বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

রাজকন্যার গল্প

Beautiful

রাজ পথটা সোজা এসে মিলেছে পান্থশালা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ায় হেম আর হিয়া। তখনো শহর জাগেনি। ভোরের সূর্যালোকের স্নিগ্ধ আভা দুজনের ধরে থাকা হাতে চুমু দিয়ে আমন্ত্রন জানায় সকালের শহরে। ওরা হাটতে হাটতে ঢুকে পড়ে প্রথম গলিতে। গলিটির তিনটি বাড়ির পরের বাড়িটি রাজার বাড়ি। রাজার বাড়ির সামনে সবুজ ঘেরা স্বচ্ছ জলের সরোবর। হেমের খুব রাগ হয়। এখানে স্বচ্ছ জলের বদলে সে দেখতে চায় লাল শাপলা আর শ্বেত পদ্মের বাসর। হিয়া শক্ত করে ধরে রাখে হেমের হাত। হেম তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আবার তাকায় জলের দিকে। একটা মাছরাঙ্গা ভুল করে পুটি ভেবে ঠোকর দিয়েছে মস্ত এক কাতলার চোখে। কাতলার লেজের জলে ভিজে মাছরাঙাটা দৌড়ে পালায় ছাতিম গাছের মগ ডালে। দৃশ্যটা দেখে হিয়া খুব হাসতে থাকে।

হিয়ার প্রাণ খোলা নিষ্পাপ হাসি দেখে হেম আনমনা হয়, ভাবে কেন সে নিজে এমন করে হাসতে পারে না। অথচ হেম চায় এমনি করে হাসতে। হেম খুব জোরে হিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয় বকুল গাছের ছায়ার নিচে। হিয়া অবাক হয় না তাতে। কারন হিয়া হেমের এই স্বভাবের সাথে অনেক আগে থেকেই খুব বেশি পরিচিত। রাজার বাড়ি আর লেকের মাঝে চওড়া যে পায়ে হাটা পথ তার পুরোটাই বকুল গাছের ছায়া দিয়ে মোড়ানো। মনে মনে হেম ভাবে তবে কি বকুল রাজার খুব পছন্দের ফুল।

হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে রাজা কি কখনো খালি পায়ে শিশির মাড়িয়ে বকুল কুড়িয়েছে তার প্রিয়ার জন্য? কে দেবে উত্তর ? রাজা তো আর নেই। হেম হিয়াকে এই রাজার গল্প, এই রাজ্যের গল্প বলতে বলতে হাটতে থাকে সামনে, বকুলের বুকে পা রেখে। হিয়া কে চেনায় ফুল, ফল, গাছ, পাখি। হঠাৎ একটা কাঠগোলাপের গাছ চোখে পড়ে। সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙ ছোয়া। হাল্কা একটা মিষ্টি গন্ধ। হিয়া কে নিয়ে সে এসে দাড়ায় কাঠগোলাপ গাছটির নিচে। গন্ধটা আরো তীব্র হয়। হেম ফিরে যায় পেছনে ৩০ বছর আগে। হিয়া কিছুই বোঝে না। সে ফুল পেয়ে খুশী। হিয়া বোঝে না জীবনের কিছুই, সে শুধু আদরের কাঙ্গাল। আবার তারা হাটতে শুরু করে। হেম মোবাইলে সময় দেখে নেয়। দেরী হয়ে গেছে আজ। কাঠের সেতু পেড়িয়ে হিয়াকে নিয়ে যখন সে এসে পৌঁছায় স্কুলের গেটে তখন এসেম্বলি শুরু হয়ে গেছে। হিয়া “বাই বাবা” বলে দৌঁড়ে স্কুলে ঢুকে যায়। হেম কান পেতে দেয়, সোনা-মানিকেরা গাইছে-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। হেম তার জীবনে অনেক বার অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে এই গান শুনেছে কিন্তু আজ অব্দি কোন শিল্পী স্কুলের এসেম্বলিতে গাওয়া এই গানের সুর, আবেগ আর প্রত্যয়কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

হেম টের পায় তার চোখের দুফোঁটা জল হাতে ধরা কাঠগোলাপের পাপড়িতে। হেম চোখ মোছে। সামনে তাকিয়ে দেখে নেয় কোন পথে ফিরবে। চোখে পড়ে স্কুলের সামনে অনেক বড় একটা কাঠগোলাপের গাছ আর ঠিক তার নিচে দাঁড়িয়ে একজন। তার হাতে ধরা সাদা ক্যানভাসে হলুদের জলরঙে আকা একটা কাঠ গোলাপ। যেমন করে ৩০ বছর আগে একটা কাঠগোলাপ হাতে স্কুল শেষে হেমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো রূপকথা। হেমের খুব জানতে ইচ্ছে করে মেয়েটির হাতের কাঠগোলাপের পাপড়িটিও তার চোখের জলে ভেজা কিনা।

রঙিন ভালোবাসা

আমার কপালের মাঝ বরাবর পিস্তলটা ঠেকিয়ে যখন আমার শেষ ইচ্ছাটি জানতে চাওয়া হল আমি তখন আমার মধ্যে নেই। পুরো শরীর জুড়ে বিজলীর মত ঝাকুনিতে ঘামের অনুভূতি আন্দাজ করা কঠিন হবে।

-না ! আমাকে বাঁচতে দিন, আমাকে মারবেন না।

লোকটির অদ্ভূত হাসি এবং পিস্তলের গুলির শব্দের মিশ্রণে আমি হারিয়ে যাই গভীর অতলে, শূন্য থেকে শূনে, যেখানে কোন ব্যথা নেই, নেই কোন অনূভূতি!
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করি আধা ঘুমে আধা জাগ্রত অবস্থায়। মাঝে মাঝে আমি এমন স্বপ্ন দেখি নাক মোটা কালো বর্ণের একজন ব্যক্তি আমাকে মারতে চায় কিন্তু তার চেহারা কখন দেখতে পারি না, পুরো মুখ জুড়ে বড় নাক!

বালিশের নিচে থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম রাত ৩:২৫ মিনিট কিন্তু ততক্ষণে ঘুমের ভাবটা কেটে গেছে। হঠাৎ গোসল করার তীব্র ইচ্ছে হল। যখন আমাকে কেউ বলে আপনার শখ কি? আমি নি:সন্দেহে বলি গোসল করা! বাথ ট্যাবের মধ্য বসে সিগারেটের টান দিয়ে পানিতে মুখ ডুবিয়ে ধোয়া ছাড়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে যদিও পানিতে ধোয়া ছাড়া যায় না তবে পানির বুদ বুদ শব্দ আমাকে আনন্দ দেয়। নাহ্ উঠে একটি সিগারেট গরম করতে হবে! সিগারেটকে হলকা আচেঁ গরম করে টানলে তামাক পাতার চির চির শব্দ সেটিও আমাকে আনন্দ দেয়। আমি সব সময় তাই করার চেষ্টা করি যা আমাকে আনন্দ দেয়। প্রতিটি মানুষের তাই করা উচিৎ যাতে সে আনন্দ পায় তবে লক্ষ্য রাখতে হবে এতে অন্যের ক্ষতি যেন না হয়।

এই মাঝ রাতে আমার সকল আনন্দের প্রস্তুতি ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিল একটি ফোন কল! ফোনটা বার বার বেজে যাচ্ছে কিন্তু সেটি ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। আমি চাই না এই মুহূর্তে মোটা কণ্ঠস্বরে কাউকে হ্যালো বলতে তবে আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি তাদের জন্য মাঝ রাতের ফোন কল গুলো অনেক বিপদের সংকেত বয়ে আনে।

-হ্যালো
-(অপর পাশে নিরবতা)
-যদি কথা না বলতে চান ফোনটা রাখতে পারেন !
-১৫ মিনিটের মধ্যে নর্থ-ওয়েস্টার্ন হসপিটালে আসতে পারবে ?
-মাই গস!!! লেলিনা!!!! এতদিন পরে? তুমি ঠিক আছতো?
-হুম…
-একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি …

ফোন রাখার পরে আমার অবস্থা চক্রবৃদ্ধি সুদ নির্ণয়ের সূত্রের ন্যায়। যেমন : C= P(1+r)n [এখানে, C= আমি P= লেলিনা, n= সময় এবং ফোন কল, r= হাসপাতাল]

ছোটবেলা থেকে গনিত নিয়ে আমার সমস্যার কোনই অন্ত ছিল না। আজও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটলো না, না জানি কি ঘটলো হাসপাতালে? ফলাফল জানার জন্য এখনি হাসপাতালে যেতে হবে।
(চলবে ….)

দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব পোস্ট করা হবে শনিবার সকালে

প্রিয়তমা-র তরে (১)

শুরুতে আমি তোমার দিকে হালকা চেয়ে দেখেছিলাম। আস্তে আস্তে কিভাবে যেন তোমাতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে লাগলাম। নিজেকে না পারি রাখতে, না পারি বুঝাতে। কি যে করি? মুশকিলে পড়ে গেলাম। তবে তোমাতে নিমজ্জিত হয়ে ভালোই লাগতে লাগলো। নিজেকে যেন অন্য কোথাও খুঁজে পেতে লাগলাম। ভালোই যাচ্ছিল তোমার আমার দিনগুলি। ঠাকুমার ঝুলি গল্পের মতো কখনো মজার কখনো বা ভয়। ভেবেছিলাম এভাবেই হয়তো যাবে আমাদের সময়গুলো।

কিন্তু আমিও কেমন পাগল দেখো, ঠাকুমার ঝুলিতে যে গা ছমছমে কি হয়, কি হয়, একটা বিষয়ও ছিল আমি তা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ জানাই তোমাকে, আমাকে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেবার জন্য।

প্রতিটা গল্পের মাঝেই একটু ভয় ভীতি থাকা ভালো। আর তা যদি নাই থাকে তাহলে গল্পের মজাটা কোথায় গেলো? আমিও তেমনি ভয় পেতে লাগলাম। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এই ভয়টা, আমাকে কোনো ভাবেই পিছু ছাড়ছিল না। আর এমন এক ভয় এটা, না যায় সহ্য করা, আর না যায় কাউকে বলা। তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল আমাকে,তোমাকে প্রতিটা মুহূর্তে হারিয়ে ফেলার ভয়।

শুনেছি রুপকথায় রাক্ষস নাকি রাজকুমার এর কাজকুমারীকে তুলে নিয়ে যেত, রাজকুমার কে তার মন মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলার জন্য। আমার কেনো যেন মনে হয় আমার সাথেও ঠিক এমনটাই হচ্ছে। তোমার থেকে আমাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু রাক্ষস পায়সাজী করে যাচ্ছে। তুমি ঠিক রাজকুমারীর মতো আমাকে ভুলে যেতে শুরু করেছ। তোমার কাছে অসহ্য লাগতে শুরু হয়েছি আমি, আমার প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ।

