বিভাগের আর্কাইভঃ স্মৃতিকথা

অম্লান স্মৃতিসূধা

৯ই মে, ২০১৮ বিদায় অনুষ্ঠানটি (স্নাতক) জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। দীর্ঘ সময়ের সহপাঠীদের ভালবাসা আর আদর সোহাগে সত্যিই অভিভূত হয়েছি। কত গ্রেডে উন্নীত হয়েছি সেটি আজ গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও মমতায় সিক্ত হয়েছি তা অম্লান। জীবনের এই আনন্দঘন মাহেন্দ্রক্ষণে নিজেকে সত্যি ভাগ্যবান মনে হচ্ছে কারণ, আমার এই স্বল্প পথচলায় যা পেয়েছি তা জীবন প্রবাহ ধারাকে ভবিষ্যত সম্ভাবনায় এগিয়ে যেতে রসদ যোগাবে। যাদের ভালবাসা আর বিনিময়হীন মঙ্গল কামনায় আমার এই গৌরবময় অর্জন সেই প্রিয় মা-বাবা, ভাই, স্বজন আর প্রতিবেশী। যাদেরকে আজ বুক ফুলিয়ে স্বরণ করছি আনন্দের সাথে।
শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি মরহুম আলহাজ্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান-স্যারকে। যার পার্শ্বে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। আজ এই বিজয়ের গল্প তিনি শুনতে পারলে অনেক খুশি হতেন এবং নিজেকে ধন্য মনে করতাম। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান, লে.কর্ণেল. এএফএম খাইরুল বাসার, মোহিত প্রধান, ড. নাজিম উদ্দিন স্যারদ্বয়কে মনে পড়ছে যাদের সহযোগীতায় কর্মে থেকেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

ইউআইটিএস-এর স্কুল অব লিবারেল আর্টস এন্ড সোস্যাল সায়েন্সে (ইউআইটিএস) এর মাননীয় ডিন, এবং আমার প্রিয় সমাজকর্ম বিভাগের সম্মানীত বিভাগীয় প্রধান ড. আরিফাতুল কিবরিয়া ম্যাডাম জীবনে অম্লান হয়ে থাকবেন। যার অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা, মাতৃ আদর আর পিতৃস্নেহ, শাসন, ভালবাসা আর শুভ কামনায় সিক্ত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে বিশ্বজোড়া স্বপ্ন দেখাতে যিনি সর্বদা সাহস দেখিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনে (অনার্স) যাদের পরশ পেয়েছি তারা হলেন- অধ্যাপক ড. কে.এম সাইফুল ইসলাম খান, মোহিত প্রধান, ড. আরিফাতুল কিবরিয়া, জাকিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ড. এস.আর. হিলালী, ড. নাজিম উদ্দিন, নিঝুম ম্যাডাম, সিলভিয়া খৃষ্টীনা গমেজ, তানিয়া তাবাস্সুম তানু, পিংকি দত্ত, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, কাজী তাছলিমা নাসরিণ জেরিণ, ওয়াহিদুর চাঁদ প্রমূখ।

আমার ছোট্ট বেলার প্রিয় বন্ধু সিফাতুল্লাহ। যার সাথে আজও একপথে চলছি। ফার্মেসি বিভাগের বিশ্বজিৎ ভাইকে মিস করছি। যার সাথে সুদীর্ঘ সময় একই বিছানায় রুমমেট হিসেবে থাকার ও ২ সেমিস্টার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। রায়হান, মুসরাত-কেও খুব মিস করব জীবনের চলমান পথে।

আমি যাদের সাথে একই ছাদের নিচে বসে অধ্যায়ন করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রিয় বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দ- অগ্রজ সাদিয়া আপু, জেমি আপু, স্নেহাস্পদ- নাইম, সানজিদা, লিমা, আলমগীর, কামরুন্নাহার, মরিয়ম, শারমিন, সাব্বির, টিশা, নেছার, স্নিগ্ধা, সম্পা, মাহমুদুল হাসান, রাকিব, স্বর্ণালতা (ডি মারিয়া) আর আমার সহপাঠী- মাবেয়া, সিফাত, স্বর্ণা, মিষ্টি-কেও খুব মিস করব।

জীবনের অবুঝ বেলা হতে কণ্টকময় জনাকীর্ণ পথ চলার অসম্ভাব্যতা থেকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেছি। যা সফল হতে অবদান রেখেছেন শিক্ষা জীবনে প্রাইমারী হতে অদ্য পর্যন্ত গুণীজনেরা। সোনাপুরা রেজিঃ বেসঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম বহুবছর পূর্বে। কালাম স্যারের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতো। ফারুক স্যারের বেতের মারের ভয় আজও মনে পড়ে। স্কুলের দুষ্টামি গুলো আজ বড্ড মিস করছি। তৃতীয় শ্রেণীর পর আর সুযোগ হয়নি প্রাইমারিতে পড়ার। অতঃপর চলে আসলাম বাড়ির পার্শ্বে ইবতেদায়ী মাদ্রাসায়। আজ আমি যেই নামে পরিচিত (মোঃ সাইদুর রহমান) এটি দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান স্যার। যিনি আজও আমাকে গ্রামের পথে দেখা হলে বুকে টেনে নেন। আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।

সুবিদখালী দারুস সুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম ২০০৫ সনে। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ্ব আবদুল আযীয নেছারী (রহ.) হুজুরের সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য করতে পেরেছি। মাদ্রাসার বোর্ডিং সুপার এবং স্বনামধন্য শিক্ষা শ্রদ্ধেয় মাওলানা খলিলুর রহমান হুজুরের চোখ রাঙানি আর ভালবাসা আজ অর্জিত গল্পের বিশেষ দাবীদার। কত শিক্ষার্থীকে হারিয়ে যেতে দেখেছি জলজ্যান্ত চোখে। প্রিন্সিপ্যাল হুজুর, মোশারফ ভাই, লতিফ ভাই -কেও আজ শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি। মোশাররফ ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ সময় একত্রে থেকেছি। লতিফ ভাইয়ের অগাধ দয়া করে আমাকে রাইচ মিলের কাজ শিখিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

আশা করি সবার শুভ কামনা নিয়ে এগিয়ে যাবো আগামীর পথে। আর আমাদের অনুজদের জন্যও রইলো আন্তরিক প্রীতি।

গাছ

গাছ

বৃক্ষনিধন নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে স্কুলের একটা দেওয়াল পত্রিকার কথা মনে পড়লো। ওই সংখ্যার বিশেষ বিষয়ই ছিল : ‘গাছ’। পঁচিশটা ছোট ছোট লেখা ছিল। তার থেকে দু- তিনটে পরিবেশন করছি।

(১)
সুমনা ভট্টাচার্য, দশম শ্রেণী, ‘ক’ বিভাগ।
।। এমন বন্ধু আর কে আছে…।।

আমার ঠাম্মারমতই, গাছ এক স্বপাকভোজী প্রাণী। নিজের খাবার নিজে তৈরি করে নেয় তো বটেই, পৃথিবীর তাবৎ প্রানীকুলের প্রত্যেককে খাওয়ানোর দায়িত্ব তার কাঁধে। কেউ যদি ভেজিটেরিয়ান হন, বা মাংসাশী, খাচ্ছেন কিন্তু ‘গাছ’ ই। ভাবছেন, শাকসব্জী বাদ দিয়ে শুধু দুধ- ছানা- মিষ্টি খেয়ে বাঁচবেন? গরু দুধ দেয় তো ঘাস- খড়- খোল খেয়ে। তবে তো দুধ – ছানা – মিষ্টি রূপান্তরিত গাছ মাত্র। মাংসও তাই। মাছ ও তো বেঁচে থাকে জলজ শ্যাওলা – কীট ইত্যাদি খেয়ে, যে গুলোকে অক্সিজেন জুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখে গাছ। কোনো খাবার না খেয়ে শুধু বায়ুভুক হয়ে বেঁচে থাকবেন? অক্সিজেন যোগাবে কে? ওই এক গাছ ছাড়া?

(২)
কিংবদন্তি ঘোষ।দশম শ্রেণি, ‘খ’ বিভাগ
।। মরাগাছ লাখ টাকা।।

মরা গাছ কি ফ্যালনা? সরাসরি জ্বালানী, ভাস্কর্য, ফার্নিচার, দালান কোঠা, মাটির বাড়ি, ছিটেবেড়া কিছুই কি হবে গাছ ছাড়া? ঠাকুমার পুজো হবে মরা চন্দনের গাত্রকর্দম ছাড়া? গলার কন্ঠি, নাকের রসকলি, — সর্বত্রই মরা গাছ। যাগ- যজ্ঞি, হোম- হবিষ্যি,— যাই করো না কেন, মরা গাছ বাদ দিয়ে হবে না।

এখুনি হাতে- গরম কাজে লাগাবার পরেও, উদ্বৃত্ত মরা গাছ বহু যুগের ওপারে গিয়েও জ্বালানি কয়লা, এমন কি হীরে হয়েও মানুষের কাজে লাগে। আমাদের মালিনী ম্যাডামের যে হীরের কানের দুল, সেটাও তো রূপান্তরিত গাছই।
বৃক্ষ উদ্ভুত হীরে- জহরত নিয়ে এ যাবতকাল বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ঘটেছে ইতিহাসে। ইরাকের বুকে আমেরিকা যে কার্পেট – বম্বিং করলো, তারও কারন কিন্তু গাছ। কি বললেন? ওখানে গাছ কম, বালি বেশি?… হতেই পারে। কিন্তু যে তরল সোনার জন্য যুদ্ধটা ঘটল,— তা তো প্রচুর পরিমাণ বিশালাকায় জীবজন্তুর রূপান্তরিত চর্বিমাত্র। এবং জলেই হোক- কি স্থলে, জীবজন্তু মানেই তো ফের সেই গাছ। তাবৎ জীবকুলের প্রাণশক্তির জ্বালানি সাপ্লায়ার।

(৩)
নন্দিনী রায়। দ্বাদশ শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ।
।। একা এবং কয়েকজন।।

গাছ দুই প্রকার।– একা, এবং বোকা। বোকাদের কথাটাই আগে বলি। এরা অকারণে দলবেঁধে, শাখা- প্রশাখা বিস্তার করে, গলাগলি – ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। ঠিক আমাদের ম্যাডামদের মতোই। সময়মত ফুল দেয়- ফল দেয়, অথবা কিচ্ছুটি না দিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচায়। তারপর একদিন ‘টুপুস’ করে মরে যায়। একদিন হাফ ছুটি হয়, কনডোলেন্সে ফিসফাস হয়,
তারপর যে- কে- সেই…. জীবনতরী বহিয়া যায় নিরুদ্দেশের পানে। উদাহরণ হিসেবে ঘাস থেকে শুরু করে জোটবদ্ধ বাঁশ পর্যন্ত আনা যায়। এরা জোটবদ্ধ গাছ। বিপরীতে কেউ কেউ আবার তাল-ঢ্যাংরা লম্বা হয়ে একা একা শুধুই উঠে যেতে থাকে উপরে— উপরে— আরোই উপরে। সম্ভবত অন্যদের উপরে নজরদারির সুবিধের জন্যে, ঠিক যেমন আমাদের হেডম্যাম্। এই জাতীয় গাছের উদাহরন– নারকেল, তাল, সুপারি ইত্যাদি। আম- জামের মতন হাত বাড়িয়ে পাড়বেন, আর টুপ করে মুখে ফেলে দেবেন, অতটি সহজ কম্ম নয়। এইসব এক – ঠেঙে গাছেদের নিয়ে বিখ্যাত কবিতাটি :
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।

ম্যাডামদের মতোই গাছকে আরো দু- ভাগে ভাগ করা যায়, নিরামিষাশী ও আমিষাশী। খুব কম গাছই আমিষাশী হয়। তাদের গোড়ায় মাছ- মাংস ধোয়া জল, হাড় গুঁড়ো প্রভৃতি খাবার দিতে হয়। কেউ কেউ ম্যাজিশিয়ানের মতো পাথর- কাঁকড় খেয়ে বাঁচে, যেমন ক্যাকটাস। আর সন্ন্যাসীর মতো ‘অর্কিড ‘ শুধু বাতাসেই পরিতৃপ্ত।

(৪)
পূর্ণিমা হেম্ব্রম। অষ্টম শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ।
।। আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ।।

গাছ আমাদের নিকটতম আত্মীয়। বন্ধু, সখা,অভিভাবক।
আমাদের সমাজে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী আমার দিদির বিয়ের সময় আগে- ভাগে এক বট গাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নামমাত্র নয়। রীতিমত বিয়ের সব লোকাচার মেনে,— গায়ে হলুদ, হাতে ধাগা বাঁধা, মালাবদল, কুটুম্ব ভোজন,— আরো কত শত আচার- অনুষ্ঠানে বটবৃক্ষকে জামাই করেছিলেন অভিভাবকরা। আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই ভেবে যে, আমার দিদি বাস্তবে বটবৃক্ষের মতো গুনবান, পরোপকারী, সহনশীল, মাথাউঁচু স্বামীলাভ করবে। ওই যে একটা গান আছে না-
….. বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে,
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে…..

কিন্তু দুঃখের বিষয়, দিদির বিয়ের পরে আমার দিদিটাই রাতারাতি বদলে গিয়ে বৃক্ষের মত সর্বংসহা স্বভাব পেয়ে গেছে।…
… জামাইবাবু নিত্যদিন নেশা করে দিদিকে বড্ড মারে।
ম্যান প্রোপোজেস্, গড ডিসপোজেস্ বলে একটা কথা শুনেছি। সেটাকে কি তার প্রত্যেকটা শব্দ-বর্ণ নিয়ে আমাদের জীবনেই ফলবতী হয়ে উঠতে হয়! দিন পাঁচেক আগে জামাইবাবু সরকারি চাকরিতে বিরাট একটা প্রমোশন পেলেন। সর্ব অর্থে ক্ষমতা তাঁর বেড়ে গেল। দিদির সামনেই অন্য এক মহিলা বিছানার দখল নিল।
আর…. আর গতকাল স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম ঠিকেদারের লোকজন দিদির প্রথম বর নির্বিবাদী বটবৃক্ষকে টুকরো টুকরো করে কেটে চালান করে দিচ্ছে। জাতীয় সড়ক যাবে যে এই গাঁয়ের মাঝবরাবর।

(৫)
আয়েশা খাতুন। একাদশ শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ
।। গাছের আমি – গাছের তুমি।।

কুরান শরীফের সুরা আবাসায় আছে,—–
— হতভাগ্য মানুষ ধ্বংস হোক। সে কত অকৃতজ্ঞ। মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি প্রচুর বারি বর্ষণ করি। অতঃপর আমি ভূমি বিদীর্ণ করি। এবং ওতে আমি শস্য, শাক- সবজি, জয়তুন, খেজুর — বহু বৃক্ষ বিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদির খাদ্য উৎপন্ন করি।—-
অর্থাৎ আল্লাতালা মানুষ ও অন্যান্য জীবজগতের জন্য যাবতীয় বৃক্ষ সকল সৃষ্টি করেছেন। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে সে কারনেই গাছ বহু প্রকার, প্রায় মানুষের মতোই। লম্বা, বেঁটে, সাদা, বাদামী, সবুজ, হলুূদ ইত্যাদি। স্বভাবও মানুষের মতো বহুবিধ। উপকারী, অনিষ্টকর, সাহসী, ভীতু, ঝগড়ুটে, পাজি, ছিঁচকাঁদুনে ইত্যাদি। উদাহরণ :

সাহসী : বট, অশ্বত্থ, পাকুর ইত্যাদি। শত – সহস্র ঝড়- ঝাপটা মাথা উঁচিয়ে- বুকচিতিয়ে পার করে দেয়। এদের হেলানো- দোলানো শক্ত।

উপকারী : প্রায় সব্বাই। ৯৯.৯৯%।
অনিষ্টকর : পার্থেনিয়াম ও তার সগোত্রীয়।
সাইলেন্ট কিলার।
ঝগড়ুটে : কুল, বাবলা, ধানি লঙ্কা। আঁচড়ে- কামড়ে-ঝালে- ঝাঁঝে- কন্টকে জীবন জেরবার করে দেয়।
ভীতু- লাজুক : লজ্জাবতী লতা।
পাজি : জলবিছুটি, আলাকুশি।
আমিষাশী : পাতাঝাঁঝি, সূর্য শিশির, কলসপত্রী।
ছিঁচকাঁদুনে : উইপিং ট্রি।সার্থকনামা।

একটা অতি পরিচিত ধাঁধাঁ দিয়ে শেষ করি :

আল্লার কী কুদরত্
লাঠির ভিতর শরবৎ।

… কি, পেটে আসছে মুখে আসছে না? ভেরি ভেরি সিম্পল্। —- ‘ আখ’।

(৬)
তৃণা বসু। একাদশ শ্রেণি, ‘ খ ‘ বিভাগ।
।। গাছ দিয়ে যায় চেনা।।

আদ্যিকাল থেকেই গাছ খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্রও যুগিয়ে আসছে। মানুষের ভাত- কাপড়ের দায়িত্বে একমাত্র গাছ ই। যেকোন পরিধেয়, – তা বল্কল থেকে বেনারসি যাই হোক না কেন, রকমফেরে তা গাছই। সিন্থেটিক পরবেন? তারও তো উৎসমূলে গাছ ই। মূল উপাদান রবার তো গাছেই ফলে। গাছ হল একটা প্যারামিটার, — যা দিয়ে আপনি ঠাহর করতে পারবেন মানুষের সামাজিক তথা অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস্।

যার সব আছে,বেশি বেশি আছে,তারচে’ বেশি আছে,পেট যার কাছে আতঙ্ক নয়, তার বাড়িতে শোভা পায় দুর্মূল্য বাহারি গাছ, পাথরকুচি, অর্কিড। সে সব গাছেদের ফুল- ফল না থাকলেও চলে। টাকার গরমে বৃহৎ বৃক্ষকে ফল- ফুল সমেত ‘বামন’ বানিয়ে বনসাই শিল্পের তকমা দেয়া চলে। একধাপ নিচে এসে দেখুন, মধ্যবিত্ত পরিবার, যাদের নিত্যি উনুন জ্বেলে রাখাটাই সাধনা, এবং তার সঙ্গে আছে শিল্প – সংস্কৃতির প্রজন্মবাহী বাতিক, তাদের বাড়ির সামনে ফুলগাছ, তো পিছনে কিচেন- গার্ডেন। পেট ও হৃদয়ের দূরত্ব খুব কিছু বেশি নয় এখনো।

আরো একধাপ নিচে এলে দেখা পাবো যাদের, তাদের পুরো পৃথিবীটাই পেট আর পেটময়। যাবজ্জীবন পেটাতঙ্কই সম্বল। জীবনের সামনে- পেছনে, আগে- পরে সমস্ত মাটি জুড়ে শুধুই পুঁই, ঢ্যাঁড়শ, মানকচু, চিচিংগে, ধুঁধুল গাছের মেলা। আর শুধু মাটি কেন, ছিটেবেড়ার দেওয়াল, খড়ের চাল, সব- স- ব ঢাকা পড়ে থাকে লাউ – কুমড়োর ফল- ফুল – পাতাতে। লক্ষ্যটা অবশ্যই ফল লাভের। তবে ফুলও যদি ফোটায় তবে তা বকফুল, বা টগরফুল, বা কুমড়োফুল, যা অনায়াসে উদরে চালান দেওয়া যাবে।

