বিভাগের আর্কাইভঃ স্মৃতিকথা

পাঁচ টাকা মূল্যের ফুটপাতের গাউনের জামায় পূজার আনন্দ উপভোগ

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। যুগযুগ ধরেই প্রতিবছর আশ্বিন মাসে শারদীয় দুর্গাপূজা আসে আবার চলে যায়। কিন্তু আমার মন থেকে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো মুছে যায় না। যেই অভাবের দিনে পাঁচ টাকা মূল্যের গাউনের জামা গায়ে দিয়ে দুর্গাপূজার আনন্দে মেতে উঠেছিলাম।

তাই শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভাগমনে মনটা চলে যায় সেই ছোটবেলার স্মৃতিতে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১১বছর। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি। তখনকার সময়ে এই বঙ্গদেশের প্রতিটা জেলাশহরে একযুগে চলছিল দুর্ভিক্ষ। যদিও স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম তাদের কাছে ১৯৭৪সালের দুর্ভিক্ষের কথা অজানা থাকলেও, সে সময়ের দুর্ভিক্ষের কথা এখনো এ দেশের অগণিত মানুষেরই মনে আছে। সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত সময়ে আমরা সপরিবারে থাকতাম নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলের ভেতরে। তখই চলছিল আশ্বিনের শুভাগমনে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। যত দুর্ভিক্ষই আর দুর্যোগই হোক-না-কেন, মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ভেতরে দুর্গাপূজা করবেই। কারণ, মিলে শ্রমিক কর্মচারীদের সংঘটন ছিল, ছিল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নও। শ্রমিক কর্মচারীদের সমস্ত দাবিদাওয়ার মধ্যে দুর্গাপূজাও একটা দাবি। তাই প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। আর ছোটবড় সবাই মেতে ওঠতো পূজার আনন্দে।

দুর্গাপূজা শুরু হবার অনেক আগে থেকেই মিলের ভেতরে থাকা সব হিন্দু ধর্মাবলম্বী যার যার সাধ্যমত কেনাকাটা শুরু করে দিতো। শুধু কেনাকাটা আর পূজার আনন্দের নামগন্ধ থাকতো না আমাদের সংসারে। কারণ, আমার বাবা আর বড়দা দু’জনেই ছিল চাকরিজীবী। বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে, আর বড়দা আদর্শ কটন মিলে। বড়দা’র চাকরির সুবাদে আমরা সপরিবারে আদর্শ কটন মিলের ভেতরেই থাকতাম। একবার দুর্গাপূজার কয়েকমাস বাকি। সে সময় আমার বাবা চিত্তরঞ্জন কাটন মিলেই কাজ করতো। একদিন ঠিক দুপুরবেলা বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে কর্মরত অবস্থায় ক্যালেন্ডার মেশিনে ডানহাতের চারটে আঙুল থেঁতলে যায়। এর কয়েকমাস পরেই শুরু হয় আশ্বিনের শুভাগমনে শারদীয় দুর্গোৎসবের সুবাতাস। বাবা হাতের চারটে আঙুল হারিয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আর মা-বাবা, বৌদি, ভাতিজা-ভাতিজি, বিয়ের উপযুক্ত দুই বোন সহ পুরো সংসারের দায়িত্বভারই বড়দা’র ঘাড়ের পর পড়েছে। এতো বড় সংসারের দায়িত্বভার দাদা একা কোনভাবেই বহন করতে পারছিলেন না। পুরো বছর মুদী দোকানে বাকি খেতেখেতে দেখা দিয়েছিল বিশাল অংকের দেনার বোজা। সেই দেনার বোজা চাকরি ছাড়ার পর এককালীন যেই সার্ভিসের টাকা পেয়েছিল, সেই টাকা দিয়েও আরও বেশকিছু টাকা বাকি থেকে যায়। তারপর বৌদির হাতের কানের গহনা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে শোধানো হয়।

এর কারণ ছিল যে, তখকার সময়ে নামমাত্র বেতনে দুইজনের সংসার চালানোই মুশকিল ছিল। কিন্তু এই সামান্য বেতনের এক শ্রমিকের মাথার উপর থাকা এক বিশাল যমের বোজার খরচ চালানো সম্ভব ছিলো না, তাই আমাদের এতো দেনার বোজার ভার সইতে হয়েছিল। আর সেই কারণেই আমাদের নুন আনতে পান্তা শেষের মধ্যে অনাহারে অর্ধাহারে কোনরকমভাবে দিনগুলো অতিবাহিত করতে হয়েছিল। এর মধ্যে মা দুর্গাদেবীর আগমনী বার্তায় ঘরে ঘরে আনন্দে মুখরিত। কান্নার রোল আমাদের সংসারের কোণায় কোণায়। একবেলা মোটা চালের ভাত পেটে গেলেও, দুইবেলা আহার ঠিকমত সেসময়ে আমাদের কপালে খুব কমই জুটেছিল। সকালে আদর্শ কটন মিলের রেশন কার্ডে পাওয়া গমের আটার বানানো রুটি। আর দুপুরবেলার খাবার বিকাল চারটা বাজে খেয়ে, অনেকসময় রাতেরবেলা সবাই না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকতে হতো।
কোনও কোনও রাতে পেটের ক্ষুধায় চোখে ঘুম আসতো না, শুধু ছটফট ছটফট করেই রাত কাটাতাম। রাতের ছটফটানি গর্ভধারিণী মা ঠিকই টের পেতো। তাই রাত ভোর হতে না হতেই আটার যাউ অথবা আটার রুটি তৈরি করার প্রস্তুতি শুরু করে দিতো। ঘরে চাল আটা না থাকলে মিলের ভেতরে থাকা পড়শিদের বাসায় গিয়ে ধরনা দিতো চাল অথবা আটা ধার করার জন্য।

এরকম অভাবের দিনে বাবা হাতের আঙুল হারিয়ে ঘরে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আর চারদিকে চলছে শারদীয় দুর্গাপূজার আনন্দ। মিলের ভেতরে থাকা সব ছেলে-পেলেদের আনন্দের সাথে আমার মনেও জাগতো পূজার আনন্দ। পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা যেই পূজামণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করতেন, সেই মণ্ডপের সামনেই বসে থাকতাম সারাক্ষণ। দুর্গাপূজা সামনে রেখে অনেকে বাজার থেকে জামাকাপড় কিনে এনে সবাইকে দেখাতো। তাদের কেনা নতুন জামাকাপড় দেখে মাকে বলতাম, আমার নতুন জামা পেন্ট কবে কিনবে।

আমার কথা শুনে মা চুপ করে থাকতেন, আর দেহের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন। পূজায় সন্তানকে নতুন জামাকাপড় না দিতে পারার দীর্ঘশ্বাস তখন বুঝতাম না। না বুঝেই খানিক পরপরই মায়ের কাছে গিয়ে নতুন জামাকাপড়ের জন্য কান্নাকাটি করতাম। মা তখন শান্তনা দিয়ে বলতেন, পূজা শুরু হতে আরও কিছুদিন বাকি আছে। সবুর করো সময়মত তোমার নতুন জামা পেন্ট হয়ে যাবে। মায়ের কথা শুনে আশায় আর অপেক্ষায় থাকতাম। পেটে ক্ষুধা থাকলেও নতুন জামাকাপড়ের আশায় ক্ষুধার জ্বালা বেশি একটা অনুভব করতে পারতাম। না। মনে মনে বলতাম, খাবার চাই না, চাই পূজার নতুন জামাকাপড়।

প্রতিদিন প্রতিক্ষণ আমার মুখে ছিল, শুধু নতুন জামা, নতুন জামা। আমার মা যেন দিশা হারিয়ে ফেললেন। মিলের শ্রমিক কোয়ার্টারে যেই ঘরে আমরা থাকতাম, সেই ঘরের পিছনে আমার মা কয়েকটা ধুন্দুলের চারা রোপণ করেছিলেন। সেই বছর মায়ের রোপণ করা ধুন্দুল গাছে বিস্তর ধুন্দুল ধরেছিল। তবে এখনকার দিনের মতন তখনকার দিনে এই ধুন্দুল অনেকেই খেতো না। এক সের ধুন্দুলের দাম ছিল আট আনা বারো আনা। আমার মা প্রতিদিন ঘরের চাল থেকে কয়েক সের ধুন্দুল সংগ্রহ করে এক নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো। আসার সময় আমাদের খাবারের জন্য আটা অথবা চাল আর অন্যকিছু কিনে নিয়ে আসতো। অবশিষ্ট কিছু বাড়তি পয়সা থাকলে সেই পয়সা আমার মা ঘরের বাঁশের খুঁটীতে জমা করে রেখে দিতো, বিপদের দিনের কথা চিন্তা করে।

আমার জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে পূজোর দুইদিন আগে ঘরের বাঁশের খুঁটী কেটে কিছু জমানো পয়সা বের করলো। দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা, চার আনা, আট আনা মিলে মোট ১২টাকার মতন হয়েছে। তখকার দিনে ১টাকার যেই দাম ছিল, এখনকার সময়ে ১০০টাকারও সেই মূল্য নেই। সেই টাকা একটা পুটুলিতে বেধে আমার মা বড়দা’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, পায়ে হেটে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে একটা গাউনের জামা আর একিটা পেন্ট ওর জন্য কিনে নিয়ে আয়। মায়ের কথামত বড়দা তা-ই করলেন। রোববার বন্ধের দিনে পায়ে হেটেই চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জ শহরে। কিনে আনলেন গাউনের জামা আর একটা হাফ-পেন্ট।

তখনকার দিনে এই বঙ্গদেশে নতুন গাউনের কাপড় আসতে শুরু করেছিল বিদেশ থেকে। বিদেশীরা তাদের ব্যবহারিক মেয়াদ উত্তীর্ণ জামাকাপড়গুলো নাকি ফেলে রাখতে। তাদের সেই ফেলে দেওয়া জামাকাপড়গুলো কিছু বাঙালী ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে আমাদের দেশে চালান করতো। সেইগুলেকেই লোকে বলতো গাউন। গাউনের কাপড়ের বিশাল আরৎ ছিল ঢাকা সদরঘাট। সদরঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে সাপ্লাই হতো। সেই গাউনের জামা পেন্টের কথা হয়ত বর্তমানে অনেকেরই মনে আছে। সেসময় আমাদের দেশটা ছিল সদ্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশ। চারদিকেই ছিল অভাব আর অভাব। আমাদের মতন গরিব মানুষের কাছে এই গাউনের কাপড়গুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। এগুলো গুলিস্তান হকার মার্কেটের সামনে আর নারায়ণগঞ্জ দুই নং রেল গেইট সহ শহরের অলিতে-গলিতে পরসা সাজিয়ে বসতো হকাররা। ডি.আই.টি মার্কেটের সামনেও বসতো এই গাউনের কাপড়ের জামা পেন্টের পরসা।

হকাররা সদরঘাট থেকে সেসব জামা পেন্টের গাইড এনে রাস্তার পাশে একটা চটের উপরে গাউনের জামা পেন্টগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতো। আর চিৎকার করে বলতো, “যেটা নেন পাঁচ টাকা, বাইচ্ছা বাইচ্ছা পাঁচ টাকা, এক দাম পাঁচ টাকা।” সেই গাউনের জাম পেন্টই ছিল আমার জন্য শারদীয় দুর্গোৎসবের নতুন জামাকাপড়। তখনতো বুঝতামনা এগুলো কিসের কাপড়। কমদামী না বেশি দামী তাও বুঝতামনা। নতুন জামা পেন্ট পেয়েছি তো মহা-খুশি। মিলের ভেতরে থাকা আরও দশটা ছেলেকেও দেখাতে লাগলাম, আমার নতুন জামা পেন্ট। আমার খুশিতে আমাদের সংসারে সবাই খুশি। আমাদের সংসারে আমিই ছিলাম সবার ছোট। সংসারে সবার চেয়ে ছোটদের আবদারই বেশি থাকে। আমার বেলায়ও হয়েছে তা-ই। আমার বড় আরও দু’বোন ছিল। সে সময় তাঁরা বিয়ের উপযুক্ত হওয়ায় সংসারের দুঃখকষ্ট বুঝতো। বুঝতামনা শুধু আমি। বুঝতাম শুধু নতুন জামা পেন্ট পড়ে সেজে-গুজে কখন পূজামণ্ডপে যাবো আর সমবয়সীদের দেখাবো।

সেই দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে। মনে পড়ে তখন, যখন প্রতিবছরই আশ্বিনের আগমনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছোটবড় সবাই শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দে জেগে ওঠে। সবার সাথে সাথে আমার মনেও শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দ জাগে। কিন্তু চোখের সামনে টেলিভিশনের পর্দার মতো ভেসে ওঠে ফেলে আসা অভাবের দিনে দুর্গাপূজায় গাউনের জামা পেন্ট হাতে পাওয়া খুশির স্মৃতিকথাগুলো।

অমীমাংসিত লেফাফা ২

খেলাঘর ভেঙ্গে গেছে বহুবার তারপরও
বেঁধেছি ঘর, কুড়িয়েছি স্বপ্ন, মেলেছি ডানা দিগন্তের হাতছানিতে;
সমান্তরাল জীবনের বাঁধ ভেঙ্গে হঠাত জেগে ওঠা বেলোয়ারী ঝাড়বাতি
দিনের আলোয় চমক দিতে পারেনি কোন দিন। পুরানো স্মৃতির ধূলো সরিয়ে
সঞ্চিত যা কিছু অর্জন ছুঁয়ে যায় হৃদয় তার সবটুকু কেড়ে নিয়েছে যান্ত্রিক বিবেকবোধ;
তুমি, আমি বা আমাদের মাঝে ধীরে ধীরে দেয়াল তুলে দিচ্ছে মাকড়সার জাল
তাই বন্যদশা থেকে মুক্তির মুক্তা সাগরের গভীরে।

মস্তিস্কে স্নায়ুর চাপ বাড়ে ক্রমশ,
ব্যস্ততাহীন ব্যস্ততা গড়িয়ে চলে ধুলোর স্রোতের মত
তারপর বাতাসে বাতাসে উড়ে যায় দৃষ্টি সীমার বাইরে।
তবু জীবনের ধুলো ভরা বাঁশি খুঁজতে গিয়ে হাতে তুলে নেই
রাতের তারা, জোনাকির জীবদ্দশা, বড়জোর পঞ্চমী চাঁদের আলো।
আমি জানি আমার উড়াল ঘোড়ার পিঠে কোন রাজকন্যা
স্বপ্নতে বসতে চাইতে পারে, তাও ভুল করে,বাস্তবতা বড়ই বেরসিক।

আমার মনের জীর্ণ ঘরে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য কেউ বাস্তবতা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে না।
অলস বিকেল গল্প বলার আয়োজনে কেউ বসে থাকবে না আমার জন্য,
আর কেন এমন দন্যদশা, এর উত্তর আমার কাছে অমিমাংসিত কারন
আমিও বুঝেছি নৈর্ব্যক্তিক ভালোবাসার থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন নৈবেদ্য পূজার থালায়।

তবু আজো আমি একাকি ভিজে চলি এক ছন্নছাড়া চাঁদের আলোয়,
গলিত জোৎস্না আমাকে দগ্ধ করে, মাকড়সার জালের মায়া বাঁধন
আমাকে ঠেলে নিয়ে যায় সময়ের শেষ প্রান্তে আর
ঘরগেরস্ত চাঞ্চল্যে আজও তুমি বাগান সাজাও নিজ হাতে।

হতাশ হাঙ্গর

আইরিশ সাগরে অক্টোবরের প্রথম থেকেই যেন শীত সাহেবের আক্রমণ বেড়ে যায়। এপারে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওপাড়ে আয়ারল্যান্ড। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আবার তার সাথে ঝড়ো বাতাস কিংবা ঘন কুয়াশা। প্রায় সারাক্ষণ একটা না একটা প্রাকৃতিক এলোমেলো ভাব থাকবেই। মাঝে মাঝে এমন হয় যে রীতিমত জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের জুতা পর্যন্ত দেখা যায় না এমন কুয়াশা। সাগরের পানি এবং পানিতে সাঁতরানো মাছগুলি বাছাই করতে থার্মাল গ্লোভস হাতে পরা থেকেও মনে হয় যেন হাত জমে বরফ হয়ে গেছে, কোন বোধ থাকে না। আর ডিসেম্বরে? সে তো এক ভয়ানক ব্যাপার। মনে হয় যেন সমস্ত সাগরের পানি বরফ হয়ে রয়েছে। এমন সময় সমুদ্রে মাছ ধরা হয় না বললেই চলে। তাই বলে কি আর ফিশিং ট্রলার গুলি বসে থাকবে? না, তেমন কোন সম্ভাবনা মোটেই নেই।

১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে রবার্টলি নামের যে ফিশিং ট্রলারে কাজ করি সেটা স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওবান শহর থেকে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল কিংবা যদি সি স্ক্যানারে দেখা যায় সাগর তলে মাছের ঝাঁক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুব বেশি হলে লিভারপুল পর্যন্ত আইরিশ সাগরের মধ্যেই মাছ ধরে বেড়াই। স্যালমন বা লাল স্যালমন পেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। আমাদের সেফ পিটারের ওভেন যেন রেডি হয়েই থাকে কখন গ্রীল করবে। একটা বা দুইটা না মোটা মুটি ৮/১০ টা রেড স্যালমন গ্রীল না হলে যেন হয় না। জাল তুলে ফেরার পথে ব্ল্যাকপুলের একটু পশ্চিমে ‘আইল অফ মান’ দ্বিপে কয়েক ঘণ্টার জন্য থেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র নিয়ে নেই। এই ফাঁকে আবার ওই আইরিশরা যারা এ কয় দিন একটু গলা ভেজাবার জন্য পাবে যেতে পারেনি তারাও একটু সুযোগ পেয়ে জেটির কাছের একটা পাবে গিয়ে দুই এক পাইন্ট লাগার (আমাদের দেশে যাকে বিয়ার বলে) গিলে আসে। জাহাজে বসে গিললে নাকি কোন স্বাদ পায় না!!
আমাদের কোম্পানির অফিস ওবান শহরে। এটা ছোট হলে কি হবে ভীষণ সুন্দর একটা টুরিস্ট শহর। সারা বছর এখানে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা দেশের পর্যটকেরা আসছে যাচ্ছে, তবে শীত কালে কিছুটা কম। সারাটা শীতেই হয়ত ছাতা নয়ত রেইন কোট সাথে নিয়ে কি আর টুরিস্টরা বের হতে চায়?

মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে এসে জেটিতে ভিড়েই মাছ এবং সামুদ্রিক অন্যান্য শামুক, স্টারফিশ ইত্যাদি সব আনলোড করে শুধু মাত্র জাহাজে ওয়াচ কিপিঙের জন্য দুই চার জন থেকে বাকি সবাই নেমে যেতাম। গত টানা অন্তত এক মাস সাগর বাসের এক ঘেয়েমি কাটাতে নেমে যেতাম। ছোট্ট অথচ ওপাশে পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই ওবান শহরের এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। সাধ মিটত না, অন্তত আমার কখন এক ঘেয়েমি আসেনি। প্রতিবার যখন এসেছি তখনি মনে হতো যেন এই প্রথম এসেছি। এর মধ্যে শহরের উত্তর দিকের সিভিক সেন্টারের টাউন হলে দেখে যেতাম কি নাটক হচ্ছে। মন মত কোন নাটক পেলে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পরতাম। সেক্স পিয়ারের নাটক গুলি ইংরেজরা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা মনে হয় আর কেউ পারে না। কাজেই এই লোভ সামলানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতাম না। নাটক না হলেও অন্তত লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টা খানিক ধরে স্থানীয় দুই একটা সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে আবার জাহাজে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই বিশেষ করে গোটা তিনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে তার কোন একটাতে খেয়ে আসতাম। এখানে খেতে

আসলে বাড়তি একটা বোনাস পেতাম।কিছুক্ষণ বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই আইরিশ। আর এরা আইরিশ টানে যা ইংরেজি বলে তা প্রথম দিকে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। তবে ওরা আমার কথা বুঝত।
একবার নিকির সাথে চলে গিয়েছিলাম ব্রিটেনের সর্ব্বোচ্চ শহর ফোর্ট উইলিয়ামে। ওবান থেকে বাসে করে উত্তর দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাস যখন পাহাড়ি পথ বেয়ে ধীরে ধীরে একে বেঁকে উপরে উঠছিল সে এক মায়া ভরা অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে পাহাড়ি উঁচু নিচু সবুজের তেপান্তর। কোথাও কুয়াশা কুয়াশা ঝাপসা আবার কোথাও ঝিকিমিকি রোদ্দুরের আলোছায়া। প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হতে পারে তা এই স্কটল্যান্ডে না এলে দেখা কঠিন। এমনিতে এখানে জন সংখ্যা খুবই কম। অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছু কিছু জন বসতির ছোঁয়া। দূর থেকে বাড়ির ছাদের লাল রঙের টালি গুলি চোখে পরার মত। ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছে মনে হলো কে যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনন্ত কালের অলস সময় নিয়ে বসে বসে হাতে এঁকে সাজিয়ে রেখেছে। শহরের এক পাশে এসে যখন দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম আহা! সে কি মন জুড়ানো ছবি! কত দূরে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ, শুধু আঁকাবাঁকা এলো মেলো পাহাড়ি সবুজ আর সবুজ। দূরে ওই উত্তরে এবং পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে নীল সাগর, দুই চারটা গাং চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পলক পরতে চায় না। মন প্রাণ চোখ সব এক সাথে বলে উঠেছিল বাকীটা জীবন এখানেই থেকে যাই। খেয়ে না খেয়ে শুধু এই প্রকৃতি দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেই।

গরম কালে স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের শহর ইনভার্নেস এর উত্তরে দেড় দুই শত মাইলের মধ্যে যখন যেখানে মাছের ঝাঁক বেশি থাকে ওই এলাকায় জাহাজের পিছনে জাল ফেলে ট্রলিং করতাম একটানা সপ্তাহ খানিক। দিনে অন্তত তিন চার বার জাল টেনে মাছ তুলে বাছাই, গ্রেডিং করে হোল্ডে সাজিয়ে রাখতাম। স্যালমন, রেড স্যালমন, ট্রাউট, কড, হোয়াইট ফিস,চিংড়ি, লবস্টার, স্নিফার, হেরিং আরও কত ছোট বড় হাজার রকমের মাছের সাথে জেলি ফিস, স্টারফিশ, কাঁকড়া, নানা জাতের ঝিনুক, শামুক, বাচ্চা হাঙ্গর, বাচ্চা অক্টোপাস সহ কত কি যে উঠত সে এক দেখার মত দৃশ্য। সমুদ্রের নিচে যে এত প্রাণী তা এই মাছের জাহাজে কাজ না করলে হয়ত কোন দিনই জানতাম না। এগুলির মধ্যে আবার যা মানুষের খাদ্য নয় সেগুলি পশু খাদ্য তৈরির জন্য ব্যবহার হতো আর মানুষের খাদ্য যোগ্যগুলি আলাদা গ্রেডিং করতে করতে নাজেহাল অবস্থা। মানুষের খাদ্য বলতে আমাদের দেশে যা বোঝায় এখানে ঠিক তেমন না। এদের সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় এক রকম ছোট ছোট মুসেল নামে ঝিনুক আছে যা বেশ দাম দিয়েই এরা কিনে বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। অবশ্য আমাদের পিটার সামুদ্রিক সাদা কাঁকড়া দিয়ে যে কাটলেট বানাত তা প্রথম দিকে দেখে মোটামুটি নাক সিটকতাম। কিন্তু এক দিন ওদের সাথে ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসে নানান পদের সস দিয়ে ওই কাঁকড়ার কাটলেট খাবার ভঙ্গি দেখে একটু মুখে দিয়েই রীতি মত আফসোস হল। এত দিন কেন খাইনি।

সে যাই হোক, এসব লিখলে কোন দিন শেষ হবে বলে মনে হয় না। আজ যে কথা বলতে এসেছি সেখানেই ফিরে আসি। এক বার ঝুর ঝুর করে স্নো পরা নীলচে সাদা ধবধবে ওবান হারবারে যখন রাজহাঁসেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছিল তেমনি একটা দিনে আমরা ওবানের ছোট্ট হারবার থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এঁকে বেঁকে বের হয়ে প্রায় এক শ মাইল দূরে এসে জাল ফেলেছি। এখানে হারবার থেকে বের হয়েই জাল ফেলা যায় না কারণ পানির নিচে প্রচুর পাহাড়ি এবং এবড়ো থেবড়ো সাগর তল। জাল বেধে জাল ছেঁড়া সহ নানা রকম ঘটনা ঘটে

