নীলমাছি

gty

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাথার উপরে বসলো,
— আবার জ্বর বাঁধিয়েছ?
— জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?

আমার বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না মাছি,
— হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করছ?

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মাছি কথা শুরু করল,
— ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
— কি!
— পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।

বিরক্তির মাত্রা অসহ্যের সীমা অতিক্রম করল,
— আমি কি ল্যাংড়া আম! তোমার তাই মনে হয়! যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর..

মাছির স্বর কিছুটা বিব্রত,
— ধ্যাত, তুমি ল্যাংড়া আম হবে কেন! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা একটুও মনে নেই তোমার!
— কোন দুপুরের কথা?
— সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে ক’জনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজি, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। যাদের পাতে দু’বেলা সাদামাটা ভাত জোটে কি জোটে না, এমন ক’জন খাবেন। কি মনে আছে?

বিরক্তি কিছুটা কমে, স্মৃতির ঘায়ে কণ্ঠ কিছুটা কোমল হয়ে আসে,
— হ্যা, মনে আছে। সেসব বহু যুগ আগের স্মৃতি। তুমি এসব জানো?
— জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।

বিস্মিত হই,
— নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
— হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, কিন্তু এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোণে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোট্ট মানুষ।
— হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।

নীলমাছি মাথা দোলায়,
— তোমার স্মৃতি দেখছি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে— ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা একটুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পড়লো।

মনের ভেতর উৎলে উঠে বিষাদ,
— বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো…

স্মৃতিকাতর মাছি বলে চলে,
— সেদিন গরম আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পড়া দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। তুমি অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।

মাছির ভুল ভাঙাই,
— তোমার খাবার দেখছিলাম না। তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
— খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ শিশু এক— আমায় কি আর ধরতে পারবে!
— হিসেবে খুব বড় ভুল করেছিলে..

মাছির অকপট স্বীকারোক্তি,
— হ্যা, আত্মঘাতী ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভেতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশঙ্কা ও আতঙ্ক! পায়ে সুতো বেঁধে আমৃত্যু উড়াবে— ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
— আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
— হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!

মাথা ব্যথা আর গায়ের তাপ দুইই বাড়ছে, ক্লান্ত স্বরে জানতে চাই,
— আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো!

মাছি শোনায় অদ্ভুত কথা,
— রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই— ফের একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।

জ্বরের ঘোরে রসিকতা করি,
— নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে!
— তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
— এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে! কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
— ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।

রূপকথার অভিশাপে অভিশপ্ত মাছির কাছে কৌতূহল গোপন করি না,
— ও নীলমাছি, সময় তবে কোথাও যায় না?
— না, যায় না। সময় তার প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চয় করে রাখে।
— তবে আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
— বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
— সবাই তো যায়, কি যায় না!

নীল মাছির কণ্ঠে বিষাদ ভর করে,
— যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলছে, “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাই না। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে,
— এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
— জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা, ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

.
নীলমাছি | ২০১৬ | বর্তমানে ‘মনসুখিয়া‘ বইটি আউট অব স্টক।

ডিজিটাল বাংলাদেশ

out.

নাম তার নিতাই চন্দ্র, ডাকে সবাই বাবু,
নেই কোনও জমিদারি, বাবু ডাকে তবু।
লেখাপড়া নেই তেমন, শুধু অল্পকিছু জানা,
ইচ্ছে ছিল লেখাপড়ার, সমস্যা ছিল আনা।

যা হয়েছে নিজের চেষ্টায়, তা দিয়েই চলে,
ঘরে খাবার না থাকলেও সত্য কথাই বলে।
কাজে ছিল পাকা, হিসাবে ছিল ঠিক,
বে-হিসাবে চলতে গিয়ে, সব হলো বেঠিক।

জায়গাজমি নেই কিছুই, পরের বাড়ি বাসা,
স্বপ্ন বলতে জীবনটুকু, বেঁচে থাকার আশা।
এখন বয়সে সে কাবু, মাথায় পেকেছে চুল,
স্মরণশক্তি কমেছে খুব, হিসাবে করে ভুল।

