বিভাগের আর্কাইভঃ সাহিত্য

ফুঁ দিয়ে যা

ফু দিয়ে যা

দালালবাদ আর পুঁজিবাদ
একই ধান্দাবাদের বাতাস
মুখোচোর আর জুতোচোর
একই ঘরে শিং খুরার রাত;
কে শিক্ষিত- কে মূর্খ বুঝা
বড় ভার! পেন্ট শার্টে বাহার;
সব একই মাটির দেহ পা
জীবন চলে শূন্য ফুঁ দিয়ে যা!
দালালবাদ আর পুঁজিবাদ
একই সূত্রে ফুলের মালায় কাদ।

০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯, ২১ মে ২৩

যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ

Screenshot

যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ
হ্যাঁ ততক্ষণ! জ্বল তুই জীবন
নির্বাণ অনলে
অনির্বাণ দহনে
স্মৃতির স্মরণে
বিস্মৃতির জাগরণে জ্বল!
জ্বল!
যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ!

যতক্ষণ দম আছে, জীবন- জ্বল তুই ততক্ষণ!
অন্তহীন ক্ষরণের জ্বালায় জ্বল
ঘুমহীন রাত্তির জ্বলায় জ্বল
অপেক্ষার বিষ গিলে গিলে জ্বল
দেখেও না দেখার ভানে জ্বল
জ্বল তুই সীমাহীন তুচ্ছতায়
ক্ষোভে অক্ষোভে নির্বাক কান্নার স্বচ্ছ জল ধারায়
জ্বল! জ্বল! জ্বল তুই জীবন
জ্বল তুই যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ!

তুই জ্বল
জ্বল তুই, যতক্ষণ ক্ষান্ত হবেনা মনের আগ্নেয়গিরি
যতক্ষণ না তৃপ্ত হবে-
সত্যের মুখে কুলুপ এঁটে মিথ্যার উত্তরসূরিরা;
তুই জ্বল
তুই মর, জীবন
মর তুই ধুকে ধুকে
এত ছলনা বেঁচে থাকতে সরল সত্য ধারণ করেছিস কোন দুঃখে!

জ্বলে জ্বলে দগ্ধের অতলে যদি বেঁচে থাকিস
ধিক্কারে, হুংকারে পদদলিত হতে হতে যদি দম ফেলিস-
ভাবিস না তোকে টেনে তুলবে ক্ষণিকের দয়া, জানিস না
অহংকারের দলিত থু থু নেভাতে পারবে না তোর জ্বলন্ত জীবন!

আর কত মূলে যাবি
জীবন এখানেই খুলেছে রঙের পসরা
আর কত চুড়ায় উঠবি
দগ্ধ পদমূল ভুলে গেছে হাটা; এখন ছন্দ হারা।

জ্বলতে জ্বলতে ছাই হবি
এই জীবনে পারবি না হতে একটি কবিতার কবি,
পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ হবি ঠিক
পারবি না তুই হতে ভালবাসার প্রেমিক।

তুই দগ্ধ হবি
স্বপ্ন সাজাতে যুদ্ধ করবি
রক্তের স্রোতে ভেসে যাবি
কাঁদতে কাঁদতে অক্ষি কোঠর শুকিয়ে ফেলবি
কিংবা-
প্রাণপণে ভিক্ষা চাইবি একটুকু প্রেম;
বলতে পারিস- কি পাবি?
দহনের দাহ্য তিরস্কার
মরণের অনিবার্য ধিক্কার!

সব সত্য অস্বীকার করে
অবশেষে তুই-ই মিথ্যা বলে গণ্য হবি!!

