বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

আমার ছিল

আমার ছিল একটা নদী
থৈ থৈ তার বুকে –
ভাসিয়ে দিতাম কল্প-পালে
স্বপ্ন-ডিঙা সুখে।

সেই নদীর আজ মন মজেছে
লোভের পলি জমে-
বুকের উপর দুখের পানা
বাড়ছে ক্রমে ক্রমে।

শীর্ণ দেহের দীর্ণ বুকের
সেই নদীমনটাকে-
স্বপ্নে শুধু ডাগর আশার
সাগর হৃদয় ডাকে।

অণুগল্প : অবিশ্বাসের ভয়

অবিশ্বাসের ভয়

: ভুতে বিশ্বাস করো?
: নাহ, ভুতে বিশ্বাস করিনা। এক্কেবারে না।
: তবে যে ভুতকে ভয় পাও!

আসাদ কাকা তিনবার শাদা দাঁড়িতে আঙুল বুলালেন। এক চুমুকে অর্ধেক গ্লাস পানি খেলেন, এরপর একটা হাই তুলে বললেন-
: বিশ্বাস করিনা বলেই তো ভয় পাই রে, বাবা।

একটু কেশে নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন-
: তখন আমার বয়স উনিশ কি বিশ। বর্ষা আরম্ভ হয়েছে মাত্র। যে দিনের কথা বলছি, ওই দিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। রাতেও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ভারী বৃষ্টিতে মাছ নদীর নিচে চলে যায়, তবে এমন টিপটিপ বৃষ্টিকে তারা পাত্তাটাত্তা দেয়না। আমি টেঁটা নিয়ে বের হলাম।

: একা বের হলে? তুমি না ভুত ভয় পাও, কাকা!

: ভুতকে ভয় পাই, কিন্তু বিশ্বাস তো আর করিনা। এমন রাতগুলোতে বোয়াল, শোল আর গজার মাছ বিলের ধারে ঘাপটি মেরে থাকে। এসব মাছ ভুনা দিয়ে ভাত বা খিচুরি খেতে কি যে স্বাদ! তাই প্রায় রাতেই মাছ মারতে বের হতাম।

গল্পটা যেনো খাবারের দিকে যেতে শুরু না করে তাই তাড়াতাড়ি বিস্ময় প্রকাশ করলাম-
: একাই মাছ মারতে গেলে!
: একাই বের হয়েছিলাম। যাওয়ার পথে তোর নিবারণ কাকাকেও ডেকে নিলাম। ওর আবার ভুতে খুব বিশ্বাস। তাই রাতে মাছ মারতে গেলে গলায় রসুনের মালা, হাতে কুপি আর এক টুকরো লোহা সাথে রাখতো। এসব সাথে থাকলে না কি ভুত কাছে আসেনা।

কাকা আরেক চুমুকে গ্লাসের বাকী পানিটুকু শেষ করলেন, এক মুট মুড়ি মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললেন-
: বিলের ধারে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে মন ভরে গেলো। মাছ আছে। টেঁটায় পরপর দুটো বোয়াল মাছ গেঁথে ফেললাম। বিশাল বড় বোয়াল। ওদিকে নিবারণের টেঁটায় বিধেছে একটা শোল মাছ, সাইজে আধ হাত হবে।নিবারণ বড় মাছ মারার জন্য আরও কিছুটা সময় থাকতে চেয়েছিলো, কিন্তু শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।

: এরপর কি তোমরা ফিরে এলে?

: না ফিরে করবো কি! এ বৃষ্টি তো থামবেনা। ফেরার পথে নিবারণকে একটা মাছ দিলাম। ও দু’টো মাছই চাইলো। বললো, বউয়ের সাথে বাজী ধরেছে যে আজ দু’টো মাছ নিয়েই ফিরবে। বাজিতে হারলে বিপদ, কারণ ওর বউ তন্ত্র সাধন করে। দিব্যি দিয়ে বলেছে দুটো মাছ না আনলে তাকে বলি দিবে।

: তুমি মাছ দিলে?

: মাথা খারাপ! তোদের কাকী আমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস! নতুন বিয়ে করেছি, বীরত্ব দেখানোর একটা ব্যপারও আছে। তবে নিবারণ নাছোড়বান্দা, ওর গলার রসুনের মালার দিব্যি খেয়ে, লোহার টুকরার দিব্যি খেয়ে, আগুনের ওপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে মাছটা চাইলো। শেষে কিনে নিতে চাইলো। কিন্তু আমি বেঁঁচবো কেনো!

মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে আমিও বললাম-
: ঠিকই তো! তুমি বেঁচবে কেনো!

কাকা এবার বালিশে হেলান দিলেন, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নিবারণ একটানে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে দিলো দৌড়। পিছু পিছু আমিও দিলাম ছুট। ওকে ধুতি ধরে থামানোর চেষ্টা করলাম, লাভ হলোনা। ধুতি খুলে আমার হাতে চলে এলো। দেখলাম ন্যাংটো নিবারণ দৌড়ে তাল গাছটার ওপর উঠে গেলো।

: তুমি ভয় পাওনি!

নারকোলে ছোটো একটা কামড় দিয়ে আরেক মুঠ মুড়ি মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে কাকা বললেন-
: ভয় পাবো না মানে! তখন হঠাৎ মনে এলো নিবারণ তো বিয়েই করেনি। তাছাড়া ও গেছে শহরে, ফিরবে এক সপ্তাহ পর। মনটা খুবই খারাপ হলো, একটা বাড়তি বোয়াল মাছের জন্য এতোগুলো মিথ্যে কথা বললো ভুতটা! শেষে মাছের বদলে ছেড়া ধুতিটা আমার হাতে রেখেই পালালো! একটুও লজ্জাবোধ নেই!

কাকার চোখে চোখ রেখে বললাম-
: তবে যে খুব বললে ভুতে বিশ্বাস করো না!

