বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অণুগল্পঃ বিবর্ণ নিঃসঙ্গতায়

বিবর্ণ নিঃসঙ্গতায়

সম্পর্কটা মিলির সাথে যেদিন ভেঙ্গে গেলো, সেদিনও হলুদ পাতারা ঝরে পড়ছিলো। একপশলা বৃষ্টি অসময়ে সামনের সব কিছু দৃষ্টিতে ‘স্লিপি’ এবং বড্ড চকচকে করে দিয়ে গেলো।

দূরের গাছ তিনটি ছাড়িয়ে আরো দূরের ঝাপসা সবুজের পানে চেয়ে থাকা যুবকটির হৃদয় চিরে যাচ্ছিল.. বুক পুড়ে মন নিজেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে গলন্ত মোম হয়ে নিজেকেই জ্বালিয়ে চলেছিল!

প্রত্যাখ্যাত প্রেম হলুদ পাতার বিবর্ণতায় ভেসে ভেসে, চরম জিঘাংসাকে বুকে নিয়ে ভালোবাসার এক পশলা বৃষ্টিস্নাত কোমলতায় ডুবে ডুবে শেষে স্বাভাবিক হলো এক বিষণ্ন পাতা ঝরার দিনে।

বুদ্ধিমান কৃপণ জামাই ও শ্বাশুড়ির গল্প

বুদ্ধিমান কৃপণ জামাই ও শ্বাশুড়ির গল্প

এক বুদ্ধিমান কৃপণ জামাই যাবে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি যেতে হলে হাতে করে কিছু-না-কিছু নিতেই হয়। না নিলে আর মানসম্মান বলতে কিছুই থাকে না। এই নিয়মটা ধনী গরিব সবার জন্যই প্রযোজ্য। তাই বুদ্ধিমান কৃপণ জামাই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে এক মিষ্টির দোকান থেকে একটা দইয়ের পাতিল কিনে, রওনা হলো।

শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দইয়ের পাতিলটা শ্বাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দিলো। শ্বাশুড়ি জামাতার হাত থেকে দইয়ের পাতিল নিয়ে রান্নাঘরে ছিকায় ঝুলিয়ে রাখলো। জামাই শ্বশুরবাড়ি গেল বিকালবেলা। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাড়ির আশে-পাশে ঘোরা-ফেরা করে বাড়ি ফিরলো রাত ৯টায়। এদিকে জামাতার আগমনে শ্বাশুড়ি কয়েকরকমের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেললো। জামাই বলে তো একটা কথা আছে, তাই।

শ্বাশুড়ি জামাইকে বলছে, বাবাজি হাত মুখ ধুয়ে এসে রাতের খাবারটা সেরে নাও।

শ্বাশুড়ি বলার আগেই তো জামাই বাবাজি হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে বসে আছে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। সাথে আছে কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা বড় এক দইয়ের পাতিল। কখন যে দই খাবে, সেই চিন্তাই জামাই বাবাজির মনটা আনচান আনচান। অনেক অপেক্ষায় থাকার পর শ্বাশুড়ির ডাক পড়লো এখন। ডাক পড়ার সাথে সাথে কৃপণ জামাই একটু তাড়াতাড়ি করেই রান্নাঘরে থাকা খাবারের টেবিলের এক কোণে গিয়ে বসলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবারের টেবিলের চারকোনা ভরে গেল। বাসলো শ্বশুর, শালা, শালিরাও। শ্বাশুড়ি খাবার পরিবেশন করছেন। খাবারের তালিকায় ছিল, মুরগি মাংস, গরুর মাংসের ভুনা, রুইমাছের ঝোল, মসুরের ডাল সহ আরও কিছু শাকসবজি। সবাই মনের আনন্দে খাচ্ছে। কৃপণ জামাই বাবাজিও সবার সাথে তাল মিলিয়ে খাচ্ছে ঠিক, তাঁর নজর কিন্তু টাকা দিয়ে কেনা দইয়ের দিকে। খাচ্ছে আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু দইয়ের পাতিল তাঁর নজরে পড়ছে না। মনে মনে কৃপণ জামাই চিন্তা করছে, দইয়ের পাতিলটা আমার শ্বাশুড়ি কোথায় লুকিয়ে রাখলো? ভাবনার বিষয়ই বটে! তারপর দেখা গেল মাথার উপর দইয়ের পাতিল ছিকায় ঝুলানো আছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, দেখি শেষতক কী হয়?

খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ পর্যায় এসে পড়লো। শালা-শালি, শ্বশুর আব্বাও খাবার খেয়ে চলে গেল। এখন খাবারের টেবিলের এক কোণায় শুধু জামাই বাবাজিই বসা। জামাই শুধু দইয়ের কথাই ভাবছে! আর মনে মনে বলছে, আমার শ্বাশুড়ি তো দইয়ের কথা একেবারে ভুলেই গেছে। এখন উপায়? ভেবেচিন্তে বুদ্ধিমান কৃপণ জামাই মাথায় একটা বুদ্ধি ডাউনলোড করে ফেললো। বুদ্ধি হলো, একটা মিথ্যে গল্প শুনিয়ে শ্বাশুড়িকে দইয়ের কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। গল্পটাও কৃপণ জামাই রেডি করে ফেললো। শ্বাশুড়ি কিছু জিজ্ঞেস করলেই, শ্বাশুড়িকে মিথ্যে গল্পটা শোনাতে হবে। এই ভেবেই জামাই খাওয়ার টেবিল থেকে আর উঠছে না, বসে বসে শুধু খাওয়া পাতে ঘষামাজা করছে।

