বিভাগের আর্কাইভঃ অন্যান্য

শারদ অর্ঘ- ১৪২৬ কবিতা সংকলন সপ্তম পর্ব- আগমনী কাব্য-৭

শারদ অর্ঘ- ১৪২৬ কবিতা সংকলন
সপ্তম পর্ব- আগমনী কাব্য-৭
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরতের আকাশ, শরতের নদী, শরতের ফুল- সবকিছুই কেমন যেন শান্ত মায়াময়। শরতের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদীতীরের কাশফুল, আঙিনার শিউলি- এরা সবাই কোমল, পবিত্র। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপটাপ শিউলি ঝরে, তখন অনুভবে শরৎ আসে। কাশবনে দলবেঁধে আসে চড়–ই পাখিরা। নদী শান্ত হয়ে আসে। তখন থাকে না তার দুকূল-ছাপানো বিপুল জলরাশির উত্তাল ঢেউ। আর শরতের নদী মানেই দুই পাড়ে কাশবনের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ। বাংলা ছাড়া এমন অনাবিল সৌন্দর্যভূমি আর কোথায় পাওয়া যাবে?

শরৎ মানেই শিউলি ফোটার দিন। শিউলির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির আরেক নাম শেফালি। আগের দিনে কবিরা শেফালি নামটাই বেশি ব্যবহার করেছেন। শিউলি বা শেফালি যা-ই বলি-না কেন, চমৎকার এ-ফুলটি নিয়ে দুটি গ্রিক ও ভারতীয় উপকথা আছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তার তীব্র ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে।

শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরও মোহময় করে এ-মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-কুশ, ঘরের আঙিনায় ফোটে শিউলি বা শেফালি, খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল। আর শেষরাতের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে-থাকা মায়াবী ফুলেরা যেন আরও রূপসী হয়ে ওঠে। শিশিরভেজা শিউলি, বাতাসে মৃদু দোল-খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ। সত্যিই বিচিত্র রূপ নিয়ে শরৎ আমাদের প্রকৃতিতে এবং চেতনায় ধরা দেয়। আমাদের অন্য ঋতুগুলো অনেক ফুলের জন্য বিখ্যাত হলেও মাত্র কয়েকটি ফুল নিয়েই শরৎ গরবিনী।

গ্রাম বাংলার পথের দুধারে বনে কত বন্য শিউলি গাছ… যেন শিউলিবন। বড় বড় শিলাখণ্ডের উপর শরতের প্রথমে সকালবেলা রাশি রাশি শিউলিফুল ঝরিয়া পড়িয়াছিল’ (পৃ. ৬৩)। ‘সন্ধ্যা হইবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নতুন সুবাস পাইলাম। আশেপাশের বনের মধ্যে যথেষ্ট শিউলিগাছ আছে। বেলা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শিউলিফুলের ঘন সুগন্ধ সান্ধ্য-বাতাসকে সুমিষ্ট করিয়া তুলিয়াছে’ (পৃ.১৪০)।

কাশফুল প্রসঙ্গে :
‘ধু-ধু বন-ঝাউ আর কাশবনের চর’ (পৃ. ৭)। ‘শুকনো কাশ ও সাবাই ঘাসের ছোট্ট একটা ছাউনি’ (পৃ. ৩৫)। ‘সেই খাটো কাশ-জঙ্গল’ (পৃৃ. ৫৯)।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ- সকলেই অসংখ্যবার শিউলির প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শরতের স্নিগ্ধতা উপভোগ করেছেন নানাভাবে। শরতের পুষ্পসম্ভার তাঁর জাদুস্পর্শে আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে :
‘এই শরৎ-আলোর কমল-বনে/ বাহির হয়ে বিহার করে/ যে ছিল মোর মনে মনে।’

অন্যত্র আছে :
‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।/ শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে-/ বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে’
রবীন্দ্রনাথ গান ও কবিতায় নানাভাবে, নানা প্রসঙ্গে অন্তত একুশ বার শিউলির কথা বলেছেন।
তার কয়েকটি :
১. যখন শিউলী ফুলে কোলখানি ভরি/ দু’টি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনত বয়ানে।
২. সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা।
৩. বকুল, কেয়া, শিউলি সনে/ ফিরে ফিরে আসবে ধরণীতে।
৪. আশ্বিনের উৎসবসাজে শরৎ সুন্দর শুভ্র করে/ শেফালির সাজি নিয়ে দেখা দিবে/ তোমার অঙ্গনে।
৫. আশ্বিনের শেফালিকা/ ফালগুনের শালের মঞ্জরি।
৬. শিউলী ফুলের নিশ্বাস বয়/ ভিজে ঘাসের পরে।
৭. প্রশান্ত শিউলি ফোটা প্রভাত শিশিরে ছলোছলো।
৮. শিউলি এলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে,/ এখনো বিদায় মিলিল না মালতীর।
৯. নীরব আকাশবাণী শেফালির কানে কানে বলা।
১০.তারি অঙ্গে এঁকেছিল পত্রলেখা/ আম্রমঞ্জরির রেণু, এঁকেছে পেলব শেফালিকা/ সুগন্ধি শিশির কণিকায়।
১১. যখন শরৎ কাঁপে শিউলি ফুলের হরষে।
১২. আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা।
১৩. ওগো শেফালি বনের মনের কামনা।
১৪. শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে।
১৫. দেখিলাম ধীরে আসে আশীর্বাদ বহি/ শেফালি কুসুম রুচি আলোর থালায়।

শরৎ-শিউলির প্রসঙ্গ এলে নজরুলের এই গানটি অনিবার্য হয়ে ওঠে। :
‘তোমারি অশ্রু জলে শিউলি-তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।’

শারদ অর্ঘ- ১৪২৬ কবিতা সংকলন
সপ্তম পর্ব- আগমনী কাব্য-৭
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরতের আকাশেতে
সাদামেঘ ভাসে,
সবুজ ধানের খেতে
সোনারোদ হাসে।

দিঘিজলে হাঁসগুলি
কাটিছে সাঁতার,
সবুজ ধানের খেত
হেরি চারিধার।

শরতের আগমন
দোলা দেয় প্রাণে,
চারিদিক মুখরিত
আগমনী গানে।

ঢাকীরা বাজায় ঢাক
কাঁসর বাজায়,
তরুশাখে বিহগেরা
বসি গীত গায়।

অজয়ের নদী চরে
বক ধরে মাছ,
নদীতীরে বটগাছে
পাখিদের নাচ।

যাত্রীসব পার হয়
নামে নদীজলে,
খেয়াঘাট ভরে উঠে
জন কোলাহলে।

আগমনী গান ভাসে
বাতাসে বাতাসে,
অজয়ের নদী চরে
বেলা পড়ে আসে।

এসো বাস্তব সত্ত্বায়

কল্পনা ছেড়ে এসো বাস্তব সত্ত্বায়,
মহা উম্মাদনায় আছো মিশে আত্মায়।
লাঞ্ছনা সয়ে সয়ে, সয়ে জ্বালা যন্ত্রণা,
প্রাণপণ সারাক্ষণ তুমি তুমি কল্পনা।

দূরে দূরে থেকে থেকে শুধু করা পরিতাপ,
ও মনের গভীরতা করিনি তো পরিমাপ।
তৃষিত এ অন্তরে কল্পিত সজ্জা,
স্বপ্নতে ভেঙে দাও সব লাজ লজ্জা।

হৃদয়ের গভীরে ভাবনার উত্থান,
সারাক্ষণ শুন্যতায় আত্মার ক্রন্দন!
এ তোমার আশীর্বাদ? নাকি কোনো অভিশাপ?
অতল গহীনে ফেলে তুমি তো নিরুত্তাপ!

স্বপ্ন যে কি কারনে এত সুমধুর হয়,
যদিও তা ক্ষনিকের দীর্ঘস্থায়ী নয়।
উড়ন্ত মেঘ হয়ে এসো খোলা আকাশে,
আবদ্ধ করে রাখো প্রেমময় আবেশে।

সুখ সন্ধানী এই বর্নীল ভূবনে,
অন্তরে গেঁথে রাখো প্রেম দিয়ে যতনে।
আপনের আপন করো বিশ্বাস আস্থায়,
কল্পনা ছেড়ে এসো বাস্তব সত্ত্বায়।

ফেসবুক যদি হয় পৃথিবীর বড় গোরস্থান সেখানে আমার সমাধি

ক’দিন ধরেই ফেসবুকে আমার জন্ম এবং মৃত্যু নিয়ে ভাবছি। এখন সুস্থ আছি। ভালো আছি। পকেটে টাকা আছে। দোকানে ইন্টারনেট আছে। মেগাবাইট কিনে ফেসবুক ব্যবহার করছি। একদিন পকেটে টাকা থাকবে না। মোবাইলে মেগাবাইট থাকবে না। মেগাবাইট নামের ইন্টারনেট নেই তো ফেসবুক নেই। একসময় মোবাইল বা ল্যাপটপ টেপাটেপি করার শক্তি এবং মন-মানসিকতা থাকবে না। তখন ফেসবুকে প্রবেশ করা হবে না। তাহলে আমার বর্তমান সখের ফেসবুক আইডির অবস্থা কী হবে? আবার জীবের সেরা মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে যখন জন্মগ্রহণ করেছি, একদিন তো মৃত্যু হবে। তখনই বা আমার স্বাদের ফেসবুক প্রোফাইল বা আইডির অবস্থা কী হবে? একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি, আমার মৃত্যু পর আমার ফেসবুক প্রোফাইল কী হবে! যা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে নিজের কিছু স্মৃতিচারণ নিয়ে আলোচনা করি। পরে নাহয় এবিষয়ের আলোচনায় আসি।

একসময় একটা ওয়ান ব্যান্ড রেডিওর পেছনে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম। স্কুলে যেতাম আর না-ই-বা যেতাম, কিন্তু রেডিওর পেছনে সময় ঠিকই দিতাম। গান শুনতাম। খবর শুনতাম। টেলিভিশনের তো দেখাই মিলতো না। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার-ওপার দুই পাড় মিলিয়ে মাত্র দুইটি সাদা-কালো টেলিভিশন ছিলো। সেই সাদাকালো টেলিভিশন এখন মনে হয় জাতীয় যাদুঘরেও সংরক্ষণ নেই। এখন বাংলার ঘরে ঘরে বড় এলসিডি কালার টেলিভিশন। রেডিও তো এখন এই যুগের শিশুরা খেলনা হিসেবেও ব্যবহার করে না। আগের রেডিওর চেয়ে বর্তমানে শিশুদের খেলনা সামগ্রী অনেক উন্নতমানের।

১৯৮০ দশকের দিকে মোবাইল ছিল না। কেউ দেশের বাইরে থাকলে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়ে প্রিয়জনের কাছে ফোন করতো। বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে পোস্ট অফিসের টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করতো। এখন আর সেইদিন নেই। সেই আমলের টেলিগ্রাফ বলতে আজকালকার ছেলে-পেলেরা বুঝেই না। এখন বুঝে মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, কম্পিউটার।

এখন প্রতিটি মানুষের হাতে মোবাইল। একসময় এর নাম ছিল সেলফোন। তা ছিল বাটন সেলফোন। এখন আর সেলফোন কেউ বলে না। এখন সবাই বলে মোবাইল ফোন বা মোবাইল। তাও আবার টাচস্ক্রিন। যাকে বলে এন্ড্রোয়েড মোবাইল। আঙুলের স্পর্শেই চলে। এই মোবাইল এখন মনে হয় বাংলার বেশিরভাগ মানুষেই ব্যবহার করছে। অনেকের হাতে বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্নরকম দামী দামী এন্ড্রোয়েড মোবাইল সেট। এই মোবাইল দিয়ে দেশ-বিদেশে মুহূর্তেই কথা বলা যায়। ছবি তোলা যায়। ভিডিও দেখা যায়, করাও যায়। আর ভিডিও কল-সহ বার্তা আদান-প্রদান-সহ থাকে আধুনিক প্রযুক্তির ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধা। মোটকথা মোবাইল এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটা অনুষঙ্গ। বর্তমানে মোবাইল ছাড়া মানুষ চলতেই পারে না। মোবাইল ছাড়া দেহ মন সবই মিছে মনে হয়। তাই বর্তমানে দেশের ধনী-গরিব সবার হাতেই মোবাইল। মানুষের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, কিন্তু মোবাইল থাকতে হবে। আছেও। তবে খুব কম মানুষেই বাটন মোবাইল ব্যবহার করে থাকে। জোয়ান বুড়ো অনেকেই ব্যবহার করে এন্ড্রোয়েড টাচস্ক্রিন মোবাইল।

এসব মোবাইল দিয়ে খুব সহজে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। তাই অনেকেই মার্কেট থেকে একটা মোবাইল কেনার সাথে সাথে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করে ফেলে। এরপর বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে ভিডিও দেখা-সহ ফেসবুকে ফ্রি রেজিষ্ট্রেশন করে মনের আনন্দে ফেসবুক ব্যবহার করতে থাকে। অনেকে টুইটার-সহ আরও বিভিন্ন সাইটে রেজিষ্ট্রেশন করে। কেউ ব্লগে, কেউ নিউজ সাইটে। যে যা-ই ব্যবহার করুক-না-কেন, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতভাগ ব্যবহারকারী ফেসবুক ব্যবহার করে এবং সবার কাছে ফেসবুকই বেশি জনপ্রিয়। তাঁদের মধ্য আমিও একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী। তাই এই জনপ্রিয় ফেসবুকে আমার জন্ম এবং মৃত্যু নিয়েই আমার আজকের আলোচনা।

