বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অণুগল্প : অনুভব

ছায়াসঙ্গী গল্পগ্রন্থের আরও একটি অণুগল্প…

অনুভব

ঠিক ভরদুপুরে বাস থেকে নামল রেজাউল।
প্রচন্ড গরমে মাথার চাঁদি ফেটে যাবার দশা। পিচ ঢালা পথটিও উত্তপ্ত। কেমন গরমের ভাপ আসছে রাস্তা থেকে। জায়গায় জায়গায় পিচ গলে গেছে, দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়।

প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে রেজাউল গলির মাথার মিষ্টির দোকানে ঢোকে। ক্যাশে বসা লোকটির জিজ্ঞাসু চাহনিকে উপেক্ষা করে টেবিলে রাখা গ্লাস নিয়ে পানি খায়। দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করে ক্যাশের অপরিচিত লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসে। এই সিটে এর আগে অমর ঘোষ বসতেন। মনে হয় এর বাবা।

সে মিষ্টির দাম জিজ্ঞেস করে। সবচেয়ে কম দামের কেজি খানেক মিষ্টি নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হেঁটে চলে। পছন্দের মিষ্টিগুলো কিনতে না পারার ব্যর্থতা আর প্রচন্ড গরমে কাকের মত মুখ হা করা অনুভূতি- এসব ওর হৃদয়ে মিশ্র অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। বৃদ্ধ বাবা সহ ঘরে আরো ছয়জন সদস্য। এক কেজি মিষ্টিতে কি হবে? কিন্তু এর থেকে বেশী কিনবার সামর্থ্যও যে তার নাই। এখন সবেমাত্র মাসের ২৫ তারিখ। সামনের মাসের ১০ তারিখে বেতন হবে। শহরের বাসায় বউ ছেলেমেয়ে… এখানে বাবা-মা আর অন্যরা। সবাইকেই তো রেজাউলের দেখতে হয়।

রাস্তার পাশে হাইস্কুলের বাউন্ডারি ওয়ালের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে যেতে যেতে রেজাউলের বেশ আগের কথা মনে পড়ে। তখন চট্টগ্রামে থাকতো ওরা। ছোট কুমিরা জেল স্কুলে পড়ত। মাসের একটি বিশেষ দিনে বাবা-মায়েরা দেখা করতে আসতেন। সবার বাবারা কত কি খাবার নিয়ে আসতেন। পাশে বসিয়ে আদরের বখে যাওয়া সন্তানকে নিজে হাতে খাইয়ে তৃপ্তি মিটাতেন।

রেজাউলের বাবা আসতেন প্রায় সময়েই খালি হাতে। কোনো কোনো সময় হয়ত এক হালি কলা কিংবা চারটা পেয়ারা… পথের পাশের বাজার থেকেই কিনে নিতেন হয়ত।

নিজের পায়ে শেকল বাঁধা অবস্থায় অন্যদের বাবা মায়ের পাঠানো আদরটুকু অন্যদেরকে উপভোগ করতে দেখে, নিস্ফল আক্রোশে ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়ত সে। নিজের হাতে এক হালি কলা কিংবা কাঁচা পাকা পেয়ারা নিয়ে অসহায় বাবার চলে যাওয়া দেখত বারান্দার শিকের ভিতর দিয়ে।

দূরে অপসৃয়মান একজন বাবা… মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছেন… বাস ভাড়াটুকুই যার সম্বল। কিন্তু সেই সময়ে রেজাউল কি বাবার সেই অসহায়ত্বটুকু বুঝতে চাইত? উপলব্ধিতে ওর জুড়ে ছিল কিছু প্রশ্নবোধক মার্ক! কেন? কেন? কেন?

আজ সেই প্রশ্নের উত্তর নিজের থেকেই সে পেয়েছে।পঁচিশ বছর পরে একজন নতুন বাবা এক পুরনো বাবার কিছু পতিত সময়ের অনুভবে বিলীন হয়… নিজের ছায়ায় নিজেকে খুঁজে পায়।

ছায়া আর কায়া মিলে যে আমি, তাতে কেন এতো বৈচিত্র্য? ভাবে আর হাঁটে… এক কেজি মিষ্টির প্যাকেট… আর কিছু জীর্ণ দীন মনোভাবও সাথে সাথে চলে।

________________________
#মামুনের_অণুগল্প
ছবিঃ আমার ২য় গল্পগ্রন্থ ছায়াসঙ্গী’র

অণুগল্প : স্বপ্নরা হারিয়ে যায়

অণুগল্প : স্বপ্নরা হারিয়ে যায়

আব্দুল মতিন ইন্টারভিউর জন্য যখন মেসের রুম থেকে বের হয়, চারদিক কাঁপিয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছোট্ট ফোল্ডিং ছাতাটি মেলে দিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওয়ানা হল। ভাগ্যিস রুমমেটের কাছ থেকে এটি ধার চেয়ে সাথে নিয়েছিল।

ভাংগা ইটের রাস্তাটি এবড়ো থেবড়ো। ইতোমধ্যেই জল জমেছে বেশ। কালি করা জুতোর সামনের ডানপাশে কাদা লেগে গেছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো ওটা দেখে। আজই বৃষ্টিটা নামার দরকার ছিল?
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাতেই প্যান্টের নিচের দিকটা ভিজে একাকার। কাদা এবং বালির ছিটে কেমন জাঁকিয়ে বসেছে সেই জায়গাটুকুতে। কালো প্যান্ট বলে রক্ষে।

বাসে উঠে বসার সিট পেলোনা সে। একহাতে ফাইল এবং অন্যহাতে ভেজা ছাতা। ছাতার পানি পাশের সীটে বসে থাকা একজনের শরীরে লাগতেই, কেমন রাগত স্বরে অদ্ভুত ঘোৎ জাতীয় শব্দ করলো। ফাইলসহ বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছে আব্দুল মতিন। একবার ভাবে, মেসেই ফিরে যায়। দরকার নেই ইন্টারভিউ দেবার। যে ক’টা টিউশন রয়েছে, তাতেই তো মোটামুটি চলছে। কি দরকার হুদা কামে গোলামির জিঞ্জির পরার?

পরক্ষণেই দুটি মায়াবি চোখের মৃদু তিরষ্কার মানসপটে ভেসে উঠে। অভিমানী ঠোট দুটো একটু বেঁকে আছে! অনিন্দ্য সুন্দর এক মুখচ্ছবি আব্দুল মতিনকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে সাহায্য করে। তাকে মাত্র দু’মাস সময় বেঁধে দিয়েছে এই মুখের অধিকারিনী। এরপরে সে আর নিজের পরিবারকে মানাতে পারবে না। অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে হবে তাকে.. বরাবরের মত।
গ্রামের বাড়িতে বিবাহযোগ্যা ছোট বোন, দুই ভাই। আর মা!

এদের সবার চেহারাও চোখে ভেসে উঠে। একটু বেদনা কি জেগে উঠে মনে?
নিজের অক্ষমতায় একটু কি কুন্ঠিত হয় সে?

পিঠের কিছু অংশও ভিজে গেছে। একটু একটু শীত লাগছে এখন। জুতোর ভিতরেও মোজা ভিজে চুপচুপা। প্রচন্ড এক বিরক্তি সাথে নিয়ে এক ঘন বরষায় বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুল মতিন সবার অলক্ষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

একটু কি কেঁপেও ওঠে? তবে আশেপাশের কেউই টের পায় না- এমনকি ওর শরীরের সাথে ঠেক দিয়ে দাঁড়ানো টেকো ভদ্রলোকটিও না। এমন হাজারো দীর্ঘশ্বাস এবং ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠা এই বাসের প্রতিটি মানুষের কাছেই এখন মামুলি ব্যাপার। হরহামেশাই ঘটছে।
তারাও কি সেগুলো ওরই মত অনুভব করেন?
একজন আব্দুল মতিন ইন্টারভিউ দিতে যাবার পথে চলন্ত বাসের ভিতর রড ধরে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। সামনে দৃষ্টি চলেনা, পিছনেও ঝাপসা। আর ভাবনার এই মুহুর্তটাও কেমন স্যাঁতস্যাঁতে আর অবরুদ্ধ মনে হয় ওর কাছে।

ইন্টারভিউ শেষ হতে বাইরে আসে। রাস্তার ওপারে একটি চা’র দোকান। দেখেই কেমন তেষ্টা পেয়ে যায় আব্দুল মতিনের। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। বেঞ্চের এক কোণে বসে। চা’র অর্ডার দেয়। অপেক্ষার মুহুর্তগুলোতে সে ভাবতে থাকে…

… বাবার রং চা খুব পছন্দের ছিল। চায়ের কাপে মুড়ি ভিজিয়ে কি আনন্দের সাথেই না খেতেন! সে মুগ্ধ হয়ে দেখত। সামান্য চা-মুড়ি খাবার দৃশ্যও যে এতোটা ভালোলাগা এনে দিতে পারে, আব্দুল মতিনের জানা ছিল না। সামান্য মানুষদের ভালোলাগাগুলো কি সবসময়েই এরকম অসামান্য?

রঙিন চা’র মত বাবার মনটিও ছিল রঙে রঙে ভরপুর! গরিবী হালতে থাকা একজন অসামান্য মানুষ। একজন বর্ণীল বাবা! যিনি তার জীবনের রঙগুলো অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে।

মূলত কৃষিকাজই তার প্রধান জীবিকা ছিল। আব্দুল মতিনের বাবা একজন কৃষক ছিলেন। গ্রামের একজন মাঝারি মানের কৃষক। কিন্তু বাবা একজন কৃষক- এ কথা ভেবে আব্দুল মতিন কখনোই হীনমন্যতায় ভোগেনি। বাবাকে বাবা ই মনে হয়েছে বরাবর।

চা’র কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজের অতীত আর বর্তমান নিয়ে ভাবনাকাশে উড়ে বেড়ায় একজন আব্দুল মতিন। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতেই বাবার জীবনের বাকী রঙ টুকুও নি:শেষ। কিছু জমিও বিক্রী করেছিলেন। আশায় বুক বাঁধা একজন বাবা- ছেলের জীবনকে বর্ণীল করতে করতে একদিন তিনি নিজেই রংহীন… বিবর্ণ হতে হতে শেষে একদিন ছবি হয়ে গেলেন। ওর মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হবার কিছুদিন আগেই বাবা মারা গেলেন…

চা’র কাপ দোকানদারের সামনে রেখে দেয়। বিল মেটায়। সামনের রাস্তাটি এই ভরদুপুরে কেমন অতিরিক্ত নীরব। আকাশে মেঘ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। জীবনের পথটিও কি এই রাস্তার মত? বড্ড নীরব… হাল্কা আঁধার চারপাশকে ঘিরে ধরেছে। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে,
‘জীবন ওর সামনে নিজেকে কতই না রঙিন ভাবে উপস্থাপন করেছে। স্বপ্নগুলোর ডানায় ডানায় হরেক রঙ। অথচ বাস্তবে জীবনের পথ এতোটাই পিচ্ছিল-আঁধারে ঢাকা, ঠিক এই পিচঢালা পথটির মতই কালো-নিকষ অন্ধকারে ডুবে আছে।’

পাস করার পর থেকে একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সোনার হরিণের দেখা কেন জানি মিলছেই না। সময় এখন বড্ড দু:সময়। ‘রেফারেন্স’ ছাড়া কোথাও চাকরি মেলে না।

হেঁটে হেঁটে এক নির্জন যাত্রী ছাউনির শেডের নিচে দাঁড়ায় সে। বাসের অপেক্ষা করে। মা-বোন-ভাইদের সাথে সাথে দুটি মায়াবী চোখও যেন ওর পানে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। এই মুহুর্তে আব্দুল মতিনের এমনই মনে হল। এদের সবার জীবনে রঙ এনে দেবার কাজটি এখন কেবল তারই ওপর। দায়িত্ব? ভালবাসা নয়?
বাবা যেমনটি ভালোবেসেছিলেন ওদের সবাইকে।

একটু কি ভারী বোধ হয়? অনুভবে এক জগদ্দল পাথরের চেপে বসা অনুভব করে হৃদয়ে। কত কিছু স্বপ্ন দেখেছিল সে। গ্রাম থেকে সবাইকে নিয়ে এই শহরের বুকে ছোট্ট একটি বাসা। অপেক্ষায় থাকা একজন মনের মানুষ। এদের সবাইকে নিয়ে বর্ণীল এক জগত। একটু কি বেশী চাওয়া ছিল তার? তবে কি স্বপ্নগুলো সবসময়ে সবার জন্য রঙিন নয়?

বাস স্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় থাকা একজন আব্দুল মতিন এই ঘোর অবেলায় নিজের স্বপ্নবৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করে স্বপ্নগুলোকে রঙহীন- বিবর্ণ দেখতে পায়। ওর বোধের গভীরে এই মুহুর্তে এই অনুভূতিটুকুই কেবল স্থায়ী হয়-

” Dreams are always colorful but reality is different… Black and White.”

রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখা একজন সাদা-কালো মানুষ, এক নির্জন বাস স্ট্যান্ডে বসে, নিজের স্বপ্নগুলোকেও সাদা-কালো ফ্রেমে আবদ্ধ দেখতে পায়।
জীবনের স্বপ্নগুলো আসলেই কি রঙিন? বিবর্ণ মানুষদের স্বপ্নরা হারিয়ে যায় কেন? এরা কখন রঙিন স্বপ্ন দেখবে?

_____________
#মামুনের_অণুগল্প
#গল্পগ্রন্থ_ছায়াসঙ্গী

অণুগল্পঃ হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে

হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে

শুনছিল শিহাব চিন্ময়ের গলায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান-
‘কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে’

মন আর শিহাব দু’জন কথা বলে, একা একা।

– এই তুমিরা ছিলই বা কখন! কতটুকু সময়?
– তারপরও অচেতন মন ‘তুমি’ কে নিয়েই ভাবে!