এদিকে শ্বাশুড়ি মনে মনে ভাবছে, জামাই বাবাজির পেটের ক্ষুধা মনে হয় নিবারণ হয়নি। তাই খাবারের টেবিল থেকে ওঠছে না।

সামনে গিয়ে শ্বাশুড়ি জিজ্ঞেস করলো, বাবাজি আর কিছু লাগবে?
জামাই– না আম্মা, আর কিছু আমার লাগবে না। তো একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাই বসে বসে ভাবছি আম্মা।
শ্বাশুড়ি– কী কথা বাবাজি? বলো শুনি!
জামাই–আম্মা আপনাদের বাড়ি আমি আর আসবো না।
শ্বাশুড়ি– কেন বাবা, কেন? কী হয়েছে বলো দেখি?
জামাই– না আম্মা, তেমন কিছু হয়নি। তবে আপনাদের বাড়ি আসার পথে একটা সাপ দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম তো, তাই।
শ্বাশুড়ি– বলো কী বাবা! কোথায়, কোনখানে?
জামাই– ঐযে, আপনাদের বাড়িতে আসা দুই সাইটে বাগান আর জংলার মাঝখান দিয়ে রাস্তার মাঝে। অনেক বড় বিষাক্ত সাপ, আম্মা। দেখেই আমার শরীর শিউরে ওঠলো!
শ্বাশুড়ি– হায় হায়! বলে কী জামাই? তা কত বড় সাপ হবে, জামাই বাবাজি?
জামাই– অনেক বড় সাপ আম্মা! তা আমার এই খাওয়ার থালা থেকে ঐযে ছিকার উপর ঝুলানো দইয়ের পাতিলটা দেখা যাচ্ছে? ঠিক এতো বড় হবে আম্মা।

এই বলেই জামাই পানির জগ হাতে নিয়ে হাত ধোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর শ্বাশুড়ি নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো, হায় হায়! আমার জামাই তো এই দইয়ের জন্যই এতক্ষণ যাবত বসে আছে! আমিতো দইয়ের কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম।

তাড়াতাড়ি জামাই বাবাজির হাত ধরে শ্বাশুড়ি বললো, হাত ধুয়ো না বাবা, দই আছে। এতো কষ্ট করে দইয়ের পাতিলটা এনেছ, না খেলে কি আর হয়! আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম বাবা। এখন দই খাও।

জামাই– আমিও তো আম্মা তা-ই ভেবে আপনাকে মিথ্যের সাপের গল্পটা শোনালাম। কারণ, আমার অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে এই দইয়ের পাতিলটা কেনা। না খেলে কি আর চলে? দেন, দেন আম্মা, তাড়াতাড়ি দেন!

আমরা কি এতো বুদ্ধিমান জামাই হতে পেরেছি? মনে হয় না!

অণুগল্পঃ শুধু পটে লিখা

অণুগল্পঃ শুধু পটে লিখা

‘কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে
তখন তুমি ছিলে নাতো ছিলে না
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে’*

গানটি বেজে উঠতেই, দশ দিক থেকে আবেগ মিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল নেয়। বাইরে ঝড়.. তুমুল বৃষ্টি.. টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ঘরে নিঃশব্দে প্রবেশ করা বিশেষ কেউ একজনের পদশব্দ, সেদিন কেউ শুনতে পায়নি।

এই গানটি বেজে চলেছিল সেই রাতেও। বাইরের লন্ডভন্ড প্রকৃতির সাথে সাথে একজন নারীও লন্ডভন্ড হয়েছিল সেই কেউ একজনের দ্বারা। বড্ড ভালোবাসত নারী তাকে। কিন্তু সেই একজন তাকে ভালোবাসেনি একটুও। তার কাছে নারী কেবলি ছিল একজন যুবতী, যার সুডৌল দেহে ইচ্ছেমত আলপনা আঁকা যায়।

এঁকেও ছিল সেই একজন।
তারপর…?
কেবলি এক নতজানু দীর্ঘশ্বাসের জীবন!

*কবিগুরুর গানের কলি।

অণুগল্প : এ_কোন_আমি

কিছু কিছু অণুগল্প গল্পকারের বিশেষ কিছু অণুমুহুর্তের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। নিজের থেকে নিজেকে বেশী আর কে চিনে? নিজের অনুভব কে তো আর গল্পকারের কল্পনা থেকে নেয়া লাগে না..

এরকম একটি অণুগল্প ‘এ কোন আমি’ আমার টানা গোলাম জীবনে এমনই এক মাঘের রাতে লিখেছিলাম। শেয়ার করছিঃ

#এ_কোন_আমি?
______________

নিজের গোলাম জীবনের এক অণুক্ষণে একজন গোলাম আমান একচিলতে আলোর প্রত্যাশায় গরাদের সামনে একা। বন্ধুর সাথে একটু আগের বলা কথাগুলো ভাবছে একা একা। বলছে কথা, একার সাথে একা।

‘বাবার সাথে থেকে থেকে বড্ড স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখেছিলাম.. নাকটা কি তাই বাবার মতই এতটা উঁচু?
এখন কেবল নাকটাই রয়ে গেছে.. বাবা নেই.. কিছুই নেই..।
এ কোন জীবনে কে আমি?’