বর্তমানে ফেসবুক প্রোফাইল বা ফেসবুক আইডি নেই এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী-সহ চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শ্রমজীবী যেকোন পেশার লোকেই হোক-না-কেন, ফেসবুকে একটা আইডি থাকবেই থাকবে। বিশেষ করে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে,তাঁরা। তাই দিন দিন দেশের প্রতিটি মানুষ বর্তমানে ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনও দেখ যায় লেখাপড়া না জানা বহুলোকও বর্তমানে ফেসবুকে পারদর্শী হয়ে উঠছে। এমনও লোক আছে নিজের নাম লেখতে কলম বেঁকা হয় সে লোকও ফেসবুক ব্যবহারকারী। কেউ যদি জানতে চায় কীভাবে মেসেস দেন? কীভাবে আপনার অনুভূতি গুলো বন্ধুদের জানান? আর কীভাবে একটা ছবির উপর মন্তব্য দেন? উত্তর আসে এরকম– আরে বাবু এটা কোনও কোন ব্যাপারই না। শুধু nice, good, Good morning, fine এইসব লেখাগুলো ভাল করে মুখস্থ করলাম, ব্যাস হয়ে গেল। আর কী লাগে বাবু? উল্টা প্রশ্নকারীকে প্রশ্ন করে। এসব কথা শুনে অবাক না হয়ে শুধু ভাবতেই হয়। ভাবনা শুধু ফেসবুক নিয়ে আর মানুষের আগ্রহ নিয়ে। দেশের সিংহভাগ মানুষের আগ্রহ এখন ফেসবুক। ফেসবুক আছে তো সব আছে। ফেসবুক নেই তো কিছুই নেই। কিন্তু কেউ ভাবে না যে মৃত্যুর পরে ফেসবুক প্রোফাইলটার অবস্থা কী হবে? এটা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নেই। ভাবনা শুধু কীভাবে ফেসবুকে বেশি করে সময় দেওয়া যায়।

তাই দেখা যায় মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ফেসবুক। ব্যবসা, বাণিজ্য, খবর, বিনোদন, কেনা-বেচা, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান, হিন্দুদের রামায়ণ পাঠ, গীতা পাঠ, মহাভারতের বাণী, পবিত্র বাইবেলের বাণী, সন্মানিত মুসলমানদের পবিত্র কোর’আন শরীফের আয়াত সংবলিত পোষ্ট। আবার সাহায্য চাওয়া, স্বজনদের সন্ধান করা, পাত্র-পাত্রীর খোঁজ করা, ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া, রাষ্ট্রনায়কদের সাথে যোগাযোগ করা। মোট কথা জীবন মরণ, ধর্মকর্ম, প্রেম-ভালবাসা, চোর ধরা ডাকাত ধরা, ঘোমড়ফাঁস করা, গুজব ছড়িয়ে দেওয়া-সহ এই ফেসবুক মানুষের কাছে এখন মহাকিতাবে পরিণত হয়েছে।

অনেক সময় লাইকের প্রতিযোগিতার বাহারও লক্ষণীয়। এই লাইক প্রতিযোগিতায় যুবতী মেয়েরাই সব চাইতে বেশি এগিয়ে থাকে। এই লাইকের প্রতিযোগিতায় আরও অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তাদের আইডি বা পেইজে লাইকের পাহাড় তৈরী হয়। এছাড়াও লাইক প্রতিযোগিতায় আছে সুপারস্টার, মডেল তারকা, অভিনেতা অভিনেত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, মন্ত্রী এমপি, দেশের ভিআইপি ব্যক্তিবর্গ। লাইক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ নিজেও।

মার্ক জুকারবার্গের প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। আজও তিনি প্রতিযোগিতা থেকে থেমে নেই। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে ফেসবুক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে মার্ক জুকারবার্গের প্রতিযোগিতা চলছে। ফেসবুক প্রথম প্রথম শুধু আমেরিকায় বসবাসকারীরা ব্যবহার করতে পারলেও, ২০০৫ সাল থেকে সারাবিশ্বের মানুষের জন্য উম্মুক্ত হয়। সেই থেকে অদ্যপর্যন্ত সারা বিশ্বেই ফেসবুকের পদচারণা। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে এই ফেসবুক। তবুও থামছেন না মার্ক জুকারবার্গ। প্রতিযোগিতা চলছে চলবে। ফেসবুক একসময় শিশু ছিল। মানে ফেসবুক যখন যাত্রা শুরু করলো। এখন দিন দিন ফেসবুক বড় হতে হতে লাগলো। আজকের শিশুতো সবসময় শিশু থাকবেনা। শিশুটির বয়স বাড়বে। বুড়ো হবে। এটাই তো নিয়ম! একদিন মৃত্যুকেও বরণ করবে।

তাহলে দিন যাচ্ছে, ফেসবুকেরও তো বয়স বাড়ছে। তাই এখানে একটা হিসাব কষে নেওয়া যায়। হিসাব কষে দেখা যায়, প্রথম যারা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে; তাঁদের বয়স এখন প্রায় সবার চল্লিশে ছুঁই ছুঁই করছে। কারণ, যারা ফেসবুকের জন্মলগ্ন থেকে ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেছে, তখন তাদের বয়স আনুমানিক ভাবে ১৮ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি ছিল। তাহলে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৯’, ১৬ বছর। ১৬+২০=৩৬ বছর। তাহলে ফেসবুকের বয়স ১৬ বছর, আর প্রথম থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বয়স হচ্ছে ৪০-এর কাছা-কাছি। এখন একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, এখন থেকে একজন মানুষের ৮০ বছর হলে জন্মলগ্ন থেকে ফেসবুকের বয়স তখন কত হবে? হিসাব করলে দেখা যায়, তখন ফেসবুকের বয়স হয়ে যাবে ৯৬ বছরের উপরে। মানে ১০০ বছরের কাছা-কাছি। বর্তমান যুগে খুব কম মানুষেই ৯০বছর বেঁচে থাকে। শতবছর তো হাতে গোনা দুই একজন মাত্র। তাহলে আজ যাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে তাদের একদিন মৃত্যু হবে। তাহলে মনে করতে হবে এই মৃতব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টাও মৃত্যুবরণ করলো। হয়ে গেলো ফেসবুকে তার সমাধি বা কবর বা শ্মশান। আর ফেসবুক হলো সমাধিস্থান বা গোরস্থান বা শ্মশানঘাট। ফেসবুকের জন্মলগ্ন থেকে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর মৃত্যু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবেও। তখন সেই মৃতব্যক্তিদের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে যাবে শুধুই একটি কবর বা সমাধি হয়ে।

মৃতব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইল কবর হয়ে থাকার পেছনে কারণও আছে। এর মূলকারণ হলো এই জনপ্রিয় ওয়েবসাইট কারোর প্রোফাইল মুছে ফেলতে নারাজ। হোক সে জীবিত বা মৃত। এই ওয়েবসাইটি সকল ব্যবহারকরীদের সন্মান রক্ষার্থে, সবার প্রোফাইল চিরদিন স্মৃতি করে রাখতে চায়। যদি তা-ই হয়, তা হলে ফেসবুকের জন্মলগ্ন থেকে অদ্য পর্যন্ত সারাবিশ্বে কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রতি মাসে কিছু কিছু ব্যবহারকারী মৃত্যুবরণ করলে, ১০০ বছরে এর সংখ্যা কত হতে পারে? সংখ্যা যা-ই হোক-না-কেন, সেসব বা এসব মৃত্যুবরণকারীর সমাধি কিন্তু ভূমিতে থাকছে, ফেসবুকেও থাকছে।

এখন লক্ষ্য করা যাক বর্তমানে পৃথিবীতে বড় সমাধিস্থান কোনটি? গুগল অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বের বড় গোরস্থান হলো ইবাকের নাজাফ শহরের নিকটবর্তী “ভ্যালি অব পিস”। ইমাম ইবনে আবি তালিবের মাজারের পাশেই এই গোরস্থানটি অবস্থিত। স্থানীয় ভাষায় এই গোরস্থানটির নাম “ওয়াদি আল সালাম” বাংলায় যার অর্থ হয় “শান্তির উপত্যকা”। এখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রায় ১৪০০ বছর ধরে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষকে এই গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। গোরস্থানটি মোট ১ হাজার ৪৮৬ একর জায়গার উপর অবস্থিত। এখন দেখা যায় এসব বড় বড় সমাধি স্থানকে পিছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাধি স্থানে পরিণত হবে বর্তমান যুগের এই জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক। এটি নিশ্চয়ই আমার জন্য একটা খুশির খবর।

খুশির খবর হলো এই পৃথিবীতে যতদিন ফেসবুক থাকবে, আমি মৃত্যুবরণ করলেও আমার প্রোফাইলটা ফেসবুক সমাধিস্থানে ততদিন থেকে যাবে। তাহলে আমার আর ভাবনা কিসের? আমার জীবন থাকতেও ফেসবুক, মৃত্যুর পরেও ফেসবুক। জয়তু ফেসবুক!

সাহায্য চাই

মন্তব্য করতে গেলে ব্রাউজারের ব্যাক বাটন এ প্রেস করতে বলে।
কিন্তু বাটন খুঁজে পাই নাই। সাহায্য চাই প্লিজ।

সঞ্চালকের উত্তর আপনার এই পোস্টে দেয়া হলো।
সম্প্রতি কমেন্ট ব্লক ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্লগকে সুরক্ষিত রাখতে ব্লগ ডেভলপার পরীক্ষামূলক ভাবে একটি পন্থা যোগ করে দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে ক্যাপচা সলভ।

প্রথমে আপনি আপনার মন্তব্য ঘরে … হোক সেটা মন্তব্য অথবা প্রতি-মন্তব্য
মন্তব্য লিখুন। লিখা শেষে ক্যাপচা ঘরের বৃত্তে I’m not a robot ক্লিক করুন।

ইমেজ আসবে এবং কি নির্বাচন করতে হবে তার ইঙ্গিত থাকবে।
একই বিষয়ের ৩টি ছবিতে নির্বাচন করে দিন। দেখবেন টিক্ চিহ্ন আসবে।

এবার আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন বাটনে ক্লিক করলেই প্রকাশ পাবে।
এটা আপনার পিসি বা মোবাইল যে কোন ডিভাইস থেকে সম্ভব।

গাঁয়ের টান মাটির গান গীতিকবিতা-১০

গাঁয়ের টান মাটির গান
গীতিকবিতা-১০

ওই যে দূরে অজয়পারে
ছোট আমাদের গাঁয়ে,
দুধারে তার মাটির ঘর
সবুজ গাছের ছায়ে।

আমার বাড়ি বেড়ার ধারে
তাল পুকুরের ঘাট,
গ্রাম সীমানা ছাড়িয়ে পাবে
কাঁকন তলার মাঠ।

ফকির ডাঙা সামনে দিয়ে
রাঙাপথ গেছে বেঁকে।
কলসী কাঁখে গাঁয়ের বধূ
জল আনে নদী থেকে।

অজয় নদী ঘাটের কাছে
নৌকাখানি বাঁধা আছে।
নদীর তীরে শালিক পাখি
বাঁধে বাসা বটগাছে।

সাঁঝের বেলা আঁধার নামে
আমাদের ছোট গাঁয়,
মাটির ঘরে আলোক ঝরে
ফুট ফুটে জোছনায়।

কবি কুহক, না ফেরার দেশে! আমাদের ব্লগার স্বজন!

কবি কুহক, সেই সময়ের সাথী, যে সময় ব্লগের শৈশব ছেড়ে যৌবনে পা দিয়েছে, প্রচুর লেখা লেখি প্রচুর গালাগালি, বলা যায় ব্লগ যৌবন, বলে কথা, প্রত্যহ তীর ভাঙা ঢেউয়ে জলের সল্লাৎ সল্লাৎ আমেজ কবি, লেখক, হ্ওযার সে কি শুভ্র বাসনায় ছুটে চলা !

গত প্রত্যকটি বই মেলায় কাঁদে ব্যাগ গোলায় দুই তিনটা ক্যামেরা, ঝুলিয়ে লিটিলম্যাগ চত্বরে ঘুরে বেড়াতেন আর ছবি তুলতেন। দুই বছর আগে এক বই মেলায় লিটিল ম্যাগ চত্বরে কবির সাথে দেখা, বললাম গুরু কেমন আছেন? এই তো যাচ্ছে চারু ভাই! কবি কইল, চারু ভাই এই দিকে আসুন একটা ছুবি নেই, তখন বাংলা একাডিমির চত্তরের দক্ষিনের সিড়িতে বসলাম আর উনি আঁকা বাঁকা হয়ে কয়েক টা ক্লিক মারলেন, আর বললেন চারু ভাই ইন বক্স এ দিয়ে দিমুনি। দেইখেইন কেমন হইছে।

এ ছাড়া অনুপ্রাণন পত্রিকায় কবিতা ছাপলেন,

সে ব্যপারে কয়েক বার কথা বলেছি, বসে আড্ডা হইছে, উনি অফিসে কফি বানিয়ে খেতেন, বললাম না গুরু আমি কফি খাই না, আরে আমি বানামু,

আরেক দিন কবিতা নিয়ে আলাপ, আমি বললাম গুরু ইদানিং আমি তুমি থেকে বেড়িয়ে এসে কবিতা লিখছি, একটু পর বললেন বেশ তো প্রকৃতি ছাড়া কি লেখা যাবে? আমি তুমির ঘ্যানোর আর ভালো লাগে না; বললেন তাই তো, হতে পারে। এই ছিল, যত সামান্য জানা, আমার প্রাণের একজন প্রিয়, গুরু কবি কুহক। না ফেরার দেশে উনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ উনার সহায় হউন। আমিন।

গাঁয়ের টান মাটির গান গীতিকবিতা-২

গাঁয়ের টান মাটির গান
গীতিকবিতা-২

শরত এসেছে পরশ লেগেছে
গাঁয়ের টান মাটির গান,
তরুর শাখায় বিহগেরা গায়
পুলকিত সবার প্রাণ।

শিউলি ফুটেছে টগর হেসেছে
ফুলবনে ফুলের শাখে,
মাধবী মালতী বেলি আর যুঁথি
মুরগীরা বাগানে ডাকে।

শারদ আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
অজয়ের উভয় কূলে,
অজয়ের চরে শালিকেরা উড়ে
দুধার ভরা কাশফুলে।

সবুজের খেতে প্রাণ উঠে মেতে
সুশীতল হাওয়া বয়,
সোনা রোদদুরে অজয়ের চরে
স্মৃতি হয়ে কথা কয়।

যেদিকে তাকাই দেখিবারে পাই
শরতের সোনা ছবি,
পূর্বদিকে দেখি লাল রং মাখি
সকালেতে ওঠে রবি।

শূন্য শিরোনাম

একটি স্বর, ঘোলা চোখ
সমগ্র হিসেব
জীবনের দেনা পাওনা, মাপ- শাপ
অসংখ্য মর্মর ধ্বনি
রুদ্ধশ্বাস প্রার্থনা
শঙ্ক শঙ্করে
চাহনি…
রুহের নিবিড়ে রুহের আনাগোনা
অশ্রুমতি… মায়ার আঁচলে
নিশান্ত আশ্রয় – পারে শুধু জননী মা
আর কেউ না…
আর নেই… জীবন চেতনা
কালও ছিলো,
সন্তান সন্ততির ভিড়ে- এক ফালি চাঁদ ঘিরে
রাত্তির চম্পাকলি শিরস্ত্রাণ…
মর্মঘাতী হেমলক ফুলে শেষ নিশ্বাসের তীব্র আখ্যান…

তারপর চলে যাওয়া
তাকে
আমাকে
আমাদের এতিম করে- নির্বাক খসে যাওয়া,
এক পশলা শিশির প্রপাত ; ধূসর অন্ধকার
লুপ্ত নীরা
কোথাও নেই- মা
এই চৌহদ্দি মা হারা, বারান্দার ফুলের চারা- মা হারা
স্তরে স্তরে সাজানো কিচেনের তৈজসপত্র- মা হারা…
ফ্রিজে জমানো বরফ, তাজা সবজি, অক্ষত ফল;
নির্জর চাতাল… তমাল রাত… ঝুলন্ত হিজল… প্রজাপতিরা শান্ত
মা নেই কোথাও… নির্লিপ্ত দিগন্ত
বাঁধন হারা

সুপ্ত পাজরে জিকির উঠে-
রাব্বির….হাম হুমা
……. কামা.. রাব্বায়ানী… ছগিরা….