সবশেষ স্তরে যাকে পাবেন, যার ঘরবাড়ি – অন্নবস্ত্র কিছুমাত্র নেই, সেই সর্বহারার ও সম্বল বলতে স্রেফ ওই গাছ। সব হারালে শেষকালে তো গাছতলাটাই আশ্রয়।

আমার ছেলেবেলার ঈদ


একটু ছোট্ট ভুমিকাঃ জীবনে যে কত দেশের কত শহরে ঈদ করেছি সে অনেকের কাছে বিস্ময় বলে মনে হবে। এর মধ্যে একটা মজার ঘটনা বলি। ঈদের আগের দিন জাহাজ দুবাই এসেছে, গেটের বাইরে এসে দেখি কাছেই ঈদ গাহ। বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম কাল তা হলে এখানে ঈদের নামাজ পড়ব। সকালে উঠে যথারীতি গোসল করে কাপড় চোপর পরে চলে এলাম মাঠে কিন্তু কোন প্রাণীর চিহ্ন নেই, নেই, নেই! কি ব্যাপার? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মহসীন বলল চল গেটের সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে দেখি কখন জামাত হবে। সিকিউরিটি বির দর্পে জানাল আরে তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ? জামাত তো ফজরের নামাজের পরেই হয়ে গেছে এখানে ঈদের নামাজ পড়তে চাইলে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যাও যাও জাহাজে ফিরে যাও। সবাই মনে একটু দুঃখ নিয়ে জাহাজে ফিরে এসেছিলাম। এছাড়া করাচী, বাহরাইন, ইরান, অক্সফোর্ড, গ্লস্টার, বার্মিংহাম, লেস্টার, লন্ডন, কার্ডিফ, নিউক্যাসেল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা, ঢাকা অন্তত এই শহর গুলিতে ঈদ করেছি বলে মনে পরছে।

আমার ছেলেবেলার সব ঈদ নির্দিষ্ট কোন শহর বা এলাকায় কাটেনি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে তাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশের নানা জায়গায় থাকতে হয়েছে। এই সুবাদে মানিকগঞ্জের ঝিটকার পাশে আমাদের নিজ গ্রামে নিজ বংশের আত্মীয় স্বজনের সাথে এবং ধামরাইর পাশেই নানা বাড়িতেও কয়েক বার ঈদ করার সুযোগ পেয়েছি।
তখনকার ঈদ এবং আজকালের ঈদের মধ্যে কোথায় যেন একটু ভিন্নতা লক্ষ করি। তখন ছিল নিছক অনাবিল আনন্দের ঈদ আর আজকাল কেমন যেন পোশাকি একটা অনুষ্ঠানের মত মনে হয়। তখন আমরা যে আনন্দ পেয়েছি তা আজ কাল ছেলে মেয়েরা পায় কিনা বলতে পারব না। তবে এমনও হতে পারে যে আজকাল ঈদের বা অন্য যে কোন আনন্দের সংজ্ঞাও বদলে গেছে।

তখন আমার বাবা এমন কোন চাকরী করতেন না যে তিনি প্রতি ঈদেই নতুন জামা কাপড় দিতে পেরেছেন। পুরনো যা আছে দেখেছি মা তাই সুন্দর করে ধুয়ে কয়লার ইস্ত্রি দিয়ে ইস্ত্রি করে তুলে রাখতেন নামাজ পরতে যাবার সময় গায়ে দেবার জন্য। এবং এ নিয়ে আমাদের কখনো মাথা ঘামাতে হবে এমন করে ভাবতে শিখিনি। শীত কালে ঈদ হলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম গোসলের জন্য মা পানি গরম করে রেখেছেন। আগেই কিনে আনা সুগন্ধি সাবান নিয়ে বাবা আমাদের ভাই বোনদের একে একে নিয়ে বাথ রুমে ঢুকতেন আর ডলে ডলে গরম পানি সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতেন। গোসল হলে মা আবার ওই সব কাপড় গায়ে দিয়ে আতর মেখে দিতেন।
ওই সময়ে আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু হতো রোজার শুরু যেদিন হতো সে দিন থেকেই। বাড়িতে মায়ের কোন সাহায্যকারী ছিল না এমনকি আমার কোন বড় বোনও ছিল না তাই মাকে সাহায্য করতে হতো আমাকেই। অন্যান্য ভাই বোনেরা বেশ ছোটই ছিল।

তখন আবার এখনকার মত চাকুরী জীবী দের উৎসব ভাতা বলে কিছু ছিল না যা দিয়ে ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে পারতেন। তখন যা পেতেন তা হচ্ছে যে মাসে ঈদ হচ্ছে সেই মাসের বা তার পরের মাসের অগ্রিম বেতন। যাই হোক বাবাকে দেখেছি যে বছর আমাদের জন্য নতুন জামা জুতা কিনবেন তখন দাম বেড়ে যাবার আগেই রোজার শুরুতে আমাদের সাথে নিয়ে বাজার থেকে কাপড় কিনে আনতেন আর তাই কেটে মা নিজে সেলাই করে নিতেন। মেশিনে সুতা লাগিয়ে দেয়া বা কোন সেলাই ভুল হলে তা খুলে দেয়ার কাজটা মা আমাকে দিয়েই করাতেন। ফলে যা হবার তাই হোল। আমি নিজেও এক সময় মার মত কেমন করে যেন কাপড় চোপর কাটি কুটি থেকে সেলাই করা সব শিখে ফেললাম। মা যখন ফিতা ধরে গায়ের মাপ নিতেন তখন থেকেই নতুন কাপড়ের গন্ধ মাখা একটা রোমাঞ্চ অনুভব করেছি। আবার কিছুটা সেলাই করে গায়ের সাথে মিলিয়ে মা দেখে নিতেন সেই তখন থেকেই অস্থিরতায় থাকতাম কখন সেলাই শেষ হয়ে জামাটা আমার গায়ে লেগে যাবে। যে দিন মায়ের সেলাই, বোতাম লাগান, বোতামের ঘর কাটা সব শেষ করে গায়ে দিয়ে পরখ করতেন ঈশ তখন যে কি আনন্দ পেতাম তা আজ এই বার্ধক্যের প্রথম প্রান্তে এসে এখনও ভুলতে পারি না। সেলাইর প্রতিটা ফোঁড়ে মায়ের স্নেহ আর যত্নের ছোঁয়ার কি কোন তুলনা হয়? মায়ের নিজে সদ্য তৈরি করা জামা বা প্যান্ট ঠিক ভাবে গায়ে লেগে গেছে দেখে মায়ের মুখের মধুর তৃপ্তি মাখা মৃদু হাসিটা আজও ভুলতে পারি না।

মার ঐ শিক্ষা থেকে আমিও আমার মেয়েদের জন্য এই ব্যবস্থা করেছি। আমার স্ত্রীও এমনি করে নিজের সন্তানদের জন্য নিজে হাতে পোষাক বানিয়ে দিত যখন ওরা ছোট ছিল। কাপড় সেলাই হলে তাতে নানা রকম হাতে কাজ করা এমব্রয়ডারি বা ফেব্রিক পেইন্ট দিয়ে আবার এক ধাপ সাজ সজ্জা দেখতে বেশ লাগত। সেই রেশ ধরে আমার মেয়েরা সেদিন বলছিল আব্বু যতই যা কিনে দাও না কেন সেই যে তুমি আর মা মিলে আমাদের জামা কাপড় বানিয়ে দিতে সে গুলি গায়ে দিয়ে যে আনন্দ পেতাম আজকাল এত দামের এই সব কাপড় গায়ে দিয়েও আর তেমন আনন্দ লাগে না। মেঝ মেয়ের এই কথা শুনে বড় এবং ছোট মেয়ে এক সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠেছিল হ্যাঁ আব্বু মেঝ ঠিক বলেছে!! শুনে কেন যেন আমার চোখ দুটি ভিজে এসেছিল সাথে সাথে ওদের তিন বোনকেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম।
আজকাল দেখি যুগের পরিবর্তনে বাবা মা ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে তৈরি পোষাকের দোকান ঘুরে ঘুরে নামি দামি কোম্পানির লেবেল আটা পছন্দের কাপড় বেছে চড়া দামে কিনছে। এতে আর যাই হোক মায়ের ছোঁয়া মাখা মমতার স্পর্শ কি পায় আজকের এই ছেলে মেয়েরা? আনন্দের প্রথম পশলার ঘাটতি তো এখানেই থেকে যাচ্ছে। এ কথা ভাবার সুযোগ কি হয় যে ঈদের আনন্দের প্রথম অনুভব মায়ের স্পর্শ আমার সাথেই আমার গায়ে লেগে রয়েছে? নাকি দামী ফ্যাশন কোম্পানির লেবেল লাগানো পোষাক মায়ের বিকল্প স্বাদ দিতে পেরেছে জানি না।

এর পর আসছি খাবার দাবারে। রোজার শুরু থেকেই মাকে দেখতাম সামান্য একটু করে ময়দা মেখে হাতে নিয়ে চিমটি কেটে দুই আঙ্গুলে ডলে জিরার আকারে এক রকম সেমাই বানাতেন আমাদের মানিকগঞ্জের ভাষায় এই সেমাইর নাম যবদানা। অবসরে বেশ কয়েক দিন ধরে বানিয়ে জমা করে রোদে শুকিয়ে কাচের বয়াম ভরে রেখে দিতেন। ঈদের দিন সকালে এই যবদানা ঘিয়ে একটু ভেজে সেমাইর মত কি করে যেন রান্না করতেন আমার খুবই প্রিয় সেমাই ছিল এটা। সারা রোজা ভরে পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতার বিলি করতেন আর সেই ইফতার সাজান খঞ্চা বা ট্রে সুন্দর মায়ের হাতে কাজ করা একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে আমার হাতে দিয়ে বলে দিতেন যা এটা ওদের বাড়ি দিয়ে আয়। এ ভাবে এক এক করে এলাকার প্রতিটা বাড়িতেই দেয়া হতো। মাঝে মাঝে এর মধ্যে আমার বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে আগে বা একটু বিশেষ আয়োজন করে দেয়ার জন্য আমি আবার বায়না ধরতাম। আবার ওই সব বাড়ি থেকেও একেক দিন বা কোন দিন এক সাথে কয়েক বাড়ি থেকেও ইফতার আসত।

আবার বাবার কলিগ বা বন্ধুদের বাবা ইফতার করার জন্য দাওয়াত করতেন তাদের বাড়ি যেতাম। আমাদের বাসায় ও তারা আসতেন। এই দিন গুলিতে ছিল আনন্দের আর এক মাত্রা। তবে একটু দূরে কোথাও হলে তারাবীর নামাজে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে বাবা দূরে কোথাও যেতে চাইতেন না।
রোজার শেষ দিনে ইফতারি করেই বের হতাম বাসার বাইরে বন্ধুদের সাথে চাঁদ দেখতে। চাঁদ দেখা গেলে সে কি আনন্দ চিৎকার! চিৎকার করতে করতেই বাসায় আসতাম, “মা মা চাঁদ দেখেছি, কাল ঈদ হবে” কই দেখি বলে মা বাবাও বের হতেন। চাঁদ দেখেই বাবা ব্যাগ নিয়ে বের হতেন বাজারে সাথে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন। মাংস, চাউল, সেমাই, বাদাম ইত্যাদি নানা কিছু যা যা মা একটা লিস্টে লিখে দিয়েছেন তাই দেখে লিস্টের সাথে মিলিয়ে বাবা এক এক করে কিনে নিতেন। ফিরে এসে দেখতাম সারা মহল্লায় মশলা বাটার ধুম। তখন আবার এখনকার মত ঘরে ঘরে ফ্রিজ নামক ঠাণ্ডা আলমারি ছিল না। আদা, রসুন সহ নানা মশলার গন্ধে বাসায় ঈদ শুরু হয়ে যেত এখন থেকেই। অনেক রাত অবধি মা নানা পদ রান্না করে রাখতেন। আমিও পাশে বসে থাকতাম। মা কে এটা ওটা এগিয়ে দিতাম কিংবা অন্তত ছোট ভাই বোনকে সামলাতাম। সে যে কি আনন্দ তা কি আর শুধু ভাষায় প্রকাশ করা যায়? এ যে শুধুই অনুভবের, একান্ত হৃদয়ের গভীরের অনুভূতি। হাসিতে উজ্জ্বল মায়ের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের ঝিলি মিলি কি আর কিছুতে পাওয়া যায়? সে যে এক স্বর্গীয় আনন্দ।

ঈদের সকালে সেমাই, ক্ষীর বা পায়েস বা ফিরনি আর গোরুর মাংস এবং খিচুড়ি, নামাজ পরে এসে দেখতাম মা সব রান্না বান্না শেষ করে গোসল করে নতুন শাড়ী থাকলে তাই পরে থাকতেন। এসেই আগে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবাকে সালাম করতাম পরে বাবার সাথে ভাইয়ের সাথে কোলা কুলি। এবার বাবা কিছু টাকা দিতেন সারা দিন ধরে ইচ্ছে মত খরচ করার জন্য। নামাজের মাঠে সবার সাথেই কোলাকুলি করে এসেছি।

নামাজ সেরে এসে আবার পোলাও মাংস খেয়ে বের হতাম মহল্লায় সব বাসায় চাচীদেরকে সালাম করতে। সেখানেও কিছু খেতে হতো। সারাটা দিনই বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি এটা ওটা দেখা। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে চোখে ঘুমের রেশ নিয়ে বাসায় ফিরে এলে মায়ের এক পশলা মিষ্টি বকুনি হজম করে বাথরুমে ভরা বালতিতে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে মায়ের আচল দিয়ে হাত মুখ মুছতাম। মা আবার আর এক দফা বকে রাতের খাবার আয়োজন করতেন রাতে সাধারণত বিরিয়ানি হতো।
সারা দিন বাসায় কে এলো বা মা বাবা কোথায় গেছেন কিছুই জানতাম না। বাবা, ছোট ভাই বোন সবাই মিলে খেয়ে দেয়ে সাথে সাথেই এত কাঙ্ক্ষিত মহা আনন্দের ঈদের সমাপ্তি ঘটিয়ে বিছানায় শুয়ে পরতাম। সারা দিনের ফিরিস্তি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরতাম কিছুই টের পেতাম না। আজ ভাবি আহা অমন ঈদ যদি আমাদের ছেলে মেয়েরা দেখতে পেত!

জীবনের টুকরো গল্প

আজ অনেকদিন পর চারুবাবুর মোড় পেরিয়ে পুবে যেতে যেতে উত্তরে দৃষ্টি গেল। হায় সেই পুরোনো দালানগুলো নেই। দূরে কালি মন্দির একাকী দাঁড়িয়ে আছে শুধু। রতন দাশ’এর কথা মনে পড়ে গেল। তখন স্কুলের শেষের দিক, মাথায় বেঞ্জু বাজানোর ঝোঁক চেপে বসেছে। রেলবাজার-বড়বন্দর থেকে ভারতের ম্যামোলা কোম্পানি’র একটি বেঞ্জু কিনেছি। ডানহাতে টিংটিং শব্দ হলে বাঁ-হাতের রীড থেমে যায়। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেই সমস্যা দূর হলো বটে, কিন্তু পরিচিত গানের সুর তুলতে পারি না। একদিন চকবাজারে বসবাসকারি সহপাঠি বীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলল, –

‘রতন দাশ’এর সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব, ও কিন্তু যে-কোনো গান শুনেই সুর তুলতে পারে।’

একদিন সত্যি সত্যি রতন দাশ’এর কাছে থেকে স্বরলিপি লিখে নিতে শুরু করলাম। ডায়রির পাতা স্বরলিপিতে ভরে উঠল। তারপর একদিন রতন দাশ আমার কাছে শেখা শুরু করল। সেই রতন দাশ নেই। কোথায় গেছে জানি না। তবু তার কথা মনে পড়ল। কেননা রতন দাশ শেষে আমার সিনিয়র বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শ পচাত্তর’এর কোনো এক সময়ে জেলা অডিটরিয়ামে প্রোগ্রাম শেষে রতন দাশ বলল, –

‘যে গান বাজালি তার স্বরলিপি লিখে দিস্ তো।‘

লিখে দিয়েছিলাম খুব যত্ন করে। তারপর জীবন আর পৃথিবীর বুকে খুদ কুড়োতে কুড়োতে কোথায় হারিয়ে গেছে আমার সাধের সুর আর স্বরলিপি মনে নেই। আজ দুচোখ ভিজে উঠল। হায় কি আনন্দের ছিল দিনগুলো! আর আজ…? রতন দাশ’কে একবার পেলে বলতাম, আমার গানের স্বরলিপি অচেনা হয়ে গেছে বন্ধু।

(১৩.৪.১৫)