এই ‘তুমি’!
তোমরা আরেকটু সময় থাকলে কি হয়?

_______________
#মামুনের_অণুগল্প
ফটো ক্রেডিটঃ গল্পকারের

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

সেদিন ছিলো ঝকঝকে দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মন ভালো হয়ে গেল। আমার মন এমনিতেই ফুরফুরে থাকে। অকারণেই আমি হাসি খুশী থাকি। আজ ও হাসিখুশি থাকার দিন। কিন্তু নিজের মনের কাছে আতংকে আছি। আজকাল আতংকে থাকি প্রায়ই। স এর যন্ত্রনায় পাগল হবার মতো অবস্থা আমার। রু এটা করো না, রু ওটা করো না। এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা ছিলো না। স মারামারি শুরু করে। যেমন সেদিন দরজা খুলতে এক মিনিট দেরী হলো। সে ঘরে ঢুকে আগুন চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি হাসলাম। স্যরি বললাম। ভয়ে ভয়ে তাকালাম তার দিকে। কেনো দেরী হলো দরজা খুলতে বলো, স রেগে আমার কাছে জানতে চাইলো।

আমি কি বলতে চাইলাম জানি না। সে ধুম করে চড় মারলো আমাকে। বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। রাগে আমারো মাথা নষ্ট – আমি বললাম বের হও তুমি ঘর থেকে। সে বের হয়ে গেলো।
পরদিন আমার একই কাণ্ড।
আর একদিন ওর এসব কাণ্ডকারখানা জানানোর জন্য ওর এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। স জালিবেতের মতো একটা মোটা বেত লুকিয়ে রাখে। ওর মনমতো কিছু না হলেই সে এলোমেলোভাবে পেটাতে থাকে।

সেদিন ও সে ঘরে খুব হাসিখুশি মুড নিয়ে ঢুকলো। কিন্তু আমি আতংকে আছি। আতংকে ওর দিকে তাকাতে পারছিনা। ভয়ে আমার গা হাত পা ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। সে ঘরে ঢুকে বললো ভাত দাও। আমি সুন্দর করে গুছিয়ে ভাত দিলাম। সে হাসলো।
জানো রু আজ কি হয়েছে ?
এরপর ওর কাজের জায়গায় ওর বন্ধু কি কি কাণ্ডকারখানা করেছে তাতে কি কি হাসির খোরাক হলো সে বলতে লাগলো। তার কথাবার্তার ধরন সুন্দর। যে কেউ মুগ্ধ হয়। সম্ভবত আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা আছে। মানুষকে মুগ্ধ করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মেছে। কিন্তু আমি ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছি। জানি না সে কি করে আজ !!
আমি কিছু শুনলাম কিছু শুনলাম না। ওকে খুব হাসিখুশী দেখলেও আমার ভয় লাগে। এরপর হয়তো কোনো ভয়াবহ কাণ্ড ঘটানোর জন্য সে অপেক্ষা করছে। স ভাত খেয়ে নীরবে হাত ধুলো। রু গুছিয়ে রাখো।
বলে সে বিছানায় গিয়ে বসলো।
আচ্ছা রু শুনো –
কাছে এসো।
আমি কাছে গেলাম। স আগুন চোখে আমার দিলে তাকালো।
কাকে ফোন করেছো তুমি ?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম কাউকে করিনি।
তুমি সকালকে ফোন দাও নি ?
আমি বললাম না।
তোমার মোবাইল আনো।
আমি আনলাম। সে খুঁজেও নাম্বার পেলো না। কারণ আমি ডিলিট করে ফেলেছি। রু তুমি ফোন নাম্বার ডিলিট করেছ কেন ? বলেই সে আমার চুল টানলো শক্ত করে –
আমি বললাম তুমি দেখলে রাগ করবে তাই।
তুমি ডিলিট করেছো তাতে আমি আরো বেশী রাগ করেছি।
স এর চোখে আগুন মুখে হাসি।
সে তার লুকোনো জায়গা থেকে বেত নিয়ে এলো।
আমি আতংকিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
স এর রাগের স্থায়িত্ব কাল বেশী। ঘন্টাখানেক থাকে। সে আমার চুল ধরে টেনে এমন পেটাতে লাগলো – আমি জ্ঞান হারালাম –

স এর সাথে প্রথম দেখা হয় এক ছবির প্রদর্শনীতে। স এর গভীর চোখ, মদির হাসি, গভীর আবেগ মথিত উচ্চারণ – আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। আমাদের প্রথম দিককার সময় গুলো স্বপ্নের মতো কেটেছে – সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, কবিতা পড়া, গান শুনতে যাওয়া, থিয়েটারে যাওয়া – আহ ! কি সময় !

প্রতিদিন ভাবি স কে ছেড়ে যাবো। কিন্তু স যখন সামনে এসে ক্ষমা চায়, আমাকে বলে দেখো তুমি আমার কথামতো চলো না বলেই আমি তোমাকে মারি। আমি ওকে বলি আমি শুনি তো। কিন্তু সব কথা কি শোনা যায় বলো স ? তুমি যা বলো সব লজিকেল না।
না, সব লজিকেল। তোমাকে শুনতেই হবে।
আমি কিছু বললাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
মনে মনে বললাম – আহা এতো ভালোবাসি – কেনো ভয়ে থাকো !!

একদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। স গভীর ঘুমে। এতো ইনোসেন্ট লাগছে ওকে – মানুষ ঘুমালেই সবচাইতে নিরীহ – আহা !
ওর মুখে ঠোঁটে হাত বুলিয়ে দিলাম – কি যে ভীষন ভালোবাসি – চোখে জল আমার –
দরজা খুলে বের হলাম। এতো সুন্দর হয় ভোর – কতদিন আমি দেখি না –

ঘরে ফিরবো না – আর ফিরবো না ঘরে আমি –
নিজেকে বললাম ফিসফিস করে –

কিন্তু কোথায় যাবো আমি ? তন্ন তন্ন করে কোথাও যাবার মতো জায়গা খুঁজে পেলাম না – তবু তবু আমাকে যেতে হবে –

আচ্ছা মানুষ তো অমৃতের সন্তান – সে হারতে জানে না –
দৃঢ় পদক্ষেপে আমি হাঁটতে লাগলাম –
উফফ ! আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন !!

লেখালেখির লেখক

বিনয় গল্প লেখে। কবিতাও লেখে। ওর চেনা জানা অনেকে সেসব লেখা পড়ে। কেউ ভাবে উচ্চ দরের লেখা। কেউ ভাবে কেন যে এসব লেখে? তাই কেউ লেখা পড়ে তেমন কোন মন্তব্য করে না।
আবার যারা চেনে না জানে না তারাও এ লেখা পড়ে অথবা পড়ে না। বলে – আপনার লেখা দেখলাম। বেশ লেখেন তো।
এই পর্যন্ত। তবে বিনয় লেখে। নিজে ছোটখাটো এক অফিসে কাজ করে। বাড়ি ফিরে কিছু সময় ছেলেমেয়েকে পড়ায়। তারপর লেখে। লেখার কথা ভাবে। কোন চায়ের ঠেকে যায় না। তাস পেটাতে ভাল লাগে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাজে তর্ক করতে ভাল লাগে না। তাই সময় পেলে লেখে।
মুশকিল হচ্ছে লেখার প্যাঁচ জানে না, উপস্থাপনা জানে না। কবিতার মত উদ্দাত্ত আলোড়ন তুলতে পারে না। এসব বিনয় ব্যাগ কাঁধে মোটা মোটা বই নিয়ে ঘোরা কিছুজনের কাছে শুনেছে।
ফলে বিনয়ের লেখা ওই পর্যন্ত।
বিনয়ও ভাবে তাহলে লিখে কি হবে? আবার ভাবে ঠিকই তো লিখেছি কিন্তু সত্যিই কি গল্পের আকার নেই? সত্যিই কি কবিতার ঝংকার নেই? তাহলে কি এসব ছেড়ে গুলতানীতে যাওয়া ঠিক? ঠেকে যাওয়া ঠিক?
বিনয় ভাবতে থাকে। অফিসে পরিতোষ একদিন বলল – দাদা, আপনি লেখক? আপনার লেখা পড়েছি।
পড়েছেন? কেমন লাগলো? এসব জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি বিনয়।
বাড়িতে বউ বলে – বেশ তো লিখছো। লেখো। লিখতেই থাকো।
বিনয় তাই লেখে। লিখতেই থাকে।

জীবন_একা_থাকা_মামুনের_অণুগল্প

লেখকেরা কখনও কখনও ‘মৃত লেখকজীবন’ রোগে আক্রান্ত হন। তখন একটা শব্দও আর নিজের মতো লেখা সম্ভব হয় না। শব্দ উঁকি দিলেও সামনে আসেনা কিংবা অনুভবের ক্রম অনুসারে নিজ নিজ জায়গা দখল করে না।

এসময় পুরনো লেখাগুলি থেকে নিজের প্রিয় গল্পগুলি আবার পোষ্ট করা যেতে পারে। নিজেই নিজের লেখা পড়ে আবারও নতুন করে লিখতে শুরু করা।
________________________________________________

‘এই বসন্তে তুমি ভালো থেকো’ কাব্যগ্রন্থটি মিলিকে এনে দিয়েছিলো বইমেলা থেকে। দু’টি বই-ই কবিতার। মেলায় গিয়ে একেবারে খালি হাতে আসবে? তাই… নেয়া। ওর একটি এখন হাতে মিলির।

বিকেল বেলাটা মিলি বাবুদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। সবসময়েই। এভাবেই দেখছে সে। বারান্দার বাইরেটা বাউরি বাতাসে উন্মাতাল।

এখন তো বসন্ত। মন নিরবে বলে। মিলির চুল উড়ছে। বাতাসে। বারান্দায় আসে শিহাব। মিলি তাকায় একপলক শিহাবের দিকে। আরেক পলক হাতের বইটির দিকে। এরপর আবার.. ওর নিজের দিকে। আপন মনে। একা একা।

ফিরে আসে শিহাব। ড্রইং রুমে। শিহাব ও.. একা একা।
দীর্ঘশ্বাস.. লুকাতে চায় কি?

মিলি কি চায়? শিহাব কি জানে?
একসাথে থাকার আজ কতগুলি বছর পার হলো.. ভাবে একবার। মনের একটা অংশ সংখ্যাগুলিকে অদৃশ্য ডিসপ্লেতে দেখালেও, অপর অংশটুকু বিস্ময়কর ভাবে নিশ্চুপ থাকে। নির্লিপ্ততা? অনাগ্রহ?

হবে হয়তো।
শেষে.. সম্পূর্ণ মনের মালিক শিহাব আগ্রহ হারায়। কবিতার ভিতর হারিয়ে যেতে যেতে মাত্র একবার নিজেকে ছোট্ট একটি প্রশ্ন করে,
-আজ মিলিকে নিয়ে পড়লে যে বড়?

মিলি বারান্দায় বসে নীলাভ মেঘগুলির দ্রুত আকাশটিকে দখল করাটা দেখছিলো.. মানুষটা এসেও বসলো না একটু.. পাশে। বসতে পারতো তো?
– ডেকেছিলে কি? তুমিও তো.. পারতে.. ডাকতে?

মনের প্রশ্নে কিছুই হয়না মিলির। এতগুলি বছর একসাথে কাটিয়েও কেনো এতো ডাকাডাকি? এই অনুভবটুকু জাগে কেবল। সে কি চায়, শিহাব কেনো আজও বুঝে না!?
-তুমি বুঝো?

একঝলক উন্মাতাল বাতাস চোখে-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ায় চোখ বুজে আসে মিলির। তাই মনকে চোখ রাঙ্গাতে পারে না। চোখ খুলবার আগেই ভিতরের রুম থেকে শিহাবের ভিতরের অন্য আরেক শিহাবের উদাত্ত গলার আওয়াজ ভেসে আসে,

” আমাকে ছুঁতে পারোনি তুমি কখনও, আমিও না তোমাকে,
একটু উষ্ণতার আশায় ত্রিশ বছর কাটিয়ে অবসন্ন আমি
এখন স্মৃতির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে দেই তোমাকে কারণে
অকারণে, এসবে আর কারো কিছুই যায় আসেনা এখন!” *

দুই বাবু ওদের বাবার গলার আওয়াজ পেতেই এক ছুটে ভিতরের রুমে।
মিলি সেই একা একা। নিজের ঘরের ভিতরে বাহিরে..সর্বত্র.. একা একা।

দমকা বাতাস মিলির চুল নিয়ে খেলা করে। ওকে ছুঁয়ে যায়.. উষ্ণ করে? বাতাস কি শিহাবের হাত? যাদুকরী!

মিলিরা একা একা.. শিহাবরা থেকেও?

জীবন কি তবে অনুভূতির ভাঙ্গাচুরা খেলায় যার যার ভূমিকায় অভিনয় করার এক প্ল্যাটফরম!
হয়তো..।

এইতো জীবন।
সবাইকে নিয়েও একা থাকা?

