বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম মাশায়েখের অংশগ্রহন ও বীরত্ব

423777

বাংলাদেশের ইতিহাস এখন যেন গাছের পাতা, স্বার্থবাজ চামচারা ছিড়ে আর ছাগলে খায়।
(সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এর মধ্যে একজনও হুজুর নাই, আটষট্টি জন বীর উত্তমের মধ্যে একজনও মাওলানা নাই, ১৭৫ জন বীরবিক্রমের মধ্যে একজন মুফতি নাই, ৪২৬ জন বীরপ্রতীকের মধ্যে একজনও আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন মুফাচ্ছের নাই, তবে দুইজন মহিলা আছেন! দেশকে স্বাধীন করতে কত ধরণের মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে! কিন্তু একজন হুজুরের নেতৃত্ব ০৫-১০ জন মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে কোন প্রতিরোধ যুদ্ধের নজির পাওয়া যায়নি। নজির পাওয়া গেছে পাকিস্তানি কর্তৃক বাংলার মা বোনদের ধর্ষণে সহযোগিতায়।

আজ আমাদের ওলামাগণ মাইকে চিল্লাইয়া দেশপ্রেমের বুলি আওড়াচ্ছেন। অথচ তারাই তালেবান কর্তৃক মসজিদে/ স্কুলে আত্মঘাতী হামলায় নিরীহ মুসলিম/শিশু হত্যাকে সমর্থন করে, কখনো জিহাদি সাপ্লাইয়ের প্রত্যয়ও ব্যক্ত করে।
(কা‌র্টে‌সি: হুমায়ুন র‌শিদ খান)। )

আসল ইতিহাস ও সত্যঃ
ourislam.com এ কিছু হুজুরের কথা বলা হয়েছে যাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা ছিল। অনেকে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন।

(১) মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ: আব্দুর রশিদ ২৪৩ দিন আত্মগোপন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ যুদ্ধে অংশ নেয়, এবং এই কারণে পাকিস্তানী হানাদাররা তার বাড়ি-ঘর সব জ্বালিয়ে দেয়।

(২) মাওলানা আবুল হাসান যশোরী: তিনি ছিলেন যশোর রেল স্টেশন মাদরাসার মুহতামিম। তার মাদরাসার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল তার মাদরাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কে শহিদ করে, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সম্মানিত আলেম মাওলানা হাবীবুর রহমান এবং তার সাথে ছিলেন ৫ জন শাগরেদ আর বাকীরা ওখানে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা। পরে মাদরাসা প্রাঙ্গনেই শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়। ওই হামলায় যাশোরী গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

(৩) মাওলানা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান চিশতী: পুরান ঢাকার জুরাইনের পীর হিসেবে যিনি পরিচিত। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের “মা” উপন্যাসে আজাদের মা সফিয়া বেগম তার ছেলে আজাদকে এই পুরান ঢাকার জুরাইনের পীরের নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। জুরাইনের পীরের বহু মুরীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিল এবং জুরাইনের পীর সাহেব নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তথ্য সূত্র: আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।

(৪) মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ.: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সে সময় কওমি মাদরাসার কয়েক জন ছাত্র হুজুরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার কি অভিমত? তিনি বলেন, এটা হচ্ছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম আর আমরা হচ্ছি মজলুম। হাফেজ্জি হুজুরের এই কথা শুনে অনেক আলেম দেশের টানে ও নির্যাতিত নারীদের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু নিজে হাফেজ্জি হুজুরের সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।

(৫) শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ.: তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদিআরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতিব হিসাবে নিযুক্ত করেন। তথ্য সূত্র: শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর জীবন ও কর্ম।

(৬) ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ.: ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন তিনি। তাকে মধ্যপ্রাচ্যের আলেমরা একনামে চিনতেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, তার ফতোয়া শুনে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার অনেক বড় বড় আলেম মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. তার নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। তথ্য সূত্র: ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ও উনার সাথীবর্গ।

এ রকম আরো অনেক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ রয়েছে যাদের অবদান বাংলার মানুষ ভুলেনি। হয়তো ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম নেই। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক যতো নিবন্ধ, প্রবন্ধ এবং বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আলেমদের নেতিবাচক ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম এসব বই, নাটক, সিনেমা দেখে আলেমদের বা দাড়ি টুপি দেখলেই রাজাকার মনে করে। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। এদেশের শত্রু-মিত্রদের চিনিয়ে দিতে হবে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের যে বীরত্ব ও অবদান রয়েছে তা মানুষের কাছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।

KB-01- 00 - Copy

ঐতিহ্য সফর : আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ শুক্রবার ফেসবুক গ্রুপ Save the Heritages of Bangladesh তাদের ২৫তম ইভেন্ট পরিচালনা করছিলো। অন্য সব সদস্যদের সাথে আমি আমার বড় কন্যা সাইয়ারাও ঐদিন অংশ নিয়েছিলাম ডে ট্যুরে আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ের কিছু প্রাচীন জমিদার বাড়ি, মন্দির, মঠ, মসজিদ ঘুরে দেখার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো এই ট্যুর গুলিতে শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি দেখার তালিকায় স্থান পায়। ঐতিহ্য সফরের ঐদিনে আমরা যে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি দেখেছিলাম তা হচ্ছে –

১। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ি – আড়াইহাজার

২। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ির পিছনে অন্য একটি বাড়ি

৩। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ির কাছেই অন্য একটি প্রাচীন বাড়ি

৪। পালপাড়া মঠ – আড়াইহাজার

৫। বীরেন্দ্র রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ি – আড়াইহাজার

৬। মহজমপুর শাহী মসজিদ – সোনারগাঁ

৭। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম – বারদী

৮। জ্যোতি বসুর বাড়ি – বারদী

৯। পথের ধারে নাম না জানা মঠ – সোনারগাঁ

১০। ঠাকুর বাড়ি যাবার পথে ছোট মঠ – সোনারগাঁ

১১। ঠাকুর বাড়ি – সোনারগাঁ

১২। ঠাকুর বাড়ি মঠ – সোনারগাঁ

১৩। দুলালপুর পুল – সোনারগাঁ

১৪। পানাম নগর – সোনারগাঁ

১৫। সর্দার বাড়ি – শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর

১৬। গোয়ালদি মসজিদ – সোনারগাঁ

১৭। আব্দুল হামিদ মসজিদ – সোনারগাঁ

আগামীতে আবার দেখা হবে অন্য কোন অঞ্চলের প্রাচীন কোন স্থাপত্যের সামনে।

সফর সংঙ্গী সকলে

রাজনীতিতে Politics প্রিয় স্বদেশে কিন্তু বুঝে না ছোট ছোট মৌলভীরা

250121_tts

এই মাত্র কিছু দিন আগেও এই হেফাজতের সাথে সরকারের কুটুম কুটুম ভাব ছিলো। তবে এই ভাবের আগে কিন্তু শাপলা চত্বরে বাঁশ ঢলা দিয়ে ছিলো আওয়ামী লীগ। সেইদিন হেফাজত কোনো হেফাজত করেনি কোমলমতি শিশুদের। অসংখ্য মাদ্রাসায় চার দেয়ালে বলাৎকার এবং গরুর মত পিটানো হেফাজত কওমীদের সিনেমার পার্ট। তবে শাপলা চত্বরে এতিম শিশুদের দিয়ে বাণিজ্য হেফাজত ভালোই করেছে। কিছু নাম গোত্রহীন এতিম শাপলা চত্বরে মরে তাজা ষাঁড়ের বলাৎকার হতে রক্ষাও পেয়েছে। বিনিময় সাবেক সভাপতি পুত্র পেয়েছে সরকার হতে জায়গা জমি ও টাকার খনি।

হেফাজতের আসল চেহারা।
দূর অতীতঃ এখন হেফাজতে জড়িত বেশ কয়েকটা ইসলামী রাজনৈতিক দল। এরা একসময় বিএনপির সাথে জোটে ছিল তখন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছে। এরপর ক্ষমতায় আসে বিএনপি জোট সরকার তারপর মনে হয় হালুয়া রুটির ভাগে বনাবনি না হওয়ায় বিএনপি জোট ত্যাগ করে। সবচেয়ে মজার বিষয় ইসলামী দল ভেঙ্গে এক অংশ আবার আওয়ামী লীগের সাথে জোটও করে। তারপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক জল গড়িয়েছে। বিএনপি রাস্তায় রাস্তায় ঘেউ ঘেউ করে পাপ মোচন করতেছে। কিন্তু এইসব ইসলামী দল দেশের রাজনীতিতে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ এখন।

নিকট অতীতঃ হঠাৎ করে গজে উঠলো হেফাজত । শাপলা চত্বর সম্পর্কে সবাই জানে। সরকার বলে কিছুই হয়নি আর বিপক্ষকারি বলে শত শত লাশ পড়েছে। তবে সত্য হলো লাশ না পড়লে হেফাজত শাপলা চত্বর ছাড়তো না সরকার নাকানি চুবানি খেত। কিন্তু আমরা পরে দেখেছি হেফাজত ও সরকার চরম ধাক্কাধাক্কির ভিতর হয়ে গেল একে অপরের ভালো বন্ধু। কিছু হেফাজতি নেতা সরকারের কোলে বসে হালুয়ারুটি খেতে খেতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন কওমী মাতা। লাভ হলো হেফাজত নেতাদের কিন্ত লাশ হলো এতিম কওম। কি সুন্দর! হেফাজতি মৌলভীদের পলিটিক্স। সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের মোল্লাদের সাথে বসে ঘোষণাও দিলেন দেশ চলবে মদিনা সনদে।

কিন্তু এখন কি হলো।
বিএনপিঃ মাঠে নাই ঘাটেও নাই। মাঝে মাঝে উপনির্বাচনে হাজির হয়ে পার্থী আর উনার বউয়ের ভোট পায় আবার এর জন্যও নিজেরা নিজেরা করে কাদা ছুড়াছুড়ি। বিএনপিকে সরকার তারপরও ভয় পায় যদি বিএনপি সোজা হয়ে দাড়িয়ে যায়। যদিও এটা আদৌ সম্ভব না এমনিতে আবিষ্কার হয়েছে রাতের ভোট, অনুগত নির্বাচন কমিশনের দক্ষতায়। হামলা, মামলা, গুম, খুনে বিএনপি আরো ত্রিশ বছর পরও সোজা হবে না। এইদিকে জামায়াত রাজাকারের বদনাম মুক্ত হতে পারিনি এখনো। তাদের এতই করুণ দশা সরকার তাদের দল ভেঙে কোমরও ভেঙ্গে দিশাহারা করে দিয়েছে । তাই জামায়াত ঘোষণা দিয়েছে ত্রিশ বছর দলীয়ভাবে কোন নির্বাচন করবে না। জাতীয় পার্টি ও বাম দল এখন নাক ডুবিয়ে গোয়ালে খেতে আছে।তারপরও সরকার ভয়ে আছে।

আজই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে মানব অধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হরণকারীদের প্রতি অবরোধসহ আরো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিবে। ভাস্কর্য ও মূর্তি নিয়ে সরকার ও হেফাজতের মাঠ গরম এটা দুই বন্ধুর ডায়লগ বিনিময় মাত্র। এতে হেফাজত এবং সরকার উভয় পক্ষ লাভবান হবে। মরবে শাপলা চত্বরের মত এতিম কওম। এতে হেফাজত পাবে আগের মত জায়গা-জমি ও বাড়ি-গাড়ি আর টাকার খনি। সরকার ঘোষণা করেছে ভাস্কর্য বানাবেই আর হেফাজত বলেছে মূর্তি ভাঙ্গবেই। মনে হয় এটা সরকার এবং হেফাজতের ভিতর সমঝোতা করা হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকার বিভিন্ন দেশের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে মৌলবাদী মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে তাদের সাহায্য লাগবে। ইতিমধ্যে আবার জঙ্গীও ধরা হয়েছে । আর পশ্চিমারা মৌলবাদীর নাম শুনলেই বমি করে। তাই সরকারকে সাহায্য করবেই। আওয়ামী লীগ বিদেশীদের বুঝাতে চায় তারাই সন্ত্রাস এবং জঙ্গী দমনে একমাত্র উপযুক্ত দল।

আপনারা যারা হেফাজত হেফাজত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলে মরতে প্রস্তুত হচ্ছেন তারা গোবর মাথায় নিয়ে হৃদয়ে ইসলামের আগুনে জিহাদ করতে তৈরী হচ্ছেন তারা বিভিন্ন নদীতে লাশ হয়ে ভাসবেন কিংবা ডাস্টবিনে পচবেন। আগের মত সরকার অনুগত সমস্ত বাহিনী মাঠে নামবে অবুঝ হুজুরদের পিটিয়ে বড় হুজুরদের ঠান্ডা করবে।

শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নিজ পরিবারের দুর্নীতি এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ

শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নিজ পরিবারের দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। ১৯৭২ সালে মুজিব ক্ষমতায় যাওয়ার পর মুজিব পরিবারের প্রত্যেক সদস্য ঘুষ-দুর্নীতির চুরি ডাকাতি রাহাজানি ছিনতাই হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে বেগম মুজিব বাড়িতে বসে ঘুষ নিয়ে সবার কাজ করে দেন লাইসেন্স পারমিট ডিলারশিপ প্রভৃতি কাজের জন্য বেগম মুজিব এই ঘুষ গ্রহণ করতেন।

বেগম মুজিব মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ দিতেন এই কাজের জন্য পাঠালাম কাজটা ঠিক মত করে দিও। শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল ছিল বখাটে যুবক। তার ছিল এক বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। শেখ কামাল শত্রুদের হত্যা করতো, সুন্দরী যুবতী ধর্ষণ করতো, দিনে-দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করে আসার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হন। শেখ কামাল এক সুন্দরী যুবতীকে জোরপূর্বক তুলে এনে বিবাহ করে।

বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রী ভারতের ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে রাতারাতি ধনী হয়ে যান এবং একমাত্র ক্ষমতার মোহে ধরাকে সরা জ্ঞান ভাবতে শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে পরেরদিন এই পৃথিবী থেকে তাকে বিদায় নিতে হতো। এভাবে তার ত্রাসের রাজত্ব শুরু। সে একজন সেনা কর্মকর্তার সুন্দরী স্ত্রীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করতে একটুও বিচলিত হননি। সেই সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবের কাছে নালিশ নিয়ে গেলে উল্টো চাকরি হারান। “”সম্ভবত এটাই সেই মেজর ডালিমের কথা বলা হচ্ছে”।

শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের সুন্দরবনের কাঠ চুরি করে বাজারে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতো। ঠিকাদাররা কাজ পেতে হলে শেখ নাসের’কে কমিশন দিতে হতো। অন্যথায় কাজ পেতনা। অথবা কাজ শেষে বিল পেতনা। শেখ নাসের, বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রী ভারতে পাচার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে রাতারাতি বিশাল ধনী হিসেবে পরিচিত লাভ করে। যশোহর থানার ওসি একবার না জেনে শেখ নাসেরের ১২ ট্রাক চাউল আটক করায় ওসিকে থানার ভিতরে থাপ্পর মেরে তার ইউনিফর্ম খুলতে বাধ্য করে, পরে সে চলে যায়।

ফজলুল হক মনি শেখ মুজিবের ভাগ্নে। ফজলুল হক মনির বাড়ি বরিশাল। বংশ পদবী মোল্লা। কিন্তু তার বাবা ঘরজামাই থাকতেন। টুঙ্গিপাড়ায় স্ত্রীর ভাগের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করতেন। মনির বাবা কোনদিনও বংশ পদবী বলেননি সকলে তাকে ইন্দু মিয়া বলতো। শেখ মুজিবের ভায়রা শেখ মুসা মনির বাবাকে ইন্দুনিয়া বলতো শেখ মনি ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। শেখ মুজিবকে কোন মূল্য দিতেন না।

রাজধানী ঢাকায় জমি জালিয়াতি করে দখল করা, ব্যাংক ডাকাতি, দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকা অফিস, জায়গা বাড়িসহ দখল করা, এসবই ছিল শেখ মনির কাজ। শেখ মনির নিজস্ব একটি বাহিনী ছিল। রাজনীতিতে শেখ মনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনি, শেখ মনি, শেখ মুজিবকে সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে চলতেন।

টুঙ্গিপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ মুজিবের সম্মুখে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি হতে ঘাড় ধরে বের করে দেয় ফজলুল হক মনি। শেখ মুজিব নিজের জীবন বাঁচাবার জন্য নিজ কন্যা শেখ হাসিনাকে বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন মনির সঙ্গে আর বেগম মুজিব চেয়েছিলেন তার ভাগ্নে শেখ শহীদের সঙ্গে কন্যা হাসিনাকে বিবাহ দিতে। পারিবারিক দ্বন্দ্বে ফজলুল হক মনি শেখ শহীদকে শেখ মুজিবের সামনে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি হতে চরম অপমান করে বের করে দেন। শেখ মুজিব ভয়ে কোন প্রতিবাদ করেননি। শেখ মুজিব মনিকে খুব ভয় পেতেন। শেখ মুজিব ভাবতেন। মনি’ শেখ মুজিবের চরম ক্ষতি করবে, অন্য কেউ সাহস পাবে না। কথাটি বাস্তবে ঘটেছিল যার প্রমাণ পরবর্তীতে জানতে পারবেন।

শেখ মো: মুসা শেখ মুজিবের ভায়রা। একই বাড়ি একই ভিটা একই উঠান। শেখ মো: মুসা শিক্ষকতা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার আপন ভায়রা হওয়ার কারণে বহু লোককে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা পয়সা আত্মসাৎ করেছে। বহুদিন ঘুরাঘুরি করে চাকরি না পেয়ে চাকরিপ্রার্থীরা যখন টাকা ফেরত চাইলেন তখন পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে বিভিন্ন মামলায় জরাবার ভয় দেখাতেন। মামলায় যাবার ভয়ে পরে কেউ আর টাকা ফেরত চাইতো না।

শেখ মো: মুসা একবার গোপালগঞ্জ হতে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে যাচ্ছিলেন স্পিডবোটে বর্ণী গ্রামের বাওর পার হয়ে যখন খালে প্রবেশ করে তখন সাত বছরের একটি অবুঝ ছেলে বরই গাছে ঢিল মেরে বরই পারবার চেষ্টা করছিল। সাত বৎসরের অবুঝ বাচ্চার একটা ঢিল স্পিডবোটে গিয়ে পড়ে। স্পিড বোর্ড এর কোনো ক্ষতি হয়নি এমনকি কারো গায়ে লাগেনি অথচ শেখ মো: মুসা স্পিডবোর্ড তীরে ভিড়িয়ে সেই সাত বছরের অবুঝ বাচ্চাকে প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে পায়ের তলায় পিষে হত্যা করে। সাত বৎসরের অবুঝ শিশু বাঁচার জন্য অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিল। বাচ্চার মা বাবাও পা ধরে সন্তানের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল কিন্তু পাষাণ হৃদয় গলায় কে?

৭ বছরের অবুঝ শিশু ঘটনাস্থলেই প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ভয়ে কেউ ঠেকাতে আসেনি। কারণ তিনি শেখ মুজিবের ভায়রা। শেখ মোঃ মুসার সঙ্গে রক্ষীবাহিনী ছিল। এই নির্মম হত্যার বিচার চাইতে গিয়েছিল থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে। আর সেই বিচারের উত্তরে সেদিন পেয়েছিল থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে চরম লাঞ্ছনা।

সেদিন শেখ মুজিবের সম্মুখে তারই ভাগ্নে ফজলুল হক মনি থানা কমান্ডারকে রাজধানীর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল এবং বলেছিলো “শেখ পরিবারের লোকেরা এরকম দু’চারটা পায়ের তলায় পিষে ফেললে কিছুই যায় আসে না”। শেখ মুজিব পরে থানা কমান্ডার এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন অথচ মনিকে টু শব্দও করতে সাহস পাননি।

শেখ মুজিবের ভায়রা শেখ মুসার আরো একটি ঘটনা এলাকায় সবাই জানেন। টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিব তার মায়ের নামে শেখ সাহেরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল তৈরি করেন। হাসপাতালের এক হিন্দু সুন্দরী যুবতী নার্স ছিল সুন্দরী নার্সকে শেখ মো: মুসা বাড়িতে ডেকে পাঠান হাসপাতালের ডাক্তার নার্সকে নির্দেশ দেন মুসা সাহেবের বাড়ি গিয়ে সেবা-যত্ন করার জন্য। শেখ মো: মুসা সুন্দরী নার্সকে রুমের ভেতর জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।

নার্স আত্মহত্যা করার হুমকি দেয়। অবশেষে মান-সম্মানের চিন্তা করে সে ডাক্তারের সহযোগিতায় বুঝাতে চেষ্টা করেন যে সে যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তবে তাকে বিবাহ করবে। যদি সে অন্য কোন চিন্তা করেন বা ব্যাপারটা প্রকাশ করে তবে তার বাবা মা ভাই বোনদের হত্যা করা হবে। এই হুমকির ভয়ে বাবা মা ভাই বোনদের কথা চিন্তা করে নার্স শেখ মো: মুসার প্রস্তাবে রাজি হয়।

শেখ মো: মুসা পরবর্তীতে এই কিছুদিন পর তোমাকে বিবাহ করব, কিছুদিন পর ঢাকায় নিয়ে বিবাহ করব ইত্যাদি বলতে বলতে বছর গড়িয়ে যায়। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। শেখ মো: মুসা তখন বিবাহের দিন ধার্য করে কথা মতো নির্দিষ্ট তারিখে মুসা সাহেব’কে বিবাহ করার জন্য তার সঙ্গেই স্পিডবোটে ঢাকার উদ্দেশ্যে টুংগীপাড়া ত্যাগ করে কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সে নার্স আর কোনদিন ফিরে আসেনি। মধুমতি নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়।

এলাকাবাসীর নদীতে লাশ পেয়ে শেখ মুজিবের নিকট ঘটনাটি জানায় কিন্তু শেখ মুজিব ভায়রার অপরাধ চাপা দেয়। এই ঘটনা যারা শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলেন তাদের শেখ মুজিব এবং বেগম মুজিব অর্থ দ্বারা মুখ বন্ধ করে দেন। ঘটনা ওই পর্যন্ত চাপা পড়ে যায়।

শেখ মুজিবের শ্যালক শেখ আকরাম শেখ আকরাম টুংগীপাড়া থানার ওসিকে থানায় ঢুকে স্যান্ডেল দিয়ে পেটান ওসি মান-সম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু না বলে বদলি হয়ে যায়। গোপালগঞ্জ মহকুমার এসডিও সাহেবকে বহু লোকের সামনে তারই সরকারি অফিসে ঢুকে চুলের মুঠি ধরে থাপ্পড় মারেন। মান-সম্মানের ভয়ে এসডিও সাহেব কোন উচ্চবাচ্য করেননি। প্রশাসনের লোক আলোচনা সমালোচনা করেন। ঘটনাটি শেখ মুজিবের কাছে পৌঁছে যায়। অথচ শেখ মুজিব এরও কোন বিচার করেন নি।

অবশেষে লজ্জায় এসডিও সাহেব চাকরি থেকে পদত্যাগ করে বিদেশ চলে যান। এরূপ অসংখ্য অন্যায় কাজ করে গেছেন শেখ পরিবারের লোকেরা। আর পার পেয়ে গেছেন শুধুমাত্র শেখ মুজিবের কারণে। অথচ একটি অন্যায়ের বিচার ও শেখ মুজিব করেননি। মানুষের অভিশাপ শেখ পরিবার এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন পাপের পালা, ক্রমে ক্রমে ভারী করে তুলেছিল। পাপ কোনদিন ক্ষমা করেনি, করেও না। সত্য প্রকাশ পাবেই, তবে সত্যের জয় দেরিতে হলেও হবে। এটাই নিয়ম এটাই সত্য।

এ. আর. ভূঁইয়া
গণতন্ত্রের কবর
বইটির স্বত্বাধিকারী নিজ। বইটি বিক্রির জন্য নহে।
বইটির প্রথম প্রকাশ আজ থেকে ৩৩ বছর আগে।
Translate by Shamim Bakhtiar.

আমাদের কিছু জানা ও কিছু অজানা ইতিহাস

কিছু বই আছে যে বইয়ের শব্দগুলো মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছেনি। সেই বইয়ের মলাট হয়তোবা কেউ খুলেও দেখেনি। হতে পারে এমন কোন বই আছে যে বইগুলোর মধ্যে একাত্তরের সেই ইতিহাস হতে শুরু করে অনেক অজানা সত্য আছে যা আমাদের বর্তমান সময়ের মানুষদের অজানাই রয়ে গেছে।
বইটির লেখক। এ. আর. ভূঁইয়া। বইটির নাম ‘গ ণ ত ন্ত্রে র ক ব র’

আমরা ইতিহাসকে কাছ থেকে না দেখলেও দলীয় হাইব্রিড ইতিহাসবিদরা যা লিখে গেছে হতে পারে সে গুলোকে আমরা বেশি প্রাধান্য দেই। কিন্তু তার পরেও কিছু নিরপেক্ষ মানুষ কিছু বই লিখে গেছেন যে বইগুলো সেই সময়ে বাজারে বিক্রি করার মত অবস্থা ছিল না। সেটা সেই সময়ের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও পরিবেশের কারণে তেমনি একটি বই “গণতন্ত্রের কবর” বইটির লেখক সত্বাধিকারী শুধুমাত্র লেখক নিজে। বইটি লেখক তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীকে উপহার ছাড়া বিক্রির অনুমোদন দেননি। আমার সৌভাগ্য বইটি আমার কাছে আছে।

বাকিটা পড়লে হয়তো আপনারা জানতে পারবেন বুঝতে পারবেন সেই সময়ের প্রেক্ষাপট গুলো কি রকম ছিল। মানুষের মূল্যবান জীবনের পরিবর্তন কিভাবে ঘটেছে। মানুষ কতটা অসহায় ছিল কতটা নির্যাতিত ছিল কতটা দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছে তাদের জীবন।

এই বইয়ের কিছু কিছু লেখা আমি ট্রান্সলেট করে আপনাদের মাঝে পরিবেশন করবো।

গণতন্ত্রের কবর
– এ. আর. ভূঁইয়া।

শেখ মুজিবের শাসনামল।
১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পর ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু করেন এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা নেওয়া। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে থাকেন কিন্তু একটা শ্রেণি তাদের কোনো অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়নি। রাতের অন্ধকারে প্রকাশ্য দিবালোকে যখন সুযোগ পেয়েছে তখনই তারা ডাকাতি খুন, রাহাজানি এবং ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে ৫ লক্ষ লোককে তারা হত্যা করেছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ আর রহমান তাঁর বইতে এই প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছিলেন এই শ্রেণি কারা? কে তাদের নেতৃত্ব দিত? শেখ মুজিব দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন যুদ্ধের পর একটি নব্য স্বাধীন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থা খুব শোচনীয় আকার ধারণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এবং তাদের এ দেশীয় দালালচক্র ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। যুদ্ধে রাস্তাঘাট সবকিছু ধ্বংস হয়েছিল। চারদিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী, অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র সাহায্য আসতে থাকে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে সাহায্য প্রয়োজন ছিল তার দ্বিগুণ সাহায্য বাংলাদেশ পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা কালোবাজারে সেগুলো বিক্রি করে দেয়। তারা নামমাত্র ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে থাকে মানুষ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করে লক্ষাধিক মানুষ। দেশে আইন বলতে কিছু থাকে না। ক্ষমতাশালীরা আইনকে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। শাসন ব্যবস্থা করুন পরিণতি দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এদেশ সফরে এসে বলেছিলেন “Bangladesh is a bottomless basket” অর্থাৎ বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি। এর অর্থ বাংলাদেশকে যতই সাহায্য করা হোক না কেন উপকারে আসবেনা। লুটেরা বাহিনী খেয়ে ফেলবে। শুধু হেনরি কিসিঞ্জার নয় স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ৮ কোটি কম্বল, সাড়ে সাত কোটি মানুষ, আমারটি কোথায়? প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই প্রকাশ্যে জনসম্মুখে ত্রাণ সামগ্রী লুট করে ভারতে বিক্রি করে।

এ দেশের গরীব, অসহায় মানুষেরা ঠিকমতো সাহায্য পায়নি, তাদের লুট খুন-ধর্ষণ জালিয়াতির মাত্রা এতটাই সীমালংঘন করেছিল যে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।”

শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল পর্যালোচনা করে দেখা যায় এই বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বের অন্য কোন দেশেও এইরূপ অরাজকতা কখনো সৃষ্টি হয়নি। মানুষ শেখ মুজিবের কাছে কি চেয়েছিল? আর কি পেয়েছিল? যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, চিকিৎসার কোনো উন্নতি, হয়নি বাসস্থানের কোন উন্নতি হয়নি, কৃষিকাজে কোন উন্নতি হয়নি, কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি।

এমনকি বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যমকে গলা চেপে ধরা হয়েছিল। মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেনি মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারেনি, মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি।

তাহলে মানুষ কি চেয়েছিল? আর কি পেয়েছিল? কি জন্য ২৫ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার নামে জাতির সাথে প্রতারণা? এই কি সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসন এই কি সেই ২৫ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ?