হাহাকারগুলো ছ’তলার টপ ফ্লোরের একশ’ ত্রিশ বর্গফুটের রুমটিতে পাক খেতে থাকে।।

অণুগল্প : মায়াবী কোমল আদর

মায়াবী কোমল আদর

নিজের টাইমলাইন একান্ত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। কিন্তু গল্প লিখতে লিখতে নিজের কথাই বলা হয়ে উঠে না।

আমি মিস করি আমার ছোট ভাইকে। ইমিডিয়েট ছোট ভাই। আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ওর সাথে কেটেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক সাথে বেড়ে উঠা, কলেজ ভার্সিটির সময়গুলোতেও কাছাকাছি ছিলাম। মুসা ভাই চবিতে যখন গুলিবিদ্ধ হলেন, আমি তখন সেই দোকানটির সামনে বসে চা পান করছিলাম। সিনেমা স্টাইলে ক্রলিং করে ফায়ারিং শুরু হলো.. হঠাৎ। দেখছিলাম সব চুপচাপ। দৌঁড়াতে বা পালাতে তখন লজ্জা লাগতো। আমার সাথের সবাই হাওয়া। ভাই ছিল পাশে তখনো। ফিরে ছোট ভাইকে দেখে এবং আমাকে ছেড়ে তার না যাওয়াটা দেখে বড্ড ভালো লেগেছিল।

এরকম অনেক ভালোলাগা রয়েছে আমার চিন্তার গোপন আলমিরায় এই ভাইটিকে ঘিরে।

সে আমার দেখা দুর্দান্ত মটরবাইক চালক। আমাদের আব্বাও ছিলেন তাই। আমার ভাই আর আমি চট্টগ্রাম থেকে মটরবাইকে করে খুলনায় নিজেদের বাড়িতে এসেছিলাম একবার। ওর সাথে এবং আরো কয়েকজন ভাই বন্ধুদের সাথে বাইক বহর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি যশোহর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, পটুয়াখালী।

নিজেকে একজন নির্ভার রাজপুত্র মনে হত তখন। আব্বার সাথে ছিলাম যে তখন!
এখন কি মনে হয় নিজেকে?
কিছুই না।
‘নাথিং এট অল।’

জীবনের খারাপ সময়গুলি এবং ভালো সময়গুলি দুই ভাই আরো ভাইদেরকে নিয়ে একত্রে কাটিয়েছি। তৃপ্ত সময়গুলো কিছু অতৃপ্ত সময়কে বুকে নিয়ে চলেছিল।
সারা রাত জার্ণি করে ঢাকা থেকে ফজরের আজানের একটু আগে বাড়ি পৌঁছে কোলাপসিবল গেটের সামনে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি, চাবি হাতে ভাইকে দাঁড়ানো পেয়েছি- যতবার গেছি ততোবার পেয়েছি। বউয়েরা সবাই তখন ঘুমে বিভোর। আর ঘুরে ঢুকে পেয়েছি আম্মাকে। সোজা তাঁর বিছানায় আমার জন্য রাখা খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি। মা আরো অনেকক্ষণ জেগে থাকতেন। আমি তখন ঘুমে বিভোর।

সেই শূণ্য জায়গাটি আজো শুণ্য আছে। কেবল আমি নেই। মায়ের আঁচলের আদর এখনো শীতের নরম রোদের মত বড্ড মায়াবী কোমল! কিন্তু অনুভব করার জন্য সেখানে আমি নেই। আমি আছি এই কংক্রিট নগরে। ইউনিটে বদ্ধ বাসা পরিবারে।

আমার মাটি নেই। মাটি মায়ের কাছে। মা নেই কংক্রিট নগরে।

ভাই মায়ের কাছে। আমার আদরের অংশটুকু বড্ড যত্ন করে পাহারা দিচ্ছে।

সব পাখি একসময় নীড়ে ফিরে।
মানুষ বাড়ি ফেরে কখন?
আমি মানুষ না..?

অণুগল্প : মদভাই

মদভাই

‘মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট’- ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বার। বিকাল তিনিটায় খুলে। পাঁচটায় জমে ওঠে। সন্ধ্যায় বসার জায়গা পাওয়া কঠিন। এই বারে নিয়মিত কাষ্টমার অনেক। তারা সকলেই অনন্য। তারা না আসা পর্যন্ত ম্যানেজার চেয়ারগুলো খালি রাখেন। আজ চার টেবিলের আখ্যান শোনাই।

ডান পাশের তিন নম্বর টেবিল। আটজন বসে আছেন। তিনজন হুইস্কী, চারজন ভদকা আর একজন বিয়ার খাচ্ছেন। প্রতিদিনের মত জমজমাট আলোচনা চলছে- কার্লমার্ক্স, লেলিন, ট্রটেস্কি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব।

প্রতিদিনের মত আজও রাত বাড়বে, আলোচনা বাড়বে, নেশা বাড়বে, বিপ্লবীরা তাল সামলে দাঁড়াতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়বে, বলবে- সরি, কমরেড। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

ডানপাশের শেষ টেবিল। দু’জন মুখোমুখি বসেছেন। প্রতিদিনের কাস্টমার। ফিসফিস করে কথা চলছে। হাসছে। সাত পেগ করে রয়াল জিন খাবে। ওরা দু’জন কখনও মাতাল হয়না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না। মদ গিলতে গিলতেই কাজের খোঁজে ফোন দেয়। মাছ শিকারের প্রাথমিক কথাবার্তা বলে।

মদিরার ম্যানেজার ভালো করেই জানেন এরা শহরের নামজাদা কন্টাক্ট কিলার। খুন করেন, খুন করান। মাছ শিকারের খেলা খেলেই এরা আয় করে- ভাত খায়, মদ গিলে।