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! চতুর্থ পর্ব

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
চতুর্থ পর্ব।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব) বর্তমানে প্রকাশিত।
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব) প্রকাশিত হবে।

পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব)

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনঃ
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সংঘটিত সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীর ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াস।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তত্কাবলীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী অসীমসাহসী বিপ্লবীরা। এই বিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য্যসেন। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, শশাঙ্ক দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, অনন্ত সিং, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকও ছিলেন।
সূর্য সেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম শহরের অস্ত্রাগার দুটো লুট করা, এরপর টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা এবং এরপর সরকারী ও সামরিক বাহিনীর অফিসারদের ক্লাব ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালানো। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশদের অস্ত্রশস্ত্র লুট করা এবং রেল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।

অভিযান শুরু হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, রাত দশটায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা – এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। রাত ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করেন।

১৯০৫ সালে রাশিয়ার মতো বৃহত্‍ শক্তি ক্ষুদ্র এশীয় শক্তি জাপানের কাছে রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। একই সময়ে রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো দখল করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরই ফল ছিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জার্মানি ইংল্যান্ড তথা মিত্রবাহিনীর হাতে পরাস্ত হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিলো। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অংশ নিলে পরাধীন দেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। এই কথায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত মহাত্মা গান্ধী সহ অনেকেই যুদ্ধে যোগ দেন এবং যুদ্ধে ভারতবাসীকে উত্সারহিত করেন।

১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকারের নীতিতে কোন রকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেসব সৈন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এসময় তাকে বেকার করে নিজ নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে এক কোটির বেশি মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। এই সন্দেহ থেকেই ক্ষোভ এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের সূচনা ঘটে। এসময় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন করে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করে একই সাথে আবার রাওলাট আইন করে ইংরেজ সরকার বিরোধী সকল বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমনের জন্য নির্যাতনমূলক আইন জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়। এই আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীন ও সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দীত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধী তখন অহিংস এবং সত্যাগ্রহ তথা রক্তপতহীন আন্দোলনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদের আয়োজন করেন। এই সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সরকার গান্ধীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরও বিক্ষোভ কমেনি। ধর্মঘটে এবং বিক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সরকারী দপ্তর এবং যানবাহন। সাদা চামড়ার ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং অধিবাসীদের উপরও ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তাদের উপরও আক্রমণ করা হয়। এপ্রিলের ১৩ তারিখ দুজন রাজনৈতিক নেতাকে অমৃতসর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর পটভূমিতেই বলতে হয় হত্যাকাণ্ডের আবহ তৈরি হয়েছিল।

হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১৪ এপ্রিল, ১৯১৯ তারিখের ডায়ারের নিজের ডেসপ্যাচ অনুসারে ১৩ এপ্রিল ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০-এর মত “বিদ্রোহীকে” হতাহত করা হয়েছিল। আর এতে খরচ হয়েছিল ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি[১]। বাগের মাঝখানে কুয়োতে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়।

বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ ( ইংরেজি: Partition of Bengal,1947 )
বাংলার রাজনৈতিক ভূগোলে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ ভারত বিভক্তির ফলশ্রুতিতে সম্পন্ন হয়। এর ফলে বঙ্গ প্রদেশ দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পরে যার পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানে এবং পশ্চিমাঞ্চল ভারতের সাথে যুক্ত হয়। পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয় এবং যা পরবর্তীতে যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠন করে।
এই ভাবে বহু রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারত স্বাধীন রাস্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছেন। আজ এই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতের সেই সকল বীর সন্তানদের প্রতি জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রনাম।
(সংগৃহীত)

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চতুর্থ অঙ্ক-প্রথম দৃশ্য

সময় : ১৭৫৭ সাল, ২৯এ জুন। স্থান : মিরজাফরের দরবার।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, নকিব, মিরজাফর, ক্লাইভ, ওয়াটস, কিলপ্যাট্রিক, উমিচাঁদ, প্রহরী, মিরন, মোহাম্মদি বেগ।]
(রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভসহ অন্যান্য আমির ওমরাহরা দরবারে আসীন। দরবার কক্ষ এমনআনন্দ-কোলাহলে মুখর যে সেটাকে রাজদরবারের পরিবর্তে নাচ-গানের মজিলস বলেও ভেবে নেওয়া যেতে পারে।)
রাজবল্লভ : কই আসর জুড়িয়ে গেল যে। নতুন নবাব সাহেবের দরবারে আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
জগৎশেঠ : ঢাল-তলোয়ার ছেড়ে নবাবি লেবাস নিচ্ছেন খাঁ সাহেব, একটু দেরি তো হবেই। তাছাড়া চুলের নতুন খেজাব, চোখে সুর্মা, দাড়িতে আতর এ সব তাড়াহুড়ার কাজ নয়।
রাজবল্লভ : দর্জি নতুন পোশাকটা নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছে কি না কে জানে।
জগৎশেঠ : না না, সে ভাবনা নেই। নবাব আলিবর্দী ইন্তেকাল করার আগের দিন থেকেই পোশাকটি তৈরি। আমি ভাবছি সিংহাসনে বসবার আগেই খাঁ সাহেব সিরাজউদ্দৌলার হারেমে ঢুকে পড়লেন কি না।
রাজবল্লভ : তবেই হয়েছে। বে-শুমার হুর-গেলমানদের বিচিত্র ওড়নার গোলকধাঁধা এড়িয়ে বার হয়ে আসতে খাঁ সাহেবের বাকি জীবনটাই না খতম হয়ে যায়।
(নকীবের ঘোষণা)
নকীব : সুবে বাংলার নবাব, দেশবাসীর ধন-দৌলত, জান-সালামতের জিম্মাদার মির মুহম্মদ জাফর আলি খান দরবারে তসরিফ আনছেন। হুঁশিয়ার… (মিরজাফরের প্রবেশ, সঙ্গে মিরন। সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। মিরজাফর ধীরে ধীরে সিংহাসনের কাছে গেলেন। একবার আড়াআড়িভাবে সিংহাসনটা প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর একপাশে গিয়ে একটা হাতল ধরে দাঁড়ালেন। দরবারের সবাই কিছুটা বিস্মিত।)
রাজবল্লভ : (সিংহাসনের দিকে ইঙ্গিত করে) আসন গ্রহণ করুন সুবে বাংলার নবাব। দরবার আপনাকে কুর্নিশ করবার জন্যে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে।
মিরজাফর : (চারিদিকে তাকিয়ে) কর্নেল সাহেব এসে পড়লেন বলে।
জগৎশেঠ : কর্নেল সাহেব এসে কোম্পানির পক্ষ থেকে নজরানা দেবেন সে তো দরবারের নিয়ম।
মিরজাফর : হ্যাঁ, উনি এখুনি আসবেন।
রাজবল্লভ : (ঈষৎ অসহিষ্ণু) কর্নেল ক্লাইভ আসা অবধি দেশের নবাব সিংহাসনের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?
(নাকীবের ঘোষণা)
নকীব : মহামান্য কোম্পানির প্রতিনিধি কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ বাহাদুর, দরবার হুশিয়ার…
(ক্লাইভের প্রবেশ। সঙ্গে ওয়াটস কিলপ্যাট্রিক। গোটা দরবার সন্ত্রস্ত। মিরজাফরের মুখ আনন্দে ভরে উঠল।)
ক্লাইভ : লং লিভ জাফর আলি খান। বাট হোয়াট ইজ দিস? নবাব মসনদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ইনি কি নবাব না ফকির?
মিরজাফর : (বিনয়ের সঙ্গে) কর্নেল সাহেব হাত ধরে তুলে না দিলে আমি মসনদে বসবো না।
ক্লাইভ : (প্রচণ্ড বিস্ময়ে) হোয়াট? দিস ইজ ফ্যান্টাসটিক আই মাস্ট সে। আপনি নবাব, এ মসনদ আপনার। আমি তো আপনার রাইয়াৎ-আপনাকে নজরানা দেব।
মিরজাফর : মিরজাফর বেইমান নয়, কর্নেল ক্লাইভ। বাংলার মসনদের জন্যে আমি আপনার কাছে ঋণী। সে মসনদে বসতে হলে আপনার হাত ধরেই বসব, তা না হলে নয়।
ক্লাইভ : (ওয়াটস নিচু স্বরে) নো ক্লাউন উইল এভার বিট হিম। (দরবারের উদ্দেশে) আমাকে লজ্জায় ফেলেছেন নবাব জাফর আলি খান। আই এম কমপ্লিটলি ওভারহোয়েলমড। বুঝতে পারছিনে কী করা দরকার। (এগিয়ে গিয়ে মিরজাফরের হাত ধরল। তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে দিতে) জেন্টেলমেন, আই প্রেজেন্ট ইউ দ্যা নিউ নবাব, হিজ এক্সিলেন্সি জাফর আলি খান। আপনাদের নতুন নবাব জাফর আলি খানকে আমি মসনদে বসিয়ে দিলাম। মে গড হেল্প হিম এ্যান্ড হেল্প ইউ এ্যান্ড ওয়েল।
ওয়াটস ও
কিলপ্যাট্রিক : হিপ হিপ হুররে।
(মিরজাফর মসনদে বসলেন। দরবারের সবাই কুর্নিশ করল।)
ক্লাইভ : আপনাদের দেশে আবার শান্তি আসল।
(কিলপ্যাট্রিকের কাছ থেকে একটি সুদৃশ্য তোড়া নিয়ে নবাবের পায়ের কাছে রাখল)
ক্লাইভ : কোম্পানির তরফ থেকে আমি নবাবের নজরানা দিলাম।
ওয়াট্স ও
কিলপ্যাট্রিক : লং লিভ জাফর আলি খান।
(একে একে অন্যেরা নজরানা দিয়ে কুর্নিশ করতে লাগল। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে উমিচাঁদের প্রবেশ। দৌড়ে ক্লাইভের কাছে গিয়ে)
উমিচাঁদ : আমাকে খুন করে ফেলো- আমাকে খুন করে ফেল। (ক্লাইভের তলোয়ারের খাপ টেনে নিয়ে নিজের বুকে ঠুকতে ঠুকতে) খুন কর, আমাকে খুন কর।
মিরজাফর : কী হয়েছে? ব্যাপার কী?
উমিচাঁদ : ওহ সব বেইমান-বেইমান! না, আমি আত্মহত্যা করব। (নিজের গলা সবলে চেপে ধরল। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরুতে লাগল। ক্লাইভ সবলে তার হাত ছাড়িয়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে)
ক্লাইভ : হাউ ইউ গন ম্যাড?
উমিচাঁদ : ম্যাড বানিয়েছ। এখন খুন করে ফেল। দয়া করে খুন কর কর্নেল সাহেব।
ক্লাইভ : ডোন্ট বি সিলি। কী হয়েছে তা তো বলবে?
উমিচাঁদ : আমার টাকা কোথায়?
ক্লাইভ : কিসের টাকা?
উমিচাঁদ : দলিলে সই করে দিয়েছিলে, সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলে আমাকে বিশ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।
ক্লাইভ : কোথায় সে দলিল?
উমিচাঁদ : তোমরা জাল করেছ। (দৌড়ে সিংহাসনের কাছে গিয়ে) আপনি বিচার করুন। আপনি নবাব সুবিচার করুন।
ক্লাইভ : আমি এর কিছুই জানিনে।
উমিচাঁদ : তা জানবে কেন সাহেব। নবাবের রাজকোষ বাঁটোয়ারা করে তোমার ভাগে পড়েছে এরূপ লাখ টাকা। সকলের ভাগেই অংশ মতো কিছু না কিছু পড়েছে। শুধু আমার বেলাতে…
(ক্রন্দন)
ক্লাইভ : (সবলে উমিচাঁদের বাহু আকর্ষণ করে) ইউ আর ড্রিমিং ওমিচান্দ, তুমি খোয়াব দেখছ।
উমিচাঁদ : খোয়াব দেখছি? দলিলে পরিষ্কার লেখা বিশ লক্ষ টাকা পাব। তুমি নিজে সই করেছ।
ক্লাইভ : আমি সই করলে আমার মনে থাকত। তোমার বয়স হয়েছে- মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে এখন তুমি কিছুদিন তীর্থ কর- ঈশ্বরকে ডাক। মন ভালো হবে। (উমিচাঁদকে কিলপ্যাট্রিকের হাতে দিয়ে দিল। সে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে গেল। উমিচাঁদ চিৎকার করতে লাগল; আমার টাকা, আমার টাকা।)
ক্লাইভ : উমিচাঁদের মাথা খারাপ হয়েছে। ইওর এক্সিলেন্সি, মে ফরগিভ আস।
জগৎশেঠ : এমন শুভ দিনটা থমথমে করে দিয়ে গেল।
ক্লাইভ : ভুলে যান। ও কিছু নয়। (নবাবের দিকে ফিরে) আমার মনে হয় আজ প্রথম দরবারে নবাবের কিছু বলা উচিত।
রাজবল্লভ : নিশ্চয়ই। প্রজাসাধারণ আশ্বাসে আবার নতুন করে বুক বাঁধবে। রাজকার্য পরিচালনায় কাকে কি দায়িত্ব দেওয়া হবে তা-ও মোটামুটি তাদেরকে জানানো দরকার।
মিরজাফর : (ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে-পাগড়ি ঠিক করে) আজকের এই দরবারে আমরা সরকারি কাজ আরম্ভ করার আগে কর্নেল ক্লাইভকে শুকরিয়া জানাচ্ছি তাঁর আন্তরিক সহায়তার জন্যে। বিনিময়ে আমি তাকে ইনাম দিচ্ছি বার্ষিক চার লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারি চব্বিশ পরগণার স্থায়ী মালিকানা।
(ওয়াটস ও কিলপ্যাট্রিক এক সঙ্গে : হুররে। ক্লাইভ হাসিমুখে মাথা নোয়ালো।)
মিরজাফর : দেশবাসীকে আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে, তাঁদের দুর্ভোগের অবসান হয়েছে। সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচারের হাত থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি পেয়েছেন। এখন থেকে কারও শান্তিতে আর কোনো রকম বিঘ্ন ঘটবে না।
(প্রহরীর প্রবেশ)
প্রহরী : সেনাপতি মিরকাশেমের দূত।
মিরজাফর : হাজির কর।
(বসলেন। দূতের প্রবেশ। মিরন দ্রুত তার কাছে এগিয়ে এল। মিরনের হাতে পত্র প্রদান।
মিরন পত্র খুলেই উল্লসিত হয়ে উঠল।)
মিরন : পলাতক সিরাজউদ্দৌলা মিরকাশেমের সৈন্যদের হাতে ভগবানগোলায় বন্দি হয়েছে। তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে।
(মিরজাফরের হাতে পত্র প্রদান)
ক্লাইভ : ভালো খবর। ইউ ক্যান রিয়েলি সেফ নাও।
মিরজাফর : কিন্তু তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসবার কী দরকার? বাইরে যে কোনো জায়গায় আটকে রাখলেই তো চলত।
ক্লাইভ : (রুখে উঠল) নো, ইওর অনার। এখন আপনাকে শক্ত হতে হবে। শাসন চালাতে হলে মনে দুর্বলতা রাখলে চলবে না। আপনি যে শাসন করতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, দেশের লোকের মনে সে কথা জাগিযে রাখতে হবে এভরি মোমেন্ট। কাজেই সিরাজউদ্দৌলা শিকল-বাঁধা অবস্থায় পায়ে হেঁটে সবার চোখের সামনে দিয়ে আসবে জাফরগঞ্জের কয়েদখানায়। কোনো লোক তার জন্যে এতটুকু দয়া দেখালে তার গর্দান যাবে। এখন মসনদের মালিক নবাব জাফর আলি খান। সিরাজউদ্দৌলা এখন কয়েদি, ওয়ার ক্রিমিন্যাল। তার জন্যে যে সিমপ্যাথি দেখাবে সে ট্রেটার। আর আইনে ট্রেটারের শাস্তি মৃত্যু। অ্যান্ড দ্যাট ইজ হাউ ইউ মাস্ট রুল।
মিরজাফর ; আপনারা সবাই শুনেছেন আশা করি। সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে। যথাসময়ে তার বিচার হবে। আমি আশা করি কেউ তার জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের বিপদ টেনে আনবেন না।
ক্লাইভ : ইয়েস। তাছাড়া মুর্শিদাবাদের রাজপথ দিয়ে যখন তাকে সোলজাররা টানতে টানতে নিয়ে যাবে তখন রাস্তার দুধার তেকে অর্ডিনারি পাবলিক তার মুখে থুথু দেবে- দে মাস্ট স্পিট অন হিজ ফেস।
মিরজাফর : অতটা কেন?
ক্লাইভ : আমি জান হি ইজ এ ডেড্ হর্স। কিন্তু এটা না করলে লোকে আপনার ক্ষমতা দেখে ভয় পাবে কেন? পাবলিকের মনে টেরর জাগিয়ে রাখতে পারাটাই শাসন ক্ষমতার গ্রানাইট ফাউন্ডেশন।
(মিরজাফর মসনদ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দরবারে কাজ শেষ হলো। নবাব দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রধান অমাত্যরা এবং তার পেছনে অন্য সকলে। মঞ্চের আলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল: কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার। ধীরে ধীরে মঞ্চে অনুজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। কথা বলতে বলতে ক্লাইভ এবং মিরনের প্রবেশ।)
ক্লাইভ : আজ রাত্রেই কাজ সারতে হবে। এসব ব্যাপারে চান্স নেওয়া চলে না।
মিরন : কিন্তু হুকুম দেবে কে? আব্বা রাজি হলেন না।
ক্লাইভ : রাজবল্লভকে বল।
মিরন : তিনি নাকি অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে দেখাই করা গেল না।
ক্লাইভ : দেন?
মিরন : রায়দুর্লভ ইয়ার লুৎফ খাঁ-ওঁরাও রাজি হলেন না।
ক্লাইভ : তাহলে তোমাকে সেটা করতে হবে।
মিরন : প্রহরীরা আমার হুকুম শুনবে কেন?
ক্লাইভ : তোমার নিজের হাতেই সিরাজউদ্দৌলাকে মারতে হবে ইন ইওর ওন ইনটারেস্ট। সে বেঁচে থাকতে তোমার কোনো আশা নেই। নবাবি মসনদ তো পরের কথা, আপাতত হোয়াট অ্যাবাউট দ্যা লাভলি প্রিন্সেস? লুৎফুন্নিসা তোমার কাছে ধরা দেবে কেন সিরাজউদ্দৌলা জীবিত থাকতে?
মিরন : আমি একজন লোক ব্যবস্থা করেছি। সে কাজ করবে, কিন্তু তোমার হুকুম চাই।
ক্লাইভ : হোয়াট এ পিটি, হায়ার্ড কিলাররা পর্যন্ত তোমার কথায় বিশ্বাস করে না। এনি ওয়ে, ডাক তাকে।
(মিরন বেরিয়ে গেল এবং মোহাম্মদি বেগকে নিয়ে ফিরে এল।)
মিরন : মোহাম্মদি বেগ।
ক্লাইভ : তুমি রাজি আছ?
মোহাম্মদি বেগ : দশ হাজার টাকা দিতে হবে। পাঁচ হাজার অগ্রিম।
ক্লাইভ : এগ্রিড (মিরনকে) ওকে টাকাটা এখুনি দিয়ে দাও।
(মিরন এবং মোহাম্মদি বেগ বেরুবার উপক্রম করল)
ক্লাইভ : দেয়ার মে বি ট্রাবল, অবস্থা বুঝে কাজ কর, বি কেয়ারফুল। কাজ ফতে হলেই আামকে খবর দেবে, যাও।
(ওরা বেরিয়ে গেল। ক্লাইভের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের মুঠো দিয়ে আঘাত করে বললো)
ইট ইজ এ মাস্ট।
[দৃশ্যান্তর]