পার্বত্য এলাকার উপজাতি কোনমতেই আদিবাসী নয়

পার্বত্য এলাকার উপজাতি কোন মতেই আদিবাসী নয়। যদি তাদের আমরা আদিবাসী বলে স্বীকার করি চরম ভুল করবো।

আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এই নিয়ে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে। একটা জাতিকে আদিবাসী বললে সমস্যা কি এটা আমরা অনেকে জানিনা। কারা আদিবাসী সেই দিক বোঝার আগে জানা দরকার বাংলাদেশে যারা হঠাৎ করে নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে এর পিছনে কারণ কি? সরকারের সাথে শান্তি চুক্তির সময়েও তারা নিজেদের আদিবাসী হিসাবে উল্লেখ করেনি। তাহলে এখন কেন করেছে।

মুল সমস্যা বাঁধিয়েছে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্রে সর্বমোট ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এসব অনুচ্ছেদের বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, সংবিধান ও আত্মপরিচয়ের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, যেসব ব্যক্তিবর্গ খুব উপজাতিদের আদিবাসী বলতে আগ্রহী তাদের অনেকেই হয়তো এই ঘোষণাপত্রের মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

নিম্নে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের কিছু অনুচ্ছেদ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

অনুচ্ছেদ-৩: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।

অনুচ্ছেদ-৪: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৫: আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।

অনুচ্ছেদ-৬: আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে চাইবে। তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে।

এছাড়াও এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির উপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক। যেমন, অনুচ্ছেদ-২৬: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।

২৬: ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।

অনুচ্ছেদ-২৮: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৩০: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখন্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না।

অনুচ্ছেদ-৩২: ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, পানি কিংবা অন্য কোনো সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।

এই অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় বাঙালীরা রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ঐ গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সে কারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। ইউএনডিপিসহ কিছু বৈদেশিক সংস্থা ইতোমেধ্যে প্রকাশ্যে এ দাবি তুলেছে।

যখন দেখি দেশের কিছু মানুষ উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আর আদিবাসীর ভিতর পার্থক্য বুঝতে চায় না তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে! রাজনীতি তো দেশকে নিয়ে, আমার কাজ যদি দেশ বিরোধী হয়ে যায় তাহলে কিসের রাজনীতি করা?

শহীদ প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়ার সুদূর পরিকল্পনায় আজও পার্বত্য এলাকা বাংলাদেশের অংশ হিসাবে টিকে আছে। মেজর জিয়া ভূমিহীন বাঙ্গালিদের তিন পার্বত্য জেলায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানে এখন বাঙালি আর উপজাতি সম পরিমান আছে। না হয় এতদিনে পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশ থেকে ছুটে যেত।
মেজর জিয়ার পরিকল্পনার কাছে উপজাতিরা ব্যর্থ হলে তখন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় তারা। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হলো আদিবাসী থিউরি।

আজ থেকে সর্বচ্চ ৩০০ বছর আগে চাকমারা বার্মা থেকে ধাওয়া খেয়ে এদেশের পার্বত্য চট্রগ্রামে আশ্রয় নেয়। অথচ এ ভুখণ্ডে হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে বাঙালীদের। আর এখন উপজাতিরা হইলো আদিবাসী। আদিবাসী হইলে পূর্ব তীমুরের মত তাদের স্বাধীন দেশ দিয়ে দিতে হবে।

২০০৫ সালে বিএনপি সরকার প্রথম জাতিসংঘে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই ধারাবাহিকতা আওয়ামি লীগ ধরে রেখেছে। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় গঠনতন্ত্রে উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক পদ থাকায় এ বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান পরিস্কার।

সূত্রঃ ক . মা। ছবিঃ মনট্টিল।

চা-পাতার কাল্পনিক ইতিহাস

একদা এক রাজা সপরিবারে তাঁর মুল্লুক ভ্রমণে বের হলেন। রাজ ভ্রমণ বহনে ছিলো ঘোড়ার গাড়ি টমটম। ভ্রমণ সঙ্গী হলেন, সেনাপতি, উজির, নাজির, কোতোয়াল-সহ কয়েক দল সৈন্যসামন্ত। রাজা-রানি ছিলেন, টমটম গাড়িতে। উজির, নাজির, কোতোয়াল ছিলেন, তাদের পরিবহন করার মতো গাড়িতে। ভ্রমণ যাত্রাকালে রাজার গড়ি বহরের দুইপাশে ছিলো ঘোড়ারোহী বিশ্বস্ত সৈন্যদল। গাড়ি বহরের পেছনে ছিলো যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ সৈন্যবাহিনী। ভ্রমণ যাত্রার সর্ব প্রথমে ছিলো, রাজার বিশ্বস্ত সেনাপতি ও বিশেষ ধরনের বাদ্য বিশারদ ব্যান্ডপার্টির দল। ব্যান্ডপার্টির দল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাস্তার আশেপাশের মানুষদের জানিয়ে দিচ্ছিল, ‘রাজা মহাশয় কোনোএক জায়গায় যাচ্ছে।’ বাজনার তালে-তালে হেলে-দুলে রাজার গাড়ি বহরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। একসময় গাড়ি বহর এগিয়ে যাচ্ছিল এক বনের ভেতর দিয়ে।

বনটি ছিলো খুবই সুন্দর পরিপাটি। সুন্দর গাছ-গাছালী আর নানাজাতের পাখ- পাখালিতে ছিলো বনটির অন্যরকম এক সৌন্দর্য আকর্ষণ। বনের সেই সৌন্দর্যে রাজাকে করেছিলো মুগ্ধ! রাজা সেই বনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করতে চাইলেন। ওমনি উজির, নাজির, কোতোয়াল সেনাপতিকে যাত্রাবিরতি করতে বললেন। সেনাপতি উজির নাজির কোতোয়াল সাহেবের হুকুম পেয়ে সেই বনের মাঝে যাত্রাবিরতি করলেন। রাজা-রানি টমটমগাড়ি থেকে নেমে বনের মাটিতে পা রাখলেন। সাথে যাওয়া সফরসঙ্গী দাস-দাসীরা রাজা-রানি বসার জন্য চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে বিছিয়ে দিলেন। রাজা-রানি কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন। এ-ই ফাঁকে সাথে যাওয়া দাস- সাসীরাও রাজাকে সন্তুষ্টি করার জন্য হালকা কিছু খাবারের আয়োজন করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর রাজা-রানি চেয়ারে এসে বসলেন, শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য। দাস-দাসীরা আয়োজন করা সেসব খাবার রাজা-রানির সামনে এনে দিলেন। সেসব খাবারের সাথে কিছু গরম পানিও ছিলো। কারণ রাজা তখন ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছিলেন, তাই গরম পানির সুব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

সারি সারি সাজানো বিছানো চেয়ার-টেবিলের একপাশে বসা ছিলেন রাজা-রানি। অন্যপাশে বসা ছিলেন রাজার উজির, নাজির, কোতোয়াল, সেনাপতি। সবার সামনেই খাবার দেওয়া হয়েছিল। রানি-সহ সবাই মনের আনন্দে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল আর খাবার খাচ্ছিলো। কিন্তু রাজা তখনো চেয়ে চেয়ে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। একসময় বনের খোলা বাতাসে রাজার সামনে থাকা গরম পানিতে নাম না জানা গাছের একটা পাতা উড়ে এসে পড়লো। গরম পানিতে গাছের পাতাটি পড়ার সাথে সাথে পুরো পাত্রের পানি লালচে হয়ে গেলো। তা দেখে রাজা রীতিমতো অবাক হয়ে বিষ্ময় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিন্তু তা রাজার রানি-সহ সফরসঙ্গী কারোই দৃষ্টিগোচর হলো না। সবাই মনের আনন্দে হাউত-মাউত করে খাবার খেয়েই যাচ্ছিল।

এদিকে রাজা পানির পাত্রে থাকা গরম পানির এ অবস্থা দেখেই যাচ্ছিল। যতই সময় যাচ্ছিল, ততই গরম পানির রং আরও লাল হতে লাগলো। রাজাও ভাবতে লাগলো, ঘটনাটা কী? কিন্তু রাজা অনেক চিন্তাভাবনা করেও গরম পানির লাল রং হয়ে যাবার রহস্য উদঘাটন করতে পারলেন না। সামনে থাকা আরও আরও খাবারও খাচ্ছিলেন না। রাজা ওই পানি নিয়েই ভাবতে লাগলেন! রাজা ভাবতে ভাবতে একসময় লাল হয়ে যাওয়া গরম পানিতে ডানহাতের তর্জনী আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখতে লাগলেন। নেড়ে-চেড়ে দেখতে দেখতে একসময় রাজা পানিতে ভিজে যাওয়া হাতের তর্জনী আঙুলটা মুখে দিলেন। তর্জনী আঙুল মুখে দেওয়ার পর রাজা গাছের পাতা পড়ে লাল হয়ে যাওয়া পানি পরম তৃপ্তি পেলেন!

তৃপ্তি পাবার পর রাজা ভিজে যাওয়া আঙুলটা চুষতে লাগলেন। রাজা নিজের আঙুল চুষতে চুষতে মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘বেশ তো! দারুণ স্বাদের পানি হয়েছে তো! এরকম পানি তো আমি জীবনেও পান করিনি?’ এ-ই বলেই পাত্রে থাকা সবটুকু পানিই রাজা পান করে ফেললেন। কিন্তু আর কোনও খাবারই খেলেন না। তখন সফরসঙ্গী উজির সাহেব রাজার না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। রাজা বললেন, ‘আজ একমুহূর্তে এমন একধরনের পানি আমি পান করেছি, এতেই আমার আজকের খাবারের চাহিদা মিটে গেলো। আর কোনও কিছুরই দরকার হবে না। এই পানি পানেই আমার চলবে।’ এরপর সফরসঙ্গী সবাই কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এখানে আয়োজন করা খাবারের মধ্যে কোনধরনের পানি ছিলো? যা খেয়ে আপনি পরম তৃপ্তি পেলেন?’ জবাবে রাজা বললেন, ‘আমার সামনে থাকা গরম পানি পান করেই আমি পরম তৃপ্তি পেয়েছি। তবে গরম পানি ছিলো স্বচ্ছ সাদা। আর আমি পানি করেছি লাল রঙের গরম পানি।

রাজার কথা শুনে সফরসঙ্গী দাস-দাসী ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ের কারণ হলো, পানি দেওয়া হয়েছিলো সাধারণ গরম পানি। আর রাজা বলছে লাল গরম পানি! দাস-দাসীরা কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগলো, ‘লাল রঙের পানি এখানে আসলো কী করে?’ সফরসঙ্গী বিশ্বস্ত দাস-দাসীদের শারীরিক কাঁপুনি দেখে রাজা হাসতে হাসতে অভয় দিয়ে বললো, ‘তোমরা কেউ ভয় পেও না। আমার সামনে থাকা পানির রং লাল হওয়ার পেছনে একটা গাছের পাতার ভূমিকা আছে। ওই পাতা গরম পানিতে পড়ার সাথে সাথে পানির রং লালচে হয়ে গেছে। আর এই লালচে পানি পান করে আমি এতোটাই তৃপ্তি পেয়েছি যে, আমার ঠাণ্ডা লাগা ভাব দূর হয়েছে। আমার মানসিক অবস্থা চাঙা হয়েছে। শারীরিক ক্লান্তির অবসান ঘটেছে।’

তখন রাজার সফরসঙ্গী সবাই আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কোন গাছের কোন পাতা? যে পাতায় গরম পানি লাল হয়ে গেলো এবং পানি পানে পরম তৃপ্তি অনুভব করছেন?’ তখন রাজা পানির পাত্র থেকে নাম না জানা গাছের পাতাটি উঠিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বললো, ‘আজকে আমার ভ্রমণ এখানে এই বনেই শেষ করলাম। তবে যথাশীঘ্র বন থেকে রাজমহলে ফিরে যাচ্ছি না। সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে, এই পাতাটি কোন গাছের পাতা? যতক্ষণ না পর্যন্ত এই পাতার গাছটিকে খুঁজে বের করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই বনেই থাকতে হচ্ছে। কাজেই, আপনারা সবাই বনের ভেতরে ঘুরে-ফিরে এই বিশেষ ধরনের পাতার গাছটির সন্ধান করুন। যিনি প্রথমে খুঁজে বের করতে পারবেন, তাকে আমি উপযুক্ত বকসিস দিবো!’

