বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

তামান্না

দরজায় টক টক শব্দ শুনে তামান্না পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খোলে।
ও তুমি ?
হ্যাঁ আমি !! কেন,আমি আসতে পারি না?
আরে, তুমি ছাড়া এই শহরে আমার আর কে আছে। তামান্না কমলা রং এর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে কয়েক বার ফোটা ফোটা জল লাবন্যময় মুখটাকে মলিন করে দেয়। কাল আমার পরীক্ষা তাই আমি মনে করছি মা আসবে দেখতে।
ও আচ্ছা, মার কথা মনে পড়ছে। তোমাকে ফোন করে নাই? আসতে না পারলেও একবার ফোনতো করতে পারে মা।
মা, –মাগো।
এই তোমাকে কোন দিন কাঁদতে তো দেখি নাই, আজ কি হল। মন খারাপ হলে পরীক্ষা ভাল হবে না আমার কথা শুনো, এই আমার কথা শুনো। সকালে তুমি পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে যাবে তাই এখন দেখা করে যেতে আসলাম। ভাল করে পরীক্ষা দিবা তোমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি দরকার।
তুমি দোয়া করো।
হা হা হা (হাসি) দোয়া দিয়া পাশ করা যায়? ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশী নাম্বার ফেলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া যায় না যদি সে মাদ্রাসার ছাত্র হয়। হয়তো এদেশে দোয়া দিয়েই ছাত্র-ছাত্রী পার হবে একদিন। বরুড়ার চিকন সরু আকা বাঁকা রাস্তা আজ শুধু স্মৃতি। কুমিল্লা শহর টাকে মনে হয় আমার পৃথিবী এই শহরে সৌরভের বাস বলে হয়তো এত ভাল লাগে। কিন্তু কিছু কিছু লোক দেখলে কেন এত ভয় লাগে জানি না। ঘৃণায় কেন বমি বমি ভাব লাগে তা বুঝতে পারি না। সৌরভ শিক্ষিত বেকার গরীব এক ছেলে অথচ তার উপর সব ভরসা আমার। তাকে আপনজন থেকেও আপন লাগে।

(২য় খণ্ড)
তোর মত ছোট লোকের ঘরে আর থাকবো না তুই একটা হারামীর বাচ্চা।
ওই ওই, আমার মা বাপকে গালি দিলে ভাল হবে না তোর কপালে এই ঘরের ভাত উঠে যাবে।
আমিও আর থাকতে চাই না।
বউ-জামাইর ঝগড়া ফেল ফেল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে দেড় বছরের তামান্না কি নিয়ে ঝগড়া বুঝতে চায় হয়তো। মেয়েটা ঝটকা মেরে কোলে তুলে জামাইর ঘর ছাড়ে রুপালী। মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি আসে, আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর। পাশের গ্রামের পরের গ্রামে রুপালীর বিয়ে হয় আব্বাস মিয়ার সাথে। রুপালী টকবগ যুবতী হয়ে উঠতে চোখ পড়ে আব্বাসের সাত ক্লাস পার হয়ে আর আট ক্লাস পড়া হয় না। রুপালীর বাপ-ভাইর কাছে আব্বাস বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। তারা তাতে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়, অনেক ধনবান শুনে খোঁজ খবর ছাড়া এক সপ্তাহের ভিতর বিয়ে দিয়ে দেয় রুপালীকে। বাসর রাতটা হয়তো সুখের ছিল।
না ভাবী সেই রাতও ছিল সাদা সুখের, প্রতি রাতে সে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরত। আমি প্রথম প্রথম চুপ করে সহ্য করতাম আর যখনি তার খারাপ কাজের প্রতিবাদ শুরু করলাম, তখনি নেমে আসলো প্রচন্ড অত্যাচার। দেখো দেখো আমার শরীলটা মেরে আমাকে বেহুঁশ করে ফেলত। তোমাকে দেখাতে পারছি না আমি শরীরের সব অংঙ্গ সিগারেটের আগুন চেপে ধরত আমার গায়ে। এখন আবার তোমরা সবাই বলছো তার কাছে ফিরে যেতে।
মেয়ে মানুষ ফসলি জমিনের মত মন, শরীরের উপর অন্য লোক ফসল ফেলায়। যা মা যা, জামাই নিতে আসছে যা। স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর জান্নাত। তার পায়ের তলায় জাহান্নামও নাই মা । আমি আর তার সংসারে যাব না তার মেয়েটাকেও নিয়ে যেতে বলো। আমি তার মেয়েও রাখতে চাই না।

(৩য় খণ্ড)
আপা মেয়েটা কে? ঠিক যেন আপনার চেহারা। দোকানদারের এমন প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে রুপালী তামান্নার দিকে চেয়ে থাকে। চিকন একটা হাসি দিয়ে বলে আমার বোনের মেয়ে দোকানদারের সাথে মায়ের মিথ্যা পরিচয় দেওয়া যেন আত্মহত্যার মত লাগে।
জলদি জলদি এই দুইটা কাপড় প্যাকেট করে দিন আমি আবার কুমিল্লা ফিরে যেতে হবে। নিজের কামাই করা টাকায় মাকে শাড়ী কিনে দিতে গিয়ে পরিচয়হীন হয়ে যাওয়া, বাহ্ দুনিয়া!! আমার ভিতর যে দুইটি কিডনি একটি মায়ের আরেকটি বাবার মনে হয়। জানো সৌরভ মন চায় দুইটা কিডনিই শরীর থেকে চিড়ে ফেলে দিতে যে দিন মার বিয়ে হয় সে দিন খুব কেঁদে ছিলাম। ওই দিন থেকে শুরু ছোট দুই নদীর পানিতে প্লাবন, যে প্লাবনে আমার বুক প্লাবিত হত এখনো হয়। আমার সামনে মা বিয়ের শাড়ী পরে অন্য লোকের বউ হয়ে চলে গেলেন ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারতাম না,বলতে পারতাম না। কিন্তু বুকটা আমর তখন থেকে পাথর হয়ে গেছে যখনি মার কথা মনে পড়তো, ছুটে যেতাম তাঁর রুমটাতে, দাঁড়িয়ে থাকতাম নীরব হয়ে। তখন আমার বয়স হয়তো ৮-১০ হবে নানী যেন আমার মা হয়ে গেল।

রাতে নানীর বুকে স্বর্গ খোঁজতাম বড় হওয়ার সাথে সাথে মামনি ঘরের কাজ করতে দেওয়া শুরু করলো। কাজ না করলে মারতো, এখন যেমন বাংলা লাটসাহেবের বউরা চাকরানীদের মেরে নিউজ হেড়লাইন হয়। মা যখন নতুন বাবা কে নিয়ে তাঁর মায়ের বাড়ী বেড়াতে আসতো, তখন নানী আমাকে পাঠিয়ে দিত আমার কোন আত্নীয়ের বাড়ী, দেখা হতো না মায়ের সাথে। মায়ের দেখা পেতে, মায়ের একটু পরশ পেতে আজও আমি কেঁদে চলি। সব প্রতিকূলতায়ও কেমন জানি আমার লেখা-পড়া করতে মন চাইতো। নানী তাই মামনির চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করায়,কাজ আর ভুল ভ্রান্তির নির্মম কষাঘাত এর ভিতরে আমার জীবন আটকে গেল। তারপরও পড়া-লিখা করলাম আমি।