বরফাচ্ছন্ন

ক’দিন ধরে শীত খুব বেড়েছে। রাত বাড়ে, শীতের আক্রমণ তীব্র হয়। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছি। লাল রংয়ের লেপ, শাদা কভার। মিঠে ওম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, দেওয়াল ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। ভীষণ সুনসান। ক’টা কুকুর বিলাপ করছে,
ভীষণ মর্মান্তিক সে বিলাপ!
কুকুরের বিলাপ থামছেই না। বিলাপের সাথে যেনো মিশে রয়েছে ভয়। পায়ের কাছের জানালা খুললেই রাস্তাটা দেখা যায়, ভয়ের কারণ খোঁজা যায়, বিভ্রান্তি দূর করা যায়। কিন্তু ওমের মায়া কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
বিলাপ রূপ নিয়েছে গাঢ় কান্নায়। আর সহ্য হলো না, গা থেকে লেপ সরিয়ে উঠলাম। লাইট জ্বালাতে গিয়ে বুঝলাম ইলেক্ট্রিসিটি নেই। শব্দ না করেই জানলা খুললাম, এক ঝটকা বরফ হাওয়া হাঁড় কাপিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাইরে ঘন কুয়াশা আর জোছনায় মাখামাখি, তিনটা কুকুর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, একই দিকে তাকিয়ে বিলাপ করছে।

কুকুরের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ওই গলির দিকে তাকালাম। দো’তলার জানলা দিয়ে গলির অনেকখানিই দেখা যায়। কুয়াশা ও জোছনার আবছায়াতে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কুকুরের কান্না থেমে গেলো। আরও কিছুক্ষণ জানলা খুলে রাস্তায় থাকিয়ে রইলাম। সব স্বাভাবিক।
লেপের ওম ডাকছে, লেপ মুড়ি দিয়ে শুতেই আবার কুকুরের ভয় পাওয়া করুণ বিলাপ শুরু। শুনশান মাঝরাত এ বিলাপ কৌতূহল রহস্য আর ভয়ের দোলাচালে অসহনীয় অস্থির। বিছানা থেকে উঠে দু’ঢোক পানি খেলাম। এরপর খুব কায়দা করে নিঃশব্দে জানালাটা অল্প একটু ফাঁক করলাম, সাথে সাথেই কুকুরগুলো আমার দিকে মুখ ঘোরালো- অকস্মাৎ এ কাণ্ড দেখে মূহুর্তের জন্য জমে পাথর হয়ে গেলাম, সে ওই মুহুর্তের জন্যই। একটা কুকুর একটু সামনে এগিয়ে এলো, কুর্নিশের ভঙ্গিতে দুই পা সামনে মেলে দিয়ে ফের উঠে দাঁড়ালো, তার কণ্ঠে আতংক,
– একটু নেমে আসো, দয়া করে একটু নেমে আসো।
– কেনো?
– এলেই দেখবে, তোমাকে বিপদে পরেই ডাকছি, দয়া করো..
– আগে বলো, শুনে নেই।
কুকুরের কণ্ঠে আঁকুতি-
– জীবন মরণ সমস্যা, তুমি তো মানুষ, আমরা বিপদে মানুষের কাছেই এসেছি।
নিজের প্রতি রাগ হলো, কেনো যে জানালা খুলতে গেলাম। কুকুরগুলো জানেনা পৃথিবীতে কোন বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাও জটিলতম প্রক্রিয়া। আমাকে দেখে তারা বিভ্রান্ত, তাদের জানা নেই অবয়ব আর ঘ্রাণ এক হলেই সবাই মানুষ নয়। এর মাঝেই কুকুরটা ডেকে উঠলো,
– মানুষ, একটু নেমে আসো এখানে, করুণা করো।
ঘ্রাণ আর অবয়বের দায় মেটাতে এখন নামতে হবে। মানুষদের বিরক্ত হতে নেই, নকল হয়েও আসল মানুষের অভিনয় করছি, তাই বিরক্তি গোপন করে মোলায়েম স্বরে বললাম,
– অপেক্ষা করো, আসছি।
আভিজাত্যের চোরাটানে যদিও বলি দো’তলায় থাকি, আসলে এটা দেড়তলা। একটা মাত্র বড় ঘর, ঘর খুললেই বিশাল ছাদ। ছাদ পেরুলেই সিঁড়ি। ঘরের দরজা খুলতেই বিরক্তি দূর হয়ে গেলো- তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘণ কুয়াশাতেও ঝকঝকে জোছনা, রোদের মত তীব্র নয়, প্রখর মসৃণ। সিড়ি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে এলাম- শব্দহীন। কাঠের দরজা খুলে রাস্তায় বেরুতে যাবো, নিচের ঘর থেকে ভেসে এলো আব্বার কণ্ঠ,
– দরজা খুলেছে কে?
– আব্বা, আমি।
– ও। এতো রাতে দরজা খুললে যে! এই রাতেও কি মিছিল হয়!
– না, কুকুরগুলো কান্না করছে, একটু তাড়িয়ে দিয়ে আসি।
আব্বার কণ্ঠে প্রশ্রয়-
– যাও, কুকুর তাড়িয়ে এখনই চলে আসবে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী মিছিলে যাও বলে ভেবো না বড় হয়ে গেছো। মনে রেখ – তুমি এখনো স্কুলের গণ্ডি পার হওনি।
আব্বাকে কিভাবে বলি, মিছিলের সব হাত সমান, সব কণ্ঠ সমান। বলতে হলো না, আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, আমি সদর দরজা দিয়ে পথে বের হতেই দরজায় খিল দিলেন। জানি, না ফেরা পর্যন্ত ঘুমাবেন না, এই ঠাণ্ডায় ছাদে পাইচারি করবেন, আকাশ দেখবেন। একটু পর আব্বাকে ডাকতে মা ছাদে উঠবেন, কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এরপর না ডেকে নিচে নেমে আসবেন। রান্নাঘরে চা বানাবেন, আব্বার সাথে আমিও ভাগ পাবো, ফ্লাস্কে চা থাকবে।

▪️
কুকুর ৩টা আগের জায়গাতেই বসে আছে, গলির দিকে তাদের চোখ, যেনো কিছু দেখছে কিন্তু সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ধীর পায়ে সামনে যেতে কুকুরদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা গেলো। একটা কুকুর, গায়ের রঙ সাদা-কালোয় মেশানো, হঠাৎ করেই জিভ দিয়ে হাতে চেটে দিলো। বিরক্তিকর, এতো পশুপ্রেমিক এখনও হয়ে উঠিনি, কিন্তু মানুষের মুখোশ মুখে পড়ে আছি বলে কিছু বললাম না। এবার লাল কুকুরটার গলায় আকুতি,
– গলির ভিতরে একটু যাও, নিম গাছের নিচে, করুণা করো, দয়া করো।
প্রাচীন নিম গাছটা নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে- অস্বাভাবিক ভয়ের, ভৌতিক। স্বাধারণত, রাতের বেলা কেউ এই গলি দিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। একে নিমগাছের গল্প, সাথে নৈশব্দ নির্জনতা। ঘরের জানলা দিয়ে ওই গলি দেখা যায়, প্রতি রাতেই ওই গলির দিকে চোখ যায়। ল্যাম্প পোস্টে একটা টিউবলাইট টিমটিমিয়ে জ্বলে, চারপাশে অন্ধকার আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ওই আবছায়া অন্ধকারে এক মাঝরাতে ধ্বস্তাধস্তি হতে দেখেছি। পুরুষ কণ্ঠের চিৎকারে পুরো পাড়ার ঘুম ভেঙে গেল। কৌতূহলের দায়ে ঘুমের রেশ কাটিয়ে ক’জন হালকা চালে গলিতে পৌছানোর আগেই লোকটি চির বিদায় নিয়েছে। হামলাকারীদের পালাতে সমস্যা হয়নি, যেতে যেতে তিন চারটা ককটেল ফুটিয়েছে, কেউ পিছু নেয়নি। এছাড়া ওই গলি অস্বাভাবিক বা অস্বস্তিকর বা ভৌতিক কিছু দেখিনি বলে ভয় কেটে গেছে। কুকুরের আবেদনে সাড়া দিয়ে গলির দিকে পা বাড়ালাম।

▪️
গলির ভেতর ঢুকতেই গায়ে কাঁটা দিল, শাদা উলের সোয়েটারের বুকে লাল-কালো মিকিমাউজও যেনো কুকড়ে যাচ্ছে, এখানে শীত আরও তীব্র। মিকিমাউজটা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘সামনে যেওনা, ঘরে চলো, শীত করছে।’ এমন ন্যাকামিকে সবসময় পাত্তা দিতে হয় না, নিম গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছ পর্যন্ত যেতে হলো না, বিভৎসতা পথ আগলে দাঁড়ালো। দুটো কুকুর ছানা, তুলতুলে, নির্জীব পরে আছে, মাথাগুলো কেউ কেটে নিয়ে গেছে। রক্ত ছড়িয়ে আছে, জমাট বাধছে। কুকুরগুলো পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কুইকুই করছে।
লাল কুকুরটা এগিয়ে এলো, মৃত কুকুরগুলোর শরীর শুকলো কয়েকবার। এরপর সামনে এগিয়ে আরেকটা সরু গলিতে ঢুকে ডাক দিলো- ‘আসো’। এগিয়ে যেতে দেখলাম আরও তিনটা কুকুরছানা, শীতে আর ভয়ে কাঁপছে। ছানাগুলোকে ঘাড়ে ধরে তুললাম, কুকুরগুলো কিছুই বললো না। যেনো এমনই কথা ছিলো। গলি থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছনে গেলাম, ওখানে ভাঙাচোরা আসবাবের নিচে ছানাগুলোকে নামিয়ে রাখলাম, বাতিল ন্যাকরা আর তয়লা দিয়ে ওমের ব্যবস্থা করা হলো। লাল কুকুরটা এদের মা, বাইরে বসে রইলো পাহারাদারের যেন। অন্য কুকুর দুটো এ পর্যন্ত আসেনি।