আমি এবং আমার বাবা


আমার বাবা ৮/১০টা বাবা থেকে আলাদা। একেবারেই আলাদা। বাবার মতো জনদরদী এমন মানুষ খুজে পাওয়া কষ্ট হবে। জন্মের পর থেকেই যাকে আপন বলে জানতাম তা হলো মায়ের পরে বাবা। বাবার আদর ভালোবাসায় আজ আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারছি। আমি আমার বাবার প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান হিসেবে আমি অন্যান্য ভাই-বোনদের থেকে আলাদা আদর পেতাম। জন্মের এক বছরের মাথায় আমি আমার বাবাকে যখন অাধো অাধো বুলিতে আব্বা…আব্বা…বলে ডাকতাম তখন থেকে আমি আমার বাবার প্রিয় ছেলে হয়ে গেলাম। বাবা কোথাও গেলে আমি কেঁদে কেঁদে হয়রান হতাম। বাবাকে একনজর দেখার জন্য আমি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতাম। আর মা তখন আমার খুঁজে পেরেশান হয়ে যেতেন। বাবা বাজারে গেলে তার পিছে পিছে যেতাম। আব্বু… বাজা…ম…জা, আনবেন আধো আধো ভাষায় বলতাম। বাবা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সত্যি সত্যি বাজার থেকে মজা নিয়ে আসতেন। তারপর ধীরে ধীরে যতই বড় হতে লাগলাম ততই আমি বাবার কাছাকাছি চলে আসলাম।
আমার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোন রকম সংসার চালাতেন। আমার বয়স যখন পাঁচ বৎসর তখনই আমার কিছুটা বোধ শক্তি হয়েছে যে, দরিদ্র বাবার কাজে আমাকে সহযোগিতা করা উচিত। বাবা যেখানে যেতেন সেখানেই আমাকে নিয়ে যেতেন। আমিও যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। মাঝে মাঝে বাবার সাথে কাজে যেতাম। বাবা হাল চাষ করতেন আমি গরুর পিছে পিছে ছুটতাম। বাবা মই দিতেন। আমি মইয়ে উঠতাম। বাবা ক্ষেত নিড়াতেন আমিও বাবার সাথে ক্ষেত নিড়ানোর জন্য বায়না ধরতাম। তখন বাবা আমাকে ছোট একটা নিড়ি কাচি কিনে দিলেন। আমি মাঝে মাঝে বাবার সাথে ক্ষেত নিড়াতাম। আগাছার পরিবর্তে মাঝে মাঝে ভাল গাছও তুলে ফেলতাম। এ নিয়ে বাবা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দিতেন। তখন আমি কেঁদে ফেলতাম। অমনি বাবা আমাকে আদর করে শিখিয়ে দিতেন। এভাবে দিনে দিনে বড় হতে লাগলাম। আর বাবার সাথে থেকে থেকে কৃষি কাজ শিখে ফেললাম।
আমি একদিন বায়না ধরলাম আমাকে একটি ছাগল কিনে দেয়ার জন্য। বাবা আমার আবদার রক্ষা করলেন। তবে টাকার অভাবে ছাগল কিনে দিতে পারেন নি। ভাগী এনে দিলেন। এতেই আমি খুশি। মাঝে মাঝে বাবা আমাকে স্কুলে যাওয়ার কথা বলতেন। স্কুলের কথা বললেই আমি ছাগল নিয়ে চড়ে চলে যেতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিরাট বড় এক চড়। যেখানে আমার বয়সের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে গরু-ছাগল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে যেত। আমিও সেখানে চলে যেতাম। ছাগল আলগা ছেড়ে দিয়ে ডাংগুলি, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউছি, হাডুডু ইত্যাদি খেলা খেলতাম। এই দেখে আমার মা খুব চিন্তিত ছিলেন। অর্থের অভাবে বাবা ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। আর সামনে এগুতে পারেননি। তারপর সংসার জীবন শুরু করে অভাবের সংসারের গ্লানি টেনে যাচ্ছেন। এখন আমিও যদি বাবার মতো কৃষক হয় তাহলে কিভাবে এই দেশ জাতি উন্নতি করবে। সবসময় মা আমার লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। একদিন আমার পড়াশুনা নিয়ে বাবার সাথে মায়ের ঝগড়া হয়।
মা বলেন, আপনি নিজেও লেখাপড়া করেননি। ছেলেকেও লেখাপড়ার শিখানোর মতো আগ্রহ দেখাননি।
বাবা বলেন, আমিতো তাকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার কথা বলি না গেলে কি করব।
তারপর একদিন বাবা আমাকে নিয়ে রাতের বেলা পড়াতে বসলেন। আমি পড়া পারছিলাম না। এইজন্য আমাকে অনেক শাষন করলেন। সেইদিন থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি লেখাপড়া করব। মানুষের মত মানুষ হব। আমাদের সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনব। তারপর থেকে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করলাম। বাবার কাজেও মাঝে মাঝে সহযোগিতা করতে লাগলাম। প্রতিদিন রাতে মায়ের সাথে বসে পড়তাম। বাবা মাঝে মাঝে আমার পড়া নিতেন। বছরের শুরুতে বাবা আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। মনযোগ দিয়ে পড়া শুনা করার সুবাধে আমি প্রথম স্থান অধিকার করে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে সেই ক্রমিক নং ক্লাশ টেন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলাম। আমার ছোট তিন ভাই ও এক বোন ছিল। তারাও আমার সাথে লেখাপড়ায় যোগ দিল।
বাবা একদিন ভাবলেন এভাবে দিনমজুরী করে সংসার চালিয়ে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করানো সম্ভব না। তাই তিনি জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে। আমি তখন ক্লাশ থ্রীতে পড়াশুনা করি। আমি বাবাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে গেলাম। সকাল আটটায় বাবার ফ্লাইট। সাতটা সময় বাবা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বিদায় বেলা বাবা আমার গলায় জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, দোয়া কর বাবা, আমাদের আর অভাব থাকবে না। ভাল করে লেখাপড়া করিও ছোট ভাই-বোনদেরকে আদর করিও। তারপর বাবা চলেন গেলেন এয়ারপোর্টের ভিতরে। আমার মন তখন বাবার জন্য কাঁদছিল। বাবা যখন বিমানে উঠে আমি তখন তাকিয়ে দেখছিলাম। বাবা হাত নাড়িয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে বিমানের ভেতর চলে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পর বিমান আকাশের দিকে উড়তে লাগল। যতক্ষণ খালি চোখে বিমান দেখা গিয়েছিল ততক্ষণ আমি বিমানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সেই সময় বাংলাদেশে কোন মোবাইল ছিলনা যে ইচ্ছে করলেই বাবার সাথে যখন তখন কথা বলতে পারবো। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। বাবার বিদেশ যাওয়ার আঠার দিন পর আমাদের কাছে একটি চিঠি আসে। বাবা ঠিক মত গিয়েছে কিনা সেই খবরটি জানার জন্য একটি চিঠির অপেক্ষায় আমরা পুরো পরিবার আঠার দিন অপেক্ষায় ছিলাম।
বিদেশ যাওয়ার ১ সাপ্তাহ পর থেকেই প্রতিদিন আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতাম আমাদের কোন চিঠি আসছে কিনা। পোস্ট অফিসে প্রতিদিন দুপুর ১২:০০ টায় আমাদের আশ পাশের যত এলাকা আছে সব এলাকার মানুষ ভিড় করত। কারণ তখন প্রতিদিন এই সময়ে পিয়ন সকল চিঠির প্রাপকের নাম ধরে ডাকত। প্রাপক সেখানে উপস্থিত থাকলে চিঠি দিয়ে দিত। উপস্থিত না থাকলে পরদিন আবার নতুন চিঠির সাথে পুরানো প্রাপকের নাম ধরে ডাকত। এভাবে পর পর তিনদিন ডাকার পরও প্রাপককে না পেলে পিয়ন ঠিকানামত বাড়িতে আসত। আর বাড়িতে আসলে পিয়নকে বকশিস দিতে হতো। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে প্রাবাসী আছে তাদের বাড়িতে পিয়ন আসলে আশে পাশের বাড়ির সব লোক এসে ভিড় করত। ১৮তম দিনে আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে বাবার সেই চিঠিটি হাতে নিলাম। একটি চিঠি একটি খবর। সেই খবরটি জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম। দ্রুত বাড়িতে আসলাম। চিঠি খুলে দেখি দুটো চিঠি লেখা। একটি মায়ের কাছে ও একটি আমার কাছে। মায়ের চিঠিটি মাকে পড়ে শুনালাম। বাবা ঠিকমত পৌঁছেছে এ খবর জানতে পেরে মা নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করলেন। বাবা আমার কাছে যে চিঠিটি পাঠিয়েছিল সেটি ছিল-
স্নেহের আমির
সর্ব প্রথমে আমার হাজার হাজার সালাম ও দোয়া নিও। আশা করি আল্লাহর রহমতে তোমার শরীর ভাল। আমি তোমাদের দোয়ার বরকতে এক প্রকার ভাল আছি।
পরসংবাদ এই যে, বাবা আমির আমি ১০ মে বিকাল ৫টায় ঠিকমত ওমান এসে পৌঁছেছি। চাকরী এখনও পাইনি। দোয়া করিও যাতে সুস্থ্য শরীর নিয়ে কাজ করতে পারি। সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছে তোমাদেরকে ছেড়ে আসতে। কিন্তু কি করব বাবা অভাবের তাড়নায় তোমাদের সুখের জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তোমাদের চোখের আড়ালে চলে আসলাম। আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না। আব্বার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করিও। আমাদের আর অভাব থাকবে না। ঠিকমত লেখাপড়া করিও। জীবনে বড় হতে হলে লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই। ছোট ভাইবোনদেরকে আদর করিও। মায়ের কথামত চলিও। তোমার মাকে আমার সালাম দিও। দাদা-দাদীকে আমার সালাম দিও। তোমার ভাইবোনদেরকে আমার স্নেহ দিও। আমার চিঠির উত্তর দিও। এই বলে এখানেই শেষ করলাম। খোদা হাফেজ।
ইতি তোমার বাবা
ওমান

বাবা দীর্ঘ আঠার বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাস জীবন কাটিয়ে এখন তিনি বাড়িতে। আমি এখন বড় হয়েছি। লেখাপড়া শেষ করেছি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। বাবাকে হজ্জ্ব করিয়ে এনেছি। বাবাকে বলছি বাবা আপনি আর কোন কাজ করবেন না। এখন আপনি নাতী-নাতনীদের নিয়ে বাকি জীবন সুখে শান্তিতে কাটাবেন।

ভাল থেকো তুমি স্বর্গ সুখে… এখনো আমরা তোমার সমাধীর সন্ধানে…

১ ২ ৩ এভাবে ৪৬ বছর…
তুমি নেই…
আজ ১৩ ডিসেম্বর…
আজকের দিনে স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্নে বিভোর হয়ে সম্মুখ লড়াইয়ে…
সেই যে হারালে… ফিরলে না কখনই
২৭ ডিসেম্বর এলে দুই বছর হবে, তোমার জননী তোমার পথ চেয়ে ক্লান্ত হয়ে পরপারে… তুমি আসো নি।
তোমার দুটো ছবি, এসএসসির সনদ আর অমিল স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে তোমার ভাই বোনেরা।

///শহীদ আশরাফুল ইসলাম ফজলুঃ
মহাদেবপুর উপজেলার বাগাচাড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ৬মে, ১৯৫৩ইং সালে শহীদ আশরাফুল ইসলাম ফজলু’র জন্ম। পিতা. মৃত আছির উদ্দীন, মাতা. আয়েশা খাতুন। পিতার কর্মস্থলের সুবাদে সৈয়দপুরের জি.আর.পি কলোনীতে তাঁর বেড়ে উঠা। ১৯৬৯ইং সালে সৈয়দপুর কয়ানিজপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাশ করেন। চার ভাই ও দুইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই ডানপিঠে ছিলেন। সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ছিলো তাঁর অগাধ বিচরণ। নিজে গান, নাটক লিখতেন। মঞ্চ নাটকের সাথেও জড়িত ছিলেন। তৎকালীন কায়দে আজম সরকারী কলেজ সৈয়দপুর, অধ্যয়নরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তার মুক্তিযোদ্ধা নম্বরঃ এফ.এফ-১০৭৫ (ভারত)। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ইয়্যুথ ক্যাম্প ও মধুপুর শিলিগুড়িতে। ৭নং সেক্টরে তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্ণেল নুরুজ্জামান। শহীদ আশরাফুল ইসলাম মধুপুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শি ছিলেন। সেই সূত্রে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিল গঠন করার জন্য সংস্কৃতি কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ব্যক্তি জীবনে সৎ ও নির্ভীক ছিলেন। বদলগাছী, রাঙ্গামাটি, সাপাহার ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় সম্মূখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ৩দিন আগে সাপাহারের আগ্রাদ্বিগুন নামক স্থানে সম্মূখ যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভোরে হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।///

**কংকালসার তামাটে দেহ
শক্ত চোয়াল তীক্ষ্ম চাহনি
নগ্নপায়ে রক্তবর্ণ চোখে,
স্টেনগান হাতে। হঠাৎ শব্দে-
মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে
ট্রিগার টেনে ধরে।
উম্মাদটাও মেতে উঠে
প্রতিশোধের নেশায়,
স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার
-দৃঢ় প্রত্যয়ে।**

ভাল থেকো তুমি স্বর্গ সুখে… এখনো আমরা তোমার সমাধীর সন্ধানে…

সময়ের বৃত্তে বন্দি জীবন

সময় প্রতিটি মানুষের জীবনের সাথে নিবির ভাবে জড়িত। সময়ের ধারাবাহিকতায় জীবন একেক সময় একেক ভাবে তার গতি পাল্টায়। ব্যক্তি জীবনে প্রতিটি মানুষই বিপুল সাহস ও অটল ধৈর্য নিয়ে বাস্তব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-নিরাশা এবং আনন্দ-বেদনায় উত্তাল জীবন-সমুদ্র পাড়ি দেন সময়কে আশ্রয় করে। সময় প্রবাহিত হয় প্রবহমান জীবন-নদীর ধারার মতো। সময়কে কখনোই ধরে রাখা যায় না, এটা প্রবাহিত হয় তার আপন নিয়মে। একটা সময় ছিল তখন ভাবতাম সময়কে কিভাবে পার করব আর এখন সময়ই পাই না পার করার মতো। বর্তমান যাপিত কর্মজীবনের সময়কে পার করার কোন মাধ্যমই পাই না। সকাল থেকে রাত কিভাবে সময় শেষ হয়ে যায় তার স্থির ব্যাখ্যা খুজে পাই না। তবু চলমান বাস্তবতার নিখুঁত বুননে সময়কে ধরে রাখা রপ্ত করি আপন মনে। তাই প্রাত্যহিক জীবনের কর্মভাবনা প্রকাশ পায় ‘কাজের ভিতর। কাজের ভিতর দিয়ে মানুষ তার পরিচয় খুঁজে। ‘মানুষেই সর্বশেষ মানুষই পরমেশ্বরে রূপ নেয়’।

প্রতিদিন ভোরে ফজর নামাজের পরেই শুরু হয় কর্মময় জীবনের পথ চলা। পরিবারের সদস্যদের জন্য নাস্তা তৈরী করা, বাচ্চাদের মসজিদে পাঠানো, মসজিদ থেকে ফিরলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠানো, টিউটরের কাছ থেকে ফিরলে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু হয়। সবার কাজ ঠিক মত করার পর আসে নিজের পালা। কর্মস্থলে যাবার প্রস্তুতি।কর্মস্থল থেকে ফিরে পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না করা, সন্তানদের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা, তারা ফিরে আসলে তাদের খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা।সন্ধ্যার পর পড়তে বসানো আবার রাতের খানার প্রস্তুতি এভাবে চলে সময়ের বৃত্তে ঘুর্ণায়মান জীবনের প্রতিটি কর্মব্যস্ত জীবন। সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন রাতে বিছানায় যাই তখন রাতের বাকী সময়টুকু যেন আর কাটতে চায় না। নির্ঘুম রাত কাটে প্রবাসী স্বামীর ফোনের অপেক্ষায়। যখন কাঙ্খিত ফোন আসে তখন জীবনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সবাই বলে অপেক্ষার প্রহর নাকি দীর্ঘ হয়, আমার মনে হয় অপেক্ষার প্রহর জীবনে কখনো শেষ হয় না। অপেক্ষাতেই নাকি প্রেমের সম্পর্ক বেশী গাঢ় হয়। সে প্রেম শাশ্বত, দেহজ কামনা বাসনার বাইরে, শুধু শারীরিক প্রেম নয়। যা ব্যক্তিমানুষের শারীরিক বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিমনে হাহাকার আর আত্মসাধনার জন্মই দেয়। নশ্বর বিশ্বচরাচরে শরীরের মত প্রেমেও ক্ষয় আছে এবং সে ক্ষয় কালক্রমে অনুতাপ ও পাপবোধের জন্ম দেয়। যেটা কারো কাম্য নয়। প্রতিটি অপেক্ষমান বিরহী আত্মা প্রেমকে দেখে নারীর সহমর্মিতা, সমবেদনা, পুরুষের আত্মনিবেদনের ভেতর দিয়ে।

আমিও সেটার বাইরের কেউ নই। বরং যাপিত জীবনের যে সুবর্ণ সঞ্চয়, সেখানে যে বাঁক ও তার ঢেউ তাকে আমার জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত হই যে, সময় এবং যৌবন আসলে মানবজীবনের এক পরাক্রমী ক্ষয়িষ্ণু অধ্যায়ের নাম। যেখানে তার অযত্ন ও অবহেলা সেখানে তার রুদ্রমূর্তি। যেখানে তার সযত্ন আসন পাতা সেখানে সে প্রাণবন্ত ও সৌন্দর্যের স্মারক। আসলে কোন বস্তু মানুষের কাছাকাছি থাকলে তার প্রয়োজনটা বুঝা যায় না। সে যখন দুরে থাকে তখন তার প্রয়োজনটা অতি জরুরী হয়ে পড়ে।

তখন স্মৃতিভারাতুর আপন যৌবনের বৈরীরূপ এসে সময়ের স্রোতে সমাহিত হয়, তখন সময়ের বৈরিতায় নিজের উত্তরাধিকারের ভেতর আপন রক্ত ছলকে উঠে; অথচ তাকেই আপন যৌবন কালের সমতলে ও সময়ের আহ্বানে তার প্রাজ্ঞমনের সম্মতি মেলে না। কাটে সম্মতির অপেক্ষায় অযাচিত বৈরী সময়। সময়ের প্রয়োজনে ব্যক্তিমানুষের মস্তিষ্কে যৌনকামনার বিপুল আলোড়নে আভিজাত্য, ঐতিহ্য পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের বিশ্বাসের জগতের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে কামনা ও লাম্পট্যকে প্রায় অভিন্নার্থে গ্রহণ করে। একার্থক বিষয় নিয়ে মানুষের মনোজগতে কোন প্রকার ভাবনার অবস্থান্তর ঘটে না। সময়ই নাকি সব নিয়ন্ত্রন করে। তাই মানবসমাজের মত সময়ের আবর্তে অনুভূতিকে সযত্নে লালন করছি এবং নিজের ভেতর তার পরিচর্যা করছি নিরন্তর। জানিনা কবে এই সময়ের দায়ভার থেকে মুক্তি পাব। সময় যেন আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে সঞ্চরণশীল ও ক্রিয়াশীল সম্ভ্রান্ত রোমান্টিক মানস এবং আধুনিকতার প্রশ্নে সদা প্রচ্ছন্ন। তাই নিজের জীবনোপলব্ধির অভিজ্ঞান থেকেই অপেক্ষার সময়কে ধারণ করে চলছি কর্মসাধনার ভিতর দিয়ে।

বুদ্ধদেব বসুর ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ কাব্যে সময় ভাবনায় নারীর একটি চিরন্তন রূপকে কল্পনা করেছেন। তিনি নারীর স্বাধীন সত্তাকে দৃঢ়চিত্তে প্রতিস্থাপন করেছেন যাতে কোন অপশক্তি, দুঃশাসন নারীর সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই সত্যই তিনি বিশেষ চিত্রকল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেটাকে ধারন করেই কাটে আমার অপেক্ষার সময়। যেন এভাবেই বয়ে যাবে সামনের অনাগত সময়……