রাজার এই ঘোষণায় সফরসঙ্গী উজির, নাজির, কোতোয়াল, সেনাপতি সৈন্যদলের সৈন্যরা, দাস-দাসীরা সবাই গরম পানিতে পড়া পাতার গাছটি খুঁজে বের করতে পুরো বনটা ওলট-পালট করে ফেলতে লাগলো। কিন্তু সন্ধান পাচ্ছিল না। একসময় এক দাসী গরম পানিতে পড়া পাতার গাছটি খুঁজে পেলো। রাজা নিজ হাতে থাকা পাতাটির সাথে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মিলিয়ে নিশ্চিত হলেন, ঠিক এই গাছেরই পাতা। গাছটি ছিলো আকারে খুবই ছোট। তবে ঝাপটা। পুরো বনে এই একটা গাছই পাওয়া গিয়েছিল। তখন রাজা মনের আনন্দে ওই দাসীকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করলেন এবং খুঁজে পাওয়া গাছটিকে বন থেকে মাটি-সহ উঠিয়ে রাজার মহলের পাশে রোপণ করতে হুকুম দিলেন। রাজার হুকুম বলে কথা! হুকুম দিতে দেরি হয় ঠিক! কিন্তু কাজ হতে দেরি হয় না!

তারপর বন থেকে ছোট আকারের গাছটিকে মাটি সহকারে উঠিয়ে রাজার মহলের একপাশে রোপণ করে রাখা হলো। দিনে দিনে গাছটিও তাজা হতে লাগলো। গাছের ডাল-পালাও গজাতে শুরু করলো। রাজাও গাছের পরিচর্যা করার জন্য লোক নিয়োগ-সহ পাতা নিয়ে গবেষণা করতে গবেষকও নিয়োগ দিলো। গবেষকরা প্রথমে গাছের শুকনো পাতা শিলপাটায় বেটে গুড়ো করলো। তারপর পানি লাল হয় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য গুড়ো গুলো গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু গরম পানি কিছুতেই লাল হলো না। তারপর আবার ওই গাছের কিছু কচিপাতা শিলপাটায় বেটে রোদে শুকানো হলো। সেই শুকনো গুড়ো গুলো গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো। যখনই গরম পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলো, তখনই পানি লাল রং ধারণ করতে লাগলো। একপর্যায়ে পাত্রে থাকা গরম পানি লালচে হয়ে গেলো। সেই পানিতে কিছু মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে গবেষকরা পান করে দেখলো।

গাছের কচিপাতার শুকনো গুড়ো মিশ্রিত লালচে গরম পানি করার পর সবাই তখন মহানন্দে দিশেহারা। সবাই জিভে তা মেরে বলতে লাগলো, “আহা্ কী মজা!” সেই মজার খবর মুহুর্তেই পৌঁছে গেলো রাজার কাছেও। সাথে গরম লালচে পানিও পৌঁছে গেলো। রাজা লালচে গরম পানি পানে সেদিনের বনের ভেতরের চেয়েও আরও বেশি তৃপ্তি পেলো। তারপর থেকে গাছটি নিয়ে শুরু হলো জোর গবেষণা আলোচনা-সহ গাছের বংশবৃদ্ধি করার জোর তৎপরতা। সেই থেকে আস্তে আস্তে দেশে দেশে শুরু হলো ওই গাছের বংশবৃদ্ধি-সহ সহজ উপায়ে গাছের পাতা গুড়ো করার কৌশল ও ব্যবহার। একসময় সেই গাছের সেই পাতার গুড়ো দেশে দেশে মানুষের হাতে হাতে ফ্রি বিতরণ করা হতো। সাথে দেওয়া হতো এর স্বাদ বাড়ানোর জন্য কিছু মিষ্টিজাতীয় চিনিও। উদ্দেশ্য ওই গাছের পাতার গুড়োর চাহিদা বাড়ানো এবং মানুষকে এর নেশায় আসক্ত করানো। তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়েছে। দিনে দিনে তুলনামূলকহারে এর ব্যবহারও অনেক বেড়েছে! চাহিদাও বেড়েছে প্রচুর!

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একসময়ের ফ্রি পাতার গুড়োর নেশায় আজ আমরা সবাই আসক্ত! আজ আমরা ঘরে বাইরে ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবাই সেই বিষ্ময়কর গাছের পাতার রসের নেশায় এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, সকাল থেকে শুরু করে দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা আমাদের আরও অন্যান্য খাবারের সাথে ওই গাছের পাতার সুমধুর রস পান করতেই হচ্ছে। তা-ও আবার আমাদের দেশ-সহ বিশ্বের সব দেশের সব অঞ্চলে সমানতালেই চলছে ওই বিষ্ময়কর গাছের পাতার রস পান। যা সারাবিশ্বে আজ এটাকে একধরনের মহৌষধ বলেও গণ্য করা হয়। কেননা, ওই গাছের পাতার গরম পানি না হলে আমাদের আর হয়ই না। মোটকথা বিয়ে-সাদীতে, অতিথি আপ্যায়নে, রাজনৈতিক মঞ্চে, অফিস-আদালতে, দেশের অর্থনৈতিক চাঙা-সহ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণেও ওই বিষ্ময়কর গাছের পাতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলেও বিশ্বাস। এখন সবার জানার কৌতুহল থাকতে পারে যে, তাহলে ওই বিষ্ময়কর গাছটির নাম কি? ওই বিষ্ময়কর গাছটির নাম, চা গাছ। আর পাতাটির নাম, চা-পাতা।

জানা যায় এই গাছটির আদি জন্মভূমি গণচীন। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উৎকৃষ্ট স্বচ্ছ গরিম পানীয় হিসেবেও গণ্য করা হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আমাদের দেশের সিলেট অঞ্চলে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চাষ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখার সর্বশেষ গুটিকয়েক লাইনের তথ্যটুকু উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ। আর পুরো লেখা নিজের ধারণা মতে সাজিয়ে লেখা।

ছবি সংগ্রহ গুগল থেকে।

আমি ঢাকা মহানগরী

এই যে আজকে আপনারা বসবাস করছেন আমার বুকে এই আমি ঢাকা মহানগরী। এক সময় কিন্তু আমি এত বড় ছিলাম না। নবাবদের আমলে মাত্র কয়েকজন নবাব বাড়ির নায়েব, গোমস্তা আর খানসামারা এখানে বসবাস করত এবং তাদের সেবা যত্নের জন্য কামার, কুমার, নাপিত ধোপা, স্বর্ণকার, তাঁতি, গোয়ালা, ময়রা এমনি যাদের প্রয়োজন তেমনি কয়েক ঘর জনবসতি ছিল। সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় চারশো পঞ্চাশ বছর হবে। আমার চারিদিকে ছিল খাল বিল নদী নালা এমনি সব কিছু, হ্যাঁ হ্যাঁ, ধান ক্ষেতও ছিল। ওই যে বুড়িগঙ্গা নদী, সে যে কি সুন্দর নদী ছিল তা বলার নেই। নবাব বাড়ির আশপাশ থেকে এসে রাজহাঁস গুলি যখন নদীর বুকে সাতার কাটত কি সুন্দর ছিল সে দৃশ্য। পানসী নৌকা, নবাবদের বজরা ছোপাত ছোপাত বৈঠা তুলে বেয়ে যেত সে দৃশ্য ছিল দেখার মত। এগুলি আবার কখনও পাল তুলে যেত তখন আরও বেশি সুন্দর লাগত, নানা রঙ বেরঙের পাল দেখতে যে কি সুন্দর ছিল তা আর বলার নয়। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কতজনে এই দৃশ্য দেখত! বজরা বা পানসী থেকে ঘাটে নেমে বেশিরভাগই যেত ঘোরার গাড়ি করে। সাধারণ মানুষেরা যেত এক্কা গাড়ি করে। গরুর গাড়িও ছিল আবার হাতে টানা রিকশাও ছিল অনেক। নবাব বাড়ির মেয়েরা তাতি বাজারে গয়না বানাতে যেত, তারা বেশির ভাগই আসত ঘোরার গাড়িতে চেপে। অল্প কিছু পাকা রাস্তা ছিল। নবাব বাড়ির সৈন্যরা যখন ওই পাকা রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে যেত ভারি সুন্দর লাগত। লোকজনে চেয়ে দেখত তাদের। সবারই একরকম পোষাক, এক রকম তরবারি হাতে, মাথায় এক রকম পাগড়ী। সন্ধ্যার পরে রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে দিত। সে সব দিন ছিল সুখের দিন শান্তির দিন। মানুষ কত ভাবেই যে উৎসব করত যেমন শবে বরাত, রমজান এবং তারপরে ঈদ, দুর্গা পূজা, কালি পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা। এ ছাড়া বার মাসে তের পাবন লেগেই ছিল। নবান্ন উৎসব, বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব, নৌকা বাইচ এমনি কত কি! সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে লোক জনেরা আমার বুকের উপর দিয়ে হেটে বেড়াত বাচ্চারা কত খেলাধুলা করত! কি আনন্দ ছিল! দেশের নানা জায়গা থেকে নৌকা করে কত মালামাল লোকজন আসত যেত। সদরঘাটে সবসময় হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকত।

একদিন দেখলাম কোথায় থেকে ফিরিঙ্গী না কি যেন বলে তারা এসে হাজির। ইংরেজিতে ট্যাঁস টুস করে কথা বলত। আস্তে আস্তে তাদের অনেক লোকজন এসে আমার বুকে ডেরা বাধতে শুরু করল। সে যে কি ভয়ংকর দিন গেছে সে কথা মনে হলে আজও আমার বুক কেপে উঠে। দেশের মানুষ যারা ওদের কথামত চাষ বাস কাজ কর্ম করত না তাদের ধরে এনে চাবুক দিয়ে যে কি মারাই মারত সে সব চাবুক দেখলেও ভয় হতো। শুরু হলো রক্তের বন্যা, এত রক্ত আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এইতো শুরু হলো অত্যাচার। তবে ওই ফিরিঙ্গীরা কিছু ভাল কাজ করেছিল। আমার উপর দিয়ে বেশ কিছু রাস্তা বানিয়েছিল, স্কুল কলেজ বানিয়েছিল। ওদের দেখাদেখি অভিজাত এবং ধনী পরিবারের লোকজনেরা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বানিয়েছিল। তারপরের ইতিহাস বড়ই করুণ। যখন তাদের অত্যাচার চরমে পৌঁছল তখন এদেশের যুবকেরা একে একে জেগে উঠল। অনেক চোরাগোপ্তা আক্রমণ, শাস্তি আরও কত কি হলো! অনেক দিন পরে দেখলাম ওই ব্যটা ফিরিঙ্গীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু ওরা পালালে কি হবে ওদের জায়গায় যারা এলো তারা আরও ভয়ংকর। পাঞ্জাবী না কি যেন বলত। কেমন করে কথা বলত। একদিন শুনলাম আমাদের এখান থেকে ওরা সমস্ত সম্পদ নিয়ে অনেক দূরে নাকি ওদের দেশ সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে ওরা আবার এক হুকুম জারি করল, কেও বাংলায় কথা বলতে পারবে না। আচ্ছা বলুনতো, বাংলায় কথা বলা যাবে না এটা আবার কেমন কথা? জন্ম থেকে যে ভাষায় কথা বলে আসছে সেই কথা কি ইচ্ছে করলেই বন্ধ করা যায়? এইতো শুরু হলো এক যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ত তারা সহ সকল ছাত্র ছাত্রী মিলে এর প্রতিবাদ করল আর ফলাফল যা হবার তাই হলো। পাঞ্জাবীরা নির্বিচারে গুলি শুরু করল। কতজন মারা গেল। বয়ে গেল রক্ত স্রোত। তাদের কথা মনে রাখার জন্য শহীদ মিনার হলো। আজও তাদের কথা কেও ভুলেনি আর কোনদিন ভুলবেও না। তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। সবই হয়েছে আমার বুকের উপরে। এমনি করে নানা অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন শেখ মজিবর রহমান দল সংগঠন করা শুরু করল। ক্রমে সে যখন শক্তিমান হলো তখন একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিল আর অমনিই সারা দেশবাসী তার আহবানে সারা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। যুবকেরা ট্রেনিঙের জন্য চলে গেল পাশের দেশে। ওদিকে ওই পাঞ্জাবীরা শুরু করল বাঙালি নিধন অভিযান। আমার উপরে ছাত্র ছাত্রীদের যত হল হোস্টেল, পুলিশ নিবাস ছিল সে গুলিসহ পথে ঘাটে শুরু করল ট্যাংক মেশিন গান দিয়ে গুলি করা। কত মানুষ যে মরল তার কোন হিসাব নেই। অনুমান করে বলছি, কয়েক লক্ষতো হবেই। যারা সুযোগ পেল তারা আমার আশ্রয় ছেড়ে চলে গেল, যার যেখানে সুবিধা। সেদিন আমার যে কি কান্না পেয়েছিল! কিন্তু আমি কাওকে কিছু বলতে পারিনি। আমিই তাদের বলে দিলাম তোমরা যে যেখানে পার চলে যাও। আমি আর তোমাদের বুকে আগলে রাখতে পারছি না, আমার উপরে হায়েনার আসর হয়েছে। আমি নিজেই বিপদগ্রস্ত। কয়েকদিন আগে থেকেই ওদের সেনা দলে আমার বুক ভারি করে ফেলেছে। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পাপে ভরা। ওরা যেমন খুশি তেমনি চলা ফেরা করছে। আমার বুকে বয়ে যাচ্ছে রক্ত নদী। যাকে খুশি তাকে মারছে সম্পদ লুটে নিচ্ছে কেও দেখার নেই কেউ প্রতিবাদ করার নেই। সকল বিদেশীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করে দিল। সংবাদ সংগ্রহের জন্যে কেও আসতে পারেনি। আমার বুকে বাস করে আমার আলো বাতাস জল নিয়ে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের কিছু অমানুষ আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ওই পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মেলাল। আহ! কত অনাচার অবিচার জুলুমই যে ওরা করেছে তা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারা শহর আতংকে ছিল। যখন তখন গোলাগুলি হয়েছে, তখন এক বিভীষিকাময় দিন গেছে। কোন ভাবে কাজকর্ম সেরেই মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। কাজে বের হবার পর বাড়ির মানুষ ভাবতেও পারেনি সে আবার সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।