বামপাশের শেষ টেবিল। তিনজন বসে আছেন। একজন নিয়মিত। বাকীরা অনিয়মিত। নিয়মিত জনের সাথে প্রতিদিনই দু’তিনজন অনিয়মিত লোক থাকেন। তারাই মদের বিল দেন। নিয়মিতজন একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তিনি প্রতিদিনই অনিয়মিতদের একটি গল্প শোনান-
: তিন পেগ খেলেই জীবনান্দের মত লিখতে পারি। কিন্তু লেখা হয়না।
: লিখেন না কেন?
: লোভ, বুঝলে লোভ।
: লোভ মানে?
: মানে আরো দু’পেগ খেয়ে নিলেই রবীন্দ্রনাথের মত লিখতে পারি। বাড়তি দু’পেগ পেটে ঢাললেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই, আই স্যয়ার। তবু লেখা হয়না।
: কেন?
: আবার সেই লোভ। আরো ভালো লেখার আশায় বাড়তি দু’তিন পেগ গিলি। তারপরেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ জীবনান্দের মত ছাইপাশ লিখে জঞ্জাল বাড়িয়ে লাভ কি! লিখতেই যদি হয় তবে রসময় গুপ্তবাবুর মত লিখ, টাচি, জীবন্ত প্রাণবন্ত।

এই টেবিলের বিপরীতে বসেন অধ্যাপক শেখর। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন। চার পেগ ভদকা আর চার পেগ জিন খান। নেশা ধরেনা। মুরগীর ঝাল ফ্রাই দিয়ে পরোটা খেতে শুরু করলেই নেশা ঝিম ধরে। খাওয়া শেষ হবার আগেই নেশায় বুঁদ। বিল পরিশোধ করে পুরো মানিব্যাগটা ওয়েটারকে টিপস হিসেবে দিয়ে যান। অবশ্য, পরের দিন বারে এসে ঐ ওয়েটারকে ডেকে ভাংতি পয়সা সমেত মানিব্যাগ ফেরত নেন।

মদিরা বার এন্ড রেষ্টুরেন্ট একটি সাম্যবাদী প্রতিষ্ঠান। এখানে বিপ্লবী, কনটাক্ট কিলার, কবি, অধ্যাপক আর সাধারণ কাষ্টমার সবাই সমান, সবাই সবার মদভাই।

অণুগল্পঃ সোনার অক্ষরে লেখা

সোনার অক্ষরে লেখা

আমি একজনকে কথা দিয়েছিলাম, এই ভবনটিকে ঘিরে একজন বালকের দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঝাঁপসা হয়ে আসা স্মৃতির করিডোর থেকে কিছু মুক্তো এনে দেবো। কিন্তু সেখানে সময়ের বুকে বিবর্ণ মুক্তোর সাথে সাথে কিছু কর্কশ নুড়ি অনুভবে বড্ড ধারালো অনুভূতি এনে দেয় বলে, ওই পথে পা বাড়াতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু যাকে কথা দিয়েছিলাম তিনি ‘স্পেশাল কেউ’ গোত্রের একজন। তাই মিশ্র অনুভবের রাস্তায় পা বাড়াতে হলো।

আমি এই কলেজটিতে মাত্র এক বছর পড়তে পেরেছি। আমার দুর্ভাগ্য? আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি একজন ক্যাডেট হই। অন্য আরো অনেক কিছুর মতই আমি ওটাও হতে পারিনি। তবে আমার বাবার আশাভংগের ওটাই ছিল প্রথম ধাপ- আমাকে ঘিরে। আজ বড্ড অনুভব করি। আমি যে একজন অনুভবক্ষম পুরুষ। একজন ছোটখাট বাবাও আমি। আমাকে কতটুকু বাবা মনে হয়, তা আমার দুই কন্যা বলতে পারবে!

আমি তরতর করে বড় হয়ে উঠছিলাম খুলনায় আমার পরিচিত আংগিনায়। বাপ্পি ভাই আমার সিনিয়র ছিলেন। তার সাথে আমি আর তনু ছোট বয়রার আনাচে কানাচে ভালোলাগা খুঁজে বেড়াতাম। বাপ্পী ভাইদের বাড়ির পিছনে অনেকটা জায়গা জংগল ছিল। সেখানে টারজান টারজান খেলতাম। বাবু ভাই বাপ্পী ভাইয়ের বড় ভাই ছিলেন- ওনাদের সাথে পিকনিক করতাম। আনন্দে ভরা ছিল জীবন।

একসময় আমাদের এলাকায় নাকি বাঘ চলাফেরা করত। তারই নিদর্শন রুপে আমার ছেলেবেলায় দেখেছি বাড়ি বাড়ি এক চিলতে জংগল। সেই জংগলে আমি বন্ধু দিপু আর শফিককে নিয়ে পাটকাঠির আগায় জিগারের আঠা মাখিয়ে ফড়িং ধরে বেড়াতাম.. বেতবনের কাটার খোঁচার তোয়াক্কা না করে ম্লান বেতফল কোঁচর ভরে এনে জগৎ জয়ের আনন্দ উপভোগ করতাম।

আমাদের বাজার মসজিদের বিপরীতের স্কুল সংলগ্ন যে মার্কেট, সেটা একসময় একটা খাল ছিল। দিনের অনেক সময় বন্ধুদের নিয়ে সেই খালে ডুবাতাম.. ডোবার ব্যাং আমার ঢিলের আঘাতে অস্থির থাকতো।

এরকম আমার শৈশবকে গলা টিপে বাবার ইচ্ছায় আমি হতে গেলাম একজন ক্যাডেট। চারদিক নিশ্চুপ চুপচাপ অহর্নিশ এক শৃংখল নিগড়। আমি যার যোগ্য ছিলাম না। অযোগ্য মন মানসিকতার এক বালক শৈশব হারানোর যাতনা নিয়ে নিজেকে বাবার ইচ্ছেমত গড়তে এক পোশাকী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হলাম।