_________________________________________
* কবিতা: ত্রিশ বছর পর- কাব্যগ্রন্থ: এই বসন্তে তুমি ভালো থেকো
কবিঃ নাসির আহমেদ কাবুল

মেগাবাইট ভূতের জন্য সংসারে অশান্তি

মেগাবাইট ভূতের জন্য সংসারে অশান্তি

ছোট একটা সংসার। সংসারের কর্তা হলেন রমজান আলি। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে অনেক আগে থেকে। কিন্তু অভাবের কারণে বিয়ে করার সাহস পায় না। কিন্তু ইচ্ছে আছে বিয়ে করার। ইচ্ছাপূরণ হয় না শুধু অর্থ নেই, তাই। রমজান আলি জন্ম থেকেই দুখী। অভাব অনটনের মধ্যেই রমজান আলি ছোট থেকে বড় হয়েছে। মা, বাবা, ভাই, বোন বলতে এখন আর রমজান আলির কেউ নেই। রমজান আলি মা বাবাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। দুই শতাংশ জায়গার উপর ছনের একটা ঘর ছাড়া রমজান আলির আর কিছুই নেই।

পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায়, তা দিয়েই রমজান আলির দৈনন্দিন জীবন চলা। একসময় রমজান আলি পাশের গ্রামের ফুলজান বিবি নামের এক গরিবের মেয়ে বিয়ে করবেন বলে ভাবছিল। বিয়েতে রমজান আলির তেমন কোনও দাবিদাওয়া নেই। শুধু নতুন জামাপ্যান্ট বানিয়ে দেওয়া, আর বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়া ২০জনকে সমাদর সহ বিয়ের কার্যসম্পাদন শেষ করে দেওয়াই ছিল রমজান আলির দাবি। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেল। দিন তারিখও নির্ধারণ করা হলো।

রমজান আলিকে তাঁর পাড়াপড়শি বুঝাতে লাগলো, “গরিবের মেয়ে সাংসারিক হয়! তোর কপাল ভালো তাই এমন একটা মেয়ে পেলি! গরিবের মেয়েরা স্বামী ভক্ত হয়ে থাকে। আবার অনেক গরিবের মেয়েরা একটু জেদী টাইপের থাকে। কোনও কোনও মেয়ের আবার একটু অহংকার অহংকার ভাবও থাকে। আমাদের ধারনা এই ফুলজান মেয়েটার কোনও অহংকার গরিমা নেই। মাঝেমাঝে দেখি বড় একটা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। মানুষের ছবি তুলে, নিজের সেলফি তুলে। এছাড়া এই মেয়েটাকে আর কোনও মেয়ের সাথে আড্ডাও দিতে দেখি না। ফুলজান বিবি খুব ভালো মেয়ে। তোর সাথে মানাবে খুব!” শুনাইলেন, রমজান আলির গ্রামের লোকজন।

সবার কথা শুনে রমজান আলি তো খুশিতে আত্মহারা! যাক! আল্লাহর রহমতে মনে হয় আমার কপাল এবার ফিরলো। রমজান আলি ভাবছে, গরিবের মেয়ে বিয়ে করলে আমার অভাবের সংসারে আর অভাব থাকবে না। কিছু না থাকলেও কাইজা কীর্তন একটু কম হবে। বড় একটা মোবাইল ব্যবহার করে তো ভালো। আমিতো সারাক্ষণ পরের বাড়িতেই কাজে ব্যস্ত থাকি। আমার স্ত্রী নাহয় মোবাইলটা নিয়ে একা একা বাড়িতে বসে বসে টিপাটিপি করুক! তাতে ওর সময়টাও কাটবে, আমার সংসারের দুই মুঠো ডাল ভাতও তৈরি হয়ে যাবে। আর গরিবের মেয়েরা স্বামীর কাছে বেশি কিছু আবদারও করে না। গরিবের মেয়েদের বিলাসিতার দিকে নজরও থাকে কম। স্বামী যা-ই দিবে, তা-ই দিয়ে খুশি থাকবে। এটা ছিল রমজান আলির ধারনা।

রমজান আলি বিয়ে করলো। নতুন বউ ঘরে আনলো। দুইদিন যেতে আর না যেতেই শুরু হয়ে গেলো এক অন্য রকম পরিস্থিতি। এখন রমজান আলির আগের ধারনা হয়ে গেল ভুল! এটা নাই, ওটা চাই! দিবে না কেন? দিতে হবে! পারবে না কেন? পারতে হবে! আমার মোবাইলে মেগাবাইট নাই, মোবাইলে মেগাবাইট ভরে দিতে হবে! এসব নিয়ে প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা।

এমন পরিস্থিতিতে দিনদিন রমজান আলির দেমাগ খারাপ হতে শুরু করলো। কাজ করে যা পাই, তাতে চাল ডাল কেনার টাকাই হয় না। তার উপর আবার মেগাবাইট? এই মেগাবাইট দিয়ে কী হয়? মেগাবাইট কী খায়? নাকি মাথায় দেয়? রমজান আলি এখন নানান চিন্তায় জর্জরিত! তবে রমজান আলি লোকমুখে শুনেছে, মেগাবাইট মানে হচ্ছে ইন্টারনেট। যা দিয়ে ফেসবুক নামের একটা বুক চালায়। সেখানে অনেকেই সেলফি ছাড়ে, ছবি ছাড়ে, ভিডিও করেও ছেড়ে দেয়। এসব কিছু ছাড়ার পর কোথায় যে চলে যায়, তা অভাবী রমজান আলির অজানা। আর এখন নিজের বিবাহিত স্ত্রীই চালায় ইন্টারনেট। ছাড়ে সেলফি, ছাড়ে ছবি, ছাড়ে ভিডিও সহ আরও অনেককিছু।

রমজান আলি পরের বাড়িতে কাজ করতে গেলে মহাজনের ঘেনরঘেনর, পেনরপেনর শুনতে হয়। আবার বাড়িতে আসলে স্ত্রীর চাওয়া পাওয়ার দাবি। মেগাবাইট মেগাবাইট বলে স্ত্রীর চিল্লাচিল্লি। রমজান আলি এখন বিয়ে করেও এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে গেল।

একদিন সকালবেলা রমজান আলি কাজে যাবার সময় স্ত্রীকে বলল, “কিছু পান্তা পুন্তা থাকলে দাও! আমি খেয়েদেয়ে মহাজনের বাড়িতে যাই!” রমজান আলির স্ত্রী জবাব দিল, “এই গোলাম! তোর কি হুশ নাই? কাউল্কা কি বাড়িত আওনের সুম চাইল আনছস? অহনে যে কচ পান্তাপুন্তা? পান্তা গাবাইয়া আইবো? ভাত দেওনের মুরুদনাই, মেগাবাইট ভইরা দেওনের খবর নাই! তয় আমারে বিয়া কইরা আনছস কে?”

স্ত্রীর এমন কথা শুনে রমজান আলি জিদ্দে নিজের ডানহাত বামহাত পাকাচ্ছে! স্ত্রী তো বকবক করছেই। রমজান আলি জিদ আর থামিয়ে রাখতে পারলো না। স্ত্রীর বকবকের মধ্যে রমজান আলি চুলে ধরেই শুরু করে দিল, দাপ্পুর-ধুপ্পুর!
রমজান আলি বিয়ে করার পর এই প্রথম তাঁর স্ত্রীর উপর হাত ওঠাতে বাধ্য হলো। স্ত্রী ফুলজান বিবি স্বামীর শক্ত হাতে মার খেয়ে বাড়ির উঠানে চিৎপটাং হয়ে পড়ে রইল। রমজান আলি সকালের খাবার না খেয়ে মহাজনের বাড়িতে চলে গেল।

রমজান আলি সারাদিন না খেয়ে গাঁদার খাটুনি খেটে ঠিক সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলো। বাড়ি আসার সময় বাজার থেকে চাল ডাল সহ তেল লবণ সাথে করে নিয়ে আসলো। বাড়িতে এসে দেখে, ঘর অন্ধকার! ঘরে আলো নেই! রমজান আলি ভাবলো, হয়ত বিদ্যুৎ নেই, তাই ঘর অন্ধকার। রমজান আলি এক পা দু পা করতে পরতে ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে রমজান আলি ধপাস্ করে মেঝেতে পড়ে গেল! পড়ে যাবার সাথে সাথে চাল, ডাল, তেল, লবণ সবকিছু ছারখার হয়ে গেলো! রমজান আলির অনেক কষ্টের রোজগারের টাকা দিয়ে কেনা বাজার সদাই সব শেষ!

রমজান আলি ধূমপান করতো। তাই রমজান আলির পকেটে সবসময় দিয়াশলাই থাকতো। রমজান আলি দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দেখে, স্বাদের স্ত্রী মার খেয়ে মনের দুঃখে সটান হয়ে ঘরের মাঝখানে শুইয়ে আছে। স্ত্রীর শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে রমজান আলি ধপাস করে মাটিতে পড়েছে। স্ত্রী ঘরের মাঝখানে শুয়ে না থাকলে আর রমজান আলি ধপাস করে পড়তো না, রমজান আলির কষ্টের টাকার কেনা চাল ডালও নষ্ট হতো না।

স্ত্রীকে ঘরের মাঝখানে শোয়া দেখেই রমজান আলি এখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। স্ত্রীকে চুলে ধরে টেনে ওঠালো। আবার শুরু করে দিল ধাপুস-ধুপুস ইন্টারনেটের কনি। ফুলজান বিবি মাগে বাবাগো বলে চিৎকার শুরু করে দিলো। গ্রামের লোকজন বাড়ি ভরে গেলো। কী হয়েছে আর না হয়েছে, পাড়াপড়শির কাছে রমজান আলি বুঝিয়ে বললো। গ্রামের সবাই স্ত্রীকে বুঝাতে লাগলো। সবার উদ্দেশে স্ত্রী ফুলজান বিবির এক কথা।
কথা হলো, “ও আমারে কিচ্ছু না দেক, আমার আফসোস নাই! না খাইয়া থাকুম কারোর কাছে নালিশ দিতাম না। কিন্তু প্রত্যেকদিন আমার মোবাইলে ২০ টেকার মেগাবাইট ভইরা দেওন লাগবো। আমি না খাইয়া থাকতে পারুম, কিন্তু মোবাইলে মেগাবাইট ছাড়া থাকতে পারুম না।”

গ্রামের সবাই এখন অবাক হয়ে বলতে লাগলো, “সর্বনাশ! খাইছে তো! এই ফুলজানরে তো মেগাবাইট রোগে ধরছে? ও তো অহনে এই মেগাবাইট ছাড়া থাকতে পারবো না? তয়লে এই রমজানের অবস্থা কী অইবো?”
তাড়াতাড়ি করে ফুলজান বিবির বাবাকে খবর দিয়ে রমজানের বাড়িতে আনা হলো। ফুলজান বিবির বাবাকে সবাই জিজ্ঞেস করলো, “মেয়েকে মোবাইল কিনে দিয়েছেন কেন? আপনার মেয়েকে তো এখন মেগাবাইট রোগে ধরেছে! মোবাইল আর মেগাবাইট ছাড়া তো এখন আপনার মেয়ে থাকতে পারে না। আপনার জামাতা তো দিনে আনে দিনে খায়, তা আপনি নিজেও জানেন! তার উপর আবার মেগাবাইটের বাড়তি খরচ কী করে রমজান আলি জোগাবে?”
ফুলজান বিবির বাবা দুহাত জোড় করে বললো, “ভাইসব, মেয়েকে আমার বড় মেয়ের জামাই মোবাইলটা দিয়েছে। এই মেগাবাইট নিয়ে আমার নিজ বাড়িতেও অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। যা বিয়ের আমি আপনাদের কাছে গোপন করে রেখেছি। আমার মেয়ে ফুলজান বিবি ফেসবুক খায়, ভাত খায় না। ভাত না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মোবাইলে মেগাবাইট না থাকলে আর চলতে পারে না। এখন আপনারা যা করার করতে পারেন, আমার কোনও আপত্তি নেই।”

ফুলজান বিবির বাবার কথা শুনে গ্রামের সবাই রমজানের সাথে বুদ্ধি করে সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত হলো, সারাদিনে দুইবেলা খাবার হবে। শুধু সকালে আর রাত্রে। দুপুরবেলার খাবারের টাকা মেগাবাইট বাবদ খরচ হবে। রমজানের সংসারে প্রতিদিন চালের দরকার দেড় কেজি। এখন থেকে সারাদিনে সংসারে চাল দেওয়া হবে এক কেজি। বাজার সদাইও থাকবে সীমিত। গ্রামের সবার সিদ্ধান্তের সাথে রমজান আলির স্ত্রীও একমত হয়ে রাজি হয়ে গেলো। গ্রামবাসী সবাই ফুলজান বিবি আর রমজান আলিকে মিলিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলেন। রমজান আলি আর ফুলজান বিবি ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাল ডাল সহ সবকিছু কুড়িয়ে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে শুয়ে রইল।

রাত পোহাতেই ফুলজান বিবির গলা পিটানি শুরু হয়ে গেল। রমজান আলিকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “কাজে যাবার সময় ফোন ফেক্সের দোকান থেকে যেন ০১৭৭৭ নাম্বারে মেগাবাইট পাঠায়! আইজগা দুইদিন ধইরা আমি ফেসবুক চালাইতে পারতাছি না। ফেসবুকের কতো বন্ধু আমার লাইগা কানতাছে! মনডায় কয় মোবাইলডারে ভাইঙ্গা চুইরা হালাইয়া দেই! মোবাইলে মেগাবাইটই যদি না থায়ে, তয় এই মোবাইল রাইক্ষা কী অইবো?”