কাকা রেগে গেলেন-
: একটা বোয়াল মাছের জন্য যে ভুত নিজের পরিচয় গোপন করে, রসুন, লোহা আর আগুন ছুঁয়ে মিথ্যে বলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে! তাকে বড়জোড় ভয় পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বাস! ইমপোসিবল… নো নো.. নেভার… নেভার…

কাকা উত্তেজিত হলে ইংরেজিতে কথা বলেন। হাই প্রেশারের রোগী কাকাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, মেঘ বিকেলের আবছায়া রোদের আভায় ওই তালগাছের পাতাগুলো স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। হালকা বাতাসে দুলতে দুলতে তালপাতারা খসখসিয়ে যেনো একে অন্যকে বলছে – ‘সত্যিই তো, ভুতকে বড়জোড় ভয় পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্বাস? কাভি নেহি।

অণুগল্প : শান্তি নাই

শান্তি নাই

‘সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে শান্ত নীরবতা ;
খড় মুখে নিয়ে এক শালিখ
যেতেছে উড়ে চুপে ;
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ
বেয়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে ;

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে ;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে
আকাশে আকাশে।’ *

আমিও এক নিঃসঙ্গ শালিখ। পার্থক্য আমার মুখে খড় নেই, উড়তেও পারি না আমি। আমার বাড়ি নেই। তাই সঙ্গীও নেই। নেই খড়.. ছোট্ট ঘর। আর ঘর বানানোর ইচ্ছেরাও মৃতপ্রায়।

একজন ব্যর্থ লেখকও আমি বটে। ইঁদুর ও তেলাপোকার খাবারে পরিণত হয়েছে আমার গ্রন্থগুলি। লেখালেখিতেও শান্তি খুঁজে পেলাম না। জীবনানন্দ দাশ ট্রামে কাটা পড়ে শান্তি পেয়েছিলেন! আমার শান্তি কোথায়?

_________________
#মামুনের_অণুগল্প
* “সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে” —-জীবনানন্দ দাশ

অণুগল্প : ঋণশোধের এওয়ার্ড!

ঋণশোধের এওয়ার্ড!

সংবাদপত্রের অফিসে চাকরি করি। প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হতে রাত গভীর হয়ে যায়। বাসের জন্য বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তবে সুবিধে হলো বাস প্রায় ফাঁকা থাকে আর রাস্তাও ফাঁকা। দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয় না। আজ কিছুটা ব্যতিক্রম- মাঝরাতেও আগারগাঁও থেকেই যানজটের শুরু।

যানজটের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত। এক সুবেশী যুবক এসে পাশের সিটে বসেছে তা খেয়াল করিনি। সামনের এতোগুলো সিট ফাঁকা থাকতেও পাশে এসে বসায় ভীষণ বিরক্ত হলাম। লক্ষ্য করলাম যুবকের গায়ে আকাশী শার্ট আর কালো ইংলিশ ফুলপ্যান্ট। গাঢ় নীল টাই। বোঝাই যাচ্ছে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সেলসে কাজ করে।

যানজট ছুটার লক্ষণ না দেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিতেই অসাধারণ মিষ্টি কণ্ঠস্বর-
: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।

চোখ মেলে দেখি ওই যুবক, তার সালামের উত্তরে বললাম-
: ওয়ালাইকুম আসসালাম।

যুবকের স্বরে বিনয় গলে পরছে-
: স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা অনুরোধ করতে পারি!

মনে মনে বললাম ‘ধ্যাত!’, কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে বললাম-
: কি অনুরোধ?
: স্যার, একটা ভুতের গল্প শুনবেন!

প্রচণ্ড বিস্মিত হলাম, সাথে রাগও, মাঝরাতে মশকরা! জানতে চাইলাম-
: হঠাৎ ভুতের গল্প শোনাতে ইচ্ছে হলো কেনো?
: স্যার, এটা আমার ডিউটি। প্লিজ শুনুন স্যার, একটা ভুতের গল্প।
: আমাকে ভুতের গল্প শুনিয়ে আপনার লাভ কি?
: স্যার, আমার টার্গেট প্রতিদিন তিন জনকে ভুতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখানো। গত তিন মাসে মাত্র সাত জনকে ভুতের গল্প শোনাতে পেরেছি। কিন্তু তাদের একজনও ভয় পায়নি। তাই তিন মাসের বেতন আটকে আছে, বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে দিন কাটছে স্যার।

বেতন আটকে থাকার কষ্ট বাঙালি মাত্রই জানে, তার কষ্ঠে কষ্ঠিত হয়ে বললাম-
: ভুতের গল্প শোনানোর চাকরি! এ আবার কেমন চাকরি!
: স্যার, ইদানিং প্রায় প্রতিটা এফএম রেডিও আর বেশ ক’টা টিভি চ্যানেলে ভুত বিষয়ে অনুষ্ঠান হয়-
: হ্যা, সে অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আপনার গল্প কে শুনবে!
: কিন্তু স্যার, সেসব গল্প তো শুধুই গল্প। সেসব গল্পে ভুত সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া হচ্ছে। এমনসব গল্প প্রচার করছে যে অল্প বয়েসী বাচ্চাদেরও ভুতের ভয় কেটে যাচ্ছে। ভুতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

তার কথায় সত্যতা আছে, আমার বাচ্চা ছেলেটা এসব অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে এখন আর ভুতকে ভয় পায়না। একটা খালি আড়াইশো গ্রামের সরষে তেলের বোতল বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমোয়, রাতে ভুত এলে ধরে আটকে রাখবে বলে। তো সেই যুবকের কাছে জানতে চাইলাম-
: ভুতের ভয় পাওয়া বহাল থাকাটা কি জরুরী?
: স্যার, অবশ্যই জরুরী।
: কেনো জরুরী?
: স্যার, ভয়ই যদি না থাকলো, তবে ভুত থেকে লাভ কি! প্রকৃতির নীতির বিরুদ্ধে যাওয়া কি ঠিক!

তার কথায় বিমোহিত হলাম, জানতে চাইলাম-
: আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন? এনজিও’তে কি?
: এনজিও’তে নয় স্যার। আমি জিপিবি’র কর্মী।

মাথায় রক্ত উঠে গেলো, জিপিবি মানে গ্রামীন ফোন, বাংলাদেশ। এই মোবাইল ফোন কোম্পানি ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় নেমেছে! মিনিটে মিনিটে মেসেজ দিয়ে তাদের আর পোষাচ্ছে না! এখন বাসে বাসে প্যাকেজ বিক্রির ধান্ধা! এর মধ্যে তিন মাস ধরে বেতন দেয় না, ছি: এতো অধ:পতন। রাগ নিয়েই বললাম-
: আপনি জিপিবিতে কাজ করেন- মানে গ্রামীন ফোন বাংলাদেশ?
: দু:খিত স্যার। আমি গ্রামীন ফোনের কর্মী নই, ভুত বিষয়ক অধিকাংশ অনুষ্ঠানই স্পন্সরর করে এই কোম্পানি। এই কোম্পানি আমাদের শত্রুপক্ষ।

বিষ্ময়ে জানতে চাইলাম-
: তবে জিপিবি আবার কোন কোম্পানি!
: স্যার, জিপিবি একটি সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, এর পুরো নাম ‘গোস্ট প্রমোশন ব্যুরো।’ ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
: ভেরি ডিসগাস্টিং! মানুষ খেতে পায়না, আর ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যতসব রং ঢং! ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।

চেঁচিয়েই কথাগুলো বললাম। বাসের ড্রাইভার ও ভিতরের যাত্রীরা ঘটনা বোঝার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। যুবক কান্না চাপার চেষ্টা করছে-
: সর‍্যি, স্যার। ভুল হয়ে গেছে। গল্প শুনবেন না বললেই পারতেন। পেটের জ্বালায় এই চাকরী করি, স্যার। ভালো একটা চাকরী পেলে কি আর মাঝরাতে বাসে বাসে ঘুরি, স্যার!