আমাকে রঙধনু দিবি

ghj

তুই আয় চলে, তুই অদৃশ্য কেউ
বুকের নদীতে তুলে যা সুখের ঢেউ
তুই রঙধনু রঙ আকাশ হয়ে যা,
তুই রোদ হ’ আমি যে বিষাদের জলে ভেজা।

তুই আকাশের মেঘ এনে দে
হাতের মুঠোয় শুভ্র রঙ দে বেঁধে
জানিস? আমার ভালো না লাগার এ বেলা,
ভাসিয়ে আয় কাছে তোর প্রেমের ভেলা।

অযথাই থেকে যাস না দূরে
ইচ্ছে হয় আকাশের মেঘে মেঘে তোকে নিয়ে বেড়াই ঘুরে
নিয়ে যা তোর কল্পরাজ্যে আনায় টেনে
মনের বাড়ি দে না তুই সুখ এনে।

কেমন যেন চুপসে আছি, ভাল্লাগে না কিছু
তুই শুভ্র মেঘ হয়ে নে পিছু
চোখের তারায় কিছু স্বপ্ন দে না
মন আমার হয়ে যাক তোর, যা মুগ্ধতার দামে কেনা।

দীর্ঘশ্বাসের প্রহরগুলো উড়িয়ে নিয়ে যা
দিস না আর একা থাকার সাজা,
চোখের গহীনে তুই স্বপ্ন হয়ে আয়
বেঁধে রাখ আমায় ভালোবাসার মায়ায়।

আকাশের মেঘের যত রঙ, এনে দিবি?
তুই হবি আমার সুখ আনন্দের অস্পৃশ্য পৃথিবী?
কোথায় করিস তুই বসবাস
আয় উড়ে, হয়ে যা আমার শুভ্র মেঘাকাশ।

.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, চুনারুঘাট)

সিঁথির ছাপাখানা

এক যুবতী অন্ধকার, সন্ধ্যা দাঁড়ায়ে-
তার শরীর হতে বেরোচ্ছে জ্যোৎস্না
দারুণ সুখবোধ সমর্পণ করে করে
শাহবাগ আর যাদুঘর- রেখাগণিতে
উঁকি দিয়ে দেখছিল ইতিউতির কবি
আমি তার লুব্ধতায় পাশে দাঁড়াই
মাপছি- নিজের উচ্চতা, কেবল রং

পাখির লবণাক্ত ঠোঁটে নির্মিত সুর
ছেপে যাওয়া গান, অসমাপ্ত বাক্যে
সিঁথির ছায়া ধরে প্রেম আর ছাপাখানা-
মূলত ঘরে ফেরা শিল্প নিয়ে হৃদয় স্থল
কবিতা লেখার সবুজ দিনে মনে রাখা
সোনারোদ মুখ শাসন করছে কবিতা!

উড়ুক্কু বেলার গান

বারংবার আরশিতে মুখের মানচিত্র দেখি
সে যেনো এক স্বৈরশাসক!
যদিও চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে
তবুও কমেনি এতোটুকু তেজ!

পান থেকে চুন খসতে তবুও দেরি হয়
ইগোর পারদ সীমালঙ্ঘন করতে দেরি হয় না
আশেপাশে কতো বৃষ্টি হয় মুষলধার
বলতে পার, ইগোরা কেন এতো বড়সড় চামার?

এই জীবন কি তাহলে নিছকই খেলা
ইগো আর সুপার ইগোর জমজমাট মেলা
তবুও এভাবেই একদিন ফুরিয়ে যাবে
ইস্টিশনের এই উড়ুক্কু কালবেলা…?

ঠিকানা

ঠিকানা খুঁজেছো কার, নেই পথ যার হারাবার
এখন আমি উদাস ফকির আকাশে কারবার!

ঠিকানা একটা ছিল বটে, সবুজে শ্যামলে ঘেরা
ছিল তখন ছন বাঁধানো ছোট্ট একটি ডেড়া
পিপিলিকা দল উঠান বেয়ে দৌড়ে যেতো স্ত্রস্ত
মাটির বুকে আঁকাবাঁকা পথ হতো সাব্যস্ত

কদম ফুল বিলকুল খা খা রোদ্দুর
কৃষ্ণচূঢ়া রক্ত লালে রাঙাবে কদ্দুর?