যায় বলে নিরাপদ দূরত্বে এসে জাল ফেলতে হয়। বেশ পাঁচ ছয় দিন চলে গেল। জালে ভাল মাছ আসছে। আমাদের আইরিশ স্কিপার (ট্রলার ক্যাপ্টেন) সাম, আসল নাম স্যামুয়েল কিন্তু সবাই সহজ ভাবে সাম নামেই ডাকে। সে আবার আরও কিছু মাছ বেশি হলে জাল তুলে এক বারে লিভারপুল বা ব্ল্যাকপুল হারবারে পৌঁছে দিয়ে জাহাজ রেখে ফেরিতে পার হয়ে বেলফাস্টে তার বাড়ি যাবে এমন একটা আশা নিয়ে একটু দেরি করতে চাইছে।
সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিন বার জাল টানা হয়েছে এবং প্রচুর মাছ ধরা পরছে। সন্ধ্যার একটু আগে দিনের শেষ বারে জাল টানা হচ্ছে, জাল বোঝাই মাছ বোঝা যাচ্ছে। জাহাজের ইঞ্জিন থামিয়ে আস্তে আস্তে উইঞ্চে টেনে জাল কাছে আনা হচ্ছে। মাছ তোলার জন্য ক্রেন রেডি করে রাখা আছে। পাশের উইঞ্চের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে বেশ লোড হয়েছে। আইরিশ জেলে নাবিকেরা পিছনের ডেকে দাঁড়িয়ে মাছ দেখে সবাই মনের আনন্দে আইরিশ ভাষায় চিৎকার করে গান গাইছে। ওদের গান শুনে মনে হচ্ছিল যেন ভাটিয়ালি গাইছে তাই আমিও বাংলায় “ও রে নীল দরিয়া” শুরু করে দিলাম। জাল কাছে এসে পরেছে। পিছনে দেখছি কয়েকটা কাল হাঙ্গর লেজ দিয়ে বারি দিয়ে পানি ছিটিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে। একটু পরেই ভেসে উঠে আবার লেজের বারি। এ আর এমন কিছু নতুন নয়।

প্রায়ই জাল টানার সময় এমন দৃশ্য আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় পেতাম এ কথা স্বীকার করতে মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে পন্টি ছিল একটু বেশি রকমের সাহসী। পারলে লাফ দিয়েই যেন জাল টেনে তুলে আনে এমন লাফালাফি করছিল। ওর চিৎকারই সবার কানে আসছিল। হঠাৎ করে কি মনে করে সম্ভবত আনন্দের আতিসহ্যে জাহাজের রেলিঙের উপরে উঠে নাচতে চেয়েছিল আর অমনিই ঝপাত করে পানিতে পরে গেল। হেই পন্টি!!! বলে সবাই এক সাথে চিৎকার। কিন্তু চিৎকার করে কি আর পন্টিকে তুলে আনা সম্ভব? নিচে তাকিয়ে আর পন্টিকে দেখছি না, তলিয়ে গেছে। সবাই জাহাজের রেলিং ধরে অসহায়ের মত নিচে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই ও ভেসে উঠল। ওদিকে পিছনেই হাঙ্গরের ঝাঁক। কি হয়েছে? এমন করল কেন? কি হবে? কি হবে? এই শীগগির হিভিং লাইন (এক ধরনের রশি, যার এক মাথা কিনারায় বা পাশের অন্য জাহাজের সাথে ভিড়ার সময় ছুড়ে দেয়া হয় এবং ওরা ওটা ধরতে পারলে এ মাথার সাথে জাহাজ বাধার মোটা রশি টেনে নেয়ার জন্য বেঁধে দেয়া হয়) ফেল।লাইফ বয়া ফেল। তাড়াতাড়ি কর। এমনি হুলস্থূল ব্যাপার। কেও হিভিং লাইন খুঁজছে, কেউবা খুঁজছে লাইফ বয়া। এক হৈ চৈ ব্যাপার। হাতের কাছেই সব নির্দিষ্ট জায়গা মত রয়েছে কিন্তু কেও খুঁজে পাচ্ছে না।

সবার আগে লুইস একটা লাইফ বয়া পেয়ে পন্টির দিকে ছুড়ে ফেলল। কিন্তু ওটা ওর কাছে পৌঁছায়নি। এতক্ষণেও হাঙ্গরেরা বুঝতে পারেনি যে ওদের এক মস্ত শিকার ওদের একটু সামনে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওরা শুধু জালের ভিতরে থাকা মাছ খাবার পিছনেই ব্যর্থ দৌড় দৌড়চ্ছিল। তবে হাঙ্গরের যেমন ঘ্রাণ শক্তি তাতে পন্টির গন্ধ ওদের কাছে পৌঁছে যেতে বেশী ক্ষণ লাগবে না। চেঁচামেচির শব্দ শুনে স্কিপার সাম দৌড়ে এসে পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি উইঞ্চ অফ করে নিজ হাতে একটা হিভিং লাইনের মাথায় একটা বয়া বেধে পন্টির দিকে তার সর্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিল। আর পন্টি দুই এক হাত এগিয়ে এসেই খপ করে বয়াটা ধরে ফেলল। এই এতক্ষণে সর্দার হাঙ্গর লাফ দিয়ে পন্টিকে উদ্দেশ্য করে ডুব দিয়েছে, সবাই এক সাথে দেখেছি। তার পিছনের সব হাঙ্গর একই কায়দায় লাফ দিয়ে ডুব দিয়েই সম্ভবত দৌড়। হাঙ্গরেরা কখনোই তার শিকার উপর থেকে ধরে না। ওরা আস্তে করে চুপি চুপি পানির নিচে দিয়ে এসে কামড়ে ধরে।

হিভিং লাইনের মাথায় বাঁধা লাইফ বয়া ধরতে ধরতে পন্টি বেশ কয়েক গজ পিছিয়ে গেছে তবুও যেই কিনা পন্টি লাইফ বয়া ধরেছে আর অমনি হিভিং লাইন ধরে টেনে কাছে আনা হচ্ছে। লাফ দিয়ে ডুব দেয়ার পর থেকে হাঙ্গরদের আর দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টা নিশ্চিত যে ওরা পন্টির গন্ধ পেয়েছে এবং কাছে আসতে আর মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না। পন্টিকে একে বারে জাহাজের পিছনের ডেকের নিচ বরাবর আনা হয়েছে। এর মধ্যে কে যেন রশির তৈরি সিঁড়ি এনে নামিয়ে দিয়েছে। ওপর থেকে নানা জনের হাঁকডাক পন্টি সিঁড়ি ধরে উঠে আস, পন্টি তাড়াতাড়ি কর। ও জানেই না যে এক ঝাঁক হাঙ্গর ওর গন্ধ পেয়ে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। তবে রক্ষা একটাই যে ওরা সোজা আসতে পারছে না। বিশাল জাল ঘুরে আসতে হচ্ছে। সিঁড়ির নিচের দিকটা সাগরের সমতলে পৌঁছে গেছে। পন্টি ওর লম্বা হাত বাড়িয়ে সিঁড়ির একটা ধাপ ধরে ফেলেছে। বলা যায় না, এখন হাঙ্গরের আক্রমণের ভয় এড়ানো যাবে না যদি কাছে এসে থাকে। পানির নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ এইতো আর একটু উপরে, আর একটু হলেই পন্টি সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সম্ভবত পায়ের জুতা ভারী হয়ে গেছে বলে পা টেনে আনতে পারছে না।

হ্যাঁ এইতো পন্টি এক হাতে সিঁড়ির রশি ধরে আর একটু উপরে তুলে এক পা সিঁড়িতে তুলে দিয়েছে। মোটা মুটি দুই স্টেপ উপরে উঠে এসেছে এমন সময় পন্টির ঠিক নিচে সাগরের পানিতে তুমুল একটা তোলপাড় তুলে পানি ছিটিয়ে একটা হাঙ্গরের মাথা বের হলও। শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ডলফিন যেমন মনের আনন্দে লাফিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঠে আসে তেমনি করে মস্ত হা করা একটা বিশাল হাঙ্গরের মাথা এক লাফ দিয়ে পন্টির ডান পা কামড়ে ধরে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পন্টি পরে যাই যাই ভাব। কিন্তু পন্টি সাহস না হারিয়ে বা ভয়ে কাবু না হয়ে এর মধ্যে সিঁড়ির রশি ধরে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান পা এক ঝারা দিয়ে বাম পা আর এক ধাপ তুলে এনেছে। ঝারি পেয়ে ডান পায়ের জুতা খুলে হাঙ্গরের মুখে আর আমাদের পন্টি খালি পা তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে উঠে এক এক করে একেবারে জাহাজের কিনারা ধরে ফেলার আগেই ডেকে দাঁড়ানো দুই জনে ওকে ধরে টেনে ডেকে তুলে ফেলল। নিচে তাকিয়ে দেখি ওরা সবাই চলে এসে মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নেয়ার আক্রোশে পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি ঝড় তুলে ফেলেছে। পন্টিও নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষণ তামাশা দেখছিল।

ঘটনার তাণ্ডবে উইঞ্চ অন করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম সবাই। সাম আবার উইঞ্চের সুইচ অন করে বলল হে হে পন্টি, এত গুলি হাঙ্গরকে এমন হতাশ করে ওদের এত সুন্দর একটা ডিনার হতে দিলে না? দারুণ বাঁচা বেচে গেছ। এই নিক, যাও একটা শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এসে পন্টির মঙ্গল কামনা করে ওকে শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল দিয়ে দাও।

নিয়তি তুমি কোথায়?

ট্যাংকার ‘নেপচুন’ জাহাজটি ত্রৈমাসিক রুটিন মেইনটেনেন্সের জন্য নিজ কোম্পানি গ্রে ম্যাকেঞ্জির রিজিওনাল হেড অফিস বাহরাইনের মোহাররেকে নিজস্ব স্লিপ ওয়েতে এসেছে। এটি ব্রিটিশ পতাকা বাহী এবং এর ধারণ ক্ষমতা বার হাজার টন। জাহাজটির পোর্ট অফ রেজিস্ট্রি লন্ডন হলে কি হবে এতে মোটামুটি চার পাঁচটা দেশের নাবিক কাজ করে। এদের সাথে রয়েছি বাংলাদেশের আমি এবং জসীম। আমরা এক সাথে লেখাপড়া করেছি এবং দেশ ছেড়ে দুই জনে এক সাথে রয়েছি বলে স্বাভাবিক ভাবে অন্তরঙ্গতা বা ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি। স্লিপ ওয়েতে সাধারণত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজের বটম, প্রপেলার, রাডার চেক করা আর টুকি টাকি যা মেরামত কাজ থাকে সেগুলি সেরে পাশের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে লোড নিয়ে ভিন্ন কোন বন্দরে চলে যাই।

এবার প্রথম যে দিন সকালে এখানে এসেছি সে দিন স্লিপ ওয়ের লোকজনেরা আমাদের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন বার্কির দেয়া লিস্ট অনুযায়ী জাহাজের মেরামত কাজ করছে। সারা দিন আমরা জাহাজের নাবিকেরা সবাই যার যার কাজ অনুযায়ী ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছি।

বিকেলে কাজকর্ম সেরে মানামা যেতেই হবে। ওখানে একটা দোকানে দারুণ সিঙ্গারা বানায়। এক শ ফিলসে একটা কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে যে চাটনি সেও দারুণ। তবে কোন পানি নেই, পানি খেতে হলে আলাদা সফট ড্রিঙ্কস কিনে নিতে হবে। জাহাজ যখনই এই ছোট্ট মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন আসে তখনই আমাকে ঐ সিঙ্গারার লোভে মানামা যেতেই হবে। কখনো শোর লিভ না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্য যেই যাক তাকেই বলে দিতাম আমার জন্য সিঙ্গারা নিয়ে এসো। এক বার এক এক করে পাঁচ প্লেট খেয়েছিলাম। আজও সে কথা মনে হলে হাসি পায়। জাহাজে শুধু মাত্র বাংলাদেশি রান্না বাদে নুন মরিচ মশলা ছাড়া পাঁচ মিশেলি যেমন কখনো ইংলিশ, কখনো ইটালিয়ান কিংবা গ্রীক। এই সব রান্না খেয়ে কি আর বাঙ্গালির মন ভরে? তাই যখন এই উপ সাগরের পাড়ে যেখানে জাহাজ যায় খুঁজে বেড়াতাম কোথায় বাংলাদেশি বা ভারতীয় বা নিদেন পক্ষে পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট আছে। অবশ্য অনেক দিন যাতায়াত করতে করতে আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল কোথায় কি আছে। জাহাজ থেকে শোর লিভ পেলেই নুন মরিচের স্বাদের আশায় ছুটে যেতাম ওই সব রেস্টুরেন্টে।

যাক, যা বলছিলাম। এবার প্রথম দিন বিকেলে বাইরে যাবার জন্য জসীমকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজের গ্যাং ওয়েতে এসে নিচে নামার সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি এমন সময় ক্যাপ্টেন পিছন থেকে ডাকল। ফিরে দাঁড়ালাম। শোন, ওই যে ডেকের উপরের ব্রিজের নিচ দিয়ে যে পানির লাইনে লিক হয়েছিল তুমি ডেভকন দিয়ে মেরামত করেছিলে মনে আছে? হ্যাঁ থাকবে না কেন, এইতো সেদিনের কথা। তা হলে কাল ওয়ার্কশপের লোকজনেরা আসার আগে ওই ডেভকনের প্রলেপ সরিয়ে দিও যাতে ওটা ওয়েল্ডিং করে নেয়া যায়। আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালেই করে ফেলব। বলে নেমে গেলাম। যাবার পথে জসীমের সাথে নানা ধরনের গল্প। ওর ভয়েজ শেষ করে দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ও চাইছে আরও কিছু দিন থেকে আরও কিছু ডলার সাথে নিয়ে যেতে। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি দেরি করে কি হবে তার চেয়ে তুই এবার চলে যা, আবার না হয় তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি! ওদিকে তোর বৌ অপেক্ষা করছে। না, ও কথা সে মানছে না। যাক, না মানলে আমি কি করব? আমার যেতে অন্তত আরও মাস খানিকের মত দেরি আছে। ও জানে কিন্তু তবুও আমাকে বলল তুই চলে যা। আরে আমি কি করে যাই? আমার আরও দেরী আছে না?
সে দিন আগের মতই মানামা থেকে সিঙ্গারা খেয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে জাহাজে ফিরে এসে শুয়ে পরলাম।

পর দিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ডেকে গেলাম। শুকনো ডেভকনের আস্তর তোলার জন্য চিপিং হ্যামার এনে যেই প্রথম বারিটা দিলাম আর ওমনিই ডেভকনের একটা বিরাট টুকরো এসে আমার ডান চোখে আঘাত করল। সে কি যন্ত্রণা! মনে হচ্ছিল এই বুঝি জীবনের শেষ। সমস্ত পৃথিবী এক ঝলক করে নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে উঠল। রঙ গুলো আসছে যাচ্ছে। ভাবছি, আমি বুঝি মরে যাচ্ছি। শুধু একটা চিৎকার দিতে পেরেছিলাম। এই মনে আছে। আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি আমার পাশে সাদা পোশাক পরা এক জন ইন্ডিয়ান নার্স দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কবরের ভিতরে এই মানবী এলো কেমন করে?সেও আবার আমার দেশের মেয়েদের মত চেহারা! দুনিয়ার কাজ কর্মের হিসেব নিবে না কি করবে বুঝে উঠতে পারছি না। অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল এখন কেমন লাগছে? এ কি! এ দেখি আবার মানুষের মতই ইংরেজিতে কথা বলছে। ফেরেশতারা কি এমন হয়, ইংরেজিতে কথা বলে? কিন্তু দুনিয়াতে শুনেছি ফেরেশতারা আরবিতে কথা বলে। তাহলে? পাপ পুণ্যের কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন? তাহলে এ কি ফেরেশতা নয়? আবার জানতে চাইল, কেমন লাগছে? এ্য, এটা কোন জায়গা? এটা বাহরাইন জেনারেল হাসপাতাল। আমি এখানে কেন? তোমার চোখে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। শোনার সাথে সাথে অনুভব করলাম আমার ডান চোখে ব্যান্ডেজ। সম্ভবত কোন আঘাত পেয়ে তুমি সেন্স লেস হয়ে গিয়েছিলে। ডাক্তার এক্স রে করে তোমার ডান চোখ অপারেশন করে মণির ডান পাশ থেকে প্রায় তিন মিলিমিটার ডিপ থেকে লোহার মরিচার গুড়া বের করেছে। কি হয়েছিল? এই এতক্ষণে সব কিছু একটু একটু মনে পরছে। আমি ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাতায়াতের পথের নিচের পানির লাইন থেকে ডেভকন তুলছিলাম। কি একটা যেন ছুটে এসে আমার চোখে আঘাত লাগল। এরপর আর কিছু মনে পরছে না। মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই পারছি না। নার্স আবার জানতে চাইলে যা মনে পরেছে তাই বললাম। শুনে খুব আফসোস করল। সিথানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনার কথা বলছে। তোমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে চোখের মণিতে লাগেনি। চোখটা রক্ষা পেয়েছে, কয়েক দিনেই ভাল হয়ে যাবে চিন্তা করো না এখন এই ওষুধটা খেয়ে নাও। সেই সকাল থেকে এমনি রয়েছ, আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

বিকেলে ক্যাপ্টেন ই বার্কি, জসীম এবং আরও কয়েক জন এলো। জসীম বলল আমি তোমার চিৎকার শুনেই দৌড়ে কাছে এসে দেখি তুমি ডেকে পরে রয়েছ পাশে চিপিং হ্যামার। তোমাকে তুলে দেখি পকেটে প্রায় চার ইঞ্চি সাইজের একটা পুরু ডেভকনের টুকরো। ওই দেখেই বুঝলাম ওটা তোমার চোখে লেগেছে। সেফটি গ্লাস পরে নাওনি কেন?যাই হোক তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনকে জানালাম উনি সাথে সাথে ওয়ার্কশপের গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে এই হাসপাতালে এলো। সাথে আমি আর ড্যানি এসেছিলাম। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে সাথে সাথে এক্স রে করে দেখে অপারেশন করে এখানে নিয়ে এলো। আমরা সবাই ছিলাম। তোমার জ্ঞান ফিরছে না বলে এই নার্স এখানেই ছিল। বেশ অনেকক্ষণ থেকে ওরা চলে গেল। এর পর থেকে পালা করে কয়েক জন নার্স

ডিউটি করেছে। বেশ যত্ন করছিল সবাই। গোসল করা যাবে না বলে গরম পানিতে শরীর মুছে দেয়া থেকে সময় মত খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো সব কিছু। শুধু টিভি দেখতে বা কোন পত্রিকা পড়তে দেয়নি। তারপর দিন বিকেলে আবার জাহাজ থেকে কয়েক জন এলো। ওদের সাথে আমাদের এই স্থানীয় অফিসের ক্রু সুপার ক্যাপ্টেন রামস বটম এলো। এ দেশে হাসপাতালে রুগীর জন্য বাইরে থেকে কোন খাবার দাবার বা ফুল বা কোন কিছুই সাথে করে নিয়ে আসার কোন নিয়ম নেই। সে দিন যাবার সময় ক্যাপ্টেন বার্কি বলল জাহাজের মেরামত হয়ে গেছে, আমরা কাল সকালে সিতরা থেকে লোড নিয়ে দোহা যাব। ক্যাপ্টেন রামস বটম বলল তুমি এখানেই থাকবে, সুস্থ হলে পরে তোমাকে হোটেলে পাঠিয়ে দিব। জাহাজ থেকে তোমার পাসপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি। ইমিগ্রেশনে এন্ট্রি করিয়ে নিয়েছি। পরে তোমার জাহাজ কোথায় থাকে সেই অনুযায়ী জাহাজে যাবার ব্যবস্থা করা যাবে। আমার চিন্তিত মুখ দেখে বলল, ডোন্ট ওরি মাই বয় আই উইল বি হেয়ার। আমি প্রতি দিন এক বার এসে তোমাকে দেখে যাব। আমি বললাম আমার ভাল লাগছে না আমি বাড়ি যাব। আচ্ছা ঠিক আছে দেশে যাবে, তবে এমন শরীরে জার্নি করবে কি করে? একটু সুস্থ হয়ে নাও তখন যেও।

চার পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হলে আমার অফিসের গাড়ি এসে হোটেল মানামায় নিয়ে গেল। হোটেলে তিন চার দিন থাকার পর এক দিন সকালে অফিস টাইমে ফোন এলো। ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান মুর্থি কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলল তোমাকে আবুধাবি যেতে হবে, কাল তোমার ফ্লাইট। গাড়ি পাঠাচ্ছি অফিসে এসে তোমার টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে যাও। অফিসে যেয়ে মুর্থির সাথে দেখা না করে সরাসরি রামস বটমের রুমে চলে গেলাম। আমি আবুধাবি যাব না, আমাকে দেশের টিকেট করে দাও। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথা আমার মনে আছে। আপাতত তুমি ওখানে যাও, আমি চিটাগাং এ এজেন্টের কাছে তোমার রিলিভার এর জন্য টেলেক্স পাঠিয়েছি কেউ এক জন এলেই তোমাকে পাঠিয়ে দিব। আচ্ছা ঠিক আছে বলে ধন্যবাদ জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এবার মুর্থির রুমে এলাম। কিছুক্ষণ কেমনে কি হল এসব নিয়ে আলাপ করে চা খাইয়ে টিকেট পাসপোর্টের খাম দিয়ে বলে দিল কাল বিকেলে ড্রাইভার তোমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসবে। আবুধাবিকেও বলে দিয়েছি তুমি ওখানে পৌঁছে অফিসে ফোন দিলেই ওরাও গাড়ি পাঠাবে। আচ্ছা গুডবাই বলে চলে এলাম।

আবুধাবি পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জাহাজে এসে দেখি ওরা তেল আনলোড করে জেটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওঠার পরেই লোড নেয়ার জন্য সউদি আরবের রাস্তানুরাহ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। এই ভাবে কয়েকটা ট্রিপ পরেই এক দিন দুবাই থেকে কুয়েত যাবার পথে ক্যাপ্টেন জানাল আগামী সপ্তাহে তোমার রিলিভার আসছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। হাতের কাছে যা ছিল তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়ার ব্যস্ততা শুরু হল। আবুধাবি যাবার পর টিকেট পেতে দুই এক দিন সময় লাগবে তখন কিছু কেনা কাটা করে নিব। যদি দুবাই থেকে ফ্লাইট হয় তাহলে ভাল হবে। এখানে সব কিছুর দাম কম। কুয়েত থেকে লোড নিয়ে আবার আবুধাবি পৌঁছাতে এক সপ্তাহ লেগে গেল। আবুধাবি পৌছার দুই দিন আগেই জাকির এসে দুবাইর এক হোটেলে থাকছে। গ্রে আবুধাবি (আমাদের কোম্পানিকে রেডিওতে ডাকার নাম) জানিয়েছে। জুলাই মাসের ২২ তারিখ সকালে আবুধাবি পৌঁছে সরাসরি জেটিতে ভীরে দেখি জাকিরকে নিয়ে এজেন্ট অপেক্ষা করছে। আমি আগেই রেডি হয়ে ছিলাম। জাকির জাহাজে ওঠার পর আমার সাইন অফ করে আমার পাসপোর্ট দিয়ে দিল। সাথে চিটাগাং এর এজেন্টকে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেনের লেখা একটা চিঠি। জসীমের কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগ সুটকেস সহ নেমে এজেন্টের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি জসীম করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। মনের অবচেতনা থেকে একটা প্রশ্নের উদয় হল। জসীম, আবার কি দেখা হবে? নিজেকে ধমক দিলাম, কি সব ভাবছ? কেন দেখা হবে না? গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই একটা বিশাল শেড এর আড়ালে চলে গেলাম। ওরা এখন জাহাজ ছেড়ে আবুধাবির অফ শোর মুরিং এ যেয়ে তেল আনলোড করবে। আর সেই তেল গিয়ে পৌঁছাবে অফ শোর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে “আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি” বা এডনকের ট্যাঙ্কে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুবাই পৌঁছে জাকির যে হোটেলে ছিল ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিল। যাবার সময় ড্রাইভার বলে গেল তোমার টিকেট হলে অফিস থেকে জানাবে, তখন এসে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাব। ওকে ইব্রাহিম, বাই!