(৪র্থ খণ্ড)
মেয়ে মানুষের রূপ কি আসলে থাকা দরকার?বলো সৌরভ। এই শরীরের রূপ দেখে তো আমার বাবা মা রুপালীকে বিয়ে করে ছিল। আর মার রূপের বিনিময় আজ আমি! মায়ের রূপের কারণেই আজ আমি মা হারানো। এই রূপের কারণে আজ আমি দেহ শ্রমিক। ওহ! চুপ করো।
না, আজ আমাকে বলতে দাও সৌরভ, এই রূপের কারণেই আমি মামা শালা দ্বারা ইজ্জত হারা। আর এই কথা আমি প্রকাশই করতে পারি নাই। মামনির শত অত্যাচারও সয়ে গিয়েছি কারণ থাকা-খাওয়া, পড়া-লিখার সুযোগ ছিল বলে। যে লোকটা আমাকে জন্ম দিলো আজ পর্যন্ত কোন দিন খোঁজও নিলো না। অথচ তাদের অপেক্ষায় আমার যায় দিন, আমি অপেক্ষা করি কাশ্মীরি সন্তানদের মত। আমি অপেক্ষা করি বাংলাদেশের গুম হওয়া লোকজনের স্বজনদের মত, আমি জানি আমার মা-বাপ জীবিত, তারপরও হবে না দেখা কোন দিন. শুন, আমি এই সব শুনতে চাই না, আমি তোমার অতীত বর্তমান সব কিছু নিয়ে। তোমাকে ভালবাসি বলে তোমার জন্য এই বন্ধুর পথ চলা সৌরভ। মেট্রিক পরীক্ষার পর মামনি বেড়াতে নিয়ে গেল তার বাবার বাড়ী। আমিও গেলাম হাসি-খুশি আমি তো জানতাম না ওইখানে অপেক্ষা করছে সর্পের ছোবল। মামনির ছোট ভাই আমার ইজ্জত লুুটে নেয় নানীকে বললাম সব কিছু, মামা শুনে বলে মিথ্যা কথা। বাড়াবাড়ী করলে নানী নাতনী দুইজনকে ঘর ছাড়তে হবে। এইটাই যেন মামি চায় তাই সে শুকনিমামার হাসি দেয়। কোন এক গ্রীষ্মের বাদলা দিনে আমি নানীর ঘর চাড়া হই। যে লোকটা আমাকে নিয়ে আসলো, সব কিছু বলেই নিয়ে আসলো। দেহ বিক্রির বিনিময় আমি শুধু ভাত চাই, একটু নিরাপদ রাত যাপন করার জায়গা চাই। কুমিল্লা শহরের গলি গলি দৌড়িয়েছি আমি, মানুষের একটু দয়াময় করুণার জন্য। কত মানুষ যে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ছিল, তাদের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আমি হয়ে যাই ধর্মহীন পতিতা, আর সেই সব লোক পবিত্র ও ভদ্র। তারপর ও বাঁচতে মন চায় শিক্ষিত হতে মন চায়, মা হতে মন চায়। চলার পথেতো তোমাকে পেলাম তোমাকে পেয়ে যেন বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করলাম। তুমি আমাকে ভালবাসো অনেক, তা আমি জানি আর আমি,পড়া-লিখা আর বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে ছুটে চলি মানুষের বিছানায়।

তামান্না, আমি একটা চাকুরী ফেলেই বিয়ে করে ফেলবো তুমিই হবে আমার রাণী ভুলে যাব সব অতীত। চলে যাব কোন এক নতুন ঠিকানায়।

বন্ধু ও গন্ধরাজ

তুমি কোথায় নামবে ?
অচেনা অজানা একটা মানুষ হঠাৎ তুমি সম্বোধন করছে ! মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেল আমার। যদিও তিনি একেবারে অচেনা মানুষ নন।
: গাবতলী।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ভরা যমুনার রূপ দেখতে লাগলাম। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী নাইট কোচ, ট্রাক, লরি জ্যামে আটকে আছে। সেই কবে থেকে নিশ্চল নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির বিস্তীর্ণ মিছিল। যোহরের আযান শোনা যাচ্ছে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করি।

নির্ঘুম রাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চোখ লাল টকটক আর মাথা ব্যাথায় টনটন করছে। আমার ঠিক পেছনে আমাদের পাশের গ্রামের একটা মেয়ে আর তার বান্ধবী বসেছে। অবিরাম খই ফোটে তাদের মুখে। কত রাজ্যের গল্প আর বিচিত্র স্বরভঙ্গি তাদের।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবদুল মতিন লিখে সার্চ করলাম। তিন বছর আগে পাঠানো ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্টটা ক্যানসেল করে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
আবদুল মতিন আমার ছোট বেলার বন্ধু। আমরা গ্রামের একই স্কুল পড়তাম। তার সাথে আমার গলায় গলায় ভাব। আমি একটু ইন্ট্রোভাট হওয়ার কারণে তেমন বন্ধু ছিল না কখনোই। আমাদের দিন বেশ ভালোই কাটছিল। মতিনের বাবার নার্সারি ছিল। ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছের চারা তৈরি করে হাটে হাটে বিক্রি করতেন। হঠাত একদিন শোনলাম মতিনরা আর বড়গাঁও এ থাকবে না। চলে যাবে ঢাকায়। তার বাবা ঢাকায় একটা বাড়ির কেয়ারটেকারের চাকরি পেয়েছেন। তাই তারা বনগাঁর পাটকাঠি গোটাতে লাগল। আমার মন তখন ভীষণ খারাপ। শেষ কয়টা দিন আমাদের আলাপ আলোচনা ছিল যেন আমরা একে অপরকে ভুলে না যাই।

তাই বিদায় বেলায় আমি তাকে একটা ডায়েরি উপহার দিয়েছিলাম সে দিয়েছিল একটা গন্ধরাজ ফুলের চারা। গন্ধরাজ ফুলের গাছটা আমি এখনো আগলে রেখেছি। সেই গাছ তার ফুল আর মোহিত সুবাসে বাড়ির সদস্যদের মন মাতাচ্ছে পনেরো বছর ধরে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ মতিনকে ফেইসবুকে খোঁজে পেয়ে রিকুয়েষ্ট দেই কিন্তু সে আমার বন্ধুত্বের আবেদন গ্রহণ করেনি। আজ সেই মতিন আমার পাশের সিটে বসে ঢাকা ফিরছে। কোথা থেকে ফিরছে জানা নেই। জানতেও ইচ্ছে করে না। শৈশবের সেই বন্ধুত্ব বুঝি নাগরিক ব্যস্ততায় সে কবে ভুলে গেছে। আমারও বা কিসের ঠেকা। ভীষণ অভিমান হয় আমার। পুরনো স্মৃতি কেউ ভুলে গেলে আমি কেন পারবো না ভুলে থাকতে।
কিন্তু তার দেয়া গন্ধরাজ চারাটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ রইলাম তার দেয়া গন্ধরাজ গাছটার জন্য…।

মৃত্যুর হালখাতা

মৃত্যুর হালখাতা দিয়ে
বর্ষের নবত্বের হুংকার !!

বোবা চোখ…
অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুশিকলে আবদ্ধ আজ গোটা পৃথিবী..

চারিদিকে দুর্ভিক্ষ,
ধুঁকে মরা মনুষ্যকঙ্কাল গুলোকে
নিত্যদিন গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে-
কষ্টকল্পিত গণলাশের সেই শুনশান নেক্রোপোলিস….

