আছে? কোর’আনে কয়টা রাষ্ট্র পরিচালনার ধারা-উপধারা, নীতিমালা ইত্যাদি আছে? কোর’আনে কয়টা দণ্ডবিধি আছে?

চুরি, ব্যাভিচার আর হত্যার বাইরে সমাজে হাজার হাজার অপরাধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেগুলোর শাস্তি কী হবে? আবার চুরির বিধান হাত কাটাই ধরুন। বাপের মানিব্যাগ থেকে ছেলের দশ টাকা চুরিও চুরি, রিজার্ভের আটশ’ কোটি টাকা চুরিও চুরি, উভয়ের শাস্তিই কি হাত কাটা? এবার তারা শরীয়তের বই হাজির করবে। অথচ আপনি হয়ত জানেন না সেই শরীয়তের বই আল্লাহর নাজেলকৃত গ্রন্থ নয়। সেটা আজ থেকে শত শত বছর পূর্বের একদল আলেমের রচিত গ্রন্থ, যারা তাদের পারিপার্শিক অবস্থা, স্থান, কাল ইত্যাদি বিবেচনা করে সেই সময়ের মানুষের জন্য প্রযোজ্য বিধি-বিধান রচনা করেছিলেন। সেটা কী করে কোর’আনের আইন হয়? সেটা বড়জোর আলেমদের আইন হতে পারে।

বর্তমানের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব যখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছে, তখন হাজার বছর আগের মুফতি-ফকিহদের ঐ বিধান কতটুকু প্রযোজ্য হতে পারে? কিন্তু কোর’আনের আইনের ধুয়া তুলে সেই পুরোনো আমলের শরীয়তের বইটাকেই জাতির উপর চাপানোর চেষ্টা চালানো হয়, আর তা দেখে যুগসচেতন মানুষরা ইসলামকেই ভুল বোঝেন। সত্য হচ্ছে কোর’আন ন্যায় ও অন্যায়কে বুঝতে শেখায়। সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করে দেয়। ব্যস, এবার মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে সে তার সামগ্রিক জীবনে সর্বাবস্থায় সত্য ও ন্যায়কে প্রাধান্য দেবে। কোনো বিধান সেটা প্রয়োগের ফলে আলটিমেটলি মানুষ ন্যায় পাচ্ছে নাকি অন্যায় পাচ্ছে? যদি ন্যায় পেয়ে থাকে তাহলে সেটাই ইসলামের আইন। আর যদি সে আইনের দ্বারা অন্যায়ের বিজয় হয় তাহলে সেটা তাগুতের আইন।

কোনো রাষ্ট্র, সেটার গঠন যদি এমন হয় যে তার দ্বারা আলটিমেটলি ন্যায় ও সত্যের প্রকাশ ঘটে, রাষ্ট্র পরিচালকরা ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকেন এবং জনগণ ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি পায় তাহলে সেটাই ইসলামী রাষ্ট্র। অপরাধীকে দণ্ডবিধির যে ধারায় শাস্তি দিলে ন্যায়ের বিজয় হয় সেটাই ইসলামী দণ্ডবিধি। আল্লাহ কেবল বড় বড় কয়েকটা অপরাধ- যেমন, চুরি, ব্যভিচার, হত্যা ইত্যাদির শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে, ওই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ওই পর্যন্তই। চুরির শাস্তি বড়জোর হাত কাটা পর্যন্তই। তার বেশি নয়। তবে নিম্নে যতদূর ইচ্ছা শাস্তি কমিয়ে দেওয়া যায় অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে, এমনকি ক্ষমাও করা যায়।

এই সীমারেখা নির্ধারিত না থাকলে কী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজেই তো আছে। সামান্য চুরির দায়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যেখানে কোর’আনের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠত থাকবে, সেখানে কস্মিনকালেও এমন হবার নয়।

একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ নিজে সত্য, আর সত্য থেকেই আসে ন্যায়। কাজেই ন্যায়ের স্থাপনা হওয়া মানেই আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়া, কোর’আনের শাসন কায়েম হওয়া।

এ লেখার বিষয়ে কারো কোন অভিযোগ থাকলে বা পরামর্শ থাকলে সরাসরি মুঠোফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন – 01787 682096

শিল্প ও সুস্থ সংস্কৃতির ইসলাম সর্মথন করে

প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এর সংস্কৃতি। সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে এবং দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অপরিসীম। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একটি জাতির প্রকৃত চরিত্র প্রতিফলিত হয়। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার ও বৈষম্য দূরীকরণে একটি দেশের সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি জাতিরই নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে। তাই আমরা পৃথিবী জুড়ে নানান রকম সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান দেখতে পাই। প্রত্যেক জাতিই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মর্যাদা যেন অটুট থাকে সে সম্পর্কে থাকে সচেতন। প্রত্যেক ধর্মের সাথেও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু আজ এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীদের মিথ্যে ফতোয়ার কারণে সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ সুর, সঙ্গীতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ এবং কোনো ধর্মেই সুস্থ সংস্কৃতি, বাক স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, মেধা বিকাশে সহায়ক এমন কোন কাজ নিষিদ্ধ নয়।

মানবজাতি সৃষ্টির পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন স্থানে আবহাওয়া ও জলবায়ুর তারতম্য, পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনে পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এক স্থানের মানুষের ভাষা, ভাবের আদান প্রদান, আচার-আচরণ, প্রথা, রীতি-নীতি ইত্যাদির সাথে অন্য স্থানের মানুষের বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়। ফলে স্থানভেদে সৃষ্টি হয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। আজ আমরা পৃথিবীর বুকে তাকালে হাজারো ভিন্ন রকম সংস্কৃতি, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান দেখতে পাই। প্রতিটি জাতিই তাদের স্বকীয় সংস্কৃতি ধারণ করে। পৃথিবীতে যতগুলো দেশ রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আবার একটি দেশের মাঝেও বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি।

উদাহরণ হিসেবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। জাতিগতভাবে আমাদের কিছু সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান রয়েছে যা সকল বাঙালিই পালন করে থাকেন। যেমন: বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। আবার আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাদের প্রত্যেক ধর্মেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান উৎসব হল মুসলিমদের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, ঈদ এ মিলাদুন্নবী; হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, স্বরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, ভাইফোঁটা; বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা; খ্রিস্টানদের বড়দিন। এগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট-বড় উৎসব অনুষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশে বিভিন্ন আদিবাসী ও উপজাতি রয়েছে। তাদেরও প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রাখাইনদের সাংগ্রে পোয়ে বা নববর্ষ উৎসব, বর্ষা উৎসব; মারমাদের ওয়াছো পোয়ে, ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে; গারোদের ওয়ানগালা; চাকমাদের বিজু উৎসব; মণিপুরীদের বিষু এবং চৈরাউবা উৎসব; মুরংদের চিয়া চট পাই বা গো হত্যা উৎসব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এমনকি অঞ্চলভেদেও কিছু কিছু আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় যা আরেক অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি থেকে আলাদা।

আমাদের ছোট্ট একটি দেশেই সংস্কৃতির কি বিশাল বৈচিত্র্য! তাহলে এটা সহজেই অনুমেয় যে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে কত রকমের সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। আর এই সংস্কৃতি থেকে জাতিকে আলাদা করা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট এই সকল সংস্কৃতি মানবজাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে এক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব সংস্কৃতি কতটা বৈধ।

প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মই সত্য ও সুন্দর, মানুষের সুকোমল বৃত্তি, প্রতিভা, সুর সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদিকে অবৈধ বলে না। অবৈধ হচ্ছে অসত্য, অশ্লীলতা এবং স্রষ্টার অবাধ্যতা। কোন ধর্মই এসবকে নাজায়েজ করতে পারে না। কেননা স্বয়ং স্রষ্টাই সুর ও নৃত্য সৃষ্টি করেছেন। শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল-কোর’আনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দবদ্ধ করে। কেবল কোর’আন নয়, যবুর, গীতা, পুরান ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও কাব্যময়। গীতা শব্দের অর্থই তো গান। নৃত্য হচ্ছে শৃঙ্খলার অনুপম নিদর্শন। পাখি আকাশে ওড়ে- তাদের মধ্যে বিরাজ করে শৃঙ্খলা। পাখির দল যে দিকে ওড়ে এক সাথেই ওড়ে, দলপতির অনুসরণ করে সামনে যায়, ডানে বায়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে, নিচে নামে- সব করে একতালে। পাখির কণ্ঠে তিনিই সুর ও সঙ্গীত দান করেছেন। সাগরের ঢেউয়েও আছে অপরূপ নৃত্য। সবুজ মাঠে ধানের শীষ যখন আন্দোলিত হয়- তাতেও দেখা যায় এক অপরূপ নৃত্যের নিদর্শন। আযান ইসলামের এক অনন্য সঙ্গীত। সুতরাং যিনি সুরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি সেই সুরকে নাজায়েজ করতে পারেন না।

কিন্তু আজ পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের অনুসারী আত্মাহীন, নৈতিকতাহীন একদল মানুষ তারই সৃষ্টি মানুষ সুর সঙ্গীত ও নৃত্যকলাকে কলুষিত করছে। নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কর্মকা- ও শিল্পকলা আল্লাহ কোথাও নিষেধ করেননি। সুতরাং মানুষ যত খুশি গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পারে, কেউ বিকৃত ফতোয়ার চোখ রাঙানিতে তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ করতে পারে না।

আমাদের শেষ রসুল (দ.) একটি আধুনিক সভ্যতার ভিত রচনা করেছিলেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি সেই নতুন সভ্যতা অর্ধ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। যে সভ্যতা একজন অসৎ মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করত। সেই প্রকৃত ইসলামের সময় এই সমস্ত ফতোয়াবাজি ছিল না। একটি সরল সত্য হোল, ইসলামের বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের বেলায় মানদ- হচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোর’আন যেটি স্রষ্টা প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ। রসুলাল্লাহ জানতেন যে, তাঁর বাণীকে ভবিষ্যতে বিকৃত করা হবে, অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ ঘোষণার জন্য সেটিকে তাঁর উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়া হবে, তাই তিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের জন্য সেটাই হালাল করেছি যেটা আল্লাহ হালাল করেছেন, সেটাই হারাম করেছি যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার কোন কথা কোর’আনের বিধানকে রদ করবে না, তবে কোর’আনের বিধান আমার কথাকে রদ করবে (হাদীস)।

সুতরাং যে কোন জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কেতাব দেখতে হবে। কোর’আনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি ছাড়া আর সবই বৈধ। এখন কোর’আন খুলে দেখুন গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তাহোলে এগুলি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আল্লাহ যেটিকে বৈধ করেছেন, সেটিকে কোন আলেম, মুফতি, ফকীহ, মুফাসসির হারাম করার অধিকার রাখেন না।

ভাবতেও অবাক লাগে, প্রকৃত ইসলামের যুগে যে মুসলিমরা দুর্দান্ত গতিতে অর্ধ পৃথিবী জয় করে সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করল; ধনে, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, সামরিক শক্তিতে সকল ক্ষেত্রে সবার ঊর্ধ্বে আরোহণ করল; সেই জাতি আজ সকল জাতির গোলামে পরিণত হয়ে অন্য জাতিগুলির দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে। এই অপমান, লাঞ্ছনা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খুঁজে তারা আজ অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে জায়েজ, না’জায়েজের ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত; কূপম-ুকতার গহ্বরে বসে প্রশ্ন করে, টিভি দেখা, ছবি তোলা, গান-বাজনা করা জায়েজ না না’জায়েজ। কী পরিহাস!

আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই রসুলের আনীত ইসলাম অর্ধদুনিয়ায় কায়েমের ফলে পরবর্তী মুসলিম জাতিটি সর্বদিক দিয়ে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে আসীন হন। কি সঙ্গীত, কি কাব্য, কি নতুন নতুন সুর রচনায়- কোথায় নেই তারা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান লিখে গেছেন। সেসব আজও সমাদৃত। যারা সঙ্গীতকে নাজায়েজ মনে করেন তারাও ওয়াজের মধ্যে কবি সাহিত্যিকদের সুর ছন্দ নির্দ্বীধায় ব্যবহার করেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজকে সঙ্গীত বৈধ কি অবৈধ, নৃত্য বৈধ কি অবৈধ তার প্রশ্ন উঠছে।

এর কারণ হচ্ছে সভ্য জাতি গঠনে এগুলো আজ কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের হাতিয়ারে এসব পরিণত হচ্ছে। কাব্যের নামে, নৃত্যের নামে আজ অশ্লীলতা, বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে- যে কোন কিছুর সাথেই হোক অশ্লীলতা, বেহায়াপনা- যা মানুষের ক্ষতি করে তাকে কোন ধর্মই বৈধতা দিতে পারে না। অশ্লীলতার প্রসারে সমাজে কিভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পায় তা প্রত্যক্ষ করে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেও অশ্লীলতা-বিরোধী উদ্যোগ নিচ্ছে, আইন-পাশ করছে। আশা করি কোন সুস্থ মানুষই গণমাধ্যম তথা চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যের এই নেতিবাচক দিকটিকে অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই বলে কাব্যকে, সঙ্গীতকে, নৃত্যকে, সাহিত্যকেই একচেটিয়াভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডকতার সামিল। মাথায় ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়, বরং সঠিক চিকিৎসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমাদের মনে রাখতে হবে একই সুরে, একই কবিতায় আমরা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মহিমা প্রচার করতে পারি, সমাজে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারি- আবার সেই সুর দিয়ে, সেই কথা দিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও করতে পারি। ভাল কি মন্দ তা নির্ভর করে এর ফল ব্যবহার এবং ফল কী দাঁড়াচ্ছে এর উপর। একটি বন্দুক দিয়ে আপনি ডাকাতকে প্রতিরোধ করতে পারেন আবার সেই বন্দুক দিয়ে নিরীহ মানুষকে খুনও করতে পারেন। বন্দুক এখানে শুধু একটা মাধ্যম। এটি দিয়ে কি করা হচ্ছে- ভালো করা হচ্ছে না কি মন্দ করা হচ্ছে তাই বিবেচ্য বিষয়। তেমনি সঙ্গীতে আপনি সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলবেন, ভালো কাজকে উৎসাহ দিবেন নাকি বেহায়াপনা করবেন, না কি অশ্লীলতার বিস্তার ঘটাবেন সেটাই বিচার্য। সাহিত্যের মাধ্যমে আপনি সমাজ সংস্কার করবেন নাকি, মানুষকে অরাজকতা করতে উষ্কে দিবেন, মানুষকে স্রষ্টামুখী করবেন, নাকি মানুষকে স্রষ্টাবিমুখ করবেন- এটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের উচিত চলচ্চিত্র, নাটক, গান, সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে তুলে ধরা।

ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব শেষ

প্রথম পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন, ২য় পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন,

যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান …

পর্ব তিন শুরু…

আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোন মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোন ব্যক্তির অধিক নামাজ ও অধিক রোজা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা।’ (সিরাত বিশ্বকোষ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।

একই শিক্ষার প্রতিধ্বনী করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। সে পণ্ডিতই হউক, মূর্খই হউক, সে শিবের বিষয় জানুক বা না জানুক সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থকে, সে যদি চিতা বাঘের মতো সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।

আমাদের এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বলতে কিছু ছিল না। ব্রিটিশদের শাসনযুগের আগে এখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা একটিও হয় নি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক সংঘাত অনেক হয়েছে, তবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত একটাও নয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারত দখল করার পরই চালিয়ে দিল Divide and rule নীতি। তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ বানালো, আলাদা রাজনৈতিক দল বানালো, আলাদা হোটেল বানালো, কলেজে আলাদা হোস্টেল বানালো। তারা হিন্দুদেরকে শেখালো মুসলিমরা বিদেশী আগ্রাসনকারী জাতি, তারা এ মাটির সন্তান নয়। এতদিন যে দেশে হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে, একই বাজারে সদাই করেছে, একই পুকুরের পানি খেয়েছে, হিন্দু ডাক্তার মুসলমান রোগীর চিকিৎসা করেছে, মুসলমানদের চাষ করা ফসল হিন্দুরা খেয়েছে সেই দেশেই সৃষ্টি হলো জাতিগত দাঙ্গার। রায়টে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের লাশ পড়ল, বাড়ি পুড়ল, উদ্বাস্তু হলো। শেষতক এক দেশে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না, তারা দুই জাতির জন্য দেশ ভাগ করে ফেলল। এ সবই হলো ব্রিটিশদের কূটবুদ্ধির ফল। আজ হিন্দুদের উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের মহামানবদেরকে, কেতাবকে গালি দেয়, মুসলমানদের উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিন্দুদের উপাস্যদেরকে, অবতারগণকে গালি দেয়। তাদের এই পারস্পরিক বিদ্বেষ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তখন সৃষ্টি হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পরিণতি কী তা ভারতবাসী গত দেড়শ বছরে প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশরা এভাবে দুই ভাইকে শত্রুতে পরিণত করে দিয়ে গেছে। এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কীভাবে কাজে লাগায় সে তথ্যও সকলের জানা।

কিন্তু এই শত্রুতা আর কতদিন? এখনও কি সময় হয় নি শত্রুতা ভুলে নিজেদের সত্যিকার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে আবার ভাই ভাই হয়ে যাওয়ার? এটা করার জন্য প্রয়োজন কেবল মানসিকতার পরিবর্তনের, প্রয়োজন সত্য সম্পর্কে জানার। আমরা এই দুটো জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি, তাদের উভয়ের ধর্মের মূল সত্য যে এক সেটাকে উভয়ের ধর্মগ্রন্থ থেকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা বলছি, ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ধর্ম হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট যা কোনো বস্তু ধারণ করে। আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা। আগুন যদি না পোড়ায়, পানি যদি না ভেজায়, চুম্বক যদি না টানে তাহলে সে তার ধর্ম হারালো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাবোধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্যই নবী-রসুল-অবতারগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। তারা সত্য নিয়ে এসেছেন, যারা সেই সত্যকে ধারণ করেছেন তারাই হয়েছে ধার্মিক। যদি মানুষ সত্যকেই ধারণ না করে, মানবতাবোধে পূর্ণ না হয়, সে যতই উপাসনা করুক সে ধর্মহীন। ইসলামের একটি নাম হচ্ছে দীনুল হক যার অর্থ সত্য জীবনব্যবস্থা। যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে সত্যে পূর্ণ করবে সেটাই তো প্রকৃত ধর্ম। শেষ নবী আরবে এসেছেন, তাই কোর’আনও এসেছে আরবিতে। কিন্তু ভারতবর্ষের অবতারগণ কথা বলেছেন সংস্কৃতিতে বা এ অঞ্চলের কোনো ভাষায়। তাঁদের উপর যে শাস্ত্রবাণী এসেছে সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষাতেই এসেছে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও সত্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খালের পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বৃষ্টির পানি সব পানিরই আণবিক গঠন অভিন্ন।

মুসলমানেরা যদি মনে করে আরবভূমি তাদের, হিন্দুরা যদি মনে করে ভারত কেবল তাদের, খ্রিষ্টানরা যদি মনে করে ইউরোপ শুধু তাদের, ইহুদিরা যদি মনে করে ফিলিস্তিন কেবল তাদের, বৌদ্ধরা যদি মনে করে মিয়ানমার কেবল তাদের তাহলে সেটা হবে চরম মূর্খতা। কারণ পৃথিবী আল্লাহর, সমস্ত ভূমি আল্লাহর। মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, মাটিতেই আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই এই মাটির উপর অধিকার রয়েছে প্রত্যেক বনি আদমের। কোর’আন মোতাবেক মাটির মানুষের ভিতরে আল্লাহর রূহ রয়েছে (সুরা হিজর -৯)। সনাতন ধর্মমতে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার অংশ রয়েছে। প্রতিটি মানুষ স্রষ্টার প্রতিভূ। সেই মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে কেউ আল্লাহর, পরমাত্মার, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না।

একই ভাবে খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মও একই স্রষ্টা থেকে আগত, যদিও তাদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এদের সকলকেই তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে এক মহাজাতিতে পরিণত করা সম্ভব। সেটা কীভাবে তা পরবর্তী কোনো এক সময় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, এলি, ভগবান, পরমব্রহ্ম চান মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব। আর ইবলিস, শয়তান, এভিল স্পিরিট, ডেভিল, লুসিফার, আসুরিক শক্তি চায় মানুষে মানুষে অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ। প্রকৃত যারা ধার্মিক তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর এই চাওয়াকে পূরণ করাই হলো ধর্ম।

এত কথা, এত লেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তা হলো এই- এ অঞ্চলে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের মতো জঙ্গিবাদী তা-ব সেভাবে এখনও বিস্তার লাভ করে নি, তবে সেই ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই তা-বকে রুখে দিতে হলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে ঐক্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কেবল ঈদের দিনে মুসলমানে মুসলমানে কোলাকুলি আর পূজার দিনে হিন্দুতে হিন্দুতে আলিঙ্গন করলে হবে না। তাদের উভয়ের সঙ্গে উভয়েরই কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করতে হবে। এতে কারো জাত যাবে না। এজন্যই নজরুল লিখেছিলেন,

ছুঁলেই তোর জাত যাবে?
জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।

সমস্ত বনি আদমকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রাণের তাগিদে, সেই তীব্র আকুতি নিয়ে দেশজুড়ে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে আমরা হাজার হাজার সভা-সমাবেশ, সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সর্বধর্মীয় সম্মেলন করেছি। ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, শত নির্যাতন সহ্য করে, নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে আমরা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে এজন্য ভয়াবহ মাশুল দিয়ে হয়েছে। আমার নিজ বাড়িতে বহুবার হামলা চালানো হয়েছে, বাড়ি ঘর আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা হয়েছে, সবকিছু লুটপাট করা হয়েছে, আমাদের দুই ভাইকে গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে জবাই করেছে ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসারীরা। হামলা হয়েছে হেযবুত তওহীদের আরো বহু সদস্য-সদস্যার উপরও। জানি না কবে আমরা ধর্মের নামে দাঁড়িয়ে থাকা অধর্মের এই প্রাচীরকে ভাঙতে পারবো, তবে এটা জানি সত্যের মোহনায় একদিন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসে মিলিত হবেই হবে ইনশাল্লাহ। সেদিন পরাজিত হবে ইবলিস শয়তান, সেদিন আল্লাহর বিজয় হবে। আল্লাহর বিজয় মানেই মানবতার বিজয়।

ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব দুই

প্রথম পর্ব

প্রথম পর্বের পর -নূহ (আ.) ও রাজা মনুহ্: মহর্ষী মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক। তিনিই হচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ.)। পুরাণে মহাভারতে তাকে বৈবস্বত্ব মনু, রাজা ন্যূহ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে জীবনরক্ষা করেন। তাদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আবার মানবজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্যই হাদিসে নূহ (আ.) কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। হিন্দু ধর্মের মৎস্যপুরাণ গ্রন্থে এবং মহাভারতেও একই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বৈবস্বত মনুর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। সেই মহাপ্লাবনের পর এই মনু থেকেই মনুষ্যপ্রজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্য সনাতন ধর্মে কেউ কেউ মনুকেও মানবজাতির আদিপিতা বলে থাকেন।

সনাতন ধর্ম ও দীনুল কাইয়্যেমাহ: ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ শাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। সনাতন অর্থও তাই। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ।

দুই জীবন: উভয় ধর্মেই ইহকাল ও পরকালের ধারণা রয়েছে। মো’মেনদের জন্য জান্নাত আর কাফেরদের জন্য জাহান্নাম। সনাতন ধর্মেও রয়েছে ধার্মিকদের জন্য স্বর্গ ও অধার্মিকদের জন্য নরক। ইসলাম বলছে জান্নাতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুলসিরাত পার হতে হবে, আর সনাতন ধর্ম বলছে বৈতরণী নদী পার হয়ে বৈকুণ্ঠে যেতে হবে।

উপাসনা পদ্ধতি: উভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।

মালায়েক ও দেবদেবী: ইসলামে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে তেমনি হিন্দু ধর্মে আছে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। এই ফেরেশতা ও দেবদেবী এক বিষয় কিনা এ নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে অবশ্য মতভেদ রয়েছে, যেমনটা অধিকাংশ বিষয়েই তারা করে থাকেন।

এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে হাজার হাজার দেওয়া যাবে। বেদ ও কোর’আনের যে আয়াত ও শ্লোকগুলো হুবহু একার্থবোধক তার তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এত মিল থাকা সত্ত্বেও এই দুটো সম্প্রদায় একত্রে থাকতে পারছে না যে বিষয়গুলো নিয়ে সেগুলো হচ্ছে নিতান্তই ধর্মের গৌণ বিষয় যেমন খাদ্যাভ্যাস, উপাসনা পদ্ধতি, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে। এক সময় এদেশের মুসলমানেরাও ধুতি পরত, কিন্তু ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলা হচ্ছে। এসব অতি তুচ্ছ বিষয়। অমিলের বিষয়গুলো খুবই দুর্বল, কিন্তু মিলের বিষয়গুলো খুবই মৌলিক। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত মুসলমানদেরকেই। কেন সেটা বলছি।

আমরা জানি, আমাদের নবী কেবল আরবের নবী নন, তিনি বিশ্বনবী। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে। আল্লাহ নিজেও পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য (জামিয়া) আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁর টাইটেল হচ্ছে রহমাতাল্লিল আলামীন, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ রাখা হয় নি। এক সাহাবির উপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তুমি দেখবে অচিরেই এমন সময় আসবে যখন একা একটা সুন্দরী মেয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কারপরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে সা’না থেকে হাদরামাউত চলে যাবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য পশুর ভয় ছাড়া কোনো ভয় থাকবে না। এখানে বলা হয় নি যে সেই নারী হিন্দু, নাকি মুসলমান, নাকি খ্রিষ্টান বা ইহুদি। কাজেই এটি পরিষ্কার যে, নবী এসেছেন সমগ্র মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরাই সেরা জাতি। তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতিকে (নাস) ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (সুরা ইমরান ১১০)। আল্লাহ ও তাঁর রসুল কর্তৃক উম্মাহর উপর অর্পিত সুস্পষ্ট দায়িত্ব এটি, এ থেকে পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সকল জাতি, ধর্মের মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বনী আদমকে এক কাতারে নিয়ে আসা উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব। এজন্যই এ দীনের অন্যতম একটি নীতি আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন যে, লা ইকরাহা ফিদ্দীন অর্থাৎ দীন নিয়ে জবরদস্তি চলবে না। দীন নিয়ে বাড়াবাড়িও চলবে না।
তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত সকল নবী-রসুলদের প্রতি এবং আল্লাহর নাজেল করা সকল ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা। পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রত্যেকটি জনপদে, প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তাহলে এত বিরাট ও প্রাচীন জনপদ ভারতবর্ষে কি কোনো নবী আসেন নি, কোনো কেতাব আসে নি? অবশ্যই এসেছেন, তবে কালের আঘাতে তাদের শিক্ষাও বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের প্রতিও মুসলমানদের বিশ্বাস রাখা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। তার মধ্যে কোর’আনে এসেছে মাত্র সাতাশ/আটাশ জনের নাম। বাকিদের অনুসারীরাও তো পৃথিবীতে আছেন, তাদেরকেও হেদায়াতের পথে আনার দায়িত্ব মুসলমানদের উপরই আল্লাহ অর্পণ করেছেন। কারণ তাদের কাছেই আছে শেষ কেতাব যেটা কেউ বিকৃত করতে পারে নি এবং শেষ নবীর আদর্শ। সেই আদর্শ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আজও মানবজাতির আকাশে জাজ্বল্যমান। শেষনবী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে অন্যসব জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।