ইব্রাহিম চলে যাবার পর হোটেলের কাউন্টারে গেলাম। আমাদের এই গ্রে মেকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিস কোম্পানির যত সিম্যান এই দুবাই দিয়ে আসা যাওয়া করে তার সবাই এই হোটেলেই থাকে। এখানকার সবই আমাদের চেনা। অফিস থেকে আগেই হোটেল ম্যানেজারকে জানিয়ে রেখেছিল। রিসিপসনের খাতায় নাম ধাম লিখে আমার হাতে ৬ তলার একটা রুমের চাবি দিয়ে বলে দিল “হ্যাভ এ নাইস টাইম হেয়ার”।

দুপুরে খাবার পর বের হয়ে সোজা বার দুবাই মার্কেটে চলে গেলাম। দেশে যাচ্ছি বলে কিছু কেনা কাটা করব। হাতে যা ডলার ছিল সেগুলি সব ভাঙ্গিয়ে যা যা মনে ধরল কিনে নিলাম। কিনে দেখি এখনও বেশ কিছু দিরহাম পকেটে রয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে কাল আবার আসব। কাল সকালে একবার দেরা তে অফিসে যাব দেখি টিকেটের কি করেছে জেনে আসব আর হিসেব নিকেশ করে কত ডলার বাকী আছে তা যদি দিয়ে দেয় তা হলে নিয়ে আসব। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের ভিতরে ঢুকে লাউঞ্জ পার হয়ে রিসিপসনের পাশ দিয়ে লিফটে উঠবো বলে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছি আর অমনি রিসিপসনের ইন্ডিয়ান জন একটু উত্তেজিত ভাবে ডাকল
এই এদিকে আস, তোমার একটা জরুরী ম্যাসেজ আছে!
এগিয়ে গেলাম।
কি খবর জন?
তুমি কি জান যে তোমাদের নেপচুনে আগুন লেগেছে?
শুনেই বুকটা ধক করে উঠল। জসীম, জাকিরের চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
কি বলছ জন?
হ্যাঁ তুমি বেরিয়ে যাবার পর তোমাকে জানাবার জন্য তোমাদের অফিস থেকে ফোন করেছিল।
বল কি?
হ্যাঁ তুমি তোমার অফিসে ফোন করে জেনে দেখ। বলেই ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ওদের ফোন বুক বের করে আমাদের গ্রে মেকেঞ্জির ফোন নম্বর বের করে দিল। নম্বর ঘুরিয়ে রিসিভার কানে নিয়ে রিং টোন শুনছি আর বুক ঢিব ঢিব করছে ‘আল্লাহ জন যা বলছে তা যেন সত্যি না হয়!’ ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান স্টেনলির কণ্ঠ চিনতে পারলাম।
হ্যালো স্টেনলি, নেপচুনের কি হয়েছে?
আমি খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে নেপচুন ইজ ডেড এন্ড মস্ট অফ দি ক্রুজ আর ইন হসপিটাল এন্ড মোর ওভার সাম আর ডেড।
কি করে হল?
সংক্ষেপে সব বলল। সাথে যারা জীবিত আছে তারা আবুধাবির কোন হাসপাতালে আছে বলে দিল।
আমি কি এখন ওখানে যেতে পারি?
না এখন পারবে না, কাল সকালে যেও।

বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল। আমার হাত থেকে কখন রিসিভার নামিয়ে রেখেছি না কি জন নিয়ে রেখেছে বলতে পারছি না। মনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বইছে। জসীম আর ওর নতুন বৌ মল্লিকার চেহারা মনে ভাসছে। আজ সকালেই মাত্র জাকির এসেছে। ওর হাসি খুশি চেহারা মনের পর্দায় ভেসে এলো। আমাকে দেখেই বলেছিল যান, আপনার জন্য ঢাকা শহর সহ পুরো বাংলাদেশ রেখে এসেছি। নিজেকে অসম্ভব অসহায় মনে হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কেন শপিং করতে গেলাম বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কি হল? জসীমের কি হয়েছে? ওকি বেচে আছে না কি? সেকেন্ডে কয়েক হাজার মাইল বেগে মনের আকাশে অসংখ্য প্রশ্নের ধারা বয়ে গেল। কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এখন কি করব? দুবাই থেকে ট্যাক্সিতে আবুধাবি গেলেও দেড় ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু এখন ওখানে যেয়েও কিছু হবে না। কাউকে দেখতে পাব না, কিছু জানতে পারব না। অনেকক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কোন বোধ নেই। জন ডেকে লাউঞ্জের একটা সোফা দেখিয়ে বলল ওখানে একটু বস। চিন্তা করে কিছু হবে না। কাল সকালে আবুধাবি গিয়ে দেখ। সোফায় বসলাম। জন রিসিপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসা যাওয়ার পথে দুবাই এলে এই হোটেলে থাকি বলে প্রায় সবার সাথে বেশ আলাপ আছে। ওর কথা কিছু কানে ঢুকছে অধিকাংশই ঢুকছে না। বুঝতে পারছি। জাকির যদি আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে আসত কিংবা জসীম যদি আমার আগে চলে যেতে চাইত তা হলে আমি নিজেই ওই জাহাজে থাকতাম। “নেপচুন ইজ ডেড” বারবার স্টেনলির এই একটা কথাই শুধু মনের আকাশে কাল মেঘের মত ছেয়ে আছে। এ কথার মানে কি তা আর কেউ না জানলেও যারা নাবিক, সাগরে ভেসে যাদের জীবন কাটে তারা খুব ভাল করেই জানে।

মানুষ নিজেই জানে না তার নিজের একটা অসম্ভব সুন্দর এবং কার্যকর গুণ আছে। আর তা দিয়ে যত রকমের বিশাল বা ক্ষুদ্র মনের আঘাত এক সময় ভুলে যেতে পারে। মনের উপরে ভুলের একটা প্রলেপ দিয়ে দেয়। যেমন পারে নিজের সন্তানের অকাল মৃত্যু যন্ত্রণা, মায়ের সাধ না মিটিয়ে তাকে কবরে রেখে আসার ব্যথা কিংবা প্রিয়তমর হঠাৎ করে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার হাহাকার। তেমনি একটা গুণ বোধ হয় আমারও আছে আর তাই সম্ভবত এক সময় যে কোন ভাবেই হোক আমিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লিফটে করে উপরে চলে গেলাম।
সারা রাতে ঘুম আসেনি। বারবার জসীম, জাকির, মাত্র গত ভয়েজের শেষে বিয়ে করা জসীমের নতুন বৌ মল্লিকা আর আমার অবস্থান নিয়ে একটি করুণ বিষাদে ভরা চলচ্চিত্র দেখেছি। যার পরিচালক নিয়তি স্বয়ং। অভিনয় করেছি আমরা এই কয়েক জন এবং আশে পাশে ছিল আরও কয়েক জন। তাদের এক জন হচ্ছে

এমন এক জন যার সাথে এই ভয়েজের শেষে দেশে যাবার পরে আমার সাথে সারা জীবনের জন্য একটা মধুর সম্পর্ক হবার কথা গুরু জন মহলে ঠিকঠাক হয়ে আছে। কি হবে এই সম্পর্কে? এই তো জসীম কত গুলি বছর ধৈর্য ধরে কত অপেক্ষা করে কত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে মল্লিকাকে নিয়ে এলো। আজ কোথায় মল্লিকা আর কোথায় জসীম? মল্লিকা কি জানতে পেরেছে? ওর এত প্রতীক্ষার জসীম এখন কোথায়? গ্রে ম্যেকেঞ্জি টেলেক্স পাঠাবে চিটাগাঙের এজেন্টকে। ওই টেলেক্স পেয়ে চিটাগাঙের এজেন্ট টেলিগ্রাম পাঠাবে জসীমের বৌ মল্লিকাকে। তাতে অন্তত তিন থেকে চার দিনের আগে মল্লিকার এ সংবাদ জানার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? মল্লিকা কি স্বপ্নে কিছুই দেখেনি? তার হাত থেকে কি কিছু ছুটে পরে যায়নি? হাটার পথে কি কোন হোঁচট খায়নি? কিংবা মল্লিকার বুকের ভিতরে লুকান জসীমের জন্য ভালবাসার যে স্বপ্ন সরোবর রয়েছে সেই সরোবরে কি উথাল পাথালি কোন ঢেউ ওঠেনি? নিশ্চয় টেলেক্স টেলিগ্রামের ধাঁধা ডিঙ্গিয়ে মল্লিকার লুকান সরোবরে এতক্ষণে উত্তাল প্রলয়ঙ্করী কোন ঢেউ আছড়ে পরছে। মল্লিকা কি ধারনাও করতে পারছে এই ঢেউয়ের মানে কি?

তা হলে আমি কেন এই কণ্টক বিভীষিকা এবং পায়ে পায়ে বিপদের হাতছানি জড়িত জীবনের সাথে তাকে জড়াব? তাকে কি জানাব জসীম মল্লিকা জাকিরের কথা? এ সব কথা জেনে সে কি আমাকে সহজেই বরণ করে নিবে? তার মনে কি দ্বিধা থাকবে না? তা হলে কি হবে, কি হবে ভেবে ভেবেই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেমন করে চলে গেল কিছুই বুঝলাম না। ভোরের আজানের সুরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের দরজা খুলে বারান্দায় চেয়ারে বসলাম। অনেক দূরের মরু পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্যের লাল রশ্মি চিক চিক করে উপরে উঠে আসতে চাইছে কিন্তু কি জানি মল্লিকার কথা ভেবে হয়ত সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বেশ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় ভিতরে এসে সকালের কাজ কর্ম সেরে কাপর পরে নিচে এসে রিসিপসনে বলে হোটেল ছেড়ে এলাম। ভাগ্য ভাল, সাথে সাথেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে সোজা আবুধাবির ওই হাসপাতালে চলে এলাম।

রিসিপসনের লোকদের আমার পরিচয় জানালাম। সাথে আরও বললাম, ওখানে আমিও থাকতে পারতাম কিন্তু নিতান্ত নিয়তির অনিচ্ছা ছিল বলে থাকা হয়নি। শুনে ওরা আফসোস করল, ভেরি স্যাড! এক জন আমাকে ডান বাম ইত্যাদি বলে লিফট দেখিয়ে দিল। লিফট বেয়ে ওদের ডান বাম অনুযায়ী ৩২ ডি নম্বর রুমে ঢুকে দেখি জাকির শুয়ে আছে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু ব্যান্ডেজ। নার্সকে বললাম, পাশের টুল দেখিয়ে বসতে বলে ডাকতে নিষেধ করল। ঘুম ভাঙলে কথা বলতে বলল। অপেক্ষা করছি। রুমের বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য যারা ছিল তারা কোথায়? নার্স রুম ছেড়ে পাশের রুম থেকে একটা টাইপ করা কাগজের ফটো কপি এনে হাতে দিল। পড়ে দেখলাম পাঁচ জন স্পট ডেড। তার মধ্যে জসীমের বিকৃত ডেড বডি পাওয়া গেছে বাকী কারো কোন চিহ্নই পায়নি। এডনকের যে পাইপ ফিটার ছিল তাকেও পাওয়া যায়নি। হয়তবা কোন হাঙর বা কোন সামুদ্রিক জীবের ক্ষুধার খাদ্য হয়েছে কি না কে জানে? এই হাসপাতালে বার জন চিকিৎসায় আছে।

প্রায় ঘণ্টা খানিক পরে জাকির চোখ মেলে তাকিয়েছে। দেখে পাশে দাঁড়ালাম। আমার দিকে হাসি কান্না সব কিছু ভুলে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে ওর কোন বোধ বিকার কিছুই নেই। আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখছি না। কি হয়েছে বা ও কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ওর সাথে আমিও কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ? মিনিট দশেক পরে ডাকলাম, জাকির! কেমন আছ জাকির? মনে হল কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল, বুঝে আমার মনেও আঘাত লাগল। মাত্র এই, এই টুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল সকালেই যাকে দেখেছি ফুরফুরে বাতাসের মত হাসছে। আজ তার এ কি চেহারা! শুধু কাল সকালে কেন, বিগত ৭/৮ বছর ধরেই দেখছি যে জাকির কখনও মুখ ভার করে থাকেনি। আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটি ভিজে আসছে। গায়ে মাথায় কোথাও হাত দেয়ার উপায় নেই। শুধু ব্যান্ডেজ। অনেকক্ষণ কাঁদল। কিছু বলতে পারলাম না, কোন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু ঠোট নড়ল দেখে বুঝলাম হয়ত কিছু বলতে চাইছে। ওর ঠোটের কাছে কান এগিয়ে আনলাম। নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ভাই, আপনি কি ভাবে জানলেন? এখানে এলেন কি ভাবে? বললাম সব কিছু। কি হয়েছিল জাকির? শুনেই আবার কান্না। কাঁদার সুযোগ দিলাম। কান্নার পানিতে যদি দুঃখ কষ্ট গুলি ধুয়ে ফেলতে পারে। কাঁদুক, ও যতক্ষণ পারে কাঁদুক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু শান্ত হলে আবার জিজ্ঞেস করলাম। তখন অতি নিচু কণ্ঠে যা বলল:
আমাকে নামিয়ে দেয়ার পর ওরা অফ শোর বয়াতে মুরিং করে সাগর তলা থেকে তেলের পাইপ তুলে মুখে লাগান ঢাকনা খুলে লাইনের তেল বের হয়ে যাবার অপেক্ষা করছে। সমস্ত জাহাজ পেট্রোলের গ্যাসে ভরে গেছে। জাকির, জসীম আর ইরানি জাবের জাহাজের পিছনের ডিসচার্জিং লাইন এডনকের যে লোকটা খুলছে তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এমন সময় পাকিস্তানি কুক হেলপার আরাফাত গ্যালিতে (কিচেন) ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালাবার জন্য দিয়াশলাই জ্বালাবার সাথে সাথেই আগুনের শিখা মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জাহাজে ছেয়ে গেল। জসীম ভাই চিৎকার দিয়ে পরে গেল জাবেরও ওই ভাবে একটা চিৎকার দিয়ে কি হল জানি না আমি আর কোন উপায় না দেখে পাশের বয়াটা নিয়ে পানিতে ঝাপ দিলাম কিন্তু ঝাপ দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে এডনকের পাইপ দিয়ে যে তেল পরে পানিতে ভাসছিল তাতে আগুন ছড়িয়ে গেছে এবং আমি ওই আগুনের মধ্যেই নামছি। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বয়া ধরে সাঁতরাতে পারব না। যতক্ষণ পারা যায় ডুব দিয়ে থেকে শ্বাস নেয়ার জন্য হাত দিয়ে উপরের পানি সরিয়ে মাথাটা কোন ভাবে উঠিয়ে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে থাকতে হবে। কিন্তু পানিতে পরার একটু পরেই আমার হাত থেকে বয়াটা ছুটে গেল। এর মধ্যে পানিতে নামার সাথে সাথেই সমস্ত শরীর পুরে গেছে বুঝতে পেরেছি, শরীরে জ্বালা করছে। সাগরের নোনা পানির জন্য চোখ খুলে কিছু দেখতে পারছি না। হাত পুরে গেছে। সাঁতরাতে পারছি না। শেষ যখন হাতে বয়া ছিল তখন দেখেছিলাম যেখানে জাহাজ ছিল তার আশে পাশে আগুন আর আগুন। জাহাজের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু আগুন। এডনকের পাইপ ফিটারদের যে বোট ছিল ওরা যে কখন বোট নিয়ে সরে পরেছিল জানি না। ওরাই ওয়ারলেস দিয়ে শোর অফিসে সংবাদ দিয়ে ওই আগুনের মধ্যেই কিছুক্ষণ ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে ফোম ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাকে যাকে দেখেছে তাদের তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে আবুধাবি হারবার থেকে ফায়ার ফাইটিং টাগ আসতে দেখেছি। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমাকে জিজ্ঞেস করল
জসীম ভাই কোথায়? আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। শুধু এটুক বলেছিলাম অন্য কেবিনে আছে।
আপনার টিকেট হয়েছে?
না এখনও অফিসে যাইনি। আজ সকালে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু কাল রাতে তোমাদের এই সংবাদ জেনে আজ অফিসে না যেয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে চলে এসেছি।

এর দুই এক দিন পরেই আমার টিকেট হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা গভীর টান থাকা স্বত্বেও বিদেশের নানা জটিলতার জন্য আর জাকিরকে দেখতে আবুধাবি যেতে পারিনি। দুবাইতে অফিস, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নানা ঝামেলা সেরে বিষণ্ণ মনে যখন দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে সিট বেল্ট বাধছিলাম তখন ভাবছিলাম, “নিয়তি তুমি এখন কোথায়”? একটু পরে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের প্লেন যখন দুবাইর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল তখন ফেলে আসা জসীমের নিশ্চিহ্ন দেহ, জাকিরের করুণ দৃষ্টি আর মল্লিকার কল্পিত হাহাকারের কথা ভেবে কেমন যেন পাথরের মত বসে বসে জানালা দিয়ে সব দেখলাম।

কখন ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেছি বলতে পারিনা। প্লেন থেকে নেমে জনস্রোতের সাথে এরাইভ্যাল লাউঞ্জে এসে নিজের ব্যাগ নিয়ে গেটের কাছে এসে ওই একই ভাবনা মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, এক ট্যাক্সি ড্রাইভার পাশে এসে জিজ্ঞেস করল স্যার কোথায় যাবেন? সেই কখন থেকেই দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?
সম্বিত ফিরে এলো।
না কেও আসবেনা, আমি মতিঝিল যাব, যাবেন?
চলেন।

সাগর তলে রূপ নগর

বাহরাইন সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে ব্রিটিশ পতাকাবাহী ট্যাংকার জাহাজ “কুইন অফ গালফ” এ ফুল লোড অর্থাৎ প্রায় ষোল হাজার টন হাই স্পিড ডিজেল নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শীতের কোন এক সন্ধ্যা বেলায় আমরা ওমানের মাস্কাট বন্দরের দিকে সেইল করেছি। মাত্র দুই দিন এক রাতের পথ। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আরব্য উপসাগর দিয়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারণত এখানে সাগর উত্তাল থাকে তবে আজ সেইল করার সময় সাগর কিছুটা শান্ত ছিল বলা যায়। কিন্তু সেইল করার পর দিন ভোর থেকেই লক্ষ্য করছি আমরা যতই এগুচ্ছি ঢেউ এর উচ্চতা আস্তে আস্তে ততই বাড়ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজের রোলিংও বাড়ছে। জাহাজে চাকরি করার অনেক সুবিধা যেমন: নানা দেশ দেখা যায়, তার সাথে নানা জাতির মানুষের সাথে মেশা যায়। জানা যায় তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা। পাশাপাশি কিছু অসুবিধা বা এক কথায় বলা যায় একটা দুঃসহ যন্ত্রণা রয়েছে আর তা হচ্ছে এই রোলিং। অনেকেই রোলিং মোটেই সহ্য করতে পারে না।

কাউকে এমনও বলতে শুনেছি যে, এই ভয়েজ শেষ হলেই আর আসব না। দেশে ফিরে গিয়ে পানের দোকান দেব তবুও এই রোলিং আর না। কিন্তু হলে কি হবে, সাগরের হাতছানির নেশায় যে একবার ডুবেছে তাকে যে আবার, বারবার সাগরের বুকে ফিরে আসতেই হবে। সাগরের যেন কেমন একটা মায়া রয়েছে। যে মায়াজালে সে সবাইকে আটকে ফেলে। সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় মুক্তার মত সাদা ফেনার লুকোচুরি মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন নীল ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে কিংবা সাগর পাড়ে আছড়ে পরে সে এক মায়াবী দৃশ্য। একটা মনকাড়া মোহ। এই মোহজাল কেউ ছিঁড়ে বের হতে পারে না। এই মায়ার টানেই আবার ফিরে আসে, আসতে হয়।

সে দিন আস্তে আস্তে রোলিং বেড়েই চলেছে, সাথে বাড়ছে বাতাসের একটানা শো শো গর্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে এমনি চলছে। স্টিয়ারিং করতে এসে ব্রিজে কেউ টিকতে পারছে না। এক এক করে তিন জন আউট। টিকবে কি করে? ওরা কেও ব্রিজে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রতিটা ঢেউ এসে যখন জাহাজের গায়ে আছড়ে পরছে তখনই সমস্ত জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ আর এ ভাবে চলা যায়? চার্টে দেখছি আমরা উপসাগরের পূর্ব পাড়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে কিনারা। পিছনে দুবাই এবং ডান পাশে ওমানের সীমা রেখা। সামনেই লিটল কুইন এবং লার্জ কুইন নামে ওমানের সীমানার ভিতরে সাগরের মাঝে প্রায় মাইল দুয়েক জুড়ে মাত্র মাইল খানিক দূরত্বে দুটি পাহাড় সারি অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আবহাওয়া যখন ভাল থাকে তখন আমরা একটু মজা করার জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করি। তবে এই মাইল দুয়েক পথে খুব সাবধানে স্টিয়ারিং করতে হয় কারণ পাহাড়ের চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে ওখান দিয়ে যাতায়াতে জাহাজের কম্পাস কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বলে জাহাজের কোর্স ঠিক রাখা বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি খুব ভাল স্টিয়ারিং না করলে পাহাড়ের গায়ে যে কোন সময় ধাক্কা লেগে যেতে পারে। আর তেমন কিছু হলে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আজ এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারো তেমন মানসিকতা নেই। সবাই রোলিং এর দাপটে অস্থির। বমি করতে করতে

অসার। এই মধ্য সাগরে তো আর জাহাজ এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না তাই যে কোন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। ইচ্ছে করলেই পাড়ে এসে লগি গেড়ে বেঁধে রাখার উপায় নেই। সন্ধ্যার একটু আগে আমাদের ক্যাপ্টেন ডেভিড ল্যাম্ব ব্রিজে এসে বলল কাসাব বে আর কত দূর? চার্ট দেখে হিসেব করে বললাম ওই ত লিটল কুইন তার পরেই কাসাব বে, তা এখান থেকে চল্লিশ নটিকাল মাইল হবে। যেতে হয়ত চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। লিটল কুইন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে কাসাব বে হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় চারদিকে ওমানের জন বসতি হীন মাইলের পর মাইল ধু ধু রুক্ষ পাথুরি পাহাড়ি এলাকা। শুধু সাগরের দিকে একটু খানি খোলা এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক এলাকা জুড়ে ত্রিশ মিটার গভীরতা নিয়ে একটা আশ্রয় নেওয়ার মত জায়গা। সামুদ্রিক চার্টে দেখান আছে। আমরা এর আগেও এখানে বেশ অনেকবার এসে নোঙ্গর করে থেকেছি। ক্যাপ্টেন চারদিকে দেখে বলল তাহলে ওখানে ঢুকে নোঙ্গর করে থাকি, দেখি আবহাওয়া একটু শান্ত হলে পরে যাওয়া যাবে। বললাম তাই ভাল হয়। সাথে সাথে আমাদের বাহরাইনের কোম্পানির অফিসে কন্ট্রোল রুমের সাথে রেডিওতে যোগা যোগ করে জানিয়া দিলাম।

রাত প্রায় এগারটা নাগাদ আমরা কাসাব বের ভিতরে ঢুকে নোঙ্গর করলাম। এই এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যারা রোলিং শুরু হবার পর থেকে এতক্ষণ না খেয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে সবাই গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) গিয়ে যে যা পাচ্ছে তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলো। সে রাতে আর তেমন কিছু করায় কারো মন ছিল না। কেবল মাত্র ব্রিজ ওয়াচে দুই জন ডিউটি করছিল আর বাকী সবাই যার যার বিছানায়।
পর দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আবহাওয়ার তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে মনে কটু খুশি হলাম যাক আজও হয়ত এখানেই থাকা যাবে। এখানে থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বড়শী দিয়ে প্রচুর মাছ ধরা যায়। আর জায়গাটাও চমৎকার। চারদিকে বেশ উঁচু নিচু নানা সাইজের পাহাড়। কোথাও খাড়া হয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে আবার কোথাও ঢালু বালুকা বেলার মত মাঝে মাঝে কিছু কিছু ছোট বড় নানা আকারের পাথরের টুকরো দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে এমন মনে হতো। কোথাও কোথাও আবার এমন যে আকাশের মেঘেরা উড়ে এসে প্রায়ই এই সব কোন পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখতে দারুণ লাগে। এখানে এসে যখন থাকি তখন আমাদের জাহাজে রাবারের একটা ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি বোট আছে ওটায় পাম্প করে ফুলিয়ে প্রায়ই কয়েক জন মিলে জাহাজ ছেড়ে ওই সব কিনারায় চলে যেতাম। অহেতুক নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করতাম। এখান থেকে উত্তরে এবং পশ্চিমে সাগর বা পিছনের পাহাড়ি তেপান্তর কেমন দেখায়। মনে হতো যেন মৌন পাহাড় গুলি আমাদের সাথে কত দিনের না বলা সঞ্চিত কথা বলে মনের আকুতি মেটাতে চাইছে। আমরাও নানা দেশের কয়েক জন পাহাড়ের সাথে চীৎকার করে নিজ ভাষায় কথা বলতাম। আবার কখন সাথে করে রঙের টিন আর ব্রাশ নিয়ে পাথরের গায়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। আজও হয়ত যারা ওখানে যায় তারা আমাদের নাম দেখতে পায়। মাইক, হ্যারি, কার্লো, অসীম, মহসিন, তিরু, গোল্ডি এমন আরও অনেক যা আজ এত দিনে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে।
সে দিন সকালে নাশতা করে বসে আছি এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে বলল