ফুলজান বিবির কথা রমজান আলি শুধু কান পেতেই শুনলো, কিন্তু কিছুই বলেনি। বলেনি এই কারণে, আগেরদিন নতুন বউকে দুইদফা খিছানী দেওয়া হয়েছে, তাই। এরপরও যখন রাত ভোর হতে না হতে বকবক শুরু করে দিলো, তাহলে আর কী করা? চোখ বুঝে রমজান আলি না খেয়েই মহাজনের বাড়ি রওনা হলো। পথিমধ্যে ফোন ফেক্সের দোকান থেকে ফুকজান বিবির মোবাইল নাম্বারে ২০ টাকার মেগাবাইট পাঠিয়ে দিল।

সন্ধ্যার সময় রমজান আলি চাল ডাল নিয়ে যথারীতি বাড়ি ফিরলো। সাথে আনা চাল ডাল সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারিও ফুলজান বিবির কাছে বুঝিয়ে দিল। পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বললো, “ক্ষুধা লাগছে, ভাত দে!”
ফুলজান বিবি বললো, “লাকড়ি নাই দেইখা ভাত রান্ধি নাই! ভাত খাইতে অইলে একটু সবুর করতে হইবো।”
রমজান আলি ঠিকই বুঝতে পেরেছে আসল ঘটনাটা ঘটনা হলো, মোবাইল। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণেই ভাত রান্না করার সময় পায়নি। স্ত্রীর মুখে ভাত রান্ধি নাই কথা শুনে রমজান আলি আর দেরি করলো না। ওমনি ফটাফট ফুলজান বিবির চুলে ধরে শুরু করে দিল, ধাপুস-ধুপুস! স্বামীর হাতে মার খেয়ে ফুলজান বিবি আর দেরি না করে সোজা বাপের বাড়ি চলে গেল। এরপর রমজান আলি নিজেই এক কৌটা চালের ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে আরামে শুয়ে রইল।

সকালবেলা রমজান আলি ঘুম থেকে ওঠে যথাসময়ে নিজের কাজে চলে গেল। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরে দেখে ফুলজান বিবি বাড়ি নেই। রমজান আলি বুঝতে পেরেছে, ফুলজান বিবি রাগ করেছে। তাই আমার বাড়ি আর সে আসবে না। হয়ত ফুলজান বিবি বাপের বাড়িতে থাকবে। “আসলে আসুক আর না আসলে না আসুক! এই জ্বালা আর সহ্য হয় না, আমিও নিজে থেকে তাকে আনতে যাবো না।” সিদ্ধান্ত নিলেন রমজান আলি।

এদিকে ফুলজান বিবি বড়ি গিয়ে তাঁর দাদীর কাছে বললো, “দাদী আমি আর রমজাইন্নার বাড়িত যামু না। ভাত দিতে পারে না, কাপড় দিতে পারে না, মোবাইলে মেগাবাইট ভরে দিতে পারে না, খালিখালি মারে। ওর বাড়িত ক্যান যামু?”
দাদী ফুলজান বিবির সব কথা শুনলেন। তারপর দাদী ফুলজানকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে ক্যাম্নে ধইরা মারে?”
ফুলজান বিবি বললো, “চুলে ধইরা ঘাড় নুইয়াইয়া পিডের মধ্যে খালি কনি মারে গো দাদী! গোলামে মানুষ না গো দাদী, মানুষ না! আস্ত জানোয়ার! কার কাছে যে আব্বায় আমারে বিয়া দিছে গো দাদি। আমি ওর ভাত খামু না।”

দাদী ফুলজানের কান্না দেখে বললো, “হুন নাতিন! ওর ভাত খাইবি, আবার সব কড়ে গণ্ডায় আদায়ও করবি। আমারতন সেরকম বুদ্ধি আছে! তয় তুই আমার বুদ্ধিমত কাজ করতে পারবি কিনা? যদি পারছ, তয় রমজাইন্নায় তোরে মা ডাইক্কা ভাত খাওয়াইবো। বুঝলি?”
দাদীর কথা শুনে ফুলজান বিবি খুশিতে আত্মহারা! দাদীকে বললো, “আমি দাদী তোমার বুদ্ধিমত কাজ করতে পারুম, তুমি আমারে বুদ্ধি দাও। রমজাইন্নার নাকে রশি হান্ধাইয়া ঘুরামু দাদী।”
দাদী বললো, “হুন, রমজাইন্নায় যহনে তোর চুলে ধইরা তোর ঘাড় নুয়াইয়া তোর পিডে কনি দেওয়নের আগেই, তুই রমজাইন্নার লুঙ্গির নিচের অণ্ডকোষে ধইরা হালাইবি। ধইরা জোরে টিবি লাগাইয়া দিবি। যেই পযন্ত রমজাইন্নায় তরে মা না ডাকবো, ততক্ষণ পযন্ত তুই অণ্ডকোষের চিবি ছাড়বি না। আবার বেশি জোরে চিবি দিছ না, তয়ইলে মইরা যাইবো গা। পরে আবার মামলা খাবি!”

দাদীর বুদ্ধি ফুলজান বিবি সঠিকভাবে মাথায় ডুকাইয়া পরদিন সাতসকালে রমজানের বাড়ি চলে আসে। রমজান আলি তখন ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে কাজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় ফুলজান বিবিকে দেখে রমজান আলি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। রমজান আলি মনে মনে বলতে লাগলো, “হালার বউ, কই যাইবা তুমি? যাওনের রাস্তা নাই! আমার কাছে আইতেই অইবো।”
এই বলে রমজান আলি ফুলজান বিবিকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ফুলজান বিবিও মনে মনে খুশি! মনে মনে বলতে লাগলো, “হালার রমজাইন্না, এইবার দেখুম তর কনির বাহাদুরি! এমন টিবি দিমু, মা ডাহাইয়া ছাড়ুম!” এইদিন ফুলজান বিবি ঘরে চাল ডাল থাকা সত্ত্বেও রান্না-বান্না না করে ঘরে শুইয়ে আছে। কাজ সেরে রমজান আলি বাড়ি ফিরে দেখে ভাতের ডেক খালি! ঘরে খাবার নেই! ফুলজান বিবি বিছানার উপর সটান হয়ে শুয়ে আছে।

ফুলজান বিবিকে বিছানায় শোয়া দেখে রমজান আলি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! ওমনি ফুলজান বিবির চুলে ধরে শোয়া থেকে টেনে উঠালো। এরপর শুরু করে দিল, ধাপুস-ধুপুস ইন্টারনেট কনি! ফুলজান বিবি একসময় সুযোগ বুঝে রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরে ফেলে। অণ্ডকোষে ধরে টিবি দেওয়া শুরু করলো।

এমতাবস্থায় রমজান আলির জান যায় যায় অবস্থা হয়ে গেছে। “মা গো, বাবা গো, ছাইড়া দে, আমারে ছাইড়া দে গো ফুলজান, ছাইড়া দে বলতে শুরু করলো।”
ফুলজান বিবি আরও জোরে টিবি দিতে লাগলো। ফুলজান বিবির টিবি খেয়ে রমজান আলি বলছে, “ভাই তর সব কথা আমি শুনুম, তুই আমারে ছাইড়া দে!”
ফুলজান বিবি এখন বলতে লাগলো, “শুন রমজাইন্না! আমি তরে ছাড়ুম! তয় আমার সব কথা তর শুনতে অইবো! যদি আমার কথা মানছ, তয় তর অণ্ডকোষের টিবি ছাড়ুম!”

অসহায় রমজান নিরুপায় হয়ে স্ত্রী ফুলজান বিবিকে বলছে, “কী কবি ক, আমি তর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করুম!” ফুলজান বিবি বললো, “প্রতিদিন তো চাল ডাল ঠিকমত আনবি’ই, হেই লগে আমার মোবাইলে মেগাবাইট ভইরা দিবি। যদি হ কছ, তয় ছাড়ুম! নয়ইলে এক্কেবারে টিবি দিয়া মাইরা হালামু।”
বেচারা রমজান আলি জীবন বাঁচানোর তাগিদে স্ত্রীর কথা মেনে নিল। এরপর ফুলজান বিবি রমজান আলির অণ্ডকোষ থেকে হাতে দেওয়া টিবি ছাড়লো।
রমজান আলি স্ত্রী থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কতক্ষণ মাটিতে বসে মনের দুঃখে কাঁদল। এরপর বাড়ির বাইরে চলে গেলো। সারাদিন বাইরে বাইরে থেকে আরেকজন থেকে কিছু টাকা হাওলাৎ করে ফুলজান বিবির মেবাইলে মেগাবাইট ভরে ভয়েভয়ে বাড়ি ফিরলো। এখন বেচারা রমজান আলি ফুলজান বিবির উপর রাগ হলেই, মার দেওয়ার আগেই ফুলজান বিবি দৌড়ে এসে রমজান আলির অণ্ডকোষের দিকে হাত বাড়ায়। রমজান আলি তখন টিবি খাওয়ার ভয়ে আর কিছুই বলে না।

একদিন রমজান আলি বেচারা কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এমনি এক পরিচিত মুরুব্বির সাথে দেখা। মুরুব্বি রমজান আলির কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কী হইছে রে রমজাইন্না? ক দেহি হুনি!”
রমজান আলি মুরুব্বির কাছে স্ত্রী ফুলজান বিবির সব গুণগান গেয়ে শুনাইলেন। মুরুব্বি মন দিয়ে শুনলেন। এরপর মুরুব্বি রমজান আলিকে বললো, “রমজাইন্না তুই বহুত বিপদের মাধ্যেই আছত রে! অহনে তোরে আমার বুদ্ধি মতন কাম করন লাগবো। তুই যদি আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারছ, তয় তুই তর বউয়ের মাইরের তন রেহাই পাইবি। না অইলে একবারে জানে মইরা যাইবি গা।আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারবিনি ক? যদি পারছ, তয় সুন্দর একটা বুদ্ধি দিয়া দেই। আমার বুদ্ধিমত বাড়িত যাইয়া ইচ্ছা মতন তর বউয়েরে পিডাগা। তর বউ তরে কিছুই করতে পারত না।”
রমজান আলি মুরুব্বি কথা শুনে বললো, “দেন চাচা দেন, আমারে বাঁচনের বুদ্ধি দেন।”

মুরুব্বি রমজান আলিকে বললো, “হুন রমজাইন্না! বাড়িত যাইয়া তর অণ্ডকোষের মাপ মতন একটা নাইকলের (নারিকেল) আইছা লইবি। আইছাডারে ভালা কইরা চাইছা দুই সাইডে দুইডা কইরা ছেদা করবি। হেই ছেদার মাইধ্যে চিকণ রশি দিয়া তর অণ্ডকোষের মাইধ্যে আটকাইয়া কোমড়ে বাইন্দা রাখবি। তয়ইলে তর বউয়ে আর তর নিচের অণ্ডকোষে ধরতে পারত না, টিবিও দিতে পারত না। তুই ইচ্ছা মতন মনের স্বাদ মিডাইয়া কইন্নাইতে পারবি। হালার বউ, যাইবি কই?”
রমজান আলি মুরুব্বি বুদ্ধিমত বাড়িতে গিয়ে তাঁর অণ্ডকোষের মাপে একটা নারিকেলের আইছা খুঁজে বের করলো। তারপর ভালো করে আইছাটা পরিষ্কার করে দুই সাইটে দুটি করে ছিদ্র করে তার ভেতর চিকণ রশি ভরে অণ্ডকোষের সাথে খাপ লাগিয়ে নিজের কোমড়ে বেঁধে নিলো। এবার আসলো ফুলজান বিবির সামনে।

ফুলজান বিবি রমজান আলিকে দেখে বলছে, “ওই গোলাম! তরে না কইছি, আগে আমার মোবাইলে মেগাবাইট দিতে? দেছ নাই কে? তর কি মনে নাই, কাইলকার কথা? আইজগা তরে মাইরাই হালামু!” এই বলেই ফুলজান বিবি খুব রেগে রমজান আলির সামনে এসে রমজান আলিকে ধরে ফেললো। রমজান আলি হাবার মতন দাঁড়িয়ে থাকলো। রমজান আলি তো জানেই যে, আজকে ফুলজান বিবি আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার নিচের অণ্ডকোষে ধরতেও পারবে না, টিবিও দিতে পারবে না।

ফুলজান বিবি যতবার রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরতে চাইছে, ততবারই ফুলজান বিবি ব্যর্থ হচ্ছে। ফুলজান বিবি বলছে, “ব্যাপারটা কী রে? এমন তো কাইলকা আছিল না? আইজগা দেখতাছি লোহার মতন লাগতাছে?” রমজান আলি এবার ধরছে ফুলজান বিবির চুলে মধ্যে। মারছে ইচ্ছামত ইন্টারনেটের কনি! জোরে জোরে শুরু করে দিলো ধাপুস-ধুপুস মেগাবাইটের ভূত তাড়ানো ইন্টারনেট কনি।
“হালার ফুলজান! নুন আনতে আমার পান্তা ফুরায়, তারপর আবার তোর মেগাবাইটের খোরাক?”

ফুলজান বিবি আজকে আর রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরতে পারেনি। নারিকেলের আইছা লাগানোর কারণে। তারপর রমজান আলির হাতে পায়ে ধরতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, “ভাই আমারে আর মারিছ না, আমি আর মোবাইলের লাইগা মেগাবাইট চামু না! আমারে তুই মাপ কইরা দে!”
তারপর ফুলজান বিবির আকুতি মিনতিতে রমজান আলির মায়া লেগে যায়। রমজান আলি ফুলজান বিবিকে ওয়াদা করাইয়া ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে আর কোনদিন ফুলজান বিবি মেগাবাইটের জন্য রমজান আলির কাছে আবদার করেনি। আর রমজান আলির সংসারে কোনদিন ঝগড়াঝাঁটিও হয়নি। শুরু হলো মেগাবাইট বিহীন রমজান মিয়া আর ফুলজান বিবির নতুন করে পথচলা। জয় হোক মানবতার!

সংগ্রামে দিশাহারা এক নারীর গল্প!!!

সংগ্রামে দিশাহারা এক নারীর গল্প?