যেন ইরাজ আহমেদ এর কাব্য ভাবনার মতে …

এভাবেই তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
গভীর আঁধারে, এভাবেই একদম একা।
আগুনের মতো একা,
নিঃসঙ্গ রাত্রিতে বিভ্রান্ত পাখির ডানার মতো একা।
চোয়ালে, কপালে হেঁটে যায় মাকড়সার সারি।
চমকে সরিয়ে দিতে গিয়ে দেখি আসলে সময়।
একেকটা দিন বাতাসের গায়ে দাগ কাটে,
একেকটা দিন ছাইয়ের মতো জমা হয়ে থাকে,
নখের আড়াল থেকে ঝুর ঝুর করে পড়ে কবরের মাটি।
হাতের মুঠোয় ধরা শুকনো গোলাপ।
দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আসে চোখ,
পুরনো ঘড়িটা হাই তোলে,
পাগলের মতো দুটো হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গে।
একশ বছর ধরে গাঢ় ঘুম,
ঘুম শেষ হয় কবে?
সময় ফুরিয়ে গেলে
এভাবেই তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গভীর আঁধারে
এভাবেই একদম একা।

*******************************
সালমা রহমান
তাং ০৬/০৪/২০১২
নিজ শয়নকক্ষ, জয়পাড়া, দোহার-ঢাকা।

স্মৃতিগুলো মনে পড়ে

স্কুল জীবন শেষ করে আজ কলেজে পা রাখলাম। যাদের সাথে দশটি বছর লেখাপড়া করলাম, তাদেরকে ছেড়ে আসতে খুবই কষ্ট হয়েছে। তবুও আসলাম। তারা কতইনা আপন ছিল আমার। কত জায়গায় ঘুরেছি তাদের সাথে। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কাশেম, নজরুল, আরাফাত ও জয়নাল খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আমার। ক্লাশে একটু ফাঁক পেলেই আড্ডায় মেতে থাকতাম আমরা।
আমি ছিলাম ক্লাসের ফাস্টবয়। সবাই আমাকে ক্লাশের নেতা নির্বাচন করেছিল। আমি যা বলতাম ওরা তা শুনত। যখন কোন অন্যায় দেখতাম তার প্রতিবাদ করতাম। তারা আমার পিছনে থাকত। কখনো পিছপা হতো না। তাইতো আজ কলেজে এসে আমার মনে পড়ে সেই ফেলে আসা বন্ধুদের নিয়ে সোনালী স্মৃতিময় দিনগুলির কথা। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন আমরা ক্লাশের সবাই মিলে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম ঐতিহ্যবাহী সোনার গাঁওয়ে। আমাদের মধ্যে শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন রহিছ স্যার। কাশেম, নজরুল, আরাফাত ও জয়নাল আমরা সব সময় এক সাথে থাকতাম। তাই সেখানে গিয়েও আমাদের পঞ্চজুটি ভাঙ্গেনি। আমার হাতে ছিল ক্যামেরা। গেটে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম একটি পুকুর। এখানে পাঁচ বন্ধু মিলে ছবি তুললাম। তারপর একের পর এক ছবি তুলে সমস্ত ফিল্ম শেষ করলাম। আজও সেই ছবিগুলো দেখলে মনে হয় এখনও বুঝি সেই সোনার গাঁওয়েই আছি।
রহিছ স্যার ছিল আমার প্রিয় স্যার। ওনি আমাকে খুব আদর করতেন। ওনার সাথে সেদিন সোনার গাঁওয়ে যেতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয়েছিল। সেদিন অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সোনার গাঁও থেকে ফিরে আসতে হল। সোনার গাঁও যেন আমাকে বলছে, ‘আশিক আর একটু থেকে যাও।’ তাইতো সেই স্মৃতিগুলোমনে পড়ে আজও।
আমার সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি হলো আমি যখন এস.এস.সি পরীক্ষা দেই তখনকার স্মৃতিটা। আমরা পাঁচ বন্ধু পাশাপাশি সিটে পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার পিছনে ছিল জয়নাল। নবম পরীক্ষার চলছে। তখন বাজে ১২:৪৫ মিনিট। এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট এসে জয়নালকে লক্ষ্য করে বললো, ‘দাঁড়াও’। এ কথা শুনতে পেয়ে আমার শরীর থর থর করে কাপতে লাগল। না জানি আমাকে চেক করে কিনা। তবে আমি ছিলাম নিশ্চিত। কারণ আমার কাছে তখন কোন নকল ছিল না। তারপরও আমার ভয় বেড়েই চলল। এদিকে জয়নালের সমস্ত শরীর চেক করল। তার পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরা পেল। সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে বহিস্কার করে খাতাটা নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। তখন জয়নাল জ্ঞানহারা হয়ে বেঞ্চের উপর পড়ে গেল। থেমে গেল আমাদের কলম। হায়রে নির্মমভাগ্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ জয়নালের মত একটা ভাল ছাত্র বহিস্কার হয়ে গেল। অথচ যারা নকলের উপর ভরসা করে পরীক্ষার হলে আসে তারা দিব্যি পরীক্ষা দিচ্ছে। আমরা খাতা জমা দিয়ে জয়নালকে রূম থেকে বের করে মাথায় পানি দিলাম। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরে এলে ওকে নিয়ে তাদের বাড়িতে আসি। জয়নালের মা ছিল অসুস্থ। ছেলের এ পরিণতির কথা শুনে সাথে সাথে তার মা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেল।
বন্ধু জয়নালের জীবন থেকে খসে গেল একটি রঙিন জীবন। যা আর কখনো ফিরে আসবে না। কলংকের দাগ লেগে গেল সমস্ত শরীরে। বন্ধুর সেই দৃশ্যটার কথা মনে হলে আজও বুকটা ছ্যাত করে উঠে। এসে যায় চোখে জল।
রচনাকাল-এপ্রিল ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।

শাপলা-শালুক


বর্ষা মানেই বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই ঘরে বন্দি হয়ে থাকা। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট-হাট করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কোথাও বের হওয়া যায় না। রাস্তায় হাটুঁ পানি জমে যায়। কাদায় রাস্তা একাকার হয়ে যায়। ক্লাশে যাওয়া যায় না। অফিসে যাওয়া যায় না। দোকানে যাওয়া যায় না। সারাদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে হয়। অবশ্য প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য বর্ষাকাল খুব ভাল। সারাদিন ঘরে বসে ফোনালাপ করা যায়। কবি সাহিত্যিকরা ঘরে বসে গল্প, কবিতা লিখেন। আমি তেমন কোন সাহিত্যিকও নয় যে, এই বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে গল্প, কবিতা লিখে সময়টা পার করব। আর ছোটদের জন্য বর্ষাকালটা আরো ভালো। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে খেলা যায়। বর্ষার পানিতে নেমে সাঁতার খেলা, শাপলা-শালুক কুড়ানো, মাছ ধরা, কলার ভেড়ায় চড়া, নৌকা ভ্রমণ আরো কত কি! বর্ষায় বাংলার মাঠঘাট ডুবে যায়। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা সবই পানিতে টইটুম্বর হয়ে যায়। দূর থেকে পানিতে ভাসমান গ্রামকে দেখে মনে হয় কোন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ডিঙি নৌকায়, কলার ভেলায় চড়ে মানুষ এ বাড়ি ও বাড়ি যায়। দৃশ্যটি বেশ উপভোগের।
আজ সকাল থেকেই মেজাজটা খুব চড়া। সেই কাকডাকা ভোর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো একনাগারে আবার কখনো থেমে থেমে। সে কি বৃষ্টি! বাইরে কিছুই দেখা যায় না। বাইরে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সারাদিন অলসভাবে ঘরে বসে সময় পার করলাম। দোকানেও গেলাম না। কারণ এই বৃষ্টির মধ্যে আমি কষ্ট করে গেলেও কোন ক্রেতা আসবে না। তার চেয়ে বরং ঘরে বসে লুডু খেলায় ভাল। যেই ভাবা সেই কাজ। ছোট বোন মোমেনা, ছোট ভাই রবিউল ও মায়ের সাথে লুডু খেলায় মেঠে উঠলাম। লুডু খেলতে খেলতে কখন যে সন্ধ্যা হলো খেয়াল নেই। এবার লুডু খেলায় বিরতী দিলাম।
পড়ার রুমে গিয়ে বসলাম। জানালা খোলা। এখনও টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের দিকে তাকালাম। চারদিক অন্ধকার। পাশেই কদম গাছে কদম ফুল হাসছে। মনকাড়া হাসি। বাগানে রজনীগন্ধা ফুট ফুটেছে কি মিষ্টি গন্ধ! নাকে লাগে ফুলের সুবাস। এসব দেখে ভাবছি উদাস মনে শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। বর্ষায় ফুটে নানা ফুল। কদম, কেয়া, শাপলা, রজনীগন্ধা, পদ্মা, হাসনাহেনা, কলাবতী, হিজল, চালতা, কলমিলতা, দোলনচাঁপা, নীলকমল, সুলতানচাঁপা, কাঁঠাল চাঁপা, কচুরিপানা, এমন নানা নামের বিচিত্র ফুল। আম, কাঁঠালের মধুর গন্ধ বর্ষায়ও যেন নাকে লেগেই থাকে। ডাহুক, শালিক, কাক, কোকিল, হরেক রকম পাখির কিচিরমিচির ডাকে প্রকৃতি মেতে ওঠে এ বর্ষায়। হাজার রূপে বর্ষার রূপের কথা বলে শেষ করা যায় না।
আউশের ক্ষেতে নেমেছে কৃষক। কাটছে ধান। আঁটি মাথায় ছুটছে কৃষক। বাড়ির পাশে বিল। বিলে শাপলা ফুটে হাসছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা শাপলা-শালুক কুড়িয়ে আনছে। মাছ ধরছে। হাঁসগুলো সাঁতার কাটছে বিলের জলে। বকগুলো বিলের পাড়ে কুচুরী পানার উপর বসে আছে। মাছ ধরে খাচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। বর্ষার আগমনবার্তা জানিয়ে ডাহুক আপন মনে ডাকছে অনেকক্ষণ। দোয়েল শীষ দিচ্ছে। বর্ষার মাঠে সবুজ ধানের শিষগুলো দুলছে আর বর্ষার রূপ কীর্তন গাইছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শালুক কুড়াচ্ছে ডুবাইয়ে। শাপলা তুলছে নৌকায় করে। উদাস করা পল্লীবধূ ঘোমটা পরা রাঙামুখ টেনে ছই নৌকায় বাপের বাড়ি নাইয়র যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা কলকল করে এগিয়ে চলছে। চলতে থাকে আপন মনে। ঘুন টেনে মাঝি যাচ্ছে। কতই না আনন্দ লাগে! আর মাঝি গান গায় ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি ও লালনের গান।
মাথার উপর বিশাল আকাশ ভাসছে। আকাশে কোথাও সূর্য্য নেই। বাতাস বইছে। ফুরফুরে বাতাস। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সারাদিন সূর্য্যরে দেখা নেই। আকাশে জমেছে কালো মেঘ, সাদা মেঘ, ধূসর মেঘ। মেঘের খেলা জমে উঠেছে আকাশে। ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রং বদলায়। স্থির থাকে না মেঘ। ছুটতে থাকে একদিক থেকে অন্যদিক। কেঁদে বুক ভাসায় আকাশ। মেঘের জল বৃষ্টি হয়ে নামে জমিনে। টুপটাপ ঝরে পড়ে বৃষ্টি। বাতাসে শোঁ শোঁ আওয়াজ বইতে থাকে। এই খানে আছে বৃষ্টি, তো অন্যখানে নেই। বিভিন্ন সুরে বৃষ্টি নামে। হৃদয় আকুল হয়ে যায়। কখনো গর্জে উঠে আকাশ। ভয়ে চুরমার হয়ে যায় হৃদয়। মাঝে মাঝে এই মেঘ এই রোদ্দুর। যাকে খেঁকশিয়ালের বিয়ে বলে গ্রামের লোকেরা। বৃষ্টি ভেজা কাদা পথ দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে হয় না। মন ভারী হয়ে যায়। কখন পিচলে পা ফসকে পড়ে যাই। সেবার একবার এক তরুণীর সামনে কাদায় পা পিছলে পড়ে সে কি লজ্জা পেলাম তা কি বলা যায়! স্মৃতিময় বর্ষার দিনগুলো কত মধুর ছিল। তখন বর্ষা মানেই ছিল আনন্দ। আর এখন এই বর্ষা আমার কাছে এক বিরক্তিকর মনে হয়। এখন ভাবি বর্ষা ঋতু না থাকলেই ভাল হতো। অলসভাবে ঘরে বসে থাকতে হতো না।
মনে পড়ছে সেই শৈশবের কথা। তখন আমার বয়স ১০/১১ বছর হবে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে লেখা পড়ায় তেমন মনযোগ ছিল না। সারাক্ষণ টইটই করে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। বনে বাঁদাড়ে ঘুরে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতাম। নাওয়া খাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। বর্ষাকাল আসলে একমূহূর্তও ঘরে বসে থাকতাম না। সেই কাকডাকা ভোরে কিছু খেয়ে বেড়িয়ে যেতাম সন্ধ্যালগ্নে বাড়ি ফিরতাম। সারাদিন শাপলা-শালুক কুড়িয়ে খেতাম। এদেশে বর্ষাকালে নদী-নালা খালবিল জলাশয়ের নিচু জমিতে এমনিতেই জন্মাতো প্রচুর শাপলা শালুক ও ভেট। বাংলাদেশে শাপলার দুটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এর একটিকে শাপলা বলা হয় আর অন্যটিকে শালুক। শালুক পাওয়া যায় এই গাছের মাটির নিচের মূল অংশে। শৈশবে অনেক শালুক কুড়িয়ে আনতাম। শালুক হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, দ্রুত ক্ষুদা নিবারন করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তিও জোগায়। এর মধ্যে শাপলা আবার দুই ধরনের। সাদা ও লাল শাপলা। সাদা শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। আর শালুকের রং নীল। শাপলা শুধু ফুলই নয়। সর্বভুক মানুষ শাপলা খায়ও। এমনও দিন গেছে সারাদিন শাপলা, শালুক ও ভেট খেয়ে দিন পার করেছি। শাপলা খাওয়ার একাধিক পদ্ধতি আছে। এই শাপলা থেকেই হয় একটি চমৎকার খাবার। ফুলের মাঝখানের বোটার উপড়ে অর্থাৎ গর্ভাশয়ে গুড়ি গুড়ি বীজ থাকে। সেটা যখন পেকে যায় তখন তাকে ভেট বলতাম। ছোটবেলায় আঙ্গুল দিয়ে খুটে সেই ভেট থেকে কালো দানাদার বীজ বের করে খেতাম। খেতে খারাপ না। খুব মজা লাগত। কিন্তু সেই ভেট হজম হতো না। বাথরুম করলে সেই ভেটের দানাগুলো আস্তা বের হতো। আর সেই বীজ দিয়ে আরেকটি সুস্বাদু খাবার হয়। নাম ভেটের খৈ। খুব হালকা এই ভেটের খৈ। মাঝে মাঝে এই ভেট বাড়িতে নিয়ে আসতাম। একদিন রেখে দিলে পরদিন এই ভেট থেকে দানা ফেটে সুন্দরভাবে বেরিয়ে আসত। তখন খেতে খুব ভাল লাগত। এই ভেট থেকে দানা বের করে রোদে শুকাতাম। মা আমাদেরকে ভেটের খৈ তৈরি করে খাওয়াতেন। আর শাপলা যেখানে হয় সেখানে যত বেশী পানি থাকে তত লম্বা হয় শাপলার ডাটা। তবে সাধারণত শাপলা গাছ ও ডাটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। নরম কচি আর খসখসে এই ডাটা খালি মুখে কিংবা ঝাল লবণ ও তেতুল মাখিয়ে মুখরোচক সবজী হিসেবে খেতাম। আবার কখনো সবজি হিসেবে মাছ দিয়ে রান্না করে খেতাম। গ্রাম বাংলার অনেকেই চুলকানি এবং রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধী গুন সম্পন্ন এই শাপলা খুঁজে ফেরেন। পানির উপরে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
আমি শৈশবে দেখতাম গ্রামবাংলার বিলে-ঝিলে ও ডোবানালায় এই ফুলের সমারোহ ছিলো চোখে পড়ার মত। কিন্তু বর্তমানে এই শাপলা তেমন বেশি পাওয়া যায় না। প্রকৃতির বিরুপ প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী শাপলা, পানিফল, শালুক আর ভেট আজ তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমানে শাপলা ফুলসহ পানি ফলগুলো যেন হারিয়ে গেছে। এখনও যদি গ্রামে যাই বর্ষায় দুয়েকটা শাপলা হয়তো চোখে পড়ে। জমিতে অতি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শাপলা ফুল। এক সময় বর্ষা মৌসুমে দেশের নদীনালা খালবিল রাস্তার দুপাশে জলাশয়ে ব্যাপকভাবে শাপলা ফুলের মনোরম দৃশ্য দেখা যেত।
হঠাৎ করে কে যেন দরজায় নক করল। শৈশবের স্মৃতি থেকে ফিরে আসলাম বাস্তবে। দেখি ছোট বোন মোমেনা কুপি হাতে পড়ার ঘরের দিকে আসছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত নয়টা বাজে। কখন যে এত রাত হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
– ভাইয়া খাবে না।
– হ্যাঁ খাব। আমি আসছি। তুই যা।
– তাড়াতাড়ি আস ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– আসছি।
বলেই আমি খাবার ঘরে চলে গেলাম। সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। শুরু হলো সুন্দর একটি সোনালি সকাল।
রচনাকাল: ২৭ জুলাই ২০১৪

জল কড়চা

রাজধানী শহর ঢাকাতে বসবাস করেন অথচ আজিকে সন্ধ্যার পরে নিজ নীড় হইতে বাহির হইলেন না, তাহারা ঘরকুনো তো বটেই আমি তো বলিব কাপুরুষও বটে! এমন আনাড়ী বৃষ্টির তুমুল পতনের পরে গুপ্ত প্রকৃতি যে কতটা উন্মুক্ত হইয়াছে তাহা যাহারা আজিকে বাহিরে ছিলেন তাহারাই দর্শন করিয়াছেন এবং সুখের সে বাতাসে অবগাহন করিয়াছেন। টানা বর্ষনের পরে ভূমি উপরিমণ্ডল ছিল কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, বায়ু ছিল নির্মল ও ভরপুর যৌবনবেগ প্রাপ্ত। রাস্তাঘাটে জল কিছুটা জমিয়া ছিল বৈকি তবে বায়ুর তীব্র বেগের সাথে তাল মিলাইয়া সে জল যেন সমুদ্রের ঊর্মীর মতই দোল খাইতেছিল। এমন বাতাস ও জলের উপস্থিতে নগরের রাস্তাঘাট, বাজার, অফিস আদালাত সবকিছুই ছিল শীতল। শীত যে আসি আসি করিতেছে তাহার অন্য আরও একটি লক্ষণ অবশ্য দেখা যাইতেছিল নগরের রাস্তায় রাস্তায়। পিঠা বিক্রেতা ছেলে বৃদ্ধ্বাদের ভ্যান গাড়ি মাটির চুলায় পিঠা সমেত দৃশ্যমান হইতেছিল যায়গায় যায়গায়। ডুবন্ত তেলে ময়দা ভাজিয়া ও সরষে ভর্তাযোগে তাহা পরিবেশনের দৃশ্য ছিল চোখে পরিবার মতই।