“দেখছ এখন ওয়েদার চেঞ্জ হয়নি, আজ আর যাব না গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বলে দাও তারপরে চল মাছ ধরি”।
ক্যাপ্টেন নিজে এ কথা বললে আর ঠেকায় কে? যেই বলা সেই কাজ। সাথে সাথে ব্রিজে যে ডিউটি করছিল ওকে সু সংবাদটা দিয়ে বলে এলাম তুমি গ্রে বাহরাইনকে কল দিয়ে বলে দাও খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা আজ এখান থেকে বের হতে পারছি না। সাথে সাথেই হ্যারি রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকা শুরু করল ‘গ্রে বাহরাইন গ্রে বাহরাইন দিস ইজ কুইন অফ গালফ কলিং’। ওপাশ থেকে জবাব এলো
‘ইয়েস কুইন ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার’।
হাই স্টেনলি গুড মর্নিং, ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার উই আর নট সেইলিং ফ্রম কাসাব বে টু ডে।
ওকে কুইন
এবার ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ওভার এন্ড আউট বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল আর আমি নিচে নেমে এসে মার্কিকে বললাম
চল আজ একটা নতুন এক্সপেরিয়ান্স নেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন আবার কি, এখানে যা করার তা সব ইতো করা হয়ে গেছে!
না, আজ ডাইভিং করব। দেখছ না আজ পাহাড়ের কত কাছে নোঙ্গর করা হয়েছে। এত কাছে কি সাধারণত: নোঙ্গর করে?এই সুযোগ কি বারবার আসে?
ইয়া, ডাইভিং! বল কি?
হ্যাঁ তুমি যাবে না কি অন্য কাওকে বলব?
এদিকে আমাদের জাহাজে ডাইভিং সেট আছে মাত্র দুটা কাজেই এক সাথে দুই জনের বেশি যেতে পারব না।
না না আমি যাব। কখন নামবে?
যদি যাও তাহলে এখনি।
বেশ, চল। ডিঙ্গি রেডি করে ডাইভিং সেট রেডি করতে করতে আরও কয়েক জনের নজরে এলো যে আমরা আজ এখানে ডাইভ দিচ্ছি।
সবার এক কথা আমাকে বললে না কেন?
আরে এইতো বললাম। আমরা ফিরে আসি তোমরা এক এক করে সবাই যেও। কাওকে তো উপরে থাকতেই হবে। তোমরা আমাদের দেখবে ফিরে এসে আমরা তোমাদের দেখব, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
বেশ। আমি আর মার্কি ডাইভিং স্যুট পরে ক্রেন দিয়ে নিচে ডিঙ্গি নামিয়ে দিলাম।

এখানে পানির গভীরতা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিটার হলে কি হবে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একেবারে সমুদ্রের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্বচ্ছ কাচের মত পরিষ্কার টলটলে পানি। কত রকমের কত কি পানির তলে দেখা যায় তা কাছে থেকে দেখার লোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। আজ তা হতে যাচ্ছে বলে মনে এক ধরনের চমক বোধ করছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ডিঙ্গিতে নেমে এলাম। দুই জনের কোমরে রশি বেঁধে রশির এক প্রান্ত ধরে উপরে পাহারায় থাকবে দুই জন। ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রথা অনুযায়ী রশির টানের মানে নিয়ে একটু আলাপ করে নিয়েছি।

ডিঙ্গিতে নেমে পিঠের অক্সিজেনের টিউব, পায়ের ফিনস, হাতের গ্লোভস, ডাইভার্স নাইফ, পানি রোধক চশমা সব কিছু ঠিক আছে কি না দেখে ডিঙ্গির পাশে বসে পিছনে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেলাম। নিচে সাগর তলে এগিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর নিচে নামছি। কত রকমের মাছ আশেপাশে দিয়ে আসছে যাচ্ছে। কেউ একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। এরা আবার কারা এলো আমাদের এই স্বর্গ রাজ্যে? এমন একটা ভাব। একটু কাছে এসে ভাল করে দেখে সুড়ুত করে দিক বদলে চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে এসেছি। এবার আর সাঁতার নয় হাঁটছি। পানিতে সাঁতরানো যত সহজ হাঁটা ততটাই কঠিন। হাঁটছি আর দেখছি। ফিনস পরা পায়ের নীচে পাথুরি তল বলে হাঁটা যাচ্ছে না লাফিয়ে সাঁতারের মত করে এগুচ্ছি। ভয় ভয় লাগছে কিন্তু দুর্বার কৌতূহলের কাছে এই ভয় কিছুই নয়।

কত রকমের প্রবাল, মাছ, নানা রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী এর কিছুই আগে দেখিনি। একটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে প্রায় মানুষের সমান উঁচু। প্রবাল ঝোপ হবে নিশ্চয়! মার্কিকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলাম চিনেছ? ও তেমনি হাত নেড়ে নিষেধ করল। কি এটা? দেখতে হবে। কাছে গেলাম। নিচে থেকে ঝাঁক ঝাঁক ছোট ছোট স্বাধীন মাছ বের হয়ে গেল। আরও কত কি মাটি ঘেঁষে বসে ছিল তারা সবাই সুড়ুত সুড়ুত করে এদিক ওদিক চলে গেল। অবাক হয়ে দেখছি। কত রকমের রঙ্গিন মাছ। অদ্ভুত সব কারুকাজ তাদের গায়ে। লাল, কাল, ধবধবে সাদা, লাল কাল ডোরা কাটা, হলুদের মাঝে সাদা বা কালো ডোরা। কত যে রঙের বাহার তা আমাদের দেশের কাঁটাবনের একুরিয়ামের মাছের বাজারেও নেই। বিশাল ফিনস, গায়ের চেয়ে ফিনস বড়, বিশাল। কাকচি মাছের চেয়েও ছোট এক রকম মাছের ঝাঁক। সবাই মনের আনন্দে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে হাঙ্গর বা ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এমন কেউ নেই তাই এরা এত স্বাধীন। এক রকম ছোট্ট মাছ দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে যাদের শরীরের এ পাশ থেকে ও পাশ ভেদ করে পানি দেখা যাচ্ছে, কোন রঙ নেই। গায়ের ভিতরে শুধু লাল কিছু রক্তের সরু অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাগর তলের বিছানায় কত রকমের স্টার ফিস সহ আরও কত নাম না জানা প্রাণী নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আমাদের সারা পেয়ে ঝট পট এদিক ওদিক নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল।

একটা প্রবাল ধরে তুলে দেখলাম আমদের কক্সবাজারের দোকানে যেমন দেখা যায় তেমন নয় মোটেই। বিশ্রী শেওলা জড়ান। পানির হালকা স্রোতে শেওলা গুলি একটা ছন্দ তুলে দুলছে। নানা রকম নানা রঙের লতা পাতা স্রোতে দুলছে। এ যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপনগর। পানির নিচে এত সুন্দর সে তো শুধু এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি কিন্তু আজ নিজে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। অথচ নিজের চোখকে কি করেইবা অবিশ্বাস করি? আস্তে আস্তে কিনারার দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের নিচে যেতে চাইছি এমন সময় মার্কির পায়ের ছোঁয়া লেগে ঝোপের বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেল। পিছনে ঘুরে উঠিয়ে হাতে নিলাম। আরে এত প্রবাল! প্রবালের এত বড় ঝোপ? সারি সারি অনেক। হাতে নিয়ে শেওলা সরিয়ে দেখি এগুলি সাদা নয় ভিন্ন রঙ, একটু লালচে ধরনের। দেখতে দেখতে নানা ঝোপঝাড় পার হয়ে একটু দূরে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার মনে হচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম। মার্কি ইশারা করল। কি হয়েছে? ওকে ওই অন্ধকার দেখিয়ে বোঝালাম। ইশারায় বলল ওটা পাহাড়ের নিচের দিক।
তাই নাকি?

আরও একটু ভয় ভয় নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। দুই জনের কোমরে দুইটা আলাদা রশি বাধা। রশির আরেক মাথা ধরে জাহাজের ডেকে দুই জনে সজাগ রয়েছে কোন রকম একটু সিগন্যাল পেলেই টেনে জাহাজের দিকে নিয়ে যাবে। আবার এদিকে দুই জনের সাথে আলাদা যে রশি দুই জনকে বেধে রেখেছে যেন দুই জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। স্রোত বা অন্য কোন উপায়ে বিচ্ছিন্ন না হতে পারে। এগিয়ে যাচ্ছি আর এই রূপনগরের রূপ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। মাটির পৃথিবী এবং সাগর তলের পৃথিবীর মধ্যে যে কত তফাত তা আজ এখানে না এলে কোন দিন জানা হত না। পানির নিচেও বাগান, বন জঙ্গল, নানা জাতের নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। অবশ্য সব প্রাণী যে নিরীহ বা হিংস্র নয় তা আমরা জানি। এখানেও ভয়ঙ্কর, হিংস্র বা বিষাক্ত বিভিন্ন প্রাণীও বাস করে। এ নিয়ে তেমন আনন্দিত বা দু;খিত হবার কিছু নেই।

পাহাড়ের যতই কাছে যাচ্ছি ততই কেমন যেন গা ছম ছম করা একটা ভাব হচ্ছিল। ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল, কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। বারবার হাতের ডাইভিং নাইফ এবং রশির অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা পরখ করছিলাম। কিছু হলেই যাতে জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারি নিজেকে সেই ভাবেই রেডি রাখছিলাম। যদিও জানি হাতে যে ছুড়ি আছে ওটা দিয়ে হাঙ্গর বা তেমন কোন সামুদ্রিক হিংস্র মহাশয়কে কাবু করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও হাতে রাখা। তবে মার্কি কি ভয় পাচ্ছিল না কি স্বাভাবিক ছিল তা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমি বুদ্ধি করে ওর পিছনেই থাকছি। এর মধ্যে জাহাজের তলা থেকে প্রায় দুইশত মিটার চলে এসেছি। আসার সময় জাহাজের নোঙ্গর দেখেছি। একটা শেওলা জড়ান বিশাল পাথরের ফাকে আটকে আছে।

এগিয়ে যাচ্ছি আর এই নতুন দেখা রূপনগরের রূপের শোভা দেখছি। এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণ আর কি দেখেছি? এখানে আরও সুন্দর। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি মাটির উপরে এমন কোন সাজানো বাগান নেই যা এখানকার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বাগানের মালী কোথায়? পানির উপর থেকে সূর্যের আলো এসে যেন সমস্ত বাগান আলোকিত করে রেখেছে। এখানেই এত সুন্দর তাহলে লিটল কুইন এবং লার্জ কুইনের নিচে বা বন্দর আব্বাসের পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে যেখানে পাহাড় সাম্রাজ্য বিস্তার শেষ করে সাগরে মিশেছে সেখানে কেমন হবে? ভাবনার সাগরে ডুবে আবার কোথায় হারিয়ে গেলাম জানি না। হঠাৎ মার্কির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেলাম। অক্সিজেনের মিটারের দিকে চেয়ে দেখি প্রেশার যথেষ্ট আছে। মার্কি দাঁড়িয়ে পরেছে। কি ব্যাপার? ও তখন সামনে একটু বাম দিকে দেখিয়ে দিল। দেখে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল শ্বাস নিতে ভুলে গেছি। বিশাল একটা কি যেন আশেপাশের সব কিছু নিতান্ত তাচ্ছিল্য ভরে মুখ হা করে এগিয়ে আসছে আর তার চার দিকে নানা আকৃতির নানা প্রজাতির মাছ ঘুর ঘুর করছে। কেউ কেউ আবার ওটার গায়ে জমা শেওলা ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। ওটা হাঙ্গর নয় চিনতে পেরেছি কারণ হাঙ্গর হলে এই এত গুলি মাছ ওর কাছে থাকার সাহস পেত না। প্রাণীটা যে হিংস্র নয় তা তার চলা ফেরা এবং তার সঙ্গীদের দেখেই বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে ওটা নিজেও আসে পাশের গাছ পালা, লতাপাতা মুখে দিয়ে এবং পাথর আর প্রবাল থেকে একটু আধটু শেওলা চেখে দেখার ভাব করছিল। ওটার আকার প্রায় পাঁচ ছয় মিটার ব্যাসের একটা গোলাকার চাকতির মত, পিছনে প্রায় তিন মিটার লম্বা চিকন লেজ, সামনের অর্ধেকটাই প্রায় মুখ আর পিঠে উপরে ত্রিকোণাকৃতির আইর মাছের মত একটা প্রায় দুই মিটার উচ্চতার কাটা,

মুখের দুই পাশে চার পাঁচটা কুলার আকারের ফিনস। সারা গায়ে সবুজ শেওলা জমে রয়েছে আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। দেখে ভয়ংকর দর্শন মনে হলেও মোটেও হিংস্র মনে হচ্ছে না। তবুও অচেনা মহাজন বলে মন থেকে ভয় দূর করতে পারছি না। কি করব?মার্কি ইশারা করে বোঝাল এখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, কোন নড়াচড়া করবে না। এমন বিকট এবং ভীষণ দর্শনের কোন প্রাণী দেখাতো দূরের কথা কোন দিন ছবিও দেখিনি। যাক, আমরা দুই জনেই চুপ করে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মাত্র অক্সিজেনের বোতল থেকে শ্বাস নেয়ার পর বুদ বুদ বের হচ্ছে অথচ রূপনগরের মহাজন সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আস্তে আস্তে আমাদের কয়েক মিটার সামনে দিয়ে যেমন গতিতে আসছিল তেমনি গজেন্দ্র গতিতে তার হেলাফেলা ভাব নিয়ে চলে গেল । সামনে দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলাম উনার চোখ মাত্র একটা। মুখের সামনের দিকে একটু উপরে এবং গোলাকার পাতা সহ। মানে উনি চোখ বুজে ঘুমাতে পারেন।

আমাদের ছেড়ে কিছু দূর যাবার পরেই মার্কির হাতে চিমটি দিয়ে ইশারা করে হাতের ঘড়ি দেখালাম আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে। চল যথেষ্ট হয়েছে, আর না। রশিতে টান দিয়ে জাহাজে সংকেত পাঠিয়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যাবার জন্য উপরে ভেসে উঠলাম। আর আমাদের দেখা মাত্র জাহাজ থেকে যারা আমাদের পাহারায় ছিল ওরা রশি টেনে আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ওই রূপ নগরের কথা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও মনে হয় এইতো সেদিন দেখে এসেছি।

সাগর সেচা প্রাণ

গত কালের দেয়া সেইলিং অর্ডার অনুযায়ী আজ বিকেলে মাস্কাটে তেল আনলোড করে হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে জাহাজে খাবার পানি এবং টুকিটাকি যা কিছু প্রয়োজন ছিল তা নেয়া হয়েছে। ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ফুল লোডিং চলছে, বাকিটা চলতি পথেই দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে নেয়া হয়ে যাবে। সাগরের অবস্থা বেশ শান্ত। কোন অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নেই। কাস্টম, ওমান ইমিগ্রেশন এবং মাস্কাট পোর্ট কন্ট্রোলের ছাড় পত্র নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে প্রায় সাড়ে ছয়টায় জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছি। হারবার এলাকা থেকে বেড় হয়ে আরব্য উপসাগর দিয়ে ফুল এহেডে চলছে। একটু পরে ন্যাভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। সামনে আশে পাশে দুই একটা জাহাজ আসছে যাচ্ছে তাদের ন্যাভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে। রাডারে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ আবার আরও কিছু উত্তর দিয়ে আরবসাগরের দিকে যাচ্ছে।

ব্রিজের পিছন দিকে চার্ট টেবিলের পাশে ইলেকট্রিক কেটলিতে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে স্টিয়ারিং করছিল ডেভিড ওকে এক কাপ দিয়ে আমার চিরাচরিত অভ্যাস মত ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের উপরে বসে রাতের নীলসাগরের বুকে খোলা আকাশের নীচে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলছি। এই অভ্যাস একদিনের নয়। যত দিন থেকে নাবিক জীবন চলছে বলতে গেলে সেই থেকে এক ভাবে চলছে।এক কাপ কাল কফি না হলে যেন ব্রিজে ডিউটি করা যায় না!

রাত বারোটায় চীফ অফিসার লুইস এর ডিউটি। নিয়ম অনুযায়ী ঠিক পাঁচ মিনিট আগে লুইস ব্রিজে এলো। ওকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের ঘরে। এর পরে আবার সকাল আটটা থেকে ডিউটি।সকালের ডিউটিও নিয়ম মত দুপুর বারোটায় শেষ করে কেবিনে ফিরে এসেছি। গোসল করে দুপুরের লাঞ্চ করে একটু গড়িয়ে নেবার ইচ্ছে হলো। আরব দেশের জুন মাসের এই প্রচন্ড গরমে আমাদের দেশের আম কাঁঠাল পাকার গরমের কথা মনে এলো। কিন্তু মনে এলেই কি আর গাছের আম পেড়ে খাওয়া যায়? মনে মনে ভাবতে ভাবতে এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শুয়ে পরেছিলাম, কখন যেন একটু ঝিমানি ভাব এসেছিল। স্বপ্নে দেখছিলাম গ্রামের বাড়িতে আম বাগানের ছায়ায় বসে আছি আর ছোট ভাই বোনেরা আধাপাকা আম পেড়ে এনে দিচ্ছে। মুখে দিতে যাব এমন সময় কাছেই কার চিৎকারের শব্দ কানে এলো। চিৎকার শুনে চাচাত বোন নীলাকে কার কি হলো দেখতে বললাম।হাতের আম হাতেই ধরা রয়েছে এখনও মুখে দেইনি। সঙ্গে সঙ্গে নীলা চ্যাঁচিয়ে বলল দাদা পারুল গাছ থেকে পরে গেছে! কি? বলার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে দেখি জাহাজের কেবিনে শুয়ে আছি। এটা নিজের গ্রামের বাড়ির আম বাগান নয় আরব্য উপসাগরের উপর দিয়ে আমার জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সেই কবে দেশ ছেড়ে এসেছি আবার কবেই যে যাব?মনটা খারাপ হয়ে গেল।একটু শুয়ে রইলাম। হঠাৎ করে কেন যেন মুখে কোথা থেকে এক রাশ থু থু জমে গেল।ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কিন্তু মুখে থু থু নিয়েই শুয়ে থাকি কি করে? তাই বাধ্য হয়েই উঠে পোর্ট হোল (জাহাজের কেবিনের এক রকম গোল জানালা) খুলে মাথাটা বের করে থু থু ফেলছি হঠাৎ জাহাজের পিছন দিকে চোখ যেতেই নীল সাগরের বুকে কি যেন কাল একটা ফুট বলের মত দেখলাম। একটু চমকে উঠলাম! কি ব্যাপার, এখানে এটা কি? গতকাল মাস্কাট বন্দর ছেড়ে আসার পর প্রায় দুই শত নটিক্যাল মাইল চলে এসেছি এখানে এই সাগরের মাঝে এটা
কি?একটু অস্বাভাবিক মনে হলো। নিতান্ত কৌতূহল নিয়ে দেখার জন্য কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে জাহাজের পিছনে

এসে দেখি কে একজন মানুষ। নিশ্চয় কেউ পরে গেছে! কে পড়েছে?জাহাজ প্রায় বার নটিক্যাল মাইল বেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে দুই শত মাইলের মধ্যে কোন কূল কিনারা নেই।
জাহাজ থেকে মানুষ পরে গেলে যার নজরে আসে তাকে “ম্যান ওভার বোর্ড” বলে চিৎকার করতে হয়, এটাই নিয়ম। সেই অনুযায়ী চিৎকার করছি কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আতঙ্কে ভয়ে আমি দিশাহারা। কি করব? কি করব?দৌড়ে ব্রিজে চলে গেলাম। আমার ওই উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা দেখে ব্রিজে যারা ছিল তারা জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে?কথা বলছ না কেন?আমি কিছুই বলতে পারছি না, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে তা ভুলিনি। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম টেনে জাহাজের গতি থামিয়ে দিলাম এবং উইলিয়াম স্টিয়ারিং করছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের হাতে স্টিয়ারিং নিয়ে জাহাজটা সম্পূর্ণ ডানদিকে ঘুড়িয়ে দিয়ে ওকে টেনে ব্রিজের বাইরে এনে হাতের ইশারায় পিছনে যে মাথাটা দেখেছিলাম সেটা দেখিয়ে দিলাম। পিছনে সেকেন্ড অফিসার ম্যাক্স এসে দাঁড়িয়েছে।ম্যাক্স জিজ্ঞেস করল “হু ইজ দ্যাট”? বললাম চিনতে পারিনি।

লোকটা এতক্ষণে বেশ পিছনে পরে গেছে। শান্ত সাগর বলে এখনও দেখা যাচ্ছে। একটু অশান্ত হলে আর দেখা যেত না।এবার উইলিয়াম এবং ম্যাক্সকে নিয়ে ব্রিজ থেকে নেমে মেইন ডেকে এলাম। এই খোলা সাগরে মাঝপথে হঠাৎ জাহাজ থেমে গেল কেন জানার জন্য প্রায় সবাই বাইরে চলে এসেছে। সবার মুখে প্রশ্নের ছায়া, কি হয়েছে? গত পরশু সকালে মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে ছিলাম তখন আমাদের রাবারের ডিঙ্গি বোট নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য পাশে নোঙ্গর করা ‘প্যাসিকফিক ম্যারিনার’ গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সেই ডিঙ্গি ক্রেন দিয়ে তুলে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাতে পেট্রোল সহ সব কিছুই রেডি ছিল।
এর মধ্যে জাহাজ ঘুরে থেমে গেছে। ওরা সহ ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গিটা নামিয়ে আমি, ম্যাক্স আর উইলি এই তিন জন ডিঙ্গিতে নেমে এক টানে ডিঙ্গির ইঞ্জিন স্টার্ট করে ফুল স্পিডে এগিয়ে গেলাম। প্রায় সমুদ্র সমতলে নেমে এসেছি বলে আর ওই মাথা দেখা যাচ্ছে না। জাহাজের উপরে পিছন দিকের কোয়র্টার ডেকে যারা ছিল ওরা দেখিয়ে দিল ওই দিকে যাও।

এগিয়ে গেলাম। অল্প একটু পরেই ওই লোককে দেখা গেল।তাড়াতাড়ি আরও তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দ্রুত গতিতে শ্বাস বইছে, বুক ঢিব ঢিব করছে, জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না, সবাই চিন্তিত।ডিঙ্গির হ্যান্ডলের থ্রটল ঘুড়িয়ে স্পীড বাড়াতে চাচ্ছি কিন্তু এর চেয়ে বেশি স্পীড নেই। কাছে চলে এসেছি। এইতো আর একটু। আর একটু। হ্যাঁ আরও কাছে চলে এসেছি প্রায় ধরা যায়। ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই এতক্ষণে চিনতে পারলাম। আমাদের জাহাজের টোপাস (ক্লিনার) ভারতের বিহার এলাকার অর্জুন।

যাক, সাঁতার জানত বলে এই এতক্ষণ ভেসে থাকতে পেরেছে। আমি হলে কি করতাম? আমি তো সাঁতার জানি না! এ কথা মনে হতেই আর এক দফা আতঙ্ক এসে ভর করল। তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে ডিঙ্গির স্পীড কমিয়ে আস্তে আস্তে কাছে এসে ওকে ধরা মাত্রই হাত পা ছেড়ে দিয়ে একেবারে সেন্স লেস। সমস্ত শরীর নোনা পানিতে ঠান্ডা বরফের মত হয়ে গেছে। সবাই মিলে টেনে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম। এবার ডিঙ্গি ঘুড়িয়ে জাহাজে ফিরে এসে অর্জুনকে ওই ডিঙ্গিতে রেখেই ডিঙ্গি সহ আমাদের সবাইকে ক্রেন দিয়ে তুলে নিল। জাহাজে উঠে দেখি ক্যাপ্টেন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার, চীফ অফিসার সহ সবাই ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ক্যাপ্টেন বলল ওর কাপড় বদলে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা রুমে নিয়ে গরম কম্বল গায়ে দিয়ে দাও আমি আসছি। একটু পরে ক্যাপ্টেন এসে হিটার চালাতে বলল। রুমটা গরম হবার পর অর্জুন একটু মিট মিট করে তাকাল। পাশে থাকা সবাই যেন হাতে চাঁদ পেলাম।কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোন কথা নেই। যেমন ছিল আবার তেমনি আসার দেহে পরে রইল। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে আবার মিট মিট করে তাকাল। বির বির করে প্রথম কথাটা বলল- ম্যায় মার গিয়া কিয়া (আমি কি মরে গেছি)?আরে না অর্জুন তুমি মরনি। এইতো আমরা সবাই তোমার পাশে। তুম লোগ কিয়া অবতার হ্যাঁয়? না না, আমরা সবাই তোমার কলিগ। এবার নরে চরে উঠে বসল। ওকে উঠতে দেখে গ্যালি (কিচেন) থেকে ব্রান্ডি মেশানো গরম কাল কফি এনে দিলাম। তবুও ও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে ও এখনো এই ধরণীর বুকে বেঁচে আছে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মত আস্তে আস্তে ওকে বোঝাতে চাইলাম যে তুমি জাহাজ থেকে পরে যাবার পরই আমরা দেখতে পেয়ে সাথে সাথে ডিঙ্গি নিয়ে তোমাকে তুলে এনেছি, তুমি মরনি। সাগর সেচে আমরা তোমার প্রাণ ফিরে পেয়েছি। অর্জুন কাঁদবে না হাসবে না কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সবার মুখের দিকে দেখছে। এবার ওর মুখে কফির কাপটা তুলে বললাম একটু একটু খেয়ে নাও।

