বিভাগের আর্কাইভঃ সাহিত্য

খুঁজতে

খুজতে

আমি তারার দেশে
যাচ্ছি- খুঁজতে-
কি হারালাম- কি হারালাম
জানলো জোছনা রাত!
ঝিঁঝিঁপোকার গায়েন;
আমি তারার দেশে-
যাচ্ছি- খুঁজতে।
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম
মা হারনার যন্ত্রনা
চাঁদের বুকে অসীম সীমানা
জনম তরীর আলপনা
মায়ের মুখ মলিন করা
দেখছি সবই অনমরা
কি পেয়ে হারিয়ে গেলো
এই নিঠুর দুনিয়া;
যন্ত্রনাটা হাজার বছরে
পুষলাম শুধু তারার দেশে-
খুঁজতে- খুঁজতে!

.
২৫ শ্রাবণ ১৪২৯, ০৯ আগস্ট ২৩

মনসুখিয়া

abu

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে– আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম… আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নেভাই। গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই ধমকে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি,
— সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।’

কথা শেষ হতে না হতেই ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠলাম, ঘুঘুবউ ফের ধমক লাগাল-
— হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না। সিগারেট নিভিয়ে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
— আজ, এবং এখন।
— বাহ! জারী করলেন কে?
— কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।

চলচ্চিত্রে দেখা উকিলের ঢংয়ে জানতে চাইলাম,
— মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
— ২৪ঘণ্টার জন্য।
— মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেন?
— কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিব না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
— বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি,
— ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছ। ভোরেও শুরু করেছো!
— হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।

টিকটিকের স্বরে দার্শনিকতা ভর করে,
— মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলি-
— সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ টাজ নেই তোমার!
— দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
— বাহ! বাহ। তুমি দেখছি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
— জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— কে তোমাকে কষ্ট দিল টিকটিমনি!
— কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছ, মানুষ।
— কখন! কখন কষ্ট দিলাম!

টিকটিকি একটু লেজ নাড়ে, সদা নীতি শিক্ষায় নিয়োজিত মুরুব্বীর স্বরে বলে,
— ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
— এজন্য এতো কষ্ট!
— হু
— কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।

টিকটিকির স্বরে দ্বিধা,
— অর্থহীন! কেনো বলো তো!
— শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
— কি যে বলো! কিছুই বুঝি না।
— কিছু বুঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। একদিন এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠি না, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে,
— তাই না কি, মানুষ! তোমার প্যাঁচাল শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকিকে আর কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই ক’টা দীর্ঘতম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাপিয়ে তারস্বরে করুণ শিস দিয়ে যাচ্ছে দু’টা দোয়েল। কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর বিষাদ তাদের!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটা হোক, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি। তাদেরও হয়তো উস্কানি দিচ্ছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
— ভাই, ওঠেন।
— কোথায় যাব জানেন?
— হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, দু’পাশের হুডে গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে। পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে। পাকস্থলীর টানে কামলা ছুটেছে কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভাঙেন,
— কুনুদিন এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
— এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
— কন কি ভাই! আকাল হইব ক্যান!
— অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা চাবাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। হাসতে হাসতে বলেন-
— আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইতাছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিল সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুননিসার আহ্লাদি স্বর,
— নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
— একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
— এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুননিসার মুখে অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঁঝাল রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুননিসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দেয়,
— শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুননিসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
ভিকারুননিসার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ,
— আমি কি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে বললে!
ভিকারুননিসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে বলে,
— প্রিয় ভিকারুননিসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর চেয়ে দামী উইশ আর কি আছে!
— এটা দামী উইশ!
— অবশ্যই অমূল্য উইশ। কেন অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
— হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হয় তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
— প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
— যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
— না, ভিকারুননিসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
— কি যে বলো না, নটরডেম!
— জন্মানোর পর মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবে না- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
— তা তো হতে হবেই।
— ভিকারুননিসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না।
— ধ্যাত! এ কথার অর্থ কি!

