বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

পথ

tyuiop

ঘর থেকে বের হই, প্রথম কদমের পূর্বে স্রষ্টার কৃপা কামনা করে এগোই পৃথিবীর পথে। … যে পথ গুলো জালের মতন ছড়িয়ে আছে। এক একটা পথ এক একটা মঞ্জিলের দিকে ছুটছে, কোন কোন পথ আবার ধূম্রজালের মতন, লেটানো, পেঁচানো; কোন অতীব ক্ষীণ আবার কোন কোন পথ বলিষ্ঠ, সুঠাম।

এসব পথে আমাকে চলতে হয়, দৌড়াতে হয়,কখনো কখনো পথের জড়তায় থমকে যেতে হয়। কখনো কখনো সইতে হয় পথের দাম্ভিকতা! আজকাল অনেক পথ দাম্ভিকতার গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বুকে নিজেকে এক মহা ত্রাস, মহা আগ্রাসী হিসেবে দাঁড় করাতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাকে এসব পথের পথিক হিসেবে একেক সময় একেক বোধ ভোগ করতে হয়। সে আমি ভুগি- নীরবে। মাঝে মধ্যে ভোগের তীব্রতায় কাঁকিয়ে উঠি, হাঁপিয়ে উঠি-

যে পথ গুলো আমার নিত্য চলার সঙ্গী কখনো কখনো সে পথ গুলোই ভীষণ অচেনা হয়ে উঠে। আমি হোঁচট খাই, পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াই। বেশ করে বুঝি আমাদের চির চেনা পথ গুলো এখন এত অচেনা যে- সে আর পথিকের মঞ্জিলে পোঁছে দেয়ার পথ থাকে না। এ পথ গুলো ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে, ফলে আমরা বাধ্য হই তার ইচ্ছের নর্দমায় গিয়ে পড়তে!

আমি সে নর্দমার গহ্বর থেকে আমার মঞ্জিলের দিকে তাকাই। ফেলে আসা ঘর- বসতি, সমাজ সংস্কৃতির দিকে তাকাই। পেছনের পথে আলো ঝলমলে ল্যাম্পপোস্ট গুলো আমার দৃষ্টি রেখা কে ব্যাঙ্গ করে, তীব্র উপহাস করে… তারও আগের পথ গুলো এবড়ো থেবড়ো মেঠো কাঁদাকর, অথচ কি অমায়িক মমতা মাখা, যেন পথিকের জন্য বুকের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করতে পেরেই সে তৃপ্ত!

আমি আহত হই, সামনের দুর্গম পথ পাণে তাকিয়ে ভীত হই। ভীতির নির্মমতায় কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হই, প্রচণ্ড রকমের ক্রোধ আর তীব্র এক স্পৃহা আমাকে ঘিরে ধরে, আমি বিপ্লবী হই। … আমি আমার পথের অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করি- “এখন কোথায় আছি?”

আমি চেষ্টা করি এই পথ সেই পথ থেকে দু’জন পথের সাথী খুঁজে নিতে। চেষ্টা করি একটি সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি বিনির্মাণে…
হায়!
এতো পথ, এতো পথিক, এতো জন স্রোত!
আমি তৃষিত মানুষের মতন একবার এক পথে ছুটে যাই, চৌরাস্তা, ত্রি মোহনায় দাঁড়াই। গলা ফাটিয়ে হাঁক ডাক দিই, হাত বাড়াই, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বপ্নের কথা বলি! একটি নির্মল ভোরের কথা শুনাই, আমি বোঝাতে চাই পথ চলার জন্য কারো করুণার প্রয়োজন নাই, কারো লাল চক্ষু সহ্য করার প্রয়োজন নাই।…

না, আমার কথা শোনার সময় নাই কারো। কারো কারো সময় থাকলেও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে, কোন কিছু শোনার মানসিকতা নাই। কেউ কেউ অত্যন্ত প্রাজ্ঞ অথচ অতীতের স্মৃতি এতো হোঁচটে ভরা যে- নতুন পথের উপর তার আর ভরসা করার সাহস নাই।
আমি দমে যাই না
পথ এগোই, একা…
আমি দেখি পৃথিবীর আলো গুলো উঁকি দিচ্ছে অজস্র গুহার মুখে, আপন উজ্জ্বল দিয়ে মেটাতে চাইছে বন্দী গুহার জমানো অন্ধকার। অথচ গুহাবাসীরা অনেকেই চায় না তাদের আবাস নিবাস আলোকিত হোক, তারা মশগুল বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাকে, তারা মেনে নিয়েছে তাদের সীমারেখা!

এরা কি পথ ভ্রষ্ট?
আচ্ছা ওরাই বা কারা? যারা নিজেদের ধ্যান জ্ঞান সবকিছু ব্যয় করছে পথ নিয়ন্ত্রণের জন্য- প্রয়োজনে তর্জন- গর্জন, যা কিছু পথের কাঁটা বলে মনে হচ্ছে দরকার হলে অনায়াশে তা সরিয়ে দিচ্ছে! আমি নর্দমায় পড়ে গেছি, আর আগেও পড়েছি অসংখ্যবার, আবার উঠে পথ চলেছি, এখনো উঠে দাঁড়াচ্ছি… দাঁড়াতে দাঁড়াতে মনে হলো আবারো তো পড়তে হবে, দাঁড়িয়ে কি হবে?
তবু দাঁড়াই,
আমার পথের লক্ষ্য দিক নির্ণয় করি, পা চালাই, অনেক দূর পরে তৃষিত হই, গলা শুকোয়।

কথা জড়িয়ে যায় জিহ্বায়।
পৃথিবীর যে অংশে আমার নিত্য চলার পথ সে অংশটাকে একবার পরখ করার চেষ্টা করি পৃথিবীর বাহিরে হতে; উপর হতে, নভোচারীদের মতন। আমি নির্বাক চেয়ে থাকি- এমন সোনার থালার মতন পটভূমি দেখে। এতো বৈচিত্রতা এতো মাধুর্যতা, এতো মমতার আবহ আর কোন অংশে নাই যা আছে আমার জন্মভূমিতে, আমার নিত্য চলার পথে…