সংগ্রাম এই শব্দটি শুনলে মনের মধ্য যেন আঘাত আনে। বাঙালীরা কি দোষ করেছিল যে জীবন দিতে হয়েছিল। শুধু ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য বাঙ্গালীদের প্রাণ নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। বাঙ্গালীরা দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করেছিল এই অধিকার জন্য। শুধু অধিকার নয় বাংলাকে শোষণ, শাসন থেকে মুক্ত করে, স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যান, বীর শহিদরা। শহিদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।

(১৯৭১ সালের এক সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
গ্রামে বাস করতেন সহজ সরল এক নারী। তাহার ৬ টি সন্তান। তিনটি মেয়ে, তিনটি ছেলে। তাহার ছোট মেয়েটির নাম দিপালী। ৬-৭ মাস বয়স হবে। বাংলার বুকে সংগ্রাম চলছে। চারদিকে রক্তাক্ত গুলাগুলি চলছে। গ্রামের মানুষ কি শান্তিতে ঘূমাচ্ছে?
না!!!
কখন কে জানে, গ্রামে আসবে ৭১ এর যমরাজ। কার মায়ের বুক খালি করবে ওরা, কার নিবে প্রাণ? গ্রামে মিলিটারি আসলে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়, শুরু হয় ছুটা-ছুটি। সবাই চারদিকে পালিয়ে যায়। কেউ জঙ্গলে, কেউ নদীতে নৌকায়, কেউ হাওরে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার আবার ফিরে আসে। এভাবে চলে তাদের জীবন দীর্ঘ নয় মাস।

একদিন দিপালীর মা পালিয়ে যাবে জঙ্গলে মিলিটারিরা এসে গেছে গ্রামে। তিনি সন্তানকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন। তিনি জঙ্গলে গিয়ে দেখেন, সন্তান রেখে বালিশ নিয়ে এসেছেন। তাহার ছোট সন্তান দিপালী ছিল ঘুমে। তিনি হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তখন তার ননদ দৌড়ে গিয়ে তাহার সন্তানকে নিয়ে আসে। দিশাহারা হয়ে মা সন্তানকে রেখে বালিশ নিয়ে আশ্রয় এর জন্য পালিয়েছিলেন। শান্তিতে নেই গ্রামের মানুষ কখন কাকে মারবে। ঘর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে।

গ্রামে মানুষ মারার জন্য লাইনে দাড় করেছিল মিলিটারিরা, কিন্তু পারেনি মারতে গ্রামের একজন রাজাকার ছিল সে ছিল মানব প্রেমিক। রাজাকারে কথায় আর গ্রামের মানুষ মারে নি। ছেড়ে দিয়েছে সবাইকে। এভাবে বলা যায় কত ইতিহাস অজানা রয়ে গেছে।

_____________________
(গল্পটি বাস্তব ঘটনা থেকে নেওয়া,
আমার মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনেছিলাম, তারপর লিখলাম)

ছবিঃ অনলাইন।

তোতলা লেখকের এক বৃহস্পতিবার

[ এই অণুগল্পটি কোনাবাড়িতে চাকরি করাকালীন সময়ে লিখেছিলাম। ফেসবুক মেমোরির কল্যাণে আজ আর একবার সামনে এলো। আমার নতুন বন্ধুদের জন্য শেয়ার করলাম ]

তোতলা লেখকের এক বৃহস্পতিবার

আজ বৃহস্পতিবার।
একাধারে আমার ‘বউ দিবস’ এবং ‘কন্যা দিবস’। সপ্তাহের এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। আজ অধিকাংশ সুইং ফ্লোর পাঁচটায় ছুটি। সামনে দুই দিন বন্ধ। ভালোলাগার থার্মোমিটারে পারদ এক ধাপ চড়া হয়ে আছে আগে থেকেই।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ছোট্ট গ্রামটির আমার এখনকার অস্থায়ী নিবাস আমাকে ডাকছে। আমার অপেক্ষায় ব্যালকনিতে দাঁড়ানো তিন নারী ‘আমাকে ঘিরে’ তাদের অপেক্ষার অনুভূতিতে কেমন প্রগলভ হয়, আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই ইচ্ছেটা ওদের সামনে এলে কেন জানি সুপ্ত থাকতে ভালোবাসে।

ছোট কন্যার সাথে আসন্ন খুনসুটির তীব্র ভালোলাগার অনুভূতি… বড় কন্যার কাছে-দূরে থাকা বাবার প্রতি ওর ভালোবাসায় সিক্ত হবার অন্যরকম ভালোলাগা… আর ওদের থেকে নিজেকে যখন বিচ্ছিন্ন দেখতে পাই, তারপরে আমার সময় হয় ‘মেকুরাণীর’ (আমার বউকে এই নামেও ডাকি আমি) সাথে মুহুর্তগুলো কাটানোর।

আমার লেখার একজন সমালোচক এবং বিমুগ্ধ পাঠক আমার মেকুরাণী। দিনভর সংসার সংসার খেলায় ক্লান্ত সে রাতের গভীর মুহুর্তগুলোতে আমার অনেক কাছে থেকে আমার লেখা আমার নিজের মুখে শোনে (আমি একটু তোতলা, কথা বলার সময় না বোঝা গেলেও আমার নিজের লেখা কাউকে পড়ে শোনাতে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায়)। এরকম একজন মানুষের কাছ থেকে পড়া শোনাটা যে কতটা কষ্টকর, সেটা ভুক্তভোগীমাত্রই অনুধাবনে সক্ষম হবেন।

তবে আমি পড়তে পড়তে ক্লান্ত হই না। পাশে আমার ‘সাথী’ থাকার অনুভূতিতে প্রচন্ড উদ্বেলিত এই আমি একটানা পড়ে যাই। হঠাৎ অনুভব করি আমার শরীরে ওর শরীর! কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে… আমার সামনে ল্যাপটপে আমার অনুভূতিগুলোর কালো আক্ষরিক রূপ! আমি যে নিজেকে এক অনুভূতির কারিগর মনে করি, নিজের অনুভূতিগুলো বাড়ি ফেরার স্বল্প সময়গুলোতে ‘ওকে’ আর বলা হয়ে উঠে না। তবে সে আমার একটা হাত ধরে থাকে… যদিও ঘুমে, তবুও ওর অবচেতন মনে আমি বিরাজ করি। সে জানে আমাদের জীবন এভাবেই কেটে এসেছে, যাচ্ছে, হয়তো এভাবেই কাটবে সামনেও। তাই এরই মাঝে জীবনের মানে খুঁজে নিতে হবে সবকিছু মিলিয়ে।

আমার মেকুরাণী আমাকে এই সামান্য হাত ধরে থেকেই রাজ্যের অনুভূতি এনে দেয়… কল্পনার এক বিচিত্র জগত যেখানে আমরা দুইময় জগত… সেখানে টেনে নিয়ে যায়। তার ভাবনা হয়তো এমন-

‘মেঘ করে আসবেই, পথ ঝাপসা হবেই বৃষ্টিতে
পা পিছলে তলিয়ে যাবে, তার আগে যতক্ষণ পারো
আঙুলে আঙুল আঁকড়ে রাখো…’ *

আমিও ঘুমন্ত সেই মুখের দিকে চেয়ে আমার কোয়ালিটি সময়গুলো পার করি… ভালোলাগা আরো ভালোলাগাকে সাথে নিয়ে পাক খেতে থাকে আমাদেরকে ঘিরে!

এমনই কিছু অনুভূতি নিতে আর কিছুক্ষণ পরে রওয়ানা হব সাভারের উদ্দেশ্যে।

_______________
* কবিতাঃ জয় গোস্বামী।

অণুগল্প : পারুর হাসিই পারুর কান্না

পারুর হাসিই পারুর কান্না

বইমেলা থেকে অগ্রজকে বইসহ টিএসসি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় আমান। নজরুলের মাজার সংলগ্ন রাস্তায় ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। দু’জনের হাতেই বইয়ের ব্যাগ। অগ্রজের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে তার ব্যাগটাও নিতে চায়। অগ্রজ দেন না। নির্বিকার হেঁটে চলেন।

সোহরাওয়ার্দীর বের হবার গেট দিয়ে বেরিয়ে পিচের পথ ধরে টিএসসি অভিমুখী যাত্রা। অনেক মানুষ। হাঁটছে। দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ফুটপাতে বসে জুটিরা খুনসুটিতে ব্যস্ত। অলস প্রহর কাটছে বেশ। ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় রয়ে যায় বুঝি একটু রেশ!

দুই রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডে এক জোড়া ছেলেমেয়ে বড্ড ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে। কাছাকাছি। পাশাপাশি।
মনের না শরীরের বুঝা দায়।

লাস্যময়ী মুখে চমৎকার হাসি ধরে রেখেছে। যুবকটির কাঁধের কাছে যুবতীর অবাধ্য চুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির কোনও অনুভূতি হয়?

হাঁটার তালে দেখে ওদের সেল্ফি তোলা। মেয়েটির চোখে চোখ পড়তেই তসর হাসি মুছে যায়। মুহুর্তের কঠোর হয়ে উঠে লাস্যময়ীর কমনীয় মুখ। এতটাই দ্রুত এই ভাবের পরিবর্তনে অবাক হয় আমান। গতি একটু শ্লথ হয়। অগ্রজ একটুখানি এগিয়ে যান। হাঁটার ছন্দপতনে তিনিও থেমে যান। পিছু ফিরে অনুজের দিকে তাকান নিরবে।
– কি হলো?
– কিছু না ভাই।

দুই ভাই গন্তব্যের দিকে আগায়। আমান ভাবে, নির্দোষ তাকানোয় কি দেখলো মেয়েটি যে এভাবে রেগে গেলো? মুহূর্তে তার চোখ থেকে হাসি মুছে যেতে দেখেছে আমান। রুপসী মেয়েটি এত দ্রুত রুপ পরিবর্তন করে ফেললো!

ঠিক পারুর মতো।
পারুর চোখ থেকেও মুহূর্তে হাসি মুছে যেত.. কোনো এক সময়। পারুর চোখের হাসিই পারুর কান্না ছিল। আমান বুঝতো।

কিন্তু পারু আমানের চোখের ভাষা পড়তে জেনেও কেন বুঝতে চাইলো না?

আজ কারো চোখ থেকে মুহূর্তে হাসি মুছে গেলে আমানের বড্ড পারুর কথা মনে পড়ে!

অণুগল্পঃ আমার_এবং_জ্ঞানী_বাবুর_গল্প

আমার ছোট কন্যাকে জ্ঞানী বাবু ডাকি আমি। আমার বন্ধের দিনটি এই জ্ঞানী বাবুর সাথে কিভাবে যে শেষ হয়ে যায়, নিজেই টের পাই না। সকাল থেকেই আমার (নাকি আমিই ওর) পিছু পিছু। আগে জুমুয়ার নামাজ পড়তে গেলেও তাঁকে ছেলের পোষাকে সাজিয়ে নিয়ে যেতাম। এখন সে বালিকায় রুপ নিয়েছে, তাই এখন আর সাথে যায় না।

বন্ধের দিনে আমি সম্পূর্ণ তাঁর। দাবা খেলতে হয় ওর সাথে, খেলতে হয় মনোপলি গেম। তাঁর নাচ দেখতে হয়, ক্লাশের বই থেকে পড়ে শোনাতে হয়। আর তাঁকে ‘টেলিভিশন’ এঁকে দেখাতে হয় (এই একটা জিনিসই আমি ভালো আঁকতে পারি কিনা)

জীবনটা হাজারো বিড়ম্বনায় ভরপুর আমার। গোলামীর জিঞ্জির গলায় পরানো। এর ভিতর থেকে কিছু ‘Quality Time’ পেতে আমাকে আমার এই বাবুটা অনেক সাহায্য করে।

আমি বুক ভরে জীবনের তাজা শ্বাস নিয়ে ৬ দিনের কষ্টকর… দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের সকাল-সন্ধ্যা বিরক্তিকর অপেক্ষার গ্লানিকর মুহূর্ত ভুলে, প্রতি সপ্তাহে জ্ঞানী বাবুর কাছে ফিরে আসি। আবারো একটা ৬ দিন কাটানোর মানসিক শক্তি অর্জন করতে।

এই আমাদের গল্প। আমার আর জ্ঞানী বাবুর গল্প। এই আমাদের যাপিত জীবন… এভাবেই এখন বেঁচে আছি আমরা। :)

_____________________
#আমার_এবং_জ্ঞানী_বাবুর_গল্প

রবীন্দ্রনাথের মুক্তি চাই

রবীন্দ্রনাথের মুক্তি চাই

রবীন্দ্রনাথ মগ্ন ছিলেন বর্ষায়। অবশ্য বসন্ত বন্দনাও কম করেন নি। তাই বর্তমানে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা সাজসাজ রবে বসন্ত উদযাপন করে জেনে ‍তিনি যতটা খুশী হলেন তার চাইতে বেশী বিস্মিত হলেন। বিস্ময় নিবারণের জন্য ভগবানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি বসন্তের আগের রাতে ঢাকার পথে পথে ঘুরতে এলেন। রবীন্দ্র সরোবরের কাছে এক বাড়ির কাছাকাছি দাঁড়াতে লেবুর ঘ্রাণ পেলেন।

হিম হিম হাওয়া, রাতের নির্জনতা আর লেবুর ঘ্রান মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করলো কবির মনে।তিনি উপরের দিকে তাকাতেই দেখলেন দোতালার এক ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে লেবুর ঘ্রাণটা আসছে। টবে থিরথির করে কাঁপছে লেবুর পাতা। ক’টা পাতা কি এক বিষণ্নতায় ঝরেও গেছে- নিচের গেটের কাছে এলোমেলো পরে আছে। তিনি দুটো পাতা তুলে নিলেন।

লেবু কঁচলালে তেতো হয়, কিন্তু লেবু পাতা কচলালে ঘ্রাণ আসে- লেবুর ঘ্রাণ। কবি লেবু পাতা কঁচলে ঘ্রাণ নিচ্ছেন আর হাঁটছেন। ধানমন্ডি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সাইন্সল্যাবের মোড়টা ঘুরতেই টহল পুলিশের মুখোমুখি-
: এই যে বুড়া চাচা, থামেন-
: আমাকে বলছেন?
: আপনারে কইতাছি না তো কারে কইতাছি, আর কেউ আছে..
: জ্বি, বলুন-!
: বুড়া মানুষ হয়া এতো রাইতে রাস্তায় কি করেন?
: বসন্তের আগের রাতে বেড়াতে এসেছি, আমি রবীন্দ্রনাথ..