নটর ডেম প্রথমে কথা গুছিয়ে নেয়, তারপর ধীর লয়ে বলে চলে,
— জন্মানোর পরই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে পরম উৎসাহে যোগ দেয় আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে। সবাই মিলে সে’ই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেন নাই। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
— একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
— গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
— কি হয়!
— অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারে নাই। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের চোখে তাকায় ভিকারুননিসা, টেবিলের ওপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
— আমি কেমন মানুষ হব- বলে দাও।
— ভিকারুননিসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পড়লাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মতো মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
— থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুননিসা আবেগঘন স্বরে বলে-
— যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেন, তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
— কথায় কথায় মরতে হবে না, মনে রেখ– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর এবং দীর্ঘতম।
— এত্ত কিছু জানি না নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেন কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
— ভিকারুননিসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেক, হারিয়ে যেও না।

পৃথিবীতে আর কোন শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে আছে, দুজনের দৃষ্টি মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না… হারিয়ে যেও না…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে খুন করেছিল, তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয় নাই। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুননিসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবে না, সে চিনে না মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’

কোনো উত্তর পাই না, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

.
মনসুখিয়া। বর্তমানে বইটি অউট অব স্টক।

নিভৃতচারী

IMG_20230808_093856

জানি না কে সে
চুপিচুপি আসে পাশে
টের পাই ফুসফুসে
সুবাস ছড়ায় বাতাসে।

বলে না কোন কথা
পুষে রাখে মৌনতা
তবু এই নীরবতা
মনে হয় গভীরতা।

জানি নিভৃতচারী
করে তবু মনচুরি
জানি না নিশাচরী
কেন এই লুকোচুরি?

তৃষ্ণা মিটবে কিসে
একবার যদি হাসে
ঝরনার জলে ভেসে
নদী হবে অনায়াসে।

জানি না কে সে
এভাবে কেন আসে
মনখারাপের দেশে
পালিয়ে যায় শেষে।

প্রবাসেও খুঁজি শ্যামলিমা তোমায়

অন্ধকার ঘোর ঘোর অমানিশা
তবু জ্বালাচ্ছে আলো জোনাকি মেয়েরা
হিজল তমালের ডাল বেয়ে ঝরছে শিশিরের মুক্তো ফোটা
ধূসর প্রবাসেও আমি স্বপ্নে হারিয়ে যাই প্রিয়তমা শ্যামলিমা।

পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনি না বিচিত্র সুরের তানে
মাঝে মাঝে দেখি শালিক জোড়া কোনো এক মরুদ্যানে
অভিমানে তারা দেখিছে এদিক ওদিক ভিন্ন দিকে মুখ করে
হোক অভিমান তবুও করি স্মৃতি রোমন্থন, তোমাকে পেতে আপন করে।

জলাশয় কখন দেখেছি ভুলে গেছি, দেয় না সে হাজিরা স্মৃতির মাঝারে
সারি সারি শ্বেত বলাকা ওড়েনা আর সন্ধ্যার আকাশে ঘরে ফেরার তরে
চাতক চাতকী রচেনা মায়ার বন্ধন, রুক্ষ মরুর মাঝে উদাসী হতে-
দখিনা বাতাসে এখানেও ওঠে ঝড়, হিমশীতল নয়! প্রিয় মুখ জ্বালাতে।

ভ্রান্তির ছলনে আমি ভুলে মাঝ রাতে পথ চলি বেহুলার সন্ধানে
কোথাও পাই না খুঁজে তারে, যারে দেখেছি শ্যামল বাংলার মননে
জোনাকি মেয়েরা জ্বালায় না আলো এখানে, ছুটে চলে শুধু যন্ত্রদানবের দল
শ্যামলিমা তোমার মত এমন শ্যামল নাই আর পৃথিবীর বুকে, আছে শুধু ছল!