কাজেই আমাদেরকে ছাড় দিতে হবে বেশি, আমাদেরকে উদার ও সহনশীল হতে হবে বেশি। আল্লাহর এই দীনের ঘরের দরজা অনেক বড়। এখানে গোটা মানবজাতি প্রবেশ করবে। ঐ দরজায় খিল লাগিয়ে তা সংকীর্ণ করা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক শতাব্দী থেকে তা-ই করা হয়েছে। আজকের মুসলিম জাতির এই হীনতার কারণ ঐ দায়িত্ব থেকে পলায়ন করে শরিয়ার টুকিটাকি বিষয় নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি আর জবরদস্তি।
হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির ভূমিকা অগ্রণী হলেও হিন্দু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব কম নয়। এটা চরম মূর্খতার পরিচয় যে আমরা এক স্রষ্টা থেকে আগত, এক জাতি, এক বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এভাবে একে অপরকে বিধর্মী মনে করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে চলেছি। আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে অশুচি অপবিত্র মনে করি। আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি। আমাদেরকে বুঝতে হবে, স্রষ্টা শুধু মসজিদে মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন না। স্রষ্টা আর্ত-পীড়িত, নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারে ব্যথিত হন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা এই নির্যাতিত মানুষের দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী, ডেভিল, দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে বাস্তবজীবনের সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে না দেখে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন। তারা নবী-রসুল ও অবতারদের প্রাণান্তকর সংগ্রামকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। তারা ধর্ম ত্যাগ করে লেবাস ধরেছেন। তারা মানুষকে জানতে দিচ্ছেন না যে, সকল ধর্মেই ধর্মব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। তাইতো ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি। এজন্য মানুষের কল্যাণসাধনই প্রকৃত এবাদত। যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান … পর্ব তিন

ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব এক

এ কথা সকল তথ্যাভিজ্ঞ মানুষই স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিকে পরিণত হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে রাষ্ট্র যখন কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ধর্ম দিনশেষে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। এ পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ধর্ম এখন বিশ্বরাজনীতির এক নম্বর ইস্যু। ইউরোপে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী খ্রিস্টান প্রভাবাধীন দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে এবং জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জড়িত হয়ে গেছে। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ক্রমশ উত্থান কীভাবে রাজনীতির অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।

ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে বৌদ্ধরা ছিল বড় জনগোষ্ঠী। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমান বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন চালিয়ে প্রায়ই নির্মমভাবে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখানে করা হচ্ছে হিন্দুদের উপর আর ভারতে করা হচ্ছে মুসলমানদের উপর।

এই দাঙ্গা, হামলার প্রেক্ষিতে উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো সন্দেহ, আরো দূরত্ব, আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি যতদিন তাদের মধ্যে বজায় রাখা যায় ততই সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুবিধা; তারা এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই আমাদের দেশটিকে ভালোবাসি, আমরা উপলব্ধি করি যে এ দেশের মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়ে হিন্দুরা মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আর মুসলমানেরা এই মাটি দিয়েই ইটের মসজিদ গড়ে নামাজ পড়ে। এই মাটির ফল-ফসল খেয়েই হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মানুষ পুষ্ট হয়। আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভিতরে বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব এখন প্রবল যা অবিলম্বে দূর করা জরুরি। যখন কোনো লোকালয়ে অগ্নিকা- হয় তখন কারো ভবনই রক্ষা পায় না, দেবালয় মসজিদ কিছুই এড়ায় না। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকজন বারে গিয়ে ফুর্তি করেছে। কিন্তু কয়দিন পরে দেখা গেল সেই আগুন সিরিয়াকেও ছাড়ল না, এখন সিরিয়ার মানুষ ইউরোপে ভিক্ষা করে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সহজ কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা অত সহজ নয়। ওটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরকারগুলো চেষ্টা করে আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারণ সরকারের কাছে ওগুলোই আছে। সরকারের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¦না দেন, ভাঙা উপাসনালয় সংস্কার করে দেন, ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগিয়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন যখন ভেঙে যায় তখন সেটা জোড়া লাগানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেজন্য এখন দুই সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম এক নম্বর ইস্যু, ধর্মকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিদ্বেষ বিভক্তি দূর করতে হলে উভয় সম্প্রদায়কে মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করার জন্য তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে তাদের গোড়া কোথায়, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি কিনা, তারা আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। তারা তাদের উভয়ের লালিত ধ্যানধারণা, সংস্কার থেকে কতটুকু ছাড় দিতে রাজি হবে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

আমরা দেখব হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মদর্শনের মৌলিক বহু বিষয়ের গোড়া এক জায়গায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেবল ডালপালা নিয়ে। এখন এই দুটো ধর্মের মধ্যে কী কী বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ সেদিকে আলোকপাত করব।

একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।

এক বাবা-মা: এক পিতামাতা থেকে সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামে বলা হচ্ছে তাঁরা হচ্ছেন বাবা আদম ও মা হাওয়া। সনাতন ধর্মে তাঁদেরকে বলা হচ্ছে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)। চলমান … পর্ব দুই

সওম (রোজা) কাদের জন্য?

মহান আল্লাহ বলেন- হে মো’মেনগণ, তোমাদের উপর সওম (রোজা) ফরদ করা হয়েছে, যেরূপ ফরদ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। [সুরা বাকারা- ১৮৩]
এই আয়াত নাজেলের মাধ্যমেই দ্বিতীয় হিজরিতে মো’মেনদের জন্য সওম ফরদ ঘোষিত হয়। এই নির্দেশ মেনেই আমরা প্রতি বছর দীর্ঘ এক মাস (রমজান মাস) সওম পালন করি। কাজেই এই আয়াতটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এই আয়াত নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

এই আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে সওম ফরদ করা হয়েছে কেবল মো’মেনদের জন্য। যে মো’মেন নয় তার জন্য সওম পালন নিরর্থক। তাহলে মো’মেন কাকে বলে সেটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার।

আমরা সাধারণ অর্থে জানি যে, কলেমা পড়ে ঈমান আনলে সে মো’মেন হয়। অন্য ধর্ম থেকে কেউ যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন প্রথমেই সে বলে আশহাদু (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি), অর্থাৎ একজন মো’মেন হয় একটা সাক্ষ্য দিয়ে বা শপথবাক্য পাঠ করে। শপথ করলে সেখান থেকে আর সরে আসা যায় না। সেই শপথবাক্যটা হলো- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই, মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল।” এই শপথবাক্য পাঠ করার সাথে সাথে জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা ফরদ হয়ে গেল। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, আমাদের সামাজিক জীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, জাতীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবন এক কথায় সকল অঙ্গনেই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য (ফরদ) হয়ে গেল। যদি কোনো একটা অঙ্গনেও আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করি তবে আর আমি মো’মেন থাকতে পারলাম না, আমার শপথ থেকে আমি সরে গেলাম, বিচ্যুত হলাম।

যদি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে এক ওয়াক্ত নামাজ আপনি পড়তে না পারেন, একটা রোজা যদি করতে না পারেন তবে আপনি গোনাহগার হবেন কিন্তু মো’মেনের খাতা থেকে আপনার নামটা কাটা পড়বে না কিন্তু যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এখন থেকে আপনি আর নামাজ পড়বেন না বা রোজা রাখবেন না তাহলে আপনি আর মো’মেন রইলেন না। আপনি সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, সত্য অস্বীকারকারী তথা কাফের হয়ে গেলেন। তখন আপনার অন্য সকল আমল নিরর্থক হয়ে যাবে।

একইভাবে আপনার সমাজ যদি এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ সমাজে আর নামাজ চলবে না, রোজা চলবে না তাহলে ঐ সমাজটা কুফরি সমাজ বলেই গণ্য হবে, সেই সমাজের একজন হিসাবে আপনিও কাফের বলেই গণ্য হবেন যদি না আপনি তওবা করে ঐ সমাজ থেকে হেযরত করে সত্যের পক্ষে চলে আসেন। রসুলাল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের পর অনেক গোত্র এভাবে জাকাত না দেবার সিদ্ধান্ত নিল ফলে খলিফা আবু বকর (রা.) তাদেরকে স্বধর্মত্যাগী ঘোষণা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন যাকে ইতিহাসে রিদ্দার যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একটু ভেবে দেখুন তো, যে গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করলেন সেই গোত্রগুলোর প্রতিটা ব্যক্তিই কি অপরাধী ছিল? প্রতিটা ব্যক্তিই কি কাফের হয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ, কারণ তারা সমাজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সত্যের পক্ষ অবলম্বন করতে পারেনি।

এখন আমার প্রশ্ন- বর্তমান মুসলিম বিশ্ব কি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে? আমরা কেবল যাকাতভিত্তিক অর্থনীতিই প্রত্যাখ্যান করিনি, আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি সুদভিত্তিক অর্থনীতি। আমরা আল্লাহর দেওয়া আইন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মনীতি, আন্তর্জাতিক নীতি, যুদ্ধনীতি এক কথায় সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে গ্রহণ করেছি পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’রটা। তাহলে আমরা কীভাবে মো’মেন থাকলাম? আর আমরা যদি মো’মেনই না থাকি তাহলে তো আমাদের সমস্ত আমলও নিরর্থক হবে। এখন যদি আবু বকর (রা.) বা অন্য যে কোনো আসহাব পৃথিবীতে আসতেন তবে অবশ্যই আমাদের বিরুদ্ধে রিদ্দার যুদ্ধ করতেন।

তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? কীভাবে আমরা মো’মেন হবো? আমরা তো চাইলেই এখনই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারছি না। এখন উপায় কী?

মহান আল্লাহ বলেন, “মো’মেন শুধুমাত্র তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে, পরে কোনো সন্দেহ পোষণ করে না, জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ [সুরা হুজরাত- ১৫]। এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের করণীয় হলো-আল্লাহকে হুকুমদাতা, মোহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে (এটাই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান, আমানু বিল্লাহি ওয়া রসুলিহি)। কোনো সন্দেহ পোষণ করা যাবে না (ছুম্মা লাম ইয়ারতাবু) অর্থাৎ এই স্বীকৃতি বা প্রতিজ্ঞা থেকে পিছপা হওয়া যাবে না, বিচ্যুত হওয়া যাবে না। জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় (জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য) জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) করতে হবে।

এই তিনটি শর্ত মানলে আমরা মো’মেন হতে পারব, অন্যথায় আমাদের সকল আমল নিরর্থক হবে। আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যদি প্রচেষ্টা করতে চাই, সংগ্রাম করতে চাই তাহলে প্রথমেই এই স্বীকৃতিপ্রদানকারীদেরকে (মো’মেনদাবীদার) ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রচেষ্টার প্রথম অংশ হলো- যতভাবে পারা যায় মানুষকে এটা বোঝানো যে, কেন আমাদের সমাজে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। এই কাজটিই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। এই সত্যের উপর সকলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান করছি আমরা। মো’মেন হবার যে শর্ত আল্লাহ দিয়েছেন সেটা পূর্ণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।

লা ইকরা ফি দ্বীন – ধর্মবিশ্বাসে জোর জবরদস্তি চলে না

ইসলামের বিরুদ্ধে বহুল উত্থাপিত একটি অভিযোগ হচ্ছে- ‘ইসলাম বিকশিত হয়েছে তলোয়ারের জোরে’। পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া, লেখক, সাহিত্যিক এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠী এই অভিযোগটিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তাদের প্রচারণায় অনেকে বিভ্রান্তও হচ্ছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রতি অনেকের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি ইসলাম প্রচারে জোর-জবরদস্তির কোনো স্থান আছে? রসুলাল্লাহ ও তাঁর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী জাতির ইতিহাস কী বলে?