তাহলে এতো থমকে যাওয়া কেন? এতো হোঁচট, এতো খানাখন্দ, এতো জঞ্জাল কিসের?
আমি আমার চোখ বুজে ভাবি
মা, মা ডাকি
বাবা বা ডাকি, এগো, ওগো বলে বৌ কে ডাকি,
আমি শুনি বাবা ডাক, পাপ্পা…
নিজের নাম শুনি মায়ের মুখে বাবার মুখে… এসব কিছু আমাকে পথ দেখায়, পথের নির্দেশনা দেখায়…।
আমি বল পাই… স্বপ্ন আঁকি,
চাঁদের আলোয় চাঁদের পথ, সূর্যের আলোয় সূর্যের পথ। এছাড়া আমি আরো সব পথ দেখি- মধ্যরাত পেরুলে বাবার জিকিরে … সাত সকালে কোরানের সুরে। আমি পথ দেখি কবিতায়, গানে, নির্মল সকালে শিশির ভেজা ঘাসফুলের মুচকি হাসিতে, পাশের বাড়ির যুদ্ধাহত জ্যেঠুর পুঁথির শ্লোকে…
এসবে আমার পথ চলার জল খোরাক তো মিলে যায়। কিন্তু আমি রুখে যাই, নতুন কোন হোঁচটে …
এই যে পথ এখানে তো তাহার থাকার কথা না
যে আছে সমাজপতির আসনে, যে কালরাতের পূজক সে কি করছে- আমাদের কবিতা সন্ধ্যায়? পুঁজি বাজারের রাঘব বোয়ালেরা কি করছে রাষ্ট্র যন্ত্রের ইঞ্জিন ঘরে?
আর…
ওরা কোন কাজে আঁকড়ে আছে শিল্পিত ক্যানভাস- যারা রক্তের সওদা করে, কালো টাকার পাহাড়ে নিজের উৎপ্রেতে থাকার গুহা বানায়! এই যে আল্ট্রামর্ডান গাড়ি গুলো সে পথ বেয়ে ছুটে চলে
আমি থমকে দাঁড়াই তাদের সওয়ারীরা যখন এক টা ভোটের জন্য পায়ের ফসকা ফেলে দেয়। আমার বার বার মনে হয় আমি ভুল পথে আছি,
এই পথ আমার নয়।

এই কবিতা
এই গান
এই ঐতিহ্যের গুণগান এসব তো ছিনতাই হয়ে গ্যাছে, যে ভাবে ছিনতাই হয়েছে আমাদের ৭১, যেভাবে গুম হয়ে গেছে আমাদের সোনালী ইতিহাস…
আমাদের পিঠেপুলির ঘ্রাণ…
শস্যক্ষেতের চোখ ধাঁধানো রূপ- মায়া!
জানি আরেকটু এগোলে বিপদ তেঁতে উঠবে।
কিন্তু আমি তো দমে যাবার জন্য পথে আসিনি- আমি এসেছি পথের শেষে পথে মঞ্জিলে
নিজের অস্তিত্বের পতাকা উড়াতে।
তা কেউ আমার পথের সাথী হোক বা না হোক
কেউ তালিয়া বাজাক বা না বাজাক, আমার পথ চলা নিরন্তর এগিয়ে যাবে।

বাংলায় রমজান ১

3117

বাংলাদেশে রমজানের ভিন্ন মাত্রার একটা সৌন্দর্য্য আছে, এটা শুধু বাংলাদেশেই কি না জানিনা। রমজান মাসে এই ছোট ছোট সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখি আর ভাবি একটি ধর্মীয় আচার কিভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকাসহ দেশের অনভিজাত মহল্লাগুলোতে রমজানের প্রথম রাতেই একটা সাধারণ দৃশ্য দেখা যায়, যে প্রতিবেশী কষ্টে আছে তার বাসায় স্বচ্ছল প্রতিবেশী কিছুটা বাজার পৌছে দিয়েছেন। বাজার পৌছানোর বিষয়টিও আবার শৈল্পিক আন্তরিকতায় পূর্ণ, প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সবচেয়ে ছোট বা বয়স্ক জনের নাম করে কর্তীকে বলা, “বাবা/মা এগুলো ওর/উনার জন্য পাঠিয়েছে, ভালো করে রান্না করে দিতে বলছেন।” এখানেই শেষ নয়, পুরো রমজান জুড়েই চলে এমনটা, ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে খুব ছোট বাটিতে করে হলেও চলে যায় পাশের বাড়ির বয়স্ক সদস্যটি বা শিশুটির জন্য। ইফতার বিনিময়ও চলে, ইফতার চলে যায় প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাড়িতেও।

রমজানের আরেকটা সৌন্দর্য্য আছে, যারা রোজা রাখেন না বা রাখতে সক্ষম নন এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও রোজদারদের সামনে কিছু খাওয়া বা পান করা থেকে বিরত থাকেন, এমন কি রেস্টুরেন্টের গেটে ঝোলানো থাকে পর্দা। এদিকে আমাদের দেশে একদল হাইব্রিড ধার্মিক আছে যারা রমজানে রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান বন্ধ রাখার জন্য আন্দোলন করেন। রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকান খোলা থাকলে যাদের রোজা রাখতে সমস্যা হয়, তাদের সংযম আর ঈমানের গভীরতা সহজেই অনুভব করা যায়।

রমজানের আরও সৌন্দর্য্য হলো, যারা ধর্মে মনোযোগী নন, তারাও সাধ্যমত দান করেন। যারা সিয়াম পালন করেন তাদের সহায়তা করেন, সম্মান করেন।

ধর্মীয় আচার যখন একই সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে, উৎসব হয়ে ওঠে তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধানের কিছুটা ব্যতয় ঘটা স্বাভাবিক। বান্দার এসব অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোও আল্লাহ ক্ষমা করবেন নিশ্চয়ই, কারণ আল্লাহ চরিত্রগতভাবেই মহান ও ক্ষমাশীল।

দান বা সদকা আদায় করলে সত্যিই কি সম্পদ বাড়ে?

unnamed

আরবি ‘সদকাতুন’ শব্দের অর্থ দান। দান দুই প্রকার ওয়াজিব (যার উপর প্রযোজ্য তার জন্য অপরিহার্য) এবং নফল (ইচ্ছাধীন)। আল্লাহ এবং রসুল (সা.) দানের বিনিময়ে শুধু সওয়াব অর্জনের কথাই বলেন নাই, সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। সদকা আদায় অর্থাৎ দান করলে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ, যাকে দান করা হচ্ছে সে ওই টাকাটা খরচ করছে অর্থাৎ টাকাটা রোলিং হচ্ছে, অলস টাকা হিসেবে আটকে থাকছে না। অলস টাকা না থাকায় সমগ্র অর্থনীতিতেই ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে এবং এর সুবিধাভোগী হবে সবাই। যৌক্তিক কারণেই যার সম্পদ বেশী তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে আর সুরক্ষিত থাকবে।