উত্তাল সাগরে দুরন্ত ঢেউ

১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আমার সপ্তম ভয়েজে যাত্রার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে দুবাই তারপর দুবাই থেকে গালফ এয়ারে বাহরাইন এসে পৌঁছলাম। ব্রিটিশ পতাকা বাহি ট্যাংকার জাহাজ ইলেক্ট্রা কুয়েত থেকে লোড করে শারজাহ যাবার পথে আমাকে বাহরাইন থেকে নিয়ে যাবে এবং সেকেন্ড অফিসার জাকিরকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। জাকির সাইন অফ করে দেশে যাবে, ওর জায়গায় আমি এসেছি। জাহাজ আসতে আরও দুই বা তিন দিন দেরি হবে এ কয় দিন কোম্পানির খরচে বাহরাইনের মানামায় একটা হোটেলে থাকি, খাই দাই ঘুরি ফিরি আর কোন কাজ নেই।
দুই দিন পর রাতে বাইরে থেকে হোটেলে ফিরে এলে রিসিপসনস্ট জানাল যে তোমার অফিস থেকে ফোন করে বলেছে তুমি আগামী কাল সকাল আটটায় রেডি হয়ে থাকবে এজেন্ট এসে জাহাজে নিয়ে যাবে। বেশ, পর দিন সকালে উঠে যথারীতি রেডি হয়ে রইলাম। একটু পরেই এজেন্ট এসে তার গাড়িতে করে নিয়ে গেল। পোর্টে ঢুকে ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি সেরে জাহাজে উঠে পরলাম জাকির সাইন অফ করে নেমে গেল। আগেই জানতাম এই জাহাজে আমার কয়েক জন বন্ধু আছে। আমি ওঠার পরে পরেই জাহাজ ছেড়ে দিল। আমার ডিউটি দুপুর বারোটা থেকে। চীফ অফিসার সুধাংশু’দা আমার কেবিন দেখিয়ে দিল, উনার কাছেই জাহাজের মাপ জোক স্বভাব চরিত্র জেনে নিলাম এটার ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১৫,০০০ টন, গ্রস টনেজ প্রায় ৭,০০০ টন, ঘণ্টায় বার নটের বেশি ক্রুজ করতে পারে না এবং এরাবিয়ান গালফের মধ্যে ক্রুড ওয়েল বাদে নানা গ্রেডের তেল নিয়ে এর চলাচল সীমিত।

দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছিল। এখান থেকে ওখানে। রাতের ন্যাভিগেশনের সময় ব্রিজের রেডিওতে কাছাকাছি যে সব জাহাজে অন্যান্য বন্ধুরা আছে তাদের সাথে ইয়ার্কি ফাজলামি, গল্প গুজবের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে নভেম্বরের শেষ দিকের কোন এক সময়ে ইরানের আবাদান রিফাইনারি থেকে Jet A1 বা জেট কেরাসিন এনে আবুধাবির এডনক কোম্পানির অফ শোর বয়াতে মুরিং করে ডিসচার্জ করা হয়ে গেছে। পাইপ লাইন ডিস কানেক্ট করে পাইপের মুখ বন্ধ করে সাগরে ছেড়ে দিয়েছি।
খালি ট্যাংকার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে যাত্রা সম্ভব নয় বলে সি ভাল্ভ খুলে পাম্পিং করে পুরো জাহাজ আবার সমুদ্রের পানি দিয়ে বোঝাই হচ্ছে। এবার পানীয় জল নেবার জন্য হারবারের ভিতরে ঢুকতে হবে।

আবুধাবির এজেন্ট গ্রে আবুধাবিকে ডাকলাম,
গ্রে আবুধাবি গ্রে আবুধাবি দিস ইস ইলেক্ট্রা কলিং।
গ্রে আবুধাবি সাথে সাথেই উত্তর দিল।
ইয়েস ইলেক্ট্রা, দিস ইস গ্রে আবুধাবি, ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার।
আমাদের আনলোড হয়ে গেছে, পাইপ লাইন ছেড়ে দিয়েছি, পানির কি করেছ?
এখানে ফ্রেস ওয়াটার নেই তোমরা দুবাই চলে যাও ওখান থেকে পানি নিয়ে বাহরাইনের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে হাই স্পিড ডিজেল লোড করে মাস্কাট যাবে।

আমরা আগের ধারনা অনুযায়ী আবুধাবি থেকে বাহরাইন যাবার চার্ট রেডি করে রেখেছি, এখন আবার দুবাইর পথ বের করতে হবে আবার দুবাই থেকে বাহরাইনের পথ বের করতে হবে, ঝামেলার ব্যাপার। যথারীতি চীফ
অফিসার এবং জাহাজের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনকে জানালাম। ক্যাপ্টেন তার রুম থেকে ভিতরের সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে এসে কালচে আকাশ দেখে থমকে গেল। আমরাও যে লক্ষ করিনি তা কিন্তু নয়। ব্যারো মিটারে বাতাসের চাপ অসম্ভব কমে গেছে। নিম্ন চাপের পূর্বাভাস। আরব্য উপসাগরের স্বভাব আমাদের বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহা সাগরের মত নয়। ওখানে শীত কালে সাগর অশান্ত থাকে আবার গরমের সময় শান্ত থাকে, আমাদের উলটো। এর মধ্যে সাগরের পানি একেবারে থমথমে ভাব ধারণ করেছে, ঠিক যেন মনে হচ্ছে বড় কোন সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরের কাচের মত। যেন কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু পারে না, একে বারে সুবোধ বালক।

ক্যাপ্টেন নিজেই রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে গ্রে আবুধাবি কে ডেকে বলল তোমরা ওয়েদার রিপোর্ট নিয়েছ?
হ্যাঁ দেখেছি, ওয়েদার ভাল।
আমি দেখছি ওয়েদার খারাপ তোমরা ভাল রিপোর্ট পেলে কোথায়?
না না ওয়েদার ভাল তুমি তারা তারি সেইল কর।
ঠিক আছে আমি সেইল করছি তবে আমার মনে হচ্ছে আবার ফিরে আসতে হতে পারে।
ক্যাপ্টেন এক রকম নিরুপায় হয়ে নোঙ্গর তোলার অর্ডার দিল। পিছনের রশি খুলে নোঙ্গর তোলা হয়ে গেলে জাহাজ ঘুড়িয়ে দুবাইর উদ্দেশ্যে ফুল এহেড ইঞ্জিন চালাবার নির্দেশ দিয়ে দিলাম। কে যেন স্টিয়ারিং করছিল মনে নেই। ক্যাপ্টেন আমাকে চার্ট চেঞ্জ করার কথা বলে আর কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে নিচে চলে গেল। সুধাংশু’দা ও তার সাথে সাথে চলে গেল। বেশি না, আবুধাবি থেকে দুবাই মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ। জাহাজ চালিয়ে দিয়ে গ্রে দুবাইকে বললাম আমরা সকাল এগারোটায় পৌঁছব, আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা কর।

ওরা বলল হ্যাঁ আমরা জানি, গ্রে আবুধাবি বলেছে। তোমরা এসে দুবাই পোর্ট কন্ট্রোলের সাথে কথা বলে সরাসরি হারবারের ভিতর ঢুকে যেও। এক সময় দুবাই এসে পানি নিয়ে দুপুর দুইটায় গ্রে দুবাই এবং দুবাই পোর্ট কন্ট্রোল কে জানিয়ে জেটি ছেড়ে হারবারের বাইরে চলে এলাম। গ্রে বাহরাইনকে ডেকে আমাদের ETA জানালাম আগামী কাল সন্ধ্যা ৭টা। কোর্স ঠিক করে আবার ফুল এহেড, গন্তব্য বাহরাইনের সিতরা পোর্ট। দুবাই আসার পথেই চার্ট রেডি করে রেখেছিলাম। আকাশ তখন ওই রকম, সাগর জলও নিস্তরঙ্গ। গুমোট থমথমে ভাব। ক্যাপ্টেন আকাশের অবস্থা, ব্যারোমিটারের রিডিং দেখে ভুরু কুচকে এবার মিডল ইস্টে আমাদের প্রধান অফিস গ্রে বাহরাইনের সাথে নিজে কথা বলে যাত্রা বিরতির কথা জানাল। কিন্তু গ্রে বাহরাইনেরও সেই একই কথা, না না, যত তারা তারি সম্ভব এসে লোড নিয়ে যাও।

ঘণ্টা তিনেক এর মধ্যে ডিউ ওয়েস্ট অর্থাৎ ২৭০ ডিগ্রিতে হেডিং করে আমরা ঘণ্টায় ১২ মাইল বেগে দুবাই পিছনে ফেলে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছি। পিছনে ৩২ তলা দুবাই হিলটন হোটেল ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, দুবাই শহরের অন্যান্য দালান কোঠা আজ আর দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে সাধারণত ৩৫/৪০ মাইল পর্যন্ত দিগন্ত রেখা বেশ স্পষ্টই দেখা যায়। আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে। আমার ডিউটি শেষের পথে। আমার জায়গায় থার্ড অফিসার পর্তুগীজ কার্লো আসবে। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি কার্লোকে কি কি বুঝিয়ে দিতে হবে তার একটা তালিকা বানাচ্ছি মনে মনে। এমন সময় হঠাৎ উত্তরের দিকে দৃষ্টি গেলে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য নজরে এলো, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম সাথে একটু ভয়।

নীল সাগরের জল অনেকক্ষণ ধরেই রঙ বদলে ফেলেছে, দুবাই হারবার থেকে বের হয়েই লক্ষ্য করেছি। এখন দেখলাম সেটা কাল হয়ে গেছে, উত্তর থেকে একটা বিশাল কাল পাহার আকাশ বেয়ে রকেটের গতিতে যেন আমাদের দিকে উড়ে আসছে। আবার ঠিক সাগরের ঢেউ এর মত যেন ইরানের আস্ত কুহে তুর পাহার মাথায় সাদা মুকুট পরে শত সহস্র মাইল বেগে ধেয়ে আসছে। সাগরে এবং আকাশে দুই পাহাড় দেখে ভয় পেলাম। যদিও এই অবস্থায় ভয়ে অস্থির হলে চলবে না। শীতের বেলা একটু তারা তারি বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসছে। ন্যাভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছি। কি আসছে এমন করে?মেঘ?ঢেউ?না, মেঘের রঙ কি এমন কাল হয়?নীল সাগরের নীল জল কি এমন কাল হয়?দেখতে দেখতে কার্লো এসে পরেছে। ওকে বুঝিয়ে দিয়ে আমার চলে যাবার কথা। ওকে দেখালাম, কার্লো দেখ, কিছু বুঝতে পারছ?ওর চেহারা দেখে ওকে বিস্মিত মনে হোল, হা করে চেয়ে আছে। উভয়েই হতবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা একটু কম তাও প্রায় ২০০০ ফুটের মত হবে।

ডিউ নর্থ থেকে ওই ঢেউ আর আকাশের কাল পাহাড় এগিয়ে আসছে, আসছে একে বারে কাছে এসে পরেছে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার কাল ঢেউ আর তার পিছনে আরও ঢেউ আর ঢেউ, সবার মাথায় সাদা হিরের মুকুট জ্বল জ্বল করছে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আকাশে যে মেঘের পাহাড় ছিল সেও এই ঢেউ এর সাথে জাহাজের ডান দিকে এগুচ্ছে। এই ঢেউ জাহাজকে পাশ থেকে ধাক্কা দিলে নির্ঘাত আজ এই শেষ নিশ্বাস নেয়া। জাহাজে থাকা এত লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট কোন কাজে লাগাবার সুযোগ কেউ পাবে না। কোন ভাবেই জাহাজের পাশে এই আঘাত লাগতে দেয়া যাবে না। সামনে বিপদ দেখে মানুষ দিশা হারিয়ে আবোল তাবোল কিছু করে বসে যাতে বিপদ আরও বেশি সুযোগ পায়। এই মুহূর্তে মাথা গুলিয়ে ফেললে হবে না, কিছু একটা করতেই হবে। সমুদ্রে যাদের বসবাস তাদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলে একটা ইন্দ্রিয় থাকে যা দিয়ে বাতাসের গন্ধই বলে দেয় কি করতে হবে তা বুঝতে পারে। এই ক্রান্তি কালের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হলে বা উলটা পালটা সিদ্ধান্ত নিলে জীবন নিয়ে আর কোন দিন মাটিতে হেটে চলার উপায় থাকবে না একে বারে সলিল সমাধি বা হাঙ্গরের পেটে স্থায়ী নিবাস হয়ে যাবে। আজকের এই লেখা আর কেউ কোন দিন লিখতে পারত না।

ক্যাপ্টেন বা চীফ অফিসারকে ডাকা তো দূরের কথা যে স্টিয়ারিং করছে তাকেও কমান্ড দেবার সময় নেই। চট করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিয়ে জাহাজের হেড ঢেউ এর দিকে করে দেয়ার জন্য হার্ড স্টার বোর্ডে (ডান দিকে) টার্ন করে দিলাম। চেয়েছিলাম ৯০ ডিগ্রী টার্ন নিয়ে ঢেউ এর মুখোমুখি হতে কিন্তু এত বড় জাহাজটা ঘুরতে কিছু সময় নিবেই, সম্পূর্ণ টার্ন নেবার আগেই প্রায় ৬০ ডিগ্রী ঘুরেছে এমন সময় প্রথম ঢেউ জাহাজের মাথায় কোণা কুনি ভাবে আছড়ে পড়লো, জাহাজের মাথা ঢেউ এর সাথে উপরে উঠেই প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় ঢেউ এর ফাকে নিচে চলে গেছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রথম ঢেউ এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে, পুরো জাহাজ পানির তলে, তার সাথে প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা না কি বলি বুঝতে পারছি না, ঝড়ের বেগে এসে জাহাজ কে পোর্ট সাইডে (বাম দিকে) প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কাত করে ফেলল। ব্রিজে কেউ দাঁড়িয়ে নেই যে স্টিয়ারিং করছিল সে ছিটকে পরল পোর্ট সাইডের দরজায়, কার্লো পড়লো রাডারের উপর আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছিলাম বলে আমাকে ফেলতে পারেনি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জাহাজের ট্রিমিং ঠিক হোল কিন্তু নোনা জলের ঢেউ একের পর এক ব্রিজের ওপর দিয়ে পিছনে যাচ্ছে। কোন একটা জানালা যদি খোলা থাকত তা হলে ব্রিজের ভিতর পানি ঢুকে যেত। শীত কাল বলে সব জানালা বন্ধ ছিল। গাড়িতে যেমন সামনের কাচ মোছার ওয়াইপার থাকে জাহাজে থাকে ঘুরন্ত কাচ, ওটা এমন তীব্র গতিতে ঘুরে যে পানি বা কিছু জমার সুযোগ পায় না কিন্তু ওটা অন করবে কে?আর অন করেই বা কি হবে সম্পূর্ণ জাহাজটা পানির নিচে ডুবছে আবার ঢেউ এর সাথে একটু ক্ষণের জন্য ভেসে উঠছে। আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরে ব্যালেন্স রাখার জন্য দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছি এর মধ্যে স্টিয়ারিং হুইল হাত থেকে ছুটে গেলে কি যে হবে কে জানে কাজেই কোন অবস্থাতেই হুইল ছাড়া যাবে না। কত টুক ঘুরাতে পেরেছিলাম জানি না হুইল ইন্ডিকেটর বা কম্পাসের দিকে তাকাবার মত মানসিক ভারসাম্য নেই। তবে ঢেউ যা আসছে এখন সামনে থেকে আসছে। অন্তত পাশে থেকে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে না। ওরা কে কি করছে কিছুই দেখার মত শক্তি বা সুযোগ কিছুই নেই।

মনে হচ্ছিল যেন পুরো জাহাজ সহ ডুব সাতার দিচ্ছি। সামনে দিয়ে ঢেউ এসে ব্রিজের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কয়েকবার এমনি করে চুবানি দিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাণ্ডব লীলা কমে গেল। যা হবার এই পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। সমুদ্র তখনও গর্জাচ্ছে, জাহাজ প্রতিটি ঢেউ এর আঘাতে থর থর করে কাঁপছে। ভাগ্য ভাল আবুধাবি থেকে ফুল লোড করে পানি নিয়েছিলাম। এমনি সাধারণত বাহরাইন যাবার পথে অর্ধেক লোড নেই আজ আকাশের অবস্থা দেখে ফুল লোড করেছিলাম ওদিকে খাবার পানির ট্যাঙ্ক ও ভর্তি। জাহাজ সম্পূর্ণ বোঝাই ছিল বলে রক্ষা না হলে যে কি হতো কে জানে।
স্টিয়ারিং ওর হাতে দিয়ে দিলাম এর মধ্যে কার্লো রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে গ্রে দুবাইকে ডাকছে। আরে বুদ্ধু, কাকে ডাকছ, রেডিওতে কোন শব্দ পাচ্ছ? বলে বাইরে এলাম। সামনের মাস্তুলের উপরের অর্ধেক ভেঙ্গে কোথায় গেছে কে জানে, ব্রিজের ছাদে দেখলাম রেডিও, জিপিএস, ডেকা ন্যাভিগেটর এবং রাডার এর এরিয়েল কিছুই নেই। মনকে প্রবোধ দেবার জন্য রাডার স্ক্রিনে দেখলাম, কমলা রঙের একটা গোল চাকতি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, জিপিএস কথা বলছে না, ডেকা মিটার শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ করছে কিন্তু কোন স্টেশনের সিগন্যাল দেখাতে পারছে না।

প্রকৃতি যে এত ভয়াবহ কঠিন হতে পারে তা আমার এর আগের ছয়টি সমুদ্র যাত্রায় কখনো দেখিনি বা পুরনোদের কাছে শুনিনি। বিশাল ঢেউ হয়, সমুদ্র অশান্ত হয়ে নানা রকম দুর্যোগ ঘটায় জানতাম, কিছু দেখেছি ও কিন্তু এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে কল্পনাও করিনি। ক্যাপ্টেন বলল আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কোথায় আছি কিছু বুঝতে পারছ?চার্ট টেবিলে এসে দেখালাম সর্ব শেষ পজিশন ছিল এখানে। এর পর এখন কোথায় বুঝতে পারছি না।
আমাদের কোর্স কত ছিল?
২৭০ ডিগ্রি
ওই কোর্স রাখার চেষ্টা কর তবে অবস্থা বুঝে ঢেউ এর সাথে হেডিং রেখে যেও যেখানে যায় যাক, জাহাজ তো বাচাতে হবে। জাহাজ না বাঁচলে আমরা বাঁচব কি করে।
চাঁদ তারা দেখে সাবেক কায়দায় ন্যাভিগেশন করার উপায় নেই, আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা যন্ত্র নির্ভর হয়ে পরেছি বলে সে চর্চাও নেই। আমার ডিউটি শেষ হলেও কার্লোর সাথে কিছুক্ষণ রইলাম। বিপদ তো সবার, ৫টা দেশের ১৭ জন নাবিক। ক্যাপ্টেন বলল তুমি যাও শুয়ে পর, রাতে আবার আসতে হবে। কার্লোর
সাথে আমি থাকি। চলে এলাম। এসে কাপড় বদলে বিছানায় শুয়ে আর ঘুম আসে না। বার বার ওই জ্যান্ত বিভীষিকা কাল দুই পাহাড় শুধু তেড়ে আসছিল। ভোর চারটায় ডেকে দিল। ব্রিজে এসে দেখি সাগরের মাতলামি অনেকটা কমেছে তবে এখনো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ অশান্ত।

সুধাংশু’দাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু বুঝতে পারছেন কোথায় আছি?
না।
তা হলে কি কানার মত চালাচ্ছেন?
এ ছাড়া আর উপায় কি?
কোন জাহাজ দেখেছেন?
না।
কোর্স কত?
ওই, তখন যা ছিল তাই রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু মাঝে মাঝেই ঢেউ এর সাথে হেডিং করতে হচ্ছে।
ড্রিফট হয়েছে বলে কিছু বুঝতে পারছেন?
ড্রিফট হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না শুধু সামনে যাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন কিছু বলেছে?
কি আর বলবে, কোন জাহাজ দেখতে পেলে ডাকতে বলেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাক, কাল দিনের আলো না হলে কিছু বোঝা যাবে না। আচ্ছা আপনি যান ঘুমান দেখি আমি কত দূর নিতে পারি।
ভোর হবার একটু আগে ডান দিকে দূরে একটা সুপার ট্যাংকারের ন্যাভিগেশন লাইট দেখে বুঝলাম ওরা লোড নিয়ে এরাবিয়ান গালফ ছেড়ে ইন্ডিয়ান ওসেনের দিকে যাচ্ছে। একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। খুব বেশি হলে ওই জাহাজ আমাদের থেকে ৫ মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর যে স্পিড তাতে দৌড়ে ওকে ধরা সম্ভব নয়। কি করা যায়?রেডিও বা ওয়ারলেস কোথায় পাই, ভাবতে ভাবতে মনে হোল, লাইফ রেফটে (life raft) যে ছোট ওয়ারলেস থাকে সেটা বের করে ওকে ডাকতে হবে। তারা তারি ক্যাপ্টেনকে ডেকে দেখালাম ওই জাহাজ। বললাম আমি একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওদের ডেকে দেখি।

ক্যাপ্টেন স্টিয়ারিং করছে। আমি আর হেল্মস ম্যান দুই জনে একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওই নাম না জানা জাহাজকে ডাকলাম। ভাগ্য ভাল। ওরা আমাদের ডাক শুনে জবাব দিয়েছে। ওরা কুয়েত থেকে ক্রুড অয়েল লোড করে কোথায় যাচ্ছে। আমাদের বিপদের কথা খুলে বললাম, এমনকি আমরা কোথায় আছি তাও জানি না। ওরা আমাদের দেখেছে, ওদের রাডারে বিয়ারিং নিয়ে আমাদের পজিশন বলে দিল। আমাদের গ্রে বাহরাইনকে জানাবার অনুরোধ করলাম। বললাম বল যে তোমাদের ইলেক্ট্রা ওই পজিশনে আছে, আমাদের ইঞ্জিন সব ঠিক আছে কিন্তু কম্যুনিকেশন এবং ন্যাভিগেশন ইকুইপমেন্ট কোন টাই কাজ করছে না তাকে রেস কিউ কর। গত কাল দুবাই থেকে সেইল করার পর থেকে গ্রে বাহরাইন বা গ্রে দুবাইর সাথে যোগাযোগ না হওয়ায় ওরা চিন্তিত ছিল। এখন খবর পেয়ে গ্রে বাহরাইন জানাল যে ইলেক্ট্রাকে বলে দাও ওরা যেখানে আছে ওই খানেই যেন ভেসে থাকে আমরা গ্রে সুইফটকে পাঠাচ্ছি, গ্রে সুইফট ওদের পাইলটিং করে নিয়ে আসবে। ওরা আমাদের খবর পৌঁছে দিলে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

চার্টে ওই জাহাজের দেয়া লঙ্গিচুড/ল্যাটিচুড মিলিয়ে দেখি আমরা বাহরাইন বামে রেখে কুয়েত যাবার পথে চলে গেছি।
এবার গ্রে সুইফটের আসার অপেক্ষা। গ্রে সুইফট আমাদের সাপ্লাই বোট। ঘণ্টায় ১৮ নট স্পিডে চালিয়ে প্রায় বিকেল চারটা নাগাদ এসে আমাদের পাশে ভিড়ল।
তারপর? তারপর আর কি, গ্রে সুইফট আমাদের স্পিডের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের আগে আগে আর আমরা ওদের পিছনে ওদের ফলো করে বাহরাইন এসে পৌঁছলাম তার পর দিন সকালে। সারা পথেই সাগরের উন্মত্ততা কমে নি। কার উপর যে এই ক্রোধ কিছু বুঝলাম না। এখানে ডকে তুলে জাহাজের কীল, বটম প্লেট, প্রপেলার, রেডার সব কিছু চেক করে কিছু প্রয়োজনীয় মেরামত করে এন্টেনা লাগিয়ে আবার জলে ভাসিয়ে দিল। আমরাও আবার সমুদ্রের পরবর্তী কোন আক্রোশের পথ চেয়ে তা মোকাবিলা করে নাবিক জীবনের অ্যাডভেঞ্চার সংগ্রহের আশায় জাহাজ লোড করে আবার যাত্রা করলাম মাস্কাটের পথে।