কান্নায় আটকে আসা গলায় সে আরও জানালো-
: ঘরে বউ ছেলেমেয়ে না খেয়ে আছে- তিন মাসের বেতন আটকে আছে। আমার কষ্ট আপনি কি বুঝবেন স্যার! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়..

যুবক মানুষের কান্না খুব হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার। তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছিনা, যানজটে থেমে আছে বাস। বাসের সকল যাত্রী ও ড্রাইভার আমাদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে যুবক বললো – ‘স্যার, আমরা ভুত হতে পারি, কিন্তু মানসম্মান আমাদেরও আছে…।’ এই কথার পরপর দু’টো ঘটনা ঘটলো- যুবক উড়ে বাসের দরজা দিয়ে বের হয়ে হাওয়ায় মিশে গেলো। এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে ড্রাইভার জানলা দিয়ে লাফিয়ে দৌড় লাগালো, এক্সিডেন্ট করলে যেমন করে পালায় আর কি!

যানজট ছুটে গেছে। এখনও মাঝ রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার ফিরেনি। অন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ওই সুমধুর কণ্ঠস্বর- ‘স্যার! আমাদের গায়ের চামড়া কেটে পাপোশ বানিয়ে দিলেও আপনার ঋণ শোধ হবেনা। আফসোস! ভুতদের চামড়া নেই। আজ ড্রাইভার যে ডরটা ডরাইছে তাতে জিপিবি’র মহাপরিচালক খুশী হয়ে সবার বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দিয়েছেন। একমাসের সমপরিমাণ বোনাসও দিয়েছেন। ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় আপনাকে জিপিবি ব্রেভারি এওয়ার্ড-এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে।’

খুশী হওয়া উচিত, কিন্তু হতে পারছি না। মাথার ভিতর কে যেনো বলছে- ‘এওয়ার্ডের টুটটুট করি। ঋণশোধের গুষ্টি কিলাই, এখন বাড়ি যাবো কিভাবে! ধুত্তোরি…!’

অণুগল্পঃ যন্ত্রণা বুঝে আসে?

অণুগল্পঃ যন্ত্রণা বুঝে আসে?

– কি বাল লিখবো?

হৃদয়ের ইনবক্সে শিহাবের ম্যাসেজ। দুই ভ্রুর মাঝে কুঁচকে থাকা চামড়ায় বিরক্তির কাঁপন, অনুভবে ভিতরের শিহাবকেও তিরতির করে কাঁপায়।

কি-বোর্ডে প্রজাপতি নেচে যায়.. শুরু হয় কথা, একার সাথে একা।
– সংযত হয়ে কথা বলো।
– তুই বল! ব্যাটা পাকনা কোথাকার।
ভিতরের শিহাবকে জানায় বাইরের চামার শিহাব।

এভাবেই কেটে যায় অশুভ সময়। মহাকালের বুকে এক চরম অসামাজিক তার পরম বৈরী সময়ে, হৃদয়ে হিমু আর মিসির আলীকে নিয়ে জীবনের পথ পাড়ি দিতে যায়। জীবনের পাতায় পাতায় রঙ এর খেলা! একজন খেলে চলে.. দিনদিন প্রতিদিন।

হৃদয়ে বসন্ত বেলা, থেমে থেমে চলে খেলা। জীবন বড্ড একঘেঁয়ে এখন। সে যেন বিধবার সাদা শাড়ির অদৃশ্য রঙিন আঁচলে ছুঁয়ে থাকা এক কুহকী প্রহর। অণুক্ষণ বিবর্ণ জ্বালা! ইদানিং জীবন কখনো সধবার বুকের রঙিন চাদর তো অধিক সময় বিবর্ণতায় ভেসে বেড়ানো নীল শালুক!

ধান্ধাবাজীর জীবন, প্যারায় প্যারায় লুকোনো এক মারা খাওয়ার জীবন। নিজের ভিতরের মি. হাইড আর ড. জেকিলের অণুক্ষণ সংঘর্ষে বয়ে চলে জীবন। আহ জীবন।

দুইয়ে মিলে এক হবার যন্ত্রণা কারো বুঝে আসে?

– বাল বুঝে আসে।

চামার শিহাবের চামারসুলভ মন্তব্যে ভিতরের শিহাব কষ্ট পায়। এক ভ্রষ্ট সময়ে নিজের নষ্ট জীবনে একজন শিহাব, ভিতরের লেখক এবং সাংবাদিকের নিরন্তর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মানুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করে।

কোথায় মানুষ?

#মামুনের_অণুগল্প

ভালবাসা শুধু ভালবাসা

ভালবাসার গল্প-১
ভালবাসার গল্প শুরু হয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগে ২৬৯ খ্রীষ্টাব্দে। রোমের চিকিৎসক তখন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় দৃষ্টি ফিরে পেল নগর জেলারের একমাত্র কন্যা। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার পর সে দেখতে পেল পৃথিবী কত সুন্দর, সবুজ গাছে পাখিদের কলরব, কুসুম কাননে অলির গুঞ্জন, সবচেয়ে আশ্চর্য হল মানুষের মন। এই মন যাকে দেওয়া যায় তা কিছুতেই ফিরে নেওয়া যায় না। যার অপর নাম ভালবাসা। ভালবাসায় দুজনের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া হয়। সেই থেকে জন্ম নিয়েছিল তাদের ভালোবাসার অমর গাঁথা। ভালোবাসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ফেব্রুয়ারির এই ১৪ তারিখে। তারপর এই ভালোবাসার স্বীকৃতি পেতে দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে।

(চলবে)

পরমাণুগল্পঃ রতি

ফুল। মুখে হাসি। বুকে মধু।

মধুকর। মুখে বিষ। বুকে খিদে।

ফুল ডাকে। রঙিন ইশারায়।

মধুকর দিশা পায়। গুন গুন। খুন শোনায়।

হুলের প্রেমে ফুলের হাসি ঝরে। পাপড়ি বাসি হয়।

ফুল মরে। কষ্টরতির পরিণতিতে।

গাছ ফলবতী হয়।

মিছে প্রণয় ( পর্ব ২ )

মিছে প্রণয় ( পর্ব ২ )