‘আমি রবীন্দ্রনাথ’ কথাটা শুনেই টহল পুলিশের দলটা হেসে উঠলো, এরপর একজন রসিকতা করে বললো-
: রবীন্দ্রনাথ বা বাবান্দ্রনাথ?
: বাবান্দ্রনাথ মানে?
: ন্যাকা, কিচ্ছু বুঝেন না! আপনি কি বাবা মানে ইয়াবার ব্যবসা করেন না কি! এখন সাপ্লাই দিতে বের হইছেন!
: বাবা মানে পিতা হয় জানতাম, ইয়াবা কি- এটাই তো জানা নেই..

টহল পুলিশের দল থেকে দুজন অতি উৎসাহে রবীন্দ্রনাথের দেহ তল্লাশি করতে শুরু করলো। এক্কেবারে চিরুনি তল্লাশি। মানে তাদের আঙুলগুলোকে চিরুনি বানিয়ে রবীন্দ্রনাথের দাড়ি গোফেও তল্লাশি চালালেন কিন্তু ইয়াবা তো দূরের কথা, ক’টা পাকা দাঁড়িও ঝরলো না। টহল পুলিশের দলটির মধ্যে একটা হতাশভাব চলে এলো।

রবীন্দ্রনাথ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলেন- কি আশ্চর্য! আগামীকাল সকালেই তাকে পূঁজো করা শুরু হবে, অথচ আগের রাতে তাকে মাদক ব্যাবসায়ী মনে করে তল্লাশী! ঘোর ভেঙে দু’পা এগুতেই- টহল পুলিশের দলনেতা আবার তাকে ডাক দিলেন-
: এই যে বুড়ামিয়া, একটু সামনে আসেন তো!

রবীন্দ্রনাথ সামনে আসতেই তার হাত ধরে দলনেতা বললেন-
: হাতের মধ্যে এইটা কি কচলাইতাছেন?
: লেবুপাতা।
: লেবুপাতা কচলাইতাছেন ক্যান! পিনিক হয়!
: পিনিক কি!
: ওরররে বুড়ামিয়া! তুমি তো দেখি সেয়ানা মাল! পিনিক চিনো না!
: সত্যিই চিনিনা, পিনিক কি কি?

দল থেকে একজন বলে উঠলেন- থানায় নিয়া পাছার মধ্যে কয়টা লাগাইলেই বুঝবা পিনিক কারে কয়! রবীন্দ্রনাথ ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছেন, দলনেতা বললেন-
: লেবুপাতা কচলায়া কচলায়া ঢাকা শহরের মধ্যে মাঝরাতে হাঁটতাছেন, সন্দেহজনক। চলেন থানায় চলেন।

রবীন্দ্রনাথ কিছু বলবার আগেই দলটি তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে তুলে নিলো।
.
বসন্তের প্রথম সকালে টিভি চ্যানেলগুলোতে একের পর এক অনুষ্ঠান। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বসন্ত বন্দনা। ঢাকা শহরের ক’শ বছরের বাঙালির আজ হাজার বছরের ঐতিহ্য পালনের হুল্লোড়। এসবের মধ্যে পত্রিকার ভিতরের পাতার ছোট্ট সংবাদটি প্রায় সবারই চোখ এড়িয়ে গেলো- ‘লেবুর ঘ্রাণযুক্ত গাঁজা সহ এক বৃদ্ধকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবীন্দ্রনাথ নামে ঐ বৃদ্ধকে মাঝরাতে সাইন্সল্যাব সড়কে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময়ে আটক করে পুলিশ। …..।’ কেউ জানলো না, বসন্তের প্রথম সকালে হাজতখানায় বসে কবিগুরু আবৃত্তি করছেন- আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/খুশিতে ঠেলায় ঘোরতে এ জীবনে/কট খেয়ে গেছি হায়, কখন যে ছাড়ে… ধুর্বাল… কখন যে ছাড়ে! ধুর্বাল…. ধুর্বা… লললল। মাঘমাস ঠেসে গেছে.. কোকিল ফেঁসে গেছে.. বসন্ত এসে গেছে… ধু…. র্বাআআআ.. ল.. ধু…. র্বাআআআ.. লল.. ধু…. র্বাআআআ.. ললল।

অণুগল্পঃ মুখোশ

বাসে প্রচুর ভীড়। নিঃশ্বাস বন্ধ করা সেই ভীড়ে মধ্যবয়স্ক একজন কন্ডাক্টর ভাড়া নিচ্ছে। এক পর্যায়ে একজনের সামনে এসে বলে, ‘ মামা আপনার ভাড়াটা?’ যাকে বলা হল সে কোনো কথা না বলে সামনে তাকিয়ে থাকে। আবার একই কথা বলতেই- ‘ এই বাইঞ্চোত! একবার ভাড়া দিলাম না?’ কথায় কথা বাড়ে… হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায় অনেক সময়।

একজন দশ টাকার নোট দিয়েছে। ভাড়া পাঁচ টাকা। কন্ডাক্টর দুই টাকা ফেরত দিতেই-‘এ্যাই, আর তিন টাকা কই?’ … ‘ মামা, ভাড়া আট টাকা।’ …’ কবে থেকে? নতুন যাই মনে হয়?’ … ‘আমরা ও তো নতুন নিই না’… ‘জলদি তিন টাকা দে’…। পেছন থেকে একজন-‘ …শালাদের মাইর দেয়া দরকার’। এক পর্যায়ে কন্ডাক্টরের কানের উপর দু’এক ঘা… যাত্রী বনাম বাস স্টাফদের এই অসম যুদ্ধে নির্যাতিত হয়েও অতি স্বাভাবিক থেকে যায় এই স্টাফেরা।

চলার পথে এগুলো খুব কমন দৃশ্য। আমি বলছি না পরিবহন স্টাফেরা ধোঁয়া তুলসি পাতা। তবে ওদের জ্ঞান-রুচিবোধের সাথে আমাদের অনেক পার্থক্য। তাই একবার ভাড়া নিয়েও ভুলে আবার চাওয়াতে কোনো দোষ দেখি না। সামান্য দু’তিন টাকার জন্য নিজেকে মানুষ থেকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনাটাও কি ঠিক?

রিক্সায় উঠেছেন ভদ্রলোক, ভাড়া ঠিক করে নেন নাই। গন্তব্যে পৌঁছে স্বাভাবিক ভাড়ার থেকে দ্বিগুণ ভাড়া দাবী করাতেই হাতের ছাতা দিয়ে গোটা দুই বাড়ি রিক্সাওয়ালার শরীরে। কিংবা রিক্সায় ওঠার আগে ভাড়া কত নিবে জানার সময় অতিরিক্ত চাওয়াতে একটা অকথ্য ভাষার প্রয়োগ… এসবও প্রতিদিন দেখি… শুনি। নিজেকে ওই অশিক্ষিত গরীব মানুষগুলোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটাও কি ঠিক?

বাসে উঠেছেন, তাড়া আছে দ্রুত পৌঁছাবার। সবারই থাকে। ড্রাইভার জায়গায় জায়গায় বাস থামাচ্ছে। যাত্রীরা চীৎকার করছে, ‘ এ্যাই …শালার পো। বাস ছাড়োছ না ক্যা? ড্রাইভার ইচ্ছে করে আরো ঘাউরামি করে। এক মিনিটের জায়গায় আরো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। ফলাফল? ড্রাইভার-হেল্পারকে আচ্ছামত ‘মাইর’। এগুলো কিন্তু আমাদের মতো সাদা মনের দাবীদার মানুষেরাই করি। একটু ধৈর্য-সহিষ্ণুতার অভাব আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কখনো ভেবেছি কি?

এতোক্ষণ বলা হল যারা পাবলিক পরিবহনে চলাফেরা করেন, তাদের সাথে রিলেটেড প্রতিদিনের কিছু কমন ইন্সিডেন্ট। এবারে যারা নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করেন তাদের বেলায় ঘটে যাওয়া কিছু দৃশ্যের কথা বলি?
প্রচন্ড জ্যাম… প্রাইভেট কারে এসির ভিতরে বসে একটু পরপর উত্তেজিত হচ্ছেন-‘নাহ! এই দেশটার কিছুই হবে না। কেউ কোনো নিয়ম মানে না।’ পরক্ষনেই অন্য একটা কারকে আপনার ডান পাশ দিয়ে রঙ সাইড ধরে বেরিয়ে যেতে দেখেই ড্রাইভারকে- ‘ কি ব্যাপার? সবাই চলে যাচ্ছে, তুমি কি করছ? যাও, ওই পাশ দিয়ে ওর পিছনে রওয়ানা হও।’ ভালোই আইন মানলেন!

খালি রাস্তা… তেমন ভীড় নেই… একটা মোড় ঘুরার সময়ে হঠাৎ একটা রিক্সা আপনার গাড়ির সামনে। প্রচন্ড ব্রেক… আর একই সাথে নিজের মুখের ব্রেক ছেড়ে দেয়া- ‘ আবে …হালার পো, মরার আর জায়গা পেলি না? কিভাবে রিক্সা চালাস? অ্যাই তোরে লাইসেন্স কে দিছে রাস্তায় বের হবার?’ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রিক্সাওয়ালারা চুপ থাকে। তবে কিছু ঘাড় ত্যাড়া রিক্সাওয়ালা ত্বরিত মুখের ওপর জবাব দেয়… আর শিক্ষিত-উচ্চবিত্ত মানুষগুলোর হাতের জোর কেমন সেই পরীক্ষার গিলোটিনে গিনিপিগ হয়।

এরকম অসংখ্য ছোটখাট জিনিসের কথা উল্লেখ করে লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। আমি এখানে যাত্রী এবং পরিবহন স্টাফদের ভিতরকার কিছু আচরণের কথা বলছি না। আমি মানুষের সাথে মানুষের ছোট ছোট ব্যবহারের কথা বলছি। যেগুলো আমরা সচরাচর ভুলে যাই। ভয়-ক্রোধ ও হতাশার সময়ে আমরা নিজেদের ভেতর থেকে বের হয়ে আসি। আমাদের মুখোশ খুলে যায়। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে আমরা নিজেদেরকে দেখতে পাইনা। তবে অন্যের চোখে ঠিকই সেগুলো ধরা পড়ে। তাই পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমরা সৃষ্টির সেরা জীব, আমরা মানুষ। তাই আসুন নিজেকে নিজের চোখে দেখবার চেষ্টা করি।

অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন একবার আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়া যেতে পারে। সেখানে হয়তো নিজের মুখোশবিহীন আসল চেহারাটি দেখা যাবে। আর ঐ চেহারাটিই আসল।।

_______________
#মুখোশ_অণুগল্প_৫২২

অণুগল্প : কদিন_বিআরটিসি_বাসে

বিআরটিসি বাস। দু’টি বাস মাঝখানে জোড়া লেগে আছে ট্রেনের দুই বগির মতো। ঢাকার দিকে চলছে। সকাল দশটা। যাত্রীদের তেমন ভিড় নেই। যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

দু’জন মহিলা যাত্রী পরবর্তী স্টপেজ থেকে উঠলেন। ভার্সিটি স্টুডেন্ট। খালি দেখে পাশাপাশি দুই সিটে বসেন তাঁরা। একই সময়ে একজন ভ্রাম্যমান হকার বাসে ওঠে। পাথর বিক্রি করে। এই রুটে প্রায়ই তাকে দেখা যায়। সে নিজের পসরা হাতে নিয়ে গুনাগুণ বর্ণনার কাজে লেগে গেলো। অলস যাত্রীরা যার যার চিন্তায় মগ্ন থেকেও বাধ্য হয়ে হকারের পাথরের গুনাগুণ কিছু কিছু শুনতে থাকে। দু’একজন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। এমন একজনের হাতে দিয়ে হকার বেশ জোর গলাতেই জানায়,
– ভাই, পাথরে ভাগ্য ফিরে। বিশ্বাস না হলে একবার পরখ করে দেখুন।

তাঁর এই কথায় আর থাকতে না পেরে এক মধ্যবয়সী ততোধিক জোর গলায় জানান,
– এই ব্যাটা, এই সব আউল ফাউল কথা কেন বলছিস? পাথরে কি ভাগ্য ফেরে বল আমাকে?

হকার বিব্রত হয় না। ওর বহুদিনের অনুশীলনকৃত মুখের হাসি একটুও ম্লান হয় না। সে বক্তার সামনে যেয়ে নরম সুরে উত্তর দেয়,
– মামা, আপনি কি কখনো ইউজ করেছেন? একবার ইউজ করে দেখেন। খোদার কসম, অবশ্যই ভাগ্য ফিরবে।

ওর কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠেন মধ্যবয়সী যাত্রী। তিনি আশেপাশে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলেন,
– শুনুন ভাইয়েরা, এই পাথর বিক্রেতা আমাকে বলছে পাথরে অবশ্যই ভাগ্য ফিরে। আমাকে বলুন, যদি ভাগ্য ফিরবেই, তবে এতগুলো পাথরের মালিক হয়ে সে কেনো এই বাসে বাসে হকারি করছে? ওর তো কোটিপতি হয়ে যাবার কথা!