বিষয়টি পরিষ্কার করতে খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দেই, ইসলামের রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রতি বছর নির্ধারিত হারে জাকাত দেওয়া ও জমিনে উৎপন্ন শস্যাদির ওশর প্রদান করা ফরজ এবং সামর্থ্য থাকলে প্রতি বছর কোরবানি করা ওয়াজিব। চার বছর আগের হিসেবে বাংলাদেশে আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ নূণ্যতম ২৫ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ যাকাত কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক রোলিং হচ্ছে, এই রোলিংয়ের ফলে গতি পাচ্ছে অর্থনীতি, সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্ররা লাভবান হচ্ছে এবং এর সুবিধা পাচ্ছেন দাতাসহ সবাই। অন্যদিকে কোরবানির চামড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চামড়া শিল্প, আর দেশের দরিদ্র মানুষের আমিষের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ মিটে কোরবানিকে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ দানে যে সম্পদ বৃদ্ধি পায় সে বিষয়টি এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে আচারগুলো পালন করলে আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কার তো আছেই।

পুনশ্চঃ আমরা চাইলেই আলেম, ইমাম, পাদ্রী, পুরোহিত, রাবি হতে পারবো না। এর জন্য বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়ন ও চর্চা প্রয়োজন। কিন্তু ইচ্ছা করলেই মূল ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্ম বিষয়ক বইগুলো পাঠ করতে পারি, আজকাল বাংলায় অনুবাদের অভাব নেই। এর ফলে হবে কি, আমরা আলেম, ইমাম, পাদ্রী, পুরোহিত, রাবি হতে পারবো না ঠিকই, কিন্তু কেউ আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করছে কি না তা বুঝতে পারবো এবং প্রশ্ন করতে পারবো।

যে ধর্মের প্রথম ঐশী বাণী “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক” অর্থাৎ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (এখানে পড়ো মানে শুধু পাঠ করা নয়, জ্ঞান অর্জন করাও বটে) এবং নবী করিম হযরত মোহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তালাবুল ইলমি ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিম’ অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ, (বায়হাকি : ১৬১৪), ওই ধর্মের অনুসারী হয়ে পাঠ বিমুখ থাকা কি উচিত- বিবেচনাটি আপনার।

প্রতিবেশী কি শুধুই মুসলিম ধর্মাবলম্বী?

Scre

বিভেদ নয়, ইসলাম সম্প্রীতি ধারণ করে। এই সম্প্রীতির চমৎকার প্রমাণ প্রতিবেশীর হক আদায়ের নির্দেশনা। ইসলামে প্রতিবেশী বলতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে বুঝায়। উল্লেখ্য, মুসলিম ও আত্মীয় প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর হক আদায়ের পাশাপাশি মুসলমানের প্রতি মুসলমানের আর আত্মীয়ের প্রতি আত্মীয়ের হকও আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রতিবেশীর হকে ভিন্নধর্মাবলম্বী এবং অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেও পালন করতে হবে।

‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২)। প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক, সে কষ্টে থাকলে তুলনামূলক স্বচ্ছল প্রতিবেশীদের কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিবেশীর পরিধি কতটুকু এ বিষয়েও ধারণা দেওয়া হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে চল্লিশটি বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশীর আওতার অন্তর্ভুক্ত। (বোখারি: /২৯০১)

প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা অভাবে আছে তাদের সম্পর্কে আমাদের জানা থাকে। তবে এমনও অনেকে আছে যারা তাদের দুরবস্থা বাইরে প্রকাশ করেনা, সঙ্কোচে কারো কাছে সহায়তাও চায় না। পবিত্র কুরআনে এদেরকে ‘মাহরূম’ অর্থাৎ বঞ্চিত হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, “এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের (বঞ্চিতের) হক।” (সূরা যারিয়াত : ১৯) মাহরুম তথা বঞ্চিতদের কাছে এমন পন্থায় সহায়তা (যাকাত, দান) পৌঁছতে হবে যেনো তারা অপমানিত বোধ না করেন।

মসজিদে দান করুন, মাদ্রাসায় দান করুন কিন্তু এর আগে নিশ্চিত হোন প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়েছে কি না। সুরম্য মসজিদে দান করে এসির হাওয়ায় নামাজ আদায় করছেন, মাদ্রাসায় দান করেছেন আর ওই মাদ্রাসায় আপনার জন্য দোয়া হচ্ছে কিন্তু প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়নি- এটি সাধারণ বিবেচনাতেই নীতিগত অপরাধ, আর মুসলিম হিসেবে ধর্মের বিধিবিধানের অবমাননা। আমরা যেনো মনে রাখি কোরআন মজীদের একাধিক সুরায় সালাত আদায় না করার সাথে প্রতিবেশীর হক আদায় না করাকে যুক্ত করে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে, আরও মনে রাখি যে, হযরত মুহম্মদ (সা:) বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)।

একই সাথে মনে রাখি প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসী প্রতিবেশীরাও সমানভাবে গণ্য হবেন। বাড়ির পাশের প্রথম বাড়িটি যদি হয় একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিকের আর সে যদি থাকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় বা অভাবে তবে প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে সেই অগ্রাধিকার পাবে।

ইসলামে সামাজিক সম্প্রীতিকে গভীর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ বর্তমানে সম্প্রীতির পরিবর্তে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এক শ্রেণির আলেম (আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন) শুধু যে বিদ্বেষই ছড়ান তা নয়, তারা ওয়াজে বা আলোচনায় বসে নির্ধারণ করে দেন কে বেহশতে যাবে, কে দোজখে, কে মুমিন আর কে কাফের। ইসলামের মূল আদর্শের সাথে এদের যোজন যোজন দূরত্ব।

সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাক, রমজান থেকেই শুরু হোক সম্প্রীতি পালনের চর্চা।

শুভ নববর্ষ ১৪২৮

173720

বৈশাখ মানেই বাংলার বৈশাখ, বাঙালির বৈশাখ। নতুন বছর উৎসবে আনন্দে প্রাণের বন্যায় আমাদের হৃদয়ে ঝড় তোলে।

আজ আবার একটা নতুন বছর। এই নতুন বছর কতটা শুভ বার্তা নিয়ে আসছে আমাদের জীবনে জানি না। কালের নিয়মে দিন যায় দিন আসে, এই প্যানডেমিকের সময় ভীষণ সংকটের মুখে আমরা। তবুও বছরটিকে শুভ বলতে চাই।