এলেবেলে – ৩৩

আর মাত্র ২ বছর হলেই প্রবাস জীবনের দু’দশক পূর্ণ হবে, কত দ্রুত সময় চলে যায়। যে কোন কারণেই হোক এই ১৮ বছরে কম করে হলেও ১০ বার দেশে আসা হয়েছে … আসা যাওয়ার এই ব্যয় সঞ্চয়ের দিকে গেলে হয়তো অনেক বদলে যেত জীবন। যাক সে সব কথা এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই … আমি কখনো বড় লোক হতে চাইনি, এখনো না। জীবন চলে গেলেই হয়।

দেশে আসার সময় আমার একটা অভ্যাস হচ্ছে কাছের এবং এমন কি দূরের মানুষের জন্য কিছু নিয়ে আসা যাকে আমরা গিফট বলে থাকি। এই গিফট দেওয়া নিয়ে আমার কিছু মজার অভিজ্ঞতা আছে …।

আমার সেই সব কাছের বা দূরের মানুষদের একজন একবার বললেন “এসব তো এ দেশেই পাওয়া যায়।” কিন্তু আমি উনাকে কি করে বোঝাই টাকা দিলেই সব কিছু কেনা যায় না। আমার আন্তরিকতাটুকু উনাদের চোখে পড়ে না।

আবার এমন কিছু প্রোডাক্ট আছে সেই গুলো এ দেশে বিক্রী হবে না। যেমন ধরুন জাপানের SONY/TOSHIBA/HITACHI কোম্পানী জাপানে যে TV বিক্রী করে তা বাংলাদেশে করে না। গ্রামীন UNIQLO যে সব কাপড় বাংলাদেশে বাজারজাত করে তা জাপানে পাওয়া যায় না। এরপরের বার আবার উনার কাছে আমার গিফট নিয়ে গেলে উনি যে গল্পটা বললেন তা শুনে আমি থ …উনার অন্য এক আত্নীয় নাকি বলেছেন বিদেশ থেকে যে সব গিফট নিয়ে আসে, তা নাকি Burgain Sale এর সময় কেনা …। হোক না ক্ষতি কি। কিছু কিছু কথা আছে যা কখনো বলতে নেই।

এবার আসি আবার অন্য ধরনের কিছু কাছে বা দূরের মানুষের কথা। উনারা গিফটটি হাতে পাওয়ার পর জানতে চাইবেন এর দাম …। আবার আর কেউ পরীক্ষা করবেন প্রোডাক্টটি কোন দেশের তৈরী। Made in China হলে তো উনাদের কাছে এটি খুব সস্তা বলে মনে হবে ( পৃথিবীর নামী দামী ব্রান্ড গুলোর ৮০ ভাগই তৈরী হয় চীনে, আমাদের দেশের EPZ এর প্রোডাক্ট এদেশের বাজারে পাওয়া যায় না)। হয়তো এই কারণেই আমার এক ইউরোপ প্রবাসী আত্মীয় আমার মায়ের জন্য বাংলাদেশের স্থানীয় বাজার থেকে গিফট কিনে বিদেশ থেকে পাঠানো বলে চালিয়ে দিলেন কদিন আগে … কথা প্রসঙ্গে মায়ের কাছে শুনে হাতে নিয়ে প্রোডাক্টিতে বাংলাদেশী দোকানীর হাতে লেখা বিক্রয় মুল্যের কোড দেখি আর নিশ্চিত হই প্রোডাক্টটি দেশ থেকেই কেনা এবং প্রোডাক্টটি কোন দেশের তৈরী লিখা নেই শুধু ইউরোপের এক কোম্পানীর নাম ঠিকানা লেখা, জানি না কেন এই মিথ্যাচার। হয়তো বা আমরা Made in…খুঁজি বলেই !!

আমরা যখন বিদেশে কোন জিনিস কিনি তা কোন দেশের তৈরী তা দেখি না, আমরা ব্রান্ড দেখি …। আর উনারা Made in …দেখেন। বেশ কয়েক বছর আগে জাপানের SONYকোম্পানীর এক নির্বাহীর ইন্টারভিউ তে বেশ মজার কথা শুনেছিলাম। উনি যা বলেছিলেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায় “আমরা একই প্রোডাক্ট বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তৈরী করি, ইউরোপের অধিবাসীরা ডিজাইন দেখেন, মধ্য প্রাচ্যের লোকজনের এমন প্রোডাক্ট তৈরী করতে হবে তা যেন ওজনে
ভারী হয়। আবার ভারতের জন্য হলে তাতে খুব জোরে শব্দ হয় ( ভারত,বাংলাদেশ সহ আফ্রিকার অনেক দেশেই যেখানে সেখানে অনেক শব্দে গান শোনার অভ্যাস আছে)।”

তারপরও আমি প্রতিবারই কিছু না কিছু নিয়ে আসি; হাতে তুলে দেওয়ার সময় ভাবতে থাকি এবার তিনি কি বলবেন ? জাপানীদের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছি উনারা তর্ক করেন না, বক্তৃতা বা বিতর্কে জাপানীরা খুবই কাঁচা। উনারা মাঝে মাঝে কারো কথা শুনে বিতর্কে না গিয়ে বলেন “তাই”। আর এই “তাই” শুনে আমার মত বাঙ্গালীদের ধারনা হতে পারে তিনি আমার কথার সায় দিচ্ছেন বা মেনে নিছেন। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা। আমিও এখন উনাদের মত বিতর্কে না গিয়ে “তাই” বলার চেষ্টা করি, যদিও তা মাঝে মাঝে সম্ভব হয় না (হয়তো বাংলাদেশী বলেই অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি)।

জীবনের কোন অভিজ্ঞতাই ফেলনা নয়।

_____________
25 August 2014

দুই দেশে এক ঈদ

অনেক অনেক দিন আগের কথা। যখন ঢাকা শহরে দুই টাকায় একটা প্রমাণ সাইজের পদ্মার ইলিশ পাওয়া যেত এবং আমার মা সেই ইলিশের কোর্মা ও ইলিশ পোলাও রান্না করতে পারতেন। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে অতি উপাদেয় খাদ্য হিসাবে ওগুলির স্বাদ আস্বাদন করতাম। আমি তখন পত্নী হীন (দয়া করে কেউ আবার বিপত্নীক ভাববেন না) তবে সহসা আমাকে সপত্নীক করার জন্য ছন্দা নামে এক হবু ভদ্র মহিলা ওরফে আমার সবে ধন নীলমণি একমাত্র প্রিয়তমা, যিনি দেশে বাস করতেন এবং কেন যেন আমার সাথেই যুগল বাঁধার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন।

তখনকার প্রেম ভীষণ কঠিন প্রেম ছিল। অনেক কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তবেই কোন প্রেমিকার কাছ থেকে একেবারে তারাহুরো করে লেখা একটা প্রেম পত্র পাওয়া যেত। সে সময়ের প্রেম প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একটু নির্জনে আলাপ, দূর থেকে সামান্য চোখের ভাষায় বা একটু ইশারা ইঙ্গিতে তোমার আমার ভালবাসা বাসির মধ্যেই সীমিত ছিল, এবং এই ছিল অনেক। এর বেশী ভিন্ন কোন উষ্ণতার আশা করা ছিল আত্মঘাতী মূলক আচরণ। তখন মোবাইল, ফোন বা ইন্টারনেটে আলাপ করার কোন কিছুই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি বলে তারা প্রেমিক প্রেমিকাদের ভর্তসনা ছাড়া আর কিছু পেত না। রাতের আঁধারে মিটমিটে হারিকেনের আলোতে পড়ার টেবিলে নোট তৈরির ছুতায় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে প্রেমপত্র লিখে আবার সেই চিঠি লুকিয়ে পোস্ট অফিসে যেয়ে পোস্ট করে এসে মাস দুয়েক পরে উত্তর পাবে সে আশায় পথের দিকে চেয়ে থাকা ছিল আরও কঠিন। প্রতীক্ষার প্রতিটি প্রহর যেন আর শেষ হতে জানত না। দুই বা তিন মাস পর কোন রকমে উত্তর পেয়ে সহজেই কি আর তা পড়া যেত? সুযোগ খুঁজতে হত কখন এই চিঠি পড়ার শুভক্ষণ আসবে। রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরত তখন বালিশের কাছে হারিকেন বা মাটির প্রদীপ এনে সামান্য আলোতে কিংবা শেষ বিকেলে সবাই যখন নানা কাজে ব্যস্ত তখন পুকুরের পাড়ে বেতের ঝোপে মশার কামড়ের সাথে বা খড়ের পালার পাশে বসে প্রেমিকের চিঠি পড়ার আনন্দ ছিল ভিন্ন স্বাদের। বুক ঢিব ঢিব করত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলে! তবুও কি যে না বলতে পারার মত একটা ভিন্ন ধরনের স্বর্গীয় আনন্দ তা বোঝান যায় না। সে চিঠি এক বার, দুই বার তিন বার পড়েও যেন আশ মিটত না। কাছেই কারো সারা পেয়ে চিঠি লুকবার যে কি চেষ্টা তা আজকাল কেউ বুঝবেই না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার এই লেখালেখির হাতে খড়ি দিয়েছে আমার ছন্দা। তাকে লিখতে হত বিশাল উপন্যাসের মত চিঠি। যাতে কবে কি খেয়েছি, কোথায় গিয়েছি, সে দেশের সুন্দরীরা দেখতে এবং শুনতে কেমন, এ ছাড়া আর কি কি দেখেছি এবং দিনের মধ্যে কতবার তার কথা মনে হয়েছে সব ইনিয়ে বিনিয়ে না লিখলে পরের চিঠিতে তার বকুনি নির্বিবাদে হজম করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না। তখন ব্রিটিশ এয়ার এর নাম ছিল BOAC বা ব্রিটিশ ওভার সিজ এয়ারওয়েজ কর্পোরেশন। আমি তখন আয়ারল্যান্ডের তৈরি এরিনমোর নামের হলুদ রঙ টিনে ভরা অতি মহনীয় সুগন্ধযুক্ত তাম্রকূট দিয়ে বিড়ি বানিয়ে ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম। এই বিড়ি বানানোর কাজে আমার সূ দক্ষতা সারা জাহাজে সর্বজন বিদিত ছিল। সেই তখনকার কথা বলছি। আজকের কথা নয়। আমি তখনও জাহাজের ডেক ক্যাডেট। আমার এই ভয়েজের ‘ওশেনিয়া’ জাহাজ খানার মালিক ছিল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি।

একবার কুরবানির ঈদের মাস খানিক আগে সউদি আরবের রাস্তানূরাহ থেকে কাঁচা তেল (ক্রুড ওয়েল) নিয়ে স্পেনের একটি বন্দরে আনলোড করেছি। এর পর জাহাজটা গ্যাস ফ্রি করে ডকিং করার জন্য ইংল্যান্ডের প্লিমাউথে যাবার কথা। হিসাব অনুযায়ী প্লিমাউথে যাবার পর আমার রিলিভার আসবে এবং আমি দেশে ফিরে এসে সবার সাথে আনন্দে ঈদ উদযাপন করব আর এরই এক ফাঁকে ছন্দার সাথে এক পলকের দেখা আর একটু খানি হাতে হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করার ইচ্ছা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সেই এক ফাঁকে ওর জন্য কেনা জিনিষগুলি দিয়ে আসব। এমন কিছু দেয়া যাবে না যা দেখে ওকে প্রশ্নের সামনে পরতে হয়। কোথায় পেলি বা কে দিয়েছে? মনের এমন একটা আশা বুকের মধ্যে ভরে রেখেছি, দিন গুলি যাচ্ছে একেকটা বছরের মত।

স্পেনের মাদ্রিদে তেল নামিয়ে চলে আসছি আর রাস্তায় গ্যাস ফ্রি করছি। কয়েক দিনের মধ্যে জাহাজ প্লিমাউথে এসে পৌঁছেছে। শুনলাম আমার রিলিভার রহিম ভাই লন্ডনে চলে এসেছে। দেশে আসার পোটলা বোচকা বাঁধাবাঁধির ঝামেলা সেরে ফেলেছি। জাহাজ তখনও ডকে আসেনি, মাত্র আউটার এঙ্কারেজে অপেক্ষা করছে। চিফ অফিসার জানিয়ে দিল রেডি হয়ে থাকতে কাল বিকেলে তোমার রিলিভার আসছে।
জাহাজ নোঙ্গরেই ছিল।

ক্যাপ্টেন হিসাব নিকাশ করে জাহাজ থেকে আমার যা প্রাপ্য তা দিয়ে দিল সাথে আমার সিডিসিটা আর একটা প্রশংসাপত্র। আমি ডলারের পরিবর্তে কিছু ব্রিটিশ পাউন্ড চেয়ে নিলাম। ভাবলাম ব্রিটেন থেকে সাইন অফ করছি যদি কিছু কেনা কাটা করি তাহলে আবার ডলার ভাঙ্গান এক ঝামেলার ব্যাপার হবে। বিকেল চারটায় সবাইকে see you again বলে হাতে বুকে মিলিয়ে আপাত বিদায় (নাবিকেরা সাধারণত বাই বাই বলে না) নিয়ে বাক্স পেটরা ডেকে এনে রেখে ব্রিজে গেলাম। ওয়াচ ডিউটি করছিল ক্যাভেন।
কি খবর ক্যাভেন কোন খবর পেয়েছ?
জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই রেডিওতে ডাকছে
“ওশেনিয়া ওশেনিয়া দিস ইজ প্লিমাউথ কলিং’ ।
ক্যাভেন জবাব দিল
‘প্লিমাউথ বল, আমি তোমাকে পরিষ্কার শুনছি”
বাংলাদেশ থেকে তোমাদের লোক এসেছে, প্লিমাউথ পাইলট ২ তাকে নিয়ে তোমাদের দিকে যাচ্ছে ওকে রিসিভ কর। আচ্ছা প্লিমাউথ, আমরা রেডি আছি। লন্ডন আমাদের জানিয়েছে। তুমি ওদের পাঠিয়ে দাও।
হ্যাঁ হ্যাঁ ওরা আধা ঘণ্টা আগে সেইল কর চলে গেছে।
ক্যাভেনকে আবার দেখা হবে বলে নিচে এসে ডেকে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দেখি প্লিমাউথ পাইলট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওটা দেখেই ছন্দার মুখটা বুকের ভিতরে কোথায় যেন ভেসে এলো। না না না শুধু বুকে নয় এ তো দেখছি সারা আটলান্টিক জুড়েই ছন্দার মুখ! যেদিকে তাকাই শুধু ছন্দা ছন্দা আর ছন্দা! কি আশ্চর্য!

রহিম ভাই এলো। ছোট্ট করে একটু কুশল জেনে এবং জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। এজেন্টের ব্যবস্থা অনুযায়ী সে রাতে প্লিমাউথের একটা হোটেলেই থাকতে হল। পরদিন লন্ডন থেকে আমাদের এজেন্ট ফোন করল। ওপাশে হ্যারি বলছে। আগামী কাল ১৩ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় BOAC তে প্লিমাউথ থেকে এথেন্স এবং তারপরে এথেন্স থেকে তোমাদের বিমানে ডাইরেক্ট ঢাকা।

ঢাকার ল্যান্ডিং কখন?
কিছু একটা দেখে বলল
উম, সকাল ৫টা
গুড হ্যারি, তুমি জান ১৪ তারিখে আমাদের গ্রেট ফেস্টিভাল এবং আমি তাহলে আমার ফ্যামিলির সাথে সময় মত দেখা করতে পারব।
আশা করি তুমি এর আগেই ঢাকা পৌঁছে যাবে। আজ সন্ধ্যার পর তুমি টিকেট পেয়ে যাবে।
ঠিক আছে, পৌঁছালেই হল। বিকেলে একটু বের হলাম। প্লিমাউথ ব্রিটন সাইড বাস স্টেশনের কাছের মার্কেট থেকে টুকি টাকি কিছু কেনাকাটা করলাম ছোট বোন আর ছন্দার জন্য। পাশের বুটস থেকে আমার নিজের জন্য একটা সানগ্লাস কিনলাম ১৪ তারিখে বাংলাদেশে ঈদ হলে এখানে ১৩ তারিখ মানে আগামী কাল ঈদ হবার কথা। এখানে ঈদের নামাজ পাব না, কোথায় মসজিদ জানি না আর তাছাড়া এই প্লিমাউথে পরিচিত কেউ নেই। তবে শুনেছি লন্ডনের ব্রিকলেনের জামে মসজিদে সাধারণত সকাল ৮টা থেকে জামাত শুরু হয়ে ১০ টা পর্যন্ত কয়েকটা জামাত হয়। তখন ওই এলাকায় ওটাই সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখন ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদ হয়েছে, প্রায় ৫০০০ মুসুল্লি এক জামাতে নামাজ পড়তে পারে।

এখানকার জামাত ধরার কোন সুযোগ নেই। ফ্লাইটটা এখান থেকে দুপুর বা বিকেলে হলেও চেষ্টা করতে পারতাম। ওকে নো প্রবলেম! দেশে গিয়ে জামাত ধরতে পারব মনে হচ্ছে। এক ঈদ দুই জায়গায়! এমন অবাক কাণ্ড কয়জনের ভাগ্যে হয়?ঢাকায় যদি ভোর ৫টায় নামতে পারি তাহলে ইমিগ্রেশন, কাস্টম ইত্যাদি এয়ারপোর্টের ঝামেলা সেরে একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে মিরপুরে যেয়ে কাটায় কাটায় জামাত ধরতে পারব আশা করি, যদি কোথাও কোন বিভ্রাট না হয়। তবে এথেন্স থেকে বিমান যদি কোন ঝামেলা না করে শিডিউলে থাকে। অবশ্য এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার হবে কারণ বিমান লেট করবে না তাই কি হয়? অন্তত এর আগের ফ্লাইটগুলিতে যা দেখেছি।

এজেন্টের গাড়ি এসে সকালে সাড়ে চারটায় প্লিমাউথ সিটি এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল। তখন সিকিউরিটির এত ঝামেলা ছিল না। চেক ইন, ইমিগ্রেশন এসব সেরে সময়মত প্লেনে উঠে বসলাম। একটু পরেই সীট বেল্ট বাঁধা, আস্তে আস্তে প্লেনের রান ওয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে এক দৌড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া। দিনের বেলা বলে সব দেখলাম জানালার পাশের সিটে বসে। সকালের নাস্তা আর চায়ের পাট শেষ। এখানে প্লেনে বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছি দেশে যাবার পথে এথেন্সের দিকে আর পিছনে রেখে এলাম যেখানে ঈদ করছে কত জনে! কি আশ্চর্য এই বিশ্ব! একই সাথে কত জায়গায় কত কি ঘটে যাচ্ছে! আমি রয়েছি এখন আকাশে!
নাস্তা করার সময় ভাবছিলাম ভাগ্য ভাল যে আজকের টিকেট পেয়েছে, না পেলে আজ যদি এখানে থাকতে হত তাহলে এখানেই ঈদ করে যেতে পারতাম। ইংলিশ ঈদ কেমন একটু দেখা হত। সারা রাতে চোখ বুজতে পারিনি। হোটেলের রুমে বসে টেলিভিশনে এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করেছি। যদি ঘুম এসে যায় আর এজেন্ট এসে ডাকাডাকি করে সেই ভয়ে। একটু চোখ বন্ধ করেছি আর ওমনিই বিমান বালার সুললিত মার্জিত ইংরেজি কণ্ঠ। লেডিজ এন্ড জ্যান্টল মেনো আপনারা আপনাদের সিট বেল্ট বেঁধে নিন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এথেন্স বিমান বন্দরে নামব ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতের অনিদ্রার জন্য মাথা টনটন করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখি এড্রিয়াটিক সাগর পিছনে রেখে প্লেন আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে। সামনে গ্রিসের এথেন্স এয়ারপোর্ট এর রাডার টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। হাতের ঘড়িতে দেখি কোথা দিয়ে এই পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম তার কিছুই টের পেলাম না? তাইতো বলি, এর মধ্যে ছন্দা এসেছিল কি করে? তাহলে কি স্বপ্ন দেখেছি ছন্দাকে? হ্যাঁ তাই হবে। যাক হাতের ব্যাগ গুছিয়ে শীতের কাপড় গায়ে চড়িয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।

নিয়ম অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রানজিটে থাকলে সেই এয়ারলাইনের পক্ষ থেকে লাঞ্চ এবং হোটেল দেয়ার কথা কিন্তু নিয়ম থাকলেও বিমানের কাউকে খুঁজে না পেয়ে নিজের পকেটে থাকা পাউন্ড দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। এর মধ্যে নাস্তা, চা কফি কয়েকবার খেয়েছি। কোন চিন্তা নেই, পকেটে অনেক ডলার আর পাউন্ড রয়েছে। আরও কয়েক জায়গা থেকে আসা বেশ কয়েকজন এবং এখানকার স্থানীয় কয়েকজন বাঙালি জমা হয়েছে দেখলাম। তাদের মধ্যে যারা আমার মত ট্রানজিট লাউঞ্জে আছে তাদের সাথে খুচরা গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি আর বুকের মধ্যে ঢোল বাজছে, দেশে ফিরে ঈদের চিন্তায় ছটফট করছি।
ফ্লাইট রাতে বলে রাতেও এখানেই খেতে হবে। পাউরুটির মত ও দেশের এক রকম রুটি, সবজি সেদ্ধ আর ডিম। দুই বেলায় এই একই খাবার খেয়েছি। ভয়ে অন্য কিছু নেইনি, কি জানি বাবা কি না কি, হালাল হারামের ব্যাপার। কি আছে নাম জানি না, চিনি না।

রাতে খাবার পর বিমানের কাউন্টারে এক লোককে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম
চেক ইন কখন করবেন?
ফ্লাইট ডিলে কাজেই এখনও কিছু বলতে পারছি না
কাল ঈদ, একথা কি আপনারা জানেন না?
একটু বান্দর হাসি দিয়ে (অন্তত তখন আমার তাই মনে হয়েছে)
আমরা এখানে আজই ঈদ করেছি!
কিন্তু আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা দেশে যেয়ে ঈদ করব, তার কি হবে?

দেখুন, এ ব্যাপারে আমি বলতে পারছি না, আসলে ফ্লাইট নিউইয়র্ক থেকেই লেট
সাথে জুরিখ থেকে আসা এক ভদ্রলোক বলেই ফেলল তাহলে আর দেশে ঈদ করা হয়েছে, দেখুন এই এয়ারপোর্টেই ঈদ করতে হয় কিনা!
আমারও তাই মনে হচ্ছে!
নানা জনে নানা ধরনের কথা বলাবলি করছি। রাতে খেয়ে এসে শুনলাম প্লেন আগামী কাল দুপুর একটার আগে আসছ না।
বাহ! দারুণ খবর শোনালেন ভাই, এবার বাড়ি গিয়ে এক ঘুম দেন, ঈদ তো করেই ফেলেছেন, আর চিন্তা কি?
যান কাউন্টার বন্ধ করে দিন!