-অনন্যা
বর্ষশুরুর ১ম প্রহর ১৪২৭

আত্মার মাগফেরাত

আত্মার মাগফেরাত

মামা দুইডা ট্যাকা দেন। মামা দুইডা ট্যাকা দেন। এভাবেই বারবার বলে বলে পিছু পিছু ঘুরছে ছেলেটি। তখন আমি ওভারব্রিজ সিঁড়ির এক কোণে কোণঠাসা হয়ে বসে আছি। আর কান্ডকারখানাগ দেখছি। শেষ পর্যন্ত…।
লোকটি (যাকে মামা বলে সম্মোধন করলো) পাশের দোকান থেকে একটি স্পীড ড্রিংকস, দুটো পটেটো ক্র্যাকার্স, একটি মিঃ টুইস্ট ও একটি পানির বোতল কিনে ব্যাগের ভিতর রাখলো। তবে হাতে রাখা স্পীড ড্রিংক্সের বোতলটি খুলে পরক্ষণেই পান করতে শুরু করলেন। ততক্ষণ অবধি ছেলেটি লোকটির পিছনে পিছনে রয়েছে। আর বলছে – মামা দুইডা ট্যাকা দেন। মামা দুইডা ট্যাকা দেন।
হাত বাড়িয়ে চাইলেও কোন ফায়দা হচ্ছিল না। লোকটি বারবার ছেলেটিকে বলছিলো – টাকা হবে না। চলে যা। তবুও ছেলেটি কিছুতেই লোকটির পিছু ছাড়ছিলো না। লোকটি যেখানেই যাচ্ছিলো সেখানেই…।
আমি নিজেও ততক্ষণে উঠে তাদের পিছনে পিছনে হাঁটছি। আর দেখতে চেষ্টা করছি কি ঘটনা ঘটে?
স্পীডের বোতলটি ফেলে দিতেই ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে বোতলটি বারবার ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে খেতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ফাঁকা বোতল থেকে কি আর…।
তারপর আবার ছেলেটি হাত বাড়িয়ে সামনে ঘুরাঘুরি করছিলো। কিন্তু তখনও লোকটির মন গলেনি দুটাকা দিতে। লোকটি ছেলেটিকে বললো, যাবি। নাকি মাইর খাবি।
ছেলেটির মুখভার। ফিরে আসতেই মুচকি হাসি হেসে আমার দিকে হাত বাড়ালো। পকেটে একটি পাঁচ টাকার কয়েন ছিলো। ছেলেটির হাতে দিতেই মুচকি হেসে দৌড়ে চলে গেল।
আমি তখনও লোকটির পিছনে। দেখলাম লোকটি ১২ টাকা দিয়ে সিগারেট কিনে হাঁকিয়ে টানছে।
হতভম্ব হয়ে গেলাম। গাড়ি এক্সিডেন্টে জীবন যেমন থমকে যায় তেমনি। রেলস্টেশন/এয়ারপোর্টের দোকানগুলো থেকে অনেকেই নিদিষ্ট মূল্যের চেয়ে তিন টাকা বেশি দিয়ে ড্রিংকস, দুই টাকা বেশি দিয়ে চিপস আর চার টাকা বেশি দিয়ে সিগারেট কিনে টানতে পারে। কিন্তু পকেট থেকে দুই টাকা দিয়ে অবুঝ ছেলের চোখ ভরাতে পারে না। বৃদ্ধ বয়সী দাদি – ঠাকুমার মুখে হাসি ফুটাতে পারে না।

তৃপ্তি অতৃপ্তির গল্প

‘ভাই শুধু টাকা জমিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে রাখে, ইন্সুইরেন্স করছে, ডিপিএস আরও কতকিছু।’
‘না রেখে উপায় নেই। ছেলে সন্তান হয়েছে। কিছু না রেখে পিতাকে গালি দিয়ে বলবে আমাদের কি করেছো?’
‘আমি ভাই কিছুই রাখবো না। আল্লাহ যা রাখে কপালে।’
‘শুনুন, আমাদের বাপমায়ের সামর্থ্য ছিলো কিছু দেওয়ার। এমনকি আমাদের সময়ে আমরা স্কুলে গিয়েছি কিনা তারও কোন খোঁজখবর নিতো না। আর এখন…।’
‘হুম, এটা একদম ঠিক কথা বলেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে তোমার বাবার কিছু ছিলো না বলে তোমাকে কিছু দেয়নি। কিন্তু আমার বাবা! আমার বাবা সরকারি চাকরি করে।’
‘তাহলে ভেবে দেখুন। টাকা না জমিয়ে কি করবো? দিনশেষে সন্ধ্যা ঠিকই নামে।’
‘হুম ভাই। এখন থেকে আপনার মতো…!’
‘আরে! উঠে যাচ্ছেন কোথায়? বসুন। একটা গল্প বলি।’
‘আচ্ছা, বলুন।’
আমেরিকার কোন এক বিখ্যাত হোটেলে বিল গেটসের মেয়ে খাবার খেতে গিয়েছে। অবশ্য সে হোটেলের ওয়েটার থেকে শুরু করে অনেকেই তাকে চেনেন। এবং তাকে নিয়ে বলাবলি শুরু করলো যে এই মেয়েটিই হলো পৃথিবীর একমাত্র ধনীর মেয়ে।
খাবার দেওয়া হলো। খাবার খেয়ে খাবারের মূল্যসহ ৫০০ ডলার ওয়েটারকে বকসিস দিয়ে বের হয়ে গেলো।
ঠিকই একই হোটেলে বেশকিছু দিন পর বিল গেটস নিজেও খাবার খেতে হাজির হলো। এবং যথারীতি সবাই বলাবলি শুরু করলো এই ব্যক্তিই পৃথিবীর এক নাম্বার ধনী। যার কোন কিছুর অভাব নেই।
খাবার দেওয়া হলো। খাবার খেয়ে খাবারের মূল্যসহ… ডলার ওয়েটারকে বকসিস দিয়ে বসে মোবাইল টিপতে শুরু করলো।
ওয়েটার খাম থেকে মূল্যসহ বকসিস বের করে অবাক /তাজ্জব হয়ে গেলো। এবং কিছু প্রশ্ন এসে তার মনের মন্দিরে ভিড় করলো।
অবশেষে বুক অবধি সাহস নিয়ে বিল গেটসের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে রইলো। বিল গেটস জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু বলবেন কি?’
ওয়েটার বলল, ‘জ্বি স্যার। একটা প্রশ্ন ছিলো।’
বিল গেটস, ‘ঠিক আছে। বলুন।’
ওয়েটার, ‘স্যার, কিছুদিন আগে আপনার মেয়ে এসেছিলো এখানে। এবং খাবার খেয়ে খুশি হয়ে আমাকে ৫০০ ডলার বকসিস দিয়ে গেছেন। অথচ, আপনি পৃথিবীর ১ নাম্বার ধনী হয়েও আমাকে মাত্র ৫ ডলার বকসিস দিলেন।’
বিল গেটস, ‘আপনার এখানে যে এসেছিলো তার বাবাকে চেনেন? তার বাবা হলো পৃথিবীর ১ নাম্বার ধনাঢ্য ব্যক্তি। এজন্যই সে আপনাকে ৫০০ ডলার দিয়েছে। আর আজকে যে এসেছে তাকে চেনেন? তার বাবা ছিলো দিনমজুর। সে আপনাকে ৫ ডলার বকসিস দিয়েছে এটা আপনার সৌভাগ্য।’