চতুর্থ অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য

সময় : দোসরা জুলাই। স্থান : জাফরাগঞ্জের কয়েদখানা
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-কারা প্রহরী, সিরাজ, মিরন, মোহাম্মদি বেগ]
(প্রায়-অন্ধকার কারাকক্ষে সিরাজউদ্দৌলা। এক কোণে একটি নিরাবরণ দড়ির খাটিয়া, অন্য প্রান্তে একটি সোরাহি এবং পাত্র। সিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন আর বসছেন। কারাকক্ষের বাইরে প্রহরারত শান্ত্রী। মিরন এবং তার পেছনে মোহাম্মদি বেগের প্রবেশ। তার দুহাত বুকে বাঁধা। ডান হাতে নাতিদীর্ঘ মোটা লাঠি। প্রহরী দরজা খুলতেই কামরায় একটুখানি আলো প্রতিফলিত হলো।)
সিরাজ : (খাটিয়ায় উপবিষ্ট-আলো দেখে চমকে উঠে) কোথা থেকে আলো আসছে। বুঝি প্রভাত হয়ে এল।
(খাটিয়া থেকে উঠে মঞ্চের সামনে এগিয়ে এল। মঞ্চের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল মিরন এবং তার পেছনে মোহাম্মদি বেগ।)
সিরাজ : (মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে) এ প্রভাত শুভ হোক তোমার জন্যে, লুৎফা। শুভ হোক আমার বাংলার জন্যে। নিশ্চিত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারী। আলহামদুলিল্লাহ।
মিরন : আল্লাহর কাছে মাফ-চেয়ে নাও শয়তান।
সিরাজ: (চমকে উঠে) মিরন! তুমি এ সময়ে এখানে? আমাকে অনুগ্রহ দেখাতে এসেছ, না পীড়ন করতে?
মিরন : তোমার অপরাধের জন্য নবাবের দন্ডাজ্ঞা শোনাতে এসেছি।
সিরাজ : নবাবের দন্ডাজ্ঞা?
মিরন : বাংলার প্রজাসাধারণকে পীড়নের জন্যে, দরবারের পদস্থ আমির ওমরাহদের মর্যাদাহানির জন্যে, বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসঙ্গত বাণিজ্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করবার জন্যে, অশান্তি এবং বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে তুমি অপরাধী। নবাব জাফর আলি খান এই অপরাধের জন্য তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
সিরাজ : মৃত্যুদণ্ড? জাফর আলি খান স্বাক্ষর করেছেন? কই দেখি।
মিরন : আসামির সে অধিকার থাকে নাকি? (পেছনে ফিরে) মোহাম্মদি বেগ।
মোহাম্মদি বেগ : জনাব।
মিরন : নবাবের হুকুম তামিল কর।
(সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল। মোহাম্মদি বেগ লাঠিটা মুঠো করে ধরে সিরাজের দিকে এগোতে লাগল)
সিরাজ : প্রথমে মিরন তারপর মোহাম্মদি বেগ। মিরন তবু মিরজাফরের পুত্র, কিন্তু তুমি মোহাম্মদি বেগ, তুমি আসছ আমাকে খুন করতে?
(মোহাম্মদি বেগ তেমনি এগোতে লাগল। সিরাজ হঠাৎ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে।)
সিরাজ : আমি মৃত্যুর জন্যে তৈরি। কিন্তু তুমি এ কাজ কোরো না মোহাম্মদি বেগ।
(মোহাম্মদি বেগ তবু এগোচ্ছে। সিরাজ আরও ভীত)
সিরাজ : তুমি এ কাজ করো না মোহাম্মদি বেগ। অতীতের দিকে চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ। আমার আব্বা-আম্মা পুত্র স্নেহে তোমাকে পালন করেছেন। তাঁদেরই সন্তানের রক্তে স্নেহের ঋণ আঃ…
(লাঠি দিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করল। সিরাজ লুটিয়ে পড়ল। মোহাম্মদি বেগ স্থির দৃষ্টিতে দেখতে লাগল মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বার হচ্ছে। ডান হাতের কনুই এবং বাঁ হাতের তালুতে ভর দিয়ে সিরাজ কিছুটা মাথা তুললেন)
সিরাজ : (স্থলিত কণ্ঠে) লুৎফা, খোদার কাছে শুকরিয়া, এ পীড়ন তুমি দেখলে না।
(মোহাম্মদি বেগ লাঠি ফেলে খাপ থেকে ছোরা খুলে সিরাজের লুণ্ঠিত দেহের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার পিঠে পর পর কয়েকবার ছোরার আঘাত করল। সিরাজের দেহে মৃত্যুর আকুঞ্চন। মোহাম্মদি বেগ উঠে দাঁড়াল)
সিরাজ : (ঈষৎ মাথা নাড়বার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু-নিস্তেজ কণ্ঠে) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…
(মোহাম্মদি বেগ লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের জীবন শেষ হলো। শুধু মৃত্যুর আক্ষেপে তার হাত দুটো মাটি আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিরকালের মতো নিস্পন্দ হয়ে গেল।)
মোহাম্মদি
বেগ : (উল্লাসের সঙ্গে) হা হা হা….