রাজপথে ছিল না ট্রাফিকপুলিশের বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততা, ছিল না একতলা কিংবা দ্বিতল বাসের ঘনঘন যাতায়েত। রিক্সার আধিক্য ছিল চোখে পড়িবার মতই। টুং টাং বেলের শব্দে পথঘাট যেন ফিরিয়া গিয়াছিল সত্তর কিংবা আশির দশকেই।

চা প্রিয় বাঙালীর সমস্ত আড্ডা আজ জমিয়াছিল সন্ধ্যার পরে চায়ের দোকানগুলোতে। দোকানিরা আজ চা বানাইতে বানাইতে হিমশিম খাইতেছিল বটে তবে অধিক বিক্রির হেতু উহাদের মনে যে বাড়তি খুশির বাতাস দোল খাইতেছিল তাহার কিছুটা ছাপ চোখেমুখেও দেখা যাইতেছিল। যা খাওয়াইয়া এবং খাইয়া দোকানী ও খরিদদার উভয়েই ছিল বেশ তুষ্ট।

টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে যাহারা নিয়মকরেই খিচুড়ি খাইয়াছেন তাহারা আজ আর খিচুড়ির দিকে না যাইয়া রাত্রের খাবারের মেন্যুতে যোগ করিয়াছেন সবজীর বাহারী পদ। তবে ব্যাচেলদের কারও কারও সাথে কথা বলিয়া জানা গিয়াছে যে তাহারা তাহাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যতালিকায় কোনরূপ পরিবর্তন না আনিয়া আজিকেও ডিম দিয়াই হাত কচলাইয়াছেন।

টানা দুই দিনের সাপ্তাহিক বন্ধ ও যুগপৎ বৃষ্টির এই ছন্দময় পতনে বাস ও মিনিবাস যেমন ছিল প্রায় ফাঁকা তেমনি নগরীর শপিংমলগুলোতেও ছিলনা তেমন কোন হৈহুল্লোড়। তবে আজিকে সন্ধ্যার পরে কিছুটা শোরগোল দেখা যাইতেছিল স্থানে স্থানে। ইহা যে রাজনৈতিক আয়োজন নয় বরং প্রাকৃতিক আহ্বানের ফল তাহা বুঝিতে হইলে ফেলু মিত্তির হইতে হইবে না।

বৃষ্টির হরেক রকম দুর্ভোগের সাথে সবথেকে উল্লেখযোগ্য দুর্ভোগ ছিল রাস্তায় জল জমিয়া গিয়া তাহা সড়ক হইতে নদীতে রূপান্তরিত হওয়া এবং ইন্টারনেট সংযোগ ক্যাবলে জল জমিয়া গতি ধীর হইয়া যাওয়া।
নগরবাসীর তাই আশা, বৃষ্টি যেমন ছুটির দিনে ভালই রোমাঞ্চকতা দিয়াছে তেমনি কর্মময় দিনে যেন বেরসিকতা না ঘটায়। রাত পোহালেই আবার বৃষ্টি হইবে কি হইবে না তাহা জানিবার জন্য আবহাওয়া অফিসের নিকট ধরনা দিতে হইলেও উহাদের উপরে যে জনগন খুব একটা আস্থা রাখিতে পারিতেছেন না তাহা তো সকলেরই জানা কথা। আস্থাটা তাই এবার বাড়িয়া গিয়াছে রেইনকোট ও ছাতা বিক্রেতাদের উপরেই।

– ছবিঃ গুগল

মিনি বিলাই

আমার বালক বয়সে আমাদের বাসায় বিড়াল ছিল। জন্মের পর থেকেই আমি দেইখা আসছি এইগুলাকে। আমরা ‘বিড়াল’ বলতাম না, আমরা বলতাম ‘বিলাই’। আমার আম্মা ডাকত মিনি। বস্তুত আম্মার লাইতেই মিনি বিলাই আমাদের বাসায় থাকত আর বছর বছর তিন চাইরটা কইরা বাচ্চা দিত। তারপর বাচ্চাগুলা বড় হইতে হইতে অন্যান্য বাসায়ে ছড়ায়ে যাইত। আমাদের উঠান বাগান বাসা মিলায়ে প্রায় তিন চারটা বিলাই ঘুইরা বেড়াইত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টা, যেইটারে আমার আম্মা মিনি বইলা ডাকত, থাকত আমাদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি কইরা। বাথরুম করত খাটের তলায়। আর সেই বাথরুম করা নিয়া আব্বার সাথে আম্মার মাঝে মাঝে ঝগড়া হইলেও আম্মার কারনে আব্বা বেশী বেইল পাইত না। কাজের লোক, যাদেরকে আমরা খালা বইলা ডাকতাম, তারা কখনোই বিলাইয়ের গু সাফ করতে চাইত না। কাজটা আম্মারেই করতে হইত। এইটা নিয়া আম্মার কখনো বিরক্তি দেখি নাই।

তো, তখন আমরা, মানে আমি আর আমার বোন ক্লাস থ্রি তে পড়ি মনে হয়, কিংবা ওয়ানে। আমাদের বাংলা বইয়ে একটা গল্প ছিল বিলাই নিয়া। সেইখানে লেখা ছিল, ‘মিনির দুধ খাওয়ার বাটি আছে। মিনি দুধ খায় চুকচুক।’ এইটা পইড়া আমাদের মনে হইল আমাদের মিনির তো আলাদা কোনো বাটি নাই। মিনিরে আমরা যখন যেইখানে পারি মাছের কাটা, বাইচা যাওয়া ভাত খাইতে দেই। তো, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের মিনির জন্য আলাদা বাটি রাখব। বাসার বাটি দিয়া হবে না কারন আমরা বললেই সেইটা মিনির হইয়া যাবে না। অনুমতির ব্যাপার আছে। সংসারে তখন আমাদের কথা কিংবা মতামতের মূল্য নাই। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দিলবাহারওয়ালার কাছ থেকে দুই টাকা দিয়া একটা প্লাস্টিকের বাটি কিনবো। দিলবাহার হইল কটকটি। সারা দেশে যেই জিনিসের নাম কটকটি সেইটারে আমাদের এলাকায় বলত দিলবাহার। এইটা কেন হইল আল্লাহ মালুম। দুই তিন দিন খোঁজ খবর কইরা আমি আর আমার বোন এক টাকা কইরা চাদা দিয়া হলুদ রঙের একটা বাটি কিইনা ফালাইলাম। বাসায় আইসা ঘোষনা দিলাম এইটা মিনির বাটি। এই বাটি বাদে অন্য বাটতে যেন মিনিরে খাবার দেয়া না হয়। শুধু তাই না, সকাল বিকাল খেয়াল রাখতে লাগলাম কেউ যেন এর ব্যত্যয় না ঘটায়। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি আর আমার বোন খেয়াল করলাম বইতে লেখা থাকলেও আমরা মিনিরে দুধ খাইতে দেই না। আমরা গিয়া আম্মারে ধরলাম। আম্মা হাইসা দিয়া মিনিরে মাঝে মাঝে আধা বাটি কইরা দুধ বরাদ্দ দিল। সময় যাইতে থাকল আর আমরাও মিনি আর তার বাটি নিয়া উৎসাহ হারাইয়া ফেললাম। আগের মতই মিনি আর অন্যান্য বিলাই আমাদের বাসায় চইরা বেড়াইতে লাগল।

এরও প্রায় বছর দুইয়েক পরে এক চমৎকার শীতের সিজনে আমরা লক্ষ করলাম আমাদের বাসায় বিলাইয়ের সংখ্যা অত্যধিক বাইড়া গেছে। যখন তখন যেকোন খাবারে মুখ দেয়া, টেবিল থেকে কাচের জিনিসপত্র ফালায়া ভাইংগা ফালানো তাদের প্রাত্যহিক কাজে পরিণত হইল। আমার বড় আপা আর তার বান্ধবীরা মিইলা সিদ্ধান্ত নিল তিনটা বাদে অন্য বিলাইগুলা দূরে গিয়া ফালাইয়া দিয়া আসবে। দূর বলতে প্রায় তিন চার কিলো দূরে খালপাড়ে ফালাইয়া দিয়া আসবে। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা আইসা ভর করল। তো এক সকালে ছোট বড় প্রায় চাইর পাঁচটা বিলাই আমরা বস্তায় ভইরা রওনা হইলাম। আমরা বলতে আপা তার বান্ধবীরা আর সাথে আমরা এলাকার গুরাগারা চার পাঁচজন। রাস্তা দিয়া যাইতেছি, মাঝে মাঝে বিলাইগুলা বস্তার ভিতর থেকে মিঁউমিঁউ কইরা ডাকতেছে। ডাক শুইনা পথচারিরা অবাক হইয়া তাকাইতেছে আর সেইটা দেইখা আপা আর তার বান্ধবীরা মুখে ওড়না দিয়া খিল খিল কইরা হাসতেছে। পিছন থেইকা আমরাও মজা পাইতেছি। প্রায় ঘন্টাদেড়েক হাঁটার পর একটা ফাঁকা এলাকায়, নদীর চরের কাছাকাছি আইসা আমরা বস্তা ফাঁকা কইরা বিলাইগুলারে ফালাইয়া দৌড় দিলাম। করুণ সুরে ডাকতে ডাকতে বিলাইগুলা আমাদের পিছন পিছন কিছুদূর আইসা আস্তে আস্তে পিছায়া পড়ল। আমরা তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় আইসা পড়লাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হইল না। আমরা ফিইরা আসার দুই ঘন্টার মধ্যে সবগুলা বিলাই আমাদের বাসায় আইসা হাজির। যেন কিছুই হয় নাই, এমন ভাব নিয়া তারা হেলতে দুলতে আবার চইরা বেড়াইতে লাগল। আপা আর তার বান্ধবীরা ভাবতে বসল, সমস্যাটা কোথায় ছিল!

তারপর আরো প্রায় এক সপ্তাহ গবেষণা কইরা, এর ওর কাছে আলাপ পাইড়া বোঝা গেল বিলাই ডিরেকশন বুঝতে পারে। এইজন্য যেইটা করতে হবে তা হইল, বস্তার ভিতর ভরার পর বস্তাটারে কয়েকবার ঘুরাইতে হবে। এই কাজ কয়েকবার করতে হবে। বস্তা থেইকা ফালানির আগে একটা রাম ঘুল্লি দিতে হবে। আর সম্ভব হইলে যেই রাস্তা দিয়া নিয়া যাব, ফেরার সময় অন্য রাস্তা দিয়া আসতে হবে।
তো আমরা প্ল্যান মোতাবেক আবার এক শীতের সকালে বিলাইগুলারে বস্তায় ভইরা রওনা হইলাম। এবার আরো দূরে, প্রায় নদীর ধারে এক নির্জন মাটির রাস্তায় বিলাইগুলারে ফালায়া দিয়া আসলাম। আসার সময় ভিন্ন রাস্তা ধইরা ফিরলাম যেন তারা কনফিউজড হইয়া যায়। বাসায় আইসা একটু খেলাধুলা কইরা দুপুরে ভাত খাইতে বসছি, দেখলাম তারা আবারো হাজির। আমাদের চাইরপাশে ঘুইরা বেড়াইতেছে। আম্মা এর মধ্যে লক্ষ করল সব বিলাই আসছে কেবল ছোটোটা ছাড়া। ভাত খাওয়ার পর আমার বোন আইসা আমারে জানাইল, যেই বিলাইটা আসে নাই সেইটা এমনিতেই একটু আদুরে আর অলস। আর ছোট বইলা হয়ত অন্যগুলার সাথে তাল মিলাইতে পারে নাই। কে জানে, সব বিলাই যখন আমাদের মাছের কাঁটা আর ভাত খাইতেছে তখন ওইটা হয়ত এখনো কাইন্দা কাইন্দা মায়েরে খুঁজতেছে। কোথায় যাবে বিলাইটা? একা একা ঘুরতেছে বেচারা। শুইনা আমার কেমন জানি লাগল। এইভাবে তো আমি ভাবি নাই! যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছি সেইখানের আশেপাশে কোনো জনমানব নাই। আর ছোট বইলা ও ত নিজের খাবারও জোগাড় করতে পারবে না। ভাত খাইয়া আমি আর দেরি করলাম না। আমার বন্ধু রাজুরে নিয়া সেই সাদার উপর কালো ফোটাঁওয়ালা বিলাইরে খুঁজতে বাইর হইয়া গেলাম। যাইতে যাইতে খুঁজতেছি আর মাঝে মাঝে মানুষরে জিজ্ঞাসা করতেছি। এইরকম করতে করতে বিকাল নাগাদ যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছিলাম সেইখানে পৌঁছায়া গেলাম। গিয়া ওইটারে আর পাই না। আশেপাশে খুজলাম। ওইখান থেকে বেশ দূরে জাইল্যাদের গ্রামেও খুঁইজা আসলাম। পাইলাম না। খুইজা আবার, যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছিলাম সেখানে গেলাম। রাস্তার ধারে একটা নাম না জানা বড় গাছের নিচে ফালায়া দিছিলাম সেইটার আশেপাশে অনেক খুঁজলাম। শীতের সময়, দ্রুত অন্ধকার হইয়া আসতেছে। সামনেই কিছুদূর পর নদী। তার আশে পাশে শুকায়া থাকা ঘের। ঝোপঝাড়ও নাই যে লুকায়া থাকবে। কিছুক্ষনের মধ্যে অন্ধকার ঘনায়া আসল। পাইলাম না। বিলাইটার কোনো নামও নাই যে ডাক দিব। তবু কয়েকবার মিনি বিলাই মিনি বিলাই কইয়া ডাক দিতে গিয়া দেখলাম গলার কাছে আইসা আটকাইয়া যাইতেছে। অন্ধকার হইয়া যাওয়া সেই সন্ধ্যায় আমার বন্ধু রাজু আমার ঘাড়ে হাত দিয়া বলল, ‘কাইন্দো না মুরাদ, কাইন্দো না’। আমি চোখ মুছতে মুছতে চারদিক অন্ধকার হইয়া গেল। মিনি বিলাইরে আর খুঁইজা পাইলাম না। কিন্তু সেই বালক বয়সে মনের মধ্যে ছাপ রইয়া গেল। বাসায় আইসা আমার বোনরে সব খুইলা বললাম। তার কোনো প্রতিক্রিয়া পাইলাম না। অন্য সবার মত তার কাছেও বিষয়টা গুরুত্ব হারাইছে। কিন্তু আমি মিনি বিলাইরে ভুলতে পারি নাই।

এরপর বিশ বছরেরও অধিক পার হইয়া গেছে। বিস্ময়কর হইলেও সত্য, আমি এখনো হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, সন্ধ্যা নাইমা আসতেছে। লোকালয়হীন নির্জন এক মেঠোপথের এক প্রকান্ড গাছের নিচে বালক বয়সের আমি দাড়ায়া আছি। পশুর নদী গিলা ফেলতেছে সূর্য। আমার গলা অবধি কান্না। চারদিক অন্ধকার হয়া যাইতেছে। আমি কি মিনি বিলাই ছাড়াই ফিইরা যাব? আজতক কোন স্বপ্নেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বপ্নে অন্তত যদি একবার সেই সাদার উপর কালো ফোঁটাওয়ালা আমার মিনি বিলাইরে খুঁইজা পাইতাম, তাইলে আত্মাটা একটু শান্ত হইত।