ইসলাম প্রতিষ্ঠার নীতিমালা আল কোর’আন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। এই দীনে কোনো জোর জবরদস্তির স্থান আল্লাহ রাখেন নি। তিনি বলেছেন- দীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, কারণ সত্য থেকে মিথ্যা পৃথক হয়ে গেছে (সুরা বাকারা, ২৫৬)। অন্যত্র তিনি বলছেন-আল্লাহ কখনও কাউকেই তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না (সুরা বাকারা, ২৮৬)। কোর’আনে রসুলাল্লাহর যে দায়িত্ব আল্লাহ সুনির্দিষ্ট করে দিলেন সেখানেও জোর জবরদস্তির কোনো স্থান রাখলেন না। কোর’আনে আল্লাহ রসুলকে বলছেন, তুমি তোমার মালিকের পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ সহকারে উৎকৃষ্ট পন্থায় আহ্বান করো। (সুরা নাহল, ১২৫) তোমার কাজ হচ্ছে শুধু ঠিক ঠিক মতো পৌঁছে দেওয়া। (সুরা আন নুর, ৫৪; সুরা ইয়াসীন, ১৭)। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে- আল্লাহ কারও ধর্মবিশ্বাসের ওপর জোর-জবরদস্তি চালিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করছেন না। আল্লাহর নীতি হলো বুঝিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বলে-লিখে, বক্তৃতা করে ইত্যাদি যত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্ভব মানুষের সামনে সত্যকে উপস্থাপন করা, হক্বের পথে আহ্বান করা, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিবে মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর হুকুম অমান্য করার শামিল। ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, সত্য গ্রহণ বা বর্জন করা নিয়ে, আল্লাহর প্রতি, রসুলের প্রতি, কেতাবের প্রতি ঈমান আনা নিয়ে কোনো জবরদস্তি চলে না। সত্যকে দেখে যারা গ্রহণ করে নেবে তারা আলোকিত হবে, আর যারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তারা অন্ধকারেই রয়ে যাবে। সত্যের বার্তাবাহকদের এ ক্ষেত্রে একটি মাত্রই কাজ, সত্য উপস্থাপন করা। এমনভাবে উপস্থাপন করা যার বিরোধিতা করার মতো বা ত্রুটি বের করার মতো কোনো সুযোগ না থাকে। যার সংস্পর্শে আসলেই মানুষ সত্যকে চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু আজ ইসলামের নাম করে নিজেদের মনগড়া মতামতকে অন্যের বিশ্বাস ও মতের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা ইসলাম নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়াও নয়।

জবরদস্তি বিভিন্ন প্রকারের আছে। শুধু ইসলাম নয়, যারা আজ ইসলামের সমালোচনা করেন, সেই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ইতিহাসও জোর-জবরদস্তিমূলক ইতিহাস। দেশে দেশে গণতন্ত্রকে গেলানোর জন্য কত কিছুই না করা হচ্ছে। পৃথিবীতে সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের বসবাস। এই সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের রুচি-অভিরুচি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, মননশীলতা, স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ এক নয়। একেক দেশের মানুষের চরিত্র একেক ধরনের। যে গণতন্ত্র ইউরোপের মানুষকে কিছুটা সাফল্যের ভাগী করতে পেরেছে সেই গণতন্ত্র এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষকে সাফল্য নাও দিতে পারে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যে সিস্টেম ফলপ্রসূ সেটা আমেরিকার জনজীবনে হয়তো খাপ খাওয়ানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। বড় কথা হচ্ছে- এসব সিস্টেম মানবসৃষ্ট হওয়ায় এবং মানুষের শক্তি-ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় মানুষের তৈরি এসব সিস্টেম পৃথিবীর কোনো এক ক্ষুদ্র অংশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও সারা পৃথিবীতে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, যেমন আজ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা ও তার তল্পিবাহক মিডিয়া এই প্রাকৃতিক সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা যে কোনো উপায়ে সারা পৃথিবীতে কথিত গণতন্ত্র কায়েম করার প্রচেষ্টায় মত্ত। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন জাতির বিশ্বাসপ্রসূত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, শক্তি প্রয়োগ করছে। যারা তাদের মতবাদ মানতে চায় না তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, আর তাতেও ফল না হলে সামরিক হামলা করে দেশ দখল করছে, ঘর-বাড়ি, স্থাপনা ধ্বংস করছে। এখানে মানবতার কোনো বালাই নেই, জনগণের মতামতের কোনো জায়গা নেই। বৈধ-অবৈধ’র কোনো মানদ- নেই। যার যে বিশ্বাসই থাকুক, যে জাতি যে মতবাদই পছন্দ করুক পশ্চিমা সভ্যতার কাছে তার কোনো দাম নেই। পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবাইকে মানতে হবে, সব জাতিতে কার্যকর করতে হবে এটাই যেন শেষ কথা। প্রশ্ন হচ্ছে- যারা দু’বেলা ‘তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচার হয়েছে’ বুলি আউড়িয়ে সত্যের উপর মিথ্যার প্রলেপ লাগাচ্ছে তারাই আবার কোন যুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীন দেশের মাটিতে বোমা ফেলছে?

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রসুল মক্কা জীবনে বহু জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু প্রতিপক্ষকে কোনো আঘাত করেন নি। দৃষ্টান্তহীন নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি তাঁর অনুসারীদের বলতেন- আসবের আসবের, সবর কর। তিনি কারও উপর ক্রুদ্ধ হন নি, অভিশাপ দেন নি, বরং ওই নির্যাতনকারী মানুষগুলোর পক্ষ নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করেছেন। এরপর যখন তারা ঈমান আনলো, সত্যকে আলিঙ্গন করল তখন ওই মানুষগুলোই রসুলাল্লাহকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে শুরু করল। উমর (রা.) রসুলকে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে হত্যা করতে ছুটে গেলেন, কিন্তু অচিরেই রসুলের চরণতলে নিজেকে নিবেদন করলেন- এই পরিবর্তন কি তলোয়ারের শক্তিতে হয়েছিল?

ইতিহাস মতে রসুলাল্লাহ ও তাঁর জাতি যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছিল এবং রক্তপাত ঘটিয়েছিল সেটা কারও ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল না। আসলে ওই যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এই জাতির ইতিহাস পড়লে খুব সহজেই বোঝা যায় যে, রসুলের হাতে গড়া ওই উম্মতে মোহাম্মদী জাতি কোনোদিন কোনোজাতির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে নি। মুসলিম শাসনের অধীনে থেকে অন্যান্য ধর্মের মানুষ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করে গেছে। এমনকি তাদের কেউ কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি কোন ধর্মের বিধান থেকে দেওয়া হবে সেটাও বেছে নিয়েছে ওই অপরাধীই, উম্মতে মোহাম্মদী তা কার্যকর করেছে মাত্র। শুধু তাই নয়, ওই জাতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও কতটা সচেতন ছিল তা বোঝা যায় ওমর (রা.) এর একটি ঘটনা থেকে। ওমর (রা.) তখন আমিরুল মু’মিনিন, জাতির ইমাম বা নেতা। পবিত্র জেরুজালেম শহর মুজাহিদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ঘুরে ঘুরে শহরের দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখার সময় যখন খ্রিস্টানদের একটি অতি প্রসিদ্ধ গীর্জা দেখছিলেন তখন নামাজের সময় হওয়ায় তিনি গীর্জার বাইরে যেতে চাইলেন। জেরুজালেম তখন সবেমাত্র মুসলিমদের অধিকারে এসেছে, তখনও কোন মসজিদ তৈরিই হয় নি, কাজেই নামাজ খোলা ময়দানেই পড়তে হতো। জেরুজালেমের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বিশপ সোফ্রোনিয়াস ওমরকে (রা.) অনুরোধ করলেন ঐ গীর্জার মধ্যেই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ পড়তে। ভদ্রভাবে ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ওমর (রা.) গীর্জার বাইরে যেয়ে নামাজ পড়লেন। কারণ কি বললেন তা লক্ষ্য করুন। বললেন- আমি যদি ঐ গীর্জার মধ্যে নামাজ পড়তাম তবে ভবিষ্যতে মুসলিমরা সম্ভবতঃ একে মসজিদে পরিণত করে ফেলত।

আজকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতা ধরে আছেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকেই উৎকৃষ্ট পন্থা বিবেচনা করেন, ইসলামকে মনে করেন প্রগতিবিরোধী, বাকস্বাধীনতা-বিরোধী, তাদের প্রতি প্রশ্ন- প্রকৃত ইসলাম মানুষকে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিল, নিরাপত্তা দিয়েছিল আজকের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কি তার এক ভগ্নাংশও দিতে পেরেছে? এটা ঠিক যে, কূপমন্ডক সংকীর্ণমনা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে ইসলামের প্রকৃত রূপ আজ হারিয়ে গেছে। তাদের অতি বিশ্লেষণ, বাড়াবাড়ী আর সত্যকে অস্বীকার করার কারণে ইসলাম আজ আর আল্লাহ রসুলের সেই ইসলাম নেই। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের বিপরীতমুখী এই বিকৃত ইসলাম দেখে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করা নিশ্চয়ই বোকামি। আল্লাহর অসীম করুণা যে, প্রকৃত ইসলামের জ্ঞান তিনি হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। সেই প্রকৃত ইসলামের অনাবিল রূপটি আমরা সর্বস্তরের মানুষের সামনে উপস্থাপন করছি।

এই মহিমান্বিত রজনীতে আমরা কি করব

ইসলামী শরীয়তে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাত আছে তার অন্যতম হল লায়লাতুল বরাত আমাদের দেশে যা শবে বরাত নামে পরিচিত। বাকী রাতগুলো হল লায়লাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর এবং ঈদের রাত্রিগুলো।

এই সমস্ত রাতের অসীম ফজিলত রয়েছে। এই সব রাত আসলে আমাদের জীবনে আসে বোনাস হিসেব। আসে আত্মশুদ্ধির জন্য। আর আসে পরকালীন পাথেয় অর্জনের এক দারুণ সুযোগ নিয়ে। এইসব রাত তওবা ও অনুতাপ করার জন্য, পাপ হতে পূণ্যের পথে আসার জন্য, জীবনকে সুপথে পরিচালিত করার দৃড় শপথ নেয়ার জন্য, সর্বপোরি আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) নৈকট্য ও ভালবাসা অর্জনের জন্য।

শবে বরাতের প্রতিটি ক্ষণ তাই অতি মূল্যবান। এটি আপনার মালিকের পক্ষ থেকে আপনার জন্য বিশেষ দয়া ও রহমত। এ রাতের প্রতিটি মূহুর্ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি’র জন্য ব্যয় করা উচিত। নফল ইবাদত, নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জিকির আসকার ইত্যাদির মাধ্যমে সারারাত অতিবাহিত করা উচিত। ফরজ নামাজগুলো অবশ্যই জামাতে পড়বেন। এ রাতে এমন কোন প্রোগ্রাম রাখবেন না যাতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। একাগ্রচিত্তে আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) দিকে মনোনিবেশ করুন। দান খয়রাত করুন, চেষ্টা করুন অভাবী ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে ফিরিয়ে না দিতে। ভালখাবার তৈরি করুন । নিজেরা খান, অন্যকে খাওয়ান। আমাদের দেশে এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরির প্রচলন আছে তা করতে পারেন। কোন সমস্যা নাই। কিছু কিছু লোক আপনাকে হালুয়া রুটি তৈরি করত নিষেদ করবে। এরা এক ধরনের বেকুব বটে। খাবার দাবার হালাল হলেই সেটা করা যায়, খাওয়া যায় এতে কোন নিষেদ নাই। আমাদের দেশে আমরা ছোলামুড়ি দিয়া ইফতার করি, ঈদের দিন সেমাই পাকাই। এগুলো কোনটাই অবৈধ নয়। একইভাবে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খেলে অন্যকে খাওয়ালে ভাল’র চেয়ে মন্দ কিছু নাই। আল্লাহতো অন্যকে খাওয়ানো পছন্দ করেন। নিজে খাবেন, গরীব দুঃখী, আত্মীয় বন্ধুকে খাওয়াবেন। তবে এই খাওয়া দাওয়া যাতে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটায়। এ রাতে গোসল করাও পূণ্যময়। এ রাতে গোসলের প্রতি ফোটা পানির জন্য রয়েছে অতি উত্তমপ্রতিদান। এ রাত হল ভাগ্যরজনী। এ রাতে মানুষের আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। পরবর্তী এক বছরের জন্ম মৃত্যু, রিজিক সুনির্দিষ্ট হয়।

এ রাত ক্ষমার রজনী। হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী এ রাতে বনু কালবের ছাগ-পালের পশমের চেয়েও অধিক বান্দাকে আল্লাহ ক্ষমা করেন। এ রাতে জান্নাতের প্রথম দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন আজ রাতে রুকুকারীর জন্য রয়েছে সুসংবাদ। একই ভাবে বাকী দরজাগুলো তে যথাক্রমে সিজদা, জিকির, আল্লাহর ভয়ে ক্রনদনকারী, তসবিহ থলিলকারী ও মুমীন মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ ঘোষনা করা হয়। সপ্তম দরজা হতে বলা হয় প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা মন্জুরের নিশয়তা আর অষ্টম দরজা হতে ক্ষমার নিশ্চয়তা ঘোষনা করা হয়।

এ রাতে আল্লাহর সাথে শরিককারি, অহংকারী, হিংসুক, ব্যাভিচারি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, যাদুকর-গণক প্রভৃতিকে ক্ষমা করা হয় না। এছাড়াও এই তালিকায় মদ্যপ, খুনী, জুয়াড়িরাও রয়েছে। তবে এই সব অপকর্ম হতে কায়মনোবাক্যে তওবা করলে আল্লাহ তা’লা ক্ষমা করে দিবেন।

মহানবী ( দঃ ) এই রাতে কবর জিয়ারত করতেন। জান্নাতুন বাকীতে যেতেন। সুতরাং এ রাতে কবর জিয়ারত করুন। মা-বাবা, দাদা, দাদী, নানা,নানী আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহতো ক্ষমাশীল। হয়তো এ রাতের প্রার্থনা আপনার স্বজনের আজাব আনন্দে পরিনত করে দিতে পারে। আর স্মরণ করুন তাদের মত আপনাকেও একদিন কবরবাসী হতে হবে। সেই কবরে যাবার পাথেয় আপনার কতটুকু আছে?