নতুন বছর, হৃদয়ের অন্তঃস্তল থেকে বলতে চাই শুভ হোক –
সব শুভ হোক।
সব অন্ধকার মুছে গিয়ে আলো আসুক। সবার ভালো হোক। পৃথিবী প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিক, বাতাস রোগ মুক্ত হোক। সুন্দর হোক। আরোগ্য আসুক, এই প্রার্থনা করি।

শুভ হোক নতুন বছর।
শুভ হোক আগামী।

সব বাঁধা কাটিয়ে ম্যাজিকের মত জনজীবনে শান্তি নেমে আসুক। স্বস্তি স্থায়ী হোক। জয় হোক মানবের, জয় হোক মানবতার, জয় হোক সমগ্র অনিয়মের উপর নিয়মের। জয় হোক সবলের উপর দুর্বলের। জয় হোক অশিক্ষার উপর শিক্ষার। জয় হোক নিরানন্দের উপর আনন্দের।

শুভ নববর্ষ

1997_n

চাই তো, ভালো থাকি, শান্তিতে থাকি, স্বচ্ছল থাকি। শুধু আমি একা নই, চারপাশে কিম্বা আমার বৃত্তের বাইরে সবাই ভালো থাকুন। কারন, হাপুস হুপুস করে পঞ্চব্যাঞ্জন দিয়ে ভাত খাওয়ার সময়ে চোখ তুলে যদি দেখি অনেকগুলো অভুক্ত, অপুষ্ট মুখ প্রচন্ড সর্বগ্রাসী ক্ষিদে নিয়ে জুলজুল করে আমার খাওয়া দেখছে, তাহলে আর একটা গ্রাসও যে গলা দিয়ে নীচে নামবে না বস্!

তাই নিজের স্বার্থেই চাই সবাই ভালো থাকুন। প্রত্যেক বছরই এই একই চাওয়া আমার, তোমার, আমাদের সবার। সবাই চাই, মা গো, সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। চাই তো ভালো থাকতে! কিন্তু বছরের চাকা ঘুরতেই চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে মেরু বিস্তৃত ফারাক। ভালো গুলো কখন যে কালোর ফাঁদে পড়ে হারিয়ে যায় তার চোখের শেষ বিন্দু জল সমেত, জানতেও পারি না।

তবুও আশায় আশ্রয় নিই। কেবল চাষাই নয়, আমরা সবাই যে আশাতেই বাঁচি। সেই আশায় বুক বেঁধে জীবনের আরো একটা বছর পার করে দিয়ে অন্তিম চরণের দিকে হেঁটে যেতে যেতে চাই, ভালো থেকো গো বন্ধুরা এবং যারা বন্ধু নও, পরিচিত আর অপরিচিত, জানা কিম্বা অজানা মানুষেরা, সবাই … সবাই …

একরাশ শুভেচ্ছা আর গ্যালাক্সি জোড়া ভালোবাসা তোমাদের সবার জন্য। মহামারী অতিক্রম করে ভালো থেকো। আনন্দে থেকো। শুভ নববর্ষ প্রিয় মানুষ!

রাত জাগা পৃথিবী

7496_n

আজ আবার নির্ঘুম রাত। গানে গানে কেটে যাচ্ছে আর সঙ্গে রঙ তুলি। পৃথিবী চলেছে নিজের গতিতে। নদী চলছে নিজেকে পৌঁছে দিতে সাগরে। আজ তবে পৃথিবীর জরিমানা হোক। কেন সে সব নদীর হাত নিয়ে, সাগরের হাতে দেয়? কেন সব মন চুরি করে মেঘ হয়ে উড়ে যায় আকাশে? আর কেনই বা ঘাসেদের সব রঙ চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢেলে দেয় শিশিরে? তাই আজ পৃথিবীর জরিমানা হোক।

দূরে কোন রাত পাখির ডানার আওয়াজ। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকটা রাতে এসে মগজে ঘুরপাক খায় ভুলে যাওয়া কষ্টেরা। চলতে চলতে চেনা হয় আরেকটা অচেনা পথ। পুরনো পৃথিবীকে ঘিরে নেয় নতুন এক গান।

পৃথিবীর যত সব আবদার, দাবি কেড়ে নেওয়া হোক। সব তারা কেন আকাশের চুলে সাজায় ? আর সব কষ্ট ভুলে গিয়ে কোন ফাঁকে মন খুঁড়ে, ভালোলাগা পুঁতে যায়? ঘাসেদের ফুলে ফুলে আলগোছে রামধনু কেন রং ছেপে দেয়? তাই আজ পৃথিবীর যত সব আবদার কেড়ে নেওয়া হোক।

চারিদিকে জলপাই আলোর মিছিলে শীতের আমেজ। আর রয়েছে নরম তুলোর বলের মতো আদুরে ইন্তি-বিন্তি বেড়াল ছানা। কুচিকুচি চোখ তুলে নিমেষে আদরের আবদার। ঘোলাটে দৃশ্যে দিন শুধু বেড়ে যায়। বড্ডো বেশি ভিড় যেন চারিদিক, নিঃশ্বাসে ভরে যায় বাতাস, উত্তাপ।

তবে পৃথিবীর মজলিশ বেঁধে দেওয়া হোক। রোজ কেন ভোর হলে পাখিদের কাকলিতে বাঁশি সুর ঢালা চাই? আকাশের কোণ ধরে রোজ রোজ কেন সোনালি রঙে আঁচল ছড়ায়? হাওয়ার কানে কানে বৃষ্টির ডাক-কেন লিখে দেয়? তাই আজ পৃথিবীর মজলিশে বাধা দেওয়া হোক।

ইতিহাস ঘুরে ঘুরে আসে, আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি হারে। মনে হয় এই বুঝি ফাঁকি দিয়ে এগিয়েছে অনেকটা পথ, মুহূর্তে ভুল ভাঙে। আরবার ফিরে আসা একই বিন্দুতে, বৃত্তের কেন্দ্রে। ব্যাসার্ধ ছোট থেকে বড় হয় অথবা বড় থেকে ছোট। লুকিয়ে রাখে সবটুকুই। এই লুকানো একলা পৃথিবীকে কেউ বুঝে নিক আবরে সবরে, গল্পে, গল্পে। যদিও গ্রহণের শেষে সবটুকুই ক্ষয়।

পৃথিবীর সব ভালো মুঠো মুঠো ছাই হয়ে যাক। কেন রোজ ভোর পাখিদের পালক চিনে হাওয়ায় ভেসে আসে? মাঝে মাঝে চিনচিনে ব্যাথা হয়ে কেন তারা জ্বালে সাঁঝ আকাশে? কেন জলপরী ডুব দেয় সাগরের ঢেউ ঘেঁষে? তাই আজ পৃথিবীর সব ভালো মুঠো মুঠো ছাই হয়ে যাক।

পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে স্থির হয়ে থাক। কেন আকাশ ধুয়ে জল নামে পৃথিবীর চোখে? চোয়ালের কোণা ঘেঁষে বড় বেশি জেদ স্থির হয়। মগজের কোষে কোষে জন্ম নেয় মেঘ। জন্মান্তরের দোষে পুড়ে যায় শরীর। সন্ধ্যের নরম আলোয় চোখে পথে নামে রক্তিম আভা। পৃথিবী এখন ক্লান্ত ভীষণ। আজ নাহয় পৃথিবী পথ ভুলে যাক।

(বহু পুরোনো, প্রকাশিত লেখা)

মৃত্যু!