একজন ক্যাডেট হতে আমাকে প্রথমে প্রি-ক্যাডেট স্কুলে কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়ানো হয়েছিল। আমাকে কোচিং করতে যেতে হতো সেই ‘সেন্ট জোসেফস স্কুলের’ কাছে এক কোচিং সেন্টারে, আজ সেন্টারটির নাম ভুলে গেছি।

স্মৃতি অনেক দূরের পথ হেটে আসছে, তাই খেই হারিয়ে ফেলছি। তবে এই ভবনটির দিকে তাকালে বিবর্ণ স্মৃতিরা কেন জানি বর্ণীল হয়ে উঠে আমাকে স্বপ্নিল তন্দ্রাতুর করে তোলে। কিছুটা ব্যথা চিরে দেয় হৃদয়, কিছুক্ষণ বিহবল রাখে আমার হৃদয়। সেখানে সোনার অক্ষরে লেখা একটি নামই ভেসে আসে-‘জেসিসি!’

মামুনের দুইটি অণুগল্প

কাছে থাকায়ই সুখ?

দস্যুরাণী সিনেমাটি দেখে ছেলেবেলায় শাবানাকে বিয়ে করব ভেবেছিলাম। খুলনার বৈকালি সিনেমা হলে বন্ধু শফিককে সাথে নিয়ে থার্ড ক্লাশে দেখেছিলাম কয়েকবার। পঁচাত্তুর পয়সা টিকেট ছিল এক একজনের!

একটু বড় হলাম, সুবর্ণা মোস্তফাকে ভালোবাসলাম নাটক ‘সংশপ্তক’ দেখার সময়ে। আর কিছুকাল পরে জুহি চাওলার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে করল। ‘স্কুলের গন্ডী পার করা কলেজে পা দেবে দেবে’ এমন এক আমি ছিলাম তখন। ভার্সিটিতে এসে দেবীর সাজে শ্রীদেবীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পেতে চাইলাম। কত বিচিত্র ছিল আমার চাওয়াগুলি, নাহ?

আর কাকে যেন ভালোবাসতাম :) আজ আয়নায় বিস্মৃত মুখ- ভুলে গেছি দুঃখ!
ভালোবাসায় কি সুখ?

মা আর বউ তাদের ভালোবাসা দিয়ে ‘ভালোবাসা’কে হারিয়ে দিয়েছে… তাড়িয়েছে? সময়ের ঘ্রাণে পলাতক ভালোবাসা বিস্মৃতিতে কি একটু আধটু জ্বালা ধরায়, এখনও?

মায়ের আঁচলের নরম কোমল ঘ্রাণ.. বউয়ের শরীরের আধো ভালোলাগাময় ঘ্রাণ… আর দুই কন্যার আদর আদর বাবু ঘ্রাণে ‘পলাতক ভালোবাসা’র ঘ্রাণ আজ বড্ড অচেনা!

কাছে আছি আমি.. কাছে থাকায়ই সুখ?
_____________________________

চলে যাবার গল্প

প্রথম বর্ষে পড়ার সময়েই বাংলা চার সংখ্যা’র আকৃতি নিয়ে মেয়েটি শাটল ট্রেন থেকে নেমে শিহাবের দশদিক আন্দোলিত করে ভালোলাগায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো! এর মাত্র ছ’মাস পরেই আরেক বিষণ্ণ বিকেলের ট্রেনে শিহাবের ন’দিক তমসাচ্ছন্ন আঁধারে ডুবিয়ে সে একবারও পিছু না চেয়ে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের নিঃসংগ যাত্রী হলো।

আর ফিরে এলো না শিহাবের কাছে.. ওর প্রিয় সবুজ পাহাড়ী ক্যাম্পাসটিতে। পাশাপাশি বসে থাকার নিশ্চুপ মৌণতার নিঝুম নিমগ্ন সুখের অনুভবে প্রগলভ হওয়া হয়ে ওঠে নাই কখনও আর। এক জীবন কতটুকু সময়?

একটা গল্প রয়েছে নির্ঘাত। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর আরেক মিলনমেলায় এসে একই জায়গায় অন্য আরো অনেক কিছু নস্টালজিয়ায় ভোগালেও, আজও মেয়েটির সেই চলে যাবার গল্পটা শিহাবের জানা হলো না।

একটা শেষ না হওয়া গল্পের শেষটা জানতে আজও ব্যাকুল শিহাব। সব দিক খালি.. অচেনা আমি আর তুমি।

কিন্তু.. কোথায় তুমি?

মামুনের অণুগল্পঃ শেষ পাতা

মামুনের অণুগল্পঃ শেষ পাতা

প্রচণ্ড শীত। উত্তুরে বাতাস কিছুক্ষণ পর পর দিকভ্রান্ত হয়ে চারদিক থেকে হীমেল পরশ নিয়ে সেনাবাহিনীর মত জনজীবনে ঝাপিয়ে পড়ছে। কাঁপতে কাঁপতে আমান নিজের মেসে ঢুকে। এতো উপরে বাতাসের আক্রমন হাড়েও কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

মনের ভেতরটা বাইরের শীতল পরিবেশ থেকে আরো হীম হয়ে আছে। মাটি ছেড়ে কংক্রিট জীবনে অভ্যস্ত হয়েও মায়ের দিকে, নাড়ির দিকে একটা আকর্ষণ সব সময়ে অনুভব করে সে। তাই না পেয়েছে নগর না পেয়েছে মাটি। এক দোআঁশলা জীবনের অধিকারী হয়েছে। জীবন নদীর শীর্ণ দু’কূল!

জীবনে মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকাও একটা আশা। আবার আশায় আশায় বাঁচা। দুইয়ে পার্থক্য কতটুকু?