শরীরের চামড়া হচ্ছে ঢিলে, গুটিকয়েক দাঁত,
চোখের দৃষ্টি নেই তেমন, ঝাপসা দেখে দিনরাত।
একসময় দৌড়াত খুব, ক্যামি ঘড়ির পেছনে,
সারাক্ষণ বসে থাকতো, টিভির পর্দার সামনে।

সেইদিন নেই বাবুর, এখন ডিজিটাল দেশ-বিদেশ,
হাতে হাতে মোবাইল ফোন, আগের দিন শেষ।
ছোট একটা যন্ত্র মোবাইল, ভেতরে সব তার,
দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়, চিন্তা কীসে আর।

লেখাপড়া লাগে না লিখতে, মুখে বললেই হয়,
কী লিখবে আমায় বলো, গুগল মামায় কয়।
তাইতো সবাই লিখে যাচ্ছে, হচ্ছে সবাই কবি,
স্টুডিওতে যায় না কেউ, নিজেই তোলে ছবি।

কমেছে ক্যামেরার মান, ধূলিসাৎ স্টুডিওর ব্যাবসা,
ফটোগ্রাফার সবাই এখন, মোবাইল ছাড়া সমস্যা।
দুঃখ করে বাবু বলে, মোদের দিন তো শেষ,
তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়ায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ।।

.
নিতাই বাবু:
১১/০৮/২০২৩ইং।

ফেউ

আকাশে ছড়িয়ে যাক একথালা ভাত
বুভুক্ষু মানুষগুলো চোখ মেলে থাক
বিত্তশালীরা কতোবড় দানশীল!
বুঝুক এইবার বস্তির যতীন।

মানুষ খেতে না পাক পড়ে থাক রাস্তায়
তারা কথা বলে বড় বড় হপ্তায় হপ্তায়
বানের জলে ভেসে যাক বানভাসী মানুষ
আমরাতো শহরে উড়াই রঙিন ফানুস।

কথায় নয় শুধু চাটুকারে ভরা
লাশবাহী গাড়িটা যাচ্ছে একা
আমরা যেমন থাকি ভাবছে না কেউ
নিরন্ন যারা তারা নয় এদেশের ফেউ।

১০০৮২০১৬

ধানশালিক যারা

স্বদেশ তুমি হাসো,এই বুনোহাঁসের বাংলায়
দ্বিধাহীন সেই রোদের মতো—বৃষ্টির প্রণয়ে
বাতাসও ডাকে সন্ধ্যা পাখির ছিন্ন ডানায়
এই পৃথিবীর ধানফুল দক্ষিণের খালপাড়ে

ভাঁটফুল ঝোপঝাড় পাতার কৌটা—মুমু রাত
এই যে গ্রাম মাটির দেওয়াল শহর বহুদলে
হেঁটে আসে নদী বাদামি বিকেল নতুন চাঁদ
ঘুড়ি আর ফড়িং নৃত্য করে কয়লার ফুলে

অধিক হেমন্ত সে নবান্ন গান চুলখোলা নারী
উষ্ণ বরফের ঠোঁট বুনে দেয় কুয়াশার চিল
নিজেল রাত্রি জলছাপ মানুষের কামার্ত পরী
উঠানের গীত ঘামের শিস মাটির সমুদ্র নীল—

আমাদের খুনসুটি এই আরও বকুল দোতারা
পৃথিবীর মলাট খুলে হাঁটে—ধানশালিক যারা!

রাতের পৃথিবী

fogg

কোন কোন ঘুম ভাঙ্গা রাতে দেখি
পৃথিবীটা নিঃসম্বল ভিখিরির মতো
ফুটপাথে কানা উঁচু থালা পেতে বসে আছে।
তন্দ্রাবেশে কুয়াশাভেজা নিস্তেজ রাত।

বাতাসের গায়ে গন্তব্যের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে
একটি নিশাচর পাখি উড়ে গেলে; তুমুল
পাখসাটে হু হু করে বাজে অস্ফুট ব্যথাচ্ছন্ন এক সুর।
কখনোবা মানুষও তো পরিযায়ী পাখি!

শোনা না শোনার দোলাচলে হিস হিসে ধ্বনি বাজে ;
ঝলসে ওঠে রাতের চাবুক।

একটা প্রকাণ্ড কালো মাকড়শার মতো
কিলবিলে দশপায়ে হেঁটে যাচ্ছে জমকালো রাত।

যেতে যেতে কোথাও কী কিছু ফেলে গেলো কেউ
একটি পতত্র? এক ফোঁটা বিষ?