মৃত্যু!
সে তো একটা পর্দা মাত্র, যার
এপার- ওপারের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে একটি মাত্র নিঃশ্বাস!
প্রত্যেকের জীবনে এটি একবারই আসবে,
আপনি চাইলেই এর স্বাদ দুবার পেতে পারবেন না;
সুতরাং সবার উচিত
একে তৃপ্তির সাথে গ্রহণ করার জন্য নিজেকে তৈরি করা। যেন বলতে পারি
আহ… তৃপ্তি…
যাচ্ছি চির পূর্ণিমার দেশে…

বাবা

fathers-lov

বাবা নেই অনেক দিন হলো। দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় কে যেন নাম ধরে ডাক দেয়। ঠিক বাবার কণ্ঠের মতো। রাশভারি গলা। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসি বিছানায়। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি গলা শুকিয়ে গেছে। দ্বিপ্রহর রাত। টেবিলের ওপর রাখা মগ থেকে ঢকঢক করে পানি পান করি। বড় রাস্তায় তখন এক-দুইটা গাড়ি চলাচল করছে। কিছুক্ষণ পর পরই প্যাঁ-পুঁ আওয়াজ। পাশে শুয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকাই। নিষ্পাপ একটা মুখ। কতো যত্ন করে গড়ে দিয়েছেন বিধাতা। ঠিক আমার বাবার মতো দেখতে! অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ। সেই মায়াময় হাসিমুখে যেনো আমাকে ডাকছেন। বাবা অদৃশ্য হয়ে যান ধীরে ধীরে। বাবা চোখের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেলে টের পাই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রু মুছি না। অনেকটা ইচ্ছে করেই। এভাবে বাবা প্রায়ই আসেন। পাশে বসেন। কথা বলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি শুনি। শুধু তাঁকে ছুঁয়ে দিতে পারি না আগের মতো।

আমিও তো আমার সন্তানের বাবা! সেও কি আমার কথা মনে করে এভাবে রাত জেগে থাকবে? এমন করে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে কি ওর? আমার বাবার মতো আমিও কি তাঁকে ডাকবো? যখন সে বেভুল ঘুমে ঘুমিয়ে থাকবে।

বাবা নেই। কিন্তু তার ছোঁয়া লেগে আছে বাড়ির সব জায়গায়। এইযে আমার শাহাদৎ আঙুল, যে আঙুলটি বাবা তার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে আমায় হেঁটে নিয়ে বেড়াতেন। ঝুল বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগ, বাবার পানি পান করার জন্য বড় কাঁচের গ্লাস, হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার, ঘরের এককোণায় অবহেলায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা হ্যারিকেন, তিন ব্যাটারির লাইটটিও আছে। কাঠের ডান্ডাওয়ালা ছাতাটিও আছে। আছে বাবার হাতের লাঠিটাও। সবকিছুতেই তাঁর হাতের পরশ লেগে আছে। শুধু তিনিই নেই।

তবুও বাবা আছেন। সব বাবারা আসে – যায়। অসীম শূল্যতা থেকে ডাকেন। কারণে – অকারণে। যা লিখে রাখে মহাকাল তার সবকিছুই সত্য নয়। মাকে দেখেছি, বাবা চলে যাবার পর অভিমানের কাঁটা গলায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সদর দরজায়। অপেক্ষা; এক পতিত সময়ের নাম। মাকে বুঝাতে পারিনি তখন। শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীঘ হতে থাকে। মনে রাখিস, মৃত্যুতে মানুষের মুক্তি আসে বা বলতে পারিস মৃত্যুর আরেক নাম মুক্তি। বাবা বলেছিলেন। অথচ আমরা ক্রমশ বন্দি হয়ে যাই বাবার ছায়ার ভেতর।

সমস্ত দুপুর জুড়ে এখন থৈ থৈ রোদ। বাবা যেখানে বসতেন সেই কাঁঠাল গাছের ছায়াটাও উধাও। ঘুণপোকা খেয়েছে তার জলচৌকিটাও। হাতের লাঠিটারও কোন খোঁজ নেই দীর্ঘদিন। সবুজের ছাদে এখন বিরান ভূমি। পূর্ণিমা উড়ে এসে বসেছিল যে ঘরে সেখানে শুধু এখন শূন্যের হাহাকার। হায় রুদ্রপথ! তুমি কেমন করে রপ্ত করেছ বশীকরণ মন্ত্র। হাওয়া ঘরে এখন কালশীটে মেঘ। বাবার মস্ত বড় অভিমান। কতো বছর কেটে গেছে। দেখা নেই, কথা নেই। অথচ আমরা সবাই কেমন দিব্যি আছি। বেঁচে আছি। খাচ্ছি, ঘুরছি, ঘুমাচ্ছি। না, ঘুমাচ্ছি না। বাবা বলতেন, ঘুমের আরেক নাম মৃত্যু। ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানে হলো মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা।

কি করলে শোধ হয় রক্তঋণ? এই প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছিলাম মায়ের আঁচলে। মা শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বড় হ বাবা। অনেক বড়। তারপর মাও অন্তর্ধ্যানে চলে গেলেন। আমি বড় হতে থাকি। আমার মাথায় মায়ের হাত। কপালে আদর রেখা। অতঃপর অপেক্ষা। নাতিদীর্ঘ বছর। মায়ের হাত আর সরে না মাথার ওপর থেকে। আমি কি তবে বড় হয়নি আজও?