মামুনের অণুগল্প : বালিকা

“পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”*

আমাদের এই বালিকাও আজ ক’দিন তীব্র যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছ। নিজেও সে সেটা বুঝে কি? তবে কিছু একটা যে হয়েছে, বয়ঃসন্ধিজনিত অনুভূতির প্রগাড় অনুভবে বিদীর্ণ হবার চেয়েও বেশ তীব্র এই নতুন অনুভব। কেমন জ্বালা ধরায়, পোড়ায়। হৃদয় বলতে কিছু একটা যে শরীরের ভেতর ওর অজান্তে ওকে হৃদয়বতী করে তুলছে… একটু একটু… পলকে পলকে, এক গোপন শিহরণ নতুন চরের মত জেগে উঠা হৃদয়ের শূন্য প্রকোষ্ঠে গেড়ে বসছে! যা ওকে দোলায়, ভীত করে, আবার কাছে টানার মত ভদ্রগোছের দূরত্ব ও রেখে যায়।
যেন এক নিষিদ্ধ লোবান!

স্কুল ফেরত বালিকা নির্জন মাঠ ঘেসে বাড়ি ফেরার পথে আজকাল বড্ড নীরব। সাথীদের পথচলতি টুকরো খুনসুটি আর কলরবও কেন জানি বালিকার মৌনতায় ফাটল ধরাতে পারেনা।

নিজের বাসায় ফিরতে প্রথম যে মোড়টি পড়ে, চা’র দোকানটিকে ঘিরে ইদানিং দুষ্টু ছেলেদের বড্ড আড্ডা। এরা নতুন সিগ্রেট ফুঁকতে শিখেছে। আর বালিকাদের স্কুল যাবার এবং ফিরে আসার সময়গুলিই ওদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়। ওরা নিজেরাও কি তা জানে?

দলটির সামনে এসে, পথ চলতি বালিকার গতি বুঝি একটু শ্লথ হয়! সে কি থামতে চায়.. এক পলক? এই উঠতি রোমিওদের ভিড়ে সে রয়েছে। এক পাশে বসা। সাধারণ একজন ‘সে’। বালিকার কাছে ইদানিং তাকে কেন জানি ‘অসাধারণ’ কিংবা এর থেকেও ভারী কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয়, যা অনুভূতির গভীর থেকে বালিকার নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।

সবার ভিতরে থেকেও সৌভাগ্যবান বালক, বালিকার শান্ত দীঘির অশান্ত জলরাশির মাঝে জ্বলে ওঠা এক পলকের স্পর্শ পায়। একটু দেখতে ইচ্ছে করে বালিকাকে! মনের সম্পূর্ণ জোর খাটিয়েও সে তাকাতে পারে না।

বালিকা কি একটু আহত হয়? চলার গতি কি তার একটু বেড়ে যায়? হবে হয়ত।

বালকের জীবনও আজ ক’দিন ধরে এমনই এলোমেলো। মায়ের পিছু ঘুরঘুর করা ছোট্ট বাবুটি এখন না থাকলেও, মাকে কেন্দ্র করেই চলে ওর জীবন। কতটুকুই বা? তবুও তো জীবন! হৃদয় আছে তো। বালকও কি হৃদয়বানে পরিণত হওয়া শুরু করল? এরকমই কিছু একটা হবে, বালক অজান্তে অনুভব করে মনের বাইরে থেকে? ভিতরে উকি দিয়েও যে দেখা যায়, সে তো আর তা জানে না।

তবে মায়ের মা মা ঘ্রাণ কে ছাপিয়েও এখন অন্য এক ঘ্রাণে আবিষ্ট এই বালকের মন। বালিকাকে ঘিরে সময়গুলো কাটে তার এখন। কত কি যে ভাবে! অনুভব করে… কিন্তু নিজের অনুভবগুলোকে প্রকাশ না করতে পারার যন্ত্রণায় থেকে থেকে নীল হয়। স্কুল পলাতক এক মেয়ে যেন বালিকা। ওর সামনে এলেই বালকের জগত কেমন নিরব হয়ে যায়। কিন্তু অন্তরে তার নিরন্তর এক ঝড় বয়েই চলে…

‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে’*

বালিকার সামনে নিজের আজকের ভীরু মনোভাব, বালকের পাগল মনকে আরো পাগলা করে দেয়। সবার মাঝে থেকেও সে নিরব চীৎকারে হৃদয়ের অধিপতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘এতো কষ্ট নিয়ে আমি হৃদয়বান হতে চাইনা। তোমার হৃদয় ফিরিয়ে নাও।’

হৃদয়ের অধিপতিও ততোধিক নীরব থাকেন।

বালিকা বাসার সামনে। ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে চায়। কাউকে কি দেখা যায়? বালিকার ফেলে আসা পথে কি কারো থাকবার কথা? নিজের মাংসল হৃদয়ের বড্ড কাছে এক নীলখাম… বালিকার হৃদয়ের গোপন কিছু অনুভব রুদ্ধ দুয়ার খুলে, অক্ষরে রুপ নিয়ে বালক হৃদয়ের পরম আরাধ্য জায়গায় সযতনে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়! কিন্তু হৃদয়ের বহু গভীর থেকে কি এক জ্বালাময় অনুভবে জ্বলছে বালিকা। তাই হৃদয়ের বাহিরের মাংসল হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকা নীল খাম, বালিকাকে বাইরে থেকেও অস্থির করে।

ভালোবাসার অনুভবে ক্রমশ: পূর্ণ হতে চলা এক বালিকা, ভেতরে-বাহিরে ভাঙতে থাকে… প্রথম প্রেমের সর্বগ্রাসী আগুন জ্বলে… বালক হৃদয়কে সেই আগুনে অবগাহন করিয়ে, দুই হৃদয়ের কষ্টগুলো ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে, কাছে থেকে পরখ না করলেই যে নিজেকে সে গড়তে পারবেনা। নিজেকে পুণর্গঠন কি খুবই জরুরী?

তাই দুই হৃদয়ের অধিকারিনী বালিকা মুখ ফিরিয়ে সামনের পানে তাকায়। এক আদিগন্ত রহস্যকে ধারণ করে মুহুর্তে বালিকা যেন বড্ড রমণীয় হয়ে ওঠে! বালিকা কি অপেক্ষা করবে? বালিকারা কি অপেক্ষা করে?

প্রথম প্রেম আস্বাদনকারী আমাদের এই বালিকার কি জানা হয়ে গেছে, সে এক নারী। নদীরা কখন নারী হয়? কিংবা নারীরা নদী?
যখন নদী ও নারী ভালোবাসার কথা বলে, তখন কি?

______________________________
** কোট করা লাইনগুলো কবিগুরু রবি ঠাকুরের।
#বালিকা_মামুনের_অণুগল্প

নুপুরের বিছানা

হাউমাউ করে কান্নার শব্দ কানে এসে ভিড় করলো। ততক্ষণে কলিজা শুকিয়ে তেঁতুল পাতা হয়ে গেছে। যার চির চির শব্দ বুকের মধ্যিখানে ধুকপুক ধুকপুক ঢোলের কম্বিনেশনে আহাজারি পায়চারি করছে।

বেশকিছু দূরে কেউ একজন কথা বলছে। মুখটা মিষ্টিমুখ, মিষ্টি হাসিতে ভরা। যেন নিয়ন আলোর বাতির ঝলকানি চোখেমুখে লেগে রঙিন হয়ে গেছে। আকাশে ফানুস উৎসব আয়োজনের মতো। যেখানে কোন ভেদাভেদ নেই।

– হাসপাতালের একই গেইট দিয়ে মানুষ মরে লাশ হয়ে বের হচ্ছে; আবার অন্যদিকে মিষ্টির প্যাকেটও ঢুকছে।
– কেউ গোরস্তানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে; আবার কেউ পৃথিবীর আমন্ত্রণে দাওয়াত পাচ্ছে।

– কি অদ্ভুত! তাই না?