আজ সকালে আধ ঘন্টা যাবত গলায় ফাঁসী দেবে বলে সিলিং ফ্যানে ওড়না আটকানোর চেষ্টা করছিল জয়িতা কিন্তু সে পারছেনা। কখনও সে ঠিক মতো ওড়নাটা ফ্যানের সাথে বাঁধতে পারছে না, কখনো বা তার মনে এতো সাহস পাচ্ছে না। মনে মনে ভাবছে – “এখন যদি কেউ রুমে এসে পড়ে ? বাসায় কেউ দেখে ফেললে জানাজানি হয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে যাবে…..
কিন্তু এভাবে আর কত দিন ? শোভনের বাচ্চা তার পেটে বাসায় যদি তা কোন ভাবে জানতে পারে এই মুখ আর দেখানো যাবেনা। তার চেয়ে ফাঁসী দেওয়াই ভালো, এবার ওড়নাটা ঠিক মতন বাঁধা হয়েছে কিনা চেক করে নিলো জয়িতা। কিন্তু এমন সময় একটি ছেলে রুমে ঢুকে দেখে ফেললো জয়িতা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সিলিং ফ্যানে তার ওড়না আটকানোর চেষ্টা করছিলো…..
বছর আঠারোর মতো হবে , এক ছেলে । চোখে সানগ্লাস, পরনে টিশার্ট আর জিন্স।
– কে আপনি আর এখানে কি করছেন ?
ম্যাডাম আপনি একি করছেন ? আপনি এখনই এখান থেকে চলে যান। কেউ দেখে ফেললে ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছি।
হ্যাঁ চলেই যাবো আমি এখানে থাকতে আসিনি। আপনার বাবা আমাকে ফোন দিয়েছিলো আপনার রুমের নাকি এসি নষ্ট হয়ে গেছে সেটা দেখতে এসেছি।
জয়িতা – আমি কিছু জানি না, আপনি এখান থেকে চলে যান ব্যাস।
ছেলে – দাঁড়ান, দেখি ওড়না টা ঠিক মত বেঁধেছেন কিনা। শেষমেষ খুলে গেলে তো না মরে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে থাকবেন।
জয়িতা – ঠাট্টা করছেন আমাকে নিয়ে ?
ছেলে – ঠাট্টা করব কেন, আমি তো আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি।
ওড়নাটি টাইট করে বাঁধার অজুহাতে ফাঁস খুলে সেটি নামিয়ে নিয়ে এলো সেখান থেকে ছেলেটি। তারপর বলল –
এবার বলুনতো মরতে যাচ্ছিলেন কেন ?
জয়িতা – সেটা আপনাকে কেন বলব বলুনতো ? কে আপনি আর আমাকে বাঁচালেন ইবা কেন…..
ছেলে – আমার সামনে আপনি ফাঁসী দিতে যাচ্ছিলেন আর কি চেয়ে চেয়ে দেখব ? সত্যিকরে বলুন তো কেন এমন কাজ করছিলেন ?
চেয়ার থেকে নেমে দুচোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝড়তে লাগলো জয়িতার…….
শুধু অনুভব করছে বুকের ভেতরের চাপা বর্ণহীন অনুভূতি আর একরাশ শুন্যতা। কি করবো আমি না শোভনের কাছে ফিরে যেতে পারবো, না এই বাচ্চা। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুটি তো কোন অপরাধ করেনি। ভাবতে ভাবতে কাঁদতে লাগলো জয়িতা…….

লেখা : ফারজানা শারমিন

সিজোফ্রেনিয়াক (অনুগল্প )

২৭/০৩/১৪

হাসিটা ঝুলে আছে লিজার ঠোঁটে।
ওরা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।
কাল লিজার হইচই চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

কি হয়েছিল লিজা এমন হইচই করছিলে যে ?
জানতে চাইলাম –
ওর ঠোঁটের হাসিটা মুছে গেল –
এখন সে অনেকটা বরফ শীতল –
সে মাত্র বার বছর বয়েসী শ্যামলা ক্ষীণা কিশোরী । যেহেতু তার এখনো আঠারো হয়নি তাকে শিশুই বলা চলে। কিন্তু শিশু হলেও ওকে স্কুল থেকে এসে ঘরের সব কাজ করতে হয় এমনকি তরকারী কেটে রান্না বসাতে হয়।
ওর মা দুর্দান্ত সুন্দরী। লম্বা, ফরসা, স্মার্ট মহিলা। শাড়ি পড়লে শাড়ি ওনার পায়ের গোড়ালি থেকে কিঞ্চিৎ উপরে থাকে ওনার হাইটের কারণে – কিন্তু —
উনি হাতের কড়ে ১ থেকে ৪০ পর্যন্ত গুনেন। আজ ও গুনছেন ইতিমধ্যে দু’বার গুণতে গেছেন – ভুল হয়ে গেছে
আবার গুণবেন – এবার ঠিক না হলে আবার গুণতে হবে –
ওনার এত কাজ আর মেয়েটা বোঝে না –
চিৎকার চেঁচামেচি করে – এমন জ্বালায় না মেয়েটা !!
লিজা তরকারি কাটতে বসে – তাকে রান্না বসাতে হবে –
ভাইয়া আর আব্বু আসলে খেতে দিতে হবে –
ওর মা গুনতে শুরু করেছেন –
এবার ভুল হওয়া চলবে না – সাবধানে – ১, ২, ৩, ৪, ৫–

অণুগল্প : হুমায়রা

এই অণুগল্পটি শ্রেফ একটি নাম শুনেই অনেক আগে লিখেছিলাম। কেন জানি ‘হুমায়রা’ নামটি ভালো লেগেছিল, যেভাবে ‘শিহাব’ অনেক ভালো লাগা একটি নাম। এজন্যই আমার অনেক অণুগল্পে পুরুষ প্রধান চরিত্রে শিহাবের উপস্থিতি।

।। অণুগল্প : হুমায়রা ।।

পিচঢালা পথটিকে পিছনে ফেলে দীর্ঘকায় মানুষটি চায়ের দোকানের সামনে এসে থামে। বেঞ্চে কয়েকজন খদ্দের বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। সে নিজেও বসে। চায়ের অর্ডার দেয়। দোকানদার একবার তাকে দেখে একপলক। শেষে নির্দিষ্ট কাপটি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়।

তপনের একটা গান বাজছে সিডি প্লেয়ারে। ‘ফরেষ্ট হীলে এক দুপুরে’। একটু অবাক হয় লোকটি। আজকাল এরকম গান সচরাচর চা’র দোকানে বাজে না! নিজের দৃষ্টিসীমায় সর্পীল পথটি চলে গেছে বহু দূর… পথের দু’পাশের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর ঝাঁঝালো পাতা বসন্তের এই মাতাল হাওয়ায় ইতস্ততঃ ঝরে পড়ছে। কালো পিচের পথটি, জায়গায় জায়গায় জীবন্মৃত পাতাদের সবুজ-হলদেটে আভায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। সেই পথ ধরে পাতাঝরার মুর্ছনায় আন্দোলিত হয়ে হেঁটে আসছে এক তরুণী। অচেনা… একা… শেষ বিকেলের সবুজ আলোয় তাকে কেমন নরম লাগছে!