হিঙ্গুলী খালের গুপ্তকথা

1512

এককালের জংলি গন্ধ বয়ে আনা আমাদের হিঙ্গুলী খাল, এখনো আঁকে ধড়াসের পিঠের মতন বক্র ফুলি, আজকাল পলি জমা ক্লেদে গোমরা মুখি হয়ে থাকে, গোলা জলে মিশে থাকে দু’ পাড়ের বসতির কষ্ট, প্রাচীন কালকেউটেরা এখনো ভাসে- নতুন নতুন খোলসে। ভাঙ্গা পাঁজরে যখন অঝোরে বৃষ্টি ঝরে তখন আমাদের কালাচান কাকা কোমরে ঝোলা বেঁধে জাল মারতে নামে। দীর্ঘ দলকলমির ঝোপের ভেতর শৈল মাছের ঘাই, কালাচান কাকা দক্ষ হাতে তাদের ধরতে জানে, কায়দা করে হাতড়ে বেড়ায় রূপোলী জলের আঁচলে, কাদামাটির স্তনে।

আসলে, হিঙ্গূলী খালের সঙ্গে কালা-চান কাকার পুরনো সখ্যতা, ফেনী নদীর জল জানে, বাঁক জানে, তটের উত্তাপ চিনে চিনে কালাচান কাকা বুঝতে পারেন নদী আর খালের গুপ্তকথা। কোন মোহনায় গ্রীষ্মের দহন লাগে, কোন জলে ছুঁইয়ে থাকে পলাশের চুম্বন, কোন স্রোতে ভাসে শিমুল ফুল তরঙ্গের আবেগে, তিনি সব খবর রাখেন।…

( হিঙ্গূলী খাল, চট্টগ্রাম- মিরসরাই থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট খালের নাম, যার নামে একটি ইউনিয়ন রয়েছে)

বহুগামিতায় থাক হে ঈশ্বর ১

হেমন্ত কুয়াশা ঝরে পড়ছে টাপুর টুপুর। দিগন্ত বিস্তৃত চর ও অচর ঝাপসা আলো আঁধারি মায়ায় অপেক্ষায় আছে, এক্ষুনি যেন ব্ল্যাক ম্যাজিক দেখাবে কোনো আফ্রিকান জাদুকর। গর্ভবতী চন্দ্রবোড়া সাপেরা দশহাত মাটির তলায় নুড়ি আর বালির লেপ তোষকে চিতোরগড়ের রাণীর আনন্দে তোফা ঘুমের জোগাড়ে ব্যস্ত। সারারাত শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাস ইতিউতি টুকটুক গল্প করে। সদ্য কিশোরী ধান, বুকের জমে ওঠা দুধের ভাণ্ডারে সিরসির হাওয়া পেয়ে খিলখিল হাসে মাথা দুলিয়ে। সূর্য এই উঠল বলে।

আলগোছে অনিমেষ ভাবনা ছড়িয়ে সরু, কাটা আলপথ পেরিয়ে হনহন চলে লোকটা। মৃদু কুলকুল শব্দে ভুলুকপথে জল এগিয়ে যায় এক সীমানা ছেড়ে অন্য সীমানার দিকে। যাযাবরের নির্দিষ্ট নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করে না সে। কাঁধে ঝুলি, গামছা কিম্বা পাগড়ি, নিদেনপক্ষে হাতে এক গাঁঠওয়ালা তৈলাক্ত বাঁশের লাঠি, এ সব কিছুই তার কাছে অনভ্যস্ত ছদ্মবেশ। মাঠের সীমাহীন আলপথে কুয়াশায় মোড়া ক্ষীণ দৃশ্যমানতায় এগিয়ে চলে লোকটা তার স্বল্পকেশ আর অনির্দেশ দৃষ্টি সম্বল।

কুকুকুকু আওয়াজে ভৈরবী রাগে বেহালায় ছড় তোলে কোনো মেঘনাদ পাখি। নিকুম্ভিলায় বসার আগে বাজিয়ে নিতে চায় চারপাশের শত্রু অবস্থান। মাঝে মাঝে অরোমান্টিক দাড়িতে হাত বোলায়, চুলকায় লোকটা। গতরাতের নরম মেয়েটার সূক্ষ যোনি ভেদের উত্তাল বৃত্তান্ত, এখন আর তার মনে নেই। যেমন মনে নেই কাল সন্ধেয় হাতে গোনা তিন টুকরো রুটি জুটেছিল কিনা ঠিকঠাক! চারদিক সচকিত করে হঠাৎ হাঁচি আসে, গুনে ঠিক দুবার।

জীবনের যত ঝর্ণা প্রপাত, বিষাদের সমুদ্রে কল্কেফুলের রঙ পরিবর্তন, সব সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় এই রাত সকালের সন্ধিক্ষণে। চড়া সূর্যের আলোয় নৌকাবিহীন নদীর জলে আলোর ঝলকানি মুহূর্ত বিপর্যস্ত করে না স্বভাব যাযাবরকে। উস্কোখুস্কো চুলের গোপন কোণ থেকে উঁকি দেয় সূক্ষ রূপোলী রেখা। কত মুখ এল গেল, কত মুখই রয়ে গেল, হারালো অন্ধকারের নিষিদ্ধ গলিতে। লেগে থাকে সময়ের গায়ে কত না বোঝা অভিমান, না পাওয়া আদর। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই এগোয় সে জন। তার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যত নেই। আছে শুধু কুয়াশাময় নিপাট বর্তমান।

ছেঁড়া ছেঁড়া কাটা স্বপ্ননকশায় রাত্রি পার হয়। জঙ্গলের দূর ঘনছায়ায় খটখট শব্দে নিশিবাসর চকিতে জাগিয়ে তোলা সাদা লক্ষ্মীবাহণ অজর গমণ শেষে ঘরে ফিরে যায়। সেইসব তরুণী কস্তুরী মুখ, অথবা কস্তুরী মুখের হরিনী ছায়া, হেমন্তভোরের চুপিচুপি অভিমান হয়ে কুঁড়ি হয়, ফোটে, ফের ঝরে যায় নাছোড় জাতিস্মর স্মৃতির অক্ষম বাহক হয়ে। অগস্ত্য অভিযানে গালের দুপাশে বলি ক্রমশঃ গভীর হয়। আলপথ ধরে ভাঙাচোরা অবয়ব এগিয়েই চলে সকল চাওয়ার হাতের ধরাছোঁয়ার সীমানার বাইরে। আঁকাবাঁকা রঙধনু দিগন্তরেখা একবার হলেও ছোঁবেই সে।
.
(প্রকাশিত : খণ্ড ক্যানভাস)