ছবিঃ সংগৃহীত

কমলা রঙের রোদ

লম্বা চাদর মুড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতির আলোয় সিগারেটের বিবর্ণ ধোঁয়ার জালে ফেঁসে উশখুশ রূপে বসে আছে। উসকোখুসকো চুল দাঁড়ি, হাতে রংবেরঙের ব্রেসলেট, ময়লা জরাজীর্ণ জীর্ণশীর্ণ জিন্স প্যান্ট ফতুয়ায় চেনার উপায় নেই। বিদঘুটে অবস্থা।
কি রে! কি হয়েছে তোর? বিকেল থেকে কোন খোঁজখবর নেই। হাঁড়িতেও দেখলাম ভাত রয়েছে।
– আর খোঁজখবর। খোঁজখবর দিয়ে কি হবে?
আবার ব্রেকআপ হলো নাকি?
– সে তো রোজ সন্ধ্যায় সিগারেটের সাথে হচ্ছে। প্রতি সন্ধ্যায় ভাবি আজ থেকেই…।
হুমম, বুঝেছি। ঝগড়া হয়েছে। আমি দেহুড়ীর সাথে কথা বলবো।
– কথা বলে কোন লাভ হবে না। একটা বেকার ছেলে…। তাও আবার কবি হতে চাই। তার সাথে কি…?
বুঝেছি। গাঁজাও…। চল, রুমে চল। রুমে বসে…।
– প্রেমে তো পড়েছিস। তোকে একটা ফ্রি-তে উপদেশ দেই। মনে রাখবি- প্রিয়তমা ভালো হলে প্রতিদিন প্রতি রাতই ১৪ই ফেব্রুয়ারি। আর না হলে প্রতিদিন প্রতি রাতই ২৫শে মার্চ।

প্রিয়তমার পিছুপিছু প্রেম

প্রেমের রশ্মি ধরে বেয়ে বেয়ে উঠতে গিয়ে কাঠগোলাপের কাঁটায় বুকের বাঁ পাশের কুঁড়েঘরের ছাউনি ভিটায় ক্ষত-বিক্ষত কিছু আঘাতের চিহ্নে এখনো প্রিয়তমার স্মৃতি ভেসে ওঠে। আর স্মৃতির খামখেয়ালি পদচারণে প্রায়শই অজ্ঞান অবচেতনে সূর্য স্নানের স্নিগ্ধতায়ও নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে মগ্ন নেশায় ছোবল দিতেও কুণ্ঠিত বোধ হয় না।

ব্রেকআপের বেতের আঘাতে ব্যথিত হৃদয়াকৃতি ডিম্বাকৃতির রূপে পথভ্রষ্ট হলেও নির্দিষ্ট যাত্রী ছাউনির ছায়াতলে ওতপেতে থাকে প্রিয়তমার মুখদর্শনে স্ব শরীরে হাজিরা দিতে। কিন্তু ২২ বছরের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রিয়তমার ছায়াতো তো বটে পায়ের ধুলোর কুচকাওয়াজও মেলেনি। তবে বিষন্ন ভগ্নদেহ ভগ্নহৃদয় শরীরের মাংসপেশি কিংবা হাড্ডি-গুড্ডির আড়ালে কলিজা টুকুও এখনো অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। না হলো মুখোমুখি মুখপানে তাকিয়ে দৃষ্টি আদান-প্রদান।
ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে কিংবা রংবেরঙের রঙিন নিয়ন বাতির আলোর ছায়াতলে প্রেমিক প্রেমিকার অট্ট হাসির ঢোল পেটানো শব্দে কতো সন্ধ্যে যে সকালের সূর্য দেখে দুমড়ে মুচড়ে গেলো তার হিসেব নেই। হিসেবের অপবিত্র অপব্যবহারে দর কষাকষি করেও যখন হা-হুতাশে রোজরোজ ভুগে ভুগে শুকিয়ে ঠোঁটেঠোঁটে নড়বড়ে তখন অবধিও এপথে প্রিয়জনের অপেক্ষায় বসে।

হলুদ গোলাপ, লাল গোলাপ তার ভীষণ পছন্দ ছিলো। সে এতো আদরে গোলাপের সুগন্ধি শুঁকে শুঁকে বিমুগ্ধ হতো সে দৃশ্য চোখের পর্দায় ভেসে উঠতেই মুচকি মুচকি হাসিতে টোল পরে। আর আমি ডুবে ডুবে ভেসে উঠি তার প্রেম জোয়ারের নিমন্ত্রণে।

গতকাল সন্ধ্যায় সে এসেছিলো। নীল রঙের শাড়ি, ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক, হাতে রংবেরঙের কাচের চুড়ি আর খোলা চুলে। যে চুলের ডগায় ডগায় আমার আঙুলের ছোঁয়াচে ছোবল এখনো কিলবিল করতে দেখলাম। তার সাথে টেঁকো মাথার একজন মধ্যবয়সী পুরুষও ছিলো।
“আমি বলেছিলাম – তুমি যদি অপেক্ষা করতে পারো তবে দুই যুগ পরে হলেও দেখা হবে ”
“হুমম, আমিও তো অপেক্ষা করছি “।
সে কয়েকটি গোলাপ নিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে দাম দিতে চেয়েছে।
আমি বললাম – গোলাপের টাকা বুক পকেট থেকে কখনো ফুরাবে না। জানো… আমার প্রথম মেয়ের নাম কি?
কি?
গোলাপি।
বিয়ের দাওয়াতে যেতে পারিনি সেদিন। তবে উপহার কিনতে ভুল করিনি। এখনো রোজ সকালে পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি আর রোজ সন্ধ্যায়…।
“তোমাকে পড়িয়ে দেই”
“হুমম, তবে সাবধান। বুড়োটা যেন না দেখে “।
শেষমেশ তবে সাধ মিটলো। ২২ বছরের অপেক্ষার সাধ। আবার কবে আসবে?
“এখন থেকে রোজরোজ”