▪️
টোকা দেবার আগেই বাবা দরজা খুলে দিলেন। মা ঘরে ঢুকতে দিলেন না, চুলোয় গরম পানি বসিয়েছেন, গোছল করে তবেই ঘরে ঢুকতে হবে। সোয়েটারের মিকিমাউজ আৎকে উঠলো,
– এত শীতে গোছল করবে! ঠাণ্ডায় জমেই যাবো।
বিরক্তি নিয়ে বললাম,
– মনে হচ্ছে তুমিই এখন গোছল করতে যাবে। এমন ন্যাকামি করলে কিন্তু ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে আসবো, হু।
– সর‍্যি। আমি কি আর আমার জন্য বলি, তোমার জন্যই তো বলি।
– এত চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা, এত চিন্তা করা ভালো না।
মিকিমাউজের কণ্ঠে খুব কষ্ট,
– সাধে কি আর চিন্তা করি! বছরের সাত মাস তো বন্দী করেই রাখো, ওই সাত মাস কত চিন্তা মাথায় আসে।
– বলো কি! তারপর!
– কিন্তু মুক্তির দিন গুনতে গুনতে আয়েশ করে চিন্তাটাও করতে পারিনা, এখন শান্তিমত একটু চিন্তা করা প্র‍্যাক্টিস করছি, তুমি শুধু ‘ন্যাকামি’ বলে ধমকাচ্ছো।
কথা বাড়ালাম না।
গোছল শেষে বের হতেই মা ভিজে মাথা মুছে দিলেন, দোয়া পড়ে বুকে ফু দিলেন। বাতাসে আলু আর সিম দিয়ে ইলিশের তরকারির হালকা পোড়া ঘ্রাণ। মা একটু ভাত খেয়ে নিতে বললেন। সাদা ভাত, টমেটোর ডাল থেকে ধোয়া উঠছে, ঘণ তরকারির ঘ্রাণে বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, তরকারি মাখিয়ে খাচ্ছি, বাবা পাশে বসে চা খাচ্ছেন। বাড়ির বাকীরা গাঢ় ঘুমে অচেতন, আমরা তিন নিশাচর জেগে থাকি, আমাদের ঘুম আসেনা অথবা আমরা ঘুমের কাছে যেতে পারিনা, যাওয়ার জন্য কাতরও হই না।
খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ফিরলাম, হাতে ফ্লাস্ক ভর্তি চা। রাত ফুরোতে আর দেড়’ঘণ্টা লাগবে, এই সময়টা জেগে জেগেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। একটা গাড়ি খুব ধীরে ধীরে চলে গেলো, সম্ভবত টহল পুলিশের গাড়ি। গাড়ির শব্দের রেশ না কাটতেই কুকুরের চিৎকার কানে এলো। জানালা খুললাম- আগের দুটো কুকুরই গলির দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রোশে ঘেউ ঘেউ করছে। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে ফুটবল খেলার রেফারির হুইসেল বাঁশি, ওটা বের করে খুব জোড়ে বাজালাম। রাতের নির্জনতা ভেদ করে হুইসেল কতদূর গেছে জানিনা, তবে পুলিশ আর নাইট গার্ডরা হুইসেলের জবাবে হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে।
জানালাটা আর বন্ধ করলাম না, ঘরে কিছু বরফহিম হাওয়া ঢুকুক। ছাদে এলাম, জোছনা ম্লান হয়ে এসেছে। তেলের পুরানো ড্রামে লাগানো গাছ থেকে শিউলি ঝরছে। শেষ রাতের আশকারায় শীত বাড়ছে।। জ্যাকেট খুলে ছাদের মাঝখানে দাঁড়ালাম, ঠকঠক করে কাঁপুনি শুরু হলো, এতেই না কুয়াশা স্নানের আনন্দ। শীত বাড়ছে… বাড়ছে… বাড়ছে…। একটা শিউলি ফুল ব্যাথাতুর স্বরে জানতে চাইলো,
– ঝরবে না কি আমাদের মত।
– জানিনা, ফুল।
– ক্লাশ টেইনকে জানো!
– কোন ক্লাশ টেইন?
– যে একদিন তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, বলতে না পেরে চলে গিয়েছিলো।
– না, জানিনা। সে কি বলতে চেয়েছিলো!
– বাহ! বুঝোনি তুমি?
– না বললে বুঝবো কেমন করে!
শিউলি ফুলের বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,
– এ এমন কথা যা না বলেও বলা যায়, যে বুঝে সে বুঝে, যে বুঝতে পারেনা, এ কথা তার জন্য নয়।
– ওহ! কি জানি কিসের কথা বলছো!
শীতে জমে যাচ্ছি, জমতে জমতে বরফ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে- ধবধবে শাদা গাঢ় জমাট বাধা বরফ, যে বরফের গলে যাওয়া নেই, যে বরফ গলেনা কখনো ক্লাশ টেইনের মায়াবী উষ্ণতায়।

▪️
#মনসুখিয়া

ভগ্নাংশ

গতকাল মধ্যরাতে মান্না দে’র গানের মত জোছনা ছিলো, প্রেম আর বিরহে বেসামাল ও উদভ্রান্ত। মফস্বল নীরব, ঝিঁঝিঁর ডাক, গাছের পাতায় হাওয়ার খসখস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। না, না শব্দ ছিলো। সংঘবদ্ধ নীরবতাকে অধিকতর নীরবতা দানের জন্যই ডেকে উঠছিলো রাত জাগা কোনো পাখি। ছাদে যাবো, ঘরের দরজা খুলতেই পোষা পায়রাগুলোর বাকবাকুম শুরু, খাঁচার সামনে দাঁড়াতে তাদের সুর ধীর হয়ে আসে। একটা গিরিবাজ জানতে চায়,
– ভালো আছো তো?
– হ্যা। তোমরা?
– ভালো আছি, খাঁচার জীবন খুব একটা খারাপ নয়, সকাল বিকাল পাখা মেলে উড়বার সুযোগ পাই, খাদ্য খানা নিয়ে ঝামেলা নেই। সমস্যা শুধু তোমার।
বিস্মিত হয়ে জানতে চাই,
– সমস্যা শুধু আমারই হবে কেনো?
– তোমারই হবে। এই যে আমাদের খেয়াল রাখা, ছাদে পাখিদের জন্য দুই বেলা শস্য দানা দেওয়া, খরগোশের জন্য ঘাসের যোগার করা, পথের বিড়াল আর কুকুরের জন্য খাবার দেওয়া- এসব তো বহু ঝামেলার কাজ, সবাই তাই বলে।
-ওহ! আমি ভাবলাম কি না কি ঝামেলা!
গররা পায়রাটার কণ্ঠে বেশ ঝাঁঝ,
– কোথাকার কোন লোক, তাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছো, এদিকে নিজের পায়ের ব্যাথাটাকে পুষছো, রাতদিন খুড়িয়ে হাঁটছো, এটা ঝামেলা নয়!
এই পৃথিবীতে উত্তরের তুলনায় প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সংখ্যা বেশী। তাই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়না, সকল বিস্ময়ের অবসান ঘটাতে নেই। পায়রাদের বাকবাকুমে খরগোশ দম্পতির ঘুম ভেঙেছে, ছাদের দিকে পা বাড়াতেই খরগোশদের একজন কান নেড়ে জানালো, তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে।

২.
ছাদ জুড়ে জোছনা আর আবছায়ার যুগলবন্দী শয়ান। ছাদের প্রতিবেশী কদম আর পেয়ারা গাছের পাতায় পাতায় জোছনার নরম ঝলকানি। যেখানে জোছনা পৌছতে পারেনি সেখানে আধো আধো অন্ধকার। শ্রাবণ মাস শেষ হয়েছে বেশ ক’দিন আগে, গাছে এখনও বেশুমার কদম ফুল। ছাদে দাঁড়িয়ে একটা ফুলে হাত বুলাতেই ফিসফিসিয়ে ওঠে কদম,
– এতো রাতে ধ্যান ভাঙালে কেনো?
চমকে উঠি, নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চাই,
– ধ্যানে ছিলে বুঝি!! কিসের ধ্যান?
– সে তুমি বুঝবে না, স্থবিরতার ধ্যান।
– ও.. হো। তবে থাক..
– থাকবে কেনো! ধ্যান যখন ভাঙালেই এসো একটু গল্প করি..
হাওয়া বয়ে যায়, হিম হিম। দুপুরে প্রচণ্ড গরম ছিলো, ভাদ্র মাসের তালপাকা তাপ। হাওয়ার শিরশিরানি গায়ে মেখে প্রশ্ন করি-
– কদম, তোমার সহস্র সহস্র বছর আগের স্মৃতি মনে আছে?
– আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই, বছরের হিসেব যে জানিনা..
– স্মৃতিও কি জমা রাখো না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদম,
– চাইলেই কি স্মৃতি ভুলা যায়! আমাদের স্মৃতি জমা করে রাখি বীজে, আমাদের জন্ম হয় বিগত সকল জন্মের প্রতিটি মুহুর্তের স্মৃতি নিয়ে।
– তাই!
– তাই না তো কি! সেই কবেকার কথা, আমার ছায়াতেই দুরন্ত এক প্রেমিক বাঁশী বাজাতো। বাঁশীর সুরে সুরে আকুল আহ্বান, বিধিনিষেধের দেওয়াল টপকে আসতো তার প্রেমিকা বৃষভানু নন্দিনী। তারপর একদিন..
– তারপর একদিন কি?
– এক গাঢ় জোছনা রাত, ঘোষ বাড়ির কর্তা এলো কুঞ্জবনে, গোপনে। নিজ চোখেই দেখলো সব। তার প্রিয়তমা স্ত্রী বৃষভানু নন্দিনী পরম প্রেমে ধারণ করে আছে সচ্চিদানন্দকে। দু’জনের মুগ্ধ প্রেম আর কানাকানি কথায় ক্রোধে ফেটে পরেনি আয়ান ঘোষ। সে বুঝেছিল প্রেমে যে ডুবে গেছে তার ডুবে যাওয়াতেই আনন্দ, ডুবে থাকাতেই বেঁচে থাকা।
বিস্মিত হই, বাড়ির পাশের এক কদম গাছ নিজের ভেতর এতো স্মৃতি জমা করে রেখেছে। তার কাছে জানতে চাই,
– সচ্চিদানন্দ আর বৃষভানু নন্দিনী কে?
– তুমি চিনো না বলছো!
– সত্যিই চিনি না, এটা জানি যে সচ্চিদানন্দ সেই কৃষ্ণ, যে বৃষভানু নন্দিনী সেই রাধা।
– শুধু এটুকুই জানো?
– আর যা জানি তা বিস্ময়, পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে কৃষ্ণের বাম পাশ থেকেই রাধার জন্ম।
– হ্যা। তো?
– মথুরা থেকে লক্ষ যোজন দূরে তারও আগে জন্ম নিয়েছিলো সেমেটিক ধর্ম, ওই ধর্মে বাবা আদমের বুকের বাম পাশের পাঁজরের হাড় থেকেই বিবি হাওয়ার জন্ম। কি অদ্ভুত মিল, তাই না। আরও আছে…
কথা শেষ করতে না দিয়েই কদম ফিসফিসিয়ে ওঠে,
– চুপ! একদম চুপ। ওসব নিয়ে কথা বলবে না। কৃষ্ণের গায়ের রঙ কেনো কালো, ক্ষৌরকর্ম ধর্মবিরুদ্ধ, কিন্তু কেনো তিনি ক্ষৌরকর্ম করতেন, কৃষ্ণ আর্যদের দেবতা ছিলেন না এই মাটির ব্রাত্যজনদের দেবতা – এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তো মরেছ। দুই পক্ষই তোমাকে মারবে, কেউ ছাড় দিবে না।
কদমের সতর্ক বাণীতে মনে মনে হেসে উঠি, কিছুটা বিমর্ষও হই। যে জীবন হওয়ার কথা ছিলো ক্ষুধার মত সরল, খাদ্যের মত আনন্দময়, বিশ্রাম ও প্রেমের মত মুখর, তার পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। একটা মাত্র জীবন, প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে এই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই জেনেও প্রশ্নের চক্রে ঘুরছি সবাই।

৩.
কদম আর কোনো কথা বললো না। নীরবতায় কেটে গেলো কয়েক মিনিট, সম্ভবত সে ফের ধ্যানে মগ্ন হয়েছে। ছাদের কার্নিশে প্রাচীন তপস্বীর মত বসে আছে এক বিড়াল, কোমল দৃষ্টি। চোখে চোখ রাখতেই বলে,
– মানুষ মাত্রই ভগ্নাংশ, ভাগশেষে শূন্য।
– মানে?
– মানুষ একটা ভাগশীল প্রাণী, নিজেকে ভাগ করে দেয়। একটা মানুষের ষোল আনা ভাগ হয়ে যায় বহু বহু ভগ্নাংশে।
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করি-
– যেমন?
– খুব সহজ, ধরো একজন মানুষ সমস্তটা মিলে ষোলো আনা। এর এক আনা দিলো পাখিদের, এক আনা খরগোশদের, এক আনা করে কুকুর আর বিড়ালকে। এরপর চার আনা দিলো পাকস্থলির অন্ন যোগানোর দায়ে, এক আনা দিলো বন্ধুদের, এক আনা দিলে সোসাইটিকে, এক আনা দিলে আত্নীয়দের। যে কয় আনা বাকী রইলো তা সমান ভাগে ভাগ করে দিলো সংসার আর প্রিয়তম মানুষদের মাঝে।
– তো?
– সব ভাগ করে দেবার পর সে বুঝতে পারলো আরও ক’টা আনা থাকলে ভালো হতো। নিজেকে ভাগ করে দেওয়া অংশগুলোয় টান পড়ছে, এর থেকে কমিয়ে দিতে হচ্ছে ওকে, ওর ভাগেরটা দিতে হচ্ছে একে।
দম নেয় বিড়াল, সামনের পা দিয়ে মুখ ঘষে, তারপর গাঢ় বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– এসব ভাগাভাগি করতে করতে ধরো কোনো এক দিন, অথবা এমন চাঁদগ্রস্ত কোনো রাতে অকস্মাৎ বুঝতে পারে, নিজেকে ভাগ করে দিতে দিতে নিজের জন্য কিছুই রাখেনি সে।।ভাগশেষে নিজের জন্য অবশিষ্ট আছে শুধু শূন্য।
বিড়ালের অঙ্ক নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনা। আকাশের দিকে তাকাই, জানি আকাশ বলে কিছু নেই, শুধু অথৈ শূন্যতা।