আমি উদাস ফকির, তারা দানা তসবি গুনি
প্রাণীসম দেহমাঝে মানুষ নামে স্বপ্ন বুনি।

নামদেহ

যেসব সুমন এখনও পুরনো নামে আছে
মুখের চামচে টলমলে পহচান নিয়ে
পা-টিপে হাঁটছে রাস্তায়
তারা মৌরলা মাছের দাম ভাবছে
স্বাতী নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে
রোববার চুলকাটা সেলুনে বিষণ্ণ ছেলেকে নিয়ে লাইন দিয়েছে

যেসব সুমন নিজের শিরোনাম একরোখে চালিয়ে দেয়নি মেয়েদের বিভক্ত ব্যথার ওপর
লোকমান্য ইফতারে দোকানে ফলের গায়ে
হাত রেখে ছ্যাঁকা খেয়েছিল
এই ভিড় ট্রেনে যারা গলার পেছন দিয়ে গান গায়
রাত্তিরে বিছানায় চুপচাপ খোলে
বউ-লেখা ব্যাজার সুটকেস

তাদের লটারি নম্বর, শোলার মটুক কিম্বা
ফেসকাটিং-এ আলো পড়ল না।
যারা সাতের পিঠে পাঁচবার এক-বোয়েম খটাখট লজেন্স বেচার স্বাধীনতা —
নিজেদের নাম-দেহ ছুঁয়ে উঠোনে ব’সে আছে, আর
বড়রাস্তায় নিউ সুমনের স্বপ্নে থোকা-থোকা বিজ্ঞাপনের বিরতি

আরো দূর অন্ধকারে

জোৎস্না নিতে জানেনা কোনো ব্যথা
অদ্ভুত এক আলোমায়া তবু
বিছিয়ে রাখা জাল তার
চাপ চাপ অন্ধকারে
জমায় রহস্যকথা ঘণ
এইখানে আকাশের নীচে
মাটির উপরে
ক্ষমতাহীন মানুষ এক
চাঁদের আলোয় আর নিজের ছায়ায়
কি যেন এক আকুলতায়
খুঁজে ফেরে কিছু
চন্দ্রমা আলো ছেড়ে আরো
আরো দূর অন্ধকারে…..

শাশ্বত সুন্দরের মৃত্যু

ffgh

কত কিছুই জানা হয় না, জানা যায় না। কেন-
প্রতিদিনের সেই একি জানালায় ঝুলে থাকে ভাঁজ করা চিবুক।
কেন, এক জন যুবক
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে তুলে আনে নিত্যনতুন অসুখ!
কেন বিদীর্ণ ভাস্কর্যের চেয়ে ঢের ম্লান হয় মানুষের মুখ ।
কতটা নৃশংসতায় ক্ষান্ত হয় নপুংসক হায়েনা
জানা যায় না- তুষের অভ্যন্তরে কতটা উত্তাপ
প্রগতির শৃঙ্খল ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি চাপ।

জানো কি?
কতটা দহন হলে একটা জীবন আকুতি করে মৃত্যু কামনায়!

অন্যরকম উৎসব

হাওয়ার গান শুনছি-সন্ধ্যার আগে
পাখিরা বয়ে বেড়াচ্ছে-বনবাস
সে অন্যরকম বিপ্লবাত্মক প্রবেশ
এত দৃশ্য, যেন সহজাত পরম্পরা-

এরকম সিম্ফনির ঘোরছায়া এল
যেদিকে তাকাই ডেটলের গন্ধ
আর বিবিসি সংবাদ, রূপকথা-
ঝুঁকে আছে-শাদা কাতানে ভর
করে মৌসুম গান আর শরীর,
সটান পিঠের নিচে সুসাস্থ্য ঘাস
ও মাটি খুব নম্র উৎসব নিয়ে
গ্রাম এবং দীর্ঘ শহর ঘিরে
চিত্রল হরিণীর বাদাবন, বসন্তকাল
এমন শাসন ছায়া ইত্যাদি~ইত্যাদি!