হিমু এবার সিনেমাহলে

ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে, আমার নামটি…। গান বাজছে। বারবার বাজছে। ক্রমাগত বাজছে। গানটি শুনতেও বেশ ভালো লাগছে। শুধুমাত্র এই একটি গান শুনলেই বারবার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে প্রিয়তমার হাতে দুহাত রেখে মুখপানে চেয়ে থাকি অজস্র বছর। অজস্র বছরের সময়গুলো যেন তখন থেকেই ফ্রেমে বন্দী হয়ে স্তব্ধ নামক খাঁচায় বসবাস করে। আর আমরা দুজনে…।
প্রেম ক্রিকেটের মাঠে হিমু সদ্য ফোঁটা ফুলের টবে ফুলের পাপড়ি। যার শিরা-উপশিরায় প্রেমের অনুভূতিরা আত্মগোপনে খেলা করে। আর মিটমিট করে হেসে হাসির জালে ফেঁসে ফেঁসে চাঁদমুখের ছবি হয়ে আয়নায় ভাসে। এজন্য হয়তো রবিঠাকুরের এই গানটি রোজরোজই বাজে।
হিমুকে বললাম – লেখা শেষ হলো?
হিমু – হুমম, শেষ হলো।
– তাহলে আমাকে দে। পড়বো। দেখি আজ কেমন রসের যৌবন ভরা গল্প লিখেছিস?
হিমু – ঐ, প্রতিদিনই যেরকম লিখি। সেরকমই।
– ঠিক আছে। সমস্যা নেই। তোর সর্বপ্রথম পাঠকতো আমি নিজেই।
হিমু একটু ইতস্তত বোধ করছিলো। আমি জোড়াজুড়ি করাতে অবশ্য ডায়েরিটি শেষমেশ দিতেই হলো। অবশ্য হিমু জানতো আমাকে ডায়েরিটা না দিয়ে রেহাই নেই। কেননা…।
অনিচ্ছা থাকা সত্বেও প্রিয়জনের কথা রাখতে বাধ্য হতেই হলো। এরকম নিয়মনীতি অনুসরণ ঘাড়ে ভর করলে অসহ্য অহর্নিশেও ভাঙা-গড়া রূপ-প্রতিরূপের সম্মুখীন হতে হয়। তখন বুকের ভেতরে ভালোবাসা নামক শব্দটিও কিছু সময়ের জন্যও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
বাস থেকে নেমে সিনেমাহলের সামনে দাঁড়াতেই লজ্জায় বুক ফেটে রক্তক্ষরণ হওয়ার উপক্রম। বারবার মনে হচ্ছিল ভিনদেশী বোমায় আহত দেহের হাড্ডি-গুড্ডির তলে লুকিয়ে থাকা হৃৎপিণ্ডটুকুও আজ বেশরম, চক্ষুলজ্জায় কাবু। আর দু-চোখ মাথানিচু করা স্বভাবের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে অন্ধ ঘরে বন্ধ হওয়া বিদ্যুৎ বাতি। যেন কোনকিছুই স্বচক্ষে দেখিনি।
টিকেটটিও আমাকে কাটতে হলো। এই ধস্তাধস্তি জাবরদস্তির জীবনে অর্থসংকটের অসংকোচেও নিজেকে মানিয়েও নিতে হলো। নইলে যে ব্যক্তি সম্মানের বাকিটুকুও বিলীন হতে শুরু করে। আর হাসাহাসির পাত্র হতে কারোই শৈথিল্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে ইচ্ছে করে।
উমা! সিনেমাহলের বক্সের সিট কিংবা ডিসি সিটের সবগুলোই প্রেমিক প্রেমিকাদের দখলে থাকে। বিশেষ করে একদম পিছনের সিটে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকারা বুঝি কাতুকুতুর চেয়েও কাছাকাছি থাকে। আর তাদের ফিসফিস করে কথাবলা আর অঙ্গভঙ্গির দৃশ্যগুলো দৃষ্টিতে এসে ভিড় করে শরীরের অবস্থা কোষ্ঠকাঠিন্যের দুরারোগ্য ব্যাধির মতো পিছুপিছু ঘুরঘুর করে। রুপা অবশ্য কাঁদে মাথা রেখেছিলো।
রুপাকে বাসে তুলে দিয়ে বাসায় আসতে অন্য বাসের সিটে বসতেই কিছু প্রশ্ন এসে মনের পাড়ে জমাট বেঁধে লাফালাফি করতে শুরু করলো। প্রশ্ন… – হিমুরা কি সিনেমা দেখে?
শেষমেশ তবে সিনেমাহলের সিটের চিপায় হিমু পৌঁছালো। কথাটা শুনে হিমু বললো – সত্যি বলছি, আমি রুপাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আসলে পৃথিবীর সকল প্রেমিকারাই জেদি।
আচ্ছা, তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ সবাই যদি জানে হিমু সিনেমাহলে….। তাহলে কি ভাববে?

প্রিয় প্রিয়তমেষু প্রিয়তমার নাম

ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো হিমু। কান্নার শব্দে রান্নাঘর থেকে বুয়া বেরিয়ে এসে বললো – মামা, কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?
কিন্তু কিছুতেই হিমুর কান্না থামছে না। আবার কোন কথাও বলছে না। শুধু খাবারের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে রয়েছে।
বুয়া গিয়ে অতনুকে ব্যাপারটা খুলে বললো। অতনু সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো – কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? খাবার না খেয়ে সামনে রেখে কাঁদছিস যে।
তারপরও হিমু কেঁদেই যাচ্ছিলো। কোনক্রমেই থামানো যাচ্ছিলো না।
কিছুক্ষণ পরে হিমু একটু শান্ত হয়ে বুয়াকে ডেকে বললো – খালা, খাবার নিয়ে রেখে দেন। আমি খাব না।
অতনু বললো – কেন রে? খাবি না কেন?
হিমু বললো – ডিম দিয়ে খাবনা।
অতনু বললো – ডিম আবার তোর কি ক্ষতি করলো?
হিমু বললো – কেন তুই জানিস না? আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম তার নাম ছিলো কুসুম। যে আমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে।
কিছুদিন পর আবার সেই কান্না। হিমু কাঁদছে…।
অতনু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলো – ছেলেটি ডিম দেখলে আজও কাঁদে। কারণ মেয়েটির নাম ছিলো কুসুম।

ছবিঃ সংগৃহীত

মধ্যবিত্ত কর্তাবাবু

মধ্যবিত্ত কর্তাবাবু

টানাটানির মধ্যবিত্ত সংসারের চালক কর্তাটি বিজ্ঞানের বিস্ময়, অর্থশাস্ত্রের রহস্যময় গণিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি একমাত্র তিনিই পরস্পরবিরোধী তত্ব ‘সার্ভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ আর ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’র প্রকৃষ্ট উদাহরণ, দেওয়ানবাগী আর মার্ক্সবাদীর সুষম সমন্বয়।

সংসারের চাকা টানতে টানতে কর্তাটি স্বৈরাচারের মত শিখে ফেলেন কোথায় চুপ থাকতে হয়, কোথায় সরব, কোথায় চালতে হয় গুটির চাল। মাছ বাজারে দরদামে যতটা উচ্চকণ্ঠ ও আপোষহীন, বাকীর খাতা খোলা মহল্লার দোকানে তিনি ততটাই ম্রিয়মান, বিনয়ের সাক্ষাৎ অবতার। পাতে পরা মাছের টুকরোটি পালা করে সন্তানদের পাতে তুলে দেবার চালে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। মাসের কত তারিখে বেতন না পেলে দুনিয়া নরক হয়ে যাবে তা মনে রাখলেও দুনিয়া বদলে দেবার লালিত স্বপ্ন ভুলে গেছেন ঘাড়ে জোয়াল পরার দিনে। দৌড়বিদ বা ছানিচোখের বৃদ্ধের মত, যখন যেভাবে প্রয়োজন- এড়িয়ে যান ডাস্টবিন ও দাবির মিছিল। তিনি দারুণ উন্নাসিক। এই উন্নাসিকতা অভিজাত, যেনো নিশিকাণ্ডে নির্বাচিত সাংসদ এড়িয়ে যাচ্ছেন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা।

মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারের দঁড়িতে হাঁটতে হাঁটতে কর্তাটি শিখে যান অত্যাবশ্যকীয় যোগ ব্যায়াম, প্রণায়াম। ঘাড় উঁচু করে পত্রিকার পাতা, সন্তানের পরীক্ষার রিপোর্টকার্ড, পুরানো শার্টের কলারের দাগ চোখের সামনে ধরে দেখেন, ওই উঁচু ঘাড়টিই বুক পকেটে গুঁজে নেন বাসের ভেতর, বসের সামনে, সকল অক্ষমতার মুখোমুখি বসে। সংসারের, পোষ্যদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তার মত মন্ত্রবিদ আর নেই– তিনি জানেন কোন খাবার সস্তা হলেও পুষ্টিকর, অধিক খাদ্যে কতটা স্বাস্থ্যক্ষয়, কোন রোগে কোন ওষুধ। টানাটানির সংসারের কর্তা নন, মন্ত্রী এক, কে না জানে মন্ত্রী মাত্রই সর্বজ্ঞ, সর্বজ্ঞানের পাইকারি ও খুচরা আড়ত।

ম্যাজিশিয়ান জানেন না- কিভাবে দু’টো শার্ট আর তিনটা প্যান্টে পার করে দিতে হয় পাঁচ ছ’বছর, শুক্রবারের জুম্মার জামাতে কিভাবে লুকোতে পাঞ্জাবীর বোগলের নিচে সেলায়ের দাগ, এক জোড়া জুতোয় কাটাতে হয় বছরের পর বছর। এসব ম্যাজিক মোটেই সহজ নয়, অথচ হাততালির প্রত্যাশা না করেই কি অবলীলায় দেখিয়ে যান কর্তা। মাসিক ১০টাকা আয় দিয়ে কিভাবে চালাতে হয় ১০০টাকার সংসার- এই মন্ত্র তিনি ছাড়া আর কেই বা জানেন!

এক একটা দিনে, এক একটা রাতে, এক একটা দিনের বা রাতের এক একটা মুহুর্তে আপন দীর্ঘশ্বাস গিলে কর্তা ভাবেন- আর তো লাগেনা ভালো এই ম্যাজিশিয়ানের জীবন, যোগ-ব্যায়ামের কৌশল। মরার আগে এ জীবনে আসুক সুদিন। আহা শরীরে জমুক কিছুটা মেদ, রক্তে বাড়ুক কোলেস্টেরল।

হিমুর হাতে নীল রঙের মাফলার

বাড়ি থেকে ফিরছি। বেশ কয়েকদিন খোলা আকাশের ক্যানভাসের কাপড় পরে, শান্ত গাঙের অথৈজলের শিহরণে শিহরিত হয়ে, খেজুর রসের পায়েসে ভেসে ভেসে ঢেউ খেলেছি। এ যেন মাতৃত্বের টান, শিকড়ের টানে নীড়ে ফেরার তাগিদ। মেঠোপথের দুপাশে রশি বেঁধে পিছুপিছু হেঁটে হেঁটে কাশফুল, কচুরিপানায় দুচোখ বন্ধ করে সুদীর্ঘ নিশ্বাস নেওয়া।

হিমু বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিল। কবে আসছি, কবে আসছি ঘ্যানঘ্যান শব্দের অন্তরালে সময়গুলো কিছুটা বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে ভুগলেও যখন নৌকার পাল তোলা মেঘ উড়ে উড়ে অচেনা অতিথি হয়ে আমার কাছে থেমে যেতো তখন এই ভগ্নদশা ভগ্নদেহটুকুও কিঞ্চিৎ ফটোসেশানে ফুরফুরে নিয়ন বাতির আলোয় জ্বলে জ্বলে পুলকিত করে তুলতো। আর তখন শহরের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা কিংবা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলটে আলো অথবা রিক্সার ছাউনি তুলে প্রিয়তমার সাথে ঘুরাঘুরিও বিবর্ণ হয়ে যেতো।

সাদা কালো ডায়েরির পৃষ্ঠার প্রতিটি লাইনে কথাগুলো লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমের শহরে নেতিয়ে পরেছিলাম সে সমন্ধে সন্ধিক্ষণের সন্ধানে ভুগে ভুগে সময়ক্ষেপণ না করাটাই শ্রেয়। কিন্তু এই অল্পস্বল্প ঘুমের বাড়ির উঠানে অবস্থানে সবেমাত্র প্রিয়তমার হাত ধরে প্রিয় কিছু শব্দের অণুগল্প রচনা করেছি, প্রিয়তমার মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে সবেমাত্র ঠোঁটের উষ্ণ আবরণের ছোঁয়াচে রোগে শীতল হবো ঠিকই বাসের হর্ণ এবং হঠাৎ করে থেমে যাওয়া স্বপ্নটাকে বিনষ্ট করে দিলো। চোখ খুলে দেখি গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।

হিমুকে দেখেই একঘেয়েমি অনুভূতির জীবন শুরু হলো। ঢাকা শহরে এরথেকে বেশি কিছু আশা করা বৈধ নয়। শুধুমাত্র প্রেমিকার প্রাক্তনের বেলায় অন্যরকম। এ-শহরে কে কয়টা রমনীর টিকেট হাতে নিয়ে ঘুরতে পারে সেটাই হয়তো মূখ্য।
হিমু বললো – তারাতাড়ি চল।
– কেন? হঠাৎ এতো তারাতাড়ি কেন?
হিমু – না, তেমন কিছু না। ওই আরকি।
– ওই আরকি? কোন কাজ আছে নাকি?
হিমু – হুমম, সেরকমই।
– তাহলে খুলে বললেই হয়।
হিমু – কি আর খুলে বলবো? রুপার সাথে…।
– হুমম, বুঝতে পেড়েছি। আর বলতে হবে না।

হিমুকে একটু অন্যরকম লাগছে। অনেকটা ফর্সা আর উজ্জ্বল চাহনি। পুরোদমে ফুরফুরে মেজাজ আর ফ্যাশন-সচেতনে। হিমু দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি যেতেই বলে উঠলো চায়ে চুমুক দে। এ শীতে চায়ের গরম ঘামে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলে কোন ক্ষতি নেই। বরং প্রিয়তমা নরম ঠোঁটের সৌন্দর্য দেখে খুশিই হবে।
হিমু চা খাচ্ছে আর মাফলার দিয়ে ঠোঁট মুছে মুছে কথা বলছে। ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অস্বস্তিকর লাগছে। এই অস্বস্তি নিয়ে হিমুকে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক মন পাড়ায় উঁকি দিলো – কি ব্যাপার! হিমু কাঁধে মাফলার? হিমুর তো এটা খুবই অপছন্দের। তারপরও আবার নীল রঙের মাফলার।
হিমু বলে উঠলো – কি এতো বিড়বিড় করছিস? নিশ্চয়ই আমার নীল রঙের মাফলার নিয়ে। তাই নয় কি?
– হুম, একদম ঠিক।
হিমু – রুপা আজকে দিলো।
– তোর না এটা অপছন্দের ছিলো।
হিমু – সবসময় নিজের পছন্দের দাম দিতে নেই। কিছু কিছু সময় প্রিয় প্রিয়তমেষু প্রিয়তমার ছায়াতলে নির্বাচিত কাকপক্ষী গল্পের নায়ক হওয়ায় ভালো।
– আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