৪.
কদম কি ধ্যানে মগ্ন হবার আগে মাথার ভেতর বপন করে গেছে বীজ! অঙ্কুরোদগম ঘটছে, খলবলাচ্ছে স্মৃতি। শত সহস্র বছর আগের কথা। সেদিন সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি। সূর্য ডোবার আগে বৃষ্টি থামলো। আধো আলো আধো ছায়াতে দাঁড়িয়ে থাকা এক হরিণকে বর্শায় গেথে নিলাম। ক্ষুধার অন্নে প্রস্ফুটিত হবে হরিণের সকল সৌন্দর্য্য।
আগুন জ্বালছে, হরিণের মাংস ঝলসানো হচ্ছে। গোল হয়ে বসে আছি আমরা ক’জন। আমার কাঁধে ভর দিয়ে আছে যে নারী, তার ঘামের ঘ্রাণ ঝলসানো মাংসের চাইতেও তীব্র সুন্দর। তাকে রেখে উঠে দাঁড়াই, পাশের ঝোপ থেকে ক’টা জোনাকি পোকা এনে গুঁজে দেই কানের ভাঁজে। সে হেসে ওঠে, তার হাসি মেঘের দিনের ঝর্ণা, উচ্ছল দুর্বার। তার হাসির সরল তীক্ষ্মতা বারবার বিদ্ধ করে যায়।
মাঝরাত। সবাই ঘুম। সে আর আমি জেগে আছি। শুয়ে আছি ঘাসে, সে আমার বামপাশে। খুব কাছ থেকে ভেসে আসছে বাঘের ডাক, ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথার ওপর বিশাল চাঁদ। দু’জনেই তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। পরস্পরের মাঝে কোনো কথা নেই, ওই আদিম আমাদের কোনো ভাষা জানা নেই, কবিতা জানা নেই, গান জানা নেই। বেঁচে থাকার জন্য ভাষা তখনও অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি, পৃথিবীর সকল প্রেম নীরবতায় বোঝাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
রাত বাড়ে, চাঁদ নেমে আসে মাথার ওপর। তার চুলে তখনও জ্বলছে কয়েকটা জোনাক পোকা। জোনাক পোকাদেরও কোনো ভাষা নেই, আলোর কারুকাজ ছাড়া। সে আলতো করে আমার বুকে হাত ধরে, তার জট বাঁধা আঠালো চুলে বিলি কেটে দেই। সে জানে বা জানেনা, সেই পাবে আমার সর্বস্ব, আমার বর্শা ও শিকারের সব ভাগ। দাঁতাল বাঘের আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্য আমার বুনো কালো শরীরই তার নিরাপত্তার দেয়াল।
সে ঘুমোয়, আমি জেগে থাকি, পাহারা দেই, যতক্ষণ না আসে নতুন সকাল।

৫.
ধ্যান ভেঙে ফের কথা বলে কদম,
– ঘরে যাও, একটু ঘুমোও। ভোর হতে দেরী নেই।
– এখন আর ঘুমাবো না। একটু পরেই ফজরের আযান দিবে, ভীষণ ভালো লাগে, খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…
কদম খুব মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে,
– মনসুখিয়ায় যাচ্ছো কবে?
– জানিনা, ডাকলেই যাবো।
– আমায় নিবে?
– শত সহস্র বিগত জীবনের স্মৃতি নিয়ে যে মনসুখিয়ায় যেতে নেই। মনসুখিয়ায় যেতে হয় নিজেকে নিয়ে, নিজের ষোলো আনা নিয়ে…
হাওয়া বয়ে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায় তীব্র স্বরে হেসে ওঠে কদম,
– তোমার ষোলো আনাই তো হারিয়ে ফেলেছো, নিজের কাছে এক কানা আনাও নেই, মনসুখিয়া তোমায় নেবে!
কদমের বিস্ময় ভাঙাতে ইচ্ছে করে না। মনসুখিয়া হতে ভেসে আসছে অভ্রবকুলের ঘ্রাণ, সে ডাকছে আমায়, ডাকে সাড়া দিতে আমারই শুধু দেরী হয়ে যায়, দেরী হয়ে যায়।

#মনসুখিয়া/দ্বিতীয়_খণ্ড।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (চতুর্থ পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (চতুর্থ পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

5

মহাসড়ক, রেললাইন ধরে অন্তহীন গন্তব্যের পথে হেঁটে চলেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর ব্যস্ততম শহরও যানহীন, জনশূন্য। মল থেকে মিল, সমতল থেকে হিল, কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, মুম্বই থেকে দুবাই— সর্বত্র এক ছবি। লকডাউন, আনলক পেরিয়ে, মাস্ক পরে, হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে প্রায় একটা বছর করোনার সঙ্গে সহ-বাস করার পর ২০২০ সালটাকে মনে হচ্ছে যেন ব্যর্থ প্রথম প্রেমের মতো। ভুলতে চাই। কিন্তু পারছি কই।

সংক্রমণ শুরু হয়েছিল ২০২০-র গোড়া থেকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে অর্থনীতির উপর করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাব শুরু হল ২২ মার্চ থেকে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে ভারতবর্ষের মাটিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক উড়ান। ৩ দিন পর থেকে শুরু হয়েছিল ‘সম্পূর্ণ লকডাউন’। কোনও বিশেষণ, কোনও মাপকাঠি বা বর্ণনাতেই সেই লকডাউনের প্রকৃত রূপ বোঝানো সম্ভব নয়।

এত টুকরো টুকরো উপাখ্যান, যে সেগুলো যোগ করলে কয়েকটা রামায়ণ-মহাভারত হয়ে যাবে। সুনসান পথঘাট, ঘরবন্দি মানুষ, হাসপাতালে হাসপাতালে লাশের স্তূপ, মৃত্যুর পরেও দেখা করা যাবে না প্রিয়জনের সঙ্গে— এ সব তো ছিলই। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে চিত্রটা রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেটা পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মানুষ হেঁটে, সাইকেলে বাড়ি ফিরছেন। রাস্তায় খাওয়া, পথেই ঘুম, প্রাতঃকৃত্য। পর দিন আবার হাঁটা। কত জন যে বাড়ির পথে মারা গিয়েছিলেন, ভারত সরকারের কাছে নাকি তার হিসেবও নেই!

এই চিত্রই বুঝিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির অসংগঠিত চেহারা। অসংগঠিত ক্ষেত্রই যে ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড, সেই কঙ্কালসার সত্যিটা সে দিন ছাইচাপা আগুন থেকে হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। হিসেব বলছে, প্রায় ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন লকডাউনে। লকডাউন জারি রেখেও ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছিল জুনের শেষে। তার আগে টানা ৬৮ দিন চলেছিল লকডাউন।

পরিংসখ্যান বলছে, ৮ ডিসেম্বর কৃষকদের ডাকা ভারত বন্‌ধে ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। তার আগে ২৬ নভেম্বর শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা দেশজোড়া ধর্মঘটে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কোনও ক্ষেত্রেই ‘সর্বাত্মক বন্‌ধ’ হয়নি। অনেক রাজ্যে, অনেক শহরে তেমন প্রভাবও পড়েনি। তাতেই এত বিপুল ক্ষতি! ৬৮ দিনের লকডাউনে অর্থনীতির ক্ষত কতটা গভীর হতে পারে, এর থেকেই অনুমেয়।

পরিসংখ্যান কী বলছে?
একটি সমীক্ষা বলছে, লকডাউনেকাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৮৩.১ শতাংশ মানুষ কাজ ফিরে পাননি। খাদ্যসঙ্কটে পড়েছেন ৮০.৮ শতাংশ মানুষ। ঘরে ফিরতে পারেননি ৪৭.৮ শতাংশ, অসুস্থ হয়েছেন ১৫.১ শতাংশ। সমস্যা এড়াতে পেরেছেন মাত্র ২.৪ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক।

পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা দেশবাসী স্বচক্ষে দেখেছিলেন। কিন্তু কার্যত আমজনতার অলক্ষ্যে লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছিল পর্যটন এবং অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্র। ঘটনাচক্রে, পর্যটন ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হোটেল, রেস্তরাঁ শিল্প। জুন মাস পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যানবলেছিল, অংসগঠিত শ্রমিক এবং স্ব-রোজগার বাদ দিয়ে এই শিল্পে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে বহু সংস্থা।

দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান পরিবহণ ‘অ্যাভিয়াঙ্কা হোল্ডিংস’, ব্রিটেনের ‘ফ্লাইবি’, আলাস্কার সবচেয়ে বড় সংস্থা ‘রাভনেয়ার’, সেন্ট লুইসের ‘ট্রান্স স্টেট এয়ারলাইন্স’, সুইডেনের ‘ব্রা’ ছাড়াও ‘ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া’, ‘মিয়ামি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতো বহু বিমান পরিবহণ সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে করোনাকালে। ভারতীয় সংস্থা ‘ডেকান চার্টার্স’ কোভিডের সময় অপারেশন বন্ধ করে এখনও পর্যন্ত তা শুরু করতে করেনি।

জনশ্রুতি, দেউলিয়া হওয়ার পথে এই সংস্থাও। এ ছাড়া উৎপাদন থেকে পরিষেবা, খুচরো বিপণী শৃঙ্খল থেকে ছোট দোকানদার, ট্রেনের হকার থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ী— কোনও ক্ষেত্রই করোনার ছোবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ব্যক্তিগত ভাবে এক জন ভারতবাসী বা বিশ্ববাসীকেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কোভিডের কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়েননি।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (তৃতীয় পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (তৃতীয় পর্ব )

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চেনাজানার বৃত্তে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে অতিমারি। যে পরিবর্তন দেখিয়েছে, পুলিশ অপারগের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে পারে। গান গেয়ে করোনা সচেতনতা বাড়াতে পারে। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দোকান থেকে কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে পারে। খারাপ সময় চিনিয়ে দিয়েছে মানবিক পুলিশকে। নতুন বছরেও নিশ্চয়ই আইনরক্ষার পাশাপাশি পুলিশ নাগরিকের পাশে দাঁড়াবে সঙ্কটের সময়।

3

করোনা-সময়ে অদ্ভুত শারদীয়া কাটিয়েছে বাঙালি। মণ্ডপে ভিড় নেই। শুধু প্রতিমা। রাস্তায় দর্শনার্থী নেই। শুধু পুলিশ। করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বলে দিওয়ালিতে আতশবাজিও তেমন ভাবে পোড়ানো হয়নি। নিন্দুকেরা বলবে আদালতের নির্দেশ ছিল। কিন্তু বাঙালির সদিচ্ছা ছিল না, বলা যাবে না। বাঙালির ইদও ম্যাড়মেড়ে করে দিয়েছে অতিমারি। বাঙালি রমজানের মাসে সন্ধেবেলা তারাবির নমাজ মসজিদে গিয়ে না পড়ে বাড়িতে বসে পড়েছে! জুম্মাবারেও বন্ধ থেকেছে মসজিদ! নতুন বছরে এমন আশ্চর্য উৎসব-কাল কাটাতে চাইবে না বাঙালি। ভুলে যেতে চাইবে উদ্‌যাপনের একাকিত্ব।
খেলার মাঠে পৃথিবী জুড়ে একের পর এক টুর্নামেন্ট, লিগ বন্ধ হয়েছে। পিছিয়ে গিয়েছে অলিম্পিক। বছরের শেষদিকে যখন চালু হল খেলাধুলো, তখন মাঠ দর্শকহীন। টিভিতে কৃত্রিম চিৎকার। কিন্তু ঘোলে আর কতটা দুধের স্বাদ পাওয়া যায়! শুরুর একটা শুরু হয়েছে বটে। কিন্তু নতুন বছরে খেলার আসর পুরোদমে বসবে তো? গ্যালারি ভর্তি দর্শক থাকবে তো?