দুটি কবিতা

বীজের সখীত্ব ঘেরা রোদের জীবন ♦

অবশেষে আমিও ভাবতে শুরু করেছি, বীজের সখীত্ব ঘেরা রোদের গার্হস্থ্য
জীবন। কীভাবে জমিয়ে রাখে সবুজ কোলাহল। কীভাবে পাখিদের পাশে দু’মুঠো
খুদদানা ছিটিয়ে দেয় কিষাণী বালিকা। খুটে খাওয়ার দৃশ্য দেখে দাঁড়ায় দুপুর,
এই মধ্যনদীতে যারা নৌকো বেয়ে যায়, তারাও থামে। অতিক্রান্ত জোয়ারের
ধ্বনি বুকে নিয়ে বাঁচে যে মনন, সে তো থেমে গেছে অনেক আগেই। বিধ্বস্থ
আকাশ থেকে স্বপ্ন চুরি করে আমরা যে ছাউনী সাজিয়েছিলাম, বিপন্ন চাঁদের
সাথে- সে ও কাটায় রাত। আর অপেক্ষায় থাকে- মেঘের ঘনত্ব কেটে যাবে
ঠিকই। স্বপ্নেরা স্পর্শ করবে বিষুববৃত্তান্ত মাখা উষ্ণতার হাত।
#

হলুদ বৃষ্টির ছায়া ♦
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মাঝে মাঝেই আমি কান্না ভুলে যাই। মাঝে মাঝেই,
একগুচ্ছ হলুদ বৃষ্টি আমাকে আলিঙ্গন করে।
অনেকগুলো বিষাদ-
সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায়।

অনেকগুলো মৃত্যু,
আমার চারপাশে ছিটিয়ে যায় ফুল, পরাগের প্রহর।
আমি মানুষের প্রস্থানদৃশ্য দেখি। দেখি,
আকাশে আকাশে তারা হয়ে ঝলক দিচ্ছে
যে প্রাণ,
একদিন তারা মাটিতে ছিল। ছিল আমার প্রতিবেশী,
আমার স্বজন।

বেদনার ত্রিভুবনে যে দেহগুলো ঢাকা পড়েছে হলুদ কাপড়ে,
আমি আবার তাদের ছবিগুলো দেখি।
উড়তে উড়তে প্রেমিকার বাহু জড়িয়েছিল যে প্রেমিক,
কিংবা যে শিশু উড্ডয়নের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়েছিল
তার মায়ের কোলে-
তাদের মুখছবি আমার দুচোখে ভেসে যেতে থাকে।

কোনো সংবাদই আমি আর পড়তে পারি না।
সকল আকাশকেই আমার অবিশ্বস্ত মনে হয়..
সকল কান্না’কে মনে হয়,সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া
এক একটি পাখির কঙ্কাল।

তোমায় দিলাম এক ঝাঁক ফুল ভালোবাসা

346AA

মন দেয়ালে রাখিয়ো টানিয়ে, দিলাম এক ঝাঁক ফুল ক্যানভাস
মন বাড়ীতে ছড়াক সে ফুলের সুভাস
তুমি মুগ্ধ হতে হতে হও সুখে মাতোয়ারা
ঠোঁট চুয়ে পড়ুক আজ প্রেমের ফোয়ারা।

মিষ্টি রঙ কসমস ফুলের মত মন হয়ে যাক আজ
নরম নরম, হাওয়ায় দোল খাওয়া মন তুলুক গলায় মিহি আওয়াজ
তুমি আবেগী হও, কও ভালোবাসার বুলি;
সে বুলি শোনে মনের শাখে আমার ফুটুক প্রেমের কলি।