সত্যিই একটু পরে দেখি সেই ভদ্রলোক আর নেই, সারা এয়ারপোর্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর তাকে পেলাম না।
যারা এথেন্স এর যাত্রী তারা যার যার বাসায় চলে গেল আর আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা ১০/১২ জন হবে মনে হয় ঠিক মনে পরছে না, ওয়েটিং লাউঞ্জের এক পাশে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে ফ্লোরে বসলাম। পরিষ্কার চকচকে ফ্লোর। কি করব, রাত কাটাতে হবে আর আগামী কাল ঈদ করতে হবে। মিটিং শুরু হল, সাইপ্রাস থেকে আসা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নেতা বানান হল। তখন বড় ভাই কথাটার খুব প্রচলন।
আচ্ছা বড় ভাই আপনি এখন আমাদের নেতা, বলুনতো এখন কি করা যায়?
কি আর করবেন, এখন সবাই ঘুম দিন কাল সকালে যা করার করব।
এখনই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলে ভাল হয় না?
কি সিদ্ধান্ত নেব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি বললাম আচ্ছা আমি না হয় হটাত করে এসেছি, আমার টিকেট করেছে আমার এজেন্ট তাই এই দিনে এই ফ্লাইটে আসতে হল কিন্তু আপনারা কেন এলেন?
নানা জনে নানা সমস্যা নিয়ে বলল।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল
নামাজ পড়ার কথা ভুলে যান, পথে এভাবে কি আর ষোল কলা পূরণ হয়?
কাল সকালে এখানে পুডিং বা ফ্রুট কাস্টার্ড বা এপল পাই জাতীয় মিষ্টি যা আছে তাই সবাই মিলে একসাথে বসে খেয়ে ঈদ করব। ঠিক আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভাল আইডিয়া! তাই হবে।
এত রাতে ওয়েটিং লাউঞ্জ সবটাই প্রায় খালি, বিশেষ কেউ নেই। কাছাকাছি সময়ে আর কোন ফ্লাইট আছে বলে মনিটরে দেখা যাচ্ছে না।

আমরা একে একে একেকটা সোফা দখল করে হাতের ব্যাগ মাথার নীচে রেখে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম কি আর এত সহজ? মাঝে মাঝে এ ওকে ডাকছে একটু ইয়ার্কি চলছে কেউ আবার উঠে বসে সিগারেট টানছে আর সময়মত বাড়িতে যেতে না পারার দুঃখে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছে। এই এত লম্বা সময় একসাথে থাকার ফলে নানান শহর থেকে আসা সবার সাথে মোটামুটি একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে।

কারো ঘুম আর আসছে না। ভোরে এথেন্সের পুব আকাশ একটু একটু করে লাল হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে সূর্য উঠতে শুরু করল। এর মানে হল আমাদের দেশের ঈদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই কুরবানির গরু জবাই করে ফেলেছে। আমরাও সবাইকে ডেকে ওয়াস রুম থেকে মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ঢোকার সময় কাউন্টারে বসা মুটকি বুড়িকে গুড মর্নিং জানিয়ে বললাম আমাদের ঈদের দুর্দশার কথা। বুড়ি শুনে খুব উহ আহ করল। আমরা কিচেনের পাশে অর্ডার দেয়ার জন্য এগুচ্ছি আর তখন বুড়ি এক সুন্দরী ওয়েট্রেসকে ডেকে গ্রীক ভাষায় কি যেন বলল। সুন্দরী ঘার কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। গতকাল লক্ষ করিনি, আজ দেখলাম অনেক মিষ্টি জাতীয় খাবার। আমাদের যার যা ইচ্ছা অর্ডার করে অপেক্ষা করছি। একটু পরে সবারটা এক সাথে দু/ তিনটা ট্রেতে সাজিয়ে দিল আর ট্রে নিয়ে আমরা জানালার পাশে পূর্ব দিকে এসে বসলাম। গ্রীসের সকাল দেখে ঈদ করব।
আমরা নাস্তা খাচ্ছি। একটু পরে দেখি সেই সুন্দরী দুই হাতে দুইটা ট্রে নিয়ে আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। একটু অবাক হয়ে ওকে বললাম
আমরা আর কিছুর অর্ডার দেইনি, আমাদের সব কিছু নিয়ে এসেছি
সুন্দরী গ্রিক উচ্চারণে বলল
আমি জানি, কিন্তু এগুলি আমাদের ম্যানেজার ইশারা করে দেখিয়ে দিল ওই বুড়ি তোমাদের ফেস্টিভ্যালের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে
তাই নাকি? বেশ বেশ!

আমরা খুব খুশী হয়ে ওর হাতের ট্রে থেকে একে একে পেয়ালাগুলি নামিয়ে নিলাম। দেখলাম আইসক্রিম।
সুন্দরীকে বলে দিলাম তোমাকে এবং তোমাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমরা খুব খুশী হয়েছি।
এর পর সবাই কফির পেয়ালা নিয়ে বসলাম। আমি পকেট থেকে সেই আইরিশ তামাক এরিনমোরের টিন খুলে বসলাম।
তামাকের গন্ধে অনেকেই যারা অধূমপায়ী তারাও দেখলাম একটু লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখে বলল
ভাই আমাকেও একটা বানিয়ে দিন।
জানতাম এমন হবে তাই বেশি করেই কয়েকটা বানালাম।

কফি সিগারেট খেয়ে যখন বাইরে এলাম দেখি বিমানের কাউন্টারে দুই জন লোক দেখা যাচ্ছে। একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
কি ভাই, কোন খবর পেলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ প্লেন লন্ডন থেকে টেক অফ করেছে। এখানে একটার দিকে পৌঁছাবে আর তার ৪৫ মিনিট পরে আপনাদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফ্লাই করবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। একটু পরেই চেক ইন শুরু করব।
হিসেব করে দেখলাম লোকটা যেমন বলেছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে বিকেল নাগাদ ঢাকায় পৌছাতে পারব। তার মানে সেদিন আর ছন্দার সাথে দেখা হবে না। দেখা হবে তার পরদিন মানিকগঞ্জে।

গল্পে গল্পে স্মৃতিচারণঃ ব্যাঙফিস্ট

ব্যাঙ মাংসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রুম্মম বললো, নিকাশদাকে কেউ কি গত ছয়মাস ডাইনিং এ দেখেছেন? দেখবেনও না। কারণ উনি নিজ রুমে দুই বেলা ব্যাঙের মাংস খান”।

রুম নাম্বার ৩১১; ভিতরে আড়াই বাই সাড়ে ছয় ফুটের দুটি খাট। রিকাবী বাজার থেকে দেড়শ টাকা করে কেনা। দুটো খাটের ওপরই খোলা বই, জিন্সের ময়লা প্যান্ট, আন্ডারওয়ার এবং আরও হাবিজাবি। ওগুলো একপাশ করে যে যার মতো বসেছে। এক খাটে তিনজন এবং অন্যটাতে দু’জন। সবাই একমনে রুম্মমের কথা শুনছে।

একটু দম নিয়ে রুম্মম ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “আপনারা আরেকটা খবর জানেন? বিয়ের এক বছর না যেতেই দাদার বউ প্রায় চলেই গিয়েছিল। তিরিশ ডোজ ব্যাঙের মাংস খাওয়ার পর বৌদি নতুন করে দাদার প্রেমে পড়েছে”। এখন তো বৌদি দাদার টানে মাঝে মধ্যে হোস্টেলে চলে আসেন। দাদার সিঙ্গেল রুমের সুবিধা পাইপাই অসুল করেন।

দুই খাটের মাঝে যে স্পেস সেখানে দাঁড়িয়ে রুম্মম এসব কথা বলছিল। খাটে চতুর্থ বর্ষের রাতিল,সঞ্জিত; পঞ্চম বর্ষের মুন্নাফ, জেমস এবং জায়েদুল। কেবল রুম্মম তৃতীয় বর্ষের। গুরুত্বপূর্ণ ওই সভায় নিকাশদা ছিলেন না। থাকার কথা না। এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই উনি বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিলেন। কিন্তু মেডিক্যালে তিন বছর ধরে উনি পঞ্চম বর্ষে। তাই কিছুটা বন্ধুহীন। মেডিক্যাল কলেজে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কোন ঘটনা না।

রুম্মমের গল্পের দ্বিতীয় অংশে জোস পেয়ে জায়েদুল ওঠে দাঁড়ালো। মুন্নাফ এবং রাতিলও ওঠবে ওঠবে করছিল।

-বৃষ্টিতে ক্যাম্পাস ডুবে আছে। এখনই ব্যাঙ ধরার উপযুক্ত সময়।
জেমস মন্তব্য করলো।

-মশাল আর হকিস্টিক লাগবে। বালতিও।
রুম্মম ওর এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিলো।

যেই কথা সেই কাজ। আধা ঘণ্টার মধ্যে ওরা ব্যাঙ শিকারে বের হলো। সাথে নতুন আরও দুজন যোগ দিয়েছে। চাঁদমুখী লোটনও। তবলায় ওর খুব নাম ডাক। কিন্তু আজ রাতে সে ব্যাঙ-সেনা।

-হকি স্টিকের কী ভিন্ন ব্যাবহার !? সবাইকে পিঞ্চ মেরে লোটন কথাটা বললো
-হকি স্টিকের এটা তৃতীয় ব্যবহার লোটন ভাই। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাবহারের মতোই কলঙ্কিত।

আজকের এরাই হকিস্টিকের দ্বিতীয় ব্যবহারে একে অপরের মাথা ফাঁটিয়েছে। পূর্ণিমা কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করলোনা।

পূর্ণিমা চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। লেডিস হোস্টেলে থাকে। প্রতিবেশী নাট্যগোষ্ঠীতে ওর সরব বিচরণ। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সে যোগ দিয়েছে। এই অভিযানে সে আজ সাতভাই চম্পা।

তিন চার ঘণ্টার মধ্যে ওরা শখানেক এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ব্যাঙ ধরে। সেসব থেকে বেছে বেছে শতাধিক লেগপিস আলাদা করে। এসব করতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়। হোস্টেল ডাইনিং-এ কোন ফ্রিজ নাই। কোথায় রাখবে?

-চন্দ্রাদের বাসায়;
মুন্নাফ প্রস্তাব করলো।

চন্দ্রা পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা এবং বেশ সুশ্রী। সবার কাছে সে খুব প্রিয়। ওর বাবা অধ্যাপক, তাই টিচার’স কোয়ার্টারে থাকে।

যেই কথা সেই কাজ। মাংসগুলি সুন্দর করে তিনটা পলিথিন প্যাকেটে ভরে সবাই এক সাথে টিচার’স কোয়ার্টারে গেলো।

মুন্নাফ দরজায় কড়া নাড়লো। পাশে জায়েদুল। বাকীরা চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে। দু’বার কড়া নাড়ার পর চন্দ্রা দরজা খুলে দিল।

-তোমাদের ফ্রিজে কিছু মাংস রাখব
-কিসের মাংস?
-মুরগীর
-সত্যি মুরগীর?
-তিন সত্যি। দুই কানের লতিতে হাত দিয়ে মুন্নাফ বললো
-পাজির দল

গালিটা দিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ভাসিয়ে চন্দ্রা ভিতরে গেল। এক মিনিটের মধ্যে ওর বাবা দরজার কাছে এলেন। বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন বর্ষের ছয় সাত জনকে প্রায় মধ্যরাতে একসাথে দেখে তিনি চিন্তিত হলেন।

-কি চাও তোমরা?
-স্যার, ফিস্ট করার জন্য কিছু মুরগী কিনেছিলাম। ডাইনিং এর কর্মচারীরা ডিউটি শেষে আমাদের মুরগীগুলি প্রসেস করতে করতেই এতো রাত হয়ে গেলো। এখন তো আর রান্না করা যাবেনা তাই রাখতে এসেছি। যদি ফ্রিজে রাখতে দিতেন !

-এই পূর্ণিমা; ওরা ঠিক বলছে তো?
-স্যার, মুন্নাফ ভাই তো একটু আগেই চন্দ্রাদিকে কসম কেটে বলেছে
-ঠিক আছে; রেখে যাও

মুন্নাফ যখন প্যাকেটগুলি দিচ্ছিল সঞ্জিত পালকে খোঁচা দিয়ে লোটন বললো;
-এই, তোর ভগবানের নাম নে !

জেমসকে পূর্ণিমা বললো,
-আমি আল্লাহ আল্লাহ করছি। দাদা আপনি ঈশ্বরের নাম নেন
-কেন?
-স্যার যদি প্যাকেট খুলে দেখেন তাইলে কারো রক্ষা নাই!

পরদিন বিকেলের ওয়ার্ড শেষে মুন্নাফ আর রুম্মম চন্দ্রাদের ফ্রিজ থেকে মাংস নিয়ে যায়। প্যাকেট ইন্ট্যাক্ট দেখে ওরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। স্যার খুলে দেখেননাই।

জনপ্রতি তিরিশ টাকা করে চাদা তুলে পোলাও এর চাল, ঘি, মশলা ইত্যাদি কেনা হয়। কিছু বিয়ারও। পূর্ণিমাকে খবর দেয়া হয়েছিল। অভিযানের মজাটাই কেবল নিতে সে কাল এসেছিল; বাকী কিছু তার পক্ষে সম্ভব না।

রাত নয়টার মধ্যে রান্না শেষ হয়। হোস্টেলের অন্যকেউ জানেনা যে ডাইনিং এর পাতিলে ব্যাঙ এর মাংস রান্না করা হয়েছে। রান্না শেষ করেই সবাই পুকুরে গোসল করতে নামে। এতে ক্ষুধা বাড়বে; তাই। হোস্টেলের সামনে বেশ বড় পুকুর।

তখন রাত সাড়ে নয়টার একটু বেশি। সবাই আয়েশ করে খেতে বসেছে। কিন্তু অতো মাংস কী খাওয়া যায়? হোস্টেলের আর কে কে ব্যাঙ খেতে পারে সেটা ভেবে তাদেরকে গোপনে খবর দেয়া হলো। এক বাটি মাংস নিয়ে লোটন লেডিস হোস্টেলে গেলো। বাটিটা এগিয়ে দিতেই পূর্ণিমার সেকি বমি! শেষে লোটন পালিয়ে বেঁচেছে।

টিটোন ওর রুমমেট বদরুলের জন্য একবাটি নিয়ে গেলো। ভীষণ কৃপণ এই বদরুল। টাকা পয়সার অভাবে না। ওর সবাই লন্ডনি। স্বভাবে কৃপণ। কোনদিন কারো সাথে বাইরে খেতে যায়নি। কিন্তু চাইনিজের চিকেন ওর খুব পছন্দ। আধা খাওয়া মুরগীর রান এনে দিলেও খুব তৃপ্তি নিয়ে খায়। বাইরে খেতে গেলে টিটোন সাধারণত তার এই সাদা মনের কৃপণ বন্ধুটার জন্য কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে আসে।

-রুমমেট তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। দেখ, আজ অনেক মাংস এনেছি। ঠান্ডা হয়ে যাবে; জলদি খা
-থ্যাঙ্কস দোস্ত; বলেই বদরুল গোগ্রাসে খেতে লাগলো

টিটোন একফাকে ৩১১তে গিয়ে রাতিলকে পাঠিয়ে দেয়। চার নাম্বার রানটাতে কামড় দিতে যাবে তখনি জানালার পাশে রাতিল এসে দাঁড়ালো;

-বদরুল ভাই কি খান?
-টিটোন চাইনিজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে এসেছে। খাবা এক পিছ?
-নাভাই। ব্যাঙফিস্ট খেয়ে পেট ভরে গেছে

সাথে সাথে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বদরুল ওয়াশ রুমের দিকে দৌড়! তারচে বেশি জোরে রাতিল ৩১১ এর দিকে।

বদরুলের বমির খবর পেয়ে টিটোন সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে রুমে ফিরবেনা। বাকীদের অনেকেই ৩১১ তে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

চার ক্যান বিয়ার ছিল। রুম্মম গ্লাসে ঢেলে সবাইকে দিলো। নিজে সবচে বেশি নিলো এবং লোটনকে সবচে কম। তারপর খাটে এবং ফ্লোরে সবাই সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ওই সময় ৩১১ এর সামনে দিয়ে কারো হেটে যাওয়ার শব্দ পেলেই ওরা কোরাস করে ব্যাঙ ডাকার শব্দ করতে থাকে। এতে কেউ হেসে চলে যায়; কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, “ঘটনা কী”?

লোটন তখন ইন্টেশনালি আশপাশে ঘুর ঘুর করছিলো। কেউ “ঘ্যাগু… ঘ্যাগু” আওয়াজের রহস্য জানতে চাইলে সে বলে, “ভিতরে যারা আছে; ওদের পেটের ভিতর এখন একশটা ব্যাঙ। তাই ঘ্যাগু… ঘ্যাগু শব্দ হতেই পারে। কিন্তু আমি তো কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা”!

আসলে, কাবাবিয়া রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে জাইয়ান দুই যুগ আগের এই স্মৃতিচারন করছে। ওর সামনে দেড় কুড়ি ডাক্তার। প্রায় সবাই জুনিয়র।

-নিকাশদা এখন কি করেন জানিস?
গল্পের এমন পর্যায়ে জাইয়ানকে এই প্রশ্ন করায় মাহবুবের ওপর জুনিয়রদের কেউ কেউ বিরক্ত হলো। মাহবুব জাইয়ানের সহপাঠী বন্ধু। কার্ডিয়াক সার্জন।

-শুনেছি, সাহারা মরুভূমিতে বৃষ্টির পানি কিভাবে ধরে রাখতে হয় তা শেখানোর কাজ করেন।

জাইয়ান গলা নামিয়ে টেনে টেনে ফান করে জবাব দিলো। সে দেখছিল, এক ফুটবল টিম ছেলে নিয়ে একলোক দরজা ঠেলে সস্ত্রীক প্রবেশ করছে। তার পেটটা অভাবনীয়ভাবে ব্যাঙের মতো।

লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই জাইয়ান সবাইকে ফিসফিস করে বললো, “নি–কা–শ–দা”।

জাইয়ানের এই ফিসফিস আওয়াজ গল্প বলার কৌশল মনে করে উপস্থিত জুনিয়রদের একজন প্রশ্ন করলো,”তারপর”?

নারী তুমি এমন কেন ? – ০২

চির সৌন্দর্যের কবি জন কিটস বলেছেন:
‘Anything of beauty is always fun:
Its beauty increases;
This is never lost in void. ‘

যে সৌন্দর্য ভাল না বাসে, হয় তার রুচিতে সমস্যা আছে কিংবা হয়তো জীবনে সে কখনো সৌন্দর্য দেখেনি। সৌন্দর্যের প্রতি ভাল লাগা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। একজন মানুষের ভিতরগত রূপটি দেখার জন্য তার কাছাকাছি অবস্থান করা, তাকে প্রতিক্ষেত্রে পর্যবেক্ষন করা অতি জরুরী হয়ে পড়ে। নিখুঁত পর্যবেক্ষন শক্তিই একজন অতি কাছের মানুষকেও চিনতে সহায়তা করে। আজ আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা আমার মনোজগতকে সাময়িকভাবে নাড়া দিয়েছে। একজন মানুষ কিভাবে এতকিছু করতে পারে ? এত ধৈর্য, এত ইচ্ছা শক্তি কিভাবে সে ধারন করে ? এ নারী প্রায়ই বলে প্রচুর অর্থ সম্পদ আর টাকা থাকলেই মানুষের মন বড় হয় না বা মানুষ সুখী হয় না দুঃখকে অতিক্রম করেই সুখকে স্পর্শ করতে হয়। আবার মাঝে মাঝে যে সুখ আসে তাও দুঃখমিশ্রিত। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। তারপরও কোনো কোনো দুঃখ, বিরহ লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেটা জীবনেরই অংশ। জীবন যে সব মিলিয়ে সামনে চলার। তাই সব রকম চিত্রই কম বেশি সব সময় দেখা যায়। জীবনের মধ্যেই তা ধরা দেয়। বড় মনের পরিচয় প্রকাশ পায় তার ব্যবহার আর আচার আচরনের মাধ্যমে। যে মানুষ অন্য মানুষের প্রাপ্ত অধিকারকে পাশ কাটিয়ে নিজের বুঝটা পুরোপুরি বুঝে তাকে কি মানুষ হিসাবে গন্য করা যায় ? নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে অন্যের যে সামান্যতম উপকারে আসে সেই তো প্রকৃত মানুষ।

মাঝে মাঝে আমি নিজেই নিজেকে চিনতে চেষ্টা করি। মনে করি এটা আমার জীবনের পরীক্ষা ক্ষেত্র। কিন্তু সবগুলো জিনিস কেমন যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে আমাকে। হতবুদ্ধি হয়ে কঠিন সময়কে আমি কেবল আলিঙ্গন করে চলেছি। কোথায় চলছি তা জানিনা।এমন কিছু মানুষ থাকে পৃথিবীতে যারা কাছে এলে অন্য সব ভুলে যেতে চায় মন। জীবনের এই শেষ বেলায়, যখন আকাশে অস্তরাগ আর ছায়া দ্রুত নেমে আসছে আবাদভূমিতে, যখন গাছের ডালে পাখিরা শেষ বেলার কথাগুলি বলে নিচ্ছে, তখনও এ নারীর সন্দর্শনে মন পাগল হয়ে যায়। আর এভাবেই জীবন চলে যাবে নদীতে ভেসে ভেসে যাওয়া ডিঙ্গি নৌকার মতো। তারপরও তাকে পরিপূর্ণ ভাবে দেবার বাসনা শেষ হবে না। কান্না নাকি মানুষের মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কোন কোন বেদনা ও অপমান একে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়। এ কেবল তাদেরই উপলদ্বির বিষয়। সেইসব বেদনায় এক নারীর অশ্রু অন্য নারীর চোখকে আর্দ্র করে। এ এক অনিবার্য ভাগাভাগি, অন্যরূপ সহমর্মিতা। কিন্তু এ নারীর বেলায় নয় কেন ? এ নারী কি শুধু দিয়েই যাবে ? কিছু কি পাবে না অন্যের কাছ থেকে ? এ কেমন বিচার ? কিছুই কি চাইবার নাই তার ?

তার যুক্তি দুঃখ মানুষের ছায়ার মতো। অন্ধকারে মিশিয়ে থাকে কেবল। আলো পেলেই ফুটে বেরোয়। ভাবনায় তুমি জগৎ সংসার ত্যাগ করতে পারো, কিন্তু জগৎ সংসার তোমাকে ছাড়বে না। আমৃত্যু তুমি সকল দুঃখ-কষ্টে, রোগে-শোকে জড়িয়ে থাকবে। নানান ভুল-ত্রুটি, মর্যাদা-অমর্যাদা তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। এর পরও তোমাকে সকলকে নিয়ে সামনে এগুতে হবে। এত কিছুর পরও এ নারীকে আমি কিছুই দিতে পারিনি, শুধুই নিয়েছি। তারপরও আমার ভালবাসার কোন কমতি নেই তার জন্য আমিও মনপ্রান উজার করে ভালবাসি। আরো ভালবাসতে চাই। তাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে আমার প্রিয় শিল্পী মানবেন্দ্র এর বিখ্যাত গান দিয়ে আমার ভালবাসার, শ্রদ্ধার বর্হিপ্রকাশ করতে চাই …

“আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি
তবু এ যেন গো কিছু নয়,
কেন আরো ভালবেসে যেতে পারে না হৃদয়” ?

চলবে ……

নারী তুমি এমন কেন ?

“ভালবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালবাসা”।

‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে হুমায়ন আহমেদ গুলতেকিনকে লিখেছিলেন এসব কথা। বাদল দিনের সে কদম ফুল এক সময় বাসি হয়ে যায়। সময়ের স্রোতে ভালবাসার মানুষ একসময় পর হয়ে যায়।স্বার্থ পূরন হলে ভালবাসায় চিড় ধরে, ক্লান্তি আসে। যে জীবন জীবনের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে; সেই জীবন হারিয়ে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক ও বেদনাদায়ক বড় ঘটনা বোধকরি আর নাই। আপন-পর, আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিতের গন্ডি এক্ষেত্রে থাকে না। শোক সাগরে সকল মানুষকেই ভাসায়।এখন আমি ক্লান্ত , অবসন্ন। নিঃসঙ্গতা আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে উঠেছে। একটা নীরব আত্মবিশ্বস্ত নৈকট্য ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে সেটা কেন যেন আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। হয়তো এটা আমার ব্যর্থতা, না হয় অবহেলা। কিন্তু তার কর্তব্য সে পালন করে যাচ্ছে কোন কিছু দাবী না করে। জানিনা কেন ? হয়তো এটা তার দায়বদ্ধতা। কে যাবে ব্যাখ্যা করতে নিজের ভেতরের অবস্থানটিকে ? আমার অবস্থান আমার ভিতরই থাক। কেন অন্যের কাছে নিজের টোটাল সত্তার স্বরূপকে নগ্নভাবে উৎঘাটন করতে যাব ? কী দায়ে ? কিসের প্রয়োজনে ? সব দায় আর প্রযোজন তো আজ প্রায় শেষ। তবে কেন নিজকে বড় করে জাহির করা ? নিজের রুচি ও চরিত্রের বাইরে জীবনে কখনো কিছু করিনি। করার চেষ্টাও করিনি, করতে গিয়েও করতে পারিনি। সব সময় নিজের কথা না ভেবে পরিবারের শক্ত অবস্থান দাড় করাতে নিজকে নিজের স্ত্রী সন্তানকে অধিকার বঞ্চিত করেছি। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরী করেছি কিন্তু সেটা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারিনি। রাজনৈতিক সুফল আমি ভোগ করতে পারিনি। যারা আমার খ্যাতি যশ ব্যবহার করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তারা আমাকে আজ কেউ চিনতে চায় না।অবিশ্বাস্য খ্যাতি ও ব্যস্ততা আমাকে আমার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। আমার স্বভাবগত উদ্যোগহীনতাও একটা কারণ বটে। আমি নিজকে আমার পরিবারের মধ্যে কখনোই সীমাবদ্ধ রাখিনি। তাই বার বার পরিবার থেকে কষ্ট পেয়েছি।শত কষ্টের মাঝে একজন আমাকে আগলে রেখেছে তার প্রেমময়ী স্পর্শ আমার মৃত্যুমুহূর্তকে পুষ্পময় করে রেখেছে। খুব কম মানুষের জীবনে এ দুর্লভ সৌভাগ্য জোটে। এ নারী আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে তার সমস্ত কিছু উজার করে। চিরকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি কখনো ব্যক্ত করেনি, আমিও বুঝার চেষ্টা করিনি। এত অঢেল পাওয়া ক’জন এর নসিবে জোটে ?