সামনে পিছনের দুটি পথ মুহুর্তে বিস্মৃত হয়… স্মৃতির অনেক গভীর থেকে উঠে আসা এক নষ্ট অতীত, যেন হিরণ্ময় দ্যুতিতে আলোকিত করে টেনে আনে এক কুহকী প্রহর। দীর্ঘ মানুষটি একবার ভাবে, ‘আচ্ছা, হুমায়রা কেমন আছে এখন? অপেক্ষার প্রহরগুলোতে বিরক্ত হতে হতে ওর ভ্রু-গুলো কি এখনো কুঁচকে থাকে?’

একটু হাসে সে। একটি গান কত স্মৃতিই না ধারণ করে।

____________
#মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্পঃ প্রেম তো ছিল না ছিল শুধু প্রহসন!

অণুগল্পঃ প্রেম তো ছিল না ছিল শুধু প্রহসন!
_____________________________________________
একজন চিত্রশিল্পী ‘ন্যুড’ চিত্রকর্মকে যেভাবে নিজের দক্ষতায় অসাধারণ শিল্পকর্মে রুপ দিতে পারেন, একজন গল্পকারও অক্ষরের সাথে অক্ষরের পরিমিত মাত্রার মিলনে, আপন দক্ষতায় অনুভবের চাদর পরিয়ে, নগ্নতাকেও শিল্পে পরিণত করতে পারে। আমিও অনেক আগে এমনই এক অপচেষ্টা করেছিলাম। গল্পটি শেয়ার করছি আরো একবার…

_______________________________________________
একটা ছায়া ক্লান্ত হয়ে অপর ছায়ার উপর থেকে নেমে আসে। বাউরি বাতাসে উষ্ণতা পাক খেতে খেতে ঘন হয়… শ্রান্তিতে ভেঙ্গে পড়ে সঙ্গিনীর পাশেই একদণ্ড বিশ্রামে শান্তি খোঁজে যেন মৌণ সময়। আলতো ছুঁয়ে থাকার ভেতরে কি থাকে? সম্পর্কহীন সম্পর্কের মাঝে ভালোলাগা কতটুকু?

আলতো স্পর্শের স্মৃতি হয়তো কারো সবটুকু অনুভুতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে এক সেকেন্ড; শেষে বিদ্যুতের মতো ঝাঁকি দিয়ে শরীরের ভিতর দিয়ে কোথাও চলে যায় … কোথায় যায়?

‘ভালোলাগা সুন্দর,
ভালোবাসা আরো সুন্দর,
কারণ –
প্রেম আসে
ভালোবাসায় পুড়ে পুড়ে ..’ – কে যেন একদিন বলেছিল শিহাবকে!

সেই কারো হৃদয়ের উজ্জ্বল আলোয় স্পর্শের নাগালের বাইরে থেকে দেখা ঝিলিক দিয়ে ওঠা হাসিমুখ … বড্ড মনে পড়ে হঠাৎ! কি যেন পর পর স্পষ্ট হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। চেনা কিছু ছিলো । চোখ? মুখ? রঙ? ভঙ্গি? ভঙ্গি ! কার মতো !!
কণার!!!

চিন্তাটা বিবশ করে তোলে ওকে। পাশের সম্পর্কহীনার ক্ষীণ কটিতে এক হাত, বেডরেষ্টে অন্য হাত স্থির হয়ে থাকে শিহাবের। আসলে মাঝে মাঝে কোনো হিসাব নিকাশ ছাড়াই দু’জন মানুষ দু’জনের জন্য তীব্র টান অনুভব করে। ঠিক কী কারণে, বুঝা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় শরীরের যে চাহিদাটুকু তৈরি হয়, তা বুঝা সহজ বলে বোধ হয় মানুষ চট করে শরীরেই জড়িয়ে যায়। আর যত তারা শরীর খুঁড়ে সত্যগুলি খুঁজতে থাকে, তত দিশাহারা হতে থাকে মনটার অসহায়ত্ব দেখে । সে যে কী পেলো না, তা জানার জন্য মাথা আছড়াতে থাকে ঢেউয়ের মতো হাহাকারে; নির্দয় বোধ কিছু বলে না ; ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ে ফেনা হয়ে যায় – আবার ঢেউ হয়ে ফিরে আসে – আবার …এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে!

পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকা এক ছায়া এজন্যই কি অপর ছায়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে? এই ঝুঁকে পড়ায় ভালোলাগা থাকলেও সেখানে ভালোবাসা ছিল কি? তাই প্রেমও ছিল না… একটুও! ছিল কেবল জৈবিক তাড়নায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রহসন… তৃপ্তির ভান করার মূর্ত উপহাস!

অতৃপ্ত এক ছায়া তৃপ্তির মহাসাগরে ভেসে যাওয়ায় ব্যকূল ছিল… শিহাব হারানো ছায়াসঙ্গিনীর খোঁজে নিজেও ভেসে বেড়াচ্ছিল… অন্দরে… বন্দরে.. অন্তরে অন্তরে… নিরন্তর! অতৃপ্ত রমনী তাই ভেসে বেড়ানো শ্যাওলা ভেবে শিহাবকে আঁকড়ে ধরে। শিহাবও হারানো সঙ্গিনীর চেহারার সাথে কিছু কিছু মিল খুঁজে পেয়ে রমণীর তৃপ্তির উপকরণ হয়।

এভাবেই ছায়ারা সঙ্গিনী হয়ে উঠে… এভাবেই পরিচিত রমনী অপরিচিত কায়ায় ভর করে হৃদয়ের কার্ণিশে ঝুলে থাকে। কিন্তু তারা কায়ায় তৃপ্ত হতেই এই দোদুল্যমান জীবন বেছে নিয়েছে। তাই হৃদয়ের খোঁজ নেবার একটুও প্রয়োজন মনে করে না।

এক হৃদয়বান ছায়া, কায়া হারিয়ে এক ছায়াসঙ্গিনীর কায়ায় মিশে যেতে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় ঢেউ হয়ে যায়… ফেনা হয়… আবারো ঢেউ… এভাবেই বেঁচে থাকা! সেখানে ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নিয়ে প্রেম হয়ে উঠে না। এখানে কেবলি প্রহসন.. আর নৈঃশব্দের মূর্ত উপহাস!

#মামুনের_অণুগল্প

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

নিজের ছোট্ট রুম থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলেন। কিছুটা মুগ্ধ হয়েই। এরপর দরজায় তালা লাগালেন। প্রতিবারই এমন হয়। কিছুক্ষণ নীল আকাশ ও সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া দেখে মনে মনে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ!’