অন্যরকম হয়ে যাও
গলা ছেড়ে আজ গান গাও;
মুগ্ধ হও একবার, তুলে দিলাম হাতে ফুল উপহার
ফুলগুলো মনে তোমার ছড়াক মুগ্ধতার রঙবাহার।

চোখের তারায় ফুলের জ্যোতি পড়ুক ছড়িয়ে
মুগ্ধতার সুখে তোমার দু’চোখ আসুক জড়িয়ে
তুমি স্বপ্নময় ঘুমে হও আচ্ছন্ন
আজ তুমি প্রেমী হও আমার জন্য।

বিনিময়ে বলো ভালোবাসি
চাইছি মনের তারে তারে বাজুক সুখ বাঁশি
সময় ফুরিয়ে গেলে কিছুই হবে না গো কিছুই হবে না
তুমি ফুল হলেও তখন ভ্রমর কথা কবে না।

এই নাও ধরো হাতে এক ঝাঁক ফুল
তোমার আমার ভুলগুলো হয়ে যাক ফুল
ফুলের কলিতে কলিতে এঁকে দিয়ো প্রেম চিহ্ন
আজ থেকে মন দু’জনার না থাকুক অভিন্ন।

.
(ক্যানন ডি৬০০, শালবনবিহার কুমিল্লা)

মরা ব্যাঙের নাচ

মাঝে মাঝে আমায় বোবায় পায় বলে বাক্যি হরে যায়। মুখে তখন একটা অদৃশ্য ‘কালা হাতে’র মতো সেলোটেপের অস্তিত্ব টের পাই, আর বুকের উপর দিয়ে গোদা পায়ে কেউ নির্ঘাত হেঁটে চলে যায়। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তরে একখানা অক্ষর পর্যন্ত মুখের পেট থেকে খসাতে যন্ত্রণা ও চরম অনিচ্ছা। ফলত অন্তর্জলি যাত্রায় বসা লোককে গঙ্গোদক দেবার সময় যেমন নূন্যতম ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দেওয়া হয়, আমিও তেমনি আধমরা ঠৌঁট ফাঁক করে উত্তর দেব দেব করতে করতেই টাইম আপ! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আমি আসলে মুখ ভেটকে গেলাস ভর্তি নিমপাতার রস গেলার মতো একটা এক্সিসট্যান্স। সুতরাং কথা খরচ করতে হলে আমি একেবারেই নাচার।

একই অবস্থা হয় লেখার বেলাতেও। একখানা অক্ষর লিখতেও আঙুল চলে না। খাতায় কলমে লেখা তো কবেই বিগত শতাব্দীর গোলাপফুল আঁকা মরচে ধরা তোরঙের মতো গতায়ু হয়ে চিলেকোঠার ঝুল ধুলোয় কিছুটা কেতড়ে পড়ে আছে। তার উপর ঠাকুমার গায়েহলুদে পাওয়া মাদুরখানা কাঠি ও সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গুটনো আছে মণখানেক ধুলো মেখে। তাকে দেখে মনে হবে একদা অষ্টাদশী বিয়ের কনেটি রূপ-যৌবন ও তৎসহ পেশিটেশি হারিয়ে ঝুল, মানে ঝুলঝুলে চেহারাপ্রাপ্ত। খাতা-কলম জিনিস দুটোর এখন অনেকটা সেই দশা। কেবল মাঝে মাঝে সরকারী ফাইলের অন্তবিহীন গতিহীন লাইনে লাইন লাগানোর জন্য দরখাস্ত-টরখাস্ত লিখতে দরকার লাগে। তো লিখতে ইচ্ছে করে না যেমন তেমন বিষয়, তার থেকেও বড়ো কথা হলো মনে হয় যেন লিখতেই পারব না। – আমি লিখতে জানিই না – কোনো দিন লিখিইনি! এসব ভাবনার পাশাপাশি প্রচন্ড একটা ভয় জেঁকে বসে।