নিষ্ফলা লজিং মাস্টার

gtry

রাত বাড়ছে, বিদঘুটে অন্ধকার, আলোর চুকেছে পাঠ;
মাস্টার, ও মাস্টার—
তোমার উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট।
হা হা হা …
বাতাসে আসে বিদ্রুপের ধ্বনি,
অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে; চারদিকে শব্দের খিল খিলানি।

ভেসে উঠে এক নারীর ছায়া
পিছনে তাড়া করে বেড়ায় অতীত স্মৃতি,
কণ্ঠটি বড়ই চেনা
হাতছানি দেয় নিষ্ঠুর নিয়তি।
সেই যে, পড়ার টেবিলে—
ছাত্রীটি— বীজ গণিত, পাটি গণিতের ফাঁকে,
অংক কষে সংসার জীবনের, রঙিন স্বপ্ন আঁকে।
‘যেখানে শোভা পাবে— একটা ছোট ঘর, সন্তানাদি
বাড়ির আঙিনা জুড়ে শিউলি ফুল আর মেঝেতে শীতল পাটি,
যাতে আসন পেতে মধ্যমণি হবে সামনে বসে থাকা মানুষটি।

হাতে হাত, মননে, প্রণয়ে, সঙ্গমের স্বপ্ন করে যতন,
জ্যামিতির কাটায় দৈর্ঘ্য—প্রস্থে মাপে সংসারের আয়তন।

এটা বয়সের আবেদন, আবেগী মনের বাসনা
নয়ন যুগল হয় স্বপ্নভাসি,
বইয়ের পাতায় বড় বড় অক্ষরে ভাসে
মাষ্টার ‘তোমায় ভালবাসি’।

টেবিলে শব্দ হয় ঠকঠক করে, সম্বিত ফিরে পায়—
‘মনযোগ দাও হে’ বইয়ের পাতায়,
সে যে বুঝে না, যাকে ঘিরে এত সব আয়োজন
সে কি না ব্যস্ত নিয়ে অন্যকিছু; মেকি যা তা’য়।

এত পানসে কেন? রঙ রস কিছুই কি স্পর্শ করে না!
মনে মনে আওড়ায়— ‘বড়ই বেরসিক! কিছুই বুঝে না,’
যাও, যাও আজ ছুটি!
সমাধান করে দিব অন্য কোনদিন, শরীরটা আজ ভাল যাচ্ছে না।

ছাত্রীর মাঝেও যে কিছু চলছে; সেটি বুঝতে হয় না বাকি,
শারীরিক অক্ষমতা; সেটা প্রকাশ করার নয়
ভালভাল কেটে পড়ি; মায়ার বন্ধন দিয়ে ফাঁকি।

কিছুদিন পর খবরে আসে ‘সুইসাইড’
দাগ কেটে যায়; এতসব খবরের ভীড়ে,
চাওয়া ছিল— ‘তাতে কি আসে যায়, সে সুখী হউক
অন্য কোথাও, অন্য কোন নীড়ে।’

এই মৃত্যুর জন্য কি আমি দায়ী? নিছক ছেলে মানুষি বৈকি!
শূন্যতাকে করে আপন,
বুকে খা খা করে একাকিত্ব, বড়ই পীড়া দেয় যাযাবর জীবন যাপন।

হৃদয় পোড়া আঘাত
আজ হয়েছে ভীষন ক্ষত,
কামনা বাসনা ছাড়া নিরাশ এই জীবন সংসার
নিষ্ফলা, অকেজো বৃক্ষের মত।

ভারতের মেট্রো বা পাতালরেলে চড়ার আনন্দ অভিজ্ঞতার গল্প

nit

একসময় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। তখন বৈশাখমাস। বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দালাল মারফত অতি কষ্টে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন পৌঁছেছিলাম। আমার সাথে ছিল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ওর দুই বোন। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, জীবনটাকে একটু পরিবর্তন করার। কিন্তু না, জীবন তো পরিবর্তন করতে পারি-ই-নি, বরং ওখানে প্রায় দেড়বছর অবস্থান করে শেষাবধি শূন্য হাতে আবার ফিরে আসতে হলো। এরমধ্যে লাভ হয়েছিল, বিশাল ভারত-সহ ভারত ঘেঁষা ভুটানের কয়েকটা জায়গা দেখা হয়েছিল। তো যাক সেকথা, আসা যাক পোস্টের মূল কথায়।

ভারত যাবার পর আমার বন্ধু বাসায় অবস্থানের পর, আমার যেন কিছুই ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার কারণ ছিল, বাংলাদেশে ফেলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা। সেই চিন্তা মনের ভেতরে রেখেই কাটিয়ে দিলাম চার-পাঁচদিন। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা আমার বন্ধু কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”

এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল! চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ! এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাই’র বাসা থেকে একটা অটো (সিএনজি) চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। অটো থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছি, আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দেখছিলাম, দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে।

কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন বা মেট্রোরেল। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।

বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। এখন চল, নিচে স্টেশনের ভেতরে যাওয়া যাক। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”

সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নামতে লাগলাম। যতই নিচে যাচ্ছিলাম, ততই স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হচ্ছিলাম! এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়।

জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো উড়াল। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছিলাম, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট।

কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান।

ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।” আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।” এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রীদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং।
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। তারপর ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো। মেট্রোরেল বা পাতালরেলে চড়ার গল্পও শেষ হলো।

জলের আঙুর


এক বর্ষায় সব পালটি খেয়ে গেছে হুতাশন।
পাতায় পাতায় এমন প্রফুল্ল গাঁট
সমস্ত পাখির মুখ খুলে গিয়ে;
নারকোলডাঁটির দুপাশে ঘন দুর্গাভুরু তোলা,
তাতে জলকুহেলি।
এমন নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ চেপে ধরেছে
আমাদের…
গাছই উচ্চারণ করছে আর পল্লব সহ্য করব না।
এই বর্ষার পেছন পেছন এল উদ্দালক
খুনের হুমকি থেকে বেঁচে;
মনের মধ্যেও ফের আরম্ভ চালু শুরু, ভাই,
জলের মোড়লি; আর তাতে পাছা-উবদি হাঁস


মাতাল-বিরক্ত পথ, টর্চ হাঁটছে
এক্কা-দোক্কা লাফ দিয়ে দিয়ে
কচি-শসা রাস্তাটায় বৃষ্টির লবন মাখানো

সব উঠোনে ঘুরে গেছে সবুজ প্যারামবুলেটার
সাদা ফুলতোলা ফ্রকের জলশিশু
তার মধ্যে আধ-শোয়া

ভেজা, হিম, ভিতু কাক হয়ে
এডাল-ওডাল উড়ে বসছে প্রেম


মনসিজ পানির ভেতরে বৃষ্টির আচ্ছন্ন ফুল
কোমর পর্যন্ত অতিকায়

ছাদ তুলতে ওস্তাদ মিস্তিরি ত্রিপলের নীচে
বালিতে পাথরকুচি — চালের উদরে ডাল —
ঠেসে দিয়ে হাভাতে ইঁটের ছোট হিল্লে করে দিল

একবার আটচালা ছেড়ে, মাটির গৌরাঙ্গ, তুমি
উঠোনে দাঁড়াও। কত আস্ত থাকে দেখি
চোখ, চূড়া, দুটি ছিচরণ!

.
(‘নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

তালমিটার

যাকে হারিয়েছো ভেবে এত কান্না
তুমি তো জানোনা তারও মনে
ঢুকে বসে আছে কিছু গভীর অন্ধকার
তুমি দুই হাতে সরাচ্ছো শুকনো পাতা
অরন্যের বুক থেকে চাইছো বইয়ে দিতে ঝর্ণা
অন্যদিকে সেও করছে পরিখা খনন
বন্দুকের গুলিগুলো পুরনো হয়ে আসে তারও
অথচ তোমার কথা ভাবলেই বৃষ্টি মনে আসে
মনে উঠে আসে ছবি ছেলেবেলার স্বপ্নগুলোর
যার সমাপন মিশে যেত আজানের সুরে

তুমি ছুটে যাচ্ছো কান্নার নগরীর দিকে
অদ্ভুত কত ছায়া ঘিরে থাকে বড়আপুর সন্তুর
তার সাথে তোমার আর দেখা হয়না
রাঁধুনি খালা বলেছিল, নদীতে নদীতে দেখা হয়
তবু বোনে বোনে দেখা হয়না
তুমি কি এখন বোন হয়ে গেছো তবে?
উজিরপূত্র, নাজিরপূত্রের সাথে যুদ্ধ শেষে
যেমন নামে বেহেশতি নীরবতা
তোমার প্রেমও ক্রমশঃ বোন হয়ে যায়
চুমুগুলো মেঘ সেজে বৃষ্টি নামায় চোখে।