লজ্জাবতী ফুল

abu

আমার প্রিয় ফুলের নাম লজ্জাবতী ফুল। অন্য অনেক ফুল থাকতে লজ্জাবতী কেন প্রিয় বন্ধুরা প্রায়ই এমন প্রশ্ন করে থাকে। কোন ফুল কার প্রিয় হবে তার কোন ব্যাখ্যা থাকে না, যুক্তিও থাকে না।

লজ্জাবতী প্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে আমার গভীর বিপদের সময় সে তার ডানা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তিপান্ন পেরিয়েছি। তিপান্ন থেকে পঞ্চাশ বিয়োগ করলে যা অবশিষ্ট থাকে তাও আমি পেরুতে পারতাম না যদি লজ্জাবতী দেবদূত হয়ে আমাকে উদ্ধার করতে না আসতো।

বাসায় উঠানের শেষে পুকুর। আমি উঠানে ফুটবল চর্চা করি ভবিষ্যতের সালাহউদ্দিন কিংবা পেলে। ফুটবলের সাথে পানির সখ্যতা এত বেশি কেন এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি। আমি যতই পুকুর এড়িয়ে যেতে চাই ফুটবল ততই পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে।

ফুটবল পুকুরে পড়ে গেলে আমি চিৎকার করি; চিৎকার শুনে ঘর থেকে কেউ না কেউ এসে ফুটবল উদ্ধার করে দিয়ে যায়। একদিন বাসায় কেউ নেই। আম্মা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। একা আমি উঠোনে গোল প্রাকটিস করছি। পুকুরের উল্টো দিকে গোলপোস্ট। তবু কিক মারার সাথে সাথে বেয়াদব ফুটবল ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে। পুকুরের পানিতে ফুটবল পড়ে গেছে কয়েকবার চিৎকার করে দেখলাম কেউ সাড়া দেয় না।

নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে ভেবে ফুটবল উঠাতে পুকুরের পাড়ে গেছি; দেখলাম পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। পুকুরের পাড় থেকে পানিতে কিভাবে এলাম বুঝতে পারলাম না।

বয়স তিন সাড়ে তিন তবু আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। হয়তো পাড় থেকে খুব বেশি দূরে যাইনি তাই রক্ষা পেলাম। পুকুরের চারপাশ ঘেঁষে অসংখ্য লজ্জাবতী। তাদের ডানা পুকুরের পানি পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁচার জন্য মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। আমি আঁকড়ে ধরলাম লজ্জাবতী।

লজ্জাবতী আঁকড়ে ধরে উপরে উঠে এলাম। পুকুরের চারপাশে অসংখ্য লজ্জাবতী লতা কোনদিন তাদের দিকে গভীর মনোযোগে তাকানো হয়নি, এবার তাকালাম। দেখলাম ছোট ছোট অসংখ্য গোলাপি ফুল ফুটে আছে। লজ্জাবতীর গায়ে হাত ছোঁয়ালাম লজ্জায় তারা গুটিয়ে গেল কিন্তু ফুলগুলি ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন বন্ধুত্বের আহ্বান জানাচ্ছে। আমি সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে লজ্জাবতী ফুল দেখতে থাকলাম। মনে হলো জগতে এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু নাই। মনে হলো ঈশ্বর লজ্জাবতীর গায়ে ফুল হয়ে ফুটে আছেন।

লজ্জাবতী ফুল আমার প্রিয় ফুল। তাদের দিকে তাকালেই ঈশ্বরের প্রতিরূপ দেখি।

নিস্পৃহ সময়ের গান

নিস্পৃহ সময়ের কথা খুউব মনে পড়ে
তখন অকবিতারাও বেসুরো গান হয়
নদী আর নারী একই সুরে কথা কয়!

আজকাল দীঘির কালচে জলে নক্ষত্র জ্বলে
জোনাকিরা বেজায় ভয় পায়
ওদের কে বুঝাবে…?
যখন সাপ আর ব্যাঙ একসাথে ঘুমায়
তখন মহাবিশ্বের কারো কোনো ভয় নাই.!!