ধরুন, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। বড়দি ক্লাসে ঢুকছেন, এক্ষুণি রেজাল্ট ঘোষণা হবে। আর ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে চোখ মাথায় উঠে গিয়ে মাথা লাট্টুর মতো ঘুরছে আর থেকে থেকে দ্যাখ বাবাজী দেখবি নাকি করে চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর বিদ্যুত ঝিলিক মারছে। কারণ আমি তো জানি, কী হতে চলেছে! ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ছিলাম গ্যালিলিওর জ্যাঠাইমা। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ঘন্টা পড়ার দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং অনেক হিসেব করে আমার ধারণা দৃঢ় হলো অঙ্কে চব্বিশ পাবো। কিন্তু সবথেকে বড়ো ট্রাজেডিটা হলো, অঙ্কে মেরেকেটে তিরিশ পেলেও আমি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে গেঁটিয়ে বসতে পারতাম। কেন, কীকরে সে অন্য গপ্প। তো বারফাট্টাই থাক। বড়দি তো রেজাল্ট বলছেন, – বলছেন – ভালো ভালো রেজাল্ট বলা হয়ে গেল, নিজের নামটা কানে শুনলাম না। নাকি নিজের নামটাই ভুলে গেছি রে, বাবা! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? টেনশনে নন-সেন্স হবার মুখে প্রায় সব শেষে একটা বিষয়ে ফেল মেরে উত্তীর্ণ হবার ঘোষণায় আমার নাম এক্কেবারে পেত্থমে! হুঁ হুঁ বাবা! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। অঙ্ক শিখি যে কাকুর কাছে তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তমমধ্যম খেয়ে মুখের ভূগোল পাল্টে গেল বটে, ক্লাস সিক্সে কিন্তু এ শম্মাই অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল এটাও মনে রাখবেন! তবে জীবনে ওই একটিবার। তারপর মাধ্যমিক পর্যন্ত ঘষটে ঘষটে মাজা ব্যথা নিয়ে অঙ্ক টপকেছি।

কিছু মনে করবেন না, এক কথা বলতে বসে অন্য কথায় কিস্যা বহুদূর চলে এলো। একেবারে “শিবেরগীত” শেষ করে বাঁকের মুখ থেকে ফেরৎ আসছি। যা বলছিলাম, লেখার ভয়ে তো হার্টবিট মাথায় ফিল করি আমি। নানা জায়গাতেই ফিল করি, এমনকি যেখানে হার্ট আছে তার ঠিক উল্টো দিকেও ঢিপ ঢিপ করে। মানে বাম দিকের বুকের পাঁজর পার করে পিঠের দিকে হার্টবিট চলে।

দূর ছাই! আবার ফালতু বকছি! বলছিলাম লেখা ও কথা মাঝে মাঝে মনের ভেতর হুুড়কো লাগিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকে। সন্দেহ হয়, অ্যালঝাইমার হলো নাকি! একটা শব্দ, একটা ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্য – কিচ্ছু মনে পড়ে না মাইরি! অথচ বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে লিখেছিলেন – ঐক্য বাক্য মাণিক্য। কিন্তু আমার তো সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হার্ট ফুসফুস কিডনি মগজ – সব ছতিচ্ছন্ন। সুতরাং ঐক্য ও বাক্যের হাত ধরাধরি প্রেমের মাণিক্য আসবে কোত্থেকে?