তাঁর কথায় বাসের ভিতরে মৃদু শোরগোল ওঠে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানায় কয়েকজন। এক যুবক তো টিটকারি মেরে জানায়,
– আংকেল, যে বিক্রী করে তাঁর বোধহয় ভাগ্য ফেরার নিয়ম নাই। কি মামা (হকারের দিকে তাকিয়ে), এটাই তো?

হকার আর কথা বলে না। যে যে যাত্রীর কাছে দেখবার জন্য সে পাথর দিয়েছিলো, সেগুলি সংগ্রহ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মধ্যবয়স্ককে বোধহয় গল্পে পেয়েছিলো। তাই তিনি থামেন না। বলে যান,
– আমার এক বন্ধু গেলো সৌদি আরবে। হজ্জ করতে। যাবার আগে এলো আমার কাছে। জানতে চাইলো আমার জন্য কি আনবে। বললাম আমার নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাল আকিক পরতেন। তো সুন্নত হিসেবে আমি পরতে চাই। আমার জন্য একটা রক্ত আকিক এবং একটা টাইগার পাথর মদিনা শরীফের মার্কেট থেকে নিয়ে এসো পারলে।

এ পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলে ওনার পাশের যুবক ফস করে জানতে চায়,
– তারপর? তিনি কি পাথর আনলেন?

যুবকের দিকে একপলক তাকান মধ্যবয়স্ক। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে উত্তর দেন,
– হ্যা ভাই। এনেছিলো সে। তবে না আনলেই বোধহয় ভালো ছিলো?
– কেনো? এ কথা বলছেন কেনো?
– পাথর হাতে পাবার একদিন পরে এক ভরি রুপা দিয়ে বানিয়ে দুই আঙ্গুলে পরলাম। তৃতীয় দিনে আমার চাকরিটাই চলে গেলো!
– বাহ! চমৎকার ভাগ্য ফিরলো আপনার।

সবাই হাসলেও কোথায় যেনো একটা বিষাদের সুর বেজে রইলো। কেউ কেউ অনুভব করে মনের ভিতরেই ম্রিয়মান হয়ে রইলো। আর এসবের ফাঁকতালে সেই হকার কখন যেনো বাস থেকে নেমে গেছে, টের পায় না কেউ।

সদ্য কিশোরী পর্যায় পার হয়েছে, এমন একজন আধুনিকা সদ্য যুবতীকে নিয়ে এক যুবক উঠলো। দুই ভার্সিটি স্টুডেন্টের সিটের সামনে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়লো। যুবকটি পিছনের একটি সিটে আগেই বসে পড়েছে। মেয়েটিকে সে ডাকতেই কেমন যেন আহ্লাদী স্বরে মেয়েটি ওখানে দাঁড়িয়েই ঢং করতে লাগলো। সেগুলি দেখে ভার্সিটি স্টুডেন্ট মেয়ে দু’টির পিছনে বসা দুই যুবকের একজন অল্প আওয়াজে বলে উঠলো,
– মাগী।

তবে ভার্সিটি স্টুডেন্ট মেয়ে দু’জনের একজন শুনে ফেলে শব্দটি। সে পিছু তাকিয়ে বক্তা যুবককে দেখে। আবার মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে মেয়েটি ভাবে, ‘এরাই শিক্ষিত সমাজের অংশ। অথচ এদের মনের ভিতরে কতটা কদর্যতা লুকিয়ে আছে। এরা আসলে খোলসধারী। মাকাল ফল। সার্টিফিকেটের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এদের দ্বারা এই সমাজের কিছুই হয় না। এরাই আবার যার যার পরিবারের কর্তা হয়। সেই পরিবারের নারীরা কি এদের সাথে বাস করে কখনো নিরাপদ অনুভব করবে?’

একজন নারী আরেক নারীর প্রতি তীর্যক মন্তব্যে কষ্ট পেতে থাকে। কিন্তু এই পুরুষপ্রধান সমাজে (যদিও নেতৃত্বে এখন নারী} কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের?

________________________
#একদিন_বিআরটিসি_বাসে_অণুগল্প

একজন ঘুড়ি উড়ানোর শিক্ষক ও ছাত্র চণ্ডী

একজন ঘুড়ি উড়ানোর শিক্ষক ও ছাত্র চণ্ডী

জমিদারের জমিদারির কথা কে না জানে? ধনসম্পদের অভাব তো নেই! অভাব নেই দাসদাসীরও। কিন্তু জমিদার বাবু ছিলেন নিঃসন্তানের মতো। বিয়ে করার ১২ বছরের মাথায়ও জমিদার বাবু সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়ে ওঠেনি। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কান্নাকাটির পর দয়াময়ের কৃপায় এক পুত্রসন্তানের পিতা হলেন, জমিদার বাবু। ছেলের নাম রাখলেন, এক দেবতার নামের সাথে মিল রেখে ‘চণ্ডী’। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। এভাবে পুত্র চণ্ডী একসময় ৫ বছরের এক বালক হয়ে গেল।

এখন চণ্ডীর লেখাপড়া শেখার বয়স হয়েছে। এই বয়সে ছেলেপেলেরা মাদ্রাসায় যায়, মক্তবে যায়, স্কুলে যায়। কিন্তু জমিদার পুত্র এসবের ধারেকাছেও যায় না। চণ্ডী শুধু ঘুড়ি আর ঘুড়ি। ঘুড়ি ছাড়া চণ্ডীর আর কিছুই ভালো লাগে না। সারাদিন তো আছেই, রাতে শোবার সময়ও চণ্ডী তাঁর ঘুড়ি আর নাটাই সাথে নিয়েই ঘুমায়।

ঘুড়ির প্রতি চণ্ডীর এরকম ভাব দেখে জমিদার বাবু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। দাস-দাসী দিয়ে চণ্ডীকে অনেকবার স্কুলে পাঠিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কুলে বই খাতা রেখে চণ্ডী বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এসেই ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে চলে যায় মাঠে। এমতাবস্থায় জমিদার বাবু পড়ে গেল মহা চিন্তায়। একটি মাত্র সন্তান! বিশাল সহায়সম্পত্তি! ছেলে যদি লেখাপড়াই না করে, তাহলে তাঁর এই সহায়সম্পত্তি দেখভাল করবে কে? বংশের নাম রাখবে কে? জমিদার বাবুর এখন ঘুম নেই, খাওয়া নেই। চিন্তা আর চিন্তা। একদিন এক বৃদ্ধ মাস্টারের কাছে গিয়ে জমিদার বাবু বিস্তারিত খুলে বললেন। জমিদার বাবুর কথা শুনে বৃদ্ধ মাস্টার হেসে বলল, এতে চিন্তার কোনও কারণ নেই। আপনার ছেলে ঘুড়িও উড়াবে, আবার লেখাপড়াও শিখবে।

মাস্টারের কথা শুনে জমিদার বাবু খুশিতে আত্মহারা! মাস্টারের হাতে ধরে জমিদার বাবু বলল, মাস্টার বাবু আপনার সদিচ্ছাই হতে পারে আমার ছেলের লেখাপড়া। এখন আপনিই বলুন, আমাকে কী করতে হবে?

মাস্টার বাবু জমিদার বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে কোন রঙের ঘুড়ি উড়াতে বেশি পছন্দ করে? আর ঘুড়ি উড়ানোর নাটাই-ই-বা তার কেমন দরকার হয়? মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার বাবু ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু খুলে বললেন। জমিদার বাবুর কথা শুনে মাস্টার বাবু বললেন, “আপনি বাড়ি গিয়ে আপনার ছেলেকে বলবেন, তোমার জন্য ঘুড়ি উড়ানোর মাস্টার ঠিক করেছি। তুমি যখন ঘুড়িই উড়াবে, তখন তোমাকে ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু আগে শিখতে হবে। ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু শেখার পর তুমি হবে একজন সফল ঘুড়ি উড়ানো প্লেয়ার। তাতে তোমারও দাম বাড়বে, আমারও সুনাম হবে। এই কথা শুনেই আপনার ছেলে আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠবে। তখন আপনি বলবেন, আগামীকালই তোমার ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার বাড়িতে আসছে।”

মাস্টার বাবুর কথা জমিদার বাবু খুব মনোযোগ সহকারে শুনলেন, খুশিও হলেন। তখন মাস্টার বাবু বললেন, আপনি আমাকে ১০টাকা দিন। এই টাকা দিয়ে ঘুড়ি কিনে আগামীকাল আপনাদের বাড়ি যাবো। ঘুড়ি উড়িয়ে আপনার ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো শুরু হবে। বিনিময়ে আমাকে কিছুই দিতে হবে না, জমিদার বাবু। কারণ, আমি একজন শিক্ষক। শিক্ষা দান করাই আমার ধর্ম। মাস্টার বাবুর কথামত জমিদার বাবু তাঁর পকেট থেকে ১০টাকা বের করে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে এলো।

বাড়ি এসে পুত্র চণ্ডীকে ডেকে আদর করে কাছে বসালেন। জমিদার বাবু পুত্র চণ্ডীকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কি লেখাপড়া করবে না? যদি লেখাপড়া না-ই-বা করো, তাহলে আমার এতো ধনসম্পত্তি ভোগদখল করবে কে? তুমি ছাড়া তো আমাদের আর কেহ নেই যে, অন্য কেহ এই জমিদারি ধরে রাখবে! এখন তুমিই বলো কী করবে?

বাবার কথা শুনে পুত্র চণ্ডী সোজা কথা বলে দিল, আমি লেখাপড়া করবো না। তোমার এতো ধনসম্পদ থাকতে আমি কষ্ট করে লেখাপড়া করতে যাবো কেন? আমি ঘুড়ি উড়িয়ে সময় কাটাতে চাই। প্লিজ বাবা, আমাকে আর লেখাপড়ার কথা বলবে না।

পুত্র চণ্ডীর কথা শুনে জমিদার বাবু রীতিমত হতবাক! ছেলে আমার বলে কী? ছেলের কথায় একটু দুঃখই পেলেন, জমিদার বাবু। তবু দুঃখ প্রকাশ না করে ছেলেকে আবার আদর করে কাছে বসালেন। এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ঘুড়ি উড়াতে শিখেছ? বাবার কথায় পুত্র চণ্ডীর জবাব, এখনো পুরোপুরিভাবে উড়াতে পারি না বাবা। তো আর কিছুদিনের মধ্যে নাটাই ঘুরানি পুরোপুরি শিখে যাবো।

জমিদার বাবু ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বলল, বাবা চণ্ডী, ঘুড়ি উড়াতে হলে আগে ঘুড়ি উড়ানোর শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে হয়! তা কি তুমি জানো?
এ কথা শুনে জমিদার পুত্র চণ্ডী এবার জমিদার বাবুকে ঝাপটে ধরে বলল, বাবা আমার জন্য একজন ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার ঠিক করে দাও! আমি মাস্টারের কাছ থেকে ঘুড়ি উড়ানো শিখে পাড়ার সকল ছেলেদের উড়ানো ঘুড়ি কেচাং কেচাং করে কেটে দিব। প্লিজ! বাবা, একজন ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার আমার চা-ই চাই! পুত্র চণ্ডীর আবদারে বাবা জমিদার বাবু বলল, ঠিক আছে বাবা। তুমি আমার একমাত্র আদরের ছেলে। তোমার আবদার কি আমি না রেখে পারি? আগামীকালই ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার আমার বাড়ি আসবে। তুমি মাস্টারের কাছ থেকে ঘুড়ি উড়ানো শিখবে। আমিও চাই তুমি একদিন এই ঘুড়ি উড়িয়ে বিশ্ব জয় করবে।

বাবা জমিদার বাবুর কথা শুনে পুত্র চণ্ডী খুশিতে আত্মহারা! জমিদার বাবুকে জরিয়ে ধরে বলল, বাবা আমি আপনার কথা চিরদিন স্মরণে রাখবো। আমি এমনভাবে ঘুড়ি উড়ানো শিখবো, আমার ঘুড়ি আর কেউ কাটতে পারবে না। আমিই সবার ঘুড়ি কেটে দিবো। তুমি আমার জন্য আশীর্বাদ করবে বাবা।

পরদিন সকালবেলা জমিদার পুত্র বাড়ির সবার আগেই ঘুম থেকে উঠে ঘুড়ির উড়ানোর মাস্টারের জন্য অপেক্ষা করছে। যেই পথ দিয়ে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করবে, সেই পথের দিকেই জমিদার পুত্র চণ্ডী তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা শুধু মাস্টারের জন্য। কখন যে ঘুড়ি উড়ানোর মাস্টার আসবে, সেদিকেই জমিদার পুত্র চণ্ডীর নজর। একসময় জমিদার পুত্র বাড়ির প্রবেশ পথ ধরে আসতে থাকা এক লোককে দেখতে পেলো। বুড়ো বয়সের এক লোক কতগুলো ঘুড়ি হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। জমিদার পুত্র দৌড়ে গিয়ে আগত লোকটির পা ছুঁয়ে নমস্কার করে বলল, নিশ্চয়ই আপনি আমার ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার?
লোকটি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, তাহলে তুমিই আমার ঘুড়ি ছাত্র চণ্ডী?