তবে ক্ষয় আছে মহাসমুদ্র কিংবা পাহাড়
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকাই অতি বড় বিজয়
বিপদের দিনে অতিকায় হাতিও মশার আহার!!

মন কেন হয় মেঘলা আকাশ

cho

যেদিকে তাকাই যেন অথৈ সমুদ্র
কূল নাই, নাই কিনার, সাঁতরেও হতে পারবো না পার
কোথায় ভুল, কোথায় শুদ্ধতা
আকাশে তাকিয়ে উদাস, পাই না কথার উত্তর।

মানুষের মন কেন কালো মেঘ আকাশ,
কেন হয় না কাশফুল
মানুষের মন হয় না সাদা মেঘ
মানুষের মন কেন পাথরের পাহাড়।

ভাবতে গিয়ে ডুবে যাই চিন্তার ডহরে
পারি না স্বাচ্ছন্দ্যে উঠতে আর
ক্রমশ মনের আকাশ হয়ে যায় গ্রীষ্ম,
আমি তো চাই মন থাকুক হেমন্ত।

চাই মন হউক শরতের মত, সুখে উদাস
অথচ সব আশা আমার গুঁড়েবালি
চোরাবালি সময়, হারিয়ে যাই মুহুর্মুহু কষ্টের অতলে,
হারিয়ে গেলেও খুঁজে না কেউ আর।

তুচ্ছ আমি, আমি অবহেলার চূড়ান্ত সীমানা
সে সীমানায় উচ্ছলতা নেই
নেই দু’দন্ড শান্তির হাওয়া
আমি অপ্রয়োজনীয়, কেন তবে হবে আমার
দুনিয়ার বুকে বসবাস!

ইশ পাখি হয়ে যেতাম যদি
অথবা আকাশে মেঘ
এখানে কেউ ছুঁয় না আমার মনের আবেগ
স্বার্থপরদের সাথে বসবাস, আর কিছু দীর্ঘশ্বাস
নিয়েই যেন দেব পাড়ি অনন্ত পথ।

.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, গ্রীণ মডেল টাউন ঢাকা)

বিশ্বস্ত বন্ধুদের প্রতি

এখন রপ্ত করতে চাই কীভাবে পালাতে হয়, কীভাবে দীর্ঘ করা যায়
বিভিন্ন ছুটিদিবস- কীভাবে অন্য কোনো গ্রহে পৌঁছে নেয়া যায়
মুক্ত নিশ্বাস। জানি সেদিন হয়তো থাকবে না আর এই শ্বাসকষ্ট,
এই পোড়ামাটিচিহ্ন লেগে থাকবে না আমার হাতে, অথবা যে ছবিগুলো
একদিন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, সেগুলোও জোড়া লাগাবার প্রয়োজন
পড়বে না আর।

এবার শিখে নিতে চাই নাম-নিশানা মুছে ফেলার কৌশল, কেউ
জানবে না এই নগরের ভোটার তালিকায় আমারও নাম ছিল,
একদিন কলমও ছিল আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর কাগজে
যে কাটাকুটিগুলো আমার পাঁজর ছিল- মূলত এরাই ছিল আমার কবিতা।

আমি পালিয়ে যেতে চাই,
মানুষ আমাকে পরাজিত পথিক বলুক
তারপরও,
যেতে চাই এই নগর থেকে অন্য কোথাও
যেখানে কেউ আমাকে আর চিনবে না
কেউ জানবে না পূর্বজনমে আমি আদৌ মানুষ ছিলাম কী না !

আবেগের আলিঙ্গন

sh

ছিঁড়েছে হৃদয়, হতাশায় জগৎ,
তবুও আশা বেঁচে থাকে, তাজা বাতাসের মতো,
পরীক্ষা এবং ক্লেশের মধ্য দিয়ে, আমরা সাহস করি,
প্রেমের যাত্রায় দুঃখ, বেদনাকে আলিঙ্গন,

এই বেদনাত্মক আত্মার ক্রন্দন,
ইথারের শূন্যতায় ভেসে যায় সুগন্ধি গোলাপ
সঙ্গীন জীবন, সংকীর্ণ পথ আর পথিক।