এভাবেই চলে গেল নয়টা মাস। একদিন পাশের দেশ থেকে সৈন্য এলো আর তাদের কাছে এখানে যারা অত্যাচার করছিল তাদের প্রধান আত্মসমর্পণ করল। এই দেশ স্বাধীন হলো। আমার ইতিহাসের আর এক অধ্যায় শুরু হলো। আমার বুকে বসে কত পরিকল্পনা হয়েছে, কত আলাপ আলোচনা হয়েছে, কত আশা উদ্দীপনা হয়েছে তা মনে হলে আজ মনটা ভরে যায়। শুরু হলো আমার বুকে আর এক খেলা। আমার বুকে নতুন বড় বড় রাস্তা ঘাট তৈরি হলো, কত সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় ভরে গেল। গন ভবন হলো, বঙ্গ ভবন হলো, সংসদ ভবন হলো। এমনি আকাশ ছোঁয়া কত দালান হলো। আমাকে এদেশের রাজধানী বানানো হলো। আমাকে মহানগরীর মর্যাদা দেয়া হলো। একটুখানি জায়গার কত দাম হলো, আমার আকার পরিধি কত বেড়ে গেল। কয়েক হাজার থেকে এখন আমার বুকে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। কত রঙ বেরঙের গাড়ি চলছে। গাড়ি চাপা পড়ে কত মানুষ প্রতিদিন মরছে কে তার হিসাব রাখে আর কেই বা তার বিচার করে? গাড়িতে গাড়িতে আমার সমস্ত রাস্তা ভরে আছে। শুধু গাড়িতে পা দিয়ে দিয়ে যাত্রা বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে বসে থাকে। কাজের কত ক্ষতি হয় কত তেল গ্যাসের অপচয় হয় কেও দেখে না। রাজা মহারাজারা এদিক ওদিক যাবার সময় শহর বাসির সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পথে বসিয়ে রেখে কত আনন্দ পায়। দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে দেখছি যেই আমার বুকে আসে সেই হনুমান হয়ে যায়। আমার মনে কোন শান্তি পাচ্ছি না। কেও আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কত মিছিল দেখেছি, কতি শ্লোগান শুনছি, ভিন্ন মিছিলের ভিন্ন ভিন্ন শ্লোগান। হরেক রকম ভাষা, হরেক রকম উদ্দেশ্য, কত কি যে হচ্ছে! এতদিন ভিন দেশিরা এখানে অন্যায় অনাচার করেছে এখন শুরু হয়েছে নিজেদের অনাচার। এত অনাচার আমি কি করে সহ্য করি? জনসাধারণের সংসদ ভবনে বসে যাকে তাকে অশ্রাব্য গালাগালি করছে। জুতা ছোড়া ছুরি করছে! ছি! ছি! কি লজ্জা!
আমার বুকের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যেয়ে কত পাপ করছে। বিধাতা এই পাপ কেমনে সইবে ভেবে অস্থির হই। মানুষ খুন করা, ধর্ষণ করাতো এখন মামুলি ব্যাপার এতে আর এখন আমি আঁতকে উঠি না। কত বিচিত্র ভাবে নৃশংস উপায়ে মানুষ খুন করছে, গুম করছে। আহা! তাদের পরিবারের কি আহাজারি! সে আর আমি সইতে পারছি না! মানুষ এত নৃশংস এত জঘন্য পিশাচ কি করে হয় ভেবে পাই না। শুনেছি বনের হিংস্র পশুরাও নাকি এমন হয় না। মেয়েরা যে ভাবে চলাফেরা করে তাতে আমার ভারি লজ্জা লাগে, আমি ওদের দিকে তাকাতে পারি না। পুরুষেরা সন্ধ্যার পর ওত পেতে থাকে কখন মেয়েরা আসবে! দেহ ব্যবসা করার জন্য কত বড় বড় লোকেরা তাদের মাইনে দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে আবার ওদিকে মঞ্চে উঠে দামি দামি মন ভেজানো কথা বলে। যে সব মেয়েরা স্বাধীন ভাবে এই ব্যবসা করে তারা এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে না তারা অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেয়।

কত জন্ম হয়েছে কত মৃত্যু হয়েছে এই আমার বুকে। এক দিকে আনন্দ হাসি উচ্ছ্বাস আবার আর এক দিকে শোক কান্না। প্রতিদিন কত লঞ্চ, জাহাজ, বাস, কোচ, প্লেন ছেড়ে যায় আবার কত আসে কেও তার হিসেব জানে না। আমার বুকে একটু আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে কত মানুষ আসছে, রোজগারের জন্য একটু ভাল থাকার জন্য। রাস্তার ফুটপাথে মানুষ গিজগিজ করে, কিন্তু আমি সবার মনের আশা পূরণ করতে পারছি না। রাস্তায় কত বাস চলে কিন্তু তবুও মানুষের ভিড় কমে না। এত মানুষ কেন আসে? মানুষের লোভ লালসা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, কেও আর অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের অভিলাষ এত উঁচু কেন হলো?

চকচকে কর্পোরেট কালচার নামে বৈধ উপায়ে নির্লজ্জের মত লোক ঠকাবার, কর্মচারীদের ঠকাবার জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা আমদানি হয়েছে। শ্রমিক কর্মচারীদের ঠকিয়ে, এ ওকে ঠকিয়ে ফাকি দিয়ে মেরে কেটে কতজনে শত শত কোটি টাকা জমা করছে, টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। ব্যাংকও সে টাকা রাখার জায়গা পায় না অথচ আমার বুকেই কত শিশুকে দেখি খাবার না পেয়ে আস্তা কুড়ে খাবার খুঁজছে। কতজনে ফ্রান্স থেকে পানি এনে পান করে আবার কতজন রাস্তার ফুটপাথে রাত কাটায়। এত টাকা দিয়ে কি করবে ওরা? এই উন্নয়নশীল দেশে এত চাকচিক্যের কি এমন প্রয়োজন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিনে দিনে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে! কি লজ্জা! আমি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর! কিন্তু কারা আমাকে নোংরা করছে? আমাকে নোংরা করে তারা কেমন করে ভাল থাকছে?

যারা আইন রক্ষা করবে তারাই আজ আইনের তোয়াক্কা না করে জঘন্য অপরাধে, পাপ কাজে, অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে। কেও তাদের বিচার করছে না। সবাই শুধু নিজের কথা, নিজের ক্ষমতা-লোভের কথা ভাবছে। আমার বুকে বসেই ওই পাঞ্জাবী ইয়াহিয়া খান বলেছিল আমি ইস্ট পাকিস্তানের মানুষ চাই না শুধু মাটি চাই। এখনও সেই রূপ দেখছি, যারা শাসন করছে তাদের এমন মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।
আসলে আমার কোন পরিবর্তন হয়নি আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি শুধু পাপের প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়েছে, পাপের পথ পরিবর্তন হয়েছে এবং পাপের ওজন ভারি হচ্ছে। মানুষের আমোদ প্রমোদের ধরণ বদলে গেছে। সেদিন দেখলাম কয়েকজন বন্ধু সারাদিন কাজ কর্ম সেরে রাতে ক্লাবে মিলিত হয়ে ইচ্ছে মত মদ পান করে সবাই যার যার গাড়ির চাবি টেবিলের উপরে রাখল এবং এক এক করে চোখ বন্ধ করে সামনে রাখা চাবি থেকে একটা চাবি তুলে নিল, যার হাতে যে চাবি আসল সে রাতের জন্য সে ওই গাড়ি যার তার বাড়িতে যেয়ে তার স্ত্রীর সাথে রাত কাঁটালো। এমন বিকৃত মানসিকতা এবং বিকৃত রুচি আমার বুকে আগে কখনও দেখিনি।

আমার ভীষণ ভয় করে! মাঝে মাঝে লজ্জায় ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার বুকে নিরীহ সাধারণ মানুষ যারা বাস করে তাদের কি হবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আমি আর পারছি না বিধাতা! আমাকে রক্ষা কর! আর কত পাপ আমাকে দেখতে হবে? হে বিধাতা তুমি কোথায়? আমাকে রক্ষা কর! মানুষের মনে শান্তি দাও!

স্মৃতিতে মুড়ির টিন বাস

প্রিয় বন্ধুরা, কোনোএক সময়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসের কথা আপনাদের মনে আছে কি? আমার মনে হয় আমার সমবয়সী যারা আছেন, কেবলমাত্র তাদেরই মনে আছে বলে আমার বিশ্বাস! আর যাদের ১৯৮৪-৮৫ সালের পর জন্ম হয়েছে, তারা সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের নামই শুধু শুনেছে। কিন্তু কখনই মুড়ির টিন বাসে চড়ে দেখেনি এবং ওই ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের ইতিহাসও অজানা।

তবে আমি মনে করি বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কারোর কাছে কোনোকিছু অজানা থাকার কথা নয়! কারণ বর্তমান যুগে সবার হাতে হাতেই অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম মোবাইল ফোন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল মানেই সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। আর এই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ‘ক’ লিখে সার্চ করলেই, ‘ক’র মর্মার্থ জানা হয়ে যায়। আর দুনিয়ার সবকিছু অজানা খবর তো মোবাইল স্ক্রিনে নিমিষেই ভেসে উঠেই। তারপরও যাদের কাছে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস অজানা, তাদের জন্যই আজকে আমার এই লেখা। তাই আজকে কোনোএক সময়ের বাংলার ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের কিছু স্মৃতি, কিছু জানা-অজানা ইতিহাস সবার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

মনে পড়ে সে-সময়ের মুড়ির টিন বাসের কথা। ওই মুড়ির টিন বাস স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করতো। আর সেসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যাওয়ার একমাত্র জনপ্রিয় যানবাহন-ই ছিলো, ঐ মুড়ির টিন। ঐ বাসটাকে আবার অনেকেই স্টার্ট বাসও আলতো। কারণ ঐ মুড়ির টিন বাস হাতে হ্যান্ডেল মেরে স্টার্ট দেওয়া হতো। তাই মুড়ির টিনের পাশাপাশি অনেকে ঐ বাসটাকে স্টার্ট বাসও বলতো। ১৯৮৪ সালের দিকেও এই মুড়ির টিন বাসে চড়ে পঞ্চবটী, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যেতাম। শুধু আমিই নয়, আমার মতো এমন হাজারো মানুষ ঐ মুড়ির টিন বাসে চড়েই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া করতো।

একসময় আমি আর আমার বড় দাদা ফতুল্লা কাঠের পুল মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। তখন আমাদের ফ্যামেলি বাসা ছিলো, নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়াল পাড়া। ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় ৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই ৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করা সম্ভব ছিলো না। আবার তখনকার সময়ে নারায়ণগঞ্জ-টু-ঢাকা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসে ০.৬০ পয়সা খরচ করে আসা-যাওয়া করাও ছিলো ব্যয়বহুল খরচ! তবুও সময় সময় পয়সার মায়া ত্যাগ করে সময়মত মিলের ডিউটি জন্য মুড়ির টিনে বসে করেই ফতুল্লা পর্যন্ত আসতে হতো।

যদিও তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত মুড়ির টিন স্টার্টবাসে জনপ্রতি ভাড়া ছিলো ১.৫০ পয়স। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ভাড়া ছিলো ০.৬০ পয়সা। তবুও এই ০.৬০ পয়সা করে আসা-যাওয়ায় জনপ্রতি ১.২০ পয়সা খরচ করা কিছুতেই আমাদের মত গরিব মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রতিদিন দুইজনের আসা-যাওয়ায় খরচ ২.৪০ পয়সা তখনকার সময়ের জন্য ছিলো অনেককিছু।বলছিলাম ১৯৮৪ সালের কথা।

তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই রকমের যানবাহন চলাচল করতো। একটা হলো, সূপিয়ার কোচ, মানে বড় বাস। আরেকটা হলো, মুড়ির টিন নামের স্টার্ট বাস। সুপিয়ার কোচ চলাচল করতো, নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলস্টেশন। আর মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের রুট ছিলো, নারায়ণগঞ্জ কালির বাজার হাইস্কুল থেকে ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা হয়ে সদরঘা পর্যন্ত। তখনকার সময়ে আবার অনেকে যাতায়াত খরচ বাঁচানোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা থেকে লঞ্চে ঢাকা সদরঘাট আসা-যাওয়া করতো। আর যারা ব্যাবসা করতো, তারা সবসময় মুড়ির টিন স্টার্ট বসেই বেশি যাতায়াত করতো।

এর কারণ হলো, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, নিতাইগঞ্জ’র যত ব্যাবসায়ী ছিলো, তারা সকলেই ঢাকা শ্যামবাজার থেকে মালামাল ক্রয় করতো। তাদের ক্রয় করা সেই মালামালগুলো মুড়ির টিন বসে করে ফতুল্লা নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসতো। কেউ কেউ আবার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে ফতুল্লা পৌঁছতো। এভাবেই তখনকার সময়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা দুই পয়সা খরচ বাঁচানোর জন্য এ-পথে সে-পথে আসা-যাওয়া করতো। তো এবার আসি মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস নিজের স্মৃতিতে থাকা বিস্তারিত কিছু আলোচনায়।

সে সময়কার মুড়ির টিন স্টার্ট বাস যাঁরা দেখেননি, তারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন! ‘মুড়ির টিন’ বাস আবার কেমন? এর ইতিহাসই বা কী? হ্যাঁ, অবশ্যই মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস আছে। একসময় আমাদের বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে পাবলিক বাসের যাত্রা শুরু হয় মুড়ির টিন স্টার্ট বাস দিয়ে। এই মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস বা কাহিনী শুনেছিলাম, আমার বাবা ও কাকার মুখে।

একসময় আমার বাবা ও কাকা নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের চাকরি করতো। বাবা অথবা কাকা ছুটিতে বাড়ি গেলে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ির উঠানে বসে স্বপ্নের ঢাকা নারায়ণগঞ্জ শহরের গল্প শুনতো। বাবা ও কাকার মুখে শুনেছিলাম, ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ঐতিয্যবহী মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস।

মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের গল্প বা ইতিহাস হলো, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন এ অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু যানবাহন ইংরেজরা এদেশের কিছু বিত্তশালীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়। সেসব যানবাহনের মধ্যে ছিলো, মালা-মাল পরিবহনের ট্রাক, জিপগাড়ি, কাসিম বা কচ্ছপ মার্কা টেক্সি-সহ আরও অন্যান্য তাদের কিছু ব্যাবহারিক ভাঙাচোরা গাড়ি। এসব ভাঙাচোরা গাড়িগুলো তখনকার সময়ের বিত্তশালীরা ইংরেজদের কাছ থেকে কমদামে কিনে রাখে।

তারপর বিত্তশালীরা ওইসব ভাঙাচোরা কাঠের বডি ট্রাকগুলো বাসের আদলে তৈরি করে একধরনের নাকবোঁচা বাস। ভাঙাচোরা ট্রাকগুলোর বাইরের দিকে কাঠের বডির ওপর মুড়ে দেওয়া হয় টিন। একটা ছৈয়া ( ছাউনি) নৌকা যেভাবে বানানো হয়, ঠিক সেভাবেই টিন দিয়ে ট্রাকের চারদিক মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে চলন্ত পথে বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। সেই থেকেই বাসগুলোর নাম হয় মুড়ির টিন।

আবার ওইসব মুড়ির টিন বাসগুলো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেওয়া হতে বলেই, এগুলোর আরেক নাম ছিলো স্টার্ট বাস। যা দেখতে একরকম গৃৃহস্তের ঘরে থাকা মুড়ির টিনের মতনই দেখা যেতো। তাই অনেকেই ঐ বাস গুলোকে মুড়ির টিন বাস বলতো। আবার অনেকে মুড়ির টিন বাসের নাম নিয়ে অন্যমতও পোষণ করে থাকে। তাদের মতে, গৃৃহস্তরা একটা মুড়ির টিনে যেভাবে ঠাসা ঠাসা করে মুড়ি ভরাট করে রাখতো, ঠিক তখনকার সময়ে মুড়ির টিন বসে সেভাবেই ঠাসা ঠাসা করে যাত্রী ভরা হতো বলেই, বাসটির নাম হয় মুড়ির টিন।

কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্যবাহী মুড়ির এখন অনেকের স্মৃতিতে নেই বলেই মনে হয়। এখন ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস, এই বাস, সেই বাস, ননস্টপ বাস, বিরতিহীন বাস, গেইট লক সার্ভিস বাস, এসি বাস, বলভো বাস, কলম্বো বাস, সরকারি বিআরটিসি বাস-সহ আরও কতরকমের বাস আর বাস। এতো এতো বাসের ভীড়ে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাস কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তা আর নিজের স্মৃতিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সময় সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে যেকোনো বাসে চড়ে যেকোনও স্থানে গেলে সেই সময়কার মুড়ির টিন বাসের কথা মনে পড়ে যায়।

পোস্টের ছবি কালেক্ট: ফেসবুক বন্ধু “শাহ আলম শরাফতী” দাদার পোস্ট থেকে।

জানা অজানা-১[ভিস্তিওয়ালা]

মুঘল সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে শের শাহের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক খরস্রোতা নদীতে। জলের প্রচণ্ড স্রোতে যখন হুমায়ুনের প্রাণ ওষ্ঠাগত, এক ভিস্তিওয়ালা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। হুমায়ুন তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, যদি কখনও তিনি দিল্লির তখতে বসতে পারেন, ওই ভিস্তিওয়ালা যা উপহার চাইবেন, তাই দেবেন। পরে যখন হুমায়ুন সম্রাট হলেন, আর সেই ভিস্তিওয়ালা তাঁর কাছে চেয়ে বসলেন সম্রাটের সিংহাসন। বাদশাহ হুমায়ুন নিজের মুকুট পরিয়ে দিলেন ভিস্তিওয়ালার মাথায়, তাঁকে বসালেন নিজের সিংহাসনে। তখন ভিস্তিওয়ালা সম্রাটকে আলিঙ্গন করে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর মুকুট আর সিংহাসন।

উল্লেখ্য যে সেই ভিস্তিওয়ালার নাম ছিলো “ভিস্তিওয়ালা নাজিম”।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানীর বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হত খাল, নদী বা কুয়ার উপর৷ একই পদ্ধতি ছিল কলকাতা শহরেও৷ নিরাপদ পানির জন্য তাই শহর অধিবাসীদের অনেক দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতে হত৷ ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ পানির জন্য সাধারণত শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির উপর নির্ভর করতে হত। শহরে যেসব কুয়া ছিল তাতেও ছিল সুপেয় পানীর অভাব। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকেরা তাই এক বিশেষ পেশাজীবি শ্রেণীর লোকদের মাধ্যমে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন। তাঁদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার এক মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। এদেরকে বলা হত ভিস্তি বা সুক্কা। ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁক দিয়ে প্রতি বাড়ি গিয়ে তাঁরা পানি দিয়ে আসত।

ভিস্তিওয়ালাদের ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ হাঁকে এক সময় শুধু ঢাকা নয় কলকাতা কিংবা দিল্লির রাস্তা মুখরিত থাকত। সময়ের পরিক্রমায় সেই হাঁক আর শোনা যায় না। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই পেশা এবং ভিস্তিওয়ালারা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে- গত শতাব্দির বিশের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার রাস্তাতেও ভিস্তিওয়ালার আনাগোনা ছিল।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায় –
ভিস্তি অর্থ পানি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য ব্যবহৃত চামড়ার থলি। শব্দটি এসেছে পার্সি ‘ভেস্ত’ বা ‘বেহস্ত’ থেকে; যার অর্থ স্বর্গ। কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধের মধ্যে পানি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হোসেন (রা.) তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে স্বর্গলাভ করেন। সেই ঘটনা থেকেই এমন নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কালো চামড়ার বালিশের মতো ‘মশক’ ভরে যারা পানি দিয়ে যেত তাদের বলা হতো ভিস্তি। অনেকে ভিস্তিওয়ালাও বলতেন।

আবার অন্য সূত্রে জানা যায়, এক সময় যখন শহরগুলোতে পাইপলাইন দিয়ে জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না, তখন ভিস্তিওয়ালাদের ওপরই নির্ভর করতে হত শহুরে মানুষকে। ছাগলের চামড়ায় তৈরি একধরনের ব্যাগে তাঁরা জল ভর্তি করে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দিতেন। এই বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগকে বলা হত ‘মশক’। ভিস্তিওয়ালাদের মশকে জল থাকত ঠান্ডা। ‘বেহেশত’ একটি ফার্সি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘স্বর্গ’। এই ‘বেহেশত’ থেকে ‘ভিস্তি’ কথাটি এসেছে। পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয়, স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, খাল আর বাগান।একটা সময় মানুষের বিশ্বাস ছিল, ভিস্তিওয়ালারা জল নিয়ে আসেন স্বর্গ থেকে। স্বর্গের জল তাঁরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন বলে স্বর্গের দূতও বলা হত তাঁদের।

আগেকার দিনে যুদ্ধের সময় জল রাখতে ভিস্তিওয়ালার মসক ব্যবহার করা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে দুর্গগুলোতে জলের সরবরাহ করা হত মশক থেকে।
জলভর্তি মশক থাকত ঢাকার টমটম গাড়িতে। কলকাতার সঙ্গে ভিস্তিওয়ালাদের সম্পর্ক খুব পুরোনো। কাঁধে মশক নিয়ে ভোরবেলা থেকেই মহানগরীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। রান্না আর স্নানের কাজে লাগত তাঁদের সরবরাহ করা জল। ১৯৪০-৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতার কয়েকটি রাস্তা ধোয়ার কাজেও ভিস্তিওয়ালাদের জল কাজে লাগত। কলকাতা আর ঢাকাতে ছিল আলাদা ভিস্তিপল্লি।

এখন অবশ্য পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। কর্পোরেশনের জল মোটর পাম্পের সাহায্যে পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিস্তিওয়ালাদেরও বেছে নিতে হচ্ছে অন্য পেশা। দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান’ হিসেবে ভিস্তিওয়ালারা ইতিহাসখ্যাত। এদের ফারসিতে বলা হতো ‘সাক্কা’। পুরান ঢাকার সিক্কাটুলীতে ছিল তাদের বাস। সাক্কা থেকেই যে সিক্কাটুলী বুঝতে অসুবিধা হয় না। দিল্লিতেও এই পেশাজীবীরা ছিলেন। সেখানেও রয়েছে সাক্কেওয়ালী গলি। থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি ও মিশমিশে কালো চাপ দাড়িওয়ালা ভিস্তির সন্ধান সাহিত্যেও পাওয়া যায়।

শামসুর রাহমানের ‘স্মৃতির শহরে’ তাদের উল্লেখ রয়েছে। রবীন্দ্র ও সুকুমার সাহিত্যেও রয়েছে তাদের উপস্থিতি। পুরনো ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের বেশ প্রভাব ছিল। আলাদা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তারা থাকতেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো ‘নবাব ভিস্তি’। জিন্দাবাহার চৌধুরী বাড়ির জমিদারকন্যা আমেতুল খালেক বেগম ভিস্তিওয়ালাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘সকাল বেলা ভিস্তি আসত বিরাট মশকে ভরে পানি কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে।… ভিস্তির সেই বিকট গলা। মশকের মুখটা খুলে চেপে ধরে কলসিতে পানি ঢেলে রাখত। বিরাট সেসব কলসি, মাটির মটকায়ও পানি রাখা হতো।… ভিস্তিওয়ালাদের ব্যাগগুলো ছিল চামড়ার। ব্যাগগুলো তৈরি হয় মূলত ছাগলের চামড়া দিয়ে।’

‘কোম্পানী আমলে ঢাকা গ্রন্থ’ থেকে জানা যায়, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস তাঁর ১৮৩০ সালের আদমশুমারি ‘সেনসাস অব দ্য সিটি অব ঢাকা’য় মুসলমানদের যে পেশাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে ১০টি ভিস্তি গৃহের উল্লেখ রয়েছে। ভিস্তিরা ছিলেন সুন্নি ধর্মাবলম্বী। সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও সেকালে মহররমের মিছিলে রাস্তার দুই পাশে প্রতীক্ষারত ও রৌদ্রক্লান্ত দর্শকদের মধ্যে পানি বিতরণ করতেন ভিস্তিরা।
ঢাকাকেন্দ্রের পরিচালক আজিম বক্শ ভিস্তিদের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল-দুপুর তারা পিঠে পানিভর্তি চামড়ার ঢাউশ ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় পানি ছিটাত, যাতে ধুলা না ওড়ে। তাদের কাঁধে ঝুলানো থাকত ছাগলের চামড়ার মশক। এই মশক দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করত। ষাটের দশক পর্যন্ত ছিল তাদের কর্মকাণ্ড। তারপর হারিয়ে যায়।’

পরে ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ পানির অপ্রতুলতার প্রতি খেয়াল রেখে নবাব খাজা আবদুল গণি ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠার জন্য দুই লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। তাঁর এই বদান্যতায় ১৮৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভায় গড়ে ওঠে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহের আধুনিক সুবিধা। আরো পরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসীর নিরাপদ পানির চিন্তা দূরীভূত হয়। এর সঙ্গে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় ভিস্তিদের পেশাদারী জীবন। আবেদন কমতে থাকে ভিস্তিওয়ালাদের। তারাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিজেদের জড়িয়ে নেন।
তবে কলকাতায় আজো ভিস্তিওয়ালাদের চোখে পড়ে।
ঢাকার দিন বদলেছে। তবে আধুনিক ঢাকায় এখন আছে আধুনিক ভিস্তিওয়ালা। তারা পাইপলাইনে বাড়ি বাড়ি পানি দেন কিংবা পানি সরবরাহ করেন। এখন ভিস্তির ব্যবহার নেই, তবে পানি সরবরাহের কাজটি কিন্তু ঠিকই আছে। সদরঘাট, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলীর লোকজন পানি সরবরাহকারীদের ‘ভারওয়ালা’ বলেন। তারা পানি ভর্তি টিনের জার ভারে বহন করেন। ওয়াইজঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমির (বাফা) পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি কল। এখান থেকে ভারওয়ালারা পানি নিয়ে পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, সদরঘাটের দোকানগুলোতে সরবরাহ করেন।

পাত্র ভেদে ভারওয়ালারা পানির দাম পান। আবার মাসিক চুক্তিতেও তারা পানি সরবরাহ করেন। সূত্রাপুরের হেমেন্দ্র দাস রোডের একটি পানির কলে দেখা গেল সারি ধরে কলস রাখা হয়েছে। অথচ আশপাশে কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সরবরাহ নলে পানি আসে দুপুর ১২টার পর। সে সময় একটা একটা করে কলস ভরা হয়। সেগুলো পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন কলসওয়ালারা। আবার নগরের বাজারগুলোয় রয়েছে পানি সরবরাহের হাঁড়িওয়ালা। তাদের কাজ বাজারের মাছ আর সবজি বিক্রেতাদের কাছে পানি সরবরাহ করা। টিনের পাত্রে ভার দিয়ে পানি সরবরাহ করেন এ পেশার লোকেরা। প্রতি টিন পানির দাম ৫ টাকা।
এদিকে এখনও কিছু ভিস্তিওয়ালা নিয়মিত জল সরবরাহ করেন মধ্য কলকাতার কয়েকটি গৃহস্থ বাড়ি আর দোকানে।

কলকাতার জনা চল্লিশেক ভিস্তিওয়ালা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের পারিবারিক পেশা। তাঁদের বেশিরভাগই আদতে বাস করেন বিহারের কাটিয়ারে। মধ্য কলকাতায় ঘর ভাড়া করে থাকেন তাঁরা। প্রত্যেক ঘরে অন্তত দশজন করে মানিয়ে গুছিয়ে থেকে যান। মহম্মদ আনসার, মহম্মদ জারিফুল, মহম্মদ রেজাউলের মতো ভিস্তিওয়ালাদের থেকে এখনও জল কিনে খান কিছু লোক। হোটেলেও যায় এঁদের জল। সকাল-বিকেল তাঁরা পুরসভার ট্যাপ কল আর টিউবওয়েলের জল মসকে ভরে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে জল পৌঁছে দেন। একটি মশকে জল ধরে ৩০ লিটারের কাছাকাছি। রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, বৃন্দাবন দাস লেন, মারকুইস স্ট্রিট, ইলিয়ট রোড, মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়ি এবং দোকান মিলিয়ে একেকজন ভিস্তিওয়ালা দিনে দুবেলা মোটামুটি ৩০টি বাড়িতে জল পৌঁছে দেন। এর জন্য মাসে চারশো টাকার মতো খরচ হয় একেকটি পরিবারে।