যবনিকা

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! তৃতীয় পর্ব

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
তৃতীয় পর্ব।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব) বর্তমানে প্রকাশিত।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব) প্রকাশিত হবে।
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব) প্রকাশিত হবে।

৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব)

এরপর ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হল। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ

প্রায় এই ১৯০ বছর এই ভারত ভুখণ্ডের মানুষরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আর তাই ১৮৫৭ সালে ভারতে প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন হয়। কিন্তু বর্বর ইংরেজদের ভাষায় ওটা ছিল “সিপাহী বিদ্রোহ”।

ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করে। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাত্‍ ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষ জুড়ে “ইংরেজ ভারত ছাড়” আন্দোলন তীব্রতর হয়। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সহ সব বড় বড় নেতা তখন সরাসরি ইংরেজদের হটাও আন্দোলনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন

মহাত্মা গান্ধীর দিক থেকে তাঁর “অহিংসা মনোভাব” এর কারণে হয়ত আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল না। গান্ধীজীর মতে “যখন আমি হতাশ হই , আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে । দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও শেষ সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন সর্বদাই।” অপরেকে নেতাজীর বক্তব্য ছিল,”তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু মহাত্বা গান্ধীর এই অহিংসা মনোভাব পছন্দ করতেন না। উনি চাইতেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এবং সেটা হবে সমর যুদ্ধ। তাই তিনি খুঁজছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন পরাশক্তি আছে। সেই হিসেবে সে খুঁজে পায় জামার্নীকে আর ইংল্যান্ড তো তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অংশগ্রহনটা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভালো ভাবে নেননি। তিনি হিটলারের কাছে গেলেন। কিন্তু সেই মুহুর্তে হিটলার প্রচন্ড ব্যাস্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। তাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষশক্তির আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র জাপানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এসময় জার্মান তাকে একটি সাবমেরিনে করে জাপানে পৌছে দেয়। জাপান নেতাজীর পরিকল্পনা শুনে, এতে মত দেয়। এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ মূলতঃ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী। ১৯৪২ সালে এই বাহিনী গঠিত হয়। এর বাহিনী ভিতরে ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ, ইংরেজ নির্যাতিত ভারতীয়, মুটে ও মজুর ছিল। আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও নেতাজী সুভাসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। জাপানী সহায়তায় বলীয়ান হয়ে এই বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতকে আক্রমন করে। [এখানে একটা বির্তক আছে যে কেন সে ভারতীয় হয়ে ভারতকে আক্রমন করলো? আসলে তার আক্রমন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে]

জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ অতর্কিত আক্রমনে ভারতে ইংরেজরা কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে যায়। এক যুদ্ধের ভিতরে আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান সুভাষ চন্দ্র দখল করে নেন। এসব দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধবিমান ও কামান নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ঠিক এই মুহুর্তে নেতাজীর দল একটু পিছপা হয়ে পড়ে। তখন তারা রেঙ্গুনে গিয়ে আবারো পুর্নগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কয়েক মাস ব্যাপী এ যুদ্ধে মারা যায় উভয় পক্ষের অনেক সৈন্য। কিন্তু ঠিক এই মূহুর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় পরাজিত হয় অক্ষ বাহিনী। তাই জাপানের আত্মসমাপর্নের ফলে বন্ধ হয়ে যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের রসদ সরবরাহ। তারপর থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নিখোঁজ হন। কথিত আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। (তবে তাঁর এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বির্তক আছে)

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রথম অঙ্ক-তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল, ১০ই অক্টোবর। স্থান : ঘসেটি বেগমের বাড়ি।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ঘসেটি বেগম, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রাইসুল জুহালা, রায়দুর্লভ, প্রহরী, সিরাজ, মোহনলাল, নর্তকী, বাদকগণ।]

(পৌঢ়া বেগম জাঁকজমকপূর্ণ জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, বাদক এবং নর্তকী। সুসজ্জিত খানসামা তাম্বুল এবং তাম্রকূট পরিবেশন করছে। একজন বিচিত্রবেশী অতিথির সঙ্গে আসরে প্রবেশ করল উমিচাঁদ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ের নাচ শেষ হলো। সকলের হাততালি।)

ঘসেটি : বসুন, উমিচাঁদজি। সঙ্গের মেহমানটি আমাদের অচেনা বলেই মনে হচ্ছে।
উমিচাঁদ : (যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে) মাফ করবেন বেগম সাহেবা, ইনি একজন জবরদস্ত শিল্পী। আমার সঙ্গে অল্পদিনের পরিচয় কিন্তু তাতেই আমি এঁর কেরামতিতে একেবারে মুগ্ধ। আজকের জলসা সরগরম করে তুলতে পারবেন আশা করে এঁকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
রাজবল্লভ : তাহলেও এখানে একজন অপরিচিত মেহমান-
উমিচাঁদ : না, না, সে সব কিছু ভাবতে হবে না। দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ান।
জগৎশেঠ : তাহলে আরম্ভ করুন ওস্তদজি। দেখি নাচওয়ালিদের ঘুঙুর এবং ঘাগরা বাদ দিয়ে আপনার কাজের তারিফ করা যায় কিনা।
(ঘসেটি রাজবল্লভের দৃষ্টি বিনিময়। আগন্তুক আসরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজির নামটা-
আগন্তক : রাইসুল জুহালা।
(সকলের উচ্চহাসি)
রাজদুলর্ভ : জাহেলদের রইস। এই নামের গৌরবেই আপনি উমিচাঁদজিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন নাকি?
(আবার সকলের হাসি)
উমিচাঁদ : (ইষৎ রুষ্ট) আমি তো বেশক জাহেল। তা না হলে আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই।
ঘসেটি : আপনারা বড় বেশি কথা কাটাকাটি করেন। শুরু করুন, ওস্তাদজি।
জুহালা : য্যায়সা হুকুম।আমি নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের আদবকায়দা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। আপাতত আমি আপনাদের একটা নাচ দেখব। পক্ষীকুলের একটি বিশেষ শ্রেণি, ধার্মিক হিসেবে যার জবরদস্ত নাম, সেই পাখির নৃত্যকলা আপনারা দেখবেন। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এই বিশেষ নৃত্যটি আমি জনপ্রিয় করতে চাই। (তবলচিকে) একটু ঠেকা দিয়ে দিন। (তাল বলে দিল। নৃত্য চলাকালে ঘসেটি এবং রাজবল্লভ নিচুস্বরে পরামর্শ করলেন। পরে উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভও কিছু আলোচনা করলেন। নাচ শেষ হলে সকলে হর্ষ প্রকাশ।)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজি জবরদস্ত লোক মনে হচ্ছে। ওঁকে আরও কিছু কেরামতি দেখাবার দায়িত্ব দিলে কেমন হয়?
(উমিচাঁদ রাইসুল জুহালাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কিছু বলল। তারপর নিজের আসনে ফিরে এল)
উমিচাঁদ : উনি রাজি আছেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে কলাকৌশল দেখাবার ফাঁকে ফাঁকে দু-চারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতে ওঁর আপত্তি নেই।
রাজবল্লভ : তাহলে এখন ওঁকে বিদায় দিন। পরে দরকার মতো কাজে লাগানো হবে।
রাইসুল জুহালা : বহোত আচ্ছা, হুজুর।
(সবাইকে সালাম করে কালোয়াতি করতে করতে বেরিয়ে গেল)
ঘসেটি : তাহলে আবার নাচ শুরু হোক?
রাজবল্লভ : আমার মনে হয় নাচওয়ালিদের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে কাজের কথা সেরে নেওয়াই ভালো।
ঘসেটি : তাই হোক।
(ইঙ্গিত করতেই দলবলসহ নাচওয়ালিদের প্রস্থান)
রাজদুর্লভ : বেগম সাহেবাই আরম্ভ করুন।
ঘসেটি : আপনারা তো সব জানেন। এখন খোলাখুলিভাবে যার যা বলার আছে বলুন।
জগৎশেঠ : সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে আমরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছি। কিন্তু শওকতজঙ্গ নবাব হলে আমি কি পাব তা আমাকে পরিষ্কার করে বলুন।
ঘসেটি : শওকতজঙ্গ আপনাদেরই ছেলে। সে নবাবি পেলে প্রকারান্তরে আপনারাই তো দেশের মালিক হয়ে বসবেন।
রাজদুর্লভ : এটা কোনো কথা হলো না। যিনি নবাব হবেন-
জগৎশেঠ : আমার কথা আগে শেষ হোক দুর্লভরাম।
রাজদুর্লভ : বেশ, আপনার কথাই শেষ করুন। কিন্তু মনে রাখবেন কথা শেষ হবার পর আর কোনো কথা উঠবে না।
জগৎশেঠ : সে আবার কী কথা?
রাজবল্লভ : আপনারা তর্কের ভেতর যাচ্ছেন আলোচনা শুরু করার আগেই। খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের আলোচনা দীর্ঘ করা বিপজ্জনক।
জগৎশেঠ : কথা ঠিক। কিন্তু নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে যাওয়াটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মাফ করবেন বেগম সাহেবা, আমি খোলাখুলি বলছি। অঙ্গীকার করে লাভ নেই যে, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাংয়ের গেলাস এবং নাচওয়ালি ছাড়া আর কিছুই জানে না। কাজেই শওকতজঙ্গ নবাব হবে নামমাত্র। আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার এবং পরোক্ষে তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজবল্লভ।
রায়দুর্লভ : ঠিক এই ধরনের একটা সম্ভাবনার উল্লেখ করার ফলেই হোসেন কুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
জগৎশেঠ : আমি তা বলছিনে। তা ছাড়া এখানে সে কথা অবান্তর। আমি বলতে চাইছি যে, শওকতজঙ্গ নবাবি পেলে বেগম সাহেবা এবং রাজা রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে আমাদের তেমন আশা নেই। কাজেই আমাদের পক্ষে নগদ কারবারই ভালো।
ঘসেটি : ধনকুবের গজৎশেঠকে নগদ অর্থ দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খচর চলবে কী করে?
জগৎশেঠ : না, না, আমি নগদ টাকা চাইছিনে। যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা আমি দেব, অবশ্য আমার সাধ্য। কিন্তু আসল এবং লাভ মিলিয়ে আমাকে একটা কর্জনামা সই করে দিলেই আমি নিশ্চিত হতে পারি।
রাংদুর্লভ : আমাকেও পদাধিকারের একটা একবারনামা সই করে দিতে হবে। (প্রহরীর প্রবেশ। ঘসেটি বেগমের হাতে পত্র দান)
ঘসেটি : (চিঠি খুলতে খুলতে) সিপাহসালার মিরজাফরের পত্র। (পড়তে পড়তে) তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজবল্লভ : বহোত খুব।
উমিচাঁদ : আমার তো কোনো বিষয়ে কোনো দাবিদাওয়া নেই, আমি সকলের খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই নিই। কাজেই এতক্ষণ আমি চুপ করেই আছি।
ঘসেটি : আপনারও যদি কিছু বলার থাকে এখুনি বলে ফেলুন।
উমিচাঁদ : নিজের সম্বন্ধে কিছু নয়। তবে সিপাহসালারের প্রস্তুতি আমার পছন্দ হয়েছে তাই বলছি। ইংরেজ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছে। সিরাজউদ্দৌলার পতনই তাদের কাম্য। শওকতজঙ্গ এখুনি যদি আঘাত হানতে পারেন, তিনি ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাবেন। ফলে জয় তাঁর অবধারিত।
ঘসেটি : সিরাজের পতন কে না চায়?
উমিচাঁদ : অন্তত আমরা চাই। কারণ সিরাজউদ্দৌলার নবাবিতে নির্বিঘ্ন হতে পারলে আমাদের সকলের স্বার্থই রাহুগ্রস্ত হবে।
ঘসেটি : সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের বড় বেশি আশঙ্কা।
উমিচাঁদ : কিছুমাত্র নয় বেগম সাহেবা। দওলত আমার কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়। আমি দওলতের পূজারী। তা না হলে সিরাজউদ্দৌলাকে বাতিল করে শওকতজঙ্গকে চাইব কেন? আমি কাজ কতদূর এগিয়ে এসেছি এই দেখুন তার প্রামণ।
(পকেট থেকে চিঠি বার করে ঘসেটি বেগমের হাতে দিল)
ঘসেটি : (চিঠির নিচে স্বাক্ষর দেখে উল্লসিত হয়ে) এ যে ড্রেক সাহেবের চিঠি!
উমিচাঁদ : আমার প্রস্তাব অনুমোদন করে তিনি জবাব দিয়েছেন।
ঘসেটি : (পত্র পড়তে পড়তে) লিখেছেন শওকতজঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে। তাহলে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় অভশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
রাজবল্লভ : আমাদের বন্ধু সিপাহসালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছে করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।
(হঠাৎ বাইরে তুমুল কোলাহল। সকলেই সচকিত। ঘসেটি বেগম কোলাহলের কারণ জানবার জন্যে যেতেই রাজবল্লভ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নাচওয়ালিদের ডেকে পাঠালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তারা সদলবলে কামরায় এল।)
রাজবল্লভ : আরম্ভ কর জলদি। (ঘুঙুরের আওয়াজ উঠবার পর পরই সবেগে কামরায় ঢুকলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পেছনে মোহনলাল। সবাই তড়িৎ-বেগে দাঁড়ালো। নাচওয়ালিদের নাচ থেমে গেল।)
ঘসেটি : (ভীতিরুদ্ধ কণ্ঠে) নবাব!
সিরাজ : কি ব্যাপার খালাআম্মা, বড়ো ভারী জলসা বসিয়েছেন?
ঘসেটি : (আত্মস্থ হয়ে) এ রকম জলসা এই নতুন নয়।
সিরাজ : তা নয়, তবে বাংলাদেশের সেরা লোকেরাই শুধু শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
ঘসেটি : নবাব কি নাচগানের মজলিস মানা করে দিয়েছেন?
সিরাজ : নাচগানের মহফিলের জন্যে দেউড়িতে কড়া পাহারা বসিয়ে রেখেছেন খালাআম্মা। তারা তো আমার ওপরে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিল প্রায়। দেহরক্ষী ফৌজ সঙ্গে না থাকলে এই জলসায় এতক্ষণে মর্সিয়া শুরু করতে হতো। (হঠাৎ কণ্ঠস্বরে অবিচল তীব্রতা ঢেলে)
রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, আপনারা এখন যেতে পারেন। মতিঝিলের জলসা আমি চিরকালের মতো ভেঙে দিলাম। (ঘসেটি বেগমকে) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মার পক্ষে প্রাসাদের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
ঘসেটি : (রোষে চিৎকার করে) তুমি আমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছ? তোমার এতখানি স্পর্ধা?
সিরাজ : এতে ক্রুদ্ধ হবার কি আছে? আম্মা আছেন, আপনিও তাঁর সঙ্গেই প্রাসাদে থাকবেন।
ঘসেটি : মতিঝিল ছেড়ে আমি এক পা নড়ব না। তোমার প্রাসাদে যাব? তোমার প্রাসাদ বাজ পড়ে খান খান হয়ে যাবে। (সহসা কাঁদতে আরম্ভ করলেন)
সিরাজ : (অবিচলিত) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মা। আপনাকে আমি নিয়ে যাব।
ঘসেটি : (মাতম করতে করতে) রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ বিধবার ওপরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?
রাজবল্লভ : (একটু ইতস্তত করে) জাঁহাপনা কি সত্যিই-
সিরাজ : (উত্তপ্ত) আপনাদের চলে যেতে বলেছি রাজা রাজবল্লভ। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল। আশা করি অপ্রিয় ঘটনার ভেতর দিয়ে তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।
(রাজবল্লভ প্রভৃতি প্রস্থানোদ্যত) হ্যাঁ, শুনুন রায়দুর্লভ, শওকতজঙ্গকে আমি বিদ্রোহী ঘোষণা করেছি। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আপনি তৈরি থাকবেন। প্রয়োজন হলে আপনাকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা। (তারা নিষ্ক্রান্ত হলো। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন।)
সিরাজ : মোহনলাল আপনাকে নিয়ে আসবে, খালাআম্মা। আপনার কোনো রকম অমর্যাদা হবে না। (বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন)
ঘসেটি : তোমার ক্ষমতা ধবংস হবে, সিরাজ। নবাবি? নবাবি করতে হবে না বেশিদিন। কেয়ামত নাজেল হবে। আমি তা দেখব-দেখব।
[দৃশ্যান্তর]