ভালবাসার অপূর্ব অনুভূতি কখনো বুঝতে পারিনি। রাজনীতিতে ব্যস্ত সময় পাড় করতে গিয়ে নারীর চিরন্তন ভালবাসা কখনো বুঝা হয়নি, তবে কাউকে যে ভাল লাগেনি তা নয়, ভাল লাগলেও রাজনীতির ক্যারিয়ার নষ্ট হবে বিধায় সেভাবে কাউকে জীবনে জড়াতে পারিনি। এ নারীকে না পেলে বোধহয় জীবনের খানিকটা অপূর্ণতা রয়েই যেত। আমার স্ত্রী কর্মাসের ছাত্রী তাই অঙ্কে ভাল ছিল কিন্তু মাঝ বয়সে এসে তার জীবনের জটিল অঙ্ক মেলাতে পারছে না। জন্ম মুহূর্ত থেকে একটা মেয়ে অবচেতন মনে বুঝতে শুরু করে সে মেয়ে মানুষ। সে অপরের অধীন। পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার তার নেই। জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে হয়তো বাবা-ভাই, স্বামী নয়তো ছেলে। এ পরাধীনতার অন্তরালে থাকতে থাকতে একসময় নিজের বিবেকের স্বাধীনতাটুকুও সে হারিয়ে ফেলে। জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কিন্তু নারী সংসারে, সমাজে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।কখনো নিজের ইচ্ছায়, কখনো পরিবারের চাপে, কখনো সমাজের নিষ্পেষণে। এটা প্রত্যেক নারীর একটা অপ্রাপ্তি।সবচেয়ে কাছের মানুষ যারা আমাকে সাহায্য করার কথা ছিল, দুঃসময়ে আমার পাশে থাকার কথা ছিল, আমার বাচ্চাদের মাথায় ভরসা আর নির্ভরতার হাত রাখার কথা ছিল, স্বার্থের টানাপড়েনে তারা নিজেদের রং বদলিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।তারপরও আমি নিজেকে ভাগ্যবঞ্চিত মনে করি না। আমি এখনও সুস্থ আছি, এখনো বেঁচে আছি। এ জীবনে আমার পাওয়া অনেক। এই যে এত মানুষের ভালোবাসা, কষ্টের সময় পাশে থাকা, কজনের ভাগ্যে জোটে। তাই পৃথিবীর কাছে আমার কোনো অনুযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। প্রকৃতির নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। এ নিয়মের আবর্তেই হয়তো কাছের মানুষ দূরে চলে যায় আর দূরের মানুষ কাছে। আমি একা একা বসে আছি। কিছুক্ষন আগে ইফতার করেছি, নামাজ পড়ার পর শরীরটা ক্লান্ত লাগায় অফিসে যাওয়া হলো না।ভাবনার কক্ষ পথে কেবল এ নারীর মুখ ভেসে উঠতে লাগল।

এক জীবনে মানুষ অনেক কিছুই পারে না। কিন্তু এ নারী তা পারছে এবং করছেও তিনি স্নেহময়ী বধূ, মমতাময়ী মা, দায়িত্বশীর শিক্ষাগুরু, স্বামীর প্রতি দায়িত্বপালনকারী সফল স্ত্রী। সে আমার প্রেমময়ী, প্রেরণাদায়িনী, শক্তিদায়িনী। এ নারী আমার কতটা প্রভাব ও কর্মকৌশলতার সাথী তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সত্যিই দুরহ। এ নারী আমার জীবনে এসে আমার পরিবার, সংসার এবং আমার গৃহাভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ তৈরী করে রাখছে যার উপর নির্ভর করে দুর্গমগিরি, দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে পারা যায়।

চলবে ……..

বন্ধুত্ব মানে মনের সাথে মনের মিল

বন্ধু মানে মেঘলা দুপুর শিশির ভেজা ভোর
বন্ধু মানে মনের মাঝে অনেকখানি জোর
বন্ধু মানে ভীষন কষ্ট একটু অভিমান
মনের মাঝে কোথায় যেন অনেকখানি টান . . . . . . . . . .

এক অকারণ অনুভূতির নাম বন্ধুত্ব? হাতে হাত রেখে পাশাপাশি চলাটাই বন্ধুত্ব ? বন্ধুত্ব মানে বয়সের সাথে বয়সের মিল নয়, বন্ধুত্ব মানে মনের সাথে মনের, গোপনে হয়ে যাওয়া পরিচয়…..বন্ধুদের। জীবনের সংকটে বন্ধুই ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবনযাপনের ভিন্ন রস।
বন্ধু কখনো পুরনো হয় না।
বন্ধুহীন আর প্রেমহীন জীবন নাবিক বিহীন জাহাজের মতো। তাই মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজন অনুভব করে। কারণ, একজন প্রকৃত বন্ধু জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অংশীদার হয়। প্রকৃত বন্ধুই পারে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুঃখ-কষ্টকে ভুলিয়ে রাখতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, ‘দুটি দেহে একটি আত্মার অবস্থানই হলো বন্ধুত্ব । সেটা হতে পারে ছেলের সাথে মেয়ের, ছেলের সাখে ছেলের, প্রেম আর বন্ধুত্ব আলাদা কিছু নয়। প্রেম হতেই কামনার সৃষ্টি।

বাবার কাছে লেখা এক সন্তানের চিঠি

তারিখঃ ঢাকা। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ ইং।

প্রিয় বাবা,

এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি
এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছুবে কিনা আমি জানি না
আমি হয়ত একটু পরেই মারা যেতে পারি বাবা!

গতকাল রাতে যে সুন্দর স্বপ্নটি দেখেছিলাম
আজ সকালে কাজে আসার আগে তোমাকে বলেছিলাম
কিন্তু তা আর সম্ভব হল না!

আজ সকালে আমাদের কারখানায় এক দুর্ঘটনা ঘটেছে!
তারপর!

তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম!
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারিদিকে মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ! হাহাকার!! চীৎকার!!!
আমাদের অফিসের বিল্ডিংটা আজ ভেঙ্গে পড়েছে!
আমি দোতালায় কাজ করছিলাম কিন্তু এখন কোথায় আছি বুঝতে পারছি না বাবা!

বাবা!
আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে!
আমার মাথার উপরে একটা সেলাই মেশিন খুব শক্তভাবে আটকে আছে!
আর সেলাই মেশিনের উপরে ভেঙ্গে পড়েছে ছাদ।
মনে হচ্ছে সেলাই মেশিনের সুচের কিছুটা অংশ মাথায়!
মাথায় ঢুকে গিয়েছে!

বাবা!
আমার মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে
আমার গলা, বুক, শার্ট সব রক্তে ভিজে গেছে
আমি একটুও নড়তে পারছি না বাবা!!!

বাবা!
আমার শার্টের পকেটে এক টুকরা কাগজ ছিল আর কলম
আমি এখন সেই কাগজে তোমার কাছে চিঠি লিখছি
কিন্তু বাবা!
এই কাগজটাতে আমার মাথা থেকে রক্ত পড়ে কিছুটা ভিজে গিয়েছে
আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বাবা!

দূরে কোথাও অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে
মনে হয় উনারা উদ্ধার কর্মী
ওরা কি আমাকে খুজে পাবে?
আমিতো জোরে ডাকতে পারছি না বাবা!
আমিতো চিৎকার করে বলতে পারছি না, “আমি এখানে আটকা পড়ে আছি! তোমরা এদিকে এসো!! আমাকে বাঁচাও!!!”

বাবা!
সোনালীর পেটে আমার সন্তান এসেছে সেই সু সংবাদটা তোমাকে দেয়াই হয় নি
ও গতকাল রাতেই আমাকে বলেছিলো
সোনালীর প্রতি যত্ন নিও বাবা!
মাকে কাঁদতে নিষেধ করো বাবা!
মাকে আর নতুন শাড়ি কিনে দেয়া হলো না!
আমি তোমাকে আর ঔষধ কিনে দিতে পারব না বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দিও!

আর পারছি না বাবা!
আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি!
কত মানুষ মারা গেছে শুনেছি, দেখেছি কিন্তু কোনও দিন বুঝিনি মৃত্যু কি!
মৃত্যু মানে কি বাবা? আমি কোথায় যাচ্ছি বাবা!
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে বাবা!
বাবা! বাবা!
বাবা!!!!………

আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাললা………

বাবার কাছে লিখা এক সন্তানের চিঠি

‘৭১ এর এক টুকরো স্মৃতি!

‘৭১ এর এক টুকরো স্মৃতি!

সময়টা ছিল খুব সম্ভব মে মাসের মাঝামাঝি। ঊনিশ’শ একাত্তর সালের কথা বলছি। ২৫শে মার্চের কালো রাতের পর, নারায়ণগঞ্জ শহর ছেড়ে অনেকেই পালাতে শুরু করে। ২৭ শে মার্চ আমরাও শহর থেকে পালিয়ে উদ্ধবগঞ্জ নামের একটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম দাদু দিদিমার সাথে। উদ্ধবগঞ্জে দাদুর মুহুরীর বাড়ী। প্রাণভয়ে প্রচুর মানুষ ঐ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার মা বাবা তখনও নারায়ণগঞ্জ শহরেই থেকে গেছিলেন, পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য। আমাদের বয়স কম ছিল, একেবারেই শিশু, যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝবার মত বোধ তৈরী হয়নি। শুধু বুঝতাম, পাকিস্তানী মিলিটারীদের সামনে পড়ে গেলেই গুলী করে মেরে ফেলবে। পাকিস্তানী মিলিটারীর ভয়েই সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে গোলাগুলির সংবাদ, পাড়া ছেড়ে সবাইকে পালাতে দেখে, ভয়ের বদলে ছোটদের মনে ছিল ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলার সাময়িক উত্তেজনা। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারছি, সেই ভেবে আনন্দ।

উদ্ধবগঞ্জের পাশের গ্রাম সোনারগাঁও। সেখানে দাদুর আরেক মক্কেল ননীবাবুর বাড়ী। মুহুরীবাবুর বাড়ীতে গাদা গাদা অসহায় মানুষের পাশে উকিল বাবুকে উনি থাকতে দিতে চান নি। দশ বারো দিনের ব্যাপার, সব ঝামেলা চুকে গেলে উকিলবাবু আবার নারায়ণগঞ্জে উনার নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবেন, এই কয়টা দিন নিজের বাড়ীতে এনে আদর সমাদর করা উনার বিরাট দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিলেন। লাল ইঁটের দোতালা দালানে উনি আমাদেরকে নিয়ে তুললেন। দশ বারোদিনের মধ্যে সব ঝামেলা চুকে যাবে, ননীবাবুর ধারণাটি সঠিক ছিল না। দশ বারোদিনের পরিবর্তে আমরা দুই মাস থেকে গেলাম। এই দুই মাস ছোটদের জন্য ছিল বেশ সুখের সময়। আমাদের দালান থেকে সোনারগাঁও জমিদার বাড়ী দেখা যেত, দালানের পেছনদিকে যে বিশাল বড় মাঠ দেখা যেত, সেই মাঠ পেরোলেই ছিল ‘পানাম’ জমিদার বাড়ি ।

দুইদিকে জমিদার বাড়ী দেখে নিজেদেরকেও জমিদার জমিদার মনে হতো। বাড়ীর সামনেই বিশাল চওড়া দীঘি ছিল, দীঘির জলে প্রচুর মাছ, চারদিকে চার ঘাটলা, রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষে বাসন ধুতে গেলে দেখা যেত, ঘাটের উপরে চিংড়ি মাছ, বড় বড় পুঁটি মাছেরা এসে ভীড় করেছে। আমার দাদুর বাজার করার ব্যাপারে ছিল দারুণ খ্যাতি। প্রতিদিন সকালে বাজারে গিয়ে তিন চার সের দুধ কিনতো, মাছ কিনতো। আসলে তখন সব কিছুই সস্তা দেখে দাদুর যুদ্ধের কথা মাথায় থাকতো না। অনেক বড় হয়ে বুঝেছি, দাদুর মাথায় আইনের ধারা ছাড়া আর কিছু খেলা করতো না। রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না। রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন আমার বাবা। সেজন্যই বাবার কাছে খুব অস্বস্তিকর মনে হতো যখন দাদু বাজার থেকে দুধের কারিয়া হাতে বাসায় ফিরতো।

দাদু সাথে করে যা কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল, সেগুলিই দেদারসে খরচ করে যাচ্ছিল। উনার ধারণা ছিল, আগামী সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন ধারণা করার কারণও ছিল, উনার মক্কেলরাই উনার কাছে সংবাদ এনে দিত, সামনের সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে! বাবা মানা করতেন, বাজার করার বহর দেখলে মানুষ ভুল বুঝতেও পারে। ঠিকই মিলেছে বাবার কথা, দাদুর বাজার করার বহর দেখে ‘বাজারে’ কেউ কেউ কুমতলব আঁটতে শুরু করে। দুই দিন পর পর দূরের গ্রামে ডাকাত পরার সংবাদ পাওয়া যায়। হঠাৎ এক রাতে খুব কাছে থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যায়। আরেকদিন, সকালের দিকে কেউ এসে বলে, ‘বাজারে মিলিটারী আইছে’, ব্যস, মা আর দিদিমা সাবান, জল নিয়ে মাথার সিঁথিতে থাকা সিঁদুর ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। এরপর আমাদের নিয়ে পাশের মুসলমান বাড়ীতে গিয়ে পালিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।

পরের দিন ননীবাবু এসে দাদুকে বলতে বাধ্য হয়, “বাবু, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের অবস্থা খুব খারাপ। মিলিটারী বাইছা বাইছা হিন্দু ধইরা ধইরা মারতে আছে। হিন্দু মাইয়াগোরে ধইরা লইয়া যাইতাছে। কী করুম! আপনে আমার অতিথি। আপনেরে এইভাবে রাইখা আমি কোথাও যাইতে পারুম না। ছোট ছোট পোলাপান লইয়া আগরতলা চলে গেলে কেমন হয়!”।

আমার দাদু খুব ভীরু প্রকৃতির ছিলেন। ননীবাবুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, সোনারগাঁও আর থাকা যাবে না। আগরতলা দিয়ে কলকাতা চলে যাবেন। ননীবাবু নিজেও চলে যাবেন। নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে এখানে আমাদের সুখেই দিন কাটছিল। এর মধ্যে দাদু সোনারগাঁও ছেড়ে যেতে চাইছেন শুনে ছোটদের মনে আবার কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিল। নতুন কিছু ঘটার অপেক্ষা, নতুন কিছু শোনার অপেক্ষায় আমাদের প্রহর গোনা শুরু হলো। দুই দিন পরেই বাজারে একদল ডাকাত ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, আমাদের অস্থায়ী নিবাসে ডাকাতি করার জন্যই ওরা আসছিল। এই সংবাদ শোনার পরে বড়দের সকলেই একমত হলো, সবকিছু গোছগাছ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে।

আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে হাতব্যাগে যে কয়টা জামাকাপড় আঁটে, তাই নিয়েই চলে এসেছিলাম। এখনতো আর নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাওয়া যাবেনা, তাছাড়া আগরতলা যাওয়া ছাড়া আর কোন গতিও ছিল না। হাতে কিছু টাকা পয়সা না নিয়ে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে কোথাও বের হওয়াও মুশকিল। মায়ের সোনা গয়নার ছোট পোঁটলা, দিদিমার কিছু গয়না নারায়ণগঞ্জের বাসাতেই ট্রাঙ্কে রয়ে গেছিল। কোন অজানার ঊদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি সবাই, আর কখনও ফিরে আসা হবে কিনা, সেই ভয়ে মা আর দিদিমা নিজেদের গয়নাগুলো নারায়ণগঞ্জের বাসায় ফেলে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি। সিদ্ধান্ত হয়, দাদুর মুহুরী হামিদ মিয়ার সাথে মা যাবে শহরে, ঘরবাড়ি তালা মেরে আসতে হবে, কিছু টাকা তুলতে হবে ব্যাঙ্ক থেকে, সাথে গয়নাগুলো নিয়ে আসবে। এভাবে এক কাপড়ে কোথাও যাওয়া যায় না, কিছু কাপড়-চোপর নিয়ে আসতে হবে। ঘরে যখন এগুলো নিয়ে আলাপ হচ্ছিল, আমি চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, সোনা গয়না মাটির নীচে গর্ত করে রেখে দিলেই তো কেউ জানতে পারবে না। নিজের মতামত জানাতেই এক ধমক খেলাম, বড়দের গোপন পরামর্শ শুনে ফেলেছি বলে।

পরের দিন খুব সকালে হামিদ নানা আসবে। মা’কে মুসলমান বৌ সাজিয়ে নেয়া হবে। মুসলমান সাজার একটাই মাত্র উপায়, বোরকায় নিজেকে ঢেকে ফেলা। দুই মাসে সোনারগাঁও এর আশেপাশের মানুষজনের সাথে আমাদের খাতির হয়ে গেছিল। পাশের বাড়ীর সখিনার মায়ের কালো বোরকা আনা হলো। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন, বয়স কম ছিল, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল খুব প্রখর। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ মায়ের জন্মস্থান, পেশায় শিক্ষক, মনের জোর ছিল আলাদা। তাই মা’কে নিয়ে কেউ দুঃশ্চিন্তা করছিল না। আগের সন্ধ্যায় আমাদের সবার সামনে মা’কে বোরকা পড়িয়ে ট্রেনিং দেয়া হলো। বোরকার মুখের উপর যে পর্দা থাকে, সেই পর্দার ঝিরি ঝিরি ফুটো দিয়ে মা ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। তাই এলোমেলোভাবে পা ফেলছিল। তাই দেখে আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম।

পরের দিন খুব সকালে মা তাদের ‘হামিদ চাচা’র সাথে রওনা হয়ে গেলো। পানামের দিকে যেতে যে বিশাল মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে কালো বোরকা পড়া মা’কে যেতে দেখে আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। কেনো জানি মনে হচ্ছিল, মা আর ফিরে আসবে না। সারাদিন বাড়ীতে সবাই চুপ করে বসেছিল। ছোটরা হই হই করছিল না। দিন পার হয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসতেই তিন বছর বয়সী ছোট ভাই কান্না শুরু করে দেয়, মা আসেনা ক্যান, মা আসেনা ক্যান বলে। ঠিক অন্ধকার হওয়ার আগ মুহূর্তে আমার মেজভাইকে দেখা গেল, দূর থেকে দৌড়ে আসছে। মা আইছে, মা আইছে বলে চীৎকার করছিল, মেজদার চীৎকার শোনার সাথে সাথে দিদিমা, ঠাকুমার দেহে প্রাণ ফিরে আসে। দেখা গেল, মায়ের সাথে আমার দুই মামাও চলে আসছে। বলা বাহুল্য, ‘দেখা যাক কী হয়’ ধারণা নিয়ে আমার দুই মামা শহরে তাদের মুসলিম বন্ধুদের সাথেই রয়ে গেছিল। মা যখন ঘরে ফিরে বোরকা খুলেছে, মায়ের চেহারা রক্তশূন্য। আমি তো আর রক্তশূন্য বুঝিনা, দিদিমাকে বলতে শুনেছি, ‘কী হইছিল? তোর চেহারা এমুন দেখা যায় ক্যান? একেবারে রক্তশূইন্য চেহারা”!

হামিদ নানা বলল, “কর্তা, আম্মারে লইয়া আইজ বড় বিপদের মইদ্যে পড়ছিলাম। আর দিন পায় নাই, আইজই আজরাইল আইয়া হাজির অইছে নারায়নগঞ্জ শহরে। আম্মারে বাড়ীর ভিতরে পাঠাইয়া দিয়া আমি গেছি কোর্ট বিল্ডিং এ, গিয়া আধ ঘন্টা দাড়াইতে পারি নাই, ট্রাক ভইরা মিলিটারী আইয়া হাজির। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ি, আমি কলেমা পড়ুম কী, আম্মার কথা মনে অইতেই আমি অস্থির অইয়া গেছি। ক্যামনে ক্যামনে যে আম্মারে আবার আপনের কাছে ফিরাইয়া দিতে পারছি, আমি নিজেই কইতে পারুম না”।

আমরা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মা কী বলে! মা হামিদ নানাকে কিছু খেতে দিতে বললো সবার আগে। এরপর মা যা বললেন, তা রীতিমত ভয়াবহ। শহরে আমরা থাকতাম বিরাট বড় এক বাড়ীতে, যেখানে শুধু বাড়ীওয়ালা ছিলেন মুসলমান, ভাড়াটেদের সবাই হিন্দু। কাজেই এই বাড়ী হিন্দু বাড়ী নামেই বাইরে পরিচিত ছিল। দরজার তালা খুলে মা কেবল ঘরে ঢুকেছে, বাড়ীর মালিক, হাজী সাহেবের কাছে সংবাদ চলে এসেছে, নারায়ণগঞ্জে মিলিটারী ভর্তি ট্রাক ঢুকছে। পাড়ায় পাড়ায় বাড়ী বাড়ী সার্চ করতেছে। এই কথা শোনার সাথে সাথেই একটু আগে খুলে রাখা বোরকা পড়ে নিয়ে মা কোনমতে ট্রাঙ্ক খুলে টাকা, গয়না নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। কাপড় চোপর আলনার মধ্যে যা ছিল, তাই টেনে নিয়ে বোঁচকা বাঁধে। মা ভেবেছিল, আমাদের পাড়ার ভেতর ঢোকার আগেই মা হামিদ চাচার সাথে বের হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। হামিদ চাচা তখনও কোর্ট থেকে এসে পৌঁছেনি, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের পাড়ার ভেতর মিলিটারী ঢুকে গেছে। পাড়াটা হিন্দুপ্রধান ছিল বলে মিলিটারীরা প্রতি বাড়ীতে ঢুকে ঢুকে সার্চ করছিল। এই সুযোগে হাজী সাহেব আমার মা’কে দাদুর বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেয়।

বেড়ার ঘরের ভেতর বসে মা ঠকঠক করে কাঁপছিল। বাইরে বুটের আওয়াজ শুনে মা’র গলা শুকিয়ে কাঠ। বেড়ার ঘরের দরজায় একটা ছোট লাথি দিলেই দরজা ভেঙ্গে যাবে। মা তো আর ঊর্দু কথা বুঝেনা, তারপরেও হাজী সাহেবের কথা শুনছিল, “কাফের নেহী হ্যায়, মুসলমান হ্যায়”। এতবড় বাড়ী টহল দিয়ে দেখেছে, লাভ হয় নি, সব বাড়ির দরজা তালাবন্ধ, কেউ কোথাও নেই। মিলিটারীরা চলে গেলো। আমার মামা কোথাও লুকিয়ে ছিল, মিলিটারী সরে যেতেই মামা, হামিদ নানা এসে উপস্থিত। তারা শুনে এসেছে, কাছাকাছি কোথায় নাকি এক বাড়ীতেই দুই জনকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। ততক্ষণে আমার মায়ের দেহে প্রাণ ছিল না। ঘরের মজুত খাদ্য বাড়ীওয়ালাকে দিয়ে দিলেন, নিজের সেলাই মেশিন আর ঘরের একটা মাত্র সিলিং ফ্যান মামার বন্ধুর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যস! কিছু টাকা আর গয়না নিয়ে হামিদ চাচার সাথে রওনা হয়ে গেলেন। পথে গাড়ী-রিকশা বন্ধ ছিল বলেই ঘুরপথে, মিলিটারীর চোখ এড়িয়ে ‘হামিদ নানা উনার ‘আম্মারে’ উকিল বাবুর কাছে এনে পৌঁছে দিয়ে যায়। সেদিন থেকে আমরা যারা ছোট ছিলাম, তারা হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম। বুঝে গেলাম, যুদ্ধ কোন খেলা নয়, এর সাথে বাঁচা-মরা জড়িত। মা’ আর একটু হলেই মিলিটারীর কাছে ধরা পড়ে যেতে পারতো, কোনদিন আর ফিরে আসতোনা। এরপর তো সোনারগাঁও থাকার আর কোন যুক্তিই ছিল না। এই ঘটনার সাত দিনের মধ্যেই আমরা ননীবাবুর আশ্রয় ছেড়ে, ননীবাবুর ঠিক করে রাখা দালালের পিছু পিছু রওনা দিয়েছিলাম।