বাংলা সাহিত্যে ভিস্তিওয়ালা
বাংলা সাহিত্যে ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদের রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিস্কার কবিতায় ভিস্তিওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক, একুশ লাখ ভিস্তি পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
সুকুমার রায় তার ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়? ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন এভাবে লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে? ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার? এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার।

শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে, ‘রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসীর ভেতর। মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা।
বাদশাহ নামদার উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ তুলে এনেছেন সম্রাট হুমায়ূনের বিপদে এক ভিস্তিওয়ালার সহযোগিতার গল্প।

তথ্য সূত্রঃ
https://www.bongodorshon.com
http://itibritto.com
http://www.kholakagojbd.com
https://www.risingbd.com ও অন্যান্য।

নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার বিপরীতে কিছু কথ্য শব্দ

আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী একে অপরের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার সময় কিছু কথ্য শব্দের ব্যবহার করে থাকি। যেমন: কী খাইবেন? জবাবে বলে–কী আর খামু টামুরে ভাই, মনডা বেশি ভালা না। এখানে ‘খাবো’ শুদ্ধ ভাষা। ‘খামু’ নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা। আবার ‘খামু’র বিপরীত শব্দের ঘেঁষা শব্দ ‘টামু’। যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে এমন কিছু বিপরীত শব্দের ঘেঁষা শব্দ দেখানো হলো–

বাবা-টাবা, জেডা-জুডা, আমি-টামি, তুমি-তামি,
কাকা-কুকা, ভাই-টাই, বইন-টইন, মামী-টামি।

ছেলে-টেলে, মায়ে-টেয়ে, মাইয়া-টাইয়া, পোলা-টোলা,
বউ-টউ, জামাই-টামাই, শ্বাশুড়ি-মাশুড়ি, ঝোলা-মোলা।

দুলা-মুলা, দুলাভাই-টুলাভাই, খালত ভাই-খুলত ভাই,
হাউড়ি-মাউড়ি, জিয়ারি-টিয়ারি, বেয়াই-টেয়াই, খাই-দাই।

খাইতাম-খুইতাম, খামু-টামু, যামু-টামু, গেছে-গুছে,
নাইচ-টাইচ, কাঁতা-মুতা, বালিশ-টালিশ, পাছে-পুছে।

জোতা-টোতা, মুজা-টুজা, ভাত-ভুত, তরকারি-মরকারি,
ঝোল-টোল, বত্তা-বুত্তা, জলে-জুলে, মশারি-টোশারি।

ডাইল-ডুইল, কুত্তা-মুত্তা, বিলাই-টিলাই, হলে-টলে,
বল-বুল, মাডে-মুডে, কাপড়-টাপড়, কলে-টলে।

উপ্রে-টুপ্রে, নিচে-নুচে, আগে-টাগে, পাতাইল্লা-পুতাইল্লা,
কালা-টালা, বেয়াই-টেয়াই, লেবু-টেবু, ফতুল্লা-মতুল্লা

ছাগল-টাগল বা ছাগল-ছুগল, গরু-টরু, হরি-টরি,
জিলাপি-টিলাপি, মিষ্টি-মুষ্টি, মালাই-টালাই, পুরি-টুরি।

আম-টাম, লেচু-টেচু, বেগুন-টেগুন, উস্তা-মুস্তা,
আলু-মালু, ভূত-মুত, গেলাস-টেলাস, বস্তা-বুস্তা।

গেলাস-টেলাস, পেলেট-পুলেট, বাসন-টাসন,
স্নান-টান, বিস্কুট-মিস্কুক, কলা-টলা, ভাষণ-টাষণ।

রাগে-মাগে, চেয়ার-টেয়ার, মদ-মুদ, গাজা-গুজা,
হালা-টালা, হালি-হুলি, বউ-টউ, পূজা-টুজা।

জামাই-জুমাই, কপি-টপি, ময়লা-টুয়লা,আগুন-টাগুন,
সিঙ্গাড়া-টিঙ্গাড়া, শাক-টাক, বাঘে-টাঘে, বাগুন-টাহুন।

হাগ-টাগ-(শাক), করি-টরি, ধরি-টরি, কপি-টপি,
চাইল-টাইল, মাছ-মুছ, ডাইল-ডুইল, টুপি-মুপি।

হুটকি-টুটকি( শুঁটকি) কলা-মলা, আপেল-টাফেল,
খাওন-টাওন, পানি-টানি, পড়া-টরা, রাইফেল-টাইফেল।

পোলাও-মোলাও, মুরগী-টুরগী, মাছ-মুছ, পাতা-পুতা,
বিরানি-টিরানি, গোস্ত-মোস্ত, গলা-টলা, ছুতা-মুতা।

এমনভাবে একে অপরের সাথে বা নিজে নিজেও অনেকেই যার যার আঞ্চলিক ভাষায় শব্দের বিপরীত শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এর কারণ কী? আমি মনে করি এটা একরকম যার যার আঞ্চলিকতার অভ্যাস!

আজ ২৫শে জুলাই জাতীয় অধ্যাপক স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮০ তম জন্মদিন…

আজ ২৫শে জুলাই জাতীয় অধ্যাপক স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮০ তম জন্মদিন…. শুভ জন্মদিন স্যার।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সুবক্তাসহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক গুণীজন। বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সমাজসংস্কারক। শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি যার মাধ্যমে গত চার দশক ধরে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের পুরোধা-র ভূমিকা তিনি পালন করছেন। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসাবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্যে লাভ করেছেন র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার। আজ স্যারের #৮০ তম জন্ম দিন।

১৯৩৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে।

স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরি জীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ। এরপর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রনে সেখানে যোগদান করেন। ঢাকা কলেজেই তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। অধ্যাপক আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি অত্যন্ত উপভোগ করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন-

ছেলেবেলায়, স্কুল থেকে কলেজে উঠে, অর্থনীতির বইয়ে পড়েছিলাম কেন একজন শিল্পপতি, কন্ট্রাক্টর বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীর চেয়ে একজন শিক্ষকের বেতন কম৷ যুক্তি হিসেবে সেখানে বলা ছিল একজন শিক্ষকের জীবন কাটে মার্জিত, পরিশীলিত পরিবেশে, বৈদগ্ধময় ব্যক্তিদের সাহচর্যে, উচ্চতর জীবনচর্চার অবকাশময় আনন্দে৷ জীবনের সেই মর্যাদা, তৃপ্তি বা শান্তি ঐ ব্যবসায়ী বা নির্বাহীর জীবনে নেই৷ এই বাড়তি প্রাপ্তির মূল্য দিতে শিক্ষকের আয় তাদের তুলনায় হয় কম৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতায় ঐ তৃপ্তি আমার এত অপরিমেয় হয়েছিল যে কেবল বেতন কম হওয়া নয়, আমার জন্য হয়ত বেতন না-থাকাই উচিত হত৷ এই পাওয়া যে কতটা তা বুঝেছিলাম কিছুদিনের জন্য অন্য কলেজে গিয়ে।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে চাননি ৷ তাঁর মতে, বাংলা বিভাগে যোগদান করাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের ছেড়ে সবচেয়ে খারাপ ছাত্রদের পড়াতে যাওয়ার মত মনে হয়েছে।
অধ্যাপক আবু সায়ীদ কখনোই ক্লাসে রোলকল করতেন না। রোলকলকে তার কাছে মনে হতো সময়ের অপব্যয়৷ তাই বছরের পয়লা ক্লাসেই ঘোষণা করে দিতেন রোলকল না করার ৷ তিনি বলেন, অনিচ্ছুক হৃদয়কে ক্লাশে জোর করে বসিয়ে রেখে কী করব? আমার চ্যালেঞ্জ ছিল এক ধাপ বেশি: কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো, সব ছাত্রের হৃদয়কে আপ্লুত করা।
ক্লাশের সেরা ছাত্রটাকে পড়ানোর চেষ্টা করার চেয়ে তিনি পড়াতে চেষ্টা করতেন ক্লাশের সবচেয়ে বোকা ছাত্রটাকে৷ সারাক্ষণ তাকেই বোঝাবার চেষ্টা করতেন, কেননা তার বোঝা মানে ক্লাসের বাকি সবার বোঝা।
স্যারের এরকম আরো অনেক মন্তব্য ও উক্তি রয়েছে যা আসলে একজন মানুষ কে অনায়েষে নাড়িয়ে দিতে পারে ,যেমন – “আমি যদি উন্নত জাতের হাস মুরগী পালন, গোখামার তৈরি, এ ধরণের কাজগুলো করতাম তাহলে এতদিনে কত টাকা যে কামিয়ে ফেলতাম। কিন্তু পড়লাম মানুষের উন্নতি নিয়ে- আলোকিত মানুষ। (হেসে) না বুঝি নিজে না পারি অন্যকে বোঝাতে।”
“বুদ্ধিজীবীরা আবার আমাকে বুদ্ধিজীবী মনে করেনা, কারণ আমি হাসি। বিদ্যাবুদ্ধি তো আর কারো চেয়ে কম ছিলনা, শুধু ওই একটা জায়গাতে মার খেয়ে গেলাম, আমার হাসি। হাসলে পরে তুমি আর বুদ্ধিজীবী থাকতে পারবেনা। আপনি হাসেন? তারমানে তো আপনি লাইট!”
“কিন্তু সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখিনা, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল সেটা আমরা মনে রাখিনা, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল তা মনে রেখে দিয়েছি।”
“আসলে জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা, হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাইনাই। ইত্যাদি…

স্যারের একটি বইএর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে।
“ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্যারের দে বক্তব্য টি কোয়ান্টাম মেথড ওয়েব সাইড থেকে কপি কর দে হয়েছে-
প্রতিদিনই বহু মানুষ আমাদের দেশ থেকে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার ধারণা, কোনো মানুষের মধ্যে যদি আলো, শক্তি, প্রতিভা থাকে; তিনি কখনই দেশত্যাগ করেন না। আর করলেও ফিরে আসেন। ফজলে হাসান আবেদ, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল; ওনারাও দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু আবার ফিরেও এসেছেন। তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন; তাদের আত্মার যে-আনন্দ, জীবনের যে-পরিচয়; সেটা তাদের মাতৃভূমি।

বিদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে কোনো বড় কাজ করা খুবই কঠিন। আমাদের অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজকের অনুষ্ঠানের যিনি প্রধান অতিথি বিদেশে অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে এই গরীব দেশটাকে ভালবেসেছেন। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। আরো আগেই তাকে আমার বই উৎসর্গ করা উচিৎ ছিল। আমি তাকে কোনো একটি বই উৎসর্গ করতে এত দেরি করায় লজ্জিত ও সংকুচিত বোধ করছি।

একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে আমাদের দেশে যে, নেই দেশে ভ্যারেন্ডা বৃক্ষ। একটি গাছ যতটা বিস্বাদ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই বিস্বাদ; এই ভ্যারেন্ডা গাছ। সেজন্যেই অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন; ভ্যারেন্ডা গাছ কি কেউ খায়? খায় না। কিন্তু আখ গাছ খায় কেন? কারণ, ভ্যারেন্ডা গাছের মধ্যে স্বাদ নেই কিন্তু আখ গাছের মধ্যে মাধুর্য আছে। মানুষ সেখানেই যাবে, যেখানে সে মাধুর্য পাবে। যে-দেশে কিছুই নেই, সে-দেশে এতটুকু একটি গাছও বৃক্ষ। আমরা হচ্ছি সেই ধরনের ভ্যারেন্ডা।

আমাদের জাতির মধ্যে অসম্ভব মেধা ও কর্মোদ্দম আছে। তারা এই দেশকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে। আরো অনেক বড় বড় মানুষেরা আসবেন। এ দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হবে। এটা আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। গ্রামের দিকে একটা কথা আছে যে, ভিক্ষুকের পায়ে লক্ষ্মী। ভিক্ষা পেতে হলে, হাঁটতে হবে। যে-যত হাঁটবে, তার ভিক্ষা তত বেশি। এটা সাধারণ হিসাব। আমাদের করণীয় একটাই। সেটা হলো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। আমরা কেউই চিরদিন বাঁচব না। কিন্তু যতদিন বাঁচব, আমার একটাই কাজ; আমার এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। সেটা আমাদের সবাইকে করতে হবে। তাহলেই আমরা অশান্তি, দুঃখ, হতাশা ও নৈরাশ্যের হাত থেকে বাঁচতে পারব। একটি আনন্দময় জীবন শেষ করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব।

একটা গাড়ি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার সময় আপনি বলবেন, গাড়িটি উঠছে বা উপরে যাচ্ছে অর্থাৎ উত্থান হচ্ছে। কিন্তু গাড়িটি পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় বলতে পারবেন না যে, পতন হচ্ছে। গাড়িটি নিচের দিকে নামলেও তার চাকাটা সামনের দিকে যাচ্ছে। তাহলে তো সে সামনের দিকে এগোচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে যাকে আমরা নৈরাশ্য বা পতন মনে করছি, সেটা আসলে উত্থান। সুতরাং আমরা চিরদিনই উত্থানের মধ্যে আছি। পতন, হতাশা বা নৈরাশ্য বলে কিছু নেই। এগুলো আমাদের মাথার অলীক কল্পনা দিয়ে তৈরি করা বিভ্রম।