আগুনের গোলাপ………

আজ পরেছি লাল বেনারসী রঙের শাড়ী
কপালে লাল টিপ হাতে রেশমী চুড়ি,
খোঁপায় ফুল বাহারী,
সিঁথিতে দিয়েছি সিঁদুর তোমার ভালোবাসার রঙে,
প্রণয়ভূষণ আলতা পায়ে,
ভালোবাসার আলোয় গড়া পায়ের নুপুর,
কামনার আগুনের অলংকার,
তোমার তো খুব পছন্দ তাই না গো,
প্রণয়ী বাতাসে মধুগন্ধীর সৌরভে
অনাদ্র বাতাসে ওড়ে শাড়ির আঁচল,
ঠোঁটে তোমার ছোঁয়াতে ফুটবে ফুল গোপন বিহারে,
নীরব মনের আবেশে ওই বাঁধ ভাঙ্গা প্রেমের
জোয়ারেতে এসেছে ঢেউ চরম তরঙ্গে,
মন আজ মেতেছে উত্‍সবে তোমার ভালোবাসার রঙে,
এই যেনো ছুঁয়ে গেলে তুমি আমার ভেজা চুলে,
আমি শুধু তোমার নি:শ্বাসটুকু টের পাই,
পরক্ষণেই মনে হয় গোলাপের সুবাস নিয়ে জেগে ওঠা ভোর ।
অস্থিরতা, অপেক্ষা, নীরবতা, কল্পনা প্রেম
মিলেমিশে এক স্বর্গীয় অনুভূতি,
তোমার বুকের মধ্যে যেন কামনার আগুন ঠোঁটে মৃদু কম্পন,
আমাকে তোমার ভালোবাসার আগুনে পোড়াতে চাইছো তুমি,
আমিও সেচ্ছায় পুড়তে চাওয়া এক প্রজাপতি হই,
নিজেকে সঁপে দেই তোমার প্রেমের আগুনে,
নগ্ন পায়ে অঙ্গারে হেঁটে হেঁটে
অতঃপর তোমার ভালোবাসায় পুড়ে ছাই হয়ে যাই……

— ফারজানা শারমিন
১৩ – ০৮ – ২০১৯ ইং

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! দ্বিতীয় পর্ব

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব) বর্তমানে প্রকাশিত।
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব) প্রকাশিত হবে।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব) প্রকাশিত হবে।
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব) প্রকাশিত হবে।

১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব)

১৭৬৫ সালের ১লা অগাষ্ট লর্ড ক্লাইভ দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে।

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।

সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রথম অঙ্ক-দ্বিতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল, ৩রা জুলাই। স্থান : কলকাতার ভাগীরথী নদীতে
ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ।

[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-ড্রেক, হ্যারি, মার্টিন, কিলপ্যাট্রিক, ইংরেজ মহিলা, সৈনিক, হলওয়েল, ওয়াটস, আর্দালি।]

(কলকাতা থেকে তাড়া খেয়ে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং তাদের দলবল এই জাহাজে আশ্রয় নিয়েছে। সকলের চরম দুরাবস্থা। আহার্য দ্রব্য প্রায়ই পাওয়া যায় না। অত্যন্ত গোপনে যৎ-সামান্য চোরাচালান আসে। পরিধেয় বস্ত্র প্রায় নেই বললেই চলে। সকলেরই এক কাপড় সম্বল। এর ভেতরেও নিয়মিত পরামর্শ চলছে কী করে উদ্ধার পাওয়া যায়। জাহাজ থেকে নদীর একদিক দেখা যাবে ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। জাহাজের ডেকে পরামর্শরত ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক এবং আরও দুজন তরুণ ইংরেজ।)

ড্রেক : এই তো কিলপ্যাট্রিক ফিরে এসছেন মাদ্রাজ থেকে। ওঁর কাছেই শোন, প্রয়োজনীয় সাহায্য-
হ্যারি : এসে পড়ল বলে, এই তো বলতে চাইছেন? কিন্তু সে সাহায্য এসে পৌঁছোবার আগেই আমাদের দফা শেষ হবে মি. ড্রেক।
মার্টিন : কিলপ্যাট্রিক সাহেবের সুখবর নিয়ে আসাটা আপাতত আমাদের কাছে মোটেই সুখবর নয় তিনি মাত্র শ-আড়াই সৈন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এই ভরসায় একটা দাঙ্গাও করা যাবে না যুদ্ধ করে কলকাতা জয় তো দূরের কথা।
ড্রেক : তবুও তো লোকবল কিছুটা বাড়ল।
হ্যারি : লোকবল বাড়ুক আর না বাড়ুক আমাদের অংশীদার বাড়ল তা অবশ্য ঠিক।
ড্রেক : আহার্য কোনো রকমে জোগাড় হবেই।
মার্টিন : কী করে হবে তাই বলুন না মি. ড্রেক। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎটাই তো জানতে চাইছি। এ পর্যন্ত দুবেলা আহার্যের বন্দোবস্ত হয়েছে? ধারেকাছে হাটবাজার নেই্ নবাবের হুকুম প্রকাশ্যে কেউ কোনো জিনিস আমাদের কাছে বেচেও না। চারগুন দাম দিয়ে কতদিন গোপনে সওদাপাতি কিনতে হয়। এই অবস্থা কতদিন চলবে সেটা আমাদের জানা দরকার।
কিলপ্যাট্রিক : এত অল্পে অধৈর্য হলে চলবে কেন?
হ্যারি : ধৈর্য ধরব আমরা কীসের আশায় সেটাও তো জানতে হবে।
ড্রেক : যা হয়েছে তা নিয়ে বিবাদ করে কোনো লাভ নেই। দোষ কারো একার নয়।
মার্টিন : যাঁরা এ পর্যন্ত হুকুম দেবার মালিক তাঁদের দোষেই আজ আমরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত বিশেষ করে আপনার হঠকারিতার জন্যেই আজ আমাদের এই দুর্ভোগ।
ড্রেক : আমার হঠকারিতা?
মার্টিন : তা নয়ত কি? অমন উদ্ধত ভাষায় নবাবকে চিঠি দেবার কী প্রয়োজন ছিল? তা ছাড়া নবাবের আদেশ অমান্য করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দেবারই বা কী কারণ?
ড্রেক : সব ব্যাপারে সকলের মাথা গলানো সাজে না।
হ্যারি : তা তো বটেই। কৃষ্ণবল্লভের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা উৎকোচ নেবেন মি. ড্রেক, তা, নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো কেন? কিন্তু এটা বলতে আমাদের কোনো বাধা নেই যে, ঘুষের অঙ্ক বড় বেশি মোটা হবার ফলেই নবাবের ধমকানি সত্ত্বেও কৃষ্ণবল্লভকে ত্যাগ করতে পারেননি মি. ড্রেক।
ড্রেক : আমার রিপোর্ট আমি কাউন্সিলের কাছে দাখিল করেছি।
মার্টিন : রিপোর্টের কথা রেখে দিন। তাতে আর যাই থাক সত্যি কথা বলা হয়নি। (টেবিলের ওপর এক বান্ডিল কাগজ দেখিয়ে) ওইতো রিপোর্ট তৈরি করেছেন কলকাতা যে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছেন তার। ওর ভেতরে একটি বর্ণ সত্যি কথা খুঁজে পাওয়া যাবে?
ড্রেক : (টেবিলে ঘুষি মেরে) দ্যাটস নান অব ইওর বিজনেস।
মার্টিন : অব কোর্স ইট ইজ।
কিলপ্যাট্রিক : তোমরাই বা হঠাৎ এমন সাধুত্বের দাবিদার হলে কীসে?
ড্রেক : তোমাদের দুজনের ব্যাংক ব্যালানস বিশ হাজারের কম নয় কারোরই। অথচ তোমরা কোম্পানির সত্তর টাকা বেতনের কর্মচারী।
হ্যারি : ব্যক্তিগত উপার্জনের ছাড়পত্র কোম্পানি সকলকেই দিয়েছে। সবাই উপার্জন করছে, আমরাও করছি। কিন্তু আমরা ঘুষ খাইনি।
ড্রেক : আমিও ঘুষ খাইনে।
মার্টিন : অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে খেয়ে ঘুষ কথাটার অর্থই বদলে গেছে আপনার কাছে।
ড্রেক : তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছ। ভুলে যেও না এখনো ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব আমার হাতে।
হ্যারি : ফোর্ট উইলিয়াম?
ড্রেক : ইংরেজের আধিপত্য অত সহজেই মুছে যাবে নাকি? এই জাহাজটাই এখন আমাদের কলকাতার দুর্গ। আর দুর্গ শাসনের ক্ষমতা এখনো আমার অধিকারে। বিপদের সময়ে সকলে একযোগে কাজ করার জন্যেই মন্ত্রণা সভায় তোমাদের ডেকেছিলাম। কিন্তু দেখছি তোমরা এই মর্যাদার উপযুক্ত নও।
মার্টিন : বড়াই করে কোনো লাভ হবে না, মি. ড্রেক। আমরা আপনার কর্তৃত্ব মানব না।
ড্রেক : এত বড় স্পর্ধা? উইথড্র। হোয়াট ইউ হ্যাভ সেইড, মাফ চাও দ্বিতীয় কথা না বলে। নাথিং শর্ট অফ অ্যান আনকন্ডিশনাল অ্যাপোলজি উইল সেইভ ইউ। মাফ চাও তা না হলে এই মুহূর্তে তোমাদের কয়েদ করবার হুকুম দিয়ে দেব।
(জনৈক ইংরেজ মহিলা দড়ির ওপর একটা ছেঁড়া গাউন মেলতে আসছিলেন। তিনি হঠাৎ ড্রেকের কথায় রুখে উঠলেন। ছুটে গেলেন বচসারত পুরুষদের কাছে।)
ইংরেজ মহিলা : তবু যদি মেয়েদের নৌকোয় করে কলকাতা থেকে না পালাতেন তা হলেও না হয় এই দম্ভ সহ্য করা যেত।
ড্রেক : উই আর ইন দ্যা কাউন্সিল সেশন, ম্যাডাম, এখানে মহিলাদের কোনো কাজ নেই।
ইংরেজ মহিলা : ড্যাম ইওর কাউন্সিল, প্রাণ বাঁচাবে কী করে তার ব্যবস্থা নেই, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন সব।
ড্রেক : সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে।
ইংরেজ মহিলা : ছাই হচ্ছে। রোজই শুনছি কিছু একটা হচ্ছে। যা হচ্ছে সে তো নিজেদের ভেতরে ঝগড়া। এদিকে দিনের পর দিন এক বেলা খেয়ে, প্রায়ই না খেয়ে, অহোরাত্র এক কাপড় পড়ে মানুষের মনুষ্যত্ব ঘুচে যাবার জোগাড়।
ড্রেক : বাট ইউ সি-
ইংরেজ মহিলা : আই ডু নট সি অ্যালোন, ইউ ক্যান অলসো সি এভরি নাইট। এক প্রস্থ জামা-কাপড় সম্বল। ছেলে-বুড়ো সকলকেই তা খুলে রেখে রাত্রে ঘুমুতে হয়। কোনো আড়াল নেই আব্রু নেই। এনিবডি ক্যান সি দ্যাট পিটিএবল অ্যানাটমিক এক্সিবিশন। এর চেয়ে বেশি আর কী দেখতে চান?
(হাতের ভিজে গাউনটা ড্রেকের মুখে ছুড়ে দিতে যাচ্ছেলেন মহিলাটি, এমন সময় জনৈক গোরা সৈনিকের দ্রুত প্রবেশ।)
সৈনিক : মি. হলওয়েল আর মি. ওয়াটস।
(প্রায়ই সঙ্গে সঙ্গে হলওয়েল আর ওয়াটস ঢুকল)
কিলপ্যাট্রিক : গড গ্র্যাসিয়োস
হলওয়েল : (সকলের উদ্দেশে) গুড মনিং টু ইউ।
(সকলের সঙ্গে করমর্দন। ওয়াট্স কোনো কথা না বলে সকলের সঙ্গে করমর্দন করল। মহিলাটি একটু ইতস্তত করে অন্য দিকে চলে গেলেন।)
ড্রেক : বল, খবর বল হলওয়েল। উৎকণ্ঠায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল যে।
হলওয়েল : মুর্শিদাবাদে ফিরেই নবাব আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। অবশ্য নানা রকম ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে-কানে খৎ দিতে হয়েছে এই যা।
ড্রেক : কলকাতায় ফেরা যাবে?
হলওয়েল : না।
ওয়াটস : আপাতত নয়, কিন্তু ধীরে ধীর হয়ত একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কিলপ্যাট্রিক : কী রকম ব্যবস্থা?
ওয়াটস : অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে কিছু উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ড্রেক : তার জন্যে কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কে জানে?
হলওয়েল : একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নবাব ইংরেজের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করতে চান না। তা চাইলে এভাবে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারতেন না।
ড্রেক : তাহলে নবাবের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হয়।
হলওয়েল : কিছুটা করেই এসেছি। তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
ড্রেক : হুররে।
ওয়াটস : মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ এঁরাও আস্তে আস্তে নবাবের কানে কথাটা তুলবেন।
ড্রেক : (হ্যারি ও মার্টিনকে) আশা করি তোমাদের মেজাজ এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। আমাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে।
হ্যারি : আমরা তো ঝগড়া করতে চাইনে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জানতে চাই।
মার্টিন : যেমন হোক একটা নিশ্চিত ফল দেখতে চাই।
(উভয়ের প্রস্থান)
ড্রেক : (উচ্চকণ্ঠে) পেশেন্স ইজ দ্যা কি ওয়ার্ল্ড, ইয়াংম্যান।
হলওয়েল : (পায়ে চাপড় মেরে) উঃ, কী মশা। সিরাজউদ্দৌলা মসকিউটো ব্রিগেড মবিলাইজ করে দিয়েছে নাকি?
ড্রেক : যা বলছ ম্যালেরিয়া আর ডিসেন্ট্রিতে ভুগে কয়েকজন এর ভেতরে মারাও গেছে।
ওয়াটস : বড় ভয়ানক জায়গায় আস্তানা গেড়েছেন আপনারা।
ড্রেক : বাট ইট ইজ ইমপরট্যান্ট ফ্রম মিলিটারি পয়েন্ট অব ভিউ। সমুদ্র কাছেই। কলকাতাও চল্লিশ মাইলের ভেতরে। প্রয়োজন হলে যে কোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে।
কিলপ্যাট্রিক : দ্যাটস ট্রু। কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল। সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। বিপদ যদি আসেই তাহলে তা আসবে কলকাতার দিক দিয়ে গঙ্গার স্রোতে ভেসে। কাজেই সতর্ক হবার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে।
হলওয়েল : কলকাতার দিক থেকে আপাতত কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তার অনুমতি পেলেই জঙ্গল কেটে আমরা এখানে হাট-বাজার বসিয়ে দেব।
ড্রেক : অফকোর্স নেটিভরা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু ফৌজদারের ভয়েই তা পারছে না।
(প্রহরী সৈনিকের প্রবেশ। সে ড্রেকের হাতে এক টুকরো কাগজ দিল। ড্রেক কাগজ পড়ে চেঁচিয়ে উঠল)
উমিচাঁদের লোক এই চিঠি এনেছে।
সকলে : হোয়াট? এত তাড়াতাড়ি। (চা-সহ প্রহরীর প্রবেশ। অভিবাদনান্তে ড্রেকের হাতে পত্র দিল আগন্তুক। ড্রেক ইঙ্গিত করতেই তারা আবার বেরিয়ে গেল)
ড্রেক : (মাঝে মাঝে উচ্চৈ:স্বরে পত্র পড়তে লাগল)’- আমি চিরকালই ইংরেজের বন্ধু। মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব আমি বজায় রাখিব। – মানিকচাঁদকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হইয়াছে, সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করিবার অনুমতি দিয়াছে। এর জন্যে তাহাকে বারো হাজার টাকা নজরানা দিতে হইয়াছে। টাকাটা নিজের তহবিল হইতে দিয়া দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করিয়া পত্রবাহক মারফত পাঠাইলাম। এই টাকা এবং আমার পারিশ্রমিক ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যাহা ন্যায্য বিবেচিত হয় তাহা পত্রবাহকের হাতে পাঠাইলেই আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। বলা বাহুল্য, পারিশ্রমিক বাবদ আমি পাঁচ হাজার টাকা পাইবার আশা করি। অবশ্য ড্রেক সাহেবের বিবেচনায় তাহা গ্রাহ্য না হইলে দুই চারি শত টাকা কম লইতেও আমার আপত্তি নাই কোম্পানি আমার উপর ষোলো আনা বিশ্বাস রাখিতে পারেন। সুদূর লাহোর হইতে আমি বাংলাদেশে আসিয়াছি অর্থ উপার্জনের জন্য, যেমন আসিয়াছেন কোম্পানির লোকেরা। কাজেই উদ্দেশ্যের দিক দিয়া বিচার করিলে আমি আপনাদেরই সমগোত্রীয়।’ (চিঠি ভাঁজ করতে করতে)
এ পারফেক্ট স্কাউন্ড্রেল ইজ দিস ওঁমিচাঁদ।
হলওয়েল : কিন্তু উমিচাঁদের সাহায্য তো হাতছাড়া করা যাচ্ছে না।
ওয়াটস : ইভেন হোয়েন ইট ইজ টু কস্টলি।
ড্রেক : সেই তো মুস্কিল। ওর লোভের অন্ত নেই। মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্যে সতেরো হাজার টাকা দাবি করেছে। আমি হলপ করে বলতে পারি দুহাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না। বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে।
হলওয়েল : কিন্তু কিছুই করবার নেই। উপযুক্ত অবস্থার সুযোগ পেয়ে সে ছাড়বে কেন?
ড্রেক : দেখি, টাকাটা দিয়ে ওর লোকটাকে বিদায় করি। (বেরিয়ে গেল)
ওয়াটস : শুধু উমিচাঁদের দোষ দিয়ে কী লাভ? মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, মানিকচাঁদ কে হাত পেতে নেই?
কিলপ্যাট্রিক : দশদিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করলে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।
হলওয়েল : কিছু না, কিছু না। হাজার হাতে হাজার হাজার হাত থেকে নিয়ে দশ হাত বোঝাই করতে আর কতটুকু সময় লাগে? বিপদ সেখানে নয়। বিপদ হলো বখরা নিয়ে মতান্তর ঘটলে।
(ড্রেকের প্রবেশ)
ড্রেক : (উমিচাঁদের চিঠি বার করে) আর একটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। শওকতজঙ্গের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার লেগে গেল বলে। এই সুযোগ নেবে মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠের দল। তারা শওকত জঙ্গকে সমর্থন করবে।
ওয়াটস : খুব স্বাভাবিক। শওকতজঙ্গ নবাব হলে সকলের উদ্দেশ্যেই হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নাচওয়ালিদের নিয়ে সারাক্ষণ সে পড়ে থাকবে আর উজির ফৌজদাররা যার যা খুশি তাই করতে পারবে।
ড্রেক : আগেভাগেই তার কাছে আমাদের ভেট পাঠানো উচিত বলে আমার মনে হয়।
কিলপ্যাট্রিক : আই সেন্ড ইউ।
ওয়াটস : তা পাঠান। কিন্তু সন্ধে হয়ে গেল যে! এখানে একটা বাতি দেবে না?
ড্রেক : অর্ডারলি, বাত্তি লে আও।
হলওয়েল : নবাবের কয়েদখানায় থেকে এ দুদিনে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছি। আপনাদের অবস্থা কি ততটাই খারাপ?
ড্রেক : নট সো ব্যাড, আই হোপ।
(আর্দালি একটা বাতি রাখল)
ড্রেক : পেগ লাগাও।
(দূরে থেকে কণ্ঠস্বর)
নেপথ্যে : জাহাজ-জাহাজ আসছে।
চারজনে
সমস্বরে : কোথায়? ফ্রম হুইচ সাইড?
নেপথ্যে : সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিনখানা, চারখানা, পাঁচখানা। পাঁচখানা জাহাজ। কোম্পানির জাহাজ! (আর্দালি বোতল আর গ্লাস রাখল টেবিলে)
ড্রেক : কোম্পানির জাহাজ? মাস্ট বি ফ্রম ম্যাড্রাস। লেট আস সেলিব্রেট। হিপ হিপ হুররে।
সমস্বরে : হুররে।
(সবাই গ্লাসে মদ ঢেলে নিল)
[দৃশ্যান্তর]
(চলবে)