দাদাকে মনে পড়ে


১৯৯৮ সাল। আজ থেকে ১৯ বছর আগের কথা। তখন আমি ডায়েরি লিখতাম। প্রতিদিনের ঘটনাগুলো প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। এখন আর ডায়েরি লেখা হয় না। দীর্ঘদিন পর ব্যক্তিগত বুকসেলফ খুলতেই আমার প্রথম ডায়েরিটি দেখতে পাই। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে একের পর এক স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকি। হঠাৎ চোখ পড়ে ১৮/১০/১৯৯৮ ইং তারিখের লেখাটির প্রতি। দুয়েক লাইন পড়তেই বুঝতে পারলাম এই দিনটি আমাদের পরিবারের একটি শোকের দিন। এই দিনে আমার দাদা পান্ডব আলী মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলয়ংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংগঠিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায়। এই বন্যার স্থায়ী ছিল এলাকাভেদে ২০-২৫ দিন। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যখন বন্যার পানি আমাদের বাড়ির উঠানে চলে আসে, তখন আমার দাদা বার্ধক্য জনিত অসুখে বিছানায় পড়ে যায়। দিন দিন খাওয়া দাওয়া কমে যায় এবং এক সময় বিছানা থেকে উঠার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
আমাদের গ্রামের কবরস্থান তখন পানির নিচে ডুবে গেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই তখন আশংকা করছে এই অবস্থায় যদি দাদার মৃত্যু হয় তাহলে কোথায় দাফন-কাফন করবেন। সবাই দাদার জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ যেন আমার দাদাকে সুস্থতা দান করেন এবং আর যদি সুস্থতা দান না করেন তাহলে যেন অন্তত বন্যার পানি বাড়ি থেকে সরে গেলে মৃত্যু হয়। আল্লাহ আমাদের আত্মীয় স্বজনদের দোয়া কবুল করছেন। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পরই দাদার মৃত্যু হয়েছে। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
১৯৯৮ সালে আমি রসুলপুর ওসমান মোল্লা ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণীতে পড়ি। এই মাদ্রাসাটি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায় অবস্থিত। আমি তখন রসুলপুর গ্রামে সালাহ উদ্দিন (মোক্তার) সাহেবের বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া করতাম। দীর্ঘ একমাস যাবত দাদা অসুস্থ্য ছিলেন এই খবর আমি জানতাম না। কারণ তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিলো না। ১৯৯৬ সালে এদেশে মোবাইল আসলেও তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোন কেনার মতো সমর্থ ছিলো না। তাই তখন চিঠিই ছিলো একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আর জরুরী খবর লোক মারফত পৌঁছানো হতো।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি দ্রুত বাড়ায় মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। মাদ্রাসা বন্ধ থাকার পরও বন্যার কারণে আমি তখন বাড়িতে যেতে পারিনি। আমি যে ঘরে থাকতাম সেখানেও পানি চলে আসছিল। তখন মনটা খুবই ছটফট করতো। বাড়ির কোন খবরা খবর পাইতাম না। দাদা-দাদি, আম্মা ও ছোট ভাই বোনদেরকে নিয়ে চিন্তা করতাম। কখন পানি কমবে আর কখন বাড়িতে যাব সেই চিন্তায় অস্থির থাকতাম। বন্যার পানি যখন কমে গেল তখন ১৪ অক্টোবর আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাড়িতে এসে দেখি আমাদের বাড়ি থেকে পানি নেমে অনেক নিচে চলে গেছে। আশে পাশের আবাদী জমি কিছুটা শুকিয়ে গেছে।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই আম্মা ও বড় ফুফু আমাকে দেখে কাঁদতে লাগলো। দাদাকে তখন বিছানায় শায়িত দেখলাম। দাদার দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একি দেখছি আমি! আমার দাদার এমন অবস্থা কেন? দাদার শরীর একেবারে কঙ্কাল হয়ে গেছে। মাংস শুকিয়ে চামড়া হাড়ের সাথে মিছে গেছে। শুকনো মাংস থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দাদার কাছে গেলাম। দাদার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দাদা কোন কথা বলতে পারছেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিছু কথা বলতে চাচ্ছেন কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। আমি তখন বুঝতে পারছি দাদা আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কোন কথা শুনছিও না বুঝছিও না। তখন আমার কান্নায় বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। দাদার মুখের কাছে কান নিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করলাম কিন্তু তারপরও কিছু শুনতে পেলাম না। তখন ভাবলাম ওনার কথা আমি বুঝতে না পাড়লেও নিশ্চয় ওনি আমার কথা শুনবেন। আমি তখন দাদাকে বললাম, দাদা আমি আপনাকে জানা অজানায় কত কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি আপনার জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দেন।
দাদা তখন মাথা নাড়ালেন।
কতদিন আগে কোন তারিখে আমি সর্বশেষ বাড়িতে আসছি আর দাদার সাথে কথা বলেছি আমার তখন মনে নেই। দাদার সাথে কথা না বলার আক্ষেপ রয়ে গেল। আম্মার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম দাদা এখন আর শক্ত খাবার খেতে পারেন না। শুধু পানি ও ফলের জোস খেতে পারেন। বিছানা থেকে উঠার ক্ষমতা নেই। তাই বিছানায় প্রশ্রাব-পায়খানা করছেন। দাদার অসুস্থতার পর থেকে আমার আম্মা একাই দাদার সেবা যত্ন করছেন। তবে মাঝে মাঝে আমার ছোট ফুফু দাদাকে দেখে গেছেন। বড় ফুফু মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে এখানে এসে দাদার কাছে ছিলেন। দাদার জন্য তখন নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আল্লাহ যেন দ্রুত আমার দাদাকে আরোগ্য দেন। ইতোমধ্যে দাদার অসুস্থতার খবর শুনে অনেক আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে দেখতে আসেন এবং দাদার জন্য দোয়া করেন।
আমি দুইদিন বাড়িতে ছিলাম। ১৬ অক্টোবর দাদা-দাদি, ফুফু ও আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রসুলপুর চলে আসলাম। বন্যার পর মাদ্রাসা খুললো। তাই পরদিন মাদ্রাসায় যাই। ১৮ অক্টোবর সকাল বেলা ঘুম হতে উঠে পড়তে বসলাম। কেন যেন আজ পড়ায় মন বসছে না। মনটা শুধু ছটফট করছে আর দাদার কথা মনে পড়ছে। ৮টার সময় গোসল করে খাওয়ার পর মাদ্রাসায় গেলাম। মাদ্রাসায় গিয়ে ক্লাস করছি। ৫ম ঘন্টার সময় দপ্তরী এসে আমাকে বললো, আমির তোমার বাড়ি থেকে একজন লোক আসছে তোমার সাথে দেখা করবে। আমি তখন হুজুরের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে দুতলা থেকে নিচে নেমে আসলাম। নিচে আসতেই দেখি আমার কাকা (আব্বার চাচাতো ভাই) মোকার হোসেন ও আমার ছোট ভাই রবিউল্লাহ। তাদেরকে দেখে হঠাৎ চমকে গেলাম। ব্যাপার কি পরশু মাত্র বাড়ি থেকে আসলাম আর আজই তারা এখানে এসে উপস্থিত! আমি তখন কাকাকে বললাম, কি ব্যাপার কাকা? আপনিতো কোনদিন এখানে আসেননি? আজ হঠাৎ এখানে আসলেন?
কাকা বললেন, তোমার দাদা মারা গেছে তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে আসলাম।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ বলে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কখন মারা গেছে কাকা?
আজ সকাল ছয়টায়। জলদি চল। তুমি বাড়িতে গেলে জানাজা হবে। কারণ তোমার বড় ভাই বাড়িতে নেই।
বড় ভাই কোথায়?
তোমার মামাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে ঢাকা গেছে।
হঠাৎ দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যেই দাদা আমাকে এতো ভালোবাসতো সেই দাদা আজ নেই। আমি বাড়িতে গেলে দাদা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে টাকা দিত। কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। আর ভাবতে পারছি না।
কাকা বললো, কাঁদবে না। সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাড়াতাড়ি চল।
আমি চোখ মুছে বললাম, একটু দাঁড়ান আমি ছুটি নিয়ে আসছি বলেই উপরে ক্লাশে ঢুকে হুজুরকে আমার দাদার মৃত্যু সংবাদ দিলাম। হুজুর শুনে আমার দাদার জন্য দোয়া করে বললেন, তুমি বাড়িতে চলে যাও।
তখন বাজে ১২:০০টা। কাকাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত লজিং বাড়িতে আসলাম। পড়ার রুমে বইগুলো রেখে লজিং বাড়ির সবাইকে দাদার মৃত্যুর সংবাদ শুনিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। নরসিংদী আসতে আসতে বেলা ২:০০ টা বেজে গেল। চারটার সময় আমাদের গ্রামের পাশে সোনাবাল্লা লঞ্চ ঘাটে এসে লঞ্চ থামল। লঞ্চ থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে ৪:৩০ মিনিটে বাড়িতে আসলাম। বাড়িতে এসে দেখি পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ আগে দাদার জানাজা ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করে লোকজন বাড়িতে চলে আসল। আমাকে দেখে বড় ফুফু, ছোট ফুফু জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আমিও চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। কেঁদে কেঁকে ফুফুকে, আম্মাকে বললাম, আমার জন্য কি আরেকটু সময় অপেক্ষা করা গেল না?
আম্মা বললো, তোর বড় ভাই ও তোর জন্য মুরুব্বীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে কিন্তু যথাসময়ে কেউ না আসায় সবার সিদ্ধান্তে ৩:০০ টার সময় দাফন কাফন শেষ করছে। আফসোস করিস না, দাদার জন্য দোয়া কর আর এখন গিয়ে কবরে মাটি দিয়ে আস।
বিকাল ৫:০০টার দিকে আমি গোরস্থানে গিয়ে দাদার কবর দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। দাদার কবরে নিজ হাতে মাটি দিয়ে দাদার জন্য দোয়া করলাম।
আজ দেখতে দেখতে দাদার মৃত্যুর ১৯টি বছর পার হলো। দাদাকে ছাড়া দীর্ঘ ১৯ বছর যাবত আমার আব্বার পরিচালনায় আমাদের সংসার চলছে।
উল্লেখ্য যে, দাদার মৃত্যুর সময় দাদার একমাত্র ছেলে আমার আব্বা শরীফ হোসেন ও আমার মেজো ভাই আবু ইউসুফ ওমান প্রাবাসে ছিলেন বিধায় দাদার পাশে থাকতে পারেন নি। কিন্তু আমরা বাকি ৪ ভাই দেশে থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগের মাধ্যম সহজ না হওয়ায় আমি, আমার বড় ভাই আকবর হোসেন, সবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ জানাজায় শরিক হতে পারিনি। শুধুমাত্র ছোট ভাই ওমর ফারুক দাদার জানাজায় উপস্থিত ছিল।
দাদার মৃত্যুর আগে ছবি তোলাটাও ছিল দুর্লভ। তখন স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা যেতো। কিন্তু দাদা ছবি তোলতেন না। আমাদের কারোর কাছে তখন ব্যক্তিগত ক্যামেরা ছিল না বিধায় দাদার ছবি ধারণ করে রাখতে পারিনি। কিন্তু দাদার ছবি আমার হৃদয়ে গেথে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই ছবি মুছবে না।
১৯টি বছর পার হলো আমরা কোনদিন দাদার মৃত্যু দিবস পালন করিনি। কারণ ইসলামে মৃত্যুদিবস পালন করার কোন বিধান নেই। আল কোরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা কারো মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, ইসলামেও শোক পালনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। তা হলো কেউ মারা গেলে তিন দিন শোক পালন করবে। তিন দিন পর শোক পালনের কোনো সুযোগ নেই, বরং চতুর্থ দিন থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে, তবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী চার মাস দশ দিন অথবা গর্ভস্থিত সন্তান (যদি থাকে) প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবে।
রাসুল (স) বলেছেন, কোনো মহিলা যে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন না করে, তবে স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। (বুখারি, মুসলিম)।
অতএব ইসলামের বিধান হলো কেউই তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন করবে না। শুধু মহিলারা স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবেন।
নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য অন্যের নিকট দোয়া চাওয়া যেতে পারে। টাকার বিনিময়ে কোন মাওলানা ভাড়া করে দোয়া করানোর বিধানও ইসলামে নেই। তবে নিজে দোয়া করাই অধিক উত্তম। বিশেষ করে পিতামাতার জন্য সন্তান সব সময়ই দোয়া করবে।
রাসুল (স)কে জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল, পিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সন্তানের আর কিছু করণীয় আছে কি? রাসুল (স) বললেন, হ্যাঁ, পিতা মাতা মৃত্যুর পর তাদের প্রতি চারটি করণীয় অবশিষ্ট থাকে ১. তাদের জন্য সব সময় দোয়া করা। তাদের মাগফেরাতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২. তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা, ৩. তাদের মাধ্যমে যাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের সাথে আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ৪. তাদের বন্ধুদের সম্মান করা। (আবু দাউদ)।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আমরা সবাই দাদার জন্য যার যার জায়গা থেকে দোয়া ও তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।
ইসলামে মৃত্যুর তৃতীয় দিবসে কুলখানি করা এবং চল্লিশতম দিবসে চেহলাম করার কোনো বিধান নেই। এমনিভাবে মৃত্যু দিবস পালন করা, মৃত্যু দিবস উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের বিশেষ আয়োজন করা ইসলামে নেই। ইসলামে মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে যা করণীয় রয়েছে তা হলো, সব সময়ই তাদের জন্য দোয়া করা। এর জন্য কোনো দিনক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন নেই। যেকোনো সময়ই দোয়া করা যায়।
তাইতো তথাকথিত এইসব বেদআত দিবস প্রথা বাদ দিয়ে আমরা দাদার জন্য সব সময় নিজেরা দোয়া করি। যেমন দৈনিক পাঁচবার নামাজের সময়, জুমআর নামাজের সময়, দুই ঈদের নামাজ শেষে দাদার কবর জেয়ারতের সময়, শবে বরাত ও শবে কদরের রাতসহ ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে। আমরা এবং আমার ফুফাতো ভাইয়েরা বাড়িতে আসলে প্রায়ই দাদার কবর জিয়ারত করে দোয়া করি।
অন্যান্য দিনের মতো দাদার মৃত্যু দিনটিও প্রতি বছর আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। আমরা অনেকে মনে রেখেছি আবার অনেকে হয়তো মনে রাখি নাই। তাই বলে কেউ দাদাকে ভুলে যাইনি। নির্দিষ্ট দিনে দাদাকে স্মরণ না করে সারা বছরই দাদাকে স্মরণ করি। যারা মৃত্যু দিবস পালন করে তারা সারা বছর মৃত ব্যক্তিকে ভুলে থাকে। মৃত্যু দিবসে তার নামে মিলাদ মাহফিল করিয়ে মৃত ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে থাকে।
মৃত্যুর সময় দাদা এক ছেলে (আমার আব্বা) ও দুই মেয়ের সংসারে ১৬ জন নাতী নাতনি রেখে যান। যারা আজ দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ১৬ জন নাতী নাতনি থেকে দাদার উত্তারাধীকার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দাদার স্বপ্ন ছিল তাঁর উত্তরাধীকারদের মধ্য থেকে কেউ একজন আলেম হবেন এবং তাঁর জানাজা পড়াবেন। দাদা সবসময় আমাদের পরিবার ও আমার দুই ফুফুর পরিবারের সবাইকে মাদ্রাসায় পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন এবং ওনার ইচ্ছা অনুযায়ী আমার বড় ফুফুর দুই ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।
আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই সবাইকে দাদা পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমরা সবাই কম বেশি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করলেও কেউ প্রকৃত আলেম হতে পারলাম না। যথেষ্ট এলেম থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আমলের অভাবে আলেম হতে পারিনি। তবে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার কারণে আমরা কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমাদের পরিবারের সবাই আল্লাহকে ভয় করে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়ে। মদ, গাজা, বিড়ি, সিগারেট খায় না। ধর্মীয় রীতি নীতি মেনেই আমাদের জীবন যাপন চলছে।
আমরা পাঁচ ভাই দাদার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও আমার দুই ফুফাত ভাই দাদার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। একজন হচ্ছেন হাফেজ মাওলানা মো: আলমগীর হোসেন। আরেকজন হচ্ছেন মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী। ওরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী একজন, সু-বক্তা, লেখক, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, মসজিদের খতিব ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। তাছাড়া দাদা আমার বড় বোনকে একজন আলেমের সাথেই বিয়ে দেন।
আমার বড় ভাই আকবর হোসেন তিনি বর্তমানে পরিবারসহ ওমান প্রবাসী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। মেজো ভাই আবু ইউসুফ দীর্ঘ ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে বর্তমানে ট্রেইলারের ব্যবসা করেন। আমার ছোট ভাই ওমর ফারুক স্ট্রেশনারীর ব্যবসায়ী ও সবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ সেও ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে কাপড়ের ব্যবসা করছেন। আর আমি চাকরি না পেয়ে বর্তমানে কম্পিউটার ফটোকপির ব্যবসা করছি।
দাদার মৃত্যুর সময় আমরা বড় তিন ভাই জানাজা পড়ানোর মতো সমর্থ ছিলো কিন্তু মৃত্যুর সময় কাছে উপস্থিত ছিলাম না বিধায় তা সম্ভব হয়নি। ফুফাতো ভাইয়েরাও নরসিংদী ও ঢাকাতে থাকায় তাদের কাছে দেরিতে খবর পৌঁছেছে বিধায় যথাসময়ে জানাজায় উপস্থিত হতে পারেন নি। তখন আলেম হিসেবে একমাত্র আমার দুলাভাই উপস্থিত ছিলেন। সবার সম্মতিক্রমে দুলাভাই দাদার জানাজা পড়ান। বর্তমানে আমার দুলাভাইও পরলোকগমন করেন। এই দুলাভাইয়ের জানাজাও তখন আমার ফুফাতো ভাই হাফেজ আলমগীর হোসেন পড়ান। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আল্লাহ যেন আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের কারো না কারোর মাধ্যমে জানাজার পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন।
পরিশেষে সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করব আপনারা সবাই আমার দাদার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন।

১৫/০৯/২০১৭খ্রি:

আমার_শৈশব_ফেলে_আসা_দিনের_স্মৃতি

আমাদের সবার একটা আনন্দময় শৈশব আছে। আমারও রয়েছে। নিচের দীর্ঘ লেখাটি পড়লে, আমার এবং আমার সমবয়সীদের শৈশব কেমন ছিলো, জানা যাবে।

বেশ দীর্ঘ লেখাটি। তাই পড়তে গিয়ে বিরক্ত হতে পারেন।
________________________________
” ছায়া ফেলে যায় তবুও নি:সময়
তারই মাঝখানে লহমার এই দেখা
একার সঙ্গে মুখোমুখি হল একা।” ১

সবার মাঝে থেকেও কখনো কখনো বেশ একা লাগে। সেই একাকীত্বকে কাটাতে কত কিছুই না করা। ইচ্ছেঘুড়ি শত সহস্র আলোকবর্ষ ঘুরে আসে, তবুও ঘুচে না নিঃসঙ্গতা। কারণ সেই ঘুরে আসাটা থাকে বর্তমানকে সাথে নিয়ে কেবলি সামনের দিকে। তাই অতৃপ্তি ঘুচে না। তখনি হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে ডাক শুনতে পাই-

‘ তোমার কিসের অভাব খোকা?
ইচ্ছে হলেই পাও কাছে সব
জুঁই জোনাকি পোকা।

তোমার আছে সবুজ পাহাড়
ফুলের বাহার, নদী-
তোমার বুকে যাক না বয়ে
জোয়ার নিরবধি।’ ২

মুহুর্তে এই বুড়ো খোকা মাইকেল জে ফক্স হয়ে ফিরে যায় সোনালী অতীতে- হিরণ্ময় অতীত- হীরার কুঁচির মত জ্বলজ্বলে আমার শৈশব সকল অতৃপ্তি মিটাতে আমাকে কাছে টেনে নেয়! যদিও এই ডিজিটাল যুগের নিরিখে সাদা-কালো ক্যানভাসে অনেকটা বিবর্ণ আমার শৈশব! দেখা যাক, কেমন ছিল সেই ক্যানভাস…

শৈশবের প্রথম স্মৃতিঃ
কোথায় যেন পড়েছিলাম, এল এস ডি নামের একটি ড্রাগ রয়েছে, যা সেবনে হ্যালুসিনেশন এর প্রভাবে মানুষ তার মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে পর্যন্ত মনে করতে পারে। আমার কাছে এটি অবাস্তব মনে হয়। আমি আমার চেতনায় শৈশবের প্রথম স্মৃতি যা দেখতে পাই, সেটি আমার দাদা বাড়ির ঘটনা। আমি আমার চাচার কোলে… তন্ময় হয়ে দেখছি আগুনের লেলিহান শিখা। রাতের বেলা… দাদা বাড়ির পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে… আকাশ ছুঁতে চাওয়া আগুনের শিখাগুলির প্রলয় নৃত্য সেদিনের এক শিশুর মানসপটে আজো ভেসে বেড়ায়। নিজেকে এতো শক্তিধর ভাবা মানুষ, কিছু প্রাকৃতিক ভৌত বস্তুর সামনে কিভাবে অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে, সেদিন আমার অবচেতন মনে গেঁথে গিয়েছিল।

নানা বাড়ির স্মৃতিঃ
জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে চাকরির সুবাদে আমার আব্বা খুলনায় একটি মেসে থাকতেন। আমি আম্মার সাথে নানা বাড়িতে। জীবনের মধুর সময়গুলো আমার সেখানেই কেটেছে। হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। পটে আঁকা ছবির মত। প্রাচীন জমিদারদের মত সিমেন্টবিহীন লাল ইটের চুনামাটির প্রলেপে বানানো একটি বাড়িতে আমার জন্ম। সেই ইটগুলো জায়গায় জায়গায় গাঁথুনির চুনা ঝরে যাওয়াতে ফোঁকর দৃশ্যমান ছিল। সেই ফোঁকরগুলো আরো গভীর করাতে আমার প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। আজ আমার ছোট বাবুকে দুষ্টুমি না করার জন্য যখন উপদেশ দেই, আড়ালে থেকে আমার শৈশবের সেই ‘আমি’ আমাকে মুখ ভেংচায়।

দিনভর খালের পাড়ে মাটির প্রধান রাস্তায় অন্যান্য খালাতো-মামাতো ভাই বোনদের সাথে খেলায় খেলায় কাটত। কত রকমের খেলা যে ছিল। কিছু কমন খেলার ভিতরে রান্না-বান্না, পুতুলের বিয়ে আর দোকানদারি করার
খেলাটাই বিশেষভাবে মনে পড়ে।