এভাবেই চলছে, শেষ পর্যন্ত,
একটি সময়ের পথে সম্পূর্ণ সুখ
দুঃখ স্মৃতির আবেশ যেনো এখানেই একাকার,
চারপাশের কানাঘষা খোলামেলা চিৎকার
মুখোমুখি মিষ্টি হাসি,

আমি বলে রাখি তোমার অপেক্ষা,
এই দিন শেষ হবে দুই আত্মা, এক হিসাবে,
নিয়তির মিষ্টি কীর্তি, প্রেমের সিম্ফনিতে
নাটক সাজিয়ে মন সুস্থ হবে,

ওহ এত ঝরঝরে,
এত স্মৃতি এত বেদনার পর
আবেগের এই ট্যাপেস্ট্রিতে,
ভালোবাসার হৃদস্পন্দন।

খুঁজতে

খুজতে

আমি তারার দেশে
যাচ্ছি- খুঁজতে-
কি হারালাম- কি হারালাম
জানলো জোছনা রাত!
ঝিঁঝিঁপোকার গায়েন;
আমি তারার দেশে-
যাচ্ছি- খুঁজতে।
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম
মা হারনার যন্ত্রনা
চাঁদের বুকে অসীম সীমানা
জনম তরীর আলপনা
মায়ের মুখ মলিন করা
দেখছি সবই অনমরা
কি পেয়ে হারিয়ে গেলো
এই নিঠুর দুনিয়া;
যন্ত্রনাটা হাজার বছরে
পুষলাম শুধু তারার দেশে-
খুঁজতে- খুঁজতে!

.
২৫ শ্রাবণ ১৪২৯, ০৯ আগস্ট ২৩

মনসুখিয়া

abu

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে– আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম… আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নেভাই। গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই ধমকে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি,
— সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।’

কথা শেষ হতে না হতেই ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠলাম, ঘুঘুবউ ফের ধমক লাগাল-
— হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। সিগারেট নিভিয়ে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
— আজ, এবং এখন।
— বাহ! জারী করলেন কে?
— কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।

চলচ্চিত্রে দেখা উকিলের ঢংয়ে জানতে চাইলাম,
— মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
— ২৪ঘণ্টার জন্য।
— মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেন?
— কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিব না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি,
— ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছ। ভোরেও শুরু করেছো!
— হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।

টিকটিকের স্বরে দার্শনিকতা ভর করে,
— মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলি-
— সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ টাজ নেই তোমার!
— দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
— বাহ! বাহ। তুমি দেখছি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
— জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— কে তোমাকে কষ্ট দিল টিকটিমনি!
— কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছ, মানুষ।
— কখন! কখন কষ্ট দিলাম!

টিকটিকি একটু লেজ নাড়ে, সদা নীতি শিক্ষায় নিয়োজিত মুরুব্বীর স্বরে বলে,
— ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
— এজন্য এতো কষ্ট!
— হু
— কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।

টিকটিকির স্বরে দ্বিধা,
— অর্থহীন! কেনো বলো তো!
— শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
— কি যে বলো! কিছুই বুঝি না।
— কিছু বুঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। একদিন এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠি না, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে,
— তাই না কি, মানুষ! তোমার প্যাঁচাল শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকিকে আর কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই ক’টা দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাপিয়ে তারস্বরে করুণ শিস দিয়ে যাচ্ছে দু’টা দোয়েল। কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর বিষাদ তাদের!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটা হোক, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি। তাদেরও হয়তো উস্কানি দিচ্ছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
— ভাই, ওঠেন।
— কোথায় যাব জানেন?
— হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, দু’পাশের হুডে গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে। পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে। পাকস্থলীর টানে কামলা ছুটেছে কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভাঙেন,
— কুনুদিন এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
— এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
— কন কি ভাই! আকাল হইব ক্যান!
— অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা চাবাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন-
— আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইতাছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিল সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুননিসার আহ্লাদি স্বর,
— নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
— একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
— এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুননিসার মুখে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঁঝাল রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুননিসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দেয়,
— শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুননিসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
ভিকারুননিসার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ,
— আমি কি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে বললে!
ভিকারুননিসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে বলে,
— প্রিয় ভিকারুননিসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর চেয়ে দামী উইশ আর কি আছে!
— এটা দামী উইশ!
— অবশ্যই অমূল্য উইশ। কেন অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
— হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হয় তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
— প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
— যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
— না, ভিকারুননিসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
— কি যে বলো না, নটরডেম!
— জন্মানোর পর মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবে না- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
— তা তো হতে হবেই।
— ভিকারুননিসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না।
— ধ্যাত! এ কথার অর্থ কি!