জীবনের নদীটি শীর্ণ হলেও কিছুটা প্রবাহ এখনো রয়েছে। নইলে জীবন থেমে যেত- মানুষ বেঁচেই না থাকলে সুখ-দু:খ অনুভব করবে কিভাবে? তাই জীবন নদীর এক পাড়ে আমান..অন্য পাড়ে না পাওয়া জীবনের হাতছানি।

এপারে বসে আমান হৃদয়ের খেরো খাতা থেকে আশার লিস্টের পাতাগুলি একে একে ছুড়ে ফেলে.. উড়ে উড়ে আশা জলে পড়ে.. ক্ষীণ প্রবাহ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এক একটি আশার মৃত্যু জীবন নদীতে জোয়ার এনে দেয়.. জীবনের বিস্তার ঘটে।

সব পাতাগুলি উড়ে যেতে যেতে একটি পাতা অবশিষ্ট থেকে যায়। একে কোনোভাবেই ছেড়া যায় না। নাকি আমান ছিড়তে চায় না? তাই জীবন নদীতে পুর্ণ জোয়ার আসে না। ওপারে যাওয়াও হয় না।

– কি হবে ওপারে গিয়ে? ওখানে কি পারু থাকে?

সেই একটি পাতায় কি রয়েছে আমান তা কখনো কাউকে বলে না! কিন্তু পৃথিবীর একজন বাদে আর সবাই কিভাবে যেন তা জেনে যায়।

শুধু পারু জানে না!

অনুলিখন : সায়নি

সায়নি

সায়নিকে হঠাৎই সেদিন শুনতে হলো – “কেত মেরে সেলফি পাবলিক পোস্টাবি আবার পাবলিক এডমায়ার করলেও দোষ”। অবাক হয়ে গেলো সায়নি। আবারও যখন পম্পা বলে উঠলো – “আরে আকর্ষণের গ্রাফ নামছে না উঠছে এটা জানতে হবে তো”। সেদিন অপমানে সারা তার দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। ক্রমশ স্মৃতির ভীড়ে হারিয়ে গেলো ও। পম্পা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ সায়নি কতো বোকা পম্পাকে বন্ধু ভেবেছিল। আজ সায়নীর বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তবে তার শরীরের বাঁধন ভালো। বয়স বোঝা যায় না। একদিন সে সত্যিই সুন্দরী ছিলো। কোমর ছাপানো লম্বা চুল, টানা টানা চোখ, পদ্মকলির মতো ঠোঁট। ছিপছিপে চেহারা। সবই ছিলো জীবনে ভালোবাসা ছাড়া। বাবা বিয়ে দিলেন বিশাল পয়সাওয়ালা এক বিজনেস ম্যানের সাথে। বিয়ের পরে জানতে পারলো তার স্বামী একাধিক নারীতে আসক্ত। কিন্তু বড্ডো দেরী করে জানলো সে, ততদিনে তার কোল জুড়ে ফুটফুটে এক সন্তান। তবুও সে তার স্বামীর বদগুণগুলো মেনে নিতে পারে নি, পঁচিশ বছর বয়স যখন স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে গেলো, সমস্ত ভালোবাসা উজার করে দিলো তার সন্তানকে, আদরে, যত্নে তাকে বড় করতে লাগলো। সায়নী ভাবলো ওই পঁচিশ বছর বয়সে যখন সত্যিই সে কাউকে আকর্ষিত করতে পারতো, তখনই করেনি, চেষ্টাও করেনি আর আজ প্রৌঢ়ত্বের দোড়গোড়ায় এসে আকর্ষণ করবে? এতো দুর্দিন তার এসেছে! সেতো ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে অন্য কারণে, একদিন সে থাকবে না এই পৃথিবীতে, অথচ তার ছবিগুলো থেকে যাবে।

সায়নি জানে তাকে বোঝার মতো কেউ নেই। তার বন্ধু কেউ নেই। বড্ডো একা সে ভীড়ের মধ্যে। অথচ কতো প্রলোভন ওর সামনে ছিলো! কেউ বলেছিল সায়নিকে সে রানীর মতো রাখবে, তার বাড়ি, গাড়ি সব সায়নির নামে লিখে দেবে। শুধু একবার সায়নি তাকে বলুক ভালোবাসে। নাহ্ সায়নি সেদিন প্রলোভনের হাতছানিতে ভেসে যায় নি। সে কারো সংসার ভাঙতে চায় নি। সে কাউকে কখনও বলেনি ভালোবাসে। সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তাকেও কেউ ভালোবাসতে পারে না। এতোগুলো বছর যে একা চলেছে সমস্ত ভীড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে আর আজ এই বয়সে এসে তাকেই শুনতে হলো ছবি পোস্টায় পাবলিককে আকর্ষণ করার জন্য! ছিঃ ছিঃ এর থেকে সায়নির মৃত্যুও ভালো ছিলো! সেদিন সায়নি সারারাত ভাবলো, যদি সত্যিই একাধিক পুরুষ তার জীবনে থাকতো, তাহলে বোধহয় ভালোই হতো। সে শুধু ভালোবাসাকে ভয় পেয়ে গেলো সারাজীবন।

মামুনের অণুগল্প : দ্য ট্রেইল

দ্য ট্রেইল

বাবার হেঁটে চলা এই রাস্তাটা তখন ইটের সলিং বিছানো ছিল। এই রাস্তায় আমি তিন চাকার বেয়ারিং গাড়িতে চড়ে দুরন্তপনায় মেতেছি, মার্বেল দিয়ে আংটি মাইর খেলেছি বন্ধুদের সাথে। বৃষ্টিতে ভিজেছি-রোদে পুড়েছি, কালো হয়েছি। মনটা সাদা ছিল তখন অবশ্য।