অথচ কথার চাষ চলছে দুনিয়াময়। কত ধরনের কথা। রূঢ়, প্রেমময়, স্নেহময়, তৈল নিষিক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খুব ভালো উপলব্ধি হয় উক্ত ধরনগুলি। আর দরকারী কথা বাদ দিয়ে ফালতু কথায় তীরের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে, না-কে হ্যাঁ, আর হ্যাঁ-কে না, দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে এমন এলেমদার কি কম পড়েছে? রাজনীতির লোকেরা আছেন তো! পড় পড় পড় পড়বি পাখি ধপ! – চোখ সরু করে মনে মনে বীজমন্ত্র আওড়ালেও, পাবলিক প্লেসে কথা বলার সময় সাধারণত কপালের চামড়ায় ইস্ত্রি মারা থাকে।

আর যারা কথা বেচে খান, সে সেক্টরটাও নেহাৎ কম যায় না। কাউকে একটুও ছোট করার নটখটামি না করেই হাত তুলছি, ছাড়ুন তো – কথা বেচতেও “এলেম” লাগে আগেই বলেছি! সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে। কত সূক্ষ্ম হিসেব কষতে হয় বলুন তো? দল, অর্থ, টিআরপি, কাকে চটাবে, কাকে রাখবে – তেমন তেমন ঘটনা ঘটে গেলে অচানক চানক্যবাজি সহজ নয়। আরও আছে, শুধু ওরাই যে নন সে যে বাপু আর বলে দিতে হবে না, তা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

দুঃখ হচ্ছে, “কথা বেচে খাওয়া” লোকজনের কথা বাদ দিলে কথার চাষ অধিকাংশ সময় শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ ঠিক কথাটা ঠিক সময়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বলতে পারি না। হয়তো বা বলতে চাইও না। ছা-পোষা মানুষ আমরা, বাঁশ খেতে চাই না, বড়ো ভয় পাই কার লেজে কখন পা পড়ে যাবে ঠিক কী! হতে পারে সে কোনো গনহত্যা বা এককের উপর অবিচার। হতে পারে কোনো কোটি কোটির ঘাপলা কেস। আমরা ফুটানি করি, ট্রোল করি, ফাজলামি করি – এই পর্যন্ত। আবার ধরুন, হয়তো আপনাকে কেউ বেশ দু-কথা বলল, আপনি ঠিকই বুঝলেন, সে লোক যতই দাঁত কেলিয়ে বলুক না কেন, কথাখানা অপমানেরই। অথচ আপনিও দাঁতটাই কেলালেন, কিন্তু উপযুক্ত যে কথা দিয়ে তাকেও আচ্ছা করে কেলানো যেত, সেটা পরে মনে করে নিজের মনেই ফুঁসবেন। তখন গালাগালটা যে অ্যাকচ্যুয়েলিই কেবল নয়, বরং “দুইচ্যুয়ালি”ই নিজেকেই দেওয়া উচিত সেই মুহূর্তে ফিল করে নিজের গালেই চড় কসাবেন।

কথা না বলেও যথেচ্ছ প্রতিবাদ করা যায় বটে! ভেরকরের বই পড়েছিলাম, সাইলেন্স অফ দ্য সি। অনেকদিন আগে পড়া। স্মৃতি ল্যাং দিতে পারে, তবু যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ফ্রান্সের এক গ্রামে জার্মানীর সৈনিকদের সঙ্গে কেউ একটি কথাও না বলে নিরুচ্চার ঘৃণা দিয়ে তাদের ইগো দুরমুশ করে দিয়েছিল গ্রামবাসী। তাই কথার সঙ্গে সঙ্গে নৈঃশব্দও হাতিয়ার হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে। আমরাও যদি পারতাম, অসৎ রাজনীতির লোকেদের নিঃশব্দে উপেক্ষা করতে!

সংসার রাজনীতিতে কথার চাষাবাদ, সার-চাপান, ল্যাং মারামারি হামেশাই চলে। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের কিংবা রামায়ণের যুদ্ধুর ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মানন্দ অস্ত্র, শিলীমুখ, ঐশিক, অশ্বমুখ ইত্যাদি হরবখতই কথার ধনুকে পরিয়ে বেমক্কা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তাতে ঘায়েল হয়ে অসার জীবনসহ দিল দরিয়ায় ভেসে যেতে চায় বটে, তবে অচিরাৎ মৃতসঞ্জীবনী আমাদের দিব্যি বাঁচিয়ে তোলে। বেড়ালের নটা জীবন তো সংসার রণাঙ্গনে বাঁচার ফিরিস্তির তুলনায় নস্যি।

তবু এক একসময় দুম করে আঁতে লেগে যায় বইকি! তখন মনে হয় কে আমি, আমি কার। দারা পুত্র, থুড়ি পতি কন্যা কে কার!