প্রার্থনা করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বাবা মা ভাই বোন সন্তান সন্ততি আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য, সমস্ত মুসলিম জাহানের জন্য। জীবিতদের জন্য। মৃতদের জন্য। সুস্থদের জন্য। অসুস্থদের জন্য। শিশুদের জন্য বৃদ্ধদের জন্য। ইহকাল ও পরকালের জন্য। ঈমান ও আমলের জন্য। আল্লাহর রসুলের ( দঃ ) সুপারিশ লাভের জন্য।

যা করবেন না
১। আড্ডাবাজি
২। আতশবাজি
৩। অযথা সময় নষ্ট করা
৪। হাসি ঠাট্টা আমোদ-ফূর্তি করে বাজে সময় পার করা।
৫। নেটে, ব্লগে, ফেসবুকে ফাও সময় নষ্ট করা।
৬। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা
৭। গান বাজনা, নাটক সিনেমা, টিভি এই সব নিয়ে সময় কাটানো।
৮।অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো।

প্রোক্রাস্টেস এর বিছানা

প্রোক্রাস্টেস এর একটা সরাইখানা ছিল। সেইটা ছিল এথেন্স এবং ইলিউসিস এর পথের ধারে। প্রোক্রাস্টেস এর অতিথি সৎকার ছিল গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে। সে পথিকদের ধরে নিয়ে আসত আর বেশ খানাপিনা করাত। তারপর তাকে শুতে দিত বেশ আরামদায়ক বিছানায়। শর্ত ছিল যে খাটে শুবে সেই খাটে একদম এঁটে যেতে হবে। যদি কেউ খাট থেকে লম্বা হত প্রোক্রাস্টেস তার পা কেটে নিত। আর কেউ যদি খাট থেকে ছোট হত তবে তাকে অদ্ভুত উপায়ে টেনে লম্বা করত। কোন উপায়েই পথিকদের জীবিত থাকার কোন উপায় ছিল না। প্রোক্রাস্টেস এর খাটে কেউ খাপেখাপ মিলে শুইতে পারছে এই ধরনের রেকর্ডও নাই। এই সবই হল গ্রীক পুরাণের কিচ্ছা।

আমাদের জামানায় আমরাও কিন্তু প্রোক্রাস্টেস এর মত চিন্তা করি। ধইরা নেই যে কোন কিছু আমাদের ধরে নেয়া স্টান্ডার্ডের মতই হবে। এর বাইরে কিছু নাই। থাকলে সেইটা ধইরা বাইন্ধা আমরা আমাদের স্টান্ডার্ডের মাঝে সেট করে নেবই। কিন্তু কখনই আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ভেবে দেখব না। আমরা আমাদের স্কুলে ভর্তি হই বা ভর্তি করাই সবাইকে একই ছাঁচে গড়ে তোলার জন্য। স্কুলে ভর্তি করানো আমার কাছে অনেকটা প্রোক্রাস্টেস এর বেডে শোয়ানো। স্কুলে বাচ্চাদের মেধা ও বুদ্ধি অনুসারে কারিকুলাম তৈরি করা হয় না। বরং বাচ্চাদেরকেই স্কুলের কারিকুলাম মেনে চলতে হয়।

সিলভিয়া প্লাথের কলোসাস এবং অন্যান্য কবিতার প্রসংগ

কলোসাস সিলভিয়া প্লাথের জীবদ্দশায় একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ইংল্যান্ডে ১৯৬০ সালে এবং ইউ এস এ তে ১৯৬২ সালে কলোসাস প্রকাশিত হয়। কলোসাসে পাওয়া যায় একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবিকে। মৃত্যু, প্রকৃতি, সমুদ্র, জল, বাৎসল্য রস, সম্পর্কের ভাঙচুর নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি কবি।

কলোসাসের কিছু কবিতা আমেরিকার যে এডিশনটিতে প্রকাশিত হয়েছিল সেটি থেকে কিছু কবিতা বাদ দেয়া হয়েছিলো। কিছু কবিতার সাথে Theodore Roethke এর কিছু কবিতার সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণে লিগ্যাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এই আশংকা ছিলো সম্ভবত। যখন প্লাথ নিজেই Reothke দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবু ঐ সময় কবিতাগুলো শুধুমাত্র প্লাথের মৌলিকতা এবং নিজস্বতা ছিলো এই ব্যপারে কোনো সন্দেহ ছিলো না। মাঝে মাঝে কোনো কোনো সমালোচক প্লাথের কবিতার অসামান্যতাকে খাটো করে উপস্থাপন করেছিলেন। এবং তার স্বামী টেড হিউজের লেখার প্রতি বেশী মনোযোগ আকর্ষণ করে সে ক্ষেত্রে সিলভিয়া প্লাথের অর্জনকে একটু খাটো করে দেখার প্রয়াস ছিলো। মৃত্যুকে প্লাথের কবিতায় বিভিন্ন দিক থেকে দেখার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

কলোসাসের প্রথম দুটি কবিতায় প্লাথ দুটি মৃত শরীরকে নিয়ে ভাবেন। “Two views of cadavar এ দুই অচেনা মানব শরীর অথচ বর্তমানে মৃত তাদের সাথে দুজন জীবিত প্রেমিক প্রেমিকার বোঝার অবকাশের প্রয়াস এবং কবিতাটি শেষ হয় কিছুটা আশাবাদ দিয়ে। যেমন নিশ্চিত মৃত্যুর আগেও কিছুটা জীবন থাকে, মমীকৃত শরীর মিউজিয়ামে – সকল মৃতই সাহসী Bleaker -এ Acknowledging that being e alive emplies eventual deathe.“ কবি মনে করেন মানুষ আসলে মৃত্যুর বন্ড নিয়েই পৃথিবীতে আসে এবং অন্য কবিতাগুলোতে মৃত্যু যেন জীবনের মুক্তি, জীবনের কোলাহল, কষ্ট যাতনা থেকে মুক্তির পথ। বই এর মাঝামাঝি অংশে তিনটি কবিতায় মৃত্যুর আইডিয়াকে উপস্থাপন করেন মৃত প্রাণীর মধ্য দিয়ে।

দুটো মৃত আঁচিল, সেখানে আছে fury, war এবং battle shouts – তারা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে এবং এখন পাথরের মতই ধ্রুব তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনেকটা পারিবারিক অবস্থানের যে আবশ্যিক ধ্রুবতা জীবনের জন্য। jharrz medallion – এ কবি একটি মৃত সাপের কথা বলেন। যে হাসে, লাফায়, উদ্বেলিত হয় আনন্দে এবং উল্লেখ্য যে সাপটি আগুনের মত সুন্দর। তিনি অবশ্য সাপটিকে খাঁটি এবং মার্জিত বলেন। কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকে mussel Hunterat Rock Harbor এ এই কবিতায় কাঁকড়ার মৃতদেহের কথাও উল্লেখ করা হয়। যদিও কাঁকড়ার শরীরের ভেতরের অংশ পরিষ্কারের কথা আছে তেমনি এর শরীরের বাইরের শক্ত খোলসকে ব্লিচ এবং পলিশ করা হয় এবং সাদা রঙ দ্বারা একে শুভ্র করা হয়। সাদা হলো খাঁটি এবং ধ্রুবতার প্রতীক। পানি এবং সাগরের কথা প্লাথের কবিতায় বার বার অনুরণিত হয়েছে। প্রথম কবিতা Lorelei তে জার্মান মিথোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। এবং এমন যে এটি মৃত্যুকে মিমোলাইজ বা প্রতীকি করতে পারবে। এবং মৃত্যুর মধ্যমে শীতলতা আসতে পারে।

My sing of a world more full and clear than can be —
অন্য একটি কবিতায় একটি ডিমের খোসাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এখানেও মৃত্যুর সেই দুঃসহ সৌন্দর্যের কথা সৌকর্যের কথা বার বার এসেছে।
কলোসাস একটি শক্তিশালী এবং জটিল কবিতা। এখানে তার জনকের কথা বলেন। তার পিতা তার আট বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবাকে তিনি এখানে একটি শক্তিশালী খোদাই করা প্রতিমূর্তি হিসেবে ভাবেন। তাকে ইচ্ছে করলেই বাকশক্তি দিতে পারেন এবং এমন যে প্রতিমূর্তি তার সাথে কথা বলতে পারবে। তিনি তার কানে রাতে থাকবেন যেন বাতাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন এবং স্মরণ করান যে তার জন্য আজ আর কোনো শিপ আসবে না – কিন্তু এই দুঃসহ স্মৃতির সাথে তিনি চিরকাল থাকবেন।

Daddy প্লাথের সাহসী এবং সহিংস কবিতা যেখানে তার বাবার কথা সরাসরি বলেছেন। এর স্তবক অনেকটা ছড়ার মত এখানে তার বাবাকে তুলনা করেন ভয়ংকর পিতৃতান্ত্রিক ভ্যাম্পায়ারের সাথে, নাজি, শয়তানের সাথেও। এবং নিজেকে তুলনা করেন কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পের ইহুদীর সাথে এবং শেষে ডিটেইলসে যেয়ে দেখান কিভাবে তার বাবাকে পেতে চান। পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেন তার বাবার জায়গায় এখন তিনি তার স্বামীকে উপন্যস্ত করেন। কিন্তু তার স্বামীও তার বাবার মতই অহংকারী এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তার বাবা এবং তার স্বামী দুজনের মৃত্যুই তার হাতে হবে।

মানসিক ভাবে এবং নৈতিকতার দিক থেকে Ariel অনেকটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এগুলো তার স্বামী টেড হিউজ প্লাথের মৃত্যুর পর আবিষ্কার করেন।
এবং তিনি এগুলোকে ১৯৬৫ সালে একত্রীকরণ করেন। এর অনেকগুলো কবিতাই লেখা হয়েছিল হেমন্তের ১৯৬২ সালে। এবং টেড হিউজের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পরে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারীতে প্রধান প্রধান কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। Ariel এর কাহিনী শুরু হয় এক রমনীর ঘোড়ায় করে গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমনের বৃত্তান্তের মধ্যে দিয়ে। একজন নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে যিনি এক ভোর সকালে পূর্ণ শক্তি এবং সাহস নিয়ে একটি ঘোড়া নিয়ে গ্রামের দিকে যান।

সম্পূর্ণ নিশ্চল অন্ধকার হতে কবিতাটি শুরু যেখানে চালক ঘোড়ায় বসে অপেক্ষা করে। পাহাড় থেকে অদৃশ্য নীল আলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়। এবং চালক এখানে ঈশ্বরের সিংহী’। তার অশ্বের জানুসন্ধি থেকে ,দ্রুতগামী খুড় থেকে নিজের ভেতর শক্তি অনুভব করা এবং চষা জমিতে সে অশ্ব নিয়ে নিজেকে বিলীয়মান করা মাটিতে এবং অদৃশ্য অবস্থা থেকে ক্রমশঃ তার বাদামী যুদ্ধাশ্বের সাথে বিলীন হওয়া এবং অধরা থেকে যাওয়া এই কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা দান করে। এখানে রমনী নিজেকে একটি ঘোড়ার সাথে মেলান যেভাবে নিজে জ্বলন্ত সূর্যের সাথে উড়ে যান। হতে পারে এটি কবির কবিস্বত্তার আত্তাহুতির একটা লক্ষণ অথবা হতে পারে তার নিজের আত্মহত্যার পূর্বসংকেত।

Metaphorer এ কবি তার অন্তঃস্বত্তা অবস্থার মুখোমুখি। মেটাফোরিক্যাল ভাষায় এই সময়ের যুগপৎ আকর্ষন এবং বিতৃষ্ণার মনোভাব কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। প্রথমেই জ্ঞাপন করেন নিজেকে নয়টি সিলেবলের গুপ্ত রহস্যের (কবিতাটিও নয় লাইনের ) আধার হিসেবে। এরপর নিজেকে ভাবেন একটি হাতি অথবা একটি বড় বাড়ি হিসেবে। অথবা হতে পারেন একটা তরমুজ যার দুটি ছোট পায়ে পদচারনা এবং নিজের উদরকে মনে হয়েছে লাল ফলের মতন, যার পা দুটো সুন্দর কাঠের। অথবা নিজেকে পাউরুটির ইস্টের সাথেও মেলান, অথবা ভাবেন নিজেকে একটা নতুন টাকাসহ পার্সের মতন –

মেটাফোর ছোট কবিতা, একজন অন্তস্বত্তা নারীর শারীরিক অবয়ব আলংকারিক ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। ভারী এবং বড় শরীর নিয়ে নারী এই সময়টায় অস্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। তখন নারী নিজেকে একটা হাতি অথবা একটা তরমুজ অথবা একটা লতানো লতার মতো ভাবে। যদিও সে জানে এই সময়টা তার শরীর চেহারা অসুন্দর এবং একটা গরুর ভেতরে বাছুরের মতো। সে জানে না সে এই সময়টায় কি করতে পারে।

Edge প্লাথের একদম শেষের কবিতা যেখানে এক মৃত নারীকে সত্যিকারের নিখুঁত নারী হিসেবে চিত্রায়ন করা হয়েছে। এখানে সে নারী খুশী যে অবশেষে একটা ক্লান্তিকর দীর্ঘ ভ্রমন শেষে তার রয়েছে দুটো মৃত ছেলে মেয়ে যারা তাকে পেচিয়ে আছে তার ভেতরে। এই কবিতায় অত্যন্ত নগ্ন ভাবে তার আত্মহত্যার ইচ্ছের বিষয়টি উঠে এসেছে।

