বছর ২ আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানির বিশেষ একটা প্রজেক্টের ট্রেনিং ছিলো টানা ৬ দিন। আমাদের চিফ ট্রেইনারের নাম ছিলো মাহমুদ হাসান স্যার।
আমার সাথে আরও যারা ছিলো সবাই অন্তত একটা বিষয়ে বিরক্ত হতোই। সেটা হলো চিফ ট্রেইনারের দেরীতে আসা, আমাদের বলা হতো ৯ টায় আসতে আর প্রতিদিন চিফ ট্রেইনার আসতেন প্রায় সাড়ে ৯-টার পরে। প্রথম দুইদিন আমাদের মধ্যে কেউ কিছু বলেননি কিন্তু কতদিন আর এভাবে মেনে নেয়া যায়…? আমাদের মধ্যে একজন একদিন তার এই অভ্যাসের প্রতিবাদও করেছিলেন। জবাবে বলেছিলেন উনার আম্মা নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত আর প্রতিদিন উনাকে হাসপাতালে দেখে আসতে গিয়েই উনার দেরী হয়। সেদিন আমাদের সবারই কেন জানিনা তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে করুণা হয়েছিলো তারপর আর তার দেরী নিয়ে আমরা কেউ কিছু বলিনি।
লোকটার আরেকটি বড় সমস্যা ছিলো আস্তে কথা বলা, কী বলতো ঠিকমতো বুঝতাম না। আর মনে হতো নেশাখোর! এত বড় শিক্ষিত মানুষ আর এত বড় চাকুরীজীবী তার চেহারা এমন হবে কেন? চোখ কেন লাল থাকবে? এসব অবশ্য আমার ব্যক্তিগত ভাবনার অংশ ছিলো। সেদিন তার মায়ের কথা জানার পরে মনে হয়েছিলো লোকটা হয়তো মায়ের দেখাশোনা করেই এমন হয়েছে। বয়স হিসেবে লোকটার কমপক্ষে ৩/৪ বছরের একটা ছেলে/মেয়ে থাকার কথা ছিলো কিন্তু লোকটা নাকি বিয়েই করেনি তখনও। আর এর পিছনেও হয়তো তার মায়ের অসুস্থতা দায়ী ছিলো। লোকটার টাক মাথা দেখে আমরা মিটিমিটি হাসতাম, তাকে একবার একজন বলেছিলো স্যার আপনার ছেলে মেয়ে কতজন…? উত্তরে তিঁনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন আমি বিয়েই করিনি আর তার বিয়ে না করার কথা শুনেও আমরা হো হো করে হেসেছিলাম।
কথা ছিলো আমরা ট্রেনিং এর জন্য জনপ্রতি প্রতিদিন ৪০০ করে টাকা পাবো। টাকাটা শেষের দিন দেয়ার কথা ছিলো কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে লোকটা শেষের আগের দিন আমাদের জানালো তার কাছে নাকি স্থানীয় এক নেতা চাঁদা দাবী করেছেন। যার কারণে জনপ্রতি ট্রেনিং ভাতা কমে যাবে। আমরা তখন সবাই প্রতিবাদ করেছিলাম আর বলেছিলাম এসব আমরা বুঝতে চাইনা আমাদের যা পাওনা তা আপনাকে দিতে হবে চাঁদা আপনি কোথা থেকে দিবেন সেটা আপনার বিষয়। সবার তীব্রতর প্রতিবাদের মুখে উনি আর কিছু বলতে পারেননি বরং ভয় পেয়েছিলেন বেশি।
শেষের দিন আসার আগেই অনেকেই হিসেব কষে ফেলেছিলেন লোকটা হয়তো ভাগবে না হয় চাঁদার টাকা আমাদের হক্বের টাকা থেকেই দিবেন। শেষেরদিন ১০টা পার হয়ে ১১টা বেজে গেলেও মাহমুদ স্যারের কোন দেখা নেই, আদৌও তিনি আসবেন কিনা এমন একটা সন্দেহ আমাদের মনে ঝেঁকে বসলো। সময় তখন ১২টা পার হয়ে গেছে এসিসটেন্ড ট্রেইনার নিজেও সেদিন উনি আসলে উনার সাথে কেমন শিক্ষামূলক আচরণ করতে হবে আমাদের শিখিয়ে দিলেন। উনি বলতে বলতে এটাও বলে ফেললেন যে, “আপনারা শুধু গায়ে হাত তুলবেন না এছাড়া যা করা যায় করবেন।” এরমধ্যে চিফ ট্রেইনারকে ফোনের পর ফোন করা হচ্ছে রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা, পুরো রুমে যেন বিস্ফোরণ হবে হবে অবস্থা সবাই উনার নাম ধরে যে পারে বলে যাচ্ছে। উনি আজকে আসলে কে কী বলবেন আর কী করবেন এসব পরিকল্পনা আঁকছেন সবাই মনে মনে।
এরমধ্যে এসিসটেন্ড ট্রেইনারের কাছে ফোন আসলো যে, মাহমুদ স্যার রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছেন। খবরটা কেন যেন আমরা বাহানা মনে করলাম কারণ এসিসটেন্ড ট্রেইনারই বললেন আরে এক্সিডেন্ট একটা অজুহাত আর আমরাও তার কথায় সায় দিলাম ভাবলাম হয়তো সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছে আর সেটাকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে কিন্তু এর মিনিট ১৫ পরে যে খবর পেলাম তা অপ্রত্যাশিত ছিলো। আমরা যাকে এই কয়েকদিন ঘৃণা করলাম যাকে আসামাত্র কিভাবে অপমান করবো, শায়েস্তা করবো এই হিসেব আঁকছিলাম সেদিনের সেই এক্সিডেন্টে তার মৃত্যুর খবর আমাদের সবার মনে সেদিন শোকের ছায়া ফেলেছিলো আমরা কেন জানিনা খবরটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তার সমস্ত ভুল ত্রুটি ভুলে আমরা তাকে সেদিন দেখতে গিয়েছিলাম, তবে তিনি ততক্ষণে লাশ…!
আমার সেদিন সবথেকে বেশি কষ্ট হয়েছিলো তার ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের কথা ভেবে। আমরা সবাই কিন্তু ট্রেনিংয়ের ফুল ভাতা পেয়েছিলাম…!
আজকে কোথাও একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলার মৃত্যুর খবর শোনলাম তাই ঘটনাটা মনে পরে গেলো।
মাহমুদ স্যারের মায়ের কোন খবর আর পাইনি কখনো, আর এটাও জানিনা কতদিন তিঁনি একাকী বেঁচেছিলেন, কারণ মাহমুদ স্যারের ছোট ২ বোন ছিলো যাদের বিয়ে হয়েছে বেশ আগেই এবং একজন প্রবাসে থাকতেন তাছাড়া তার কোন ভাই ছিলোনা আর তাঁর মায়ের দেখাশোনা করবার মতো কেউই ছিলোনা…
.
২৪/০৬/২০১৯