দর্শক নেই বলে অনেকগুলো সিঙ্গল স্ক্রিন আনলক পর্বেও বন্ধ করে দিতে হল। ‘জনতা কার্ফু’র পর পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স, থিয়েটার, অডিটোরিয়াম, রেস্তরাঁ, পার্ক— বিনোদনের সব দরজা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রমরমা বেড়েছে লকডাউন পর্বে। একের পর এক সিনেমা রিলিজ করেছে সেখানেই। গৃহবন্দি দর্শকদের কাছে খুলে গিয়েছে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের ব্যক্তিগত পরিসর।

কাজের পরিসরেও বড়সড় বদল এনে দিয়েছে কোভিড-১৯। এক দল লোকের কাজ একেবারে চলে গিয়েছে। এক দলের কাজকর্মের গোটাটাই চলছে বাড়ি থেকে। তৃতীয় একটা দল মধ্যপন্থায়। অফিস দরকার মনে করে ডেকে পাঠায়। আর এক দলের কাজের ধরনটাই পাল্টে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের এক বইবিক্রেতা এখন প্লাস্টিক কারখানায় রাত জেগে খেলনা বানান। দিনের বেলা সেই তিনিই দোকানে দোকানে পাঁউরুটি-লাড্ডু-বিস্কুট ফেরি করেন। রোজগার হয়েছে ৩ ভাগের এক ভাগ। বেসরকারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ভিন্‌রাজ্যে কাজে যাওয়া ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের কাজ হারিয়ে বেঁচে থাকা আর ঘরে ফেরার গল্প আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।

একটা দীর্ঘ সময় মানুষ বাড়িতে বন্দি ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তার বাইরে বেরনো বারণ। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন সেটুকুই কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসা। সেই কেনাকাটার ফাঁকেই বাঙালি বেদম ভিড় বাড়িয়েছে বাজারে। সামাজিক দূরত্বের দফারফা করে ছেড়েছে। কিন্তু বাকি সবই ঘরে বসে।

নির্ধারিত সময়ের বাইরে বেরোলেই পুলিশের ধমক, মার, অন্যের ভ্রূকুটি। তাতেই বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে। গোটা দুনিয়ায় চলতে থাকা নিয়ম-কানুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে। বিষময় একটা বছর শুধু অদ্ভুত এক আঁধার পথে হাঁটিয়েছে, তা নয়। আলোকবর্তিকাও দেখিয়েছে। গোটা বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা সেখানেই। পরিবারকে সময় দেওয়া। অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পুরনোকে ভুলে সেই বাড়ানো হাত ধরেই যাওয়া যাক নূতন বছরে।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (দ্বিতীয় পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (দ্বিতীয় পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

2

এমন একটা অভিশপ্ত বছরকে ক্যালেণ্ডার থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, শিহরণ, মনখারাপ, বিচ্ছেদ, শোক, ঘাবড়ে যাওয়ায় ভরপুর এ রকম বছর আগে কখনও আসেনি। তবে খারাপ সময়ও তো শিক্ষা দিয়ে যায়। সেটুকুই দিয়ে গেল ‘অভিশপ্ত বছর ২০২০ সাল’। ছোট ছোট ভাণ্ডে রাখা একটা মস্ত বড় শিক্ষার ভাণ্ডার। তার কতকটা ভুলে যাওয়ার। আর বাকিটা নিয়ে সরাসরি ২০২১-এ ঢুকে পড়া।

তার আগে ঢুকে পড়া যাক অভিধানে। শব্দগুলো নিয়ে। প্যান্ডেমিক, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, কোয়রান্টিন, আইসোলেশন, আনলক, কোমর্বিডিটি, কন্টেনমেন্ট জোন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ভার্চুয়াল, সেফ হোম আরও কত কী! অন্য কিছু শব্দও গোটা করোনাকালে বাঙালির সুজন হয়েছে। হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি। আর্সেনিক অ্যালবাম এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। বাঙালির জীবনে এ ভাবে শব্দগুলো একমাত্রায় জড়িয়ে যায়নি কখনও। বাঙালি তার বাংলা প্রতিশব্দ নতুন করে ভাবতে বসেছে। অতিমারি, সামাজিক দূরত্ব, নিভৃতবাস ইত্যাদি শব্দ বছরভর মুখে মুখে ঘুরেছে। ঘুরছে। দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে। এ সব শব্দের ব্যবহার নতুন বছরেও থেকে যাবে। ভোলা যাবে না সমাজযাপনে তাদের অভিঘাত।

বাঙালি কোনও কালেই স্বাস্থ্যসচেতন ছিল না। তারা ভিড়ে মুখচাপা না দিয়েই হাঁচি-কাশিতে অভ্যস্ত। যত্রতত্র থুতু ফেলাতেও কোনও অপরাধবোধ নেই। কিন্তু গোটা ২০২০ কেউ সামান্য হাঁচি-কাশি দিলেই তার দিকে ঘুরঘুর করেছে অবিশ্বাসী চোখ। সে দশা কাটেনি। তবে অতিমারি শিখিয়েছে, হাঁচি-কাশির সময় মুখের সামনে নিদেনপক্ষে হাতটা রাখতে হয়। রাখা উচিত। সর্বত্র থুতু ফেলা যায় না। মুখে মাস্ক রাখা চাই। হাতে সাবান বা স্যানিটাইজার দিতে হয়। বাইরের হাত মুখে দিতে নেই। নতুন বছর তো বটেই, এ সব অভ্যাস আজীবন থাকা উচিত। কিন্তু বাঙালি তাতেই বা কবে তোয়াক্কা করেছে! অনেক মুখই কিন্তু মুখোশহীন বছর শেষের প্রকৃত ছবিতে।

প্রকৃত আর ‘ভার্চুয়াল’ কি সমনামী? অফিসের বৈঠক। প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা। বন্ধুত্বের আলিঙ্গন। জন্মদিনের কেক কাটা। প্রধানমন্ত্রীর সভা। রাজনৈতিক কর্মসূচি। পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন। সব, সবই অভিশপ্ত বছরে ভার্চুয়াল। নতুন বছরে এই ‘ভার্চুয়াল’ বরং ‘অ্যাক্চুয়াল’ আসুক। তবে বাঙালি শিখে গিয়েছে, আড়ালের অন্য নাম অনলাইন।

অনলাইনে ক্লাস করা যায়, পরীক্ষা দেওয়া যায়, শিক্ষক পড়াতেও পারেন। এর আগে ইউটিউবে এমন চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক ‘জ্ঞান’-এর ভিডিও সেখানে রয়েছে। প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীরা চোখ বুলিয়েছে। কিন্তু বাঙালি আবার সাহচর্য সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল। অতিমারি দিল সব ঘেঁটে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ার টোল থেকে প্রাইভেট টিউটর— সকলের দরজা বন্ধ। খোলা শুধু অনলাইন। মাধ্যম হিসাবে খুবই উত্তম।

জরুরি তো বটেই। আপৎকালীনও। কিন্তু সকলের কাছে পৌঁছনোর মতো পরিকাঠামো দেশে নেই। তাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, মূল স্রোত থেকে প্রান্তিক— সকল নাগরিক যদি নতুন বছরে এমন পরিকাঠামোর ভিতরে চলে আসতে পারে, তা হলে ভুলে না-গিয়ে ‘অন’ থাকুক এই চেনাজানা।

অভিশপ্ত বছর ২০২০ হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (প্রথম পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (প্রথম পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

আজকের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে আরেকটি খ্রিস্টীয় বছর ২০২০ বিদায় নেবে। বছরটি পৃথিবীকে দিয়েছে মহামারীর তাণ্ডব, মৃত্যুর মিছিল, কর্মহারা জীবন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই রাত পেরিয়ে ভোরের সূর্য পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসবে আরেকটি নতুন বছর। আর নতুন বছর নিয়ে মানুষ আশায় বুক বাঁধবে। করোনামুক্ত ঝলমলে একটি বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে পথচলা শুরু করবে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে/ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে/আমায় তারা ডাকে সাথে- আয় রে আয়।/সজল করুণ নয়ন তোলো, দাও বিদায়…।’ সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে আছে আনন্দ-বেদনার কাব্য। ২০২০ বছর বিদায়ের ক্ষণেও সেই একই কথা বাজবে সবার অন্তরে। আজ রাত ১২টা পেরোলেই শুরু হবে নতুন খ্রিস্টীয় বছর ২০২১। আর ভোরবেলাতেই উদয় হবে নতুন বছরের নতুন সূর্য।

আমাদের জীবনের সব কর্মকাণ্ড ইংরেজি সালের গণনায় হয়, তাই খ্রিস্টীয় বছর বিশেষ গুরুত্ববাহী। সেই বিবেচনায় বিদায়ী বছরটা কেমন গেল তার হিসাব কষবেন সবাই। ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো আরও একবার রোমন্থন করবেন। একইভাবে জীবনের সব ধরনের নেতিবাচক বিষয়গুলোকে দূরে ঠেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন করে পথচলার প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন।

ফিরে তাকানও যাক কি ঘটেছিল ২০২০ সালে। বছরটি যখন শুরু হয়, তখন পৃথিবীর মানুষ নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্প করে। কিন্তু বছরের ২ মাসের মাথায় পৃথিবীর মানুষের সামনে আসে ভয়াবহ এক বিপদ। চীনের উহানে প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবরে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে। নড়েচড়ে বসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দেয় দেশগুলোকে। এরপরই একে একে বন্ধ হতে থাকে বিমান চলাচল। অনেক দেশের সীমানা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ অভ্যন্তরীণভাবে লকডাউন দিয়ে নাগরিকদের সুরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও কাজ চলছিল না। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোতে বড় হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। বিদায়ী বছরের শেষে এসে বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ মানুষের মৃত্যুর খবর জানা যায়। আক্রান্ত হন আট কোটিরও বেশি মানুষ।

কিন্তু তবুও মানুষ নতুন আশার আলো দেখার প্রহর গুনছে। আসছে নতুন বছর ২০২১ । কান পেতে শুনি তাই নতুনের আহ্বান! নতুনকে স্বাগত জানানোর গান, কোটি কোটি বিশ্ববাসীর কণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান….
এসো হে নববর্ষ ২০২১ এসো এসো!