দুঃখ-কষ্ট, মৃত্যু আছে কিন্তু কোনোটিই স্থায়ী নয়; সাময়িক। এগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। আমি যতবড় আশাবাদীই হই। কেউ ভীষণভাবে আঘাত করলে, আমার অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা যাবে। কিন্তু সে আর্তনাদই শেষ কথা নয়। কাজ, সংগ্রাম, শ্রম আর আক্রমণের মধ্যেই আমাদের জীবন। আমাদের অনেক দুঃখের কারণ হচ্ছে আশাহীনতা। বাইবেলে একটা কথা আছে, “And whosoever liveth and believeth in me shall never die” যে বিশ্বাস করবে সে বেঁচে থাকবে; সে মরবেনা। বিশ্বাস আর আশাটা যেন সবার মধ্যে থাকে। নৈরাশ্য বলতে কিছু নেই। আমি এই কথাটাই সবাইকে বলব যে, নৈরাশ্যের মত অনস্তিত্বশীল বিভ্রমে বিশ্বাসী হবেন না। এটা আশারই অন্যরূপ মাত্র।

আসলে স্যার কখনোই বন্দিত্ব সহ্য করেন নি। তিনি যেমন উদার তেমনিই মুক্ত, স্বাধীন চেতনার মানুষ। “ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের পরতে পরতে সেই বক্তব্যই স্পষ্ট করা হয়েছে।

স্যার সব সময় আত্মমর্যাদা , আত্মসম্মান কে প্রাধান্য দিয়েছেন নিচের উক্তি থেকেই তা অনুভব করা যায়, যেমন- “আমাদের দেশে সবাই একটা ‘পা’ চায়, পায়ের নিচে পড়ে থাকতে চায়।”
“আমি বলি, সম্মান করতে হলে মাথা উঁচু করে কর। তুমি তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলছ। আর যে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাকে দোয়া করেই কি লাভ, দয়া করেই কি লাভ।”
“শক্তিমান মানুষের পরিচয় হচ্ছে বাড়াবাড়িতে। এই যে তোমার আশেপাশে এত সমস্যা, এত কিছু হচ্ছে। কই তোমার তো কোন বাড়াবাড়ি দেখিনা।”

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মই হয়েছে জাতিকে বাড়িয়ে নেয়ার এগয়ে নেয়ার জন্য, দুর্দশার বৃত্ত ভাঙ্গার জন্য ! এইযে আলকিত মানুষ চাই আন্দোলন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে যার জন্ম। স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সবার আগে অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। আলোকিত মানুষ চাই- সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক দিনে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে নানা উথথান পতনের মধ্য দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে। মূলতঃ দেশের আদর্শগত অবক্ষয় দেখে তা থেকে উত্তরণের জন্যে অধ্যাপক সায়ীদ এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে স্যার বলেন:
দেশের এই সার্বিক অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাহীনতার ভেতর সীমিত সংখ্যায় হলেও যাতে শিক্ষিত ও উচ্চমূল্যবোধসম্পন্ন আত্মোৎসর্গিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ বিকশিত হওয়ার পরিবেশ উপহার দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। তিনি অনুভব করতেন- একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন, মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা-কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে- আমরা এখানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। কাজেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাণহীন, কৃত্রিম, গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন-পরিবেশ।

এই মহা মনীষির জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। ধন্য বোধ করছি। পরিশেষে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের সুস্বাস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
কবি ও প্রাবন্ধিক।

লেখার সূত্র জোগাড়ঃ কোয়ান্টাম, মুক্ত বিশ্বকোষ, ভাঙ্গো দুর্দশার বৃত্ত গ্রন্থ, ও স্যারের বিভিন্ন বক্তব্য।

শুভ জন্মদিন হে বঙ্গতাজ

শুভ জন্মদিন হে বঙ্গতাজ!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর, পরম আস্থাভাজন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতা বঙ্গতাজ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এর ৯৫তম জন্মবার্ষিকী তে বিনম্র শ্রদ্ধা।

আল্লাহ আপনাকে পরকালীন সম্মান ও শান্তি দান করুন।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আত্মকথা


পদ্মার বুকে এভাবেই দাড়িয়ে রই আমি: হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।

আমি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তোমাদের এই দেশের সর্ববৃহৎ রেল সেতু। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আমি কতবড়? বলছি দাঁড়াও, আমি ১৭৯২.৮ মিটার ( প্রায় ১.৮কিমি) দীর্ঘ। এটা ভেবে মাঝে মধ্যে গর্ববোধ করি যে আমি তোমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু। আমার আরও একটি গর্বের জায়গা কি জানো? আমি একটা শতবর্ষী ব্রিজ, ক’ বছর আগেই ১০০ বছরে পা দিলাম। আমার জন্ম কত সালে জানো, সেই তোমাদের দাদাদের জন্মের সময়ে। সেই ১৯১০ সালে! …আমি বাপু সেই ব্রিটিশ আমলের ব্রিজ। আমার নাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কি করে হলো জানো কি? তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর নামে। ভাইসরয় কি তা আবার আমায় জিজ্ঞেস করো না। কারন আমি লোহার ব্রিজ, তোমাদের মত পণ্ডিত নই, অতকিছু আমি জানিনা। আমাকে বানানোর কারণ আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর বঙ্গের সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজ করার জন্য, কারণ মাঝখানে ছিলো পদ্মা। আমি সেই পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে তোমাদের যোগাযোগ সহজ করে দিচ্ছি।

আমাকে বানাতে কত শ্রমিক লেগেছিল জানো? ২৪,০০০ শ্রমিকের ৫ বছর। তাহলেই বোঝো, আমি কত বড়! কখনো কি ভেবে দেখেছো? প্রবল পদ্মার স্রোতেও আমি একশ বছর দাঁড়িয়ে আছি! যেখানে একবার নদীর পানি বাড়লেই তোমাদের বাড়িঘর ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, সেই পদ্মার বুকেই আমি একশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও আমার কিছুই হয়নি… ও হ্যাঁ আমি একবার ভেঙে পড়েছিলাম তোমাদের স্বাধীনতার সময়ে.. আমাকে প্লেন থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। বোমার আঘাত সহ্য করতে পারিনি; তখন একবার ভেঙে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি আমি শেষ আমি আর কোনদিন দাঁড়াতে পারবো না তবে তোমার আমাকে মেরামত করে দিয়েছো… এ কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমি তো ইস্পাতের তৈরী ব্রিজ। আমি শত বছর ধরে দেখে যাচ্ছি তোমাদের এই দেশটাকে… তার আগে বলি একটা হাসির গল্প: গ্রামের নিরক্ষর একদল মানুষ আমাকে দেখতে এসেছে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে “ওটা কিসের? ” “লোহার? ” ওরে!! নয় মন নোয়াই( লোহাই) লাগছে!” ওদের কথা শুনে একগাল হেসেছিলাম। তোমরা এটাও ভাবো আমার ওজন কত? আচ্ছা আর কি ভাবো আমায় নিয়ে ? লালন শাহ সেতুর ( হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশের সড়ক সেতু) উপর দিয়ে গাড়িতে করে যাও, তখন আমার পানে একদৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকো! কিন্তু কি ভাবো আমায় নিয়ে? জানতে ইচ্ছে হয় খুব জানতে ইচ্ছে হয়!

আমি যদি তোমাদের মত কথা বলতে পারতাম তবে বলতামঃ দাঁড়াও হে পথিক, দুটো কথা বলি তোমার সাথে.. কিন্তু আমি তো আর তোমাদের মত মানুষ নই। কথা কইতে পারি না। জানো পদ্মার বুকে মাঝে মধ্যেই দেখি আমার নিচ দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছে.. আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাকে একবার পদ্মা থেকে তুলে জড়িয়ে ধরতাম। কেউ নেই সেই লাশের। কোন খোঁজও থাকে না, এটা ভাবতে ভাবতে লাশটা পদ্মায় ভাসতে ভাসতে চলে যায়। জানো যেদিন অমনটা দেখি সেদিনটা খুব কষ্ট পাই। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কি করে কাঁদবো? আমি যে তোমাদের মত মানুষ নই। পরক্ষণেই ভাবি আমি মানুষ নই ভালোই হয়েছে, আমি তো আর কাউকে মেরে পানিতে ভাসিয়ে দেই না.. সেদিক থেকে বোধ হয় তোমাদের থেকে আমিই ভালো।

আমি কথা বলতে পারিনা বোবা, বোবার তো শত্রু নেই। তাই আমারও শত্রু নেই। আমি তোমাদের ব্রিটিশ আমল দেখেছি, পাকিস্তান দেখেছি, তোমাদের বাংলাদেশ ও দেখছি। বলার আছে অনেক কিন্তু কি করে বলবো? আমি তো বোবা। আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু তোমরা আর শোনো কই? তাই আর বললাম না। একটা কথা কি জানো? আমি বাঁচতে চাই আরও সহস্র বছর। কথা বলতে না পারি তোমাদের তো উপকারে আসতে পেরেছি। না হয় তোমাদের জন্যই আমি আমার জীবনটাকেই উৎসর্গ করে দিলাম….

.
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ধনিয়া পাতার বড়া

শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এ আবার কী! হ্যাঁ, এটা আমাদের দেশে হিন্দু পরিবারে সকালে, দুপুরে, আর রাতের খাবার ভাতের সাথে থাকা একরকম সুস্বাদু খাবার। শুধু হিন্দুই নয়, আমরা বাঙালিরা ভাত খাবারের সাথে প্রথম ধাপে হাল্কা পাতলা কিছু তরকারি বা সবজি ব্যবহার করে থাকি। যেমন: শাক, ভর্তা, ডালের বড়া, সবজি বড়া, বেগুন ভাজি, করলা ভাজি, কালিজিরা বাটা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারমধ্যে ধনিয়া পাতার বড়াও তেমনই একটা।

এই সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে বেশি পরিশ্রম আর বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। একটু পরিশ্রমের বিনিময়ে আধাঘন্টা সময়ের মধ্যেই ১০ থেকে ১২টি ধনিয়া পাতার বড়া তৈরি করা যায়। খেতেও খুবই মজা। শীতের দিনে গরম ভাতের সাথে গরম গরম ধনিয়া পাতার বড়া অন্যকোনো মজাদার খাবারের সাথে তুলনা করা যাবে না। এ একরকম অতুলনীয় সুস্বাদু ঘ্রাণযুক্ত মচমচে খাবার। তাহলে জেনে নিন, কীভাবে ধনিয়া পাতার সুস্বাদু বড়া তৈরি করবেন!

আমাদের দেশে শীতকালীন অনেকপ্রকার সবজির সাথে ধনিয়া পাতাও প্রচুর পরিমানে বাজারে পাওয়া যায়। আমরা যাঁরা শহরের বসবাস করে থাকি, তাঁদের সম্বলই একমাত্র বাজার। তাই বাজার থেকে মাত্র দশ টাকার ধনিয়া পাতা কিনুন! বাসায় বা বাড়িতে গিয়ে উপরে ছবির মতো ধনিয়া পাতার গোড়াগুলো ছেটে নিন। তারপর ভালো করে ধুয়ে নিন। ধোয়া হয়ে গেলে ধনিয়া পাতাগুলো একটু বড়মাপের করে কুচি করুন! সাথে তিন থেকে চারটে কাঁচামরিচ আর দুটো মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ কুচি করে কুচি করা ধনিয়া পাতার সাথে মেশান। সাথে পরিমাণ মতো লবণ আর একটু হলুদের ফাকি মেশান। এর সাথে একমুঠ সুজি আটা বা চালের গুড়ো মিশিয়ে ভালো করে মাখুন! যাতে ধনিয়া পাতাগুলো আঠা আঠা হয়ে দলা ধরতে পারে। এবার নিচের ছবি লক্ষ্য করুন!

উপরের ছবিটি দেখুন! ধনিয়া পাতা কুচির সাথে কাঁচামরিচ কুচি, পেঁয়াজ কুচি, লবণ ও সুজি আটা বা চালের গুড়ো মিশিয়ে মাখার পর এরকম হবে। এরপর বড়া ভাজার জন্য কড়াই নিয়ে গ্যাসের বা লাড়কির চুলোর সামনে যান। চুলায় কড়াই বসান! কড়াইতে পরিমাণ মতো রান্না করার তেল ঢালুন! তেল ঠিকমতো গরম হলে পিঁয়াজু সাইজে কড়াইতে ছাড়ুন! এরপর নিচের ছবি ফলো করুন!

উপরের ছবির মতো এভাবে কিছুক্ষণ সিদ্ধ হতে সময় নিন। বড়ার নিচের পিঠ একটু পোড়া পোড়া হয়ে গেলে উল্টিয়ে দিন। এপিঠ ওপিঠ ইলিশ মাছ ভাজার মতো মচমচা করে ভাজতে থাকুন! নিচের ছবিতে ফলো করুন!

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ধনিয়া পাতার পিঁয়াজু সাইজের বড়াগুলো একটু লালচে রং ধরেছে। কিন্তু পুরোপুরিভাবে ভাজা হয়নি। পুরোপুরিভাবে হতে আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে হবে। যদি পারেন, এর সাথে কয়েকটা শুকনো মরিচ ভেজে নিন। খানিক সময়ের মধ্যেই হয়ে গেল স্বাদের ধনিয়া পাতার বড়া। সাথে আছে স্বাদের শুকনো মরিচ ভাজা। এবার গরম ভাতের সাথে পরিবেশ করুন! নিজেও মনের আনন্দে ইচ্ছেমতো খেতে থাকুন। নিচের ছবিতে ফলো করুন!

মাত্র দশ টাকার ধনিয়া পাতায় অন্তত বিশটা বড়া তৈরি করা যাবে। যা একটি বড়সড় পরিবারের একবেলা ভাত খাবারের প্রথম ধাপের সাথে থাকা সুস্বাদু স্বাস্থ্যসম্মত যথেষ্ট খাবার। দুইজনের সুখী পরিবার হলে দুইবেলা খেতে পারবেন বলে আশা করি। ধনিয়া পাতার বড়া খেতে মন চাইলে পরিবারের কাউকে জ্বালাতন না করে, নিজের টা নিজেই করতে পারেন। খেয়ে মজা পেলে বা ভালো লাগলে আমার এই পোস্ট সার্থক হবে। সবাইকে শুভেচ্ছা।