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায় প্রথম পর্ব

আমার পরবর্তী নতুন বিভাগ “ভারত সূর্য ডুবে গেল হায়!” পর্বে পর্বে প্রকাশ দেওয়ার আশা রাখি। সকলের সহযোগিতা ও আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে নতুন বিভাগটি আজ থেকে নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত করা হলো। শেষাংশে সংযোজিত করা হয়েছে ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন আলেখ্য গীতি নাটকের দৃশ্যায়ন।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
প্রথম পর্ব।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব)
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব)
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব)
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব)
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব)

ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব)

মুলতঃ ইংরেজরা ১৬০৮-এ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিচরণ শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের করুন মৃত্যু দিয়ে এই ভুখন্ডে অর্থাত্‍ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।

এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ইংরেজদের পক্ষ থেকে লর্ড ক্লাইভ। এবং তাকে সহায়তা করে নবাব সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ সহ অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার স্বরূপ মীরজাফর বাংলার নবাব হয় এবং লর্ড ক্লাইভ তত্কা লীন ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করে। এর পরে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ড চলে যায় আবারো ফিরে আসে ১৭৬৫ সালের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। একজন কেরানী থেকে সে গর্ভনর হয়।

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রথম অঙ্ক-প্রথম দৃশ্য

যবনিকা উত্তোলনের অব্যবহিত পূর্বে আবহ সংগীতের পটভূমিতে নেপথ্যে ঘোষণা :

ঘোষণা : এক স্বাধীন বাংলা থেকে আর এক স্বাধীন বাংলায় আসতে বহু দুর্যোগের পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি; বহু লাঞ্ছনা বহু পীড়নের গ্লানি আমরা সহ্য করেছি। দুই স্বাধীন বাংলার ভেতরে আমাদের সম্পর্ক তাই অত্যন্ত গভীর। আজ এই নতুন দিনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিস্মৃত অতীতের পানে দৃষ্টি ফেরালে বাংলার শেষ সূর্যালোকিত দিনের সীমান্ত রেখায় আমরা দেখতে পাই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। নবাব সিরাজের দুর্বহ জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনি আমরা স্মরণ করি গভীর বেদনায়, গভীর সহানুভূতিতে। সে কাহিনি আমাদের ঐতিহ্য। আজ তাই অতীতের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্য আমরা বিস্মৃতির যবনিকা উত্তোলন করছি।