জমিদার পুত্র বলল, হ্যা স্যার! আমিই আপনার ছাত্র চণ্ডী! আমাকে আপনি ভালো করে ঘুড়ি উড়ানো শেখাবেন। যাতে কেউ আমার ঘুড়ি কাটতে না পারে। আমিই সবার ঘুড়ি কেটে দিবো। মাস্টার বললেন, তুমি অবশ্যই পারবে। তবে ঘুড়ি উড়ানো শিখতে হতে কিছু নিয়মকানুন আগে শিখতে হয়। তা তোমাকেও শিখতে হবে।
জমিদার পুত্র চণ্ডী বলল, স্যার, আপনার দেওয়া সমস্ত নিয়মকানুন শিখেই, আমি ঘুড়ি উড়ানো শিখবো। মাস্টার বলল, ঠিক আছে চণ্ডী! তাহলে আগে তোমাকে ঘুড়ির নাম শিখতে হবে। মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার পুত্র চণ্ডী অবাক হয়ে বলল, বলেন কি স্যার! ঘুড়ির আবার নাম আছে নাকি? মাস্টার বাবু হেসে বলল, ভেজাল তো এখানেই চণ্ডী! ঘুড়ির যদি নাম না-ই থাকতো, তাহলে কাগজ আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চারকোণা একটা বস্তুর নাম ঘুড়ি হলো কীভাবে?

মাস্টারের কথা শুনে জমিদার পুত্র মাথানত করে বলল, তাহলে আগে ঘুড়ির নামগুলো আমাকে শিখতে হবে স্যার। তো ঘুড়ির নামগুলো বলুন, আমি শিখে নিই!
চণ্ডীর কথায় মাস্টার হেসে বলল, ঘুড়ির অনেক নাম। সবগুলো নাম শিখতে তোমার কয়েকমাস সময় লাগবে। তা কি তুমি ধৈর্য ধরে শিখতে পারবে? জমিদার পুত্র চণ্ডী বলল, তা যতদিনই সময় লাগে লাগুক! আমাকে ঘুড়ির নামগুলো শিখতেই হবে, স্যার। তো বলুন না, ঘুড়ির কতগুলো নাম আছে? মাস্টার বলল, প্রথম স্তরে ১১টি নাম আছে! এই ১১টি ঘুড়ির নাম তুমি মুখস্থ করতে পারলে, এরপর আছে আরও ৩৯ টি নাম। তা কি তুমি পারবে চণ্ডী? চণ্ডী হেসে বলল, এটা আমার জন্য কোনও ব্যাপারই না, স্যার। আমি ফটাফট শিখে ফেলবো। মাস্টার বলল, বেশ! তাহলে তুমিই হবে ঘুড়ি উড়ানোর সেরা খেলোয়াড়। তাহলে শুরু করা যাক, আগে ১১টি ঘুড়ির নামগুলো শেখা!

মাস্টার বাবু জমিদার বাড়ি আসার আগেই ১১টি ঘুড়ির গায়ে ১১টি স্বরবর্ণ লিখে এনেছিলেন। যথাক্রম– অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ। মাস্টার বাবু জমিদার পুত্র চণ্ডীর সামনে সাথে আনা ঘুড়িগুলো মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে বলল, এখন দেখ, ঘুড়ির গায়ে লেখা আছে ঘুড়ির নাম। এই নামগুলো তুমি পড়বে, আবার ঘুড়ির গায়ে লেখা দেখে দেখে মাটিতে লিখবে। মুখস্থ হয়ে গেলে বাড়িতে গিয়ে কাগজের খাতায় তা লিখে রাখবে। তাহলে আর কোনদিন এই শেখা নামগুলো তুমি ভুলে যাবে না।

জমিদার পুত্র বলল, আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা কাগজের অনেকগুলো খাতা কিনে রেখেছে। কিন্তু আমি ওইসব খাতা কোনদিন লিখিনি। আপনি যখন বলছেন, তো ঘুড়ির নামগুলো আমি বাড়ি গিয়ে একটা একটা করে লিখে রাখবো, স্যার। এখন একটা ঘুড়ি নাটাইতে বেধে দিন, আমি উড়াতে থাকি। মাস্টার বাবু বলল, তা তো তুমি উড়াবেই। আজকে এই ১১টি ঘুড়ির নাম মুখস্থ করতে হবে। আগামীকাল থেকে তোমার ঘুড়ি আকাশে উড়বে। মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার পুত্র বলল, ঠিক আছে স্যার, তাহলে আপনি একটা একটা করে নামগুলো বলে দিন; আমিও মুখস্থ করতে থাকি! মাস্টার বাবু বলতে লাগলো, এটা “অ” এটা “আ” এটা “ই” এটা “ঈ”, এভাবে উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ, মোট ১১টি।

জমিদার পুত্র মাটিতে বসে ১১টি ঘুড়ি সামনে নিয়ে অ আ ই ঈ পড়তে শুরু করে দিলো। একবার পড়ে, আবার একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে লেখে। এভাবে সকাল থেকে দুপুর হয়ে গেল, কিন্তু জমিদার পুত্র চণ্ডীর পড়া শেষ হচ্ছে না। মাস্টার বাবুও জমিদার পুত্র চণ্ডীর সাথেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। এদিকে জমিদার বাবু সকাল থেকে আদরের ছেলেকে না দেখে এদিক ওদিক খুঁজাখুঁজি করছে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে কোথাও চণ্ডীকে পাওয়া গেল না। বাড়ির ভেতরে ছেলেকে না পেয়ে জমিদার বাবু বুঝতে পারলো, ছেলে ঘুড়ি নিয়েই হয়ত ব্যস্ত সময় পার করছে। এই ভেবে জমিদার বাবু বাড়ির বাইরে যেতেই, চোখ পড়ল মাঠের দিকে। দেখে মাস্টার বাবুর সাথে আদরের ছেলে চণ্ডী বসে আছে। জমিদার বাবু সামনে গিয়ে মাস্টার বাবুকে প্রণাম জানিয়ে বললেন, আপনি কখন এসেছেন মাস্টার বাবু?

মাস্টার বাবু বললেন, আমি তো সেই সকালবেলাই আপনার বাড়ি এসেছি। আসার পথেই আপনার আদরের পুত্র চণ্ডীকে পেয়ে গেলাম। ব্যস, শুরু করে দিলাম আমাদের ঘুড়ির খেলা। তা এখনো চলছে, জমিদার বাবু। জমিদার বাবু দেখতে পাচ্ছে, তাঁর আদরের ছেলে বসে বসে ঘুড়ি দেখে দেখে মাটিতে লিখছে। এই অবস্থা দেখে জমিদার বাবুর বিশ্বাস হলো এখন থেকে তার ছেলের লেখাপড়া শুরু! জমিদার বাবু খুশি হয়ে মাস্টার বাবুকে বললেন, চলুন, বাড়িতে গিয়ে আমরা কিছু জলখাবার করে নিই! মাস্টার বলল, তা আর এখন দরকার নেই, জমিদার বাবু। আপনি আপনার ছেলেকে আজকের মত বাড়িতে নিয়ে চলে যান। বিকালবেলা ওকে একটা খাতা কলম হাতে ধরিয়ে দিবেন। কলম দিয়ে আপনার ছেলে চণ্ডী এই ১১টি ঘুড়ির নাম লিখে রাখবে। আগামীকাল আমি আসলে, তাঁর লেখাগুলো আমি দেখবো। এভাবে জমিদার পুত্র চণ্ডীকেও বুঝিয়ে দিয়ে মাস্টার নিজের বাড়ি চলে গেল। জমিদার বাবু তাঁর আদরের ছেলে আর ঘুড়িগুলো সাথে নিয়ে বাড়ি চলে এলো।

বাড়ি এসে চণ্ডী তাড়াতাড়ি স্নান করে কোনরকম সামান্য কিছু খেয়ে খাতা কলম আর ঘুড়ি নিয়ে নিজ ঘরের খাটের পর বসে পড়লে। চণ্ডীর মুখে এখন শুধু অ আ ই ঈ উ ঊ এভাবে ১১টি। রাতেও ঘুমের ঘোরে চণ্ডী অ আ ই ঈ বলছে তো বলছেই।

পরদিন আবার মাস্টার বাবু যথাসময়ে জমিদার বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। ১১টি ঘুড়ি আর জমিদার পুত্র চণ্ডীকে নিয়ে মাঠে গেলেন। সাথে আছে খাতা আর কলমও। মাঠে গিয়ে চণ্ডী থেকে মুখস্থ করা পড়া নিলেন। লেখা দেখলেন। চণ্ডীর প্রশংসা করলেন। চণ্ডীকে বললেন, এবার তুমি প্রথম ঘুড়িটা নাটাইয়ের সূতার সাথে বেধে আকাশে উড়িয়ে দাও! চণ্ডীকে মাস্টার বাবু জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম ঘুড়ি কোনটা এবং নাম কী?
চণ্ডী বললেন, প্রথম ঘুড়ির নাম হলো “অ”, স্যার।
মাস্টার আদেশ দিলেন ১১টি ঘুড়ি থেকে এই “অ” ঘুড়িটা বের করে নাটাইয়ের সূতোর সাথে বেধে উড়াতে থাকো। “অ” ঘুড়ি কাটা পড়লে, এর পরেরটা “আ” ঘুড়িটা উড়াবে। এভাবে এই ১১টি ঘুড়ি উড়ানোর পর আমি বাদবাকি ৩৯টি ঘুড়ি একসাথে কিনে নিয়ে আসবো। এই ১১টি ঘুড়ির নাম তুমি যেভাবে শিখেছ, ঠিক ৩৯টি ঘুড়ির নামও একইভাবে তোমাকে শিখতে হবে। প্রথম প্রথম ঘুড়ি কাটা পড়লে দুঃখ করবে না। কাটা খেতে খেতেই একদিব তুমি অপরের ঘুড়ি কেটে দিতে পারবো। আগে তোমার ঘুড়ি কাটা না পড়লে, পরের ঘুড়ি তুমি কাটতে পারবে না। এই বলে মাস্টার বাবু চণ্ডীকে মাঠে রেখে নিজ বাড়িতে চলে গেল।

চণ্ডী সারা দুপুর “অ” ঘুড়িটি উড়িয়েছে। কারোর ঘুড়ির সাথে আর কাটা পড়েনি। পেটে ক্ষুধা অনুভব হলে, চণ্ডী ঘুড়িগুলো আর নাটাই হাতে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
বাড়িতে আসার পর জমিদার বাবু আদরের ছেলেকে ডেকে বলে, চণ্ডী তোমার মাস্টার বাবু কোথায়?
চণ্ডী বলল, উনি আমাকে সব দিকনির্দেশনা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। এই ১১টি ঘুড়ি শেষ হলে আবার তিনি আমার জন্য ৩৯টি ঘুড়ি নিয়ে আসবে। বাবা জমিদার বাবু বুঝতে পেরেছে যে ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে।

চণ্ডী তাড়াতাড়ি করে স্নান করে খাওয়াদাওয়া করতে করতে দিনের সময় প্রায় শেষ পর্যায় এসে পড়েছে। চণ্ডী ভাবলো, এখন আর ঘুড়ি নাটাই নিয়ে মাঠে যাওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং খাতা কলম নিয়ে ঘুড়ির নামগুলো খাতায় লিখতে থাকি। এই ভেবেই চণ্ডী খাতা কলম আর ঘুড়িগুলো সাথে নিয়ে নিজের ঘরের খাটের পর গিয়ে বসে পড়লো। এভাবে ১১টি ঘুড়ি শেষ করতে জমিদার পুত্রের প্রায় ১৫ দিন কেটে গেল।

যথাসময়ে মাস্টার বাবু আবার ৩৯টি ঘুড়ি নিয়ে জমিদার বাড়িতে উপস্থিত হলো। এবার ৩৯ ব্যঞ্জনবর্ণ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ ইত্যাদি লেখাযুক্ত ঘুড়ির পালা হবে শুরু। জমিদার পুত্র চণ্ডীকে যেভাবে ১১টি স্বরবর্ণ লেখাযুক্ত ঘুড়ি উড়িয়ে অ আ ই ঈ শিখিয়েছে, ঠিক একইভাবে ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ লেখাযুক্ত ঘুড়ি দিয়ে তাও শিখিয়েছে। এভাবে দিন যেতে লাগলো, মাস যেতে লাগলো। চণ্ডীও আস্তে আস্তে ঘুড়ির চেয়ে লেখাপড়ার দিকেই বেশি ঝুকে পড়ছে। চণ্ডীর এখন আর ঘুড়ির প্রতি তেমন নেশা নেই। নেশা শুধু পড়া আর লেখার দিকে। এভাবে একদিন জমিদার পুত্র চণ্ডী নিকটস্থ স্কুলে ভর্তি হলো। ওয়ান থেকে শুরু করে মেট্রিক পাস করলো। যেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, জমিদার পুত্র ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে পাস করলো।

রেজাল্ট হাতে নিয়ে চণ্ডী তাঁর বাবাকে প্রণাম করতে গেলে, বাবা জমিদার বাবু চণ্ডীকে বলল, এই খুশির খবর আর ভক্তির প্রণাম আগে আমাকে নয়! এই খবর আর প্রণাম তোমার ঘুড়ি উড়ানোর শিক্ষক মাস্টার বাবুকে দিতে হবে। যার দয়ায় আর পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ তুমি শিক্ষিত। যাও তাড়াতাড়ি গিয়ে তোমার ঘুড়ি উড়ানো শিক্ষার মাস্টার বাবুকে প্রণাম করে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে আসো। তারপর আমাদের প্রণাম করবে। চণ্ডী এখন শিক্ষিত ছেলে। তাই বাবার আদেশ অমান্য না করে চণ্ডী সোজা চলে গেল তাঁর ছোটবেলার ঘুড়ি উড়ানোর শিক্ষক মাস্টার বাবুর বাড়িতে। মাস্টার বাবুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে চলে এলো নিজের বাড়িতে। এরপর আরও লেখাপড়া শিখে চণ্ডী একদিন নিজেই এক কলেজের অধ্যাপক হয়ে গেলেন। ঘুড়ি উড়ানো শিক্ষকের মতন শিক্ষায় আর চণ্ডীর মতো চেষ্টায় মানুষ অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে।