আমাকে ভুলেছ তুমি
বর্ষাস্নাত হিজল,
আমার আতপ্ত তুমি
হাস্য উজ্জ্বল,
আকাশ দিয়েছে পাড়ি
শূন্য হাতে,
গভীর স্নেহান্ধ আনাড়ি
চুমুতে,
অবশেষে দাঁড়াই ঘুরে
মুখোমুখি-
নির্লিপ্ত হিজল স্বপ্নাতুরে
জড়িয়ে রাখি
অনন্ত সুখে মাখামাখি।
বিভাগের আর্কাইভঃ সাহিত্য
দুপুর
সব বিকেলের গাঢ় আলোয় জিব মেলেছে
এক সংকেত চিহ্ন নিয়ে, দূর হতে ঢুকে পড়ে
সাপখেলা দুপুর, এখানে দরজার খিল খুলে
প্রবেশ করে জীবনের কথা, ভাতের চেয়ে…
তবু জ্যোৎস্না খায়, অন্ধ বাঁদুড়। দাঁত থেকে
রাত্রি বেরোয়, তাতে লেগে আছে সাক্ষরতা।
তোমাদের দুপুর আর আমাদের দুপুরবেলার
বিস্ময়ের রূপ বুঝতে গেলে কোনো এক
শুক্রবারের আশপাশে গিয়ে ধূসর কল্পনারস
খুঁজে নিয়ো, নিয়ম করে টুকে রেখ সেসব গীত।
পুরনো হলুদকোটা রং মাড়িয়ে পাড়ি দিচ্ছে
স্ত্রীদের ঝলসানো আগুন, সেখানে চাইলেই
ঝিঙেফুলের শৈশব বড় হতে হতে ভুলে যায়
কে কার নিকট আটকা পড়ে, নির্জন শাসনে!
.
৩০ মে ২০২৩
চলো শাপলা চত্বরে আজ
ছুটির দিন বিকেলের রোড, থেকে যায় ফাঁকা,
সেই রোডে থাকে গোধূলি রঙ আঁকা
ব্যস্ততা আর ছুটে চলা হন্তদন্ত লোক নেই
নেই গাড়ির বহর, চলো ঘুরি রিক্সায়
সময় কেটে যাবে আনন্দেই।
শাপলা ফোটা মতি মিয়ার ঝিলে
জল ছিল কি তখন, জানতে ইচ্ছে এ দিলে,
এমন পাপড়ি মেলা শাপলা ফুল
তার উপরে বিকেলের আকাশ, শুভ্র মেঘ তুলতুল।
রিক্সায় ঘুরুন্টি মেরে আসি, যাবে
রিক্সায় বসে আইসক্রিম খাবে?
বিকেলের আকাশে রক্তিম মেঘের আনাগোনা
আজ হাওয়ার আওয়াজ শুনি, যন্ত্রের আওয়াজ যায় না শোনা।
আকাশের বুকে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিদের দল
মাঝে মাঝে শুভ্র আর রক্তিম মেঘেদের কোন্দল,
না করো না গো, রিফ্রেশ হতে চাও না,
ঘরের ভেতর উত্তপ্ত হাওয়া,
একটি বিকেল তোমার কাছে আছে পাওনা।
সন্ধ্যার আযান হলে ফিরে আসবো ঘরে
কাজ তো সাজানোই আছে থরে থরে,
মন হলে ভালো, কাজ করতে নেই আর অনীহা
আমার সাথে ঘুরো, বাড়িয়ে দাও কাজের স্পৃহা।
.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, মতি মিয়ার ঝিল)
ভিসা ভোট
অবাধ সুষ্ঠু ভোট দানে
আমেরিকার ভিসা
বাহ বাহ কি চমৎকার!
কেউ আর বলতে পারবে না
মামা বাড়ির আবদার;
কি সাঙ্ঘাতিক চিন্তা রে বাবা
হোক না অবাধ সুষ্ঠু ভোট
ইতিহাস শুধু সাক্ষী থাক
অসুষ্ঠু ভোটে ভিসা নাপাক
নতুন আঙ্গিকে হোক ভিসা ভোট।
১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯, ২৯ মে ২৩
জিততে গেলে হেরে যাব
সাত
— চাঁদ, যা দিদিকে ডেকে আন তো। রুটিক’টা বেলে দিক।
— এই ছোড়দা, দিদিকে ডাক।
— আমার বয়ে গেছে।
শিউলিকে পাচ্ছ না? দ্যাখো গে’ খুকুর কাছে ব’সে। খুকুর খোঁজ নেই? সে নিশ্চিত শিউলিদের ঘরে। চাঁদ তিনটে ফ্যানাভাতের গন্ধ, সাত সুপুরিগাছ আর তেইশটা রোদ্দুর পেরিয়ে সুশীলকাকুর বাড়ি পৌঁছে গলা খাঁখারি দিল। বারান্দায় উপুড় টিনের কৌটো, পাঁচছটা পুরনো পুঁতির মালা থেকে ভালো পুঁতিগুলো ছিঁড়ে শিউলি মাটিতে রাখছে… নাকি নিজেই খ’সে যাচ্ছে টাপুস-টুপুস; আর খুকু, ভালো নাম অশোকা, সেগুলো লাল কারে গেঁথে নিলেই নতুন মুক্তোহার!
— খুকুদি, তোমার বন্ধুকে মা ডাকছে।
— আমার বন্ধু সবাই। তুইও তো।
— আমি তোমার ভাই না? সবুজ রঙের ফ্রক পরা বন্ধুকে ডাকছে।
দুজনে এক-নদী হেসে গড়িয়ে পড়ল।
— এখানে সবুজ ফ্রক পরা কোনও মেয়ে নেই।
— না না সবুজ না, নীল।
এবার ফুঁসে উঠবে দাঁতের ফেনা-ঘেরা হাসির সমুদ্র।
— হোই রঙকানা, মাসিমা যাকে ডাকছে তার নাম বল।
নাম মুখে আনার নিয়ম নেই, খুকুদি ভালো ক’রেই জানে। কিন্তু চাঁদের বুদ্ধি কি কিছু কম?
— তালিবোশ্শ’য় রোশ্শি, রস্সোউ, ল’য় রোশ্শি।
আট
শিউলি কদবেলমাখা ক’রে সবাইকে দেওয়ার সময়ে দিদিমা বলেছিল :
—আমার ভাগেরডা তুই নে গে, বুনডি। আমার দাঁত কদবেল খালি ট’কে যায়।
এ-বাবা, ফলস দাঁত আবার টকে কী ক’রে! বাসু অবাক।
— তোমাগো ফলস দাঁত আছে যে জানবা?
তার এই আনজাস্ট এনরিচমেন্ট ঠেকাতে চাঁদ পেছন থেকে ডিঙি পেড়েছে বুঝে শিউলি টপাৎ ক’রে গোটা দলাটা মুখে পুরে দুটো বিশেষণ ছুঁড়ে দেয় : ১/ ছোঁচা ২/ পাতকুড়োনি, আর উড়ে আসা কিলের কথা ভেবে কুঁচকে রাখে পিঠ।
ওসবে না গিয়ে ভাই তার বাঁহাত খুঁজছে… শিউলি হাত মুঠো ক’রে পেছনে লুকোলো। ছেলেটা তখন মগ জলদস্যু, এক চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, দিদির কব্জি কামড়ে ধরেছে। ওর গজদাঁত দিয়ে ঝরঝর ক’রে পানখাওয়া রক্ত পড়ছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মুঠো চিৎকার ক’রে খুলে যাবে কেন? ওমনি চাঁদ নিজের বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল শিউলির কনিষ্ঠায় পেঁচিয়ে ছেড়ে দেয় — আড়ি!
আড়ি, বলতে গেলে, ভালো। বাড়িতে যখন ঢের সারে বাচ্চা, তাদের ক্লোজড গ্রুপে দাঙ্গা ঠেকাতে আক্রোশকে খসখসে অভিমানে মুড়ে ফেলার নামই আড়ি। আর অভিমান কিছুদিন পরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে খামের ভেতরের রাগটাকে পচিয়ে দেবে। হয়ত তখনও রাস্তায় কারফিউ, কিন্তু বাগানের দুই গাছই মাথা দুলিয়ে ‘রাজি’ বলছে।
বড়দের কি আড়ি হয় না? গত বছর মান্নাপাড়ায় ভাড়াটে-বাড়িওলা তুমুল ক’রে দুজনেই কোর্টে কেস ঠুকে দিয়ে এল। মহকুমা আদালতে ডেট পড়ে; কোনও দিন এনার উকিল গায়েব, কোনওদিন ওনার। একই ট্রেনে কোর্টে হাজির হয়ে ঠনঠনে রোদে শিরিষতলায় দুজন-দুদিকে-মুখ ব’সে থেকে থেকে আবার একই ট্রেনে একই বাড়ি।
তার মধ্যে হঠাৎ বাড়িওলা শসা কিনে কলাপাতা-সমেত বাড়িয়ে দিয়েছে ভাড়াটের দিকে। সে আড়ষ্ট হাতে গ্রহণ ক’রে রোদের তেজ কমলে নিল দুটো চা। পাশাপাশি ভাঁড়ে চুমুক, ছেলের পরীক্ষা বা বাজারদর নিয়ে শৌখিন কথা; ভেতরে ভেতরে তখন ওই কবিতাটা হচ্ছে — কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য, অশুচি…।
মায়া ভেবেচিন্তেই চাঁদকে পাঠিয়েছিল দিদিকে ডেকে আনতে, তারপর সে ‘ও গৃহস্থ’ ডাকা লোকটার কাছে গিয়ে বসে :
— আপনার ছোট পুত্র আর বড় কন্যার তো মুখ-দেখাদেখি বন্ধ আজ দুই সপ্তা।
— ও, আড়ি? আড়ি-তে গাইছে দুজন? দুরূহ কাজ কিন্তু, শমের আধ মাত্রা পরে ধরতে হবে। গাইতে পারলে অন্যরকম চার্ম তৈরি হয়! যেমন, ‘আজু বহোত সুগন্ধ পবন সুমন্দ মধুর বসন্ত্’, রাগ বাহার। হাতে তালি দিয়ে নির্মল দেখাতে থাকে — ধা দেন্ তা, তেটে কতা, গদি ঘেনে, ধা-আজু বহোত…।
আট
রেল স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তায় নামল দুটো পালতোলা নারী-পুরুষনৌকো। দেখে পুকুরঘাটে কাপড়-আছড়ানো ঘোমটা স্থির, বটতলায় বিড়িটানা আঙুল নেমে এল ঠোঁট ছুঁতে গিয়ে — কতটা লম্বা দেখেছ, কী সুন্দর জুতো, কী ভারি-ভারি গয়না, সঙ্গে আবার চাকর, তার কাঁধে কত বড় ব্যাগ! সব পয়সাওলাই রাস্তার চোত্রাপাতা-চোরকাঁটা বাঁচিয়ে, কুকুর-মানুষের গু বুঝে পা ফেলে তারপরেও দুটি হোঁচট খেয়ে গ্রামের কুটুমবাড়ি পৌঁছোয়। কিন্তু কলকাতার বড়লোকদের কাঁধের পেছনে আলোর ঝালর থাকে — জাদুকর ম্যানড্রেক! তারা কোথাও হাজির হলে আচমকা বায়ুপ্রবাহ বেড়ে যাবে; শিমূলগাছ দুটো তুলোফল ঝরাতে গিয়েও — থাক বাবা, যদি মাথায় লাগে; শালিখপাখি ঘেঁটি বেঁকিয়ে পাড়ার বেড়ালকে জিগ্যেস করবে — কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, আইডিয়া আছে?
চাঁদ বাড়ি ফিরে দ্যাখে ভবানীপুরের মাসি উঠোনে চৌকিতে ব’সে হ্যাঁচ্চাই এক ব্যাগ খুলে জিনিস বের করছে তো করছেই — বাবার জন্যে সাধনা-র চ্যবনপ্রাশ, দিদিমার জন্যে নতুন থান, চাঁদের কেডস, গোপুর জন্যে বর-বউ পুতুল, শিউলির ফ্রক… মায়ের কিছু নেই? এই যে, দুকেজি সরষের তেল! দেখতে দেখতে উঠোনটাই দোকান, পাড়ার লোকেরা নেড়েচেড়ে দেখছে জিনিসপত্র, মাসি উঁচু গলায় দাম শোনাচ্ছে, তার মধ্যে দিদিমা : সঞ্জুভাই, বালতিতে জল ভরো, অশ্বিণী চান করবে। উঠোনে আর একটা জলচৌকিতে মেসো গা আগ্লা ক’রে বসলে চাঁদ আর গোপু ছোট ছোট থাবায় তার আঁচিলখচিত পাহাড়-পিঠে তেল ড’লে দিচ্ছে। বদলে দুজনের চ্যাটচেটে হাতে পাঁচ পাঁচ দশ নয়া।
রানীর রাজপুত্রকন্যা নেই, সেই যন্ত্রণার ওপর সে ধনসম্পদের ডাকটিকিট চিটিয়ে রাখতে চায়। মায়াকে বিদ্রূপ করে বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনোর জন্যে, আবার খুব ইচ্ছে দিদির একদুটো সন্তান নিজের পরিচয়ে মানুষ করবে। তারা ঘটাং-ঘটাং কাশবে না, চপর-চপর ভাত চেবাবে না, কুজড়িমুজড়ি জামাকাপড় প’রে বেরোবে না রাস্তায়, কলকাতার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র হবে।
দিদির ‘হ্যাঁ’ না পেয়ে রানী নিমতিতা কলোনিতে আসা কমিয়েছে, এলে দুকেজি সরষের তেলের হিংসেঝাঁঝ ছড়িয়ে যায়।
শিউলি ভাইয়ের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে মাকে ধরল।
— মাসি এই আমাদের বাড়ি এসে আবার এই বারাসাত চলে যাচ্ছে কেন?
— যাচ্ছে পদ্মর সঙ্গে দেখা করতে। দুই বাঁজায় ব’সে পরের সংসারের মুন্ডুপাত করবে না?
নয়
ঋজুদার মতো পদ্মপিসির গল্পটাও অ্যাডাল্ট, শিউলি দিদিমাকে তুইয়ে-তাইয়ে শুনে নিয়েছে :
সাত-আট বছর বয়েসেই পদ্মকুঁড়ির বিয়ে হল পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের সঙ্গে। রাত্তিরে সে ঘরে ঢুকলেই বউ আপাদমস্তক চেঁচাত। কিছুদিন পরে মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিল; প্রথম জন ফিরল তার মাসির শ্বশুরবাড়ি, সিদ্ধান্তপাড়ায়।
আস্তে আস্তে সে-মেয়ে বড় হয়, অতি নম্র, মাটি দিয়ে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হবে না; আর এমন রূপসী, পুকুরঘাটে গেলে বৌঝিরা কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন খবর পেয়ে তার বর লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মর কাছে আসতে লাগল। এদিকে তোমাদের বাড়িতে অনেক দিনের পুরনো এক কুরির মেয়ে ছিল, সে জন্ম-বোবা।
— কুরি মানে কী, দিদ্মা?
কুরি হচ্ছে ময়রা। কাজের মেয়ে হলে কী হবে, জোচ্ছোনার ভীষণ দাপট। বাড়িতে ভিখারি এলে নাদু চাল-আলু দিতে গেছে, সে বারান্দায় ব’সে ইশারা করছে — অত চাল দিয়ো না। শীত হোক বর্ষা হোক, জ্যোৎস্না শুতো বাড়ির বারান্দায়। সে ধরে ফেলল, পদ্মর বর গভীর রাতে তার কাছে আসে, পদ্ম নিঃসাড়ে দরজা খুলে দেয়, আবার শেষ রাতে ঘর থেকে তাকে লুকিয়ে বের করে।
যদি মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে পড়ে, কী হবে! হিন্দুদের মধ্যে দুই বিয়ে তখনও করে কেউ কেউ, কিন্তু এক বউয়ের হাল হয় রক্ষিতার মতো। বাণীনাথ শালীর মেয়েকে বললেন, জামাকাপড় গোছাও। বাগেরহাটে গরীব বাপমা-র কাছে ফিরে গেল পদ্ম, সেখান থেকে দেশভাগের পর দুই ভাই বৈদ্যনাথ আর অজিতের সঙ্গে হিন্দুস্তানে।
কিন্তু দুঃখের কথা কি জানিস? পদ্মপিসির কোনওদিনও সন্তান হতো না। শরীর খারাপই হতো না ওর। তোদের ঠাকুর্দা জানত না, বলার সাহসও কেউ দেখায়নি।
— দিদ্মা, পিসি এখনও শাঁখাসিঁদুর পরে ক্যান্?
— বরের তো কোনও দিশে-হদিশ নেই, আইনমতোন ছাড়াছাড়িও হয়নি। ওই শাঁখাসিঁদুর নিয়েই চিতেয় উঠতি হবে পদ্মর।
শিউলি কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে ব’সে থাকে। তারপর হাসি পায় তার ঠোঁটদুটোর :
— বলো দিদ্মা, সারা জীবন মাছ খাতি পারবে পদ্মপিসি!
.
(চলছে)
তোমায় নিয়ে বাঁচি
গ্রীষ্মের খরতাপে অস্থির এই নগরে,
চাতকের ন্যায় অসহায় মানুষে,
প্রশান্তির উপলব্ধি আনে-
একটুখানি শীতল বাতাস।
থমথমে দুপুরে ক্লান্ত পথিকের পথ,
দীর্ঘায়িত হয়ে পড়লেও,
নিরাশার অনুযোগের মোচন ঘটে-
ছায়া দানকারী গাছটার অকৃপণতায়।
পৃথিবীর সুখগুলোর শত ভাগে,
ভালোত্বের সংস্পর্শ হৃদয়ে প্রশান্তি আনে,
খরতাপ গ্রীষ্মের প্রাণহীনতায়-
চাতকের উপলব্ধি কষ্টের উপলক্ষ্য আনে।
জাগতিক শত গল্পে,
শত অভিযোগ-অনুরোধে,
খরতাপে জ্বলন্ত দেহটায়-
শীতল বাতাস সুখানুভূতি জাগায়।
তবে,
এইসব জাগতিকজ্ঞান বিতরণে পারঙ্গম নই,
গ্রীষ্মের খরতাপ-শীতল বায়ুতে-
আমি আবদ্ধ নই।
আমি প্রেমহীন নগরে,
প্রাণের সঞ্চারে বেরিয়ে পড়েছি,
জাগতিক মোহে আবিষ্ট নই-
শুধু তোমাতে বেঁচে আছি।
পৃথিবীর গল্প গুলো হারিয়ে যাবে,
চাতকের হাহাকারও থামবে,
মোহে জড়াবে না কেউ-
যখনি আবদ্ধ হবে প্রেয়সীতে।
আমি দ্বিধাহীনভাবে বাঁচি,
তোমার পানে চেয়ে,
কবিতা হই কিংবা কবি-
তোমাতেই যেন বেঁচে থাকি।
আবারো শীতল প্রবাহে প্রশান্তি আসবে,
মানুষে সৌহার্দ্য রচিবে,
চাতকের উপলব্ধিতে শান্তি-
আমিও বাঁচবো তোমায় নিয়ে।
বেঁচে থাকা
ভালো থেকো, বেঁচে থেকো / অমৃত ইচ্ছা তোমার বলয় / মাথায় রেখেও সর্বদা বাঁচা যায় না / আসলে বেঁচে আছি কী না / বুঝতেই কেটে যায় এক পূর্ণ জন্ম / পূণ্য যজ্ঞ থেকে জন্ম নিয়েও / যাজ্ঞসেনী বনবাসে যায় / কীচক ও দুর্যোধনের শ্লীলতাহানির হরিণ হয় / বেঁচে থাক বললেও / সর্বদা বেঁচে থাকা যায় না।
হারপিক
০১
বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই ভাগলপুর গ্রাম। অবশ্য এখন আর গ্রাম নয়। আধা শহর। কিছুটা গ্রাম আর কিছুটা শহর। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের আশেপাশের এলাকায় ঢুকলে যে কেউ আর ভাগলপুরকে এখন গ্রাম বলবে না। একটা কমপ্লিট আধুনিক শহরের মেজাজ নিয়ে সে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরম্য পরিকল্পিত বিল্ডিং এর সাথে আছে সুদৃশ্য কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া, লন, পাওয়ার হাউজ, নয়নাভিরাম বাগানের পর বাগান। শহরের কী নেই এখানে! মেডিকেলের সামনের রাস্তাটির দুই পাশেই দোকানের সারি। অসংখ্য ফার্মেসি। খাবার হোটেল। বেশ চওড়া দাম। আর হবেই বা না কেনো – এসব হোটেলে যারা খেতে আসেন তাদের প্রায় সবাই রোগীদের আত্নীয় স্বজন। আজ আছে কাল নেই। বিপদে পড়ে হোটেলে খেতে আসেন। সবাই জানে এসব খাবারে জমিতে সার দেওয়ার মতো করে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে। তবুও কোনো উপায়ান্তর নেই। আর সেই সুযোগে হোটেল মালিকেরা কাঁচা ঘাস কাটার মতো বেশ নগদ কামাই করে নেন। শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা বুঝি এখানেই! শহরে বিভিন্ন প্রজাতির ধান্ধা করা যায়। গ্রামে এতোটা যায় না।
মেডিকেল কলেজের অদূরেই আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাসা। অবশ্য কেউ কেউ বাড়িও বলে থাকেন। আমাদের দেশের একসময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিলো শহরে হলে বাসা। আর গ্রামে হলেই বাড়ি। এখন অবশ্য এই সংজ্ঞাটা কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন টিনের ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর এসব কে লোকে বাড়ি বলে। আর যে বাড়ি গুলো শহরের বাড়ির মতো পাকা, আধাপাকা সে সব কে বাসা বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখন গ্রামেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাড়িটি বনেদি গোছের। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে চারপাশে চারটি ঘর। পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘর দুটি আধা পাকা। উত্তরে-দক্ষিণে কাঁচা। অবশ্য এই দুটি ঘর প্রায় সব সময় খালি পড়ে থাকে। কেবল ঈদের সময় ছেলেরা, মেয়েরা সবাই বাড়িতে আসলে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির চারপাশে পাকা দেয়াল। সুউচ্চ। পূর্বদিকের ঘরের সামনেই বিশাল আঙ্গিনা। পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের জন্য খুব পয়মন্ত। খেলার মাঠ হিসাবে সারাদিনই জমজমাট থাকে। এরপরেই একটি বিশাল দীঘি। লোকে বলে কুমির দীঘি। জনশ্রুতি আছে, এই দীঘিতে একবার একটি ছেলেকে কুমিরে ধরে। কুমিরটি ছেলেটিকে না খেয়ে মুখের উপর নিয়ে সারা দীঘিতে চক্কর দিচ্ছিলো। ছেলেটির চিৎকারে হাজার হাজার লোক দীঘির পাড়ে জমায়েত হয়। কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য দীঘির জলে ঝাপ দিতে সাহস পায়নি। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধা আসলেন। তিনি জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, দীঘির পানিতে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিলে ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব। বুড়ির এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো। কেউ করলো না।
শিকদার সাহেবের জান্নাতবাসী বাবা বললেন, আর কোনো রাস্তা নেই বুড়ি মা? বুড়ি খট খট করে জানালেন, আছে বাপু। আর একটি রাস্তা আছে। এই ছেলের বদলে অন্য একজন লোককে পুকুরে বিসর্জন দিতে হবে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তা কি করে সম্ভব? অবশেষে অনেক জোগাড় যন্ত্র করে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিয়ে ছেলেটিকে বাঁচানো হয়।যাওয়ার সময় বুড়িমা বলে গিয়েছিলেন, একটা শানবাঁধানো ঘাট বানিয়ে দাও বড়ে মিয়া। এই ঘাটই আমার সীমানা। গোসল করার সময় কেউ যেনো ভুলেও এই সীমানা লঙ্ঘন না করে। সেই থেকে দীঘির ঘাট শানবাঁধানো। অবশ্য বাড়ির পেছনেও একটি পুকুর আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই দুইটিতে গোসল করে। মেয়েরা পশ্চিমের পুকুরে আর পুরুষেরা পূর্ব পাশের দীঘিতে। এটা আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাবার করা নিয়ম। তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এখনও গ্রামের বয়স্করা উনার বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি বলেন।
সেই বাবার একমাত্র সন্তান আঃ রশিদ শিকদার। তিনিও নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। একজন সাদা মনের সফল মানুষ। পাঁচ সন্তানের জনক। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। সবাই বড় হয়ে গেছেন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করেন। হাই সেলারী পান। এতো কিছু সফলতার মাঝেও একটা বিষয় শিকদার সাহেবের মনের মধ্যে মাঝে খচ খচ করে। গ্রামের কিছু উঠতি পরিবারের লোকজন তাদেরকে প্রতিহিংসার চোখে দেখেন। সুযোগ পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। শিকদার সাহেব এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন। তিনি তাদের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করেন না। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তবুও তিনি প্রতিহিংসার এই অনল পুরোপুরি নিভাতে পারছেন না।
০২
এই শিকদার বাড়িতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ একের পর এক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির সব মানুষের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। আতংকের পর আতংক। কেউ জানে না কখন কী ঘটে যায়! এই জন্য সবার মুখের মানচিত্রে এক গভীর চিন্তার রেখাপাত। বাড়ির গৃহকর্ত্রী আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আজ বড় ছেলে নাফিস শিকদার বউ, ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে আসার কথা। সকলেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা বেগম তরকারিতে লবণ দিবেন এমন সময় ছোট মেয়ে তাজমুন নাহার দীনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মা, মা—- ওমা । কি হয়েছে রে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন আয়েশা বেগম বললেন। আজকাল তরকারি রান্না করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে উনি খুব ক্ষেপে যান। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তেল দিলেন না পানি দিলেন! হলুদ দিলেন না মরিচ দিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না। দীনা বললো।কী বলছিস? কোথায় রেখেছিলি? কেনো? খাটের উপর।তুই আসার আগের দিন মানে পরশু আমার মোবাইলটাও খাটের উপর থেকে হারিয়ে যায়। কতো খুঁজাখুঁজি করলাম। পেলাম না। আজ আবার তোরটা গেলো। দেখ্ তো মা বাথরুমে হারপিকটা ঠিক আছে কিনা? মায়ের আদেশ পালন করার জন্য দীনা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই দীনা মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে। ছিমছাম গড়ন ।এতো বড় হয়েছে। বি সি এস পাশ করে এখন একটি স্বনাম ধন্য সরকারি কলেজের প্রভাষক। তবুও এতোটুকু অহংকার নেই। শিশুর মতো সহজ-সরল। শিকদার সাহেবের পরিবারে দীনাই একমাত্র অবিবাহিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। ভালো ভালো ঘর। সুপাত্র। তবুও শিকদার সাহেব রাজি হন না। সবাইকে বলেন, মেয়ে মাত্র চাকুরী পেয়েছে। আর কিছুদিন যেতে দিন।
একটু পরে দীনা আবার রান্নাঘরে ছুটে এসে প্রায় চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, মা হারপিকের কৌটা আছে; কিন্তু ভেতরে এক ফোঁটা হারপিকও নেই। কি বলিস মা! গতকালই তো আনা হয়েছে। এর আগেও আরও তিনটি হারপিকের একই পরিণতি হয়েছে। আয়েশা বেগম বললেন। দীনা কী বলবে কিছুই ভেবে পেলো না। শেষে বললো, মা ইলা কোথায় গেছে? ইলাকে দেখছি না কেনো? আয়েশা বেগম বললেন, কোথায় আর যাবে? হয়ত দীঘির পাড়ে খেলছে! দীনা আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির দিকে হাঁটা দিলো।
এই ইলা দীনার ভাগ্নি। আপন বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। পুরো বাড়িতে ছোট মানুষ বলতে ওই একজনই। ইলা তার মা-বাবার সাথে নানু বাড়িতেই থাকে। তার মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে। মা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুজনই সারাদিন অফিসে থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ফিরেন। নানা-নানীর সাথে তার সারাদিন কাটে। কখনও একলা। জন্মের পর থেকে এভাবেই চলছে ইলার জীবন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী। ওর ক্লাসে বরাবরই প্রথম হয়। দুষ্টুমিতেও একদম পিছিয়ে নেই। সকলের সেরা। অবশ্য গুণীজনেরা হামেশাই বলে থাকেন, মেধাবিরা একটু- আধটু দুষ্টু হবেই। মেধা ছাড়া দুষ্টুমিরা করা যায় না।
দীনা দীঘির পাড়ে এসেই ইলাকে পেয়ে গেলো। ডাকসই চলছে। দীনাও মুহূর্তেই শৈশব ফিরে পেয়েছে। তারও খেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন ডাকসই খেলা হয়নি। অনেকদিন—।। ইলাকে বললো, আমাকে খেলতে নিবি? ইলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বললো, তুমি খেলবে মানে? তুমি কি আমাদের মতো শিশু নাকি? দীনাও মজা করে বললো, হুম শিশু ইতো। দেখিস, আমি কোনোদিন বুড়ি হবো না। ইলা আর কিছু বললো না। দীনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুজনের মনেই আনন্দ আর ধরে না। একটু পরে ইলার ছোট মামা আসবে।। শহর থেকে। আরশি আসবে। ঐশী আসবে। ইউশা আসবে। কতো গল্প হবে বস্তা বস্তা। খেলা হবে। কবিতা আবৃত্তির আসর হবে। চাঁদনী রাতে কানামাছি হবে। লুকোচুরি খেলা হবে। মজার উপর মজা। আনন্দের উপর আনন্দ। এতো আনন্দ— ইলা রাখবে কোথায়?
০৩
গত কয়েকদিন ধরে ইলা বমি করছে। কিছুক্ষণ পর পর। কেবল বিকেল হলে একটু ভালো থাকে। কিছুদিন ধরে ইলার খাবারের প্রতি খুব অরূচি। কোনো কিছুই খেতে চায় না। এর সাথে যোগ দিয়েছে বমির ভয়। ওর এখন বদ্ধমূল ধারনা জন্মে গেছে কোনোকিছু খেলেই বুঝি বমি হয়ে যাবে। ইলার বাবা জায়েদ করিম নিজেই একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ঔষধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। সাথেই ভাগলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলা ভালো হচ্ছে না। ইলার বাবা এখন ঠিক করেছেন ইলাকে একটা ফুল চেকআপ করাতে হবে। মেয়েটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইলার ছোট মামা এবং মামীর মোবাইল দুটিও পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আরেকটি হারপিক কেনা হয়েছিলো। সেটির পূর্বের দশা হয়েছে। হারপিকের কৌটা আছে; ভেতরে কোনো লিকুইড নেই। এসবের সাথে যোগ দিয়েছে একটি অভিপ্রেত খস খস শব্দ। শব্দটি একেকবার একেক জায়গা থেকে আসে। মাঝে মাঝে আসে না। শব্দ লক্ষ করে গেলেও সেখানে শব্দের উৎসের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। ইলার ছোট মামি শহুরে মেয়ে। তিনি ঠিক করেছেন এই বাড়িতে আর থাকবেন। মোটামুটি সবারই একটা ধারনা পাকা হয়েছে যে, এই বাড়িতে কোনো দুষ্টু ভূতের আছর পড়েছে। সে-ই এই সব কর্মকাণ্ড গোপনে করে বেড়াচ্ছে। আঃ রশিদ শিকাদার সাহেব প্রবীণ হলেও চিন্তা-চেতনায় একজন কমপ্লিট আধুনিক মানুষ। তিনি কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। গ্রামে দু’একজন যারা চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে তাদেরকে উনি অনেক প্রেসার দিয়েছেন কেউ মানুষ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেননি।
আর ইলার নানীও বসে নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এইসব কর্মকাণ্ড ভুত-প্রেত ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে ভিন গাঁ থেকে একজন ডাকসাইটে ভূত তাড়ানোর ওঝা কাম কবিরাজ নিয়ে আসলেন। বাড়ি জুড়ে হুলস্থূল কাণ্ড। ওঝা তাঁর সাগরেদদের দিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশে তাঁর হাতের আশা দিয়ে রেখা টেনে দিলেন। সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যান, তাহলে তাঁর রক্ত বমি হবে। সাথে মারা পড়বে। অতঃপর ভেতর বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালানো হলো। বেশ বড় আগুনের কুণ্ড। কয়লা আর কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। ওঝা ঘোষণা করে দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে থাকা সমস্ত ভূত-প্রেত কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই দৃশ্য সবাই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের এসব ভণ্ডামি ভালো লাগছে না। তিনি বারবার গিন্নীকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু গিন্নী তাঁর কথা শোনেনি। দীনাও বাবার সাথে সহমত। কিন্তু মা –কে কিছু বলতে সাহস পায়নি।
ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আগুনের মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধূপের গন্ধে সমস্ত বাড়ি মৌ মৌ করছে। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, আতংক। ইলা দীনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি, ঐশী এবং ইউশাও। তিথি, নাবিলা, সিয়াম, সিফাত ওদেরও আজকে বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা। বিভিন্ন ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে। ওঝাকে এখন অতিমাত্রায় উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বশে আকাশের দিকে লাফ দিচ্ছেন। খামচি দিয়ে একটা একটা করে ভূত ধরে আনছেন। আর চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। আগুনে পোড়ার পর ভূতের আত্মা সাঁই সাঁই করে পালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই পালিয়ে যাওয়ার শব্দ সবাই স্বকর্ণে শুনতে পেলেন। এভাবে সমস্ত ভূত মারা যাওয়ার পর ওঝা বাড়ির প্রত্যেক ঘরে, ঘরের সামনে পেছনে, আনাচে কানাচে ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন। সবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, আপনাদের বাড়ি আজ থেকে সর্ব প্রকার জিন, ভূত-প্রেত মুক্ত হলো। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া আমি বাড়ি এমন ভাবে বন্ধন করে দিয়েছি যে, ভূত কেনো, ভূতের বাপ-দাদার সাধ্য নেই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে।। অবশেষে তিনি ইলাকে বিশেষ ভাবে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, আর কোনোদিন এই মেয়ের বমি হবে না।
ইলার নানী মনে মনে খুব স্বস্তি পেলেন। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। দীনা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। বিশ্বাসও করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মনকে এই বলে প্রবোধ দিলো যে, আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়! সবকিছু ভালো হলেই তো ভালো!!
০৪
কিন্তু ওঝা চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পড়েই যখন ইলা বমি করতে লাগলো, তখন দীনার সমস্ত বিশ্বাস কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। এদিকে দীনার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আগামীকালই সে ময়মনসিংহ ফিরবে। ইলাও দীনার সাথে ময়মনসিংহ আসার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। শুধু অপেক্ষা করছে কখন, কিভাবে কায়দা করে আন্টিকে প্রস্তাবটি দেওয়া যায়। ইলার দৃঢ় বিশ্বাস আন্টি নিশ্চয় না বলতে পারবেন না। ইলার ছোট মামারাও আগামীকাল ঢাকা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে ইলার ছোট মামা তাঁর নানীর জন্য একটি সুন্দর মোবাইল হ্যান্ড সেট, কিছু খাবার-দাবার, সাবান-হারপিক সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিস কিনে এনেছেন।
পরদিন সকাল বেলা দীনা বাথরুমে গিয়ে দেখতে পায়, হারপিকের বোতল শেষ। অথচ গতকালই কিনে আনা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি পরিবারের প্রায় সবার কাছে পৌঁছে যায়। এক ধরনের আতংক এমনিতেই সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাঁর উপর এসব ঘটনায় সবাই এখন রীতিমত বিব্রত। চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিছুতেই কিছু হলো না। দীনা বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম হতে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ আসবে। ইতোমধ্যে টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছে। ইলাও দীনার সাথে আসছে। ইলার আম্মু আসতে দিতে চায়নি। আব্বুও। তবুও ইলার জিদের কাছে তারা পেরে উঠেনি। সে আসবেই। তাছাড়া ডাক্তারও বলেছেন ওর বায়ু পরিবর্তন খুব জরুরি। আরও একটি কারণ আছে, অফিস ফেরত দীনা বাসায় একা একা থাকে, সময় কাটতে চায় না। ইলা থাকলে বেশ হয়।
ট্রেনে উঠার আগমুহূর্তে ইলা একবার স্টেশনে বমি করে দিলো। দীনার জন্য এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও তাঁর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশার কথা বমি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা ট্রেন ছাড়ার পূর্বেই উঠতে পেরেছে। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দীনার সুপরিচিত। সিনিয়র কলিগ। নাম জনাব কছিম উদ্দিন। দীনার কলেজেরই সহকারি অধ্যাপক। জনপ্রিয় কবি এবং কথা সাহিত্যিক। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বের ভাইভা নিয়ে ফিরছেন। সদালাপী মানুষ। সহজ, সরল প্রকৃতির। দীনাকে দেখে খুব খুশি হলেন। দীনাও খুব খুশি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে লাগলো। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। চমৎকার প্রাকৃতিক আবাহন। সবে বসন্ত উকি দিয়েছে। রেললাইনের দুই পাশে প্রায়ই শিমুলের ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও কুঁড়ি। বমি করতে করতে ক্লান্ত ইলা একটু পরেই আন্টির শরীরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কছিম উদ্দিন স্যার দীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথের মেয়েটি কে?স্যার ও আমার ভাগ্নি। একমাত্র বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটি বুঝি ট্রেনে উঠার আগে বমি করছিলো? জী স্যার। কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কী রকম? দীনা সবিস্তারে প্রত্যেকটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। ইলার বমি করা, মোবাইল হারিয়ে যাওয়া, খসখস, শব্দ করা, ওঝার ভোজবাজি কোনোকিছু বাদ দেয়নি। ট্রেন ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে। কছিম উদ্দিন স্যার প্রত্যেকটি ঘটনা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করলেন।
ইলা এখনও ঘুমুচ্ছে। দীনা একটু পর পর ইলার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কছিম উদ্দিন স্যার কী যেনো ভাবছেন। উনি কবি-সাহিত্যিক মানুষ। ভাবাভাবিই উনার কাজ। তাই দীনা উনাকে বেশি ঘাঁটালেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অবশেষে দীনাই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ভাবছেন? কছিম উদ্দিন স্যার সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ও তোমার ঘটনাটাই ভাবছিলাম দীনা। কিছু পেয়েছেন স্যার? দীনা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো। হুম, ঘটনাটির এক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি। তুমি হয়ত মানতে চাইবে না। কারণ তুমি ইলাকে খুব ভালোবাসো। আমি মানবো না কেনো স্যার? আপনি বলুন। যুক্তিসংগত হলে আমি অবশ্যই মানবো। কছিম উদ্দিন স্যার বলা শুরু করলেন, তোমাদের বাড়ির এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী হলো এই মেয়েটি। প্রত্যেকটি হারপিক ইলাই খেয়েছে। দীনার মোটেই সহ্য হলো না। সে শুরুতেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। কী বলেন স্যার। আপনার কথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসম্ভবের উপর অসম্ভব। এ হতেই পারে না। দীনার সুতীব্র প্রতিবাদ দেখে কছিম উদ্দিন স্যার হাসতে লাগলেন। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে শেষে বললেন, আমার কথা যে ১০০% ঠিক আমি সেটা দাবী করছি না। আমি যা বলছি, সেটা আমার একটা হাইপোথিসিস। সাধারণতঃ ভুল হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে তুমি যেহেতু শোনতে প্রস্তুত নও, তাহলে আর আমি বলছি নে। দীনা সাথে সাথে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বললো, না স্যার। আপনি বলুন। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো।
০৫
কছিম উদ্দিন সাহেব বললেন, প্রথমতঃ ইলা কোনো একদিন কৌতূহল বশত সামান্য পরিমাণ হারপিক ছেঁকে দেখেছে। মুখে নিয়েই ও বুঝতে পারে হারপিকের স্বাদটি তেতো নয়। কিছুটা টক টক। তবে সব মিলিয়ে স্বাদ মন্দ নয়। সেই থেকে শুরু। ও একটু একটু করে হারপিক খেতে শুরু করে দেয়। পরিমাণ সামান্য হওয়ায় এটা ওর শরীরে আস্তে আস্তে মানিয়ে যায়। একটা সময় এটা ওর নেশায় পরিণত হয়। ও হারপিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখনই পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই ওর লিভার সেটা কাভার করতে পারছে না। ফলে বমি দেখা দেয়। লিভারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অযোগ্য কোনোকিছু রাখবে না। বমির মাধ্যমে সেটা বের করে দেবে। অবশ্য এখানে মূল অনুঘটক হলো মস্তিষ্ক। সে-ই প্রথম সংকেত দেয়। এজন্য বমি মানুষের জন্য অনেক সময় বিরাট উপকারী হয়ে থাকে। বমি না হলে পাকস্থলী ফুলে যাবে। প্রসাব, পায়খানার নানা জটিলতা দেখা দিবে। এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।
আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি স্যার? দীনা বললো।
হুম। কেনো নয়। অবশ্যই করতে পারো।
হারপিক খেলে তো স্যার ওর মারা যাওয়ার কথা?
একদম খারাপ বলোনি তুমি। কিন্তু হয়েছে কি তুমি যদি পরিমাণের কম বিষও খাও; তোমার শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তুমি মারা যাবে না। তারপর আস্তে আস্তে বিষের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে দাও। একটা সময় দেখবে তোমার শরীর এই মারাত্বক বিষকেই কনজিউম করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা, তুমি হয়ত শোনে থাকবে একটি লোককে কিং কোবরা কামড় দেয়। সবাই অস্থির। চিৎকার, চেঁচামেচি, ডাক্তার এসব চলছিলো। কিন্তু যাকে কামড় দিয়েছে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসছিলো। পরে দেখা গেলো লোকটির কিছুই হয়নি। আসলে কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়। যাহা সহাবে সে তাহাই সয়।
দীনা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। স্যার বলতেই থাকলেন, দ্বিতীয়তঃ মোবাইল চুরির বিষয়টি। দীনা তোমাকে বলতে ভয়ই পাচ্ছি। কারণ তুমি খুব রিয়েক্ট করো।
না স্যার। আমি আর রিয়েক্ট করবো না। আপনি বলুন।
স্যার আবার বলা শুরু করলেন। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিই বলেছো ইলার মা-বাবা দুজনেই চাকুরী করেন। উনারা ইলাকে সময় দিতে পারেন না। তোমার মা-বাবাই উনার একমাত্র সঙ্গী। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে স্কুলের সময়টা ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় আসলেই ও একদম বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তোমার মা-বাবা ওকে পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। উনারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাদের দিয়ে ইলার বা-বাবার অভাব পূরণ হচ্ছে না। ইলা অনেক সময় তোমার আম্মুর মোবাইল অথবা তোমার আব্বুর মোবাইল দিয়ে ওর মা বাবাকে কল দিতে চেয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দিতে পারেনি। হয়ত মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কিছু মনে করো না দীনা হয়ত ওর নানা-নানী ওকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি। অথবা ওর বাবা-মা কল রিসিভ করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কারণে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটির প্রতি ইলার মন বিষিয়ে উঠেছে। আসলে বিষণ্ণতার চেয়ে বড় ঘাতক আর নেই। যে বয়সে তার মা-বাবার আদর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন; সেটা সে পাচ্ছে না। তাই ও এখন দিন দিন ক্ষেপে যাচ্ছে এবং একরকম মানসিক সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু খেয়াল করলেই দেখতে ইলা অনেকদিনই তার মাকে চাকুরী ছাড়তে বলেছে। এই কথা শোনে দীনা বললো, স্যার আপনি জানলেন কিভাবে? আমার সামনেই ও অনেকদিন এই কথা বলেছে। স্যার আর একটি প্রশ্ন করি। হুম একটি নয়। তোমার যতো জিজ্ঞাস্য আছে সব বলো।
স্যার মোবাইল গুলো ও কী করেছে? খুব কঠিন প্রশ্ন দীনা। উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আমার ধারণা, মোবাইল গুলো সে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জিদ একটাই, সে যেহেতু এই মোবাইল দিয়ে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কাউকেও কথা বলতে দিবে না। হতে পারে স্যার। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, তুমি ওকে হাতে নাতে ধরতে চাও দীনা?
জী স্যার। কিন্তু কিভাবে?
এখন তুমি বাসায় ফেরার সময় ওর সামনেই একটি হারপিক কিনবে। সেটা নিয়ে তোমার টয়লেটে রাখবে। তারপর দেখো কী হয়! এই বলে স্যার হা হা হা হেসে উঠলেন। সেই সুউচ্চ হাসির শব্দে ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে।
০৬
দিন দুই পরে একদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কলেজ রোড পানিতে সয়লাব। কলেজ রোডের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে এটিও অন্যতম। অবশ্য আশার কথা হলো এই সময়টাতে রিকশার কোনো অভাব হয় না। অসময়ে দুধের মাছের মতো। যেমন খুশি দাম হাঁকানো যায়। ইচ্ছা হলে যাও, না হলে না যাও। দীনা রিকশার ভাড়া ঠিক করছিলো। এমন সময় কছিম উদ্দিন স্যার। তিনি অফিসে যাবেন। কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সকাল নয় টায় ক্লাস। দীনা সালাম দিলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর দীনা?
স্যার বিশ্বাস করবেন না, আপনার কথাই মনে ভাবছিলাম। সেদিন আপনার কথা মতো আমি একটি হারপিক কিনে তবেই বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর স্যার আপনার কথাই ঠিক স্যার। আমি হাতেনাতে ধরেছি। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে তেমন কিছু বলিনি স্যার।
তুমি ঠিক করেছো। ওকে এখন তুমি সঙ্গ দাও। সব সময় অব্জারভেশনে রাখবে। ওর পছন্দ মতো চকলেট, চুয়িংগাম, চকলেটবার মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেবে। মনে রাখবে ও এখন এক প্রকার নেশায় আসক্ত। তুমি ওকে এখানে এনে খুব ভালো করেছো। আমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিও।
অবশ্যই আলাপ করিয়ে দেবো। স্যার আরও একটি কথা, সবগুলো মোবাইল কুমির দীঘিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, কোন্টা?
এই যে স্যার একটা খসখস শব্দ প্রায়ই হতো!!
ওটা কিছু নয়। ইঁদুর, বিড়াল, চিকা ওরা এমন শব্দ করে থাকে। বিশেষ করে ওই সময়টাতে তোমার কেউ স্বাভাবিক চিন্তা করোনি। তাই যে কোনো স্বাভাবিক শব্দ তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই কছিম উদ্দিন স্যার স্বভাব সুলভ হা হা হা করে হেসে উঠলেন। দীনাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।।
আসলে গল্পটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ! ইলার হারপিক খাওয়ার এই ঘটনা এক কান, দুই কান করতে করতে সারা গ্রামে সাড়া তুললো। কিছু মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলো এই মেয়েটির মধ্যে একটি সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বলেই সে হারপিকের মতো বিষ খেয়ে হজম করতে পেরেছে। বেশ আর যায় কোথায়? সরল বিশ্বাসে অনেকেই ইলার কাছে পানি পড়া সহ বিভিন্ন কাজে আসতে লাগলো। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কথা!!
——————-
স্মৃতিদগ্ধ সুখিমানুষ
আমি আজ সেই ঝড়ের কথা বলছি –
যে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল স্বপ্ন বাসর
পরস্পর স্থান বদল করেছিলো আকাশ পাতাল ;
আদ্রতাহীন স্বপ্নের ঘর্ষণে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঘটেছিল—
তাতে সব স্মৃতি পুড়ে সেদিনই হয়েছিল ছাই।
আজ আমি সুখি মানুষের উপমা দিতে দূরে যেতে হয়না
আমি পুড়ে যাওয়া স্মৃতিহীন এক সুখি মানুষ।
পুরনো স্মৃতি আজ ভেসে বেড়ায় না মানস পটে
ছায়াপাত ভেসে নিয়ে গেছে ছাই ভস্মগুলো
কোন এক নর্দমার উর্বরতা বাড়াচ্ছে হয়তো !