অণুগল্প: মন_গাছ

মন বৃক্ষের নিচে একদিন ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল, এই কাণ্ডের রেশ দীর্ঘ দিন আমাদের তাড়া করেছে।

শীলা নামের যে মেয়েটা মৃদুল কে ভালোবাসতো এক ভোরে তাকে দেখা গেল মন গাছে ঝুলে আছে। ধরাধরি করে তার লাশ যখন নামানো হলো, আমরা তাকাতে পারিনি, তার জিব্বা মুখ থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। তাকে বীভৎস দেখাচ্ছে, যে স্নিগ্ধ মুখ আমাদের উৎপীড়িত করত সে মুখের এমন বীভৎস রূপ আমরা সহ্য করতে পারিনি।
অথচ তাকে প্রেমিকা ভাবার কোন কারন নাই, সে বিশ পেরিয়েছে আমরা টিনএজ বয়সও ছুঁতে পারিনি। তবু তাকে প্রেমিকা ভাবতাম, তার আশেপাশে ভিড় করে থাকতাম। শীলা আমাদের প্রশ্রয় দিত, বোনের আদরে গালে চিমটি কাটতো। তার একটুখানি আদরে আমরা দিশেহারা হয়ে যেতাম।

মন গাছের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা পাড়ায় ঢুকেছে সেই সরু রাস্তায় একদিন মৃদুল কে দেখা গেল বর বেশে বধু নিয়ে আসছে। তার বধু শীলার মতই স্নিগ্ধ, অথচ তাকে আমরা ডাইনি ভাবতাম। সে ডাইনি ছিল না, আমাদের মন পাবার জন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। আমরা তাকে ঘৃণা করতাম বলতাম ‘ডাইনি তুই মর’।

একদিন তাকেও ডাইনির মত মন গাছে ঝুলতে দেখলাম, মৃদুল আরেক ডাইনিকে বিয়ে করে নিয়ে এলো।

অণুগল্প : জীবন

চার দেয়ালের ভেতর ঘরবন্দি মানুষ। শূন্য শহরটা এখন রূপকথার মরুভূমি। অথচ মাহমুদ আলী এখন যে ফ্ল্যাটটিতে আছেন সেখানে এই মুহূর্তে কেউ নেই। দুপুরের খা খা রোদ জানালার গ্লাস ভেদ করে তার শরীরের ওপর পড়ছে। জানালার এলোমেলো পর্দাটা ঠিক করে দেয়ার মতোও আজ কেউ নেই তার।

ইদানিং পৃথিবীতে মানুষের! বড্ড অভাব। মাহমুদ আলীর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত উঠানামা করে। চোখের ভেতর খেলা করে তীব্র রোদ। লাল-নীল-সাদা-হলুদ-সবুজ বিচিত্র সব রংয়ের খেলা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুনতে পায় বুকের ভেতর নিরন্তর হাতুড়ির শব্দ।

মাহমুদ আলীর চোখদুটো এখনও খোলা। শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে। বুকের ওপর থেকে রোদটা সরে গেছে। কিন্তু তাকে ধরে উঠে বসাবে এমন মানুষ পৃথিবীতে আর নেই।

অণুগল্প : মোবাইল

বাসের সুপারভাইজার যখন ভাড়া চাইলো তখন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ম্যানিব্যাগটা ফেলে এসেছি। হায়, এখন উপায়? পাশে সিটে বসা ভদ্রলোক আমার মুখের ভাবখানা দেখে বিষয়টা বুঝতে পারলেন যে, আমি মহা ফাঁপড়ে পরে গেছি। তিনি নিজের পকেট থেকে চকচকে বিশ টাকা দিয়ে দিলে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

নতুন বাজার থেকে যাচ্ছি গুলিস্তান। বাসে প্রচণ্ড ভীড়। এতো লোক থাকার পরেও কেউ এগিয়ে না এলেও পাশের সিটে বসা এই চিকনা ধরণের লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল।

বুকপকেটে মোবাইলটা রেখে ধপ্ করে বসে পড়লাম সিটে। কখন যে চোখদুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছে টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো সুপারভাইজারের ডাকে। চোখ মেলে দেখি পাশে বসে থাকা চিকনা ভদ্রলোকটি আর নেই। বাস থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে চোখদুটো এবার কপালে উঠলো আমার! হায়, আমার মোবাইলও হাওয়া! সুপারভাইজারের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আমার নাম্বাটিতে ফোন দিলাম। সুন্দর মেয়েলি কণ্ঠে কেউ একজন বলছে “দুঃখিত, এই মূহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন”।

আমি আর চেষ্টা করি না। কেননা, কষ্টে থাকলে মেয়ের সুন্দর কণ্ঠও বিষের মতো মনে হয়। বিশ টাকার বিনিময়ে আমার চৌদ্দ হাজার টাকার সেটটা চলে গেল। ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকি পিচঢালা পথে। একাকী, আনমনে। মোবাইলের বদলে রোদটাকে সঙ্গী করে।

অণুগল্প : নীরা

nari-5

নীরার সাথে আমার ঘর বাঁধার শখটা দীর্ঘদিনের। যখন তুমি এবং আমি সম্বন্ধটা বুঝতে পারি তখন থেকে এই চিন্তাটা মাথায় ঢুকে যায়। সম্পর্কে তেমন কিছু না হলেও ও ছিল আমার বছর দুয়েক বড়। প্রায়ই প্রতিদিনই আমাদের দেখা হতো। দূরত্বটা এবাড়ি ও বাড়ির। প্রথম যখন নীরার সাথে দেখা তখন তারা নতুন এসেছে আমাদের পাড়ায়। আকাশটা কালো হলেও সেদিন কোন বৃষ্টি হয়নি। এমনি এক কালো মেঘের নিচে দাঁড়িয়ে তার সাথে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়। তারপর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। আমি শহরে এসেছি। চাকরী করছি। মাঝেমধ্যে কথাও হয়। প্রতিটা কথাতে স্বপ্ন লেগে থাকে।

সেদিনের আকাশটা বেশ পরিষ্কারই ছিল। কোথাও কোন রকম কালো মেঘের দেখা পাইনি। আমাদের অফিসে চা-নাস্তার আয়োজনটা হয় ছাদে। ভাবলাম বিকেলের মিষ্টি রোদে একটু চা পান করে আসি। টেবিলে বসে আকাশের দিকে তাকিয়েছি মাত্র। এমন সময় নীরার ফোন। জরুরী তলব। এক্ষুনি গ্রামে ফিরতে হবে।

সারারাত জার্নি করে বাড়ি আসতে আসতে সকাল আট টা। দরজা খুলেই দুঃসংবাদ দিল ছোটবোন রোজী। ’ভাইয়া, নীরা আপুকে না কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ গতকাল রাতে কই যেন চলে গেছে।

ঝুপ শব্দে হাতে রাখা ব্যাগটা পড়ে গেলে রোজী সেটা তুলে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। আমি বাইরে বের হয়ে আসি। শ্যাওড়া গাছটি যেমন ছিল এখনও ঠিক তেমনি আছে। মাটি থেকে বের হওয়া যে শিকড়ে দুজন বসতাম। সেখানে ময়লার আস্তর। হাত দিয়ে ঝেড়ে বসে পড়ি। দৃষ্টিটা মেলে দেই আকাশে। আজও আকাশে মেঘ করেছে কিন্তু বৃষ্টি নেই। মেঘে মেঘে কথা হচ্ছে চমৎকার। যেন তারা জানান দিচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। হঠাৎ মাথার চুলে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে ঘুরে দেখি নীরা। দাঁড়িয়ে আছে অশ্রুসজল চোখে। আর কোন কথা হয় না আমাদের মধ্যে। নীরাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি। বৃষ্টি নামে। অঝোর ধারায়। মেঘেরাও মেয়েদের মন বোঝে।

নীরার চোখে জল

নীরার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি। যার সঙ্গে একসময় যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ব্যয় করেছি তার নাম হলো নীরা। সবাই সবকিছু নিজের মতো করে পায় না। পেলেও সময় ও সুযোগের অভাবে ধরে রাখতে পারে না। আসলে মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়। নীরা নামের মেয়েটিও তেমনি একটা মরীচিকাময় সময়। যাকে আমি ধরে রাখতে পারিনি। তখন সবে মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। শাহবাগের ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো এক এক করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। জাদুঘরের সামনে থেকে শুরু করে টিএসসি পর্যন্ত গাড়ি আর রিক্সার বিশাল জ্যাম। গাড়ির ভেঁপু আর রিক্সার বেলের টিং টং আওয়াজে এই সন্ধ্যায় একটা অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অফিস শেষ করে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রিয়জনের সানিদ্ধ্য পাওয়ার জন্য। রাস্তার ফুটপাত ঘেঁষেই অনেক দোকান। তাই স্বভাবতই ফুটপাত জুড়ে লোকজনের ভীড় চোখে পড়ার মতো। এই ভীড় ঠেলেই অনেককেই দেখলাম শরীর অদ্ভুত কায়দায় বাঁকিয়ে দ্রæত ছুটে চলেছেন স্বীয় গন্তব্য স্থানে।

নীরার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই সেই পুরনো ব্যাথাটি আবারও অনুভূত হলো আমার। বুকের বাঁ পাশটি কেমন যেন একটু মোচড় দিয়ে উঠল। ঠিক বুড়োরা কাজ শেষে যেমন করে আরকি। দীর্ঘ সময় পর ছোট্ট শিশু মাকে দেখলে মায়ের মন অস্থির হয়ে যায় তেমন করে বুকের মধ্যে একটা দুলুনি অনুভূত হলো। শেষ কবে দেখা হয়েছিল সেই স্মৃতিটুকু ভুলে গেছি এতোদিনে। অনেক চেষ্টা করেও আর মনে করতে পারলাম না।

পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। উদ্দেশ্য আজিজ মার্কেট। অনেকদিন ধরে ওদিকে যাওয়া হয়না। লম্বা ব্যাগটা তখনও কাঁধের ওপর ঝুলানো। সেখানে সম্পদ বলতে আছে আমার লেখা একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি, তারা শঙ্করের ’কবি’ উপন্যাস, আল মাহমুদের সোনালি কাবিন। আমার কাছে এই দুইটি বইকে চির যৌবনা বলে মনে হয়। যতবার পড়ি ততবার মুগ্ধ হই। ফুটপাত ধরে হাটার একটা বড় সুবিধা হলো মানুষের শরীরের বিচিত্র ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আমার এক চাচা ছিল তিনি বলতেন, মানুষের ভীড়ে হাটলে মানুষ খুঁজে পাবি। মানুষকে চিনতে সুবিধা হবে তোর। সেই থেকে আমি মানুষের ভীড়ের মাঝে চলি। মানুষের শরীরের ঘ্রাণ নিই। আবার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ঐ মানুষের ঘ্রাণই। কিছু উটকো মানুষের উৎকট গন্ধে ফুটপাতের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে দিনকে দিন। যাক সে কথা। হাটছি একমনে। মানুষের শরীরের গন্ধ নিতে নিতে। জাতীয় জাদুঘরের সামনে আসা মাত্রই হঠাৎ একটা মেয়েলি কণ্ঠের ডাক কানে এলো।
-এই মাহমুদ শোন।
যেহেতু আমার নাম ধরেই ডাকছে তাই দু’কান খাড়া করলাম। ডান পা’টা সামনে রেখে বাঁ পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িযে থাকলাম কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু মেয়ে কণ্ঠ মনে করে ভাবলাম হয়তো ভুল শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে যে ছেলেটি এখনও কাঁধে ব্যাগ আর কবিতার বই নিয়ে ঘোরে তাকে আর যাই হোক কোন মেয়ে ডাকতে পারে না। তাই আবারও মাথাটা নিচু করে বাঁ পা’টা সামনে এগিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
– মাহমুদ, ডাকছি শুনছো না কেন? একদম ঘাড়ের উপর এসে কেউ একজন বলল। চমকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম আমি। মাথাটি পিছে ঘোরানো মাত্রই থ হয়ে গেলাম। পাওয়ার ওয়ালা চশমাটি খুলে দুই-তিন মিনিট মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভুল দেখছি না তো! চশমাটি হাত বদল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার মনে হলো, আমি টাইম মেশিনে চেপে ফিরে গেছি সুদূর অতীতে।
– একি! নীরা তুমি? কতোদিন পর ……. আর বলতে পারলাম না। আমার মুখের কথা ও কেড়ে নিয়ে বলল,
-‘কেমন আছো মাহমুদ, কোথায় থাকো, কি করো এখন?’
আমি বললাম, একসাথে তিনটি প্রশ্ন, ভাবছি কোন প্রশ্নের উত্তর আগে দেবো।
– তুমি সেই আগের মতোই আছো, একটু বদলাওনি। বলেই নীরা তার সেই চির পরিচিত হাসিটা হাসলো।
আমি ওর শরীরের দিকে তাকাই। সেই চিকনা মেয়েটি এখন কত মোটা হয়ে গেছে। কাল রংয়ের একটা পাতলা শিপন শাড়ি পড়েছে সাথে ম্যাচিং করে বøাউজ। ফর্সা মেয়ের গায়ে কালো শাড়ি বেশ সুন্দর মানিয়েছে। আগের মতো হলে হয়তো বলতাম, তোমাকে যা সুন্দর লাগছে না নীরা, মনে হচ্ছে এখনই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু এই মূহুর্তে সেটা সম্ভব নয়। আগের সেই লম্বা চুলও নেই। কেটে একদম ছোট করেছে। অথচ ক্যাম্পাসে একসময় ওর চুল ছিল বিখ্যাত। চুলের কারণেই কত ছেলে ওর পিছু ঘুরঘুর করতো। আর আমি ওকে দেখা মাত্রই জীবনান্দের বিখ্যাত সেই কবিতার লাইনটি বলতাম. ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’

হাতে ঘড়ি পড়া একদম পছন্দ করতো না ও। কিন্তু এখন হাতে শোভা পাচ্ছে একটি দামি ব্রান্ডের ঘড়ি। যে মেয়েটি প্রতিদিন কপালে কালো টিপ পরে আসতো এখন সেখানে কিছুই দেখতে পেলাম না। সবকিছুতে পরিবর্তন আসলেও তার চোখ দুটোতে তেমন কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। শুধু চোখের মধ্যে আগে যে সাগর দেখছিলাম সেটা এখন নেই। বড়, গোল ঐ চোখদুটি মাঝে থাকা সাগরে একসময় কতো সাঁতার কেটেছি আমি। এই চোখ এবং চুল দেখেই আমি একদিন নীরার প্রেমে পড়েছিলাম। সে কথা মনে হলে এখনও মাঝে মাঝে বুকের ডান পাশটা চিনচিন করে ব্যাথা করে।

প্রথম দিকে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে একরকম প্রায় জোর করেই হাত ধরে আবারও টেনে নিয়ে গেল পাবলিক লাইব্রেরীর ক্যাফেটেরিয়ায়। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ল্যাম্পপোষ্টের লাইটগুলো উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হচ্ছে। চাঁদের আলোও মাঝে মধ্যে এই যান্ত্রিক শহরে বড়ই বেমানান লাগে। কে বা আছে এমন! যে আজকাল চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

মুখোমুখি বসে আছি দুজন। কারো মুখে কোন কথা নেই। নীরার হাতদুটি ওর কোলের ওপর রাখা। মেরুন রংয়ের ভ্যানিটি ব্যাগটা পাশের চেয়ারে। আমি টেবিলের ওপর দুই হাত বিছিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এই মুহূর্তে নীরাকে গিলে খাচ্ছি আমি। ওর টলটলে পানির মতো স্বচ্ছ গাল, ঠোঁট, চিবুক বেয়ে নেমে একেবারে বুকের ওপর এসে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলে ও একটু অস্বস্থিতে পড়ে যায়। নড়েচড়ে বসে নীরা। হয়তো বুঝতে পারছে যে, একটা পুরুষ তাকে চোখের ইশারায় ভোগ করতেছে। মেয়েরা এই বিষয়গুলো খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারে। আমি আবার ওর চোখের দিকে তাকাই। এই চোখ একটা সময় আমাকে পাগলের মতো ওর কাছে টেনে নিয়ে আসতো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কতটা বিকেল যে পার করে দিয়েছি তার হিসেব নেই। আমি আজও হাজার মানুষের ভীড়ে এই চোখ দুটোকে খুঁজে ফিরি।

– কিছু খাবে? নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করি। ও নিঃশ্চুপ। হাত দুটো আগের মতোই কোলের ওপর রাখা। তবে আঙুলে আঙুলে ঘষছে এখন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, তুমি একবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি?
– তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি বেশ সুখে আছো। আমি ওর চোখের উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললাম।
– তোমরা ছেলেরা না শুধু নারীদের উপরের সৌন্দর্য দেখেই ভাবো মেয়েরা কত্ত সুখী। অথচ বুকের ভিতরে যে চৈত্রের খরা বইছে সেটা একবারও দেখার চেষ্টা করো না।
– তুমি তো জান, আমি যে শুধু তোমাকে দেখি তাই নয় তোমার ভিতরটা পর্যন্ত আমি পড়তে পারি। কবিতার মতো। তোমাকে অনুবাদ করতে পারি, আবৃত্তিও করতে পারি।
– সেটা হয় তো আগে পারতে কিন্তু এখন পার না।
– এখন আর আগের মতো চেষ্টা করে দেখি না যে। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই এসব সাধনা বাদ দিয়েছি।
– চেষ্টা করে দেখ মাহমুদ, তোমার কি মনে হয় আমি অনেক সুখে আছি? আকুল হয়ে জানতে চায় নীরা।

আমি আবার নীরার চোখের দিকে ভালো করে তাকাই। তবে চক্ষু ডাক্তারের মতো করে নয়, একজন সত্যিকার প্রেমিক হয়ে যাই যেন আমি। একটা গভীর আত্মবিশ্বাস ফুঁস করে ওঠে বুকের ভেতর। যে চোখ এক সময় প্রতি নিয়ত আমার সাথে কথা বলতো, খেলতো, দুষ্টুমিতে ভরা ছিল যে চোখ সেখানে দেখি রাজ্যের হতাশা। ভরাট, গোল দুটি চোখ না পাওয়ার বেদনায় কেমন যেন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে আমার কাছে। চুপসে গেছে শীতে ঝরে যাওয়া পাতার মতো। আমি জানি আর কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বর্ষার ঢল নামবে দুচোখে। আমি আমার চোখ ওর কোলের কাছে নামিয়ে আনলাম। হাত দুটো আগের মতোই কোলের ওপর রাখা। ভ্যানিটি ব্যাগটা কখন যে কোলের ওপর টেনে নিয়েছে টের পাইনি। আমি কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেললাম।
– তুমি হয়তো সম্পূর্ণ দোষ আমার ওপর চাপিয়েছো। বিশ্বাস করো, আমি তোমার সাথে বিন্দুমাত্র প্রতারণা করিনি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর আমি চলে যাই সাভারে। মামার বাসায়। তুমি তো জান আমার মা-বাবা বেঁচে নেই। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। পরে মা আমাকে নিয়ে যান মামার বাসায়। সেখানেই বড় হতে থাকি। যখন আমার বয়স পাঁচ বছর তখন মা’ও আমাকে ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে মামাই আমাকে মানুষ করেছেন, পড়ালেখার খরচ দিয়েছেন। উনা কে আমি পিতার মতোই সম্মান করতাম। বাবার আদর কি জিনিস আমি জানতাম না। মামা আমাকে এমন আদর, স্নেহ করতেন যে, বাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। জানো, এতোদিন পর বাবাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার জীবনটা আরও অনেক সুন্দর হতো। আমার নির্ভরতার শেষ ঠিকানা ছিল আমার মামা অথছ সেই মামার বাসায় গিয়ে আমার জীবনে কালো অধ্যায়ের শুরু। বাসায় গিয়ে দেখি মামাতো ভাই আবীর ছাড়া বাসায় কেউ নেই। এই আবীরের সাথে আমি ছোটবেলায় কতো খেলা খেলেছি, দুষ্টমি করেছি। আমি বাসায় ঢোকা মাত্রই তার চেহারায় একটা পরিবর্তনের আভাস পেলাম। কয়েকদিন মামাকে বলতেও গিয়েছি বিষয়টা কিন্তু মামা কানে তোলেননি। মামিকে বলতে গিয়ে একদিন অপমানিত হলাম। শেষ যেদিন আমি চলে আসবো সেদিনই ঘটলো দুর্ঘটনাটি। অনেক চেষ্টা করেও আমি ওর হাত থেকে সেদিন মুক্ত হতে পারিনি। ধর্ষিত হলাম। কিন্তু সব দোষ এসে পড়লো আমার ওপর। যে দিন এ পরিস্থিতির শিকার হলাম তার পরের দিনেই মামা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। ছেলে গুনশানে থাকে। ছেলের বাবার অঢেল ধন-সম্পদ। আমার বিয়ে হয়ে গেল। কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে থাকে নীরা।
– থাক, আর বলতে হবে না। আমি থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।
– শুনতে ভাল লাগছে না বুঝি?
– তুমি এ অবস্থায় বিয়ে করলে কেন? থানায় যেতে পারতে, মামলা করতে পারতে। আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ি।
– এ জন্যই তো বলি, মেয়েদের দুঃখ ছেলেরা কোনদিন বুঝে না।
– এখন তোমার কি অবস্থা? অস্থির হয়ে জানতে চাই আমি।
– এখন আমি অনেক ভাল আছি। বাড়ি-গাড়ি সব হয়েছে। স্বামীর মতো যদিও আমার গুলশানে কোন বাড়ি নেই তবে একটা ডুপ্লেক্স ফ্লাট কিনেছি। লম্পট স্বামীকে ডিভোর্স করেছি। আর নতুন একটা পেশা বেচে নিয়েছি। কলগার্ল! মানুষকে আনন্দ দেয়াই এখন আমার প্রধান কাজ।
ওর মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি পাথর হয়ে গেলাম। হাতে রাখা গ্লাসটি মুখে তুলতেও ভুলে গেলাম। কি বলে মেয়েটা, মাথা ঠিক আছে তো? নিজের মনেই বলি। উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশে মেঘ করেছে। নীরার বেদনায় বুঝি মন খারাপ হয়েছে তারও। কিছুক্ষণ পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। দমকা হাওয়ায় ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে এখন। হঠাৎ আমার হাতের মধ্যে উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম। দেখি আমার হাত নীরা হাতের মুঠোয় বন্দি। আগে যেভাবে আমার আঙুলগুলো নিয়ে ওর হাতের মুঠোয় খেলা করতো ঠিক সেভাবে খেলছে। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি অঝোর ধারায় কেঁদে চলছে মেয়েটি। বর্ষার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন পানি ঝরছে নীরার চোখ থেকে। আমি উঠে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। মাথাটি বুকের কাছে টেনে নিযে বললাম, যে চোখ দেখে আমি তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম সে চোখে বর্ষার পানি মানায় না নীরা। ঐ চোখে আমি আবার সমুদ্র দেখতে চাই, আগের মতোই সাঁতার কাটতে চাই তোমার চোখের গভীর সমুদ্রে। আমি তো এখনও বেঁচে আছি তাই না?