বহুদিনের অভ্যাস।
এখন আপনা আপনিই মন থেকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিসমূহ দেখতে থাকলে মনের অগোচরেই তার পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে! এর জন্য আলাদা ভাবে মুখ দিয়ে উচ্চারণের প্রয়োজন হয় না। আর মহান আল্লাহপাক এই মনকেই দেখেন… সেখানেই বসত গড়েন। কিন্তু তার জন্য চাই সাদা…স্ফটিকের মত মন।

আজ দুই মাস হতে চলল গাজীপুরের এই এলাকার মসজিদের ইমাম হিসাবে আব্দুল জাব্বার সাহেব নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ফেনীর একটি প্রত্যন্ত এলাকায় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইমাম-কাম-মোয়াজ্জিন… একাই তাকে এই দুটো দায়িত্ব পালন করতে হতো। সেখানের মসজিদ কমিটি কোনোমতে তাকে খাইয়ে-পরিয়ে আর মাসিক থোক কিছু টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ভাবনায় হোঁচট খেলেন।
এইতো একটা নাফরমানী চিন্তা করে ফেলেছেন। মসজিদ কমিটির কি সাধ্য তাকে বাঁচিয়ে রাখে? আল্লাহপাক চেয়েছেন বলেই না সেখানে তার রিযিক এসেছে… সেটা পরিমাণে যাই আসুক না কেন।

মনে মনে কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন) পড়লেন। সাথে সাথে একথাও তার মনে পড়ল, সেই গ্রামের মসজিদে আল্লাহ পাক তার জন্য যে পরিমাণে রিযিক পাঠাতেন, সেটা দিয়ে তার নিজের এবং ভোলায় তার পরিবারের প্রতি মাসের খাওয়া খরচই মিটানোই মুশকিল হয়ে যেত। অন্যান্য কিছুর কথা তো বাদই দিলেন। টাকাগুলো সব কুরিয়ারে বাড়িতে পাঠাতেন। নিজের তিনবেলা খাবার এক এক দিন এক এক বাড়িতে নির্ধারিত ছিল। ভাল-মন্দ খাওয়া হয়েই যেত। এটাও আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

তবে প্রতিবেলায় নিজের উদরপুর্তি করে ভালো ভালো খাবার খাওয়ার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত ভোলায় বৃদ্ধা মা, বউ আর তিন সন্তানের অভুক্ত চেহারাগুলো। কিন্তু খাবার নষ্ট করা যাবে না ভেবে জোর করে হলেও সেগুলো গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। নিজের চোখের পানিকে মনের ভিতরের রক্তক্ষরণের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হয়েছে। পাছে তার চোখে পানি দেখে খেতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি আবার কষ্ট পান!

কতটা গরিবী হালতে রয়েছে তার পরিবার যে তিনবেলা পেটভরে খাবারও খেতে পারে না। নদী ভাঙ্গনে তাদের সহায়-সম্পদ নদীর গর্ভে চলে গেছে। গুচ্ছগ্রামের বাড়ীটা পাওয়াতে তাদের মাথাগোঁজার একটা ঠাই হয়। এখানে তার কাছে যে সবাইকে এনে রাখবেন, সেই সামর্থ্যও তার নেই। নিজে কোনোমতে মসজিদের সাথের ছোট্ট খুপড়িতে থাকেন। পরিবারের বাকী ৫ জনকে এনে কোথায় রাখবেন? আল্লাহপাক সবরকারীদের সাথে থাকেন। সেই সবরই তিনি করছেন। এই অজ পাড়াগাঁ এ আজ পাঁচটি বছর ধরে পড়ে থাকা কি কম সবরের কাজ?

একদিন গাজীপুরের এই মসজিদটির ইমাম নিয়োগের খবর পান আরেক পরিচিত গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সে গাজীপুরেই থাকে। তার কথামত দরখাস্ত করেন… ইন্টারভিয়্যু দেন এবং সিলেক্ট হয়ে আজ এখানে।

ভাবতে ভাবতে মসজিদ ছাড়িয়ে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলেন। আজ জুম্মাবার। আজানের এখনো ঘন্টা খানিক বাকী আছে। এখান থেকেই বাজারের শুরু। এই এলাকায় বেশ বড় একটি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে।বেশ দূরে আরো কয়েকটি। এগুলোকে কেন্দ্র করেই এই এলাকাটার গড়ে উঠা। নাহলে একসময় এই এলাকা ইটভাটার জন্য কুখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরী গড়ে উঠল, কাজের জন্য শ্রমিকেরা এলো। তাদের জন্য ঘর-বাড়ি বানানো শুরু হল… ইটের ভাটার ইট দিয়ে বাড়ী হল… একসময় ভাটা বিলুপ্ত হল… দোকান-পাট তৈরী হল। এভাবেই.. একসময় বড় বড় মার্কেটগুলো এবং ফ্ল্যাট বাড়ীগুলোও অস্তিত্ব পেল। আর এগুলোর পাশে সেলাই দিদিমনিদের জন্য টিন শেডের ‘গার্মেন্টস বসতি’ কিছুটা বেমানান হলেও এদেরকে কেন্দ্র করেই এই জমজমাট আজকের এলাকা।

কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে স্বর্ণের দোকান- সবই হয়ছে। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট্ট মসজিদটিও বাড়তে থাকে। ফাউন্ডেশন দিয়ে একতলা শেষ করে এখন দুই তলার ছাদের ঢালাই চলছে। আর এ সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছেতে সবার সহযোগিতায় হয়েছে।

প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি দেহ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আব্দুল জাব্বার সাহেব না চাইতেই সবার সমীহ আদায় করে নেন। একেতো ধর্মীয় নেতা (ইমামের অর্থ তাই), তার ওপর বিশাল দেহ… সম্মান তো আসবেই। কিন্তু তাকে যারা পরিচালনা করেন সেই মসজিদ কমিটির সদস্যদের কাছে নয়। এটাই এখন সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। যাদের ভিতর ন্যুণ্যতম ধর্মীয় জ্ঞান নেই, আজকাল এরাই বেশীরভাগ মসজিদের কমিটিতে পদ নিয়ে আছে। আর তার মত আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ইমামদেরকে চলতে হয় কিনা এদের নির্দেশনা মত?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুদী দোকান এর পাশের চা’র দোকানের দিকে আগাতে থাকেন। এখানের এই চা বিক্রেতা নয়ন কে বেশ ভাল লেগেছে ওনার। যা বলে সরাসরি বলে ফেলে। কাউকে ডরায়ও না, ছাড় দিয়েও কথা বলে না।

তাকেকে দেখে সালাম দিয়ে বসতে বলল নয়ন। এরপর চা খাবে কিনা জানতে চাইলে আব্দুল জাব্বার সাহেব সম্মতি দেন। নয়ন চা বানায় আর পাশের খদ্দেরের সাথে কথা বলে। সময় বয়ে যায়..