দূরে এঁকেবেঁকে তখন মিলিত হতে থাকে দীর্ঘশ্বাসেরা।

চাহনীর দূরমালা

আজকাল আমার, আমাকেই মনে পড়ে খুব-
আর মনে পড়ে সেই সড়ক, যে তার নাম ভুলে
গেছে অনেক আগেই। সবুজ শুশ্রূষা পেয়ে সেরে
উঠেছে যে নগর, তার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে একাকী
বেহালা বাজায় যে বিবাগী বাউল,মনে পড়ে তার
চাহনীর দূরমালা,কীভাবে স্পর্শ করে আকাশের মেঘ।

আজকাল নিজের নাম লিখে বর্ণিল অক্ষরে সাজাই তার
চারপাশ। রঙ দেখে চিনি আলোর ইন্ধন। লাল – কালো
রূপের তপস্যা। দেখি খুব কাছেই নোঙর ফেলছে নতুন,
আত্মকেন্দ্রিক ভোরের ছায়া। আর পুরাতন বিকেলগুলো
কিছুই পারেনি ভেবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে চাইছে পূবের
দিগন্তে। ভাবি, মানুষও তো এমনিভাবে হারায় নিজেকে,
ভুলে যায় নিজ নাম। তারপর স্মরণের বেলায়, পোষে পাখি
নাম শিখিয়ে, উড়িয়ে দেবে বলে।

কবিতায় জেগে উঠি

আজকাল নিজের থেকে নিজেই যখন পালিয়ে বেড়াই
তখন দেখি হাঁচি লুকানোর মত জায়গাও নেই..
অথচ সবকিছু আগে যেমন ছিল, এখনো সেই!

তবুও শুন্যতা দিয়ে শুন্যতা ভরাই…
তেলাপোকার মতো নিজেকে সান্ত্বনা দিই
নিজেকে ছাড়া আমি আর কাকে ডরাই!

তথাপি মাঝে-মধ্যে কবিতায় জেগে উঠি
রাতদুপুরে নিজেই চেপে ধরি নিজের টুটি!
তখন অভিধানের সব অপয়া শব্দেরা হাসে
তবে কি
ওরাই কেবল এই আমাকে ভালোবাসে?

শান্তির পায়রা হবি আমার

choo

তুই কি হবি শান্তির পায়রা
বসবি এসে মনের শাখে
দিবি সাড়া সকাল সাঝে
তুই কি পায়রা আমার ডাকে?

মনের বাড়ী বিষণ্ণতা
উড়ে নিত্যা বৈরী হাওয়া
একটু শান্তি আসবি নিয়ে
এটুক ছিল আমার চাওয়া।

হবি নাকি পায়রা আমার
মনের শাখে খাবি কি দোল
তোর ডানাতে নিয়ে উড়বি
হেথায় সেথায় ভুলে বেভোল?

সাদা পায়রা শান্তির প্রতীক
আমার শান্তি যা হয়ে যায়
একটুখানি স্বস্তি দিতে
আমার পাশে যা রয়ে যা।

উড়বি ঘুরবি মন আকাশে
স্বাধীন পাখি ইচ্ছে মতন
তোকে নিয়ে স্বপ্ন হাজার
পুষবো না হয় বুকে যতন।

একটি শাখে দুটি পাখি
আমিও কি হবো পায়রা
দে পরিয়ে এসে না হয়
মাথায় আমার প্রেমের টায়রা।

তুই কি হবি শান্তির পায়রা
মনের শাখে বসবি এসে
আমায় নিয়ে দূর কোথাও
ডানায় করে যাবি ভেসে?

সজীব বয়ান

একটি রণ বাহিনীর গোড়াপত্তন চলছে। শুরু হয়ে গেছে যাবতীয় কলা কৌশল আয়ত্ত করন প্রক্রিয়া। অচিরেই মাঠে নামবে সোমত্ত জোয়ান।যাদের অন্তরে দীর্ঘকালের লালিত বাসনা, রক্তে লহরিত সুর, তীব্র তারানা; বলয়ের সম্মোহিত ছন্দে তারা উঠে আসছে মহান দর্পণে!