সিলভিয়া প্লাথের কলোসাস, এরিয়েল, ড্যাডি সহ অন্য কবিতাগুলোতে মহত্ত্বের ঘনীভূত হবার ব্যপারটি প্লাথ জানতেন। প্লাথ অবশ্য সচেতন ছিলেন নিজের ভেতর অনুভব বিচ্ছুরিত হওয়া এবং তাকে মহত্তম অনুভুতি দিয়ে সার্বজনীন করার ব্যপারে। তাঁর কবিতাগুলোর ভেতরে শক্তির ব্যপারে নিশ্চিত ছিলেন। তার মা এর কাছে লিখেছিলেন এই বলে যে এই কবিতাগুলো হলো তেমনি কবিতা যেগুলোর দ্বারা মানুষ আমাকে মনে রাখবে। Larkin প্লাথের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন – তার কবিতাগুলো বেশী প্রসারিত এবং উচ্চ তীক্ষণ স্বরবিশিষ্ট যেটা সাহিত্যে আরো বেশী উচ্চকিত হবার দাবী রাখে। তিনি আশ্চর্য ছিলেন প্লাথের এই প্রতিভা নিয়ে যেটি সমাচ্ছন্ন এবং আবিষ্ট রাখে পাঠককে তার লেখার প্রতি।

আকাশের তারা সবসময় সুন্দর দেখায় [Halo Effect]

সিলিকন ভ্যালীর একটা ফার্ম, সিস্কো, একসময় ছিল নতুন অর্থনীতির বরপুত্র। সাংবাদিকরা এর সর্বসাফল্য নিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতঃ এর চমৎকার গ্রাহক সেবা, নির্ভুল কৌশল, দক্ষ অধিগ্রহণ, অদ্বিতীয় কারবারী সংস্কৃতি, সহজাত দক্ষ ক্যারিশমাটিক সিইও। দুই হাজার সালের মার্চমাসে এইটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে দামী কোম্পানী।

পরের বছর সিস্কোর শেয়ারের দাম ৮০% পড়ে গেলে, সাংবাদিকরা সুর পালটানো শুরু করে। হঠাৎ করে কোম্পানীর প্রতিযোগীতামূলক সুবিধাগুলোকে ধ্বংসাত্মক ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করা হলঃ বাজে গ্রাহক সেবা, ধূমায়িত কৌশল, বেকুবমার্কা অধিগ্রহণ, পঁচা কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং একজন বেকুব সিইও। এসব যখন বলা হচ্ছে, তখন কিন্তু কোম্পানীর না কোন কৌশল বদলানো হয়েছে, না সিইও পালটানো হয়েছে। যা পাল্টেছে তা হল কোম্পানীর চাহিদা, সেটা হয়েছে ডটকম ক্রাশের ফলশ্রুতিতে, তা কিন্তু কোম্পানীর কোন ভুল-ত্রুটির জন্য নয়।

যখন কোন বিষয়ের কোন একটা দিক আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আর সেটা পুরো বিষয়টার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করে সেটাকেই আমরা বলি হেয়লো এফেক্ট (Halo effect) বা জ্যোতিষ চক্কর বলতে পারি। সিস্কোর ক্ষেত্রে এই জ্যোতিশ্চক্র বিশেষভাবে উজ্জ্বল ছিল। সাংবাদিকরা সিস্কোর শেয়ার মূল্য দেখে টাস্কি খেয়েছে আর কোন ভেতরের কোন খবর না নিয়েই ভেবেছে পুরো বিজনেসটা নিশ্চয়ই চকচকে আর টকটকে।

হেয়লো এফেক্ট সব সময় একইভাবে কাজ করে, আমরা কোন সহজলভ্য বা উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বা বিবরণ নিয়েই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারনা করে ফেলি। যেমন কোন কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা থেকে বাড়তি যাচাই বাচাই ছাড়াই আমরা খুব সহজে কোম্পানীর ব্যাবস্থাপকদের পরিচালনা ক্ষমতা বা এর কোম্পানির বিজনেস কৌশলের সম্ভাব্যতা নিয়ে উপসংহারে চলে যাই। আমরা প্রায়শই সফলতা বা শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করি যেখানে এগুলো খুব সামান্যই আছে, যেমন, আমরা যখন শুধু খ্যাতির উপর ভিত্তি করেই কোন ম্যানুফ্যাকচারার থেকে পন্য কিনি। . হেলো এফেক্টের আরো একটা উদাহরণ হল, আমরা ধরে নিই এক ধরনের ব্যবসায়ে সফল সিইওরা অন্য যেকোনে ব্যবসায়েও সফল হবে, এবং আরেকটা বিষয় হল, তারা তাদের ব্যক্তি জীবনেও নায়ক বনে যায়।

মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লী থর্নডাইক প্রায় শত বছর আগে, এই হেলো এফেক্ট আবিষকার করেন। তাঁর উপসংহার ছিল, যে কোন একটি গুণ ( উদাহরণস্বরূপঃ সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থা, বয়স) ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তা পুরো ব্যাপারটাতে এর একটা অসমান প্রভাব থাকে। সৌন্দর্য হল সবচেয়ে বেশি গবেষনা করা উদাহরণ। ডজন ডজন গবেষণা দেখিয়েছে যে, আমরা দেখতে ভাল লোকদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই/ এমনি এমনিই ধরে নিই যে তারা সুপ্রিয়, সৎ এবং বুদ্ধিমান। আকর্ষনীয় লোকজন তাদের পেশাগত জীবনে সহজেই এই সুবিধা পেয়ে থাকে এমনকি স্কুলেও এই হেলো এফেক্ট দেখা যায় যেখানে শিক্ষকরা অসচেতনভাবেই দেখতে ভাল বাচ্চাদেরকে বেশি মার্ক দিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপনের সাথে এই হেলো এফেক্টের এর দারুন সংযোগ আছেঃ টিভিতে, বিলবোর্ডে, ম্যাগাজিনে যেসব সেলিব্রেটিরা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে তাদের দিকে একবারটি দেখুন। কিভাবে রজার ফেদেরারের মত একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় কিভাবে একজন কফি মেশিন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, যদিও সেটা সফল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। আমরা সেলিব্রেট্রিদেরকে এতবেশি বিজ্ঞাপনে দেখি যে, আমরা কখনো চিন্তাও করি না কেন এটা-সেটার বিজ্ঞাপনে তাঁদেরকে দেখানোটা আদৌ আমাদের জন্য কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা। কিন্তু এটাই হল হেলো এফেক্টের সবচেয়ে সেয়ানা পার্টঃ এটা আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে। যা কিছু রেকর্ড করা দরকার তা হল, আকর্ষণীয় মুখ, আকর্ষনীয় জীবনধারা (লাইফস্টাইল) এবং ঐ নির্দিষ্ট পণ্য।

জোরালো নেতিবাচক প্রভাবের সাথে সাথে হেলো এফেক্ট বড় ধরনের অবিচারের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এমনকি যখন জাতীয়তা, লিঙ্গ, অথবা বর্ণ সবকিছুর ব্যাপারে বাঁধাধরা চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কেউ বর্ণবাদী কিংবা লিঙ্গ-বিদ্বেষী না হয়েও এসবের স্বীকার হতে পারে। হেয়লো এফেক্ট আমাদের দৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন করে দেয় যেমনটা দেয় সাংবাদিক, শিক্ষক এবং ভোক্তাদের।

কদাচিৎ এই প্রভাবের নির্মল দিক দেখা যায় – হতে পারে সেটা স্বল্পমেয়াদী, আপনি কখনো প্রেমের সাগরে ভেসেছেন? If so, যদি তাই হয়, তাহলে আপনি জানেন, কতটা নিখুঁত মনে হতে পারে একজন কে। আপনার মনের মানুষকে মনে হবে পুরো একটা প্যাকেজ, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান, পছন্দনীয় এবং উষ্ণ। এমনকি আপনার বন্ধুরা অনেক কিছু নেতিবাচক দিক পয়েন্ট আউট করতে পারে, আপনি এর কোন কিছুই দেখেন না, বরং মনে হয় সেগুলোও কত সুন্দর!

প্রকৃত বৈশিষ্ট বুঝতে হেয়লো এফেক্ট আমাদেরকে বাধা দেয়। এটা কাটাতে হলে আপনাকে ফেসভ্যালু বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্বমানের অর্কেস্ট্রাওগুলোতে বাছাইয়ের সময় পর্দার আড়ালে ক্যান্ডিডেটদেরকে পারফর্ম করতে হয় যাতে লিঙ্গ, বর্ণ, বয়স এবং চেহারা কোন ভূমিকা রাখতে না পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল আপনার, যথাযথ তথ্য নেয়ার ও বুঝার মত ধৈর্য্য থাকতে হবে।

[রলফ ডবেলি থেকে অনূদিত]

শোফার নলেজ (মুখ ও মুখোশ)

ম্যাক্স প্লাংক সাহেব ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবল প্রাইজ জেতেন। ঐ বছর তিনি জার্মানি ভ্রমনে যান। সেখানে প্রচুর অভ্যর্থনা- সংবর্ধনা পান, স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর বক্তৃতা করা লাগে। প্রতিটি সেমিনারে-সভাতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর একই বক্তৃতা শুনতে প্লাংকের শোফার সেটা মুখস্থ করে ফেলেছিল। একই বিষয় শুনতে শুনতে সে কিছুটা বিরক্তও হয়ে উঠেছিল। সুতরাং সে প্লাংক সাহেবকে এক চমৎকার প্রস্তাব দিল। বলল, একই বক্তৃতা দিতে দিতে আপনি নিশ্চয় বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। মিউনিখের সভায় আপনি শোফারের টুপি পরে সামনে বসে থাকবেন। আর আমি মিস্টার প্লাংক সেজে বক্তৃতা করব। সন্দেহ নেই ব্যাপারটা আমাদের দুজনের জন্যই বৈচিত্র নিয়ে আসবে। ড্রাইভারের এ সৃজনশীল প্রস্তাবটা প্লাংকের খুব মনে ধরল। তিনি বললেন, তথাস্তু।
সুতরাং নির্দিষ্ট দিনে মিউনিখের নামজাদা সব প্রফেসরদের সামনে প্লাংকের শোফার কোয়ান্টাম কেকানিক্সের উপর লম্বা বক্তৃতা দিল। আর প্লাঙ্ক শো’ফার সেজে বসে রইলেন। সভাশেষে একজন প্রফেসর দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন করলেন। তখন প্লাঙ্করূপী ড্রাইভার বলল, মিউনিখের মত জায়গায় কোন জাঁদরেল প্রফেসর এরকম সিম্পল প্রশ্ন করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এটার উত্তর দেয়ার জন্য তো আমার ড্রাইভারই যথেষ্ট বলে সে ড্রাইভাররুপী প্লাঙ্ককে দেখিয়ে বলল, আমার ড্রাইভার এ প্রশ্নের জবাব দিবে।

আমেরিকার প্রখ্যাত ইনভেস্টর ও ব্যবসায়ী চার্লি মুঙ্গারের মতে দুই ধরনের জ্ঞান আছে। প্রথমটা হল আসল জ্ঞান। যার জন্য লোকে অনেক পরিশ্রম করে, রাত জাগে, পড়ালেখা করে। দিনরাত খেটে-খুটে কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করে। আরেকটা হচ্ছে, শোফার নলেজ। (শোফার নলেজ)। এইটাকে আমরা লোকদেখানো বিদ্যা বলতে পারি। এই ধরনের লোকেরা মূলত বিদ্যা জাহিরের ক্ষেত্রে ওস্তাদ হয়ে থাকে। সুন্দর ভঙ্গি আর সুন্দর চুল কিংবা চমৎকার হাসিই হয়ত তাদের বক্তৃতার মূলধন। অনেকটা টিভি নিউজ প্রেজেন্টারদের মত, অন্যের তৈরি করা খবর তারা চমৎকার উচ্চারণে দেখে দেখে স্মার্টলি পড়তে পারে।
.
দুঃখজনক ব্যাপার হল, এখনকার সময়ে আসল নলেজ আর শোফার নলেজ আলাদা করা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। নিউজ প্রেজেন্টারদের ক্ষেত্রে আমরা তবু বুঝতে পারি যে, এই নিউজের আসল মালিক তারা নয়। সবাই জানে তারা শুধু পাঠক।

সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এটা বুঝতে পারা আরো বেশি কঠিন। সাংবাদিকদের অনেকেই সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করে। অনেক ঝানু রিপোর্টার আছেন যারা সুদীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। একটা জটিল বিষয় বুঝতে ও বুঝাতে তাদের আন্তরিক চেষ্টা থাকে, এর পেছনে সময় দেন। দীর্ঘ পড়াশোনা করেন। তারপর তারা ঐ বিষয়ে বিশ্লেষণ দেন। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকরা শোফার নলেজের কাতারেই পড়ে। তাঁরা ভাসা ভাসা জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষন দাঁড় করিয়ে ফেলেন। আর দেখা যায়, তাদের স্বল্প ও বেমানান জ্ঞানের কারনে বিশ্লেষন হয়ে উঠে একচোখা, শ্লেষ-বিদ্বেষ আর আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর।
কারবারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা যায়। যে কোম্পানী যত বড় তার জন্য তত বড় স্টার সিইও দরকার। উৎসর্জন ( Dedication ), ঐকান্তিকতা (Solemnity ), দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এই সমস্ত শক্তি ও গুণাবলীর চেয়ে স্টার হওয়াটাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে মেকাপটা বেশি হয়ে উঠে। শেয়ারহোল্ডার ও সাংবাদিকরা প্রায় মনে করেন, লোকরঞ্জনের ক্ষমতা মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দিবে। বাস্তবে যা কখনোই নয়।