তখনো সাঁতার শিখি নাই। কিন্তু তাতে কি? খালে যখন ভাঁটা থাকে, তখন দলবেঁধে সবাই নেংটো হয়ে কাদা পেরিয়ে তাল গাছের ঘাটলার সর্ব শেষ ধাপে অবস্থান নেই। কোমর সমান পানিতে হাবুডুবু খাবার সেই নষ্টালজিক অনুভূতির কাছে, এখনকার সকল অনুভূতিকে তুচ্ছ মনে হয়। আজ ইট পাথরের নগর জীবনে পার্কের স্লিপারে আমার কন্যাদের যখন আমোদে মেতে উঠতে দেখি, তখন খালের পাড়ে নিজেদের তৈরী মাটির স্লিপারে নগ্ন ‘আমি’র উচ্ছলতাকে মনে পড়ে। পানি ছিটিয়ে ঢালু খালের কর্দমাক্ত সেই প্রাকৃতিক স্লিপারে যে আনন্দ পেয়েছি, আজ আমাদের সন্তানেরা কল্পনায়ও আনতে পারবে কি? ভাটার সময় খালের কাদার ভিতরে ‘ডগরা’ মাছ ধরার সেই আনন্দঘন মুহুর্ত বড্ড মিস করি। এখনকার হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কিনে পুকুরে হুইলে মাছ ধরার আনন্দ শৈশবের সেই হাত দিয়ে মাছ ধরার তুলনায় বড্ড পানসে লাগে।

নানাবাড়ির অন্দর মহলের পুকুর ঘাটটিও আমাকে বেশ টানত। সেখানে তিন মামার জন্য আলাদা তিনটি ঘাটলা ছিল। মহিলাদের জন্য একেবারে ঘেরা। সেই লাল ইটের পলেস্তারাবিহীন ঘাটলাকে আমার কংকালের মত দাঁত বের করা হাসিমুখ মনে হত। আসলে এখনকার সময়কে যদি আধুনিক ধরা যায়, তবে আমার শৈশবে তখন নানাবাড়ির জৌলুস ভগ্নপ্রায় প্রাচীনতাকে ধারণ করে মধ্যযুগে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

আমার হাতে খড়িঃ
আমার হাতে খড়ি হয়েছিল আমার নানার হাতে। তখন কালো স্লেটের চল থাকলেও তাল পাতার চিকন ফালি করা খাতায় বাঁশের কলম কয়লা গুড়ো করে বানানো কালিতে চুবিয়ে লিখতে হত। আর এক টুকরো কাপড় রাখা হত কালির লেখা মুছবার জন্য। এখন যে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কিংবা কিন্ডারগার্টেনে সবাই বি-সিরিয়ালের রেডিমেড সুদৃশ্য পেন্সিলের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত, আমাদের সময়ের সেই বাঁশের কলম দিয়ে তালপাতায় লেখার সুখানুভূতি কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? একটা ছোট হোগলার মাদুর সাথে নিয়ে যেতাম টো্লে। একজন হিন্দু পন্ডিতমশাই ছিলেন আমাদের সকল শিশুদের একমাত্র শিক্ষক। সেখানে আমার আসল হাতে খড়ি বেশ জাকজমকের সাথে হল। তখন এই বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে বাতাসা, খই, চিড়া ভাজা ছিল প্রধান উপকরণ। অন্যান্য ছাত্ররা সবাই মিলে একসাথে এক মহাউৎসব পালন হত। আমরা মাটিতে মাদুর বিছিয়ে লেখাপড়া করতাম। ওহ! সেই দিনগুলি!!
প্রতিদিন সকালে ফজরের সময়ে উঠে নানার কাছে আরবি শিখতাম। এরপরে আদর্শলিপি থেকে নানা আমাদের সকল ভাই-বোনদেরকে মুখস্ত করাতেন খুবই কমন কিছু কবিতা-

” সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন যেন আমি ভাল হয়ে চলি।”- কিংবা

” পারিব না একথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার।”- অথবা

” পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল”- কি বন্ধুরা, মনে পড়ে? [আমার সমবয়সী যারা তাদেরকে বন্ধু সম্বোধন করেছি]

তখন গ্রামে চাষাবাদ-ই ছিল একমাত্র জীবিকা। অনেক কামলা কাজ করত। তাদেরকে সকাল বেলা এক গামলা পান্তা ভাত অবাক বিস্ময়ে খেতে দেখতাম! লাল আউশ চালের ভাত সরিষার তেল, পিয়াজ এবং পোড়া মরিচ ডলে ভাতগুলোকে আরো লাল করে ফেলে তাদের সেই তৃপ্তিকর খাবার দৃশ্য এখনো আমার জিভে জল এনে দেয়! আর দায়ে কাটা তামাক চিটা গুড় সহযোগে হুক্কায় দম দেবার এবং হুক্কার নারিকেলের খোলে পানির ভিতর থেকে বের হওয়া সেই অদ্ভুত শব্দ এখনো কানে বাজে [যদিও হুক্কা পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই বিষবৎ পরিত্যাজ্য]

আর একটি জিনিস উল্লেখ করে এই পর্বের ইতি টানবো। ধান কাটার মওশুমে ধান কাটা হয়ে গেলে কিছু ধান মাঠে পরে থাকতো। ছোটরা দলবেঁধে সেই ধান টোকাতে যেতাম। এতোটা দুষ্টু ছিলাম যে, অনেক সময় ক্ষেত থেকে ধান গাছের উপরের শীষ কেটে নিয়ে যেতাম। যদিও এখন বুঝি যে, সেই কাজটি ছিল এক ধরণের চোর্য্যবৃত্তি। তবুও কি এক উদ্দাম নেশায় সেই কাজটিও সকলে করতাম। এ ছাড়া ইদুরের গর্ত থেকেও ওদের জমানো ধান বের করে নিয়েছি। এই কাজটি অনেক বিপদজনক ছিল। প্রায় ইঁদুরের গর্তেই সাপ থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে ভয় ডর বলে কিছু ছিল না। এই জমানো ধান চলে যেতো ভ্রাম্যমান খই, মুড়ি-মুড়কি বিক্রেতার ঝোলায়। এরা ধান কাটার সময় এলে বাড়ি বাড়ি এসে ওদের জিনিসগুলোর পরিবর্তে ধান নিয়ে যেতো। এখানেও নানীর গোলা থেকে ধান চুরি করে এনে কত মোয়া নিয়েছি। আজ নিজেকে বড্ড চোর মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে কি একটুও আফসোস হচ্ছে না? থেকে থেকে কি মনটা আবারো সেই ‘না বলে নেয়ার’ মুহুর্তগুলিতে ফিরে যেতে চাচ্ছে না? হৃদয়ের তন্ত্রীতে কেবলি বেজে উঠছে ওয়ারফেজ এর সেই গানটি-

“… আজো ভুলিনি সেই দিনগুলি
মনে পড়ে যায় আবারো ফিরে আসে…”
… …

দাদা বাড়িঃ
আমার ছেলেবেলায় বেশীরভাগ সময়ই নানা বাড়িতে কেটেছে। তবে দাদা বাড়িতেও অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। নানা বাড়ি থেকে সেই সময়ে দাদা বাড়ি যাতায়াতের বেশ ঝক্কি ছিল। তখনকার বাসগুলো ছিল মুড়ির টিনের’ মত। এগুলোকে স্টার্ট দিতে এক ধরণের লম্বা হ্যান্ডেল ব্যবহার করতে হত, যেটি বাসের বাহির দিয়ে একেবারে সামনের একটি ছিদ্রতে ঢুকিয়ে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরালেই তবে স্টার্ট হত। আর যাতায়াতের অনেকটা পথ নৌকায় করে বিষখালি নদী দিয়ে যেতে হত। আব্বা আমার ছেলে বেলায় একটি লোহার চেয়ার তৈরী করিয়েছিলেন, নৌকার দুলুনিতে যাতে আমি ভারসাম্যহীন হয়ে না পড়ি, তাই সেই চেয়ারে বসিয়ে আমাকে একটি বেল্টের সাথে আটকে রাখতেন। আজ ৪৩ বছর ধরে সেই চেয়ারটি আমার কাছে সযতনে রয়েছে!

দাদাকে আমার আম্মাও দেখেন নাই। আর দাদীর স্মৃতি খুব অল্পই মনে আছে আমার। আমরা দাদা বাড়ি গেলে তিনি আমার এক চাচাকে পুকুর থেকে খেজুর এর ছড়া তুলে এনে আমাকে দিতে বলতেন। গাছ থেকে খেজুর ছড়া সহ কেটে পাকাবার জন্য পুকুরে ভিজিয়ে রাখা হত। আর আজ কার্বাইডের বিষাক্ত ছোবলে কোনো ফলই খাবার উপায় নেই। দাদীর কথা আমার এটুকুনই মনে আছে।

আমার প্রথম দুর্ঘটনাঃ
তখন গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলনা। হারিকেন, কেরোসিন কুপি যাকে আমরা ল্যাম (আসলে হবে ল্যাম্প) বলতাম আর কোনো অনুষ্ঠানের সময় হ্যাজাক বাতি ব্যবহার করা হত। এই ল্যামের সলতের পোড়া অংশ কিছুটা স্ফীতাকারে দলা হয়ে থাকত। এগুলোকে আমরা ছোটরা বলতাম ফুল। এই ফুল খেতাম। একদিন আব্বার এক দূর সম্পর্কের ভাই, মেনহাজ নাম ছিল ওনার, তিনি দাদা বাড়ি অবস্থানের সময় আমার দেখাশোনা করতেন; তিনি বললেন, ‘ এই ফুল না খাইয়া কেরোসিন খা’। তিনি আসলে রসিকতা করে বলেছিলেন। কিন্তু শিশুদের সাথে এমন কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করাটা যে কতটা বিপদজনক, তিনি সেদিন সেটি বুঝেছিলেন। আজ ভাসা ভাসা মনে পড়ে, তার কথামত ল্যামের ভিতরের সবটুকু কেরোসিন আমি খেয়ে ফেলেছিলাম। এরপরের ঘটনা অনেক উদ্বেগজনক। সেই সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামে আশেপাশে কেন, বহুদূর পর্যন্ত কোনো ডাক্তার ছিল না। মুরব্বিদের হাতুড়ে চিকিৎসায় আর পরম করুনাময়ের অশেষ রহমতে আমি সুস্থ হতে পেরেছিলাম।

আর একটি স্মৃতি মনের মুকুরে দোলা দিয়ে যায়। তখন দেশীয় প্রজাতির মাছে হাওড়,খাল-বিল সয়লাব ছিল। সেগুলোর স্বাদ যেমন ছিল, তাদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বর্ষা মওসুমে দাদা বাড়ির সামনের ধানি জমিগুলো বিলে পরিণত হত। তখন সেখানে হরেকপদের মাছে টইটুম্বর করত। আমার আরো এক চাচার নাম ছিল ‘চান মিয়া’। আমরা ডাকতাম চান্দু কাক্কু বলে। তিনি আমাকে নিয়ে নৌকায় করে সেই বিলে কই মাছ ধরতে যেতেন। যাবার সময় আম্মা বড়শিতে দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে দিতেন, যাতে বেশী বেশী মাছ ধরা পড়ে।

নগরজীবনে প্রবেশঃ
আব্বার পোষ্টিং তখন ছিল খুলনায়। তিনি আমাদেরকে সেখানে নিয়ে এলেন। আমার আর একটি ভাই তখন পৃথিবীতে এসেছে। মাছুম, আমি আর আবা-আম্মা- এই চারজনের নগরজীবন শুরু হল। তখন তো আর নগরজীবন এতো জটিল এবং সবুজবিহীন কংক্রিটের হয়ে উঠেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল তখন। আমরা খুলনার খালিশপুরের এক ভাড়া বাসায় উঠে এলাম।

এখানেই আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর দেখা পেলাম।
সে একজন মেয়ে ছিল। রুপা তার নাম। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, তার ঠিক সামনেই ছিল ওদের বাড়ি।সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি। আর আমরা থাকতাম একটি টিনশেডের ভাড়া বাসায়।সেখানে আরো দুটি পরিবারও থাকতো। তো এহেন সামাজিক মর্যাদার বিস্তর ব্যবধান স্বত্বেও আমি আর রুপা বন্ধু হয়েছিলাম। বিকেলে রুপার ভাই এবং তার অন্য বন্ধুদের সাথে আমিও খেলতে যেতাম। রাবারের টেনিশ বল দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা খেলতাম। আর যখনই বলটি ড্রেনে পরে যেত, রুপার ভাই মুন্না আমাকেই বলটি তুলে আনতে বলত। আমি যে ছিলাম সেই সময়ে সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে সব থেকে নিচুতে। আমি তুলে আনতাম, আর মনে মনে ভাবতাম, সব সময় আমাকেই কেন তুলে আনতে বলে? রুপা কষ্ট পেত। একদিন সে সরাসরি বলেই ফেলল, তুই আর বল তুলে আনবি না।’ সেই ছেলেবেলায়ই শ্রেণী বৈষম্য আমার চেতন মনে না বুঝেই ধরা দিয়েছিল… আর রুপাই আমাকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল। জানি না আজ এই বন্ধুটি কোথায় আছে, কেমন আছে!
এখানে বেশ বড় একটি দিঘী ছিল। অনেক দূর পর্যন্ত তার শান বাঁধানো ঘাটলা পানির গভীরে নেমে গেছে। আমি বিকেল বেলা অন্যদের সাথে ঝাপাঝাপি করতাম। আম্মা ছোট ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার খোঁজখবর তেমন নিতে পারতেন না। আব্বা পাঁচটায় অফিস থেকে এসেই আমাকে না পেয়ে পুকুরে চলে যেতেন। অফিসের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। আমাকে পুকুর থেকে ধরে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমার চোখ লাল হয়ে থাকতো। এটা দেখে আব্বা প্রচন্ড রাগ হতেন। আমাকে ‘মাইরও’ দিতেন বেশ করে। তারপরও প্রতিদিন একই সময়ে পুকুরে না ডুবালে কেন জানি শান্তি পেতাম না। আর আব্বার সামনে যাতে লাল চোখ নিয়ে যেতে না হয়, সেজন্য জলকেলির এক পর্যায়ে দুহাতে পানি নিয়ে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ লাল না সাদা?’ অপরজন সব সময় সাদা-ই বলত। আর পরক্ষণেই সেই ‘সাদা পানি’ দিয়ে নিজের চোখে ঝাপটা দিতাম। আর মুহুর্তেই চোখ সাদা হয়ে যেত। আমাদের কচি হৃদয়ে সেই সময়ে এমনটি-ই আমরা ভাবতুম। কিন্তু তারপরও কেন যেন চোখ লাল এর জন্য আব্বার ‘মাইর’ থেকে রক্ষা পেতাম না।

এখান থেকে বাসা বদল করে আমরা খুলনার রায়ের মহলে চলে এলাম। এখানে এসে আমার দুরন্তপনা আরো বেগবান হয়েছিল। কলা পাতাকে ঘোড়ার কেশরের মত দু’পাশে ছিড়ে বানিয়ে সেটিকে ঘোড়ায় পরিণত করে তাতে চড়ে দিনভর রায়েরমহলের মাটির রাস্তায় দৌড়ে বেড়াতাম। এখানে এই এলাকায় তখন ঘোড়া দিয়ে মালামাল টানার কাজটি করা হত। গরুর গাড়ির বদলে ঘোড়ার গাড়ির বহুল ব্যবহার ছিল। ঐ সময়টিতে আমি নিজেকে একটি ঘোড়া ভাবতাম।

আমার আনুষ্ঠানিক প্রথম স্কুল ছিল এইখানে। রায়েরমহল প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে আব্বা আমাকে একদিন ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য সুখকর ছিল না। একজন মহিলা টিচার ক্লাশ নিতে এলেন। অন্য সকলকে পড়া জিজ্ঞেস করলেন, সাথে আমাকেও। আমার আজ প্রথম দিন! কিভাবে পারব? কিন্তু তিনি অন্য সবার সাথে আমাকেও কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। পরের পিরিয়ডে সোজা বাসায় চলে এলাম। আর গেলাম না ঐ স্কুলে। সেই ছিল আমার একদিনের জীবনের প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। সব শুনে আব্বাও আর ওখানে যেতে জোর করলেন না।

গত কোরবানির ঈদে আমার মেয়েদেরকে নিয়ে সেই স্কুলটি দেখিয়ে এনেছি। সেদিন এতোগুলো বছর পরে যখন স্কুলের সামনে গেলাম, পুরনো সেই মুহুর্তগুলো কেন জানি এক অন্য আবেশে আমাকে আন্দোলিত করছিল…সেদিনের সেই বিব্রত মুহুর্তটি কেন জানি এক অনাবিল সুখের উচ্ছ্বাসে নিজেকে প্রগলভ করে তুলল। এক টুকরো অতীত যেন অন্ধকার ফুঁড়ে সহস্র সূর্যের আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে মনের গহীনে সেই সুরটি-ই বাজিয়ে তুলল-
‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…’
… …
শুধুমাত্র আমাকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আব্বা রায়েরমহলের বাসা থেকে টুটপাড়া দেলখোলা রোডের আর একটি ভাড়া বাসায় শিফট হয়ে এলেন। আমাকে খুলনা সেইন্ট জোসেফস হাই স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি করে দেয়া হল। নিরবচ্ছিন্নভাবে আমার স্কুল জীবন চলতে লাগল।
এই পর্বে বেশ কিছু নতুন বন্ধু হয়েছিল আমার। তাদের ভিতর দোলন ভাই এবং তার বোন চাঁপার সাথে বন্ধুত্ব টুকু একটু গাঢ় ছিল।

জীবনের প্রথম মুদ্রা চিনলাম এই সময়ে। তখন নতুন দশ পয়সার প্রতি আমার খুব লোভ ছিল। আমি এটিকে বলতাম রাঙা পয়সা। আব্বার কাছে এই ‘রাঙা পয়সার’ আব্দার করতাম। তিনি দিতেনও। তবে চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিবেন, এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।

আমার জীবনের প্রথম পোষা পাখি নিয়ে আনন্দ এবং কান্না করার যুগপৎ অভিজ্ঞতাও লাভ করি এই টুটপাড়ার বাসায়ই। আব্বা একদিন আম্মার জন্য একটি ময়না পাখি কিনে এনেছিলেন। আম্মা সেটির খুব যত্ন নিতেন। একটি বাঁশের তৈরী খাঁচায় কালো কাপড় দিয়ে ‘ওকে’ ঢেকে রাখা হত। আর কথা বলানোর জন্য আমাদের সে কি প্রচেষ্টা! এভাবে ছ’মাসের বেশী সে আমাদের চারজনের পরিবারের পঞ্চম সদস্য হিসাবে বেঁচে ছিল।
একদিন ময়নার শেষ সময় উপস্থিত হল। আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে সেই বিকেলটির কথা। বাসার ছাদের ওপর আম্মা মৃত ময়নাটিকে ছাদের মেঝেতে রেখে আলতো করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আছেন। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা… প্রচন্ড বাতাসে আম্মার চুলগুলো উড়ছে…মৃত ময়নার শরীরের পশমগুলো ও… আম্মার দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে নীরবে জলধারা বহমান… আমিও কাঁদছি। এমন একটি বিকেল আমাদের মা-ছেলেকে বেদনায় আপ্লুত করে রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ।

তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলের শেষ দিক। প্রায়ই প্লেন থেকে কাগজ ফেলা হচ্ছে। তখন কি আর রাজনীতি বুঝতাম? [ এখনো যে বুঝি, তাও কিন্তু নয়] ঐ কাগজের পিছনে আমি, দোলন ভাই আর চাঁপা দৌড়ে বেড়াতাম। প্লেনের পেট থেকে কি পড়ল, তাকে লাভ করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতাম সেই দিনগুলোতে!