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাঞ্জল শ্লোগানে। সমুচ্চারে। শৌর্যের গানে…।
যাবত কালের নিবিষ্ট ক্ষুধা থেকে, বারবার উপেক্ষিত সুন্দরের প্রস্তাবনা থেকে, পতিত অশ্রু বান- প্রেমের নৈবদ্য থেকে ছুটে আসছে নিবিড় এক প্রলয়। সুধা মাখা তীর,পুষ্পিত ধনুকে।
পরাগের গোলায়। হৃদয়ের সমস্ত মমতা মেনে মেখে শাণিত হচ্ছে সৈনিকের চোখ-দুর্জয় দৃষ্টি।

যেখানে ডেকেছে রংধনু কুৎসিত মেঘে, যেখানে পুড়েছে ফুলের স্নায়ু হিংস্র আগুনে, যেখানে ডুবেছে কবি নির্মম বিষাদে, যেখানে রুদ্ধ পথ- শৃঙ্খলিত শিল্পের চরণে। সেখানেই হবে শুদ্ধি
অভিযান! সজীব বয়ান। নতুন এক সংবিধান প্রণীত হবে কবিতা আর গানে।

প্রতিদিন উদযাপিত হবে সুরভী সন্ধ্যা- জ্যোৎস্না উদ্যানে। মহুয়ার বাগানে প্রজাপতির নৃত্য।
সু ঘ্রাণে মোহিত পৃথিবী আপন অক্ষে বয়ে বেড়াবে এক অভিন্ন নদী…

নাকফুলের অভিজ্ঞান

সন্ধ্যায় ডালিমদানার সাক্ষাতে সেসব হাসছে
কবিতার কাগজে মোড়ানো শীতল শিরোনাম
আর তুমি স্থির জমে থাকা রক্তজবা ব্যঞ্জনায়
নাকফুলের অভিজ্ঞানে পড়েই চলেছ।

কাউতালি শব্দ কখন ট্রেন হয়ে ছুটে যাচ্ছে
ঈশ্বরদী জংশন-পথের গায়ে ভাঙাচোরা গ্রাম-
শাদাকালো টিভির এন্টেনা ঘোরানো হাত
সুতোর ববিনে ঘুড়ি উড়তে থাকা সহজিয়া দিন
বোধহয় নিজের যত্ন ভুলে সন্তপ্তয় চেপে বসেছ
তুমি জানো না,আমাদের শিরার গহিনে খেলা
বেশুমার নদীর পিঠ বয়ে এনেছিল পিছুটান-
লুকোচাপা সম্পর্ক, তাতে জন্মেছে বাদামবন।

দেশদ্রোহী

মা, ওরা এখনো টিকে আছে যত্রতত্র, ভালো মানুষের বেশে-
সুযোগ পেলে তোমার সর্বনাশ করার স্বপ্ন দেখে নীরবে নিভৃতে
এখনো বেহায়ার মতো সুযোগ বুঝে তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে
‘‘এমন দেশে তো এমনই ঘটনা ঘটবে! জানে, সর্বজনেই জানে।’’

তোমার আলো-বাতাস কি তারা ভোগ করছেনা কভু!
তোমার বুকের দুগ্ধ স্রোতরূপী জলে কি তার তৃষ্ণা মিটেনি মৃদু!
তোমার বুকের রাশি রাশি সোনালি ধানে কি তার জুটেনি আহার!
তোমার শ্যামলিমার অপরূপে কি তার চোখে জাগেনি বিস্ময় অপার!

ওরা ছিলো ভিনদেশি শত্রু, অঙ্গার করেছিলো তোমার বুক
বাংলার বুক শ্মশান করতে উদ্যত ছিলো সদা উন্মুখ!
বারুদে বন্দুকে যত্রতত্র খই ফুটিয়েছিলো হায়েনার দল
এরাও তো খই ফোটাচ্ছে কথার ধুম্রজালে, রচেছে মিথ্যে ছল।

মা, তোমার কোনো সন্তান যদি হয় পথের বিবাগী; চলে ভুল পথে
সে দোষ তো মায়ের নয়! পার যদি লড়ে যাও তার সাথে
ঝোপের আড়াল হতে হুক্কাহুয়া রবে বোল বলোনা শেয়াল শয়তান
রুখে দিতে আছে এখনো বেঁচে দেশপ্রেমিক লড়াকু মন।

মায়ের বদনে কালিমা মেখে, পরিচিত হইও না জাতীয় কুলাঙ্গারে
বাংলার জল, বাংলার ফল আর শ্যামলিমা পেয়েছি বিধাতার আশির্বাদের তরে।