শোফারকে গার্ড দেয়ার জন্য ওয়ারেন বাফেট সুন্দর তরিকা দিয়েছেন, সেটা হল, যোগ্যতার বৃত্ত (Circle of Competence)। প্রত্যেকের উচিত নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতার একটা বৃত্ত টেনে নেয়া। এই বৃত্তের ভেতরে থাকবে সেই সব যাতে আপনি প্রত্যক্ষ জ্ঞানবলে পরিপূর্ণ দক্ষ। আর বাইরে থাকবে সেই সব যা আপনি আংশিক বোঝেন। মুঙ্গারের মতে, আপনার উচিত সার্কেল অব কম্পিটান্স এর ভেতরে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা। এটা ইম্পর্টেন্ট না সার্কেলটা কত বড়। ইম্পর্টেন্ট হচ্ছে, সার্কেল পরিধি কোথায় তা জানা। আপনি যদি যেখানে আপনার কম্পিটেন্স নাই সেখানে খেলতে যান তবে নিশ্চিতভাবে আপনি হারবেন। এজন্য আগে নিজের দক্ষতা গুলো নির্দিষ্ট করে নিন। এবং অবশ্যই নিজের সার্কেলের ভেতরেই খলুন।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, শোফার নলেজ সম্পর্কে সচেতন থাকা চাই। কোম্পানীর মুখপাত্র, নিউজ প্রেজেন্টারদের সাথে প্রকৃত জ্ঞানীকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এটা আপনি কিভাবে করবেন? দেখবেন, প্রকৃত বিশেষজ্ঞ নিজের সীমা জানেন, কি জানেন আর কি জানেন না সে বিষয়ে তারা সচেতন। যদি তারা নিজেকে সার্কেল অব কম্পিটান্স এর বাইরে দেখেন, তখন তারা খুব সহজেই বলেন, ‘আমি জানি না।‘ লজ্জা নয়, এমনকি প্রচ্ছন্ন গৌরবের সাথে।
শোফারের কাছে আপনি সব কিছুই শুনবেন, কিন্তু কখনোই শুনবেন না, ‘আমি জানি না। ‘

[রলফ ডবেলি’র দ্যা আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি অবলম্বনে]

আল মাহমুদ বাংলার কিংবদন্তী অসাধারণ এক কবি

কবি তাকে বলি যিনি জানেন কি করে সৌন্দর্য তৈরী করতে হয় তাঁর দক্ষ হাতের সাবলীল ব্যবহারে। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ছন্দের ক্ষেত্রে, উপমার ক্ষেত্রে, অলংকার, উপমা উতপ্রেক্ষার বিচিত্র ব্যবহারে তিনি যে কবিতাকে সামনে তুলে ধরেন তাতে পাঠক মোহগ্রস্থ হয় এবং এটা সুর একটা আবহ কবি তৈরী করেন যেখানে পাঠক আর নিজের মধ্যে থাকেন না – কবির কবিতার সাথে একধরনের সংলগ্নতা তিনি বোধ করেন যাতে একটা কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে। অথবা কবিতা তাকেই বলি যা চকিত চমকে মনকে দুলিয়ে দিয়ে যায়। চৈতন্যে সাড়া জাগায়। সেই দোলা বা সাড়া কখনো আসে ভাবের ব্যঞ্জনায়, কখনো মনোভঙ্গির অপ্রত্যাশিত খরতায়, কখনো বা রূপকলার আকস্মিক জ্যোতির্ময়তায়। এদের যে কোন একটির অভিঘাতেই পাঠকের মনের উদ্ভাসন ঘটতে পার, তার অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্তৃততর হতে পারে। সেই প্রজ্বলন ও প্রসারন পাঠকের মধ্যে ঘটিয়ে কবির বাক্য সৃষ্টি যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে। যেমন –

শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেব আদ্যাক্ষর রক্তবর্ন অনার্য প্রাচীন।
(সোনালী কাবিন -২ ) কবি আল মাহমুদ।

এভাবে বিশ্লেষণ করলে একজন কবি আল মাহমুদকে আমরা পাই, যিনি বিশের দশক থেকে শুরু করেন কিন্তু তিরিশের দশকের ধারাকে উপেক্ষা করে ভিন্ন একটা গতিধারা তৈরী করেন, যেখানে একজন আল মাহমুদ বিশেষ ভাবে নিজেকে চিনিয়ে দেন। তিরিশের দশকের কবিরা কবিতার ধারা রবীন্দ্র ধারা থেকে সরিয়ে পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করেন সেখানে কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র স্বত্তায় দাঁড় করান। গ্রামীন, লোকজ এবং মৌলিক শব্দের স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে তাঁর কবিতার শরীরকে অলংকৃত করেন। তাঁর উপমা উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এমনই গ্রামীন লোকজ যে সেখানে কবি আল মাহমুদ একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবে চিনিয়ে দেন তাঁর জাত। তাঁর লোকজ শব্দে যেভাবে পাওয়া যায় মাটির টান তেমনি তিনি যে আধুনিক কবিতার একজন আলাদা নতুন শব্দের রূপকার সে আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। যেমন –

রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে ,
সৃষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাংগে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশী ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জায় আগল
(সোনালী কাবিন – ১৪)

কবি আল মাহমুদ তিরিশোত্তর কবিদের চাইতে ভিন্ন তাঁর শব্দ ব্যবহারের চমকপ্রদ ব্যবহারে। গ্রামীন শব্দ তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন কবিতার শরীরে এবং একটা ভিন্ন মাত্রা দেন। যেমন –

বুবুর স্নেহের মত ডুবে যায় ফুলতোলা পুরনো বালিশ –
স্নেহের সাথে বুবুর ফুলতোলা বালিশের অনুষঙ্গ চমৎকার – কারণ বুবু যখন ভাইয়ের জন্য বালিশের কভারে ফুল তুলেন তখন ভাইয়ের প্রতি বোনের স্নেহের আতিশয্যের কারণেই সেই বালিশ ভিন্ন এক ব্যঞ্জনার আবেশে ভরপুর হয়। কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার – একে তো মক্তবের মেয়ে আবার সে চুলখোলা এবং একটা সাধারণ নাম যে নাম গ্রাম্য মেয়েদের সাথে মানিয়ে যায় – একটা গ্রামীন নিষ্পাপ মেয়ের ছবি চোখে আসে যেখানে একই সাথে কাব্য বোধের সাথে একাকার আয়েশা আকতার।

বধুবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মত কন্যা বলো কবুল কবুল –
কবুল বলার সাথে একটা মেয়ের ভাগ্য পরিবর্তন হয় গাঙ্গের মতন। যে গাং এক এক সময় এক এক রকম। কবুল বলার সাথে সাথে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে যে একটা বিচিত্রতর পরিবর্তন হয় সেখানে কবুল একটা ভিন্ন জীবন, নতুন রোমান্সের জগতে সে প্রবেশ করে সে এক বিচিত্র অভিনিবেশের দাবী রাখে।
নারীই শিল্পের মহাশক্তি। পৃথিবীতে যত কবিতা মহাকাব্য লিখা হয়েছে তার অধিকাংশই নারী বিষয়ক। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মহাযুদ্ধ হয়েছে নারীকে কেন্দ্র করেই। আল মাহমুদের কবিতায় নারী তার সমস্ত সৌন্দর্য আর উচ্ছ্বলতা নিয়ে হাজির হয়। কবি তার নারীকে রূপ আর জৈব তৃষ্ণার আঁধার করে খোলা তরবারির মত হাজির করেন। নদীর ঢেউ আর ভাংগা গড়ার চলার ছন্দের সাথে নারীর শরীরের ভাঁজ, শিহরণ আর গতিময়তার চমৎকার সাদৃশ্য ভিন্নতর ব্যঞ্জনা দান করে।

ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ (সোনালী কাবিন)

এক্ষেত্রে কবি কমরুদ্দিন আহমেদের “আল মাহমুদ কবি ও কথাশিল্পী” প্রবন্ধে লিখেন আবহমান বাংলার বাঙ্গালীর জীবন যাপন, মৃত্যুর সীমারেখাকে অতিক্রম করে ভাষা আর প্রেমময় কাব্যের শপথের নান্দনিকতায় পাঠকচিত্তকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যায় কবি আল মাহমুদের কবিতা।”

কবি আল মাহমুদের কবিতায় পল্লী প্রকৃতি, লোকজ জীবন ধরা পড়ে ভিন্ন আঙ্গিকে – স্বতন্ত্র তাৎপর্য নিয়ে। তিনি অবহেলিত বাংলার গ্রামীন জীবনের খুঁটিনাটি প্রসংগকেও অনায়াসে উপমা চিত্রকল্পে স্থাপিত করেন অনন্যতায়। মূলত আল মাহমুদের ভাষা একান্তই তাঁর নিজস্ব। পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ প্রবচনকে আর কোন কবি সম্ভবত এমন নিপুন ও শৈল্পিক ভংগীতে ব্যবহার করেন নি। গ্রামীন জীবনের উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা ও চিত্রকল্প। জসীমউদ্দিন যেমন লোক সাহিত্যের উপর তাঁর কুটির নির্মাণ করেন সেখানে আল মাহমুদ আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান তাঁর কাব্যে ব্যবহার করেন। পলায়ন পর মানব সত্তা আল মাহমুদের চেতনায় গড়ে প্রবল দূরাগত ভাংগনের শব্দ। পালাবার পথ খোঁজেন কিন্তু পান না। কেননা –

নারীর নিঃশ্বাস এসে চোখে মুখে লাগে
বুকে লেগে থাকে ক্লান্ত শিশুর শরীর”

সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালী কাবিন একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সোনালী কাবিন কাব্যে আল মাহমুদ লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে উদ্ভাবন করেন এক ধরণের শব্দ জাদুময়তার।

আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গৃঞ্জার মালা পরো বালা,
প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে? —-

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর এবং ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্য কালের কলস। এ দু’টি কাব্যের ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ নিজেকে প্রকাশ করেন সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব ঘরানার কবি হিসেবে। আল মাহমুদ প্রকরণ সচেতন কবি। ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একাধারে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত এবং গদ্য কবিতা লিখেছেন। কবি মনে করেন ছন্দ ত্যাগ করলে কবির চলে না। ছন্দ নির্মাণে তিনি কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। উপমা সমৃদ্ধ কবিতা কবি আল মাহমুদ অনেক লিখেছেন। দেশ, নারী, প্রকৃতি, তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ –

১। চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণাস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী (কবির বিষয়/অদৃষ্টবাদীর রান্নাবান্না )
২। স্তন দুটি দুধের ভারে ফলের আবেগে ঝুলে আছে”
(অন্তরভেদী অবলোকন/সোনালী কাবিন)
৩। — আর নরম দুটি বুক,
পুঞ্জিভূত অভিমান (দোয়েল ও দয়িতা/দোয়েল ও দয়িতা)
৪। বেড়ালের পায়ের সতর্কতা নিয়ে লোকটা গোলার্ধ থেকে গোলার্ধে
ঘুরে ফিরে সংবাদপত্রের ছবি হয়ে থাকে
(মীনার প্রান্তরে ইয়াসির আরাফাত/একচক্ষু হরিণ)
৫। কোন খানে পাড়ো তুমি জবর সোনার আন্ড, কও মিছাখোর ?
বলেই টানবে লেপ, তারপর তাজ্জবের মতো
পেখম উদোম করে দেখবে এক বেশরম কাউয়ার গতর –
(আমিও রাস্তায়/সোনালী কাবিন)

আল মাহমুদকে সত্যিকার শক্তিশালী কবি মনে হয়েছিল তাঁর ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ কবিতাটি রচিত হওয়ার পর। হাজার বছরের প্রচলিত মিথকে ভেঙে ফেলার ক্ষমতা যিনি রাখেন তিনি নতুন মিথেরও জন্মদাতা বটে। আল মাহমুদ যখন বলেন:
মাঝে মাঝে ভাবি, ছেলেটি কেন এমন ‘বাঘ বাঘ’ বলে চেঁচাতো?
আমরা ভয়ে বিহ্বলতায় চারদিকে ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে
বলতাম শুয়োরের বাচ্চা। সে বোকার মতো হাসতো। বিব্রত,
অপদস্থ। তারপর আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম,
মিথ্যাবাদীর ডাকে আমরা আর সাড়া দেব না।
আহ, আবার যদি ফিরে আসত সেই মিথ্যাবাদী ছেলেটা
জনমত ও তিরস্কারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্তরের চারণের মতো
বলে উঠতো, ‘মুত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী-
হুঁশিয়ার’।

ছেলেটা যদি মিথ্যাবাদী হবেই তবে বাঘ কেন এসেছিল শেষ পর্যন্ত? এটা এক ভয়ঙ্কর আবিষ্কার। এভাবে ঈশপের কাহিনীকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে নতুন করে কাহিনী গড়ার দুঃসাহসী অভিযানে নামেন আল মাহমুদ, যে অভিযানে তিনি সফলও হয়েছেন বলা যায়। কী অসাধারণ হয়ে উঠেছে তাঁর দিব্যদৃষ্টি তা আমরা টের পাই যখন তাঁকে বলতে শুনি:

আমি তাদের উরতের পেশিতে বিদ্যুতের চমক দেখে
থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই পথেই তারা
গন্তব্যে পৌঁছুবে, যেখানে শ্বাপদারণ্যের পাশেই আছে নদী।
মানুষের জন্য পারাপারের পানসি বাঁধা। গোটানো পালে
জলপুষ্পের প্রতীক। দড়ি আর দাঁড়।