১৭৫৬ সাল; ১৯এ জুন।
প্রথম দৃশ্য
সময় : ১৭৫৬ সাল, ১৯এ জুন। স্থান : ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ।
[শিল্পীবৃন্দ: মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-ক্যাপ্টেন ক্লেটন, ওয়ালি খান, জর্জ, হলওয়েল, উমিচাঁদ, মিরমর্দান, মানিকচাঁদ, সিরাজ, রায়দুর্লভ, ওয়াটস]
(নবাব সৈন্য দুর্গ আক্রমণ করছে। দুর্গের ভেতরে ইংরেজদের অবস্থা শোচনীয়। তবু যুদ্ধ না করে উপায় নেই। তাই ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গ প্রাচীরের এক অংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ নিয়ে কামান চালাচ্ছেন। ইংরেজ সৈন্যের মনে কোনো উৎসাহ নেই, তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।)
ক্লেটন : প্রাণপণে যুদ্ধ করো সাহসী ব্রিটিশ সৈনিক। যুদ্ধে জয়লাভ অথবা মৃত্যুবরণ, এই আমাদের প্রতিজ্ঞা। ভিক্টরি অর ডেথ, ভিক্টরি অর ডেথ।
(গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্লেটন একজন বাঙালি গোলন্দাজের দিকে এগিয়ে গেলেন)
ক্লেটন : তোমরা, তোমরাও প্রাণপণে যুদ্ধ করো বাঙালি বীর। বিপদ আসন্ন দেখে কাপুরুষের মতো হাল ছেড়ে দিও না। যুদ্ধ করো, প্রাণপণে যুদ্ধ করো ভিক্টরি অর ডেথ।
(একজন প্রহরীর প্রবেশ)
ওয়ালি খান : যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিন, ক্যাপ্টেন ক্লেটন। নবাব সৈন্য দুর্গের কাছাকাছি এসে পড়েছে।
ক্লেটন : না, না।
ওয়ালি খান : এখুনি যুদ্ধ বন্ধ করুন। নবাব সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে দুর্গের একটি প্রাণীকেও তারা রেহাই দেবে না।
ক্লেটন : চুপ বেইমান। কাপুরুষ বাঙালির কাছে যুদ্ধ বন্ধ হবে না।
ওয়ালি খান : ও সব কথা বলবেন না সাহেব। ইংরেজের হয়ে যুদ্ধ করছি কোম্পানির টাকার জন্যে। তা বলে বাঙালি কাপুরুষ নয়। যুদ্ধ বন্ধ না করলে নবাব সৈন্য এখুনি তার প্রাণ নেবে।
ক্লেটন : হোয়াট? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?
(ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্যে এগিয়ে গেল। অপর একজন রক্ষীর দ্রুত প্রবেশ)
জর্জ : ক্লেটন, অধিনায়ক এনসাইন পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টের সমস্ত ছাউনি ছারখার করে দিয়ে ভারী ভারী কামান নিয়ে নবাব সৈন্য দুর্গের দিকে এগিয়ে আসছে।
ক্লেটন : কী করে তারা এখানে আসবার রাস্তা খুঁজে পেলো?
জর্জ : উমিচাঁদের গুপ্তচর নবাব ছাউনিতে খবর পাঠিয়েছে। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে, আর গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে বন্যাস্রোতের মতো ছুটে আসছে।
ক্লেটন : বাধা দেবার কেউ নেই। (ক্ষিপ্তস্বরে) ক্যাপ্টেন মিনচিন দমদমের রাস্তাটা উড়িয়ে দিতে পারেননি?
জর্জ : ক্যাপ্টেন মিনচিন, কাউন্সিলার ফাকল্যান্ড আর ম্যানিংহাম নৌকোয় করে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন।
ক্লেটন : কাপুরুষ, বেইমান। জ্বলন্ত আগুনের মুখে বন্ধুদের ফেলে পালিয়ে যায়। চালাও, গুলি চালাও। নবাব সৈন্যদের দেখিয়ে দাও যে বিপদের মুখে ইংল্যান্ডের বীর সন্তান কতখানি দুর্জয় হয়ে ওঠে।
(জন হলওয়েলের প্রবেশ এবং জর্জের প্রস্থান)
হলওয়েল : এখন গুলি চালিয়ে বিশেষ ফল হবে কি, ক্যাপ্টেন ক্লেটন?
ক্লেটন : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি, সার্জন হলওয়েল?
হলওয়েল : আমার মনে হয় গভর্নর রজার ড্রেকের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এখন যুক্তিসঙ্গত
ক্লেটন : তাতে কি নবাবের অত্যাচারের হাত থেকে আমরা রেহাই পাব ভেবেছেন।
হলওয়েল : তবু কিছুটা আশা থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ করে টিকে থাকবার কোনো আশা নেই। গোলাগুলি যা আছে তা দিয়ে আজ সন্ধে পর্যন্তও যুদ্ধ করা যাবে না। ডাচদের কাছে, ফরাসিদের কাছে, সবার কাছে আমরা সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু সৈন্য তো দূরের কথা এক ছটাক বারুদ পাঠিয়েও কেউ আমাদের সাহায্য করল না।
(বাইরে গোলার আওয়াজ প্রবলতর হয়ে উঠল)
ক্লেটন : তা হলে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।
(ক্লেটনের প্রস্থান। বাইরে থেকে যথারীতি গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। হলওয়েল চিন্ততভাবে এদিক-ওদিক পায়চারি করছেন।
হলওয়েল : (পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে) এই কে আছ?
(রক্ষীর প্রেবেশ)
জর্জ : ইয়েস, স্যার।
হলওয়েল : উমিচাঁদকে বন্দি করে কোথায় রাখা হয়েছে?
জর্জ : পাশেই একটা ঘরে।
হলওয়েল : তাঁকে এখানে নিয়ে এসো।
জর্জ : রাইট, স্যার
(জর্জ দ্রুত বেরিয়ে চলে যায় এবং প্রায় পর মুহূর্তেই উমিচাঁদকে নিয়ে প্রবেশ করে)
উমিচাঁদ : (প্রবেশ করতে করতে) সুপ্রভাত, সার্জন হলওয়েল।
হলওয়েল : সুপ্রভাত। তাই না উমিচাঁদ? (গোলাগুলির আওয়াজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হলওয়েল বিস্মিতভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন) নবাব সৈন্যের গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন বলুন তো?
উমিচাঁদ : (কান পেতে শুনল) বোধহয় দুপুরের আহারের জন্যে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়েছে।
হলওয়েল : এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে উমিচাঁদ। আপনি নবাবের সেনাধ্যক্ষ রাজা মানিকচাঁদের কাছে একখানা পত্র লিখে পাঠান। তাঁকে অনুরোধ করুন নবাব সৈন্য যেন আর যুদ্ধ না করে।
উমিচাঁদ : বন্দির কাছে এ প্রার্থনা কেন সার্জন হলওয়েল? (কঠিন স্বরে) আমি গভর্নর ড্রেকের ধবংস দেখতে চাই।
(জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সার্জন হলওয়েল, গভর্নর রাজার ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকা করে পালিয়ে গেছেন।
হলওয়েল : দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছেন?
জর্জ : গভর্নরকে পালাতে দেখে একজন রক্ষী তাঁর দিকে গুলি ছুঁড়েছিল, কিন্তু তিনি আহত হননি।
উমিচাঁদ : দুভার্গ্য, পরম দুর্ভাগ্য।
হলওয়েল : যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেবেন বলে আধ ঘণ্টা আগেও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ক্যাপ্টেন ক্লেটন। শেষে তিনিও পালিয়ে গেলেন।
উমিচাঁদ : ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা।
হলওয়েল : উমিচাঁদ, এখন উপায়?
উমিচাঁদ : আবার কি? ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে গাইস হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেফানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। আপনিই এখন কমান্ডার-ইন-চিফ। (আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে এল)
হলওয়েল : (হতাশার স্বরে) উমিচাঁদ।
উমিচাঁদ : আচ্ছা, আমি রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি। আপনি দুর্গ প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দিন।
(উমিচাঁদের প্রস্থান। হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ শোনা গেল। বেগে জর্জের প্রবেশ)
জর্জ : সর্বনাশ হয়েছে। একদল ডাচ সৈন্য গঙ্গার দিককার ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়ে নবাবের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী হুড় হুড় করে কেল্লার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
হলওয়েল : সাদা নিশান ওড়াও। দুর্গ তোরণে সাদা নিশান উড়িয়ে দাও।
(জর্জ ছুটে গিয়ে একটি নিশান উড়িয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নবাব সৈন্যের অধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ ও মিরমর্দানের প্রবেশ)
মিরমর্দান : এই যে দুশমনরা এখানে থেকেই গুলি চালাচ্ছে।
হলওয়েল : আমরা সন্ধির সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছি। যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে-
মিরমর্দান : সন্ধি না আত্মসমর্পণ?
মানিকচাঁদ : সবাই অস্ত্র ত্যাগ কর।
মিরমর্দান : মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও।
মাকিনচাঁদ : তুমিও হলওয়েল, তুমিও মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়াও। কেউ একচুল নড়লে প্রাণ যাবে।
(দ্রুতগতিতে নবাব সিরাজের প্রবেশ। সঙ্গে সসৈন্যে সেনাপতি রায়দুর্লভ। বন্দিরা কুর্নিশ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। সিরাজ চারদিকে একবারে ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে হলওয়েলের দিকে এগিয়ে গেলেন।)
সিরাজ : কোম্পানির ঘুষখোর ডাক্তার রাতারাতি সেনাধ্যক্ষ হয়ে বসেছে। তোমার কৃতকার্যের উপযুক্ত প্রতিফল নেবার জন্যে তৈরি হও হলওয়েল।
হলওয়েল : আশা করি নবাব আমাদের ওপরে অন্যায় জুলুম করবেন না।
সিরাজ : জুলুম? এ পর্যন্ত তোমরা যে আচরণ করে এসেছ তাতে তোমাদের ওপরে সত্যিকার জুলুম করতে পারলে আমি খুশি হতুম। গভর্নর ড্রেক কোথায়?
হলওয়েল : তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন।
সিরাজ : কলকাতার বাইরে গেছেন, না প্রাণ নিয়ে পালিয়েছেন? আমি সব খবর রাখি, হলওয়েল। নবাব সৈন্য কলকাতা আক্রমণ করবার সঙ্গে সঙ্গে রজার ড্রেক প্রাণভয়ে কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কৈফিয়ত তবু কাউকে দিতেই হবে? বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথা থেকে আমি তার কৈফিয়ত চাই।
হলওয়েল : আমরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। শুধু আত্মরক্ষার জন্যে-
সিরাজ : শুধু আত্মরক্ষার জন্যেই কাশিমবাজার কুঠিতে তোমরা গোপনে অস্ত্র আমদানি করছিলে, তাই না? খবর পেয়ে আমার হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দি করা হয়েছে ওয়াটস আর কলেটকে। রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
সিরাজ : বন্দি ওয়াটসকে এখানে হাজির করুন।
(কুর্নিশ করে রায়দুর্লভের প্রস্থান)
সিরাজ : তোমরা ভেবেছ তোমাদের অপকীর্তির কোনো খবর আমি রাখি না।
(ওয়াটস সহ রায়দুর্লভের প্রবেশ)
ওয়াটস।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি!
সিরাজ : আমি জানতে চাই তোমাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে? কাশিমবাজারে তোমরা গোলাগুলি আমদানি করছ, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তোমরা নিজেদের দখলে আনছ, দুর্গ সংস্কার করে তোমরা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবল্লভকে তোমরা আশ্রয় দিয়েছ, বাংলার মসনদে বসবার পর আমাকে তোমরা নজরানা পর্যন্ত পাঠাওনি। তোমরা কি ভেবেছ এইসব অনাচার আমি সহ্য করব?
ওয়াটস : আমরা আপনার অভিযোগের কথা কাউন্সিলের কাছে পেশ করব।
সিরাজ : তোমাদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তোমাদের বাণিজ্য করবার অধিকার আমি প্রত্যাহার করছি।
ওয়াটস : কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য করবার অনুমতি দিল্লি বাদশাহ আমাদের দিয়েছেন।
সিরাজ : বাদশাকে তোমরা ঘুষের টাকায় বশীভূত করেছ। তিনি তোমাদের অনাচার দেখতে আসেন না।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি নবাব আলিবর্দি আমাদের বাণিজ্য করবার অনুমতি দিয়েছেন।
সিরাজ : আর আমাকে তিনি যে অনুমতি দান করে গেছেন তা তোমাদের অজানা থাকবার কথা নয়। সে খবর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন কিলপ্যাট্রিক, ক্লাইভ সকলেরই জানা আছে। মাদ্রাজে বসে ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটির সঙ্গে যে পত্রালাপ করে তা আমার জানা নেই ভেবেছো? আমি সব জানি। তবু তোমাদের অবাধ বাণিজ্যে এ পর্যন্ত কোনো বিঘ্ন ঘটাইনি। কিন্তু সদ্ব্যবহার তো দূরের কথা তোমাদের জন্যে করুণা প্রকাশ করাও অন্যায়।
ওয়াটস : ইওর এক্সিলেন্সি আমাদের সম্বন্ধে ভুল খবর শুনেছেন। আমরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছি। উই হ্যাভ কাম টু আর্ন মানি। এ্যান্ড নট টু গেট ইনটু পলিটিক্স। রাজনীতি আমরা কেন করব।
সিরাজ : তোমরা বাণিজ্য কর? তোমরা কর লুট। আর তাতে বাধা দিতে গেলেই তোমরা শাসন ব্যবস্থায় ওলটপালট আনতে চাও। কর্ণাটকে, দাক্ষিণাত্যে তোমরা কী করেছ? শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে অবাধ লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছ। বাংলাতেও তোমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাও। তা না হলে আমার নিষেধ সত্ত্বেও কলকাতার দুর্গ-সংস্কার তোমরা বন্ধ করনি। কেন?
হলওয়েল : ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে চাই্
সিরাজ : ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজরা অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, কেমন?
ওয়াটস : আমরা অশান্তি চাই না, ইওর এক্সিলেন্সি
সিরাজ : চাও কি না চাও সে বিচার পরে হবে। রায়দুর্লভ।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা!
সিরাজ : গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা কামানের গোলায় উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিন। গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে ঘোষণা করে দিন সমস্ত ইংরেজ যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। আশপাশের গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিন তারা যেন কোনো ইংরেজের কাছে কোনো প্রকারের সওদা না বেচে। এই নিষেধ কেউ অগ্রাহ্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : আজ থেকে কলকাতার নাম হলো আলিনগর। রাজা মানিকচাঁদ, আপনাকে আমি আলিনগরের দেওয়ান নিযুক্ত করলাম।
মানিকচাঁদ : জাঁহাপনার অনুগ্রহ।
সিরাজ : আপনি অবিলম্বে কোম্পানির যাবতীয় সম্পত্তি আর প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করুন। কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করবে কোম্পানির প্রতিনিধিরা আর কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখানকার প্রত্যেকটি ইংরেজ।
মানিকচাঁদ : হুকুম, জাঁহাপনা।
সিরাজ : (উমিচাঁদের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে) আপনাকে মুক্তি দেওয়া হলো, উমিচাঁদ।
(উমিচাঁদ কৃতজ্ঞতায় নতশির)
আর (মিরমর্দানকে) হ্যাঁ, রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে আমার একটা মিটমাট হয়ে গেছে। কাজেই কৃষ্ণবল্লভকেও মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করুন।
মিরমর্দান : হুকুম জাঁহাপনা।
সিরাজ : হলওয়েল।
হলওয়েল : ইওর এক্সিলেন্সি।
সিরাজ : তোমার সৈন্যদের মুক্তি দিচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার বন্দি। (রায়দুর্লভকে) কয়েদি হলওয়েল, ওয়াটস আর কলেটকে আমার সঙ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে আমি তাদের বিচার করব।
রায়দুর্লভ : জাঁহাপনা।
(সিরাজ-বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই মাথা নুইঁয়ে তাঁকে কুর্নিশ করল।)
[দৃশ্যান্তর]

গাঁয়ের কবিতা মাটির গান কবিতা-৩

গাঁয়ের কবিতা মাটির গান কবিতা-৩
-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ও লাল মাটির দেশে গো লাল মাটির দেশে।
যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

মাটির ঘরে মাটির পরশ,
মাটির গন্ধে হৃদয় অবশ,

মাটির দেশে মাটির মানুষ, থাকে কেমন বেশে গো,
থাকে কেমন বেশে।

ও লাল মাটির দেশে গো লাল মাটির দেশে।
যেথা সকাল হলে সোনার আলো

লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

সবুজ ছায়া ও মাটির স্নেহ,
কোথায় গেলে পাবে কেহ,

শঙ্খচিলে ডাক দিয়ে যায় বাতাসে চলে ভেসে গো,
বাতাসে চলে ভেসে।

ও লাল মাটির দেশে গো, লাল মাটির দেশে।
যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

অজয় ঘাটে বালির চরে,
সারি সারি শালিক উড়ে,

সারাদিন খেলে নদীচরে, নীড়ে ফেরে দিনের শেষে গো,
নীড়ে ফেরে দিনের শেষে।

ও লাল মাটির দেশে গো লাল মাটির দেশে।
যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

চাঁদের আলো পড়ে ঝরে,
আমার গাঁয়ে মাটির ঘরে,

মাটির গন্ধে মন মাতিয়ে ঘুম আসে অবশেষে গো,
ঘুম আসে অবশেষে।
ও লাল মাটির দেশে গো লাল মাটির দেশে।

যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।

ভোররাতে চাঁদ ডুবে যায়,
সবুজ গাছে পাখিরা গায়,

পূবআকাশে কিরণ ছড়ায় প্রভাতসূর্য ওঠে হেসে গো,
প্রভাতসূর্য ওঠে হেসে।

ও লাল মাটির দেশে গো লাল মাটির দেশে।
যেথা সকাল হলে সোনার আলো
লাল মাটিতে মেশে গো, লাল মাটিতে মেশে।