একমুঠো আনন্দে একফালি বারান্দা

aa

গ্রীষ্মের প্রাণ জুড়োনো বিকেল কিংবা রোদমাখা দুপুরেও যদি থাকে ঝিরিঝিরি হাওয়া, হাতে চায়ের কাপ, ম্যাগাজিন—শখের বারান্দায় রাখা আরামকেদারায় পিঠ এলিয়ে তা উপভোগ করার যে মজা, তা বাড়ির আর অন্য কোনও অংশে নেই। শহুরে জীবনের কারাগারে এ যেন একটুখানি খোলা আকাশ। তাই তো মনের মতো বাড়ি খুঁজতে গিয়ে সকলেই অন্যতম প্রাধান্য দেন বাড়ির এই অংশটির প্রতি। আর কিছু থাকুক না থাকুক, বাড়ির যে কোনও কোণে এক চিলতে বারান্দা থাকা চাই-ই চাই।
bb

বাড়ির এই অংশের প্রতি আমাদের ভাল লাগাও চিরকালীন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার কাঠামো এবং চেহারায় আমুল পরিবর্তন এসেছে। পুরনো দিনের দালান বাড়ির সেই কাঠের নকশা করা রেলিংয়ে ঘেরা লম্বা, টানা পরিসর আজকাল আর নেই। তখন তো জায়গার কোনও টানাপোড়েন ছিল না, ফলে মনের মতো আয়তনে বারান্দা তৈরি করার স্বাধীনতাটুকু পাওয়া যেত। বলাই বাহুল্য, আজকাল আর সেই সুযোগ নেই। বাড়ির আয়তনের সঙ্গেই আজকাল ছোট হয়ে এসেছে বারান্দার পরিসরও।

আধুনিক ‘ফ্ল্যাট’ কালচারে বারান্দার জায়গা নিয়েছে ‘ব্যালকনি’। সে তাকে যে নামেই ডাকুন না কেন, বারান্দার প্রতি সেই ভালবাসা, টান কিন্তু আজও অমলিন। তবে সাজসজ্জার নিরিখে কিন্তু বাড়ির অন্যান্য অংশের তুলনায় বারান্দা যারপরনাই অবহেলিত। সাধারণত বারান্দা বা ব্যালকনি বাড়ির সামনের দিকেই থাকে। সুতরাং বাইরে থেকে দেখতে গেলে কিন্তু বারান্দার দিকেই সবার আগে নজর যাওয়া স্বাভাবিক। অথচ বাড়ির এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটির সাজসজ্জার দিকে আমরা কেউই বিশেষ নজর দিই না। ড্রয়িং, ডাইনিং, বেডরুম ইত্যাদির প্রতি যে যত্ন নিই, বারান্দার ভাগ্যে তার একরত্তিও জোটে না। এ কিন্তু ভারী অন্যায়!

cc

বারান্দায় ছোট ছোট টবে রঙিন ফুল বা সাধারণ প্ল্যান্ট রাখতে পারেন। পাতাবাহার, মানিপ্ল্যান্ট, ফরচুন ট্রি, বনসাই ইত্যাদি বারান্দায় দেখতে বেশ ভাল লাগে। হ্যাঙ্গিং পটও বারান্দার সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করবে। আজকাল তো বাজারে বিভিন্ন ধরনের সুন্দর সুন্দর টব পাওয়া যায়। চিরাচরিত টবের পরিবর্তে সিরামিক, তামা, পিতল বা ক্লে-র তৈরি টব রাখতে পারেন।

কিংবা বারান্দার গ্রিল বা পিলার বরাবর কোনও লতানো গাছ দিয়ে সাজাতে পারেন। বিভিন্ন ওয়াল হ্যাঙ্গিং বা উইন্ড চাইমসও রাখতে পারেন। কাগজ বা ম্যাগাজিন পড়ার অভ্যেস থাকলে এক কোণে ছোট কাপবোর্ড রাখতে পারেন, বারান্দা অনেক পরিপাটি থাকবে। কাপ বোর্ডের উপরে ছোট তামা বা পিতলের ক্যান্ডেল বোল রাখতে পারেন। ভিতরে রঙিন নুড়ি পাথর, ফুল আর জল রাখুন। মোমবাতি না রাখলেও দেখতে ভাল লাগবে। গ্রীষ্মের দিনগুলোয় সন্ধেবেলা তাতে মোম জ্বালাতে পারেন। বারান্দাময় একটা উষ্ণ আবহ বজায় থাকবে। কাপ বোর্ডের উপর ছোট মূর্তি বা ফোটো ফ্রেমও রাখতে পারেন।

dd

বারান্দায় বসার ব্যবস্থা থাকা অত্যাবশ্যক। ছোট বারান্দার ক্ষেত্রে কয়েকটা বেতের মোড়া বা কাঠের টুল রাখলেই যথেষ্ট। জায়গায় কুলোলে একটা ছোট সেন্টার টেবলও রাখতে পারেন। বড় ব্যালকনির ক্ষেত্রে প্রপার সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখুন। বেতের সোফা বারান্দার ইমেজের সঙ্গে বেশ ভাল মানায়। অবশ্য রট আয়রন বা কাঠ পছন্দ হলে, তাও রাখতেই পারেন। সঙ্গে রাখুন মাঝারি আকারের একটা সেন্টার টেবল। আসবাব বদল সম্ভব না হলে, বারান্দার চেয়ারে কয়েকটা কুশন কিনে রাখতে পারেন। একটু উজ্জ্বল বা আধুনিক কুশন কভার বাছলেই দেখবেন, ব্যালকনির আমেজে বেশ বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। বড় ব্যালকনি হলে কোণজুড়ে রাখতে পারেন দোলনাও। আরামকেদারা বা সুইং চেয়ার রাখলে বিশেষ জায়গারও প্রয়োজন নেই। তাই ছোট বারান্দার ক্ষেত্রে এগুলো বাছতে পারেন।

জনস্বার্থে : সংক্রমণ ঠেকাতে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন

Loc

দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দ্বারা পরিচালনা, উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এসব সিদ্ধান্ত এখন থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে এবং আগামী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত তা কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো—

১. সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ যে কোনো উপলক্ষে জনসমাগম সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে উচ্চ সংক্রমণ এলাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে।

২. মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

৩. পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, সিনেমা হল, থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করা হবে।

৪. গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।

৫. সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আন্তজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে।

৬. বিদেশফেরত যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।

৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী খোলা ও উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা করতে হবে।

৮. স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
১০. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে।
১১. অপ্রয়োজনে রাত ১০টার পর ঘর থেকে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

১২. প্রয়োজনে বাইরে গেলে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক না পরলে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

১৩. করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বা করোনার লক্ষণ রয়েছে—এমন ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।

১৪. জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা, অসুস্থ, ৫৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তিদের বাসায় থেকে কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৫. সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজন করতে হবে।

১৬. সশরীরে উপস্থিত হতে হয়—এমন যেকোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।