যে স্মৃতি মানুষের কান্নার অনুষঙ্গ
সে স্মৃতিতো আমার পুড়েছে অনেক আগে।
হাত বাড়ালেই এখন দেখি অসীম আকাশ ; অবারিত সবুজ মাঠ
ধূসর মরুভূমি খুঁজে পাইনা ত্রিসীমানায়।
বিরহ গীতি লিখতে বসে পাইনা খুঁজে
লুকোচুরি খেলা কোন এক কিশোরীর
শুধু দেখি স্বর্ণলতার ডালে খেলছে রঙিন প্রজাপতি।
সাকিনা’র রূপে মশগুল
সাকিনা তোমার রূপে হয়েছি মশগুল
তোমাকে অনুভব করা মস্ত বড় ভুল,
সাকিনা মন চায় তোমায় শতকোটি চুমি
তুমি যেন ভালবাসার পবিত্র ভূমি।
সাকিনা জানি তোমাকে ভাবা বড় অপরাধ
মন চায় নেই তোমার স্বাদ।
সাকিনা আমি তোমার নেই মনে
যে হারিয়ে যাবো, তোমার ভালবাসার বনে।
সাকিনা তোমাকে পেলে হতাম খুব সুখী
কিন্তু হচ্ছে না কখনো
তোমাকে ভেবে ভেবে হবো দুঃখী….
28/05/2023
ফ্রিকোয়েন্সি শূন্য হলে
সূর্য অস্ত যাচ্ছে
শহর জুড়ে ভাসমান অন্ধকার
আর আমরা প্লাস্টিক ফুলগুলো সাজিয়ে রাখি
খুঁটে নিতে যৌথ আলোর নির্যাস
গভীর রাতে ক্ষীণ-আলোয় জমে ওঠে কথোপকথন
একদম শাল থেকে আম বৃক্ষ পর্যন্ত
বিষদৃষ্টি যতোসব মানুষের চোখ
এভাবে ফ্রিকোয়েন্সি শূন্য হতে থাকলে
আমরা আঁধারের বুকে ঘুমিয়ে পড়ি।
ভালো মানুষই যে বেশি
এই যে হাসি আনন্দের ক্ষণ, নির্দ্বিধায় হেঁটে বেড়ানোর পথ
মানুষের কোলাহলে নিজেকে বন্দি না ভাবা,
এই যে সহস্র মানুষের ভিড়ে এলে বিপদের হাতছানি,
কেউ কী ফেলে যায় সেথায় একাকি!
এখানে এই শহর, নগর অথবা গাঁয়ে
ছড়ানো ছিটানো ভালো মানুষের মন
এখানে মানুষের মাঝে মানুষের আন্তরিকতার ফুল ফুটে,
মানুষের ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে
মানুষের জন্য ভালোবাসা।
এখানে পথে প্রান্তরে, অলিগলিতে
কই দেখি না তো মন্দ মানুষের আস্ফালন
কেউ দুর্ঘটনার হলে স্বীকার, কেউ পড়লে অযাচিত বিপদে
মানুষই তো চলে আসে উদার মন নিয়ে,
শ্রম মেধা আর ঘামের মূল্যে বিকায় মানবিকতা।
এই যে একাকি পথে যাওয়ার বেলা, ভয়হীন চোখ
যে যার মত হেঁটে যাই ফেলে কদম
কই কখনো কেউ বদ মতলবে দাঁড়ায়নি সম্মুখে,
কেউ বলে উঠে নি সহসা মন্দ কথা।
এখানে এই পথের বাঁকে ভালো মানুষেরই বসবাস
ক’জনা মন্দ পারে নি টলাতে ভালোদের মানবিকতার আসন,
মানুষ মানুষের জন্য,
তাই বুঝি পৃথিবীটা এত মনোরম।
বলো না আর মন্দ মানুষে ভরে গেছে শহর,
তোমার মাঝেও কিছু মন্দ ওঁৎ পেতে রয়
সুযোগে তুমিও মন্দদের দলে যেতে পারো অনায়াসে
অচিরেই মনটারে বাঁধো মানবিকতা আর আন্তরিকতার সুতায়।
প্রকৃতি সুন্দর
আর কিছু নেই! সন্ধ্যার আলো খেয়ে
ফলের বাজার শুয়ে আছে
নিজেদের শোকসভা নিয়ে ব্যস্ত পেয়ারাগুলো;
বাবা, এককেজি পেয়ারা কিনতে গিয়ে
একটা চারা কিনে বাড়ি ফেরে
গাছ বড় হবে, তারপর ফল!মা কেবল হাসে-
কাঠবিড়ালি এখন শান্তিচুক্তি করতে পারো
আমি মধ্যিখানে মা-বাবার সংসার দেখি।
মেঘও রেখে যায় পাশে ভূমিষ্ট ছায়াডোর
কয়েকটি বিলাপ গেঁথে গেঁথে মেঘও রেখে যায় তার ভূমিষ্ট ছায়াডোর
পৃথক কোনো স্বার্থ নেই নিমগ্ন মাটিরও,
মেঘ ও মাটি পরস্পরের দেখা পেলে নিমিষেই মিতা হয়ে যায়
সবগুলো মিথ অস্বীকার করে তারা পরে নেয় একই পোশাক।
ভোরের পরিষেবা গ্রহণ করে সেরে উঠে সমগ্র ক্রান্তিকাল থেকে।
নদীরা নিরক্ষর নয়। তাই তারাও পড়তে পারে মেঘমাটির লিখিত
অঙ্গীকার।নিশ্চিত নিদ্রা চোখে নিয়ে যে চাঁদ শুয়েছিল অন্তরের
অগ্নিকোণে, তারও জাগার পালা শুরু হয়।
পালা করে আমরা পাহারা দিয়েছি যে ফালগুনের আভাস,
চেয়ে দেখি তার ঠিক দশগজ দূরে-
রূপসী বাংলা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ।
দুটি কবিতা
প্রবাহিনী
দুঃখ বুঝিনা যা জমাট।
রাত্রিকোলে শিখণ্ডি নাচ প্রথম পেখম মেলে
মেঘলা দিনের রোদ-আঁচলে
তুমিই প্রথম নারী
অথবা হাজার জনের ভেতর একলা ছবি।
নদীও এমন আছে গভীরতা জানা যায়নি
যে নারী বয়ে যায় আমি তার সর্বশেষ প্রেমিক।
_____________________________
অসুখ
আমি মৌয়ালি- আমি চাক ভাংবো,
তোমার ভূগোল থেকে পৌঁছে যাব আমি,
পৌঁছে যাব অন্য কোথাও
জেগে ওঠো প্রেম
আসো গন্ধম বৃক্ষের নিচে সংসার পাতি।