মসজিদ কমিটির সভাপতি পাটোয়ারী সাহেবের বলা কথা গুলো এখনো মনে আছে। একটু বেশীই মনে আছে। কারণ কথাগুলোর ভিতরে বিশেষ কিছু ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ আপনাকে আপনার এই বিশাল দেহ দেখেই আমরা বেশী পছন্দ করেছি। কারণ ফিগার একটা বড় ফ্যাক্টর। নাহলে আপনার থেকে আরো বেশী জানেন এমন ইমাম আমরা পেয়েছিলাম।’

পাটোয়ারী সাহেব সরকারী চাকুরে। নিজের চার তলা বাড়ী আছে। সেগুলোর ভাড়া পান। আর টাকা ধার দেবার সমিতি রয়েছে। সোজা কথায় বললে ‘সুদে টাকা লাগানো’ হয় এই সমিতির মাধ্যমে। এলাকায় এরকম অনেক সমিতি রয়েছে। যে সকল শ্রমিকেরা এখানে চাকরী করে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এরাই এই সব সমিতি থেকে টাকা সুদে ধার নেয়। তাই এখানের স্থানীয় সকলেই এখন এক একটা সমিতির মালিক। এটাই অর্থ আয়ের সহজ পথ ভাবেন তারা। এদিকে আবার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এরাই হয় মসজিদ কমিটির সদস্য!

ওনাদের বাড়ীতেই মসজিদের ইমাম হিসেবে পালাক্রমে এক একদিন এক একজনের বাসায় আব্দুল জাব্বার সাহেবকে খেতে হয়।

ইসলাম ধর্মে আছে, হালাল খাবার খেতে হবে। অথচ সুদের কারবার যারা করে মসজিদের ইমাম সাহেবকে তাদের বাড়িতেই খেতে হয়! আর এ ছাড়া কিছু করারও তো নেই। তাকে যা বেতন দেয়া হয়, সেটা একেবারে ফেলে দেবার মত না। গ্রামের বাড়ীর সবাইকে নিয়ে এখানে এনে রাখতে পারবেন এখন। কিন্তু এলাকার এটাই রেওয়াজ। তিনি যদি না করে দেন, তাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। নাহয় বাড়ি বাড়ি খেলেন না, কিন্তু কোনো না কোনো সময়ে তো কারো না কারো বাড়ি খেতে যেতেই হবে। তখন?

আগের ইমাম সাহেবও খুব কামেল লোক ছিলেন। এই মসজিদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে, ওয়াজ এর আয়োজন করে এই মসজিদ এতোদুর নিয়ে এসেছেন।

অথচ তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল।
কারণ তিনি জুমুয়ার খুতবাতে সুদের বিরুদ্ধে বলতেন। কমিটির লোকেরা ওনাকে এই ব্যাপারে না বলার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারো কথাই শুনলেন না। অবশেষে তাকে চলে যেতে হল।

চা খেয়ে বিল দিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলেন। আজানের আর বেশী বাকী নেই। পথে দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। অর্ধনগ্ন নারীদেহের রঙিন ছবি। এরকম কিছুদুর পরপর রয়েছে। সেদিকে চোখ চলে গেলেও দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সাধারণ পাবলিকের সাথে এখানেই তার পার্থক্য। দীর্ঘদিনের অনুশীলন বলে কথা।

হাঁটতে হাঁটতে পাটোয়ারী সাহেবের আর একটি কথা মনে পড়ল। প্রথম দিন অনেক কিছুর সাথে তাকে এই কথাটিও বলেছিলেন, ‘আপনি ইমাম। মানুষের আখিরাতের মুক্তির জন্য কোরআন হাদিসের আলোকে বয়ান করবেন। সেটা আপনার এক্তিয়ার। কিন্তু সুদের বিষয়টি বাদ দিয়ে বয়ান করবেন। আমাদের এই এলাকার বেশীরভাগ মানুষই হয় সুদের ব্যবসা করে, না হয় সুদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন এই বিষয়ে আলোচনা করলে সকলেরই শরীরে লাগে।’

সেই সময় একবার চিন্তা করলেন, পাটোয়ারি সাহেবকে বলেন যে, তবে এই ব্যবসা বাদ দিচ্ছেন না কেন?
কিন্তু অনেক কিছু চাইলেই আমরা বলতে পারি না।

যখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, না, এভাবে নিজেকে ছোট করে ইমামতি করা যায় না। তখনই ফেনীর সেই ৫ বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা মনে পড়ে… ইমাম হবার পরও তাকে জমিতে হালের বলদ নিয়ে চাষে সাহায্য করতে হয়েছে… জায়গীর থাকার মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে দিনের পর দিন বিনা বেতনে পড়াতে হয়েছে… মসজিদের দেখাশুনা করা তো ছিলই।

আর ছিল পরিবারের সবাইকে ফেলে একা একা থাকা… দিনের পর দিন! আহ! অসহ্য যন্ত্রনাকর সেই দিনগুলোকে ফেলে এখন যখনই না একটু সুদিন আসি আসি করছে, তিনি কি নিজের বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে সেটিকে পায়ে মাড়িয়ে আবার সেই কষ্টকর দিনগুলোতে ফিরে যাবেন? মা-বউ ও তিন বাচ্চাকে এখানে সামনের মাসে নিয়ে আসবেন চিন্তা করেছেন। পাটোয়ারী সাহেব একটা দু’রুমের বাসাও তার জন্য অল্প ভাড়াতে ঠিক করে দিয়েছেন। পাশেই স্কুল আছে। সেখানে ছেলেমেয়ে তিনজনকে ভর্তি করাতে পারবেন। একটা মাদ্রাসা করার চিন্তা করেছে মসজিদ কমিটি, সেটাও তাকে চালাতে হবে। সেদিক থেকেও কিছু টাকা আসবে। আর সকালে এখন তার কাছে প্রায় ৫০-৬০ জনের মত আরবী পড়ছে। সেখান থেকেও অনেক টাকা আসছে।

এই সব কিছুকে ছেড়ে যেতে হবে একেবারে খালি হাতে, যদি কমিটির সদস্যদের কথার বাইরে নিজের বিবেকের কথা মত চলেন।

কি হবে আবার ফিরে গেলে?
মাকে ফোনে সেদিন বলেছেন, ‘চিন্তা কইরো না। আমার কাছে তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি। আর কষ্ট করা লাগবে না।’

মা এর হাসিমুখ এতো দূর থেকেও তিনি দেখতে পেলেন। বউ এর খুশী অনুভব করতে পারলেন। ছেলেমেয়েদের বাবার কাছে আসার… একটু পেট ভরে খেতে পারার আনন্দকে নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন।