১৭. হোটেল, রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষ প্রবেশ করতে পারবে।
১৮. কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও অবস্থানের পুরোটা সময়ই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

জনস্বার্থে : করোনাভাইরাস : প্রথম আলো। সোমবার, ২৯ মার্চ ২০২১

গোলমাল_কমিটি_১

আমরা গোলমাল কমিটি। বয়স দশ সাড়ে দশ। মসজিদের বাগান আমাদের প্রিয়, একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে সব ফুল সাবাড়। মসজিদের ফুল গেছে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। মসজিদের গা ঘেষে রাস্তা গেছে কোর্টের দিকে মুসল্লিরা আসরের নামাজ পড়ছেন। গতকালের হায়ার করা ভিডিওতে দেখা মোগলে আযমের মধুবালায় মনমগজ আচ্ছন্ন গলা খুলে গাইছি, “পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া”। আমাদের কোরাস গানের তালে ইমামের নামাজ ছুটে গেছে, রুকু বাকী রেখেই সেজদায়। পেছনের মুসল্লিরা বেজায় খ্যাপা।

এই বিচ্ছুদের গতি করতে হবে ভেবে মসজিদ কমিটি মিটিং এ বসেছে, দেখা গেল মসজিদের সেক্রেটারির ছেলেই পালের গোঁদা। প্রতিটি বাসায় অভিভাবক কতৃক ভাল করে ধোলাই খাওয়ার পরে গোলমাল কমিটি সিদ্ধান্ত নিল পাল্টা আঘাত হানতে হবে। জুম্মায় আমরা মিনারে উঠে নামাজ পড়ি, এক জুম্মায় সবাই যখন প্রথম সেজদায় গেছে আমরা আগুন আগুন বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। নামাজ বাকী রেখে মুসল্লিরা যে যেদিকে পারে দৌড়, সে এক বিতিকিচ্ছি অবস্থা।

আগুন তদন্ত কমিটি আগুন খুঁজে পেল না কিন্তু গোলমাল কমিটির প্রতিটি সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি হিসাবে এক মাসের জন্য মসজিদ থেকে নির্বাসন দেয়া হল।

মসজিদের পুকুর গোলমাল কমিটির রাজত্ব, গোলমাল কমিটি ছাড়া অন্য কোন রাজাধিরাজ নাই। এক মাসের নির্বাসন কাটানো কঠিন ছিল, তবু শাস্তি শেষের প্রথম প্রহরেই রাজ্য পুনরুদ্ধারে মরিয়া গোলমাল কমিটি পুকুরে হাজির। অজুরত মুসল্লিরা প্রমাদ গুনলেন, আমাদের হাতে রাজ্য সমর্পন করে মানে মানে কেটে পড়লেন।

শবে বরাতের রাতে আগন্তুক এক মৌলানার ওয়াজ মনে ভয় ধরিয়ে দিল, মসজিদের এবং মুসল্লিদের সাথে বেয়াদবির শাস্তি কি বর্ণনা করতে করতে একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়লেন। ভীত আমরা মসজিদ কেন্দ্রিক রাজত্ব গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।

দীর্ঘদিন আমাদের দেখা নাই, গোলমাল কমিটি নামকরণ করা মসজিদের মুয়াজ্জিন এলেন আমাদের খোঁজে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে মসজিদে ফিরতে বললেন, মসজিদে ফিরলাম কিন্তু গোলমালে ফিরলাম না।

আমাদের তখন নতুন উন্মাদনায় পেয়েছে। নিজেরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে একতা সাহিত্য ক্রীড়া সংগঠন নামে সংগঠন গড়েছি। পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়েছে ফুটবলের মহাযুদ্ধ, যুদ্ধে আমাদের ক্লান্তি নাই। বিজয়ে ক্লান্তি নাই, একের পর এক বিজয় আমাদের যুদ্ধবাজে পরিণত করছে। আমরা হয়ে উঠছি আমাদের কালের পেলে, ম্যারাডোনা।

বন্ধুর_জন্মদিনে

1658072

আমি বাংলাদেশের সমান, বয়সে। দুই চার মাস এদিক সেদিক হতে পারে। বাংলাদেশ এবং আমি একসাথে বড় হয়েছি। ৫০ বছরে দু’জনের তুলনা করলে দেখি আমাদের বড় হওয়া প্রায় অভিন্ন।

আমাদের জীবনে ঘাত প্রতিঘাত এসেছে, ঝড়, ঝঞ্ঝা এসেছে আবার আলো ঝলমলে অসংখ্য দিন একসাথে পার করেছি। ৫০ বছর পিছনে তাকালে দেখি আমরা বেশ সফল, প্রথম প্রথম অন্যের মুখাপেক্ষী থাকলেও সামলে উঠেছি, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছি।

এ পর্যন্ত পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে অনেক, আমাদের সবসময় তাড়া করেছে অসংখ্য শত্রু। বাইরের পরিচিত শত্রুর মোকাবেলা কঠিন ছিল না কিন্তু ঘরের গুপ্ত ঘাতক অনেক সময় পীড়ার কারণ হয়েছে তবু আমরা লক্ষ্যচ্যুত হই নি।

জন্মের প্রারম্ভকালে দরিদ্রতা আমাদের আঁকড়ে ধরেছে, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। দীর্ঘদিন না খেয়ে, আধবেলা খেয়ে পার করেছি। খিদের জ্বালায় অনেক রাত ঘুমোতে পারিনি, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারেও ধর্ণা দিতে হয়েছে।

অনেকে অবহেলা, অবজ্ঞা করেছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দেখিয়েছে তবুও হার মানিনি। নিজের সম্মান বিসর্জন না দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। চেষ্টার কাছে সময় পরাভূত হয় এর সাক্ষ্য আমাদের চেয়ে কেউ বেশি দিতে পারবে না।

যারা একদিন অবজ্ঞা করত, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দেখাতো তারা এখন যেচে আত্মীয়তা পাতাতে চায়, আমাদের নজর কাড়তে তারা এখন হ্যাংলামি করে।

আমি এবং বাংলাদেশ এখন গর্বে সিনা টান করতে পারি, অখ্যাত অচ্ছুৎ থেকে নিজের চেষ্টায় আমরা এ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।

আমি ভাগ্যবান বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে পঞ্চাশ পূর্ণ করেছি, বাংলাদেশ আমার ল্যাংগুটে বন্ধু। বন্ধুর জন্মদিনে অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই, আমি নিশ্চিত আমার বন্ধুও আমার জন্য একই রকম শুভকামনা পোষণ করে।