রাস্তাটির সাথেই একটা চারতলা বাড়ি। সেটা প্রথমে সেমি পাকা একতলা বাড়ি ছিল। এটাই ছিলো এই শহরে আমাদের প্রথম কোনো বাড়ি। আমার একেবারে ছোট দুটি ভাইয়ের জন্মও এই বাড়িতেই।

আমার মা আমার বাবা এবং আমাদেরকে সাথে নিয়ে সেই ছোট্ট বাড়িটাকে আজকের বড় বাড়িটায় রুপ দিয়েছেন।

আমাদের বাড়ির সামনের বাবার হেঁটে চলা এই রাস্তায়ই আমি প্রথম বারুদের গন্ধ পাই। মুক্তির প্রলয়োল্লাসে মেতে উঠি। এখানেই প্রথম সাইকেল চালানো শিখি… মটরবাইক ও।

সেই বাড়িতে আমার এরকম অনেক ‘প্রথম কিছু’ জড়িয়ে আছে।

এই ছবিটায় সব চেয়ে আসল যেটা সেটা হলো- এই ছবিটায় আমাদের বাবা রয়েছেন। একজন বাবার ছবি এটা!

রাস্তাটা আমাদের জন্য রেখে যাওয়া বাবার ট্রেইল…।।

________________
#মামুনের_অণুগল্প-৫২৬

সাদামাটা প্রেমের গল্প

মনে আছে, পড়ন্ত বিকেলে, চুপিসারে ক্যামেরা বন্দী করেছিলাম তোমাকে….!
বলেছিলাম, সাদামাটা সাজে তুমি সত্যিই সুন্দর.. আর জানোই তো- আমার কাছে সাদামাটা মানে “দু’মুঠো ভাত, আলুভর্তা আর দুটো কাঁচামরিচ”…

তুমি বলেছিলে, এ আবার কেমন উপমা…!

আমি বলেছিলাম, লোক দেখানো অপূর্ব কথা আর মেয়ে পটানো ছন্দগাথা একঘেয়ে বড্ড..
আমার তো একটাই তুমি, তুমি বদলালেই বদলাবে তোমার উপমা..
সেই তুমিটাই যখন একই আছো, তখন আমার দেওয়া সাদামাটা এই উপমার সুখের ব্যাখ্যা টাও হয়তো বুঝতে পারছো..

মনে আছে, “ভাল্লাগেনা’ ব্যামোতে আক্রান্ত হয়ে একদিন তোমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলাম…!
বলেছিলাম, চলো না পালিয়ে যাই.. এই সমাজ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকুক হাভাতের মতো, কুৎসা রটিয়ে বেড়াক দিক্বিদিক..

তোমার সেদিন মন খারাপ ছিলো, লজ্জা ভয়ে চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে অসহায়ের মতো..

আর আমি…! উন্মাদ পাগলের মতো অট্টহাসি হেসে তোমাকে বলেছিলাম,
আর কবে, আর কতদিন পরে তোমার ডাকে ভাঙ্গবে আমার সকালের ঘুম….!!!
আর কতদিন পর, তোমার এই লজ্জাবতীর লজ্জা আর মিথ্যে ভয়টুকু কেবল আমার হবে…!!!

মনে পড়ে, সেদিনের সেই আমিটাকে…! যে আমিটাই আজকের আমি.. অথচ তুমি…!

তিন লাইনের_অণুগল্প : একজনই_তিনি

ঈশ্বর সর্বাগ্রে মানুষ বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং মানুষের সুন্দর জীবনযাপনের নির্দেশীকা হিসেবে ধর্মকে মানুষের পিছনে রেখেছেন।

কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে মানুষকে পিছনে ফেলে দেয়!

এই পৃথিবীতে যত মসজিদ-মন্দির-গীর্জা বা যে কোনো ধরণের উপাসনালয়ের প্রতি আমার নিরন্তর একই ভালবাসা, কারণ আমি জানি মানুষ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলেও একই ঈশ্বরের উপাসনাই করে।

___________________________
#একজনই_তিনি_তিন_লাইনের_অণুগল্প
Photo Credit: Rumi

গোলাপ বাগান

হঠাৎ পলাশ একটা গোলাপ কিনে ফেলল। ঘরে ফিরে বিহনীর হাতে দিয়ে বলল – আই লাভ ইউ।
বিহনী দাঁড়িয়ে পড়ল আর গোলাপ হাতে নিয়ে কিছুটা অবাক সুরে হেসে উত্তর দিল – আই লাভ ইউ টুউ।
তারপর আশ্লেষে পলাশ বিহনীকে জড়িয়ে ধরল। হাসি মুখে দুজন দুজনের দিকে তাকাল। বিহনী বলল – তুমি বসো, আমি চা করে আনছি।
পলাশ বিহনীর হাত ধরে আবার সোফায় বসিয়ে দিল। বলল – না, আজ তুমি বসো, আমি চা করে আনছি। আর চা খেতে খেতে আমরা খুব গল্প করব।
বিহনী সোফাতে বসে পড়ল। যেমন টিভি দেখছিল তেমন দেখতে লাগল।
অনেককটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছে। তখন পলাশকে চিনত না জানত না। বাবার পছন্দ মেনে নিয়ে এই সংসারে প্রবেশ। গান করার ইচ্ছে ছিল তাও টুকটাক চলছে। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। আঁকার ইচ্ছে ছিল এখনও মাঝে মাঝে ছেলের সঙ্গে আঁকতে বসে। রবীন্দ্রনাথ সুকুমার রায়ের অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারে। আঁকা গান আবৃত্তি এসবে পেশাদার হওয়া তো অত সহজ না। অনার্স টেকে নি। তাই পড়াশুনা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। চাকরীর চেষ্টাও জারি ছিল জোটাতে পারে নি।
পলাশ এ সব কোন কিছুতেই বাধা দেয় নি। বরং প্রায়ই উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু বিহনী তার নিজের ক্ষমতা জানত। বরং বাবা বলত এ সব একটু আধটু জানলেই হবে। অত মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখন বিহনী বুঝেছে সংসার সামলিয়ে অনায়াসে এসব করা যায়। কিন্তু তার জন্য নিজস্ব এবিলিটি থাকা দরকার। তাই সাংসারিক প্রবাহে চলমান থেকেছে বিহনী। তাই পলাশের সাথে সাথে বিহনীও এ সংসারের নিজস্ব হতে পেরেছে।
ছেলে একটু আগে ফোন করেছিল। ভালই আছে। কাল থেকে ইন্টার্নশিপ শুরু হবে।
আজ কি দিন কি বার মনে নেই বিহনীর। চায়ের এত অপূর্ব স্বাদ বিহনীর জীবনের বয়স কমিয়ে দিয়েছে।
তাই হাতের পাপড়ি মেলা গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকল।