এসবই স্রেফ উবে যাবে!
তার একটি সিদ্ধান্তের দ্বারা।

মসজিদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জুতো জোড়া হাতে নিতে নিতে ভাবেন, একটা হাহাকার জীবনে সবসময় থেকেই যায়। সেটাকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না।দারিদ্র্যতা জীবনের একটা অলংকারের মত তার জীবনে রয়েই গেলো। তবে যে এই দারিদ্র্যতাকে মেনে নিতে পেরেছে, তাকে কখনো শান্তির পিছনে ছুটতে হয় নাই। বরং শান্তিই তার পিছু নিয়েছে।

বড় করে শ্বাস নিয়ে মিম্বরের দিকে চলে যান। আজান দিতে হবে।

পুরো মসজিদে পিনপতন নীরবতা না থাকলেও মোটামুটি সকলেই নীরব। এই নতুন ইমাম এর কথার ভিতরে একরকম যাদু আছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে। খুৎবার আগে ইমাম সাহেব বাংলায় কিছু বয়ান করেন। এখন সেটাই দিতে যাচ্ছেন নতুন ইমাম আব্দুল জাব্বার সাহেব। তিনি সালাম দিয়ে শুরু করলেন,

– আল্লাহ পাক সুদকে হারাম করেছেন… যাকাতকে করেছেন ফরয।।

#মামুনের_ছোটগল্প

মামুনের অণুগল্প : শূণ্য

শূণ্য

একটা পর্দা। দুটি দেহ। এক হতে চেয়েছিল অনেকের সাথে থেকেও। একজনের ভুলের কারণে বিচ্ছিন্ন হল। চাইলেই তাঁরা এক হতে পারে।

দূরত্বটা বেশী ছিল না। কিন্তু সংকোচ ওদের ভিতর এতোটা দুরত্ব এনে দিলো… পর্দার আড়াল থেকেও অ…নে…ক অনেক দূরে সরে গেল তাঁরা। এতোটা দূরে সরে যাবে কল্পনায় ও আসেনি তাদের! এখন ভাবে, পর্দার বাইরেই তো ভাল ছিল!

‘Every time we touch
I get this feeling
Every time we kiss
I swear I can fly
Can’t you feel
My heart beat, so..
I can’t let You go
Want You in my life..’

“মানুষের হৃদয়, বিবেক, স্বপ্ন আর আশা তার সুখ দুঃখ গুলির মতোই মানুষের নিজের কাছে থেকে যায়। কেউ চাইলেই শূণ্য হতে পারে না “- শিহাবকে অনেক আগে কেউ একজন বলেছিল।

সেই থেকে নিজেকে শূণ্য করার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত রেখেছে শিহাব। হৃদয় আর বিবেকের গলা টিপে ধরে দুঃখগুলো দূরে তাড়াতে চাইছে। সুখগুলো স্বপ্নভঙ্গের কারণে আগেই আশাহীন হয়ে সেই ‘কেউ একজনের’ পিছু পিছু চলে গেলো। সেই থেকে যদিও একা… কিন্তু শূণ্য হতে পেরেছে কি?

_____________
#মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্পঃ কায়া

“তেরোই জুলাই কথা দিয়েছিলে আসবে।
সেই মত আমি সাজিয়েছিলাম আকাশে
ব্যস্ত আলোর অজস্র নীল জোনাকি।
সেই মত আমি জানিয়েছিলাম নদীকে প্রস্তুত থেকো,
জলে যেন ছায়া না পড়ে মেঘ বা গাছের।
তেরোই জুলাই এলে না।
জ্বর হয়েছিল? বাড়িতে তো ছিল টেলিফোন
জানালে পারতে। থার্মোমিটার সাজতাম।
নীলিমাকে ছুঁয়ে পাখি হতো পরিতৃপ্ত।” *

জীবনের শুরুতে, এরকম অনেকগুলি তেরোই জুলাই মিস হয়েছিলো শিহাবের কণাকে ঘিরে। ইচ্ছে-অনিচ্ছায় কিংবা কার ভুলে? আজ আর তার স্মরণের কোনো প্রয়োজন দেখে না সে।

এরপর বিস্মৃতির আড়ালে অনেকগুলি বছর… হারানো এক অন্য জীবন! আদৌ সেটা জীবন ছিলো কিনা সে অনেক গবেষণার বিষয় হতে পারে, তাই সেদিকেও যেতে চায় না শিহাব।

তারপর? অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন আরেক ভিন্ন প্ল্যাটফরমে আবারও দেখা হলো দু’জনের। হাসলে গালে টোল পড়ত কণার। যদিও সেদিন টোল পড়েছিল, কিন্তু কোথায় সেই হাসিমুখ? অপূর্ব মুখশ্রীর সেই মেয়েটি সেদিন শিহাবের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ধরে রাখলেও, সেই হাসিটুকু শিহাবের জন্য ছিলো না! সে এখন অন্য কারও জন্য হাসে!

নীলিমাকে ছুঁয়ে পরিতৃপ্তি পেতে, মাত্র একজীবন, অনেক পাখির জন্যই খুবই অল্প সময়।।

_____________________________
#মামুনের_অণুগল্প … কায়া // অণুগল্প ৫৩৮।

* কথোপকথন_২২ঃ পূর্ণেন্দু পত্রী

অণুগল্পঃ আ লিটল বিট টেন্সড্

আ লিটল বিট টেন্সড্

আমার আশেপাশে হাজারো চরিত্র। এদের হৃদয়ের অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করে চলি কী-বোর্ডে দ্রুত সঞ্চরণশীল আঙ্গুলের দ্বারা। কখনো আনন্দিত হই, হরিষে বিষাদময় প্রহরগুলিতে নিজেও ডাউনমুডে থাকি, রোমান্টিসিজমের অতলে ডুবে ডুবে মুক্তো খুঁজে বেড়াই… এভাবে সময়ের বুক থেকে সকল সময় নিরন্তর বয়ে যেতে থাকে আমার।

কিন্তু নিজের একান্ত কাছের চরিত্রগুলির মাঝে আমি বড্ড অসহায় বোধ করি। কেন যেন মনে হয় তাদেরকে ঠিকভাবে আমার হৃদয়ে আঁকতে পারলাম না… কাছের সম্পর্কগুলির সঠিক যত্ন নেয়া হলো না.. সময়ও বেশী নাই আর।

এখন জীবন এক বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী বৃহস্পতিবারকে ঘিরে ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। শুক্রবারটা কিভাবে যেন জীবন থেকে উবে যায়… মুহুর্তে গায়েব হয়ে যাবার মতো।

আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। ভালো লাগাগুলিও মন্দ লাগাদের মাঝে হারিয়েছে। খুঁজে ফিরিয়ে আনার উৎসাহও মরে যাচ্ছে।

ধুত্তুরি! কিছুই ভালো লাগে না আমার।

শেষ হয়ে যাক এ জীবন… Am a little bit tensed.