হৃদয় পোড়া দগদগে ক্ষত

টিউশনিটা ছেড়েই দিতে হলো। নইলে যে ও কথার ভীড়ের মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে সুর প্রতীকীর সাঁজে নিজেকে সাজিয়ে ফেলতাম। আর নিজের তৃপ্ত কিছু অশোভন ইচ্ছেগুলো মনের নেশায় মাখিয়ে ছোবল দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করতাম না। কারণ, অল্প বয়সী মেয়েদের সম্মতি পেতে কাঠখড় পোহাতে হয়না। তারা নিজে নিজেই জ্বলে অন্যকে উত্তপ্ত করে।

সে প্রায়শই আমার বাঁশির সুরের প্রলোভনে লোভী লোভী প্রসংশা করতো। কখনো কখনো সে বাঁশির সুর রেকর্ড করে আমাকে শোনাতো। আবার কখনো কখনো গুনগুন করে ঠোঁটের ডগায় কিলবিল করে ভাসিয়ে নিতো। যাতে করে তার ঠোঁটের রসের রসাতলে রসায়নে রসায়িত হই। আবার কখনো কখনো হালকা বেগুনি রঙের টিশার্ট পরে, চুলগুলো এলোমেলো অগোছালো করে গালে হাত দিয়ে একপলকে চেয়ে থাকতো। কিছু বলতে গেলেই স্যার শব্দটি মাথার মগজে পেরেক ঠোকাতো।

সে প্রায়শই কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খুলে দিতো। চোখে চোখে চোখাচোখি আঁকিবুঁকি হতেই ওড়নার কোণা ধরে কামড়াতে কামড়াতে মুচকি হাসি হেসে চলে যেতো। যাবার সময় বলতো আপনি খুবই স্বচ্ছ ও সুন্দর দেখতে। সত্যি! রোজরোজ এই কয়েক ফোঁটা অক্ষরের মিলনে, কিছু অনুনয় বিনয় নম্রতায় আমি নিজেও প্রেম-পথের পৃষ্ঠার পাদদেশে প্রিয়তমেষুর সন্ধানে পথিক হয়েছিলাম।

শেষবার বিদায় নেওয়ার সময়। দুচোখ বেঁয়ে বেঁয়ে অশ্রু ফোঁটা পড়লো। বুকের হাড্ডি-গুড্ডির খাঁচার অন্তরালে সারবস্তু আবিষ্কার নামক কলিজা যন্ত্রটি ধুকধুক করতে লাগলো। তখন বুঝেছিলাম, আমিও প্রেমে পড়েছি। প্রেমে পড়ার আতরের আত্মারা সুগন্ধি মেখে আমাকেও সুভাষিত করেছিলো।
শেষবার সবেমাত্র দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে আসবো ঠিক তখনই পিছন থেকে প্রিয়মুখের প্রিয়জন সাপটে ধরে ফেলে। আমি বৈদ্যুতিক খুঁটির মতো দাঁড়িয়েছিলাম। এটাই যেন আমার আজন্ম পাপ। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা দায়ভার আমার শরীরের নয়, হৃৎপিণ্ডের।

বেশ কয়েকমাস ধরে অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল আসে, দুঃখী দুঃখী হৃদয় কাঁপানো মেসেজ আসে। যে মেসেজে আমি কান্নার আওয়াজ পাই, হাহাকার রোগের গন্ধ পাই। ফিরে যাওয়ার আকুতি অনুমতি মিনতি খুঁজে পাই। শুধু আমার কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর মেলে না। হিমুরা কয়বার প্রেমে পড়ে। একবার, দুবার নাকি…।

ছবিঃ সংগৃহীত

প্রিয় প্রিয়তমেষু পাখির বিয়ে

সিগারেটের আগুনে ঠোঁটের নীলাভ উষ্ণ আবরণে ছোঁয়াচে সুপ্ত মাংসপেশিগুলো কালচে বর্ণ ধারণ করছে। যার কালি দিয়েও হতো প্রিয়তমেষু পাখির কয়েকটি ছবির স্কেচ তৈরি করা যাবে নিমিষেই। নতুবা মাথার চারপাশের সাদা চুলগুলোয় কালো কালির প্রলেপ দেওয়া যাবে হরহামেশাই। হয়তো তখন পৃথিবীর অগুনিত পর্বতের মানুষেরা বলবে – হিমু পাগল হয়ে গেছে। আসলেই তো হিমু পাগল হয়ে গেছে।

গত কয়েকমাসে হিমুকে হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার লোভ লালসায় ক্ষুধার্ত ছিন্নমূল মানুষের মতো লেগেছে। মনে হচ্ছিল – সামনে যা পাবে কোনরূপ সাড়াশব্দ না করে সোজাসুজি ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু, তবুও কি কোন নিস্তার আছে। ছিন্নমূল এ জীবন সস্তার ভিড়ে আরও অনেক পথভ্রষ্ট কিংবা পথিকের সাড়াশব্দ দেখে পায়ের তালু থেকে কলিজা অবধি শুকিয়ে যায়। যেখানে চাকরি পাওয়াটা আর কঠিন।

শেষমেশ হিমুকে শুধু শুনতে হলো বকুনিঝকুনি। ওর লেখার বিষয়বস্তুকে নিয়েও কটাক্ষ করে ডাস্টবিনের স্তুপে সুস্পষ্টভাবে সংস্পর্শে ফেলে দেওয়া হলো।
প্রিয় প্রিয়তমেষু পাখির আঘাতটা চাবুক হয়ে দেহের কাহিনিতে তখনই লেগেছিল হিমুর। সহ্যশক্তির অপার সৌন্দর্যে রক্তবমি হলেও, চোখের ভীড়ে ভীড়ে অশ্রুসজল গড়াগড়ি করলেও কোনকিছু বলার সাহস জোটেনি।

বাসস্ট্যান্ডে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর বাতির ছায়াতলে রোজ সন্ধ্যায় সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ধস্তাধস্তি জাবরদস্তি হয় হিমুর। আবার কখনো সন্ধ্যে বুড়োর সাথে সন্ধ্যে তারার হিসেব কষতে কষতে রাত অবধি জেগে থাকার বাহানা খুঁজে পাওয়া অবচেতন হিমুকে প্রায়শই অজ্ঞান রূপে ছাঁদের উঠানে পরে থাকতে দেখা যায়।
হিমু হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দিন তিনেক হলো। ডাক্তার বলেছিল সিগারেট ছাড়তে কিন্তু সিগারেটের তীব্র নিন্দার নেশার ছোবলে পরে পরে আরও বেশি ঋণাত্মক সূচকে নেমে এসেছে।
মাস তিনেক পরে রপার সাথে হিমুর কথা হলো –
– হ্যালো, হ্যালো।
– হিমু চুপ করে শুনছে (কোন সাড়াশব্দ নেই)।
– হ্যালো, কি হলো কথা বলবে না?
– হুমম, বলো।
– কেমন আছো?
– জ্বি, ভালো আছি।
– আমি কিন্তু তোমার খবরাখবর রাখি।
– ও আচ্ছা। খুশি হলাম। আর কিছু…।
– জ্বি, আরও অনেক কিছু। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
– হুম, অবশ্যই।
– আচ্ছা, এখনো কি সিগারেট…?
– না।
– খুশি হলাম জেনে। অবশেষে আমার একটি কথা রাখলে।
– না, তোমার ধারণা ভুল।
– মানে?
– তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গাঁজা খাই।

ছবিঃ সংগৃহীত