পেতিইন্যি_বন্ধু_আমার_মামুনের_অণুগল্প

আমার এক পেতিন্যি বন্ধু ছিলো!

চাটগাঁর বন্ধুরা!
শব্দটা পরিচিত না?
তবে বন্ধুর ‘অরিজিন’ চাটগাঁয়ের না। দেশের অন্য আরেক জেলায়। মায়ের দিক থেকে খুলনায় তাঁর জন্ম বসবাস.. শেষ ও।

ভদ্দরলোকদেরকে সে পেতিন্যি বলতো। শেষে বন্ধুমহলে এই নামই হয়ে গেলো ওর। আসল নামটা জানার প্রয়োজন দেখি না।

আমার নেংটা কালের বন্ধু। একই খালের কাদা পানিতে উলংগ হয়ে ঝাঁপিয়েছি কতো! শ্মশানঘাটেও শক্তি অর্জনে ন্যাংটো হয়ে ঘুরেছিলাম। কয়েকরাত। দু’জনেই।

এমন পেতিন্যি বন্ধু আমার। আমায় বড্ড ভালোবাসতো! আমিও বাসতাম অনেক! তবে ওরা বড্ড গরীব ছিলো। আর বন্ধুর ছিল ভদ্দরলোকদের প্রতি প্রচন্ড রাগ। ঘৃণা। শিরায় শিরায়। প্রতিটি কোষের অণুতে অণুতে।

ভদ্দররলোকেরা ওর বোনকে ‘রেপ’ করেছিলো।গোয়ালের গরুর গলার রশি তার সেই বোনটির বুকের জ্বালা মিটিয়েছিলো। বড় আদরের বোন ছিলো ওর। সেদিনই চোখের জল সব শুকালো বন্ধুর। সেই দিনই সে নিজের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। মানুষের ভিতরে আর এক মানুষ। অন্য মানুষ!

এখন মাঝে মধ্যে ভাবি, সেই অন্য মানুষ হবার সময়টায় আমার কাছে কি বন্ধুকে অপরিচিত লেগেছিলো একটুও?

প্যান্টের জিপার খুলে রাখতো সে ভদ্দরলোকদের দেখলে। এমনই তীব্র ছিলো। বন্ধু আমার।

চরমপন্থী দলগুলোর একটির আঞ্চলিক কমান্ডার হয়েছিলো সে। শুনেছিলাম পরে। পড়ালেখায় ভীষণ ব্যস্ত আমি তখন, হয়নি সময় এক জেলে পরিবারের ভূমি থেকে উচ্ছেদের খবর জানার। কেউ বলেও নাই আমায়। আমি তখন চারশো’ কিলোমিটার দূরের আরেক শহরে। এক অবাক হৃদয় নিয়ে নিজের জীবনে বড্ড ব্যস্ত।

বন্ধু গলা কাটছে। ভেতরের পুঞ্জীভূত ক্রোধ ঘৃণার আগুনে আরো কালো হয়েছে তাঁর। মিটছে জিঘাংসা। হাতে কচকচে কালো টাকা। অত্যাধুনিক অস্ত্র। দ্রুতগামী বাহন। বাহিনী। রোমাঞ্চকর জীবন!

আসলেই কি?

বন্ধুকে আমার চেয়ে কে বেশী জানতো? ও কি চাইতো কিংবা চাইতে পারতো আমি জানতাম। আমি আমার পেতিন্যি বন্ধুকে জেনেছিলাম। সব রুপেই তাকে চিনতে পেরেছিলাম। বন্ধু আমার এটা জেনে যেতে পারলো না।

এক পরিত্যক্ত জুট মিলের ভেতর আমার বন্ধুকে টুকরা করা হয়েছিলো। বস্তাবন্দী লাশ কালের অতলে হারিয়েছে শেষে। অন্য একটি দল একাজ করেছিলো। এমনই হয়। এই পথ ভালো না। ছিলো না। কখনও ভালো হয়ও না।

আমার পেতিন্যি বন্ধু ভদ্রলোকদের ঘৃণা করলেও, আমায় বড্ড ভালোবাসতো!

আমি ভদ্দরলোক নই বলে?

ভদ্দরলোক কখনও ছিলামও না আমি… এখনও নই।।

#পেতিইন্যি_বন্ধু_আমার_মামুনের_অণুগল্প