নীরা আমাকে আরও জোরে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আমি আর বাঁধা দিই না। কারণ আমি জানি, তার এই কান্না কষ্টের নয় আনন্দের। প্রিয় মানুষ কে কাছে পাওয়ার আনন্দ।
নীরার হাত ধরে ভরা বৃষ্টিতে বাইরে বের হয়ে আসি। ভিজতে থাকি দুই জন। আনন্দে অবগাহন করতে থাকি।

ছোটগল্প: দড়ি

মাথার উপরে টাঙানো দড়িটার দিকে শেষবারের মতো এক ‍দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফয়সাল। ছিঁড়ে যাওয়া মাকড়সার জাল যেমন করে ঝুলে থাকে আর সামান্য বাতাসেই দুলতে থাকে ঠিক দড়িটাকেও এখন তাই মনে হচ্ছে। নিজেকে তার মাকড়সা মনে হয়। ঝুলে যাওয়া একটা দড়ির শেষ মাথায় এসে সে চিৎকার করছে। না নামতে পারছে নিচে, না যাইতে পারছে ওপরে। জান বের হওয়ার মতো একটা অবস্থা। সে জোরে চিৎকার করবে নাকি মিঁইয়ে কান্না করবে বুঝে উঠতে পারে না।

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল মনে নেই। হবে হয়তো মিনিট পাঁচেক কিংবা সাত এর মতো। আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না ওর। স্মৃতিশক্তি যেনো লোপ পেয়ে বসেছে। অনেককিছুই মাথা থেকে হারিয়ে গেলেও দীনার কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। দীনা! হু, দীনার কথাই বলছি। আর দশটা মেয়ের মতো করে না হলেও সে দীনাকে অনেক ভালোবাসতো। বয়সেও ফয়সালের চেয়ে দু’বছরের বড় হবে ও। তারপরেও দীনার চাওয়াকে না করতে পারেনি। সেদিন কেন যে পারেনি সে নিজেও জানে না। দীনার মনে হয়তো বা অনেক কিছুই খেলা করতো। রঙিন আকাশে স্বপ্নগুলো ভাসিয়ে দিতো একে একে। কোন এক চৈত্রের সকালে দীনা এসে হাজির ফয়সালের মেসে। তখন সবে লেখাপড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে যোগদান করেছে ও। মাস শেষে ভালো বেতনও পাইতেছিল। দীনাকে দেখে কিছুটা হতচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে দীনাকে রুমে নিয়ে আসে। ভাগ্য ভালো যে, সেদিন মেসে আবদুল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ ছিল না। আবদুল্লাহ্কে খুব সংক্ষেপে কিছু বিষয় বুঝিয়ে আবার নিজের রুমে আসে ফয়সাল।

অল্প কথায় যা বললো দীনা তার সারমর্ম হলো সে তার বাসায় কাউকে না জানিয়ে ফয়সালের কাছে এসেছে। বাসায় আর যাবে না। বেশ বিধ্বস্ত চেহারার দীনাকে তার সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। অথচ ছোট বেলায় এই মেয়েই কিনা সারা গ্রাম দাঁপিয়ে বেড়াতো। ফয়সালের চেয়ে বড় হয়েও তার সামনে আসলেই কেমন যেন চুপসে যেতো লজ্জাবতী লতার মতো। তারপর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। সাত বছরের সংসারে তাদের পাঁচ বছরের অতনী নামে একটা মেয়ে আছে। অতনী জানুয়ারী থেকেই স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েটার কথা শুনলে আত্মা ভরে যায়।

এই সংসারে এখন দীনা নেই। অতনী নেই। ঘরভরা হাসি নেই। কিছু চেয়ে না পেলে অতনী যে বালিশটায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো সেই ছোট্ট বালিশটা খাটের এক কোণায় পড়ে আছে। ধূলা পড়ে কেমন মলিন স্যাঁতস্যাঁতে সাদা হয়েছে। দীনারা চলে যাবার পর ফয়সালও ঘরের আর কোন জিনিসপত্র ঘুছিয়ে রাখেনি। দীনা যেমন করে রেখে গেছিল ঠিক তেমনি পড়ে আছে। অবহেলায়, অযত্নে।

শক্ত করে দুইহাত দিয়ে ধরে টান মেরে দেখে ছিঁড়ে যায় কি না। না, বেশ শক্তি আছে দড়িটায়। অথচ এই দড়িটা সংগ্রহ করতে তাকে বেশ গলদঘর্ম হতে হয়েছে। মনে হয়েছে কাঠখোট্টা এই ঢাকা শহরে দড়ি সংগ্রহ করাটাই সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ। বিষ খাওয়ার মতো যার হাতে কোন পয়সা নেই সে এই করোনা কালে দড়ি কিনবেই বা কি করে। নদী ভাঙ্গন যেমন করে তীরে থাকা মানুষের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়। স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয় এই করোনাও তেমনি ফয়সালের স্বপ্নগুলো কেড়ে নিয়েছে। দিন তিনেক তাকে ব্যায় করতে হয়েছে এই দড়ি খোঁজার পিছনে। শেষে যখন হতাশ হয়ে বিকল্প কিছু ভাবতে শুরু করেছে ঠিক তখনই এই দড়িটার খোঁজ মেলে।

চাকরী খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছিল একটা দড়ি খুঁজে বের করা। অথচ এই সপ্তাহ খানেক আগেও সে দেখেছে অনেক জায়গায় দড়ি পড়ে আছে বেশ অবহেলায়। হাতিরঝিল দিয়ে হাঁটতে গিয়েও চোখের সামনে পড়েছে অনেক দড়ি। শুধু তাই নয় করোনা কালের আগে কাওরান বাজারে মাছ কিনতে গিয়েও সে প্রচুর দড়ি দেখেছে। অথচ এই দড়িটাই আজ যেনো সোনার হরিণ। তন্ন তন্ন করেও খোঁ মিলছে না তার। হতাশ ফয়সাল মাথা তুলে আসমান দেখতে গিয়ে থমকে যায়। কাওরান বাজার রেলগেটের পাশেই একটা নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ হচ্ছে। চোখ তুলে উপরে তাকাতে গেলে চোখ ব্যাথা হয়ে যায় এমনই উঁচা বিল্ডিং। চোখ উপর থেকে নিচের দিকে আনতেই চমকে ওঠে। আরে! এই তো দড়ি। উচা বিল্ডিংটার নিচতলার এককোনায় পড়েছিল দড়িটা। দড়ির অর্ধেকটা ভেজা। চুন-সুরকি আর বালিতে মিশে একাকার। তাতে কি! ভাবে ফয়সাল। দড়িটা তার যেভাবেই হোক চাই। বাসায় গিয়ে নাহয় পরিষ্কার করে নিবে। নিচতলায় এই ইট, চুন-সুরকি আর বালির যে দেখাশোনা করছিল সেই দারোয়ানকে অনেক অনুরোধ করার পর তার হৃদয় গলে যায়। কেননা ফয়সালের জানা আছে, নিচুতলার মানুষদের আর যাই হোক একটা ভালো মন থাকে। একটু অনুরোধে যদি গলে যায় তো একেবারে মোমের মতো হয়ে যায়।

-ভাই, আসসালামুই আলাইকুম। গলাটা একটু পরিষ্কার করে সালাম দেয় ফয়সাল।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। বেশ ভারি গলায় জবাব দেয় দারোয়ান।
– কে আপনি? এখানে কি চাই? কেন এসেছেন?
-ভাই, আ-আমি ফয়সাল। এসেছি ঐ দড়িটার জন্য আঙুল উঁচিয়ে দড়িটার অবস্থান দেখিয়ে দেয় ও।
-দড়ি-টড়ি এখন হবে না। যান তো।
-ভাই, আমার খুব দরকার ভাই। যদি দেন তাহলে আমার খুব উপকার হবে ভাই। আরও অনেক অনুনয়-বিনয় করার পর দিলটা নরম হয় দারোয়ানের। দড়িটা দিয়ে দেয়। শুধু দড়ি না, একটা পুরাতন বাজারের ব্যাগে ভরে দিয়ে দেয়।
দড়িটা হাতে পাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল সে বুঝি স্বর্গ হাতে পেয়েছে। লম্বায় প্রায় বিশ হাত হবে। দড়িটা হাতে নিয়েই ফয়সাল বুঝে যায় এটাতেই কাজ হবে। দড়িটা নিয়ে বাসায় এসে বদ্ধ দরজার তালা খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ নাকে এসে ঢোকে। চিকা মরার মতো এই গন্ধটা কয়েকদিন ধরেই সে পাচ্ছিল। কিন্তু গন্ধটার উৎস কোথায় সে খুঁজে দেখেনি। দড়িটা খাটের ছুঁড়ে মেরে দড়াম করে শুয়ে পড়ে ফয়সাল।

ফয়সাল মরে যাচ্ছে। ফাঁসিতে ঝুলে। চেয়ারের ওপরে উঠে দড়িটা গলায় আটকানোর পরে পা দিয়ে ল্যাং মেরে চেয়ারটা ফেলে দেয় ফ্লোরে। ছটফট করতে থাকে বন্দুকের গুলি লাগা পাখির মতো। পানি! আহ্ কেউ যদি তাকে এই মূহুর্তে একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিতো। অতনীর মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। দীনা! দীনা কোথায়? অন্ধকার পৃথিবীতে প্রিয়জনের মুখটা দেখতে পারার ভীষণ কষ্টে ফুরৎ করে জানটা বের হয়ে যায়। নিথর ফয়সালের দেহ ঝুলতে থাকে ফাঁসির দড়িতে।

দরজায় দুড়ুম-দাড়াম শব্দ হচ্ছে। শব্দ তিক্ষ্ণ থেকে তিক্ষ্ণতর হতে থাকে। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ। ঘুম থেকে হুড়মুড় করে উঠে বসে ফয়সাল। পানির পিপাসায় যেনো বুক ফেটে যাচ্ছে। ফিল্টারে পানি নেই। ডাইরেক্ট লাইন থেকে মগে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করে। ওদিকে তখনও দরজার তার মেয়ে চিৎকার করছে, বাবা..। ও বাবা…..। দরজা খোলো। আমি অতনী, বাইরে দাঁড়িয়ে আছি তো। কিছুক্ষণ পর দীনাও ডাকতে থাকে। ফয়সাল, দরজা খোলো, আমি ফিরে এসেছি। ফয়সাল দরজা খুলতে গিয়ে দড়িটার দিকে তাকায়। ধূলোমাখা দড়িটা যেনো তাকে বিদ্রুপ করছে।