নটর ডেম প্রথমে কথা গুছিয়ে নেয়, তারপর ধীর লয়ে বলে চলে,
— জন্মানোর পরই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে পরম উৎসাহে যোগ দেয় আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে। সবাই মিলে সে’ই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেন নাই। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
— একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
— গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
— কি হয়!
— অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারে নাই। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের চোখে তাকায় ভিকারুননিসা, টেবিলের ওপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
— আমি কেমন মানুষ হব- বলে দাও।
— ভিকারুননিসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পড়লাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মতো মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
— থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুননিসা আবেগঘন স্বরে বলে-
— যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেন, তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
— কথায় কথায় মরতে হবে না, মনে রেখ– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর এবং দীর্ঘতম।
— এত্ত কিছু জানি না নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেন কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
— ভিকারুননিসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেক, হারিয়ে যেও না।

পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে আছে, দুজনের দৃষ্টি মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে খুন করেছিল, তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয় নাই। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুননিসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবে না, সে চিনে না মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’

কোনো উত্তর পাই না, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

.
মনসুখিয়া। বর্তমানে বইটি অউট অব স্টক।

নিভৃতচারী

IMG_20230808_093856

জানি না কে সে
চুপিচুপি আসে পাশে
টের পাই ফুসফুসে
সুবাস ছড়ায় বাতাসে।

বলে না কোন কথা
পুষে রাখে মৌনতা
তবু এই নীরবতা
মনে হয় গভীরতা।

জানি নিভৃতচারী
করে তবু মনচুরি
জানি না নিশাচরী
কেন এই লুকোচুরি?

তৃষ্ণা মিটবে কিসে
একবার যদি হাসে
ঝরনার জলে ভেসে
নদী হবে অনায়াসে।

জানি না কে সে
এভাবে কেন আসে
মনখারাপের দেশে
পালিয়ে যায় শেষে।

প্রবাসেও খুঁজি শ্যামলিমা তোমায়

অন্ধকার ঘোর ঘোর অমানিশা
তবু জ্বালাচ্ছে আলো জোনাকি মেয়েরা
হিজল তমালের ডাল বেয়ে ঝরছে শিশিরের মুক্তো ফোটা
ধূসর প্রবাসেও আমি স্বপ্নে হারিয়ে যাই প্রিয়তমা শ্যামলিমা।

পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনি না বিচিত্র সুরের তানে
মাঝে মাঝে দেখি শালিক জোড়া কোনো এক মরুদ্যানে
অভিমানে তারা দেখিছে এদিক ওদিক ভিন্ন দিকে মুখ করে
হোক অভিমান তবুও করি স্মৃতি রোমন্থন, তোমাকে পেতে আপন করে।

জলাশয় কখন দেখেছি ভুলে গেছি, দেয় না সে হাজিরা স্মৃতির মাঝারে
সারি সারি শ্বেত বলাকা ওড়েনা আর সন্ধ্যার আকাশে ঘরে ফেরার তরে
চাতক চাতকী রচেনা মায়ার বন্ধন, রুক্ষ মরুর মাঝে উদাসী হতে-
দখিনা বাতাসে এখানেও ওঠে ঝড়, হিমশীতল নয়! প্রিয় মুখ জ্বালাতে।

ভ্রান্তির ছলনে আমি ভুলে মাঝ রাতে পথ চলি বেহুলার সন্ধানে
কোথাও পাই না খুঁজে তারে, যারে দেখেছি শ্যামল বাংলার মননে
জোনাকি মেয়েরা জ্বালায় না আলো এখানে, ছুটে চলে শুধু যন্ত্রদানবের দল
শ্যামলিমা তোমার মত এমন শ্যামল নাই আর পৃথিবীর বুকে, আছে শুধু ছল!