কিংবা যখন তিনি বলেন:

তারপর সত্যি একদিন বাঘ এসে সব খেয়ে ফেলল। প্রথম
সেই বালকটিকে, শেষে নখ আর দাঁত দিয়ে আঁচড়ে ফেলল
মানুষের গ্রাম, ঘরবাড়ি, রক্ত, মাংস।
এই যে প্রচলিত গল্পের বাইরেও বোঝার একটা গল্প আছে সেটাকে তিনি প্রকাশের তাড়না অনুভব করেন। যদিও কবিতাটির ভাষা কোথাও একটু ঢিলেঢালা হয়ে গেছে তবু যে মেসেজ দেবার তাড়না তাঁর ছিল সেটা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। পাঠকের মনে হতে পারে কেউ সাদামাটা গল্প শোনাচ্ছেন কিন্তু কিছু পংক্তি সত্যিই চমকে দেয়।

আমরা তো সেই মিথ্যাবাদীর খুলির ওপর রোদ চমকাতে দেখে এসেছি’
কিংবা ‘আর দেখেছি সকল সত্যবাদীদের পঙ্গপালের মতো পালাতো।”–
মৃত্যু এসেছে এই যে অসাধারণ দর্শন তিনি এখানে নিয়ে আসেন যেখানে আগে শুধু ভাবা হতো রাখালের মিথ্যাবাদী চরিত্র। সে চরিত্রের উপর তিনি আরোপ করেন দার্শনিকতা। প্রতিদিনই আমাদের দুয়ারে মৃত্যু এসে হানা দেয়। প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে পায়ে হেঁটে যাই। কবি কমরুদ্দিন আহমেদ তাঁর আল মাহমুদ কবি ও কথা শিল্পী প্রবন্ধে লিখেন –

কবি আল মাহমুদ গ্রীক, রোমান পুরাণ থেকে শুরু করে লোকগল্প ও লোক শ্রুতি অকপটে ব্যবহার করেছেন। এবং প্রচুর সাহিত্যিক উপাদান ও ব্যবহার করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো “কাব্যগ্রন্থের সক্রেটিসের মোরগ এর উজ্জ্বল উদাহারণ।

ইহুদীরা হাসুক তবু সম্পদের সুষম বন্টন অনিবার্য
ইহুদীরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর
মানুষ মানুষের ভাই (ইহুদীরা – অ, বা , রা, বা)
সম্পদের সুষম ব্যবস্থা ইসলামের সুষম বন্টনের দিকেই ইংগিত করেন, যা যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা।”

সিন্দুকের তালা কি খেয়ে ফেলে সংরক্ষিত সোনার দিনার ? ইউসুফের সেই কঠিন যুক্তির কাছে সমস্ত
রূপ ও লালসার আগুন নিভে যায়।

আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবি। যিনি শুধু একটি টিনের সুটকেস নিয়ে শুধু কবিতাকে অবলম্বন করে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ জ্ঞান বৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অকিঞ্চিৎকর দান বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। লোকজ উপাদান, নারী, রাজনীতি সচেতনতা, আশাবাদ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দ বয়ন কৌশল তাঁর কবিতার অনন্য সম্পদ। তিনি কবিতায় গভীরভাবে খোঁজেন জীবনকে, মানুষকে, প্রেম ও প্রকৃতিকে। কবির জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ ই জুলাই। আসছে ১১ জুলাই কবির জন্মদিন। কবির ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। কবি সুস্থ্য থাকুন। ভালো থাকুন। তিনি দীর্ঘায়ু হোন।

তথ্যসূত্র –
আল মাহমুদ কবি ও কথাশিল্পী – কমরুদ্দিন আহমেদ
আধুনিক বাংলা কবিতা বিষয় ও প্রবণতা – ফজলুল হক সৈকত
এবং ইন্টারনেট।

অণুগল্পের পাঠক প্রিয়তা

এটা ঠিক আজকাল প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় অণুগল্প লেখা হচ্ছে। অণুগল্পের বই বের হচ্ছে। খুবই ভাল খবর। বাংলা সাহিত্যের একটা দিক।

এই অণুগল্প কবে লেখা শুরু হয়েছিল, কে শুরু করেছিল, কোন লেখা অণুগল্প, কোন লেখা অণুগল্প নয় – এসবের চেয়ে খুব জরুরী যেটা সেটা হল এই অণুগল্পকে কিভাবে আরও ভালভাবে বেশি দিকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় স্পষ্ট উচ্চারিত করা যায়। সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত। তার জন্য যারা অণুগল্প লিখছে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে সবচেয়ে বেশী।

এই অণুগল্প লিখিয়েদের লেখায় বহু এক্সপেরিমেণ্ট দেখা যাচ্ছে। এই এক্সপেরিমেণ্ট অনেক পাঠকের বোধগম্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার সেই লেখা কিছু পাঠক বলছে অসাধারণ, এটাই হল আসল অণুগল্প।

উভয় ক্ষেত্রে লেখকই কিন্তু পাঠক। যারা শুধু পাঠক তারা এ রকম ‘গল্প নয় অথচ অণুগল্প’কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অথবা পড়ছে না মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
আবার সেইসব শুধু পাঠক ছোট ছোট লেখা, দীপ্ত লেখা, মনগ্রাহী লেখা, অন্যভাবনার লেখা, ভাল বিষয় ভাবনার লেখা ঠিক পড়ছে। প্রশ্নোত্তর করছে। সেগুলো অণুগল্প কি না, গল্পের ফরম্যাটে আছে নাকি অণুগল্পের নিয়ম মানছে না, অণুগল্পের নিয়মটা কি ইত্যাদি নিয়ে সেইসব সাধারণ পাঠক বা শুধু পাঠক মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা শুধু ভাল লাগা দেখছে।

কবিতার ক্ষেত্রে যেদিন থেকে জটিলতা, গদ্যের ঝলক, শব্দের ধাঁধা ইত্যাদি এল সেদিন থেকে কবিতার দিক থেকে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেরকম ভাবে অণুগল্পের ক্ষেত্রে গল্প কিন্তু গল্প নয় এটা অণুগল্প, আখ্যান কিন্তু আখ্যান নয় এটা অণুগল্প, এটি গল্পের মত বলেছি কিন্তু হাজার দিকের কথা বলা আছে তাই এটা অণুগল্প – ইত্যাদি গোলকধাঁধাঁয় পাঠক হাবুডুবু খেতে চায় কি?

যদি এই গোলকধাঁধাঁয় সে এখন হাবুডুবু খায়ও এক সময় সে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেমন কবিতার ক্ষেত্রে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার জন্য অবশ্য অনেক লেখক পাঠককেই দায়ী করে। তাতে সাহিত্যের কি লাভ?

মোদ্দা কথা হল সহজ সরল সাধারণ লেখাই আসল লেখা। সহজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মগজমারি। সে লেখকের দিক থেকে যেমন পাঠকের দিক থেকে তেমনি।
ছোট কিন্তু সহজ সরলভাবে সুনির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ভাবনার আড়ালে তুলে ধরার চেষ্টাই সাহিত্য। পড়ার সময় যেন সমস্ত শ্রেণির পাঠকের বুঝতে কোন অসুবিধা না হয়। আবার পড়ার পরে বিষয়ের গভীরে পাঠক যেন সহজেই ঢুকতে পারে। সেই লেখাই সাহিত্য। না হলে পড়তে পড়তে কিছুই বুঝতে পারলাম না আবার পড়ে তবে বুঝতে হবে তাহলে পাঠক সে লেখা আর পড়বে কি?

এক পাঠক কবিতা বুঝতে পারে নি বলে শ্রীজাত বলেছেন – “অসুবিধে নেই কিছু। আমিও মেটাফিজিক্স বুঝি না।”(ফেসবুক থেকে)। অণুগল্পের লেখকও এমন বলতে পারেন। কিন্তু ওই যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পাঠক কি আর ফিরবে?

তাই অণুগল্পের ক্ষেত্রে সমস্ত এক্সপেরিমেনণ্ট একটা অবস্থানে জুড়ে যাক যেটা হল সমস্ত শ্রেণীর পাঠকের কাছাকাছি হওয়া। অণুগল্পের অস্তিত্বকে আরও পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। যে কোন অবস্থানে গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ সাহিত্যধারায় আজও সমান জনপ্রিয়। কেন না তার সহজতা সরলতা পাঠকপ্রিয়তা। খুব বেশী এক্সপেরিমেণ্ট, খুব বেশি এটা নয় ওটা দারুণ, এটা অণুগল্প নয়, ওটাতে আপনি এটা দেন নি, এ করেন নি ও করেন নি ইত্যাদি (এসব তো চলতেই থাকবে) ভাবার চেয়ে বলার চেয়ে গভীর কিছু সহজ করে সাধারণভাবে সবাই লিখুক সবাই পড়ুক। সবগুলোই হোক অণুগল্প কিংবা অণুগল্প নয়।

লেখক নিজের শিক্ষা নিজে শিখুক। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। সাহিত্য পাঠ করার সময় পাঠক কি ভাবে? এটা গল্পের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা উপন্যাসের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা প্রবন্ধের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা কবিতার মত পড়ব বা পড়েছি কিংবা এটা অণুগল্পের মত পড়ব বা পড়েছি। তা কিন্তু পাঠক ভাবে না। পাঠক বিষয় ভাবনায় ডুবে যায়, ভাবনার আবেশে আবেশিত হয়, বিষয় ভাবনায় উদ্বেলিত হয়। সহজ পাঠের গভীর উপলব্ধিতে আরও সাহিত্য জীবন গড়ে তোলে। আরও বেশি সাহিত্য পাঠ করার আকাঙ্খা খুঁজে পায়।

তাহলে? সেই আরও বেশি সাহিত্য জীবনে, আরও বেশি সাহিত্য আকাঙ্খায় অণুগল্প তার অবস্থান আরও প্রসারিত করুক। সেই ভাবনাকে সামনে রেখে লেখা হোক আরও আরও অনেক অনেক অনেক অণুগল্প।

ছড়াদাদুর পাঠশালা ৯


আজ প্রথমে আমরা একটা ছোটদের কবিতা লিখব।
দাদু বললেন – এইধরণের কবিতায় শিশু-কিশোরমনের নানা স্বপ্ন-কল্পনা-ভালবাসা-আবেগ প্রভৃতি মাননিক বিষয়কে তুলে ধরার চেষ্টা থাকে। যেমন ধরো, একটা বালক পড়া, ঘোরা, খেলা সবকিছু যথাসময়ে মন দিয়েই করে। এভাবেই সে তার জীবনটা গড়ে তুলবে- এই ভাবনা তার মা-বাবা তাকে দিয়েছেন। আমরা স্বরবৃত্তে এই বিষয়টাকেই লেখার চেষ্টা করবো-

মা বলেছেন/ – যা সোনা, আয়/একটুখানি /খেলে-
মুক্ত বায়ের/ সুখ তো গায়ে/খানিকটা আয় /ঢেলে।

পড়ার শেষে /হেসে-ভেসে/ কল্প-না’য়ে /চড়ে-
ওড়ার কথা -/ ঘোরার কথা/ বাবাও বলেন/ গো রে।

আমার পড়ায়/ আমেজ ছড়ায়/নেই বিরক্তি-/ভীতি-
লেখার খাতায়/ কেকার খুশি/ ঝরায় নিতি-/ প্রীতি।

খেলার সময় / কেবল খেলি/মেলি মনের/ ডানা-
পড়ার সময়/ শুধুই পড়ি / গড়ি জীবন/খানা।
আদৃতা বলে – দাদু এটি
৪+৪+৪+২ মাত্রার তিনটি পর্ব এবং দুই মাত্রার একটি অতিপর্ব রেখে লেখা হল। তাই না?
দাদু সোৎসাহে বলেন- একদম ঠিক বলেছো। এটা একটা ছোটদের কবিতাটি। অনেকে একে আবার কিশোর কবিতাও বলেন।
এবার লিখব একটা ছড়া। চারদিকে এত নকল সামগ্রী আর মিথ্যে বাড়বাড়ন্ততে সত্যি ও আসল জিনিসেও সন্দেহ জাগছে মানুষের।

সকল কিছুই /নকল এবং/ মিথ্যে দেখে/ দেখে-
চিত্ত জুড়ে/ নিত্য সবাই/সন্দেহ নেয়/ মেখে।

সত্যি কি এক/রত্তিও নেই/আসল কি নেই/ কিছু?
উঠছি ভোরে/ ছুটছি জোরে/মিছের পিছু/পিছু!

সন্দেহে মন/-দেহের ভিতর/ভাবনা ইতর/ জাগে-
অবিশ্বাসের/ বিষ শ্বাস এখন/অবিরতই /লাগে।

আসলটাকেও /নকল লাগে/ধকল সয়ে /সয়ে-
সত্যিগুলোও/ ধুলোয় পড়ে/যাচ্ছে মিছে/ হয়ে।

সত্যি মরে/ পথ্যি ছাড়া/আসল মরে /ধুঁকে-
মিথ্যে বেড়ায়/ নৃত্য করে/চিত্তভরা/ সুখে।

অরনি বলে- এটাও ৪+৪+৪+২ মাত্রার স্বরবৃত্ত।
-ঠিক ধরেছো। দাদু বলেন। – তাহলে আজ এই পর্যন্ত থাক। আগামি দিন আমরা মাত্রাবৃত্তে লেখার চেষ্টা করবো। (চলবে)