সবমিলিয়ে জীবনের সারসত্য আবিষ্কার হয়েছে ধীরে ধীরে। আমাজনের জঙ্গলে খিদে তেষ্টায় কাতর পথহারা আবিষ্কারকের থেকে কম অভিজ্ঞতা লাভ হয়নি সেজন্য। এই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত প্রত্যেকেরই প্রায় নিজস্ব পাদটীকাটি হলোঃ এযাবৎ ভুবনে ভ্রমে ভ্রমণ করেছি।

যে চুলোর পাড়ে গেলে সত্যি সত্যি মানবজনমের সোনা ফলে তেমন কোনো চুলোর পাড় তো জোটে না। তাই সমাজ ও সংসারের চুলোয় দিবারাত্র পুড়ে কয়লা হতে হতে কখনও কখনও বোবায় ভর করে। অথচ শেষ পর্যন্ত কোথাও যাই না আমরা। অশ্বডিম্ব প্রসব করে কাঁটার মুকুট পরে জীয়ন্তে আমরা জলে ডোবা মৃতদেহ। ফুলে ঢোল উপুড় হয়ে ভাসছি চারদিকে নাচতে নাচতে। পুব থেকে হাওয়া বয় নাচতে নাচতে ঘুরে যাই পশ্চিমে। পশ্চিম থেকে হাওয়ার তালে পুবে। এইভাবে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মরা ব্যাঙের নাচন নাচছি – যে মরা ব্যাঙের ভেতর একদা বিদ্যুৎ ছিল।

মরা ব্যাঙকে নাচিয়েছিলেন বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি জীবদেহে বিদ্যুতের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে। কোনো গ্যালভানি কোনো একদিন কি আমাদের আগাপাশতলা এমনই বিদ্যুৎ ফুঁড়তে পারেন না, যাতে আমরা নড়ে উঠতে পারি চরমভাবে বিদ্যুৎবাহিত হয়ে? কে জানে, কখনও হবে কিনা! তা যদি হয় কোনোদিন, তবে হয়তো কথার উৎসমুখ খুলে গিয়ে আমাদের অসহ্য এই নোনাধরা জীবনে আর কখনও তাকে বোবায় পাবে না।

(প্রকাশিত)

অভাবে সবই বিসর্জন

nitai

মান জ্ঞান ধ্যান সাধন
অভাব অনটনে হয় বিসর্জন
ভুলে যায় গুরুর বচন
চেষ্টা শুধু ক্ষুধা নিবারণ।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি,
গরিবের নাই যে গতি
ভিক্ষা চাইলে মারে লাথি,
তবুও থাকে দুহাত পাতি।

গুরুর বাক্য শুনে না তখন
পেটে ক্ষুধা লাগে যখন
ধর্মের নিয়মও হয়না পালন
দুঃখ যখন করে আগমন।

জীবনাবাস (২)

ssdfoo

জংলার ধারে বসে আছে
নিদ্রা কাতুর বক
ঠা ঠা রোদ্দুর
পোড়াচ্ছে দুপুর, ম ম আমবাগান!
বসে আছি আজন্মকাল
নির্লিপ্ত ধ্যানে
ভেসে গেছে সমগ্র জীবন
খামখেয়ালির মনে।
বাকানো খেজুরের ডালে
ঝুলে আছে বাবুইপাখির প্রাসাদ
তাবত আকাশ জানে
মেঘের কাননে জমেছে কষ্ট- বজ্রনিনাদ!