জীবনের প্রথম টিকা দেয়ার ভীতিকর অভিজ্ঞতা লাভ হল এখানেই। তখন জোর করে ধরে হাতের উপরিভাগে ক্ষত করে যে চিকিৎসা সেবাটি দেয়া হত, তার প্রতি আমাদের শিশু সমাজে অনেক আতংক বিরাজ করত। মনে আছে, যন্ত্রনায় আব্বার কোলে বসে অনেক কেঁদেছিলাম।

আবারো জীবনে পরিবর্তন এলো আমাদের। আব্বা খুলনার ছোট বয়রাতে চার কাঠা জায়গা কিনে সেমি পাকা গোলের ঘর করে সেখানেই চলে এলেন। নিজেদের বাড়ি! বাসা থেকে আমাদের বাড়িতে উত্তরণ হলেও, আমার কচি হৃদয় এভাবে বার বার জায়গা বদলে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল। পরিচিত মহল, চেনা বন্ধু এবং খেলার সাথীদেরকে ছেড়ে আসার কষ্টটা অনেক বেধেছিল হৃদয়ে।

এই এলাকাটি ছিল তখন জঙ্গলে পরিপুর্ণ। সবুজে সবুজে এমনভাবে ছেয়ে ছিল যে, দিনের বেলায়ও গা ছমছমে অনুভূতির উদ্রেক করত। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটি ইটের সলিং বিছানো পথ, এর দু’পাশে নতুন তৈরী হওয়া বাড়ি-ঘর। এভাবেই জায়গাটি জেগে উঠছিল। সেই নিজেদের বাড়িতে আমার তিন নাম্বার ভাই মাসুদ পৃথিবীতে এলো। খুব সুন্দর ছিল সে। এখনো সুন্দর। তাই ওকে সবাই ডাকতো হিরো। আমার দিন কেটে যেত এই ছোট ভাইটিকে ঘিরে।

নতুন এই জায়গাটিতে নতুন করে বন্ধু জুটিয়ে নিলাম। আমার সেই সব বন্ধুরা ছিল সবাই গরীব ঘরের। এদের সাথে আমাদের ভিতরকার শ্রেনী ব্যবধান ছিল, খালিশপুরে রুপাদের সাথে আমাদের যতটুকু ব্যবধান ছিল- সেরকম। আমি নাক দিয়ে অনবরত জল বেরিয়ে থাকা সেই সব ছেলেদের সাথে দিনভর খেলে বেড়াতাম। বেয়ারিং এর চাকা দিয়ে কাঠের তক্তার সাথে লাগিয়ে এক ধরণের গাড়ি তৈরী হত। অনেক পঙ্গু ভিক্ষুক এমন তিন চাকাওয়ালা গাড়িতে এখন ঘুরে বেড়ায়। আমি আমার শ্রমিক পরিবারের সেই বন্ধুদেরকে নিয়ে আমাদের ইটের রাস্তায় বেয়ারিং গাড়ি নিয়ে টইটই করে বেড়াতাম। কখনো আমি বসতাম, ওরা ঠেলতো; কখনো ওদের কেউ বসতো, আমি ঠেলতাম। আব্বার চোখে অনেকবার আমি ঠেলছি এই অবস্থায় ধরা পড়েছি। বাসায় এসে প্রচন্ড বকা শুনেছি, পরের দিন আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমার এই বন্ধুরা কখনো আমার বাসার পড়ার টেবিলটি দেখারও সুযোগ পায় নাই। সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি শ্রমজীবি মানুষের কাছে থাকতে ভালোবাসতাম। আল্লাহপাক সেজন্যই বুঝি বা আজ আমাকে শ্রমিকদের কেন্দ্র করেই কাজ করার জন্য নির্বাচিত করেছেন।

রাস্তা থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট টোকাইদের মত করে টোকাতাম। চাড়া (ভাংগা মাটির পাত্রের টুকরা) দিয়ে তাস খেলার জন্য। এই খেলাটি আমার খুব নেশার মত ছিল। গোল্ড ফ্লেক নামের সিগ্রেটটির মান সবচেয়ে বেশী ছিল। কিছুটা লম্বাটে হলুদ রঙের এই প্যাকেট রাস্তায় কিংবা ময়লা আবর্জনার ভিতরে দূর থেকে দেখলেই আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হত। কে কার আগে নিবে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলত, এই প্যাকেটটির মান ছিল ১০০০। আর একটি প্যাকেট যেটি কে-টু নামে পরিচিত, এর মান ছিল ৫০০।

মার্বেল খেলতাম রাস্তার পাশে বসে। দু’ভাবে খেলা হত। আঙটি মাইর এবং খচা। আঙটি মাইর খেলায় নির্দিষ্ট একটি মার্বেলে লাগালেই সেটি যে লাগাতে পারত তার হয়ে যেত। আর খচা সিষ্টেমে অনেক মার্বেল একটি নির্দিষ্ট দাগের ওপারে ফেলতে হত। এরপর সেখান থেকে একটিকে লাগানোর জন্য নির্দিষ্ট করে মারতে হত। ঐ নির্দিষ্টটি ছাড়া অন্য কোনো মার্বেলে লাগলেই ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ হয়ে যেত। এই খেলাটিতে অনেক মার্বেল লাগতো। কুলায় করে কয়েশ’ মার্বেল মেরেও খেলেছি আজ মনে পড়ছে।

আর একটি বিপদজনক খেলা খেলতাম। সেটি ছিল ডাংগুলি। এটি অভিভাবকেরা আমাদেরকে সহজে খেলতে দিতে চাইতেন না। এই খেলা খেলতে গিয়ে অনেকের চোখ নষ্ট হয়েছে।

লাটিম ঘুরানো একটি আর্টিষ্টিক খেলা হলেও, এটি নিয়েও প্রতিযোগিতা চলত। অভিভাবক মহলে এই খেলাটির প্রতিও কিছুটা বিধি-নিষেধ জারি হয়েছিল। তবে আমাদের দেশের ধুমপানের বিরুদ্ধে প্রনীত আইনের প্রয়োগ এর মত ছিল সেই নিয়ম-কানুন। আমরা মোটেই মানতাম না। রঙ বেরঙের মার্বেল কিনতে বাসের পিছনে ঝুলে ঝুলে বয়রা থেকে খালিশপুর পর্যন্ত চলে যেতাম। বিনে ভাড়ায় এভাবে ভ্রমন ছিল আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। যদিও এটি খুব-ই রিস্কি ছিল।

সব চেয়ে মজার খেলা ছিল জঙ্গলের ভিতরে টারজান টারজান খেলা। নিজেকে টারজান ভাবতাম। একটি কাঠের ছুরিও বানিয়ে নিয়েছিলাম। আর টারজানের ছবি আঁকতে পারতাম একটানে। সেই ব্যাক ব্রাশ করা চুলের ছবির টারজান আমাদের শিশুমনে দীর্ঘদিন রাজত্ব করে গেছে।

তখন এলাকায় মাত্র একটি বাসায় টেলিভিশন ছিল। প্রতিদিন বিকেলে সেই বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে কার্টুন ছবি দেখতাম। সেজান, ক্যাপ্টেন স্কার্লেট (এই নামটি ভুলও হতে পারে)। আর নতুন কুঁড়ির আসর, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, দ্য বায়োনিক ওম্যান এগুলো না বুঝেই দেখতাম।আব্বা এভাবে মানুষের বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখা পছন্দ করলেন না। তিনটি রিক্সা ছিল আমাদের, ভাড়ায় খাটত তখন। সেগুলো বিক্রি করে একদিন নতুন টেলিভিশন কিনে আনলেন। সেদিনের আনন্দের কথা লিখে আর কি প্রকাশ করব!!!

আমাদের বাড়ির পায়ে হাঁটা দূরত্বেই ছিল রেডিও অফিস। সেখানে যেতাম ছড়া বলবার জন্য। অন এয়ার সেই অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে…”আপা, আমি একটি ছড়া বলব… আমার ছড়ার নাম… লিখেছেন…”- বাসায় কতবার যে প্র্যাকটিস করেছি! যেভাবে ভুলতে পারিনা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে স্কুল থেকে গিয়ে বিব্রত হবার ঘটনা। তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি। কবি আল মাহমুদের নোলক কবিতা ছিল ঝাড়া মুখস্ত। ষ্টেজে উঠে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে প্রথম লাইনটি বলেই আর দ্বিতীয় লাইন মনে আসলো না…।

টেলিভিশন আসার আগে বিনোদনের কাজটি ছিল মূলতঃ রেডিও তে দুর্বার আর ছায়াছবির গান শুনে শুনে। আজও দুর্বার অনুষ্ঠানটি শুনলেই সেই ছেলেবেলার মুহুর্তগুলোই কেন জানি মনে পড়ে যায়। আর ছায়াছবির গানের ভিতরে বদনাম ছবির প্রয়াত জাফর ইকবালের গলার সেই ‘হয় যদি বদনাম’ গানটি সেই যে হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল, আজো চির ভাস্বর- চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। আর তুফান সিনেমাটির গানগুলোর কথাও কেন জানি মনে রয়ে গেছে।

রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে বৈকালি সিনেমা হলে [এখন এই সিনেমা হলটি আর নেই] যেতাম থার্ড ক্লাশে ছবি দেখতে। সিনেমা দেখাকে আমরা বলতাম বই দেখা। ৭৫ পয়সা ছিল একজনের থার্ড ক্লাসের টিকেটের দাম। দুই টাকা যোগাড় করে দুই বন্ধুর টিকেটের টাকা হয়েও ২৫ পয়সার বড় পিয়াজু খেতে পারতাম ইন্টারভ্যালের সময়ে। ফিরতি পথ আবারো রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে, না হয় পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা।

ঐ সময়ে কালো কুচকুচে রঙের একটি পুরনো আমলের অ্যানালগ টেলিফোন ছিল আমাদের বাসায়। আব্বা ছোট্ট একটি তালা দিয়ে রাখতেন। আজ মনে পড়ছে এই সেটটির কথাও।

বিশ্ব রাজনীতি তখন পাকিস্থানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি রদ করা নিয়ে জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে চাপ প্রয়োগ আর অনুরোধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আব্বা প্রতিদিন ইত্তেফাক পেপার নিয়ে আসতেন। সেখান থেকে পড়ে আমাদেরকে শুনাতেন প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভুট্টোকে অবশ্য পরবর্তীতে ফাঁসি-ই দেয়া হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে বছর নিহত হলেন, আমি তখন হাফ প্যান্ট পরে রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াই। এক সকাল বেলা শুনি রেডিওতে কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে। একটু অবাক হলাম। পরে জানলাম আমাদের প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলা হয়েছে।

অনেকেই ছোট্ট টিনের তৈরী লঞ্চ নিয়ে খেলেছে। যার নীচে তেল রাখার একটি কম্পার্টমেন্ট থাকতো। সেখানে আগুন ধরিয়ে দিলে লঞ্চের একেবারে নীচ দিয়ে ভিতরে রাখা পানি পিছন দিকে বের হত, আর লঞ্চটি সামনের দিকে এগিয়ে যেত। আমার এরকম একটি লাল রঙের লঞ্চ ছিল। আমি সেই সময়ে এই মডেলের একটি বড় লঞ্চ বানানোর স্বপ্ন দেখতাম। যাতে করে খুলনা থেকে একা একা আমি আমার নানা বাড়ি চলে যেতে পারি।

প্রথম ক্লাশ ফাইভে থাকতে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে নানা বাড়ি চলে গেছিলাম। বাসায় সবার সে কি চিন্তা। পরে আব্বা মটর সাইকেল চালিয়ে খুলনা থেকে খবর পেয়ে নানা বাড়ি চলে এসেছিলেন। সেই ছিল আমার প্রথম বাড়ি থেকে একটু অন্যরকম মুক্তির স্বাদ পেতে পলায়নের ঘটনা। এক বছরের ভিতর আমি এভাবে তিনবার পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করেছিলাম। অবশ্য তার মূল্যও আমাকে আব্বার হাতে প্রচন্ড মাইর খাবার দ্বারা চুকাতে হয়েছিল।

আমার শৈশব শেষ হয়ে গিয়েছিল, যখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে চান্স পেলাম। ১৯৮৪ ইং সাল। ২১ তম ইন্টেক এর খায়বার হাউসের ক্যাডেট ছিলাম আমি। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সেখানে পাঠানোর দ্বারা আমার সোনালি অতীত- হিরন্ময় অতীত- আমার টারজান টারজান খেলার সেই মহামূল্যবান সময়কে জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল।

তবে সেখানেই বাপ্পী লাহিড়ির ‘সোনার অক্ষরে লেখা’ গানটি হৃদয়ে এতোটা বসে গিয়েছিল যে, আজ ও সেই আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে কতবার যে চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এসেছে… হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে… না লিখলেই মনে হয় ভালো হত। কেন ইচ্ছে করে হৃদয়কে ফেলে আসা স্মৃতির শাণিত কৃপাণে চিরে ফালা ফালা করা!!

এই ছিল আমার হীরার কুঁচিতে জাজ্বল্যমান সোনালী শৈশব, যা এখন হরিদ্রাভ বিষন্নতায় বিবর্ণ! আজ সকলের সাথে আমার অনেক না বলা স্মৃতি রোমন্থন করলাম। রুপালী আলোর জালে জড়ানো আঁধারের মত আমার শৈশব, আমার হৃদয়ে অজানা রাতের মত নীরবেই থেকে যেত; যদি না আজ ফেসবুকে প্রকাশ করতাম।।

#আমার_শৈশব_ফেলে_আসা_দিনের_স্মৃতি

১ ( কবিতাঃ দেখা, কাব্য গ্রন্থঃ হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ, কবিঃ শঙ্খ ঘোষ)

২ (রাশেদ রউফঃ বাংলাদেশের খোকা তুমি)

প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ


গত দীর্ঘ ৯ মাস ২ দিন আমার স্ত্রীর গর্ভের ভেতর বেড়ে উঠছিল একটি প্রাণের অস্তিত্ব। যা আমাকে বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। আমি একটা নতুন জগতের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। দিন দিন আমি আমার স্ত্রীর পরিবর্তন কাছ থেকে লক্ষ্য করেছিলাম। যা আমাকে একটি নতুন জগতের সাথে পরিচয় করে দিচ্ছিল। প্রতিদিন রাতে শুয়ে অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুনতাম। আর ভাবতাম কেমন হবে আমার সন্তান। ছেলে না মেয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিল না। আল্লাহ যা দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম এবং অপেক্ষায় ছিলাম একটি সুস্থ্য সবল সন্তানের আশায়। শত কষ্টের মাঝেও আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে আনন্দের উচ্ছ্বল ঢেউ দেখতাম। তার চেহারা দেখে আমার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে যেত।
আমার অনাগত সন্তানের বয়স যখন আট মাস তখন আমি আল্ট্রানোগ্রাম করিয়ে জানতে পারলাম আমার সন্তানটি মেয়ে হবে। অনেকে মেয়ে সন্তানকে অবহেলা করে। আমি মেয়ে সন্তানের সু-সংবাদটি পেয়ে এত খুশি হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করছি আমার সন্তানকে যেন সুস্থ্য দেহে ভূমিষ্ঠ করে।
অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখ রাত ১০:০০টার পর থেকে আমার মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আনন্দ বার্তা দিচ্ছিল। আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হলো। এক দিকে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করছিল, অন্য দিকে আমার স্ত্রীর অসহনীয় যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল তা দেখে আমার হৃদয়টা কষ্টের দাবানলে জ্বলছিল। আনন্দ লাগছিল এই ভেবে যে, আল্লাহর অশেষ কৃপায় যে কোন মুহুর্তে আমি আমার মেয়ের মুখ দেখতে পাব। মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী বলছিল ‘আমি মনে হয় মরে যাব। আমাকে মাফ করে দিও।’ আমি তাকে বার বার একই সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে, এ ধরনের অলক্ষণে কথা বল না। তোমার কিচ্ছু হবে না। একটু ধৈর্য ধর।
পরিশেষে ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২ খ্রীষ্টাব্দ, ২১ শাওয়াল ১৪৩৩ হিজরী, ২৫ ভাদ্র, ১৪১৯ বাংলা, রোজ রবিবার, সময় সকাল ৭:৩০ মিনিটে ভুমিষ্ঠ হলো আমার প্রথম কন্যা সন্তান। আমি তখন তার মুখ দর্শন করে তাকে কুলে নিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, সত্যি সত্যি আমি বাবা হয়েছি। আমি তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে এসেই সে মেয়েকে কুলে নেয় এবং তার পিঠে হাত বুলিয়ে আনন্দের বার্তার জানান দেয়।

দুখু মিয়া

দরিরাম পুরের দুখু মিয়া পারেনি দমিতে।
দুঃখিদের নিপীড়ন পারেনি সহিতে।
সামাজিক বিভেদের সংগ্রামী সৈনিক।
জা‍তীয় চেতনায় নির্ভয় নির্ভিক।
ক্ষুরধার ‍লেখনি তার শানিত অস্ত্র।
সাবলিল ভাষা তার ঐন্দ্রজালিক মন্ত্র।
কাব্যের ঝংকারে দূর্বিনীতদের করেছেন শত কষাঘাত।
শ্রাদ্ধ্ করেছেন রূপকের ছলে করেছেন পদাঘাত।
গেয়েছেন সাম্যের গান হয়ে মহিয়ান।
জাতি ধর্ম নি‍র্বিশেষে হয়ে বলিয়ান।
গানে গানে উ‍জ্জীবিত করেছেন নির্জীব জাতিকে বিজয় মন্ত্রে।
জুজুর ভয় পেরিয়ে উদ্বেলিত করেছেন অভয় মন্ত্রে।
দূর্জয় দুর্বার কাজী নজরুল অমর রবে কোটি কোটি প্রানে।
আমার অকুন্ঠ সন্মান বিপ্লবী বিদ্রোহী জাতীয় কবির জন্মদিনে।